সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় সতীশ বড়ো কাতর গলায় বলল, কাউকে বলিস না।
খেপে গেলাম। বোধহয় চিৎকার করেই উঠতাম। এত রাতে তবে আর একটা নাটক হয়ে যাবে পাশাপাশি কোন পালে যারা থাকে, তারা দরজা খুলে ছুটে আসতে পারে। নানা প্রশ্ন করতে পারে। কারণ দীর্ঘ সফরে জাহাজিদের মাথা ঠিক থাকে না, সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়, কেউ উন্মাদ হয়ে যায়—ঠিকঠাক আর দেশে ফেরা হয়ে উঠে না। সতীশকে নিয়ে অনেকের মনেই এ-ধরনের সংশয় দেখা দিয়েছে। হয় আমাকে, নয় অপরেশকে সারেঙ ডেকে সতীশের খোঁজখবর নেয়। দেশ থেকে ওর চিঠি এল কিনা, চিঠিতে কোনো খারাপ খবর আছে কিনা—সতীশ দিন-দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে। আমরাও বলছি, না তো, দেশ থেকে তো চিঠিপত্র ঠিকই আসছে। বউ-এর জন্য লম্বা সিল্কের নাইটি কিনেছে বলতে পারতাম। কিন্তু সারেঙসাব বুড়ো মানুষ—তাকে এমন খবর দিলে যেন সতীশকে ছোটো করা হবে। ওর বৌয়ের মর্যাদা রক্ষা হবে না। কিছু না অশালীন ইঙ্গিত থেকে যায় এমন খবরে! কাজেই চুপ করে যেতাম। কিন্তু ফোকসালে ঢুকে দেখি অপরেশ, নিমাই বসে আছে। ওরা হয়তো আমাদের খুঁজতে উপরে উঠে যাবে ভাবছিল। আমাদের দেখেই বলল, কি রে, কোথায় গেছিলি এত রাতে! কিছু বললাম না। চুপ করে থাকলে সন্দেহ বাড়ে। আমাকে নিয়ে তাদের ভয় নেই। কারণ তারা জানে, আমি কিছুটা খোলামেলা স্বভাবের। আমার খুব-একটা শুচিবাই না থাকলেও কোনো নারীসংসর্গে যেতে যে রাজি না তারা জানে। তারা নিজেরাও বন্দরে নারীসংসর্গ করে না। কারণ দুরারোগ্য ব্যাধির ভয় কার না থাকে। ডালভাত খাওয়া বাঙালি যেমন হয়ে থাকে—বরং আমাদের উপাস্য দেবী বলতে কিছু নারীর উলঙ্গ অ্যালবাম। যা দেখলে মানসিক অবসাদ থেকে আত্মরক্ষা করা যায়। জাহাজের একঘেয়ে খাওয়া, একঘেয়ে সমুদ্রযাত্রা, একঘেয়ে ঝড়-সাইক্লোন, নীল আকাশ, এবং নক্ষত্রমালা—সবই বড়ো তিক্ততার সৃষ্টি করে। সেখানে বন্দরে কোনো নারীর হাতছানি অবহেলা করা খুব কঠিন। সতীশের শুচিবাই তাকে কিছুটা আলগা করে রেখেছে আমাদের কাছ থেকে। নারী সম্পর্কে সে কোনো অশ্লীল কথা পর্যন্ত বলে না। আমাদের প্রিয় অ্যালবাম থেকে তাকে কত চেষ্টা করেছি নরনারীর সংসর্গের ছবি দেখাতে। ওটা ছুঁলেও যেন পাপ। দেখলে নরকবাস। অথচ আমরা জানি, আমাদের শুচিবাই কম। আমরা এইসব ছবি নিয়ে হেসেখেলে মজা করতে পারি। এতে বোধহয় থাকে কঠিন সব উপসর্গ থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়। আমরা সহজেই তারপর জাহাজ ঘাটে ভিড়লে শিস দিয়ে নেমে যেতে পারি—সুন্দরী যুবতীকে ফুল উপহার দিতে পারি—কার্নিভালে ঢুকে যে-কোনো যুবতীর সঙ্গে রঙ্গরসে মজে যেতে পারি—শুধু সহবাস ছাড়া আমাদের যেন আর কিছুতেই আপত্তি নেই। আমরা এজন্যও বাকি ন-দশ মাস জাহাজে থাকব ভেবে ভেঙে পড়ছি না।
অপরেশ যে বেশ খেপে আছে, বোঝাই গেল।
সে উঠে গিয়ে ফোকসালের দরজা বন্ধ করে দিল। দরজা বন্ধ করলে বাইরে থেকে ভেতরের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না।
অপরেশ ব্যাং-কে বসে একটা সিগারেট ধরাল। তারপর তাকাল সতীশের দিকে। সতীশ তার ব্যাংকে এসে শুয়ে পড়েছে। কম্বলের ভিতর খামে সব ফটো, সেগুলি বালিশের নীচে লুকিয়ে ফেলেছে। আমি লক্ষ করছি-অপরেশ ফুঁসছে।
অপরেশ গজগজ করছে, শালা মরবে। শালার মগজে বীর্য উঠে মরবে। বেটার কোনো ওয়ে-আউটই নেই। জাহাজে কেন মরতে এলি। বিছানায় কোনো দাগ লাগে না! সব বউ-এর জন্য জমা করে রাখছিস! জমা করলে থাকে, থাকলে পাগলের মতো উঠে যাস। কী হাড়কাঁপানো শীত! তার মধ্যে লুকিয়ে বউ-এর ফটো দেখতে উঠে গেলি!
ঠিক ধরে ফেলেছে অপরেশ।
আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কোথা থেকে ধরে আনলি!
বললাম, মেসরুম থেকে।
একসঙ্গে থাকলে, আর এতদিন এক ফোকসালে থাকলে মায়া-দয়া জন্মাতেই পারে। চিন্তা হতেই পারে। তাছাড়া সতীশের সুন্দরী বউকে আমরাও দেখেছি একদণ্ড কাছছাড়া হয় না। কিন্তু এটা যে কতবড় বিপজ্জনক খেলা একজন জাহাজির পক্ষে, ভেবেই অপরেশ ক্ষুব্ধ।
সে সোজা উঠে এল।—এই ওঠ। বলে সতীশের হাত ধরে টানাটানি করতে থাকল।
নিমাই বলল, ছাড়ো তো অপরেশদা। এত রাতে আর ঝুটঝামেলা ভাল্লাগে না।
আর ও তো মরবে।
মরবে কেন!
শোন, এমন অনেক দেখেছি! জানিস, মাথায় বীর্য উঠে গেলে পাগল হয়ে যায়। দিওয়ানা হয়ে যায়।
যা, কী যে আবোলতাবোল বকছ না?
এই উঠবি, না শুয়ে থাকবি। তোর সতীপনা বের করছি। এই নিমাই বের কর তো। ঘাড় ধরে দেখাব।
সতীশ কম্বলের নীচ থেকে হাতজোড় করল, দাদা ক্ষমা কর। আমি পারব না।
পারতে হবে। ওঠ বলছি। অনেক সতীপনা সহ্য করেছি। এখন মেসরুমে শালা, পরে সমুদ্রের তলায় যাবি—তোর তো নিরিবিলি জায়গা চাই। তুই সব করতে পারিস।
সতীশ মটকা মেরে পড়ে আছে।
অপরেশের মাথা গরম হয়ে গেছে। সে এমন একটা কাজ করে বসবে বুঝতে পারিনি। এক ঝটকায় বালিশের তলা থেকে ফটোভরতি খামটা তুলে নিল।
আর নিতেই ছুটে গেল সতীশ।
সব ফেলে দেব।
অপরেশ জেটির উপরে উঠে পোর্টহোলের কাচ খুলতে লাগল।
ওর মুখে এক কথা, আগে দ্যাখ, না দেখলে ফেলে দেব।
নিমাইকে বলল, আরে বের কর আমাদের অ্যালবাম। যেটাকেই দেখা, সব এক। তার বউ-এরটা আলাদা নয় বুঝোক। ওষুধ প্রয়োগ না-হলে বাঁচবে না। ব্যাটা সাধুপুরুষ। বউ ছাড়া কিছু বোঝে না। আট-দশ মাস সফর-করা অপরেশ আমাদের চেয়ে অভিজ্ঞ। সে বলতেই পারে। জাহাজের অসুখ সম্পর্কেও সে বেশি খবর রাখে। সতীশ অপরেশের হাত ধরে টানাটানি করছে। অপরেশ হাতটা পোর্টহোলের বাইরে রেখে দিয়েছে। ছেড়ে দিলেই সমুদ্রের নীল জলে প্রপেলারের চাকায় তছনছ হয়ে গভীর জলের অন্ধকারে ভেসে যাবে।