এই শরা চল আমার সঙ্গে।
টুকু ঘরে ঢুকে শাড়ি সায়া পাল্টে নিল। মুখে সামান্য প্রসাধন করল। তারপর দরজা টেনে শেকল তুলে তালা লাগিয়ে দিল।
তকে বের হতে দেখে নধর কোথা থেকে হাজির।
সঙ্গে যাবে।
কারও যেতে হবে না। মনে মনে কুকুরটার দিকে তাকিয়ে গজ গজ করছে টুকু। তাছাড়া খালি বাড়ি রেখে সে যেতেও পারে না। শরাকে পাঠাতে পারত, খবর দিয়ে আয়, দুদুমণি নরেন সাধুর থানে গণ্ডি খাটছে। খবর পেলে মাসি নিজেও ছুটে আসতে পারে। মাসকাবারি রিকশাওয়ালাকে খবর দিলেই হল, রিকশায় চড়ে মেসো না হয় মাসি চলে আসতে পারে। কিন্তু সে একটা কিছু করতে চায়। শরাকে দিয়ে খবর পাঠালে আর দশদিনের মতোই তার প্রতিবাদের কোনো গুরুত্ব থাকবে না। মাসি এসে বলতেই পারে, মা কী করবে! দাদারা মাথা পাতছে না— বড়দা লিখবে, আমার সময় কোথায়, টাকা পয়সা যা লাগে জানাবে। তোর মেসোই বা কী করবে। তারই বা সময় কোথায়। কত সম্বন্ধ এল, দানবের মতো দাবি দাওয়া সব। কে মেটাবে অত খাই।
এ-সব কথা শুনলে টুকুর যে মাথা হেঁট হয়ে যায় কেউ বোঝে না। কোনো কথাই আর তার শুনতে ভালো লাগে না।
টুকু বলল, এই শরা চল। তোর নীলুমাসিকে খবরটা দিতে হবে। আমরা সাইকেলে যাব আর আসব।
সাইকেলে! আমার তো সাইকেল নেই।
তোর সাইকেল না থাকলেও চলবে। তুই না হয় আমি রডে বসব।
তোমার নিন্দামন্দ হবে টুকুদি।
হোক। আমার আর নিন্দামন্দের বাকি আছে কি। মাসিকে খবরটা দিই। নাতনির জন্য বুড়ি নরেন সাধুর থানে দণ্ডি খাটছে। বুড়ি মরবে। আমি কেন মরার ভাগী হতে যাব।
শরাকে খুবই বিচলিত দেখাচ্ছে। টুকুদি রডে বসবে না সে বসবে বুঝতে পারছে না। যেই বসুক লোকেরা চোখ টাটাবে।
টুকুদি আমাকে না নিয়ে গেলে হয় না।
না হয় না।
এই অবেলায় বের হবে? আমাকে নিয়ে বের হলে যে লোকে তোমারও মাথাটি খারাপ ভাববে। তোমার নিন্দামন্দ হবে। লোকে কুকথা বলবে।
তুই যাবি, না বকবক করবি।
শরা আর কী করে। টুকুদির চুলের গন্ধ পাবে রডে বসলে। এই লোভেই যেন সে সাইকেলে চেপে বসল। টুকু রডে বসে বলল, বড়ো সড়কের দিকে চল।
ওদিকটায় তো ফাঁকা। ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না। মাসির বাড়ি যাবে না!
টুকু খেপে যাচ্ছে।
তুই কি আমার গার্জিয়ান। নাম।
শরা ভয়ে ভয়ে সাইকেল থামিয়ে নেমে পড়ল। রাস্তায় লোকজন তাকে দেখছে। কাউকে সে গ্রাহ্য করছে না।
চৌধুরীমামা আড়তে যাচ্ছেন, তাকে দেখেই বলল, টুকু না?
টুকু বলল, বড়ো সড়কে যাচ্ছি।
শরা ঘাবড়ে গেল। টুকুদির মামারা জানতে পারলে তাকে লাঠিপেটা করতে পারে। এতো বড়ো আস্পর্ধা, টুকুকে সাইকেলের রডে বসিয়ে কলোনি ঘোরা হচ্ছে। এত সাহস হয় কী করে। অথচ টুকুদির কথা সে অগ্রাহ্য করতে পারে না। সে হতাশ গলায় বলল, টুকুদি বাড়ি চল। মাথা গরম কর না। আমি না হয় মাসিকে খবরটা দিয়ে আসছি।
টুকু সাইকেলে চেপে শুধু বলল, রডে বোস। কোনো কথা না। দশ ভাতারের খোঁজে যাচ্ছি। এক ভাতার নিয়ে আমার পেট ভরবে না। বুঝতে চেষ্টা কর।
মেজাজ টুকুদির খুবই অপ্রসন্ন। এতেক খারাপ কথা টুকুদি কখনো বলে না। কী সুন্দর স্বভাব টুকুদির। আর সেই কিনা বলছে, দশ ভাতারের খোঁজে যাচ্ছি। তার যেন এ-বড়ো অচেনা টুকুদি। দুদুমণি দণ্ডি খাটতে না গেলেই পারত। এমন সুন্দর মেয়ের বর জুটছে না, খোঁড়া বলে কী তার কোনো মূল্য নেই। দুদুমণি বাজিয়ে বেড়াচ্ছে সর্বত্র, টুকুদির পাত্র জুটছে না। টুকুদি যে বলল, গাছের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেছে। সবকিছুই বড়ো রহস্যজনক ঠেকছে।
টুকু কলোনির ওপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। টুকুকে সবাই চেনে—কুমুদ মজুমদারের নাতনি, পা খোঁড়া মেয়েটার বিয়ে হচ্ছে না। স্কুলের মাঠ পার হয়ে তেলিপাড়ায় আসতেই শরা বলল, তুমি এখানে দাঁড়াও, মাসিকে খবরটা দিয়ে আসছি।
না। কোনো খবর দিতে হবে না।
টুকু সোজা বড়ো সড়কের দিকে উঠে গেল। তারপর সাইকেল থেকে নেমে কিছুটা ঘোরের মধ্যে যেন হেঁটে গেল।
শরা সাইকেল নিয়ে টুকুদিকে অনুসরণ করছে।
একবার না পেরে বলল, তোমার কী হয়েছে টুকুদি।
এই যে ছোটো জায়গাটা দেখছিস, দাদু আমার নামে দিয়ে গেছে। এখানটায় কিছু একটা করতে হবে। এই একটা চা-এর দোকান টোকান। বাস স্ট্যান্ড, সারের গুদাম, সরকারি কোয়ার্টার কত কিছু হচ্ছে। রাস্তার ধারে তুই আমি মিলে কিছু একটা করতে চাই। এক ভাতারের হাত থেকে তো বাঁচি! দশ ভারি হয়ে বেঁচে থাকাও অনেক গৌরবের। চা-এর নেশার চেয়ে আমার নেশা নাকি মানুষের বেশি! দেখি না দোকান করে। জলে ডুবে যাচ্ছি। তুই না হয় আমার খড়কুটো হয়েই থাক। কি পারবি? রাজি। টুকু প্রায় এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে হাঁপাতে থাকল।
তোমার কোন কথাটা আমি রাখিনি টুকুদি। কিন্তু তোমার গাছটা রাগ করবে না?
গাছ! টুকু হা হা করে হাসল।–তুই রাজি কি না বল।
বললে যে গাছের সঙ্গে তোমার বে হয়ে গেছে।
বোকা কোথাকার। গাছ কখনো রাগ করে। না সে রাগ করতে জানে। তুই রাজি আছিস কি না বল। তুই রাজি থাকলে গাছটা মাটিতে লেগে যাবে মনে হয়।
তখন সারা আকাশ ম্লান অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে সহসা রূপালি বন্যায় ভেসে গেল। আবিষ্কারের মতো মনে হল—গাছটা লেগে যাবে। জীবনে সামান্য সূর্যালোক। এইটুকুই টুকুর আজ বড় বেশি দরকার। জমিটায় সে হাঁটুমুড়ে বসে পড়ল। জমিটা তার নিজের, নিজস্ব। চা-এর দোকান, মানুষজন, ভিড় এবং ব্যস্ততা —এক টুকরো স্বপ্ন। শুরা না এলে এই স্বপ্নটুকু যেন খুঁজে পেত না।