- বইয়ের নামঃ অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচিত গল্পসংগ্রহ
- লেখকের নামঃ অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচিত গল্পসংগ্রহ
অনাবৃতা
জতুর আজও ঘুম ভেঙে গেল। কোথাও থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ—কেউ কাঁদছে। মাথার দিকের জানালা খোলা। গন্ধরাজ লেবুর পাতা ডাল হাওয়ায় দুলছে। তার কেমন ভয় করছিল।
পাশের খাটে মা শুয়ে আছেন।
মা বোধহয় ঠিকই টের পান।
কী হল জতু? ঘুমিয়ে পড়। ও কিছু না।
কেমন ভূতুড়ে মনে হয়, মা কি বোঝেন, জতু ঠিক টের পেয়ে গেছে মধ্য রাতে কেউ কাঁদে। মা কি চান না, জতু জেগে থাক, বিছানায় উঠে বসুক, ভয়ের কী আছে, দুপুর রাতে কেউ কান্নাকাটি করলে কী করা! তোর না ঘুমানোর কী আছে বুঝি না। মা এমন ভাবতেই পারেন।
জতু তার মায়ের সঙ্গে পুবের ঘরে থাকে। বাবা প্রবাস থেকে এলে এই ঘরে থাকেন। জেঠিমা কাকিমাদের আলাদা ঘর। উঠোনের চার ভিটিতে চারটি আটচালা। দক্ষিণের ঘরে আত্মীয়-কুটুম এলে থাকেন। মাষ্টারমশাই আর নিমাইদা রাতে আত্মীয়-কুটুম না এলে ও ঘরটায় থাকে। উত্তরের ঘরে ঠাকুরমা ঠাকুরদা, বিশাল বাড়িতে এদিক ওদিক মেলা শরিক, গোয়ালবাড়ি, রান্নাবাড়ি-অন্দরে পুকুরও আছে একটা। বড়ো একটা তেঁতুলগাছ আছে ঘাটে। বৃষ্টি হলে ঘরবাড়ির জল গাছটার শেকড়বাকড় পার হয়ে পুকুরে গিয়ে নামে। কতকাল থেকে বর্ষায় এই জল নামছে জতু ঠিক জানে না। গাছটার শেকড়বাকড় আলগা, বর্ষার মাটি ধুয়ে নিলে শেকড়বাকড় আলগা হবারই কথা। এত বড়ো গাছ, আর তার কুমিরের মতে শেকড়বাকড় এলোমেলোভাবে জড়িয়ে আছে বলে, সকালে ঘাটে গেলে জতুর দাঁড়িয়ে থাকতে কিংবা বসে থাকতে অসুবিধা হয় না। গাছের শিকড়বাকড়ে উঠে বসে থাকে। বউটি জলে নামে, সে দেখে। জলে ডুব দেয় সে দেখে। সে না বললে বউটি জল থেকেও উঠে আসতে পারে না।
কেন যে মা সকালেই তাকে ডেকে দেন, ও জতু ওঠ। কমলবউ উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। ওঠ বাবা। সঙ্গে যা। তুই না গেলে পুকুরে ডুব দিয়েও শান্তি পাবে না।
জতুর উঠতে ইচ্ছে হয় না। মাঝরাতের চাপা কান্নার তার মগজ গরম হরে থাকে। শীতল হতে সময় নেয়। ভোররাতের দিকেই প্রগাঢ় ঘুম চোখে। মা ডাকাডাকি করলে, চোখ মেলতে তার কিছুতেই ইচ্ছে হয় না।
সে এক রাতে ঘুম থেকে উঠে বসেছিল।
কেউ কাঁদছে ফুঁপিয়ে।
সে বলেছিল, মা তুমি কিছু শুনতে পাও না।
কী শুনতে পাব?
বারে, শুনতে পাচ্ছ না?
মা কেমন অস্বস্তিতে পড়ে যান। খাট থেকে নেমে মাথার জানলা বন্ধ করে দেন। মাথার জানলা বন্ধ করে দিলে হাওয়া ঢোকে না। গরমে খুব কষ্ট হয় জতুর। ঘরে হ্যারিকেন জ্বলে। মা যে কেন জানলাটা বন্ধ করে দিলেন। সে হাঁসফাঁস করতে থাকে। তবে জানলা বন্ধ করে দিলে চাপা কান্নার আওয়াজ থাকে না। অবশ্য গাছে একটা প্যাঁচা ডাকছিল। রান্নাবাড়ির দিকটায় প্যাঁচাটা থাকে। জামগাছের মাথায় এক জোড়া প্যাঁচা কবে থেকেই আছে।
আরও শব্দমালা সে শুনতে পায়। কীটপতঙ্গের আওয়াজ তো আছেই। রাতে পাখিরা বিল থেকে উড়ে যায়—তার পাখার শব্দ এবং ভরা বর্ষার সময় বলে চারপাশের জলমগ্ন জায়গায় শাপলা শালুকের সবুজ পাতায় টিট্রিভ পাখিদের বিচরণ—তার কলরবও কানে আসে। বাড়ির দক্ষিণে সদর পুকুর, চারপাশে চালতাগাছের ছায়া। দুটো খেজুরগাছ এবং ছোটো বিশাল শিমূল গাছও আছে। বাড়ির পিছনে মোত্রাঘাসের জঙ্গল। ডাহুক পাখিরাও গভীর রাতে মারামারি শুরু করে দিলে কোলাহল ওঠে। বর্ষায় জলে জঙ্গলে দেশটা ভেসে থাকে।
মা বললেন, তুই শুয়ে পড় জতু। বসে থাকলি কেন? গরম লাগছে। জানলাটা খুলে দি। তুমি জানলা বন্ধ করলে কেন?
জতু তুই বড়ো জ্বালাস!
জতু মার জন্য অপেক্ষা না করে, নিজেই জানলাটা খুলে দিল। কান্না আর শোনা যাচ্ছে না। পাশের বাড়িটা যতীন দাসের। দেখতে কদাকার মানুষটি কুশঘাটে শাড়ি বিক্রি করতে যায়। ঘরে দুটো তাঁত, দুজন তাঁতি, সকাল বিকাল চরকার ববিনে সুতো পরানো হয়, তানা। হয়, মাকুর খটাখট শব্দে কান পাতা যায় না। কমলবউ নিজেও তাঁত বুনতে পারে। মিষ্টি সুন্দর মতো বউটাকে যতীন দাস গেল বছর বিয়ে করে এনেছে। আগের পক্ষের বউটি আত্মহত্যা করায় যতীন দাসের বিয়ে না করেও উপায় ছিল না।
নে শুয়ে পড় জতু।
জতু জানে শুয়ে পড়লেই তার ঘুম আসবে না। ঘুম এলেও মা-ই আবার তাকে জাগিয়ে দেবেন ওঠ জতু। যা উঠোনে কমলবউ দাঁড়িয়ে আছে।
এত সকালে সে না উঠলে কমলবউ উঠোন থেকে নড়বে না। মাকে জ্বালাবে। পাড়াপড়শিরা জেগে যাবার আগে পুকুরঘাটে তার সঙ্গে যেতে হবে।
রোজ কাঁহাতক ভালো লাগে। তার উঠতে ইচ্ছে হয় না। কিন্তু বউটি যে তার প্রায় সমবয়সি, সমবয়সি না হোক, কিছু বড়ো হলেও ক্ষতি নেই। জতু ক্লাস এইটে পড়ে। তার দাদারা কলেজে পড়ে। তিন ক্রোশ সাইকেল চালিয়ে দাদারা কলেজ যায়। দত্তদের বাড়ি বললে এ-অঞ্চলে সবাই এক ডাকে চেনে। তার জ্যাঠামশাই ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। বাড়ির বাইরে একটা নীল রঙের ডাকবাক্সও আছে।
তাছাড়া বাড়িটা তাদের খুবই ছিমছাম। দক্ষিণের ঘর পার হলেই বাইরের উঠোন, বিকেলে সেও দাদাদের সঙ্গে নেট টানিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলে। জ্যাঠামশাই ঘোড়ায় চড়ে তখন রোগীর বাড়ি থেকে ফেরেন। জ্যাঠামশায়ের ডিসপেনসারি ঘরের মেঝে শান বাঁধানো। বড়ো বড়ো বয়েম। উদখল আরও বড়ো। নিমাইদা এ-বাড়িতে এসেছে কবিরাজি শিখতে। দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ায় বন্যার জলের মতো রিফুজিতে ভেসে যাচ্ছে দেশটা। কমলবউ রিফুজি মেয়ে সে জানে। ভালো নাম কমললতা। নাকে নথ করিয়ে দিয়েই যতীন দাস তাকে বাড়িতে তুলে এনেছে।