সতীশের কাতর অনুনয়, দোহাই অপরেশদা। পায়ে পড়ি।
দ্যাখ তবে। এই নিমাই ওর সামনে অ্যালবামটা মেলে ধর। ব্যাটা দেখুক লজ্জা ভাঙুক।
নিমাই দেখল, অ্যালবাম খুলে দিলেও সতীশ তাকাচ্ছে না।
অপরেশের হুঙ্কার, ঠিক আছে, নে এবার ঠিক ফেলে দিচ্ছি। দেখি তারপর কী। থাকে তোর। বউ মগজে সেঁটে আছে।
ফেলবে না দাদা। প্লিজ, পায়ে পড়ছি।
তাকা। দ্যাখ। দিল তোর সাফ হয়ে যাবে।
ঠিক যেন ধর্মগ্রন্থ খুলে রেখেছে নিমাই। সতীশ বলল, কী নোংরা ছবি!
দেখ না! নোংরা হোক। তবু দেখ। আমাদের ধর্মগ্রন্থ এটা, বুঝিস! পাঠ কর। ভালো করে দ্যাখ। জীবনেরও ধর্মগ্রন্থ।
সতীশ দেখছে।
দ্যাখ।
সতীশ দেখছে নিমাই অ্যালবামের পাতা উল্টে যাচ্ছে।
সতীশের আর খেয়াল নেই।
এই তবে সব! সতীশ কেমন দেখতে দেখতে নেশায় পড়ে গেল।
অপরেশ বলল, যা, ব্যাং-কে বসে দেখ। সতীশ ব্যাং-কে বসে দেখতে থাকল। কী মজা লাগছে। নারে! মহাকাব্যের উৎপত্তিস্থলটা দ্যাখ বাবা ভালো করে।
সতীশ তাকাচ্ছে না। নিবিষ্টমনে দেখছে। ইস, কী নোংরা। কেউ এভাবে ছবি তুলতে পারে। এদের লাজলজ্জা নেই দাদা! কী কুৎসিত। বমি পাচ্ছে।
শালা বমি পাচ্ছে তোমার। মারব এক থাপ্পড়। যা এবার বালিশের নীচে রেখে শুয়ে পড়। অনেক জ্বালিয়েছ। আর না। বউ-এর ফটোগুলো আমার কাছে থাকল। দরকার পড়লে চেয়ে নেবে।
অবশ্য শেষ পর্যন্ত দরকার পড়েনি।
অপরেশই কলকাতার ঘাটে ফটোগুলি ফিরিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, বউকে বলবি, আর-একদিন নেমন্তন্ন করে যেন খাওয়ায়। আমরা তো খারাপ। কে কত ভালো জানা আছে! পাগল হসনি রক্ষে। এবারে অ্যালবামটা ফেরত দে।
পাচ্ছি না।
মিছে কথা বলছিস!
ধরা পড়ে গিয়ে সতীশ বলল, এটা থাক দাদা আমার কাছে। তুমি না-হয় আর একটা কিনে নিও।
আজব বাতি
দেবনাথ ডেক ধরে হেঁটে যাচ্ছিল। প্রবল ঝোড়ো হাওয়া সমুদ্রে। টলতে টলতে সে হেঁটে যাচ্ছিল। তার কেন জানি, এ সময় ফের লাইটার জ্বেলে সিগারেট ধরাবার ইচ্ছে হল। ফোকসালে সে ইচ্ছে করলে সিগারেট ধরাতে পারত। কিন্তু সবাই যা করছে। বন্ধু, প্রেমা, রাজু সবাই যেন টের পেয়ে গেছে ব্যাটা কিছু লুকাচ্ছে। এমনকি তাকে গোপনে অনুসরণ পর্যন্ত করতে পারে! সে টুইন-ডেকে উঠে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, না, কেউ এদিকটায় আসছে না। ডেক-টিণ্ডাল তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে বোট-ডেকে জল মারছে। তার কাজ গ্যাঙওয়ের পেছনটাতে। হাতে রঙের টব। চিপিং করার হাতুড়ি পকেটে। সে রং করতে যাচ্ছে। সকালে চা-চাপাটি খেয়ে একটা সিগারেট মৌজ করে খেতে কার না ইচ্ছে হয়। কিন্তু ফোকসালে প্রেমা রাজুর উপদ্রবে সে লাইটার জ্বেলে সিগারেটটা পর্যন্ত ধরাতে পারল না। রোজ এক উপদ্রব।
আরে দেখি দেখি! কবে কিনলি?
সঙ্গে সঙ্গে সে লাইটার ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেয়। পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে।
দেখি না! কত দিয়ে কিনলি?
দেবনাথ রা কাড়ে না। তাড়াতাড়ি উঠে সিঁড়ি ধরে কোথাও পালিয়ে গিয়ে যেন বাঁচে। ওরা ধাওয়া করে। সেও ডেক ধরে দৌড়ায় এবং একসময় জোরজার করে চেপে ধরলে দেবনাথ হাত তুলে দেয়।—দ্যাখ, দ্যাখ না। নেই।
কোথায় রেখেছিস?
ফোকসালে।
আসলে এভাবেই লাইটারটা নিয়ে ওদের চারজনের মধ্যে বেশ একটা রহস্যময়তা গড়ে উঠেছে। লাইটারটা দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। পোর্ট অফ সালফার থেকে জাহাজ ছাড়ার পরই ওরা পেছনে লেগেছে। সে কিছুতেই লাইটারটা হাতছাড়া করতে চায় না। ওরাও দেখবেই। ছাড়বে না।
এই দে না, সিগারেট ধরিয়ে নি।
না।
শালা তোমার লাইটারে কী আছে? আমরা খেয়ে ফেলব? তুই কী রে! আমাদের কাপ-ডিশ ধরে দেখিস ব্যাটা, কী করি! প্রেমা, লকারে চাবি দিয়ে রাখবি তো। জাহাজে উঠে এসেছে—নিজের কাপ-ডিশ পর্যন্ত আনেনি! ব্যাটা হাড়কেপ্পন!
দেবনাথ চুপচাপ থাকে। তা সে সামান্য কিপ্টে স্বভাবের। তার মতো মানুষের পক্ষে কোনো শৌখিন জিনিস কেনা সম্ভব রাজু প্রেমা ভাবতেই পারে না। পলকে সিগারেট ধরিয়েই নিভিয়ে দেয়। তখনই ওরা দেখে ফেলে, বস্তুটি সত্যি শৌখিন। আকারে একটু বড়োকাচের আবরণ, এক পাশে সোনালি জলের দাগ, কিছু সবুজ লতাপাতার চিত্রমালা কাচের গায়ে। এইটুকু দেখেই বুঝেছে, দেবনাথ তবে টাকা খরচ করতে শিখেছে। প্রথম দিকে জাহাজে ওঠে, সে বন্দর এলে নামতই না। নতুন জাহাজিও নয়। এই নিয়ে পাঁচ সফর। সিটি লাইনেই তার পর পর তিন সফর হয়ে গেল। ডারবান, কেপটাউন, স্যান্টিস–কোথাও সে নামেনি। বুনোসাইরিসে এক বিকেলে নেমে সস্তায় কিছু আপেল কিনে এনেছিল— এই যা। তারপর পোর্ট অফ জামাইকাতে মাঝে মাঝে দল বেঁধে নেমে গেছে। কিন্তু কোনো সওদা করেনি।
দেবনাথ পকেট থেকে লাইটার বের করে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল, না। কেউ অনুসরণ করছে না। মেজ মালোম দু-নম্বর ফল্কায় দাঁড়িয়ে বড়ো মালোমের সঙ্গে কথা বলছেন। জাহাজ যাচ্ছে হাইতি দ্বীপে। সেখান থেকে সোজা বিশ-বাইশ দিনের যাত্রা। রসদ নেবার জন্য জাহাজটা দ্বীপে কয়েক ঘণ্টা থামবে। সাত আট মাস হল ওরা সফরে বের হয়েছে–একঘেয়ে সমুদ্রযাত্রা কাঁহাতক ভালো লাগে।
দেবনাথ জাহাজে উঠলেই বাড়িঘরের কথা ভেবে বিষণ্ণ থাকে। কিনারায় কাজ পেলে সে কিছুতেই জাহাজে মরতে আসত না—এমন সে কতবার আক্ষেপ করেছে। সেই দেবনাথ বেশ হাসিখুশি। শিস দিয়ে একদিন হিন্দি গানের কলিও ভাঁজছিল দেখে রাজু এমনকি সারেঙ পর্যন্ত অবাক। আরে দেবনাথ শিস দিচ্ছে।