চা খাই। কতদিন পর এলাম। তোমার কাছে বসতে ইচ্ছে করছে। তাড়িয়ে দিচ্ছ কেন।
টুকু খড়কুটো জ্বেলে আলগা উনুনে চা করল, দু-কাপ চা, এক কাপ শরাকে দিতে গেল বারান্দায়। শরা নেই।
এই গেলি কোথায়!
এই এখানে দিদি। আমগাছতলায় দাঁড়িয়ে সাড়া দিচ্ছে।
চা ঠান্ডা হয়ে যাবে।
শরার এই এক দোষ। বাড়িটার এলে যেতে চায় না। গাছপালার ছায়ায় ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে। এতটা জমি ফুলের বাগান বাঁশঝাড় নিয়ে বাড়িঘর কম মানুষেরই আছে। জমি কেউ রাখছে না—বেশি দরদামে জমি বেচে দিচ্ছে। বড়োমামা বাপের জমি বেচে দিতে রাজি না। চলে যখন যাচ্ছে, জমি ভাগ করে কী হবে। ছোটোমামা মেজমামা গাইগুই করলে কী হবে, তাঁর এক কথা। মা বেঁচে থাকতে জমি ভাগ হবে না। জমি বন্টননামা না হলে যা হয়, পড়ে আছে— দুদুমণির রাজত্বে কেউ বড়োমামার ভয়ে হাত দিতে সাহস পাচ্ছে না। এতে বিরজাসুন্দরীর তেজ আরও বাড়ছে।
না খেয়ে কোথায় বের হয়ে গেলেন!
শরা এখন না এলেই যেন ভালো ছিল। মিল খোলা থাকলে বেলার আন্দাজ মাথায় থাকে। বন্ধ বলে মিলের ভোঁ বাজে না। হাতঘড়িটা তপনকাকার দোকানে পড়ে আছে। খুবই স্লো যাচ্ছে ঘড়ি। কটা বাজে বুঝতে পারছে না। বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় বেশ ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছিল। সাইকেল বের করে একবার বড়ো মাসিকে খবরটা দেওয়া দরকার। বাড়ি খালি রেখেই তাকে যেতে হয়। নধর অবশ্য বারান্দায় শুয়ে থাকবে। বলে গেলেই হল, আমি আসছি। বিরজাসুন্দরী কোথায় না খেয়ে বের হয়ে গেল, মাসিকে খবরটা দিতে হয়। সারমেয়টি খুবই অনুগত—কী করে যে সব বোঝে! বের হবে ঠিক করছিল, শরা এসে হাজির। কী করে যায়।
টুকুদি তোমার বিয়ের কিছু হল! শরা বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে কথাটা বলে ফেলল। শুরা সবই জানে, বিরজাসুন্দরী তাকে নিয়ে আতান্তরে আছে, তাও জানে, মাঝে মাঝে এই প্রশ্নটা প্রতিবেশীরাও কেন যে করে ফেলে। আগে চেঁচামেচি করা, বিয়ের কথা বললে গা জ্বলে যাবারই কথা। তাকে নিয়ে সবাই মজা করছে ভাৰত, শরাও বলত, শরার কথায় রাগ করতে পারত না। শরাকে খুব ব্যাকুল দেখাত। সামান্য খুঁত আছে শরীরে। তাই বলে কী মেয়েদের বিয়ে হয় না!
চা-এর কাপ নামিয়ে কী ভেবে টুকু থামল। খুব গরম চা। খেতে তার খারাপ লাগে। তাড়াতাড়ি থাকলে প্লেটে ঢেলে খায়। এখন তাড়াহুড়ো নেই, কতদিন পর শরা এসেছে। তার ভালোই লাগছিল। দেশ বিদেশ ঘুরে এলে দাড়ি গজিয়ে যায়। প্যান্ট সার্ট নোংরা হয়ে যায়। ছেড়া তালিমারা প্যান্ট পরেও চলে আসে। বোধহয় সে এখন বাড়িতেই আছে। চুল শ্যাম্পু করেছে। গোঁফ রেখেছে। মুখে চোখে সরল বালকের মতো মনে হয় দেখলে। টুকু যা বলবে তাই বিশ্বাস করবে।
তুমি হাসলে যে টুকুদি।
হাসব না। আমার কবেই বিয়ে হয়ে গেছে। তুই খবরই রাখিস না। তুই এতো বোকা।
বিয়ে।
হ্যাঁ বিয়ে।
কার সঙ্গে।
গাছের সঙ্গে।
গাছের সঙ্গে বিয়ে হওয়াটা কী ভালো টুকুদি।
ভালো মন্দ বুঝি না। তুই আর কোনোদিন বলবি না, টুকুদি তোমার বিয়ের কী হল! কী ঠিক তো!
শরা কী ভাবল কে জানে। সে উঠে পড়ল। গাছের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সে ক্ষুন্ন হয়েছে, অন্তত টুকু শরার মুখ দেখে এমনই ভাবল।
আমি যাই। নীলুমাসির খবর কি! আসে?
আসে।
সুধাদি চলে গেছে?
সুধাদি প্রাইমারি ইস্কুলের মাস্টারনি। কোনো খবরই রাখিস না। সুধার বর তাকে ফেলে চলে গেছে।
সুধাদিকে বল, আমি ফিরে এসেছি। কোথাও আর এখন যাচ্ছি না। তোমার নকশিকাঁথায় চন্দ্র সূর্য নামলে আসব।
বোস। এখন যাবি না। একবারে নরেন সাধুর কাছে ঘুরে আয়। মনে হয় বিরজাসুন্দরী সেখানে গিয়ে বসে আছে। আমার সাইকেলটা নিয়ে চলে যা। না গেলে মাসিকে খবর দিতে হবে। বিরজাসুন্দরী ধনুরাঙা পণ, কিছুতেই ঘরের খুঁটি করে রাখবে না। আমাকে তাড়াবে।
কোথায় তাড়াবে।
কী জানি। যা, বসে থাকিস না।
বড়ো অনুগত শরা। সে সাইকেল বের করে বিরজাসুন্দরীর খোঁজে বের হয়ে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে নধরও সাইকেলের পেছনে ছুটতে থাকলে, শরা ডাকল, টুকুদি দ্যাখ তোমার নধর আমার পিছু নিয়েছে। ঘেউ ঘেউ করছে। তোমার সাইকেল ধরেছি বলে রাগ করছে।
টুকু ডাকল, নধর এদিকে আর। শরা সাইকেল নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে না। এক্ষুনি ফিরে আসবে। আয় বলছি।
নধর এক লাফে বারান্দায় উঠে পায়ের তলায় শুয়ে লেজ নাড়তে থাকলে টুকুর চোখে জল এসে গেল।
দুদুমণি না খেয়ে কোথায় বের হয়ে গেল।
বড়মামা লিখেছে, টুকু কিছু করুক। এত দাবিদাওয়া—দেবে কোত্থেকে। আমার ঘাড়েও তো তিন তিনটি মেয়ে।
কিছু করুক। কী করবে বুঝতে পারছে না। সকালে কটা বাচ্চা বাড়িতে এসে পড়ে যায়। অজ আম ইট-অ পড়ায়। ক খ লিখতে শেখায়নামতা পড়ায়। মাত্র পাঁচ টাকা করে পায়। এতে তার ত্রিশ টাকা উপার্জন হয়। তারপর আর কি করা যায়—সে সাইকেলে মাসির বাড়ি যাবার সময়, অথবা শহরে যদি যায়, চারপাশের লোকজন দেখে—কেউ বসে নেই। সে কোনোদিন ভাবে বড়ো রাস্তায় মোড়ের মাথায় চায়ের দোকান দিলে কেমন হয়। বিরজাসুন্দরীকে কথাটা বলতেই, কী চোপাচায়ের দোকান দিবি! কী বললি, তুই, মজুমদারের নাতনি চা-এর দোকান দিয়েছে! মান সম্মান তুই বুঝবি না। তোর মামারা জানতে পারলে আগুন জ্বলে যাবে। তাদের বাড়ির মেয়ে চায়ের দোকান দিয়েছে রাস্তায়! শেষে তুই আরও কি দোকান খুলে বসবি কে জানে।