দুদুমণির কার সঙ্গে কী কথা হয় বাড়ি ফিরে বলা চাই। শরাটা আবার পাগল হয়ে গেছে টুকি। বাড়ি থেকে পালিয়েছে—বিরাম বাজারে যাবার সময় বলে গেল, টুকুর কাছে যদি যায়, খবর দিতেন। সে তো কবেকার কথা। মাসখানেক হয়ে গেল। শরা দেশান্তরী হয়েছিল, ফিরে এসেছে তবে।
এদিকেই আসছে। বাড়ি ঢোকার রাস্তা থেকেই চিৎকার করছে, জয় টুকুদির। কতদিন তোমাকে দেখি না টুকুদি। থাকতে পারলাম না। ভাবলাম যাই দেখি, টুকুদির হাতের যশ দেখি। ওই যে তুমি কাঁথায় চন্দ্র সূর্য নামিয়ে আনবে বলেছিল, সেই বল কাল। চন্দ্র সূর্য নামাতে পারলে!
টুকুর সূচিশিল্পে যশ আছে। সুচসুতোর মধ্যে প্রাণের রস সঞ্চার না করতে পারলে এমন ছবি নাকি ফুটে ওঠে না। দু-দুবার তার হাতের কাজ প্রদর্শনীতে প্রাইজ পেয়েছে। নকশি কাঁথার বাজার আছে এমনও শুনেছে সে। কাঁথার ফুল ফল গাছের ছায়া আকাশ এবং চন্দ্র সূর্য নিয়ে পড়ে আছে শরার কথাতেই। কত খবর রাখে, তা ঘোরাঘুরি করলে খবর না রেখেই বা উপায় কী!
শরাই কলেজ একজিবিশনে প্রায় জোরদার করেই দুটো তার হাতের কাজ নিয়ে যায়। শরা জোরজার না করলে হত না। শরা এক সকালে এসে ডেকেছিল, টুকুদি আছ?
কে?
আমি শরা টুকুদি।
তুমি কোথার? ঘরের ভিতর টুকু ঝাঁট দিচ্ছিল। সে ঝাঁটা হাতে নিয়ে উঁকি দিলে বলেছিল, ও বাবা হাতে ঝাঁটা, ঝাঁটাপেটা করবে! কী দোষ করেছি!
তোর আজ কলেজ নেই।
কলেজেই যাচ্ছি। কলেজ কম্পাউন্ডে মেলা বসবে। বই-এর মেলা—সঙ্গে হস্তশিল্প। ভাবলাম টুকুদির কাছ থেকে দুটো হস্তশিল্প নিয়ে যাই—চোখ ধাঁধিয়ে দেই।
হয়েছে থাক। বোস।
সাইকেল থেকে নামাল না পর্যন্ত।
কই দেখি।
পাগলামি করবি না।
আচ্ছা তুমি কী টুকুদি! আমি তোমার সঙ্গে মিছে কথা বলতে পারি! ঘরে পড়ে থাকলে কে মর্ম বোঝে। দেখই না দিয়ে।
না কিছু হয়নি। তুই যা।
কেন ওই যে দুটা ময়ূর উড়ে যাচ্ছে, ওটা দাও। আর পাহাড় ঝরনা নদী আছে যেটায় ওটা দাও।
বোকার মতো কথা বলবি না তো! বাড়ি বসে থাকি, কিছু নিয়ে থাকতে হয়। দুদুমণির মতো তোরও দেখছি আমার সবকিছুতেই যশ খুঁজে পাস।
যশ না থাকলে কে কার প্রশংসা করে! দাও তো। আমার সময় নেই। মেলা কাজ। আমরা আর্টসের ছাত্ররা স্টল নিয়েছি আলাদা। ওখানে বাঁধিয়ে রাখব। লোকে আমার টুকুদির কাজ দেখে ভিড়মি খাবে—কী আনন্দ। দেরি কর না টুকুদি। ঝাঁটা ফেলে শিল্পটুকু দাও তোমার।
এরপর আর পারে!
নে নিয়ে যা। হারবি না কিন্তু। হারালে দুদুমণির চোপার চোটে ভূত পালাবে বলে দিলাম। যা মুখ!
বড়ো ছেলেমানুষী স্বভাব শরদিন্দুর। বয়সে তার বয়সিও না, বড়ই হবে, অথচ সেই ছেলেবেলা থেকেই টুকুদি টুকুদি করে। আর সে বামুনের নাতিন বলে হেয় জ্ঞান করার স্বভাব আছে তার। মাঝির বেটা কলেজে পড়ে এটাও হেয় জ্ঞানের কারণ হতে পারে। অথবা কিছুই হয়তো নয়, অভ্যাস, কেউ যদি দিদি দিদি করে আনন্দ পায় সে বাধা দেবার কে?
শরার এখন সাইকেলখানা কোথায় টুকু জানে না। এমন সুন্দর ছেলেটার মাথা খারাপ ভাবতেও খারাপ লাগে। না ভেবেও উপায় নেই, কলেজ কবেই ছেড়ে দিয়েছে। বই পড়ে, তবে ভারী ভারী বই। এই সব বইই নাকি তার মগজে ঘুণপোকা ঢুকিয়ে দিয়েছে। তার এক কথা, টুকুদি, এই মহাবিশ্বটি বড়ো আজব কারখানা। ভাবলে মাথা ঘোরায়। কত আজগুবি কথাও যে শরা বলে।
উঠোনে দাঁড়িয়েই শরা এদিক ওদিক চুপি দিল। কেউ নেই। গেল কোথায়! সে ফের ডাকল, গেলে কোথায় টুকুদি, তোমার জয় দিলাম। মুখখানাও দেখলাম বারান্দায়, তারপর কোথায় অদৃশ্য হয়ে আছ।
সে সাড়া দিল না।
দুদুমণি না খেয়ে না বলে কোথায় চলে গেছে, খারাপ লাগে না! সে যে গলার কাঁটা দুদুমণির তাও বোঝে। তাই বলে গন্ধর্ব কবচ, হয়! মানুষের বিবেক সাফ না থাকলে কিছু হয় না। বিবেক সাফ থাকলে কি শেষে শরা হয়ে যেতে হয়।
টুকুদি তোমার আবার জয় দিচ্ছি। একবার বের হও না। কতদিন পর এলাম, একবার ঝলমলে দেবী মুখখানা দেখি। আরে বাবা, গাছে তোমাদের কত আম। ওই গাছটা কথা বলতে পারে। গাছে রাশি রাশি আম ঝুলছে, কাঠবিড়ালি উঁকি দিয়ে আছে। কাক শালিখ উড়ে আসছে—তাজ্জব ব্যাপার, আর গ্রহপুঞ্জ ঘুরছে টুকুদি। একটা ফলের মতো ঝুলে আছে, ঘুরছে ঘুরছে। ছবিটা ভারি মজার না টুকুদি। চন্দ্রসূর্য নামল?
না বের হলে রক্ষা নেই। সারাক্ষণ উঠোনে দাঁড়িয়েই বকবক করবে।
বের হয়ে টুকু বলল, কবে ফিরলি? মন ভালো নেই, বকবক করিস না, বাড়ি যা।
চন্দ্র সূর্য নামল!
কাঁথার নকশাতে চন্দ্র সূর্য চায়—গাছপালা, ফল ফুল পাখি চায় শরা। খোঁজ নিতে এসেছে, কাঁথাখানায় কাজ শেষ, না বাকি আছে। সে দেখতে চায়। মন কেমন নরম হয়ে গেল টুকুর বলল, বোস।
বলে টুকু একখানা জলচৌকি এগিয়ে দিল।
ঠাইনদিকে দেখছি না।
কোথায় গ্যাছে। মুখে কিছু দিল না, ঘুম থেকে উঠে দেখি নেই। চা খাবি।
দাও। লিকার দেবে। দুধ দেবে না।
কোথায় ছিলি এতদিন।
কুরুক্ষেত্র গয়াগঙ্গা সব ঘুরে এলাম। পৃথিবীটা একটা মস্ত ব্যাপার, অতি ক্ষুদ্র অণু তবে এমনিতে কিছু বোঝা যায় না। ব্রহ্মাণ্ড বোঝ? ব্রহ্মাণ্ড রোজ লক্ষ কোটি আন্ডা দিচ্ছে জানো। কুম্ভীচক্রে ঘুরছে। কত লক্ষ কোটি বিশ্ব নিয়ে মহাবিশ্ব ভাবলে মাথা খারাপ।
মাথা খারাপের আর কাজ নেই। বাড়ি যা।