আরও কী দোকান খুলে বসবি কথাটাতে কত কুৎসিত ইঙ্গিত দুদুমণি বোঝে না। চায়ের দোকান, এই যেমন, তার যা সামান্য টাকা আছে, টালির চাল, বাঁশের বেড়া, দুটো টুল, একটা কেটলি, কিছু গ্লাস আর একটা বড়ো মাটির হাঁড়ি, গামলা–হয়ে যাবে মনে হয়েছিল। একটা স্বপ্ন। তার কাঁথাখানার কাজ শেষ হলে আরও কিছু পয়সা আসবে। শরাই মাধববাবুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। শহরে হস্তশিল্পের একটি দোকান আছে তার। ভালো দামই দেবে। তবে বড়ো সময় লাগে, দিনরাত স্বপ্ন না দেখলে নকশি কাঁথার চন্দ্র সূর্য নামে না। করে যে শেষ হবে, কবে যে নামবে, কখনো জ্যোৎস্না রাতে উঠোনে নকশিকাঁথাখান মাদুরে বিছিয়ে বসে থাকে।
বাড়ি থেকে বিশেষ বেরও হতে পারে না। সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটে বলে মানুষের নজর বড়ো বিপাকে ফেলে দেয়। সে হেঁটে গেলে—এতো কী দেখার আছে বোঝে না। হাঁটাহাঁটি যেটুকু পাড়ার মধ্যে। পাড়া থেকে বের হলে সাইকেল, পরিচিত কেউ ডাকলে, সে মাটিতে এক পা রেখে সাইকেলে বসেই কথা বলে। কত উড়ো কথা কানে আসে, অপরিচিত যুবকদের চোখ তাঁর খুঁড়িয়ে হাঁটার মধ্যে আনন্দ খোঁজে। সেটা যে কী সে ভালোই বোঝে।
মাসির বাড়িতে বড়ো আয়নায় তার খুঁড়িয়ে হাঁটার মধ্যে কোনো যৌনতার ছবি থাকে কিনা সে সুযোগ পেলেই খুঁজে দেখে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে নিজেকে দেখে। তার পেছনটা বড়ো বেশি দোল খায়। এমনিতে সে স্থূলকায় নয়, শরীরের গড়ন খুবই তার মজবুত। ঈশ্বর তাকে লাবণ্য এবং সুষমা দুইই দিয়েছেন। খুঁড়িয়ে হাঁটার জন্য পেছনটা তার একটু বেশি ওঠানামা করে। মানুষের লুব্ধ দৃষ্টি তার দিকে এতো কেন তাও বোঝে।
দোকানের কথাতে বিরজাসুন্দরীর একদিন কী চোপা! চায়ের নেশা না ছাই, তোর নেশাতেই দোকানে ভিড় বাড়বে। এটা বিরজাসুন্দরী দশভাতারির মতো ভাবে। নাতনি দশভাতারি হলে বিরজাসুন্দরীর মরণ। গলার ফাঁস।
বিরজাসুন্দরী কেন, মামাদেরও চটাতে সে সাহস পায় না। তার সমবয়সিরা কেউ বসে নেই। সবাই স্বামীর ঘর করছে। তারা বেড়াতে এসে খোঁজখবরও নেয়। কোলে কাঁখে বাচ্চা থাকে। স্বামীর এলেম কত কোলে কাঁখে বাচ্চা নিয়ে এসে দেখিয়ে যায়।
বিরজাসুন্দরী মনে মনে তখন খুবই অপ্রসন্ন। আমার টুকুর বিয়ে হচ্ছে না, তোরা শরীর খালি করে মরদ নিয়ে পড়ে আছিস, টুকুর কি আমার শরীর নাই।
তারও খারাপ যে লাগে না তা নয়। তার তো একজন পুরুষ সত্যি দরকার। সে কাকে অবলম্বন করে বাঁচবে। তার শরীর এতো মজবুত, যে রোগ বালাই পর্যন্ত নেই। শরীরে রোগ ভোগ থাকলেও কিছু নিয়ে সে থাকতে পারত। কত রাতে যে তার ঘুম হয় না। এ-পাশ ওপাশ করে। উঠে জল খায়। বিরজাসুন্দরী ঠিক টের পায়।
সে রাতে উঠলেই টের পায় বিরজাসুন্দরী জেগে আছে।
বাইরে যাবি।
না।
উঠলি যে।
জল খাব।
দুগগা দুগগা।
জল খাওয়ার সঙ্গে দুগগা দুগগা বলার কি আছে টুকু বোঝে না। পরে ভেবে দেখেছে, দুদুমণি টের পায়—এই জলতেষ্টা কেন। এতো রাতেও টুকু না ঘুমিয়ে থাকে কেন। জল তেষ্টা পায় কেন!
সকালে উঠেই টুকু দেখতে পায়, দুদুমণি পাটভাঙা সাদা থান পরে, নামাবলি গায়ে দিয়ে কোথায় বের হচ্ছেন।
কী হল, সাত সকালে কোথায় যাচ্ছ।
যাচ্ছি মরতে।
কোথায় কার কাছে মরতে যাচ্ছ বলে যাবে না।
না, বলে যাব না।
বলে গেলে, দেখবে এসে আমিও বাড়ি নেই।
বুড়ি জব্দ।
হরতুকির কৌটাটা আবার রাখলাম কোথায়। টুকুদিদি, খুঁজে দে না। আমি এক্ষুনি ফিরে আসছি। কোথাও বের হলেই তুই এতো ফোঁস করিস কেন। আমিতো চেষ্টা করছি।
না আর চেষ্টা করতে হবে না। বের হবে না। তোমার জন্য মুখ দেখাতে পারি না। কী রে তোর দুদুমণি সকালে উঠেই কোথায় বের হল। যা গরম পড়েছে—কী রোদ, ছাতা মাথায় কোথায় যাবে! তোর দুদুমণির গোরু খোঁজা চলছে, কবে যে শেষ হবে।
এটা যে প্রতিবেশীদের কটাক্ষ, দুদুমণি কিছুতেই বোঝে না। দুদুমণি শুনতে পেলে বলবে, তা মা যা বলেছ, গোরু খোঁজাই সার, পাচ্ছি না। এসব কথা শুনলে তার সত্যি মরে যেতে ইচ্ছে হয়।
সুধার বাবা যে যেতে বলল!
বলুকগে।
বিরজাসুন্দরী অগত্যা সেদিন বারান্দায় বসে পড়েছিল। কিছুটা সান্ত্বনা দেবার মতো যেন বলা, আরে বিবাহ কী সহজ কথা, সাত মন ঘি না পুড়লে পাকা কথা হয় না। বিধির নির্বন্ধ, তাই বলে তো হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না, কপালের নাম গোপাল তাও বুঝি—যখন হবার ঠিকই হবে, তবে মন যে মানে না।
তুমি যাবে না সোজা বলে দিলাম। অনেক বিভ্রাট বাধিয়েছ, লোক হাসিয়েছ। সুধার বাবা উদ্ধার না করলেও চলবে।
লোক হাসালাম! কবে?
হাসালে না, যাকে রাস্তার দ্যাখ তার কাছেই বলবে, তোরা আমার ভগবান। কাকে না বলেছ, পালান কাকা, অধীর কর্মকার, মানিক দাস কে না সুযোগ বুঝে তোমার কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়ে গেছে। আমাকে তুমি কী ভাব। যাবে না বলে দিলাম—এক কথা।
আমার অন্য কাজ আছে। তোর জন্য ভাবতে আমার বয়েই গেছে।
কী কাজ বল, আমি করে দিচ্ছি। কাকে খবর দিতে হবে বল, ডেকে নিয়ে আসছি। তুমি আমার পাত্রের খোঁজে এক পা বাড়ি থেকে বাড়িয়েছ তো, আমার মরা মুখ দেখবে।
তখনই বুড়ির কী কান্না। তুই কী বললি টুকু, মরা মুখ, তোর মা নেই, আমার কেউ নেই, থাকলে তুই এতো বড়ো কথা বলতে পারতিস। তাপরই ঘরে ঢুকে গায়ের নামাবলি তক্তাপোষে ফেলে দিয়ে একেবারে নিরাসক্ত গলায় কথাবার্তা, আমার কী, এতো যার মান, তাকে বিয়েটা করবে কে! দু-দিন বাদে ফেরত দিয়ে যাবে।