একদিন রাতে জতুর কী হল সে জানে না। চুপি চুপি দরজা খুলে বের হয়ে দেখল, বাগানের দিকটায় কেউ জ্যোৎস্নায় দাঁড়িয়ে আছে। এত রাতে মানুষ বাইরে থাকলে চোর ডাকাত ভাবাই যায়। কিন্তু সে দেখল, লোকটা বাগানের গাছ থেকে ফুল তুলছে। ঠিক নিমাইদা, নিমাইদা এত রাতে বাগানে ঢুকে কী ফুল তুলছে সে জানে না। তবে জ্যোৎস্নায় নিমাইদা গাছ লতা পাতা ফুল ভালো চেনে, সে এটা জানে।
বাড়িতে কবিরাজি ওষুধে লাগে। এমন অনেক গুল্মলতাই ঠাকুরদার আমল থেকে বড়ো হয়ে উঠেছে। বাড়ির এই বাগানটায় একটি দারুচিনি এবং এলাচের গাছও আছে। তেজপাতার লতাও আপন মহিমায় নিজের মতো একটি কয়েদবেল। গাছ জড়িয়ে বেঁচে আছে।
নিমাইদাকে রাতে উঠতে হয়, কারণ রাত থাকতেই কাজকাম শুরু হয়ে যায়। গাছ থেকে পাতা, ফুল এবং শেকড়বাকড় তুলে পুকুরঘাটে ধুয়ে তারপর শান বাঁধানো বারান্দায় ছড়িয়ে রাখতে হয়। জ্যেঠামশাইয়ের নির্দেশ মতোই সে কাজ করে থাকে। রাত থাকতে তুলে না নিতে পারলে, জীবনদায়ী ওষুধ বোধ হয় তৈরি করা যায় না। শেকড়বাকড়ে, পাতায় এবং ফুলে সকালের রোদ না খাওয়ালে চলে না।
তারপরই মনে হল সে উঠোনে নেমে এসেছিল, সেই এক কুহকে। চাপা কান্নার উৎস খুঁজতে বের হয়েছে, তার মনে পড়ে গেল। তবে নিমাইদা বাগানে ঘোরাঘুরি করায় বুঝতে অসুবিধা থাকল না, রাত আর বেশি নেই। রাতে চাপা কান্না শুনলে কার না অস্বস্তি হয়।
তার মতো সবারই অস্বস্তি হতে পারে। কিন্তু কেউ কিছু বলে না। অথবা কারও কোনও কৌতূহলও নেই। কিংবা সে এবং তার মা ছাড়া রাতের এই অস্বস্তি এত বেশি বোধ হয় কেউ টের পায় না। কারণ যতীন দাসের ঘরটি ডেফল গাছটা পার হয়ে গেলেই। বড়ো সংলগ্ন ঘর। ঘরে যতীন দাস আর কমললতা রাতে শোয়। তারপর আরও ঘর আছে যতীন দাসের। তাঁত, তানা সুতোর ডাঁই ঘরগুলোতে। দক্ষিণের দিকে সুপারি বাগান, পিছনের দিকে বেতের জঙ্গল এবং একটা বিশাল গাবগাছ। তারপরই বুক সমান বর্ষার জল—যত দূর চোখ যায়।
শেষ রাতের জ্যোৎস্নায় জতু এত গাছপালা এবং ঘরবাড়ির মধ্যে হেঁটে বেড়ালে শুনতে পায় ঠাকুরদা কাশছেন। আর কোনও আওয়াজ নেই। নিমাইদা বাগান থেকে ঝুড়ি নিয়ে বের হয়ে গেল। সদর পুকুরের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। যতীন দাসের লেবুর ঝোপে জোনাকি ওড়াওড়ি করছে। কিন্তু কোনও চাপা কান্নার আওয়াজ নেই।
সে হয়তো ভুল শোনে।
সে আবার সতর্ক পায়ে দরজা ঠেলে ঘরে ঠোকে এবং দরজা বন্ধ করে দেয়। খাটে উঠে শুয়ে পড়ে। পাশ ফিরে শোয় না। চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে। কান খাড়া করে রাখে। তার ঘুম আসে না।
সকালে সে আজ নিজেই উঠে পড়ল। দরজা খুলে দেখল কমললতা দাঁড়িয়ে আছে। একটা ডুরে শাড়ি পরনে। হাতে পেতলের একটা ঘটি। তাকে বের হতে দেখেই অন্দরের পুকুরের দিকে হাঁটা দিল কমল। অলগাভাবে হাঁটছে যেন সে এখন যেখানে পা বাখবে সবই অসুবিধে হয়ে যাবে। কমল তাকে ছুঁয়ে দিলেও জতুর যেন জাত যাবে।
জতু জানে তার কাজটা কী। বউটি পুকুরের জলে ডুব দেবে। গভীর জলে ডুব দিয়ে ভেসে উঠবে। বলবে, জতু আমার কিছু ভেসে ছিল না তো। ঠিক ডুবে গেছি তো।
কিছু তো ভেসে থাকে। যেমন শাড়ির আঁচল, অথবা চুল, এত ঘন লম্বা চুল খোঁপা না ডুবে গেলে হয় না। আবার ডুব।
জতু আগে বেশ মজা পেত এই নিয়ে।
না ডোবেনি।
কী ডোবেনি।
তোমার ঘোমটা।
কমলবউ ঘোমটা খুলে শাড়িটা দুহাতে জড়িয়ে ডুব দিলে, কিছুই ভেসে থাকে না। একেবারে যতটা পারা যায় নীচে কাঁকড়ার মতো বিচরণ করতে থাকে। চোখ লাল, এতক্ষণ শ্বাস বন্ধ করে থাকাও কঠিন। কিছু ভেসে থাকার আতঙ্কে জলের নীচ থেকে উঠেই আসতে চায় না।
জতু না বললে, কমল জল থেকেও উঠে আসত না।
এই এক খেলা যে জতুকে ক্রমে আকৃষ্ট করে তুলেছে। বউটি জলে নেমে যায়, শাড়ি ভিজতে থাকে, কোমর জলে নেমে শাড়ি দু-হাতে বুকে জড়িয়ে রাখে, তারপর খোঁপা খুলে চুল ছড়িয়ে দেয়। খোঁপা বাঁধা থাকলে, জলে সব চুল ভেজে না, রাতে অশুচি হয়ে থাকে শরীর। জলের নীচে ডুব দিলে কমল, পুণ্যতীর্থ গয়া গঙ্গা আছে টের পায়। না হল না চুলের ডগা ডোবেনি।
কমল পড়ে যায় মহাবিভ্রাটে। তার কেবল মনে হয় বারবার ডুব দিয়েও সে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ধুয়ে সাফ করতে পারেনি।
আবার ডুব?
কীরে জতু কী হল!
আঁচল ভেসে আছে।
কমল নিজের মধ্যে বোধ হয় থাকে না। সে তার সায়া শাড়ি খুলে সব বুকের মধ্যে জড়িয়ে ডুব দেয়। সেমিজটিও খুলে ফেলে। কীভাবে যে শাড়ি সায়াতে বাতাস ঢুকে থাকে এবং ডুব দিলেও শাড়িসায়া ভেসে ওঠে জলে। জতু কমলকে শুধু দেখে।
কখনও মনে হয় মাছের মতো পাখনা মেলে দিয়েছে জলে। অন্দরের পুকুর, তায় বর্ষাকাল, জল টলমল হয়ে আছে, জলের নীচে নুড়ি পাথর পর্যন্ত স্পষ্ট। স্ফটিক জলে কমল নেমে গেলে সবই দেখতে পায়। সুন্দর শরীর এবং স্তন, সবই অবাধে কমল জলের নীচে নগ্ন সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারে।
জতু হাঁটছে।
কমল হাঁটছে।
ঘুম থেকে কেউ ওঠেনি। কিছুটা অন্ধকার মতো হয়ে আছে—সূর্য উঠলেই এই অন্ধকার কেটে যাবে। কমল তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে হাঁটছে। ইঁদারা পার হয়ে, বাড়ির পাঁচিল বাঁশঝাড় পার হয়ে কমল পিছন ফিরে তাকাল।
এই আয়।
যাচ্ছি তো।
কমল ঘাটে এসেই এক কাণ্ড করে বসল আজ। চারপাশে সতর্ক নজর তার। পুকুরের পাড়ে সব আম জাম নারকেল গাছ। তারপর বিশাল জলাভূমি যতদূর চোখ যায়। অন্দরের পুকুরে পুরুষমানুষদের আসার নিয়ম নেই। জতু পুরুষমানুষ কি না সন্দেহ আছে এখনও। ক্লাস এইটে পড়লে পুরুষমানুষ হওয়া যায় না। অন্দর সদর সব সমান তার কাছে। কমল এটা ভালো করে জানে বলেই সেজমামিকে বলে জতুকে সহজেই বিছানা থেকে তুলে আনতে পারে। জলের নীচে ডুবে গেছে কি ডোবেনি কেউ বলে না দিলে তার জলে ডুবে তৃপ্তি হয় না।