সত্যি শিস দিচ্ছিল দেবনাথ!
লাইটারটা জ্বালাবার আগে দেবনাথ আশ্চর্য এক উত্তেজনা বোধ করে। সে হাত দিয়ে বার বার দেখে পকেট আছে তো—এই এক ভয় নিরন্তর। কেউ না মেরে দেয়। মেরে দিলে নির্ঘাত সে পাগল হয়ে যাবে। সামান্য একটা লাইটারের প্রেমে পড়ে যেতে পারে কেউ, এই প্রথম দেবনাথ টের পেল। সে সিগারেট বের করে লাইটার জ্বালাতে গিয়ে দেখল বারবার নিভে যাচ্ছে। ঝাপটা হাওয়া নিভিয়ে দিচ্ছে। সমুদ্রের বিশাল ঢেউ এবং অসীম অনন্ত আকাশ ছাড়া তাকে দেখবার কেউ নেই। সে আড়ালে-আবডালে কাজ করতে ভালোবাসে। আসলে কেউ জানেই না লাইটারটা জ্বালিয়ে সে অপলক দেখে কিছু। লাইটারের কাচের মধ্যে তার দৃষ্টি আবদ্ধ হয়ে যায়। কেমন এক ঘোর তৈরি হয়। সে জাহাজের কাজকর্মের ব্যস্ততার কথা পর্যন্ত ভুলে যায়।
এই যে দেবনাথ! বসে কেন?
না স্যার, মানে…। সে তাড়াতাড়ি লাইটার নিভিয়ে মাস্তুলে রং লাগাতে শুরু করে। ধরা পড়তে পড়তে কতদিন বেঁচে গেছে। সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা ফোকসাল, কিন্তু একদণ্ড খালি থাকে না। যখন-তখন যে-সে ঢুকে যায়।
আরে তুমি লাইটার জ্বালিয়ে কী দেখছ!
সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠে। তাড়াতাড়ি লাইটার নিভিয়ে দিয়ে হেসে ফেলে।
না দেখছিলাম?
কী দেখছিলে?
সে কী দেখছিল বললে জাহাজে মারামারি পর্যন্ত শুরু হয়ে যেতে পারে। বলা যায় না, খুনটুনও।
সে বলে, না, কিছু না।
দেবনাথ সবসময় সতর্ক থাকে। ঘুমাবার আগে লাইটারটা কোথাও লুকিয়ে রাখে। নিজস্ব লকার থাকে না। দুজনের জন্য একটা লকার বরাদ্দ। কাজেই চাবি দিয়ে যে নিশ্চিত থাকবে তার উপায় নেই। লকারের ডুপ্লিকেট চাবি রাজুর কাছে। সে পেলেই ওটা মেরে দেবে। এবং যদি টের পায়, কোনো অলৌকিক ছবি লাইটার জ্বাললে দেখা যায় তবে তো কথাই নেই।
লাইটারটা কেনার পর থেকেই তার বিচিত্র শখ জন্মেছে। সে নীল রঙের টাই পরে সাদা প্যান্ট সাদা শার্ট গায়ে দিয়ে বোট-ডেকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কাজের সময় ছাড়া কোনো জাহাজি এদিকটায় বড়ো আসে না। বোট–ডেকের মাথায় কাপ্তানের কেবিন। ব্রিজে উঠে যাবার সিঁড়ি। পাশে চার্টরুম। বোট-ডেকের পাশে কিছুটা আড়াল আছে। দুটো বোটের মধ্যবর্তী জায়গা ফাঁকা। আফটার-পিক কিংবা ব্রিজ থেকে জায়গাটা দেখা যায় না। কেবল ওয়াচ বদলের সময় ফায়ারম্যানরা উঠতে নামতে দেখতে পায়, দেবনাথ চুপচাপ বোট-ডেকে বসে আছে।
আরে এখানে!
এই এমনি। সে আবার কিছু লুকিয়ে ফেলে।
সে তার বিছানার চাদর বালিশের ওয়াড় সব পাল্টে ফেলেছে। ফোকসাল আর কেবিনের তফাত আকাশপাতাল। ফোকসালে চারটে বাঙ্ক। ম্যাট্রেস। কোম্পানি থেকে দুটো নীল প্যান্ট, নীল শার্ট, একটা গরম কালো রঙের সোয়েটার পায় জাহাজিরা। সেও পেয়েছে। বাড়তি জামা প্যান্ট যতটা দরকার—এই যেমন সে কার্ডিফের সেকেন্ডহ্যান্ড মার্কেট থেকে একটা কোট কিনেছিল প্রথম সফরে শীতের দেশে এখনও সেই কোটই সম্বল। সে আর কিছু কেনাকাটা করেছে বলে কেউ জানে না। কারণ একঘেয়ে সমুদ্রযাত্রায় বের হলেই মন খারাপ হয়ে যায়। মা বাবা ভাই বোন ফেলে সমুদ্রে ঘুরতে তার ভালো লাগে না।
বিচিত্র শখ। এজন্য যে, সাদা চাদর সাদা ওয়াড় যেমন কেবিনে ধোপদুরস্ত, ছিমছাম পাতা থাকে সব কিছু, তেমনি তার, বিছানায় সাদা চাদর বালিশের সাদা ওয়াড়—স্টুয়ার্ডের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে নিয়েছে। এমনকি বন্দরে এলে মেসরুম মেট ফুলও রাখে ফ্লাওয়ার ভাসে-স্টুয়ার্ডের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে তার বাঙ্ক, বিছানা অফিসারদের মতো করে নিয়েছে। সে দামি গন্ধ সাবান মাখে। গায়ে বিদেশি আতর দেয় আজকাল।
স্বাভাবিক কারণেই একজন সামান্য জাহাজির এই ধরনের শৌখিন জীবনযাপন বিচিত্র শখের পর্যায়ে পড়ে। জাহাজিরা অফিসারদের মতো কে কবে শোখিন হয়!
হাইতিতি দ্বীপ থেকে জাহাজ যাচ্ছে অকল্যান্ডে। এ সময় দরিয়ায় ঝড়-ঝাপটা লেগে থাকে বলে ডেকে বের হওয়া যায় না। বলতে গেলে মাত্র পাঁচ-সাতদিন সমুদ্র শান্ত ছিল। তখন দেখা যেত দেবনাথ একা একা বোট-ডেকের দিকে উঠে যাচ্ছে। ডেক-জাহাজিদের পাঁচটার পর ছুটি। জাহাজের স্টাবোর্ড-সাইডে থাকে ডেক-জাহাজিরা। সুখানিরাও থাকে। তিন সুখানি এক ফোকসালে। পাশের ফোকসালে থাকে ডেক-টিল্ডাল আর ডেক-কর্মীরা। সিঁড়ি ধরে নেমে গেলে দুদিকের ফোকসালে থাকে এনজিন-সারেঙ আর ডেক-সারেঙ। স্টাবোর্ড-সাইডের জাহাজিদের রাতে পালা করে দুজনকে অবশ্য ওয়াচ দিতে হয়। ফরোয়ার্ড-পিকে ডিউটি থাকে। অন্ধকারে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়লে টনটন করে ঘণ্টা বাজাতে হয়।
দেবনাথের আদ্ভুত আগ্রহ রাতে ফরোয়ার্ড-পিকে ওয়াচ দেওয়ার। সাধারণত এই ওয়াচ ডেক-জাহাজিরা পছন্দ করে না। পুরো চার ঘণ্টা একটানা দাঁড়িয়ে দূরের সমুদ্রে লক্ষ রাখা খুবই কঠিন কাজ। এ-কাজে উৎসাহ কেন এত দেবনাথের কেউ বুঝতে পারছে না। যেন সে যদি রোজ এই ওয়াচের কাজটা পায় বর্তে যায়। এটাও রাজু, প্রেমাকে হতবাক করে দিয়েছে। কোথায় সারাদিন খাটুনির পর পড়ে ঘুমাবে, না তিনি চললেন ফরোয়ার্ড-পিকে ওয়াচ দিতে।
তারা আরও আশ্চর্য হল, অকল্যান্ড বন্দরে তাকে থ্রি-পিস-স্যুট করাতে দেখে। আরে শালা যে জাহাজের সব টাকা খতম করে যাবে বলে ঠিক করেছে। অবশ্য ইচ্ছে করলেই এটা হয় না। জাহাজিরা সমুদ্রের মাইনের এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত তুলতে পারে। তবে বেশি পারে না। কিন্তু দেবনাথের টাকায় কুলোচ্ছে না বলে সে ফালতু কিছু কাজ স্টুয়ার্ডের করে দেয়। সে হিসাবপত্র রাখতে ওস্তাদ। কিছু টিপসও নিয়েছে স্টুয়ার্ডের কাছ থেকে। যেমন পানামা থেকে কম্বল কিনে নিতে পারলে বেশি দামে বিক্রি করা যায়। ঘড়ি কিনে নিলেও বেশি দাম পাওয়া যায়। সে রেডিও পর্যন্ত কিনে নিয়েছিল বিক্রি করবে বলে। তবে দাম পায়নি বলে বিক্রি করেনি। সে এখন অবসর পেলেই রেডিওতে বিদেশি সংগীত শুনতে শুনতে কেমন মজে যায়।