টুকুদি ওঠো। দুটো একটা তারা ফুটছে। চল মাসির বাড়ি হয়ে যাই।
তুই বোস আমার পাশে। আমার কোথাও আর যেতে ইচ্ছে করছে না। ঘাস থেকে দুটো একটা ফুল তুলে খোপায় গুঁজে দিতে থাকল টুকু।
অ্যালবাম
আমাদের কিছুই আর ভালো লাগছিল না। জাহাজ কবে দেশে ফিরবে জানি না। মাসের পর মাস দরিয়ার ভাসছি। বন্দরে মাল নামাচ্ছি। মাল তুলছি। জাহাজঘাটায় তবু দিন কেটে যায়। জাহাজে নানা কিসিমের কিনারার মানুষ উঠে আসে। তাদের সঙ্গে আলাপ হয়। কেউ আসে—সস্তায় টোবাকো নিয়ে। কেউ সেকেন্ড হ্যান্ড। মার্কেট থেকে কেনা কোট-প্যান্ট জ্যাকেট—কিংবা গাউন। তারপর বিকেলে ছুটি হলে ঘুরে বেড়াও। কার্নিভালে যাও। সস্তায় মদ গেলা যায় সি-ম্যান মিশানগুলিতে। ফলে দিন কেটে যায়। সবচেয়ে খারাপ লাগে জাহাজ সমুদ্রে ভেসে গেলে। যতদূর চোখ যায় শুধু নীল জলরাশি।
সেই কবে কলকাতা থেকে জাহাজে সাইন করে উঠেছি—আর দেশে ফেরার নাম নেই।
ব্যাংক লাইনের জাহাজ এরকমেরই। মাতামুণ্ডু ঠিক নেই। জাহাজ কোথায় যাবে, কবে ছাড়বে, কোন বন্দরে কতদিন লেগে যাবে এবং কবে জাহাজ আবার কোথায় যাচ্ছে দুদিন আগেও জাহাজিরা জানতে পারে না। জাহাজ ছাড়ার চব্বিশ ঘণ্টা আগে বোর্ডে নোটিশ ঝুলত—কোথায় জাহাজ যাবে, আমরা খবর পেতাম।
ইদানীং বুড়ো ডেকসারেঙ ছাড়া সবাই বেশ মনমরা। ইঞ্জিন সারেঙও বেশ আছেন। যেন সদ্য দেখছেন—আরে বোঝে না কেন—কত দেশ, কত মানুষ সারা দনিয়া চষে বেড়াচ্ছ, সোজা কথা যত লম্বা সফর তত লম্বা বোটখানা। নামার সময় এককাড়ি টাকা পাবা সোজা কথা। তা ঠিক—যত, লম্বা সফর তত বেশি টাকা—শেষের দিকে দেড়-দু’গুণ টাকা কোম্পানিকে গচ্চা দিতে হয়। তবু ব্যাং লাইনের জাহাজে একবার বের হলে কবে দেশে ফেরা যাবে কেউ বলতে পারে না। সারেঙের এক কথা, কোম্পানির মর্জি। বিনি মাগনায় তো কাজ করছ না। তবে এত মুখ গোমড়া কেন বুঝি না। জাহাজে ওঠার সময় মনে ছিল না! সাইন কে করতে।
সারেঙসাবও যে মিথ্যা চোটপাট করছেন না বুঝি। আমাদের মাথা গরম, জাহাজ যাচ্ছে, মাটি টানার কাজে। ব্রিটিশ ফসফেট কোম্পানির সঙ্গে নাকি চুক্তি সারা। অস্ট্রেলিয়ার উপকূলে ফসফেট এনে ফেলতে হবে। নিউ ক্যাসেল, সিডনি, জিলঙ—এমন সব বন্দরের নামও শুনেছিলাম। জাহাজ অকল্যান্ডের জাহাজঘাটায় ভিড়ে আছে। খবরটা এনেছে কোয়ার্টার মাস্টার হাপিজুর। সে-ই পিছিয়ে এসে বলল, হয়ে গেলা ন-দশ মাস কাবার।
তার মানে আরও ন-দশ মাস! সারেঙসাব খবরটা পেয়ে খুশিই দেখলাম। দু আড়াই বছর—মাথা খারাপ হয়ে যাবার যোগাড়—শুধু জল আর নীল আকাশ, ঝড় সাইক্লোন। কখনো গভীর বৃষ্টিপাত অথবা জ্যোৎস্নারাতে গভীর সমুদ্রে আমাদের ডেকে বসে থাকা। ঘুম আসে না।
সবচেয়ে খারাপ লাগছে বেচারা সতীশের কথা ভেবে। সবে বিয়ে করে ব্যাটা জাহাজে এসে উঠেছে। কলকাতার ঘাটে সে সাইন করার পরও রাতে জাহাজে থাকত না। তা নতুন শাদি, সারেঙসাবের কোমলমতিতে টুটাফাটা দাগ থাকতে পারে—তিনি বলতেন, যা। সকাল সকাল চলে আসিছ। কেউ যেন টের না পায়। জাহাজ ছাড়ার আগে সে একদিন বউয়ের রান্নার হাত কত মিষ্টি, পরখ করবার জন্য আমাদের বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে গেছিল। ভারি সুন্দর মিষ্টি দেখতে লাজুক। সতীশের মা-বাবাও খুব খুশি আমরা যাওয়ায়। রবিবার বলে সারাদিন সতীশের বাড়িতে চুটিয়ে আড্ডা, তাস খেলা, এবং প্রায় সোরগোলের মধ্যে তার বউকে দেখেছিলাম—চুপিচুপি সতীশকে ফাঁক পেলেই ডেকে নিয়ে যাচ্ছে। ফিরে এল মসকরা—কি দিল!
কি দেবে আবার!
শালো, তুমি কি করে এলে বল!
আরে না, তোরা কখন খেতে বসবি জানতে চাইল।
ফের মিছে কথা!
সতীশ বেচারা হেসে ফেলত।
বল কি করেছিস! বউটাকে একদণ্ড বিশ্রাম দিচ্ছিস না!
জাহাজ মাটি টানার কাজ নিয়েছে শুনে সেই সতীশ খুবই ভেঙে পড়ছ। খুব হিসেবি সতীশ।
বউ-এর জন্য টাকা বাঁচাচ্ছো। বন্দরে নেমে কেনাকাটা যা-কিছু বউকে খুশি করার জন্য। বন্দরে যে-কদিন থাকা হয়, রোজ বউকে একটা চিঠি। সাঁজবেলায় সবাই যখন শহরে ঘুরতে বের হয়, সে তখন ব্যাংকে শুয়ে বউকে চিঠি লেখে। কখনো লুকিয়ে বউ-এর ছবি দেখে। লুকিয়ে না দেখে উপায়ও নেই। কারো সামনে পড়ে গেলে, ফটোটা নিয়ে টাটানি শুরু হয়। এটা সতীশ একদম পছন্দ করে না। তার একটা যে গোপন পৃথিবী আছে, সেটা যেন খোলামেলা হয়ে যায়। সে জাহাজে উঠে তার বউ-এর ছবিগুলি না দেখালেই ভালো করত। বিয়ের সময় তার যত ছবি তোলা হয়েছিল, তার সব কপি সঙ্গে এনেছে। সে না দেখালে অবশ্য আমরা জানতেও পারতাম না। সমুদ্র সফরে এই ছবিগুলি তার সঙ্গে আছে। বন্দর এলেই সে ছবিগুলি দেখার সুযোগ পায়। এক ফোকসালে আমরা। চারটা ব্যাংকে চার বাঙালিবাবু। সতীশ, নিমাই, অপরেশ আর আমি। সমুদ্রে নানা কাজ থাকে। সকালে একসঙ্গে উঠতে হয়। ডেকে জল মারতে হয়। তারপর চা চাপাটি খেতে হয়। তারপর কশপের ঘরে খেতে হয়। স্টোর রুম থেকে যে-যার মতো দড়িদড়া বের করে নেয়। তক্তা বের করে নেয়। কারও রঙের কাজ, কারো চিপিংয়ের কাজ। কেউ ফোকসালে অবশ্য তখন কাজে ফাঁকি দিয়ে ঢুকে যেতে পারে। তবে ডেকরেঙের সতর্ক নজর। তারপর দুপুরে ভাত-ডাল-সবজি, গোস্ত। আবার কাজা। পাঁচটা না বাজলে কাজ থেকে ছুটি হয় না। তখনও ফোকসালে লোজন থাকে। সে যে গোপনে বউ-এর ছবি দেখবে, তারও উপায় নেই। একমাত্র ফুরসত মেলে জাহাজ ঘাটে ভিড়লে। সবাই বন্দরে নেমে গেলে ফোকসাল ফাঁকা।