এ-সময়টাতেই তার সুযোগ। সে জাহাজঘাটায় এক-দু-দিন বন্দরে যে নামে না, তা নয়। তবে তার কাছে বন্দরের সুন্দরী যুবতীদের আকর্ষণের চেয়ে বউ-এর ফটো দেখার আকর্ষণ অনেক বেশি। সে এই করে পনেরো-যোলো মাস জাহাজে কাটিয়ে দিয়েছে। কখনো বৌকে চিঠি লিখে, কখনো তার বউ-এর চিঠি পড়ে, ছবি দেখে তার সময় কেটে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে সে হাই তুলত। রাতে এপাশ-ওপাশ করত। ঘুমোতে পারত না। উঠে জল খেত। ঘুম ভেঙে গেলে একদিন টের পেয়েছিলাম, সতীশ ফোকসালে নেই। গেল কোথায়? বাথরুমে যেতে পারে। বেশ ঠান্ডা পড়েছে। কনকনে শীত। আমরা কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছি। জাহাজ যাচ্ছে ফিজিতে। সেখান থেকে মাটি কাটার কাজ শুরু হবে। ফিজি থেকে প্রায় দেড়-দু হাজার মাইল আরও ওপরে অজস্র ফসফেটের দ্বীপ আছে। সেইসব দ্বীপ থেকে সফেট বোঝাই করে অস্ট্রেলিয়ার উপকূলে খালাস করতে হবে। কনকনে শীতে ফোকসালের বাইরে কোথায় গেলা। বাথরুমে যেতে গেলে সিঁড়ি ভাঙতে হয়। যদি গিয়ে থাকে, ফিরে আসবে। কিছুটা মানসিক অবসাদে ভুগছে সতীশ, টের পাচ্ছিলাম। জাহাজে এটা মারাত্মক রোগ। আমরা সতীশকে সাহস দিতাম। বলতাম, দেখতে দেখতে কেটে যাবে কটা মাস। এত ভেঙে পড়ছিস কেন! সে কথা বলত না। সিগারেট টানত ঘনঘন। মাঝে মাঝে পোর্টহোলে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখত।
সেই সতীশ না নেমে এলে ভয়ের। কম্বল মুড়ি দিয়ে আর তো শুয়ে থাকা যায় না। আবার কাউকে ডাকাও যায় না। হয়তো দেখা যাবে সতীশ গ্যালিতে কনকনে ঠান্ডা থেকে শরীর গরম করার জন্য চা বানাচ্ছে। কিংবা রেলিঙে দাঁড়িয়ে, নিশীথে সমুদ্র দেখতে দেখতে দেশের কথা ভাবছে। ঘুম না হলে আমরাও ডেকে উঠে গেছি কতদিন। ফল্কার ওপর মাদুর পেতে শুয়ে থেকেছি। মাস্তুলের আলো দুলছে। জাহাজ দুলছে। মনে হচ্ছে আকাশ কখনো ঝপাত করে মুখের সামনে নেমে এসেছে। আবার ঝপাত করে উঁচুতে উঠে গেছে। এটা দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। গরমের সময় প্রায় জাহাজিরাই ফোকসাল থেকে উঠে আসে। উপরে সমুদ্রের ঠান্ডা হাওয়া। বেশ আরাম বোধ করা যায়। কিন্তু এই প্রচণ্ড ঠান্ডায় উপরে উঠে গেলে হাত-পা টাল মেরে যায়। সারা গায়ে কনকনে শীতের সূচ বিধতে থাকো কখন গেল, কোথায় গেলা! আর তো শুয়ে থাকা যায় না। কম্বল গায়েই সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে গেলাম। গ্যালির দরজা বন্ধ। মেসরুমের দরজা বন্ধ। ব্রিজে সেকেন্ড অফিসার আর কোয়ার্টার মাস্টার। কাচের ঘর বলে, বুঝতে কষ্ট হয় না—কোয়ার্টার মাস্টার হুইলে হাত রেখে দূরের সমুদ্র দেখছেন। সেকেন্ড অফিসার ব্রিজে পায়চারি করছেন। এখন সেকেন্ড অফিসারের ডিউটি মানে, রাত একটার ওয়াচ চলছে। গেল কোথায়! ইঞ্জিন রুমে! সেখানে তার কী কাজ থাকতে পায়ে! বাথরুম খালি, গ্যালি বন্ধ, মেসরুমের দরজাও বন্ধ। ডেক, ফলকা, এলিওয়ে সব খালি—এই নিশীথে জেগে থাকার কথা একমাত্র ইঞ্জিন রুমে যারা ডিউটি দেয়।
খুবই ফাঁপরে পড়ে গেলাম।
কোথায় আর যেতে পারে এই ঠান্ডায়। ঝড়ো হাওয়ায় সমুদ্র বেশ ক্ষেপে উঠেছে। আকাশে মেঘ নেই, তবু বরফঠান্ডা ঝড়ো হাওয়া। কম্বল উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে।
তারপরই মনে হল, মেসরুম তো বন্ধ থাকায় কথা নয়। দরজা কে বন্ধ করল! রাতের পরিদাররা তো ওয়াচ শেষ করে হাতমুখ ধুয়ে মেসরুমে বসে সিগারেট খায়। দরজা খোলা থাকারই কথা। সারা জাহাজ ঘুরে যখন কোথাও পাওয়া গেল না, ছুটে এলাম, যদি মেসরুমে দরজা বন্ধ করে কিছু করে বসে। দরজা দেখি ভিতর থেকে বন্ধ। ডাকলাম, কে ভিতরে? সাড়া নেই।
অগত্যা পোর্টহোল দিয়ে উঁকি দিতেই দেখি সতীশ তাস সাজাবার মতো ফটোগুলি সাজিয়ে বসে আছে। প্রায় বেঘোরে পড়ে গেছে ছবিগুলি দেখতে দেখতে–এক তরুণীর স্তন নাভি অধর আরও গভীর অভ্যন্তর ভেসে বেড়াচ্ছে বোধহয় সতীশের …..
ডাকলাম, এই, কি হচ্ছে, হ্যাঁ। বসে বসে কী করছিস। এই তোমার কাজা! হ্যাঁ বউকে দেখছ সবার গোপনে বউকে দেখছ। আমরা তোমার বউকে খেয়ে ফেলব।
সতীশ কেমন চমকে গেল। সে ভাবতেই পারেনি, গ্যালির উলটোদিকের পোর্টহোলে কেউ এতে উঁকি মারতে পারে। এত উপরে উঠে … পোর্টহোলে কেউ মুখ গলাবে—কার এত দায়-সমুদ্রের ঝড় উড়িয়ে নিলে রক্ষা করবে কে? আমাকে
এতটা বিপদের মুখে ফেলে দেওয়া যেন তার ঠিক হয়নি। সে দু-হাতে তাড়াতাড়ি সাপটে ফটোগুলি তুলে ফেলল। তারপর দৌড়ে এসে পোর্টহোলের কাছে দাঁড়াল। চোখেমুখে প্রচণ্ড ক্লেশ ফুটে উঠেছে। ভয়ে সচকিত গলায় বলল, নাম, নেমে যা লক্ষ্মী ভাইটি। ঝড়ে উড়েফুড়ে গেলে কেলেঙ্কারি।
দরজা খোল।
খুলছি। তুই নাম। তোর ভয়ডর নেই।
জীবনের মায়া নেই!
দরজা খোল।
খুলছি।
পোর্টহোল থেকে নামছি না দেখে সে যেন অগত্যা দরজা খুলে দিল। একলাফে নেমে এল দরজায়।
কী করছিলি!
সে ঠোঁটে আঙুল রেখে বলল—হিস।
তারপর বাইরে বের হয়ে বলল, কাউকে বলিস না। কেমন অপরাধীর গলা। নিজের বৌ-এর ফটো লুকিয়ে দেখা কী এমন অপরাধ বুঝলাম না। সে এই ফটো দেখে সারা সফর কাটিয়ে দিতে পারলে মন্দ কি! কিন্তু যা আমাদের ভাবিয়ে তুলছে, তা জাহাজে থাকলে, সবাইকে ভাবিয়ে তুলতে পারে। সে হাসে না। কথা বলে না। কাজে কোনো জুস পায় না। খেতে পারে না ভালো করে। অনিদ্রা। এগুলো জাহাজির ভালো লক্ষণ নয়।