দুটি কুকুর রাস্তার কিনারে কুণ্ডলী পাকিয়ে। আর একটা বস্তির ভিতর থেকে ছুটে আসছে আর পিছনে বছর দশেকের একটি মেয়ে বাখারি হাতে তাকে তাড়া করছে। কুকুরটা রাস্তায় বেরিয়ে মাঠের দিকে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে দাঁড়াল। মেয়েটি ব্যর্থ হয়ে, রাগ প্রকাশ করল ঘুমন্ত দুটির উপর। বাখারির আচমকা আঘাতে কিউ শব্দ করে ধড়মড়িয়ে উঠে তারাও মাঠের দিকে সরে গিয়ে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, আক্রমণকারীর চলে যাওয়ার অপেক্ষায়।
আশ্চর্য! সত্যেন ভাবল, দিনের বেলায় কুকুরগুলো এমন নিরীহ ভীতু আর রাত্তিরে এরাই কিনা অন্য চেহারা নেয়। মেয়েটিকে অনুসরণ করে তার চোখ গিয়ে পড়ল দূরে পাঠশালার রকে। একটি কালো কুকুর সামনের দুই পা ছড়িয়ে কাত হয়ে শুয়ে। দুই পায়ের মধ্যে মুখটা মেঝেয় রাখা। কান দুটি খাড়া। চোখ খোলা না বন্ধ দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না। বাবুলের বর্ণনা মতোই ঘোর-কালো এবং দুই জাতে ব্রাউন স্পট। দেখলে মনে হয় রেগে রয়েছে। সত্যেন কুকুরের জাতপাত বোঝে না, তবে মুখের গড়ন, কান আর মসৃণ গা দেখে তার মনে হল দোআঁশলা। নিছকই নেড়ি নয়।
এই তাহলে সেই পালের গোদা, সুপ্রভাকথিত শয়তান যে চার জনের পায়ের মাংস তুলেছে। বস্তির লোকেরা একে কালুয়া নামে ডাকে। কালুয়ার থেকে হাত ছয়েক দূরে কালোয়-সাদায় মেশানো আর একটি লম্বা হয়ে ঘুমোচ্ছে। পেটটা ঝুলে রয়েছে এবং স্তনের সারি। দূর থেকেই বোঝা যায়, বাচ্চা হবে। ওই শয়তান ব্যাটারই কাজ। সত্যেন নিশ্চিত এ সম্পর্কে। মদ্দা আর তো চোখে পড়ছে না।
এবার সে পাঠশালার কাছাকাছি এবং ইচ্ছে করেই মন্থর হল। মেয়েটি রকে বসল এবং কালুয়ার মাথায় একটা থাপ্পড় মারল। কালুয়া মেঝেয় গড়িয়ে টানটান হয়ে আড়মোড়া ভাঙল। মেয়েটি আবার মারার জন্য হাত তুলেছে, কালুয়াও দু-পা তুলে হাতটা ধরার চেষ্টা করল, আদুরে ভঙ্গিতে।
এইসব দেখতে দেখতে সে পাঠশালা ছাড়িয়ে মাঠে উঠে বাস স্টপের দিকে এগিয়ে গেল। অফিসে কয়েক জনকে সে গত রাত্রে কুকুরের কামড় থেকে ছেলের বেঁচে যাওয়ার কথা বলল। তাইতে অনেকেই নানাবিধ মন্তব্য করল। বস্তির ভোট, কর্পোরেশন ইলেকশন থেকে শুরু করে কুকুর পোষার উপকারিতা, দিশি ও বিলিতি কুকুরের মধ্যে স্বভাবের পার্থক্য, রাস্তায় প্রকাশ্যে তাদের যৌনবিহারের ফলে কতরকম অসুবিধার সামনে পড়তে হয় ইত্যাকার কথাবার্তা অবশেষে পৌঁছোল কুকুরের সঙ্গে মানুষের যৌন তাড়নার তুলনামূলক বাদানুবাদে।
কুকুর জানোয়ার হতে পারে, কিন্তু মানুষের মতো বছরে তিনশো পঁয়ষট্টি দিনই গরম হয়। ওদের সিজন আছে, শুধু সিজনেই মেট করে। আর আমরা, মানুষরা? এক যুবক বাঁকা স্বরে কথাটা বলে জামার গলা ঢিলে করে পাখার নীচে বসল। মাস ছয়েক তার বিয়ে হয়েছে।
এ বিষয়ে বউমা কী বলেন, সেটা না জানা পর্যন্ত আর এসব কথা নয়। কাজে ব্যস্ত হওয়ার ভান করে এক মাঝবয়সি আলোচনা বন্ধ করে দিলেন।
কিছুক্ষণ পর মোহিত এসে সত্যেনের কাছে দাঁড়াল। পঁচিশ বছর বেয়ারার কাজ করছে। নম্র, বিনীত, অল্পকথার মানুষ। অল্পবয়সি কেরানিরা ওকে মোহিতদা বলে ডাকে।
বিষ দিয়ে কুকুর মারুন। দু-চারটে মরলেই দেখবেন ঠাণ্ডা, আর কামড়াতে আসবে না। আমার পাড়াতেও কুকুরের উৎপাত ছিল, এখন একদম নেই।
তুমি মেরে দিলে?
হ্যাঁ, একসঙ্গে তিনটে।
বিষ পাব কোথায়?
আমার শালা ওষুধের ল্যাবরেটরিতে কাজ করে। ওখানকার এক কেমিস্ট তৈরি করে ওকে দিয়েছিল। বললে এনে দিতে পারে।
কী করে বিষ খাওয়াব?
কেন, কিছু-একটা খাবারের মধ্যে, সন্দেশ বা কেক বা পাঁউরুটির মধ্যে পুরে ছুড়ে দেবেন। কপাৎ করে খেয়ে নেবে।
তক্ষুনি মরে যাবে?
না না, তক্ষুনি কি মরে! সকালে দেখবেন মরে পড়ে আছে।
এনে দাও তো আমায়। পয়সা লাগবে?
সে সামান্য দু-পাঁচ টাকা। তবে খুব সাবধান, পাড়ার লোক যেন না জানতে পারে আর নিজেও সাবধান, হাতেটাতে লাগলে তক্ষুনি সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলবেন। এতে মানুষও কিন্তু মরে।
মোহিত চলে যাবার পরই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে সত্যেন ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠল। তাহলে এবার শয়তানটাকে শায়েস্তা করার মোক্ষম জিনিস সে পেয়েছে। আর কোনোদিন ওখানকার মানুষ আতঙ্কে চলাফেরা করবে না। বাবুলকে যদি কামড়াতই তা হলে কী অবস্থা ওর হত? যন্ত্রণাকর চোদ্দোটা ইঞ্জেকশন। জলাতঙ্কও হতে পারে, মারাও যেতে পারে। অথচ সে কিছুই করেনি, রাস্তা দিয়ে শুধু হেঁটে যাচ্ছিল। এজন্য চড়াও হয়ে কামড়ে মাংস ছিঁড়ে নেওয়া?… সত্যেন দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিল, বিষ খাইয়ে শয়তানটাকে মারাই উচিত।
অফিস থেকে ফেরার সময় সে একটি ছাড়া কোনো কুকুরই দেখতে পেল না। বস্তির কিছু মেয়ে-পুরুষ রাস্তার ধারে বসে কথা বলছে। বাতির নীচে হাঁড়ি নিয়ে বসে এক ঘুগনিওয়ালা। রাস্তায় এখন লোক চলাচল খুবই কম। রাত আটটার পর একদমই লোক চলে না, কেননা লোকালয় ক্রমশই পাতলা হয়ে গেছে দু-তিনটি হাউজিংয়ের পরই। ট্যাক্সি বা স্কুটার হয়তো কচিৎ দেখা যায়।
কালুয়াকে দেখতে না পেয়ে সত্যেনের কিছুটা আশাভঙ্গ হল এবং সেজন্য রেগেও উঠল। শয়তানটা গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছে। ওর চালাকি ভাঙব… দেখব কেমন করে বাঁচে। হঠাই, একটা চ্যালেঞ্জের মতো ব্যাপার হিসাবে এটাকে মনে করে সে উত্তেজিত হয়ে উঠল।
দূর থেকে দুটি কুকুরকে দুলকি চালে আসতে দেখে সত্যেন থমকে গেল। বস্তির লোকেরা তার কাছাকাছিই। ভয় কাটিয়ে পায়ে পায়ে সে এগোল। কালুয়া আর সেই পেট-ঝোলা মাদিটা। ওরা তার পাশ দিয়েই চলে গেল। সত্যেনের মনে হল, শয়তানটা এক বার যেন তার দিতে তাকাল। শিরশির করা শিরদাঁড়াটা সোজা রেখে সে বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছোল।