একটা সামান্য লাইটার তাকে এমনকি প্রেমে ফেলে দিল বুঝতে পারছে না তারা!
শালা ফুটানি করতে গিয়ে ধনে জনে যাবে এবার। এবং সত্যি সে একদিন রাজুকে বলল, এই, দু-ডলার ধার দিবি।
রাজু বলল, আর কি কেনার থাকল বাবা! তুমি তো ফোকসালে থাক না মনে হয়। কেবিনে থাক, ফুল কিনে আনছ কেন গুচ্ছের! ফুলের ভাস! দরিয়ায় সব শালা উলটে পড়ে ভাঙবে।
দেবনাথ রা কারে না।
এরপর তারা ভাবল, দেখা যাক ব্যাপারটা কী!
জাহাজ আবার সমুদ্রে। যাবে তাসমানিয়ায়। দেবনাথ আবার ওয়াচ দেবার জন্য রাত বারোটায় ফরোয়ার্ড-পিকের দিকে হেঁটে যাচ্ছে।
আগে থেকেই ঠিক করা ছিল সব। তারা তিনজনেই জেগে ছিল। কেন এত আগ্রহ। এমন একটা একঘেয়ে কাজের। পালা করে দেবার নিয়ম। ডেক সারেঙকে ভজিয়ে সে এখন একাই রাতের ওয়াচ দেয়।
ওরা ডেকে উঠে দেখল, দেবনাথ কানের কাছে রেডিও নিয়ে শুনছে। থামছে। আবার হাঁটছে। সে গেলে ওয়াচের পরীদার চলে আসবে। সে একটু বেশি আগে যাচ্ছে। রাত এগারোটা না বাজতেই দেখলাম ওয়াচ দিতে যাচ্ছে আচ্ছা লোক মাইরি! পারলে যেন দুটো ওয়াচ তাকে একা দিলে সে আরও বেশি খুশি হতে পারে। লাইটারটা আর তারা দেখেইনি। ওটাও কি বিক্রি করে দিল! কী জানি কীসে যে মজে যায় কখন মানুষ বোঝা কঠিন। লাইটারটা আর তারা দেখতে পায় না। সে সিগারেট খাওয়াও কি ছেড়ে দিল শেষ পর্যন্ত।
সমুদ্রে জ্যোৎস্নার আলাদা একটা রূপ আছে। অন্ধকারেরও। আকাশে বেশ বড়ো গোল চাঁদ। ঢেউ নেই বলে স্থির দেখাচ্ছে। ঢেউ থাকলে জাহাজ টলত। চাঁদও মাতলামি শুরু করে দিত আকাশে। তবে মজা, জাহাজ যেদিকে যায়, চাঁদও সেদিকে ভেসে চলে। যেন দুই সঙ্গী নির্জন সমুদ্রে এবং এই নীরবতা কখনও মানুষকে অনেক দূর ভাসিয়ে নিতে পারে। বিশেষ করে মধ্যরাতে সমুদ্র আরও নিথর। এনজিনের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ কানে আসে না। মাঝে মাঝে ওয়াটার ককের ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ শোনা যায়। নতুন রং হলে রং বার্নিশের গন্ধ। মাস্তুলে আলো জ্বালা থাকে। ডেকে, টুইন ডেকে এবং আফটার-পিকে আলো জ্বালা থাকে। অস্পষ্ট আলো অন্ধকার সারা জাহাজ ডেকে ভেসে বেড়ায়। শুধু ব্রিজে জেগে থাকে সুখানি, সেকেন্ড মেট, এনজিন রুমে ফায়ার ম্যান, টিণ্ডাল। খুব দূরবর্তী মনে হয় তখন ডাঙার জীবন। যেন অনন্তকাল জাহাজটা সমুদ্রে ভেসে বেড়াবে বলেই বের হয়ে পড়েছে। সামনে পেছনে, আকাশ-নক্ষত্র এবং প্রপেলারের জল ভাঙা শব্দ ছাড়া আর কিছুর অস্তিত্ব থাকে না।
এমন জ্যোৎস্নারাতেই রাজু, বন্ধু, প্রেমা খুব সতর্ক পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। এনজিন থেকে ওয়াচের লোকজন উঠে এলে ঘাবড়ে যেতে পারে। গ্যালি থেকে চা করে নিয়ে যাবার জন্য উঠে আসতেই পারে। অথবা তেষ্টা পেলে জল। দেখলে বলবে, কে? কে?
কারণ জাহাজে এই মধ্যরাতে ডেকে বেড়াবার কারও কথা নয়। তাছাড়া সব জাহাজেই নানারকম ভৌতিক কাণ্ডকারখানা ঘটে থাকে এমন বিশ্বাস থাকে জাহাজিদের। কারণ জাহাজের দীর্ঘ সমুদ্র সফর কখন কাকে যে অবসাদগ্রস্ত করে তুলবে বলা কঠিন। অবসাদ থেকে আত্মহত্যা—আরও নানা কারণে এসব ভৌতিক ঘটনা প্রাচীন নাবিকেরা এত বেশি বিশ্বাস করে থাকে যে, তারা যেন নিজের চোখে দেখেছে এবং এভাবেই পল্লবিত হয়ে যায় সব খবর। জাহাজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রটে যায়, বরফ-ঘরে মাঝে মাঝে প্রায় বড়ো আস্ত ছাল-ছাড়ানো গোরু ভেড়ার ভিড়ে কোনো নারীর লাশ ঝুলে থাকতে দেখা যায়। স্টুয়ার্ড রসদ আনবার জন্য বরফ-ঘরে কখনও একা ঢোকে না। সিঁড়ি ধরে নেমে যেতে হয়। আলো নিভে গেলে রাস্তা খুঁজে উপরে ওঠাই দুঃসাধ্য।
সুতরাং এই দুই ছায়ামূর্তি প্রায় আড়ালে উঠে যাচ্ছে ফরোয়ার্ড-পিকে। টুইন ডেকে উঠেই মাস্তুলের পাশে আড়াল করে দাঁড়াল তারা। এলিওয়ে ঘরে যেতে পারে না। অভিসাররা ওদিকটায় থাকে। এলিওয়েতে কার্পেট পাতা। বেশ উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। ওদিক ধরে গেলে ওদের দেখে ফেলতে পারে কেউ। পরদিন সকালে সারেঙ-এর কাছে নালিশ উঠতে পারে—ওরা এত রাত্রে ডেকে কী করছিল? জাহাজে চোরাইমাল কে কীভাবে নিয়ে যায় বলা যায় না। এসব ভয়ও আছে তাদের। ফরোয়ার্ড-ডেকে এসে ওরা আরও সতর্ক হয়ে গেল। কারণ ব্রিজে সেকেন্ড মেট ওয়াচ দিচ্ছে। দেখে ফেলতে পারে। স্টাবোর্ড-সাইড ধরে গেলে দেখতে পাবে সে। যে কোনও কারণেই হোক ওদিকটায় অন্ধকার না থাকলেও নিজেদের আড়াল করার মতো যথেষ্ট সুযোগ আছে।
রাজু ফিসফিস করে বলল, আরে দেবনাথ কোথায়!
সত্যি তো, দেবনাথ ফরোয়ার্ড-পিকে নেই। নোঙর ফেলবার আই-হোলের পাশে তার দাঁড়িয়ে ওয়াচ দেবার কথা।
কিন্তু চার নম্বর ফল্কা পার হতেই ওরা টের পেল, দুটো উইন্ডসহোলের মাঝখানে দেবনাথ। ওরা আরও আশ্চর্য—দেখল সামনের উইন্ডসহোলের মুখটা সে উলটো মুখে ঘুরিয়ে নিয়েছে। বাতাসের ঠিক বিপরীত দিকে। আর উইন্ডসহোলের মুখের ভিতর ঝুঁকে কী দেখছে।
কেমন আলো জ্বলছে, আলো নিভছে উইন্ডসহোলের মুখে। আলো জ্বললে আবছা মতো মুখটা ভেসে উঠছে, আলো নিভে গেলে মুখ অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
বেটা কী দেখছে ঝুঁকে!
ওরা হামাগুড়ি দিতে থাকল। কারণ এখন উঠে দাঁড়ালেই ব্রিজ থেকে সেকেন্ড মেট তাদের দেখে ফেলবে। নোঙর-ফেলার উইনচ ম্যাসিনের কাছে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে যেতেই টের পেল, আসলে দেবনাথ ঘোরে পড়ে গেছে। ঘোরে পড়ে না গেলে এমন বাহ্যজ্ঞানশূন্য কেউ হয় না তারা এত কাছে, একবার রাজুর খুকখুক করে কাশি—এইরে ধরা পড়ে গেল। তোরা! বলতেই পারে। কিন্তু হুশ নেই। ওরা পেছন থেকে ঝুঁকে দাঁড়াল সন্তর্পণে আর দেখল, দেবনাথ তার অলৌকিক লাইটার জ্বালিয়ে বার বার মজা পাচ্ছে। তারা লাইটারটা দেখতে পাচ্ছে না। কারণ গোটা উইন্ডসহোলের মুখ ওর মাথা আড়াল করে রেখেছে। ডান হাতটা বাতাস থেকে লাইটারের আগুন বাঁচাবার জন্য উইন্ডসহোলের ভেতরে ঢোকানো।