সেই থেকে অনেকদিন চুপচাপই ছিল। কোথাও বের হত না। আজ কী হল কে জানে, আবার বের হয়ে পড়েছে।
কুকুরটার দিকে টুকুর চোখ গেল।
বেইমান।
দু-জনে ঠিক শলাপরামর্শ করেই বের হয়েছে। না হলে, নিশ্চিন্তে নধর বারান্দায় শুয়ে থাকতে পারে।
এই কোথায় গেছে দুদুমণি?
লেজ নাড়ছে। একবার চোখ তুলে তাকে দেখল। আবার মুখ গুঁজে দিল পেটের দিকে।
তোমার আরাম বের করছি।
বলেই টুকু তাড়া লাগাল কুকুরটাকে। কুকুরটা লাফ মেরে উঠোনে নেমে গেল।
বের হ। যেদিকে চোখ যায় চলে যা। দুদুমণি গেছে, তুইও যা। থেকে কী হবে!
তখনই শরা সাইকেল চালিয়ে সোজা উঠোনে ঢুকে গেল।
গেছে?
নরেন সাধুর কাছে গেছে।
শরা সাইকেল থেকে লাফিয়ে নামল। তারপর বলল, এক গ্লাস জল দাও টুকুদিদি। নরেন সাধুর থানে মচ্ছব। ঠাইনদি পর্যন্ত খাটছে।
টুকুর মাথা গরম হয়ে গেল। দণ্ডি খাটছে এই বয়সে। বুড়ি মরবে। কুলো মাথায় রোদে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে সারাদিন মন্দির প্রদক্ষিণ করা সোজা! মানত করেছে বুড়ি। মানত না করলে সাধুর পাল্লায় পড়ে গেছে। সর্বস্ব যাবে। খায়ওনি। নরেন সাধু তুমি মানুষ! ঠাকুরের নামে দুদুমণিকে দণ্ডি খাটাচ্ছ, তোমার পাপ হবে না। গন্ধর্ব কবচ পেতে হলে দণ্ডি খাটতে হয়, বললেই হয়েছে! বিরজাসুন্দরী না খেয়ে, তাকে লুকিয়ে তবে সেই গন্ধর্ব কবচ আনতে গেল। দুদুমণি তাকে নিয়ে কত অসহায় এটি ভাবতে গিয়ে তার দু-চোখ ভিজে গেল। যে যা বলছে, করে যাচ্ছে।
টুকুদি, নরেন সাধু জানোয়ার।
টুকু কী করবে বুঝে পাচ্ছে না। সে ভিতরে কেমন অস্থির হয়ে পড়ছে। সেখানে তার ছুটে যাবারও ক্ষমতা নেই। সাধুর থানে শনি মঙ্গলবারে পাঁঠা পড়ে। তিথি নক্ষত্র বুঝে লোকে হত্যে দেয়। যার যা মনস্কামনা পূর্ণ হয়। বাজার পার হয়ে রাজবাড়ির রাশতলায় এখন সাধুর আশ্রম। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, মাথায় লম্বা টিকি, টিকিতে জবাফুল বাঁধা। জরা ব্যাধি মৃত্যুর হাত থেকে মানুষ রেহাই পেতে চাইলে থানে যেতেই হয়। মানত করতে হয়।
সাধুর চেলা কালীপদই একদিন বারান্দায় বসে বলে গেছে, ঠাইনদি, সব গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থানে হয়। টুকুর কুষ্ঠিটা দেবেন, বিচার করে দেখব।
কালীপদ আচার্য বামুন। গ্রহরাজ বলতে কথা। গাছের পাকা পেপে থেকে, কাঁঠালের দিনে কাঁঠাল, আমের দিনে আম সবই সে পায়। দাদু বেঁচে থাকতেও দেখেছে, কালীপদ এলে, ফল–মূল তার হাতে তুলে দিয়ে দাদু তৃপ্তি পেতেন। গ্রহরাজ সন্তুষ্ট থাকলে বাড়ির অমঙ্গল হয় না। কুষ্ঠি ঠিকুজিও সেই করে দেয়। বাড়িতে তার আগমন সব সময়ই শুভ সময়ের কথা বলে। তাকে নিয়ে আতান্তরে পড়ে গেছে বিরজাসুন্দরী সে ভালই জানে। সেই বলে গেছে বোধহয়, সাধুর কাছে যাবেন, বিধান মতো তাঁর কাজ করে দেখুন—ফল হাতে নাতে পাবেন।
ইদানীং টুকু দেখেছে, দুদুমণি, সূর্যস্তব পাঠ করছেন। সকালে উঠে সূর্যপ্রণাম। শেষে এই দণ্ডি খাটা। সে খেপে যাবে শুনলে—ভেবেই হয়তো লুকিয়ে চলে গেছে।
কী শরা।
একবার বড়ো মাসিকে খবরটা দিতে হয়।
এই শরা চলত আমার সঙ্গে।
কোথায় যাবে?
বড়োমাসিকে খবরটা দিই। দুদুমণির মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
নীলুমাসিকে এখন পাবে? স্কুল আছে না। স্কুল থেকে কি ফিরেছে।
সে বলল, কটা বাজে।
ঘড়িতে সময় দেখে বলল শরা, চারটা বেজে গেছে।
আকাশ মেঘলা বলে কটা বাজে বুঝতে পারছিল না টুকু। মাসি বাড়িতে এখনও ফেরেনি। মেসো ফিরতে পারে। মেশোর স্কুল বাড়ির কাছেই। খুব টিউশানি করে, এখন গরমের ছুটি বলে তাও নেই। মেসো বাড়ি থাকতেই পারে। তবে ক্লাবে গিয়ে বসে থাকলে মুশকিল। বোনটাও বাড়ি থাকলে এক্ষুনি চলে যেতে পারত। কলেজ হোস্টেলে থাকে বলে বাড়ি খালি পড়েই থাকে। কেউ না থাকলে, যা হয়, তালা দিয়ে যায় মাসি। মেসোর কাছে ডুপ্লিকেট চাবি থাকে, তবে তার যে একদণ্ড আর এই বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এক্ষুনি ঘরের দরজায় শেকল তুলে তালা দিয়ে বের হয়ে পড়তে পারলে বাঁচে। ক্রোশখানেক রাস্তা সাইকেলে যেতে দশ বিশ মিনিট—কিন্তু গিয়ে যদি দেখে কেউ নেই, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
মেসোদের দিকটাই পাকা রাস্তা, টাইম কলের জল, কারেন্ট সব আছে। পাকা বাড়ি একতলা। ছাদের সিঁড়ি করবে বলে ইট বালি সিমেন্ট তুলে রেখেছে। গরমের ছুটিতে সিঁড়িটা করে ফেলবে। বারান্দায় গ্রিল। উঠোনে ঢুকে ভিতরের বারান্দায় দিকটায় যাওয়া যায়। মেসো মাসি কেউ না ফিরলেও তার অসুবিধা হয় না। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত ঢোকালেই সদর দরজার চাবি।
মাসিই বলেছে, আমরা না থাকলেও অসুবিধা নেই। কোথায় চাবিটা থাকে দেখিয়ে দিয়েছে। দুদুমণির কত খবর থাকে, এবেলা ওবেলা তাকে মাসির বাড়ি যেতেই হয়। কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলেই সবার চোখ তার ওপর। টুকু এসেছে আবার। ঠিক বিরজাসুন্দরী মেয়ের কাছে খবর পাঠিয়েছে, টুকুর পাত্রের একটি খোঁজ পাওয়া গেছে। প্রতিবেশীরা জানালা খুলে তাকে দেখলেই টুকুর গা জ্বালা হয়। আজকাল সে চোরের মতো সবার আড়ালে মাসির বাড়ি ঢুকে যায়—সাঁজ লাগলে চুপিচুপি বের হয়ে আসে। সিঁড়ির মালমশলাতে উঠোন ভরতি—সে শত চেষ্টা করলেও চাবিটার নাগাল পাবে না। সেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে।
কিন্তু আজ সে মরিয়া।