ওরা পেছনে দাঁড়িয়ে আছে, দেবনাথ টের পাচ্ছে না। এমনকি নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও খেয়াল করছে না। না করারই কথা। জাহাজ জল ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছে, তার কলকল ছলছল শব্দ আরও গভীর হতে পারে।
ওরা তিনজনই এই রহস্যকে ছুঁতে চায়।
কী আছে লাইটারে!
বার বার জ্বলছে, আবার নিভিয়ে দিচ্ছে।
যেন এক বালক খেলাচ্ছলে কাজটা করছে।
ওরা দেখছে, লাইটার জ্বললে ওর মুখ অধীর হয়ে উঠছে। মুখের সবটা দেখা যাচ্ছে না। আংশিক। ওতেও বুঝতে পারে, কিংবা মাস্তুলের আলোয় ওর মুখের অধীরতা কিংবা শরীরে আশ্চর্য ধবনি খেলা করে বেড়াচ্ছে টের পাওয়া যায়। ওদের ছায়ামূর্তি তাকে ঘিরে রেখেছে। উইন্ডসহোলের থেকে মুখ এবং হাত বের করে আনলেই জাপটে ধরবে। যা পাগল, ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়ে যদি উইন্ডসহোলের ভেতর ফেলে দেয়, তবে আজকের মতো আর লাইটারের রহস্য ধরা যাবে না। ফল্কার কাঠ না খোলা পর্যন্ত দেখা কঠিন। গুড়ো সালফার বোঝাই। উইন্ডসহোলে গলিয়ে দিলে হাজার হাজার টন ফসফেটের ভিতর থেকে লাইটারটা খুঁজে বার করাও শক্ত। কারণ তারা ধরে নিয়েছে, দেবনাথ অপ্রকৃতিস্থ। না হলে এমন আচরণ জাহাজে ভাবা যায় না। বাড়ির জন্য যে এত বিষণ্ণ হয়ে থাকত, সে-ই লাইটারটা কেনার পর আশ্চর্যরকম ভাবে পালটে গেল। শৌখিন, কেতাদুরস্ত নাবিক।
আর এ সময়ই দেখল, দেবনাথ মুখ বের করে এনে লাইটারটা ঝাঁকাচ্ছে। আসলে বোধ হয় আর জ্বলছিল না। তেল উঠে আসার পথে কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছ। সঙ্গে সঙ্গে শিকারি ঈগলের মতো রাজু লাইটারটা ছিনিয়ে নিয়ে গেল। আর প্রেমা ওকে ঝাপটে ধরে রেখেছে। কারণ তারা জানে, সেও দৌড়োবে রাজুর পেছনে।
জায়গাটার একটা বিশেষ সুবিধা আছে। পাঁচ-সাতটা উইন্ডসহোলের মুখ উপরে উঠে সাপের ফণার মতো মুখ বাঁকিয়ে রেখেছে।
প্রেমা চিৎকার করতে পারছে না। দেবনাথ নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্য ধস্তাধস্তি শুরু করে দিয়েছে।
হইহল্লা হলে ব্রিজ থেকে সেকেন্ড মেট ছুটে আসবে। এমনকি জাহাজের সাইরেনও বেজে উঠতে পারে। ধড়ফড় করে সবাই জেগে যাবে। মধ্যরাতে সাইরেন কেন।
ফলে দেবনাথ হল্লা জুড়ে দিতে পারছে না।
কিন্তু এ কি, রাজু লাইটারটা জ্বেলে কী দেখছে। যেন তারও হুঁশ নেই।
প্রেমা দেবনাথকে ছেড়ে ছুটে গেল—এই, কী দেখছিস? রাজু ছুটতে থাকল। সে কিছুতেই হাতছাড়া করবে না।
আরে এ তো ভারি বিপজ্জনক খেলা! মধ্যরাতে স্তব্ধ আকাশের নীচে কজন নাবিকের মধ্যে মহামারি কাণ্ড। কে বিশ্বাস করবে! রাজুর হাত থেকে লাইটারটা কেড়ে নিল প্রেমা।
সেও হতবাক। কেমন ঘোরে পড়ে যাচ্ছে।
জ্বাললে এক নগ্ন সুন্দরী নাচে। নিবিয়ে দিলে নগ্ন সুন্দরী অদৃশ্য হয়ে যায়। আগুন বাতাসে কাঁপলে নাচের বাহার একরকম, বাতাস না থাকলে সেই নগ্ন নারী সোজা মাথার উপর হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। তার শরীরের সব ভাঁজ এত স্পষ্ট যে-কোনো মানুষ মুহূর্তে কামুক হয়ে উঠতে পারে। আসলে কাচের ভিতর কোনও মজা আছে অথবা আগুনের প্রতিবিম্ব কোনও মায়াবি নারীর শরীর নিয়ে ভেতরে ঘোরাফেরা করে। এখন এই আজব বাতিটা কে যে কজা করবে। এবং যখন ডেক জুড়ে এভাবে মারামারি হাতাহাতি চলছিল, তখনই ছিটকে কোথায় পড়ে গেল লাইটারটা। কাচ ভেঙে গেল।
দেবনাথ এই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে হাউ হাউ করে কেঁদে দিল। সে চিৎকার করে উঠল, কেন, কেন তোরা আমার এত বড়ো সর্বনাশ করলি! আমি তোদের কী ক্ষতি করেছি? বল বল! বলে ছুটে গিয়ে সে একটা রড তুলে এনে রাজুকে খুন করতে গেলে প্রেমা ধরে ফেলল।
দেবনাথ সত্যি কেমন হয়ে গেল! সে কারও সঙ্গে আর কথা বলত না। চুপচাপ একা মধ্যরাতে ডেকে ঘুরে বেড়াত। পকেটে ভাঙা লাইটার নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কথা বলে নিজের সঙ্গে। তারপর এক রাতে সে আর ডেক থেকে ফিরে এল না। অজানা সমুদ্রে সে হারিয়ে গেল।
আত্মরতি
এই যাবি টুম্পা।
কোথায়?
মিডনাইট ফ্যাশন শোতে।
ওরে বাপস, এত রাতে।
তোদের ফ্ল্যাট থেকে বেশি দূর না, হেঁটেই যাওয়া যাবে। তুই আমি পালিয়ে যাবি!
মরতে চাস নাকি।
এখন তো আমাদের মরারই বয়স রে। গেলে দেখা যাবে রবি বর্মার শরীরী নারী, রবি বর্মার বর্ণময় রোমান্টিকতা, রবি বর্মার ইশারাবাহী যৌনতা। সকালের কাগজটা দেখিসনি—শাড়ির ফ্যাশান শো-শাড়ির রং, শরীরের ওপর তার ইঙ্গিতময় বিন্যাস, খসে পড়া আঁচল উদ্ভিন্ন লাবণ্যের হঠাৎ প্রকাশ–শাড়ির ভিতর থেকে ফুটে ওঠে শরীরের উদ্ভাস—সত্যসুন্দর শাড়িতে ধরা দিয়েছেন ইবকল রবি বর্মা। কাগজেই লিখেছে রে। খবরটা পড়ার পর আমার মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে রে।
যাও মরো গে। সামনে আর দু-মাসও সময় নেই পরীক্ষার—তোকে এখন মিডনাইট ফ্যাশন শোতে পেয়েছে রুবি।
আচ্ছা টুম্পা তোর ইচ্ছে হয় না হালকা শাড়ির ভিতর নিজের শরীর ভাসিয়ে রাখতে? এ শাড়ি শরীর ঢেকেও পৌঁছে দেয় শরীরের বার্তা। এ শাড়ি দর্পিত করে শরীরের ইচ্ছা। এ শাড়ি আবরণ নয়—মধ্যরাতে এ-শাড়িই নারী শরীরের উদ্বোধন, আমি কাগজ থেকেই তোকে পড়ে শোনাচ্ছি রে—আহা কী সুখ, নারীর শরীরকে উত্তীর্ণ করবে উৎসবে। ভারতের টপ মডেলরা হাঁটবেন উৎসবের কোহলসিক্ত ক্ষীণ সরণিতে-রজনী উদ্দীপ্ত আঁচল কখনো উড়বে, খুলবে, খসবে। আলোর মোহময় উদ্ভাসে কখনো চমকে উঠবে অন্তর্বাসের মৃদুভাস উচ্চারণ। শুনছিস তো, কাগজে লিখেছে। কাগজ থেকে পড়ে শোনাচ্ছি। কি রে যাবি! চল না বাবা।