- বইয়ের নামঃ মতি নন্দী উপন্যাস সমগ্র ৩য় খণ্ড
- লেখকের নামঃ মতি নন্দী
- প্রকাশনাঃ দীপ প্রকাশন (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০. ভালো লেখা, না তার ভান?
ষোল বছর আগে (১৯৭৮ সালে) ষাটের দশকে উঠে আসা বাইশজন লেখকের প্রতিনিধিত্বমূলক গল্প সংকলন গ্রন্থের আলোচনা করেছিলাম একটি লিটল ম্যাগাজিনে। ওই সংকলনের অন্তর্ভুক্ত একজন লেখেন, তিনি ‘বিশ্বাস করেন পূর্বসূরি লেখকদের সঙ্গে ষাটের দশকের লেখকদের কোনোরকম বিষয় ও বোধগত মিল নেই।’
তখন আমি লিখেছিলাম কুড়ি বছর আগে (অর্থাৎ ১৯৫৭ নাগাদ, যে সময় থেকে আমি লেখা শুরু করি) বাংলা গল্পে যে বিষয় ও বোধসমূহ প্রকাশিত হয়েছে এই সংকলনের গল্পগুলিতে প্রায় সেই জিনিসই পাচ্ছি। লিখেছিলাম : ‘জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী বা বিমল করকে সরিয়ে রেখেই বলা যায়, দীপেন, সন্দীপন, দেবেশ, দিব্যেন্দু, সুনীল বা শ্যামল এমনকি তখনকার শীর্ষেন্দুও যে বিষয় ও বোধ নিয়ে গল্প লিখেছিল, তার থেকে ষাটের দশকের লেখকরা নতুন কোনো জমিতে পা দেননি, শুধুমাত্র চেহারার আদলে কিছু রকমফের হওয়া ছাড়া। নতুন সংজ্ঞা, ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধির নতুন প্রণালী বা রূপকের নতুন বিস্তার যে বাস্তবতার জমি থেকে উৎপন্ন হয় তা ‘পূর্বসূরিদের’ আমল থেকে এমন কিছু বদলায়নি যাতে ‘কোনোরকম’ শব্দটি গ্রাহ্য হতে পারে। ইতিহাসের যে চাপ গত দশ বছর (১৯৬৭—৭৭) এই রাজ্যটি সহ্য করেছে তার থেকেও শ্বাসরোধকারী উত্তপ্ত, দিশাহারা করে দেওয়ার মতো চাপ চল্লিশের দশকে সহ্য করেছে এই বাংলা। উপরিভাগে কিছু রূপান্তর ঘটলেও ষাটের দশকে যা প্রবাহিত হয়ে এসেছিল তা চল্লিশেরই জোয়ার থেকে। আমাদের সামাজিক বনিয়াদে মৌল কোনো রূপান্তর ঘটেনি। যেসব বহিঃশক্তির সমাবেশের প্রভাবে আমাদের জগৎকে ঘিরে বাস্তবতা ও ভাবাবেগ তৈরি হয় তাতে এমন কোনো বিস্ফোরণ ঘটেনি যাতে পূর্বসূরি ও ষাটের দশক, এই দুই আমলের মানসিকতার মধ্যে ফাটল ধরিয়েছে মনে করতে হবে। এখন ভারতে শতকরা ৮০ জন দিনযাপন করেন ভূমির ওপর নির্ভর করে। পূর্বসূরি লেখকদের মতো ষাটের দশকের এঁরাও কৃষিপ্রধান সামাজিক আবহাওয়াতেই লালিত। ঔপনিবেশিক মানসিকতার জের এখনও টেনে চলেছে এই সমাজ। এই সমাজের শৃঙ্খলারক্ষার প্রধান খুঁটি হলো ধর্ম ও বুর্জোয়া নীতিবোধ। ভবিতব্যে নির্ভরশীলতা, অনুসন্ধিৎসায় অনিচ্ছা, প্রথানুসরণের ইচ্ছা, অ্যাডভেঞ্চারে স্বতঃস্ফূর্ত তাগিদের অভাব এবং নির্লিপ্ত অর্থাৎ স্থাণু ও জড়চেতনার অনুকূল প্রতিটি উপাদান আমাদের ব্যক্তি ও সমাজজীবনে অটুট হয়ে রয়েছে। কংগ্রেসের বা নেহরুদের বিকল্প কিছুর চিন্তা সত্তর দশকের অর্ধেক অতিক্রান্ত হওয়ার পর তবেই আমাদের মাথায় এসেছে। শরৎচন্দ্র, যাত্রাপালা বা ক্রিকেট টেস্ট ম্যাচ প্রভৃতি কৃষিনির্ভর আবহাওয়ায় যে সব ব্যাপারের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ এখনও তা আমাদের উৎসবের কারণ।’
লেখাটির ষোল বছর পর উপরোক্ত পর্যবেক্ষণ থেকে এখনও আমি এক পা—ও পিছিয়ে আসতে রাজি নই। পশ্চিমবাংলার সমাজ—বাস্তব পঁয়ত্রিশ বছর আগে যেখানে ছিল এখন অবশ্য আর সেখানে নেই। এখন তার সঙ্গে বর্ধিত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলির পৃষ্ঠপোষকতা— স্থূল অনুভূতি, আগ্রাসী পেশিশক্তি, কাপট্য, ভান, নির্বুদ্ধিতা আর অন্ধ আক্রোশ। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে— ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান ও বিস্তার, জ্যোতিষীদের আংটি ও মাদুলির ফলাও কারবার, লটারির পুরস্কার মূল্য কোটি টাকায় পৌঁছে যাওয়া, সংবাদপত্রে প্রতিদিনের রাশিফল নামক ধাপ্পা আর বিনা পরিশ্রমে হাতিয়ে নেওয়ার জন্য সুযোগের ও উৎকোচের অন্বেষণ। এই সবই ইঙ্গিত দেয়, পশ্চিমবাংলা নিজেকে সঁপে দিয়েছে ভবিতব্যের হাতে, সে হারিয়েছে আত্মবিশ্বাস, কাজের ও চিন্তার ক্ষমতা। তার বদলে অর্জন করেছে ভীরুতা, আত্মপ্রবঞ্চনা, হতাশা আর আতঙ্কে দিনযাপনের গ্লানি। টেনেটুনে কোনোক্রমে নিজেকে টিকিয়ে রেখে জীবনযাপনের জন্য একটু জায়গা করে নেওয়ার অভ্যাসে এই রাজ্যের সাধারণ মানুষ রপ্ত হয়ে গেছে। দশ বছর আগেও বাসে যে আসনে পাঁচজনে বসতো এখন তাতে বসছে ছজন, লোকাল ট্রেনে তিনজনের আসনে বসছে চারজন। পশ্চিমবঙ্গ আত্মমর্যাদাবোধ তো হারিয়েছেই, ন্যায্য সুস্থতার জন্য দাবি জানাতেও ভয় পায়।
এমন অবস্থায় বাস্তব সচেতন গল্প, উপন্যাস, কবিতার লিখিয়েরা কী করতে পারেন? তা হলে একটা কথা সোজাসুজি প্রথমেই বলে নিই, গল্প বা কোনো কিছু লিখে দেশের বা দশের উন্নয়ন ঘটানো যায় না। পৃথিবীতে এমন ব্যাপার কোথাও ঘটেছে বলে জানি না। বহু বছর ধরে বহু লেখক বহু ভাবে গরিব সর্বহারাদের দুঃখ, বেদনা, প্রতিরোধ ও সংগ্রামের কাহিনি লিখেছেন, তাতে সর্বহারাদের বৈষয়িক ও আত্মিক দুর্দশা এক কাচ্চচাও লাঘব হয়নি। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাংলার তথাকথিত ‘প্রগতি’ সাহিত্য। গরিবদের কাহিনি যাঁদের নিয়ে লেখা হয়েছে এবং হচ্ছে তাঁরা কেউ সে সব কাহিনি পড়েননি এবং পড়ছেন না। তার কারণটা বুঝে নেওয়া খুব জটিল নয়। যাঁদের জন্য এই সব লেখা হয়েছে বা হচ্ছে তাঁরা একদমই পড়তে—লিখতে জানেন না। পড়েন শুধু টেবিল—চেয়ারে বসে কাজ করা কিছু লোক। এঁরা প্রধানতই শহুরে এবং মধ্যবিত্ত। ‘শিক্ষিত’ নামক জনসমষ্টির বিরাট একটা অংশ সাহিত্য পাঠের ধারই ধারেন না।
লেখক এই সব তথ্য জানেন এবং এটাও জানেন এঁরা তাঁর লেখাকে ভালো হয়েছে বললে তিনি প্রতিষ্ঠা অর্জনে সুবিধা পাবেন। তাই গরিব সর্বহারাদের নিয়ে গল্প লেখার সময় তাঁর মনে ভেসে থাকে এক মধ্যবিত্ত পাঠকের চেহারা যিনি সাহিত্য রসাস্বাদনে পটু, বোদ্ধা, হয়তো বা আলোচনা—প্রবন্ধও লিখে থাকেন। লেখক এই শিক্ষিত পাঠকের বোধ ও বুদ্ধির কাছে নিবেদন করেন তাঁর লেখাটিকে। তাঁর গল্পের মানুষরা যদিও দিনমজুর, ছোটচাষি, ভিক্ষুক, বেশ্যা, উপজাতি, বাচ্চচা শ্রমজীবী ইত্যাদি। লেখক কিন্তু কোনোদিনই এঁদের মতো জীবনযাপন করেননি, এঁদের সমস্যার ও ভাবনার ধারে কাছেও তিনি যেতে পারেন না এবং তিনি এঁদের ব্যক্তিমানুষ হিসেবে ততটা দেখেন না যতটা দেখেন সামাজিক শ্রেণি হিসাবে। একটি প্রগতিশীল পত্রিকায় গত দশ বছরের গল্পকারদের নিয়ে একটি সমীক্ষা—প্রবন্ধে দেখলাম বলা হয়েছে, ‘এখানেই পূর্ববর্তী সময়ের গল্প থেকে এই সময়ের এ জাতীয় গল্পের মূল পার্থক্য।’ প্রবন্ধকারের মতে, গল্পকারদের দৃষ্টি সর্বহারাদের ওপর গিয়ে পড়েছে হয়তো বা নকশালবাড়ি আন্দোলনের ঝাঁকুনির ফলে।
আমাদের বাস্তবতাকে বিভিন্ন আমলের লেখকরা নানা ভঙ্গির চাহনি মেলে পর্যবেক্ষণ করতে চেয়েছেন। এই চাহনি বা রচনার কাজ করতেই লেখক নিজেকে সংস্কার করেন। সমাজবাস্তবতার বাইরের গড়ন আর তার ভিতরের টানাপোড়েন অর্থাৎ কোনটি প্রকৃত আর কোনটি প্রতিবিম্ব এটা চিনে নিয়ে আলাদা করা বেশ জটিল ব্যাপার। এই টানাপোড়েন, ঘাতপ্রতিঘাত থেকে তৈরি হয় লেখকের অনুভূতি। কিন্তু বাস্তবের মৌল শক্তিগুলির কি কোনো বদল এখন পর্যন্ত ঘটেছে? নকশাল আন্দোলন দেশের ও দেশের মানুষ সম্পর্কে অভিজ্ঞতার অভাব থেকে তৈরি ভঙ্গিসর্বস্ব এমন এক বিপ্লবীয়ানা, যা তৈরি করতে পারেনি নতুন কোনো বিপ্লবী পথ, গড়ে তুলতে পারেনি আদর্শের জন্য রাজনীতি করার উন্নত কোনো নৈতিকতা। এই আন্দোলন যেভাবে দপ করে উঠেই নিভে গেল, যেভাবে টুকরো গোষ্ঠীতে পরিণত হলো, সর্বোপরি এর নেতাদের মধ্যেই যেভাবে হতাশা ও অবসাদের ছাপ ফুটে উঠতে লাগল, তাই থেকেই বোঝা যায় শুধু এর বহির্বাস্তবতাকে অবলম্বন করে গল্প লিখলে তার পরিণতি ওই আন্দোলনের মতই ব্যর্থ হবে। এই আন্দোলনের ঝাঁকুনি থেকে উৎপন্ন গল্পগুলির কিছু কিছু পাঠকদের তারিফ অর্জন করেছে কিন্তু সেটা মূলতই সমাজের ও রাষ্ট্রের দৃশ্যমান বিশৃঙ্খলাটুকু লেখায় প্রতিফলিত হওয়ার জন্য। ৫৬ বছর আগে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রঙ্গপুর সাহিত্য সম্মেলনে তাঁর ভাষণে বলেছেন : ‘সাহিত্যিক বাস্তব জগতের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে তার চিত্র আঁকবেন কিন্তু তাঁর অন্তর্দৃষ্টি যথেষ্ট পরিষ্কার হলে তিনি দেখবেন যে বাইরের জগতে যা ঘটে তার চেয়ে লেখকের মনের জগতে আর এক মহত্তর ব্যঞ্জনাময় বাস্তব আছে।’
মনের জগতের বাস্তবটিকে আবিষ্কারে আমাদের প্রগতিশীল লেখকরা খুব বেশি সফল হতে পারেননি। না পারার একটি বড় কারণ, মানুষকে সামাজিক শ্রেণির প্রতিভূরূপে দেখার তত্ত্ব মেনে লিখতে গিয়ে একটা ছাঁচের মধ্যে ঢুকে যাওয়া। স্বাধীনতা লাভের আগে সারা দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে রাষ্ট্রীয় পরাধীনতা ঘোচাবার জন্য একটা একমুখী কর্মিষ্ঠ সদর্থক সমাজচেতনা গড়ে উঠেছিল। ‘মহত্তর ব্যঞ্জনায়’ ভূষিত মানবিক মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা তখন তৈরি হয়ে ওঠে, ফলে এক ধরনের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা সমাজে দানা বাঁধে। এরই সঙ্গে যোগসূত্র রচিত হয়েছিল বহিঃস্তরের আন্দোলনের আর বাঙালি সাহিত্যিকদের কাছে সেইজন্য অন্তর্দৃষ্টিকে সাহায্য করতে সেটাই নোঙরের কাজ করে। ব্যক্তিমানুষকে সদর্থক সামাজিক পটভূমিতে রাখার সুযোগ তখন ছিল। সেই আমলের বহু লেখকের গল্প উপন্যাস আজও পাঠকদের আনন্দ দেয়।
মানুষের অভিজ্ঞতা বিষয়ে যে কোনো ধরনের সত্যে পৌঁছতে হলে শেষ পর্যন্ত শৃঙ্খলার দিকে আসতেই হবে। কিন্তু শৃঙ্খলা সম্পর্কে বিশেষ কোনো ধারণা আঁকড়ে বসে থাকা যায় না। এটা স্থাণু নয়, এটা বদলায়। যেমন বদলায় বিশৃঙ্খলার ধরন। বিশৃঙ্খলার ততটাই বরদাস্ত করি যতটা আমাদের বর্তমান মূল্যবোধগুলির সঙ্গে মানিয়ে যাচ্ছে। মানুষের প্রকৃতি এমনই, নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি বিশৃঙ্খলা সইতে পারে না। পরিমাণটা সহনীয় করতে তখন কল্পনার সাহায্য নেওয়া হয়। কল্পনা তখন শৃঙ্খলা সম্পর্কে মায়াবী পরিমণ্ডল তৈরি করে দেয়। এই পরিমণ্ডলই অন্যতর কোনো উপলব্ধির জন্য পাঠককে উত্তেজিত করায়। কিন্তু যে কল্পনার সাহায্য লেখকরা নেবেন তা কীসের উদ্দেশে ধাওয়া করবে, সেই লক্ষ্যটা স্থির করার জন্য চাই মানুষ ও সমাজ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা। গত দশ পনেরো বছরের মধ্যে যাঁরা গল্প লিখতে এসেছেন তাঁরা বিশৃঙ্খলার বহিঃস্তরের কিছুটা অল্প পরিসরের মধ্যে দেখতে পেয়েছেন। এটা কিন্তু সমগ্র বাস্তব নয়। পাঠককে অন্য কোনো উপলব্ধিতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য শুধু ‘অন্তর্দৃষ্টি’ই যথেষ্ট নয়, তাদের কল্পনার বহনযোগ্যতার ক্ষমতাও থাকা চাই। এই দুটি ব্যাপারেই এখন বিরাট ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এই ঘাটতি পূরণ কোনো তত্ত্ব দ্বারা সম্ভব নয়। সম্প্রতি এক বিদগ্ধ গ্রন্থসমালোচক আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে বাংলা কথাসাহিত্যে যথার্থ শিল্পীর সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে। এটা যদি বাংলা সাহিত্যের পক্ষে এবং বাংলা সাহিত্যের প্রাপ্তমনস্ক পাঠকের পক্ষে আক্ষেপের কথা হয়, তবে এর চেয়েও আক্ষেপের কথা, এই ঘটনাটি সম্বন্ধে আমরা যথেষ্ট মনোযোগী হতে পারছি না, অথবা এর প্রতি আমরা এক দায়িত্বজ্ঞানহীন ঔদাসীন্য দেখাচ্ছি।’ তিনি বলছেন, ‘মনে রাখবার মতো ছোট গল্পের সংখ্যা যে ভীষণভাবে হ্রাস পেয়েছে, এটাও আমাদের আর যথেষ্ট দুঃখ দিতে পারে না।’
সামাজিক চেতনায় গত কুড়ি বছরে যদি কিছু বদল হয়ে থাকে তা হলে সেটা ওই ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন ঔদাসীন্য’টার বেড়ে যাওয়া। সোমনাথ হোর বলছেন : ‘পঞ্চাশের মন্বন্তরের যে ক্ষত, যুদ্ধের যে অমানবিকতা, ছেচল্লিশের দাঙ্গার বীভৎসতা—এগুলি আমার আঁকার পদ্ধতিতে খোদিত হয়ে যাচ্ছিল, আমার অজানিতে।… দুর্ভিক্ষের ছবির যে খড়ি হাতের আঙুল পেরিয়ে হৃদয়ে যে দাগ কেটেছিল, তার দাগ আর মিলাল না।’ জীবনকে ভালোবাসলে, অন্তর্দৃষ্টির গভীরতা থাকলে হৃদয়ে দাগ কেটে যাওয়া দাগ সৎ ও খাঁটি শিল্পী কখনও মিলিয়ে যেতে দিতে পারেন না। উনি চল্লিশের দশকের পোড় খাওয়া মানুষ। দাগটা রেখে দেওয়ার দায় উনি বহন করে চলেছেন।
তারপরও অনেক দশক এসেছে ও চলে গেছে কিন্তু হৃদয়ে দাগ কেটে দেওয়ার মতো কোনো মন্বন্তর, কোনো যুদ্ধ বা কোনো বীভৎস দাঙ্গা, এমনকি ছিন্নমূল মানুষের বন্যা পশ্চিমবঙ্গ আর দেখেনি। গত চার দশক ধরে ক্রমান্বয়ে অপহৃত হয়ে চলেছে মানবিক মূল্যবোধগুলি, সমাজ চেতনায় ছড়িয়ে গেছে টেনশন, গা—ছাড়া হয়ে পড়েছে ব্যক্তির সঙ্গে তার জগতের সম্পর্ক। মানুষ পড়েছে অবিশ্বাসের শূন্যতার মধ্যে। আধুনিক সময়ের এই আঁচড়গুলো পড়ছে যে সমাজদেহের অঙ্গে সেটা কিন্তু রয়ে গেল চারদশক আগের। এই বাইরের আর ভিতরের মধ্যেকার আমলকে তারা সনাক্ত করতে চাইল। এই দুইয়ের সঙ্ঘাত থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎকে ভাষার মাধ্যমে গল্পে সঞ্চার করার জন্য মাঝে মাঝেই ঝাঁক বেঁধে আন্দোলনে নেমেছেন তরুণরা। সাহিত্যে বাসি হয়ে যাওয়া প্রথাগুলিকে ভেঙে নতুন চেতনার বাস্তবতায় তাঁরা বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন চমকপ্রদভাবে আধুনিক হওয়ার জন্য, বাস্তবকে মুচড়ে মনোমতো করে বানিয়ে, যুক্তির মাত্রা কমিয়ে চমকদার বাক্য সাজিয়ে যাওয়া ছাড়া কিন্তু তাদের কাছ থেকে আর কিছুই পাওয়া গেল না। আধুনিকপন্থীদের হামলার প্রধান লক্ষ্য হয় বুর্জোয়া সমাজ ও মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ। সবেগে ঝাঁপিয়ে পড়তে হলে প্রথমে একটু পিছিয়ে আসতে হয়। তাই করতে গিয়ে সমাজ—বাস্তবতা থেকে আন্দোলনকারীদের কখন যেন বিযুক্তি ঘটে যায়। আধুনিক রূপে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর তাঁরা বুর্জোয়া বিরোধিতার একই কথার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে থাকেন, তবে একটু অন্য গলায়। সাহিত্য থমকে থাকে একই জায়গায়। তখন আমরা বলি, মনে রাখবার মতো গল্প আর পাচ্ছি না। যশস্বী হওয়ার আগে বাঙালি লেখকরা যে পরিমাণ যত্ন ও পরিশ্রম লেখার জন্য দেন, দুঃখের কথা, পরে আর তা দেন না। আরও দুঃখের কথা, বহু নামী লেখকের দুর্বল রচনা সম্পাদকেরা ছাপিয়ে চলেছেন, যে রকম রচনা কোনো অনামী লেখক লিখলে অবশ্যই অমনোনীত হত। এবং আরও দুঃখের কথা, পাঠকরা দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে সত্যিই উদাসীন।
মতি নন্দী
২৩.১.৯৪
ভালো ছেলে
এক
অনন্তের ক্লাস নাইনের এবং অমরের ক্লাস এইটের এগারো দিন পর অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় বাসে উঠতে গিয়ে শক্তিপদ পিছলে চাকার তলায় চলে যায়। মৃত্যু সঙ্গে সঙ্গেই ঘটে। হাতে ছিল তাঁর দু—ছেলে অনন্ত আর অমরের জন্য দু—জোড়া চটির বাক্স।
‘যদি ও—দুটো হাতে না থাকত তা হলে শক্তিদা হ্যান্ডেলটা ভালো করে ধরতে পারতেন।’
মাস ছয়েক পর এক সন্ধ্যায় শক্তিপদের অফিসের সহকর্মী অবিনাশ কথাটা বলেছিল তাদের ঘরে বসে। অনন্ত আর অমর পরস্পরের দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিয়েছিল। ধীরে ধীরে পাংশু হয়ে যায় তাদের মুখ। মৃত্যুর তিন দিন আগে শক্তিপদ কয়েক আউন্স উল আর বোনার কাঁটা অনিমার জন্য আর এক বাক্স রং পেনসিল অলকার জন্য কিনে এনেছিলেন। ওরা ক্লাসে উঠেছে ফাইভে আর ফোরে।
শীলা বলেছিল, ‘মেয়েদের দিলে, আর ছেলেরা বুঝি ক্লাসে ওঠেনি?’
অনন্ত আর অমর চোখ চাওয়াচাওয়ি করেছিল।
‘মাকে বল না আমাদের চটি নেই।’ অনন্ত বলেছিল। অমর একটু গোঁয়ার, মুখ আলগা। সে চেঁচিয়েই শীলাকে জানিয়ে দেয়, ‘আমার আর দাদার জন্য চটি চাই।’
সেই চটি কিনে বাসে উঠতে গিয়ে….অবিনাশ তাই বলেছিল, ‘বাক্সদুটো হাত থেকে পড়ে যাচ্ছিল, সামলাতে গিয়ে রড থেকে হাতটা পিছলে গেল।’
‘বাক্স দুটোর কী হল, আমরা তো চটি পাইনি!’ অমর ক্ষুণ্ণস্বরে বলেছিল।
অমরটা বোকা, ওর প্রথম চিন্তাই চটি। ভিড় আর উত্তেজনার মধ্যে নিশ্চয়ই কেউ তুলে নিয়েছিল রাস্তা থেকে। কিন্তু অনন্ত একটা কথাই তখন ভেবেছিল, ‘যদি ও—দুটো হাতে না থাকত’ তা হলে বোধহয় বাবার মৃত্যু হত না।
সেই সময় রেকাবিতে পরোটা আর বেগুন ভাজা নিয়ে অনিমা ঘরে ঢোকে। অবিনাশ আপত্তি জানাবার জন্য রান্নাঘরের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলেছিল, ‘এলেই যদি এইরকম খাবার দেন বউদি তা হলে কিন্তু আর আসব না।’
‘এ আর কী এমন।’
শীলা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে জানায়।
অবিনাশ তখন প্রায় অভিভাবক হয়ে উঠেছিল। রোজই আসত। সংসারের খুঁটিনাটি ব্যাপারও তার পরামর্শ ছাড়া চলত না। পাঁচজনের পরিবার একসময় তার অনুগ্রহনির্ভর হয়ে চলেছিল।
শক্তিপদর মৃত্যুর দিন শীলার হাতে ছিল বত্রিশ টাকা। মাইনের টাকা শক্তিপদ নিজের কাছে স্টিল আলমারির লকারে রাখত, চাবিও থাকত তার কাছে।
চাবির রিংটা ছিল প্যান্টের পকেটে, হাসপাতালের কেরানি সেটা শীলাকে দিতে অস্বীকার করে। মৃত শক্তিপদর সঙ্গে পাওয়া জিনিসগুলো যেমন রুমাল, নস্যির ডিবে, চটির বিল, চশমার খাপ, মানিব্যাগ, পাঁচটি চাবিসহ রিং আর একটা ডাকঘরের খাম পুলিশের হাতে তুলে দেয়। খামটির এক ধার ছেঁড়া ভিতরে একটা চিঠি। পুলিশের এস আই বলেছিল পরদিন থানা থেকে মৃতের জিনিসগুলো প্রমাণ দিয়ে নিয়ে যেতে।
অবিনাশের এক আত্মীয় পুলিশের পদস্থ অফিসার। তাকে সে অনুরোধ করেছিল জিনিসগুলো বিনা ঝামেলায় ফেরত পাবার জন্য। পরদিন শক্তিপদকে দাহ করে ফেরার সময় অনন্তকে সঙ্গে নিয়ে অবিনাশ থানায় যেতেই জিনিসগুলো কিঞ্চিৎ খাতিরসহই ফেরত পায়। অনন্ত একটা খাতায় সই করে জিনিসগুলো নেয়। তখন সে জানত না খামের মধ্যে চিঠিটা কার লেখা এবং তাতে কী লেখা। বাড়ি ফিরে প্রথমেই টাকার জন্য আলমারি খোলা হয়। তারপর সে বাবার জিনিসগুলো ও খামটিও লকারে রেখে চাবি বন্ধ করে দিয়েছিল। এরপর নানা কাগজপত্র বার করার জন্য লকার খোলা হয়েছে কিন্তু এককোণে প্লাস্টিকের মোড়কে সুতো দিয়ে বেঁধে—রাখা ওই জিনিসগুলো বা খামটিতে হাত আর দেওয়া হয়নি।
সাকসেশন সার্টিফিকেট বার করা, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা, এগারো দিন চাকুরির মাইনে, এ ছাড়াও জীবনবিমার তিন হাজার টাকা, সবই অবিনাশ সংগ্রহ করে দিয়েছিল। শীলাকে সঙ্গে নিয়ে কখনো—বা অনন্তকে নিয়ে সে ট্রামে, বাসে, ট্যাক্সিতে আদালতে এবং অফিসে অফিসে ঘুরেছে নিজের খরচে, ঘুস দেবার প্রয়োজন হলে নিজের পকেট থেকেই দিয়েছে।
‘আপনার ঋণ কীভাবে যে শোধ করব ঠাকুরপো…আমার ছেলেমেয়েদের উপর ভগবানের কী যে অসীম দয়া, না হলে এমন বিপদের দিনে কি আপনাকে পেতাম! তিনিই পাঠিয়ে দিয়েছেন আপনাকে।’
প্রভিডেন্ট ফান্ডের তেরো হাজার টাকার চেক নিয়ে নামার সময় শীলা যখন কথাগুলি বলছিল, প্রৌঢ় লিফটম্যানের মুখে তখন এক চিলতে হাসি দেখেছিল অনন্ত। জীবন সম্পর্কে নিশ্চিন্ত একটা ধারণায় পৌঁছবার পর মানুষ এমন বৈরাগীর মতো হাসতে পারে। অবিনাশের মুখেও একটা হাসি ফুটে উঠেছিল—কিছুটা আত্মসুখ, কিছুটা বিনয় ও উদবেগ মেশানো।
‘ও—সব পরে শুনব, আগে এই চারটে নাবালকের কথা তো ভাবতে হবে।’
এবার হাঁটতে হাঁটতে তারা সার্কুলার রোডে আসে।
‘চা খাবেন বউদি?’
‘আপনি খান, আমি দোকানের ছোঁয়াছুঁয়ি…’
বিধবা জীবনে শীলা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল কয়েক সপ্তাহেই।
অবিনাশ চায়ের বদলে কোকাকোলা খেয়েছিল দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। অনন্ত জীবনে সেই প্রথম এই পানীয়ের আস্বাদ পায়। তার ভালো লেগেছিল এবং তিন ভাই—বোনের কথা মনে পড়ে বিষণ্ণ বোধ করে।
‘শক্তিদার তো আরও বেশি থাকার কথা।’
‘হবে, আমি তো এ—সব খবর রাখতুম না। সংসারের টাকা আমার হাতে কখনো দিতেন না। ঝিয়ের মাইনেটাও নিজে হাতে দিতেন। আমি বরং কখনো—সখনো…’
অনন্ত জানে মা কেন থেমে গেছল। বাবা পায়খানা গেলে মা তার পকেট হাতড়ে বা মানিব্যাগ থেকে দু—তিন টাকা সরাত। একদিন সে দেখে ফেলেছিল। কাউকে সে—কথা সে বলেনি। বাবার নিশ্চয় সন্দেহ হত। মানিব্যাগ খুলে একদিন বাবাকে ভ্রূ কোঁচকাতে দেখেছিল। অনন্ত ভয়ে ভয়ে থাকত, হয়তো বাবা তাকে জিজ্ঞাসা করবে, ব্যাগে টাকা কমে গেল কেন? কিন্তু করেনি।
টাকা নিয়ে মা কী করত। অনন্ত স্কুল থেকে ফিরে একদিন দেখেছিল রাস্তায় সদর দরজার সামনে তিন—চারটি লঙ্কা—নুন—মাখা শালপাতা। কেউ আলুকাবলি বা ফুচকা খেয়েছে। কে খেয়েছে জিজ্ঞাসা করতেই মা থতমত খেত।
‘ওপরের মেজোবউ কি রত্না বোধহয়, প্রায়ই তো ডেকে ডেকে কিনে খায়।’
আর একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখল মা বাড়ি নেই। অমর তার আগে স্কুল থেকে পৌঁছে খেতে শুরু করে দিয়েছে।
‘মা কোথায় রে?’
‘অনু আর অলুকে নিয়ে সিনেমা গেছে।’
‘পয়সা পেল কোথায়? তুই জানলি কী করে?’
‘কে জানে কোথায় পেয়েছে, ওপরের জেঠিমা বলল।’
অলুর স্কুল সকালে, দশটার মধ্যেই সে বাড়ি ফিরে আসে।
‘অনু স্কুলে যায়নি?’
‘বোধহয় হাফ—ছুটি করে চলে এসেছে।’
‘তালা দিয়ে গেছল?’
‘ওপরে চাবি রেখে গেছে।’
ওপরে আছে বাড়িওয়ালার আত্মীয় এক পরিবার। বিশেষ মাখামাখি নেই। বাড়িওয়ালা থাকে শিলিগুড়ি। অনন্ত তাকে কখনো দেখেনি। ওপরের জ্যাঠামশাই আর তার ভাই বাড়িওয়ালার ভূমিকা নিয়েই বসবাস করে। তবে প্রতি মাসের পাঁচ তারিখে বাবা মানিঅর্ডারে ভাড়ার পঁয়ষট্টি টাকা শিলিগুড়িতে পাঠিয়ে দেয় জনৈক সুখরঞ্জন পোদ্দারের নামে। একবারের জন্যও পাঁচ তারিখের নড়চড় হয়নি। নামটা সে জেনেছে যেহেতু পোস্ট অফিসে গিয়ে মানিঅর্ডার করার ভার ছিল তার উপর। দু—বছর পর বাবা মারা যাবার তিন মাস আগে পঁয়ষট্টি হয়েছিল সত্তর।
বাবা পছন্দ করত না পাড়ার লোক বা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মেলামেশা বা ঘনিষ্ঠতা। কলকাতায় বউবাজারে আর জামশেদপুরে থাকে দুই মামা, কিন্তু সম্পর্ক নেই। যাদবপুরে কাকার রেস্টুরেন্ট আছে, অবস্থা ভালো, তার সঙ্গেও বাবার মুখ দেখাদেখি নেই। ঠাকুমা আর ঠাকুরদা ছিল কাকার সঙ্গে। দু—জনেই মারা গেছে। ভাইয়ের সঙ্গে বাবার যে কেন ঝগড়া, অনন্ত তা জানে না।
মা সিনেমা দেখত বা এটাসেটা কিনে খেত এবং সেজন্য কোথা থেকে পয়সা পেত, শুধু অনন্ত নয় তার ভাইবোনেরাও তা বুঝে গেছল। শীলা হয়তো সেটা জানত কিংবা জানত না। সে প্রায় নিরক্ষর এবং সরল আর অসম্ভব পরিশ্রমী। কিন্তু ছেলেমেয়েরা বাবার কানে তোলেনি। তারা মাকে ভালোবাসে।
কোকাকোলা খাবার পর সেদিন ট্রামে উঠে ওরা লম্বা সিটে পাশাপাশি বসেছিল। মাঝখানে শীলা।
‘দু—মাস আগে চার হাজার টাকা পি এফ থেকে তুলেছিলেন, ওরা খাতা থেকে আমায় দেখাল। কীজন্য, কিছু জানেন কি?’
শীলা মাথা নাড়ল।
‘দু—বছর আগে তিন হাজার।’
শীলার বিভ্রান্তি অব্যাহত। সে তাকাল অনন্তর দিকে।
‘কিছু জানিস?’
অনন্ত মাথা নাড়ল। বাবা খুব খরচে লোক নয়। ছেলেমেয়েদের জন্য কেনাকাটার বা খাওয়া—দাওয়ার বা বেড়ানোর জন্য খরচ করত না। নিজের জন্যও নয়। একজোড়া প্যান্ট আর একজোড়া হাওয়াই শার্ট, সারাবছর অফিসের জন্য ওই পোশাক। ফিতেওলা জুতো তিন বছর তো চলতই। মোজা থেকে সব ক—টা আঙুল বেরিয়ে থাকত।
.
বাবার এত টাকা তোলার কেন দরকার হল? ধার—দেনা ছিল কি?
অনন্তের কাছে সেটা তখন রীতিমতো রহস্যময় মনে হয়েছিল এবং বাড়ি ফিরে চেকটা আলমারির লকারে রাখতে গিয়ে প্লাস্টিকের মোড়কটা দেখে হঠাৎ তার মনে হয়েছিল বাবার পকেটে খামের মধ্যে যে চিঠিটা ছিল সেটা আজও দেখা হয়নি।
মোড়ক থেকে খামটা বার করে পকেটে রাখার সময় সে পিছন ফিরে দেখে ঘরে কেউ তাকে লক্ষ করছে কি না। ঘরে তখন অনু আর অলু ছাড়া কেউ ছিল না।
কেন যে তার মনে হয়েছিল চিঠিটা সবার সামনে পড়া উচিত নয়, তা সে আজ একুশ বছর পরও জানে না। কিন্তু অদ্ভুত অন্যায় খবর পাওয়া যাবে যেটা কাউকে বলার নয়, এমন একটা ধারণা সেই মুহূর্তে হয়েছিল। অন্যের চিঠি পড়া উচিত নয় এই বোধটাও তখন কাজ করছিল প্রবলভাবে।
বাড়ির কোথাও বসে সবার চোখ এড়িয়ে পড়ার জায়গা নেই। সন্ধ্যার পর পার্কের মাঝে আলোর নীচে গিয়ে বসল চিঠিটা পড়ার জন্য। দুটি তাসের আসর গোল হয়ে। তাদের থেকে কিছু দূরে সে বসেছিল। খামের উপর ঠিকানা ইংরেজিতে, অক্ষরগুলো মেয়েলি ছাঁদের। শেষবারের মতো সে ইতস্তত করেছিল চিঠিটা বার করার আগে।
চার ভাঁজ করা ছোটো চিঠি।
‘শক্তি,
আজও তোমার অফিসের সামনে রাস্তার ওপারে ছুটির সময় অপেক্ষা করেছি। এই নিয়ে পরপর চারদিন। তুমি বেরোলে দেখলাম, নিজের মনে হেঁটে স্টপে গিয়ে বাসে উঠে বাড়ি চলে গেলে। একবার মুখ তুলে তাকালেও না কোনোদিকে। তা হলে দেখতে পেতে এক অভাগিনীকে। আমি কী দোষ করলাম যে গত এক মাসে একবারও এলে না। লক্ষ্মীটি এসো। যদি অপরাধ করে থাকি পায়ে ধরে মাপ চাইব। এসো এসো এসো। ভালোবাসা নিয়ো। প্রণাম নিয়ো
ইতি
মিনু (১১ ডিসেম্বর)
এক নিশ্বাসে চিঠিটা পড়ে ফ্যালফ্যাল করে অক্ষরগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকেছিল মিনিট দুই। তারপর প্রথমেই সে ভেবেছিল, কে এই মিনু? বাবার সঙ্গে এর কী সম্পর্ক?
চিঠিটা সে তিনবার পড়েছিল আর ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারল এই পত্র—লেখিকার সঙ্গে তার বাবার কিছু একটা গোপন সম্পর্ক রয়েছে যার সম্পর্কে ঘুণাক্ষরেও তারা কিছু জানে না। ‘মিনু’ নামটি কখনো তাদের সংসারে উচ্চচারিত হতে সে শোনেনি। চিঠির বিষয় থেকে মনে হয় দু—জনের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক। এটা ভাবতেই সে মনে মনে অপরাধীর মতো কুণ্ঠায় জড়সড় হয়ে যায়। বাবার ব্যক্তিগত জীবনের একটা আড়াল করা দিক হঠাৎ পর্দা সরিয়ে দেখে ফেলার মতো লজ্জায় সে ভরে গেছল। আর সেই কুণ্ঠা এবং লজ্জার কারণ, চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলতে গিয়েও সে কিন্তু ছিঁড়তে পারেনি। সে ভাবতে পারছিল না তার মা ছাড়াও আর কোনো মেয়েলোক বাবার জীবনে থাকতে পারে। তার মনে হয়েছিল বাবার এটা জঘন্য কাজ।
চিঠিটা তাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়ে গেছল। পার্কে বসে তাসুড়েদের চেঁচামেচির মধ্যে বাবাকে দুশ্চরিত্র ভাবতে তার বাধছিল অথচ মন থেকে সায়ও পাচ্ছিল না। তখন তার কৈশোর বয়স। সে বার বার বাবার আচরণ, কথাবার্তার মধ্য দিয়ে খুঁজতে চাইল কোনো অসংগতি, অযৌক্তিক কাজ কিংবা মা—র সঙ্গে ঝগড়া, মনোমালিন্য পাওয়া যায় কি না।
কিছুই পায়নি। মা—র সঙ্গে কোনোদিন উঁচুস্বরে বাবা কথা বলেছে বা বিরক্তি প্রকাশ করেছে বা অবহেলা দেখিয়েছে এমন কোনো উদাহরণ সে সংগ্রহ করতে পারল না। খুব রেগে উঠলে তার চোয়ালের পেশি দপদপ করত কিন্তু মা—র জন্য একবারও করেনি। অনন্ত কোনোদিন মৃদু বা গাঢ়স্বরে দু—জনকে কথা বলতে বা চোখে চোখ রাখতে দেখেনি অথচ পরস্পরের প্রতি আচরণে তাদের খুঁত নেই। যন্ত্রের মতো নিখুঁত ছিল সম্পর্ক।
রাত্রে আঁচাবার সময় অনন্ত মাকে উনুনের আঁচ শিক দিয়ে খুঁচিয়ে নামাতে দেখে সাধারণভাবেই জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘মিনু বলে কাউকে চেনো?’
শীলা একবার মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘না।’ কয়েক সেকেন্ড পর আবার বলেছিল, ‘কেন?’
অনন্ত জবাব দেয়নি।
একুশ বছর পর চল্লিশের দিকে ঢলে—পড়া বয়সে মধ্যরাত্রে বিছানায় শুয়ে সে সেদিনের মতো আবার নিশ্চিন্ত হল একটা ব্যাপারে। চটির বাক্স হাতে ছিল বলে বাবা বাসের হাতল ধরতে পারেনি এই যুক্তিটা ঠিক নয়। বাবার সম্পর্কে একটা রহস্য জেনে যাওয়ার পর সেই রাতে অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে তার মনে হয়েছিল চিঠিটা সম্ভবত সেইদিনই বাবার হাতে এসেছিল যেদিন মারা যায়। হয়তো বাবা মিনুকে এড়াবার জন্যই চলন্ত বাসে ওঠার চেষ্টা করেছিল কিংবা চিঠিটা পড়ে এতই চঞ্চল বা অন্যমনস্ক হয়ে গেছল…আর যাই হোক চটির বাক্সে হাতজোড়া হয়ে থাকার কারণটা, যা অবিনাশকাকা প্রায়ই বলেন এবং প্রতিবার শুনে বুকের উপর সে পাষাণভার বোধ করে, সেটা ঠিক নয়।
সেই রাতে পাষাণভারটা মন থেকে নেমে তাকে হালকা করে দেয়। চিঠিটা পড়ার জন্য সে আর নিজেকে অপরাধী মনে করেনি এবং সেটা আজও সে নষ্ট করেনি।
বিছানা থেকে উঠে আলো জ্বেলে ঘরের কোণে জলচৌকির উপর থাক দিয়ে রাখা স্টিলের দুটো ট্রাঙ্কের উপরেরটা খুলল। ডালার খোপে গোঁজা কয়েকটি কাগজ থেকে সে চার—ভাঁজ করা একটি চিঠি বার করল।
চিঠিটি অনন্তের স্ত্রীর। বহুবার পড়েছে গত দু—দিনে। আবার সে পড়ার জন্য ভাঁজগুলো খুলতে লাগল।
দুই
অনন্তের স্ত্রীর নাম রেবতী। তার কথা ভাবতে ভাবতেই কিছুক্ষণের জন্য একুশ বছর পিছনের দিকে তাকিয়েছিল। যথেষ্ট উপরে উঠে পাখি—নজরে সে নিজের পিছন দিকে তাকাবে এমন ক্ষমতা তার নেই। জমির উপর দাঁড়িয়ে গিরিশ্রেণি দেখার মতো সে উঁচু—নীচু জীবনের কয়েকটা চূড়ামাত্র দেখতে পায়। তারই একটি, বাবাকে লেখা চিঠিটা।
এরপরের চূড়া ক্লাস টেন—এ তার ফেল হওয়া। এই নিয়ে স্কুল—জীবনে সে দ্বিতীয়বার পরীক্ষায় অকৃতকার্য হল। প্রথমবার ক্লাস ফোর—এ। অমর তৃতীয় হয়ে ক্লাস টেন—এ ওঠে। ও ভালো ছাত্র। সবাই বলে অমর কিছু একটা হবে। হয়েওছে। সে এখন দিল্লিতে থাকে। বড়ো একটা চামড়া—ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে সংযোগ রাখার দায়িত্বে আছে।
বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ডের তেরো হাজার টাকা, অবিনাশকাকার পরামর্শে পোস্ট অফিসের ক্যাশ সার্টিফিকেটে রাখা হয়েছিল অনু আর অলুর বিয়ের জন্য। ব্যাঙ্কে সাতশো এগারো টাকা আর অফিস থেকে সাহায্য বাবদ দু—হাজার টাকা। পুরো একটা বছর ঘর ভাড়া আর চারজনের স্কুল খরচ দিয়ে সাতাশশো টাকায় সংসার চলেছে, অনন্ত এখন তা ভাবতে পারে না। তখন দু—টাকা সের মাংস ছিল। টাকা ফুরিয়ে যাবার ভয়ে তারা একদিনও কেনেনি।
পরামর্শটা অবিনাশকাকার দেওয়া—অনন্ত কোনো কাজে ঢুকে যাক। সংসারে এবার টাকা রোজগারের লোক দরকার। ঘষতে ঘষতে বি এ, এম এ পাশ করে তো বড়োজোর কেরানি হবে, তার থেকে যেহেতু ওর মাথাটা অমরের মতো পরিষ্কার নয় তাই এখনই যেকোনো ধরনের কাজে অনন্ত লেগে পড়ুক। পঞ্চাশ—ষাট, যত টাকাই আনুক সেটা সাহায্য করবে। পাঁচ—পাঁচটা লোকের খাওয়া—পরা, সহজ কথা নয়।
শীলা আপত্তি করেনি। দিনযাপনের চিন্তায় ও অভাবে ধীরে ধীরে তার বাস্তববুদ্ধি বেড়েছে সেই সঙ্গে অবিনাশ—ঠাকুরপোর উপর নির্ভরতা। অনন্তকে কাজে ঢুকিয়ে দেবার কথায় শুধু একবারমাত্র সে বলেছিল, ‘এখন তো ওর খেলাধুলো করার বয়স।’
‘তা বললে তো হয় না, ওর বয়সি কত ছেলে দেখুন গে কত কাজ করছে। ট্রেনে জিনিস বেচছে, দোকানে কাজ করছে, মোট বইছে…ওর থেকেও কম বয়সি।’
অবিনাশকাকা মাথা নীচু করে বসে—থাকা অনন্তের পিঠে হাত রেখেছিলেন। কথাগুলো খুব স্বচ্ছন্দে বলতে চেষ্টা করেও পারছিলেন না। গলায় আটকে যাওয়ার জন্য মাঝে মাঝে খাঁকারি দিতে থামছিলেন।
‘বড়োছেলেরাই তো একসময় সংসারে বাবার জায়গা নেয়। স্কুলে যাওয়া, খেলাধুলো, আড্ডা এসবের দরকার আছে কিন্তু ভাগ্য যদি অন্যরকম অবস্থায় ফেলে দেয়, তাহলে আর কী করার থাকতে পারে। মা—কে দেখা, ভাই—বোনেদের মানুষ করে তোলা, নিজেকে নিজে বড়ো করা এসব তো এবার তোকেই করতে হবে। জীবনে ত্যাগ করতে হয় নানাভাবে, সবাইকে করতে হয়।…কী আর করবি, ভাগ্য যার যেমন দেবে…।’
শুনতে শুনতে অনন্ত নিজেকে বাবার ভূমিকায় কল্পনা করে অভিভূত হয়ে গেছল। বাবা গ্র্যাজুয়েট, বয়সে তার থেকে অন্তত তিরিশ বছরের বড়ো, চাকরি করছিলেন প্রায় কুড়ি বছর, একটা সংসার তৈরি করেছেন, অনেক ঝাপটা সামলে তাদের নিয়ে এগোচ্ছিলেন, এমন একটা লোকের জায়গা সে নেবে কী করে?
অমর, অনু, মা সবার মুখের দিকে সে তখন তাকিয়েছিল। ওরা ঘরে ছড়িয়ে বসেছিল। চল্লিশ ওয়াটের বালবে ওদের ভয় ভাবনা দুঃখ আরও বেশি উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। ওরা মাঝে মাঝে মুখ নামাচ্ছে আর সন্তর্পণে তার দিকে তাকাচ্ছে। যেন বিচারসভায় বসে ওদের হত্যাকারীর প্রাণদণ্ডের আদেশ শুনছে এমন একটা ভাব চোখেমুখে।
নিজেকে বিরাট একটা মানুষ হিসেবে দেখার ইচ্ছা অথবা লোভ অনন্তের মাথার মধ্যে তখন ঢুকে যায়। সর্বস্ব ত্যাগ করে, আরাম বিশ্রাম সুখ উচ্চচাকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিয়ে সে ভাই—বোনেদের বড়ো করে প্রতিষ্ঠিত করছে, নিজে যাপন করছে সামান্য জীবন। ভালো জামা—প্যান্ট পরে না, সিনেমা দেখে না, রেস্টুরেন্টে খায় না, ট্যাক্সি চাপে না, কারোর কাছে হাতও পাতে না। আত্মীয়স্বজন, পাড়া—প্রতিবেশী শ্রদ্ধাভরে তার দিকে তাকাচ্ছে, তার সম্পর্কে প্রশংসা করছে—কল্পনা করতে গিয়ে সে ঘরের সবক—টি মানুষের জন্য ভালোবাসা আর করুণাবোধ করছিল।
‘আমি সবাইকে দেখব।’
‘য়্যা!’ অমর হঠাৎ অবাক হয়ে শব্দ করে ফেলেছিল।
‘তোদের আমি দেখব।’
ওরা তিনজন কী বুঝল কে জানে, মা—র চোখ শুধু জলে ভরে উঠেছিল।
‘তুই সুখী হবি, দেখিস আমি বলছি,…জীবনে তুই কখনো কষ্ট পাবি না।’
রেবতীর চিঠিটা আবার ডালার খোপে রেখে অনন্ত হাসবার চেষ্টা করল। রেবতী গত পরশু তাকে ছেড়ে চলে গেছে, খবরটা কেউ এখনও জানে না।
মা—কে দেড় বছর আগে দিল্লি নিয়ে গেছে অমর। অনুর বিয়ে হয়েছে কটকে এক স্যাকরার সঙ্গে। তাকে সে সাত বছর দেখেনি। পাঁচটি ছেলেমেয়ে নিয়ে সে খুবই ব্যস্ত। অনুর বিয়েতে সবাই অমত করেছিল, কিন্তু সে জেদভরেই বোনের বিয়ে দেয়। শান্তনু পড়ত অলুর সঙ্গে কলেজে। বেকার ছিল। আজও প্রায় তাই। শান্তনু দু—বার চাকরি খুইয়েছে মাতলামো করে। এখন চাকরি খুঁজছে। অলু ফুড কর্পোরেশনে চাকরি করে। তাদের দুটি ছেলে।
কারোর সঙ্গেই অনন্তের দেখাসাক্ষাৎ নেই। দায়সারা বিজয়ার প্রণাম সে পায় বটে, সকলের ঠিকানায় জবাবও দেয় কিন্তু ওই পর্যন্তই। অলু কলকাতায় থাকে অথচ তার সঙ্গে তিন বছর দেখা হয়নি। অবিনাশকাকা রিটায়ার করে তাঁর দেশের বাড়িতে চলে যান, সেখানেই আছেন। ব্লাডপ্রেশারের রোগী, মাঝে মাঝে চিঠি দিয়ে শেষবারের মতো দেখে যেতে বলেন।
রেবতীর চলে যাওয়ার খবরটা জানাবার মতো লোক আছে শুধু মা। তার বিয়ের ব্যাপারে মা ছাড়া কেউ আর আগ্রহ দেখায়নি। অবশ্য ছেলেকে গৃহী দেখতে কোন মা না চায়!
আলো নিবিয়ে অনন্ত খাটে পা ঝুলিয়ে বসল।
অন্যরা শুনলে কী বলবে? বোনেদের না জানিয়েই সে বিয়ে করেছে। তবু কীভাবে যেন ওরা জেনে গেছল। অলু একদিন ঘণ্টাখানেকের জন্য এসেছিল রেবতীকে দেখতে। বাসে তুলে দিতে যাবার সময় অলু বলেছিল, ‘বউয়ের বয়স হয়েছে। পছন্দ করেই যখন বিয়ে করলে, কমবয়সি করলে পারতে।’
‘কত আর বয়স, তিরিশের নীচেই।’
আড়চোখে সে দেখেছিল, অলুর ঠোঁট মুচড়ে গেল।
‘তিরিশের নীচে! আমার থেকে অন্তত দু—তিন বছরের বড়ো বই কম নয়।’
অলুর জন্মসাল ধরে অনন্ত হিসেব করল।
‘তোর এখন একত্রিশ?’
‘হ্যাঁ। তিন মাস পর বত্রিশে পড়ব।’
‘আমারও তো ঊনচল্লিশে পড়ার কথা। বয়সের ফারাক খুব একটা কি?’
‘আর দু—দিন বাদেই তো বুড়ি হয়ে যাবে।’
‘হোক, শরীরই কি স্বামী—স্ত্রীর জীবনে সব? তা ছাড়া আমিও তো বুড়ো হয়ে যাব।’
তার কথার ভঙ্গিতে ও স্বরে গভীর শান্ততা এবং জীবনের উপর সহজ ভরসা প্রকাশ পেয়েছিল।
‘ভাগ্যে যা আছে তা হবেই।’
অলু চুপ করে থাকে।
‘তোর বোধহয় পছন্দ হয়নি বউদিকে।’
‘না না, পছন্দ হয়নি কে বলল? বেশ সুন্দরী, ফিগারটিও চমৎকার। আমি তো প্রথমে দেখে অবাকই হয়ে গেছলুম। তুমি এমন সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে ভাব করলে কী করে? চিরকালই তো মেয়েদের দেখলে কুঁকড়ে সরে যেতে।’
অনন্ত অত্যন্ত খুশি হয়েছিল। অলুর দিকে তাকিয়ে গালভরা হাসি নিয়ে বলেছিল, ‘তোরা তো আমাকে বোকা ছাড়া আর কিছু ভাবিস না।’
‘মোটেই না। ছোড়দা আর অনু ভাবতে পারে আমি কোনোদিন ভাবিনি। …তুমি ওদের কোনো খবর পাও?’
‘না।’
‘ভাবছি একবার দিল্লি যাব। ছোড়দা যদি ওর একটা কাজকম্মের ব্যবস্থা করে দিতে পারে।’
‘শান্তনু এখন খায়টায়?’
‘ও জিনিস কি আর ছাড়া যায়!’
‘ওর স্বাস্থ্য এখন কেমন?’
‘ভালো না, রক্ত আমাশায় ভুগছে।’
‘খুব খারাপ রোগ।’
‘দাদা অনেকের জন্য তো অনেক করেছ, আর একটু করো না।’
‘আমি আবার কার জন্য কী করলুম! ভাগ্যে যা আছে তা—ই হয়েছে।’
‘শ পাঁচেক টাকা আমায় দেবে?’
‘পাঁ—চ—শো, কোথায় পাব!’
‘ওরা তোমায় কিছু দেয়নি।’
‘শ্বশুরবাড়ি? আরে দূর, দেবার মতো কেউ থাকলে তো দেবে। তিন বোন একটা ছোটো ভাই, আমাদের মতোই বাবা নেই।’
‘তোমার কাছে নেই?’
‘এখনই…খুবই দরকার? কবে চাই?’
‘আজ পেলে আজই।’
‘জোগাড় করতে হবে।’
অলুকে বাসে তুলে দিয়ে ফেরার সময়, ‘চিরকালই তো মেয়েদের দেখলে কুঁকড়ে সরে যেতে, কথাটি নিয়ে সে মনে মনে খুব হেসেছিল। কেউ জানে না, সতেরো—আঠারো বছর আগে সে একজনকে দারুণ ভালোবেসেছিল। গৌরী নাম। এখন সে কোথায় থাকে কে জানে!
বাড়ি ফিরতেই রেবতী বলেছিল, ‘কিছু বলল কি তোমার বোন?’
‘কী বলবে?’
‘আমার সম্পর্কে। নতুন মানুষ দেখলে মেয়েরা মন্তব্য না করে কি থাকতে পারে?’
‘তোমার ওকে পছন্দ হয়নি?’
‘যেভাবে হাঁড়ির খবর নিচ্ছিল…তোমার আর—এক বোনের নাকি অবস্থা খুব ভালো, কটকে থাকে?’
‘শুনেছি, আমি ঠিক জানি না।’
রেবতী ‘তোমার বোন’, ‘তোমার মা’, ‘তোমার ভাই’ এইভাবেই বলে। কখনো ‘মা’, ‘ঠাকুরঝি’, ‘বা ‘ঠাকুরপো’ ওর মুখ থেকে বেরোয়নি। অনন্ত একবার বলেছিল, ‘আমার মা এখন তোমারও মা।’
‘আগে তো দেখি তারপর মা ডাকব।’
রেবতীর শুকনো নিস্পৃহ স্বর বুঝিয়ে দিয়েছিল সে সহজে সম্পর্ক পাতাতে অনিচ্ছুক। অনন্ত কখনো জোর দেয়নি। সে নিঃসঙ্গতা থেকে রেহাই পেয়েছে, এতেই সে খুশি এবং সুখী।
এখন তার সুখ ধ্বংস হয়ে গেছে। জানাজানি হলে সে মুখ দেখাবে কী করে? যে শুনবে প্রথমেই সে বলবে, ‘কার সঙ্গে বেরিয়ে গেল?’ কিংবা ‘কোথায় গিয়ে উঠেছে?’
অনন্ত জানে কোথায় গেছে। চিঠিতে কিছু বলেনি বটে কিন্তু সে অনুমান করছে রেবতীর পিছনে আছে দিলীপ ভড় নামে সেই লোকটি যাকে বিয়ের আগে রেবতী পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, ‘এই হচ্ছে দিলীপদা, অনেক উপকার করেছে আমাদের। দিলীপদা না থাকলে আমাদের পরিবারটা ভেসে যেত। …আর ইনি হচ্ছে সেই ভদ্রলোক কাগজে ‘পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন।
‘ওহ আপনি!’
অনন্ত নমস্কার করেছিল, লোকটি না—দেখার ভান করে সিগারেটের বাক্সটা এগিয়ে দেয় তার দিকে। অনন্ত হাত জোড় করে বলে, ‘মাফ করবেন, খাই না।’
সিগারেট কেন সুপুরিও সে খায় না। অবিনাশকাকা বলেছিলেন, ‘এখন থেকে টাকা জমানো অভ্যেস কর। আজেবাজে সিনেমা দেখে, রেস্টুরেন্টে খেয়ে, প্যান্ট—জামা—জুতোয় কী পান—সিগারেটে টাকা ওড়াসনি। মনে রাখিস তিনটে ভাইবোন, মা তোর জিম্মায়।’
অনন্তের বয়স তখন আঠারো। অবিনাশকাকা প্রথম দিন তাকে বই বাঁধাইয়ের দোকানটায় পৌঁছে দিয়ে মালিক প্রসাদ ঘোষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পর, কথাগুলো বলেন।
‘কিছুই তো কাজ জানে না, তবে শক্তিবাবুর ছেলে বলেই নিচ্ছি, এখন পঁয়ত্রিশ টাকা দোব, শিখুক, কাজ শিখলে তখন বাড়াব।’
‘পঁয়ত্রিশ, বড্ড কম। একটু বাড়ান, পঞ্চাশ করুন।’
অবিনাশকাকা আধ ঘণ্টা কষাকষি করে চল্লিশ টাকায় প্রসাদ ঘোষকে রাজি করান।
‘আপনার অফিস তো আর সেরকম কাজকম্ম দিচ্ছে না। সেই কবে ছ—মাস আগে একটা চার হাজার টাকার কাজ শেষ পেয়েছিলুম তারপর হাঁটাহাঁটিই সার হল। স্টোরকিপারকে তো ফাইভ পার্সেন্ট দিয়েছি, আরও একটা পার্সেন্ট বাড়াতে রাজি।’
‘আমি কালই কথা বলব সুনির্মলবাবুর সঙ্গে। শক্তিদার ছেলের উপকার হবে শুনলে নিশ্চয় কিছু কাজ করবে।’
চারদিনের মধ্যে দু—হাজার টাকার কাজ পেয়েছিল কমলা বাইন্ডার্স। সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কাজ। প্রথম দিন অনন্ত মুশকিলে পড়েছিল দুপুরবেলায়। খিদেয় পেটে মোচড় দিচ্ছিল কিন্তু পকেটে পয়সা নেই। পাঁচজন দফতরিই বাড়ি থেকে রুটি ভাত এনে খায়। যেদিন আনে না কাছেই রাস্তার চায়ের দোকানে পাঁউরুটি আলুর দম খেয়ে নেয়।
অনন্তকে কাজ দেওয়া হয়েছিল পরেশ দাস নামে প্রৌঢ় কারিগরটির সঙ্গে। শীর্ণ, কুঁজো লোকটির বিরাট এক কোরণ্ড। মালকোঁচা দিয়ে ধুতিতে সেটি আঁট করে বাঁধা, পরনে ছেঁড়া গেঞ্জি। সে লক্ষ করেছিল অনন্ত বাড়ি থেকে খাবার আনেনি। দুটি রুটির উপর আলুছেঁচকি রেখে বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘খাও। পেট ভরবে না জানি তবু সারাদিন খালি পেটে থাকা ভালো নয়।’
সে লজ্জায় পড়ে গেছল। নিতে রাজি হয়নি। পরেশ দাস দু—বার অনুরোধ করে নীরবে রুটি চিবিয়ে খায়।
‘মালিক কত দেবে বলেছে।’
‘চল্লিশ টাকা।’
‘বাড়িতে খেতে গেছে। এলে আট আনা পয়সা চেয়ে নিয়ে চায়ের দোকানে গিয়ে খেয়ে নিয়ো। লজ্জা কোরো না, আগাম বলে চাইবে।’
প্রসাদ ঘোষ ফিরে এল আধ ঘণ্টা পর। কিন্তু সে আট আনা চাইতে পারেনি। সে ভেবে দেখেছে সকাল থেকে ঝাঁট দেওয়া, টিউবওয়েল থেকে কলসিতে জল ভরা ছাড়া শুধু কয়েকটা পুরোনো পাঠ্য বইয়ের মলাট খুলেছে আর কয়েকটা বোর্ডে লেই মাখিয়েছে। এই কাজের জন্য হয়তো আট আনা প্রাপ্য হয় কিন্তু এখুনি হাত পাতলে মালিক কী ভাববে তার সম্পর্কে তাদের পরিবার সম্পর্কে? হাঘরে ভিখিরি! আট আনাও পকেটে রাখার সামর্থ্য নেই!
সে আর চাইতে পারেনি। সারাদিন কয়েকবার জল খেয়েছিল। রাত্রে বাড়ি ফেরার সময় চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ফ্রকপরা একটি মেয়েকে সে চা তৈরি করতে দেখে। সর্বাগ্রে তার নজরে পড়ে আঁটো ফ্রকের ভিতর থেকে স্তনের দৃঢ়তা ফুটে রয়েছে। আবলুস রঙের চামড়া। ঘাড় পর্যন্ত চুল। মুখটি মিষ্টি। চাহনিতে চঞ্চলতা। দু—দিন পর দুপুরে বেঞ্চে বসে আলুর দম কিনে রুটি দিয়ে খেতে খেতে সে চাওয়ালাকে বলতে শুনল, ”গৌরী, উনুন কামাই যাচ্ছে, মটরগুলো সেদ্ধ কর।”
সেদিন মধ্যরাত পর্যন্ত সে ঘুমোতে পারেনি। শরীরে অদ্ভুত একটা অস্বস্তি চলাফেরা করেছিল।
অনন্ত আজ রাতেও আর এক ধরনের অস্বস্তি বোধ করছে তবে শুধুই মাথার মধ্যে ইঞ্জিনের পিছনে মালগাড়ির মতো সার সার চিন্তা মাঝে মাঝেই লাইন বদলে অন্য লাইনে চলে যাচ্ছে। সে রেবতীর কথাই ভাবতে চায় কিন্তু তার কৈশোর আর প্রথম যৌবন বারবার তার চিন্তাকে থামিয়ে দিচ্ছে লাল সিগন্যালের মতো।
দিলীপ ভড় রেবতীদের ঘরের তক্তাপোশে পা ছড়িয়ে একটা বালিশ বগলে রেখে কাত হয়ে শুয়েছিল। সিগারেটের ছাই পড়ছিল মেঝেয়। রেবতীর ছোটোবোন শ্বাশ্বতী ওর পায়ের কাছে বসেছিল, একটা হাত দিলীপ ভড়ের পায়ের উপর আলতো করে রেখে অনন্তকে দেখছিল কৌতূহলে। অনন্ত তখন ভাবছিল এই লোকটা কে? নিকট আত্মীয়?
‘কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন কেন?’
‘তা ছাড়া উপায় ছিল না।’
‘সম্বন্ধ করে বিয়ে দেবার মতো কেউ নেই?’
‘না।’
অনন্ত হঠাৎ বিষণ্ণ হয়ে পড়ল। কেউ নেই বলাটা ঠিক হল কি? দুটো বোন, একটা ভাই আর মা থাকা সত্ত্বেও তার কেউ নেই। সবাই দূরে দূরে। তাকে ফেলে মা যেতে চায়নি। কিন্তু থেকেও কোনো লাভ হত না। পেটের যন্ত্রণায় কাতরাত আর বিড়বিড় করত: ‘ভগবান, ভগবান, আর পারছি না গো। এবার নিয়ে যাও আমায়।’ দেখাশুনো করার লোক রাখারও সামর্থ্য নেই। রান্না, বাসনমাজা, কাচাকাচি সংসারের যাবতীয় কাজ অনন্ত নিজেই করত। মাঝেমধ্যে অলু এসে কিছুক্ষণ থেকে চলে যেত। পাড়ায় ছিল মেয়ে ডাক্তার মাধবী দত্ত। তিনি দেখে বলেছিলেন, ‘হাসপাতালে ভরতি করান, মনে হচ্ছে ক্যানসার।’
অনন্ত সেইদিনই অমরকে চিঠি দিয়েছিল। চারদিনের মাথায় অমর দিল্লি থেকে উড়ে এসে উঠল অফিসের গেস্ট হাউসে। মা—কে সে পরদিনই বড়ো ডাক্তার দেখিয়ে এক্স—রে করায়। ‘মা—কে নিয়ে যাব, ট্রিটমেন্ট দিল্লিতেই করাব।’
‘থাক না এখানে।’
‘অপারেশন করে একটা চেষ্টা করা যাক। এখানে থেকে লাভ কী? দেখার লোক নেই, তা ছাড়া খরচও অনেক।’
‘শুনেছি এ রোগে কেউ বাঁচে না।’
অমর জবাব দেয়নি। সন্ধ্যার সময় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে নীচুস্বরে কথা বলছিল। অমরের মুখ থেকে সে হালকা মদের গন্ধ পাচ্ছে। মা ভিতরে দালানে বসে রয়েছে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে।
‘মরবেই যদি তা হলে এখানেই মরুক না। আবার টেনে হিঁচড়ে অত দূরে নিয়ে গিয়ে কী লাভ!’
‘অপারেশন করলে আরও কিছুদিন কয়েক মাস কী একটা বছর টিকে যাবে। পারবে তুমি? ওষুধপত্তর ধরে কম করেও হাজার আষ্টেক টাকা, পারবে?
অনন্ত অসহায় বোধ করল। ব্যাঙ্কে তার সাড়ে সাত হাজারের মতো টাকা জমেছে। ক্যানসার রোগীর জন্য টাকা খরচ আর ভস্মে ঘি ঢালা একই ব্যাপার। কিন্তু বিনা চিকিৎসায় মা মারা যাবে? হতে পারে না। জীবনবিমা করেছে কুড়ি হাজার টাকার। তার মাইনে এখন কেটেকুটে ছ—শো একানব্বুই টাকা। অমর কত টাকা রোজগার করে তা সে জানে না। হয়তো সাত—আট হাজার মাইনে পায়। বার চারেক তো বিদেশ ঘুরে এসেছে।
‘চেষ্টা করে দেখি। অফিস কো—অপারেটিভ থেকে নয় লোন নেব।’
‘ভালো। পরশু সন্ধের ফ্লাইটে আমি চলে যাব।’
পরশু সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে সে দেখল দরজায় তালা ঝুলছে। তার পায়ের শব্দে দোতলা থেকে কাকিমা চেঁচাল, ‘কে?’
‘আমি অনন্ত।’
‘চাবিটা নিয়ে যাও।’
অনন্ত দোতলায় উঠে এল। জেঠিমা পুজোর ঘরে। কাকিমা, ঠিকে—ঝি আরতি, পাশের বাড়ির দু—জন গৃহিণী দালানে টিভি দেখছে।
‘ওই পেরেকে টাঙানো রয়েছে। বিকেলেই ওরা গেল। দিদি খুব কাঁদছিলেন, তোমার সঙ্গে আর দেখা হল না।’
শোবার ঘরে টেবলে চিরুনি চাপা দেওয়া একটুকরো কাগজ। তাতে বড়ো অক্ষরে লেখা : ‘দাদা, মা—কে নিয়ে যাচ্ছি, আমার কাছে শেষ ক—টা দিন থাকবে। রাগ কোরো না। ইতি—অমর।’
বারকয়েক পড়ে সে থম হয়ে বসে থাকে। মধ্যরাত্রে ঘুম ভেঙে যেতেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সে বাচ্চচাছেলের মতো কেঁদেছিল। দেড় বছর আগে লিখে রেখে যাওয়া অমরের চিঠিটা ট্রাঙ্কের মধ্যে এখনও রয়েছে। মা এখন জীবিত।
অনন্ত বিছানায় পাশ ফেরার সময় মুখে একটা শ্রান্তির শব্দ করল। সারাটা জীবন শুধু খাটুনি আর খাটুনি। এইবার সে একদমই একা। রেবতী পরশু চলে গেছে। কোনো ঝগড়া হয়নি, সামান্য তর্কাতর্কিও নয়। এমনিই চলে গেছে। পাঁচ মাস আগে তাদের বিয়ে হয়েছে।
কীভাবে সে পরিচিতদের কাছে মুখ দেখাবে! জেঠিমা আজ সকালে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘বউমা কোথায়, বাপের বাড়ি গেছে?’
‘হ্যাঁ।’
অমরের মতো ছোট্ট কাগজে অল্প কয়েকটা অক্ষর : ‘আমার আর ভালো লাগছে না। চলে যাচ্ছি। আর ফিরব না। রেবতী।’
মা বলেছিল, ‘তুই সুখী হবি, দেখিস…আমি বলছি। জীবনে তুই কখনো কষ্ট পাবি না।’
কবে বলেছিল, মা কবে বলেছিল কথাটা? ভাবতে ভাবতে অনন্ত ঘুমিয়ে পড়ল।
তিন
মাইনের দিন শক্তিপদ তারা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে কচুরি কিনে বাড়ি ফিরত। গোনাগুনতি মাথাপিছু চারটি অর্থাৎ চব্বিশটি। একবার সবাইকে ভাগ করে দিয়ে দেখা গেল একটি বেশি। পকেট থেকে খুচরো নোট ও পয়সা বার করে শক্তিপদ গুনে দেখল চব্বিশটির দামই সে দিয়েছে। দোকানি তা হলে ভুল করে একটি বেশি দিয়ে ফেলেছে। ‘ফেরত দিয়ে আসি।’ কচুরিটা কাগজে মুড়ে সে তখনই রওনা হয়ে গেছল। শীলা তখন বলেছিল, ‘পরে যেয়ো, আগে খেয়ে নাও।’ শক্তিপদ জবাব দেয়নি। অমর অস্ফুটে বলেছিল, ‘ফেরত দেবার দরকার কী? মিষ্টিওলাও তো কত লোককে ঠকায়।’
প্রথম মাইনে পেয়ে বাড়ি ফেরার সময় অনন্ত তারার দোকানের সামনে দাঁড়াল। দোকানের ভিতরে কয়েকজন খাচ্ছে। ক্ষীণ গন্ধ আসছে কচুরি ভাজার। ফুলকো গরম কচুরিতে আঙুলের টোকা দিয়ে গর্ত করছে একজন। কচুরি নিয়ে বাবা যখন বাড়ি পৌঁছত তখন ঠান্ডা হয়ে যেত। বেশিরভাগই চোপসানো। অনন্ত কানে কানে মা—কে বলত, ‘ফুলোগুলো কিন্তু আমার।’ আঙুল বসিয়ে গর্ত করে সে তারমধ্যে তরকারি ভরে দিত।
অনন্ত পায়ে পায়ে কাচের শো—কেসের সামনে এল। পকেটে চারটে দশ টাকার নোট মুঠোয় চেপে ধরে সে গলা থেকে স্বর বার করতে পারল না। দোকানি তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী দোব?’
‘কচুরি।’
‘ক—টা?’
‘চব্বিশটা।’ আপনা থেকেই সংখ্যাটা তার মুখে এসে গেল।
‘দু—মিনিট দাঁড়াতে হবে, ভেজে আনছে।’
অনন্ত অপেক্ষা করতে করতে রোমাঞ্চ বোধ করল। ব্যাপারটা ঠিক বাবার মতোই হচ্ছে। বাড়িতে নিশ্চয় সবাই অবাক হয়ে যাবে। বাবাকে তখন সবার মনে পড়বে। ভাববে, সংসারের শূন্যস্থানটা এবার পূর্ণ হল। সবাই অন্যরকমভাবে তাকে দেখবে।
তার বুকের মধ্যে একটা উচ্ছ্বাস ঠেলে উঠছে। রাস্তার যানবাহন, লোকের চলাচল, কোলাহল, নানান শব্দ, ভঙ্গি, সব তখন অনন্তের ইন্দ্রিয়ের পরিধি থেকে সরে গেছে। সে শুধু দেখতে পাচ্ছে বাবাকে, একহাতে তরকারির ভাঁড় অন্যহাতে কচুরির ঠোঙা, ঈষৎ ঝুঁকে, শুধুমাত্র রাস্তার দিকে তাকিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সামনে মানুষ থাকলে একবার মুখটা তুলেই পাশ কাটিয়ে নিচ্ছে।
‘চব্বিশটা কচুরি।’
‘চব্বিশটা, ঠিক গুনেছেন তো?’
‘কম নেই।’
দশ টাকার নোট কাচের উপর রাখল। তার প্রথম উপার্জন, প্রথম খরচ। খুচরো নোটগুলো পকেটে রাখার সময় তার মনে হল সবাইকে মিষ্টিমুখ করানো উচিত।
‘পাঁচটা কড়াপাক সন্দেশ দিন।’
‘আট আনার না এক টাকার?’
‘আট আনার।’
বাবা কোনোদিন সন্দেশ আনেনি। তা হলে কি নেওয়া ঠিক হবে? অনন্ত দ্বিধায় পড়ল। বাবাকে কি ছোটো করা হবে? তা তো সে চায় না। প্রথম চাকরির প্রথম মাইনে পেয়ে বাবা কি বাড়ির লোকেদের মিষ্টিমুখ করায়নি? জীবনে তো শুধু একবারই। এতে নিশ্চয় দোষ হবে না।
পকেটে সন্দেশের ঠোঙা, দু—হাতে কচুরি ও তরকারি নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একবার তার হাসি পেল। ইচ্ছে করেই অল্প কুঁজো হয়ে রাস্তার দিকে মুখ নামিয়ে সে কিছুটা হাঁটল। এখন তার পকেটে যে ক—টা টাকা, তার অন্তত কুড়িগুণ থাকত বাবার পকেটে। বাবার সমান হতে কি তার কুড়ি—বাইশ বছর লাগবে?
রাস্তার উপর চুন দিয়ে গোলাকার বৃত্ত আঁকা। রবারের বল খেলা হয়েছে বিকেলে। গোলকিপারের এলাকা চিহ্ন করে দাগ টানা। সে মাঝে মাঝে গোলকিপার হয়েছে। কোনো খেলাতেই তার দক্ষতা নেই। অমরকে সবাই দলে চায়। অন্য পাড়াও তাকে ফুটবল বা ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে নিয়ে যায়।
সদর দরজা ভেজানো। পা দিয়ে ঠেলে খুলতেই আবছা অন্ধকার উঠোনে দেখতে পেল পিছন ফিরে মা সাবান কাচছে। ডাকতে গিয়েও ডাকল না। পা টিপে সে মা—র পিছনে এল। ঝুঁকে ঘাড়ের কাছে মুখ নামাল।
‘হাল—লুম।’
‘বাবা গো!’
শীলা কেঁপে উঠে পিছনে তাকিয়ে দেখল অনন্ত ঠোঙা আর ভাঁড় তুলে হাসছে।
‘এরকম করে ভয় দেখায়!’
‘আমি তো হালুম করেছি। বাঘ এখানে আসবে, তাই ভেবেছ? এই দ্যাখো।’
শীলা ভ্রূ কুঁচকে অবাক হয়ে তাকিয়ে।
‘কী রে?’
‘বাবা যা আনত।’
‘আজ মাইনে দিল বুঝি! ঘরে রাখ আসছি। ঠাকুরপো তোর জন্য অনেকক্ষণ বসে রয়েছে।’
অনন্ত ঘরে ঢুকতেই সবাই তার হাতের জিনিস দুটোর দিকে চোখ রাখল। পাতলা হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। ঠোঙা আর ভাঁড়টা কোথায় সে রাখবে ভেবে পাচ্ছে না। মেঝেয় বই নিয়ে অলু আর অমর। তক্তাপোশে অনু। অবিনাশ চেয়ারে বসে মন দিয়ে অমরের ভূগোল বইটা পড়ছে।
‘কাল অফিসে এসেছিল তোদের মালিক। আস্ত ঘুঘু…হাতে কী?’
‘কুচুরি।’
‘মাইনে দিয়েছে? মহা ধড়িবাজ, বলে কিনা আমার তো লোকের দরকার নেই, আপনি বললেন তাই ছেলেটাকে রাখলুম, খরচ বেড়ে গেল। আসলে মতলব এইসব বলে যদি আরও কিছু কাজ পাওয়া যায়। সুনির্মলবাবুকে বললুম সব। তিনি তো রেগে উঠে বললেন এখান থেকে যথেষ্ট কাজ পেয়েছে, শুধু শক্তিবাবুর ছেলের জন্যই ওকে কাজ দিয়েছি নইলে দিতুমই না। তোর সঙ্গে ব্যবহার করে কেমন?’
‘ভালো।’
‘কাজ শিখেছিস কিছু? এক মাস তো হল।’
‘অল্পস্বল্প, শক্ত কাজ তো নয়।’
ঘরে ঢুকল শীলা। তার চোখ ঝকঝক করছে। ঠোঙাটা তুলে নিয়ে বলল, ‘কী দরকার ছিল এসব আনার, আজেবাজে পয়সা নষ্ট।’
মায়ের আনন্দ কারোর কাছেই চাপা রইল না। শীলা একটা কাঁসার থালায় তরকারির বেশিরভাগ ঢেলে চার ভাগ করল, আর একটা প্লেটে বাকিটা তুলে অবিনাশের হাতে দিল। কচুরির ঠোঙাটা অনন্ত বাড়িয়ে দিল অমরের সামনে, ‘চারটে। সবার জন্য চারটে করে।’
ঠিক এইভাবেই তার বাবা বলত। ঠোঙা থেকে চারটে কচুরি তুলে সে অবিনাশের প্লেটে রাখল।
‘তোর কই?’
‘আমার আর মা—র আছে। আগে বরং একটু মিষ্টিমুখ হোক।’
ম্যাজিসিয়ানের মতো হাত নেড়ে অনন্ত পকেট থেকে এক ঝটকায় সন্দেশের ঠোঙা বার করল।
‘জীবনের প্রথম রোজগার। তবে এরপর আর এভাবে খরচ করা নয়।’
অবিনাশ স্মিত হেসে বললেও স্বরে কিছুটা ভর্ৎসনা ছিল।
‘হ্যাঁ, আর নয়।’ শীলা প্রতিধ্বনি করল। ‘তোরটা এখুনি খেয়ে নে, রেখে দিলে আর থাকবে না। যা সব…আমার ক—দিন ধরেই অম্বল হচ্ছে ভাজাটাজা আর খাব না।’
‘তা হলে আমায় দাও।’ অমর হাত বাড়াল। অনন্ত তার হাতে একটা কচুরি দিল, দুই বোনকেও। অবিনাশ হাতটা তুলে তাকে দিতে নিষেধ করল।
অনন্ত ভাই—বোনেদের মুখের দিকে তাকাল। এই মুহূর্তে সারা ঘর স্থির একটা নিশ্চিন্তিতে ডুবে গেছে। সবার মুখেই সুখের বুড়বুড়ি। অমর কচুরির সামান্য একটু ছিঁড়ে তরকারির ঝোলে বুলিয়ে অনেকক্ষণ ধরে চিবোচ্ছে, মাঝে মাঝে দু—চোখ বুজে আসছে। অনু আঙুলের ডগায় ঝোল মাখিয়ে জিবে ঠেকাচ্ছে। অলুর চোখ দ্রুত চিবোনোর জন্য বড়ো হয়ে উঠেছে আর ঢোক গিলছে। বহুদিন পর তাদের ঘরে কিছুক্ষণের জন্য বাবা ফিরে এল। ‘বড়োছেলেরাই তো একসময় বাবার জায়গা নেয়’, আজ থেকে সে বড়ো হয়ে গেল। এখন তার আঠারো চলছে।
অনন্ত রাত্রে স্নান করে জলকাচা পাজামাটা উঠোনের তারে মেলে দিচ্ছিল। শীলা কাছে এসে নীচুস্বরে বলল, ‘ওরা আজ ভাড়া চেয়েছে, একসঙ্গে চার মাসেরই।’
অনন্ত চুপ করে রইল।
‘একগাছা চুড়ি বিক্রি করলে ভাড়াটা মেটানো যায়।’
‘অনু অলুর বিয়ের জন্য রাখবে বলেছিলে।’
‘ওদের বিয়ের বয়স হতে এখনও সাত—আট বছর বাকি। ততদিনে টাকা জোগাড় হয়ে যাবে। তেরো হাজার টাকা তো রয়েইছে।’
‘ততদিনে সোনার দামও তেরোগুণ হয়ে যাবে।’
‘তা হলে? উনি প্রতি মাসে ঠিক সময়ে ভাড়া পাঠিয়ে দিতেন, কোনোবার দেরি করেননি। এই প্রথম বাকি পড়ল, তাও চারমাসের।’
‘এরকম দু—চার মাস বাকি সব ভাড়াটেদেরই পড়ে।’
‘আমাদের কখনো পড়েনি।’
দু—জনে চুপ করে রইল। দোতালায় রেডিয়ো থেকে পল্লিগীতি ভেসে আসছে। নর্দমা থেকে একটা ছুঁচো উঠোনে লাফিয়ে উঠে শীলার পা ঘেঁষে ছুটে গেল। দূরে কোনো বাড়িতে ঝগড়া হচ্ছে।
‘একটা কথা বলব, রাগ করবি না?’
‘কী কথা?’
‘খোকার মা আজ বিকেলে বলল, বলাই মিত্তির লেনের দাসেদের বাড়িতে রান্নার লোক খুঁজছে।’
‘রাঁধুনি হবে!’
অনন্ত চাপা চিৎকার করে উঠল। তার হাতের আঙুলগুলো থরথর কাঁপছে।
‘তুমি চিন্তা করতে পারলে?…শেষকালে এমন একটা কাজের কথা…বাবা বেঁচে থাকলে তুমি এ—কথা বলতে পারতে?’
‘উনি তো আর নেই।’
‘আমাদের বংশ, মান—সম্মান?’
‘খেতে পরতে হবে, বাড়ি ভাড়া, এটা—ওটা, স্কুলের মাইনে…তুইও কি কখনো ভাবতে পেরেছিলিস পড়া ছেড়ে চল্লিশ টাকার কাজ নিবি?’
‘আমি ব্যাটাছেলে, আমার সব মানিয়ে যায়…না, তোমাকে রাঁধুনি হতে হবে না।’
অনন্ত প্রায় ছুটেই ঘরে এল। দেওয়াল ঘেঁষে অমর ঘুমোচ্ছে মেঝেতেই। তার পাশে বালিশটা ছুড়ে, আলো নিবিয়ে সে শুয়ে পড়ল। কিছু পরে সে পাশের ঘর থেকে মা—র কণ্ঠস্বর পেল, ‘কী বিচ্ছিরি শোয়া বাপু…ওদিকে পা সরা।’
অনন্তের ঘুম আসছে না। অজস্র রকমের চিন্তা তার মাথায় যাওয়া—আসা করছে। প্রত্যেকটাই ভয়ের আর হতাশার। মা রাঁধুনি এ—কথা শুনলে পাড়ার লোকে কী বলবে, ওপরের লোকেরাও? অলু, অনু, অমরের স্কুলে যেভাবেই হোক অনেকেই জেনে যাবে। ঝি—চাকর—রাঁধুনি মোটামুটি তো একই পর্যায়ের। কেউ যদি ওদের আঙুল দেখিয়ে বলে রাঁধুনির ছেলে…রাঁধুনির মেয়ে’! ভাগ্য যাকে যেমন দেবে তা মেনে নিতেই হবে, কিন্তু তাই বলে মান—সম্মান ধুলোয় লুটিয়ে দিতে হবে নাকি?
গত এক মাসে সে বন্ধুদের বা পাড়ার লোকের সঙ্গে কথা বলেনি। পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হলে ব্যস্ততার ভান করে হনহনিয়ে এড়িয়ে গেছে। স্কুলের অশোকবাবুর সঙ্গে একদিন রাস্তায় দেখা। এড়িয়ে যেতে গিয়েও পারেনি। জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘পড়া ছেড়ে দিলি? করছিস কী এখন?’
ইতস্তত করে সে বলেছিল, ‘অ্যাপ্রেন্টিস, কাজ শিখছি কারখানায়।’
‘কীসের কারখানা?’
অনন্ত তৈরি ছিল না প্রশ্নটার জন্য। সামনে নারায়ণ মেডিক্যাল হল—এর সাইনবোর্ডে চোখ পড়তেই বলেছিল, ‘ওষুধের কারখানা।’
‘কত দিচ্ছে?’
‘একশো চল্লিশ টাকা।’
‘অমরকে ভালো করে পড়াশুনো করতে বলিস, একটু খাটলেই ন্যাশনাল স্কলারশিপ পেয়ে যাবে।’
‘আমি তো সারাক্ষণই বাইরে থাকি স্যার। আপনারা যদি ওকে বলেন…বাড়িতে তো বিশেষ পড়তে দেখি না।’
‘মাথা আছে ওর, একটু খাটলেই পেয়ে যাবে, আমার কোচিং—এ ওকে আসতে বলিস…না না টাকা লাগবে না।’
অমর ক—দিন ধরে সকালে স্যারের কোচিং—এ যাচ্ছে। অমর বোধহয় জানে না সে কত টাকা পায় কমলা বাইন্ডার্স থেকে। কিন্তু সে ওষুধের কারখানায় যে অ্যাপ্রেন্টিস নয় এটা অমর জানে। কথায় কথায় যদি অশোকবাবুকে বলে ফেলে দাদা কোথায় কাজ করে! খুঁটিয়ে বাড়ির খবর নেওয়ার অভ্যাস স্যারের আছে।
ঘুমের মধ্যে সে ছটফট করেছে। ঘুম ভেঙে যাবার পর বিশ্রী একটা অস্বস্তি নিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে রইল। অনু স্কুলে যাবে। মা বাসি রুটি আর তরকারি ওকে খেতে দিয়েছে। অমর এখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। উঠোনে বাসন রাখার শব্দ হল। কাল কচুরি আর সন্দেশ কেনার পর যে—টাকা ক—টা ছিল সে মাকে দিয়েছে। মা—র কাছ থেকে দুটো টাকা নিয়ে এবার সে বাজার যাবে। খুব সহজে এবং দ্রুত তার বাজার করা হয়ে যায়। আলু, ডাল আর একটা আনাজ। মাছের বাজারের দিকেই সে যায় না। মাছ তারা শেষ কবে খেয়েছে? মাসতিনেক আগে। হঠাৎ খুব ইলিশ ওঠে, পাঁচ টাকা কেজি পর্যন্ত দাম নেমেছিল। রাত্রে একটা আধ কেজি ইলিশ এনেছিলেন অবিনাশকাকা। পরদিনের জন্য গোনাগুনতি তুলে রাখা হয়েছিল। সকালে রাঁধতে গিয়ে মা একটা মাছ কম পায়। কেউই স্বীকার করেনি তবে সবাই সন্দেহ করেছিল এটা অমরেরই কাজ।
‘আর ঘুমোয় না, ওঠ এবার, বেলা হয়ে গেল।’ অনন্ত চোখ খুলে জানলা দিয়ে তাকাল। সামনের বাড়ির দোতলার বারান্দায় উৎপলের দাদু চেয়ারে বসে কাগজ পড়ছে। ওদের সদরের পাশেই আস্তাকুঁড় ছিল। দিন—সাতেক হল দাদু ঝিয়েদের সঙ্গে ঝগড়া করে জঞ্জাল ফেলা বন্ধ করেছে। রোজ সকালে দাদু বারান্দায় বসে লক্ষ রাখে কেউ ওখানে কিছু ফেলছে কি না। আরও তিনটে বাড়ি পেরিয়ে জঞ্জাল ফেলতে হওয়ায় ঝিয়েরা প্রথমে গজগজ করে এখন মেনে নিয়েছে। সকালে অনন্তদের জঞ্জাল ফেলে অনু। ওর স্কুল সাড়ে দশটা থেকে। ভাঙা—কলাইয়ের থালা হাতে দূরে গিয়ে ফেলতে অনু লজ্জা পায়। তাই ও ঘরের জানলা থেকে প্রথমে দেখে নেয় দাদু বারান্দায় আছে কি না। না থাকলে ছুটে গিয়ে ফেলে দিয়ে আসে। পাতের এঁটো—কাঁটা কিছুই প্রায় থাকে না, আনাজ খোসাসমেতই রান্না হয়, শুধু উনুনের কিছু ছাই ছাড়া তাদের সংসারে প্রতিদিনের কোনো জঞ্জাল হয় না।
অনন্ত বাজারে বেরোবার আগেই অমর কোচিং—এ চলে গেছে। খোকার মা উঠোনে নীচু গলায় শীলার সঙ্গে কথা বলছিল। তাকে দেখে ওরা কাজ বন্ধ করল। অনন্ত না—দেখার ভান করে পেরেক থেকে থলিটা তুলে নিয়ে, চেঁচিয়ে বলল, ‘টাকা দাও।’
দুটো টাকা শীলার আঁচলে বাঁধা ছিল। খুলে দেবার সময় বলল, ‘খোকার মা—কে না বলে দিলুম। চাল শুধু এ—বেলার মতোই আছে।’
অনন্ত অসহায়ভাবে তাকাল। বাবা মারা যাবার পর এক বছর কেটে গেছে। যে—ক—টা টাকা ছিল তা—ও ফুরিয়েছে। এখন তার চল্লিশটা টাকাই সম্বল। সে ভেবে পাচ্ছে না তাদের পাঁচটা পেট কীভাবে ভরবে।
‘এবার থেকে দু—বেলা রুটি খেতে হবে।’
‘আটা কিনতেও তো পয়সা লাগবে। মেয়েদের জামা না কিনলেই নয়, সেলাই করে করে কত আর পরবে, অমরের জুতোটাও ফেলে দেওয়ার মতো হয়ে গেছে…’
‘তা আমি কী করব, শুধু আমায় বলছ কেন?’ অনন্ত হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল। শীলা অবাকচোখে তাকিয়ে। এভাবে কখনো ওকে চেঁচিয়ে উঠতে দেখেনি। দু—জনে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল। দু—জনেই জানে উত্তর দেবার কিছু নেই, উত্তর হয় না। অনন্ত চোখ নামিয়ে মাথা নীচু করে বেরিয়ে গেল।
বাজার থেকে ফেরার সময় সে অমরকে দেখল বইখাতা হাতে তিনটি ছেলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। ওর পায়ের কাবলি জুতোটার গোড়ালির চামড়ার পটিটা উলটোনো, বকলেস নেই। জুতোর কালো রং ধুলো—কাদায় ফ্যাকাশে। ডান পাটির একধারের সেলাই ছিঁড়ে আঙুল বেরিয়ে গেছে। অমরের বুশ—শার্টটা ময়লা। ফুলপ্যান্টটা ঢলঢলে। দেখেই বোঝা যায় বহুদিন সাবানে কাচা হয়নি।
অনন্ত এবং অমর যে ফুলপ্যান্ট পরে আছে সে—দুটি তাদের বাবার। দুই ভাইয়ের মাপ একই। চার মাস আগে বাবার দু—জোড়া জামা—প্যান্ট দর্জিকে দিয়ে ছোটো করিয়ে নিয়েছিল। এখনও একটা প্যান্ট রয়েছে। সেটা ছোটো করিয়ে অমরকে দেবে। বাবার একজোড়া ধুতি আর একটা পাঞ্জাবি আলমারিতে পড়ে আছে। অনেকদিনই সে ভেবেছে প্যান্টগুলো অমরকে দিয়ে সে ধুতি পরবে। পাঞ্জাবি তার দরকার নেই। ওটা দিয়ে মায়ের ব্লাউজ হয়তো হতে পারে।
অমরের পাশ দিয়ে যাবার সময় ওরা কথা বন্ধ করল। দু—জন তার মুখ চেনা, অমরের ক্লাসেই পড়ে। তৃতীয়জনকে সে চেনে না। মুখে আলতো হাসি ফুটিয়ে সে একবার শুধু তাকাল মাত্র, যেভাবে বয়স্করা ছোটোদের দিকে তাকায়।
যাতে উনুন কামাই না যায় সেজন্য অনন্ত বাজারে যাবার পর শীলা উনুনে আঁচ দেয়। উনুন ধরে উঠতে উঠতে বাজার এসে যায়। দু—বেলার রান্না সে সকালেই সেরে নেয় কয়লা খরচ কমাতে।
অনন্ত যখন ফিরল শীলা তখন হাঁড়িতে ফুটন্ত জলে চাল ঢালছে।
‘বাবার একটা ধুতি বার করে দাও তো।’
‘কী করবি?’
শীলা বাষ্প থেকে মুখ সরিয়ে তাকাল।
‘পরবি?’
‘হ্যাঁ।’
‘তুই বার করে নে না।’
ধুতি—পাঞ্জাবি কাচিয়ে তোলা ছিল। পুরোনো হলেও ব্যবহার কম হয়েছে। অনন্ত পাট ভেঙে ধুতিদুটো তক্তাপোশের উপর ছড়িয়ে দিল। দু—তিন জায়গায় ফুটো, বোধহয় পোকায় কেটেছে।
অমর ঘরে ঢুকল। ধুতির দিকে একবার তাকিয়ে সে পিছন ফিরে তাক—এ বইখাতা গোছাতে লাগল। অনন্তের মনে হল সকলেরই জামা ফ্রক প্যান্ট থানকাপড় দরকার আর সে কিনা আস্ত দুটো ধুতি পেয়ে যাবে!
‘দুটো রয়েছে, তুই একটা নিবি নাকি?’
‘নাহ ধুতি আমার চলবে না তা ছাড়া কেমন যেন বুড়োটে দেখায়।
অনন্ত অপ্রতিভ বোধ করল। তাকে কি সত্যিই বুড়ো দেখাবে? তার বয়সি কেউ ধুতি পরে এমন কাউকে তার মনে পড়ছে না।
‘তোর জুতোটা একদম গেছে।’
অমর জবাব দিল না। চেয়ারে বসে সে একটা বইয়ের উপর ঝুঁকে পড়ল।
‘জুতো কেনার মতো টাকা তো হাতে নেই, আমি যা পাই তাতে একমাসের চালও কেনা যাবে না।’
অমর বই থেকে চোখ সরাল না। অনু ঘরে ঢুকল।
‘দাদা, আমার পেনসিলটা নিয়েছিস?’
‘হ্যাঁ, এই নে।’
অনু বেরিয়ে গেল। ওর ফ্রকের পিঠের বোতামগুলো নেই, একটিমাত্র সেফটিপিন দিয়ে আটকানো। অনন্ত পাট মিলিয়ে ধুতিদুটো ভাঁজ করতে লাগল।
ভাত খাবার সময় শীলা বলল, ‘চুড়িটা বিক্রি না করলে তো আর চালানো যাচ্ছে না, কয়লাওলা এসেছিল, দু—মাস ওকে কিছু দেওয়া হয়নি, বলে গেল আর কয়লা দেবে না।’
‘কত পাবে?’
‘সাড়ে আট টাকা।’
‘তোমার কাছে যা আছে তাই থেকে দিয়ে দাও।’
‘বাকি দিনগুলো যে কী করে…’
মালকোঁচা দিয়ে ধুতি তার উপর নীল শার্ট। অনন্ত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করল তাকে বুড়োটে দেখায় কি না। শীলার দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘কেমন যেন দেখাচ্ছে!’
‘কেন ঠিকই তো আছে।’
‘জামাটা ময়লা, ধুতির সঙ্গে মিলছে না।’
‘রাতে সাবান দিয়ে কেচে দোব।’
‘ওদের জন্য এবার কিছু কিছু কেনা দরকার…চুড়িটা থেকে কত পাবে?’
‘আটগাছা চুড়ি, হার, তোর বাবার আংটি, বোতাম নিয়ে চারভরি সোনা বিয়েতে দিয়েছিল। চুড়িগুলোয় আছে ছ—আনা করে।’
‘এতে কতদিন আর চলবে, অমর রোজগেরে হতে হতে এখনও পাঁচ—ছ—বছর তো লাগবেই।’
‘ভগবান ঠিক চালিয়ে দেবেন।’
বেরোবার সময় শীলা তাকে চার আনা আর কাগজে মোড়া চারখানা আটার রুটি দিল। ট্রামে—বাসে না চড়ে অনন্ত প্রায় একমাইল পথ হেঁটেই যাতায়াত করে। গলি দিয়ে যাবার সময় তার মনে হল সবাই যেন তার দিকে তাকাচ্ছে। পাড়ার কোনো লোকের সঙ্গে তার কথাবার্তা বলার মতো আলাপ নেই। সমবয়সিদের সঙ্গেও দরকার না হলে সে কখনো কথা বলে না। সবাই জানে সে কুনো, মুখচোরা, অমরের ঠিক উলটোটি।
দূর থেকে অনন্ত দেখল গৌরী সুলভ পুস্তক ভাণ্ডারের কাউন্টারে দু—গ্লাস চা রেখে ফিরে যাচ্ছে। তার বুকের মধ্যে হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠল। চায়ের দোকানের বেঞ্চে সেই ছোকরাটাও বসে রয়েছে যাকে সে সকাল—সন্ধ্যা যাতায়াতের সময় প্রায়ই দেখে। বছর পঁচিশ বয়স হবে। ডিগডিগে, লম্বা, ফরসা চেহারা। চোখা নাক। চুলে তেল নেই, সামনের দিকটায় ঢেউতোলা। ঘাড় কামানো। টেরিলিনের কালো প্যান্ট, ছুঁচলো জুতোটায় পিতলের বকলেস। গায়ে লাল গোলগলা ঝকমকে গেঞ্জি। কোনোদিন পরে সাদা ফুলশার্ট। একদিন তার কানে এসেছিল ছোকরাটি গৌরীর বাবাকে বলছে, ‘কাকাবাবু, একদিন খিদিরপুরে আমার সঙ্গে চলুন, মাল দেখুন…’
ছোকরা এখানে কেন বসে থাকে? গৌরীর জন্য? অনন্ত একটু দমে গেল। ছোকরার জামাপ্যান্ট জুতো ঝকঝকে দামি, পরিপাটি, দেখতেও ভালো, কথা বলে ঝরঝরে। অনন্ত নিজের সঙ্গে তুলনা করার কোনো চেষ্টাই করল না। চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে যাবার সময় সে আড়চোখে দেখল ছোকরার দিকে তাকিয়ে গলার সবুজ পাথরের মালাটা বুড়ো আঙুল দিয়ে টেনে ধরে গৌরী হাসছে…’বাবা বাজার থেকে কিন্তু এখুনি এসে যাবে, খুলে রাখি?’
অনন্ত সামনের দিকে তাকিয়ে হেঁটে গেল। চাওয়ালার মেয়েকে নিয়ে আর সে মাথা ঘামাবে না। কিন্তু মনের মধ্যে একটা জ্বালা সে অনুভব করছে। কিছু একটা যেন সে চেয়েছিল অথচ সেটা তাকে দেওয়া হল না। কারোর কাছ থেকে কিছু পাওয়ার মতো দাবি বা অধিকার তার কোথাও নেই। গৌরী সম্ভবত ভালো করে কখনো তাকে লক্ষও করেনি। তার ভালো লেগেছে মানেই যে গৌরীরও ভালো লাগবে এমন কোনো কথা নেই।
দুপুরে আলুর দম নিয়ে সে মাথা নীচু করে রুটি দিয়ে খাচ্ছিল। বেঞ্চে তার পাশে মোটর গ্যারাজের দু—জন। তারা পাঁউরুটি কিনে এনেছে। এখন রাস্তায় লোক চলাচল কম। লোকদুটো কথা না বলে খেয়ে যাচ্ছে। বাঁশ দিয়ে খাড়া—করা ত্রিপলের ছায়ায় একটা টুলে গৌরী বসে। খেতে খেতে অনন্ত একবার মুখ তুলে তাকাতেই চোখাচোখি হল। হাতায় আলুরদমের ঝোল নিয়ে গৌরী উঠে এসে তার প্লেটে ঢেলে দিল।
‘না না, আর দরকার নেই।’
‘দুটো রুটি খেতে খেতেই তো ঝোল ফুরিয়ে গেল, বাকি রুটিগুলো কি শুকনো চিবোবে?’
অনন্ত হাসবার চেষ্টা করল। ওর গলায় সবুজ মালাটা নেই দেখে তার ভালো লাগল। মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা স্বস্তি পাচ্ছে।
‘ওব্যেস নেই দুপুরে রুটি খাওয়ার।’
‘তা হলে ভাত নিয়ে আস না কেন? অনেকেই তো আনে টিফিন কেরিয়ারে।’
‘ভাত আমি খেয়েই আসি।’ অনন্ত কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে আবার বলল, ‘আমাদের টিফিন কেরিয়ার নেই।’
‘দশরথের ভাতের হোটেলে তো খেতে পারো।’
অনন্ত চুপ করে খেয়ে যেতে লাগল। হোটেলে ভাত খাবার পয়সা নেই বলতে তার কুণ্ঠা হল। প্রসঙ্গ বদলাবার জন্য সে বলল, ‘তোমার বাবা খেতে গেছে?’
‘আমি খেয়ে এলে বাবা খেতে যায়। বাবা ফিরে এলে আমি ঘরে যাব। আজ অবশ্য সিনেমায় যাব।’ গৌরী হাসল। অনন্তের মনের মধ্যে গুমোট জমে ভারী হয়ে উঠল। নিশ্চয় সেই ছোকরাটার সঙ্গেই যাবে। ওর বাবার কি এতে সায় আছে? থাকতে পারে। হয়তো ওর সঙ্গে গৌরীর বিয়েও দেবে।
‘একা যাবে?’
কথাটা বলেই অনন্ত লজ্জা পেল। সামান্য এইটুকু আলাপে এমন প্রশ্ন করা উচিত হয়নি। মুখ থেকে হঠাৎ—ই বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু গৌরী এমন গায়েপড়া কৌতূহলে যেন খুশিই হল।
‘একা একা সিনেমা দেখতে আমার ভালো লাগে না।’
‘আমারও। অবশ্য সিনেমা আমি খুব কমই দেখি, যুদ্ধের বই দেখতেই ভালো লাগে।’
লোকদুটো দাম চুকিয়ে চলে গেল। দর্জির দোকান থেকে হাঁক শোনা গেল, ‘একটা চা দিয়ে যাস গৌরী।’
‘আমার ভালো লাগে রগড়ের বই দেখতে।’
‘চার্লি চ্যাপলিনের বই দেখেছ? আমাদের স্কুল থেকে একবার দেখাতে নিয়ে গেছল, দারুণ হাসির।’
‘স্কুলে পড়তে?’ গ্লাসে লিকার ঢালতে ঢালতে গৌরী বলল।
‘হ্যাঁ।’
‘পড়া ছাড়লে কেন?’
‘সংসার চালাতে হবে তো। বাবা হঠাৎ বাসচাপা পড়ে মারা গিয়ে…দুটো বোন একটা ভাই আর মা রয়েছে।’
গৌরী চামচ নাড়া বন্ধ রেখে ওর দিকে তাকাল। ও—চোখে সহানুভূতি, দরদ। অনন্তের গুমোট কেটে যাচ্ছে।
‘তুমিই বড়ো?’
‘হ্যাঁ। বড়োছেলেরাই তো বাবার জায়গা নেয়।’
ভারী গলায় কথাটিকে কেটে কেটে বলল। বলার সময় গৌরীর মুখের ভাব লক্ষ করছিল। কিছু বুঝতে পারল না।
দর্জির দোকানে চা দিয়ে ফিরে এসে গৌরী বলল, ‘বাবা টাকাকড়ি রেখে যায়নি?’
‘কিচ্ছু না শুধু তেরো হাজার টাকা পেয়েছি প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে, বোনেদের জন্য তোলা আছে, আর মায়ের ভরিচারেক গয়না।’
গৌরীর বাবাকে আসতে দেখে অনন্ত বেঞ্চ থেকে উঠল। পয়সা দেবার জন্য শার্টের পকেটে হাত ঢোকাতেই গৌরী চাপাস্বরে দ্রুত বলল, ‘দিতে হবে না।’
অনন্ত কয়েক সেকেন্ড বিভ্রান্তের মতো তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে কমলা বাইন্ডার্সের দিকে এগোল। বলতে গেলে গৌরীর সঙ্গে এই তার প্রথম পরিচয় অথচ এত কথা সে যে বলতে পারল, এটাই তাকে অবাক করছে। মেয়েটার চাহনিতে কী যেন একটা আছে যা তাকে সাহসী করে দিল। কিন্তু তাই বলে বিনি পয়সায় আর সে খাবে না, একবারই যথেষ্ট বরং কিছু একটা উপহার দিয়ে সে শোধ দেবে।
সন্ধ্যায় অনন্ত বাড়ি ফেরার সময় হাতিবাগানে একটা রেস্টুরেন্টে গৌরী আর সেই ছোকরাকে দেখতে পেল। টেবলে পাশাপাশি ওরা। ছোকরা প্লেটের দিকে মুখ নামিয়ে কাঁটা চামচে মাংখখণ্ড গাঁথায় ব্যস্ত। রাস্তার দিকে একবার যেন তাকাল। অনন্তকে বোধ হয় দেখতে পায়নি কিন্তু সে ওর গলায় সবুজ মালাটা দেখতে পেয়েছে। গৌরীর পরনে হলুদ রঙের শাড়ি।
ক্লান্ত, মন্থর পায়ে যখন সে বাড়ি পৌঁছোল তখন নিজেকে তার মনে হচ্ছিল বুড়ো হয়ে গেছে।
কে বা কারা যেন বলেছি, ‘অনন্ত খুব ভালো ছেলে।’ তখন তার বয়স কত ছিল? সাত, আট, হয়তো নয়। তখন তার চারপাশের জগৎ ধীরে ধীরে জীবন্ত হয়ে উঠছিল; তখন মানুষজন সম্পর্কে সচেতনতা শুরু হচ্ছিল, তাদের সে আলাদা আলাদা করে বুঝে প্রত্যেককে নিজস্ব ছকের মধ্যে দেখতে পাচ্ছিল। এখন থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগের ঘটনা মনে করতে গিয়ে তার মনে হচ্ছে স্মৃতি যেন তার সঙ্গে চালাকি করছে। বহু মানুষ, বহু ঘটনা ধূসর হয়ে গেছে, কিছু কিছু মানুষ চেতনায় রয়েছে আলোকিত কুয়াশার মতো।
একা নির্জন অন্ধকার ঘরে অনন্ত তার অতীতের দিকে দৃষ্টি রাখতে গিয়ে মানুষ, ঘটনা, দৃশ্য, শব্দ, রং এখন আর আলাদা করতে পারছে না। রেবতীর চলে যাওয়াটা তাকে যতটা নাড়া দিয়েছে একদা গৌরীর জন্য তার হৃদয় কি এইভাবেই মুচড়ে উঠেছিল? অমর যেদিন বলল, ‘আমি আর এখানে থাকব না’ সেদিনও কি এমন করে অসাড় হয়ে গেছল তার অনুভব ক্ষমতা।
অমরকে সে চড় মেরেছিল। কারণটা আজও তার মনে আছে। স্কুল ফাইনালে প্রথম পঁচিশজনের মধ্যে অমর স্থান পেয়েছিল। অবিনাশকাকা এক বাক্স সন্দেশ কিনে এনেছিল। শীলা উপরে জেঠিমাদের কয়েকটা দিয়ে আসে, সামনে উৎপলদের বাড়িতেও অনন্ত নিজে গিয়ে পাঁচটা সন্দেশ দেয়। উৎপলের দাদু অবাক হয়ে বলেছিল, ‘তিনটে লেটার পেয়েছে, বলিস কী!’
তার এক সপ্তাহ পরেই দাদু মারা যায়। হাই ব্লাডপ্রেশার ছিল, হৃৎপিণ্ডও বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছে গেছল। বিকেলে বারান্দায় চেয়ারেই চলে পড়ে। দামি খাটে, প্রচুর ফুলে সাজিয়ে, সংকীর্তন করে ওকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। অমরও সঙ্গে গেছল। শ্রাদ্ধে অনন্তদের সবাইকে নিমন্ত্রণ করে গেছল উৎপল। পরিবেশনকারীদের অন্যতম ছিল অমর। প্রায় আটশো লোক নিমন্ত্রিত হয়েছিল। কাপড় দিয়ে রাস্তার অর্ধেকটা ঘিরে টেবলে খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। সেদিন অনু মায়ের পুরোনো সিল্কের শাড়ি পরেছিল। অলু উপর থেকে ইস্ত্রি এনে বাড়িতে কাচা ফ্রকটাকে মোটামুটি কাজের বাড়িতে যাওয়ার যোগ্য করে তুলেছিল। অনন্ত নিজেদের সদরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল, খাওয়া শেষ করে একদল বেরিয়ে এলে নতুন পাত পড়ামাত্র গিয়ে বসে পড়বে। তখন অমর তার পাশ দিয়েই বাড়িতে ঢোকে। সে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কী রে, চলে এলি যে?’ অমর অস্পষ্ট স্বরে কী যেন বলেছিল।
নিমন্ত্রণ খেয়ে বাড়ি ফিরে সে মায়ের কাছে কীভাবে তার সামনের লোকটি বাজি ধরে চল্লিশটা রসগোল্লা টপটপ খেয়ে গেল সেই গল্প করছিল, ‘ভাবতে পারবে না, লোকটা এই টিংটিঙে। বাজি ছিল তিরিশটা, দশটা বেশি খেল!’
অনু বলল, ‘কী বাজি ছিল?’
‘এক টাকা!’
‘মা—ত্ত—র!’
তখন মা হঠাৎ বলে ফেলে, ‘অমর অনেকগুলো সন্দেশ এনেছে।’
সে প্রথমে বুঝতে পারেনি। তারপরই খটকা লাগতে জিজ্ঞাসা করে, ‘কীভাবে আনল? ওরা কি অমরকে দিয়েছে?’
‘দেবে কেন। এমনিই এনেছে।’
‘এমনি, এমনি মানে? নিশ্চয় লুকিয়ে এনেছে…চুরি করে এনেছে।’
মা—কে চুপ করে থাকতে দেখে অনন্ত রাগে দাউদাউ করে উঠেছিল।
‘চোর! আমার ভাই চোর! সামান্য ক—টা সন্দেশের লোভ আর সামলাতে পারল না?’
সে লাফিয়ে উঠেছিল। ছুটে রান্নাঘরে গিয়ে বাসন ছুড়ে ছুড়ে খুঁজছিল।
‘নিশ্চয় কেউ—না—কেউ ওকে সন্দেশ সরাতে দেখেছে।…আমাদের সবাইকে চোর ভাবছে…চোরের ফ্যামিলি…’
‘তুই অমন কচ্ছিস কেন…পাগল হলি নাকি?’
শোবার ঘরের তাকে কাগজে মুড়ে রাখা ছিল প্রায় গোটা কুড়ি সন্দেশ। চাপ খেয়ে দলা পাকানো। মা সেটা অনন্তের হাতে তুলে দিতেই সে ছুটে বেরিয়ে যায় উৎপলদের বাড়িতে।
‘কাকাবাবু এগুলো নিন, অমর বাড়িতে নিয়ে গেছল।’
উৎপলের বাবা অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘কী ব্যাপার?’
‘অমর এগুলো বাড়িতে নিয়ে গেছল।’
‘চুরি’ শব্দটা বলতে গিয়েও বেধে গেল গলায়। কাঁধে হাত রেখে উৎপলের বাবা মৃদুহেসে বলেছিল, ‘আরে দূর, ছেলেপুলেরা এরকম একটু—আধটু করে থাকেই, ফেরত দেবার কী দরকার। ও তুমি নিয়ে যাও।’
‘না, আমরা নিতে পারব না।’
টেবলে তখন কাগজ বিছানো হচ্ছে, অমর কলাপাতা হাতে অপেক্ষা করছিল। অনন্ত ছুটে গিয়ে সন্দেশমোড়া কাগজটা টেবলে রাখল। দলাপাকানো কাগজটার ফাঁক থেকে সন্দেশ দেখা যাচ্ছে। সেইদিকে তাকিয়েই অমরের মুখ থেকে রক্ত সরে গেল। সে ফ্যালফ্যাল করে তার আশেপাশের কৌতূহলী মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে হাতের কলাপাতাগুলো টেবলে নামিয়ে দিল।
‘ছেলেটা সত্যিই ভালো।’
কে যেন তখন বলছিল। অনন্ত কোনোদিকে আর তাকায়নি। বাড়িতে এসে গুম হয়ে দালানে বসে থাকে। একটু পরেই অমর আসে।
‘ভালো ছেলে সার্টিফিকেট নেবার জন্য আমাকে এভাবে ডোবালে কেন? আমি পাড়ায় মুখ দেখাব কী করে?’
অনন্ত উঠে দাঁড়াল। কয়েক সেকেন্ড পর বিরাজমান নৈঃশব্দের মধ্যে চড়ের শব্দটা তীক্ষ্ন হয়ে উঠল। অমর কোনো কথা না বলে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। একটু পরে অনন্ত ওর পাশে গিয়ে শোয়।
অমর দু—দিন ঘর থেকে বেরোয়নি। তৃতীয় দিন দুপুরে কোথায় যেন যায়, ফিরে আসে অনেক রাতে যখন পাড়া নিশুতি হয়ে গেছে। মা শুধু বলেছিল, ‘ভাত তোলা আছে, খাবি?’
ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই অনন্ত শুনতে পায় দালানে কথা বলছে মা আর অমর।
‘আমি এখানে আর থাকব না, চলে যাচ্ছি।’
‘কোথায় যাবি?’
‘ব্যবস্থা করে এসেছি।’
‘ব্যবস্থা?’
‘এন্টালিতে একজনের বাড়িতে থাকব, তার দুটো বাচ্চচা ছেলেকে পড়ানো, দেখাশোনার কাজ করতে হবে।’
‘তোর নিজের পড়াশুনো?’
‘করব।’
অনন্ত শুনতে শুনতে অসাড় হয়ে গেল। তার মনে হল অমর আর কোনোদিনই এই সংসারে ফিরে আসবে না, চিরকালের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কেন? বরাবরই ও আলগাভাবে ছিল এই সংসারের সঙ্গে। কিছুটা স্বার্থপর, কিছুটা উদাসীন। সবাই বলে ট্যালেন্টেড। ওকে বই নিয়ে পড়তে বিশেষ কেউ দেখেনি, অথচ ভালো রেজাল্ট করেছে। অনন্তের আশা ছিল, অমর ভালো চাকরি করে সচ্ছলতা আনবে, অন্তত বাবার থেকে বেশি রোজগার করবে।
সন্দেশগুলো ফিরিয়ে না দিলে অমর থেকেই যেত। সে কি অন্যায় কাজ করেছে? অনন্ত দু—দিন ধরে উত্তর খুঁজেছে। অমরের ধারণা ভালো ছেলে সাজার জন্য সে কাজটা করেছে। ভগবান জানে, মোটেই তা নয়। এইরকম কিছু দেখলে তার ভিতরে অসহ্য একটা চাপ তৈরি হয়, অস্থিরতা জাগে। সেটা বার করে না দিলে তার মনে হয় দম ফেটে মরে যাবে।
তার তখন দশ—এগারো বছর বয়স। পাড়ার সর্বজনীন দুর্গাপুজোয় তারা কয়েকজন সমবয়সি ভলান্টিয়ার হয়েছিল। প্যান্ডেলের একধারে সাবিত্রী—সত্যবানের মূর্তি রাখা ছিল। প্রতিমা দেখার পর মেয়েরা সরায় রাখা সিঁদুর সাবিত্রীর মাথায় ছুঁইয়ে নিজেদের সিঁথিতে দিত। সামনে রাখা থালায় পয়সা ফেলত। নানান আকারের রেজগিতে থালাটা ভরে উঠত দু—তিন ঘণ্টাতেই। দশ পয়সা থেকে সিকি—আধুলি, দু—টাকা, এক টাকার নোটও থালায় পড়ত। যুগলদা থালাটা তুলে নিয়ে নতুন একটা থালা রেখে যেত।
নবমীর দুপুরে অরবিন্দই বলেছিল, ‘পার্কে নাগরদোলা বসিয়েছে, চাপবি?’
‘পয়সা নেই।’
অরবিন্দের মামাতো ভাই পুজোয় বেড়াতে এসেছিল পাটনা থেকে। নাম ছিল নন্দন। তার কাছে ছিল একটা সিকি।
‘দশ পয়সা এক—এক বারে। আরও তো পয়সা চাই।’
অরবিন্দ আর নন্দন নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে অনন্তকে বলল, ‘তুই এইদিকটা আড়াল করে দাঁড়া।’
‘কেন?’
‘যা বলছি শোন।’
তিনদিক ত্রিপল দিয়ে ঢাকা ছোট্ট একটা ঘরে দু—হাত লম্বা সাবিত্রী হাতজোড় হাঁটু গেড়ে ভগবানকে ডাকছে, তার পাশে শোয়ানো সত্যবান। সামনে বাঁশের বেড়া। দুপুরে ভিড় প্রায় নেই—ই। চৌকিতে রাখা ক্যাশবাক্সে মাথা রেখে অন্যদিকে মুখ করে কোষাধ্যক্ষ যুগলদা আধশোয়া। দুটি ছেলে রেকর্ড বাজাচ্ছে।
‘পিছন ফিরে বাঁশে হেলান দিয়ে এদিকে মুখ করে দাঁড়া।’
অনন্ত ওর কথা—অনুযায়ী দাঁড়িয়েছিল। নন্দন তার পাশে দাঁড়াল। অরবিন্দ বাঁশের উপর ঝুঁকে খুব মন দিয়ে সাবিত্রীর দিকে তাকিয়ে। ওর হাতে একটা রুমাল। অনন্ত দেখল, রুমালটা হাত থেকে হঠাৎ থালার উপর পড়ল। অরবিন্দ দু—পাশে তাকিয়ে নীচু হয়ে এক লহমায় রুমালটা মুঠো করে তুলে প্যান্টের পকেটে রাখল।
অরবিন্দ মন্থরভাবে প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় কর্পোরেশনের খাবার জলের ট্যাঙ্কের পাশে দাঁড়িয়ে হাতছানি দিয়ে তাদের দু—জনকে ডাকল।
‘চল।’
‘না, যাব না।’
‘নাগরদোলায় চাপবি না?’
‘না। আমি দেখেছি অরবিন্দ রুমালের সঙ্গে পয়সাও তুলল।’
‘আমরা ওমলেটও খাব। তাড়াতাড়ি আয়।’
অনন্ত যায়নি। ওরা দু—জন দূর থেকে বার বার হাতছানি দিয়ে ডেকে তার জন্য অপেক্ষা করেছিল। সে মাথা নেড়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকে। তখন তার ভয় করছিল। যদি কেউ দেখে থাকে? সারা পাড়ার লোক জেনে যাবে, রাস্তায় বেরোলেই লোকেরা আঙুল দিয়ে দেখাবে, কীরকম চোখে যেন তাকাবে। তার থেকেও বড়ো কথা বাবা, মা লজ্জায় পড়বে।
প্যান্ডেলের সামনের বাড়ির ঝি দোতলার জানালা থেকে দেখেছিল। সে বলে দেয় যুগলদাকে।
‘পয়সা সরিয়েছে ওরা?’
‘কী জানি, আমি দেখিনি।’
‘তুই তো ওদের সঙ্গেই দাঁড়িয়েছিলি।’
‘হ্যাঁ, তবে আমি দেখিনি।’
পুজো কমিটির তিন—চারজন তখন হাজির ছিল। তারা নিজেদের মধ্যে চাপা স্বরে আলোচনা করছিল। একবার তার কানে এল—’না না এ—ছেলেটা ভালো…দলে নেই।’
পরদিন অরবিন্দ আর তার মামাতো ভাইকে ডাকিয়ে এনে প্যান্ডেলে কান ধরে ওঠ—বস করানো হয়। তার দু—দিন পর ওরা দু—জন অনন্তকে সন্ধ্যার সময় ধরেছিল গলির মুখে।
‘তুই বলে দিলি কেন?’
‘না বলিনি।’
‘বলিসনি?’
অরবিন্দ তার পেটে এক ঘুসি মারল। সে পেট চেপে ধরে কুঁজো হতেই, ওরা দু—জনে এলোপাতাড়ি ঘুসি চালাল তার বুকে—পিঠে—মাথায়। সে দু—হাত তুলে যতটা সম্ভব আটকাতে চেষ্টা করে। একবারও পালটা আঘাত করার চেষ্টা করেনি বা পালাতে চায়নি।
‘ভালো ছেলে সাজা হচ্ছে? বলিসনি…তুই বলিসনি?’
‘না, আমি বলিনি।’
ওরা আবার ঘুসি চালিয়েছিল। সেইসময় পাড়ারই একজন দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে ধমক দেয়। ওরা দু—জন সরে যাবার সময় শাসায়, ‘আচ্ছা, পরে আবার ধরব, যাবি কোথায়?’
অরবিন্দ আর তাকে কিছু বলেনি। তার ঠোঁটের কোণের রক্ত দেখে মা ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সে কারণটা বলেনি।
‘হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছি।’
‘দেখে চলবি তো?’
অনন্ত তখন হেসেছিল। মানসিক আনন্দের প্রতিচ্ছায়ার মতো এমনই অস্পষ্ট যে লক্ষই করা যায় না হাসিটা। সেইদিন থেকে তার হৃদয়ের অন্তস্থলে দ্রুত একটা কী যেন পরিবর্তন ঘটে গেছল। পাড়ার বা স্কুলের ছেলেদের সঙ্গে সে আর মিশত না। স্কুল থেকে ছেলেরা ছোটো ছোটো দলে বাড়ি ফিরত। সে ফিরত একা। যা তার চোখে পড়ত, বাসে ঝুলন্ত মানুষ, বৃষ্টি, বারান্দায় ঝোলানো খাঁচায় পাখি, নর্দমার নোংরা জল সব দেখত।
‘ভালো ছেলে’। সেদিন পুজো প্যান্ডেলে কে যেন বলেছিল। কিন্তু সে ‘ভালো ছেলে’ কেন? অরবিন্দের মতো সে পয়সা চুরি করতে পারেনি। সততার জন্য জন্য নয়, আসলে তার ইচ্ছা হয়নি কিংবা সাহসে কুলোয়নি বলেই।
অরবিন্দই স্কুলে তার সম্পর্কে চাউর করে দেয়—ভালো ছেলে। তার মতো আরও অনেকে তখন বলতে শুরু করে। সে শুধু হাসত আর সেখান থেকে সরে যেত।
‘অনন্ত সাধু হয়ে যাবে। বাজি ধরে বলছি।’
ক্লাসে একদিন ছেলেরা তার পিছনে লেগেছিল। সে মুখে হাসি ফুটিয়ে শুধু শুনে গেছল। হয়তো তার হাসিটা খাঁটি ছিল না কিন্তু শান্ত নিরাসক্ত একটা ভাব তাতে ছিল।
‘ওকে চড় মেরে দেখ, কিছছু বলবে না।’
একজন তার গালে আলতো করে চড় মারে। সে তখনও হাসছিল।
অমরও তাকে ‘ভালো ছেলে’ বলল, কিন্তু সত্যিই কি সে তাই? সে ভিতু আর মুখচোরা বলেই কি সবার আগে নিরাপদ হবার জন্য ভালো ছেলে সাজে?
ঘর থেকে বেরিয়ে সে দেখল মা দেওয়ালে ঠেস দিয়ে একদৃষ্টে উঠানের দিকে তাকিয়ে।
অনন্ত অপরাধীর মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কলতলায় গেল মুখ ধুতে। ফিরে এসে দেখল মা একইভাবে বসে।
‘আমি কি অন্যায় করেছি?’
মা একবার মুখ তুলে তাকাল। অনন্তের মনে হল সেই চাহনিতে যেন বলা হয়েছে—ন্যায়—অন্যায় বিচার করে কী লাভ?
‘ও চলেই যেত, আজ নয়তো কাল।’
কয়েক ঘণ্টা পর অনন্ত চায়ের দোকানটার সামনে দিয়ে যাবার সময় দেখল সেই ছোকরা, পরে জেনেছে ওর নাম রমেন, বেঞ্চে বসে সিগারেট খাচ্ছে, হাতে চায়ের গ্লাস ভ্রূ কুঁচকে বিরক্তমুখে লোক—চলাচল দেখছে। দোকানে গৌরী নেই। এই নিয়ে গত এগারো দিন গৌরী অনুপস্থিত।
দুপুরে একটা ছোটো ছেলেকে সে দোকানে দেখল। মুখের আদল আর গায়ের রং থেকে তার মনে হল বোধ হয় গৌরীর ভাই। তবু নিশ্চিত হবার জন্য সে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমাকে আগে দেখিনি তো, তোমাদের দোকান?’
‘হ্যাঁ।’
‘গৌরী কে হয়?’
‘দিদি।’
‘ও আজ এল না যে?’
‘দিদির বিয়ে।’
অনন্ত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কবে?’
অপরিচিতের সঙ্গে ছেলেটি যেন এই বিষয়ে কথা বলায় অনিচ্ছুক। অনন্ত আর কৌতূহল দেখাল না। তার মনে হল, রমেনের সঙ্গে নয়, অন্য কোথাও গৌরীর বিয়ের ব্যবস্থা হয়েছে। তা যদি হয় তা হলে ভালোই। রমেনকে তার ধাপ্পাবাজ ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি। তবে সে বিষণ্ণবোধ করল, গৌরীকে আর দেখতে পাবে না। এইরকম বিষণ্ণতা অমর সম্পর্কে তার হয়নি। এটি তার একান্ত ব্যক্তিগত অন্যটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্বার্থ। অমর রোজগার করে তার বোঝা হালকা করে দেবে এ ছাড়া আর কোনো প্রত্যাশা ওর কাছে নেই।
চার
দু—দিন পর বৃষ্টি হচ্ছিল সন্ধ্যাবেলায়। অনন্ত আমহার্স্ট স্ট্রিটে একটা গাড়ি বারান্দার নীচে দাঁড়িয়েছিল ভিড়ের একধারে। রাস্তার কিনারে জল জমে গেছে। বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে জলে ফুটপাথ, রাস্তা এবার ডুবে যাবে। মাঝে মাঝে দমকা বাতাস বৃষ্টির ছাট আসছে আর মানুষগুলো পিছিয়ে এসে জমাট হচ্ছে। রাস্তায় আলো কম, গাড়িও কম, লোকজন নেই বললেই চলে। স্টপে বাস এসে দাঁড়ালে এখান ওখান থেকে ছুটে এসে লোক উঠছে।
সেই সময় গৌরীকে ছুটে গাড়ি বারান্দার নীচে আসতে দেখে তার বুকটা ধক করে উঠল। বোধ হয় বাস থেকে নামল। অনন্তকে দেখতে পায়নি। ওর কপাল, গাল, বাহু, থুতনি বেয়ে জল ঝরছে। আঙুল দিয়ে টেনে কপাল থেকে জল মুছে গৌরী পিছনে তাকাল।
‘আরে!’
অনন্ত হাসল। সামান্য ইতস্তত করে গৌরীর পাশে এল। চোখে পড়ল গলার সবুজ মালাটা। গলা থেকে কোমর পর্যন্ত ফ্রকটা লেপটে রয়েছে। স্তনের ডৌল এমনকী বোঁটাও ব্রেসিয়ারের মধ্য দিয়ে এত স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে যে অনন্তের মনে হল ওর সর্বাঙ্গে যেন কোনো আবরণ নেই।
অনুও বড়ো হয়ে উঠেছে। তেরো বছরের হল। গৌরীর মতো এমন ভাপিয়ে ওঠা শরীর নয় তবু ওর বুক চোখে পড়ে। কয়েকদিন আগে সে ঘরের মধ্যে হঠাৎ ঢুকে পড়েছিল। অনুর পরনে তখন শুধুমাত্র সায়া, একটা হাত সবে ব্লাউজের মধ্যে গলিয়েছে। তাকে দেখেই কুঁকড়ে তাড়াতাড়ি পিছনে ফিরে যায়। ছি ছি কী ভাবল। অপ্রতিভ হয়ে সে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দরজায় এসে মা—র সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে।
‘এখানকার কাজটা ছেড়ে দেব ভাবছি।’
‘কেন!’
‘দূর, এসব কাজ শিখে কি উন্নতি করা যায়! পঁচিশ—তিরিশ বছর কাজ করছে এক—একজন আর মাইনে কিনা দুশো—আড়াইশো।’
‘তা হলে কী করবি?’ ভয়ে ভয়ে মা বলেছিল। ‘তবু কয়েকটা টাকা তো আসছে।’
‘চল্লিশ আবার টাকা নাকি? গয়নাগুলোর কিছুই তো আর রইল না, এরপর…’
‘পোস্টাপিসের কাগজ না ভাঙালে আর তো কোনো উপায় নেই। দাসেদের বাড়িতে কাজটা নিলে তবু…এখন আর অত মানসম্মান দিয়ে কী লাভ? ভগবান যখন যে—অবস্থা দেবেন সেইভাবেই তখন চলতে হবে।’
‘টাকাটা অনু—অলুর বিয়ের জন্য।’
‘বারবার তুই ওই বলিস। খেতে—পরতে পাচ্ছি না আর বিয়ের জন্য টাকা রেখে দেওয়া। রাখোতো ওসব কথা। যেমন ভাগ্য করে এসেছে তেমনি বিয়ে হবে। কবে তুই আয় করবি, অমর করবে, তার জন্য অপেক্ষা করে কি সংসার চলবে? অনুকে স্কুল ছাড়িয়ে দেব, মিছিমিছি টাকা নষ্ট করা। ও নিজেও আর পড়তে চাইছে না।’
‘সে কী, ছেড়ে দেবে পড়া?’
অনন্ত মর্মাহত হয়েছিল। অনু তখন শাড়ি পরে এসে দাঁড়িয়েছে।
‘আর পড়বি না?’
‘না।’
অনুর স্বরে জেদ ছিল। সংসারকে সাহায্য করতে চায়। কিন্তু ক—টা টাকাই বা তাতে বাঁচবে? ভালো ঘর—বর পাবার কোনো যোগ্যতাই ওর নেই। সাদামাটা, স্বাস্থ্য নেই, চটক নেই, লেখাপড়াও ক্লাস সিক্স। শুধু অনু নয়, অলুরও বিয়ে দিতে হবে কিন্তু কীভাবে যে পারবে তা সে জানে না। অমর নাকি দুটো টিউশনি করছে। ষাট—সত্তর টাকা নিশ্চয় হয়। কাউকে কিছু বলেনি, কিছু চায়ও না। কলেজের মাইনে, বইপত্র, বা জামাপ্যান্ট কেনার জন্য হাত পাতে না। কিন্তু তাতেও কি কোনো সাশ্রয় হচ্ছে। শুধু আধ—পেটা খেয়ে থাকতেই তো কম করে মাসে দেড়শো—দুশো টাকা দরকার। সার্টিফিকেটগুলো না ভাঙালে উপোস দিয়ে মরতে হবে।
দমকা বাতাস গাড়ি বারান্দার নীচে দাঁড়ানো লোকগুলোকে বৃষ্টির ছাঁট ভিজিয়ে দিল। গৌরী সরে এল তার গা ঘেঁষে।
‘তুমি এখানে কোথা থেকে?’
‘একজনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলুম, পেলুম না।’
‘মনে হল তুমি বাস থেকে নামলে।’
‘না তো, এতক্ষণ ওধারে মুদি দোকানের সামনে একটা ছোট্ট বারান্দার নীচে দাঁড়িয়েছিলুম। দেখছ কীরকম ভিজে ঢোল হয়ে গেছি!’
‘জ্বর হতে পারে।’
‘আমার অভ্যেস আছে ভেজার।’
অনন্ত আড়চোখে দেখল কয়েকজনের নজর গৌরীর বুকের উপর গেঁথে রয়েছে। সে একটু সরে গৌরীকে আড়াল করল।
‘তোমাকে আর দোকানে দেখি না যে?’
‘ভালো লাগে না তাই যাই না।’
‘তোমার নাকি বিয়ে?’
‘কে বলল?’
‘তোমার ভাই।’
‘অ।’
দু—জনেই চুপ করে রইল। রাস্তার আলোয় বৃষ্টিকণা বরফের মতো ঝলসে উঠছে। অনন্তের গায়ে কাঁটা দিল ঠান্ডা বাতাসে। গৌরী লেপটানো ফ্রক দেহ থেকে ছাড়ানোয় ব্যস্ত। রাস্তার মাঝে গোছ ডুবে যাওয়ার মতো জল জমে গেছে। গাড়ি চলে যাওয়ামাত্র ঢেউ এসে ফুটপাথের উপর ভাসিয়ে দিচ্ছে। ওরা পিছিয়ে বাড়ির দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল।
‘জোর করে বিয়ের ব্যবস্থা করেছে।’
‘এত তাড়াতাড়ি?’
‘আমিও তো তাই বলেছি। বাবা—ই শুনছে না…বোধ হয় আঁচ পেয়েছে।’
‘কীসের?’
‘রমেনদার সঙ্গে আমার ব্যাপারটা।’
‘কী ব্যাপার?’
‘থাক, আর ন্যাকামোয় দরকার নেই। ব্যাপার কাকে বলে যেন উনি জানেন না!’
অনন্ত কথা বলল না। গৌরীর ভিজে চুল থেকে সে নারকেল তেলের গন্ধ পাচ্ছে। তার কনুইয়ের সঙ্গে দু—বার ছোঁয়া লাগল গৌরীর বাহুর। মা বা বোনেদের ছাড়া আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ের এত কাছে সে দাঁড়ায়নি। অদ্ভুত ধরনের একটা প্রফুল্লতা আর সাহস তার ভিতরে তৈরি হয়ে যাচ্ছে অথচ সে জানে গৌরীর মনে তার জন্য আলাদা কোনো জায়গা নেই। নেহাতই রোজ দেখা হতে হতে যতটুকু আলাপ। তাদের বয়সটা কাছাকাছি। গৌরী স্বভাবে খোলামেলা, কথা বলতে ভালোবাসে। বোধহয় লেখাপড়া একদম করেনি।
বৃষ্টি ধরে আসছে। অনেকেই হাত বাড়িয়ে দেখে নিচ্ছে কতটা কমেছে। কয়েকজন গাড়িবারান্দা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। জায়গাটা ফাঁকা হয়ে আসছে দেখে অনন্ত অস্বস্তিবোধ করে বললে, ‘তুমি তো এবার বাড়ি যাবে?’
‘হ্যাঁ যাব, তুমিও তো যাবে।’
‘আমার খুব একটা তাড়া নেই। আমি এ—রাস্তা ও—রাস্তা করে বাড়ি যাই।’
‘বাড়িতে কে কে আছে?’
‘মা আর দুই বোন। একটা ভাই ছিল সে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। তোমায় তো বলেইছি আমার বাবা নেই…বাস চাপা পড়ে মারা গেছে।’
‘আহ।’
অনন্তের মনে হল গৌরীর মুখ থেকে শব্দটা স্বাভাবিকভাবেই বেরিয়ে এসেছে।
‘চলো এবার হাঁটি, তুমি তো এখন সোজা শ্রদ্ধানন্দ পার্কের দিকে যাবে, আমি যাব একেবারে উলটোদিকে, বিবেকানন্দ রোড হয়ে, হেদোর পাশ দিয়ে।’
‘আগে একটু গরম চা খেয়ে নিলে বেশ হত, খাবে?’
‘আমি দিনে দু—কাপের বেশি খাই না।’
‘আমার জন্য নয় আজ এক কাপ বেশিই খাবে। চলো, একটু এগোলেই ঘোষ কেবিন।’
‘তুমি দেখছি এখানকার সব চেনো, আস বুঝি?’
গৌরী হাসল। ওরা ফুটপাথ দিয়ে জল ভেঙে চলতে শুরু করল। দু—জনেই হাতে চটি তুলে নিয়েছে। বৃষ্টি এখন গুঁড়ি গুঁড়ি। ফুটপাথ কোথায় শেষ হয়ে রাস্তা শুরু হয়েছে সেটা জলে ডুবে থাকায় বোঝা যাচ্ছে না।
‘দাঁড়াও আমি আগে রাস্তায় নামি।’
অনন্ত পা টিপে টিপে ফুটপাথের কিনারে এসে সন্তর্পণে রাস্তায় নেমে হাত বাড়িয়ে দিল : ‘হাতটা ধরে নামো।’
গৌরী তার হাত ধরে নামার সময় গর্তে পা দিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল। সে দু—হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে দাঁড় করিয়ে দিয়েই হাত সরিয়ে নিতে গেল। গৌরী আঁকড়ে ধরে রেখেছে তার হাত।
‘ধরে থাকো, আবার কোন গত্তে যে পড়ব কে জানে।’
অনন্তের মনে হচ্ছে হাতটা তার দেহের অংশ নয়। বুকের মধ্যে ধকধকানিটা এবার কানে তালা লাগিয়ে দেবে। লোমকূপগুলো এক—একটা আগ্নেয়গিরি হয়ে উঠেছে। এই প্রথম নারীদেহের কোমলতা সে অনুভব করল। নিজের অজান্তে সে গৌরীর কবজি অস্বাভাবিক জোরে চেপে ধরতেই মুখ তুলে গৌরী তাকাল, চোখে বিস্ময়। অনন্তের চোখ জ্বালা করছে, সে পরিচ্ছন্নভাবে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।
‘হাতটা ছাড়ো।’
সে দ্রুত হাতটা টেনে নিয়ে নিজের দেহের সঙ্গে চেপে ধরল।
‘আমি চা খাব না, আমার কাছে একটা পয়সাও নেই।’
‘আমার কাছে আছে।’
ঘোষ কেবিনে পাশাপাশি ওরা বসল। দু—জনেই ভিজে সপসপে। গৌরী ইশারায় দোকানের ছেলেটাকে ডাকল।
‘দুটো ডবল হাপ।’
‘আর কিছু দোব, ওমলেট, মটন চপ, মটন কাটলেট, মটন দোপেঁয়াজি, ফিশ ফ্রাই?’
গৌরী তাকাল অনন্তের দিকে। সে মাথা নাড়ল।
‘দুটো ফিশ ফ্রাই।’
ছেলেটি সরে যেতেই ফিসফিস করে অনন্ত বলল, ‘আমার কাছে সত্যিই পয়সা নেই।’
‘বললুম তো আমার কাছে আছে।’
‘তুমি পেলে কোথায়?’
‘যেখান থেকেই পাই না।’
‘কেউ দিয়েছে তোমায়?’
গৌরী চুপ করে রইল।
‘তোমার রমেনদা?’
এক চিলতে হাসি ওর মুখে ফুটে উঠল। সাদা পাথরের টেবলে আঙুলের টোকা দিতে দিতে মুখটা ঘুরিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল।
‘মালাটাও ওর দেওয়া।’
‘দেখতে ভালো নয়?’
‘বাবা তো বিয়ে ঠিক করেছে, তা হলে কী করবে?’
‘করুক না ঠিক, আমি আমার ব্যবস্থা করব।’
‘কী ব্যবস্থা?’
‘সে এখন বলব না।’
‘তোমার রমেন এখানেই কোথায় যেন থাকে।’
‘হ্যাঁ আর একটু এগিয়ে বাঁ দিকের গলিটায়। ওদের বাসাতেই এসেছিলুম, বেরিয়ে গেছে কোথায়।’
‘তুমি প্রায়ই আস?’
‘হ্যাঁ।’
‘লোক কেমন, কী করে?’
‘ফরেন মাল খিদিরপুর থেকে এনে বিক্রি করে, আমাকে একটা আমেরিকান জর্জেট দিয়েছে, দারুণ শাড়িটা।’
‘তুমি আমার কাছে একটা আলুর দমের দাম নাওনি, মনে আছে? আবার আজকেও খাওয়াচ্ছ। তোমার কাছে আমার দেনা রয়ে গেল।’
‘শোধ দেবে বুঝি!’
‘হ্যাঁ, তবে এখন নয়। আগে হাতে টাকা আসুক।’
‘এরা কত দেয়?’
‘চল্লিশ টাকা।’
‘য়্যা, মোটে চল্লিশ।’
গৌরীর মুখে অবিশ্বাসের ছাপ দেখে অনন্ত লজ্জা পেল। মুখ নীচু করে আঙুল দিয়ে টেবলে আঁকিবুকি কাটতে লাগল। ছেলেটা টেবলে প্লেট নামিয়ে রাখতেই সে মুখ তুলল। আড়ষ্ট হাতে ছুরি দিয়ে ফ্রাইটা খণ্ড করতে করতে বলল, ‘যা জুটে গেল তাই করছি, চাকরির যা বাজার। শুধু শুধু বসে থাকার চাইতে তবু তো…তবে চেষ্টা করে দেখছি।’
ফ্রাইয়ের একটা খণ্ড মুখে দিয়ে আরামে সে চিবোতে লাগল। স্বাদটা বড়ো ভালো, খিদেও পেয়েছে খুব। গৌরীর ছুরি—কাঁটা ধরা দেখে সে বুঝতে পারছে তার মতো আনাড়ি নয়। হঠাৎ তার মনে পড়ল অনু—অলুকে। সে আজ বাজার থেকে যা এনেছে তাই রান্না হয়েছে। সকাল থেকে ভাত আর আলু—ঝিঙে—পোস্ত ছাড়া এখনও পর্যন্ত কিছু ওদের পেটে পড়েনি। মা পেট ভরে কখনোই খেতে পায় না। ছেলেমেয়েদের খাইয়ে কিছুই তো প্রায় থাকে না।
ফ্রাইটা আর তত স্বাদু মনে হচ্ছে না। পর পর মুখগুলো ভেসে উঠছে। ওরা যখন জানবে রেস্টুরেন্টে খেয়ে এসেছে তখন মনে মনে কিছু একটা নিশ্চয় ভাববে। যদি ভাবে সংসারের টাকা থেকে সরিয়ে সে খেয়েছে! গৌরী নামে একটা মেয়ে যে তাকে খাইয়েছে, এ—কথা কি কেউ বিশ্বাস করবে?
তার বুকের মধ্যে একটা মোচড় দিয়ে উঠল। একটু আগেও তার মনে হচ্ছিল আজকের দিনটা জীবনে মনে রাখার মতো একটা দিন। যতদিন বাঁচবে সে গৌরীর প্রত্যেকটি কথা, দেহের যাবতীয় নড়াচড়া, ওর চুলের গন্ধ, ওর চাহনি, হাসি, বিস্ময় সব স্মৃতিতে বাঁচিয়ে রেখে দেবে। তাই সে উদগ্রভাবে প্রতিটি মুহূর্তকে শুষে নিয়ে জমা করে রাখছিল তার চেতনার প্রতিটি কোষে। কিন্তু হঠাৎ কোষগুলোকে ফাটিয়ে দিল কতকগুলো শুকনো অবসন্ন মুখ।
‘আচ্ছা, এই যে খাচ্ছি। মুখে গন্ধ হবে?’
‘হবেই তো। পেঁয়াজ, রাই সর্ষে…গন্ধ হবে না?’
অনন্ত দমে গেল। সে ঠিক করল মশলা দেওয়া পান খাওয়াবার জন্য গৌরীকে বলবে।
‘তুমি ধুতি পরো কেন? এখনকার ছেলেরা তো প্যান্টই পরে।’
‘এটা বাবার ধুতি।’
‘মরা মানুষের জিনিস ব্যবহার করতে নেই।’
‘করলে কী হয়?’
‘কিছুই হয় না, তবে লোকটার কথা মনে পড়ে যায়। তোমার মনে পড়ে না বাবাকে?’
‘কই না তো! বাবা আমাদের সঙ্গে খুব কমই কথা বলত, আমরাও কাছে ঘেঁষতুম না।’
‘এক—একজন লোক ওইরকম হয়, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশতে পারে না; আমার বাবাও ওইরকম।’
অনন্তের খাওয়া হয়ে গেছে। প্লেটে পড়ে আছে শুধু স্যালাড। খুঁটে খুঁটে সে বিট আর গাজরের কুচি মুখে দিতে লাগল পেঁয়াজ বাদ দিয়ে। গৌরী দু—আঙুল তুলে ছেলেটাকে বলল ‘চা।’
অন্য টেবলগুলো ভরে আছে। তাদের টেবলেও মুখোমুখি অফিসফেরত দু—জন দু—কাপ চা নিয়ে বসে। তারা বৃষ্টি, রাস্তায় জমা জল নিয়ে কথা বলছে আর মাঝে মাঝে নিরাসক্তচোখে, গৌরীর দিকে তাকাচ্ছে।
‘আমার ছাদটা ফাটা, শোবার ঘর বোধ হয় ভেসে গেছে।’
লোকটিকে উদবিগ্ন মনে হলেও ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে না বাড়ি যাবার জন্য। মনে হয় রোজই এই সময় এখানে এসে চা খায়।
অনন্ত গরম চায়ে চুমুক দিয়েই চমকে কাপ সরিয়ে নিল।
‘জিব পুড়ল তো?’
‘এত গরম বুঝতে পারিনি।’
সে প্লেটে চা ঢেলে ফুঁ আ দিয়ে জুড়িয়ে নিআয়ে খেল। গৌরী তাই দেখে শুধু হাসল।
দরজার কাছের টেবলে দোকানের মালিক বসে। গৌরী ফ্রকের গলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ব্রেসিয়ারের ভিতর থেকে ছোটো একটা চামড়ার ব্যাগ বার করল।
‘তিন টাকা চল্লিশ।’
অনন্ত কৌতূহল সামলাতে না পেরে আড়চোখে দেখল ব্যাগটার মধ্যে ভাঁজ করা কয়েকটা দু—টাকার নোট। পাঁচ টাকার নোটের রংও দেখতে পেল। দুটো দু—টাকার নোট গৌরী টেবলে রাখল। মৌরি রাখা প্লেটে মালিক একটা আধুলি আর দশ পয়সা রাখল। ছেলেটা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। গৌরী আধুলিটার সঙ্গে খানিকটা মৌরিও তুলে নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এল। ইতস্তত করে অনন্তও দু—আঙুলের চিমটেয় মৌরি তুলল।
‘দশ পয়সাটা নিলে না যে, বকশিশ?’
‘হ্যাঁ।’
‘সেলাম করল না তো!’
‘দশ পয়সায় আবার সেলাম দেবে কী!’
রাস্তায় জল, ফুটপাথেও পায়ের গোছ ডুবে যাচ্ছে। জলের মধ্যে পা টেনে টেনে সাবধানে গর্ত খুঁজে খুঁজে লোকেরা হাঁটছে। বৃষ্টি—ধোওয়া গাছের পাতাগুলো ছাড়া আর সব কিছুই ম্লান। ঘোষ কেবিনের নিওন আলোয় গৌরীর গায়ের চামড়া ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। ভিজে চুল মাথায় বসা। ফ্রকটা ন্যাতার মতো শরীরে ঝুলছে।
‘কোনদিকে যাবে, বাড়ি?’
‘হ্যাঁ। তুমিও?’
‘চলো তোমার সঙ্গে খানিকটা যাই।’
অনন্ত একবার ভাবল, চটি হাতে তুলে নেবে কি না। সাত মাস আগে চার টাকা দিয়ে ফুটপাথের দোকান থেকে কেনা। স্ট্র্যাপ ঢিলে হয়ে গেছে জল ঠেলে যেতে যেতে যদি খুলে যায়! গৌরীর পায়েও চটি কিন্তু হাতে তুলে নেয়নি। সে আর চটির কথা ভাবল না। ধুতিটা হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে গৌরীর পাশাপাশি হেঁটে চলল।
‘তোমার সঙ্গে বোধহয় কারোর ভাব নেই।’
অনন্ত বুঝতে পারল না গৌরী কী বলতে চায়। সে মাথা নেড়ে বলল, ‘না, আমি ছেলেদের সঙ্গে বড়ো একটা মিশি না।’
‘ছেলে নয় মেয়ে। কারোর সঙ্গে তোমার ভাব নেই?’
অপ্রতিভ হল অনন্ত। ভাব থাকাটা ভালো না মন্দ, উচিত কি অনুচিত, সে বুঝতে পারছে না।
‘নাহ, ওসব আমার নেই।’
‘কী নেই?’
গৌরী মুখ ফিরিয়ে তাকাল। ওর চোখে হাসি। একটা বাচ্চচা ছেলে ছুটে আসছে জল ছিটিয়ে। তাদের সামনে যে—লোকটি যাচ্ছে সে ধমক দিয়ে উঠল। বোধহয় ছেলেটা শুনতে পেল না বা অগ্রাহ্য করল। গৌরী কাছে সরে এল। অনন্ত থমকে হাত বাড়িয়ে ছেলেটাকে ধরতে গিয়ে পারল না।
‘তুমি খুব ভালো ছেলে।’
‘কী করে বুঝলে!’
‘সে বুঝতে পারি। তুমি একদমই চ্যাংড়া নও!’
‘আমার ঘাড়ের উপর একটা সংসার। তাদের দেখতে হবে তো।’
ওরা কিছুক্ষণ কথা বলল না। যত এগোচ্ছে ফুটপাথের জল ক্রমশই কমে আসছে। ট্রাম বন্ধ। স্টপে এক—একটা বাস থামছে আর ঝাঁপিয়ে পড়ছে মানুষ। গাড়ি আর পথচলতি লোকে রাস্তাটা বিশৃঙ্খল হয়ে গেছে। দু—ধারে জল জমে থাকায় রাস্তার মাঝখান দিয়ে রিকশা আর লোক চলছে। বাস, ট্যাক্সি বা বাড়ির মোটরের গতি মন্থর স্রোতের মতো মানুষ হেঁটে চলেছে শিয়ালদার দিকে।
দু—জনে ফুটপাথের কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রাস্তাটার জটপাকানো অবস্থা দেখছিল।
‘তোমাকে একটা কথা বলব, কাউকে এ—পর্যন্ত কিন্তু বলিনি।’
‘কী কথা?’
গৌরী কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলল, ‘রমেনদার সঙ্গে আমি চলে যাব।…দমদমায় ঘর দেখে এসেছে।’
‘সে কী!’
‘কেন, মেয়েরা কি ভালোবেসে ঘর ছাড়ে না?’
‘তোমার বয়স কত?’
‘বয়স দিয়ে কী এসে যায়?’
‘তোমার বাবা রেগে যাবে।’
‘যাবে তো যাবে, আমার তাতে বয়েই গেল।’
‘তোমার বিয়ে ঠিক করেছে।’
‘কে করতে বলেছে? হাওড়ায় কোন এক গ্রামের ছেলে চাষা না কুলি কে জানে… রমেনদাকে বাবা কেন যে দেখতে পারে না জানি না।’
‘যদি পুলিশে খবর দেয়?’
‘দিক না, খুঁজে পেলে তো! তুমি কিন্তু কাউকে বোলো না।’
‘না।’
অনন্ত নিজের সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠল। গৌরী তাকে বিশ্বাস করেছে। নিশ্চয় কিছু একটা তার মধ্যে পেয়েছে বলেই। এইরকম আস্থা তার উপর এখন পর্যন্ত কেউ তো রাখেনি। কিন্তু রমেন লোকটাকে তার ভালো লাগেনি। গৌরীর উচিত হবে না ওর সঙ্গে চলে যাওয়া। তার মনে হল কথাটা বোধহয় এখন বলা ঠিক হবে না। সাহস করে ঘর ছাড়ছে, অমরও তাই করেছে।
মা কালকেও অমরের কথা বলেছে : ‘ছেলেটা কোথায় গেল একটু খোঁজ কর।’ সে বলেছিল, ‘কচি—খোকা নয়, ঠিকই আছে কোথাও, এখানের থেকে হয়তো ভালোই আছে।’
গৌরীর বাড়িতেও এইভাবে কথা হবে নিশ্চয়।
‘তোমার মা কষ্ট পাবে।’
‘তা পাবে। আমি চিঠি লিখে যাব।’
‘কবে যাবে?’
‘এখনও দিনটিন ঠিক করিনি, টাকাপয়সা ব্যবস্থা করার ব্যাপার আছে তো, সংসার পেতে বসার জন্য সবই তো কিনতে হবে।…তোমায় যাবার আগে বলব। এখন যাই, আর আসতে হবে না।’
‘আমায় বলবে কী করে?’
‘ভাইয়ের হাতে চিঠি দোব, যখন খেতে আসবে তোমায় দেবে…চলি।’
গৌরী রাস্তা পার হয়ে চলে যাচ্ছে। ভিড়ের মধ্য দিয়ে তার নিতম্বের দোলা, আর ফ্রকের গাঢ় নীল ফুলছাপ আর ভিজেচুল যতক্ষণ দেখা যায় অনন্ত দেখার চেষ্টা করল। আশা করেছিল একবার অন্তত পিছন ফিরে তাকাবে, কিন্তু গৌরী তাকায়নি। এতক্ষণ যে মৃদু আঁচ তার মনকে তাজা ঝরঝরে করে রেখেছিল গৌরী চলে যাওয়ামাত্র সেটা নিবে আসছে। ওর চলে যাওয়ার মধ্যে কেমন একটা নিষ্ঠুর ভঙ্গি রয়েছে যাকে বলা যায় কাঠিন্য। তবে ওর মায়া—মমতাও আছে। একবার আলুর দমের দাম নেয়নি, আজও ফ্রাই খাওয়াল। অথচ কী এমন তার সঙ্গে পরিচয়? পাঁচ মাস ধরে দুপুরে কিছুক্ষণের জন্য দেখা হওয়া আর কয়েকটা সাধারণ কথাবার্তা! কত সহজভাবে তার সঙ্গে কথা বলল আজ। কত তাড়াতাড়ি তাকে বিশ্বাস করেছে, নয়তো বাড়ি থেকে পালাবার কথা কি বলত?
একটা গুপ্ত খবর জেনে যাওয়ার এবং সেটাকে কোনোমতেই প্রকাশ না করার সংকল্প থেকে তৈরি হওয়া চাপ তার মধ্যে উত্তেজনা এনে দিয়েছে। বাড়ির উদ্দেশে হাঁটতে হাঁটতে অনন্তের মনে পড়ল পান খাওয়াবার জন্য গৌরীকে আর বলা হল না। মুখে কি গন্ধ হয়েছে? নিজের মুখের গন্ধ টের পাওয়া যায় না। হাতের চেটোয় ভাপ দিয়ে সে শুঁকল, কিছু বুঝতে পারল না। তাইতে অস্বস্তিবোধ করতে লাগল। সে ঠিক করল আজ সবার সঙ্গে দূর থেকে কথা বলবে। মুখটা অন্যদিকে ঘোরাবে মা যখন ঝুঁকে থালায় কিছু দিতে থাকবে।
কিংবা বলেই দেবে গৌরী তাকে খাইয়েছে। কে গৌরী? চাওয়ালার মেয়ে, রোজ ওর সামনে বেঞ্চে বসে আলুর দম দিয়ে রুটি খাই, তখন কথাবার্তা বলি। নানান রকমের কথা, সিনেমা, জামাকাপড়, হাঁটার স্টাইল, পুরুষদের কতরকমভাবে মেয়েদের দিকে তাকানো, বাড়িওয়ালাদের বদমাইশি, আরও অনেক রকম কথা। খুব ভালো মেয়ে, একদমই গায়েপড়া নয়। বয়স? প্রায় সমানই কিংবা দু—এক বছরের ছোটো।
মা কীভাবে নেবে? খারাপ কিছু ভাববে কি? সন্দেহ করার মতো মন মায়ের নয়। তা যদি হত তা হলে নিশ্চয় জেনে যেত মিনু নামে একজনের সঙ্গে বাবার সম্পর্ক ছিল।
অনন্ত যখন বাড়ি পৌঁছল শীলা তখন অবিনাশের সঙ্গে কথা বলছে। অনু ঘরে নেই, বোধহয় পাশের বাড়িতে কিংবা দোতলায় আর অলু তক্তাপোশের এককোণে কাত হয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ছে। ভিজে শার্ট আর ধুতি উঠোনের তারে মেলে দিয়ে অনন্ত ঘরে আসতেই অবিনাশ বলল, ‘রাস্তার জল কমেছে?’
‘এদিকে বিশেষ জল জমেনি। আমাদের ওদিকটায় খুব জমেছে!’
‘ঠাকুরপো অনেকক্ষণ এসেছেন, অফিসে নাকি লোক নেবে, তাই বলছিলেন…
‘কিন্তু ও তো স্কুল ফাইনালটাও পাশ করেনি, টাইপও জানে না।…তাই বলছিলুম প্রাইভেটে পরীক্ষাটা দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে আর সেইসঙ্গে টাইপটাও শিখে নিলে ভালো। এমপ্লয়ির ছেলে, ধরাধরি করলে হয়ে যাবে। ইউনিয়নও এসব ক্ষেত্রে বাগড়া দেবে না, আমি কথা বলেছি। তুই সামনের বছরই পরীক্ষা দেবার জন্য তৈরি হ। এখানে না হোক অন্য কোথাও চেষ্টা করা যাবে। কোয়ালিফিকেশন না থাকলে তো কোথাও কিছু পাবি না। দপ্তরির কাজ করে কত টাকা আর পাবি, নিজে কারবার খুলেও যে কিছু করবি তা—ও সম্ভব নয়।’
‘না, আমি দপ্তরিখানা ছেড়ে দেব, এখানে আমার ভবিষ্যৎ নেই।’
অনন্ত ভারী গলায় বিজ্ঞের মতো তার সিদ্ধান্ত জানাল। শীলা চকিতে একবার অলুর দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, ‘মেয়েদের বিয়ের টাকা ভাঙিয়ে খাচ্ছি। তা—ও তো একদিন শেষ হয়ে যাবে, তারপর?’
অবিনাশ মেঝের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হল। অনন্ত একদৃষ্টে দেওয়ালে চোখ রাখে, কোলের উপর হাতদুটি। শীলা এই নীরবতাকে ভাঙার চেষ্টা করল না।
‘অমরকে যেতে দেওয়া ঠিক হয়নি।’
দু—জনে অবিনাশের মুখে জিজ্ঞাসু চোখ রাখল।
‘ওকে ওইভাবে অপদস্থ করা অনন্তর উচিত হয়নি…জীবনে এসব জিনিস বহু ঘটে, সামান্য ব্যাপার, তাই নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি…ছেলেটার মনে খুবই লেগেছে।’
অনন্ত মাথা নামাল। তারও একসময় মনে হয়েছিল, সে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। অনুতপ্ত বোধ করে ভেবেছিল অমরের খোঁজ নেবে পাড়ায় ওর বন্ধুদের কাছে অথবা কলেজে। কিন্তু কিছু সে করেনি।
‘কোথায় গেছে?’
‘জানি না!’
‘ও থাকলে, চার—পাঁচ বছরের মধ্যেই সংসারটাকে মোটামুটি নিশ্চিন্ত করে দিতে পারত।’
অনন্তের মনে হল, আর একটা বোঝা তার ঘাড়ে এসে পড়ল। সংসারের নিশ্চিন্ত হওয়ার একটা পথ ছিল কিন্তু তার জন্যই সেই পথ হারিয়ে গেল। এখন তার উপরই দায়িত্ব পড়ল আবার পথ বার করে নিশ্চিন্তি এনে দেওয়ার। নিশ্চিন্তি মানে টাকা রোজগার করতে হবে কিন্তু কীভাবে করবে?
‘আমাকে তা হলে স্কুল ফাইনাল পাশ করতে হবে?…কিন্তু আমি তো সব ভুলে গেছি।’
তার করুণ স্বর অবিনাশের গম্ভীর মুখে হাসি ফোটাল। অলু একবার বই থেকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল।
‘বই জোগাড় কর। পারিস তো একটা কোচিংয়ে ভরতি হয়ে যা। রোজ যদি ঘণ্টাচারেক করেও বই নিয়ে বসিস তা হলে ছ—মাসেই তৈরি হয়ে যাবি, পারবি না?’
অনন্ত শুধু তাকিয়ে রইল। ঠিক এইভাবে এই ঘরেই সে একদিন শুনেছিল, ‘ভাগ্য যদি অন্যরকম অবস্থায় ফেলে দেয় তা হলে আর কী করার থাকতে পারে। মা—কে দেখা, ভাইবোনদের মানুষ করে তোলা, নিজেকে নিজে বড়ো করা…’
সে মুখ নামিয়ে বুকের মধ্যে আটকে রাখা বাতাস নাক দিয়ে বার করার সময় বলল, ‘দেখি।’
‘দেখি আবার কী? তোর মতো ভালো ছেলের না পারার তো কথা নয়!’
‘পারবে না কেন, খুব পারবে।’
শীলা এমন এক সরল প্রত্যয় নিয়ে বলল যে ভয় পেয়ে অনন্ত রেগে উঠল। তীক্ষ্ন—চোখে সে তাকাল।
‘আমার পড়াশুনোর ব্রেন নেই, থাকলে কি ফেল করতুম?’
‘তোকে তো ফার্স্ট—সেকেন্ড হতে হবে না, শুধু পাশটা করতে হবে চাকরি পাবার জন্য। খাটলেই পাশ করা যায়।’
অনন্ত আবার মুখ নামিয়ে ফেলল। তাকে আবার বই নিয়ে বসতে হবে। আবার অঙ্ক, গ্রামার, এসে, সংস্কৃত, লেটার রাইটিং, মুখস্থ আর মুখস্থ। ভালো ছেলেরা পারে, পারতেই হয়, তাদের বড়ো হতে হয়, সবাইকে দেখতে হয়।
ক্লান্তচোখে সে তার ভবিষ্যৎ জীবনের দিকে তাকিয়েই যেন বলল, ‘ঠিক আছে।’
পাঁচ
ছ—মাসে নয়, অনন্ত প্রথমবার ফেল করে পরের বার কোনোক্রমে পাশ করেছিল। কিন্তু তারই মধ্যে জীবন একটা বাঁক নিয়ে কিঞ্চিৎ স্বস্তি এনে দেয় তাদের সংসারে। সে আড়াইশো টাকার একটা চাকরি পেয়ে যায়।
সেদিন অশোকবাবুর কোচিং থেকে ফিরতে তার রাত হয়ে গেছল। তাকে আটকে রেখেছিলেন একটা প্যাসেজ ইংরেজিতে নির্ভুল অনুবাদ করাবার জন্য। একসময় বিরক্ত হয়ে তিনি বলে ওঠেন, ‘বাড়ি যা, তোর দ্বারা এসব হবে না। তোর ভাইয়ের পেছনে এর ওয়ান—টেন্থও খাটতে হয়নি অথচ কী রেজাল্ট করল, আর তুই…’
অনন্ত বিষণ্ণমনে বাড়ি ফেরার সময় ঠিক করে ফেলে প্রত্যেকদিন ভোরবেলায় সে একপাতা করে গ্রামারও মুখস্থ করবে।
বাড়িতে পা দেওয়ামাত্র শীলা ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘উৎপলদের চাকরটা তোকে ডাকতে এসেছিল, ওর বাবার কী যেন দরকার তোকে। এলেই যেতে বলেছে, কীজন্য তা আর বলল না।’
অনন্ত অবাক হয়ে বলল, ‘আমাকে! ব্যাপার কী? আমার সঙ্গে তো ওনার জীবনে কখনো কথা হয়নি।’
তারপরই মনে পড়ল সন্দেশগুলো সে ওঁকেই ফেরত দিয়েছিল, তখনই প্রথম দু—চারটে কথা বলেছিলেন। উৎপলের বাবা সাধন বিশ্বাস পেশায় অ্যাটর্নি। কাঁচাপাকা চুল, কখনো ইস্ত্রিবিহীন পাঞ্জাবি বা পাজামা পরেন না। গালদুটি সর্বদা মসৃণ, পায়ে চটি। একটা ভক্সহল মোটরে অফিসে বেরোন। সন্ধ্যার পর একতলার ঘরে ওঁকে দেখা যায়। চামড়ামোড়া গদির চেয়ারে বসে লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে। ঘরের এককোণে পিছন ফিরে একটা লোক টাইপ করে যায় রামকৃষ্ণদেবের ছবিটার নীচে চেয়ারে বসে।
‘গিয়ে দেখ না একবার, ঘরে তো আলো জ্বলছে।’
শীলার মতো অনু—অলুও উদগ্রীব চোখে তাকিয়ে। সে নিজেও কৌতূহলী হয়ে উঠেছে ওদের মতো।
সাধন বিশ্বাসের ঘরের দরজা থেকে সে সন্তর্পণে উঁকি দিল। টাইপিস্ট তার কাজে ব্যস্ত। সাধন বিশ্বাস চেয়ারে হেলান দিয়ে মনোযোগে কী একটা পড়ছেন। সে বুঝে উঠতে পারছে না এখন তার কী করা উচিত।
উনি মুখ তুললেন এবং দ্রুত আড়ালে সরে—যাওয়া অনন্তের উদ্দেশে বলে উঠলেন, ‘কে ওখানে?’ সাড়া না পেয়ে আবার বললেন, ‘ওখানে কে?’
‘আমি সামনের বাড়ির অনন্ত।’
চেনার জন্য কয়েক সেকেন্ড মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘ও, এসো।’
অনন্ত পা টিপে ঘরে ঢুকল। মোজাইকের ঝকঝকে মেঝেয় ফুলের নকশা, মাড়াতে অস্বস্তি হয়। চেয়ারের পিঠ ধরে সে দাঁড়াল।
সাধন বিশ্বাসের ঠোঁটে হাসি দেখে সে বিভ্রান্ত হল, কোনো ধারণায় আসতে পারছে না কেন তাকে ডেকেছেন!
‘দেরি করলে যে?’
‘কোচিং থেকে ফিরতে ফিরতে…’
‘কী পড়তে যাও?’
‘প্রাইভেটে স্কুল ফাইনাল দোব…দেবার ইচ্ছে আছে।’
‘সারাদিন কী করো?’
‘একটা দপ্তরিখানায় কাজ শিখতে যাই।’
‘অ্যাপ্রেন্টিস?…কত পাও?’
অনন্তর চোখে ভেসে উঠল গৌরীর মুখটা আর সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেল, ‘য়্যাঁ, মোটে চল্লিশ!’ টাকার পরিমাণটা অসম্মানজনক, যে—কেউ শুনলেই তার সম্পর্কে ধারণা নীচে নামিয়ে দেবে।
‘কমই দেয়…একশো চল্লিশ।’
একবার মুখের দিকে তাকিয়ে সাধন বিশ্বাস কলমটা টেবলে ঠুকতে শুরু করলেন। অনন্ত ভয় পেল, মিথ্যাটা কি ধরে ফেলেছেন? হয়তো কোনোভাবে শুনেছেন কত পায়।
‘একটা চাকরি আছে সৎ আর বিশ্বাসী লোক দরকার, তোমার কথা মনে পড়ল। করবে?’
‘কী কাজ?’ অনন্তের শ্বাসকষ্ট শুরু হল।
‘আমার বন্ধু আবার ক্লায়েন্টও, কলকাতায় অনেক বিষয়সম্পত্তি আছে, বস্তি আছে একটা, বাড়ি আছে গোটাচারেক, নতুন একটা ফ্ল্যাটবাড়িও তৈরি করছে পার্ক সার্কাসে, শিবপুরে পেট্রল পাম্প, দেশে জমিজমা সিনেমা হল আছে, তা ছাড়া কয়লার ব্যবসা ওষুধের দোকান…নিজে কিছুই দেখে না, বনেদি বড়োলোক হলে যা হয়, কর্মচারীরাই সব দেখে আর দু—হাতে চুরি করে…সে থাক গে, ওর এস্টেটে একটা চাকরি খালি আছে, করবে?’
‘কী চাকরি?’
‘ভাড়া আদায় করার। এতকাল যে করত তাকে সরিয়ে ওষুধের দোকানে বসাচ্ছে, বাবার আমলের লোক তাই আর ছাড়ায়নি। কাজটা টাকাপয়সা নিয়ে। ভাড়া কালেকশন করতে টেনান্টদের ঘরে ঘরে যাওয়া, ভাড়াটেদের দেখাশোনা, বাড়ির মেরামতি, ট্যাক্স দেওয়া, আদায়ের হিসাবপত্তর রাখা, টাকা জমা দেওয়া, এই হল কাজ। কিন্তু চুরির সুযোগ আছে তাই একজন সৎ বিশ্বাসী লোক এখুনি চাই। আজই কথা হচ্ছিল, আমি বলেছি আমার জানা একটি ভালো ছেলে আছে, সামনের বাড়িতেই থাকে।…করবে?’
উনি কী করে জানলেন আমি ভালো ছেলে? অনন্ত অবাক হল। বোধহয় সন্দেশ ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনা থেকেই ওঁর ধারণা হয়েছে। বহুদিন সে মনে মনে আক্ষেপ করেছে, অমরকে ভাবে চোর প্রতিপন্ন না করালেও হত, হাজার হোক ভাই তো কিন্তু এখন তার মনে হল শাপে বরই হয়েছে।
‘হ্যাঁ করব।’ কোনোক্রমে কথাটা সে বলতে পারল। হাঁটুদুটো মাখনের মতো লাগছে হয়তো সে দুমড়ে পড়ে যাবে। চেয়ার আঁকড়ে থাকা আঙুলগুলোর গাঁট টনটন করে উঠল।
‘এখন যা পাচ্ছ তার থেকে বেশিই যাতে পাও দেখব। বোসো, একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি, কালই কি যেতে পারবে? সকাল দশটার পর…তার আগে ঘুম থেকে ওঠে না।’
অনন্ত মাথা হেলাল কিন্তু চেয়ারে বসল না। সাধন বিশ্বাস কলমদানি থেকে লাল কলমটা তুলে তাঁর নাম ছাপা প্যাডে যতক্ষণ ধরে চিঠি লেখায় ব্যস্ত রইলেন ততক্ষণ নিজের হৃৎপিণ্ডের ধকধকানি ছাড়া আর কিছু শুনতে পেল না, চোখে একটা ঝাপসা পর্দা নেমে এসেছে যার ওধারে সাধন বিশ্বাসকে ছায়ার মতো লাগছে।
চিঠিটা চার ভাঁজ করে এগিয়ে দিলেন।
‘দেরি কোরো না কালই যাও।’
টেবলটা দ্রুত ঘুরে গিয়ে অনন্ত নীচু হল প্রণাম করতে। হরিণের চামড়ার চটির মাথায় পা ঢোকানো। গোড়ালিদুটো যেন শ্বেতপাথরের। চামড়ার উপর আঙুল বোলানোর সময় শিরশির করে উঠল তার মেরুদণ্ড।
‘থাক থাক…ভালো করে কাজ কোরো।’
‘কোথায় যেতে হবে?’
‘খুব বেশি দূরে নয়, রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটে পরেশনাথ মন্দিরের কাছেই, ঠিকানা লিখে দিয়েছি…সমীরেন্দ্র বসুমল্লিক, ফটকে লেখা আছে অঘোর এস্টেট…ওর ঠাকুরদার নাম।
সদর দরজায় অনু দাঁড়িয়ে, তার পাশে শীলা। তার জন্যই অপেক্ষা করছে। সাধন বিশ্বাসের ঘরটার আধখানা এখান থেকে দেখা যায়।
‘দাদা, তোকে কী লিখে দিল রে?’
অনন্ত দু—জনের মুখের দিকে বিহ্বলচোখে তাকিয়ে শুধু বলল, ‘ভগবান আছে।’
তিনজনে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। চেয়ারে হেলান দিয়ে সে প্রত্যেকের মুখের দমবন্ধ কৌতূহল তারিয়ে তারিয়ে চাখল।
‘বললেন একটা চাকরি আছে, করবে?’
‘কী বললি?’
‘করব বললুম।’
‘কোথায়, কীসের চাকরি, কত দেবে?’
সেদিন রাতে অনন্ত ঘুমের মধ্যে বার বার ছটফট করল। সকালে ঘুম ভেঙে যেতেই সে পাশের ঘরে কথাবার্তার শব্দ পেল।
‘ইস্ত্রি না করলে এই পরে যাবে নাকি? চেয়ে আন ইস্ত্রিটা। চটি জোড়ায় কালি দিয়ে দে।’
রাতে উঠোনে ধুতি আর শার্ট নিয়ে মা সাবান দিতে বসে। দোতলা থেকে তখন জেঠিমা চেঁচিয়ে বলেছিল, ‘এত রাতে কাচাকুচি করছ যে?’
‘অনন্ত কাল নতুন চাকরিতে জয়েন করবে।’
চিত হয়ে অন্ধকার ঘরে সে হেসেছিল। চাকরিই হল না আর কিনা জয়েন?
‘কোথায় গো?’
‘এক জমিদারের আপিসে।’
অঘোর—এস্টেট খুঁজে নিতে অনন্তর অসুবিধা হয়নি। লোহার ফটক থেকে মাটির পথ অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরে বারান্দার নীচে পৌঁছেছে। টানা তিন ধাপ সিঁড়ি, ডান দিকে বেলেপাথরের সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে, বাঁদিকে পরপর কয়েকটা ঘর, সামনে পাথরের উঠোন আর ঠাকুর দালান।
সিঁড়ির পাশে একটা বেঞ্চে দুটি লোক বসে। চাহনি আর বসার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায় বাইরের লোক, কোনো কাজের জন্য এসেছে। বাঁদিকের ঘরগুলো থেকে লোকজনের গলা পাওয়া যাচ্ছে। অনন্ত উঁকি দিয়ে দেখল প্রথম ঘরটার অর্ধেক জুড়ে নীচু তক্তাপোশ, তাতে শতরঞ্চি পাতা। জানলার কাছে বাবু হয়ে বসে এক প্রৌঢ়, কোলের কাছে রাখা ডেস্কে ঝুঁকে একটা কাগজ থেকে দেখে দেখে খাতায় লিখছে। ঘরের কড়িকাঠ থেকে লোহার শিকে আটকানো দু—সারি কাঠের তাক ঝুলছে, মোটা মোটা ধুলো লাগা খাতা আর কাগজপত্রে সেগুলো ঠাসা। পাশের ঘরটায় কয়েকটা টেবল—চেয়ার। নানানরকমের কাগজে আর খাতায় টেবলগুলো ভরা। দেখে মনে হয় না ওগুলো কখনো নাড়াচাড়া করা হয়েছে। দুটো স্টিলের আলমারি ছাড়াও কাঠের র্যাক তিনদিকের দেওয়াল ঢেকে ফেলেছে। এখানেও খাতা আর কাগজ। পুরোনো একটা পাখা কিচকিচ শব্দ করে ঘুরছে। পিছন ফিরে একটি লোক চেয়ারে বসে।
অনন্ত বুঝতে পারছে না সমীরেন্দ্র বসুমল্লিকের সঙ্গে সে কীভাবে দেখা করবে। কোনো চাকর বা দারোয়ানকে দেখতে পাচ্ছে না। এত বড়োলোক এত বিষয়সম্পত্তি, সে ভেবেছিল দেখবে ঝকঝকে সাজানো অফিস, লোকজন গিজগিজ করছে। তার বদলে এমন নির্জন পুরোনো একটা বাড়ি, যার মেঝেয় সিমেন্টের চটা ওটা, দেওয়ালে নোনা, জানলা দরজার কাঠ ময়লা, শার্সির কাচ ভাঙা—দেখে সে দমে গেল।
‘কী চাই?’
অনন্ত ঘরে ঢুকল। প্রৌঢ় চশমাটা আঙুল দিয়ে ঠেলে নাকের উপরে তুলে তার দিকে তাকিয়ে।
‘সমীরেন্দ্র বসুমল্লিকের সঙ্গে দেখা করব।’
‘কী দরকার?’
‘একটা চিঠি এনেছি।’
‘কার কাছ থেকে?’
‘সাধন বিশ্বাস, অ্যাটর্নি।’
প্রৌঢ় হাত বাড়াল।
‘দেখি।’
অনন্ত চিঠিটা দিতে চটি খুলে তক্তাপোশে উঠল। চিঠিটা ইংরেজিতে। তাতে অল্প কথায় লেখা, যে—ছেলেটির কথা বলেছি তাকে পাঠালাম। অনেকক্ষণ ধরে পড়ার পর প্রৌঢ় তার আপাদমস্তক দেখে হাঁক দিল, ‘যুগল’। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই শুধু দোতলা থেকে কুকুরের ডাক শোনা গেল। প্রৌঢ় এবার গলা চড়িয়ে ডাকল।
‘কী বলছেন?’
দরজায় দাঁড়িয়ে ধুতি—গেঞ্জি পরা একটি লোক, প্রৌঢ়রই বয়সি। বোঝা যায় পুরোনো চাকর।
‘দেখা করতে এসেছে, অ্যাটর্নিবাবু চিঠি দিয়ে পাঠিয়েছেন।’
যুগল চিঠিটা নিয়ে দোতলায় উঠে গেল। মিনিট দুয়েক পর নেমে এসে বলল, ‘যান।’
সিঁড়িটা বাঁক নিতেই সামনের দেওয়ালে মানুষ প্রমাণ একটা আয়না। কাচের বহু জায়গায় কালো ছোপ পড়েছে। সোনালি চওড়া ফ্রেমটা বিবর্ণ। অনন্ত নিজের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে পেল। এই প্রথম সে জানতে পারল নিজের পুরো চেহারাটা কেমন।
সিঁড়িটা পৌঁছেছে লম্বা একটা দালান ঘরের প্রান্তে যার অপর প্রান্তে কয়েকটা সোফা এবং গদি আঁটা পুরোনো চেয়ার ও নীচু টেবল। পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি পরা গৌরবর্ণ, সুদর্শন একটি লোক সোফায় হেলান দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন, পায়ের উপর পা তোলা। একটা অ্যালসেশিয়ান কার্পেটের উপর দেহ ছড়িয়ে দু—পায়ের মধ্যে মুখ গুঁজে, অনন্তকে সে চোখ তুলে একবার দেখল মাত্র।
টেবলে সাধন বিশ্বাসের চিঠিটা একটা অ্যাশট্রে দিয়ে চাপা। অনন্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। একসময় কাগজটা মুখের সামনে থেকে সরিয়ে তাকালেন, চোখের মণিদুটো বিষণ্ণ, গভীর ও বড়ো। ঘুমের রেশ তখনও জড়িয়ে রয়েছে।
অনন্ত ঠিক করে রেখেছিল প্রণাম করবে। করতে পারল না। কী যেন একটা নিস্পৃহ দূরত্ব মানুষটির অচঞ্চল ভঙ্গি থেকে তৈরি হয়ে রয়েছে, যা ভেদ করে এই ঘর, আসবাব, এমনকী বাইরের পৃথিবীও লোকটির কাছাকাছি যেতে অক্ষম। সে বুকের কাছে দুই মুঠি ধরে দাঁড়িয়ে রইল। এই লোকটির ইচ্ছা—অনিচ্ছার উপর তার জীবনের ধারা বদলাবে।
‘বয়স কত…কুড়ি?’
অনন্তের ভরসা হল না কথা বলতে। শুধু হাসল।
চিঠিটা তুলে চোখ বোলালেন, একবার তাকালেন অনন্তের দিকে। কয়েক সেকেন্ড কী ভাবলেন।
‘নীচে গিয়ে বোসো, আর অজয়বাবুকে পাঠিয়ে দাও।’
কে অজয়বাবু সে জানে না, নীচের ঘরের প্রৌঢ়ই সম্ভবত। সিঁড়িতে সে মুখ ফিরিয়ে আয়নায় আবার নিজেকে দেখল। এই কয়েক মিনিটে তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন ঘটেছে বলে মনে হল না। সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে তার মনে পড়ল নমস্কার করে আসা হয়নি।
প্রৌঢ়ই অজয়বাবু। পরে জেনেছে ওর পুরো নাম অজয় হালদার। দোতলায় উঠে গিয়েই তাকে প্রায় তখুনি নেমে আসতে দেখে অনন্তের বুক কেঁপে উঠল। এত তাড়াতাড়ি ফিরে এল, তার মানে, বিদায় করে দাও! বেঞ্চে বসা লোকদুটিকে ইশারায় উপরে যেতে বলে অজয়বাবু গম্ভীরমুখে নিজের জায়গায় বসে বলল, ‘তোমার নাম কী?’
‘অনন্তকুমার দাস।’
‘বাবার নাম?’
‘ঈশ্বর শক্তিপদ দাস।’
‘বড়োছেলে?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘কে কে আছে?’
‘মা, এক ভাই, দুই বোন। আমি বড়ো।’
‘কদ্দুর লেখাপড়া?’
‘স্কুল ফাইনাল দোব, প্রাইভেটে…রাতে কোচিং—এ পড়ি। বাবা হঠাৎ বাস অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেলেন, তাই স্কুল…টাকাপয়সা কিছু রেখে যাননি।’
‘ঘটি না বাঙাল?’
‘ঘটি।’
‘এখানে বসে কাজ করার মতো ব্যাপার খুব কম। যখন জমিদারি ছিল তখন এখানে কাজ ছিল, অনেক লোকও ছিল। এখন যা—কিছু ব্যবসার কাজটাজ ধর্মতলা স্ট্রিটের অফিস থেকে হয়। বুলুবাবু ওখানেই বসেন।’
অজয়বাবু চশমায় ঠেলা দিয়ে জানলার বাইরে তাকাল। অনন্ত মনে মনে অধৈর্য হয়ে উঠেছে। ধান ভানতে শিবের গীত গাইছে, কাজটা হবে কি হবে না সেটা আগে বলুক। প্রৌঢ় জানলা থেকে চোখ ঘরের মধ্যে এনে তাকের উপর দিয়ে বিষণ্ণ চাহনি বুলিয়ে অনন্তের মুখে বসাল।
‘তুমি কাল থেকে কাজে এসো। যা করার সব কাল বুঝিয়ে দেব।’
‘এই সময়ে আসব?’
‘তাই এসো। আসল কাজ বাইরে, ভাড়াটেদের কাছ থেকে ভাড়া আদায়। অনেক টাকা মার গেছে, বছরের পর বছর ভাড়া বাকি, আদায় হয়েছে জমা পড়েনি…ভাড়াটে আছে কিন্তু আমাদের খাতায় নাম নেই অথচ তার কাছ থেকে ভাড়া আদায় হচ্ছে…এইসব। ভালো ভাড়াটেও আছে। রাজাবাজারের বস্তিটা গণিকে লিজ দেওয়া, গণির ভাড়ার টাকা মাসে মাসে ঠিক এসে যায়। এন্টালি আর আহিরিটোলার বাড়ি দুটোতেই যত ঝামেলা। সব পুরোনো ভাড়াটে, চল্লিশ—পঞ্চাশ বছর ধরে এক—একজন বাস করছে। আর দুটো বাড়ি টেরিটি বাজারে, সবই অফিস, ঠিক সময়ে দিয়ে দেয়।’
অজয়বাবু নীচু স্বরে ধীরে ধীরে যা বললেন তার বেশিরভাগই অনন্তের কানে পৌঁছল না। সে বুঝে গেছে কাজটা সে পেয়েছে, সত্যিকারের একটা চাকরি। সংসারের মাথার উপর এবার একটা চালা বসল।
ধীরে ধীরে তার চোখ জলে ভরে এল। কার কাছে সে কৃতজ্ঞতা জানাবে? সমীরেন্দ্র বসুমল্লিক…অজয়বাবু…সাধন বিশ্বাস নাকি অমর?
‘এস্টেটের নিয়ম হয়েছে ধর্মতলা অফিসের মতো এখানেও একই স্কেলে মাইনে দেওয়া হবে।…প্রথম ছ—মাস প্রোবেশনার, থোক আড়াইশো পাবে।’
‘কত?’
অজয়বাবু আবার বলল, অনন্তের কানে এল মা যেন বলছে, ‘আর একটু ভাত নে।’
‘কাঁদছ কেন?’
‘রাতে আমার ঘুম হত না। কী করে সংসারটা চালাব ভেবে পেতাম না। সবাই আমার মুখ চেয়ে আছে, বড়োছেলেই তো বাবার জায়গা নেয়।’
‘ছ—মাস পর যদি পাকা হও তখন হাতে তিনশো টাকার মতো পাবে।’
ছয়
রাস্তায় দাঁড়িয়ে সেদিন চারপাশের বাড়ি, মানুষ, যানবাহন, দোকান, ফেরিওয়ালা এমনকী রাস্তার জঞ্জালও তার কাছে নতুন এবং বিস্ময়কর মনে হচ্ছিল। অসহায়ভাবে সে বুঝতে পারছিল না তার পৃথিবীটা হঠাৎ বদলে যাচ্ছে কেন! তার বোধের আয়ত্তে থাকছে না কেন? সে কোথাও কোনো ত্রুটি দেখতে পাচ্ছে না। শুধু মনে হচ্ছে মানুষ এবং বাড়িগুলো একটু ছোটো হয়ে গেছে, অথচ সবই রয়েছে পুরোনো শৃঙ্খলা মেনে।
সেদিন হাঁটতে গিয়ে তার পদক্ষেপ বার বার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। লোকে কি মাতাল ভাববে? সে আপনমনে হেসে ইচ্ছে করে আরও এলোমেলো পা ফেলছিল। জামার হাতায় চোখের জল মুছেছিল। কী অদ্ভুতভাবে একটা নতুন রাস্তা তার সামনে এসে গেল। এই রাস্তা ধরে তাকে সাবধানে এগোতে হবে, সংসারটাকে সঙ্গে নিয়ে।
ছ—মাস না হলে চাকরিটা পাকা হবে না। ছ—মাস সে খুব ভালো কাজ দেখাবে, খাটবে আর কোনো প্রলোভনেই টলবে না। এই কাজে নাকি চুরির সুযোগ আছে, নিশ্চয় তার উপর লক্ষ রাখা হবে। রাখুক।
অনন্ত নানান অজানা রাস্তায় সেই দুপুরে হেঁটেছিল, বহুক্ষণ। সে জানে হারিয়ে যাবার কোনো উপায় নেই। প্রত্যেকটা গলি তাকে একসময় চেনা রাস্তায় পৌঁছে দেবেই। একসময় সে পৌঁছেও গেছল বাড়িতে। মা তখন মেঝেয় ঘুমোচ্ছিল। নিঃশব্দে জামা খুলে আলনায় রেখে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখল মা—র চোখ খোলা, চাহনিতে ভয়। ফিসফিস করে বলল:
‘কী হল রে?’
‘হয়েছে।’
ধড়মড়িয়ে উঠে বসল শীলা। ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘ভগবানকে সকাল থেকে ডাকছিলুম, মন বলছিল হয়ে যাবে। কত টাকা দেবে?’
বিকেলে অনন্ত রকে বসে বহুদিন পর ছেলেদের রবারের বল খেলা দেখল। নিজেকে তার হালকা লাগছে। কী বিরাট চাপে এতদিন কুঁকড়ে ছিল আজ সে বুঝতে পারছে। পাড়ার লোকেদের মুখোমুখি হতে এবার তার আর সংকোচ নেই। এখন সে মোটামুটি রোজগেরে—জীবনের সঙ্গে জড়ানো কিছু কিছু পরিস্থিতির সামনে দাঁড়াবার ক্ষমতা তার হয়েছে। তবে এটুকু জানে, প্রথম মাসের মাইনে না পাওয়া পর্যন্ত তাকে আগের মতোই টেনেটুনে চলতে হবে।
প্রসাদ ঘোষকে তার জানিয়ে আসা উচিত ছিল, আর সে কমলা বাইন্ডার্সে যাবে না। অঘোর এস্টেট থেকে বেরিয়ে প্রথমে ওখানেই যাওয়া দরকার ছিল অথচ তখন তার একদমই মনে পড়ল না! আঠারো দিনের কাজের টাকা পাওনা হয়েছে। কাল ন—টার মধ্যে গিয়ে জানিয়ে আসবে। টাকা নিশ্চয় তখুনি দেবে না, ঘোরাবে। কোনো পাওনাদারকেই একবারে টাকা দেয় না।
তা ছাড়া, গৌরীর কাছেও খবরটা পৌঁছনো দরকার। আড়াইশো টাকার চাকরি পাবার যোগ্যতা যে তার আছে এটা ও জেনে যাক। ওর অবাক হওয়া মুখটা কেমন দেখাবে কে জানে! কিন্তু ও তো আর দোকানে আসে না, ভাইকে বলে দিলেই হবে। গৌরী বলেছিল, ভাইয়ের হাত দিয়ে চিঠি দেবে। সে চিঠি আর পাওয়া হবে না, হয়তো আর কোনোদিন তাদের দেখাই হবে না।
সে বিমর্ষ হয়ে থেকেছিল কিছুক্ষণের জন্য। গৌরীর সঙ্গে সম্পর্কটা বন্ধুত্বই, এমন আলাপ যে—কোনো ছেলের সঙ্গেও হতে পারত। অনন্ত মন থেকে গৌরীকে ঝেড়ে ফেলে দিতে চেয়েছিল। জীবনের এই সময়টায় কোনো মেয়ের কথা ভাবলে তার চলবে না, তাকে উন্নতি করতে হবে। তা ছাড়া, গৌরী তো ভালোবাসে আর একজনকে। দরকার কী ওকে নিয়ে আজেবাজে ভাবনায়।
অনন্ত তার পরবর্তী সতেরো বছরে সংসার আর চাকরি ছাড়া, আর কিছু ভাবেনি। কিছু কিছু ঘটনা ঘটেছে, সে নাড়া খেয়েছে, বিভ্রান্ত হয়েছে, দুঃখ পেয়েছে। কিন্তু তার জীবনধারায় কোনোটিই বাঁক ফেরাতে পারেনি কিংবা হয়তো সে বাঁক নিতে চায়নি। তার নিজস্ব জগতের বাইরে যেতে সে ভয় পায়। একটা নির্দিষ্ট খাতের মধ্যে সে জীবনকে ঢেলে দিয়েছিল এবং বছরের পর বছর খাতটাকে শুধু গভীরই করেছে, কখনো উপচে পড়ার বা বদলাবার চেষ্টা করেনি। সে শুধু ভালো ছেলে হয়ে থাকার চেষ্টা করেছে।
এন্টালিতে অঘোর ভবনের ভাড়া আদায় করতে গিয়ে প্রথম দিনে তার বুকের মধ্যে কাঁপন ধরেছিল। প্রত্যেকেই তাকে দেখে অবাক হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছে। এ আবার কে? অনন্ত জানত প্রথমটা এরকমটা হবেই।
‘পরিমলবাবু কোথায়? আপনি কে?’
‘আমি পরিমলবাবুর জায়গায় কাজ করছি, তাকে এখন অন্য কাজে দেওয়া হয়েছে।’
রাস্তার উপর কাচ ও আয়নার দোকানের মালিক নারায়ণ দত্ত যেন ভাবনায় পড়ে গেল এমনভাবে মাথা চুলকে অনন্তর দিকে তাকাল।
‘পরে আসবেন।’
‘কখন?’
‘এই তো দোকান খুললুম, অন্য একসময় আসুন, এখনও ক্যাশে কিছু জমা পড়েনি।’
‘অন্য এক সময় মানে কখন?’
অনন্ত নাছোড়বান্দা। যত বিরক্তই হোক সে লেগে থাকবে। নারায়ণ দত্ত অবশ্য ভাড়া ফেলে রাখে না। ভাড়াটেদের ভাড়া দেওয়ার তারিখ খাতা থেকে দেখে সে বুঝে নিয়েছে কার কাছে কবে যেতে হবে।
‘পরশু বিকেলে আসুন।’
ভাড়ার বিলবই তার সঙ্গেই আছে। ন্যাশনাল গ্লাস স্টোরের বিলের পিছনে সে তাগিদায় আসার তারিখটা লিখে রাখল। পাশেই হিন্দ মোটর পার্টসের দোকান। মালিক এক পাঞ্জাবি। এখানেও প্রায় একই কথা, পরের হপ্তায় দেব।
অঘোর ভবনের ফটকের লাগোয়া একটা পান—সিগারেটের দোকান। দেওয়ালে কাঠের পাটা লাগিয়ে ফুটপাথের দিকে দেড় হাত বেরিয়ে থাকা জায়গাটুকুতে বাবু হয়ে বসে, পরিষ্কার ধুতি গেঞ্জি পরা, কপালে সিঁদুর ফোঁটা, পাকানো গোঁফ, টেরিকাটা, হৃষ্টপুষ্ট লোকটির বা দোকানের নামে বিল লিখেছে বলে অনন্তর মনে পড়ল না। খাতায় নাম থাকলে নিশ্চয়ই বিল লেখা হয়েছে! সে তন্নতন্ন করে বিলবইটার প্রত্যেক পাতা দেখল। অঘোর ভবনের দেওয়ালেই যখন দোকান, তা হলে অবশ্যই তাদের ভাড়াটে। কিন্তু পান—সিগারেট দোকানের নামে একটিও বিল নেই!
অস্বস্তিভরে সে দোকানের সামনে দাঁড়াল। লোকটাকে শক্তধাতের মনে হচ্ছে। পান সাজছে যন্ত্রের মতো হাত চালিয়ে। চুন, খয়ের, সুপুরি, জর্দা, দশ সেকেন্ডের মধ্যে পান তৈরি! সার সার নানা ব্র্যান্ডের সিগারেট প্যাকেট। বলা মাত্রই আঙুলের ডগা দিয়ে প্যাকেট টেনে নিয়ে সিগারেট বার করে দিচ্ছে।
অনন্ত অপেক্ষা করল খদ্দেরদের বিদায় হওয়ার জন্য। একসময় লোকটি ভ্রূ তুলে তাকাল, ‘কী দেবে?’
‘আপনার দোকান?’
‘হ্যাঁ।’
সন্দিগ্ধ এবং বিস্মিত চোখে তাকে দেখছে। অনন্ত এগিয়ে এসে গলা নামিয়ে বলল, ‘আপনি ভাড়া দেন?’
‘নিশ্চয়।’
‘আমি ভাড়া আদায় করতে এসেছি।’
‘কী নাম আপনার, কে পাঠিয়েছে?’
‘এস্টেট থেকে আসছি, আমার নাম অনন্ত দাস।’
বিল বইটা সে দেখাল। লোকটার কথায় সামান্য বিহারি টান না থাকলে বাঙালিই মনে হত।
‘আপনি যে বাড়িওয়ালার লোক তা বুঝব কী করে? বিল তো ছাপাখানা থেকে যে— কেউই ছাপিয়ে আনতে পারে।’
অনন্ত ফাঁপরে পড়ল। একটা চিঠি বা ছবিওলা আইডেন্টিটি কার্ড থাকলে ভালো হত। এমন প্রশ্ন যে উঠতে পারে তা একবার ভেবেওছিল। অজয় হালদার বলেছিল : ‘ও—সব লাগবে না, সবাই একবার চিনে গেলে আর কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করবে না।’ অনন্ত দ্বিতীয়বার আর বলেনি। নিজেকে চিনিয়ে নিতে না পারাটা হয়তো তাকে অযোগ্যতার পর্যায়ে ফেলে দেবে।
‘আমার ভাড়া পরিমলবাবু নিয়ে যেত।’
‘তিনি আর নেই।’
‘জানি। আমাকে বলে গেছে। এস্টেটের পেট্রল পাম্পে কাজ করছে।’
‘তা হলে ম্যানেজারবাবুকে বলব ভাড়ার জন্য আপনাকে চিঠি দিতে।’
‘চিঠিমিঠি কেন দেবেন’…লোকটা বিব্রত হয়ে বলল। ‘আপনাকেই ভাড়া দেব। পরিমলবাবু তো বিলটিল দিত না, আপনিও দেবেন না।’
‘সে কী! বিল দেব না?’
খদ্দের এসে পান চাওয়ায় লোকটা ব্যস্ত হল। অনন্ত এইবার বুঝতে পারছে ভাড়াটেদের লিস্টে কেন এর নাম নেই। এস্টেটকে গোপন করে দোকান বসানো হয়েছে, ভাড়াটাও গোপন রাখা হয়েছে। পরিমল চাটুজ্জেই একমাত্র লোক আদায়ের দায়িত্বে ছিল। সে যা জমা দিত তাই জমা করা হত। খাতাপত্র সেই লিখত, হিসেবও রাখত। কেউই ভাড়াটে সম্পর্কে খোঁজখবর নিত না। এভাবে কত টাকা যে পরিমল চাটুজ্জে পকেটে পুরেছে কে জানে!
‘তিন হাজার টাকা সেলামি দিয়েছি, মাসে সত্তর টাকা ভাড়া। আজ দু—বছর হল দোকান করেছি।’
লোকটা হাসছে। হাসিটা খুব স্বচ্ছ নয়।
‘আগের লোক কামিয়েছে, আপনিও কামান। ভাড়ার টাকা তো আমি দেবই। টাকা কে নিচ্ছে তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। এ—বাড়িতে অনেকভাবে টাকা কামাতে পারবেন।’
‘অনেক ভাবে?’
‘হ্যাঁ অনেকভাবে। আপনাকে পরে বলব।’
‘এখনই বলুন না।’
‘বাড়ির উঠোনটা তো দেখেছেন, কত রকমের লোহালক্কড়, বস্তা, বাক্স, পেটি পড়ে আছে, ওমনি ওমনি কি আছে? ভাড়া দিচ্ছে। বিলটিলের ধার ধারে না।’
‘কারা দিচ্ছে?’
‘কাচের দোকানের মাল থাকে, মোটর পার্টসের দোকানেরও থাকে, বাইরের প্লাইউড দোকানের বড়ো বড়ো বোর্ড, রাতে রেডিমেড জামাকাপড়ওয়ালার চৌকি বাক্সও থাকে। জলের পাম্প খারাপ বলে, নতুন পাম্প পরিমলবাবু কিনল, পাম্পটা কিন্তু ভালোই ছিল, সেটা বিক্রি করে দিল, টাকা কি জমা দিয়েছে? দেখুন আমি সব জানি, বুঝতে পারি। এখানকার দারোয়ান নিতাই ওরই লোক…বাঙালি। একে আগে তাড়ান, চোট্টা আছে। রাতে এসে দেখবেন কত লোক ঘুমোয়, সকালে স্নান করে, পায়খানা সারে, সবার কাছ থেকেই পয়সা নেয় নিতাই। আমি আপনাকে ভালো লোক দিব, আমার ভাইয়ের ছেলে।’
লোকটা এতক্ষণ ঝুঁকে চাপা স্বরে দ্রুত কথা বলছিল। খদ্দের আসতেই সোজা হয়ে বসল। অনন্ত উত্তেজিত বোধ করছে। এতভাবে বাড়িটা থেকে টাকা ওঠে অথচ এক পয়সাও জমা পড়েনি। আজই সে গিয়ে ম্যানেজার অজয়বাবুকে বলবে। রাতে সাধন বিশ্বাসকে তো জানাবেই। প্রথম দিনেই এই সব খবর পেয়ে যাওয়া, তার কল্পনার অতীত।
‘ওকে আসতে বলি?’
‘কাকে?’
‘আমার ভাইয়ের ছেলেকে।’
‘আগে ম্যানেজারবাবুর সঙ্গে কথা বলব। লোক রাখা না—রাখার মালিক তো আমি নই। এখন আপনার ভাড়াটা দিন।’
‘কাল পাবেন, দোকানে তো টাকা রাখি না, ঘর থেকে আনতে হবে। আপনি ম্যানেজারবাবুকে বলুন…এখানে যা চলছে তাতে এস্টেটেরই লোকসান হচ্ছে। ভালো লোক রাখা চাই। আমার ভাইয়ের ছেলেকে রাখলে চোরা কারবার বন্ধ হয়ে যাবে। আপনাকে সব তো বললুম, এবার আপনি ম্যানেজারবাবুকে বলুন।’
‘বলব। আপনার নামটা কী?’
‘নন্দকিশোর তেওয়ারি। আর যদি বলেন, আপনারও যাতে দু—চার টাকা আসে তা—ও ব্যবস্থা করতে পারি।’
‘আমি চোর নই।’
‘আহহা, আমি কি চুরির কথা বলছি! আপনাকে দেখেই বুঝেছি ভালো লোক আছেন। উপরি রোজগার তো ভালো—মন্দ সব মানুষই করে। টাকার কি দরকার নেই? সবার দরকার।’
‘আমার দরকার নেই। আমি কাল তা হলে আসছি।’
ফটক দিয়ে ঢুকে ডান দিকে সিমেন্ট বাঁধানো বড়ো চৌকো উঠোন আর সিঁড়ির পাশ দিয়ে ঢাকা লম্বা একটা পথ। নন্দকিশোর যা বলেছিল সেই রকমই, প্রায় গুদামের মতো হয়ে আছে জায়গাটা। একধারে স্তূপ হয়ে আছে কাঠের ভাঙা বাক্স। তার পাশে বস্তায় ভরা কাপড়ের ছাঁট, মোটর গাড়ির স্প্রিং পিনিয়ন, শরবতের ঠেলা গাড়ি, মোবিলের ড্রাম, দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ির পাশে বান্ডিল করে রাখা চটের বস্তা।
সে নিতাইকে খুঁজল। একতলায় একটা ঘরে থাকে, এইটুকুমাত্র সে জানে। ওকে সে একবারমাত্র অঘোর এস্টেটে দেখেছে। অজয় হালদার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিল: ‘দারোয়ান কাম কেয়ারটেকার। বছর দশেক কাজ করছে।’ চল্লিশের কাছাকাছি বয়স। কালো, রোগা, একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে। নিতাইয়ের বিনীত কৃতার্থ ভঙ্গি তার ভালো লাগেনি।
ঢাকা পথটায় সে উঁকি দিল। পথের শেষে তালা দেওয়া কলঘর, তার পাশে পায়খানা ও পাম্পঘর। বাঁ দিকে তিনটে ঘর, বসবাসের জন্য নয়। মাত্র একটি জানালা প্রতি ঘরে, সম্ভবত মালপত্র রাখার জন্যই ঘরগুলো। একটা ঘরের জানালা এবং দরজায় গেরুয়া রঙের পর্দা। অনন্ত এগিয়ে এসে পর্দা সরিয়ে দেখল, দরজায় তালা দেওয়া। এখানেই কি নিতাই থাকে? সে কি জানালা—দরজায় পর্দা টাঙানোর মতো লোক?
অনন্ত ফিরে আসার সময় সিঁড়ির কাছে তাকে পাশ কাটিয়ে পথটার দিকে চলে গেল একজন মহিলা। যাবার সময় কৌতূহলে তার দিকে একবার তাকিয়েছিল। ডান গালে আঁচিল, হাতে ছাতা আর ব্যাগ, ছোটোখাটো ফরসা চেহারা। কালো ফ্রেমের চশমা। দ্রুত ছোটো পদক্ষেপ, পরনে কালো সরু পাড় সাদা মিলের শাড়ি। তার মনে হল, ইনিই বোধ হয় ঘরটায় থাকেন। ভাড়াটে? কিন্তু একতলায় দোকান ছাড়া আর তো কোনো ভাড়াটে নেই।
কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে অনন্ত ঘরটার কাছে ফিরে এল। আলো পাওয়ার জন্য জানলার পর্দা অল্প সরানো, দরজার পর্দাও। কিন্তু তাতেও ঘরের ভিতরটা আবছা। অনন্ত কিছুই দেখতে পেল না। বাসন নাড়ানোর শব্দ এল।
মহিলা প্লাস্টিকের একটি বালতি হাতে হঠাৎ বেরিয়ে আসতেই অনন্ত এক পা সরে গেল। মহিলা তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কাউকে খুঁজছেন কি?’
‘হ্যাঁ, মানে আমি ভাড়া তুলতে এসেছি, নতুন, আজই প্রথম। আপনি কি টেনান্ট?’
‘টেনান্ট বললে টেনান্ট, নয়তো নয়।’
‘তার মানে!’
‘আপনি একটু দাঁড়ান, আমি জলটা ধরে নি। ছাদের ট্যাঙ্কে মাঝে মাঝে জল থাকে না, খুব অসুবিধায় পড়তে হয়…আপনি বরং ঘরে বসুন।’
‘না না এই তো বেশ আছি। আবার কেন…।’
কথা না বাড়িয়ে উনি কলঘরের দিকে গেলেন। চাবি দিয়ে কলঘরের তালা খুললেন। দরজা ভেজিয়ে দিলেন ভিতরে ঢুকে। অনন্তের মনে হল, এটাও পরিমল চাটুজ্জের আর একটা রোজগারের ব্যবস্থা। লোকটাকে তার দেখার ইচ্ছা হচ্ছে। শুনেছে বাগুইহাটিতে জমি কিনে একতলা বাড়ি তৈরি করেছে।
জলভরা বালতি নিয়ে উনি ফিরতেই অনন্ত জিজ্ঞাসা করল, ‘চাবি কি আপনার কাছেই থাকে?’
‘এটা ডুপ্লিকেট। দোকানের ওদের কাছেও একটা করে আছে।’
পর্দা সরিয়ে উনি ঘরে ঢুকে ভিতর থেকেই বললেন, ‘আপনি ভেতরে এসে বসুন।’
অনন্ত সামান্য দ্বিধা করে ঘরে ঢুকল। ঘরটা বেশ বড়োই। দড়িতে পর্দার কাপড় ঝুলিয়ে ঘরটা দু—ভাগ করা। উনি পর্দার ওধারে গেছেন হয়তো বাইরের কাপড় বদলাতে।
পর্দার এধারে অর্থাৎ দরজার কাছাকাছি খুবই পুরোনো একটি কাঠের গোলাকার টেবল আর দুটি হাতলবিহীন চেয়ার। টেবলে কয়েকটি পুরোনো বাংলা খবরের কাগজ সযত্নে ভাঁজ করে রাখা। শুধুই তারিখ দেওয়া একটা ক্যালেন্ডার দেওয়ালে। ঘরের কোণে এইমাত্র ছেড়ে রাখা জুতোর পাশে হাওয়াই চটি। ছোটো একটা জলচৌকিতে কুঁজো আর কাচের গ্লাস। জানলার কাছে নীচু একটা জালের আলমারি, তার উপরে কেরোসিন স্টোভ। জলের বালতিটা ওখানেই রাখা। আলমারিটাই বোধ হয় ভাঁড়ার এবং রান্নাঘরের কাজ করে। পর্দার ওধারে কী আছে অনন্ত তা জানে না। কিন্তু এধারে এত কম আসবাব এবং সেগুলি এত পরিচ্ছন্ন, গোছানো যে তাই থেকে এর মালিকের মানসিক গঠনটা যেন আঁচ করা যায়…নির্বিরোধী এবং কল্পনাপ্রবণ। অনন্তের মনে হল এই মহিলার সঙ্গে ঘরের চেহারাটার খুবই মিল আছে।
‘বসুন। বলুন কী বলছিলেন?’
একটা চেয়ারে উনি বসলেন অনন্তের মুখোমুখি। পর্দার ওধারে হালকা একটা ধোঁয়ার শিষ লতিয়ে উঠেছে। ধূপ জ্বালিয়েছেন। শাড়ি বদলে একটা সাদা থান পরেছেন। চশমার কাচ কাপড়ে মুছতে মুছতে হাসি মুখে তাকিয়ে। চোখের কোলে কালো ছোপ। বয়স বোধ হয় চল্লিশের এধার ওধারে।
‘আপনি কদ্দিন আছেন!’
‘তিন বছর।’
‘ভাড়া কত?’
‘সস্তাই, চল্লিশ টাকা।’
‘আপনার নাম কিন্তু আমাদের খাতায় নেই।’
সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন। ভ্রূ কুঁচকে সন্দিহান গলায় বললেন, ‘নাম নেই…কেন?’
‘কাকে ভাড়া দিতেন?’
‘পরিমলবাবুকে, তিনিই তো মালিকের লোক!’
‘হ্যাঁ। বিল দিতেন?’
‘নিশ্চয়, দাঁড়ান আপনাকে দেখাই।’
উনি উঠে গেলেন। দড়িতে কড়া লাগানো পর্দাটা সরিয়ে ভিতর মহলে যাবার সময় অনন্ত ওঁর দিকে তাকিয়েছিল। তাই সে সরানো পর্দার ফাঁকা জায়গা দিয়ে দেখতে পেল দেওয়ালে প্রায় এক হাত চতুষ্কোণ, সাদা ফ্রেমে বাঁধানো একটা ফোটো। একটি পুরুষের মুখ, গলা ও কাঁধ দেখা যাচ্ছে। ফোটোর নীচে কাঠের ব্র্যাকেট, সেখানে ধূপদানিতে তিন—চারটি জ্বলন্ত ধূপ।
ধীরে ধীরে অনন্তের ঘাড় থেকে শিরদাঁড়া বেয়ে চলন্ত পোকার মতো একটা বিস্ময় নেমে গেল কোমর পর্যন্ত। বাবা! কোনো সন্দেহ নেই। ডান দিকের রগের কাছে কাটা দাগটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওটা নাকি স্কুলে পড়ার সময় কংগ্রেসের সত্যাগ্রহ আন্দোলনের মিছিলে পুলিশের লাঠিতে হয়েছে। বাবা এর বেশি তাদের কিছু বলেনি।
এখানে এমন অকস্মাৎ বাবার ছবি দেখতে পেয়ে অনন্ত প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেল। তার বোধ ও যুক্তির শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার মতো দশায়। টেবলে রাখা আঙুলগুলো থরথর করছে, গলা শুকিয়ে এল। মাথায় একটা চিন্তাও স্থির থাকছে না।
ইনি তা হলে কে? বাবার ছবি এত যত্নে টাঙানো, ধূপ জ্বালানো…কে হন? মনের মধ্যে হঠাৎ ঝলসে উঠল বাবাকে লেখা কে এক মিনুর চিঠিটা।
‘এই যে পাঁচ মাস আগের একটা বিল।’
অনন্ত অসাড় হাতটা বাড়িয়ে বিলটা নিল। হুবহু তার কাছে যে বিল রয়েছে সেই রকমই। এস্টেটের স্ট্যাম্পটা আসলই কিন্তু সইটা কেমন জড়ানো, কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
মিনতি করের নামে বিল। ডাকনাম মিনু হওয়াই সংগত।
‘মিনতি কর আপনার নাম?’
‘হ্যাঁ।’
‘পরিমলবাবুর সই?’
‘বলতে পারব না, উনি লিখেই আনতেন, শুধু তারিখটা বসাতেন ভাড়া নেবার সময়।’
ছবিটা কবে তোলা? সতেজ যুবকের মতো দেখাচ্ছে। চাহনিটা জ্বলজ্বলে, তীক্ষ্ন অথচ হালকা হাসিতে ছাওয়া। বাবার এমন মুখ সে কখনো দেখেনি। ঘন থাক থাক চুল কপাল থেকে পিছনে ওলটানো। চুল উঠে কপালটা চওড়া হয়ে গেছল শেষ দিকে। চোয়ালে চর্বি জমেছিল কিন্তু এই ছবিতে গালদুটো মসৃণ, সমান। বাবার বয়স তখন কত, পঁচিশ—আঠাশ? ছবিটা কি বিয়ের আগে তোলা? অনন্ত কখনো তার বাবার এই ছবি দেখেনি।
সে কথা বলছে না। উনি অবাক হয়ে অনন্তের দৃষ্টি অনুসরণ করে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালেন। ছবিটার দিকে সারাক্ষণ চোখ স্থির হয়ে রইল।
‘এটা তো পাঁচ মাস আগের, তারপর আর ভাড়া দেননি?’
পাংশু হয়ে গেল ওর মুখ। শিশুর মতো মাথা নাড়তে লাগলেন।
‘চার মাস দেননি, এইটে নিয়ে পাঁচ মাস।’
‘হ্যাঁ। আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব হয়নি, এখনও সম্ভব নয়। অ্যাঞ্জেল কেমিক্যালসে কাজ করতুম, আজ ছ—মাস সেখানে লক আউট চলছে। জানি না অফিস আর কখনো খুলবে কি না।… আমাকে কি তুলে দেবেন?’
অনন্তের বড়ো করুণ লাগল ওর শেষের কথাটি। কিন্তু বাবার সঙ্গে এর কোথায় পরিচয়, কেমন করে পরিচয়? এই রকম একটা ছবি তাদের সংসারে নেই কেন? গত ছ—মাসের মধ্যে একবারও কি কেউ বাবার সম্পর্কে কোনো কথা বলেছে…অনু, অলু, মা? সে নিজে?
প্রশ্নগুলো একসঙ্গে তার মাথাটাকে কামড়ে ধরছে আর যন্ত্রণাটা বুকের দিকে এগোচ্ছে।
সে কি নিজের পরিচয়টা এবার দেবে? ওঁর সঙ্গে বাবার সম্পর্কটা আগে জানা দরকার। ধূপ কি রোজ জ্বালেন? বাবার কোনো ছবি সে আজ পর্যন্ত দেখেনি। তাদের ঘরে মানুষের কোনো ছবি নেই।
‘তুলে দেওয়ার মালিক তো আমি নই। তবে আপনি বেআইনিভাবে রয়েছেন।’
‘আমি তো ভাড়া দিয়ে গেছি। ভাড়া বাকি তো পড়তেই পারে।’
‘কিন্তু আমাদের খাতায় আপনার নাম নেই, আপনার ভাড়াও জমা পড়েনি। সবই পরিমলবাবু নিজে গাপ করেছেন।’
‘সে কী! আমি তা হলে ভাড়াটে নই? পরিমলবাবু এইরকম লোক তা তো বুঝতে পারিনি। আমাদের অফিসে ওর ভাই কাজ করেন তার মারফত ওর সঙ্গে পরিচয়। খুব দরকার শুনে ঘরটা আমাকে দিলেন। ওঁকে ছাড়া আর কাউকে চিনিই না।’
অনন্ত মাথা নাড়ল।
‘বাইরে পানওলারও একই ব্যাপার।’
‘আমাকে আপনারা তা হলে রাস্তায় বার করে দিতে পারেন?’
‘আপনি অত ভাবছেন কেন? আর কোথাও কি থাকার জায়গা আছে?’
‘আমার কোথাও কেউ নেই।’
আর্তনাদের মতো অনন্তের কানে ঠেকল। অবিনাশকাকা বলেছিল বাবা প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে দু—বারে সাত হাজার টাকা তুলেছে, সে কি এনারই জন্য? কীভাবে খরচ হল?
চিঠিটায় একটা লাইন ছিল : ‘গত এক মাসে একবারও এলে না।’ এখানে কি বাবা আসত! কিন্তু মিনতি কর তিন বছর এই ঘরে, তার মানে বাবা মারা যাওয়ার পর এসেছেন। আগে তা হলে কোথায় থাকতেন?
‘আপনার আত্মীয়স্বজন, ছেলেমেয়ে…!’
‘নেই।’
‘আপনি অবিবাহিতা?’
প্রশ্নটা করেই শ্বাসবন্ধ করে উত্তরের অপেক্ষায় রইল। জিজ্ঞাসা করাটা বোধহয় গর্হিত হয়ে গেল।
মিনতি করের চাহনিটা ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এল নিবিয়ে দেওয়া সলতের আগুনের মতো। চোখের মণিদুটো গাঢ় হয়ে উঠল। মাথাটা একটু নুয়ে পড়ল।
অনন্ত আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারল না। উত্তেজনার আধিক্যে সে বলে ফেলল, ‘ওই ছবিটা কার, আপনার স্বামীর?’
প্রশ্ন করেই মায়ের মুখটা একবার তার চোখে ভেসে উঠল। বাবার গোপন জীবনের মধ্যে সে ঢুকতে যাচ্ছে। উচিত কি অনুচিত, বুঝতে পারছে না। সে অঘোর এস্টেটের কর্মচারী, ভাড়া আদায় করতে এসেছে। তার সামনে এমন একজন যিনি আইনত ভাড়াটে নন। সেইভাবেই তার আচরণ, কথাবার্তা হওয়া উচিত নয় কি? কারোর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে প্রশ্ন করার অধিকার তার নেই।
তবে ওঁকে অঘোর এস্টেটের একজন কর্মচারী এমনভাবে ঠকিয়েছে যেটা ধরা ওঁর পক্ষে সম্ভব নয়। দোষটা ওঁর নয়। অনন্ত তার অনভিজ্ঞতা সত্ত্বেও বুঝতে পারছে তার তরফ থেকে বলার কিছু নেই।
কিন্তু সে বাবার জীবনেরই একটা অংশ। ওই ছবিটায় তারও এক ধরনের অধিকার আছে। সুতরাং সে জিজ্ঞাসা করতে পারবে না কেন?
‘উনি আমার কেউ না অথচ সব।’
মৃদু স্বরের কথাগুলো চন্দনের গন্ধের সঙ্গে ভেসে অনন্তের রোমকূপগুলোয় ধীরে ধীরে থিতিয়ে বসল। অযথা একটা ভার তার শরীরকে ক্লান্ত করতে শুরু করল। সে চুপ করে থাকল।
‘জীবনটা একসময় বড়ো ছোটো মনে হত, সময় কীভাবে যেন হু হু করে চলে যেত।’
মিনতি কর আবার মুখ ফিরিয়ে ছবিটার দিকে চেয়ে রইলেন। অনন্ত, ওঁর ডান চোখের কিনারা বাষ্পে চকচক করছে, দেখল।
‘পাশের বাড়িতে ওঁরা থাকতেন, ছোটো থেকে আলাপ। আমাদের বিয়ে হবে ঠিক ছিল, হয়নি।’
‘কেন?’
‘আমার নামে অনেক কিছু রটনা করেছিল ওঁর ভাই, উনি তা বিশ্বাস করেছিলেন। তখন আমার উপর রেগে তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলেন।…পরে অবশ্য ভুল বুঝতে পারেন।’
‘আপনি বিয়ে করেননি?’
মিনতি কর ধীরে মাথা নাড়লেন।
‘মেয়েরা একজনকেই ভালোবাসে।’
‘ওঁর বউকে দেখেছেন।’
‘না।’
অনন্ত ইতস্তত করে বলল, ‘ওর পরিবার সম্পর্কে কিছু জানেন না?’
‘খুব বেশি নয়। দুটি ছেলে দুটি মেয়ে জানি, তারা স্কুলে পড়ে। বড়োটি হয়তো এখন কলেজে।’
‘তারা কি আপনার কথা জানে?’
‘বোধ হয় না।’
মিনতি কর উঠে ছবিটার কাছে গেলেন। দু—তিনটে ধূপ নিবে গেছে, দেশলাই জ্বেলে ধরালেন।
‘এখন ধূপগুলো যা হয়েছে, একটা গোটা দেশলাই খরচ হয়ে যায়।’
‘রোজ জ্বালেন?’
‘প্রতি শুক্কুরবার জ্বালি, এই বারেই উনি মারা গেছেন।’
বাবার মৃত্যুর তারিখটা তার মনে আছে কিন্তু বার কী ছিল মনে নেই। তারিখটা এলে বাবাকে মনে পড়ে। ছড়ানো এলোমেলো কিছু ছবি, কিছু ভঙ্গি,…থালায় ভাত মাখার, জুতোয় ফিতে বাঁধার, রাস্তা দিয়ে হাঁটার। কিছু কথার… ‘পায়ের আঙুলে ময়লা কেন?’; পেনসিলটা দু—আধখানা করে দু—জনে নাও’; ‘রান্নাঘরটা এত নোংরা থাকে কেন?’ সেদিন অন্যদের কীভাবে বাবাকে মনে পড়ে তা জানে না, কেউ বাবার প্রসঙ্গ তোলে না। তাদের জীবনে আর যেন মানুষটির কোনো দরকার নেই। মা—ও কখনো কিছু বলে না।
অথচ এই ঘরে বাবাকে মনে রাখা হয়েছে। কিছু একটা দিয়েছেন যা মিনতি করের জীবনে গভীরভাবে শিকড় ছড়িয়েছে। কী সেটা? ভালোবাসা! বাবাও নিশ্চয় ওঁর কাছ থেকে পেয়েছেন। ব্যাপারটা সে ঠিকমতো বুঝতে পারছে না। আর কিছু জিজ্ঞাসা করাটাও উচিত হবে না।
‘চাকরি নেই তা হলে ভাড়া দেবেন কী করে, এখন চালাচ্ছেন কীভাবে?’
‘টিউশানি করছি, সকাল বিকেল রাত, খাওয়াটা চলে যায়।’
‘কিন্তু ভাড়া?’
‘আমি জানি না…কীভাবে যে দোব! উনি থাকলে আজ এসব চিন্তা করতে হত না।’
অনন্ত উঠে দাঁড়াল।
‘যাচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ। আমাকে আর আপনি করে বলবেন না, লজ্জা পাব।’
‘আমাকে তুলে দেওয়া হবে কি? আমি তো জানতাম না পরিমলবাবু এভাবে ঠকাবেন!’
‘দেখি কী করা যায়।’
ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নিতাইকে সে খুঁজে পেল না। নন্দকিশোর তাকে দেখে চেঁচিয়ে বলল, ‘দেখবেন বাবু, আমার ভাইয়ের ছেলের কথাটা মনে রাখবেন।’
অঘোর এস্টেটে ফিরে এসে অনন্তকে অপেক্ষা করতে হল। ম্যানেজার অজয় হালদার ব্লাডপ্রেশারের রুগি, দুপুরে ঘণ্টা দুই ঘুমোন। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে অনন্ত জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে সময় কাটাল। তখন সে গোপন একটা ব্যাপার জেনে ফেলার ধাক্কা সামলে নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে যায়। সে ঠিক করে ফেলে মিনতি করের কথা বাড়িতে কাউকে বলবে না।
তার আজকের অভিজ্ঞতার কথা সে অজয় হালদারকে বলল। তিনি চোখের ইশারায় দোতলার বৈঠকখানাকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘ওনাকে জানাতে হবে। নিতাইকে সরিয়ে অন্য কাউকে রাখা না—রাখার মালিক উনি। তবে এরকম যে চলছে সেটা আঁচ করে ঠারে ঠোরে ওনাকে বলেওছি কয়েকবার। যাই হোক পরিমলকে শেষ পর্যন্ত অ্যাটর্নিবাবুর পরামর্শে সরানো হল। এটা এমনি এক চাকরি প্রলোভন পদে পদে। সৎ মানুষকে অসৎ করে দেয়, দশ বছরে তিনজনকে সরানো হল। তুমি যেসব কথা খুলে জানালে এটাই দরকার। সৎ থাকবে তা হলে জীবনে উন্নতি করতে পারবে।’
কথাগুলো শুনতে শুনতে অনন্তের বুকের মধ্যে কাঁপন লাগল। সেসব কথাই বলেছে শুধু একটি ঘরের কথা বলেনি যেখানে বাস করে এমন একজন যে তার বাবাকে ভালোবাসত, আজও ভালোবাসে।
সে বিমর্ষ হয়ে বাড়ি ফিরল। জেনেশুনে এই প্রথম সে অসাধু হল। কেউ জানতে পারলে তাকে আর ভালো বলবে না। কাউকে বোঝাতেও পারবে না কেন সে মিনতি কর নামটা খাতাপত্রের বাইরে রাখতে চায়।
রাত্রে সাধন বিশ্বাসকে সে এন্টালির বাড়ির কথা বলল। তিনি যে ঠিক লোককেই কাজটার জন্য সুপারিশ করেছেন, লোক চেনার সেই বিরল ক্ষমতার গর্ব তার চোখেমুখে প্রতিফলিত হল। এবারও একতলার ঘরের কথাটা সে বলতে পারল না।
রাতে খাওয়ার পর হঠাৎই সে মাকে বলল, ‘বাবার কোনো ছবি নেই?’
‘আছে তো।’
‘কই দেখি?’
শীলা ট্রাঙ্ক খুলে কাপড় ঘাঁটাঘাঁটি করে ছবি বার করে আনল।
অনন্ত অবাক হয়ে দেখল সেই ছবিটাই যা আজ সকালে সে দেখেছে, তবে এটা আকারে অনেক ছোটো পোস্টকার্ড মাপের।
‘কবেকার তোলা?’
‘বিয়ের পর।’
‘রেখে দাও।’
সে দ্বিতীয়বার আর ছবিটার দিকে তাকায়নি।
ঘুমিয়ে পড়ার আগে সে মনের মধ্যে একটা খচখচানি অনুভব করেছিল। সে তখন জানত না আজীবন এটা তাকে অস্বস্তি দেবে।
.
সাত
পরের মাসেই অনন্তের চাকরি পাকা হয়ে গেল। যে উদবেগ সে এবং তাদের সংসার কাঁটা হয়ে থাকত, সেটা আর নেই। এখন তারা নিরাপদ, এই বোধ তাদের স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছে পরিচিতের সঙ্গে মেলামেশায়।
অজয় হালদারের অবসর নেবার সময় হয়ে এসেছে, ব্লাডপ্রেশারের জন্য প্রায়ই কামাই করে। বাবার আমলের লোক, সমীরেন্দ্র তাই ওকে বসিয়েই মাইনে দেন। ওর কাজগুলো একে একে অনন্তের উপর এসে পড়তে লাগল। এতে সে খুশিই। অবসর সময় কীভাবে কাটাবে সেই সমস্যা অনেকটা মিটিয়ে দেয় বাড়তি কাজগুলো।
কর্মস্থল থেকে সে সোজা বাড়ি ফিরে আসে। সে সিনেমা দেখে না, আড্ডাও দেয় না যেহেতু তার বন্ধু নেই। মায়ের সঙ্গে সাংসারিক কথাবার্তা ছাড়া আর তার অবসর কাটাবার কিছু নেই।
ধুতি—শার্টের মতোই অঘোর এস্টেট থেকে বাড়ি প্রায় দেড়মাইল রাস্তা হেঁটে যাতায়াতের অভ্যাসটা সে ছাড়েনি।
আহিরিটোলার বাড়ির ভাড়া আদায়ে বা কর্পোরেশন অফিসে ট্যাক্স, ইলেকট্রিক অফিসে বিল জমা দিতেও সে হেঁটে যায়। হাঁটা তার কাছে নেশার মতো।
‘শরীর ফিট থাকে।’
‘তাই বলে রোজ রোজ এত হাঁটবি? এখন তো আর ট্রাম বাসের খরচ বাঁচাবার মতো অবস্থা নয়।’
‘না হলেই বা, খরচ না করলে যখন চলে তখন করব কেন, এ তো আর চাল নুন তেল নয়? হিসেব করে দেখেছি হাঁটলে আঠারো থেকে কুড়ি টাকার মতো সেভ হয়, বাড়িভাড়ার প্রায় ওয়ান—ফোরথ।’
শীলা দালানে রুটি সেঁকছিল। অনন্ত খালিগায়ে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে। তার পাশে থালায় গরম রুটি আর বেগুনভাজা।
‘সেদিন ওপরে গেছলুম, বড়োগিন্নি এ—কথা সে—কথার পর বলল, এবার কিছু বাড়াও, অনেকদিন ধরেই সত্তর রয়েছে…গোটা একতলা, এখন এর ভাড়া কম করে আড়াইশো, সেলামিও হাজার চারেক হবে। অনন্ত তো রোজগার করছে…’
‘ভাড়া বাড়াও বললেই যেন বাড়াতে হবে। আমাদের আহিরিটোলার বাড়িতে তিনখানা ঘর, ছাদ, আলাদা কল—পায়খানা নিয়ে রয়েছে, ভাড়া দেয় কত জানো? উনচল্লিশ টাকা বারোআনা। রেন্ট কন্ট্রোলে এই মাসেই সাধনবাবু ভাড়া বাড়ানোর জন্য মামলা তুলবেন। এন্টালির বাড়িতে এক—একটা ফ্ল্যাট, কেউ দেয় পঁয়তাল্লিশ, কেউ দেয় পঞ্চান্ন, সব পঞ্চাশ—ষাট বছরের ভাড়াটে।…উঠে যাক, এখুনি ছ—শো টাকার ভাড়া হয়ে যাবে। এদের বলে দিয়ো একআধলাও বাড়াব না।’
অনন্ত ক্রমশই হিসেবি হয়েছে, সেই সঙ্গে প্রখর হয়েছে বাস্তববুদ্ধি। সে এখন থেকেই ভাবতে শুরু করেছে অনুর বিয়ের কথা। অনু বড়ো হয়েছে। ওর শরীরের দিকে আগের মতো আর অসংকোচে তাকানো যায় না।
কয়েকদিন ধরেই তার চোখে পড়ছে উঠতি বয়সি কিছু ছেলে, তাদের জানলার উলটোদিকে উৎপলদের রকে বসে একটু বেশি জোরে কথা বলছে, নিজেদের পরাক্রম সম্পর্কে জোরালো দাবি রাখছে, ঘনঘন তাদের জানলার দিকে তাকায়। ওদের বেশিরভাগই তার থেকে মাত্র তিন—চার বছরের ছোটো কিন্তু তাকে দেখলেই গলা নামিয়ে কথা বলে। এটা তাকে অদ্ভুতভাবে তৃপ্ত করে। সে অভিভাবক, সংসারের কর্তা এবং মানী। বাবা বেঁচে থাকলে এমনভাবেই লোকে তাঁর সঙ্গে ব্যবহার করত! অথচ তখন তার বয়স পঁচিশও নয়।
খবরের কাগজে পাত্র—পাত্রীর বিজ্ঞাপন থেকে সে অনুর জন্য সম্বন্ধ খুঁজতে শুরু করে। তিন—চার জায়গায় চিঠিও দেয়। উত্তরও আসে।
‘সবাই টাকা চায়।’
‘এই তো আঠারোয় পড়ল আর দুটো বছর থাক না।’
‘না না, ছোটোতেই বিয়ে দেওয়া ভালো। তুমি বোঝো না, অল্পবয়সি কাঁচা মন সহজে অ্যাডজাস্ট করে নিতে পারে তাতে সুখীই হয়। আগেকার দিনে সাত—আট বছরেই বিয়ে দেওয়া হত, খুব ভালো নিয়ম ছিল।’
‘যা ভালো বুঝিস কর। গয়নাগুলো থাকলে ভাবনা ছিল না…দু—চার ভরি তো দিতেই হবে, একেবারে খালি গলা—হাতে কি মেয়ে দেওয়া যায়!’
‘ব্যাঙ্কে তো হাজার ছয়েক রয়েছে এখনও, তাই থেকে…’
‘অলুর জন্য লাগবে না?’
‘অর্ধেক টাকা ওর জন্য থাকবে।’
‘বিয়ের খরচ তো আছে…কিছু কেনাকাটা, লোক খাওয়ানো, নমস্কারি, ফুলশয্যার তত্ত্ব, দানের বাসন নমোনমো করে দিলেও তো হাজার দু—তিন, তার ওপর গয়না, অর্ধেক টাকায় এত সব হবে?’
অনন্ত চুপ করে থাকে। একটা প্রবল বিরক্তির মধ্যে তাকে হাত—পা বেঁধে যেন জোর করে শুইয়ে দেওয়া হচ্ছে। হাত—পা ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলেই বাঁধনগুলোয় টনটন করে ওঠে। এসব দায় বাবার।
কিন্তু এখন সে বাবার জায়গায়, সে বড়োছেলে। অনেক টাকার দায় তার ঘাড়ে, অনেক বছর এটা থাকবে। তাকে টাকা রোজগার করে যেতে হবে শুধু এদের জন্য। অমর থাকলে সাহায্য করত কি?
এন্টালি থেকে মৌলালির দিকে হেঁটে যাবার সময় দু—তিনদিন সে একটা চায়ের দোকানে সকালে অমরকে দেখেছিল খবরের কাগজ পড়ছে। সামনের প্লেটে টোস্ট। পরনে লুঙ্গি আর হলুদ পাঞ্জাবি। কাছাকাছিই কোথাও থাকে। দেখা করে কথা বলতে ইচ্ছে করলেও সে জড়তা কাটাতে পারেনি। কী ব্যবহার করবে?
অবশেষে দোকানটার সামনেই একদিন সকালে তারা মুখোমুখি হয়ে গেছল। ন—টার মধ্যে সেদিন এক ভাড়াটের সঙ্গে দেখা করার কথা। অনন্ত ব্যস্ত হয়ে হাঁটছিল, অমরকে সে দেখতে পায়নি।
‘এদিকে কোথায় যাও?’
অনন্ত চমকে উঠেছিল। অমরের দিকে প্রথমে সে অবিশ্বাসীর মতো তাকিয়ে হঠাৎ ডান হাতটা ওর কাঁধে রেখে বলেছিল, ‘তুই তো বেশ মোটা হয়েছিস।’
অমরের ভ্রূটা কুঁচকে উঠল। কথাটায় আমল না দিয়ে বলল, ‘বাড়ির সবাই ভালো আছে?’
‘হ্যাঁ, মা তোর কথা বলে।’
‘অ।’
ওদের দু—পাশ দিয়ে মানুষ চলাচল করছে। ফুটপাথের মাঝখানে পথজুড়ে থাকার জন্য কেউ কেউ বিরক্তিভরে তাকিয়ে গেল।
‘চা খাবে…এসো তা হলে।’
অনুরোধ নয়, প্রশ্ন নয় যেন নির্দেশ। উত্তরের জন্য পরোয়া না করে অমর চায়ের দোকানের দিকে এগোল। ওর সঙ্গে অনন্তও ঢুকল। মুখোমুখি বসল। জীবনে এই দ্বিতীয়বার সে রেস্টুরেন্টে বসল। প্রথমবার গৌরীর সঙ্গে। ছোটো দোকান, চারটে মাত্র টেবল। দরজাবিহীন রান্নাঘর থেকে ডিম আর সেঁকারুটির গন্ধ আসছে।
‘ওমলেট খাবে?…অ্যাই এদিকে আয়।’
যতক্ষণ না ওমলেট এবং মাখন লাগানো টোস্ট এল, অমর খবরের কাগজের পাতা উলটে দ্রুত উপর—নীচের হেডিংগুলোয় চোখ বোলাল। দু—তিনবার ঝুঁকে পড়ল।
ততক্ষণ অনন্ত ওকে দেখছিল। মসৃণভাবে কামানো গালদুটো ভরন্ত। গায়ের রং একটু তামাটে হয়েছে। পাঞ্জাবির বোতাম খোলা, বুকের লোম ঘন, দু—হাতেও রোম, বাঁ—হাতে কালো ডায়ালের ঘড়ি। চুল এলোমেলো, কিছুটা যেন লম্বাও হয়েছে। গলার স্বর আগের থেকে ভারী। অমর একটা পুরুষমানুষ হয়ে উঠেছে। ওকে দেখে অনন্তের ভালো লাগল।
কাগজ নামিয়ে অমর চায়ে চুমুক দিয়ে একটা টোস্ট তুলে নিল।
‘সবাই তা হলে ভালো আছে।’
‘মা তোর কথা প্রায়ই বলে, গিয়ে দেখা করলেই তো পারিস।’
অমর কাগজ পড়ায় মন দিল। টোস্টে কামড় দিয়ে চিবোতেই মড়মড় শব্দে অপ্রতিভ হয়ে অনন্ত চিবোনো বন্ধ রেখে টুকরোটা মুখের মধ্যে রেখে দিল ভেজাবার জন্য। অমর তার অস্তিত্বকে অগ্রাহ্য করে যাচ্ছে। কিছুই ভোলেনি তা হলে।
‘তুই এখন কী কচ্ছিস, থাকিস কোথায়?’
‘একটা ফার্মে আছি, রাত্তিরে পড়ি।’
‘বি এ—টা পাশ করেছিস?’
‘হ্যাঁ। তুমি কি এখনও বই বাঁধানোর কাছে আছ?’
‘না অনেকদিন ছেড়ে দিয়েছি। এই কাজটা…।’
অনন্ত থেমে গেল। ওকে বলা যাবে না। অমর জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে।
‘…বছর চারেক করছি। একটা এস্টেটে, এখন আর জমিদারি নেই, ওদের কলকাতার বাড়িগুলোর দেখাশোনা ভাড়া আদায় এই সব করি।’
‘অনু—অলুর কোন ক্লাস হল, পড়ছে ওরা?’
‘অনু ছেড়ে দিয়েছে পড়া, অলুর এবার প্রি—ইউ।’
‘ছাড়ল কেন, পড়া কি ছাড়তে আছে! এবার তা হলে বিয়ে দিয়ে দাও।’
নিজের বোন নয়, যেন দূরসম্পর্কের কোনো আত্মীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিচ্ছে এমন ভঙ্গিতে অমর বলল। অনন্তের ভিতরটা ক্রমশই বসে যাচ্ছিল। ফিকে হেসে ওমলেটের শেষ টুকরোটা চামচেয় তোলার চেষ্টা করতে করতে বলল, ‘তাই ভাবছি। টাকাপয়সা তো নেই হাতে…।’
অনন্তের আশা জাগল, অমর এবার বলবে সে সাহায্য করবে। কিন্তু তার বদলে সে ওমলেটের টুকরোটাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ‘ওভাবে উঠবে না, হাত দিয়ে তুলে নাও।’
অপ্রতিভ হয়ে অনন্ত তাই করল। অমর টাকা দিয়ে সাহায্য করবে না এটা সে বুঝে গেছে। কিংবা হয়তো চাইছে হাতজোড় করে দাদা তার কাছে টাকা চাক।
কিন্তু সে চাইবে না। ক—টা বছর একাই সংসার চালিয়ে গেল, একাই সে বোনেদের বিয়ে দেবে। যেমন ভাগ্য করে এসেছে তেমন পাত্রই পাবে।
‘উঠব এবার।’
অমর ইশারায় ছেলেটাকে ডেকে বুকপকেট থেকে পাঁচ টাকার নোট বার করে দিল।
‘তুই তা হলে আর আসবি না।’
‘না।’
‘খোঁজখবরও করবি না?’
‘এই তো খোঁজ নিলুম, এইভাবেই নেব…দূরে থাকাই তো ভালো।’
‘তুই কি আমার ওপর রেগে আছিস এখনও?’
অমর হাসল। স্বচ্ছ উদার। তাতে একছিটেও মালিন্য নেই।
‘একদমই না। হ্যাঁ, তখন রেগে ছিলুম তো বটেই। এখন বুঝতে পারছি ভালোই করেছি। সবাই মিলে ওভাবে একসঙ্গে, কোনোক্রমে আধপেটা খেয়ে বেঁচেবর্তে শুধু দিন কাটিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই হত না। জড়াজড়ি করে এখন আর কিছু করা যায় না। বড়োজোর ভেসে থাকা যায় কিন্তু সাঁতার কাটা যায় না।’
‘সবাইকে দেখা, ভরণপোষণ…দায়িত্ব আছে সেটা তো পালন করা উচিত বিশেষ করে যাদের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক রয়েছে। নয়তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করতে হবে। …মা দাসেদের বাড়ি রাঁধুনির কাজ নেবে বলেছিল আমি নিতে দিইনি…না খেয়ে থাকব সে—ও ভালো তবু মানসম্মান খোয়াব না।’
অনন্ত জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে রইল। অমরের মুখে বিরক্তিটা প্রকট হয়ে উঠেছে। খুচরো পয়সাগুলো পকেটে রেখে বাঁ হাতের তালুতে মৌরি তুলে নিল।
‘মানসম্মান বাঁচিয়ে রেখে কী পেয়েছ? চার বছর আগে যা ছিলে এখনও তো তাই আছ…ভবিষ্যতেও তাই থাকবে…লোকে বলবে তোমরা মানী, সৎ, ভালো…তাই দিয়ে কি অনুর বিয়ে দেওয়া যাবে?’
‘সেটা আলাদা কথা, যা চলে আসছে, যা নিয়ম সেইভাবেই বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সম্মান একটা আলাদা ব্যাপার।’
‘কীসে আলাদা?’
অনন্ত এই মুহূর্তে কোনো জবাব খুঁজে পেল না। সে উঠে দাঁড়াল।
‘তুই তা হলে আমাদের সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক রাখবি না?’
‘রাখারাখির কী আছে! তোমাদের কি কোনো অসুবিধা হয়েছে আমি না থাকায়?
‘না।’
অস্বাভাবিক জোর দিয়ে সে ‘না’ বলল। অমরের যে আদৌ কোনো গুরুত্ব নেই তাদের সংসারে এটাই সে বোঝাতে চাইল।
‘তাহলে? কী দরকার সম্পর্কের ডালপালা ছড়িয়ে?’
‘তাতে সাঁতার কাটায় সুবিধা হয়।’
‘ঠিক।’
অমরের সঙ্গে এরপরও কয়েকবার দেখা হয়েছে রাস্তায়, এই চায়ের দোকানের সামনে। ‘ভালো আছিস?’ ‘বাড়ির সবাই ভালো?’ ‘মা তোর কথা বলছিল, দেখতে চায়।’ ‘যাব একদিন।’ এইভাবেই হাঁটা থামিয়ে তারা কথা বলেছে। অমর কোথায় থাকে, কোথায় কাজ করে কিছুই বলেনি, অনন্তও জানাতে চায়নি। প্রথমদিন দেখা হওয়ার কথাটা সে মা—কে বলেছিল, তারপর আর বলেনি। মা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অমর সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছিল তার কাছে।
অনুর বিয়ের জন্য অর্থ ও পাত্র জোগাড় করার ভাবনা মাঝে মাঝেই তাকে বিব্রত করত। মাঝে মাঝে মনে হত অমর ঠিকই বলেছে, জড়াজড়ি করে সাঁতার কাটা যায় না। কীভাবে সাঁতার কাটতে হয় সেটাও শেখেনি। অমর বেরিয়ে গিয়ে শিখেছে। হয়তো পাড়ে উঠতে পারবে।
বিজ্ঞাপন দেখে নিয়মিত চিঠি দিয়ে যাচ্ছিল অনন্ত। কটক থেকে একটি জবাব তাকে আশান্বিত করল। মাকে চিঠি দেখাল। ছোটো চিঠি, পাত্রপক্ষ একপয়সাও নগদ নেবে না, একরতি সোনাও চায় না। মেয়ে পছন্দ হলে তারাই বিয়ের খরচ দিয়ে মেয়ে নিয়ে যাবে।
শীলা অবাক হয়ে বলল, ‘শুনেছি এরকম অনেক বিয়ে হয়েছে, বরপক্ষই খরচ দিয়ে মেয়ে নিয়ে গেছে। সে—সব পরমাসুন্দরী মেয়ে…অনু তো দেখতে পাঁচপাঁচি!’
‘বলি না মেয়ে দেখে যেতে।’
‘অতদূরে, খোঁজখবর নেওয়া তো সোজা নয়। কেমন ঘর, কেমন লোক, ঠগ কি না কিছুই তো জানি না। ঠাকুরপোকে বল না একবার। ওর তো চেনাশোনা কেউ কটকে থাকতে পারে, খোঁজখবর নিয়ে জানাবে।’
অবিনাশের চেনালোক ছিল ভুবনেশ্বরে। সে প্রায় রোজই কটকে যায় ব্যবসা সূত্রে। তাকে দিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তিনপুরুষ তারা কটকের বাসিন্দা, সম্পন্ন একান্নবর্তী বিরাট পরিবার। দুটি দোকান আছে গহনার। পাত্রের বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশ, বিয়ে হয়েছিল, বউ মারা গেছে একটি এক বছরের ছেলে আছে। পাত্র ক্লাস সেভেন—এইট পর্যন্ত পড়েছে।
ওরা তিনজন বিভ্রান্ত বিষণ্ণ হয়ে সন্ধ্যায় দালানে বসে ছিল। অবিনাশকে লক্ষ করে অনন্ত বলে, ‘কাকা কী করব বলুন? পরে সবাই আমাকে বলবে, হাত—পা বেঁধে মেয়েটাকে দাদা জলে ফেলে দিল, তা হতে দেব না।’
‘এমন ঘর, জল ভাবছিস কেন?’
‘বয়সের পার্থক্যটা? অনুর প্রায় দ্বিগুণ!’
‘এমন পার্থক্যে কি বিয়ে হয় না? আমার মা আর বাবার মধ্যে পার্থক্য তো একুশ বছরের, কোনো অসুবিধা হয়নি…বাহান্ন বছর দিব্যি কাটিয়ে গেছে একসঙ্গে।’
‘সে আমলে ওসব হত এখন কি আর হয়?’
শীলা অস্ফুটে বলল, ‘গিয়েই ছেলে ধরতে হবে। লেখাপড়ার কথা নয় ধরছি না, পুরুষমানুষের রোজগারই আসল গুণ।’
অনন্ত বুঝতে পারছে না সে রাজি হবে কি হবে না। শীলার খুঁতখুঁতনি বিপত্নীক হওয়ার জন্য। অবিনাশের মত আছে।
‘আমার মনে হয় অনুকেই জিজ্ঞাসা করা উচিত…ওর মতামতটাই আসল। ও যদি রাজি থাকে তা হলেই আমরা এগোব।’
অনু ঘরে ছিল। সব কথাই তার কানে গেছে। অনন্তর কথাগুলো শেষ হওয়ার কয়েক সেকেন্ড পরই ঘর থেকে তার গলা শোনা গেল।
‘আমার অমত নেই, তোমরা যেখানে বিয়ে দেবে সেখানেই বিয়ে করব।’
ওরা স্বস্তিবোধ করেছিল। কিন্তু অনন্তের বুকের মধ্যে শুরু হয়ে যায় নতুন একটা খচখচানি। সে মুখ নামিয়ে বসে থাকে।
তখন অবিনাশ মৃদুকণ্ঠে বলেন, ‘যার যেখানে অন্ন বাঁধা সেখানেই পাত পাততে হবে।’
এক মাসের মধ্যেই অনুর বিয়ে হয়ে গেল। পাত্রের দাদা ও সম্পর্কিত মামা এসে মেয়ে দেখে পছন্দ করে যায়। অনু বলেছিল, তার কোনো বন্ধুকে সে নিমন্ত্রণ করবে না। প্রায় নিঃসাড়েই বিয়ে হল। সদরে বাড়তি একটি বালব ছাড়া বিয়েবাড়ির কোনো চিহ্ন ছিল না। বরের সঙ্গে এসেছিল চারজন। উঠোনে উনুন পেতে রান্না হয়, খাওয়া হয় দালানে। পাড়ায় কাউকেই তারা বলেনি, শুধু সাধন বিশ্বাস আর তার ছেলে উৎপলকে নিমন্ত্রণ করেছিল। তিনি আসেননি শরীর ভালো না থাকায়, উৎপল এসে একটা তাঁতের শাড়ি দিয়ে গেছে। দোতলার জ্যাঠামশাই বাদে আর সবাই খেয়ে গেছে। দু—তিনজন কাঙালি সদরের সামনে অপেক্ষা করে করে বিরক্ত হয়ে চলে যায়।
পরদিন বর—বউ বাড়ি থেকেই হাওড়া স্টেশনে যায়। ওদের ট্রেনে তুলে দিতে সঙ্গে গেছল অনন্ত। অনু ট্যাক্সিতে ওঠার সময় কাঁদেনি। ট্রেন ছাড়ার মুহূর্তে কেঁদে উঠবে এমন একটা ব্যাপারের জন্য সে তৈরি ছিল। ট্রেন ছেড়ে দিল। অনন্ত দেখল হাজার বছরের পুরোনো কাঠের মতো শুকনো মুখ নিয়ে তার বোন একদৃষ্টে সামনে তাকিয়ে বসে। মুখটাকে চিরকালের মতো অনন্তের বুকে খোদাই করে দিয়ে ট্রেনটা চলে গেল।
আট
অনন্ত ঠিক করেছিল অলুর বিয়ে এমনভাবে দেবে যাতে ওর মনে কোনো খেদ না থাকে।
বি এ পাশ করার দু—বছর পর অলু ফুড কর্পোরেশনে চাকরি পায়। নিজের চেষ্টাতেই জোগাড় করেছে। অনন্ত শুনে থ হয়ে গেছিল। তাদের বাড়ির মেয়ে চাকরি করবে দশটা—পাঁচটা! বিস্ময়টা ক্রমশ ভয়ে রূপান্তরিত হয়ে তাকে কিছুদিন নানান অশুভ ভাবনায় ডুবিয়ে দিয়েছিল। প্রায়ই তার মনে হত, অলু বাবার মতো বাস চাপা পড়ে মরে যাবে। এই পরিবারের মধ্যে অলু একটু আলাদা ধরনের। অমরের সঙ্গে ওর মিল আছে। কলেজে পড়ার সময় কিছু ছেলেমেয়ে ওর সঙ্গে দুপুরে বা বিকেলে আসত। বাড়ি ফিরে অনন্ত সে খবর পেত শীলার কাছে।
‘অলুর বন্ধুরা বেশ মিশুকে। মুড়ি খেতে চাইল, আমি বললুম দোকানে যাবার লোক নেই, ওদেরই একজন মুড়ি, বেগুনি কিনে আনল। চা করে দিলুম। ছেলেগুলো বেশ।’
‘ছেলে?’
‘ওর সঙ্গেই পড়ে।’
অলু কলেজ ইউনিয়নের সহ—সম্পাদিকা হয়েছিল। অনেকদিনই সে সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরত। অনন্তের সেটা ভালো লাগত না।
‘ওকে বলে দিয়ো বিকেল থাকতে থাকতেই যেন বাড়িতে ঢোকে। এ—বাড়ির মেয়েরা সূর্য ডুবলে বাড়ির বাইরে থাকে না।’
‘বিকেলে টিউশানিতে যায়, হয়তো কোনো কারণে দেরি হয়েছে।’
একদিন শীলা একটি পাতলা পত্রিকা অনন্তকে দেখাল। ‘অলু কেমন পদ্য লিখেছে দেখ।’
অনন্ত অবাক হয়ে পত্রিকার পাতাটার দিকে তাকিয়ে থেকেছিল। ছাপার অক্ষরে তাদের কারোর নাম সে জীবনে এই দ্বিতীয়বার দেখল। বাবার বাসচাপা যাওয়ার খবরটার সঙ্গে ‘শক্তিপদ দাস’ নামটা খবরের কাগজে বেরিয়েছিল।
ষোলো লাইনের পদ্যটা তিন—চারবার সে পড়ে। একদমই মাথামুণ্ডু বুঝতে পারেনি। কিন্তু ‘স্তন’ আর ‘চুম্বন’ শব্দদুটি তাকে রীতিমতো ভয় পাইয়ে দেয়। অলুর হাত দিয়ে এইসব নোংরা জিনিস বেরোয় কী করে? একটা মেয়ে! তাদের বাড়ির মেয়ে এইসব অসভ্য চিন্তা করছে আর পাঁচজনকে তা জানাচ্ছে, লোকে কী ভাববে! তারই বোন, তার সম্পর্কে কী ধারণা হবে? পাড়ার কেউ পড়েছে কি না কে জানে।
অলুর পদ্যটা কয়েকদিনের জন্য তাকে সন্ত্রস্ত রেখেছিল। সে আবার ভয় পায় যখন শীলা বলল, ‘অলু দু—দিনের জন্য বন্ধুদের সঙ্গে দিঘায় বেড়াতে যাবে।’
‘কী দরকার যাবার?’
‘মানুষ বেড়াতে যায় না? এই তো ওপরের ওরা পুরী—টুরি ঘুরে এল।’
‘ঘুরুক গে, পয়সা আছে তাই গেছে।’
‘তোরও তো পয়সা আছে, সেদিন তো বললি এখন সাড়ে ছ—শো টাকা মাইনে। আমায় নিয়ে চল না, কাশীটা একবার দেখে আসি।’
‘শুনতেই ওই সাড়ে ছ—শো। হাতে আর একটু জমুক। জিনিসপত্রের দাম কত বেড়েছে জানো? একজোড়া কাঁচকলা চল্লিশ পয়সা, শুনেছ কখনো?’
অলু দিঘা ঘুরে এল। তাদের বাড়ির মেয়ে দুটো দিন বাইরে কাটাচ্ছে, এটা সে ভাবতেই পারে না। অলু যখন তখন বাড়ি থেকে বেরোয়, ফেরারও ঠিক নেই, এটাও সে মানতে পারে না। সেজন্য মা—র কাছে বিরক্তি প্রকাশ করে, রাগও। কিন্তু অলু তা গ্রাহ্য করে না।
প্রথম মাসের মাইনে পেয়ে অলু শীলার হাতে দু—শো টাকা দেয়। অনন্ত তখন ঘরে। ওদের কথা তার কানে যাচ্ছিল।
‘আমাকে দিচ্ছিস কেন, দাদার হাতে দে।’
‘তুমিই দাও।’
‘আমি না, তুই দিলেই ভালো দেখায়। সংসারের সব খরচ—খরচা তো ওই করে।’
অলুর মুখটা খুশিতে, লজ্জায় আর উত্তেজনায় টসটস করছিল। দেখতে সুশ্রীই, আলগা চটক সারা অবয়বে। কথাবার্তায় চোখা, অনুর মতো কুনো ভোঁতা নয়। এই বোনটিকে নিয়ে অনন্তর যত দুর্ভাবনা ততই নিশ্চিন্তি।
‘দাদা।’
অলুর বাড়ানো হাতে কড়কড়ে দুটো একশো টাকার নোট। অনন্ত ভেবেছিল পুরো মাইনেটাই তার হাতে দেবে। তাই তো উচিত। এতকাল যেমন টাকা চেয়ে নিয়েছে, সেইভাবেই চাইবে। অবশ্য টিউশনি শুরু করার পর অলু আর টাকা চায়নি।
‘আমায় দিচ্ছিস কেন, জমা, ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোল।’
‘অ্যাকাউন্ট আছে, এটা সংসারের খরচের জন্য।’
অ্যাকাউন্ট আছে শুনে অনন্ত ধাক্কা খেল। তার পরামর্শ না নিয়েই অলু ব্যাঙ্কে টাকা জমাতে শুরু করে দিয়েছে। নিজেই হিসেব করে দু—শো টাকা দিচ্ছে সংসারের জন্য। অথচ এমন দিনও গেছে টিপেটিপে ষাট টাকায় মাস চলেছে। তার মনে হল, সংসার থেকে অমরের মতো অলুও বিচ্ছিন্ন হতে চলেছে। তাকে আর ধর্তব্যের মধ্যে রাখছে না।
অনন্ত টাকাটা হাতে নেয়নি। অলুকে বলেছিল টেবলে রাখতে। আর বলেছিল পরের বার থেকে মা—র হাতেই যেন দেয়।
একদিন অলু তার মাকে জানাল সে বিয়ে করবে। ছেলেটির নাম শান্তনু। কলেজে তার দু—বছরের সিনিয়র ছিল। আধুনিক গান লেখে, রেডিয়োয় আর অ্যামেচার থিয়েটার দলে অভিনয় করে, খবরের কাগজে এটা—ওটা লেখে, ভবানীপুরে নিজেদের বাড়ি, অবস্থা ভালো। তবে চাকরি করে না।
রাত্রে অনন্ত খেতে বসলে শীলা ফিসফিস করে জানাল,
‘অলু বিয়ে করবে, ছেলে চাকরিবাকরি করে না।’
‘কী করে তা হলে?’
‘তুই ওকেই জিজ্ঞেস করিস। বেকারকে বিয়ে করবে, ওর কি মাথা খারাপ হয়েছে?’
‘পরে চাকরি পাবে।’
‘যখন পাবে তখনই বিয়ে করবে। তুই বারণ কর।’
‘আমাকে তো অলু বলেনি কিছু, যেচে বলাটা ঠিক হবে না। তা ছাড়া ছেলেকে তুমিও দ্যাখোনি আমি দেখিনি।’
পরদিন অফিস যাবার আগে অলু তাকে বলেছিল। অনন্ত চুপ করে শুনে যায়।
‘রেজিস্ট্রি করব। গাদাগুচ্ছের খরচ করার মতো টাকা আমার নেই।’
আমার নেই মানে? অলু কি নিজের বিয়ের খরচ নিজেই করবে? অনন্ত আর একটা ধাক্কা খেল। নিজের দায় নিজেই বইবে, ভালো। তাকে যদি অগ্রাহ্য করতে চায় করুক।
‘তুই ভেবেচিন্তে দেখেছিস?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমাদের বংশে কেউ রেজিস্ট্রি বিয়ে করেনি।’
‘করেনি, এবার হবে।’
অনন্ত একবার শুধু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আলনা থেকে শার্টটা তুলে নিয়ে বলল, ‘আমরা কেউ কিন্তু দায়ী থাকব না যদি কিছু ঘটে।’
‘কী ঘটবে?’
‘ভালোবাসার বিয়ে তো…দেখলুম না তো কাউকে সুখী হতে।’
‘তুমি আবার দেখলে কবে?’
অলু তীক্ষ্ন স্বরে ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল। ‘তুমি তো লোকজনের সঙ্গে কোনোদিন মেলামেশাই করোনি। কোনোদিন তোমার একটা বন্ধু দেখলাম না, একটা বই পড়তে দেখলাম না…সিনেমা, গান, নাটক, বেড়ানো কিছুই না। শুধু কাজে যাওয়া আর ঘরে বসে থাকা…তুমি ভালোবাসার বিয়ের কী বোঝ আর কী জানো, শুধু তো ভালো ছেলে হয়েই জীবন কাটিয়েছ।’
অনন্ত হতভম্ব হয়ে, শার্টের মধ্যে দু—হাত গলানো অবস্থায়, তাকিয়ে থেকেছিল। দরজার কাছে শীলা দাঁড়িয়ে।
‘অলু কাকে কী বলছিস তুই! তোর দাদা সতেরো বছর বয়স থেকে সংসারের হাল ধরেছে, তোদের মানুষ করেছে, আর তুই কিনা চাকরি পেয়ে সব ভুলে গেলি?’
অলুকে বিচলিত দেখাল কিন্তু রাগ পড়েনি।
‘ভালোবাসার বিয়ে নিয়ে দাদা বাজে মন্তব্য করল কেন? আমি অসুখী হব এমন ইঙ্গিত দেওয়ার কী দরকার ছিল? আমি তো অনু নই যে সবাই মিলে যেমন—তেমন একটা বিয়ে দেবে আর মেনে নেব।’
‘যেমন—তেমন? ওকে জিজ্ঞেস করে মত নিয়ে তবেই বিয়ের কথা বলেছি।’
‘মতামত দেবার মতো বুদ্ধি তখন ওর হয়নি, হলে বিয়ে করত না। তোমরা ওর জীবনটা নষ্ট করেছ।’
অলু দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ওর জুতোর শব্দ সদরে না পৌঁছোনো পর্যন্ত কেউ কথা বলেনি।
‘অনুর জীবন কি নষ্ট হয়েছে, মা?’
‘পাঁচটা ছেলেমেয়ে পেটে ধরেছে, সতীনের ছেলেকে নিজের পেটের ছেলের থেকে আলাদা করে দেখে না, অনু আমার কত ভালো মেয়ে। ও সুখী হবে না তো কে হবে! জামাই বাড়ি করবে বলে জমি কিনেছে…’
অনন্ত আর শোনেনি। সে কাজে বেরিয়ে গেছল। সারাদিন তার মাথার মধ্যে ঘুরেছে অলুর কথাগুলো। সত্যিই সে মেলামেশা করেনি। সত্যিই তার কোনো বন্ধু নেই। ভালোবাসার কিছুই সে জানে না। অলুর প্রত্যেকটা কথাই সত্যি, ভালো ছেলে হয়েই তার দিনগুলো কেটে গেল।
রাত্রে অনন্তের ঘুম এল না। এন্টালির বাড়িতে ফাটা ছাদ দিয়ে জল পড়ছে, রাজমিস্ত্রি নিয়ে আজ গেছল কাজ বুঝিয়ে দিতে। ফেরার সময়, প্রতিবারের মতো, মিনতি করের ঘরে যায়।
‘রোজই অপেক্ষা করি এই বুঝি দারোয়ান এসে জিনিসপত্র ছুড়ে ছুড়ে ফেলে আমায় বার করে দেবে। রাতে ঘুম হয় না।’
‘আপনাকে তো বলেছি, এসব চিন্তা করবেন না। যদি তুলেই দিত, তা হলে দশ—বারো বছর আগেই দিত। আমি যতদিন আছি আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।’
‘পেটের ছেলেও এত করে না, তুমি যা করছ আমার জন্য।’
ঘরের মধ্যে লম্বা পর্দাটা আর নেই। অনন্ত যখনই আসে দরজার কাছে চেয়ারটায় বসে। ছবিটা একই জায়গায়, একই রকম উজ্জ্বল। শুধু ফ্রেমের রংটা ধূসর হয়েছে।
‘এখনও আপনি আগের মতোই ভালোবাসেন?’
চোখ পিট পিট করলেন মিনতি কর। আরও শীর্ণ, চোয়ালের চামড়া শিথিল, চোখের কোণে ভাঁজ, পিঠটা একটু বাঁকা কিন্তু হাসিটা বাচ্চচা মেয়ের মতো।
‘এই নিয়ে কতবার জিজ্ঞাসা করলে বলো তো?’
‘চারশো তিয়াত্তরবার।’
‘ঠাট্টা নয়, ঠাট্টা নয়…তোমার ভীষণ কৌতূহল ছবিটা সম্পর্কে,…নেবে ওটা?’
অনন্তর বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠেছিল। আচমকা তার মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছিল কথাটা, ‘নেব।’
‘আমি মরে গেলে, তার আগে নয়।’
মিনতি কর চা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় প্রসঙ্গটা বন্ধ হয়ে যায়।
ভোররাতে অনন্তের চোখে ঘুম নেমে আসে।
তিনদিন পর সন্ধ্যায় অলুর সঙ্গে একটি যুবক এল। উঠোনে দাঁড়িয়ে অনন্ত তখন খালি গায়ে ভিজে গামছা রগড়াচ্ছিল। যুবকটিকে দেখামাত্র তার মনে পড়ল রমেনকে। দাঁড়ানো, তাকানো ছাড়াও অসম্ভব মিল রয়েছে শরীরের গড়নে। আপনা থেকেই তার দৃষ্টি অলুর গলায় পড়ল। গৌরীর স্মৃতি অস্পষ্ট হয়ে এলেও সবুজ পাথরের মালাটা জ্বলজ্বলে রয়েছে। এত বছরে একবারও ওর সঙ্গে দেখা হল না।
‘শান্তনু…এই হচ্ছে আমার দাদা।’
হাত তুলে নমস্কার করল শান্তনু। অনন্ত কোনোরকমে হাতের মুঠি দুটো বুকের কাছে তুলল। কোনো কথা বলল না।
‘তোমার সঙ্গে কথা বলবে বলে এসেছে।’
‘কী কথা।’
নিজের গম্ভীর, নিস্পৃহ স্বরে অনন্ত অবাক। তার যে কোনো আগ্রহ নেই সেটা ওরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে।
‘বিয়ের কথা বলতে এসেছি।’
‘মা—র সঙ্গে।’
শান্তনুকে নিয়ে অলু মা—র ঘরে ঢুকল। একটু পরেই অনন্ত নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। পার্কে একটা রাজনৈতিক সভা চলছিল, সভার পিছনে বসে বক্তৃতা শুনতে শুনতে তার মনে হল পনেরো বছর আগে সে ঠিক এই কথাগুলিই শুনেছে এই পার্কে। লোকগুলোর বক্তৃতার স্বর এবং ভঙ্গি একটুও বদলায়নি। শ্রোতারাও পনেরো বছর আগের মতোই হাততালি দিল।
অলু বিয়েতে সাক্ষী হবার জন্য অনন্তকে বলেছিল। সঙ্গে সঙ্গে সে রাজি হয়ে যায়। নিজে পছন্দ করে বিয়ে করছে কারোর মতামতকে গ্রাহ্য না করে। সুতরাং ভবিষ্যতে অলুর কিছু বলার মুখ থাকবে না।
শীলার কাছ থেকে অনন্ত শুনল, বিয়ের পর অলু শ্বশুরবাড়ি যাবে না। শান্তনুর মা, বউদি আর দাদার আপত্তি আছে এই বিয়েতে।
‘নগদ, গয়না, আলমারি, খাট এইসব আশা করেছিল।’
‘ছেলের তো কোনো রোজগারই নেই।’
‘তা হলেই বা বড়ো বংশ, নিজেদের বাড়ি, বড়ো বড়ো নামি আত্মীয়স্বজন…ওরা ঠিক করেছে ঘর ভাড়া নিয়ে আলাদা থাকবে।’
‘তার মানে অলুকেই সব খরচ টানতে হবে। এরকম বিয়ের কী যে দরকার…যাক গে ওরা যা ভালো বোঝে করুক।’
‘তুই সেদিন আর শার্ট পরিস না, পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে যাস।’
অনন্ত পাঞ্জাবি পরেই রেজিস্ট্রারের অফিসে হাজির হয়েছিল অলুর সঙ্গে। সে বাসে ওঠার কথা বলেছিল, অলু হাত তুলে ট্যাক্সি থামিয়ে বলেছিল ‘আজ আর বাসে নয়।’ ট্যাক্সি থেকে নামার পরই তার মনে পড়ে জীবনে এই দ্বিতীয়বার সে ট্যাক্সিতে উঠল! খুব আশ্চর্য হয়ে সে মুখ ফিরিয়ে গাড়িটাকে বারবার দেখে চিনে রাখার চেষ্টা করে। প্রভিডেন্ড ফান্ড তোলার জন্য প্রথম ট্যাক্সি করে গেছল।
শান্তনু আর তার দুই বন্ধু তখনও আসেনি। অলু অধৈর্য হয়ে কয়েকবার তার হাতঘড়ি দেখল।
‘ক—টায় আসবে বলেছে?’
‘একটায়।’
দেওয়াল ঘড়িতে তখন একটা—দশ। রেজিস্ট্রারের বন্ধ ঘরের মধ্যে দু—জন নারী—পুরুষ। তারা বিয়ের ব্যাপারেই কথা বলতে এসেছে।
‘বোধহয় ট্র্যাফিক জ্যামে পড়েছে।’
আরও দশ মিনিট পর শান্তনু এল। ঝোলা কাঁধে চাপদাড়িওলা সঙ্গে একজন। অলুকে দেখে পরিচিতের হাসি হাসল।
‘আরে প্রশান্তর জন্য বারোটা থেকে অপেক্ষা করে করে…দাদা ভালো আছেন…শেষকালে আর দাঁড়ালাম না। অরুণ ইনি অলুর দাদা, আর এ হচ্ছে আমার বাল্যবন্ধু অরুণ সেন।’
আধ ঘণ্টার মধ্যেই বিয়ে শেষ করে, রেজিস্ট্রারের অফিস থেকে ওরা বেরিয়ে পড়েছিল। অলুর হাতে গোলাপের স্তবক, অরুণের দেওয়া। বুকের কাছে রেখে মাথা নামিয়ে মাঝেমাঝে গন্ধ শুঁকছিল। শীলা একটা সিঁদুরের কৌটো অনন্তকে দিয়ে বলেছিল, ‘বিয়ের পর অলুর সিঁথিতে শান্তনু যেন দেয়।’
অনন্ত ভুলে গেছল। রেজিস্ট্রারই বললেন, ‘সিঁদুর এনেছেন?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এই যে।’
অনন্ত পকেট থেকে বার করে কৌটোটা। শান্তনু নস্যির টিপের মতো সিঁদুর তুলে অলুর সিঁথিতে মাখিয়ে দেয়। অলুর চোখদুটো মুদে এল, চামড়া ভেদ করে আলতো একটা আভা মুখের উপর ছড়িয়ে পড়ল। নতুন সিল্কের শাড়ি পরেছে, হালকা গোলাপি জমিতে, রজনীগন্ধার ঝাড় উঠেছে পায়ের কাছ থেকে হাঁটু পর্যন্ত। আজ পরবে বলেই কিনেছে।
অনন্ত মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ভাবল, অলুর যে এত রূপ তা তো কখনো জানতুম না।
অরুণ হঠাৎ উলু দিয়ে উঠল। অনন্ত সভয়ে তাকাল রেজিস্ট্রারের দিকে, তিনি হাসছেন।
‘এ আর কী, টেপরেকর্ডার এনে সানাইও বাজায়।’
অলু প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই অনন্ত তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। ছলছল করছে ওর চোখ।
‘অনেক কথা বলেছি, মাপ করে দিয়ো।’
‘আরে ও কিছু নয়, কিছু নয়।…ওরকম হয়ই…ভালো করে সংসার কর, সুখে থাক…’
অনন্তর গলা ধরে গেল। সে বোকার মতো হাসল সকলের দিকে তাকিয়ে। শান্তনু প্রণাম করল।
ঝোলা থেকে সন্দেশের বাক্স বার করে অরুণ এগিয়ে ধরল।
‘এবার মিষ্টি মুখ…এই নিয়ে এগারোটা বিয়ের সাক্ষী হলুম, এখানেই দু—বার হল। দেখছি প্রফেশনাল উইটনেস হয়ে যাচ্ছি…এবার থেকে ফী নিতে হবে।’
পরিবেশটা হালকা হয়ে গেল। কিন্তু অলু কখন যে তার হাত ব্যাগ থেকে টাকা বার করে রেজিস্ট্রারের টেবলে রেখেছে, অনন্ত বুঝতে পারেনি। তার পকেটে তিরিশ টাকার বেশি নেই। বেরোবার সময়ও সে ভাবেনি রেজিস্ট্রারকে টাকা দিতে হবে। অন্যরা নিশ্চয় লক্ষ করেছে মেয়ের দাদা টাকা বার করল না। অলু কি আশা করেছিল, এই খরচটা দাদা দেবে?
সে অপ্রতিভ বোধ করল অন্তত এই টাকাটা তারই দেওয়া উচিত ছিল। কিছুই তো সে অলুকে দেয়নি, শাড়ি পর্যন্ত নয়। বিয়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে অলুই খরচ করেছে। জেদি মেয়ে।
অনন্ত বিমর্ষ বোধ করেছিল রাস্তায় বেরিয়ে। তার মনে হচ্ছে কী যেন একটা সে হারাচ্ছে। একসময় বাবা, মা, সে, তিন ভাইবোনে পরিবারটা ভরা ছিল। একে একে লোক কমে যাচ্ছে। এখন তো সে আর মা। যখন প্রচণ্ড অর্থাভাব তখন এতটা নিঃসঙ্গ বোধ হয়নি। কী করে পরের দিনটায় খাওয়া জুটবে সেই ভাবনাটা তাকে ব্যস্ত রাখত। ধীরে ধীরে ভাবনাটা মেঘগর্জনের মতো আকাশে গড়িয়ে গড়িয়ে দূরে মিলিয়ে গেছে। এখন অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য।
‘আমি যাই এখন।’
‘সে কী, আমরা যে এখন কোথাও বসে খাব ঠিক করেছি, আপনিও থাকবেন আমাদের সঙ্গে।’
‘না ভাই,’ শান্তনুর কাঁধে হাত রাখল অনন্ত। ‘অলু জানে আমি ভাত খেয়েই এসেছি। তা ছাড়া অম্বলটা আবার একটু বেড়েছে, বাইরের খাবার খাব না।’
‘কিন্তু আমরা যে…’
‘তাতে কী হয়েছে। অলু এদের নেমন্তন্ন কর, রোববার আসতে বল।’
অলু দু—জনের উদ্দেশে বলল, শুনলে তো অরুণ, রোববার নিশ্চয় আসবে!’
‘নিশ্চয় নিশ্চয়, খাওয়ার ব্যাপারে ফেল করি না।’
অলু জানিয়ে রাখল সে অফিসের দু—তিনজনকেও বলবে।
বাসে রড ধরে দাঁড়িয়ে আসার সময় অনন্তের মনে হল, বোধহয় এরা সুখীই হবে। ভালোবাসার কিছুই তো সে জানে না। অলু এখন বাপের বাড়িতেই থাকবে যতদিন না কোথাও ঘর পায়।
বাপের বাড়ি। অনন্ত অবাক হয়ে ভাবল, অলুর বা অলুদের বাড়ি আর নয়, আজ থেকে তাদের বাড়ি ওর বাপের বাড়ি। মেয়েটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল এই সংসার থেকে। অবশ্য হতই।
অসম্ভব শ্রান্তি নিয়ে অনন্ত বাড়ি ফিরে শুয়ে পড়ল। আজ সে কাজেই যাবে না। এই বছরের প্রথম কামাই, গত বছরে একদিনও নেই, তার আগের বছর ইনফ্লুয়েঞ্জায় দশ দিন।
শীলা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে যাচ্ছে তক্তাপোশের পাশে দাঁড়িয়ে। অনন্ত কপালের উপর হাত রেখে চোখ বুজে।
‘শুধু একজন, বন্ধু!’
‘আবার ক—জন আসবে? একি টোপর পরে বিয়ে যে সঙ্গে পঞ্চাশ—একশো বরযাত্রী আসবে।’
‘দুটো মালা কিনে নিয়ে গেলি না কেন?’
অনন্ত উত্তর দিল না।
‘মন্তর পড়েছিল?’
‘না।’
‘তা হলে! এসব বিয়ে কি শুদ্ধ?’
অনন্ত চুপ।
‘ও কখন ফিরবে কিছু বলেছে?’
কোনো উত্তর নেই।
‘অলু কী করল, শুধু সই?’
‘হ্যাঁ।’
‘সিঁদুরটা শান্তনুই দিল তো?’
জবাব না পেয়ে শীলা আধ মিনিট চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কপাল থেকে হাত নামিয়ে অনন্ত তীব্র চাহনিতে তাকাল।
‘এবার শুধু আমরা দু—জন এই সংসারে।’
শীলা অপ্রত্যাশিত এই কথাটার কোনো তাৎপর্য খুঁজে পেল না। শুধু বলল, ‘ফাঁকা ফাঁকা লাগবে এরপর।’ কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে যোগ করল, ‘এবার তুই বিয়ে কর।’
‘কেন?’
‘ছেলেপুলে না থাকলে কি ঘর মানায়! বংশরক্ষা করতে হবে তো।’
‘অমর আছে।’
‘থাকলেই বা, পুরুষমানুষের বিয়ে না করলে কি চলে? এবার আমি মেয়ে দেখব।’
‘না।’
‘তুই নিজে পছন্দ করে বিয়ে করবি।’
‘না।’
‘তা হলে?’
অনন্ত চোখ বন্ধ করে হাতটা আবার কপালে রাখল।
‘আর টানতে পারব না, আর ভালো লাগে না, আমি এবার জিরোব।’
‘তা জিরো, এত বছর ধরে কম পরিশ্রম করেছিস, তাই তো সবাই বলে…’
ছিলেছেঁড়া ধনুকের মতো অনন্তের দুটো হাত ছিটকে গেল দু—ধারে। চিত হয়ে শোয়া শরীরটা এক ঝাঁকুনিতে উঠে বসল। মুঠো করা দুই হাত তুলে চিৎকার করে উঠল, ‘সবাই বলে আমি ভালো ছেলে, ভালো ছেলে, ভালো ছেলে…সবাই খুশি তো? কথা দিচ্ছি আমি ভালো ছেলেই থাকব।’
ধীরে ধীরে সে আবার শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে থাকা তার দুই চোখের কোল বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল ঝরে পড়ল।
নয়
পাঁচ বছর পর অনন্ত বিয়ে করল।
শীলার ক্যানসার ধরা পড়া, দিল্লি থেকে অমরের আসা এবং শীলাকে নিয়ে যাওয়ার ছ—মাস পরেই সে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। বয়ানটা কেমন হবে তাই নিয়ে সে দিন চারেক চিন্তার মধ্যে কাটায়। পাত্রী চাই কলমের থেকে শব্দ বাছাই করে প্রথমে সে বিজ্ঞাপনের খসড়া করেছিল: দঃ রাঢ়ী কায়স্থ (৩৫), স্বাস্থ্যবান, একা, মাঃ আয় ১০০০। গৃহকর্মনিপুণা রুচিশীল নম্র পাত্রী চাই। অন্য জাত বা বিধবাতেও আপত্তি নাই।
দুটো মিথ্যা কথা সে লেখে। বয়সটা প্রায় চারবছর কমিয়েছে, মাসিক আয় বাড়িয়েছে প্রায় দেড়শো টাকা। তারপর আয়নার সামনে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে বহুক্ষণ নিজেকে খুঁটিয়ে দেখেছিল। পঁয়ত্রিশ বছরের মতো তাকে মনে হয় কি?
আয়নার খুব কাছে মুখটা এনেও সে বয়স বুঝতে পারছিল না। সামনের চুল উঠে গিয়ে কপালটাকে চওড়া করে দিয়েছে। সেখানে দুটো রেখা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ভুরুতে কয়েকটা চুল খোঁচা হয়ে উঠে রয়েছে। কানদুটো ছোটো, পাশে ছড়ানো; কিছু চুল খুব ভালোভাবেই কানের গর্ত থেকে উঁকি দিচ্ছে; চোখদুটো গোল, ভিতরে বসা; নীচের ঠোঁটটা পুরু, কাঁধটা সরু, বুকের খাঁচাটা ছোটো, পেটটা ঝুলে থলথলে। মোটা কোমরের দু—ধারে চর্বির ভাঁজ। বাহুদুটি শীর্ণ, মেয়েদের মতো নরম।
অনন্ত একটি একটি করে নিজের দেহের ত্রুটি বার করে খসড়া থেকে প্রথমে স্বাস্থ্যবান কথাটা বাদ দিয়েছিল। তবে পঁয়ত্রিশ বছরটা এমনই, শোনামাত্র মনে হয় পরিণত যুবক, বয়সটা যেন ত্রিশের থেকে একটু বেশি অথচ চল্লিশের কাছাকাছি নয়। কিন্তু সে সাহস পায়নি নিজেকে ত্রিশের দিকে নিয়ে যেতে।
তবু নিশ্চিত হবার জন্য তার কাছাকাছি বয়সিদের সে লক্ষ করে গেছে দু—দিন ধরে। রাস্তায়, বাজারে, বাসে সর্বত্রই তার চোখ ছুঁকছুঁক করেছে। যাকেই মনে হয়েছে মধ্য—তিরিশ তন্নতন্ন করে তার গড়ন, হাবভাব, চলনের দিকে তাকিয়ে থেকেছে, আর মনে হয়েছে পঁয়ত্রিশে যা হওয়া উচিত তার সেই রকম শরীর নয়। সে উনচল্লিশই লেখে।
খসড়ায় হাজার টাকা আয় বসাবার সময় সে দ্বিধায় পড়েছিল। হাজার কথাটা শুনতে ভালো, মনেও গাঁথে। তা ছাড়া সে তো মাইনের টাকা গুনেগুনে বউয়ের হাতে তুলে দেবে না।
তবে পাত্রীদের তরফ থেকে খোঁজখবর নিশ্চয়ই করবে। নিশ্চয় অঘোর এস্টেটে কেউ যাবে, কে কত মাইনে পায় সেটা বার করে নেওয়া মোটেই শক্ত নয়। তারা জেনে যাবেই সে একটা মিথ্যাবাদী। হাজার টাকাটা সে কেটে দেয়। বিজ্ঞাপনের ফর্ম ভরতি করে, টাকা দিয়ে দুপুরে খবরের কাগজের অফিস থেকে বেরিয়ে আসার পরই অদ্ভুত একটা উত্তেজনা তাকে গ্রাস করে। সারাদিন তার শরীরের তাপ এমন অবস্থায় থাকে যে রাত্রে হোটেলে ভাত মুখে দিতে পারে না। দু—গ্রাস কোনোরকমে চিবিয়েই উঠে পড়ে।
‘কী হল অনন্তবাবু, রান্নায় কিছু…’
মালিক অবনী দত্তর উদবিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলে, ‘শরীরটা ভালো নেই।’
‘তাই বলুন। এতদিন খাচ্ছেন, এমন তো কখনো দেখিনি। অম্বলটা বোধহয় বেড়েছে।’
‘হ্যাঁ।’
রাতে ঘুম এল না। সারা একতলায় সে একা। বিজ্ঞাপনেও ‘একা’ শব্দটা বসিয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞাপনটা সে দিল কেন? তার কি বিয়ে করার বা কোনো স্ত্রীলোককে ঘনিষ্ঠভাবে পাওয়ার খুবই দরকার! এতটা বছর তা হলে কাটল কী করে!
ঘর পেয়ে অলু চলে যাবার পর, যখন সে আর মা একই কথা, একই অভ্যাস, একই গণ্ডির মধ্যে দিন, হপ্তা, মাস, বছর কাটিয়ে গেছে তখন সে কিছু বোধ করেছিল কি?
কীভাবে তার দিন কেটেছে? অনন্ত গত পাঁচ বছরের এমন কোনো স্পষ্ট ছবি দেখতে পেল না যা দিয়ে সে কোনো তারিখ, কোনো ঋতু, কোনো মানুষকে শনাক্ত করতে পারে। তার ইন্দ্রিয়গুলো এমন কোনো আবেগ ধরে রেখে দেয়নি যা তাকে ভালো কোনো স্মৃতি দিতে পেরেছে। দেখাশোনার সব কিছুই তার কাছে অর্থপূর্ণ আবার অর্থহীন মনে হয়েছে।
একঘেঁয়ে দিন, ভ্যাপসা অথবা ভিজে। ছোটোবেলা থেকে সে একই গন্ধ পেয়ে আসছে বিছানা, আলমারি, বাসন, কলঘর সবকিছু থেকেই। বাজার যাওয়া, অঘোর এস্টেটে যাওয়া…খাতা, বিল—বই, তাগিদ, মামলা, ভাড়াটেদের হাজার অভিযোগ। আর হাঁটা, যেটা তার একমাত্র বিলাস।
গৌরীদের চায়ের দোকানটা উঠে গেছে, কমলা বাইন্ডার্সের প্রসাদ ঘোষ মরে গেছে, তার ছেলে এখন বসছে। পুরোনো লোকদের মধ্যে আছে শুধু ল্যাংড়া গুরু দাস। অন্য কোথাও কাজ জোটাতে পারেনি।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়ছে বটে, একটা ছেলে কিছুদিন কাজ করেছিল…সে তো বহু বছর আগে, পরেশদা তারপরই কোরণ্ডটা অপারেশন করাতে গিয়ে মরে গেল।’
একদিন সে সিনেমা দেখতে টিকিট কেটে হলে ঢুকেছিল। হিন্দি ছবি, কিছুক্ষণ পরই বিরক্ত বোধ করতে থাকে। বিরতির সময় বেরিয়ে আসে। এতগুলো লোক টানটান হয়ে চেয়ারে বসে দেখছে অথচ তার ভালো লাগল না।
সন্ধ্যায় গঙ্গার ধারে গেছে। কিছুক্ষণ বসে থেকে বাড়ি ফিরে এসেছে। পার্কে বসে তাস খেলা দেখেছে। মা চুপ করেই থাকে, ইদানীং আর বেশি কথা বলত না। সাধন বিশ্বাস একরাতে থ্রম্বসিসে মারা গেলেন। সে শ্মশানে গেছল। উৎপল এখন বাবার চেয়ারটায় বসে। পাড়ার দুর্গোৎসব কমিটির সভাপতি ছিল গত বছর।
অনু বছর সাতেক আগে কটক থেকে এসেছিল ওর স্বামীর গলব্লাডার অপারেশন করাতে। সঙ্গে আসে শুধু ভাসুরপো। সারাদিন খুব চিন্তায় থাকত। এখন সে নতুন বাড়িতে থাকে, বার বার যেতে বলেছে। চিকিৎসায় হাজার দশেক টাকা খরচ করে গেছে।
অলুর সঙ্গে দেখা নেই সাড়ে তিন বছর। বেহালায় থাকে। মা দিল্লি যাবার দিন দশ আগে বিকেলে এসেছিল, তার সঙ্গে দেখা হয়নি। শান্তনুকে এক সন্ধ্যায় নীলরতন হাসপাতালের গেটের কাছে দেখেছিল কথা বলছে একজনের সঙ্গে। শান্তনু টলছিল। লোকটিকে বারবার জড়িয়ে ধরছিল। সে দূর দিয়ে চলে যায়।
মাসে দু—তিনবার যখন সে এন্টালির বাড়িতে যায় মিনতি করের সঙ্গে তখন দেখা করে কিন্তু আর ভালো লাগে না কথা বলতে। আর ভালো লাগে না ছবিটার দিকে তাকাতে। নন্দকিশোরের ভাইপো একতলায় ওর ঘরের সামনে লম্বা প্যাসেজটায় সন্ধ্যার পর চোলাই মদের কারবার ফেঁদে বসে। এলাকায় এখন সে নামকরা মস্তান। অনন্ত সাহস পায় না কিছু বলতে। নন্দকিশোর পানের দোকান একজনকে ইজারা দিয়ে কসবায় চলে গেছে। সে মাসে মাসে পাঁচশো টাকা পায় দোকান থেকে। নন্দকিশোর চারটে গোরু কিনে কসবায় খাটাল করেছে, রেশন দোকানও দিয়েছে। মাসে একবার দু—বার আসে। চোলাইয়ের কথা বলতেই, ম্লান মুখে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে, ‘সবই এই। দিনকাল কীরকম করে যে বদলে গেল। কত ভালো ছেলে ছিল। আমার কথায় ওকে কাজ দিলেন…আমার লজ্জা করে।’
মিনতি কর এখন আর উচ্ছেদের ভয় দেখেন না। ওষুধ কোম্পানিটা উঠে গেছে। সেখান থেকে চব্বিশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। ভাড়া দিতে চেয়েছিলেন। অনন্ত বলেছে দরকার কী, যেমন চলছে চলুক।
‘সন্ধের পর বড্ড ভয় করে। ঘর থেকে বেরোতে পারি না, কলঘরেও যেতে পারি না…আর কী বিশ্রী গন্ধ। দরজা জানলা বন্ধ করে রাখি, হাঁপিয়ে যাই।’
অনন্ত চুপ করে শোনে। বৃদ্ধা হয়ে গেছেন কিন্তু যথেষ্ট সমর্থ। টিউশনি করে যাচ্ছেন, দোকান, বাজার, রান্না, জল তোলা নিজেই করেন। কিন্তু কতদিন করবেন? সে বিষণ্ণ হয়ে যায়। ওর ভালোবাসা এখনও কুড়ি—পঁচিশ বছর আগের মতো তীব্র আছে কি? ছবি আগলে থাকতে থাকতে ব্যাপারটা কি অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়নি? এখন তার মনে হয় বাড়াবাড়ি, দেখানেপনা।
সন্ধ্যায় অনন্ত বাড়িতে ফিরে নিজের ঘরে শুয়ে থাকে। একটা ট্রানজিস্টর কিনেছে। মাঝে মাঝে শোনে। গান, বাজনা, কথিকা শোনার কোনো বাছবিচার নেই। নাটক হলে মা দরজার কাছে এসে বসে। দোতলায় টিভি এসেছে। সে এখনও টিভিতে কোনো অনুষ্ঠান দেখেনি।
পাত্রীর জন্য বিজ্ঞাপনটা কেন দিল তার কোনো কারণ অনন্ত খুঁজে পায়নি। অমর হঠাৎ মাকে নিয়ে চলে যাবার পর আচমকা নিঃসঙ্গতার যে গর্তে সে পড়ে গেছে তাই থেকে উঠে আসার জন্যই কি একজন সঙ্গী চাইছে? কিন্তু সে ছোটোবেলা থেকেই তো নিঃসঙ্গ।
তিরিশ হাজার টাকার কাছাকাছি ব্যাঙ্কে জমেছে। ভাবলে তার অবাক লাগে। কী করবে টাকাগুলো! কোনো শখ, কোনো বাবুয়ানি নেই ফলে তার কোনো খরচ নেই। মিনতি করের মতোই কি দিন কাটাতে হবে? যদি কঠিন অসুখ করে, সেবা—শুশ্রূষার দরকার হয়, কে তাকে দেখবে!
রাত্রে অনন্তর ঘুম হল না। তার মনে হল, স্ত্রীর থেকেও তার বেশি দরকার একটা মানুষ, যে কিছু একটা করবে তার নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে।
রবিবারের কাগজে তার বিজ্ঞাপনটা বেরোবার সাতদিন পর সে খবরের কাগজের অফিস থেকে এগারোটি চিঠি আনল। রাত্রে চিঠিগুলো মন দিয়ে পড়ল। সবগুলোই কলকাতার এবং স্বয়ং পাত্রীদেরই লেখা। তিনটি চিঠি বেছে নিয়ে সে স্থির করল উত্তর দেবার আগে লুকিয়ে এদের একবার দেখে নেবে।
ঊর্মিলা দেব স্কুল—শিক্ষিকা। তার চিঠিতে দেওয়া ঠিকানা মতো সে স্কুলে বেরোবার সময় আন্দাজ করে জীর্ণ একটা বাড়ির দিকে চোখ রেখে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে রইল। অবশেষে সেই বাড়ি থেকে একজনকে বেরোতে দেখল যাকে তার মনে হল স্কুল—শিক্ষিকা। সামনে দিয়ে যাবার সময় একবার অনন্তের দিকে চাইল। তাদের চোখাচোখি হল। অনন্তের মনে হল বিনা অনুমতিতে তার দিকে তাকানোর জন্য যেন কৈফিয়ত চাইল চাহনি মারফত। এসব মেয়েমানুষ খাণ্ডারনি হয়। সে নাকচ করে দিল ঊর্মিলা দেবকে।
তার দ্বিতীয় অভিযান সত্তরের—বি রাধিকাপ্রসন্ন মিত্র লেনে। একতলা টিনের চালের বাড়ি। রাস্তার দিকে সামনের ঘরে দুটি জানালা। পিছনে একটা বটগাছ। চাকুরে নয় সুতরাং বাড়ি থেকে বেরোবার নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। দু—দিন বাড়িটার সামনে দিয়ে সে হেঁটে গেল। জানলায় একটা মুখও দেখতে পেল না, দরজাটাও বন্ধ।
তৃতীয় দিন বিকেলে সে কড়া নাড়ল। মিনিট দুয়েক পর ভিতর থেকে নারীর কণ্ঠে প্রশ্ন এল, ‘কে?’
‘আমি, একবার কথা বলতে চাই।’
দরজা খুলে আটপৌরে ঢিলেঢালা বেশে, ঘুম—ভাঙা ফুলো চোখে যে দাঁড়াল তার নাম রেবতী সেনগুপ্ত। মাজা গায়ের রং, দীর্ঘাঙ্গী, ভ্রূ—র চুল তুলে চোখদুটি সাজানো, চোখা নাক, ডিম্বাকৃতি মুখ এবং মুখ বিস্ময়।
‘কাকে চাই!’
‘এখানে কি রেবতী সেনগুপ্ত থাকেন?’
‘আমিই।’
‘আপনি কি কাগজের একটা পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনের কোনো জবাব দিয়েছেন?’
রেবতী বিব্রত হল। শাড়ির আঁচলটা কাঁধে তুলে দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, দিয়েছি…আপনি?’
‘বিজ্ঞাপনটা আমি দিয়েছি, আমার জন্যই।’
রেবতী তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, ‘একটু দাঁড়ান’।
দরজা ভেজিয়ে ভিতরে চলে গেল। মিনিট কয়েকের মধ্যেই একটি তরুণী দরজা খুলে তাকে ভিতরে আসতে বলল। মুখের আদল থেকে মনে হল রেবতীর বোন।
দরজার পাশেই ঘর। তক্তাপোশে লোটানো তোশক আর বালিশ একটা রঙিন নকশাদার বেডকভারে ঢাকা। অনন্তের মনে হল, এখুনি ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ঘরের দরজায় এক প্রৌঢ়া বিধবা দাঁড়িয়ে।
‘রেবতী আমার বড়োমেয়ে। আমার তিন মেয়ে, তারপর এক ছেলে। ওদের বাবা সাত বছর আগে মারা গেছেন। বিজ্ঞাপনটা রেবতীই প্রথম দেখে।’
‘আমার নাম অনন্ত দাস। চিঠির জবাব না দিয়ে নিজেই চলে এলুম। বিজ্ঞাপন বা চিঠি থেকে সবকিছু বোঝা যায় না তো। চক্ষু—কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হয়ে যাওয়াই ভালো, আমারও বাবা নেই, বছর কুড়ি হল মারা গেছেন।’
সেই প্রথম তার রেবতীদের বাড়িতে যাওয়া। এরপর বাকি চিঠিগুলো নিয়ে তাকে আর মাথা ঘামাতে হয়নি।
সেদিন ঘণ্টাখানেক সে ছিল। রেবতী তাকে চুম্বকের মতো টেনেছে, তাকে উত্তেজিত করেছে, রাত্রে ঘুম হয়নি।
এরপরও তিনবার সে গেছে। পরিবারের সকলের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তার নিজের কথা, ভাই বোন মায়ের কথা, কষ্ট করে সংসার চালানো, অঘোর এস্টেটে অপ্রত্যাশিত চাকরি পাওয়া, বোনেদের বিয়ে, অমরের চলে যাওয়া, মা—র ক্যানসার—সবই সে বলেছে।
ওদের নিজেদের বাড়ি, দু—খানি ঘর। তিনদিনের মধ্যে দু—দিনই সন্ধ্যার সময় রেবতী বাড়ি ছিল না।
‘এইমাত্র বেরোল এক বন্ধুর সঙ্গে, কখন আসবে ঠিক নেই। আপনি কি বসবেন?’
অনন্ত কিছুক্ষণ বসে থাকে। দু—একটা কথাও বলে। চা খায়, সঙ্গে দুটি সন্দেশ।
তৃতীয় দিনে রেবতী বেশিরভাগ সময়ই অন্য ঘরে ছিল। অনন্ত ছটফট করছে ওকে দেখার জন্য। পাশের ঘর থেকে রেবতীর কণ্ঠস্বর পেয়ে সে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। সে বুঝতে পারছে তার মধ্যে একটা পরিবর্তন ঘটছে।
রেবতীর মা বিয়ের কথা তুললেন। ‘রেবতীর বাবা মারা গেলেন তখন ও বিএ পড়ছিল, আর পড়া হয়নি। আমরা কিন্তু কিছুই দিতে—থুতে পারব না শাঁখা সিঁদুর ছাড়া।’
অনন্তের মনে পড়ল অনুর বিয়ের কথা। সে বলল, ‘দিলেও আমি কিছু নোব না। আপনারা আমার সম্পর্কে খোঁজখবর নিন। আমি কোথায় থাকি, ঘরদোর কেমন সেটাও তো একবার দেখবেন।’
ঠিক হয় রেবতীকে নিয়ে গিয়ে অনন্ত তার একার সংসার দেখিয়ে আসবে। সন্ধ্যা নাগাদ সে রেবতীদের বাড়ি যায়। তখন ঘরের তক্তাপোশে বালিশ বগলে রেখে কাত হয়ে শুয়ে একটি লোক সিগারেট খাচ্ছিল। রেবতীর বোন শাশ্বতী আদুরে ভঙ্গিতে লোকটির পায়ের ওপর হাত রেখে বসে। রেবতী জানলার ধাপে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে হাসছিল।
অনন্ত ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছিল। ওকে দেখেই ঘরের সবাই চুপ করে তাকিয়ে রইল। অবশেষে শাশ্বতী বলল, ‘আসুন।’
‘আজ দেখতে যাবার কথা ছিল।’
রেবতীর পায়ের দিকে তাকিয়ে অনন্ত বলল।
‘আজকেই, কিন্তু আজ যে…’
অনন্তর বুক কেঁপে উঠল। রেবতী কি যাবে না? সকালে সে ঘর—দালান জল দিয়ে ধুয়েছে, কাচানো ওয়াড় বালিশে পরিয়েছে, ঝুল ঝেড়েছে, তাকের জিনিসপত্র গুছিয়েছে, স্টোভে কেরোসিন ভরে রেখেছে, যদি চা খেতে চায়! ভেবে রেখেছে ট্যাক্সিতে রেবতীকে আনবে এবং পৌঁছে দেবে।
‘যাও না, কতক্ষণ আর সময় লাগবে।’ লোকটি অনুমতি দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল।
‘আপনি বসুন, আমি কাপড়টা বদলে আসি…ওহ পরিচয় করিয়ে দিই, এই হচ্ছে দিলীপদা, অনেক উপকার করেছে আমাদের, দিলীপদা না থাকলে আমাদের পরিবারটা ভেসে যেত…আর ইনি হচ্ছেন সেই ভদ্রলোক কাগজে পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন।’
‘ওহ আপনি।’
অনন্ত নমস্কার করল, লোকটি প্রতি নমস্কার না করে সিগারেটের প্যাকেটটা তার দিকে এগিয়ে ধরে।
‘মাফ করবেন, খাই না।’
তক্তাপোশের নীচ থেকে একটা মোড়া বার করে দিল শাশ্বতী। অনন্ত দেওয়াল ঘেঁষে বসল। তার ভিতরে অস্বস্তি। কয়েকবারই সে দিলীপদা নামটা ওদের নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় উচ্চচারিত হতে শুনেছে। আজ সে চোখে দেখল। মাঝারি আকৃতি, ফরসা, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, বুশশার্ট ও প্যান্টটা দামি কাপড়ের। এদের আত্মীয় নয়, তাহলে কে? উপকারী বন্ধু। কী উপকার করেছে যাতে ভেসে যাওয়া বন্ধ হয়!
‘কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন কেন?’
‘তা ছাড়া উপায় ছিল না।’
‘সম্বন্ধ করে বিয়ে দেবার মতো কেউ নেই?’
‘না।’
‘কোথায় চাকরি করেন?’
‘জমিদারের এস্টেটে, সম্পত্তি দেখাশোনার কাজ।’
‘অ।’
দিলীপদা নিস্পৃহ হয়ে শাশ্বতীর দিকে মনোযোগ দিল।
‘মাসিমা কোথায় রে?’
‘ও ঘরে শুয়ে আছে, মাথা যন্ত্রণা হচ্ছে। ডাকব?’
‘থাক। তাঁতিকে পাঠিয়ে দেব তা হলে, কখন আসবে?’
‘দুপুরে পাঠিয়ো।’
‘ভাস্বতী এই শনিবার আসবে?’
‘মেজদির কোনো কথার ঠিক নেই। আসতেও পারে।’
দিলীপদা উঠে বসল রেবতী ঘরে ঢুকতেই। হালকা টিয়া পাখি রঙের সিল্কের শাড়িটা ওর শরীরের উঁচু—নীচু জায়গাগুলোর উপর আলতো করে বিছানো। লিপস্টিকের আভাস পাওয়া যাচ্ছে, হাতকাটা ব্লাউজে বাহুর ডৌল বড়ো সুন্দর দেখাচ্ছে। কিন্তু অনন্ত চোখ নামিয়ে নিল।
‘আমার সঙ্গেই চলো, ওদিকে একটা কাজ আছে সেরে নেব।’
বাদামি অ্যাম্বাসাডারটা অনন্ত গলিতে ঢোকার সময় দেখেছিল। সেটা যে এই লোকটিরই বুঝতে পারল যখন চাবি দিয়ে দরজা খুলে ড্রাইভারের সিটে বসল। রেবতী পিছনের দরজা খুলে দাঁড়াল।
‘উঠুন।’
‘আপনি উঠুন।’
‘উঠব।’
অনন্ত গাড়িতে ঢুকতেই দরজা বন্ধ করে রেবতী সামনের দরজা খুলে দিলীপের পাশে বসল। অনন্ত আশা করেছিল অন্যরকম।
তাদের গলির মধ্যে গাড়ি ঢুকিয়ে বার করা কঠিন। তাই অনন্ত ঢোকাতে বারণ করল।
‘আমি এখানেই থাকছি, তুমি দেখে এসো।’
দিলীপদা সিগারেট ধরাল। রেবতীকে নিয়ে গলি দিয়ে হেঁটে আসার সময় সে সন্তর্পণে জিজ্ঞাসা করল, ‘উনি কে হন?’
‘দিলীপদা? উনি ফ্যামিলি ফ্রেন্ড, ওর নাম দিলীপ ভড়। বিরাট বিল্ডিং কন্ট্রাক্টর।’
আর প্রশ্ন না করে অনন্ত বাড়িতে ঢুকল, তালা খুলে রেবতীর দিকে তাকাল। কিছু বুঝতে পারল না। দালানের আলো জ্বালল।
চোখ ঘুরিয়ে মুখ তুলে রেবতী দেওয়াল, মেঝে, কড়িকাঠ দেখছে। অনন্ত প্রাণপণে বুঝতে চেষ্টা করছে ওর প্রতিক্রিয়া।
‘রান্নাঘরটা দেখুন।’
প্রায় ছুটে গিয়ে সে রান্নাঘরের দরজা খুলল।
‘মা এই জায়গাটা বসে রাঁধত।’
রেবতী দূর থেকে দেখে ফিকে হাসল।
‘দুটো ঘর।’
অনন্ত দরজা খুলে আলো জ্বালল। রেবতী দরজার কাছ থেকে উঁকি দিল।
‘চলি এবার।’
‘চা খাবেন?’
‘না, না, চা নয়।’
রেবতী সদরের দিকে এগোচ্ছে, অনন্ত পিছু নিল।
‘খুব পুরোনো বাড়ি।’
‘হ্যাঁ, শুনেছি আশি—নব্বুই বছরের। পাড়াটা খুব বনেদি।’
‘ভ্যাপসা একটা গন্ধ রয়েছে। জানলাগুলো ঠিকমতো বন্ধ হয়?’
‘হয়। মেঝেটা নতুন করে করাব ভাবছি, দেওয়ালের পলেস্তরাও…এসব করবার দরকার এতকাল হয়নি তো।’
কথাটা রেবতীর কানে গেল কি না সে বুঝল না। রাস্তার লোকেরা ওর দিকে তাকাচ্ছে। রকে যারা বসে ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে। বারান্দা থেকে ঝুঁকে আছে কয়েকটা মুখ।
দিলীপ ভড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল। ‘দেখা হল?’
‘হ্যাঁ।’
কোনো কথা না বলে ওরা গাড়িতে উঠল। স্টার্ট দিয়ে মাথা নীচু করে দিলীপ ভড় তাকাল।
‘চলি তা হলে, আবার দেখা হবে।’
ফিরে এসে অনন্ত গুম হয়ে বসে রইল। রেবতী কিছুই বলল না। ঘর নিশ্চয়ই পছন্দ হয়নি। ওর মতো ঝকঝকে মেয়ের পক্ষে এটা বসবাসের উপযুক্ত জায়গা নয়।
এই প্রথম সে তার বাসস্থানকে ঘৃণা করল। প্রত্যেকটা পরিচিত বস্তু, যেগুলোকে সে কখনো লক্ষই করত না, তার চোখে কুৎসিত হয়ে দেখা দিচ্ছে।
অনন্ত ফাঁপরে পড়েছিল বিয়ের ব্যাপারে। সে একা, বিয়ের কাজকর্ম দেখার, করার কেউ নেই। উপরের জেঠিমা, কাকিমাদের বলা যায়, কিন্তু সে রাজি নয়। অলুকে জানানোর ইচ্ছে নেই, অনু হয়তো আসতে পারবে না, মা—র পক্ষেও আসা সম্ভব নয়।
‘এই নিয়ে এত চিন্তার কী আছে, আমার ওখান থেকে হবে…আমার ক্যামাক স্ট্রিটের ফ্ল্যাটটা তো খালিই পড়ে আছে। ওখান থেকেই বর যাবে, কনে নিয়ে ফিরেও আসবে।’
দিলীপ ভড় নিমেষে সমস্যাটার সমাধান করে দেয়। অনন্ত রাজি হয়। বিয়ের দিন সকালে ক্যামাক স্ট্রিটে ‘মধুবন’ বাড়ির সাততলায় অনন্তের পৌঁছনোর কথা। দালানের দরজায় তালা দিয়ে বিয়ের জন্যে কেনা জুতো, পাঞ্জাবি, ধুতিতে ভরা নতুন সুটকেসটা হাতে নিয়ে বেরোবার সময় তার মনে হল দোতলায় খবরটা দেওয়া উচিত। জন্ম থেকে ওরা তাকে দেখছে।
কাকিমা রান্নাঘরে ছিলেন, অনন্তকে দেখে কৌতূহলে বেরিয়ে এলেন খুন্তি হাতেই।
‘কাকিমা আজ আমার বিয়ে।’
‘য়্যাঁ…ওম্মা, কোথায় বিয়ে হচ্ছে? জোগাড়যন্তর কই, ও দিদি শুনে যাও অনন্তের আজ বিয়ে।…এ বাড়ি থেকে হচ্ছে না?…আজকেই!’
জেঠিমা বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। অনন্তকে লাজুক দেখাচ্ছে।
‘হঠাৎই ঠিক হয়ে গেল জেঠিমা। আপনাদের জানাবার পর্যন্ত সময় পাইনি…এক বন্ধুর বাড়ি থেকে বিয়েটা হচ্ছে। এখানে কে করবে—টরবে, তাই বন্ধুর বাড়ি থেকে।’
‘কেন রে আমরাই করতুম।’
‘আবার কেন আপনাদের ঝামেলায় ফেলব।’
‘বিয়ের কাজ কি ঝামেলার কাজ বাবা? আমাদের তুই পর ভাবলি!’
‘না না সে কী কথা। আপনাদের সাহায্য ছাড়া কি আমাদের চলত।’
‘খুব ভালো করেছিস। এই সেদিনই বলাবলি করছিলুম অনন্তর এবার বিয়ে করা উচিত। রোজগেরে ছেলে, এভাবে বাউণ্ডুলের মতো থাকবে কেন, রেঁধে দেবারও কেউ নেই।’
‘দিদি তো বলছিল জোর করে তোর বিয়ে দিয়ে দেবে। মেয়ের বাড়ি কোথায়…কে কে আছে মেয়ের, অবস্থা কেমন, বল সব।’
‘আমার মতো অবস্থা, বাবা নেই। দুই বোন এক ভাই আর মা।’
‘চাকরি করে?’
‘মেজোবোন স্কুলে পড়ায় বাইরে থাকে। এরা থাকে সিমলেয়। কাউকে নেমন্তন্ন করিনি, বউভাতে করব।’
‘আগে যদি বলতিস, আমরাই সব ব্যবস্থা করে দিতুম।’
দু—জনকে প্রণাম করে সে বেরিয়ে পড়ল। ট্যাক্সি থেকে নেমে, মধুবনের সাততলায় পৌঁছে যখন সে কলিংবেল টিপল তখন বেলা প্রায় এগারোটা। পাজামা শার্ট পরা এক ছোকরা দরজা খুলে হেসে তাকে ভিতরে আসতে বলল।
‘আপনার নামই তো অনন্ত দাস?’
‘হ্যাঁ।’
‘বাবু সকালে টেলিফোনে বলে দিলেন, আপনার গায়ে হলুদ ছুঁইয়ে মেয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে। ড্রাইভার হলুদ দিয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি জামা খুলুন।’
বড়ো দালানের মতো বসার জায়গায় মোটা কার্পেটে মেঝে ঢাকা, সাদা দেয়াল, এককোণে দুটো বড়ো সোফা তার বাঁ দিকে বারান্দা। দেয়ালের ধারে একটা শূন্য টেবল ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই। তিনটে বন্ধ দরজা সে দেখতে পাচ্ছে, বোধহয় শোবার ঘরের। অনন্ত কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেল। এমন একটা নির্জন পরিবেশ সে আশা করেনি। সুটকেস টেবলে রেখে সে জামা খুলল। ছোকরা তার শরীরের যত্রতত্র হলুদ ছুঁইয়ে পেতলের রেকাবিটা নিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় বলল, ‘আপনি কি উপোস দিচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘কিচেনে বিস্কুট আছে, বাদাম আছে, খেতে ইচ্ছে করলে খাবেন। বেডরুম খোলা আছে। আমি গায়ে হলুদ পৌঁছে দিয়ে টোপর, মালাটালা কিনে নাপিত, পুরুত সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসব।’
অনন্ত সোফায় বসে রইল অনেকক্ষণ। একবার বারান্দায় গিয়ে নীচের রাস্তা দেখল। তিনটে দরজার একটা রান্নাঘরের। জলতেষ্টা পেয়ে যাচ্ছে। বেসিনের কল থেকে গ্লাসে জল নিয়ে খেল। মেঝেয় একধারে চারটে মদের খালি বোতল। ফ্রিজের পাল্লা খুলে দেখল একদমই ফাঁকা।
সে শোবার ঘরে এল। দেওয়াল ঘেঁষে চওড়া খাট। ছোটো নীচু টেবলের উপর টেলিফোন। দেওয়াল আলমারি ছাড়াও রয়েছে ছোটো একটা স্টিল আলমারি, ছোটো দুটি চেয়ার, মেঝেয় কার্পেট, লাগোয়া বাথরুমের দরজা। বিপরীত দেওয়ালে মদের রঙিন ক্যালেন্ডারে আলস্য ভাঙছে আড়মোড়া দিচ্ছে এক নগ্ন বিদেশিনী। ছবিটা দেখেই ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল তার দুটো কান। পেটের মধ্যে যাবতীয় বস্তু কুঁকড়ে গেল। ঘর থেকে বেরিয়ে সে টানটান হয়ে সোফায় শোয়ামাত্রই ঘুমিয়ে পড়ল। স্বপ্নের মধ্যে কাটাতে কাটাতে অনন্ত বিয়ের রাত পেরিয়ে এল। সকালেও তার মনে হল অবাস্তব এক জগতের মধ্যে সে বাস করছে। সন্ধ্যার সময় বর—বউ দিলীপ ভড়ের মোটরেই মধুবনের ফ্ল্যাটে এসে উঠল। রাতটা সে কাটাল সোফায়, রেবতী ঘরে শুয়েছিল দরজায় চাবি দিয়ে।
দশ
অদ্ভুত সময়, অদ্ভুত জীবনের মধ্যে অনন্ত নেমে যাচ্ছে যেভাবে মানুষ চোরাবালিতে নামে। শেষবারের মতো দুটো হাত বার বার মুঠো করে একটা শক্ত অবলম্বন পাবার জন্য যেমন আঁকুপাঁকু করে, রেবতীকে আঁকড়ে অনন্ত তেমনি চেষ্টা শুরু করল। সে জানে তার দেরি হয়ে গেছে, তার গলা মুখ চোখ ডুবে গেছে, বাকি আছে উঁচু করে তোলা হাতদুটো। সে জানে জীবনকে শুষে নিতে যত বেশি ব্যগ্র হবে তত দ্রুত তলিয়ে যাবে। রেবতীকে তাই সে সমীহ করে।
তারা একই শয্যায় শোয় কিন্তু অনন্তের মনে হয় রেবতী বহু মাইল দূরে, তারা কথা বলে কিন্তু পরস্পরকে যেন বোঝাতে পারে না। বিয়ের এগারো দিন পর অন্য দিনের থেকে একটু আগেই বিকেলে বাড়ি ফিরে অনন্ত দেখল দরজায় তালা দেওয়া। সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চায়ের দোকানে গিয়ে বসল। আলুর দম—রুটি খেয়ে খবরের কাগজ নিয়ে সময় কাটাতে লাগল।
রেবতীকে দূর থেকে সে দেখতে পেল দ্রুত হেঁটে আসছে। ওর মেরুন—সবুজ তাঁতের শাড়িটা তারই কেনা। হাতে চামড়ার ছোটো ব্যাগটা। কিন্তু একটা কালো অ্যাম্বাসাডার থেকে যে রেবতী নামল সেটা তার চোখ এড়ায়নি। সে চেষ্টা করল দেখতে মোটরে কে আছে, কিন্তু দেখতে পেল না। গাড়িটা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গেল।
আশেপাশে না তাকিয়ে রেবতী হাঁটে। ও ঠিকই জানে বহু চোখ তাকে দেখছে। গ্রাহ্যের মধ্যে আনে না, চায়ের দোকানের সামনে দিয়ে সে চলে গেল। তখন বাড়িমুখো চা—পিপাসু এক অফিস ফেরত অশ্লীল শব্দ করে হাই তুলল। অনন্ত মাথাটা নামিয়ে দিল কাগজে।
হাতঘড়িতে সে দেখল পনেরো মিনিট পেরিয়ে গেছে রেবতী চলে যাওয়ার পর। ঘড়িটা সে বিয়ের দু—দিন পর কিনেছে। বাবার কেনা ওয়াল ক্লকটা আজও নিখুঁত সময় দিয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে সময় জানতে তার অসুবিধা নেই, বাইরে প্রায় প্রত্যেকের হাতেই ঘড়ি। দরকার হলে সে জিজ্ঞাসা করে নেয়। তাই ঘড়ি কেনার জন্য ‘বাজে খরচের’ দরকার তার হয়নি। এখনও দরকার হয় না, তবু কিনেছে। উপরের কাকিমা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘শ্বশুরবাড়ি থেকে কী কী দিল?’
প্রথমেই সে বলে ফেলেছিল, ঘড়ি। তাই সে ঘড়িটা কিনে ফেলল। রেবতীর ঘড়ি আছে। তবু তিনশো টাকায় তাকে একটা কিনে দেয়।
অনন্ত যখন ফিরল রেবতী তখন চা করছে। শার্টটা খোলার পর গেঞ্জিটা খুলতে গিয়েও খুলল না। বাড়িতেও গেঞ্জি পরে থাকা সে শুরু করেছে বিয়ের পর।
‘চা আমাকেও একটু দিয়ো।’
‘এই ফিরলে?’
‘হ্যাঁ।’
কেন যে মিথ্যা কথাটা বলল তা সে জানে না। আপনা থেকেই মুখে এসে গেল।
‘কী করলে সারা দুপুর?’
রেবতী উত্তর দেবার আগে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। চাউনিটা তুরপুনের মতো, ঘুরতে ঘুরতে তার মনের মধ্যে গর্ত করে যাচ্ছে, যার মধ্য দিয়ে প্রশ্নের পিছনের উদ্দেশ্যটা দেখা যাবে। অনন্ত তার মুখটাকে নির্বিকারে করে রেখে দিল, হাতে চায়ের কাপ নেবার সময়।
‘কিছুই তো করবার নেই। তাই একবার বাড়ি থেকে ঘুরে এলাম। মা—র মাথার যন্ত্রণাটা খুব বেড়েছে, ডাক্তার দেখাতে হবে মনে হচ্ছে।’
‘স্পেশালিস্ট দেখানোই ভালো।’
‘অনেক টাকার ধাক্কা।’
‘টাকার জন্য ভাবতে হবে না।’
রেবতী তাকাল এবং মিষ্টি করে হাসল। অনন্ত উত্তেজনা বোধ করে অথবা বহুদিন পর সাংসারিক দায়িত্বের স্বাদ পেয়ে, যেটাই হোক, বলল, ‘মাথার ব্যথার কখনো অবহেলা করতে নেই। স্পেশালিস্ট কত আর নেবে…পঞ্চাশ, একশো, দু—শো? অবহেলা যদি না করা হত তা হলে আমার মায়ের ক্যানসার গোড়াতেই ধরা পড়ত। কালই আমি খোঁজ নেব। আমাদের মালিক সমীরেন্দ্র বসুমল্লিককে যে ট্রিটমেন্ট করেছিল তার কাছেই বরং যাব।’
‘এত তাড়াহুড়োর দরকার কী…একটু বাজারে যাবে, ঘি, গরম মশলা ফুরিয়েছে। কপিটা আজই রেঁধে ফেলি।’
রাতে অন্যদিনের মতো রেবতী আজ বাঁ দিকে না ফিরে অনন্তের দিকে কাত হয়ে শুল। কিছুক্ষণ পর তার বাঁ হাত অনন্তের বুকের উপর পড়ল। সে নিশ্বাস চেপে শক্ত হয়ে শুয়ে রইল। এই প্রথম রেবতী তাকে স্বেচ্ছায় স্পর্শ করল, এটা কীসের আভাস দিচ্ছে?
সে প্রায় চুপিসারে তার ডান হাত বিছানা থেকে এমনভাবে বুকের দিকে আনতে লাগল যেন রেবতীর হাতটা একটা পাখি, সামান্য নড়াচড়া টের পেলেই উড়ে যাবে।
ধীরে ধীরে সে তা রাখল রেবতীর আঙুলের ওপর। মুঠিতে চাপ দিল এবং হাতটায় টান দিয়ে কাছে আসার জন্য ইঙ্গিত করল।
বাহুতে ভর দিয়ে মাথাটা সামান্য তুলে রেবতী ঝুঁকে পড়ল এবং অনন্তের ঠোঁটের উপর আলতো চুমু দিল।
অনন্ত সংবিৎ হারানোর আগে বুকের মধ্যে প্রচণ্ড চিৎকার শুনতে পেল। একটা অস্থিরতা তার শরীরটায় দাপিয়ে যাচ্ছে। একটা দুর্লভ চূড়ায় সে উঠবে। সেখান থেকে তার জীবনের পিছন দিকে একবার মাত্র সে তাকাবে।
রেবতী মাথাটা সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। অনন্ত দু—হাতে তাকে জাপটে ধরল।
‘নাহ।’
‘হ্যাঁ।’
রেবতী চেষ্টা করল অনন্তর মুঠি আলগা করতে। অনন্ত হুড়মুড় করে তার বুকের উপর ভেঙে পড়ল, এলোপাথাড়ি চুমু দিতে লাগল ওর গালে, গলায়, বুকে।
‘না আ আহ, কী ছোটোলোকমি হচ্ছে!’
রেবতীর নখ বসে গেছে অনন্তের ঘাড়ে। সে কিছুই বোধ করছে না শুধু একটা অন্ধ রাগ ফুঁসে উঠছে তার মাথার মধ্যে।
‘আমি তোমার স্বামী।’
‘তাতে কী হয়েছে!’
‘তা হলে বিয়ে করলে কেন?’
‘শুধু এইজন্যই বিয়ে করা?’
‘এটাও একটা কারণ।’
‘একটা নয়, তোমার কাছে এটাই একমাত্র কারণ।’
রেবতীর স্বরে তাচ্ছিল্যের ছোঁয়া রয়েছে। অনন্তের ইচ্ছা করছে ঘুসি মেরে মেরে ওর মুখটাকে থেঁতলে দিতে।
‘তোমার একটা মেয়েমানুষের শরীর দরকার, যে—কোনো, যেমন—তেমন, মেয়েমানুষ।’
অন্ধকারে মূঠো করা অনন্তের হাতটা উঠেছিল, সেটা দেখতে পেলে রেবতী হয়তো কথাগুলো বলত না। কয়েক সেকেন্ড পর হাতটা মন্থরভাবে নেমে গেল।
মাত্র এগারো দিন তাদের বিয়ে হয়েছে। অনন্তের মনে হচ্ছে, তারা আর মিলতে পারবে না। বোকার মতো সে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। চল্লিশটা বছর কেটেছে যেভাবে বাকি জীবন সেইভাবেই নয় কেটে যেত।
জীবনকে সে কিছু কি দিয়েছে যে আজ প্রতিদান আশা করছে? ভাই বোন মা সবাই একে একে সরে গেছে। তাদের জন্য সে সতেরো বছর বয়সে বাবার জায়গা নেওয়ার দম্ভে বলেছিল, ‘আমি সবাইকে দেখব।’ মা বলেছিল, ‘তুই সুখী হবি।’
সুখ।
রেবতী ওপাশ ফিরে দেওয়াল ঘেঁষে শুয়ে।
পরদিন যথারীতি সে বাজারে গেল, স্নান করল, ভাত খেল এবং বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। অন্যদিনের মতো সন্ধ্যার সময় ফিরল।
অন্ধকার ঘরে রেবতী শুয়েছিল। আলো জ্বালতেই চোখ বন্ধ করল।
‘শুয়ে যে! শরীর খারাপ নাকি?’
‘না…ভালো লাগছে না তাই।’
‘রান্না করবে না?’
‘যাচ্ছি।’
অলু একদিন এসেছিল ঘণ্টাখানেকের জন্য। তাকে বলেছিল: ‘এমন সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে ভাব করলে কী করে?’ আর পাঁচশো টাকা চেয়েছিল। দু—দিন পর ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে মানিঅর্ডার করে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
একদিন সন্ধ্যায় দোতলার কাকিমার সঙ্গে রাস্তায় মুখোমুখি হতেই তিনি এ—কথা সে—কথার পর গলা নামিয়ে বলেন, ‘তোকে তো ন্যাংটো বয়স থেকে দেখছি, তুই তো আমার ঘরের ছেলে, বল তো প্রায়ই গাড়ি নিয়ে একটা লোক তুই বেরিয়ে যাবার পরই আসে আর বউমা সেজেগুজে তার সঙ্গে বেরিয়ে যায়…কে লোকটা?’
‘গাড়ি নিয়ে!’
‘ওই মোড়ে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করে, আমি অবিশ্যি দেখিনি, রেডিয়োয় গান গায় প্রফেসরের বউ সঙ্ঘমিত্রা—ওদের ঝি দেখেছে। তোর কাকাবাবুও দু—দিন দেখেছেন। দুপুরে পার্ক স্ট্রিট দিয়ে দু—জনকে গাড়ি করে যেতে।’
শুনতে শুনতে অনন্তের বুকটা খালি হয়ে যেতে লাগল। একটা নোংরা সন্দেহ পাড়ায় ছড়িয়েছে। তার নিজেরও ব্যাপারটা ভালো লাগছে না। তা ছাড়া একবারের জন্যও রেবতী তাকে বলেনি সে দিলীপ ভড়ের সঙ্গে বেরিয়েছিল। গোপন করা কেন? মাকে স্পেশালিস্ট দেখাবার জন্য আর তো একবারও বলল না। মা—র কাছে সেদিন সত্যিই গেছল কি!
‘ওহো, দিলীপদা, উনি তো রেবতীর মাসতুতো দাদা।’
কাকিমার মুখের ভাবের বিশেষ কোনো বদল ঘটল না। রেবতীকে দোতলার কেউ পছন্দ করে না। সে ওদের সঙ্গে কথা বলতে চায় না।
‘হোক দাদা, লোকে তো পাঁচকথা বলে, তুই একটু বারণ করিস।’
রাত্রে পাশাপাশি শুয়ে অনন্ত একসময় জিজ্ঞেস করল, ‘দিলীপদা আসে?’
সে টের পেল পাশের শরীরটা টানটান হয়ে শক্ত হল।
‘পাড়ায় অনেকে খারাপ ভাবে নিয়েছে।’
‘কী নিয়েছে?’
‘ওর সঙ্গে তোমার বেরোনোটা।’
হঠাৎ অনন্তের চোখে ভেসে উঠল মধুবনের খালি ফ্ল্যাট আর শোবার ঘরের দেওয়ালের ক্যালেন্ডারের ছবিটা। বুকটা তার দুরদুর করে উঠল। একটা বাজে সন্দেহ তার মনে ঝিলিক দিল।
‘আমি কার সঙ্গে বেরোই না বেরোই তাতে পাড়ার লোকের কী?’
‘তাদের কিছুই নয়, কিন্তু আমার কিছু।’
‘তোমার।’
‘কেন বেরোও?’
এত কঠিনস্বরে অনন্ত কখনো কথা বলেনি।
‘বেরোলেই বা, কিছুক্ষণ মোটরে ঘুরলে কী হয়েছে?’
অনন্ত বলতে যাচ্ছিল, বেরিয়ে কোথায় যাও? জিবের ডগা থেকে সে কথাটা প্রত্যাহার করল।
‘বিয়ে করাটা উচিত হয়নি।’
‘কার, তোমার?’
‘তোমার…কোনো দরকার ছিল কি?’
‘ছিল।’
‘ছিল?’
‘বলা যাবে না। ওর কাছে আমরা অনেক কৃতজ্ঞ, অনেক ঋণী।’
‘তার জন্য আমাকে বলি হতে হবে।’
তাদের মধ্যে আর কোনো কথা হয়নি। রেবতী হাত বাড়িয়ে অনন্তর বাহু স্পর্শ করল। সে কোনো উত্তেজনা অনুভব করল না।
শান্তভাবে কয়েকটা দিন কেটে যাবার পর, বাড়ি ফিরে অনন্ত দেখল দরজায় শিকল তোলা, তালা ঝুলছে না। ঘরে যাওয়ামাত্র টেবলে রাখা চিরকুটটা তার চোখে পড়ে।—’আমার আর ভালো লাগছে না। চলে যাচ্ছি। আর ফিরব না। রেবতী।’
রান্নাঘরে রাতের খাবার ঢাকা দেওয়া। তার দেওয়া কোনো কিছুই নিয়ে যায়নি। ঘড়িটা টেবলে রাখা।
খাটে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে থাকতে অসম্ভব একটা শ্রান্তির শব্দ তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল। আবার সে একা। পাঁচ মাসের জন্য সে অন্য একটা জগতে ঘুরে প্রত্যাবর্তন করল।
একদিন পর জেঠিমা বলল, ‘বউমাকে দেখছি না যে! বাপের বাড়ি গেছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কদ্দিনের জন্য?’
‘মাসখানেক থাকবে।’
এক মাস সময় পেল। এর মধ্যে কেউ কৌতূহল দেখাবে না। কিন্তু তারপর? জানাজানি হবেই। মুখ দেখাবে কী করে? যে শুনবে প্রথমেই বলবে—কার সঙ্গে বেরিয়ে গেল? কিংবা—কোথায় গিয়ে উঠেছে?
খবরটা রেবতীর বাড়ির লোকেরা কেমন ভাবে নেবে? তারা কি ওকেই সমর্থন করবে?.. কোথায় গিয়ে উঠেছে? বাড়িতে না মধুবনের ফ্ল্যাটে!
নানান অনুমান, প্রশ্ন এবং দ্বিধা কাটিয়ে চারদিন পর রাত্রিবেলায় সে রেবতীদের বাড়িতে হাজির হল। তাকে দেখে প্রত্যেকের মুখে অস্বস্তি ফুটে উঠল। সে বুঝল, এরা তা হলে জানে।
‘রেবতী কি এখানে?’
ওর মা ইতস্তত করে বলল, ‘বিকেলেও তো ছিল…বলে যায়নি কোথায় গেছে।’
‘তা হলে আমি একটু ঘুরে আসি।’
‘একটু কিছু মুখে দিয়ে যাও বাবা।’
অনন্ত ওখান থেকে বেরিয়ে এল মধুবনের সাততলায়। দরজা খুলল দিলীপ ভড়ই।
‘আসুন।’
যেন তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। অনন্ত সোফায় বসল। সামনের সোফায় দিলীপ ভড়। হাতে আধভরতি মদের গ্লাস। ছোটো করে চুমুক দিল।
‘রেবতী এখানে নেই। এসেছিল। আমি ফিরে যেতে বলি, ও রাজি হয়নি। ওকে তাই পাঠিয়েছি আমাদের দেশের বাড়িতে।’
‘ফিরে যেতে…কোথায় ফিরে যেতে?’
‘আপনার কাছে।’
‘আমি তো ওকে গ্রহণ নাও করতে পারি, তখন যাবে কোথায়?’
দিলীপ ভড় বড়ো করে হাসলেন। গ্লাসটা শেষ হয়ে গেছে।
‘আমার কাছে।’
‘আপনি ওকে ভালোবাসেন?’
‘নিশ্চয়।’
‘তা হলে বিয়ে দিলেন কেন? আমারও তো একটা জীবন আছে।’
‘সেই জন্যই ওকে ফিরে যেতে বলি। ঠিক এই কথাটাই ওকে বলেছি। ও শুনল না।’
‘পরিচিতদের কাছে এবার মুখ দেখাব কী করে!’
‘বলে দিন বাস চাপা পড়ে মারা গেছে, কিংবা কলেরায়।’
‘তা হয় না, পরে ওকে কেউ দেখে ফেললে আরও জানাজানি হবে।…অবশ্য আমার এতে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই…বউ যদি দুশ্চরিত্রা হয়, স্বামী কী করতে পারে?’
‘আপনাকে কেউ দোষ দেবে না?’
‘না, সবাই জানে আমি ভালো ছেলে।’
কথাটা বলেই অনন্তের বুকের মধ্যে একটা যন্ত্রণা শুরু হল। ধীরে ধীরে ফ্যাকাশে হয়ে এল তার মুখ। ফ্যালফ্যাল করে সে দিলীপ ভড়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে অস্ফুটে বলল, ‘কিন্তু সত্যিই কি আমি তাই!’
এগারো
প্রায় তিন ঘণ্টা হয়ে গেল অনন্ত এলোমেলো হাঁটছে। রাস্তায় ট্র্যাফিক কমে গেছে। একটা ট্রামের সামনে লাল বোর্ডে ‘লাস্ট কার’ লেখাটা চোখে পড়েছে। পথচারীরা প্রায় নেই। দু—একটা আধ ভেজানো দোকান, ভিতরে আলো জ্বলছে। বগলে চট নিয়ে দু—তিনজন শোবার জায়গা খুঁজছে ফুটপাথে। অনন্ত আলোজ্বলা গির্জার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে তারপর নিজের হাতঘড়ি দেখল। বন্ধ হয়ে আছে।
‘ইসস একদম ভুলে গেছি।’
ঘড়িতে দম দিতে দিতে সে আরও জোরে হাঁটা শুরু করল। হাঁটুর কাছে টান ধরেছে। কষ্ট হচ্ছে হাঁটতে। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে গিয়ে হাঁটুর পিছনে শিরাটার হাত বুলোল, কিন্তু সে গতি কমাল না। জলতেষ্টা পাচ্ছে অসম্ভব। থুতু ফেলতে গিয়ে শুকনো জিবটা টাগরায় আটকে গেল।
দরজায় আস্তে টোকা দিল। জায়গাটায় আলো নেই, তখনও চোলাইয়ের গন্ধ ভাসছে। আবার সে টোকা দিল।
‘কে?’
‘আমি।’
দরজা খুলে একটা ছায়া দুই পাল্লার ফাঁকে ভেসে উঠল। তখন সে কাতর অনুনয়ে বলল, ‘আমি শক্তিপদর ছেলে, আমার এবার ভালোবাসা দরকার…দেবে?’
ছায়াসরণীতে রোহিণী
এক
লালবাজার মোড় থেকে প্রায় পঞ্চাশ মিটার পুবে বউবাজার স্ট্রিটে ট্রামের তার ছিঁড়ে পাঁচ—ছটা ট্রাম দাঁড়িয়ে পড়েছে। তাদের দু—পাশ দিয়ে বাস, মিনিবাস এবং অন্যান্য গাড়ি ফুড়ুত করে বেরিয়ে যেতে গিয়ে সামনে থেকে আসা ট্র্যাফিকের মুখোমুখি হয়ে রাস্তাটা এখন অচল করে ফেলায় গাড়ির পিছনে গাড়ি জমতে জমতে লালবাজার মোড় পর্যন্ত জ্যামের জের পৌঁছে গেছে। জনা চারেক ট্র্যাফিক কনস্টেবল ও একজন সার্জেন্ট ছুটে এসে কলকাতার এই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাটাকে চালু করার জন্য হিমসিম খাচ্ছে। কে জানে, পুলিশের কোন বড়োকর্তা বা কোন মন্ত্রী জ্যামে আটকে পড়ল কিনা!
অপেক্ষা থেকে নিস্তার পাবার জন্য কিছু গাড়ি পাশের গলিগুলোয় ঢুকে পড়ছে। তাড়া আছে এমন মানুষেরা গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করেছে। পরনে হালকা নীলের উপর সাদা নকশা সুতির শাড়ি, গায়ে ফিকে গোলাপি কার্ডিগান এবং কাঁধে মোটা কাপড়ের একটি রঙিন ঝুলি নিয়ে এক রমণী ট্যাক্সির ভাড়া চুকিয়ে নামল। ফুটপাথ ধরে সে দ্রুতপায়ে বিবাদী বাগের দিকে এগোবার চেষ্টা করল ভিড়ের মধ্য দিয়ে।
যদিও জানুয়ারির শেষ, কিন্তু কলকাতায় এবার শীত তেমনভাবে আসেনি। এখন দুপুর আড়াইটে, রোদ ঝলমল করছে, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ। বিকেলে ফুরফুরে হাওয়া বইলে ভালোই লাগে। বোধহয় বসন্ত এবার দু—দিন সপ্তাহ এগিয়ে আসবে। অবশ্য লালদিঘিতে যে ক—টা গাছ রয়েছে তাদের ভাবগতিক দেখে কিছুই বোঝার উপায় নেই। ক্যালেন্ডারি মতে বসন্ত না এলে তারা যেন শীতবস্ত্র পা থেকে নামাবেই না। কিন্তু এই দুপুরে কর্মব্যস্ত অফিস পাড়ায় শীত—বসন্ত নিয়ে কেউই মাথা ঘামাচ্ছে না। ট্র্যাফিক অচল হওয়ায় সবাই বিরক্ত। এরই মধ্যে হালকা নীল ছাপা শাড়ির রমণী যেন একটুকরো বসন্ত। তার দিকে যারই চোখ পড়ছে, দ্বিতীয়বার তাকাতে হচ্ছে।
রমণীর দ্রুত গমন—চেষ্টা পদে পদেই ব্যাহত হচ্ছে। কলকাতার যেকোনো ফুটপাথের মতো এটিও টেলিফোন, ইলেকট্রিক, কর্পোরেশন, সিএমডিএ প্রভৃতি জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের দ্বারা ধর্ষিত। গর্ত, ঢিপি, ইট, কাদা প্রভৃতির জন্য পদক্ষেপে সতর্ক থাকায় বাধ্য হয়েই চলার বেগ মন্থর করতে হয়েছে। ফলে তার গমন ভঙ্গিতে কবুতরীর আদল এসেছে। তার উপর রমণীর দেহ পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি উচ্চচ, যেটা বাঙালি মেয়েদের গড়পড়তা উচ্চচতার থেকে বেশি। ঈশ্বরের এবং সেই সঙ্গে নিজের চেষ্টায় দেহ—কাঠামোটি যেভাবে ভরাট হয়ে রয়েছে, তাতে মনে হয় দুর্বলচিত্তের পুরুষদের সঙ্গে নির্মম রসিকতা করার জন্যই যেন এই দেহটি নির্মিত। বস্তুত এই ট্র্যাফিকের জট—সমস্যা সমাধানে যে সময় লাগবে, তার থেকেও দশ বা পনেরো সেকেন্ড সময় বেশিই লাগবে এবং সেজন্য কর্তব্যে ব্যস্ত সার্জেন্টটিকে দোষারোপ না করে এই রমণীর রচনাকারকেই দায়ী করা উচিত। সার্জেন্টের অনুসরণে মিনিবাসের ড্রাইভার অ্যাক্সিলেটরে পায়ের চাপে আন্দাজের গোলমাল ঘটিয়ে সামনের স্টেটবাসের পিছনে যে ঢুঁ মারল, বলাবাহুল্য সেজন্য একজনই দায়ী।
রমণীর কিন্তু ভ্রূক্ষেপ নেই। যেন সে জানেই, তার উপস্থিতি পুরুষ—চিত্তের কাজকর্মে কী ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে। মুখে হালকা প্রসাধন, কিন্তু সদ্য অসুস্থতা কাটিয়ে ওঠা রোগীর মতোই যেন তার দুগ্ধহীন কফি রঙের মুখের ত্বক দুর্ভাবনায় শুকনো। ভালো করে লক্ষ করলে দুটি চোখের ঘন কালো মণিতে ত্রাসের ছায়া দেখা যাবে। দূর থেকে যা বিনিদ্র রাতের ক্লান্তি বলে মনে হচ্ছে।
রবীন্দ্র সরণির মোড় পার হয়ে লালবাজারের পুলিশী সদর দফতর অতিক্রম করে সে রাধাবাজার যাওয়ার গলিতে ঢুকল এবং চলার গতি দ্রুত করল। কাঁধ পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত কালো রেশমের মতো কেশ ঈষৎ আন্দোলিত হচ্ছে অথচ মহাদেবের ডমরু সদৃশ দেহটির গড়নে দ্রুত গমনজনিত কোনো বেতালা অসংগতি ফুটে উঠছে না। নিতম্বের উচ্ছ্বাস নিয়মিত ছন্দেই উত্থিত হয়ে স্তিমিত হয়ে চলেছে। নাভির নীচে শাড়ির ভাঁজগুলি প্রশস্ত সানুদেশের উপর বিছানো। তার দেহের দৈর্ঘ্যের সঙ্গে বিস্তারের কোনো বিবাদ নেই এবং অচঞ্চল ভঙ্গিতে গ্রীবা ও চিবুক তুলে সে হেঁটে চলেছে। পদক্ষেপের দৃঢ়তাই জানান দিচ্ছে তার পায়ের পেশি বলিষ্ঠ।
এই গলিতে নানাবিধ ঘড়ির দোকান দু—ধারে। মনোহারি দেওয়াল ঘড়িতে দোকানগুলি যেভাবে শোভিত, তা বহু লোকই গতি মন্থর করে দেখতে দেখতে যাচ্ছে। রমণী দোকানে ঢুকল। বিক্রয়কারিণী সিড়িঙ্গে চেহারার ঘোর কৃষ্ণবর্ণ এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বালিকা। রাগী সিংহের মতো তার চুলগুলি ফাঁপানো। রমণী পরিচ্ছন্ন ইংরেজিতে তাকে বলল, ‘ছ—দিন আগে পুরুষদের একটি রিস্টওয়াচ সারাতে দিয়েছিলাম, আজ সেটি দেবার তারিখ।’ এই বলে সে ঝুলি থেকে একটি ছোটো চামড়ার পার্স বার করে তার থেকে বিল বার করল।
নম্বর দেখে শো—কেস থেকে একটি চৌকো স্বর্ণাভ দামি ঘড়ি তুলে নিয়ে বিক্রয়কারিণী সুন্দর করে হাসল। তার দাঁতগুলি শ্বেত প্লাস্টিকের মতো এবং সাজানো। সম্ভবত তার চাকুরি দাঁতের জন্যই। দাম চুকিয়ে রমণী দোকান থেকে বেরিয়ে দু—ধারে সন্তর্পণে তাকাল। তারপর আবার দ্রুতগতিতে ব্রেবোর্ন রোডে পৌঁছে উত্তর দিকে হাঁটতে শুরু করল।
বড়ো বড়ো কয়েকটি অফিস—বাড়ি এবং দুটি রাস্তা অতিক্রম করে সে সাততলা একটি বাড়িতে ঢুকল। দশ—বারোটি অফিস এই বাড়িতে, কিন্তু লিফট মাত্র একটি। লিফটের দরজায় লাইন দিয়ে জনা দশেক অপেক্ষমাণ। রমণী তাদের দিকে একনজর তাকিয়ে পাশের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করল।
লোকগুলি নেহাতই ষড়রিপুর দাস। তাই চোরাদৃষ্টিতে রমণীর সিঁড়িভাঙা দেখতে গিয়ে শ্বাস রোধ করে রইল এবং তাদের দ্রষ্টব্য বস্তুটি চোদ্দো ধাপ অতিক্রম করে সিঁড়ির বাঁকে অন্তর্হিত হওয়ার পর নিশ্বাস ফেলে হাঁপ ছাড়ল।
‘এতবড়ো বাড়িতে দুটো লিফট থাকা উচিত।’ এক মধ্যবয়সি মন্তব্য করল। ‘জরুরি কাজ রয়েছে অথচ—’
‘লিফটম্যানটা বরাবরই এইরকম, উঠলে আর নামতে চায় না, রিপোর্ট করা উচিত।’ যুবকটি এই বলে বন্ধ কোলাপসিবল দরজার কাছে এসে মাথা বাঁকিয়ে উপর দিকে তাকাল। ‘নাহ, পাত্তাই নেই…হেঁটেই উঠি।’ এই বলে যে লাইন ছেড়ে সিঁড়ি দিয়ে লাফাতে লাফাতে উঠে আড়াই তলা বরাবর পৌঁছে রমণীকে দেখতে পেয়েই লাফানোর বেগ কমাল। ধুতি—শার্ট পরা এক শীর্ণকায় লোক উপর থেকে নেমে আসছে, তাকে দেখে রমণী থেমে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল ‘সাহেব আছেন?’
‘আছেন,’ লোকটি মাথা কাত করল ঈষৎ সম্ভ্রমভরে।
রমণী তিনতলায় পৌঁছে বাঁদিকের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল। দরজার পাশে একটা কাঠের চৌকো টুকরোয় সাদা বড়ো অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা: ইস্টার্ন ম্যাগাজিনস প্রাইভেট লিমিটেড। তার নীচে আর একটি কাঠে ইংরেজিতে লেখা: বরুণা প্রিন্টার্স। তার পাশের কাঠে উপর থেকে নীচে ইংরেজিতেই তিনটি ম্যাগাজিনের নাম: চিত্ররেখা। মহারানি। শৈশব। নামগুলি তিনরকম রঙে, হলুদ, গোলাপি ও গাঢ় কমলায় লেখা।
এই অফিস ইস্টার্ন ম্যাগাজিনসের বৃহৎ দেহকাণ্ডের শুধু মুখটুক। এখানে সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক তিনটি ম্যাগাজিনের সম্পাদকীয় দফতর ছাড়াও আছে সার্কুলেশন, অ্যাকাউন্টস ও বিজ্ঞাপন বিভাগ। এ ছাড়া বাঁধাই ও ছাপার এবং কম্পোজিং ও প্রসেসিংয়ের কাজকর্ম হয় বেলেঘাটায়। ফোটো বিভাগটিও সেখানে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে প্রায় এক বিঘে নিজস্ব জমিতে প্রেসবাড়ি, গুদাম ও গ্যারাজ। সম্প্রতি আর্ট বিভাগটিও সেখানে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ব্রেবোর্ন রোডের অফিস থেকে। বাচ্চচাদের জন্য শৈশব নামে একটি পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ হচ্ছে। দফতর করতে জায়গা চাই, তাই এই স্থানান্তর। প্রয়োজন হলে আর্ট ডিরেক্টর শম্ভু দত্তকে বেলেঘাটা থেকে ডেকে পাঠানো হয়।
বিরাট একটা ঘর, যার আয়তন দেড়খানা ভলিবল কোর্টের সমান। তিনতলার অর্ধেক নিয়ে ইস্টার্ন ম্যাগাজিনস। ঘরের দেওয়াল সংলগ্ন কাঠের পার্টিশান দেওয়া কামরাগুলিতে তিনটি ম্যাগাজিনের দফতর। মাঝখানটিও গলা—সমান উঁচু কাঠের দেওয়ালে ঘেরা। সেখানে মোটামোটা লেজার বই, স্টিলের চারটি আলমারি, লোহার র্যাক, আর নানান আকারের খাতা, ফাইল, চিঠিপত্র, ভাউচার ইত্যাদি নিয়ে ব্যবসায়িক কাজ চলে ছোটোবড়ো সাতটি টেবিলে।
ইস্টার্নের মালিক, কর্ণধার এবং ব্যবসাটিকে বিরাট করে তোলার জন্য সব কৃতিত্বের অধিকারী গঙ্গাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কামরা ব্রেবোর্ন রোডের দিকে উত্তর—পশ্চিম কোণে। নীল কাপের্ট, এয়ারকুলার, দেয়ালে ফেল্টের বোর্ড, তাতে ম্যাগাজিনের মলাট পিন দিয়ে আঁটা ও মোটা কাচে ঢাকা টেবিল, যাতে ছয়জন বসে খেতে পারে। কাঠের গ্লাসে কলম, তাতে নানা রঙের ও ধরনের পেনসিল। লাল ও জলপাই রঙের দুটি টেলিফোন, টেবল ক্যালেন্ডার ও ডায়েরি এবং স্লিপের প্যাড, এই ক—টিই টেবিলের স্থায়ী জিনিস, অবশ্য সকাল ন—টায় গঙ্গাপ্রসাদ চামড়ামোড়া ঘূর্ণি চেয়ারে বসার পর থেকেই টেবল ভরে উঠতে শুরু করে নানান ধরনের দরকারি কাগজে। তিনটি চেয়ার ছাড়াও দেওয়াল ঘেঁসে আছে অতিথিদের বসার জন্য দামি কাপড়ে মোড়া পুরু ফোমের গদি আঁটা জলচৌকির মতো আসন ও ঠেস দেওয়ার বালিশ।
গঙ্গাপ্রসাদ সাদাসিধে ধরনের। যতটুকু না হলেই নয়, শুধু ততটুকুরই পক্ষপাতী। প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চচ বলেই নিজের কামরাটিকে মূল্যবান, সুদৃশ্য জিনিস দিয়ে সাজাতে হবে এমন চিন্তা তিনি করেন না। যতটুকু সজ্জা বা আসবাব, সেটা তাঁর স্ত্রী বরুণার নির্দেশে হয়েছে। স্ত্রীকে তাঁর ভয় পাওয়ার ও ভালোবাসার কথা অফিসের বেয়ারাও জানে। বরুণার জন্যই তাঁকে টাই পরে বাড়ি থেকে বেরোতে হয় এবং অফিসে পৌঁছে গাড়ি থেকে নামার আগে সেটি খুলে তিনি পকেটে রেখে দেন। একবার টুপি পরার প্রস্তাব বরুণা দিয়েছিল এবং গঙ্গাপ্রসাদ ঢোঁক গিলে বলেছিলেন, ‘গরমের দেশে ওসব মাথায় দিলে চুল উঠে টাক পড়ে।’ বরুণা সঙ্গে সঙ্গেই প্রস্তাব প্রত্যাহার করে।
আটানব্বুই কিলোগ্রামের সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চচতার শরীরের ভার চেয়ারের পিঠে এলিয়ে দিয়ে গঙ্গাপ্রসাদ এখন প্রকাশিতব্য বাচ্চচাদের ম্যাগাজিন ‘শৈশব’—এর প্রথম সংখ্যার জন্য নির্ধারিত মলাটের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে। টেবলে ছড়ানো আরও দুটি ওই একই মলাট, তবে রঙের ভিন্ন সমন্বয়ে। কোন রঙেরটি দিয়ে শৈশব শুরু হবে, তার চূড়ান্ত নির্বাচনে তিনি ব্যস্ত বা চিন্তায় মগ্ন।
আর্ট ডিরেক্টর শম্ভু দত্ত দশ মিনিট ঠায় বসে। মাঝে দু—বার কথা বলার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু গঙ্গাপ্রসাদের ভ্রূকুটি দেখেই গভীরভাবে মলাট অধ্যয়নে নিজেকে নিযুক্ত করে টেবলের অপর দিকের চিন্তাস্রোত কোন খাতে বইছে, সেটা আড়চোখে বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
গঙ্গাপ্রসাদের ভ্রূ যতটা উঠেছে, ঠিক ততটাই ঝুলে রয়েছে দুই স্তরে চর্বির চিবুক। গোলাকার বিরাট মুখটিতে ঘামের বিন্দু ফুটেছে। আনমনে গঙ্গাপ্রসাদ বন্ধ এয়ারকুলারের দিকে তাকাতেই শশব্যস্ত শম্ভু দত্ত বলল, ‘চালিয়ে দেব?’
‘না। কিন্তু তুমি যে কেন এই কালো রঙের ত্যারচা দুটো স্ট্রিপ কোণে রাখতে চাইছ বুঝছি না।’ গঙ্গাপ্রসাদ হাতের মলাটটি টেবলে ছুড়ে ফেলে বললেন। ড্রয়ার টানলেন রুমাল বার করার জন্য। সাত—আটটি রুমাল সেখানে।
‘তাহলে কি তুলে দেব?’ শম্ভু দত্ত ক্ষীণস্বরে জানতে চাইল। গঙ্গাপ্রসাদ ছয় বছর আগে প্রথম যখন চিত্ররেখা প্রকাশ করে ম্যাগাজিন ব্যবসায়ে নামেন, শম্ভু দত্ত তখন থেকেই রয়েছে। সে জানে, তর্ক করে লাভ নেই।
‘কালো রঙটার বদলে মেরুন দাও। আর এই বাচ্চচাটার জাঙিয়াটা…।’ গঙ্গাপ্রসাদ আবার ভ্রূ কোঁচকালেন, ‘খুলে দিলে কেমন হয়, পেছন ফিরেই তো রয়েছে।’
শম্ভু দত্ত চোখ সরু করে মলাটে দৃষ্টি রাখল। জাঙিয়াপরা আদুড় গা, একটি শিশু সিঁড়ি দিয়ে ওঠার জন্য প্রথম ধাপে পা রেখেছে। কয়েক ধাপ উপরে দুটি কিশোর—কিশোরী সিঁড়ি দিয়ে উঠে যেতে যেতে পিছনে হাসিমুখে শিশুটির দিকে তাকিয়ে। পরিকল্পনাটা গঙ্গাপ্রসাদেরই, অর্থাৎ বরুণার। শৈশব ধরতে চায় কৈশোরকে।
‘বুবুনের ছোটোবেলার এইরকম একটা ছবি আছে।’ ‘গঙ্গাপ্রসাদের স্বর কোমল ও গাঢ় শোনাল। ‘ওর মায়ের তোলা। কলকাতায় চৌব্বাচার পাড়ে রাখা বালতি ধরার জন্য যেই দু হাত তুলেছে আর তখনই পিছন থেকে স্ন্যাপ নিয়েছিল। আমরা তখন দর্জিপাড়ার বাড়িতে থাকি। আজও যখন ছবিটা দেখি, ইচ্ছে করে কোলে নিয়ে খুব একচোট ধামসাই। যা নাদুসনুদুস ছিল। অথচ সেই বুবুন এখন জার্মানিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। দেখ শম্ভু, ম্যাগাজিন তো আর বাচ্চচারা পকেট থেকে পয়সা বার করে কিনবে না, কিনবে তাদের বাবা—মা। ফিগারটা ভালোই হয়েছে, তুমি বরং জাঙিয়াটা খুলে দাও, বাৎসল্য রসকে ইনভাইট কর। দেখলেই কোলে তুলে নিতে ইচ্ছে করবে এমনভাবে বাচ্চচাটাকে প্লেস কর, পাছা দুটো নরম নরম করে দাও।’
মলাটটা আবার তুলে নিয়ে গঙ্গাপ্রসাদ মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন। সেই সময় দরজা খুলে সন্তর্পণে মুখ বাড়াল সেই রমণী, যাকে কিছুক্ষণ আগে হেঁটে আসতে দেখা গেছে।
‘আসব?’
গঙ্গাপ্রসাদ মুখ তুলে দেখেই চেয়ারে সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করতে করতে বললেন, ‘আরে রোহিণী, তোমার কথাই ভাবছিলুম। এসো এসো একটু পরামর্শ দাও তো।’
রোহিণী কাঁধ থেকে ঝুলিটি নামিয়ে শম্ভু দত্তর পাশের চেয়ারটিতে বসামাত্র গঙ্গাপ্রসাদ মলাটটি তার সামনে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই বাচ্চচাটাকে তোমার কেমন লাগছে? টেন্ডার, সুইট, সফট নয় কি?’
রোহিণী একঝলক তাকিয়ে স্মিত হেসে মাথা নাড়ল।
‘জাঙিয়াটা খুলে দিলে কেমন হয়। এইটুকু বাচ্চচার কি সেক্স থাকে।’
‘না না ওটা থাক।’ রোহিণী ব্যস্ততা দেখাল না বটে তবে কণ্ঠে দৃঢ়তা ফুটে উঠল।
গঙ্গাপ্রসাদ অপ্রতিভ হয়ে শম্ভু দত্তর ভাবলেশহীন মুখের দিকে বার কয়েক আড়ে তাকিয়ে অস্ফুট বললেন, ‘কিন্তু আমার কেমন যেন একটা আদর করার ইচ্ছে …বুবুনের ছবিটা মনে পড়ার জন্যই বোধহয়…।’
শম্ভু দত্ত ইতিমধ্যে রোহিণীর সমর্থন পেয়ে সাহস সঞ্চয় করে ফেলেছে। সে গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, ‘পয়সা দিয়ে যারা পাঁচ টাকার ম্যাগাজিন কিনবে, তারা মোটামুটি সচ্ছল, শিক্ষিতও। নিশ্চয় রুচিও আছে। তারা কি বাড়িতে বাচ্চচাদের ন্যাংটো রাখে বা এইভাবে দেখতে চায়? সাধারণত বস্তিটস্তি বা গ্রামট্রামে গরিবঘরের ছেলেপুলে ন্যাংটো থাকে।’
‘আমি ঠিক সেদিক থেকে ভেবে ‘না’ বলিনি।’ রোহিণী মুখ ঘুরিয়ে শম্ভু দত্তর দিকে তাকিয়ে বলল। ‘বাচ্চচাটা জাঙিয়া পরেছে বলেই দেখতে ভালো লাগছে, আর এটাই তো প্রধান বিবেচ্য বিষয়—ভালো লাগা, তাই তো?’
‘নিশ…চয়।’ গঙ্গাপ্রসাদ টেবলে চাপড় মারলেন। ‘ঠিক আছে শম্ভু তাহলে আর ওটা খোলার দরকার নেই।’
মলাটগুলো গুছিয়ে নিয়ে শম্ভু দত্ত দ্রুত বেরিয়ে গেল।
‘তোমার এবারের মহারানির লেখাটার টাইটেল একটু বদলে দিয়েছি, দেখেছ?’
‘হ্যাঁ ভালোই হয়েছে।’
‘একটু বেশি কাব্য কাব্য হয়ে গেছিল। লেখার বিষয় বা বক্তব্যটা আঁচ করতে অসুবিধে হচ্ছিল। সোজা সহজ আর ক্যাচি হওয়া দরকার, চোখ পড়লেই কৌতূহল জাগবে এমন টাইটেল চাই। চা খাবে?’
‘না।’
‘লিম্বু পানি? পাতিলেবুর রস, গোলমরিচ, সন্ধব নুন আর চিনি দিয়ে?’
‘চিনিটা বাদ।’
টেবিলের নীচে হাত ঢুকিয়ে গঙ্গাপ্রসাদ কলিং বেলের বোতাম টিপলেন। দশ সেকেন্ডের মধ্যেই ঘরে ঢুকল সেই ধুতি—শার্ট পরা শীর্ণকায় লোকটি, সিঁড়িতে রোহিণীর সঙ্গে যার দেখা হয়েছিল।
‘কমল দু—গ্লাস লিম্বু পানি, একটা চিনিছাড়া।’
কমল বেরিয়ে যেতেই গঙ্গাপ্রসাদ জানতে চাইলেন, ‘মীনা চ্যাটার্জির সঙ্গে আজ তোমার ইন্টারভিউ না?’
‘সাতটায়। টিভি সিরিয়ালেও নামছে, তাই নিয়ে নাকি ব্যস্ত।’
‘বড়ো পর্দা থেকে ছোটো পর্দায়! বোধহয় ফিল্মে আর তেমন সুবিধে হচ্ছে না। এরপর কি যাত্রায়?’
রোহিণী ফিকে হাসল। মীনা চ্যাটার্জিকে নিয়ে চিত্ররেখায় ফোটো ফিচারের প্রস্তাব গঙ্গাপ্রসাদেরই দেওয়া। সকালে বিছানা ছেড়ে ওঠা, যোগব্যায়াম থেকে শুরু করে রাতে ঘুমোতে যাবার আগে ড্রেসিং টেবলে বসে মুখ, গলা, হাতের চামড়ায় এটা সেটা মাখা, মোটামুটি শরীরটাকে নানান ভঙ্গিতে দেখাতে হলে যা যা করা দরকার, মীনা চ্যাটার্জির সেই সব করার ছবির এবং একটি সাক্ষাৎকারের জন্য চিত্ররেখা চার পাতা বরাদ্দ করেছে। ওটা পাঁচ বা ছয় পাতাও হয়ে যেতে পারে, যদি ম্যাটার কম পড়ে।
‘টিভি—র জন্য আলাদা একটা বিভাগ চিত্ররেখায় করব ভাবছি। হাজার হাজার পরিবারের মগজে টিভি জায়গা করে ফেলেছে। ভেবেছি, তোমাকেই এটার দায়িত্ব দেব। তুমি টিভি দেখ তো?’
‘আমার টিভি সেট নেই। উপরের চারতলায় আছে, কিন্তু গিয়ে দেখার আর ইচ্ছে হয় না। পরিবারের কথাটি একটু জালাতনে…।’
‘মানে?’
রোহিণী ঠোঁট চাপল। গালের পেশি একটু শক্ত হল এবং প্রসঙ্গ এড়াবার জন্য বলল, ‘আপনি কি টিভি দেখেন?’
‘ধুর! সময় কোথায়। ছুটির দিনে ওয়ান ডে ক্রিকেট ম্যাচ কয়েকটা দেখেছি, দারুণ একসাইটিং। আর একবার রাতে ঢাকার একটা নাটক দেখেছিলাম। বরুণা তো ঢাকারই প্রোগ্রাম দেখে, কলকাতার থেকে নাকি ফার বেটার। তবে নাটকটায় একটা জিনিস আমাকে স্ট্রাইক করল। ক্যারেক্টাররা সবই মিডলক্লাস শিক্ষিত মুসলমান অথচ ‘বাবা—মা’ বলল, এমনকী পানি না বলে জলও বলল। পায়ে হাতে দিয়ে হিন্দুদের মতো প্রণাম করল। উচ্চচারণে বাঙালে টানটোন নেই। মনে হচ্ছিল, কলকাতারই কোনো হিন্দু পরিবার। তোমাকে একটা পোর্টেবল সেট কিনে দেব, দেখো আর চিত্ররেখায় শুরু করে দাও।
ট্রে—তে দুটি গ্লাস নিয়ে কমল ঢুকল। ওরা গ্লাস দুটো হাতে তুলে নিল। প্রথম চুমুক দিয়েই গঙ্গাপ্রসাদ ‘আহ হ’ বলে ওঠার পর এবং কমল বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেই রোহিণী ঝুলি থেকে ভাঁজ করা বাংলা একটা খবরের কাগজ বার করে এগিয়ে ধরল।
‘আজকের কাগজ। তিনের পাতায়, ফোর্থ কলামের একেবারে তলায় ছোট্ট খবরটা পড়ুন।’
গঙ্গাপ্রসাদ কাগজটা খুলে উপর দিকের হেডিংগুলোয় চোখ বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘ভেতরের পাতাগুলো সকালে পড়ার আর সময় হয়ে ওঠে না। রাত্তিরে গিয়ে…।’ থেমে গেলেন। তাঁর বিরাট বপু হঠাৎ সামান্য ঝুঁকে পড়ল। কপালে ভাঁজ উঠল। তিনি তীক্ষ্ন চোখে রোহিণীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কোনো নাম তো দেয়নি।’
‘হ্যাঁ, নাম নেই। কিন্তু…’ ইতস্তত করে রোহিণী চুপ করে গেল।
‘পুলিশ সূত্রে পাওয়া খবরে জানা গেছে, বহরমপুর জেল থেকে যাবজ্জীবন কারাবাসের দণ্ড পাওয়া এক আসামী পালিয়ে গেছে। তাকে ধরার জন্য জোর তল্লাস চলছে। খবরটা নিজস্ব সংবাদদাতার। এইরকম খবরের কোনো মানে হয়? কীসের আসামি, কী তার নাম, কবে জেল ভেঙে পালিয়েছে, সে সব কিছুই নেই। এটা কি একটা রিপোর্ট হল!’ গঙ্গাপ্রসাদ কাগজটা বিরক্তিভাবে ছুড়েই প্রায় টেবিলে রাখলেন।
দু—হাতের তালুতে গাল চেপে ধরে গোঁজ হয়ে তাকিয়ে রইলেন দেওয়ালের ডিসপ্লে বোর্ডের দিকে।
‘পড়েই বুকটা কীরকম ছ্যাঁত করে উঠল।’ রোহিণী প্রায় ফিসফিস করে বলল। ‘ওকে তো বহরমপুরেই রাখা হয়েছে।’
‘কেউ পালালে যে সেটা শোভনেশই হবে, তার কি কোনো কারণ আছে?’
গঙ্গাপ্রসাদ ড্রয়ার খুলে একটা ছোটো চামড়া বাঁধানো ডায়েরি বার করে, পাতা উলটে লাল ফোনে রিসিভারটা তুলে নিলেন। ডায়াল করতে করতে বললেন, ‘রাইটার্সে আইজি প্রিজনস—এর কাছ থেকে খবর পাই কিনা দেখি।’
রোহিণী সিধে হয়ে বসল। হাতের মুঠিতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল ঝুলিটা। একদৃষ্টে সে তাকিয়ে রইল গঙ্গাপ্রসাদের মুখের দিকে।
‘হ্যালো আই জি প্রিজনস—এর অফিস? …হ্যালো, আমি ইস্টার্ন ম্যাগাজিন থেকে বলছি। আইজি আছেন? …নেই? দেখুন আমি একটা খবর জানতে চাই। আজ কাগজে একটা খবর বেরিয়েছে; বহরমপুর জেল থেকে একজন যাবজ্জীবনের আসামি পালিয়েছে, ওর নামটা কি আপনারা বলতে পারেন? ….হ্যাঁ ধরছি।’
রোহিণী ঝুঁকে পড়ল টেবলে। টেলিফোনে ওধার থেকে কী খবর দেয়, সেটা যেন সে নিজেই শুনে নিতে চায়।
ফোনের মাউথপিস হাত দিয়ে চেপে গঙ্গাপ্রসাদ চাপাস্বরে বললেন, ‘দেখছি বলল।’ তারপরই ‘হ্যাঁ হ্যাঁ কী বললেন? এখনও কিছু জানেন না! খবরটা আপনারাও দেখেছেন! হ্যাঁ হ্যাঁ…তাহলে কালই খবর নেব। আচ্ছা, ধন্যবাদ, নমস্কার। ‘ গঙ্গাপ্রসাদ রিসিভার রাখলেন।
‘কী বলল, জানে না?’ রোহিণী শ্বাস বন্ধ করে বলল।
‘হ্যাঁ। কাল খোঁজ নেব।’ অনুত্তেজিত, শান্ত স্বরে কথাগুলো বলে গঙ্গাপ্রসাদ হাসলেন। ‘মনে হচ্ছে আপসেট হয়ে পড়েছ, ভয় পাচ্ছ?’
রোহিণী শুধু তাকিয়ে রইল তার সামনে গোলাকার, স্মিত হাসিতে ভরা, অভয় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা মুখটির দিকে।
‘কত বছর হল!’
‘ছ—বছর।’
‘কোনোরকম যোগাযোগ কি তুমি রেখেছ?’
‘না। একবারও নয়। আমার কোনো দরকার নেই যোগাযোগের, মনে হয় কোনোদিন দরকার হবেও না। আর ওর তরফ থেকেও সম্ভবত এই একই বক্তব্য।’
‘তোমার মনোভাব দেখছি এখনও একই রয়ে গেছে।’
‘বদলাবার মতো কোনো কারণ তো ঘটেনি।’ রোহিণী খবরের কাগজটা তুলে চোখের সামনে ধরল। তার মুখের পেশি কঠিন দেখাচ্ছে।
‘তুমি কীভাবে আছ, কোথায় আছ, শোভনেশ জানে না?’
‘না, জানার কথা নয়।’
‘তাহলে তো তোমার ভয় পাওয়ার কথা নয়। এই তিরিশ—চল্লিশ লাখ লোকের শহরে একজনকে খুঁজে বার করা কি সহজ ব্যাপার? তা ছাড়া ওরও তো ধরা পড়ার ভয় থাকবে, অবশ্যই এই পলাতক আসামি যদি শোভনেশই হয়।’
‘গঙ্গাদা, আপনি আপনার বন্ধুটিকে ভালোই চেনেন, আমার থেকেও ভালো চেনেন। আপনাদের মধ্যে আলাপ কলেজ—জীবন থেকে, তার মানে আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে। আমি চিনি মাত্র বিয়ের আগে চার মাস আর তারপরে ছ—মাস।’
একষট্টি বছর বয়সি লোকটি অস্বস্তি ভরে নড়ে উঠে, গলা পরিষ্কার করে বললেন, ‘শোভনেশ একটু অন্য ধরনের, অদ্ভুত চরিত্রেরই। কতগুলো ব্যাপারে, বিশেষ করে নিজের পেশা ছবি আঁকার ব্যাপারে বড়ো কঠিন আর নির্মম ছিল।’
‘দানব ছিল বলুন।’
গঙ্গাপ্রসাদ আড় চোখে ঘৃণায় দোমড়ানো রোহিণীর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে হালকা স্বরে বলে উঠলেন, ‘অতীতটা অতীতেই থাক, এবার বর্তমানের খবর বল। তারপর তোমাদের কদ্দূর, মানে দ্বিতীয়বার আমার উইটনেস হবার চান্সের কদ্দূর?’
শোভনেশের সঙ্গে রোহিণীর রেজিস্ট্রি বিয়েতে গঙ্গাপ্রসাদ সাক্ষী ছিলেন।
‘এখনও আমার ডিভোর্স হয়নি। এখনও আমি মিসেস সেনগুপ্ত।’
‘যার স্বামী খুনের দায়ে যাবজ্জীবন পেয়েছে, সে তো চাওয়ামাত্রই ডিভোর্স পাবে। কিন্তু তোমরা এগিয়েছ কতটা?’
‘আমি এবার হুঁশিয়ার হতে চাই গঙ্গাদা। দশ বছর আগে যে—চোখে পৃথিবীকে দেখতাম, যেসব ধারণা মানুষ সম্পর্কে করতাম, তার অর্ধেকটাই বদলে গেছে। নিজের সম্পর্কেও এখন আমি অন্যরকম ভাবি। এটা তো ঠিক, এক—একটা মেয়েকে সম্মান মর্যাদা নিয়ে শুধুমাত্র খেয়ে পরে যদি টিকে থাকতে হয়, তাহলে তাকে চালাক হতেই হবে। স্নেহ, মমতা, প্রেম, বন্ধুত্ব, সবকিছুকেই সন্দেহের চোখে দেখতে হবে। ঝোঁকের মাথায় কিছু করে ফেলার বয়স তো আর নেই।’
‘তুমি আমার সম্পর্কেও এখন তাহলে সন্দিহান?’
‘এই একটা জায়গায় আমি সবথেকে নিরাপদ।’ রোহিণী আজ এই প্রথম সহজভাবে হাসল। দেখা গেল বাঁদিকের গজদাঁতটি। দেহ শিথিল করে চেয়ারে হেলান দিল।
‘সত্যিকারের দাদা।’
‘আমি তোমার থেকে কত বছরের বড়ো? ছাব্বিশ, সাতাশ?’
‘সব্বোনাশ, তাহলে তো বাবার বয়সি প্রায়!’ রোহিণী আঁতকে ওঠার ভান করল। ‘তাহলে যে গঙ্গাকাকা—টাকা বলতে হয়।’
‘শোভনেশের সঙ্গে তোমার বয়সের ডিফারেন্স কত?’
‘ঠিক পঁচিশ বছরের।’
‘ও আমার থেকে দু—বছরের ছোটো। আর রাজেনের সঙ্গে তোমার?’
‘আমার থেকে ও চার বছরের ছোটো, রাজেনের এখন তিরিশ।’
‘তোমার তাহলে এখন…।’ টেলিফোন বেজে উঠল। বাক্যটি অসম্পূর্ণ রেখে গঙ্গাপ্রসাদ লাল রিসিভার তুললেন।
‘ব্যানার্জি। …ওহ বরুণা…হ্যাঁ হ্যাঁ আমি ঠিক সাড়ে পাঁচটায় বাড়ি পৌঁছব। গোছগাছ এর মধ্যেই করে ফেলেছ? এখন তো মাত্র…।’ হাতঘড়ি দেখলেন গঙ্গাপ্রসাদ ‘পৌনে চারটে। আচ্ছা বাবা আচ্ছা, এখনি যাচ্ছি। …ঘরে কে রয়েছে? রোহিণী….দিচ্ছি।’
গঙ্গাপ্রসাদ রিসিভারটা বাড়িয়ে ধরলেন। কে ফোন করছে বলার দরকার হল না।
‘হ্যালো।’ হালকা গলায় রোহিণী শুরু করল। সে জানে, ওধার থেকে যিনি কথা বলছেন, তাঁকে একাই কথা বলতে দিতে হবে। তার কাজ শুনে যাওয়া।
‘বউদি আমি…’
‘রোহিণী, আমরা বিকেলে বাসুদেবপুর যাচ্ছি, গাড়িতে, তিন দিন থাকব, রবিবার রাতে ফিরব, তুমিও চলো আমাদের সঙ্গে, তোমার দাদা অবশ্য কালই ফিরবে কিন্তু আমার সঙ্গে রবিবার ফিরবে, একা একা থাকতে ভালো লাগবে না, মোটরে খুব বেশি হলে ঘণ্টা দুই। তুমি তো গ্রামট্রাম দ্যাখোনি কখনো মানে ট্রেন থেকে দেখেছ, তাই তো? কিন্তু থেকেছ কখনো? অসম্ভব ভালো লাগবে বিশেষ করে মাঘ মাসেই এই সময়টায়। ভোরবেলা মাঠে কুয়াশা, ঘাসে শিশির, খালিপায়ে হাঁটতে যা লাগবে! হ্যাঁ, খেজুর রসও পাবে, আমাদের প্রায় দশটা খেজুর গাছ, না না এগারোটা; আর তোমায় মৌরলা মাছ খাওয়াব। আমাদের পুকুরের। ভাজা, চচ্চচড়ি, টক, আমিই রাঁধব; তুমি কি ভাবছ আমি রাঁধতে জানি না?’
‘বউদি…’
‘অ্যাঁ? মৌরলা কি তোমার পছন্দ নয়? চিংড়ি? গলদা যদি ওঠে, তাহলে নারকোল কুরে…তুমি কুচো চিংড়ি দিয়ে মোচার ঘণ্ট খেয়েছ? হ্যালো, হ্যালো,…তাহলে আসছ তো? শাড়িটাড়ি সব পাবে ওখানে, সব রাখা আছে, আমি তো ম্যাক্সি পরেই থাকি। অবশ্য আমার ব্লাউজ তোমার গায়ে হবে না, তাতে কিছু আসে যায় না, তুমি খালি গায়েই থেকো, ওখানে পুরুষমানুষ বলে কেউ নেই, তোমার দাদা তো কালই চলে আসবে। আর থাকলেই বা কি, ও মোটেই পুরুষমানুষ নয়, আমি জানি। ভালো কথা, তুমি কি সাঁতার জান? হ্যালো, হ্যালো, রোহিণী?’
‘বউদি আমার হার্টের ট্রাবলটা সকাল থেকে বেড়েছে, এখুনি ডাক্তারের কাছে যাব। কীরকম যেন বুকের মধ্যে হচ্ছে…ব্লাড প্রেশারটাও মনে হচ্ছে…’ বলতে বলতে রোহিণী তাকাল গঙ্গাপ্রসাদের দিকে। ঘরে ঢুকল অ্যাকাউন্ট্যান্ট ক্ষিতীশবাবু। হাতে কয়েকটা চিঠি। সেগুলো হাত বাড়িয়ে নিয়ে গঙ্গাপ্রসাদ অনুমোদনের ভঙ্গিতে রোহিণীর দিকে মাথা নাড়লেন।
‘হ্যালো রোহিণী, হার্টের অসুখ তো অফিসে এসেছ কেন?’
‘মীনা চ্যাটার্জি আজ বিকেলে ইন্টারভিউয়ের জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ডেট দিয়েছে।’
‘দিলেই যেতে হবে? এখুনি তুমি বাড়ি গিয়ে শুয়ে থাক।’
‘ডাক্তারের কাছে যাব না?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ ডাক্তার দেখিয়েই…নিশ্চয় গুচ্ছের ক্যাপসুল লিখে দেবে, ওগুলো কিনেই বাড়ি গিয়ে খাবে। তুমি কিছু ভেব না, এই বয়সে মেয়েদের হার্টের অসুখ আবার হয় নাকি? বরং তোমায় দেখলেই পুরুষদের…’
‘ওহ, বউদি আবার…।’
‘রোহিণী’ ওধার থেকে হঠাৎ স্বরটা ফিসফিসে হয়ে গেল। ‘তোমার দাদা কি টাই পরে আছে?’
‘অ্যাঁ, কি বললেন?’ গলা চড়িয়ে চিঠিতে মগ্ন গঙ্গাপ্রসাদকে শুনিয়ে রোহিণী বলল, ‘দাদা টাই পরে আছেন কিনা?’
চমকে গঙ্গাপ্রসাদ মুখ তুললেন এবং নিমেষে কোটের পকেট থেকে টাইটা বার করে হাতে ঝুলিয়ে রোহিণীকে দেখালেন।
‘দাদা তো পরেই রয়েছেন।’
‘কী রঙের? ওধারের স্বরে সন্দেহ।
‘মেরুন জমিতে সোনালি আর কালো স্ট্রাইপ।’
‘আচ্ছা, এখন তুমি তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে চলে যাও, দেরি করো না। পরের বার যখন বাসুদেবপুর যাব তোমাকে নিয়ে যাব, ওখানে ভালো রেস্ট পাবে।’
রিসিভার রেখে রোহিণী বড়ো করে শ্বাস ফেলল। ক্ষিতীশবাবু বেরিয়ে যেতেই গঙ্গাপ্রসাদ বললেন, ‘বরুণা খুব সরল, ভালো মনের।’
রোহিণী শুধু হাসল। এতক্ষণ যত কথা সে বলেছে আর শুনেছে, তার মধ্যে অস্বস্তিটা চাপা পড়ে ছিল। ঘরটা হঠাৎ নীরব হয়ে যেতেই সে আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেল।
‘লোকটা যদি শোভনেশ হয়…’
‘তাতে কি হয়েছে? তোমার ভয় পাওয়ার তো কিছু নেই।’
‘প্রথমে আমারই খোঁজ করবে।’
‘কোথায় পাবে তোমায়?’
‘এই অফিসটা ও চেনে।’
‘আমার কাছে আসবে? আসুক। আমি বলব, রোহিণী কোথায় আছে আমি জানি না। ফেরারিকে আশ্রয় দেবার প্রশ্নই ওঠে না। পুলিশকে ডেকে ধরিয়ে দেব না, তবে পুলিশের ভয়টা দেখাব। কিন্তু তার আগে জানতে হবে ফেরারি লোকটা কে?’
‘আপনি কাল সকালে ফিরছেন। আমি অফিসে ফোন করে জেনে নেব।’
‘অত ঘাবড়াচ্ছ কেন বল তো? তুমি এখন একটু অন্য কোনো ঘরে বসো, দু—জন ভিজিটার আসবে।’
‘আমি মহারানির ঘরে থাকব। তারপর ইডেনে যাব। রাজেনের নেট প্র্যাকটিস আছে, পরশু জয়পুর যাবে।’
‘আমি তো বাড়ি যাব। ভালোই হল, তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাব।’
দুই
বি সি রায় ক্লাব হাউসের সামনে রোহিণীকে নামিয়ে গঙ্গাপ্রসাদ বললেন, ‘টিভি—র জন্য নতুন বিভাগটার কথা মাথায় রেখো। একটা সেট তোমার ওখানে পাঠিয়ে দেব।’
গাড়িটা সোজা বাবুঘাটের দিকে চলে গেল। গঙ্গার ধার দিয়ে দক্ষিণে যাবে। গঙ্গাপ্রসাদের বাড়ি ডায়মন্ডহারবার রোডে, মোমিনপুরে।
রাস্তা পার হবার জন্য রোহিণীকে অপেক্ষা করতে হচ্ছিল। বাস বা মোটর এখানে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটে, রাস্তাটাও চওড়া। পার হতে হলে, ফাঁক পেয়েই ছুটতে হবে। ততক্ষণ সে দু—ধারে তাকিয়ে সন্তর্পণে একবার পিছনেও তাকাল। কাস্টমস ও পুলিশ মাঠে ক্রিকেট খেলা এইমাত্র বোধহয় শেষ হয়েছে। মালি স্টাম্পগুলো তুলে তাঁবুতে ফিরে যাচ্ছে। দূরের এবং কাছের মানুষদের ওপর দিয়ে সে চোখ বোলাল। ছয় ফুটের উপর লম্বা, শীর্ণ, ধুতি—পাঞ্জাবিপরা একটি লোকের দিকে কয়েক সেকেন্ড দৃষ্টি ধরে রেখে সে মনে মনে অপ্রতিভ হল। জেল থেকে ধুতিপাঞ্জাবি পরে পালানো শক্ত ব্যাপার। তা ছাড়া লোকটার চুল কুচকুচে কালো, একটু কুঁজোও। নয়তো গলা, কাঁধ, মুখের গড়নে অনেকটা মিল আছে।
শোভনেশের চুল কাঁচাপাকা মেশানো, ঝাঁকড়া, ফাঁপানো। ক্যালেন্ডারের মৃত সতী—কাঁধে দক্ষযজ্ঞের শিবের চুলের মতো। জুলপিটা পুরু, গালের অর্ধেক পর্যন্ত। ছিপছিপে, আঙুল থেকে কনুই পর্যন্ত দড়ির মতো শিরায় পুরোবাহু যেন বেঁধে রাখা। কবজি চওড়া। বুকটা চাপা। কোটরে ঢোকা চোখ জ্বলজ্বলে। ঘনভুরুর চুলও ধূসর। এমন চেহারার একটি লোকও রোহিণীর এখন চোখে পড়ল না।
শেষ পর্যন্ত ছুটেই রাস্তা পার হতে হল। ঝুলিটার মুখ ফাঁক করে ঘড়িটা একবার দেখে নিয়ে সে ক্লাব হাউসের লোহার ফটক দিয়ে ভিতরে ঢুকল। দুটি যুবক বেরিয়ে আসছে। রোহিণীকে দেখে তারা পরিচিতের হাসি হাসল।
‘আছে?’ সে জিজ্ঞাসা করল।
‘মাঠে পাবেন।’ ওদের একজন বলল।
এদের সঙ্গে রাজেনই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। দু—জনেই বাংলা দলে বছর চারেক খেলছে। ভদ্র, বিনয়ী। তার সঙ্গে রাজেনের সম্পর্কটা ওরা জানে। একতলায় সদর দিয়ে ঢুকেই বাঁদিকে উপরে ওঠার সিঁড়ি। ডানদিকে করিডোর ধরে সোজা গিয়ে ফুলবাগানের কিনারে সিমেন্টের সরু পথ দিয়ে ফেন্সিংয়ে পৌঁছল রোহিণী। মাঠে ঢোকা উচিত নয় ভেবে সে দাঁড়িয়ে রইল।
নেট প্র্যাকটিস শেষ হয়ে গেছে। এখন চলেছে ক্যাচিং প্র্যাকটিস। একজন বল তুলে ব্যাট দিয়ে সজোরে মারছে। দূরে ছড়ানো পাঁচ—ছ’জন ফিল্ডার আকাশছোঁয়া বল লুফছে। বাউন্ডারি ধরে ধীরে ছুটছে দু—জন। নেটের পিছনে চেয়ারে, মাটিতে বসে আছে আরও চারজন। তাদের পাছে ছড়ানো কিছু সরঞ্জাম। রোহিণী খাঁ খাঁ কংক্রিট স্ট্যান্ডের উপর দিয়ে চাহনি ঘুরিয়ে মাঠের উপর রাখল। সমানভাবে ছাঁটা মসৃণ তকতকে ঘাস।
‘এই হল ঐতিহাসিক ইডেন গার্ডেনস’, রাজেন প্রথম দিন তাকে মাঠে এনে বলেছিল, পৃথিবীর সবথেকে পুরোনো ক্রিকেট ক্লাব হল ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব, অবশ্য ইংল্যান্ডের কথা ছেড়ে। প্রায় দুশো বছর বয়স এই ক্লাবের। এই মাঠে উনিশশো পঞ্চাশ সাল পর্যন্ত তাদেরই ছিল। ‘আর মাঠটার বয়স?’ রোহিণী কৌতূহলী হয়ে জানতে চায়। সে এইটুকু জানত, গভর্নর জেনারেল অকল্যান্ডের দুই বোন, যাদের পদবি ছিল ইডেন, তারাই বাগান করেছিল। তাদের নামেই ইডেন উদ্যান। ‘কিন্তু এই মাঠটা তখন সেই বাগানের মধ্যে ছিল না।’
স্ট্র্যান্ড ধরে আউট্রাম ঘাটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সেদিন রাজেন প্রায় ক্লাস—লেকচার দেবার ঢঙে বসেছিল, ‘মোহনবাগান মাঠের কাছ থেকে একটা রাস্তা ইডেনের মধ্য দিয়ে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম পর্যন্ত সোজা চলে গেছিল বাগান আর মাঠটাকে আলাদা করে। সেই রাস্তায় লোকজন, গাড়িঘোড়া চলত। রাস্তাটা শেষ পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়ে ক্রিকেট মাঠটাকে বাগানের অন্তর্গত করা হয়। ক্যালকাটা ক্লাব এই মাঠটায় প্রথম কবে খেলে, সঠিক বছরটা জানা যায়নি, তবে আঠারশো পঁয়ষট্টি নাগাদই হবে আর কাঠের প্যাভিলিয়ন তৈরি করে আঠারশো একাত্তরে। তারপর সেই প্যাভিলিয়নও ছেড়ে দিয়ে এখনকার এই বি সি রায় ক্লাব হাউসে উঠে আসে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল। এখন যে হাজার হাজার টন কংক্রিট দেখছ মাঠটাকে ঘিরে রয়েছে, সে সব কিছুই ছিল না যখন আমরা স্বাধীন হই। মাঠ ঘিরে ছিল শুধু দেবদারু গাছ। বলের আর গাছের রঙ একাকার হয়ে উঁচু ক্যাচ নিতে নাকি খুব অসুবিধে হত। বড়ো বড়ো ম্যাচের সময় ফুটবল মাঠ থেকে কাঠের গ্যালারি এনে বসানো হত। জ্যাঠামশাই ইডেনে খেলা দেখছেন ছত্রিশ সাল থেকে। ঊনচল্লিশের ফেব্রুয়ারিতে বাংলা এই মাঠে রঞ্জি ট্রফি ফাইনাল খেলেছিল। সে গল্প জ্যাঠামশাই এখনও করেন। আট আনা আর এক টাকা দু—আনার টিকিট। খেলা শুরু হত এগারোটায়, শেষ হত সওয়া পাঁচটায়। ভাবতে পার, সওয়া পাঁচটা পর্যন্ত ইডেনে খেলা হচ্ছে? তখন এত উঁচু কংক্রিটের স্ট্যান্ড ছিল না। খোলা মাঠ, অনেকক্ষণ পর্যন্ত মাঠে রোদ থাকত, গঙ্গার হাওয়া আসত। বাংলা সেবারই প্রথম ট্রফি জিতেছিল।’
ক্রিকেট খেলা দেখতে রোহিণীর মোটামুটি খারাপ লাগে না। বোম্বাইয়ে থাকতে টেস্ট ম্যাচ দেখেছে পাকিস্তানের সঙ্গে। আর ইংল্যান্ডের সঙ্গে কলকাতাতে। তবে পাঁচদিন দেখার ধৈর্য বা আগ্রহ তার নেই। হাজার হাজার লোকের সঙ্গে বসা, নানান রকমের কথাবার্তা, মন্তব্য, পোশাক—আশাক আর জনতার মেজাজ বদলে যাওয়া, এই সবই তার ভালো লাগে। মাঠের মধ্যের ব্যাপার—স্যাপার তাকে টানে না, যেহেতু খেলার অনেক কিছুই সে বুঝতে পারে না, খবরাখবরও রাখে না। রাজেন যখন বলল, বাংলা ঊনচল্লিশে প্রথম রঞ্জি ট্রফি জিতেছে, তখন সে বলেছিল, ‘দ্বিতীয়বার কবে জেতে?’ রাজেন ঘুরে দাঁড়িয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করে বলেছিল, ‘ঠাট্টা হচ্ছে?’ রোহিণী বুঝতে পারে, বোকার মতো কিছু সে বলেছে। সামলাবার জন্য সে বলে, ‘আমি কি ক্রিকেটের রেকর্ড রাখি যে, বলে দিতে পারব কোন বছর দ্বিতীয়বার জিতেছে?’ রাজেন যেন আশ্বস্ত হল। হালকা সুরে বলেছিল, ‘এখনও পর্যন্ত দ্বিতীয়বারটা আসেনি।’ এইবার রোহিণী দাঁড়িয়ে পড়ে চোখ পিটপিটানিটা নকল করে বলে ‘ঠাট্টা হচ্ছে?’ রাজেন মাথা নেড়ে তারপর জানায়, কথাটা সত্যিই, বাংলা আর কখনো রঞ্জি ট্রফি জিততে পারেনি।
.
শুনে রোহিণী অবাক হয়ে গেছিল। তার মনে হয়েছিল, হাজার হাজার লোকের টেস্ট ম্যাচ দেখার জন্য পাগল হয়ে ওঠা, এই ঐতিহাসিক মাঠ, এতবড়ো সাজানো তকতকে বাড়ি আর প্রায় লক্ষ লোকের খেলা দেখার ব্যবস্থা, সবই যেন কীরকম অর্থহীন, হাস্যকর। অনেকটা তার নিজের জীবনের মতোই।
ফেন্সিংয়ে দু—হাত রেখে রোহিণী মাঠের মধ্যে রাজেনকে দেখতে পাচ্ছে। উঁচু করে মারা বলটা লোফার জন্য দৌড়তে দৌড়তে ঝাঁপ দিল দু—হাত বাড়িয়ে। বল হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই মাঠের কয়েকজন তারিফ জানাতে চেঁচিয়ে উঠল। রাজেন কনুই তুলে দেখছে ছড়ে গেছে কিনা। সাটিনের মতো এমন মোলায়েম ঘাস, রোহিণীর ইচ্ছে করছে জুতো খুলে রেখে মাঠের মধ্যে গিয়ে হেঁটে বেড়াতে।
‘বেশ তো হাঁটুন না।’
চমকে সে পিছনে তাকাল। কেউ নেই। খাকি শার্ট আর ধুতি—পরা একজন মালির সঙ্গে একটি লোক কথা বলছে, তাও পনেরো—ষোলো মিটার দূরে। ক্লাব হাউসের কমপ্লিমেন্টারি আসনগুলির চালার উপরে দুটি পায়রা ছাড়া আর কোনো প্রাণী সে দেখতে পেল না।
রোহিণী অপ্রতিভ হল। কথাটা তার চেতনায় বরাবরের জন্য যেন ছাপ দিয়ে গেছে। কিছুতেই সে যেন ভুলতে পারে না—’বেশ তো হাঁটুন না।’ গভীর গমগমে স্বরে শোভনেশ তাকে অযাচিতই বলেছিল পিছনে দাঁড়িয়ে। চমকে পিছন ফিরে তাকিয়েছিল সে আর সাত বছরের ভাগনি মেধা। দীর্ঘদেহী, টকটকে গায়ের রং, কাঁচাপাকা আলুথালু চুল, লম্বা মোটা জুলপি, সামান্য চাপা নাক আর সরু চোখ দেখলেই মণিপুরী বা নাগা বলে মনে হয়। ঘন নীল সুতির টি শার্টের বুকের কাছে এমব্রয়ডারি করা সাদা দুটি অলিভ পাতা।
অ্যাকাডেমি আর ফাইন আর্টসের পশ্চিমের গ্যালারিতে ছবির সেই প্রদর্শনীতে তখন জনা দশেক দর্শক ছিল। দিদি সোহিনী যোগলেকর আর মেয়ে মেধার সঙ্গে রোহিণীও গেছিল ছবি দেখতে। প্রদর্শনীর স্পনসর ছিল রং তৈরির কোম্পানি, হিমালয়ান পেইন্টস। সোহিনীর স্বামী রঞ্জন যোগলেকর, যার ডাকনাম বাপু, হিমালয়ানের মার্কেটিং ডিভিশনের কন্ট্রোলার। অফিসের কাজে বাপুর সঙ্গে বোম্বাই থেকে এসে ওরা ছিল ওল্ড বালিগঞ্জে কোম্পানির গেস্ট হাউসে। ছবি দেখতে বাপু আসেনি। অফিসে তার কাজ ছিল, তা ছাড়া আঁকা ছবি দেখতে তার ভালোও লাগে না।
প্রদর্শনী—ঘরে ঢুকে ছবিগুলোর উপর একনজর তাকিয়েই দিদির চোখে বিরক্তি আর ভয় দেখতে পেয়েছিল রোহিণী। বাঁদিকের দেওয়ালে ছ—সাতটা তেলরঙের ছবি ছিল, অদ্ভুত ভঙ্গিতে শোয়া, বসা, দাঁড়ানো নগ্ন নারীর। অত্যন্ত বাস্তব চিত্রণ। শুধু পেশি বা ভাঁজগুলিই নয়, দেহের কোনো কোনো জায়গায় কেশও নিখুঁত। মনে হয় একজন নারীকেই নানান ভাবে ও ভঙ্গিতে রেখে পাটে পাটে মেলে দেওয়া হয়েছে—আর ঘাড়, কাঁধ, ঊরু তলপেট, হাঁটু, গোড়ালি, আঙুল, নিতম্বের কমনীয় গড়নকে। সোহিনী বারকয়েক অস্বস্তিভরে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রোহিণীকে বলেছিল, ‘মেধাকে নিয়ে তুই ওইদিকের ছবি দ্যাখ।’
দেখতে দেখতে একটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে রোহিণী বলেছিল, ‘দেখেছিস কী সুন্দর মাঠ, ইচ্ছে করছে ছবিটায় ঢুকে খালি পায়ে হাঁটি।’
আর ঠিক তখনই পিছন থেকে ‘বেশ তো হাঁটুন না।’
শোভনেশ হাসছিল। গালের পেশিতে ও চোয়ালে শক্ত সবল ভাঁজ, ঠোঁটের ঢাকনা খোলা সরল দু—পাটি দাঁত, চোখ দুটি আরও সরু হয়ে গেছে হাসির কুঞ্চনে। রোহিণীর বুকের মধ্যে ছমছম করে উঠেছিল। শোভনেশ আঙুল দিয়ে ছবিটাকে দেখিয়ে বলেছিল, ‘ওই যে দূরে একটা বেড়া আর তার পাশের চালাটা দেখা যাচ্ছে, তার ওধারে একটা গ্রাম আছে, আদিবাসীদের। নাম টুংলাপুট। হাঁটতে হাঁটতে ওখানেও চলে যেতে পারেন।’ রোহিণী ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘাসের সবুজ প্রান্তরের চড়াই, দূরে একটা টিলা, ছোপ ছোপ জঙ্গলের আভাস, আকাশের রং দেখে মনে হয় সূর্য অস্তে নামছে। সারা প্রকৃতি জুড়ে শান্ত নীরবতা। ঠিক এই সময়েই শাঁখ বেজে ওঠার কথা। শোভনেশ হুক থেকে ছবিটা খুলে রোহিণীর দিকে এগিয়ে দিল। ফ্রেমের কোণে আঁটা কাগজে দাম লেখা আড়াই হাজার টাকা। রোহিণীর হাত কেঁপে যায়। আড়াই ফুট বাই আড়াই ফুট জলরঙের ছবিটা হাতে নিয়েও সে ধরে রাখতে পারেনি। কাচ ভাঙার শব্দে যে ক—জন দর্শক ছিল ফিরে তাকাল। তাড়াতাড়ি উবু হয়ে বসে রোহিণী কাচ কুড়োতে যেতেই দুটি কাঁধ ধরে শোভনেশ তাকে দাঁড় করিয়ে বলেছিল, ‘দোষটা আমারই, আপনি কুড়োবেন কেন?’
.
রোহিণী কুড়োবে কী কুড়োবে না ভেবে পেল না। রাজেন ইচ্ছে করেই বলটা তার দিকে গড়িয়ে দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে। ফেন্সের দরজা দিয়ে আনমনে কখন যে সে মাঠে ঢুকে খালি পায়ে দাঁড়িয়েছে, মনে নেই।
প্র্যাকটিস শেষ হয়ে গেছে। জয়পুর রওনা হবার আগে এটাই শেষবার। রাজস্থানের সঙ্গে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা। রাজেনের ধারণা, ম্যাচটা তারা জিতবে। কেন জিতবে তাই নিয়ে পরশু দিনই আধ ঘণ্টা ধরে একটা লেকচার দিয়েছে।
‘পাঁচ মিনিট।’ রাজেন কাছে এসে বলল। ‘এক সেকেন্ডও বেশি নেব না। তুমি ততক্ষণ বরং এই চেয়ারটায় বোস। আমি চান সেরে জামা—প্যান্ট চেঞ্জ করেই আসছি।’
রাজেন ছুটে চলে গেল। সাদা ট্রাউজার্স ও হাফহাতা স্পোর্টস শার্ট—পরা ছিপছিপে শরীর। রোহিণীর থেকে দু—ইঞ্চি লম্বা, বেলেমাটির মতো গায়ের রং, কোঁকড়া চুল আর নাকটি চোখা। বাঁ চোয়ালের নীচে আঁচিল। বাঁ হাতে ব্যাট করে, ডান হাতে লেগব্রেক বল। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে সে হাত নেড়ে, ড্রেসিং রুমে ঢুকল। ফেন্সের ধারে একটা স্টিলের চেয়ার। রোহিণী বসল। সূর্য অস্তে নেমেছে, মাঠে ছায়া। চড়াইয়ের মতোই দুটো কালো পাখি উড়ছে—বসছে আর খুঁটে খুঁটে কী খাচ্ছে। বিরাট স্কোর বোর্ডটার দিকে সে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আগের খেলার কয়েকটা নাম আর স্কোর রয়ে গেছে। দূর থেকে লঞ্চের ভোঁ ভেসে এল। তার মনে হচ্ছে, একটা গামলার মধ্যে যেন বসে রয়েছে। বাইরে কী ঘটছে কিছুই বোঝার উপায় নেই। সে জানে না জেল পালানো লোকটা কে, এখন সে কোথায়!
‘পাঁচ মিনিট হয়েছে কিনা দ্যাখো!’
হেঁটে আসতে আসতে রাজেন চেঁচিয়ে বলল। রোহিণী ঘড়ি দেখার বদলে কাঁধের ঝোলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দোকান থেকে নেওয়া ঘড়িটা বার করল।
‘সারাতে কত নিল?’
‘তা দিয়ে তোমার দরকার কী?’
রাজেনের বাঁ হাতটা টেনে নিয়ে রোহিণী ঘড়িটা পরিয়ে স্টিলের ব্যান্ডটা টিপল।
‘আমি ডান হাতে পরি।’
‘না, বাঁ হাতে পরবে।’ ভ্রূ কুঁচকে রোহিণী বিরক্তি জানাল। ‘আর এই হাবিজাবি লেখা শার্ট পরা কেন? সাধারণ জামা তো পরতে পার। ম্যানুফ্যাকচারের ব্র্যান্ডনেম বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে কীজন্য, তুমি কি ডিসপ্লে বোর্ড? এসব জামা তারাই পরে, যাদের পার্সোনালিটি কম।’
রাজেন প্রতিবাদ জানাবার চেষ্টা করতে গিয়ে দু—হাত তুলে বলল, ‘সারেন্ডার করছি। এবার তাহলে চলা যাক।’
দু—জনে ক্লাব হাউস থেকে বেরিয়ে পশ্চিম দিকে হাঁটতে শুরু করল। বোঝা যায়, ওরা গঙ্গার ধারে বেড়াতে অভ্যস্ত।
‘গাড়ি আছে।’ রাজেন বলল।
‘থাক, বেশি দূর যাব না। ইডেনের ভেতরে গিয়ে বরং একটু বসি। মীনা চ্যাটার্জির সঙ্গে ইন্টারভিউ সাতটায়, পাংচুয়াল হতে চাই।’
‘কে মীনা চ্যাটার্জি?’
‘বাংলা সিনেমা দ্যাখো?’
‘না। ও হোও…নাম শুনেছি। এই তো রাস্তায় পোস্টার দেখলাম, কী একটা ছবির নায়িকা। বেশ ভালোই দেখতে। আমাদের উইকেটকিপার ছোটকা মীনা চ্যাটার্জির অন্ধ ভক্ত। ফিল্ম রিলিজ হলে প্রথম দিনে দেখবেই। কী যে অদ্ভুত মানসিকতা। ওর নাকি পাড়ার মেয়ে, ছোটোবেলায় একসঙ্গে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছে।’
‘তোমাদের ছোটকার পাড়া কোথায়?’
‘জোড়াবাগানে। তবে মীনা চ্যাটার্জিরা বোধহয় অল্প দিনই ছিল, তারপর পাড়া ছেড়ে কোথায় চলে যায়। গত বছর জামশেদপুরে যাবার সময় ট্রেনে কথায় কথায় ছোটকা কাকে যেন বলছিল, আমি আর ওতে কান দিইনি।’
রোহিণী বসার জায়গা খুঁজে এধার—ওধার তাকাচ্ছে। খোয়া, গর্ত, ধুলো এবং পুলিশী ঘোড়ার অসভ্যতার চিহ্ন ইতস্তত ছড়ানো। বিরক্ত হয়ে সে বলল, ‘আদিখ্যেতা করে যে কেন নন্দন কানন বলা হয়!’
‘টেস্ট ম্যাচের সময় যদি আসো, তাহলে দেখতে জায়গাটার কী অবস্থা হয়। চলো, জলের ধারটায় বসি।’
শীত যতটা থাকার কথা, নেই। তাই সন্ধ্যা আসন্ন সত্ত্বেও ভিড় রয়ে গেছে। বাচ্চচাদের ছুটোছুটি, মায়েদের ত্রস্ত ডাকাডাকি, বৃদ্ধবৃদ্ধার শান্ত পদক্ষেপ, ফেরিওয়ালাদের সুরেলা হ্রস্ব ডাক, পাখিদের কিচিরমিচির, সব মিলিয়ে রোহিণীকে খানিকটা জুড়িয়ে আনল।
‘না এখানে নয়, বাঁদিকে তাকিয়ে দ্যাখো।’
রাজেন তাকিয়ে দেখল। প্রায় তিরিশ হাত দূরে, বড়ো গাছের গুঁড়ির আড়ালে বসা একটি কিশোরীকে বাঁহাতে জড়িয়ে মুখের কাছে মুখ এনে এক ছোকরা কিছু বলছে। ঝোপঝাড় আর মোটা মোটা গাছে আর ঘন পাতায় এই দিনটা এখন আবছা হয়ে এসেছে। নজরটা একটু সরাতেই সে আবার অমন একটা ঘনিষ্ঠতার নমুনা পেল মেয়েটির কোলে মাথা রেখে শুয়ে একজন।
‘প্রকাশ্যে এইভাবে, এমন রুচিহীন অসভ্য…।’
রোহিণী বলতে বলতে হাঁটতে শুরু করল।
রাজেন বলল, ‘দুপুরে এলে দেখতে, রাস্তা দিয়ে চলতে চলতেই রেলিং দিয়ে দেখা যায়…কী অল্পবয়সি সব ছেলেমেয়ে, মনে হয় স্কুলে পড়ে, এমন কম্প্রোমাইজিং ভঙ্গিতে গাছতলায় বসে থাকে। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে লোকজন দাঁড়িয়ে দেখে, হাসাহাসি করে, ওরা তাতে ভ্রূক্ষেপও করে না, বরং যেন মজাই পায়। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের বাগানেও ভরদুপুরে এরকম ছেলেমেয়েদের দেখেছি।’
‘ডেফিনিটলি এরা কলকাতার নয়, সাবার্ব থেকে আসে। কলকাতার গেরস্ত, ভদ্র পরিবারের হলে চেনা কেউ দেখে ফেলার ভয়টা থাকত, অন্তত মেয়েদের থাকত।…এখানটায় বসি।’
ফাঁকা জায়গায়, তিনটি ছেলেমেয়ে নিয়ে বসে থাকা মধ্যবয়সি এক দম্পতির কাছাকাছি ওরা বসল।
‘ভয়টা কি শুধু মেয়েদেরই থাকে?’
‘তবে না তো কী, ছেলেদের থাকে?’
‘যেমন? একটা উদাহরণ দাও।’
রোহিণী বলতে যাচ্ছিল, যেমন আমি। এই মুহূর্তে আমার থেকে ভীত পৃথিবীতে আর কেউ নেই। একটা খুনি জেল থেকে বেরিয়ে পড়েছে, সেটাই আমার কাছে ভয়ের ব্যাপার। আমাকে পেলে সে গলা টিপে মেরেও ফেলতে পারে। একটা অনিশ্চিত আতঙ্কে পড়ে গেছি।
‘কী ব্যাপার তুমি অমন চোখ কুঁচকে মুখে বিশ্রী ভাঁজ ফেলে কী ভাবছ? উদাহরণ খুঁজছ?’
‘দ্যাখো রাজেন’, রোহিণীর স্বর হঠাৎ তীব্র হয়ে উঠল। ‘আগেও তুমি কয়েকবার বলেছ আমার মুখে ভাঁজ পড়ে, হাসলে গলা বসে যায়, চোখের কোণের চামড়া কুঁচকোনো, জানি তুমি একথা কেন বল।’
রাজেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রইল। এইরকম আবেগের বিস্ফোরণ, সাধারণত রোহিণীর মধ্যে ঘটে না।
‘কবে আবার বলেছি?’
কথাটা কানে না তুলে রোহিণী একই তীব্রতায় বলল, ‘বয়স হয়েছে, এখন চোখের কোণে ঠোঁটের কোণে যদি ভাঁজ পড়ে, কী করতে পারি বল? তুমি বরং…।’ রোহিণী থেমে গেল।
‘বরং?’
‘বরং, ভুল শোধরাবার যথেষ্ট সময় রয়েছে। রাজেন তুমি আমার থেকে চার বছরের ছোটো।’
‘ওহ এই ব্যাপার।’ রাজেন হাঁফ ছাড়ার ভান করল শব্দ করে শ্বাস ফেলে। ‘আমি ভাবলুম, না জানি কী দোষের কথা বলে ফেলেছি। এই নিয়ে কতবার মনে করালে তুমি চার বছরের বড়ো। গত দু—বছরে, যদি মাসে একবার করেও হয় তাহলে চব্বিশবার। তার মানে চব্বিশবার আমাকে টর্চার করেছ, প্রতিবারে এজন্য যন্ত্রণা পেয়েছি বারো ঘণ্টা করে, মিনিমাম। তাহলে চব্বিশ ইনটু বারো, কত হয়?’
‘এটা রসিকতা করার ব্যাপার নয়।’
‘দুশো অষ্টাশি। কতটা ইনহিউম্যান হলে একজন মহিলা দুশো অষ্টাশি ঘণ্টা ধরে একজন পুরুষকে দগ্ধে দগ্ধে রোস্ট বানাতে পারে, তার হিসেব দিতে পার? এই নিষ্ঠুরতা গিনেস বুক অব…।’
‘রাজেন।’ রোহিণী তার হাঁটুতে রাখা, রাজেনের হাতটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। ‘বিহেভ। ওই গাছতলার মতো সীন আমি অপছন্দ করি।’
রাজেন আবার হাত রাখল। রোহিণী সরিয়ে দিল। রাজেন আবার রাখল, রোহিণী সরিয়ে দিয়ে সামান্য পিছিয়ে বসল। হাঁটু অন্যদিকে ঘুরিয়ে।
‘আহহ, এইটাই চেয়েছিলাম, দারুণ পোজ, তোমাকে সবথেকে সেক্সি দেখায় এইভাবে বসলে।’
‘দেখাক।’ বলেই রোহিণীর মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ ছুঁয়ে গেল। শোভনেশের ভারী গলার হুকুমের স্বর ধাক্কা দিয়ে উঠল, ‘এইভাবে, ঠিক এইভাবে, নড়বে না। তোমাকে ভারী সফট দেখায় এই পোজে।’ রেগে রোহিণী বলেছিল, ‘দেখাক, আমি পারব না। এসব আমার দ্বারা হবে না।’
প্রায় একইভাবে রাজেনও বলল, তবে একদমই অন্য প্রসঙ্গে, অন্য স্বরে। শোভনেশ বলেছিল, সফট দেখায়, রাজেন বলল সেক্সি। দুটোই শুনতে ভালো লাগে। যেকোনো মেয়েরই লাগবে।
‘কিছু হয়েছে বোধহয়, মেজাজ এত খাট্টা কেন?’
‘কিছু হয়নি।’
‘পরশু রওনা হব। ক্রিকেট এখন আর খেলা নয়, যুদ্ধ। যুদ্ধযাত্রার আগে পুরুষদের রণসাজ পরিয়ে, কপালে তিলকটিলক দিয়ে, দেবতার ফুল মাথায় ঠেকিয়ে, আরতিটারতি করে রমণীরা যুদ্ধে পাঠাত। কী দারুণ একটা সময়ই না ভারতে ছিল। পুরুষরাও তাই জেতার জন্য জান লড়িয়ে দিত। জেতার ইচ্ছাটা তৈরি হত মেয়েদের ভালোবাসা প্রেম পাবার জন্য। আর এখন?’ রাজেন অর্থপূর্ণ নীরবতা তৈরি করল নাটকীয়তা আনতে। ‘রণসাজ, তিলক, আরতি নয় শুধু একটু করুণাঘন দৃষ্টিপাত, একটি সাজানো হাসি তাও বরাদ্দ হয় না। এইজন্যই তো বাংলার ক্রিকেটের এই অবস্থা। বাঙালি মেয়েরা—’
‘তোমার বাজে বকা কি বন্ধ করবে?’ রোহিণীর স্বরের ঝাঁঝ যে পড়ে গেছে, রাজেন সেটা বুঝতে পেরে দ্বিগুণ উৎসাহে শুরু করল। ‘ওখানে গিয়ে খেলব কি? প্রথম বলেই তো আমি ফিরে আসব। স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি, কৈলাশ মাট্টুর প্রথম ওভারের প্রথম বল। অফ স্টাম্পের এক হাত বাইরে; ছেড়ে দেবার জন্য ব্যাট তুলেছি; পিচ পড়েই সিম করে ছিটকে ঢুকে এল। ব্যাট নামাবার সময়ই পেলাম না; অফ স্টাম্পের বেলটা উইকেটকিপারের কাছে উড়ে গেল। আমি বোকার মতো মুখ করে ফিরে আসছি।…উফফ কী লজ্জা। কেউ তো আর জানে না, জানার কথাও নয় কেন আমার কনসেনট্রেশন ভেঙেচুরে তালগোল পাকিয়ে গেছল। সবাই সান্ত্বনা দেবে, ‘ব্যাড লাক রাজেন…বলটা অসম্ভব ভালো ছিল…এমন বলে গাওস্করও আউট হত।’ আমার শুধু একটাই অপরাধ, হাঁটুতে হাত রেখেছিলাম।’
রোহিণী হেসে ফেলেই গম্ভীর হয়ে উঠল। ‘আমার খুব অস্বস্তি লাগে যখন ভাবি আমি তোমার থেকে বয়সে বড়ো, আমি বিবাহিতও। ধরে নিচ্ছি আমার কিছু ফিজিক্যাল অ্যাসেট আছে, কিন্তু কতদিন আর সেটা থাকবে? পদ্মপাতার জলের মতোই তো মেয়েদের যৌবন!’
‘রোহিণী, এসব কথা বহুবার তুমি বলেছ। আমিও প্রত্যেকবার যা বলেছি, সেটাই রিপিট করব। সেই পুরুষগুলো অত্যন্ত নির্বোধ, যারা রমণীকে বিচার করে শুধুই তার রূপ আর যৌবন দিয়ে। এই দুটো নিশ্চয়ই পুরুষদের কাছে বাঞ্ছিত। সুন্দরী বউয়ের মালিক হয়ে কে না গর্ববোধ করে? কিন্তু হৃদয়, আবেগ, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, সহমর্মিতা, শেষ পর্যন্ত এগুলোই কিন্তু অ্যাসেট হয়ে ওঠে।’
মুখ নীচু করে ঘাস ছিঁড়তে ছিঁড়তে রোহিণী শুনে যাচ্ছিল। এখন তার মনে হচ্ছে, নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে উঠতে হলে তার একজন পুরুষমানুষ দরকার, যার উপর সে নির্ভর করতে পারবে। আর, যদি শোভনেশই সেই ফেরারি হয়, যদি খুঁজে খুঁজে তার কাছে এসে হাজির হয়, তাহলে আত্মরক্ষার জন্য দুর্গের মতো শক্তিশালী একটা আড়াল তার দরকার। রাজেন শরীর ও মনের দিক থেকে একটুও দুর্বল নয়। লড়াই করতে পিছোবে না। গঙ্গাদা তাকে ফ্ল্যাট দিয়ে, চাকরি দিয়ে যথেষ্ট সাহায্য করেছে, করবেও। তবু মনের গভীরে একটা নিরাপদ আশ্রয়, আশ্বাস, নির্ভরতা তার খুব দরকার। রাজেন কখনো কোনো সময়ই তার কাছ থেকে নোংরা সুযোগ নেবার চেষ্টা করেনি, যদিও ফাজলামিতে মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
রাজেন নতমুখ রোহিণীর দিকে তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়ে আছে। কথা বলার ঝোঁকে মুখটা উদ্ভাসিত, চোখ জ্বলজ্বলে। রোহিণীকে আনমনা দেখে সে বলল, ‘আমাদের দেশে মেয়েদের মুখটাই সব। মুখ সুন্দর হলেই সে সুন্দরী। তার গোটা শরীরটা যদি প্যাঁকাটির মতো কিংবা জালার মতো হয়ও, কোথাও যদি গড়নে ব্যালান্স, সামঞ্জস্য নাও থাকে, তবু সে রূপসি। আমাদের রুচি, সৌন্দর্যবোধ এভাবেই তৈরি হয়ে আছে। আমরা একদমই ফিজিক্যাল নই। দেখছ না, খেলায় আমরা কত পিছিয়ে।’
খাপছাড়াভাবে হঠাৎ রোহিণী বলল, ‘আমার ডিভোর্সটা করে ফেলা দরকার।’
‘উকিলের সঙ্গে কথা বলতে হবে। জয়পুর থেকে ফিরে এসেই যাব।’
‘তোমার বাড়িতে কি বলেছ কিছু আমার সম্পর্কে? বাবা, মা, দাদারা বউদিরা কি জানে?’
‘মা—কে বলেছি, তবে সব কিছু নয়। তোমাকে একবার দেখতে চেয়েছে।’
রাজেনের বলার ঢঙে কিন্তু ভাব দেখে রোহিণী উৎকণ্ঠিত হল। ‘সব কিছু বলোনি মানে? না, কোনোকিছুই চেপে যাওয়া চলবে না। তুমি ফিরে এসো, আমি যাব মায়ের কাছে। দরকার হলে আমার কথা আমিই তাঁকে বলব।’
রাজেনের মধ্যে উৎসাহ দেখা গেল না। অস্বস্তি কাটাতেই যেন সে এধার—ওধার তাকিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘ঝালমুড়িওয়ালাটা তো এখানেই ছিল।’
বাগানের আলো জ্বলে উঠেছে। বহু মানুষ যেমন বেরিয়ে যাচ্ছে, আসছেও তেমনি নতুনরা। সর্বত্র আলো পড়েনি। পুঞ্জ পুঞ্জ অন্ধকার আর ছায়া ছড়িয়ে আছে। অনেক নরনারী সেদিকে যাচ্ছে।
রাজেন হঠাৎ বলে উঠল, ‘এই ঠিক হয়ে বসো, একটা লোক অনেকক্ষণ ধরে তোমায় দেখছে।’
রোহিণী প্রায় লাফিয়েই রাজেনের পাশে এসে আর্ত গলায় বলল, ‘কে? কোথায়?’
রাজেন হেসে উঠে বলল, ‘ওই দ্যাখো, কিন্তু এত ভয় পাওয়ার কী আছে?’
সত্যিই একটা লোক ওদের থেকে কুড়ি—পঁচিশ হাত দূরে তাদের দিকে মুখ করেই বসে।
‘এরা এক ধরনের মানসিক রুগি। সারা ময়দানে এদের দেখতে পাবে। যেখানেই মেয়ে আর পুরুষ একটু ঘনিষ্ঠভাবে বসবে, এরাও সেখানে গিয়ে কিছু ভালোবাসার ব্যাপার ঘটবে এই আশায়, সেটা দেখার জন্য বসে থাকবে।’
রোহিণী অবশ্য পাঞ্জাবি পরা, বেঁটে মোটা লোকটিকে দেখে হাঁফ ছাড়ল।
‘কিন্তু আমরা তো ঘনিষ্ঠ হয়ে বসিনি।’
‘বসতে তো পারি।’
‘বটে।’
‘কিন্তু তোমার মীনা চ্যাটার্জির সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্টের সময় হয়ে এসেছে।’
হাতঘড়িতে সময় দেখেই রোহিণী দাঁড়িয়ে পড়ল।
‘আর একটা কথাও নয়। দশ মিনিটে পৌঁছে দিতে পারবে? গাড়িটা রেখেছ কোথায়?’
‘ক্লাব হাউসের পাশে।’
রোহিণীর সঙ্গে রাজেনকেও হনহনিয়ে যেতে হল গাড়ি পর্যন্ত।
.
রাজভবনের কাছে রেলিং—ঘেরা গোলাকার দ্বীপটি ঘুরে গাড়ি দক্ষিণমুখো হবার পর রোহিণী বলল, ‘আচ্ছা, বহরমপুর থেকে কলকাতায় পৌঁছতে কতক্ষণ সময় লাগে।’
রাজেন গাড়ির গতি বাড়াতে পারছে না ট্র্যাফিকের জন্য। সেজন্য বিব্রত হচ্ছে। সংক্ষেপে বলল, ‘অনেকভাবে আসা যায়, কীসে আসতে চাও? ট্রেন, মোটর, ট্রাক, বাস, নৌকো, সাইকেল, হণ্টন কীভাবে?’
রোহিণী ভেবে পাচ্ছে না একজন পলাতক আসামির পক্ষে এর কোনটা ব্যবহার করে কলকাতায় আসা উচিত।
‘যেভাবেই আসুক, মোট কথা একটা লোক ইচ্ছে করলে বাই রোড, জঘন্য রাস্তা আর ট্র্যাফিক জ্যাম ধরে নিয়েও পাঁচ থেকে সাত ঘণ্টার মধ্যে আসতে পারবে। কারোর আসার কথা আছে নাকি?’
‘না।’
ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ি থামল ব্রেক কষার জন্য। রাজেন তার ওভারটেক করার কৃতিত্বে বাধা পেয়ে দাঁত চেপে ‘হারামজাদা’ বলে জানলা দিয়ে মুখ বাড়াল।
‘রাজেন, দু—চার মিনিট দেরি হলে এমন কিছু ক্ষতি হবে না। পুলিশের নোট বইয়ে নম্বর তোলা বা হাসপাতালে যাওয়াটাও এখন খুব জরুরি নয়। তোমার একটা বড়ো ম্যাচ রয়েছে সামনেই।’
রোহিণী ডান হাতের তালু রাখল রাজেনের ঊরুতে। রাজেন আড়চোখে একবার তাকাল। পার্ক স্ট্রিটে ঢুকেই গাড়ির গতি মন্থর হয়ে গেল, প্রায় রিকশার মতোই।
‘কী ব্যাপার?’
‘চারদিন পরই খেলা, ইনজুরি টিনজুরি যাতে না হয়…’
‘মতলবটা কী?’
‘দু—ধারে কত খাবার দোকান, দেখতে দেখতে যাওয়াতেও কত সুখ বিশেষত প্রচণ্ড খিদের মুখে।’
‘আজ থাক দেরি হয়ে যাবে।’
‘রোহিণী, তোমার সম্পর্কে কত কিছু জানি, আবার অনেক কিছুই জানি না।’ রাজেনের মুখ ও স্বর গম্ভীর।
কাঠ হয়ে গেল রোহিণীর আলগাভাবে বসার ভঙ্গি। কী জানতে চায়? সবই তো সে বলেছে।
‘তুমি রাঁধতে জান কি?’
কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল ধাতস্থ হতে, তারপরই সে রাজেনের হাঁটুর কাছে বিশাল একটা চিমটি কাটল।
‘তুমি একটা মিটমিটে, কী বলব, মিচকে শয়তান। ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলে। গাড়িটা এবার জোরে চালাও। সার্কুলার রোডটা ক্রশ করে আর একটু গিয়েই ডান দিকে।’
রাজেন গাড়ির গতি বাড়িয়ে বলল, ‘আমি কিন্তু এখনও জানি না রাঁধতে জান কি না। এটা জানার উপর, বলতে পার, আমাদের সম্পর্কটা কী হবে সেটা নির্ভর করছে।’
‘জানি।’
‘প্রমাণ চাই।’
‘ডান দিকে, ডান দিকে রাখো, এই তো আঠারো নম্বর।’
অ্যাপার্টমেন্ট বাড়ি। রাস্তার দিকে প্রত্যেক অ্যাপার্টমেন্টেরই একটি করে ছোট্ট ঝুলবারান্দা। একতলায় গাড়ি রাখার পাকা আঙিনা। ফটকে ডর্দি—পরা দারোয়ান। লিফট রয়েছে করিডরের দু—ধারে।
‘তুমি ফিরবে কীভাবে। অপেক্ষা করব?’
‘না, না, থাকতে হবে না। ঘণ্টাখানেক তো বটেই, তার বেশিও লাগতে পারে। আমি মিনিবাসে চলে যাব।’ দু—পা গিয়েই রোহিণী থেমে গেল। ফিরে এসে ঝুঁকে মুখ নামিয়ে বলল, ‘রাঁধতে পারি কি পারি না সেটা একদিন প্রমাণ করে দেব।’
‘কালকেই দাও। তা হলে প্রথম বলেই আউট হব না, এই গ্যার্যান্টি দেব।’
‘দুপুরে মহারানির ঘরে থাকব, টেলিফোন কোরো।’ বলেই দ্রুতপায়ে রোহিণী আঠারো নম্বর বাড়ির ফটকে ঢুকে গেল। গাড়িতে বসে রাজেন তাকিয়ে রইল যতক্ষণ না বোতাম টিপে রোহিণী লিফট চালু করল।
তিন
পালিশ করা সেগুন কাঠের একপাল্লার দরজায় পিতলের পাতের উপর ইংরেজিতে লেখা: মীনা চ্যাটার্জি। কলিং বেলের বোতাম টিপতেই ভিতরে পিয়ানোর টুং টাং বেজে উঠল। দরজায় নজরদারি কাচ লাগানো ছোটো গর্তটার দিকে রোহিণী তাকিয়ে ছিল। দরজা খোলার আগে ওটা দিয়ে তাকাবেই। তাকিয়ে যেন ভালো করে দেখতে পায়। গুন্ডা—টুন্ডা নয়, একটা মেয়ে।
দরজা ফাঁক করে পরিচ্ছন্ন শাড়ি ব্লাউজ পরা এক কিশোরী সম্ভবত কাজের মেয়ে, জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।
‘আমার আসার কথা ছিল, মিস চ্যাটার্জি কি আছেন?’
‘আপনি বসুন, দিদি এখনও ফেরেনি।’
ঢুকেই কাশ্মিরী কাজ—করা মাথাসমান উঁচু কাঠের পার্টিশন। তার লতাপাতার জাফরির ফাঁক দিয়ে ঘরটা ভালো দেখা যায় না। রোহিণী ইতস্তত করল বসার আগে। ঘরের একদিকে আধ হাত পুরু, টকটকে লাল কাপড়ে মোড়া রাবার ফোমের সোফা। চারজন অনায়াসে বসতে পারে। তার উলটোদিকে গদি—পাতা নীচু চৌকি, যার পায়াগুলিতে পিতলের কুলপি লাগানো। ছড়িয়ে আছে কয়েকটি গেরুয়া ওয়াড় পরানো তাকিয়া। এ ছাড়াও আছে দুটি গদির চেয়ার। ঘরের মাঝে কাপের্ট এবং নীচু আখরোট কাঠের গোল টেবল, তাতে কয়েকটি বাংলা ও ইংরেজি রঙিন ম্যাগাজিন। হালকা পাতিলেবু রঙের দেওয়াল। আসমানি রঙের মোটা কাপড়ের পর্দা, যাতে খয়েরি ডোরা। কাঠের কয়েকটি ব্র্যাকেট বিচিত্র জ্যামিতিক কোণ রচনা করেছে দেয়ালে। তাতে রয়েছে কাঠের, পিতলের ও পাথরের মূর্তি ও পুতুল। এর মধ্যে একটি, তিন বছর আগে পাওয়া সেরা চলচ্চিচত্র অভিনেত্রীর অ্যাওয়ার্ড, বাকিগুলি উপহার পাওয়া। সারা ঘরে একটিই ছবি, সদর দরজার মাথায় দেড় ফুট লম্বা রামকৃষ্ণদেবের হাসিমুখ। মুখের নীচে সাদা ডায়ালে সোনালি কাঁটার ডিম্বাকৃতি ইলেকট্রনিক দেওয়াল ঘড়ি। টেবিলে ফুলগুলি প্লাস্টিকের নয়। সোফার দু—পাশে কাপ ডিশ রাখার জন্য কাঠের ছোটো টেবিলে ছাইদানিগুলি পরিষ্কার। বাইরের কোনো শব্দ ঘরে আসছে না। অন্দরে যাবার দুটি দরজা। তাতে পর্দা ঝুলছে। ভিতর থেকেও কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। অসম্ভব নীরবতা ঘরে বিরাজমান।
মেয়েটা পাখা খুলে দেবার জন্য সুইচ বোর্ডের কাছে গিয়ে ফিরে তাকাল। খোলার দরকার আছে কি না জানতে চায়। রোহিণী বলল, ‘আস্তে, এক পয়েন্টে চালিয়ে দাও। আজ বেশ গরমই।’
সে সোফায় বসাই স্থির করল। সারা ঘরটা এবং অন্দরে যাবার একটি দরজা তার নজরের আওতায় থাকবে। মাথাটা ডানদিকে ঘোরালে অন্য দরজাটাও নজরে আসবে।
‘আপনাকে চা কি কফি দেব?’
‘না।’
‘কোল্ড ড্রিঙ্কস?’
‘না। উনি কখন আসবেন, কিছু বলছেন কি?’ ভিতরে কোথাও ফোন বেজে উঠল।
‘বলেছেন ফিরতে যদি দেরি হয়, তা হলে একটু যেন অপেক্ষা করেন।’
তৃতীয়বার বাজার মুখে রিং বন্ধ হয়ে গেল। কেউ রিসিভার তুলেছে। তার মানে কেউ ভিতরে রয়েছে। রোহিণী শুনেছে, মীনা চ্যাটার্জি একাই থাকে, অবিবাহিতা। বছর চারেক আগে এক গুজরাটি ব্যবসায়ী শিয়ালদা কোর্টে মামলা তুলে মীনাকে তার স্ত্রী অভিহিত করে ষাট হাজার টাকা গহনা অপহরণের দায়ে অভিযুক্ত করেছিল। সেই মামলার ফল খবরের কাগজে আর বেরোয়নি।
পর্দা সরিয়ে মেয়েটি ভিতরে চলে গেল। রোহিণী লক্ষ করল, ভিতরে যাবার পর সে দরজাটা আধখোলাই রেখে দিল। মহারানির সম্পাদক প্রশান্ত হালদারের কাছ থেকে মীনা সম্পর্কে কিছু আগাম তথ্য লিখে নিয়েছিল সে। রোহিণী ঝুলি থেকে ডায়েরি বইটা বার করে, ঝালিয়ে নেবার জন্য সেটা খুলল।
অফিসিয়াল বয়স ছাব্বিশ। তার মানে কি ত্রিশ? ছবিতে যা দেখেছে বা ফিল্মে, তাতে কিছু বোঝা যায় না। মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেছে, এমন রোলেও গত বছর ওর ছবি রিলিজ করেছে। মোটামুটি মানিয়েই গেছে। মীনা এখন বয়সের এমন একটা অঞ্চলের মধ্যে, যেখানে বয়স নিরলস ও কঠিন যত্ন পেলে থমকে থাকে।
রোহিণী নিজের কথা ভাবল। বোধ হয় সেও এখন এই অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু কতদিন থাকবে? রাজেন বলেছে শরীরটাই সব নয়। ও আবেগপ্রবণ। শোভনেশ বলেছিল, শরীর ছাড়া মেয়েদের আর আছে কী? সেও মাঝে মাঝে আবেগের বশবর্তী হত, কিন্তু রাজেনের মতো এত কোমলতা সহাকারে নয়। শোভনেশের রূঢ়তার একটা আকর্ষণ ছিল, ওর নির্যাতনের ধরনে আদিম একটা—
রোহিণীর মনে হল, কেউ যেন তাকে লক্ষ করছে। আড়ষ্ট হয়ে উঠল তার পিঠ আর বুকের পেশি। মাথার মধ্যে শীতল হয়ে রক্তস্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে কোমর পর্যন্ত নেমে এল। সে আড়চোখে তার ডান দিকের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল। পাল্লা ইঞ্চি দুয়েক ফাঁক। কাটা পর্দা একবার নড়ে উঠল। কেউ ফাঁক করে দেখছিল বোধ হয়। অথচ যখন সে ঘরে ঢোকে, দরজাটা তখন কিন্তু বন্ধই দেখেছিল।
কে? শোভনেশ?
ভয় পেয়ে মাথাটা খারাপ হল নাকি? রোহিণী নিজেকে ধমকাল। এখানে শোভনেশ আসবে কী করে? এটা তো মীনা চ্যাটার্জির ফ্ল্যাট। ওর সঙ্গে শোভনেশের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে কি? ছ—বছর আগেও, যখন মীনা অ্যামেচার নাটক দলের সামান্য অভিনেত্রী ছিল, তখন কোনো সম্পর্ক যদি থাকত, তা হলে সে জানতে পারত। আসলে এই নিস্তব্ধ ঘরে একাকী বসে থাকার আর মনে মনে শোভনেশের কথা ভাবার জন্য বোধ হয় সামান্য ব্যাপারেই তার ভয় লাগছে। দরজাটা হয়তো হাওয়ায় খুলে গেছে। পর্দাটা হয়তো পাখার হাওয়ায় নড়েছে।
রোহিণী আবার পর্দার দিকে তাকাল, নড়ছে না। এক পয়েন্টে পাখা ঘুরলে অত ভারী কাপড়ের পর্দা নড়বে কেন? ঠিক তেমনি, শোভনেশই বা এখানে হাজির হবে কেন? বহরমপুর থেকে পাঁচ—সাত ঘণ্টায় আসা গেলেও এবং মীনার সঙ্গে আগে থেকে পরিচয় থাকলেও গত ছ—টা বছর তো জেলের বাইরের পৃথিবীর ঘটনার কিছুই ওর জানার কথা নয়। কত কী বদলে গেছে, সে কোথায় চলে গেছে, কী করছে সে সব জানবে কী করে? মীনা তো দু—বছর হল এখানে বাস করছে। শোভনেশ কী তা জানবে? তা হলে সে এখানে এসে উঠবে কী করে? তা হলে সে সল্টলেকে তার ফ্ল্যাটের খবরও তো জানে না।
রোহিণী যুক্তিগুলোকে আঁকড়ে ধরে কিছুটা হাঁফ ছাড়ল। সকালে খবরটা পড়ার পর থেকেই কী যে এই শোভনেশ—আতঙ্ক তাকে পেয়ে বসেছে! মানে হয়? সে নিজেকে সহজ করার জন্য উঠে পড়ল। ব্র্যাকেটে রাখা অ্যাওয়ার্ড আর সুভেনিরগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে তার চোখ ডান দিকের দরজার দিকে সরে গেল। হঠাৎই একটা অন্যায় কৌতূহল তাকে পেয়ে বসল। ঘরে কে রয়েছে?
হাতখানেক সরে গিয়ে হাত বাড়িয়ে পর্দাটা ফাঁক করল। এমনভাবে সে দাঁড়াল, যেন কেউ হঠাৎ এসে পড়লে সে হাতটা চট করে নামিয়ে জিনিসগুলোকে দেখার ভান করতে পারে।
দরজাটা ইঞ্চি তিনেক ফাঁক হয়ে রয়েছে। জমকালো নকশাদার বেডকভারে মোড়া একটা খাটের কিছুটা, ড্রেসিং টেবল আর এয়ারকুলারের কিছুটা আর যেটির আধখানা সে দেওয়ালে দেখতে পেল তাতে তার ভ্রূ কুঁচকে উঠল। এবং কৌতূহল অবশেষে ভব্যতার শেষ সীমা ছাড়িয়ে গেল।
কাচ বাঁধানো ছবিটার আধখানা সে দেখতে পাচ্ছে। পায়ের পাতা, হাঁটু আর হাঁটুতে রাখা একটা মুখ, যেটা ঝাপসা। শোভনেশের আঁকা ন্যুড একনজরেই চেনা যাবে শুধু মুখটা দেখলেই। কুয়াশার মতো ঝাপসা সাদা ছায়ার পিছনে মুখের রহস্যময় ভৌতিক একটা আভাস পাওয়া যাবে। শোভনেশের সই থাকে ছবির নীচের বাঁ কোণে।
ছবিটার বাকি আধখানটায় রয়েছে শরীরের বাকি অংশ। রোহিণী সেটা দেখার লোভ আর সম্বরণ করতে পারল না। দরজার পাল্লাটা সে আঙুলের ডগা দিয়ে ঠেলল।
‘কে?’
বিদ্যুৎ ছোঁয়া লাগার মতো একটা ঝাঁকি খেয়ে সে পিছিয়ে গিয়ে দ্রুত আবার সোফায় এসে বসল। ঘরের লোকটা পুরুষ। বুঝতে পেরেছে কি দরজাটা সে ঠেলেছে? যদি জিজ্ঞাসা করে, তা হলে কী বলবে? লোকের বাড়িতে এসে দরজা ঠেলে শোবার ঘর চুপি চুপি দেখা শুরু রুচিহীনতাই নয়, একটা অপরাধও। না, বলা যাবে না। এই লজ্জাকর কাজ কিছুতেই স্বীকার করা যায় না, সে করবেও না।
সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলে রোহিণী কাঠ হয়ে বসে রইল। ছবিটার কিছুই প্রায় দেখার সময় পায়নি। চোখটা কতক্ষণের জন্য ছিল? পি টি উষা যতটুকু সময়ের জন্য ওলিম্পিক ব্রোঞ্জ হারিয়েছে ততটাই বোধ হয়।
ঘোর কালো পটভূমিতে ক্রমশ মিলিয়ে যাওয়া কালো রংটায় সামান্য ম্যাজেন্টার আভাস। দাবার মতো সাদা—কালো বরফি আঁকা পাথরের মেঝেয় বসা নগ্ন একটা নারী। দুই হাঁটু মুড়ে উঁচু করা, সামনে ঝুঁকে দুই হাতে হাঁটু জড়ানো এবং মুখটি জোড়া হাঁটুর উপর। স্তন দুটি ঊরুতে চেপে বসানো। ছবিটি আঁকা পাশ থেকে। মাথা থেকে মেঝেয়—রাখা নিতম্বের তলদেশ পর্যন্ত অর্ধ—জ্যা টানা ধনুকের মতো তুলির রেখা—রোহিণী এই রেখার সঙ্গে পরিচিত। বরফি কাটা পাথরের মেঝেটার সঙ্গেও তার পরিচয় আছে।
‘আপনি মহারানি থেকে এসেছেন?’
রোহিণী এই নিয়ে আজ কতবার যে চমকে উঠল! কোলে রাখা থলিটা আঁকড়ে সে মুখ তুলে তাকাল। লোকটি সাড়ে ছয় বা সাত ফুট লম্বা। তার মনে হল, কোথায় যেন একে দেখেছে!
‘হ্যাঁ।’
‘আপনার নাম?’
শীর্ণ, পাটকাঠির মতো। গলাটা লম্বা এবং সামনের দিকে বাড়ানো, কাঁধ দুটি অল্প ঝুঁকে থাকায়, এই ধবধবে ফরসা, বছর পঁয়তাল্লিশের লোকটিকে কুঁজো দেখাচ্ছে। পরনে ধুতি আর হাতাওয়ালা পাঞ্জাবি, আজকেই পাট ভাঙা হয়েছে। মুখটা যেন তার চেনা মনে হচ্ছে, কিন্তু কোথায় যে দেখেছে ঠাহর হচ্ছে না।
‘রোহিণী সেনগুপ্ত।’
‘সেনগুপ্ত!’ লোকটির স্বরে কেমন যেন একটা কর্কশ আবরণ সেনগুপ্ত শব্দটিকে ঘিরে ফুটে উঠল।
‘আমি মীনার ম্যানেজার, পিআরও, এমনকী গার্জেনও বলতে পারেন।’ চেয়ারে বসার পর লোকটি নিজের পরিচয় দিল। ‘আমার নাম সুভাষ গায়েন’ তারপর রোহিণীর মুখে বিস্ময় লক্ষ করে বলল, ‘পাশাপাশি বাড়িতে আমরা থাকতাম। ওকে ছোটোবেলা থেকেই চিনি।’
‘কোথায়?’
‘জোড়াবাগানে।’
‘এখনও কী—’
‘না। মীনারা ভাড়া থাকত। ওর বাবা ছিল নিমতলার কাঠের দালাল। যখন ওর বছর দশেক বয়েস, বাবা মারা যায়। খুব কষ্টের মধ্যে পড়ে। ওরা উঠে যায় পাড়া থেকে।’
‘কোথায়?’
‘যেখানেই যাক, আপনার লেখার জন্য তার দরকার হবে না নিশ্চয়।’ শিষ্ট স্বরে বললেও রূঢ়তার চাপা ঝাঁঝ চাপতে পারেনি। রোহিণীর মাথার মধ্যে উত্তাপ জমে উঠল। কথা বলা শেখেনি, অথচ নাকি অভিনেত্রীর পিআরও! ভেবেছে মহারানি ধন্য হয়ে যাবে মীনাকে ফিচার করে? ইডিয়টটাকে বুঝিয়ে দিতে হবে, পাবলিসিটি ছাড়া মীনার মতো থার্ড গ্রেডের অ্যাকট্রেসের লাইনে টিকে থাকা অসম্ভব, যতই অ্যাওয়ার্ড পাক না কেন।
রোহিণীর মুখভাব লক্ষ করছিল সুভাষ গায়েন। মৃদু স্বরে বলল, ‘জীবনের সব কথাই কি প্রকাশ করা যায়?’ লোকে ওর অভিনয় জীবনের, বর্তমান জীবনের সম্পর্কেই ইন্টারেস্টেড, তাই তো? আপনি এর উপরই লিখুন, এটাই আমরা চাই। অতীতে তা অনেকের অনেক কিছুই ঘটেছে, সে সব ভুলেও গেছে বা ভুলে যাবার চেষ্টা করেছে। আপনিই বলুন, আপনি কি অতীতের সব ব্যাপার লোককে বলতে রাজি আছেন?’
রীতিমতো অভব্য! কী করে একজন অপরিচিতা মহিলাকে এভাবে ইঙ্গিত দিতে পারে যে, গোপন করার মতো ব্যাপার তার জীবনে আছে? রোহিণী তার বিরক্তি ও আপত্তি মুখভাবে ও কণ্ঠস্বরে সচেতনভাবে জাহির করল।
‘আপনার সঙ্গে কয়েক মিনিটের পরিচয়, এর মধ্যেই বুঝে ফেললেন আমার অতীত কেমন ছিল? আপনি কী মুখ দেখেই অতীত পড়ে ফেলতে পারেন?’
‘না, তবে কারোর কারোর পারি।’
একটা জবাব ঠোঁটে এসে গেছল রোহিণীর। কিন্তু কীরকম একটা খটকা লাগছে তার। এখানে শোভনেশের আঁকা ছবি ঘরে টাঙানো। কেন, কীভাবে এল? কোথাও থেকে কিনে এনে টাঙিয়েছে কি? পয়সা দিয়ে কেনা ছবি এই ধরনের লোকেরা পাঁচজনকে দেখাবার জন্য বাইরে রাখে, শোবার ঘরে রাখবে না। কেউ উপহার দিয়ে থাকলেও বাইরেই রাখবে। শ্লীল—অশ্লীল নৈতিক প্রশ্নেই কি লোকচক্ষুর আড়ালে রেখেছে? তা হতে পারে না। নীতিবাগীশরা ন্যুড ছবি শোবার ঘরে তো দূরের কথা, ঘুঁটে রাখার জায়গাতেও রাখবে না। তা হলে? কীভাবে এল ছবিটা?
লোকটা এত সাহস পেলে কোথা থেকে? শোভনেশের সঙ্গে কি কখনো পরিচয় ছিল? ও কি জানে শোভনেশ তার স্বামী, যে একটি স্ত্রীলোককে খুন করেছে, যাবজ্জীবন সাজা পেয়েছে। তাই কি এমন কায়দা করে, ঘুরিয়ে সেটা জানিয়ে দিল?
‘আমার অতীত বলতে পারেন?’ প্রায় চ্যালেঞ্জের সুরে রোহিণী বলল।
তার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে সুভাষ গায়েন। রোহিণী লক্ষ করল লোকটির চোখের মণি সামান্য ধূসর। নাকের ডগা নীচের দিকে বাঁকানো। ঠোঁটের কোণ মুচড়ে রাখা। মুখটাই যেন একটা মুখোস।
সুভাষ গায়েন ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। রোহিণীর তার একবার মনে হল, কোথায় যেন একে সে দেখেছে। কোথায়, কোথায়? ওর নিজের উপর রাগ ধরতে শুরু করল। এত কম তার স্মৃতি!
‘আমায় কোথায় যেন দেখেছেন, কিন্তু মনে পড়ছে না, তাই তো? মৃদু স্বরে বলল সুভাষ গায়েন।
রোহিণীর মুখ জ্বালা করে উঠল। অপ্রতিভ বোধ করেও সে বলল, ‘হ্যাঁ।’
সুভাষ গায়েন হাসল। কিন্তু হঠাৎ প্রসঙ্গ বদল করে বলল, ‘মীনার ফিরতে দেরি হবে, কত দেরি হবে বলা শক্ত। আপনি কি অপেক্ষা করবেন, না অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আর একদিন আসবেন?’
‘সেটা এতক্ষণ বলেননি কেন!’ রোহিণী তার বিরক্তি জানিয়ে দিল এবং ক্ষোভও। ‘মিছিমিছি বসে থেকে সময় নষ্ট করলাম।’
তাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে সুভাষ গায়েনও উঠল।
‘সময় নষ্ট হবে কেন, আপনি তো একটা জিনিস আবিষ্কার করেছেন। লাভই হয়েছে বলুন!’
প্রায় বিদ্রূপই শোনাল। রোহিণী টান টান সোজা হয়ে থুতনি তুলে বলল, ‘কথাটা ঠিক বোধগম্য হল না।’
খাপছাড়াভাবে সুভাষ গায়েন বলল, ‘আপনার ফিগারটা চমৎকার। আর্টিস্টরা মডেল হিসেবে এইরকমই চায়।’
কথাটাকে অগ্রাহ্য করে রোহিণী বলল, ‘কী জিনিস আবিষ্কার করেছি, বলুন সেটা?’
সুভাষ গানেয় দু—কদম পিছিয়ে ঘরের পর্দাটা তুলে ধরে দরজার পাল্লাটা ঠেলে খুলে দিল। তারপর তীব্র চোখে তাকিয়ে বলল, ‘ছবিটা শোভনেশ সেনগুপ্তরই আঁকা। আমি জানি, সে আপনার স্বামী, এখন জেলে।’
‘আপনি ওকে চেনেন!’ বিস্ময়ের ধাক্কায় রোহিণী নিজের ব্যক্তিত্বের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল। তার মনের কাজকর্মের তাল কেটে গেছে। বিভ্রান্তিতে সে আচ্ছন্ন, বিমূঢ়।
সুভাষ গায়েন মাথা নাড়ল। দৃষ্টির তীব্রতা স্তিমিত হয়ে এসেছে। মুখ পাশে ফিরিয়ে বলল, ‘চিনি না। তবে চেনা থাকলে ও জেলে যেত না।’
‘কেন?’
সুভাষ গায়েন চুপ করে রইল। রোহিণী অধৈর্য হয়ে প্রায় চেঁচিয়েই বলল, ‘এ কথা বললেন কেন? বলুন? বলুন? আপনাকে বলতেই হবে!’
‘তাহলে আমিই জেলে যেতাম—ওকে খুন করে।’
‘সে কি!’
‘যাকে ও খুন করেছে, সে মীনার দিদি বীণা। তাকে আমি ভালোবাসতাম, বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শোভনেশ যে তাকে নষ্ট করেছে, পচিয়ে দিয়েছে, সেটা আগে আমি জানতে পারিনি। যদি জানতে পারতাম, তা হলে—’
‘বীণা তো মডেলের কাজ করত।’
‘অভাবের সংসার, লুকিয়ে লুকিয়ে সে দু—তিনজন আর্টিস্টের কাছে কাজ করত। শেষকালে শোভনেশের এক্সক্লুসিভ ছিল, আর তখনই ওদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যে ছবিটা দেখলেন, ওটা বীণার। শোভনেশের উপহার, কিন্তু বাড়িতে ছবিটা আনতে লজ্জা পায়। এক বন্ধুর কাছে রেখে দিয়েছিল। বছর দুয়েক আগে সে মীনাকে ওটা ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। ছেলেমেয়েরা বড়ো হচ্ছে তো।’
‘আমি এসব জানতাম না।’
‘কেন আপনি তো কোর্টে ট্রায়ালের সময় সাক্ষী ছিলেন। সেখানে বহু অজানা কথাই তো জানা গেছে।’
এতক্ষণে রোহিণী ধরতে পারল, কোথায় ওকে দেখেছে। কোর্টঘরে পিছনের দিকে একটা বেঞ্চে বসে কখনো আনমনে বিষণ্ণ চোখে, কখনো উদগ্রীব হয়ে সামনে ঝুঁকে ও সাক্ষীদের জেরা শুনত। বহু লোকই খুনের বিচার শুনতে যায়, রোহিণী ধরে নিয়েছিল, লোকটি তাদেরই মতো কেউ।
‘বিয়ের আগে আর পরেও বীণার সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না।’
‘শোভনেশ যদি আপনাকে বিয়ে না করত, তা হলে বোধ হয় বীণা বেঁচে থাকত।’
‘তার মানে? ওর মৃত্যুর কারণ আমি? এসব কী বলছেন?’
সুভাষ গায়েন মুখ ঘুরিয়ে একবার রোহিণীর দিকে তাকিয়েই শোবার ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। দরজাটা যেরকম শব্দ করে বন্ধ হল, তার একটাই অর্থ। আর সে বেরোবে না।
কাজের মেয়েটি ভিতর থেকে বেরিয়ে এল অন্য দরজা দিয়ে। ‘আপনি কি বসবেন?’
‘না।’
চার
ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে লিফটের জন্য বোতাম টিপে রোহিণীর মনে হল, সুভাষ গায়েনকে একটা খবর দেওয়া হল না। বহরমপুর জেল থেকে যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া একজন পালিয়েছে। শোভনেশ ওখানেই ছিল। হয়তো জেল ভাঙা কয়েদি সে—ই।
লিফট এসে গেছে। রোহিণী লিফটে ঢুকে ‘জি’ লেখা বোতামটা টিপে ভাবল, কিছু কিছু খবর যদি কেউ কেউ জানতে না পারে তাতে অনেক সময় শান্তি রক্ষায় সাহায্যই হয়।
মিনিবাসে ভিড় ছিল। শেয়ালদার প্রাচী সিনেমার স্টপে পৌঁছে রোহিণী বসার জায়গা পেল। অবশ্য তার আগে ব্রিফকেস কোলে নিয়ে বসা টাই—পরা এক সুদর্শন পুরুষ তাকে আসন ছেড়ে দিতে চেয়েছিল। সে রাজি হয়নি। ভাঙাচোরা কলকাতার রাস্তায় বাসে দাঁড়িয়ে যাওয়া বসে যাওয়ার থেকে, অনেক আরামের যদি না জানোয়ার—ঠাসা ভিড় থাকে।
বাসে উঠেই সে সব যাত্রীদের মুখগুলো একবার দেখে নেয়। ভয় পাওয়ার মুখটি নেই। যতবার বাস থেকে লোক ওঠানামা করেছে সে দরজার দিকে তাকিয়েছে। একটা নতুন অভ্যাসের মধ্যে সে যে ঢুকে যাচ্ছে, এটা রোহিণী বুঝতে পারছে। কিন্তু সে নিরুপায়।
শোভনেশের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে সুভাষ গায়েন নামে এক অস্বস্তি। লোকটার একটা কথা তাকে কামড়াচ্ছে এবং আজীবন তাড়া করে যাবে—’শোভনেশ যদি আপনাকে বিয়ে না করত, তা হলে বোধ হয় বীণা বেঁচে থাকত।’ কথাটার অর্থ সুভাষ গায়েন আর খুলে বলেনি। কী হতে পারে?
অর্থটা হয়তো এই, শোভনেশ যদি বীণাকে বিয়ে করত, তা হলে বীণা মরত না। কিন্তু ব্যাখ্যাটা রোহিণীর কাছে খুব সোজা, অগভীর এবং যুক্তিকর মনে হল না। তা হলে এইরকমও হতে পারে, পাছে বর্তমান স্ত্রী রোহিণী পূর্ব প্রণয়ের কথা জেনে ফেলে, তাই শোভনেশ শেষ করে দেয় বীণাকে। কিংবা বীণা তার প্রণয়ীর বিশ্বাসঘাতকতায় ক্ষেপে গিয়ে এমন একটা কিছু করবে বলে হুমকি দিয়েছিল বা করতে যাচ্ছিল, যা বন্ধ করার জন্য শেষ উপায় হিসাবে শোভনেশ এই কাজ করতে বাধ্য হয়।
বিচারের সময় শোভনেশ একদমই মুখ খোলেনি। উদ্দেশ্যটা কী, কেন সে খুন করল সে সম্পর্কে একটা কথাও তার মুখ থেকে পুলিশ বা উকিল জেরা করে বার করতে পারেনি। শুধু সে বলেছে, ‘আমি খুনি কি না প্রমাণ করার জন্য এত সময়, পরিশ্রম, অর্থ ব্যয় করার কী দরকার, যা শাস্তি দেবার দিয়ে দিন।’ কিন্তু যতক্ষণ না সাক্ষ্য—প্রমাণ পেয়ে আদালত নিশ্চিত হচ্ছে, ততক্ষণ তো আর সাজা দেওয়া যায় না। ‘হ্যাঁ, আমি বীণাকে খুন করেছি’, শুধু এই কথার উপরই কি প্রকৃত অপরাধী সাব্যস্ত হয়?
মে দিবসের ছুটির দিন, ঘটনার সময় রোহিণী ছিল মোমিনপুরে গঙ্গাপ্রসাদের বাড়িতে। দুপুরে নিমন্ত্রণ ছিল তাদের দু—জনের। শোভনেশ বলেছিল, গোয়াবাগানে তার একটা জরুরি কাজ আছে, সেখান থেকে সে একটার মধ্যে মোমিনপুর পৌঁছে যাবে। রোহিণী একাই ট্যাক্সি নিয়ে দশটা নাগাদ মোমিনপুর রওনা হয়ে যায়, বউবাজারে শোভনেশদের পঁচানব্বুই বছর—বয়সি বিরাট বাড়িটা থেকে। দুপুর একটার মধ্যে শোভনেশ না যাওয়ায় গঙ্গাপ্রসাদ ফোন করেন। ওধার থেকে কেউ রিসিভার তোলেনি। এরপর আরও চারবার ফোন করে হতাশ হয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘পাগলের বংশ তো, দেখো হয়তো গোয়াবাগান থেকে মোমিনপুর পর্যন্ত বোশেখ মাসে হেঁটে আসতে কেমন লাগে বোঝার জন্যই হয়তো—ও অপেক্ষা করে লাভ নেই, আমরা খেতে বসে যাই।’
খাওয়া শব্দটা মাথায় বুদবুদ কাটতেই হঠাৎ রোহিণীর মনে পড়ে গেল, কাল সে রাজেনকে রেঁধে খাওয়াবে বলেছে। দুপুরে ওকে ফোন করতে বলেছে মহারানির অফিসে। কীরকম একটা আবেগের ঢেউ তখন, রাজেনের ছেলেমানুষি কথাবার্তার ধাক্কায় তাকে এমনই দুলিয়ে দিল যে, সে তখন ঠিক করে ফেলে, রাতে ওকে খেতে বলবে। কিন্তু খাওয়াবেই যে, এমন কোনো কথা দেয়নি। দুপুরে ফোন করলে বলে দেওয়া যায়, ম্যাচ জিতে ফিরতে পারলে রেঁধে খাওয়াব কিংবা চলো, সন্ধ্যাবেলায় অ্যামবারে গিয়ে শুধুই তন্দুরি চিকেন গোটা দুই খাই।
রাত্রে নিমন্ত্রণ করে রাজেনকে ফ্ল্যাটে আসতে বলাটা কতটা উচিত হবে, এখনও সে তা বুঝতে পারছে না। শোভনেশের মতো রাজেন অ্যাগ্রেসিভ নয়। ভদ্র, মার্জিত ধরনের বিশেষণগুলো ওকে মানায়। একবার, মাত্র একবার হালকাভাবে জড়িয়ে ধরা, গালে গাল ঘসা, ঘাড়ে, গলায়, থুতনিতে মিষ্টি কামড়, বুকে মুখ চেপে ধরা আর দু—তিন সেকেন্ডের জন্য ঠোঁটের উপর ঠোঁট রাখা ছাড়া রাজেন কোনোরকম বাড়াবাড়ির চেষ্টা করেনি। একটু ফাজিল, হিউমার বোধটা প্রচুর পরিমাণে আছে, যেজন্য রোহিণীর ওর সান্নিধ্য ভালো লাগে। রাজেন ছটফটে, ছেলেমানুষ অথচ দরকারের সময় প্রবীণ হতে পারে। ওকে বাইরে থেকে কুনো স্বভাবের মনে হয়।
রোহিণী মাঝে মাঝে বিস্মিত হয়ে ভেবেছে, এখন ছেলে ক্রিকেট খেলে কী করে? খবরের কাগজে, ম্যাগাজিনে ক্রিকেটারদের যে ধননের কর্কশ কথাবার্তা, বন্য উদ্দাম আচরণের খবর পড়েছে, তাদের সঙ্গে রাজেনের তো কোনো মিলই নেই! অবশ্য তারা টেস্ট খেলে। রাজেন অতদূর পর্যন্ত যায়নি, যেতে পারবেও না। ‘পাগল, আমি টেস্টম্যাচ খেলব? বয়স কত হল জান?’ রাজেন একদিন বলেছিল, ‘তোমার সঙ্গে যখন প্রথম আলাপ হল, তখনই ঠিক করে ফেলি: গাওস্কার কি বিশ্বনাথের রাস্তা ধরে নক্ষত্র হওয়ার থেকে রোহিণী নক্ষত্রের আলোয় বরং পথ চিনে—না না, সেটা যে খুব সহজ আমি মোটেই তা বলছি না, রোহিণীর আলোয় পথ চিনে বরং তার কাছে পৌঁছে যাওয়ার সাধনায় লেগে থাকলে একশো টেস্ট খেলার সুখ আর যন্ত্রণা হয়তো একদিন পেলেও পেতে পারি।’
কথাগুলো মনে পড়ায় রোহিণী হেসে ফেলল। জানালা থেকে চোখ বাসের মধ্যে আনতেই দেখল, রড ধরে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি অল্পবয়সি ছেলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে। ছেলে দুটিকে সল্টলেকে তার পাড়াতেই দেখেছে। কার্ডিগানের বোতাম খোলা রয়েছে। সে সন্তর্পণে কোলে রাখা ঝোলাটার মুখ খুলে ভিতরে কিছু দেখার ছল করে কার্ডিগানে টান দিল। ছেলেদের এই বয়সে যেসব কৌতূহল চিমটি কেটে যন্ত্রণা দেয়, রোহিণী সেই চিমটি থেকে ওদের রক্ষা করতে চায়।
‘কোথায় এলাম রে?’ একজন বলল। অন্যজন ঝুঁকে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে জায়গাটা বোঝার চেষ্টা করতে লাগল। রোহিণী হাসল, তবে মনে মনে। রাজেনের মতোই এ দুটো। বাস থেকে নেমে মিনিট দু—তিন হাঁটতে হবে। রাস্তাটা নির্জন। দু—ধারে ফাঁকা প্লট আর ঝোপ। আলোগুলো টিমটিমে। অনেকগুলো তো জ্বলেই না। বাড়িগুলোর দরজা জানলা বন্ধ। বাইরে কিছু ঘটলে কেউ বেরোবে না।
‘কাঁকুড়গাছির কাছাকাছি এসেছি।’
‘এই যে রাস্তাটা দিয়ে বাসটা যাচ্ছে, এর নাম জানিস?’
‘সিআইটি রোড।’
‘হল না।’
‘ভিআইপি রোড।’
‘দূর, সে তো দমদম এয়ারপোর্ট থেকে উলটোডিঙির মোড় পর্যন্ত।
‘তাহলে কী?’
‘তুই বল।’
‘বললুম তো দুটো নাম, আচ্ছা তাহলে নজরুল ইসলাম সরণি।’
‘তাও নয়। ওটা তো ভিআইপি রোডেরই অফিসিয়াল নাম।’
রোহিণী ওদের কথা শুনছিল, ধীরে ধীরে কৌতূহলী হয়ে উঠল। রোজই এই রাস্তা দিয়ে সে যাতায়াত করে, কলকাতার এটাই বোধ হয় সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ পথ, কেননা দমদমে প্লেন থেকে নেমে প্রধানমন্ত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী, নানান দেশের প্রেসিডেন্ট বা রাজা—রানিকে কলকাতায় যেতে হলে এই পথ দিয়ে যেতেই হবে।
‘তোকে ক্লু দিচ্ছি। রাস্তাটা একজন বাঙালির নামে, বিশ্ববিখ্যাত তাঁর নিজের ক্ষেত্রে।’
‘তুই তো কুইজ ছাড়লি।’
রোহিণী লক্ষ করল, তার মতো বাসের অনেকেই ছেলে দুটির কথোপকথন শুনছে আর মনে মনে উত্তর হাতড়াচ্ছে এবং সেই সঙ্গে টের পেল তার মধ্যে যে টেনশনটা স্নায়ুগুলোকে টেনে রেখেছিল, ওই কৌতূহলই তা ঢিলে করে দিচ্ছে।
‘রবীন্দ্রনাথ?’
‘ওঁর নামে তো রাস্তা রয়েছেই। আমি যাঁর কথা বলছি, তাঁর নামে আর কোনো রাস্তা নেই।’
সারা বাস ভাবতে শুরু করল এবং রোহিণীও। হঠাৎ সে বলে ফেলল, ‘কতদূর পর্যন্ত রাস্তাটা?’
এতগুলি লোকের চোখ টানতে পারায় ছেলেটি ঈষৎ ফেঁপে উঠেছিল, এবার ফুলে উঠল রোহিণীর মনোযোগের কারণ হয়ে উঠতে পেরে।
‘বেলেঘাটায় ফুলবাগানের মোড় থেকে এই সামনে উলটোডিঙির মোড়, এক মাইল কী তার বেশিও হতে পারে, এতবড়ো রাস্তাটা!’
‘বলো কি ভাই। এতখানি রাস্তার নাম কেউ জানে না?’ এক মাঝবয়সি বিস্ময় এবং সন্দেহ প্রকাশ করলেন, ‘এই রাস্তার চারপাশে কত সাহিত্যিক, সাংবাদিক, পলিটিসিয়ান, মিনিস্টার থাকে, তারা কেউ জানে না?’
পিছনের সিট থেকে একজন ফোড়ন কাটল, ‘দাদা, বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি, এটা মানেন তো? এই যে পলিটিসিয়ান মন্ত্রীদের কথা বললেন, ভোটের আগে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয় সেগুলো ভুলতে কতক্ষণ সময় নেয় বলুন তো?’
এবার কথাবার্তা অন্যদিকে মোড় নেবে। তাই রোহিণী ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘যার নামেই রাস্তা হোক, সেটা কেউ জানে না আর আপনি জানলেন কী করে?’
আপনি সম্বোধনে ছেলেটির ব্যক্তিত্ব অবশ্যই বেড়ে গেল, যেটা রোহিণীর অভিপ্রেত ছিল। বাস থেকে নেমে ওদের রক্ষণাধীনে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছনোর চিন্তাটা তার মাথায় এসে গেছে।
‘ফুলবাগানে শেতলা মন্দিরটার সামনে আর উলটোডাঙায় হাড়কো কমপ্লেক্সের গায়ে দুটো পাথর লাগানো আছে ছোট্ট দেওয়ালে, কলকাতার পুরমন্ত্রী বসিয়েছে। তাতে এই রাস্তার নাম বলা আছে—আচার্য সত্যেন বোস সরণি।’
‘অ্যাঁ!’ আত্মবিস্মৃত জাতির একজন কেউ আকাশ থেকে পড়লেন। ‘নামটা বলা উচিত ছিল, একদম মনেই পড়ল না।’
‘পুরমন্ত্রী যখন বসিয়েছে, তখন তো অফিসিয়াল নামই।’
‘অথচ কেউ তা জানে না। ভাই তুমি ঠিক বলছ?’ মাঝবয়সি লোকটি তার সন্দেহ স্পষ্টভাবেই প্রকাশ করলেন।
বাসটা বিধান শিশু উদ্যান স্টপ থেকে ছেড়েছে। ছেলেটি ভ্রূ কুঁচকে আহত স্বরে বলল, ‘সামনের স্টপই উলটোডাঙার মোড়। নামুন, আপনাকে দেখিয়ে দেব।’
ছেলেটি যেন এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। রোহিণীর দিকে আর দৃকপাত না করে সে দরজার দিকে এগোল, সঙ্গে অন্য ছেলেটিও। মাঝবয়সির গন্তব্য বোধহয় এখানেই, নামার জন্য তিনিও প্রস্তুত হলেন। রোহিণী দমে গেল। বাস থেকে নেমে সম্ভবত একাই তাকে হাঁটতে হবে। এই অল্পবয়সিরা সব ব্যাপারেই কেন যে উত্তেজিত হয়ে ওঠে, এটা সে বুঝতে পারে না। কিন্তু বয়সটা বছর পনেরো কম হলে সেও কি এখন বাস থেকে নেমে পড়ত? উত্তরের জন্য সে অবশ্য মাথা ঘামাল না। তার মাথায় এখন অনেক কিছু রয়েছে ভাবার জন্য।
রোহিণীর সঙ্গে একজনই শুধু নামল এবং নেমেই লোকটি বাঁদিকে হাঁটতে শুরু করল। প্রতিদিনই সে সিডি ব্লকে সেকেন্ড অ্যাভিনুয়ের এই চক্করটায় মিনি বাস থেকে নামে। তার গন্তব্য ডানদিকে। ফাঁকা রাস্তার দিকে তাকিয়েই তার মনে হল, ছেলে দুটি থাকলে ভালো হত। অন্ধকারটা ঝাপসা, তারই মধ্যে খামচা খামচা রাস্তার আলো।
কোন এক বাড়ির টিভি থেকে খবর পড়া শুরুর আগের জিঙ্গল বাজছে। খিদে তো পেয়েছেই, তাছাড়া চঞ্চলা নামে বছর বারোর যে মেয়েটাকে কাল গৌরীর মা কাজের জন্য এনে দিয়েছে, সে যে কী করছে এতক্ষণ কে জানে! ওকে দোকান থেকে কয়েকটা জিনিস আনতে দিয়েছে আর দশটা ডিম। কী করে গ্যাস বার্নার জ্বালাতে—নেভাতে হয়, কাল ও আজ তা শিখিয়ে বলে রেখেছে রুটি করে রাখতে। মেয়েটা যথেষ্ট চালাক আর কৌতূহলী। এই বাড়িতে তিনটি ফ্ল্যাটে গৌরীর মা ঠিকে কাজ করে। বাসন মাজা, ঘর মোছা আর কাপড় কাচার জন্য রোহিণী তাকে আশি টাকা দেয়। যেহেতু দুপুরের পর সে থাকে না তাই কাজটা একবেলার। তবে দোকান—বাজার থেকে কিছু আনতে হলে গৌরীর মাকে সে টাকা দিয়ে রাখে, পরের দিন সকালে কাজে আসার সময় কিনে নিয়ে আসে। দুষ্প্রাপ্য কেরোসিনও কালোবাজার থেকে এনে দেয়। রেফ্রিজারেটর থাকটা খুবই দরকার। তাহলে গ্যাস খরচ কমবে, একসঙ্গে তিনদিনের বাজার করে রেখে নিতে পারবে, দু—দিনের রান্নাও। গঙ্গাদার কাছে হাজার পাঁচেক টাকা ধার চাইবে ভেবেও চাইতে পারেনি। বিনা ভাড়ায় ফ্ল্যাটে থাকতে দিয়েছেন, চাকরি দিয়েছেন, এরপরও কিছু চাইতে তার লজ্জা করে।
বাড়ির সামনে নীচু পাঁচিল নীচু লোহার ফটক। সোজা সিমেন্ট বাঁধানো পথ বাড়ির শেষ পর্যন্ত গিয়ে ঘুরে গেছে পিছন দিকে। এই পথটায় রাত্রে গাড়ি রাখা হয়। তিনটি মোটর থাকে। পিছন দিকেই দারোয়ানের এবং জলের পাম্পের ঘর। চৌকো, সাদামাটা এই হালকা গোলাপি ও মাখন রং লাগানো বাড়িতে দুটি সিঁড়ি ষোলোটি ফ্ল্যাটের জন্য। রোহিণীর সিঁড়িটি ‘বি’ ব্লকে। তিনতলায় তিনশো ছয় নম্বর ফ্ল্যাট। পুব ও দক্ষিণ বন্ধই প্রায়। উত্তরের ঘরের জানলা খুললে দেখা যায় মাঠ, যেখানে এখনও বাড়ি ওঠেনি।
গেটের আলো পাঁচ দিন ধরে জ্বলছে না। আজও তাই। মোটর রয়েছে দুটি। একটি এখনও ফেরেনি। একতলার কোলপসিবল দরজার উপরে কম পাওয়ারের আলোটা জ্বলছে। ইলেকট্রিক মিটার বোর্ডগুলোর উলটোদিকে আটটি লেটার বক্স। রোহিণী অভ্যাসমতো বাক্সের কাচ দিয়ে দেখল, কোনো চিঠি নেই। দিদি অনেকদিন চিঠি দেয়নি।
সিঁড়ির দোতলার ল্যান্ডিংয়ের আলো জ্বলছে না। তিনতলারটাও নেভানো মনে হচ্ছে। যদি জ্বলত, তাহলে দোতলায় আলোর ছিটে পড়ত। রোহিণী থমকে দাঁড়াল। হৃদস্পন্দন সামান্য বাড়ল। আলো তো কালও জ্বলছিল। কোথাও কোনো শব্দ নেই। মনে হল একটা খসখসানি যেন সে শুনতে পেল। কাঠের মতো সে দাঁড়িয়ে থাকল। কোনো মানুষ কী? দারোয়ানের থাকার কথা গেটের কাছে। কিন্তু নেই। সিঁড়ির দরজা রাত এগারোটা পর্যন্ত খোলা থাকে। বাইরের যে—কেউই উপরে উঠে যেতে পারে। কাছাকাছি কোনো বাড়িতে কিছুদিন আগে ডাকাতি হয়ে গেছে। কলিংবেল টিপে দরজা খুলিয়ে জনাচারেক ফ্ল্যাটে ঢোকে। ছোরা দেখিয়ে বেঁধে রেখে গহনা, নগদ টাকা, ঘড়ি, টেপ রেকর্ডার এমনকী দামি ছ—টা শাড়ি পর্যন্তও নিয়ে গেছে। আলমারি খুলে শাড়ি ও গহনা বার করার সময় বাধা দিতে গিয়ে গিন্নি ছোরার খোঁচা খেয়েছে ঘাড়ে আর পেটে। নগদে ও জিনিসে সত্তর হাজার টাকা ডাকাতরা নিয়েছে।
রোহিণী প্রথমেই নিশ্চিন্ত হল, ডাকাতরা তার ফ্ল্যাটে আসবে না। ওরা খোঁজখবর করেই আসে। আর নিশ্চয় এটা জানবে যে, একটা খুদে ট্রানজিস্টর, দুটো সুটকেস কয়েকটা শাড়ি, যার মধ্যে সর্বোচ্চচ দামেরটি সাড়ে ছশো টাকার, একটা সিলিং ফ্যান, টেবল ল্যাম্প ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে না। নগদ প্রায় সাতশো টাকা আছে ডিক্সনারির মধ্যে, খুঁজে বের করা খুবই শক্ত। শোভনেশের দেওয়া হিরের আংটি, কানের মুক্তোর টপ, এগুলোর কোনোটাই সে পরে না। আছে সুটকেশে একটা খামের মধ্যে। এর জন্য ফন্দিফিকির করে ডাকাতরা এলে তাদের মজুরি পোষাবে না।
আবার খসখস হল। রোহিণী কয়েক ধাপ নেমে এসে একতলার ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়াল। ডাক্তারবাবুর ফ্ল্যাটের কলিংবেলে আঙুল রাখল। দরকার মনে করলেই টিপবে। উনি বৃদ্ধ, কিন্তু ওর চাকরটা বেশ বলিষ্ঠ। অন্যদিকের ফ্ল্যাটে এক মাড়োয়ারি পরিবার। প্রত্যেকের আনফিট শরীর, তা ছাড়া নিরীহ গোবেচারা ধরনের। ডাকাত শুনলে হয়তো চেঁচামেচি করবে, কিন্তু দরজা এঁটে।
লোডশেডিং হলে চলাফেরায় খুব অসুবিধে হয় শুনে গঙ্গাদা বলেছিলেন, একটা পেনসিল টর্চ ব্যাগে রেখে দিয়ো। টর্চ কিনেওছে। কিন্তু ব্যাটারি ফুরিয়ে যাওয়ায় সেটা টেবলে রেখে দেয়। ভুলে গেছে নতুন ব্যাটারি লাগাতে। একটা কাজ অবশ্য করা যেতে পারে, দারোয়ান বা তার বউকে ডেকে সঙ্গে করে উপরে ওঠা।
কিন্তু আর খসখস হচ্ছে না। চোর—ডাকাত হলে এতক্ষণ অপেক্ষা করত না। নেমে এসে তার পাশ দিয়ে ভালোমানুষের মতো বেরিয়ে যেত। রোহিণী আবার সিঁড়ি দিয়ে এক পা এক পা করে উঠতে শুরু করল। আর তখনই বাইরে মোটর থামার শব্দ হল।
সাহস পেয়ে সে দোতলা পর্যন্ত উঠল। তিনতলার সিঁড়িতে ঘুটঘুটে অন্ধকার। চোখ সইয়ে নিয়ে আবার উঠতে শুরু করল দেওয়ালে হাতে রেখে। ঠিক কোন ধাপটায় ল্যান্ডিং, সেটা বুঝতে পারছে না। একবার হোঁচটও খেল। ডান পা—টা সন্তর্পণে তুলে উপরের ধাপে ফেলতে গিয়ে সে আর সিঁড়ি পেল না ফলে সামনে ঝুঁকে পড়ে। ভারসাম্য রাখতে এক পা এগিয়ে দিতেই জুতোর ঠোক্কর লাগে নরম একটা জিনিসে।
রোহিণী এবং কুকুরটি একই সঙ্গে আর্তনাদ করে উঠল। তবে দু—জনের মুখ থেকে দু—রকম আওয়াজ বেরোয়। রোহিণী থরথর করে কাঁপতে থাকে আর কুকুরটি, বাইরের ফটকে যার আস্তানা, চোরের মতোই নীচে নেমে গেল।
একতলায় সুইচের শব্দ এবং সিঁড়ির সবকটি আলো জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চচাদের কণ্ঠস্বর ও দুমদাম পা ফেলার আওয়াজ ভেসে এল। চারতলার তুষার দত্ত সপরিবারে ফিরলেন।
.
রোহিণীকে ফ্যাকাসে মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রথমে ছেলে দুটি তারপর বড়ো মেয়ে নন্দা—যার বয়স ষোলো, তারপর একদা বডি বিল্ডার ও বেঁটেখাটো তুষার দত্ত—যিনি কলপ দিয়ে যৌবনকে চিরস্থায়ী করে রাখতে চাইছেন, এবং সবশেষে সিঁথিতে সিঁদুর লেপা ও চশমা পরা, আরতি নামে একটি চর্বির বস্তা, অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওদের কারোর সঙ্গেই রোহিণীর ভালো পরিচয় নেই। শুধু দু—তিনবার ওদের ফ্ল্যাটে গেছে জরুরি ফোন ধরার জন্য।
‘সিঁড়িটা অন্ধকার ছিল, বেকায়দায় পা—টা এমন মচকে গেল।’
রোহিণী কৈফিয়ত দেবার মতো স্বরে তাড়াতাড়ি কথাগুলো বলেই বুঝতে পারল, সত্যিই সে ভয় পেয়ে গেছিল। মুখে করুণ ভাব ফুটিয়ে সে হাসারও চেষ্টা করল।
‘পা ফেলতে পারছি না, তাই দাঁড়িয়ে পড়েছি।’
রোহিণী যদি জানত, কী সর্বনাশকে সে এই একটি বাক্যদ্বারা ডেকে আনছে, তাহলে মুখে চাবি দিয়ে রাখত।
‘হাড় টাড় ভাঙল নাকি? দেখি দেখি, কোন পা?’ তুষার দত্ত হাত বাড়িয়ে প্রায় হুমড়ি খেলেন রোহিণীর পায়ের গোড়ায়।
‘না না ভাঙেনি।’ রোহিণী দু—হাত মেলে ধরে ঝুঁকে পড়ল।
‘কী করে জানলেন ভাঙেনি?’ তুষার দত্তের হাত পৌঁছে গেল রোহিণীর ডান পায়ের পাতায়। ‘এই পায়ে?’
রোহিণী সিঁটিয়ে গিয়ে বলল, ‘বাঁ পায়ে।’
সঙ্গে সঙ্গে বাঁ হাতের আঙুলগুলো বাঁ পায়ের পাতাটা জুতো সমেতই আঁকড়ে ধরল। তারপর পাতা থেকে গোছ পর্যন্ত তুষার দত্তর অর্থপেডিক পরীক্ষা শুরু হল। জুতোটা আগেই খুলে নিয়েছিল, সায়াটা কিঞ্চিৎ তোলার চেষ্টা করতেই রোহিণী মরিয়া হয়ে বলল, ‘দেখুন তো, আপনি গুরুজন পায়ে হাত দিচ্ছেন, আমার কী যে লজ্জা করছে!’
.
‘তাই বলে পা—টা ভেঙেছে কিনা দেখব না।’
রেহাই পাবার জন্য রোহিণী সাহায্যের আশায় অসহায় মুখে ওর ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রীর দিকে তাকাল। তারাও বিভ্রান্ত।
‘মনে হচ্ছে স্প্রেন হয়েছে, সম্পূর্ণ রেস্ট দরকার। পায়ে চাপ দিয়ে ওঠা তো উচিত নয়।’
‘পারব, পারব, এই ক—টা তো সিঁড়ি।’
রোহিণী ব্যগ্র স্বরে তিনতলার ল্যান্ডিংয়ের দিকে তাকাল। ‘বারোটা মাত্র, পারব।’
‘পারবেন তো নিশ্চয়, কিন্তু দুটো সিঁড়ি ভাঙাও এখন উচিত হবে না। আপনি বরং—’
তুষার দত্ত তার পরামর্শকে বাস্তবায়িত করার আগেই রোহিণী হাত বাড়িয়ে নন্দাকে তার বাঁদিকে টেনে আনল।
‘এই তো নন্দা, ওর কাঁধে ভর দিয়ে উঠে যাব।’
সকাল থেকে কী যে ঝামেলা! রোহিণী দাঁতে দাঁত ঘষল। এভাবে ভয় পাওয়ার কোনো মানে হয়? বাইরে, মনের ভেতরে সবখানেই তো অন্ধকার। আনাচে কানাচে কুকুর তো আছেই, তার উপর এইসব উপকারী জীবেরা। এখন ঘরে পৌঁছনো তো খোঁড়ার অভিনয় করে যেতে হবে।
‘ওর একার পক্ষে কি সম্ভব? দু—জনেই পড়ে যাবেন, আমি বরং—’
তুষার দত্ত বোকামি করে আর সময়ক্ষেপ করল না। রোহিণীর প্রতিরক্ষা তৈরি হবার আগেই তার অরক্ষিত ডান বাহু জড়িয়ে ধরল বগলের তলা দিয়ে বাঁ হাত ঢুকিয়ে।
আরতি চুপ করে ব্যাপারটা দেখে যাচ্ছেন। ঠান্ডা গোবেচারা মানুষ। নীচুস্বরে কথা বলেন আর সংসারের কাজ করেন অবিরাম। রোহিণী অস্বস্তিভরে তার দিকে তাকাল। নন্দা তার বাবার এই কাজটা অনুমোদন করতে না পেরে বলল, ‘বাবা তোমায় আর ধরতে হবে না, আমার গায়ে যথেষ্ট জোর আছে।’
.
তুষার কটমটিয়ে একবার শুধু মেয়ের দিকে তাকাল। ‘এইবার আস্তে আস্তে পা ফেলুন। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আহহ অত তাড়া কীসের।’
রোহিণীর ইচ্ছে করছে ছুটে তিনতলায় উঠে যেতে, কেননা তুষার দত্তর বাম বাহু তার পাঁজরের যে জায়গায় চাপ দিচ্ছে তাতে বিপন্নকে সাহায্য দেবার রীতিটা রক্ষিত হচ্ছে না। নন্দা তার অস্বস্তির কারণটা বুঝেই ডান বাহু ছেড়ে পিঠের উপর দিয়ে হাতটা বাড়িয়ে বাম বগলের নীচে ঢোকাতে গেল। কিন্তু তুষার দত্তর বাইসেপ দুর্ভেদ্য করে রেখেছে অঞ্চলটা। নন্দা একটু ফাঁক খুঁজছে হাতটা গলাবার জন্য, তুষার দত্ত আরও চেপে ধরেছে রোহিণীর পাঁজর। আরতি ওদের পিছনে, সামনে ছেলে দুটি।
রোহিণী ঠিক করল, আর নয় এবার কিছু করা দরকার। নন্দা বাবার ব্যাপারটায় লজ্জা পাচ্ছে এবং নিজের হাত রেখে একটা আড়াল তৈরি করতে চাইছে, এতে রোহিণী নিজেও কুঁকড়ে যাচ্ছে। এইটুকু মেয়ে, কী ভাবছে তার সম্পর্কে! বিরক্তিতে রাগে সে বাকি দুটি সিঁড়ি একলাফে পেরিয়ে ঘুরে দাঁড়াল।
‘আমার কিছুই হয়নি, মিছিমিছি আপনাদের কষ্ট দিলাম।’ রোহিণী নিজের দরজার কলিং বেলের বোতামে চাপ দিল।
‘এটা কোনো কষ্টের ব্যাপারই নয়।’ তুষার দত্ত এখন বিনীত ও ভদ্রলোক। ‘বরফ দেওয়া দরকার। আমি এক্ষুনি আইসব্যাগ আর বরফ আনছি।’
লোকটি পড়িমরি চারতলায় উঠে গেল, তা সঙ্গে ছেলে দুটিও। নন্দার মুখে লজ্জার কালো ছাপ। আরতি কিছুই বোঝেননি। উৎকণ্ঠিতভাবে বললেন, ‘বরফ দেওয়া ভালো। তাহলে আর ব্যথা হবে না।’
রোহিণী যথাসাধ্য হাসল এবং আবার বোতাম টিপল। তখন নন্দা ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘আন্টি, আপনার কাজের মেয়েটা বিকেলে চলে গেছে। আমি গেটে দাঁড়িয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিলাম, তখন ও চলে যাচ্ছে। আমায় বলল, একা থাকতে ভয় করছে, আর আসবে না।’
‘সে কি! ভয় করছে? আশ্চর্য তো!’
‘তাই তো বলল। আমি বললুম, তিনতলায় আবার ভয় কীসের? নতুন বাড়ি, ভূতটুত এখনও বাসা বাঁধেনি, তা ছাড়া এত লোক রয়েছে। তা আমার কথায় আর কিছু না বলেই হাঁটতে শুরু করে দিল। মেয়েটার মাথায় বোধ হয় ছিট আছে।’
রোহিণী দমে গেল খবরটা শুনে। যাও বা একটা কাজের মেয়ে পাওয়া গেল, একদিনেই ভেগে পড়ল।
‘সঙ্গে করে কিছু নিয়ে যেতে দেখলে?’
‘না, খালি হাতেই তো গেল। তবে লুকিয়ে কিছু নিয়েছে কিনা জানি না।’
থলি থেকে চাবি বার করে রোহিণী দরজা খুলল। ‘আচ্ছা।’
মুখের হাসি মিলিয়ে যাবার আগেই সে দরজার পাল্লা বন্ধ করে দিল।
অন্ধকার ঘরে দাঁড়িয়ে রোহিণী চোখ বন্ধ করল। সারা দিন নয়, যেন সারা জীবন ঘুরে এসে এখন সে চটপট হিসেব—নিকেশ করে ফেলার কাজে ব্যস্ত। অনেকগুলো বছর পিছিয়ে না গেলে এখনকার এই অবস্থাটা কেন হল, তার ফর্দ তৈরি করা যাবে না। তবে একটা জিনিস এখনও তার অটুট আছে, তার মূলধন, তার দেহ। এটা পাঁচ মিনিট আগেও পরীক্ষিত হয়েছে। কিন্তু এই দেহই তাকে এখন এই অন্ধকার জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখল।
চোখ সরে যেতে সে মেঝেয় ঘষে পা বাড়াল। ডাইনিং স্পেস, ডান দিকে খাওয়ার টেবল। সোজা গেলে শোয়ার ঘর, বাঁ দিকেও একটা ঘর, যেটা ফাঁকাই পড়ে আছে। টেবলটার পাশে রান্নাঘর আর কলঘর। অনাবশ্যক আসবাব একটিও নেই। রোহিণী হোঁচট না খেয়ে সুইচ বোর্ডের কাছে পৌঁছল।
উত্তরের জানলাটা খোলা। অন্ধকারের ফ্রেমের মধ্যে চৌকো একখণ্ড সাদা ক্যানভাসের আভা। অনেকটা কুয়াশার মতো, যা ভোরবেলায় মাঠের দু—হাত উপরে জমাট হয়ে থাকে। ঝাপসা সাদা ছায়ার পিছনে ছমছম করা রহস্য স্থির হয়ে রয়েছে। ক্যানভাসটায় রয়েছে একটা কৃষ্ণচূড়া, যে নিষ্পত্র ডালগুলো দিয়ে লজ্জা ঢাকার কাজে ব্যর্থ হয়ে রাস্তার ইলেকট্রিক বাতির সামনে অপ্রতিভ অবস্থায়। রোহিণী আচ্ছন্নের মতো জানালার দিকে তাকিয়ে থাকল। অনেক কিছুই তার মনে পড়ে যাচ্ছে।
কলিং বেল বেজে উঠল। সুইচ টিপে ডাইনিংয়ের আলো জ্বালিয়ে সে একনজর জায়গাটায় তাকাল। চারটে ঠোঙা আর কিছু রেজগি টেবলে রয়েছে, যা সকালে ছিল না। চঞ্চলা তাহলে জিনিস কিনে দিয়েই কাজ ছেড়েছে। মেয়েটা বিশ্বাসী আর খাটিয়ে ছিল। চলে গিয়ে লোকসানই হল।
আবার বেল বাজল। লোকটা যে নাছোড়বান্দা টাইপের, এটা সে বহুদিন আগেই বুঝে গেছে। এখন বরফ এনেছে আর সেই বরফ পায়ে ঘষে দেবার জন্য বায়না জুড়বে। ব্যাটার বড্ড নোলা, এবার শাস্তি দিতে হবে, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে রোহিণী ঊর্ধ্বাঙ্গ মুচড়ে কার্ডিগানটা থেকে নিজেকে বার করতে করতে এবং অন্যমনস্কতার জন্য শাড়ি যাতে বিস্রস্ত হয়ে কিছুটা বেআব্রু করে দেয় সেদিকে লক্ষ রেখে, সে দরজার আই হোলে চোখ রাখল।
যা ভেবেছিল তাই—ই, কিন্তু পেছনে গম্ভীর মুখে মেয়েও দাঁড়িয়ে। হাঁফ ছেড়ে কার্ডিগান আবার শরীরে সেঁটে নিয়ে রোহিণী দরজার অর্ধেকটা খুলল। তুষার দত্ত কিছু বলার আগেই সে তার হাত থেকে আইসব্যাগটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে বলল, ‘ওহ এনেছেন; দিন। ভালোই হল। ধন্যবাদ।’
সে দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছে তখন তুষার দত্ত ব্যস্ত হয়ে, ‘দাঁড়ান দাঁড়ান’ বলে মেয়ের দিকে তাকালেন।
‘আন্টি, আপনার তো আজ রান্না হয়নি।’
‘দেখতে হবে মেয়েটা কিছু রেঁধে রেখেছে কিনা।’
‘মা বলল, আপনার যদি অসুবিধা না হয় তো আমাদের সঙ্গে খাবেন।’
‘মানে আমিই বললুম যে, ওনার কাজের মেয়েটা তো চলে গেছে—’
বাপ আর মেয়ের মধ্যে চাহনির একটা জ্বলন্ত সংঘর্ষ ঘটে গেল। তার স্ফুলিঙ্গ নিভে যাবার আগেই রোহিণী বলল, ‘আচ্ছা, আমি আগে দেখি নিই রেঁধে রেখেছে কিনা।’
দরজা খুলে রেখেই সে রান্নাঘরে এসে আলো জ্বালল। সকালে মাজা বাসনগুলো গ্যাসবার্নারের পাশে উপুড় করে রাখা, রান্না হয়েছে এমন প্রমাণ কোথাও নেই। রুটিও করে রেখে যায়নি। ফিরে আসতে আসতে দেখল, ওরা দু—জন ব্যগ্র দৃষ্টিতে তাকে দেখছে।
‘আরে, রেঁধে রেখেছে দেখছি!’ বিস্ময়টা একটু বেশি মাত্রায়ই হয়ে গেল, কিন্তু রোহিণী সেটা কমাবার চেষ্টা করল না। ‘ডিমের ঝুরি করতে বলেছিলাম, সেদ্ধ করে রেখেছে! ভালোই হল, ভাজাভুজি যত কম খাওয়া যায়—।’
দু—জনের মুখে হতাশা ফুটে উঠল। কিন্তু রোহিণীর এতে কিছু করার নেই। খিদেয় পেটের মধ্যে নাড়িভুঁড়ি কচলাচ্ছে, তবুও সে উপরের ফ্ল্যাটে যেতে ইচ্ছুক নয়। ওরা লোক ভালো, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, একটু বেশি ভালো।
‘ডিম সেদ্দটা কী একটা খাওয়ার জিনিস হল। আপনাকে ধোঁকা আর মাছের ডিমের চাটনি খাওয়াব। চলুন চলুন।’ তুষার দত্ত হাত ধরে টানবার মতো ভঙ্গি করলেন। রোহিণী এক পা পিছিয়ে গেল।
‘না, রাত্তিরে আমি বেশি খাই না।’
‘ফিগার রাখার জন্য?’ তুষার দত্ত কোনোরকম রাক ঢাক না রেখেই রোহিণীর গলা থেকে হাঁটু পর্যন্ত চাহনির বুরুশ চালালেন। নন্দার চোখে যে সেটা এড়াল না, রোহিণী তা লক্ষ করে বলল, ‘ফিগার রাখাটা কী খুব দোষের বা অস্বাভাবিক কিছু?’
‘না না না, তা বলছি না—’
‘আপনার খিদে পায়নি তুষারবাবু?’ কোমল স্বরে রোহিণী জানতে চাইল।
‘নিশ্চয় পেয়েছে।’ প্রায় সগর্বে তুষার দত্ত ঘোষণা করলেন।
‘তাহলে খেতে যান।’
গম্ভীর মুখে রোহিণী দরজা বন্ধ করে দিল। উপরে গিয়ে টেলিফোন ধরা বা করার পথটাও এবার বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু ঘাড়েপড়া একটা ঝঞ্ঝাটে জড়ানোর থেকে দূরে থাকতে এটা করতেই হল। লোকটা যা মাথামোটা, তার প্রত্যাখ্যানটা বুঝতে পারল কিনা কে জানে! তবে নন্দা বুঝতে পেরেছে।
এবার কিছু একটা রান্না করে খেতে হবে। চঞ্চলা ডিম, পেঁয়াজ, মুসুর ডাল, আর সকালের জন্য বিস্কুট কিনে রেখে গেছে। কাল গৌরীর মা না আসা পর্যন্ত জানা যাবে না, মেয়েটা কেন পালাল। ডিমের ওমলেট না শুধুই সেদ্ধ, কোনটা তাড়াতাড়ি করা যাবে? সেকেন্ড পাঁচেক ভেবে নিয়ে রোহিণী বাটিতে জল দিয়ে তিনটে ডিম সেদ্ধ করতে বসাল। সকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট ক্যালোরি এর থেকে পাওয়া যাবে।
কিবা শীত, কিবা গ্রীষ্ম, রাতে শোয়ার আগে রোহিণীর স্নান করার অভ্যাস। ডিম সেদ্ধ হবার আগেই সে শরীরকে যাবতীয় আবরণ থেকে রেহাই দিয়ে অন্ধকার শোবার ঘরে ম্যাক্সিটা খুঁজতে শুরু করল। চঞ্চলা কোথাও তুলে রেখেছে। ঘরে না পেয়ে নগ্ন অবস্থাতেই সে ডাইনিংয়ে এল। বন্ধ জানলাটার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকাল। শোবার ঘরে উত্তরের খোলা জানলা দিয়ে শুধু মাঠ আর কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখা যাচ্ছে। ওদিক থেকেও সে নিশ্চিন্ত। একা একটা ফ্ল্যাটে থাকার জন্যই তার দেহ সম্পর্কিত জড়তা ভেঙে গেছে। নগ্ন হয়েই বহুরাতে সে ঘুমিয়েছে, ঘুম ভেঙে ভোরে কলঘরে গেছে, ব্যায়াম করেছে এবং গৌরীর মা আসার আগে সায়া—শাড়ি পরেছে। একটা হালকা স্বাচ্ছন্দ্য আর অনাস্বাদিত মুক্তির আনন্দ সে পায়, যতক্ষণ নিরাবরণ হয়ে একা থাকে।
তন্ন তন্ন করে সে সারা ফ্ল্যাট খুঁজল। দুশো টাকা দিয়ে কিনে বোম্বাই থেকে দিদি চার মাস আগে ম্যাক্সিটা পাঠিয়ে দিয়েছিল। এটা পরে সে নীচের কল থেকে বালতিতে জল তুলে এনেছে, যখন পাওয়ার কাটের জন্য পাম্প না চলায় ট্যাঙ্কে জল ছিল না। উপরে উঠে ফোনও ধরেছে এবং নন্দা ফিসফিস করে তখন অনুরোধ জানায় তার জন্যও একটা আনিয়ে দিতে। জিনিসটা তার খুব প্রিয়, খুঁজে না পেয়ে তার বিরক্তি চরমে উঠল। খাটে বসে সে হতাশ হয়ে ডাইনিং থেকে আসা আলোয় ঘরের মধ্যে যতটা সম্ভব দেখার জন্য এধার—ওধার তাকিয়ে আয়নায় নিজের আবছা মূর্তিটা দেখে চমকে গেল।
ঠিক এইভাবেই! দোতলার খড়খড়ির জানলাটা খোলা ছিল। নিমগাছটার উপর দুপুরের রোদ ঝরছিল। পাতাগুলো গনগনে তাত শুষে নিয়ে কোমল হালকা আলো পাঠিয়ে দিচ্ছিল ঘরে। সেকেলে বিরাট ঘরের ভারী কড়িবরগার উঁচু ছাদ আর সাদা—কালো বরফি কাটা মার্বেলের মেঝের মধ্যবর্তী শূন্যতায় সেই আলো স্তরে স্তরে ভাগ হয়ে। ‘এই আলোটা আমার পছন্দ।’ শোভনেশ বলেছিল। জানলার কাছে কালো চামড়া—মোড়া পুরনো ভারী ডিভানে বসেছিল রোহিণী। ‘এইবার কাপড়চোপড়গুলো খুলে ফ্যালো।’ বিষাক্ত সাপ দেখে ভয় পাওয়ার মতো সে দাঁড়িয়ে উঠেছিল। ‘সে কী?’ বিশ্বাস করতে পারছিল না শোভনেশের কথা। ‘তাতে কী হয়েছে! এখানে শুধু তুমি আর আমি, বাইরের কেউ তো দেখতে পাবে না। তাড়াতাড়ি করো।’ শেষ দিকে কঠিন হয়ে গেছল শোভনেশের স্বর, প্রায় আদেশের মতো। রোহিণী জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। নিমগাছটা বাড়ির বাগানের মাঝামাঝি, তার দু—পাশে বাড়ির দুটো অংশ, যেখানে অন্য শরিকরা থাকে এবং গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে যার প্রায় কিছুই দেখা যায় না। তিনতলায় জানালার সবগুলোই বন্ধ, তবে খড়খড়ির একটি দুটি পাখি খসে গেছে। এই জানালাগুলো কখনো সে খোলা দেখেনি। ছাদে লোক নেই। কেউ দেখতে পারে না ঠিকই কিন্তু সেজন্য নয়, রোহিণী কখনো কোনোদিন কারোর সামনে বিবসনা হয়নি। তার মন কিছুতেই সায় দেয়নি এই প্রস্তাবে। হোক না সেটা স্বামীর বা খ্যাতনামা কোনো আর্টিস্টের। ‘কী হল, দাঁড়িয়ে রইলে কেন?’ শোভনেশ অধৈর্য, বিরক্ত হয়ে গলা চড়ায়। ‘না আমি পারব না, ন্যুড হয়ে মডেল সাজা আমার দ্বারা হবে না।’ রোহিণী বন্ধ দরজার দিকে এগোয়। ড্রইং বোর্ডে সাঁটা কাগজের সামনে পেনসিল হাতে শোভনেশ দাঁড়িয়ে ছিল। প্রায় দশ কদম ছুটে এসে সে রোহিণীর দুটো কাঁধ সাঁড়াশির মতো আঙুলে চেপে ধরে ঠান্ডা গলায় বলে, ‘তাহলে বিয়ে করেছিলে কেন?’ রোহিণী বলে, ‘শুধুই আমি করেছি? বিয়ে তো দু—জনে করেছি। কিন্তু তা কী এইভাবে মডেল হবার জন্য? এসব আমার দ্বারা সম্ভব নয়। যে তোমার সামনে কাপড় খুলত, তাকে ডেকে আন।’ এরপর শোভনেশ যা করল, রোহিণী তা কল্পনাতেও আনতে পারবে না। দু—হাতে ব্লাউজের গলা ধরে পড়পড় করে ছিঁড়ে দিয়ে শোভনেশ তাকে ঠেলতে ঠেলতে ডিভানের কাছে এসে ধাক্কা দেয়। রোহিণী চিত হয়ে পড়তেই সে শাড়ি ধরে টান দিয়ে খুলতে শুরু করে। আকস্মিকতার ধাক্কা কাটিয়ে রোহিণী পা ছোঁড়ে, সেটা শোভনেশের হাঁটুতে লাগে। সেই ফাঁকে ধড়মড়িয়ে উঠে সে দৌড়ে গিয়ে দরজার খিল খুলে তিনতলায় ছুটে আসে নিজের ঘরে। বিছানায় বসে হাঁফাতে হাঁফাতে পাশে তাকাতে চোখ পড়ে আয়নায়।
ঠিক এইভাবেই সেদিন সে বসেছিল।
কলিং বেল একবার টুং করে বেজেই থেমে গেল। রোহিণী অবাক হল এবং অস্বস্তি বোধ করল। আবার! এত রাতে? কে হতে পারে? অপেক্ষায় রইল আবার বেজে ওঠার। একটা কিছু গায়ে চাপাতে হবে। ছেড়ে রাখা শাড়িটাই টেনে নিল।
ডিম অনেকক্ষণ সিদ্ধ হচ্ছে। বেশি শক্ত হলে খেতে বিশ্রী লাগবে। শাড়িটা জড়িয়ে রান্নাঘরে এসে বার্নার নিভিয়ে সে বেল বাজার জন্য আবার অপেক্ষায় রইল।
আর বাজছে না। এবার সে কৌতূহলী হয়ে পড়ল। এত রাতে তুষার দত্ত বাঁদরামো করবে না। তাহলে কে? পায়ে পায়ে দরজায় এসে আই হোলে চোখ রাখল। ফাঁকা সিঁড়ি, দেওয়াল। একটা লোকও নেই।
দরজা খুলে উঁকি দিল। তারপর নীচের দিকে চোখ পড়তেই হতভম্ব হয়ে বলে উঠল, ‘একি!’
তার খুঁজে না—পাওয়া ম্যাক্সিটা পাট করা অবস্থায় দরজার গোড়ায়। হৃৎপিণ্ডের ধড়ফড়ানিটা কমল, একটা বড়ো শ্বাস বেরিয়ে এল এবং ঠোঁট মুচড়ে হাসি ফুটল। এ কাজ অবশ্যই নন্দার। বেচারা লোভ সামলাতে পারেনি, বিবেকটাও। এখানকার সব ফ্ল্যাটেরই সদর দরজার লকটা এমনই ঝঞ্ঝাটের যে, বন্ধ করলে শুধু ভিতর থেকেই নব ঘুরিয়ে খোলা যায়। বাইরে থেকে দরজা খুলতে হলে চাবি চাই—ই। যদি ভিতরে কেউ না থাকে এবং চাবি সঙ্গে না নিয়ে তখন কেউ বাইরে আসে এবং দরজাটি যদি তখন বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সমূহ বিপদ। হয় দরজা ভেঙে ঢুকতে হবে কিংবা পাইপ বা কার্নিস বেয়ে বারান্দা দিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকে ভিতর থেকে দরজা খুলতে হবে নয়তো চাবিওয়ালা ডেকে চাবি বানিয়ে দরজা খুলতে হবে। এর প্রত্যেকটাই সময়সাপেক্ষ এবং ঝঞ্ঝাটের।
রোহিণী এখানে আসার পর একবার এইরকম ঘটনা ঘটেছিল। তার সামনের ফ্ল্যাটে বাসকারী এক তামিল দম্পতি, শ্রীনিবাসনরা চাবি সঙ্গে নিতে ভুলে গিয়ে সন্ধ্যায় বেরিয়েছিল। ভিতরে কেউ ছিল না। রাত্রে ফিরে বিপদে পড়ে। বিপদে রোহিণীও পড়ে, রাতের মতো তার ফ্ল্যাটে ওদের অতিথি হয়ে থাকতে বলে। একটিমাত্র বিছানা এবং মশারিও একটি। শ্রীনিবাসনরা শান্ত, ভদ্র, উচ্চচশিক্ষিত। রোহিণীর অসুবিধে বুঝে তারা রাতের মতো বেলেঘাটায় বন্ধুর বাড়িতে চলে যেতে চেয়েছিল। তাদের নিরস্ত করে সে উপরে যায়।
শোনামাত্র তুষার দত্ত খুশিতে টগবগিয়ে ওঠে।
‘দরজাটা ভেঙে দিলেই তো হয়, কিছু ভাববেন না, আমি ভেঙে দিচ্ছি।’
‘সে কী। দরজা ভাঙবেন?’
‘কেন আমি কি পারি না ভেবেছেন?’ খুবই উত্ত্যক্ত দেখাচ্ছিল তুষার দত্তকে। ‘শাল কাঠের তক্তা মাথা দিয়ে ভেঙেছি, লোহার পাটি দাঁতে চেপে দু—হাতে পাকিয়ে পাকিয়ে বিড়ে বানিয়েছি আর এ তো প্লাইউডের একপাল্লার দরজা! কাঁধ দিয়ে একটা ছোটো পুশ করব দেখবেন মড়াত করে একটা আওয়াজ হবে শুধু।’
‘দরজাটা রিপ্লেস করার টাকা দেবে কে?’
তুষার দত্ত গোলমালে পড়ে যায় রোহিণীর কথার টানে বাস্তব ভূমিতে নেমে এসে। চার—পাঁচ শো টাকা তো কম করে লাগবেই। তার পেশির বর্ম দুর্ভেদ্য হতে পারে কিন্তু টাকাপয়সা হিসাবের মল্লযুদ্ধে তুষার দত্ত সহজেই কুপোকাত হয়।
‘জানি, আপনি মড়াত কেন, পটাস করে দরজা ভাঙতে পারবেন কিন্তু আপনাকে এত রাতে আর কষ্ট করতে হবে না।’ রোহিণী প্রায় আবেদনই জানিয়েছিল। ‘মিসেস শ্রীনিবাসন আমার সঙ্গে থাকবেন, আপনি যদি মিস্টার শ্রীনিবাসনের একটু শোয়ার ব্যবস্থা করেন এখানে।’
‘নিশ্চয় নিশ্চয়, এতবড়ো সোফাটা তাহলে আছে কীজন্য। মশারি না টাঙালেও চলবে, মশা মারার ধূপ জ্বালিয়ে দিচ্ছি।’
ইংরেজির মতো বেশ ভালোই বাংলা বলতে পারে রজনী শ্রীনিবাসন। রাতে বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে রোহিণী এই শীর্ণকায়া তামিল বউটির সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারে সে বি—কম, স্বামীর অফিসেই স্টেনোগ্রাফার আর সেই মাল্টি ন্যাশনাল সংস্থায় অ্যাকাউন্টসের একটা বিভাগের কর্তা কৃষ্ণমাচারি শ্রীনিবাসন। ফ্ল্যাট ভাড়ার এগারোশো টাকা দেয় অফিসই। ‘চাকরি না করলেও চলে, কিন্তু করবে না কেন, যদি আয় বাড়িয়ে কমফর্ট আর সিকিউরিটি বাড়াতে পারি। এখন ছেলেমেয়ে নেই, কিন্তু হবে তো। মেয়ের বিয়ের জন্য, আমাদের ব্রাহ্মণদের, অনেক টাকা লাগে।’ কোয়েম্বাটোরের মাঝারি সরকারি অফিসার রজনীর বাবা দেড় লাখ টাকার বিনিময়ে জামাই সংগ্রহ করেছেন। ‘খুব সস্তাতেই বলতে হবে।’ রজনী আপ্লুত হয়ে বলেছিল। তখন রোহিণী মনে মনে ভেবেছিল, এই ফ্ল্যাট ভাড়া দিলে গঙ্গাদা এগারোশো টাকা মাসে মাসে পেতেন। তার জন্যই পাচ্ছেন না। সে কৃতজ্ঞ থাকল।
পরদিন সকালেই তুষার দত্ত চাবিওয়ালা ডেকে আনে। তখন একটা পরামর্শ সে রোহিণীকে দেয়: ‘দুটো চাবির একটা ফ্ল্যাটের বাইরে কোথাও রাখুন, তাহলে এইরকম দুর্ভোগে পড়তে হবে না।’
‘কোথায় রাখব?’
‘আমার কাছে রাখতে পারেন, অবশ্য যদি বিশ্বাস করেন।’
‘না না অবিশ্বাসের কী আছে। আমার চুরি করার মতো দামি জিনিস কিছুই নেই।’
.
একটা চাবি সে তুষার দত্তর বউয়ের হাতে দিয়ে এসেছিল। কিন্তু তারপর থেকে তার মনের গভীরে একটা অস্বস্তি মাঝে মাঝে খচখচ করে। সে কোথায় যেন অনাবৃত, অনিরাপদ হয়ে রয়েছে। যেকোনো সময় তার জীবনের ঢিলেঢালা গোপনীয়তা আক্রান্ত হতে পারে, ব্যক্তিগত অংশের অনেকটাই যেন হারিয়ে গেল। তার ব্যক্তিত্ব যেন এখন থেকে অন্যের হাতে কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।
সেদ্ধ ডিম খেতে খেতে রোহিণী ভাবল, চাবিটা উপর থেকে চেয়ে এনে রজনীর কাছে রাখলে কেমন হয়! ওরা দু—জনে সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরে আসে। দিনের বেলায় তো চাবির দরকার পড়বে না। নন্দার ভীষণ কৌতূহল আন্টির ব্যক্তিগত জীবন জানার জন্য। হয়তো ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ফ্ল্যাটে ঢোকে। এটা ওটা ঘাঁটে।
আইসব্যাগ থেকে কিউবগুলো বার করে বাটিতে রেখেছিল। কিছুটা গলেছে। বাটি তুলে চুমুক দিয়ে জলটুকু খেয়ে সে স্নান করতে গেল। পশ্চিমে ছোটো বারান্দা, শোবার ঘর দিয়ে সেখানে যেতে হয়। অন্তর্বাসগুলো জলকাচা করে বারান্দার রেলিংয়ে মেলে দিয়ে সে রোজ যা করে না, বারান্দার দরজাটা আজ বন্ধ করে ছিটকিনি তুলে দিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াবার সময় ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে তার মনে হল, মেয়েদের বসবাসের জায়গা যতটা ছিমছাম পরিচ্ছন্ন হওয়া উচিত, ঘরটা মোটেই সেরকম অবস্থায় নয়। এতটা অগোছালো হয় না যদি দিন—রাতের জন্য কাজের লোক থাকত। একটু গুছিয়ে নিলে ভালো হয়। কিন্তু এখন আর শরীর বইছে না। চঞ্চলা মেয়েটা ঠিক কেন যে পালাল, কাল গৌরীর মা—র কাছ থেকে সেটা জেনে নিতে হবে।
কালকের জন্য আর কী কী করণীয় কাজ রইল? চিরুনি থেকে কয়েকটা চুল টেনে বার করে রোহিণী জানালায় গেল। ফুঁ দিয়ে আঙুল থেকে চুল উড়িয়ে জানলার পাল্লা বন্ধ করল। বিছানায় মাথার কাছেই জানালাটা, শীতকালে খুলে রাখলে ঠান্ডা লেগে যাবে। কিন্তু সব ঋতুতেই ঘরের জানালা খুলে সে বাইরে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
বাবাকে মনে পড়লেই ছোটোবেলার অনেক কথা, ঘটনা তার স্মৃতিতে জেগে ওঠে। মেয়েদের ইংরাজি বলা—কওয়া শেখানোর জন্য তাঁর চিন্তার আর শেষ ছিল না। রেডিয়োয় রাত ন—টার ইংরেজি খবর শোনা বাধ্যতামূলক ছিল। দুই বোনকে পুজোর অঞ্জলি দেবার ভঙ্গিতে রেডিয়োর সামনে বসতে হত, শুধু ইংরেজি উচ্চচারণ শেখার জন্যই নয়, পৃথিবীতে রোজ কত ঘটনা ঘটছে ওয়াকিবহাল থাকার জন্য। ‘শিক্ষিত লোকেদের সঙ্গে তা না হলে কথা বলবে কী করে? হাঁদা গ্র্যাজুয়েট হয়ে লাভ কী?’ খবর শেষ হলে বাবা ইংরেজিতে প্রশ্ন করতেন, ইংরেজিতেই উত্তর দিতে হত। অর্ধেক শব্দের মানেই বুঝত না রোহিণী, কিন্তু সোহিনী চমৎকার গুছিয়ে মেমসাহেবদের মতো উচ্চচারণে বলে দিত। বাবার চোখমুখ তখন জ্বলজ্বল করে উঠত গর্বে। ‘আমার এই মেয়েটারই হবে।’ কী হবে সেটা অবশ্য আর বলতেন না।
ইংরেজি খবরের পর, সাড়ে ন—টার মধ্যে শোওয়া আর ঠিক পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠা। তারপর পার্কে গিয়ে দৌড়ানো। বাবা হাঁটতেন জোরে জোরে, ডায়াবিটিস ছিল। ক্লাস এইটে পড়ার সময় স্কুল ম্যাগাজিনের জন্য রোহিণী প্রথম গল্প লিখে বাবাকে দেখায়, একটা ভিখারি মেয়ের ধনীগৃহে ভিক্ষা চাইতে গিয়ে তার লাঞ্ছনা ও অপমান ছিল বিষয়। বাবা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন, ‘আমার এই মেয়েটার ট্যালেন্ট আছে।’
মশা যেন আজ কমই মনে হচ্ছে। ঘরের আলো নিভিয়ে সে টেবল—ল্যাম্প জ্বালাল বেড সুইচ টিপে। খবরের কাগজটা নিয়ে বেডকভার সরিয়ে বিছানায় শুলো। মশারিটা আর টাঙাতে ইচ্ছে করছে না। বেডকভার দিয়ে গলা পর্যন্ত ঢেকে সে কাগজটা খুলে আবার সেই ছোটো খবরটায় চোখ রাখল।
গঙ্গাদা কাল সকালে বাসুদেবপুর থেকে ফিরে খোঁজ নেবেন। হয়তো রাইটার্সে যাবেন। যদি জেলভাঙা লোকটা সত্যিই শোভনেশ হয়, তাহলে? তিরিশ—চল্লিশ লাখ লোকের শহরে একজনকে খুঁজে বার করা সহজ নয় ঠিকই, কিন্তু গঙ্গাদাকে খুঁজে বার করতে তো ওর এক মিনিটও সময় লাগবে না। বাড়ি চেনে, অফিসও চেনে। গঙ্গাদা বলেছেন, তিনি কোনোরকম হদিশ দেবেন না, বরং পুলিশে ধরিয়ে দেবার ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেবেন। কিন্তু অফিসের অনেকেই তার এই ফ্ল্যাটের ঠিকানা জানে। তাদের কারোর কাছ থেকে তো জেনে নিতে পারবে। শোভনেশ তার সন্ধান পাবে অথবা পাবে না, এই উৎকণ্ঠাটাই সবথেকে ভয়ংকর। সারাক্ষণ কুরবে, মুহূর্তের জন্যও তাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না।
‘যদি আপনি জানতেন, ওর মডেল মৃত বীণা চ্যাটার্জির সঙ্গে ওর দৈহিক সম্পর্ক আছে, তাহলে কী আপনি শোভনেশ সেনগুপ্তকে বিয়ে করতেন?’
‘না।’
এক সেকেন্ডও ভাববার জন্য সময় নেয়নি রোহিণী। উকিলের নয়, শোভনেশের মুখের দিকে চোখ রেখে সে জবাব দিয়েছিল কঠিন স্বরে।
‘কেন বিয়ে করতেন না? উনি তো ভারতখ্যাত আর্টিস্ট, ওনার ছবি তো বহু টাকায় বিক্রি হয়।’
‘হতে পারে, কিন্তু চরিত্রহীন লোকেদের আমি ঘৃণা করি।’ রোহিণী তখন দেখেছিল, তার কথা শুনেই দপ করে জ্বলে ওঠে শোভনেশের চোখ। হাত মুঠো করে বীভৎস দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করতে থাকে। সে ভয় পেয়েছিল। মনে হয়েছিল, কোর্ট ঘরটা যদি জনশূন্য হত শোভনেশ তাহলে ছুটে এসে তার গলা টিপে ধরত। ত্রাসের চাপেই সে একসময় জেরার মুখে বলে, ‘হ্যাঁ, আমার মনে হত, উনি আমাকেও গলা টিপে মারতে পারেন—একবার চেষ্টাও করেছিলেন।’
‘কেন করেছিলেন?’
কোর্টকে তা জানাবার আগে রোহিণী দেখেছিল, শোভনেশ দু—হাতের ফাঁদে আঙুলগুলো একটা অদৃশ্য গলায় জড়িয়ে, পিষে, ক্রমশই কঠিন করে ঝাঁকাচ্ছে।
মাথার মধ্যে উত্তাপ জমে উঠলে যা হয়, রোহিণীর চোখ থেকে ঘুম ছুটে পালাল। সে জানে, এখন আর ঘুমকে তাড়া করে ধরা যাবে না। সে জানে, কেননা এমন অশান্ত, উত্তেজক রাত সে বহুবার যাপন করেছে, এখন স্মৃতির দরজা খুলে তাকে ঢুকতে হবে একটা সুড়ঙ্গে। দু—ধারে সার দেওয়া ঘর। হাঁটতে হাঁটতে সে ঠিক করবে কোন ঘরটায় ঢুকবে। ঘরে ঘরে আলাদা আলাদা ঘটনা। আজও তো ঘটেছে অনেক কিছু। সেগুলোও নিশ্চয় কোনো ঘরে জমা হয়েছে, ভবিষ্যতে কোনো এক রাতে সেখানে সে ঢুকবে।
রোহিণী খবরের কাগজটা মেঝেয় ফেলে দিল। বেড সুইচ টিপে আলো নেভাল। জানলা দিয়ে বাইরের আলো এসে আবছা করেছে সিলিং।
ছ—বছর আগের একটা ঘরের সামনে থমকে গিয়ে সে ভিতরে ঢুকল।
.
ওল্ড বালিগঞ্জে হিমালয়ান পেইন্টসের গেস্ট হাউসের বিশাল অ্যাপার্টমেন্টে জামাইবাবু ককটেলে ডেকেছিল জনা চল্লিশ গণ্যমান্যকে। দোতলায় নীচু পাঁচিলঘেরা ছাদে সবাই জমায়েত। একদিকের দেওয়ালে ছ—সাতটা চীনা লণ্ঠনের টিমটিমে আলো ছাদটাকে আধো—অন্ধকার করে রেখেছে। টবের গাছে জোনাকির মতো হলুদ, নীল, টুনি জ্বলছে। উর্দিপরা বেয়ারারা কাবাব, চিজ, মাংসের শিঙাড়া, কাজুবাদাম আর সোডা, বরফ, রাম ও স্কচ হুইস্কির গ্লাস সাজানো ট্রে হাতে ঘুরছিল। হিমালয়ান পেইন্টসের কলকাতা অফিসের নানান স্তরের কর্তারা ছাড়াও ছিল সাংবাদিক, কবি, ছবির সমালোচক, ফিল্ম পরিচালক, ছবি আঁকিয়ে, ব্যবসায়ী এবং আরও কিছু লোক।
শোভনেশের ছবির প্রদর্শনীর সফল সমাপ্তির জন্য তার স্পনসরের দেওয়া পার্টি।
রঞ্জন আর সোহিনী অতিথিদের মধ্যে ঘুরে ঘুরে, যাদের কাউকেই প্রায় তারা চেনে না, হেসে হেসে, বহুকালের পরিচিত এমন মুখ করে আলাপ করে যাচ্ছিল। একদিকের পাঁচিলের ধারে আলো কম, ছায়া ছায়া একটা কোণে রোহিণী একা দাঁড়িয়ে ছিল। তার হাতে ছিল টোম্যাটো জ্যুসের গ্লাস।
সকালেই মেধাকে শান্তিনিকেতন দেখার জন্য দিদি সেখানে তার এক বন্ধুর বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। দুদিন থেকে আসবে। মদ—টদ খেয়ে অনেকেই বেসামাল হয়ে বিশ্রী পরিস্থিতি তৈরি করে। যদিও সেসব ঝঞ্ঝাট সামলানোর জন্য লোক মজুত থাকে, তবু দিদি একদমই চায় না ছোটো ছেলেমেয়েরা এই ধরনের পার্টিতে থাকুক।
‘একা কেন?’
সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল শোভনেশ। রোহিণী একটু অপ্রতিভ হয়। যার জন্য আজকের অনুষ্ঠান, সেই লোকটি একধারে একা—দাঁড়ানো—হোস্টের শালি ছাড়া পরিচয় দেবার মতো কিছুই নেই—এমন একজনকে আলাপ করার জন্য বেছে নেওয়ায় সে কৃতার্থ বোধ করে। প্রদর্শনীতে ছবিটা তার হাত থেকে পড়ে যাওয়ার ঘটনাটা মনে তখনও টাটকা।
‘কাউকেই চিনি না জানি না, এই বেশ আছি।’ রোহিণী দুর্বল স্বরে কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে বলে।
‘সে কী! বিখ্যাত বিখ্যাত লোক সব এরা। চলুন আলাপ করিয়ে দিই।’ এই বলে রোহিণীর বাম বাহু মুঠোয় ধরে আকর্ষণ করে শোভনেশ।
‘না না।’ রোহিণী আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ‘আমার দরকার নেই আলাপ করে। হোস্টের শালি এই পরিচয়ে এঁদের সঙ্গে কথা বলে খুব স্বস্তি পাব না।’
শোভনেশের আঙুলগুলো জড়িয়ে রয়েছে তার বাহু। হয়তো ইচ্ছে করেই, কিন্তু রোহিণীর মনে হল ইচ্ছে করে নয়। পার্টি এখন প্রাথমিক স্তর ছাড়িয়ে ওঠার পথে। ছোটো ছোটো জটলায় ভাগ হয়ে গেছে এক—এক ধরনের মানসিকতার গণ্ডি। শুরুতে মৃদু নম্র কণ্ঠে যারা কথা বলছিল এখন তাদের গলা চড়ছে। বিলম্ব করে যারা গ্লাস মুখে তুলছিল, এখন তারা একটু ব্যস্ত হয়ে ট্রে থেকে ভরা গ্লাস তুলে খালি গ্লাস রাখছে।
‘আপনার দেবার মতো পরিচয় নিশ্চয় আছে, আর সেটা মুখে বলার দরকার হয় না। আপনি আপাদমস্তক একটি মেয়ে, এটাই সেরা পরিচয়।’
জবাব না দিয়ে রোহিণী স্মিতমুখে চুমুক দিল রসে। ‘আপনি কী খাচ্ছেন?’ শোভনেশ জানতে চায়। ‘টোমাটোর রস বোধহয়! কোনো মানে হয়?’
রোহিণী বুঝে ওঠার আগেই শোভনেশ তার গ্লাস থেকে খানিকটা হুইস্কি রসের মধ্যে ঢেলে দিল।
‘আগে কখনো খাননি তো?’
‘না।’ বিমূঢ় হয়ে গেছিল রোহিণী।
‘তাহলে আমার অনুরোধে আজ খাবেন।’
শোভনেশের স্বরে খানিকটা আবদার, খানিকটা অনুরোধ, খানিকটা হুকুম, ঘনভুরুর ছাউনির নীচে জ্বলজ্বলে চোখ, সাদা অসম্মান দাঁত এবং দীর্ঘ দেহটিকে সামনে ঝুঁকিয়ে ঝোড়ো চুলের মাথাটা তার মুখের কাছে রাখা। রোহিণীর আপত্তি অসাড় হয়ে গেছিল। সে গ্লাস তুলে চুমুক দেয়। একটু তেতো স্বাদ ছাড়া সেই রসের আর কিছু বদলায়নি।
‘ভালো মেয়ে।’ শোভনেশ তারিফ জানায় আর রোহিণীর মাথায় আলতো টোকা মারে, বন্ধুর মতো। ‘এইবার চোঁ চোঁ করে শেষ করে দিন।’
রোহিণী তাই করেছিল বলামাত্র। ‘আর একটা আপনার জন্য আনি, ধরুন এটা।’ শোভনেশ তার গ্লাসটা রোহিণীর হাতে গচ্ছিত রেখে চলে গেল এবং ফিরে এল দুটো গ্লাস হাতে। টোম্যাটোর রস আর নিজের জন্য হুইস্কি।
‘দিন গ্লাসটা আর এটা ধরুন।’
হুইস্কির গ্লাস তার সামনে এগিয়ে ধরা। সভয়ে রোহিণী প্রথমেই ভিড়ের দিকে তাকিয়ে দিদিকে খুঁজল। একবার যদি দেখতে পায়, তাহলে এই বয়সেও তাকে চড় খেতে হবে। তার হাতে ধরা শোভনেশের আধ—খাওয়া গ্লাসটা ছাদের পাঁচিলে রেখে চাপা স্বরে সে বলল, ‘না, সরিয়ে নিন।’
‘আচ্ছা আচ্ছা, এই দেখুন।’ গ্লাসে খানিকটা টম্যাটোর রস ঢেলে লাল করে দিয়ে শোভনেশ বলল, ‘ককটেল! কেউ আর বুঝতে পারবে না।’
‘না।’
কয়েক টন ওজনের দৃঢ়তা একটি শব্দের মধ্যে বোঝাই করে রোহিণী কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকে। দিদির ভয়ে নয়। কেউ তাকে বাধ্য করবে, তা যতই মজা করে বলুক না কেন, এটা সে মন থেকে মানতে পারে না। তার ব্যক্তিত্বকে অগ্রাহ্য করে কেউ যদি ধরে নেয়, যা বলব তাই সে মানবে, তাহলে ভুল করবে।
শোভনেশও তাকিয়ে থেকেছিল তার চোখের দিকে, অবাক হয়ে। প্রায় তিরিশ সেকেন্ড এইভাবে ওরা ছিল। রোহিণী তার অপলক কাঠিন্য নরম করেনি। শোভনেশের চাহনিতে কিন্তু ক্রমশ প্রীতিভরা তারিফ ফুটে ওঠে। কথা না বলে সে প্রায় ছুটে গিয়ে আর একটা টোম্যাটো রস নিয়ে এসে এগিয়ে দিয়ে মৃদুস্বরে বলে, ‘নাও।’
রোহিণীর গ্লাসধরা মুঠিটা শোভনেশ চেপে ধরে রেখেছিল কিছুক্ষণ। ‘নিন’ না বলে ‘নাও’, রোহিণীর কাছে সম্বোধনের এই বদলটা এড়াল না। ধীরে ধীরে তার চোখ নরম হয়ে আসে। ঠোঁটে হাসি ফোটে।
‘একটু ঢেলে দিন।’ সে গ্লাস এগিয়ে দেয়। শোভনেশ মাথা নাড়ে অসম্মতি জানিয়ে, বলে, ‘তোমার ছবি আমি আঁকব!’
শোভনেশ পিঠে হাত রাখল। রোহিণীর তখন মনে হয় নাতিগরম সেঁকের মতো হালকা চাঞ্চল্যকর একটা অনুভব তার শরীর স্পর্শ করেছে। হাতটা পিঠ থেকে নীচে নামছে তার দেহের কোমল বর্তুলতা জরিপ করতে করতে। শোভনেশের লম্বা হাত যতদূর নীচে নামতে পারে ততটাই পৌঁছে নিতম্বের উপর সফর করে আবার একইভাবে ঘাড় পর্যন্ত উঠে এল।
রোহিণী প্রথমে এত অবাক হয়ে পড়ে যে, হাতটা ঠেলে সরিয়ে দেবে, বা নিজেকে সরিয়ে নেবে, দুটোর কোনোটাই করতে পারল না। বাবা মারা যাবার পর তার দেহে এমন নিশ্চিন্তে কোনো পুরুষ হাত দেয়নি। বিক্ষুব্ধ কোনো প্রতিক্রিয়া তার মধ্যে ঘটল না। মেয়েদের প্রকৃতিদত্ত বোধ থেকেই সে বুঝেছে হাতটা নোংরা নয়। তার দেহকে এই হাত অসম্মান করছে না।
‘অ্যাভারেজ বাঙালি মেয়ের তুলনায় তুমি অনেক লম্বা। কত হাইট?’
‘পাঁচ—আট।’
‘মাই গড! ওজন?’
‘মাস ছয়েক নিইনি। আটান্ন থেকে ষাট কেজির মধ্যে বোধ হয়।’
‘ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স নিয়ে কৌতূহল যদিও খুব প্রবল, তবু প্রশ্ন করব না। অনুমান করে নিয়েছি।’
‘এবার কিন্তু আমার হাত থেকে গ্লাস পড়ে যাবে।’
‘গ্লাস তো ছবি নয়!’
‘দুটোতেই কাচ আছে, দুটোই ভঙ্গুর।’
‘কিন্তু ভঙ্গুরতার মধ্যেই তো আনন্দ রয়েছে। হুইস্কি বা টোম্যাটোর রস বা নিসর্গচিত্র কোনোটাই অদরকারি নয়। তুমি কোনটা বেছে নেবে?’
‘ছবিটাকে মানে নিসর্গচিত্রকে, আপনি কোনটা বাছবেন?’
‘তোমাকে।’
‘আপনি বোধ হয় একটু বেশি খেয়ে ফেলেছেন।’
ঠিক এই সময়ই বেঁটে এবং ভীষণ মোটা একটি লোক, রোহিণী যাকে ছবির প্রদর্শনীতে একটা চেয়ারে বসে থাকতে দেখেছিল, তাদের দিকে এগিয়ে এল। বরং বলা যায়, গড়িয়ে এল। পরনে খয়েরি স্যুট, হাতে গ্লাস।
‘ওরে ব্যাটা, তুই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ফুসুর ফুসুর চালাচ্ছিস আর—।’ লোকটি থেমে গেল। ফ্যালফ্যাল চোখে রোহিণীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এ তো আমার থেকেও লম্বা!’
‘আমার কলেজ—দিনের বন্ধু গঙ্গাপ্রসাদ ব্যানার্জি, প্রেস আছে, দু—তিনটে ম্যাগাজিন আছে। গঙ্গা কী নাম রে সেগুলোর?’
গঙ্গাপ্রসাদ স্থিরভাবে দাঁড়াতে পারছিল না। জিভ আড়ষ্ট হয়ে গেছে। চোখ বিস্ফারিত।
‘নাম দিয়ে কী হবে য়্যা, যে নামেই ডাক না কেন গোলাপকে—এই তো ইনি, এনার নাম কী আমি জানতে চেয়েছি?’
‘আমার নাম রোহিণী।’
‘গঙ্গা, আমি এর ছবি আঁকব।’
‘সে কী রে শোভু। তোর যে একজন কে আছে, যাকে ন্যাংটো করে শুইয়ে বসিয়ে ছবি আঁকিস, আবার এঁকে কেন?’
রোহিণী এই প্রথম শোভনেশকে বিব্রত এবং বিরক্ত হতে দেখল। কথার বিষয়টা এড়াবার জন্য তাড়াতাড়ি শোভনেশ বলল, ‘বেশি খেয়ে ফেলেছিস গঙ্গা, এবার বাড়ি যা। বরুণা আজ ঝাঁটার শক্তিপরীক্ষা করবে তোর পিঠে।’
‘সেইজন্যই তো তোর কাছে এলুম। বাড়ি পৌঁছে দিবি চল, নীচে গাড়ি রয়েছে। বরুণাকে তুই ফেস করবি। যা যা বানিয়ে বলার বলবি। এনার সঙ্গে…হ্যাঁ ভাই, কী যেন নাম বললে?’
‘রোহিণী।’
‘রোহিণী—নক্ষত্র, চন্দ্রপত্নী তাই তো? আপনার সঙ্গে—তোমার সঙ্গে, অনেক ছোটো তো, তুমিই বলি—পরে আলাপ করব, এই নাও আমার কার্ড, ঠিকানা ফোন নম্বর সব পাবে।’
কোটের পকেট হাতড়ে গঙ্গাপ্রসাদ কার্ড বার করে রোহিণীকে দিল। ওকে স্থিরভাবে দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য শোভনেশ ওর দুটো কাঁধ শক্ত করে ধরল।
‘লাগছে লাগছে ছাড়, ওরে বাবা আমি ঠিক আছি। আমার বডি, সোল, মেমারি, ইন্টালিজেন্স সব ঠিক আছে। এই রোহিণীর হাত থেকেই তো সেদিন ছবিটা পড়ে ভাঙল। কী, ঠিক বলেছি? মেমারি। তুই বললি ছবিটা ওকে প্রেজেন্ট করবি, আজও করিসনি। কী, ঠিক আছে মেমারি?’
অপ্রতিভ শোভনেশ তখন গঙ্গাপ্রসাদকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘চল এবার, অনেক হয়েছে। গাড়িতে তুলে দিয়ে আসি।’
‘অনেক মোটেই হয়নি। ছবিটা ওকে কবে দিবি বল? আমি গিয়ে দিয়ে আসব। রোহিণী তোমার বাড়ির ঠিকানাটা দাও, আমি গিয়ে দিয়ে আসব।’
‘আপনি এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? রোহিণী বিব্রত অথচ হাসিমুখ করে বলে। গঙ্গাপ্রসাদকে তার মজার লোক মনে হচ্ছে।
‘ব্যস্ত হব না? অ্যাঁ, ব্যস্ত হব না? শোভু বলল, হোয়াট আ বডি! ছবিটাকে কত গভীরভাবে দেখছে দ্যাখ। বাহ্যজ্ঞান রহিত একেই বলে। ছবি এদের হাতেই তুলে দিতে ইচ্ছে করে, আমি বললুম, দিয়ে দে প্রেজেন্ট করে। মনে থাকে যেন, আমি বললুম। ও বলল, কিছু মনে করবে না তো? বললুম, হ্যাঁ রে কী বললুম বল তো?’ গঙ্গাপ্রসাদ তেরচা চাহনিতে তাকাল শোভনেশের দিকে।
‘আপনার মেমারি বোধ হয়—’। রোহিণী হাসি চেপে মুখে উদবেগ ফুটিয়ে কথাটা বলতেই গঙ্গাপ্রসাদ আড়ষ্ট হয়ে গেল। দুলুনি বন্ধ করল। মনে হল, খোলসের মতো শরীর থেকে অপ্রকৃতিস্থ ভাবটা খসিয়ে দিচ্ছে। তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়ে সে বলল, ‘রোহিণী তুমি কী কোথাও চাকরি করো? বিয়ে হয়েছে?’
‘বিয়ে হয়নি আর একটা প্রাইভেট ফার্মে রিসেপশনিস্ট রয়েছি।’
‘কোথায়?’
‘এই কলকাতাতেই।’
‘বলবে না? ঠিক আছে। জেনে রাখো, ঠিকানা বার করে তোমার বাড়িতে গিয়ে ওই ছবি দিয়ে আসব।’
‘পারবেন বাড়ির ঠিকানা বার করতে?’
‘আমার নাম গঙ্গা ব্যানার্জি। এই চল্লিশ লাখের শহরে একটা আলপিন হারিয়ে গেলে খুঁজে বার করে দিতে পারব, আর এ তো একটা আস্ত মানুষ। রিসেপশনিস্টকে খুঁজে বার করা কী খুব শক্ত, এইরকম ফিগার যার? ছোটোখাটো ফার্মে নিশ্চয় তুমি নেই?’
রোহিণী শুধু স্মিত হাসিতে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেছিল। গঙ্গাপ্রসাদকে তারপর শোভনেশ টেনে নীচে নিয়ে যায়।
দিন দশেক পর রবিবার সকালে মা জানলা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘রুনু, দ্যাখ তো গাড়ি করে কারা এল?’
রোহিণী জানলায় এসে দেখে, মোটর থেকে গঙ্গাপ্রসাদ নামছে, হাতে কাগজে মোড়া জিনিসটি বোধ হয় সেই ছবিটাই, গাড়ির মধ্যে বসে আছে শোভনেশ।
দরজা খুলে সত্যি সত্যিই বিস্মিত চোখে সে গঙ্গাপ্রসাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘কী বলেছিলুম? কলকাতা শহরে তোমাকে খুঁজে বার করব ঠিক করলে, সেটা কারোর পক্ষেই এমন কিছু শক্ত কাজ হবে না।’
খাটে দুই হাঁটুতে মাথা রেখে অন্ধকারে রোহিণী বসে। স্মৃতির ঘর থেকে বেরিয়ে সে সুড়ঙ্গটায় এখন দাঁড়িয়ে। পা টিপে টিপে ছ—বছর আগের অতীত থেকে সে বেরিয়ে আসছে।
.
গঙ্গাদা আজ সকালে বললেন, ‘তাহলে তো ভয় পাওয়ার কথা নয়। এই তিরিশ চল্লিশ লাখ লোকের শহরে একজনকে খুঁজে বার করা কী সহজ ব্যাপার?’
আসলে বেশিরভাগ সাফল্যই হয়ে যাওয়ার ব্যাপার! সেদিন গঙ্গাদা তাদের বাড়িতে এসেছিলেন অনেকটা এইভাবেই। ঠিকানাটা পেয়ে গেছিলেন। হিমালয়ান পেইন্টসের কলকাতা অফিসে খোঁজ নিয়েছিলেন, রঞ্জন যোগলেকরের শ্বশুরবাড়িটা কোথায়? তার শালি কোথায় চাকরি করে? খুব সহজেই শুধু একটা টেলিফোনেই কাজটা হয়ে যায়। সুভাষ গায়েনের সঙ্গে দেখা, এটাও সেই হয়ে যাওয়ারই ব্যাপার। এমনকী, সিআইটি রোডটার নাম যে আচার্য সত্যেন বোস সরণি—এটা জানাও তো ওইভাবেই।
এখন ইচ্ছে করলে যে—কেউই তার ঠিকানা বার করে ফেলতে পারে। তাহলে তার নিরাপত্তাটা কোথায়?
রোহিণী অন্ধকার ঘরে পায়চারি শুরু করল। তার পায়ের শব্দে নীচের ফ্ল্যাটের লোকেরা, যদি ঘুমিয়ে না পড়ে থাকে, কী ভাববে? যা খুশি ভাবুক, তাতে তার কিছু আসে যায় না।
নিরাপত্তার কথা এবার ভাবতেই হবে, কিন্তু সেটা শোভনেশের ভয়ে নয়। বয়স, মেয়েদের যেটা সবথেকে বড়ো ঘাতক, একদিন তো দেখা দেবেই। ইদানীং মাঝে মাঝেই তার মনে হয়েছে, কতকাল সে একা এইভাবে চলতে পারবে? বয়স ক্রমশ বাড়বে। ধীরে ধীরে প্রৌঢ়ত্ব আসবে, তারপর বার্ধক্য, সে বুড়ি হবে। রোহিণী অবাক হতে হতেও ভয় পেল। তখন কে তাকে খাওয়াবে? এই ফ্ল্যাটে কতকাল আর গঙ্গাদা তাকে থাকতে দেবেন? কত বছর আর সে চাকরি করতে পারবে? ভাবতে ভাবতে রোহিণীর বুকের মধ্যে কনকনে একটা যন্ত্রণা উঠল। সে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল।
তাহলে আর রাজেনকে অপেক্ষায় রাখা ঠিক হবে না। এই শরীর সজীব তীক্ষ্ন সটান থাকতে থাকতেই নিরাপদ জায়গায় একে সরিয়ে রাখতে হবে। আজ ইডেনে বসে রাজেনকে সে যখন বলেছিল, ‘ধরে নিচ্ছি আমার কিছু ফিজিক্যাল অ্যাসেট আছে, কিন্তু কতদিন আর সেটা থাকবে? পদ্মপাতায় জলের মতোই তো মেয়েদের যৌবন।’ তখন সে দু—জনের মধ্যে বয়সের ব্যবধানটার কথা ভেবেই বলেছিল। পুরুষের লোভ তো মেয়েদের যৌবনের দিকেই। বউয়ের যৌবন ধসে পড়লে স্বামীরা ওপরের তুষার দত্তর মতো হয়ে যায়। রাজেনও হতে পারে, এইরকম আভাসই সে ওকে দিয়েছে।
কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে, বয়সটাকে বাধ্য হিসাবে দেখার কোনো যুক্তি নেই। তার থেকে কমবয়সি লক্ষ লক্ষ বাঙালি মেয়ের থেকেও সে বেশিদিন যৌবন ধরে রাখতে পারবে, এই প্রত্যয় তার আছে। রাজেনকে তার ভালো লাগে বললে কম বলা হবে, ওর সান্নিধ্য সে প্রার্থনা করে। রাজেনের ক্ষমতা আছে মন প্রসন্ন করে তোলার। স্ত্রী হিসাবে নিজেকে ভাবলে, ওর কাছে নিজেকে সমর্পণ করার চিন্তায় তার মনে আড়ষ্টতা আসে না, যেটা শোভনেশের সঙ্গে আসত।
রাজেনের শরীরে জোর আছে, পুরুষালি দেখতে, ভালো মাইনের চাকরি, শিক্ষিত তো বটেই। বনেদি বাড়ির ছেলে, সেটা চালচলনে বোঝা যায়। সবথেকে বড়ো কথা, সব কিছু জেনেই সে বিয়ে করতে চেয়েছে। কাল কি ওকে বলব রাতে খাবার জন্য? অনেক দিন সে গাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেছে, তিনতলায় উঠে দরজা পর্যন্তও এসেছে, কিন্তু ফ্ল্যাটের ভিতরে ঢোকেনি। রোহিণী তাকে একটু বসতে, এক কাপ চা খেয়ে যেতে অনুরোধ করেছে। রাজেন রাজি হয়নি। অদ্ভুত সংযমী প্রেমিক! ‘যতদিন না তুমি বউ হতে রাজি হচ্ছ, আমি ভেতরে যাব না।’ ছেলেমানুষের মতো অভিমান দেখিয়েছে। অথচ আমার হাতের রান্না খেতে চায়!
রোহিণী বালিশে মুখ চেপে হেসে ফেলল। রান্না খেতে গেলে যে ফ্ল্যাটে ঢুকতে হবে, বলার সময় সেই খেয়াল ওর ছিল না। কাল দুপুরে টেলিফোন করবে অফিসে। প্রথমেই ওকে এটা মনে করিয়ে দিতে হবে।
কাজের মেয়েটা পালিয়েছে, নিজেকেই কাল দোকান আর বাজার বয়ে আনতে হবে। কী রাঁধবে? নুডলসের কিছু? ভাতের কী ময়দার সঙ্গে খাওয়া যায় মাছের কী চিকেনের কোনো প্রিপারেশন? মহারানিতে ‘খাবার—দাবার’ বিভাগটা দেখে উৎপল। মেয়েদের নাম দিয়ে ও নাকি নিজেই লেখে। উৎপলের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
তার ঘুম আসছে এবার। শরীর আলগা হচ্ছে, চোখের পাতা ভারী হচ্ছে। উপরের ফ্ল্যাটে ঘড়ির কুক্কুটা দু—বার ডেকে উঠল। রোহিণী ঘুমিয়ে পড়ার আগে আগামীকালের জন্য করণীয় কাজগুলো পর পর মনে করতে চাইল। বাজার যাওয়া, অফিসে গঙ্গাদার কাছ থেকে জেনে নেওয়া, উনি পুলিশের কাছ থেকে যা জেনেছেন। রাজেনকে আর অপেক্ষা করানো নয়। এবং সব শেষে নিজেকে বলল, রোহিণী, ভয় পাচ্ছ কেন? এমন কিছু অসাধারণ নও যে, জীবন নিয়ে তোমাকে গোলমালে পড়তে হবে। লক্ষ লক্ষের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দাও, তাহলে কেউ আর তোমায় খুঁজে পাবে না।
পাঁচ
কলিং বেল বাজছে।
রোহিণী চোখ খুলল। হাত বাড়িয়ে টেবল থেকে হাতঘড়িটা তুলে চোখের কাছে আনল। ছ—টা দশ! প্রায় লাফ দিয়ে খাট থেকে সে নামল। এত বেলা পর্যন্ত বিছানায় থাকা জীবনে পাঁচ—ছ—বারের বেশি ঘটেনি। নিজের দিকে ঘাড় হেঁট করে তাকিয়ে সে গায়ের ম্যাক্সিটা নাড়িয়ে নিল। ভিতরে কিছু পরা নেই।
আবার বেল।
দরজার দিকে যেতে অপাঙ্গে আয়নায় নিজেকে দেখে নিয়ে রোহিণী চুল ঠিক করতে করতে আই—হোলে চোখ রাখল। কী আশ্চর্য, অফিসের বেয়ারা কমল, অর্থাৎ কমলদা! এত সকালে? ছ্যাঁত করে উঠল তার বুকের মধ্যে! কারোর কিছু হয়নি তো? ম্যাক্সির গলার কাছটা টেনেটুনে যতটা সম্ভব খোলা জায়গাটা ঢেকে সে লক ঘুরিয়ে দরজা খুলল।
‘আরে কমলদা, আপনি?’
রোহিণী আর কিছু বলার আগেই কমল মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, ‘দিদি, কাল একটা ভুল হয়ে গেছে। ঠিক ভুল নয়, গলদই বলতে পারেন। আপনাকে দেবার জন্য প্রশান্তবাবু একটা চিঠি দিয়েছিলেন, খুব জরুরি চিঠি। রাত্রেই আপনার কাছে পৌঁছে দিতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি আসতে পারিনি।’ খামটা সে রোহিণীর হাতে দিল।
‘ভেতরে আসুন।’
রোহিণীর পিছনে কমল ভিতরে এল। দু—জনে ডাইনিং টেবলে বসল। চিঠিটা পড়তে পড়তে তার ভ্রূ কুঁচকে উঠল। কমল সেটা লক্ষ করে বলল, ‘লেখাটা যে কী করে হারাল, কেউ বলতে পারল না। অথচ পরশু আমার হাতেই দুপুরে দিয়ে গেল, আমিও সেটা উৎপলবাবুর টেবিলে রাখলাম। কাল প্রেসে পাঠাতে গিয়ে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। সারা অফিস তন্ন তন্ন করে সন্ধে পর্যন্ত খোঁজা হল। আজ সকাল এগারোটার মধ্যে প্রেসে পৌঁছে দিতেই হবে। প্রশান্তবাবু চিঠি লিখে আমাকে বললেন, তুমি তো মানিকতলার দিকে চালতাবাগানে থাক, তোমার অসুবিধে হবে না যেতে। সোজা আগে সল্টলেকে গিয়ে এখুনি এটা রোহিণী দিদিকে দিয়ে তারপর বাড়ি যেয়ো। উনি যেন রাতেই লিখে রেখে দেন। তুমি সকালে ওর কাছ থেকে লেখাটা নিয়ে বেলেঘাটায় প্রেসে দিয়ে আসবে। কিন্তু আমি কাল আর আসতে পারিনি।’
করুণ মুখে কমল তাকিয়ে রইল। রোহিণী আবার চিঠিটা পড়ল। বিব্রত কণ্ঠে এবং চাপা বিরক্তি নিয়ে সে বলল, ‘কিন্তু আমি গ্রহ নক্ষত্র রাশিফলের কী জানি? আমাকে এসব লিখতে বলা কেন? আমার তো সকালে কাজ রয়েছে। রাতে একজনকে খেতে বলেছি, এখন আমি বাজার যাব।’
‘প্রশান্তবাবুকে উৎপলবাবুই বললেন, রোহিণী রাশিফল রেগুলার পড়ে না, মাথাও ঘামায় না, ওকেই লিখে দিতে বলুন। মহারানির পুরোনো তিন—চারটে সংখ্যা আর ইংরিজি বাংলা ম্যাগাজিনের থেকে এটা ওটা নিয়ে আধ ঘণ্টাতেই নামিয়ে দিতে পারবে।’
‘উৎপলবাবু নিজেই তো অফিসে বসে করে দিতে পারতেন, ‘খাবার—দাবার’ তো উনি এইভাবেই লেখেন।’ রোহিণী একটু ঝাঁঝের সঙ্গেই বলল। সে শুনেছে, উৎপল প্রায়ই ক্ষোভ জানায় এই বলে যে, রোহিণীকে দিয়ে কোনো কাজই করানো হয় না, শুধু গ্ল্যামারাস কভারেজ ছাড়া। ‘গঙ্গাবাবুর স্নেহের ধারাটা শুধু একদিকেই প্রবাহিত হয়।’ কথাটা প্রথম শুনে রোহিণীর মাথা গরম হয়ে গেছিল। গঙ্গাদাকে সে কিছু বলেনি, তবে নিজের থেকেই সে সম্পাদক প্রশান্ত হালদারের কাছে কাজ চেয়ে নেয়। ‘বসিয়ে মাইনে দেওয়া হচ্ছে’, এই ধারণাটা অফিসে চাউর হয়ে গেছে। বোধ হয় উৎপলেরই কাজ।
‘দিদি, কাল আমার মেজোছেলে ইউনিভার্সিটি যাওয়ার সময় বাসের ধাক্কা লাগে। মেডিকেল কলেজে ভরতি হয়েছে। ওকে দেখতে গিয়েছিলাম, বড্ড রাত হয়ে গেল তাই আর আসতে পারিনি।’
‘সে কী! কখন হল? ছেলের বয়স কত?’ রোহিণী চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। হাত—পা শক্ত হয়ে গেছে।
‘এই তো চব্বিশে পড়ল গত পৌষে। ইংরিজিতে এম এ পড়ছে। অফিস থেকে বেরোচ্ছি, তখন হন্তদন্ত হয়ে মেয়ে এসে খবরটা দিল। দুপুরেই হয়েছে। খুব সিরিয়াস নয়, তিনটে পাঁজর ভেঙেছে। অপারেশন হয়েছে, ভালোই আছে। আপনি লিখে ফেলুন, ততক্ষণে আমি আপনার বাজার করে আনি।’
‘না না, সে কী কথা। আমি লিখে ফেলছি। আপনি বসুন, চা করি।’
কমল নাছোড়বান্দা। বার বার বলতে লাগল, ‘ছেলে ভালো আছে, তার জন্য কোনো দুশ্চিন্তা এখন আর নেই। থলেটা দিন আর কী কী আনতে হবে বলুন, বাসে করে মানিকতলা গিয়ে বাজার করে এনে দিচ্ছি। বড়োজোর এক ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসব।’
মায়া হল রোহিণীর। রোগা, দুবলা, কাঁচাপাকা দাড়ি ভরা মুখ। আধ ময়লা ধুতি আর ফিকে নীল হাফ শার্ট। অফিসের জরুরি কাজটা করতে না পারার জন্য যেন মরমে মরে আছে। তার জন্যই রোহিণীদির বাজার করা হবে না, এটা যেন আরও বেশি ওকে অপরাধী করে তুলেছে। এখন যেন হালকা হবে দিদির জন্য কিছু একটা উপকার করে দিতে পারলে।
‘আচ্ছা, থলি দিচ্ছি।’
রোহিণী ডিক্সনারির মধ্য থেকে একশো টাকার একটা নোট বার করে কয়েক মুহূর্ত ভাবল। চর্ব্য—চোষ্য রাঁধার সময় নেই, সময় থাকলেও উপায় নেই, উপায় থাকলেও চীনে বা মোগলাই তিন—চারটের বেশি সে জানে না। ছিমছাম হলেই হবে। রাজেন তো ভোজ খেতে চায়নি, শুধু তার হাতের রান্না খেতে চেয়েছে।
‘কমলদা, মাছ আনবেন। ভাজা খাওয়া যায় এমন, ভেটকি, বাগদা কী পার্শে কী তপসে। ফাইন সরু চাল এক কিলো, কড়াপাকের সন্দেশ দশ টাকার, দই আড়াই শো। একজনকে খেতে বলেছি, খুব হালকা রান্না করব। বুঝতেই পারছেন এক হাতে বেশি তো করে উঠতে পারব না।’
কমল থলি নিয়ে যাবার সময় বলে গেল, ‘পৌনে আটটার মধ্যেই আসছি।’
রোহিণী চিঠিটা চোখের সামনে ধরে দ্রুত ভেবে নিল। উৎপল তাকে মুশকিলে ফেলার জন্য রাশিফল তৈরি করার ঝামেলাটা ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। ঠিক আছে, দেখিয়ে দেব ঝঞ্ঝাটে কাজ পারি কিনা। মহারানির পুরোনো সংখ্যা দেখে লাভ নেই। ধরা নাও পড়তে পারে, কিন্তু উৎপল যে বেনামা চিঠি সম্পাদককে লিখে তাকে অপদার্থ প্রমাণ করবে না তারও গ্যারান্টি নেই। ভালো করে টুকতেও জানে না, ভাষাটাসা বদলে, এটা ওখানে সেটা এখানে করে লেখা দাঁড় করাতেও শেখেনি—এই সব কথা যেন না শুনতে হয়।
সবথেকে ভালো হয় ইংরিজি ম্যাগাজিন থেকে টুকলে। মহারানি যারা পড়ে, তারা ইংরিজি অতশত বোঝে না, পড়ে না। কিন্তু তার কাছে যেসব ম্যাগাজিন আছে, তাতে তো রাশিফল থাকে না। তাহলে? আগে বাথরুম আর দাঁত মাজাটা তো সেরে নিই। ব্যায়াম করার জন্য আজ আর সময় দেওয়া যাবে না। দু—হাত তুলে শরীরটা টেনে, দু—পাশে বাঁকিয়ে আর হাঁটুতে নাক ঠেকিয়ে নমো নমো করে কাজটা সে সেরে নিল।
চায়ের জল বার্নারে চড়িয়ে রোহিণী দাঁত মাজতে মাজতে দরজা খুলে বারান্দায় এল। শুকিয়ে গেছে সায়া, ব্রা। এবার এ দুটো পরা দরকার। মুখ ধুয়ে চা বানিয়ে খেতে খেতে সে মনে করার চেষ্টা করল এই বাড়িতে, চটুল ধরনের কিন্তু গাম্ভীর্যের মুখোস— পরানো ইংরিজি ম্যাগাজিন কারা রাখতে পারে? সাতটি ফ্ল্যাটের থেকে ছাঁটাই করতে করতে অবশেষে দোতলার প্রৌঢ়া বিধবার ফ্ল্যাটটিকে সে অনুমানে প্রথম স্থান দিল।
বিধবার জন্য নয়, তাঁর যুবক বোনপো আর তার বউয়ের হাবভাবের, পোশাক—আশাকের কথা ভেবেই। টেপ ডেক আছে, প্রায় রাতেই পপ গান বাজায়। ঘরের মধ্যে হয়তো নাচে টাচেও। একটা সাদা মারুতি আছে। ভোরে দু—জনে জগ করতে বেরোয়। বোধ হয় কোনো মাল্টি ন্যাশনালে রাজেনের মতোই ম্যানেজমেন্টের জুনিয়র স্তরের একজিকিউটিভ। রাজেন ঠাট্টা করে এদের সম্পর্কেই বলে, ‘আওয়ার হোম—গ্রৌন ইউপ্পিস, ইয়াং আরবান প্রফেশ্যনালস অর্থাৎ এককথায় আপস্টার্ট, সোজা বাংলায় উঠাই—গিরাই।’ আপাতত, রাশিফল আছে এমন ইংরিজি ম্যাগাজিন যদি রাখে, তাহলে ওরা ইউপ্পি, উড়িপি, যা খুশি হোক, তাতে তার কিছু আসে যায় না।
ম্যাক্সি থেকে শাড়ি, চুলে ঝমাঝম চিরুনি, তারপর তিন মিনিটের মধ্যেই রোহিণী দোতলায় পিতলের পাতে ‘দত্তরায়’ লেখা দরজায় কলিং বেলের বোতামে আঙুল রাখল।
দরজা খুলল বউটিই। বয়স বাইশ—তেইশ, শীর্ণ দেহটি সোয়েট স্যুটে মোড়া। বোধ হয় জগিং সেরে কিছুক্ষণ হল ফিরেছে। কোমর পর্যন্ত খোলা চুল, লম্বাটে মুখ, গালে ব্রণর দাগ, সিঁথেয় অস্পষ্ট সিঁদুর, লম্বা নখে রং এবং চোখে প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে বিগলিত হাসি ফুটল। মেয়েটির মুখ তাতে মিষ্টি দেখাল।
রোহিণীর দ্বিতীয় একটা গলার স্বর আছে। খসখসে, চাপা, অনেকটা সর্দিধরা স্বরের মতো। শুনলে গা সিরসির করে। এই স্বরটা সে লোক বুঝে, খুব আধুনিক, উচ্চচ মহলে বিতরণ করে, সফিস্টিকেটেড, ইংরেজিতে কথা বলে গদগদ হয় এমন মানুষদের সঙ্গে কথা বলার সময় ব্যবহার করে। রাজেনের সঙ্গে প্রথম আলাপের সময় ব্যবহার করেছিল, পরে আর করেনি। ঠাট্টা করে রাজেন অনেক দিন বলেছে, ‘তোমার সেকেন্ড ভয়েসটা একটু বার করো তো, দারুণ সেক্সি লাগে।’
রাজেন যত ঠাট্টাই করুক, রোহিণী দেখেছে, শতকরা পঁচানব্বই ভাগ ক্ষেত্রে এই গলাটা কাজ দিয়েছে। যেমন এখন সে দ্বিতীয় গলায় বলল, ‘ভাই খুব মুশকিলে পড়ে গেছি, তোমাদের কাছে এমন কোনো ইংলিশ ম্যাগ আছে, যাতে স্টারস অ্যান্ড প্ল্যানেটসের পোজিশ্যনকে বেস করে ফোরকাস্ট, মানে…ইয়ে কী বলব…।’
‘রাশিফল?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আছে?’
‘আমি তো অত লক্ষ করি না, আপনি ভিতরে আসুন, আমি দেখছি।’
রোহিণী ভিতরে ঢুকল। এই বাড়ির সব ফ্ল্যাটের নক্সাই একরকম। ঘরের মাঝে নীচু টেবলটার নীচে তাক থেকে বউটি কতকগুলো ম্যাগাজিন বার করে রোহিণীর সামনে রাখল। প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল সে ওগুলোর উপর। সূচিপত্র দেখল, পাতা ওলটাল, কিন্তু বাঞ্ছিত জিনিসটি পেল না।
‘আচ্ছা, আমি ওকে জিজ্ঞাসা করে দেখি, বাথরুমে রয়েছে। ওর এসবে কিওরোসিটি আছে।’
অতঃপর একটা ম্যাগাজিনের পাতা ধীরে ধীরে ওলটাতে ওলটাতে রোহিণী কান খাড়া করে রইল। বাথরুমের দরজা দেখা যাচ্ছে না কিন্তু সে জানে ওটা কোথায়।
খট খট শব্দ এবং ‘এই শুনছ।’
বাথরুমের ভিতর থেকে হুসস ধরনের একটা শব্দ উঠল। তারপর চাপা স্বরে, ‘ওপরের সেই ভদ্রমহিলা এসেছেন।’ এবার সংক্ষিপ্ত একটা খ্যাক ধরনের শব্দ বেরিয়ে এল। ‘আরে সেই তিনতলার, যার হিপ সোফিয়া লোরেনের মতো সুইং করে বলেছিলে, সেই। …না না বেরোতে হবে না। উনি এসেছেন একটা জিনিসের খোঁজে, তুমি কী বলতে পারো…’
রোহিণীর কান ততক্ষণে বন্ধ হয়ে চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেছে। হাতের ম্যাগাজিনটার খোলা পাতায় তার দৃষ্টি আটকে।
একটা প্রবন্ধ, যার শিরোনাম অনুবাদ করলে দাঁড়ায়: ‘লালসার আগুনে ভস্মীভূত শিল্পীরা।’ লেখক সিধারথ সিনহা। কয়েকটা ছবি, তার মধ্যে একটা শোভনেশের আঁকা নগ্ন নারীর। ভারতের চারজন নামি নাট্যকার—পরিচালক, ফিল্ম অভিনেতা, ক্ল্যাসিকাল গায়ক আর শোভনেশকে নিয়ে লেখাটা। বোধ হয় উদাহরণ দেওয়ার জন্য এদের রাখা হয়েছে। তিনজনের ছবি রয়েছে শুধু শোভনেশেরই নেই। নিশ্চয় পায়নি, তাই নেই। বদলে ওরই আঁকা একটা ছবি ছেপেছে।
কী লিখেছে শোভনেশ সম্পর্কে, সেটা দেখার জন্য যখন রোহিণীর দৃষ্টি প্রবন্ধের উপর দিয়ে ওঠানামা করছে, তখন বউটি ঘরে ঢুকল। এক কোণে স্তূপ হয়ে পড়ে আছে ইংরেজি খবরের কাগজ। তার থেকে ঘেঁটে একটা খুদে আকারের আট পাতার ট্যাবলয়েড বার করে আনল।
‘এই যে আপনি যা চাইছিলেন।’ বউটির মুখ সাফল্যের গর্বে উদ্ভাসিত। ‘দারুণ মেমারি ওর, ঠিক বলে দিল।’
‘আচ্ছা, আমি যদি এটা পড়ার জন্য নিয়ে যাই, তোমাদের কি অসুবিধে হবে?’ রোহিণী ম্যাগাজিনটা দেখিয়ে গড়গড়িয়ে এবং তার নিজস্ব গলায় বলল। তার মানসিক স্থৈর্য আর পরিপাটি নেই।
‘না না, আপনি নয়ে যেতে পারেন। আমাদের তো দেখা হয়ে গেছে।’
রোহিণী দুটি পত্রিকাই হাতে নিয়ে বেরোবার সময় নিজেকে গুছিয়ে ফেলে আবার তার মন্থর দ্বিতীয় গলার স্বরে ফিরে গেল। ‘তুমি অনেক ছোটো তাই আর আপনি—টাপনি বললাম না। কত দিন বিয়ে হয়েছে?’
‘সাত মাস।’
‘তাহলে তো এখন অনেকদিন ছুটিতে থাকবে।’ রোহিণীর অর্থপূর্ণ হাসির ইঙ্গিতের প্রতিবিম্ব অন্যদিকেও ফুটল।
‘নাম কী তোমার?’
‘কুন্তী।’
‘আহহ হোয়াট আ বিউটিফুল নেইম! পঞ্চপাণ্ডব পাব তো? আচ্ছা চলি ভাই।’
ভাই বললে ওর দিদি না বলে উপায় নেই। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে রোহিণী আন্দাজে টের পেল, কুন্তী দরজা বন্ধ না করে তাকিয়ে রয়েছে। নিশ্চয় সোফিয়া লোরেনকে দেখছে।
নিজের ফ্ল্যাটে এসে, ম্যাগাজিনটা পড়ার প্রচণ্ড ইচ্ছাটা দমন করে রোহিণী কাগজ—কলম নিয়ে ডাইনিং টেবলে বসল। লেখালেখির কাজ সে এখানে বসেই করে। ভস্মীভূত শিল্পীরা অপেক্ষা করতে পারবে কিন্তু গ্রহ—নক্ষত্রদের এক্ষুনি প্রেসে পাঠাতে হবে। কমলের ফিরে আসার সময় হয়ে এল।
এয়ারঈজ, টর্যাস, জেমিনি, ক্যানসার, লিও…রোহিণী পর পর বারোটি রাশির বাংলা নাম মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ ইত্যাদি লিখে সে কাগজটার তারিখ দেখল। মাস দেড়েক আগের এক রবিবার। অদলবদল না করে হুবহু বাংলা করে দিলেও কেউ ধরতে পারবে না। মহারানিতে রাশি পিছু গড়ে পাঁচ—ছ লাইন করে বেরোয়। ইংরেজি কাগজটাতেও তাই রয়েছে।
শোভনেশের আগ্রহ ছিল জ্যোতিষে। বিয়ের আগে একবার সে রোহিণীর কররেখা দেখেছিল। মিনিট পাঁচেক নীরবে গভীর মনোযোগে দেখার পর বলেছিল, ‘খুব জটিল নও। আবেগটা কম, অল্পে সন্তুষ্ট হও, বুদ্ধিচর্চার দিকেই ঝোঁক…’ তাকে থামিয়ে রোহিণী বলেছিল, ‘এসব বলার জন্য জ্যোতিষ জানার দরকার হয় না। আমিও বলে দিতে পারি হাত না দেখেই।’ শোভনেশ বলেছিল, ‘তাহলে কী জানতে চাও?’ রোহিণী হালকা স্বরে বলে, ‘মেয়েরা যা জানতে চায়। বিয়ে থা’, ছেলেপুলে, স্বামীর ভালোবাসা, গাড়ি, বাড়ি, গয়না।’ শোভনেশের মুঠোয় ধরা ছিল আঙুলগুলো। রোহিণীর করতল খুলে সে আবার তাকায়। ‘বিয়ে খুব শিগগিরই হবে। আর সেটা হবে আর্টের সঙ্গে যুক্ত কোনো লোকের সঙ্গে, সুখীও হবে।’
রোহিণী তখন হেসেছিল। বাড়ি ফিরে মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আমার কোনো কোষ্ঠীঠিকুজি আছে কি?’ মা জানিয়েছিল, নেই। বাবা এসবে বিশ্বাস করতেন না, তাই করানো হয়নি। শোভনেশের কোষ্ঠী ছিল। ওর ছিল বৃষ রাশি।
ট্যাবলয়েডে চোখ রাখল রোহিণী। দেড় মাস আছে শোভনেশের রাশি কী বলেছিল? ‘খরচ বাড়বে। বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ আসবে এবং তা গ্রহণ করলে লাভই হবে। বন্ধুদের সাহায্যে যশবৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। প্রণয়ের ক্ষেত্রে সফল হবেন, তবে সতর্ক থাকা দরকার। সন্তানের স্বাস্থ্য সম্পর্কে যত্নবান হতে হবে। কর্মক্ষেত্রে প্রভাব বৃদ্ধি পাবে।’
জেলে বসে শোভনেশের এই রাশিফল দেখার সুযোগ ছিল কি? সুযোগ থাকলে হো হো করে হেসে উঠে নিশ্চয় বলত, ‘যশবৃদ্ধি? প্রণয়? সন্তান? উরি ব্বাবা, তার ওপর বিদেশ ভ্রমণ, কর্মক্ষেত্রও! এতসব এখন সামলাব কী করে?’ কয়েদিদের কি খবরের কাগজ পড়তে দেওয়া হয়? কিন্তু রোহিণীর এখন এই নিয়ে মাথা ঘামাবার অবকাশ নেই। খসখস করে সে লিখে চলল। মাঝে একবার সে লেখা থামিয়ে অন্যমনস্ক চোখে টেবলে রাখা ম্যাগাজিনটার দিকে তাকিয়েছিল। কী লিখেছে শোভনেশ সম্পর্কে? হাত বাড়িয়ে ম্যাগাজিনটার মলাটে প্রকাশের তারিখ দেখল। ১ ডিসেম্বর। মাত্র দু—মাস আগের।
আটটা পঞ্চাশে কমল এল। তার সঙ্গেই পাউরুটি আর মাদার ডেয়ারির দুধের পাউচ হাতে গৌরীর মা—ও ঢুকল।
‘দিদি আপনার কথা রাখতে পারিনি। ইচ্ছে করেই রাখিনি। বাগদা, গলদা, পার্শে, তোপসে সবই ছিল কিন্তু কিনিনি।’
রোহিণীর জিজ্ঞাসু চোখের দিকে কমল তাকিয়ে অসাধ্য এক কাজ করে ফেলার মতো দাবি নিয়ে থলিটা তুলে বলল, ‘ইলিশ।’
‘অ্যাঁ’, এই অফ সিজনে?’
‘সেইজন্যই তো আপনার কথা অগ্রাহ্য করলুম। বাংলাদেশের চালানি মানে চোরা চালানি, আজ হঠাৎ এসে গেছে। একজনই নিয়ে বসেছিল, পঁয়ত্রিশ টাকা কিলো, সস্তাই বলতে হবে। সবথেকে ছোটোটা বারোশো গ্রাম, ওটাই আনলুম।’
‘খুব ভালো করেছেন, দেখি মাছটা!’
খুশিতে ঝকমক করে উঠল রোহিণীর চোখ। কমল কিন্তু কিন্তু করে বলল, ‘আমি যে কাটিয়ে আনলুম। আপনি কাটতে পারবেন কী না—।’
‘কী বলছেন কমলদা, বাঙালি মেয়ে আর ইলিশ কাটতে পারব না। ইসস আস্ত গোটা ইলিশ দেখতে যে কী টেরিফিক! কতদিন যে দেখিনি।’ থলিটা হাতে নিয়ে রোহিণী ফাঁক করে দেখল। মুখ নীচু করে ঘ্রাণ নিল। রাজেনকে শুধুই ভাত আর ইলিশ খাওয়াবে। তেল আর ভাজা আর ঝালসর্ষে দিয়ে ভাতে। ও ভীষণ ঝালের ভক্ত। কমলদাকে রীতিমতো খাদ্যরসিকই বলতে হবে।
‘আচ্ছা, আর একদিন আপনার জন্য আস্ত একটা আনব। …দিদি, লেখাটা?’
‘হয়ে গেছে। আর দু—মিনিট, কুম্ভ আর মীনটা বাকি। আপনাকে তো দশটার মধ্যে দিয়ে আসতে হবে। বরং ততক্ষণে দুটো ভাজা খেয়ে যান।’
রান্নাঘরের কলে গৌরীর মা বাসন মাজছিল। রোহিণী মাছ ভাজতে ভাজতে আবদারের গলায় বলল, ‘একটু সর্ষে, কাঁচালঙ্কা বেটে দেবে?’ তারপরই অনুযোগ করল, ‘তোমার ওই মেয়েটা বাপু না বলে—কয়ে কাল চলে গেছে। কেমন লোক দিলে তুমি?’
‘সে কী! চলে গেছে! আজকাল দিদি এইরকমই হয়েছে। কাজের লোক পাওয়া যে…তুমি বার করে রাখ, আমি নীচের ঘরের কাজ সেরে এসে কেটে দোব। তবে মেয়েটা ভালো, হাত—টান—ফান নেই। আমার সঙ্গে কাল আর দেখা হয়নি, আজই গিয়ে ওর মাকে জিজ্ঞেস করব, কেন কাজ ছাড়ল? চঞ্চলার মা—ইই তো আমাকে বলেছিল কাজ দেখে দেবার জন্য। ছ—টা ছেলেমেয়ে, মরুক গে। হ্যাঁ, দিদি, লোকটা কি তোমার আপিসের?’
‘হ্যাঁ!’ রোহিণী কড়া নামিয়ে বার্নার নিবিয়ে বলল, ‘গৌরীর মা, মাছগুলো তো সন্ধে পর্যন্ত তুলে রাখা যাবে না। কী করি বল তো।’
‘ওই জন্য বলেছিলুম একটা ফিজ কেনো। এ বাড়ির সবার ঘরে আছে, শুধু তোমার ঘরেই ফিজ, টিভি নেই।’ এমন ঘরে কাজ করাটা যে অগৌরবজনক, গৌরীর মা—র স্বর সেটাই জানিয়ে দিল।
‘কারোর ঘরে একবেলার জন্য যদি রাখা যায়! তুমি একটু দেখবে? সামনের মাদ্রাজিরা তো নিরামিষ, নন্দাদের ঘরেও রাখতে চাই না, ওদের সামনের ঘরের সঙ্গে আলাপ নেই। তুমি তো ওদের কাজ করো, একটু বলে দেখবে? আমি তো বলতে গেলে ওদের চোখেও দেখিনি আজ পর্যন্ত।’
‘কত্তা গিন্নি দু—জনেই খুব ভালো লোক। তুমি নিজে গিয়েই বরং বলো, সেটাই ভালো দেখাবে।’
দু—টুকরো মাছ ভাজা নিয়ে রোহিণী রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দেখল, কমল ম্যাগাজিনটা খুলে ঝুঁকে রয়েছে শোভনেশের আঁকা ছবিটার উপর। হঠাৎই ঝনঝন করে উঠল তার মাথার মধ্যে। প্রায় হুমড়ি খেয়ে রোহিণী টেবলের অপর প্রান্ত থেকে হাত বাড়িয়ে ম্যাগাজিনটা ছিনিয়ে নিল হতভম্ব কমলের হাত থেকে।
‘এসব আপনাকে দেখতে হবে না।’ কর্কশ স্বরে সে বলল এবং ম্যাগাজিনটা শোবার ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় ছুড়ে রেখে রোহিণী চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকল।
বিশ্রী রকমের অভব্যতা হল। কিন্তু মাথাটা কীরকম যে করে উঠল। কী মনে করছে কমলদা! ওইরকম ছবিওলা ম্যাগাজিন, ছোঁ মেরে সরিয়ে নিল। নিশ্চয় নোংরা অশ্লীল কিছু আছে যেটা লোককে দেখতে দিতে চায় না। বাজে মেয়ে, চরিত্র ভালো নয়, এইরকম ধারণা হওয়াটাই স্বাভাবিক। রোহিণী লজ্জায় মুষড়ে পড়ল।
কমল অন্যমনস্কের মতো মাছের কাঁটা বেছে খাচ্ছিল। ম্যাগাজিনটা হাতে নিয়ে রোহিণীকে আসতে দেখে মুখ তুলে হাসল।
‘লেখাটা শেষ করে ফেলি।’
কাগজ—কলম নিয়ে রোহিণী কুম্ভ রাশিটা শুরু করল। মনে মনে সে কুঁকড়ে আছে।
‘দিদি, মনটা খুব উতলা হয়ে রয়েছে ছেলের জন্য…আমি ইংরিজি পড়তেও পারি না। ছবিটা ভালো লাগছিল দেখতে, তাই—’
রোহিণী অবাক হয়ে কমলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভালো লাগছিল?’ তারপরই সম্বিত ফিরিয়ে এনে বলল, ‘কমলদা, আমি সেজন্য কিছু মনে করিনি। আমারও মনটা একটা ব্যাপারে উতলা হয়ে রয়েছে। এই ম্যাগাজিনটায় একটা লেখা বেরিয়েছে আমার স্বামীর সম্বন্ধে। এখনও পড়া হয়ে ওঠেনি। আপনি কী জানেন, আমার স্বামী একজন আর্টিস্ট ছিল, সে এখন জেলে?’
কমল তার দুশ্চিন্তা—জর্জরিত স্তিমিত চাহনি রোহিণীর সন্ত্রস্ত এবং ব্যগ্র চোখে রেখে বলল, ‘লেখাটা তাড়াতাড়ি শেষ করে নিন।’
মাথা নামিয়ে রোহিণী লেখায় মন দিল। গৌরীর মা—র ঝাঁট দেবার শব্দ ছাড়া ফ্ল্যাট নিঝুম। দালানের এক ধারে বেসিনের কলে হাত ধুয়ে এসে কমল কাগজগুলো নিয়ে ভাঁজ করে পকেটে রেখে বলল, ‘মাছটায় স্বাদ আছে।’
গৌরীর মা ঝাঁট দেওয়া শেষ করেছে। রান্নাঘর থেকে বলল, ‘দিদি তোমার টোস করে রাখছি, পরে এসে ঘর মুছে দোব’খন।’
‘কমলদা, আপনার ছেলের জন্য আমিও দুশ্চিন্তায় থাকব। নিশ্চয় হসপিটালে একবার যাবেন। দুপুরে অফিসে অবশ্যই বলবেন, কেমন আছে।’
‘বলব।’ তারপর ইতস্তত করে কমল বলল, ‘অফিসে আপনার সম্পর্কে অনেকে অনেক কথাই বলে, কিন্তু আমি তাতে কান দিই না। স্বামী যদি অন্য কোনো মেয়েকে খুন করে, সেটা তো স্ত্রীর দোষ নয়। কিন্তু অনেকের ধারণা, স্ত্রীরই দোষ।’
‘কী দোষ?’ রোহিণী বিভ্রান্ত, উৎকণ্ঠিত হয়ে জানতে চাইল। ‘আমি তো খুন করতে বলিনি, প্ররোচিতও করিনি।’
কমল হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। ‘আমি ওদের বুঝি না। এরা এইরকমই, পরচর্চা, পরনিন্দা ছাড়া আর কিছু বোঝে না। যার স্বামী যাবজ্জীবনের জন্য জেলে, সে যদি কোনো পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করে তাতে দোষটা কোথায়? কিন্তু অনেকের কাছে সেটাই দোষের। যাবজ্জীবন মানে তো তার বউ বিধবাই। বিধবার কী বিয়ে হয় না আমাদের দেশে? আমিই তো করেছি।’
কমলের শীর্ণ চোপসানো মুখ, কাঁচাপাকা দাড়িসমেত উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ‘গরিব বামুনের মেয়ে, এক সময় পরিচয় ছিল। আমার নীচু জাত, তাই ওরা বিয়ে দিতে রাজি হয়নি। তাড়াতাড়ি এক জায়গায় বিয়ে দিয়ে দেয়। বিয়ের এক বছর পরই বিধবা হয়, এসব ছাব্বিশ বছর আগের কথা।’
কমল চলে যাবার পর রোহিণী কিছুক্ষণ বসে প্রৌঢ় লোকটির কথা ভাবল। ঠান্ডা প্রকৃতির নিরীহ স্বল্পবাক। পঁচিশ বছর ইস্টার্ন ম্যাগাজিনসে রয়েছে। ধুতি—শার্ট আর চটি ছাড়া অন্য পোশাকে কেউ ওকে দেখেনি। উচ্চচাকাঙ্ক্ষী, ভদ্র ডিসিপ্লিনড জীবন। ছেলে ইংরাজিতে এম এ পড়ছে। রোহিণীর মনে হল, এই সব লোকের সঙ্গে আলাপ করলে জীবনের জ্বালা—যন্ত্রণাগুলো নিবিয়ে ফেলতে সাহায্য পাওয়া যায়। এখন সে শান্ত বোধ করছে।
টোস্ট আর দুধ খাবার টেবলে রেখে দিয়ে, গৌরীর মা আর এক ঘরের কাজ সারতে চলে গেছে। যাবার আগে ভাত চড়িয়ে দিয়ে গেছে। ম্যাগাজিনটা নাড়াচাড়া করতে করতে রোহিণী ভাবল, মাছের টুকরোগুলো অপরিচিত জনের কাছে নিয়ে গিয়ে ফ্রিজে রাখার অনুরোধ জানানোটা কতটা সংগত হবে? তার আগে বাথরুম যাওয়া, স্নান করা, তারও আগে ভাতটা নামানো। এইসব ভাবতে ভাবতে সে পাতা খুলে ‘লালসার আগুনে ভস্মীভূত’ প্রবন্ধে খুঁজতে শুরু করল।
শেষের দিকে শোভনেশের কথা। প্যারাগ্রাফের প্রথম বাক্যটি পড়েই সে চমকে উঠল।
.
‘শোভনেশ সেনগুপ্তর বংশে অদ্ভুত একটা ধারা আছে। উন্মাদ হওয়ার। তার পিতামহের পিতামহ শ্যামাচরণ, ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বিধবা মায়ের সঙ্গে হুগলির এক গ্রাম থেকে উত্তর কলকাতায় মামার বাড়িতে আসেন ছয় বছর বয়সে। প্রাথমিক শিক্ষা হেয়ার স্কুলে। খুব অল্প বয়সে মামাদের কাগজের ব্যবসায়ে শিক্ষানবিশি শুরু করে পরে পাটের দালালিতে নামে। প্রচুর বিত্ত তিনি সঞ্চয় করেছিলেন। মধ্য কলকাতার বউবাজার অঞ্চলে এক বিঘা এলাকা নিয়ে তৈরি বিশাল জরাজীর্ণ বাড়িটি এখনও তাঁর সমৃদ্ধির সাক্ষ্য বহন করছে। শ্যামাচরণ সন্দেহ ও ঈর্ষার বশে গলা টিপে হত্যা করেন তাঁর রক্ষিতাকে। কিন্তু বিচারের সময় দেখা যায়, তিনি সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে গেছেন।
‘শ্যামাচরণের তিন পুত্র। জ্যেষ্ঠ দ্বারিকনাথ বাবার ব্যবসা ছাড়াও স্টিমার কিনে পরিবহন ব্যবসায়ে নেমে পৈতৃক সম্পদ আরও বাড়ান। মেজোছলে ইংল্যান্ড যান এবং এক ইংরেজ রমণীকে বিবাহ করেন। শ্যামাচরণ তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন। ছোটোছেলে অল্প বয়সে ধনুষ্টংকারে মারা যান। দ্বারিকনাথ একবার ক্রোধের বশে তাঁর এক কর্মচারীকে এমন প্রহার করেন যে তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। এর দু—বছর পর তিনি স্ত্রীকে হাত—পা বেঁধে ছাদের এক কুঠুরিতে সাতদিন বন্ধ করে রাখেন। জলটুকুও খেতে দেননি। অবশেষে বাড়ির এক ঝি পুলিশে খবর দেয়। তাকে মৃতপ্রায় অবস্থায় ঘর থেকে উদ্ধার করা হয়। দ্বারিকনাথ তখন খুলনায় গিয়েছিলেন। পুলিশ তাঁকে সেখানে গ্রেফতার করতে গেলে তিনি স্টিমার থেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে ডুবে মারা যান।
‘দ্বারিকনাথের তিন কন্যা ও এক পুত্র। বিবাহের তিন বছর পর বড়ো মেয়ে তরলাবালা উন্মাদ হয়ে যান। বাষট্টি বছর বয়সে তাঁর মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তিনি বাপের বাড়িতে একটি বদ্ধ ঘরে নিঃসঙ্গ জীবন কাটান। কিন্তু পুত্র রামচন্দ্র বা অন্য দুই মেয়ে স্বাভাবিক জীবনই যাপন করে পরিণত বয়সে মারা যান। বস্তুত এই সময় থেকেই সেনগুপ্তদের পাগলের বংশ, এমন একটা ধারণা কলকাতায় চাউর হয়ে যায়। বৈবাহিক সম্বন্ধ গড়ার প্রস্তাব পরপর প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় বহু অর্থব্যয়ে দ্বারিকনাথ তাঁর বাকি দুই মেয়ের বিয়ে দেন বরিশাল ও রানাঘাটে, ছেলের জন্য কন্যা সংগ্রহ করেন হাওড়ার এক গ্রামের দরিদ্র পরিবার থেকে।
‘পৈতৃক ব্যবসায়ে রামচন্দ্র একেবারেই মনোযোগী হননি। তাঁর ঝোঁক ছিল শিল্পের দিকে। তিনি দক্ষ অভিনেতা ছিলেন। থিয়েটারে অর্থ বিনিয়োগ করে নাট্য কোম্পানি তৈরি করেন। রামচন্দ্রের আমলেই সেনগুপ্তদের বিত্ত ও বৈভবের দ্রুত পতন ঘটে। একের পর এক বিপর্যয় ঘটে। যাত্রীসহ একটি স্টিমার ডুবে যাওয়ায় বিশাল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। পাটের ব্যবসায় তদারকির অভাবে ও কর্মচারীদের চুরি ও শোষণে ছিবড়েতে পরিণত হয়। থিয়েটার ব্যবসাও দু—বছরের মধ্যে বন্ধ করতে হয় প্রভূত গুনাগার দিয়ে। বস্তুত যাবতীয় স্থাবর সম্পত্তি রামচন্দ্রই বিক্রি করে ফেলেন, শুধু বাড়িটি ছাড়া।
‘রামচন্দ্রর দুই ছেলে দুই মেয়ে। দ্বিতীয় ছেলে রমেশচন্দ্রই শোভনেশের বাবা। বড়ো ছেলে উমেশচন্দ্র নিঃসন্তান ছিলেন তাই শোভনেশের ছোটোভাই রমেশকে তিনি দত্তক নেন। উমেশ—রমেশের ছোটোবোন সুষমার বারো বছর বয়সেই মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ দেখা দেয়। যে—ঘরে তরলাবালা উন্মাদ জীবন কাটান, সুষমাকে সেই ঘরেই রাখা হয়।
‘বংশে প্রতি পুরুষেই একজন করে পাগল হয়েছে, এটা ভয় পাইয়ে দিয়েছিল উমেশচন্দ্রকে। প্রথমে তিনি বিয়ে করতে রাজি হননি ছোটোবোনকে ধীরে ধীরে উন্মাদ হয়ে যেতে দেখে। কিন্তু ভীরু ও অলস প্রকৃতির উমেশচন্দ্র বাবার হুমকি, সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবার শাসানি ও মায়ের অলঙ্কারাদি পাওয়ার লোভ সামলাতে পারেননি। তবে বিয়ের আগে গোপনে তিনি নিজেকে নপুংশক করিয়ে নেন এক চিকিৎসক বন্ধু দ্বারা।’
কলিংবেল বাজল। পড়া থামিয়ে রোহিণী উঠে গিয়ে দরজা খুলল। গৌরীর মা বাকি কাজ সারতে এসেছে। রান্নাঘরে ঢুকেই সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘এ কি, ভাত নামাওনি। পোড়া গন্ধও কি পাচ্ছ না?’
রোহিণী ‘তাই তো’ বলে ব্যস্ত হয়ে ছুটে গেল। আবার চাল সেদ্ধ করতে বসিয়ে সে দুধ আর ঠান্ডা টোস্ট দাঁতে ছিঁড়ে চিবোতে চিবোতে রান্নাঘর থেকে বাটনা বাটার শব্দের মধ্যে ডুবে গিয়ে ভাবল, শোভনেশদের পারিবারিক এত কথা সিধারথ সিনহা নামের লোকটি জানল কী করে! প্রায় একশো পঁচিশ বছরের, পাঁচ পুরুষের ইতিহাস তো অবাঙালি কারোর পক্ষে সংগ্রহ করা সহজসাধ্য নয়!
পুরো লেখাটার আকার অনুযায়ী শোভনেশের সম্পর্কেই বেশি জায়গা খরচ হয়েছে, তুলনায় বাকি তিন ভস্মীভূত শিল্পীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে কমই। নানা কাগজে ম্যাগাজিনে প্রকাশিত সংবাদ থেকে তথ্য নিয়ে যতটুকু লেখা সম্ভব, উপর উপর শুধু ছুঁয়ে যাওয়া, তাইই। কিন্তু শোভনেশের ব্যাপারটা, খেটেখুটে খবর জোগাড় করে লেখা। ম্যাগাজিনটা বোম্বাই থেকে বেরোয়। সেখানে বসে এটা লেখা নয়, সেখান থেকে এসে এত পুরোনো সব কথা জোগাড় করা সোজা কাজ নয়।
তার মনে হচ্ছে, সম্ভবত লেখকের নাম সিদ্ধার্থ সিংহ। দেশের পাঠকদের বড়ো অংশের কাছে গ্রহণীয় হবার জন্য বাঙালিয়ানা খসিয়ে সিধারথ সিনহা হয়েছেন। যেমন হিন্দি ফিল্মে পদবি উড়িয়ে দিয়ে মিস্টার রাজেশ, মিস মিতা বলা হয়। ভারতের কোন জায়গার লোক বোঝে কার সাধ্য। আরও মনে হচ্ছে, এই সিদ্ধার্থ শুধু বাঙালিই নন, কলকাতারই বাঙালি। এঁকে খুঁজে বার করতে পারলে নিশ্চয় শোভনেশের পারিবারিক অনেক খবর পাওয়া যেতে পারে। অন্তত উনি কোথা থেকে এসব কথা জেনেছেন, ওঁর সোর্সটা কী, তা জানতে পারলেও হবে। বোম্বাইয়ে ম্যাগাজিনটার সম্পাদকীয় অফিসে চিঠি দিয়ে সিদ্ধার্থ সিংহর ঠিকানাটা আনতে পারলে লোকটির সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়।
লেখাটায় যা সব বলা হয়েছে, তার বিন্দুবিসর্গ আজ সকাল পর্যন্তও সে জানত না। শোভনেশ তার পারিবারিক অতীত সম্পর্কে কোনোদিন একটি কথাও বলেনি। শুধু বলেছিল, ‘আমি একা। বাবা—মা নেই। একটা ভাই, সে আলাদা থাকে, তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। অল্প বয়সে বাবার চাপে পড়ে বিয়ে করেছিলাম, বউ মারা গেছে।’
‘বিয়ে হয়েছিল! কত বছর বয়সে?’
‘কুড়ি—একুশে।’
‘কী করে মারা গেল?’
‘ম্যালিগন্যান্ট টাইফয়েডে।’
‘দেখতে কেমন ছিল? ছবিটবি আছে?’
‘ছবি রাখা আমি পছন্দ করি না। আর এত বছর আগের চেহারা, মুখ এখন চেষ্টা করলেও মনে করতে পারব না।’
গৌরীর মা দালান মুছছে। চেয়ারে সে বাবু হয়ে বসে। চঞ্চলা কাল বিস্কুট কিনে এনেছিল, রোহিণী ঠোঙাটা রাতে বাটি চাপা দিয়ে রাখে। এখন বাটি তুলে সেটা দেখে সে একটা বিস্কুট মুখে পুরল। খবরের কাগজটার পাতা আর একবার উলটে দেখে নিল। একটা লাইনও বহরমপুরের খবর নেই।
তাকে অন্যমনস্ক দেখে গৌরীর মা বলল, ‘মাছ নিয়ে আমার সঙ্গে ওপরে চলো, আলাপ করিয়ে দোব। মাসিমা একদিন দুখ্যু করে বলল, বুড়োবুড়ি বলে কেউ গপ্পোটপ্পো করতেও আসে না। বসে বসে শুধু টিভি দেখা ছাড়া কিছু করার নেই। ছেলে, ছেলের বউ কোচিন না মোচিন কোথায় যেন থাকে, মেয়ে জামাই বিলেতে। নাও ওঠো, চুলটা একটু আঁচড়ে নাও, বুড়ি একটু সেকেলে, সিঁদুর আছে? আচ্ছা থাক আজকাল অফিসের মেয়েরা অত সিঁদুরমিদুর দেয় না। বরং একটা লাল টিপ পরে নাও, আছে তো?’
‘খুঁজতে হবে।’
গৌরীর মা নিজের কপাল থেকে টিপটা খুলে রোহিণীর কপালে সেঁটে দিয়ে বলল, ‘সাজগোজের দিকে তোমার একদম নজর নেই। স্বামী নিরুদ্দেশ হলেও, সধবা তো! হ্যাঁ দিদি, খোঁজটোজ চালাচ্ছ তো?’
‘কোথায় আর খোঁজ চালাব, বলো। আশি—পঁচাশি কোটি লোকের দেশ, সহজ তো নয়!’
‘তারকেশ্বরে হত্যে দাও একবার।’
‘হ্যাঁ তাই দোব ভাবছি। চলো এবার।’
দু—জনে পলিথিন ব্যাগে মোড়া মাছ নিয়ে উপর তলায় উঠে বেল বাজিয়ে অপেক্ষা করছে। রোহিণী পিছনে মুখ ফিরিয়ে তুষার দত্তর ফ্ল্যাটের খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে তাকাল। দেওয়ালে কাচের পাল্লা দেওয়া আলমারিতে ডিনার সেট, সাজিয়ে রাখা। বিয়েতে পাওয়া। আঠারো বছরে একবারও ব্যবহারের সুযোগ আসেনি। স্টিলের থালা বাটি গ্লাসও সাজানো হয়েছে। আর একটা তাকে কয়েকটা রাজস্থানি মেয়ে পুঁতুলের সঙ্গে প্লাস্টিকের পুতুলও। আর এক তাকে তুষার দত্তর পেশি ফোলানোর ফসল কয়েকটা কাপ মেডেল। দেওয়ালেও জাঙ্গিয়া পরা তুষার দত্তর চার রকম ভঙ্গির ছবি, বহিরাগতদের যেন অস্বস্তির উপাদান জোগাতেই টাঙানো। হঠাৎ প্রেশার কুকারের বাষ্প নিঃসরণের তীক্ষ্ন আওয়াজ হল। ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে নন্দা খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়েই থমকে গেল আড়ষ্ট হয়ে। রোহিণী হাতছানিতে তাকে ডাকল।
‘আমার পরিচিত একজন জয়পুর যাচ্ছে, তাকে বলব তোমার জন্য…একটা আনতে। ওখানে দারুণ দারুণ প্রিন্টের পাওয়া যায়, কাচ বসানো।’
‘একটা’ কী জিনিস যে আনতে বলবে, সেটা আর বলার দরকার হল না। নন্দার মুখ উজ্জ্বল হয়েই ফ্যাকাসে হল।
‘বাবা ওসব পরা পছন্দ করে না। আমি দুপুরে আপনার ঘরে গিয়ে পরেছিলাম। চঞ্চলা তখন ছিল, ওকে বারণ করেছিলুম আপনাকে যেন না বলে।’
‘ঠিক আছে, আমি কিছু মনে করছি না।’
ইতস্তত করে নন্দা কী একটা বলতে যাচ্ছে, সেই সময় ফ্ল্যাটের দরজা খুলে গেল। এক ছোটোখাটো চেহারার, স্নিগ্ধ মুখ, গৌরবর্ণা মহিলা ওদের দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে। বয়স ষাট—পঁয়ষট্টির মধ্যে।
‘মাসিমা, এই যে দিদি এসেছে।’
‘ওহ, এসো ভেতরে এসো। মাছ রাখবে তো? তোমার নাম তো রোহিণী।’
‘হ্যাঁ। আগে আমি কখনো এমন ঝামেলায় তো পড়িনি।’ রোহিণী কুণ্ঠিত স্বরে বলল। মাছ আনলাম, রেঁধে খেয়েও ফেললাম। তুলেটুলে রাখার মধ্যে আমি নেই। রাতে খাই নিরামিষ। কিন্তু আজই—’
‘শুনেছি, গৌরীর মা—ই বলেছে। বসো। ‘তুমি’ বলছি বলে—’
‘না না, নিশ্চয় বলবেন, মায়ের বয়সি আপনি।’ রোহিণী বসার জন্য ব্যস্ত হল না।
‘তা ছাড়া দিদি আপনাদেরই স্বজাত বদ্যি। ছোয়াছুঁয়ির আর কথাই উঠবে না।’
‘বদ্যি নাকি! তবে আমি অত জাতটাতের বাছবিচার করি না। তুমি নিজেই রেখে দাও।’
দালানের প্রান্তে রাখা ফ্রিজের কাছে গিয়ে পাল্লা খুলে মহিলা ডিপ ফ্রিজের ডালাটা টেনে বললেন, ‘এর মধ্যেই রাখ।’
রাখার সময় রোহিণী দেখল, প্লাস্টিকের সাত—আটটা কুলপি ভেতরে রয়েছে। নীচের তাকে কয়েকটা ঢাকা বাটিতে রান্না করা খাদ্য, জলের আর সিরাপের বোতল, মাখনের কৌটো। রোহিণীর চোখের দিকে নজর রেখেছিলেন মহিলা। বললেন, ‘একটা মালাই চেখে দেখবে নাকি?’
‘না না, আমি এই সকালে ঠান্ডা খাব না।’
‘কাল গুরুভাই এসেছিলেন। আমরা তো বারাসাতের বিনোদানন্দ ব্রহ্মচারীর শিষ্য। একটাই মালাই তখন পড়ে ছিল, তাই দিলাম। খেয়ে খুব ভালো লেগেছে বলায় বললাম, আজ আসুন, বেশি করে খাওয়াব।’
‘আমাকে অন্য আর একদিন করে খাওয়াবেন মাসিমা। আমারও খুব ভালো লাগে।’ রোহিণী ক্ষীণভাবে স্বরটা আবদেরে করল। খুশিতে টসটস করে উঠল ওঁর মুখ। প্রীত কণ্ঠে বললেন, ‘খেলে বুঝতে পারবে, দোকানের থেকে আমার মালাইয়ের পার্থক্যটা কত।’
‘হ্যাঁ দিদি, মাসিমার হাতের রান্না খুব ভালো, সেদিন জিরে—গোলমরিচ দিয়ে যা কচুর মুখি রেঁধেছিলেন না!’
গৌরীর মা—র তারিফটা উপভোগ করে উনি বললেন, ‘তোমার শ্বশুরবাড়ি কোথায়?’
রোহিণী ধরেই রেখেছে, গৌরীর মা তার সম্পর্কে যতটুকু জানে, সবিস্তারে নিশ্চয় এঁর কাছে তা বলেছে। তবে এটা জানে না, তার শ্বশুরবাড়ি কোথায়। কাউকে সে জানাতে চায়ও না। যদি হঠাৎ চেনাশোনা বেরিয়ে যায় তাহলে আবার এক ধরনের ফিসফিসে কৌতূহলের পাত্রী হয়ে পড়তে হবে।
‘মাসিমা, আমি এখন আসি, দিদি চললুম, এখনও কাজ পড়ে আছে।’ ব্যস্ত গৌরীর মা আর এক ফ্ল্যাটের কাজ শেষ করতে গেল।
‘সেন্ট্রাল ক্যালকাটায়, বউবাজারের দিকে।’
‘ওমা! আমরাও তো একসময় বউবাজারেই থাকতাম। পঁচিশ নম্বর দিগম্বর বর্ধন লেনে।’
শোনা মাত্রই রোহিণী মাথা ঘুরে প্রায় পড়ে যাবার মতো আঘাত পেল তার স্নায়ুকেন্দ্রে। ওটা তার শ্বশুরবাড়িরই ঠিকানা। ডাইনিং টেবলের একটা চেয়ার টেনে ধীরে ধীরে সে বসে পড়ল।
‘কবে ছিলেন?’ দমবন্ধ অবস্থায় রোহিণী জানতে চাইল।
‘আমার বিয়ের ঠিক পরেই। বছর চল্লিশ আগে তো বটেই। ওঁর অফিস ছিল মৌলালিতে, হেঁটেই যেতেন। তখন যুদ্ধের শেষের দিকে। আমরা ও বাড়িতে যাওয়ার কয়েক মাস পর ব্ল্যাক আউট উঠে গেল। আমার বড়োছেলে তখনই হয়।’
‘সে বাড়িতে কে কে ছিল?’
‘আমরা ছাড়াও, একতলায় আরও দু—ঘর ভাড়াটে ছিল। বাড়িওয়ালারা থাকত দোতলায়, পেল্লায় বাড়ি দু—ভাইয়ের, ওরাও বদ্যি, পার্টিশান করে পাঁচিল তুলে দু—ভাই আলাদা। এক সময় বিরাট ধনী ছিল, কিন্তু বসে বসে খেলে যা হয়। শেষে এমন অবস্থায় পড়ল যে, ভাড়াটে বসাতে হল। অনেকটা জমি ছিল বাড়ির সঙ্গে, গাছপালাও। আমরা দেখেছি কয়লার ডিপো আর রিকশার খাটাল হল সেই জমিতে, এক ডেকরেটার বাঁশ রাখত।’
‘বাড়িওয়ালার পরিবারে কে কে ছিল?’
‘ওরা তো দুই ভাই। বড়োভাইয়ের ছেলেপুলে হয়নি, তাই ছোটোভাইয়ের দুই ছেলের মধ্যে ছোটোটিকে পুষ্যি নেয়। এরা বাঁদিকের পোর্সানে থাকত, আর আমাদের বাড়িওয়ালা রমেশবাবুরা ডানদিকে। বড়োছেলে শোভনেশ, আর্ট কলেজে পড়ত, তখনই বাপ ওর বিয়ে দিয়ে দেয়।’
‘তখন ছাত্র তো, অত কম বয়সেই ছেলের বিয়ে দিয়ে দিল?’
‘ছেলে তো করতেই চায়নি, একদিন সে কী ঝগড়া বাপ আর ছেলেতে। আমি তখন ছাদ থেকে নামছি শুকনো কাপড় তুলে। শুনলাম—’ মহিলা কথা থামিয়ে মাথা নাড়তে লাগলেন। ‘সে—সব কথা মুখে আনা যায় না, তোমার মতো অল্পবয়সিদেরও বলা যায় না। আমরা ও—বাড়িতে যাওয়ার পর পাড়ার লোকের কাছে শুনি, সেনগুপ্তদের নাকি পাগলের বংশ। প্রতি পুরুষে হয় কোনো ছেলে নয় কোনো মেয়ে, একজন না একজন পাগল হয়েছেই। পাগল রাখার জন্য ওদের একটা ঘরই আছে। বুঝলে রোহিণী, ঘিঞ্জি এলাকায় বসবাসের অনেক অসুবিধে যেমন, তেমনি সুবিধেও অনেক আছে। এইরকম ফ্ল্যাটে দরজা বন্ধ করলেই একা, জানলা দিয়েও পাশের বা সামনের বাড়ি পাওয়া যায় না। ছাদ থেকেও গল্পসল্পর উপায় নেই। কিন্তু গলিতে বাড়ি হলে, সদর তো সবসময়ই খোলা জানলায় কী বারান্দায় দাঁড়াও, সবসময় কথা বলার লোক পাবেই। ভাড়াটে ভরতি বাড়ি হলে তো কথাই নেই, ঝগড়াঝাটি করেও সময় কেটে যায়। ও পাড়ায় প্রত্যেকের হাঁড়ির খবর প্রত্যেকে রাখত। আমাদের বাড়িওয়ালার সম্পর্কেও অনেক কথা শুনেছি। শুনে খুব ভয় ধরে গেছিল।’
‘কেন?’ রোহিণীর মস্তিষ্কের কোষগুলো সজাগতার তুঙ্গে পৌঁছল। এতক্ষণে আসল জায়গায় কৌতূহল তার জানার বিষয়টায় পা রেখেছে। ‘ভয় পাওয়ার মতো কী শুনেছেন?’
‘ভয় পাব না? কেউ—না—কেউ পাগল হয়ে আসছে পাঁচ পুরুষ ধরে, এই পুরুষে কেউ এখনও হয়নি, কিন্তু হবেই—কে হবে? পাড়ার লোকেরা তো এই নিয়ে রীতিমতো জল্পনাকল্পনা করত। পঞ্চাশ—ষাট বছর বয়সেও পাগল হয়েছে, আবার দশ—বারো বছর বয়সেও হয়েছে। কখন যে কে হবে, তার ঠিক নেই। বাপ—জ্যাঠার বয়স হয়ে গেছে, কিন্তু তারাও তখন পাগল হতে পারে আবার শোভনেশ আর তার ভাই পরমেশও পাগল হয়ে যেতে পারে। সে যে কী এক যন্ত্রণাকর অবস্থা, ভাবলে তো সুস্থ মানুষও পাগল হয়ে যাবে।’
‘দারুণ ইন্টারেস্টিং তো মাসিমা, অদ্ভুত ব্যাপার! ওরাও কি এই নিয়ে ভাবত না?’
‘ভাবত না আবার! সিঁটিয়ে থাকত সবসময়। যাগযজ্ঞি শান্তি স্বস্ত্যয়ন তো লেগেই ছিল। তাবিজ তাগা, মাদুলি, আংটি, জ্যোতিষী, গণৎকার থেকে শুরু করে স্পেশালিস্ট ডাক্তার দেখানোও হয়েছে। কেউ একজন পাগল হলে ওরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, কিন্তু কেউই হচ্ছে না। এ যে কী সমস্যা, কী যন্ত্রণা ভাবলে এখন হাসি পায় বটে, কিন্তু যদি তুমি তখন ওই বাড়িতে থাকতে—তাহলে বুঝতে।’
মহিলা হাসলেন না। রোহিণীর হাতের আঙুলগুলো একবার কেঁপে উঠল। ওই বাড়িতে সে কয়েক মাস থেকেছে। কিন্তু কিছুই কি তখন তাকে অবাক করেনি? অমাবস্যা আর পূর্ণিমায় শোভনেশ বাড়ি থেকে বেরোত না। সারাদিন ছবি আঁকার ঘরে নিজেকে যেন বন্দি করে রাখত। একবার রোহিণী জুতো কিনতে যাবার জন্য তাকে সন্ধ্যায় বেরোতে বলেছিল। শোভনেশ রাজি হয়নি। ‘আজ অমাবস্যা, দিনটা ভালো নয়।’ অবাক হয়ে সে বলেছিল, ‘তুমি এসব মানো নাকি? এই ধরনের কুসংস্কার—’ তার কথা শেষ হবার আগেই অস্বাভাবিক চাহনিতে তীব্র স্বরে শোভনেশ বলে, ‘যা জানো না, তাই নিয়ে কথা বলো না। আমাদের বংশে এসব মানা হয়। দরকার থাকলে তুমি বেরোতে পার, তোমার শরীরে সেনগুপ্তদের রক্ত নেই।’
রোহিণী তখন কথাগুলোর অর্থ ধরতে পারেনি। তাই নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহসও তখন ছিল না। কিন্তু এ ছাড়াও তাকে অবাক করার মতো আরও কিছুও তো ঘটেছিল।
‘শোভনেশ মাঝে মাঝে আমাদের ঘরে আসত। এসেই বলত ‘বউদি কিছু বুঝতে পারছেন?’ বুঝতে পারা মানে, পাগল হবার লক্ষণটক্ষণ দেখা যাচ্ছে কিনা সেটাই। আমি বরাবরের মতোই বলতাম, ‘তোমার দাদার মধ্যে যতটুকু দেখি, তোমার মধ্যেও ঠিক তাই দেখতে পাচ্ছি।’ শুনে খুশি হত। বিয়ের পর ওর ছটফটানি যেন বাড়ল। আমার স্বামীকে একদিন বলেছিল, ‘আমার সন্তান হওয়া কি উচিত? দাদা আপনি কী বলেন? বংশের এই ব্যাধিটা থামিয়ে দেওয়া দরকার। পরমেশকে বলেছি বিয়ে করিসনি, এমনকী তোর ঔরসেও যেন কারোর গর্ভে সন্তান না হয়, সেটা দেখিস। কিন্তু ও রাজি নয়। বউকে বলেছি, ‘আমাদের কোনো ছেলেপুলে হবে না। সেও রাজি নয়। ঠিক করেছি, আমি অপারেশন করিয়ে নেব। করলে কী অন্যায় হবে?’ উনি আর কী বলবেন, তুমি যা ভালো বোঝ তাই কর, বলে এড়িয়ে গেলেন।’
‘বউ মারা গেল কীভাবে?’
মহিলা এবার অবাক হয়ে রোহিণীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ‘তুমি জানলে কী করে?’
হিম হয়ে গেল রোহিণীর বুক। হঠাৎই তার মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে এসেছে। শোভনেশের বউয়ের মৃত্যু নিয়ে উনি তো এখনও একটা কথাও বলেননি। ব্যাপারটা সামলাবার জন্য সে হালকা স্বরে বলল, ‘এসব লোকের বউয়েরা সাধারণত বাঁচে না। আমার এরকম ঘটনা জানা আছে, স্বামীর বাতিকে উত্ত্যক্ত হয়ে একজনের বউ গলায় দড়ি দেয়, আর একজনের বউ অবশ্য পালিয়ে বেঁচেছিল। দু—জনেই ধনী, বনেদিবাড়ির বউ ছিল। তাই মনে হল—।’
‘শোভনেশের বউ যখন মারা যায়, আমরা তখন একটা বিয়ের নেমন্তন্নে টালিগঞ্জ গেছিলাম। দোতলার বড়ো ঘরটার জানলাগুলোয় গরাদ নেই। সেখান থেকে লাফিয়ে নাকি নীচে পড়ে, পেটে চার মাসের বাচ্চচা ছিল। আমাদের কিন্তু অন্যরকম মনে হয়েছিল।’
‘কী মনে হয়েছিল, খুন?’ রোহিণীর স্বর অস্ফুট হয়ে গেল, শ্বাসনালিতে উত্তেজনার চাপ পড়ায়।
‘হ্যাঁ। শুধু আমরা কেন পাড়ার লোকেও তাই মনে করে। কমলার মতো ঠান্ডা শান্ত মেয়ে, আঠারো—উনিশ বছর বয়সে কেন আত্মহত্যা করতে যাবে বলো, তার ওপর পেটে বাচ্চচা?’
‘কিন্তু ওর স্বামী তো অপারেশন করে নেবে বলেছিল, তাহলে আবার বউয়ের পেটে বাচ্চচা এল কী করে?’
‘করেছিল কী করেনি তা বাপু আমরা জানি না, আমাদের আর কিছু বলেওনি শোভনেশ। পরে আর তো আমাদের সঙ্গে কথাই বলত না।’
‘টর্চার করত?’
‘তেমন কিছু তো দেখিনি।’
‘তখন কি ছবি আঁকত?’
‘ঘরে বসে বসে আঁকত। আমি তো আঁকার ঘরে ঢুকিনি কখনো।’
‘এখন সেই শোভনেশ কোথায়, ওই বাড়িতেই আছে? আবার বিয়েটিয়ে করেছে?’
‘তা বলতে পারব না। কমলা মারা যাবার পর, ছাদের দরজায় তালা দিয়ে দিল। আর উপরে যেতে পারি না, তাই নিয়ে ঝগড়াও হল। ইতিমধ্যে উনি বদলি হলেন জলন্ধরে, সেন্ট্রাল গরমেন্টের চাকরি তো, তারপর থেকেই বাংলার বাইরে বাইরে ঘোরা। কলকাতার কোনো খবর পর্যন্ত রাখিনি। রিটায়ার করে এই চার বছর হল আমরা এসেছি। মাঝে মাঝে ভাবি একবার ঘুরে আসি দিগম্বর বর্ধন লেনে, তখনকার মানুষরা কে কেমন আছে দেখতে ইচ্ছে করে। বাড়িটার এখন কী দশা কে জানে।’
কলিং বেল বাজল। উনি গিয়ে দরজা খুললেন।
‘নীচের আন্টি আছেন?’ নন্দার গলা পেয়ে রোহিণী উঠল।
‘আন্টি, আপনার ফোন।’
একবার শুধু ভ্রূ কুঁচকেই রোহিণী বিরক্তি চেপে মুখে হাসি টেনে বলল, ‘আসি মাসিমা। খুব ভালো গল্প বলেন, আবার একদিন এসে শুনব। রাতে এসে মাছ নিয়ে যাব।’
দ্রুত পায়ে এসে টুলের উপর রাখা ফোনের রিসিভারটা তুলে সে চাপা স্বরে বলল: ‘হ্যালো।’
‘রান্না জানার প্রমাণ আজ দিচ্ছ তো?’
‘তোমাকে বলেছি না, খুব দরকার না পড়লে এখানে ফোন করবে না।’
‘খুব দরকারেই তো করছি। তোমার কি মনে হয়, প্রথম বলেই আউট হওয়াটা খুব মর্যাদাকর ব্যাপার হবে?’
‘আমার শরীর, মন আজ খুব ক্লান্ত, নানারকম চাপ…তুমি দুপুরে ফোন কোরো অফিসে।’
‘কীসের চাপ, ফোনে কী তা বলা যায়?’
‘দেখা হলে বলব। তোমাকে হয়তো আমার এবার দরকার হবে।’
‘খুব দরকার হলে আমি দেখা করব না, আর খুব খুব—’
‘রাজেন!’ রোহিণী গম্ভীর ধমক দিল। ‘তুমি যে প্রথম বলেই বোল্ড হবে, সেটা এখনি বুঝতে পারছি। সিরিয়াস হও। ইলিশ মাছ আনিয়েছি, আর একটি কথাও নয়।’
রিসিভার রেখে রোহিণী হাসল নন্দার দিকে তাকিয়ে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় নন্দা ‘আন্টি’ বলে ডেকে, দ্রুত নেমে তার পাশে এল।
‘চঞ্চলা আর আসেনি?’
‘না তো, কেন?’
‘আন্টি, আমি কিন্তু ওকে ভয় দেখাইনি। ও বললেও তা বিশ্বাস করবেন না।’ নন্দার কাতর আবেদনভরা মুখটির দিকে তাকিয়ে রোহিণী অবাক হল।
‘ও হয়তো তাই বলবে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, লোকটাকে দেখে আমিও ভয় পেয়ে গেছিলাম।’
‘কে লোকটা? কীরকম দেখতে?’
‘খুব লম্বা, রোগা, আর ইয়া ঝাঁকড়া কাঁচাপাকা চুলদাড়ি, ভুরুটাও পাকা, ইয়া লম্বা জুলপি, সরু সরু চোখ দুটো দেখলে ভয় করে, যেন জ্বলছে!’
‘কোথায় লোকটা?’ রোহিণী প্রায় আর্তনাদ করে উঠল। এ তো শোভনেশ!
‘জানি না। আমি ম্যাকসিটা পরে নীচে সংঘমিত্রাকে দেখাতে গেছিলাম। তখন ওদের জানলা দিয়ে দেখি, ওই লোকটা গেট দিয়ে ঢুকছে। ঢুকে এধার—ওধার কেমন যেন তাকাচ্ছে। কাঁধে একটা নানান কাপড়ের তাপ্পিমারা ঝোলা। তারপর উপরে গিয়ে আপনার কলিংবেল বাজালাম, কিন্তু দরজা আর খুলছে না। শেষে ধাক্কা দিয়ে ‘চঞ্চলা চঞ্চলা’ বলে নাম ধরে ডাকতে ও দরজা খুলল। দেখি, ভয়ে মুখ একদম ফ্যাকাসে।’
নন্দা যদি একটু ভালো করে নজর করত, তাহলে হয়তো বলত, আন্টি, ঠিক আপনার এখনকার মুখের মতো। কিন্তু বর্ণনাটা গুছিয়ে, শ্রোতার মনে দাগ কাটানোর চেষ্টায় তখন সে ব্যস্ত।
.
নন্দা ঢোঁক গিলে আবার শুরু করল, ‘প্রথমেই বলল, ছেলেধরা এসেছিল। আমি তো শুনে অবাক! জিজ্ঞাসা করলাম, কখন এসেছিল? বলল এইমাত্র। কলিংবেল টিপতেই দরজা খুললুম, দেখি, একটা ছেলেধরা কাঁধে ঝুলি নিয়ে দাঁড়িয়ে। লোকটা কটমট করে তাকিয়ে বলল, তুমি কে? এই বলে ভেতরে তাকিয়ে এধার—ওধার দেখতে লাগল। তারপর ঝুলি থেকে একটা কাগজ বার করে বিড়বিড় করে পড়ে বলল, ‘এটা কত নম্বর ফ্ল্যাট?’ চঞ্চলার তখন অজ্ঞান হয়ে যাবার মতো অবস্থা। কথা বলতে পারছিল না। লোকটা তখন বলল, ‘এখানে কে আছেন, তাঁকে ডাকো।’ চঞ্চলা বলল, ‘কেউ নেই এখন, মাসিমা বেরিয়ে গেছে। আমি একা আছি।’ এই বলেই ও দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর আমি ওপর থেকে নীচ খুঁজলাম, কিন্তু লোকটা যেন হাওয়া হয়ে গেছে, কোথাও দেখতে পেলাম না। চঞ্চলা বলল ‘আমি আর এখানে থাকব না।’ আমি কত ওকে বোঝালাম, ছেলেধরাটরা সব বাজে কথা, ওরা দুপুরে এভাবে এসে ধরে না, আর ধরলেও তোকে ধরবে না। কিন্তু কে শোনে আর সে কথা, গোঁ ধরে রইল—’আন্টি, আপনার কি পায়ের যন্ত্রণাটা আবার হচ্ছে?’
‘না না আমি ঠিক আছি। তুমি আইসব্যাগটা বরং নিয়ে যাও।’
রোহিণীর মনে হচ্ছে, তার দুই হাঁটুতে বাত হয়েছে। সে বৃদ্ধা হয়ে গেছে। হাঁটাচলার ক্ষমতা রহিত। নন্দা ব্যাগটা নিয়ে চলে যেতেই সে বিছানায় শুয়ে পড়ল। কোনো সন্দেহ নেই লোকটা কে হতে পারে। কিন্তু কীভাবে জোগাড় করল তার এখানকার ঠিকানা?
যতই সে ভাবতে লাগল, তার ভয়টা ক্রমশ নিজের প্রতি রাগে রূপান্তরিত হতে শুরু করল। কেন সে এই লোকটিকে বিয়ে করতে গেল? বোম্বাইয়ে দিদিকে টেলিফোনে যখন সে বিয়ের সিদ্ধান্তের কথা জানায় তখন দিদি বারণ করে বলেছিল, ‘রুনি, আর্টিস্টরা সাংঘাতিক লোক, এদের বিশ্বাস করিসনি। এরা অন্য প্রকৃতির হয়, এরা আলাদা জগতের লোক। সত্যিমিথ্যে দিয়ে বানিয়ে বানিয়ে মনগড়া জিনিসকে আসল বলে চালায়, তাইতে বোকারা কনফিউজড হয়। তোরও সেই দশা হয়েছে। তুই ভুল করিসনি। তোর জন্য অনেক অনেক ভালো পাত্র পাওয়া যাবে, আমি জোগাড় করে দেব এখানে।’
দিদির কথা শুনলে আজ এই অবস্থা তার হত না। মা তখন বেঁচে। শুধু বলেছিলেন, ‘তোমার মন যা চায় তাই করো, তুমি এখন সাবালিকা।’ বিয়ে রেজিস্ট্রি হয়ে যাবার তিন দিন পরই দিদি বোম্বাই থেকে সকালের ফ্লাইটে এসে মাকে নিয়ে রাতের ফ্লাইটেই ফিরে যায়। বিশেষ কোনো কথাবার্তা হয়নি। যাবার সময় শুধু বলে যায়, ‘চাকরিটা ছেড়ো না, ভবিষ্যতে এটাই তো সম্বল করে বাঁচতে হবে।’ শোভনেশের মামলার রায় বেরোতেই দিদি টেলিফোন করে বলেছিল, ‘যা বলেছিলাম সেটা এখন মিলিয়ে নে। রঞ্জন বলেছে, আর তোকে কলকাতায় থাকতে হবে না। প্লেনের টিকিট পাঠাচ্ছি, দু—হপ্তার মধ্যে এখানে পৌঁছচ্ছিস এটাই আমি দেখতে চাই।’ চাকরি আর ভাড়া বাড়ি ছেড়ে, গঙ্গাদার আপত্তি সত্ত্বেও, সে দিদির কাছে চলে গেছিল।
এক ঘণ্টা পর, আরামদায়ক রৌদ্রের মধ্যে তিন নম্বর ট্যাঙ্কের কাছে মিনিবাসের জন্য যখন সে দাঁড়াল, তখন তার কাঁধ ঝুলে পড়েছে, মাথা সামান্য ঝোঁকানো, ঝোলটার একটা কোণ শক্ত মুঠিতে ধরা আর চোখে শূন্য চাহনি।
.
‘তাহলে কাল সকালেই, দশটায়।’ টেলিফোন রেখে প্রশান্ত হালদার তাকালেন রোহিণীর মুখের দিকে। ‘অসুবিধে হবে না তো?’
‘না।’ ইতস্তত করে তারপর সে বলল, ‘কার সঙ্গে আপনি কথা বললেন?’
‘মীনার সেক্রেটারি কাম গার্জিয়ান সুভাষ গায়েন, যার সঙ্গে কাল তুমি কথা বলে এসেছ।’
‘আমার সম্পর্কে কিছু বলল?’
‘না তো? কেন, বলার মতো কিছু হয়েছে নাকি?’
‘না, লোকটাকে খুব রাফ মনে হচ্ছিল। আমিও একটু মাথা গরম করে ফেলেছিলাম, অবশ্য অন্য একটা ব্যাপারে।’ প্রশান্ত হালদার জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছেন দেখে রোহিণী যোগ করল, ‘ঘরে একটা ছবি টাঙানো ছিল, সেটা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম বলে লোকটা বিশ্রীভাবে জবাব দিয়েছিল।’
‘কী ছবি?’
‘একটা পেইন্টিং, ন্যুড মেয়ের।’
‘মীনার?’
‘না না অন্য কারোর।’
‘আহহ।’ প্রশান্ত হালদারের সিধে হয়ে যাওয়া শিরদাঁড়াটা আবার চেয়ারে, পিঠে নেতিয়ে পড়ল। ‘মীনার হলে ছবি তুলিয়ে এনে ছাপতুম।’
‘গঙ্গাদা কখন আসবেন বলেছেন কিছু?’
‘সময় তো হয়ে গেছে। খুবই ব্যস্ত এখন। আর একটা অফসেট ছাপার মেসিন কেনা হচ্ছে, বেলেঘাটার বাড়ি কমপ্লিট হলেই আসবে। তখন আমাদের সবাইকেই ওখানে চলে যেতে হবে। তা ছাড়া ম্যাগাজিনগুলোকে ট্রেন্ডি, ক্যাচি, আপবিট করারও তোড়জোড় হচ্ছে। নতুন ডিজাইনে মহারানি, চিত্ররেখা বেরোবে। অনেক ফিচার উঠে যাবে, নতুন নতুন ফিচার আসবে। গঙ্গাবাবু এজন্য বোম্বাইয়ের এক ডিজাইনিং কনসালট্যান্টের ওপর ভার দেবেন ঠিক করেছেন, কেন তুমি এসব শোননি?’
‘না তো! কবে ঠিক হল?’
‘গত হপ্তায় আমাকে বলেছেন।’
টেবিলের ওধারে একজোড়া বিস্মিত চোখ। রোহিণী অপ্রতিভ বোধ করল। সবাই জানে, সে গঙ্গাপ্রসাদের কাছের লোক, ভিতরের খবরাখবর জানে। কিন্তু গঙ্গাদা এইসব পরিকল্পনার কিছুই তাকে বলেননি। এটা গোপন রাখার মতো একটা ব্যাপার কী? হঠাৎ তার মনে হল; শোভনেশ সম্পর্কেও অনেক কথা উনি লুকিয়েছেন, যা বিয়ের আগেই জানালে আজ এই দশা তার হত না।
ফোন বেজে উঠল। রিসিভার কানে দিয়েই প্রশান্ত হালদার সেটা রোহিণীর দিকে বাড়িয়ে বললেন, ‘তোমার।’
‘হ্যালো।’
‘কখন বেরোবে?’
‘পাঁচটায়।’
‘মাছটা ততক্ষণে যদি বেড়াল—টেড়ালে খেয়ে ফেলে?’
‘খাবে না। ঠিক পাঁচটায়।’
‘যদি পৌনে ছ—টায় যাই?’
‘ঠিক পাঁচটায়।’ রোহিণী রিসিভার এগিয়ে দিল চিঠি পড়ায় মগ্ন প্রশান্ত হালদারের দিকে। তিনি হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘বিপ্লব আসেনি, বোম্বে থেকে যে কপি এসেছে সেগুলো দ্যাখো আর ছবির ক্যাপসন করে দাও।’
আধঘণ্টা পর গঙ্গাপ্রসাদ এলেন এবং প্রশান্ত হালদারকে ডেকে পাঠালেন। মিনিট পাঁচেক পর তিনি ফিরে এসে রোহিণীকে জানালেন, ‘তোমাকে ডেকেছেন।’
দুই তালুতে গাল চেপে একদৃষ্টে টেবলের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন গঙ্গাপ্রসাদ। রোহিণী চেয়ারে বসল উৎকণ্ঠা নিয়ে। রাইটার্স বিল্ডিংস থেকে যে খবর নিয়ে এসেছেন, সেটাই বলার জন্য ডেকেছেন। মুখ দেখে মনে হচ্ছে ভালো খবর নয়। আশঙ্কায় তার বুক ঢিপ ঢিপ করে উঠল।
‘বহরমপুরে আমার এক চেনা ব্যবসায়ী বন্ধু আছে। আজ সকালে বাসুদেবপুর থেকে ফিরেই তাকে ট্রাঙ্ককল করেছিলাম। ওখানে ভীষণ টেনশান এখন। কম্যুনাল ব্যাপার। কুড়ি—পঁচিশজন মারা গেছে, ই এফ আর, স্টেট আর্ম পুলিশ নেমেছে। লালগোলা, ভগবানগোলা, কাশিমবাজার, নসিপুর স্টেশনেও দাঙ্গা হয়েছে। পুলিশ এখন ভীষণ ব্যস্ত, কোনোদিকে তাদের নজর রাখার ফুরসতই নেই। ব্যাপারটা যেকোনো লেভেলে গেছে, কাগজ পড়ে তা বোঝা সম্ভব নয়। এরই মধ্যে যদি কেউ জেল থেকে পালায়—খুবই সম্ভব পালানো। বলেছে, খোঁজ নিয়ে আমাকে বিকেলেই জানাবে। আমি ফোনের জন্য অপেক্ষা করছি।’
গঙ্গাপ্রসাদ ঘড়ি দেখলেন, ভ্রূ কোঁচকালেন। তারপর আবার বললেন, ‘রাইটার্সেও ব্যস্ত সবাই। প্রেসিডেন্সি জেল থেকে এক আন্ডারট্রায়াল আসামি পালিয়েছে। দমদম সেন্ট্রাল জেল থেকে তো আটজন নকশাল পালিয়েছিল, তারপর এইসব ঘটনা। আবার এদিকে আলিপুর জেলের সুপারকে ঘেরাও করেছে কর্মচারীরা, তাই নিয়ে হই হই। জেল গেটে ডিউটি দেয় এক খুনের আসামি, সে নাকি বাইরে থেকে খবরাখবর চালান করে ভেতরে, তাকে সরাবার দাবি নিয়েই ঘেরাও। লালবাজার থেকে অ্যাডিশনাল ফোর্স গেছে। জেল মন্ত্রী, আই জি প্রিজন্স, হোম সেক্রেটারি আলোচনায় বসেছে, এর মধ্যে কে আর বহরমপুর জেল থেকে পালানোর খবর দেবে?’
গঙ্গাপ্রসাদ ও রোহিণী পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল। কারোরই আর কিছু যেন বলার নেই। অবশেষে দু—জনে চোখ সরিয়ে নিল।
ফোন বেজে উঠল। গঙ্গাপ্রসাদ ব্যস্ত হাতে রিসিভার তুললেন, রোহিণীর মুখটা চট করে দেখে নিয়ে।
‘হ্যালো, কে নির্মল?’ গঙ্গাপ্রসাদ ঘাড় নাড়লেন কাঠ হয়ে যাওয়া রোহিণীর দিকে তাকিয়ে।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ শোভনেশ সেনগুপ্ত…অ, অ, হ্যাঁ…হসপিটাল থেকে? সে কি নাম বলতে পারছে না? তাই কখনো হয়…দু—জন একসঙ্গে? পুলিশ পাহারা কি ছিল না?…কখন পালায়?…সন্ধেবেলা…কত তারিখে? য়্যাঁ সে তো পাঁচদিন আগে। তুমি কি আর একটু ডিটেইল খোঁজ নেবে? চেহারা, বয়স, নাম, কী অসুখ, কতদিন জেলে রয়েছে…কেউ মুখ খুলছে না? খুলবে খুলবে, সিলভার টনিক খাওয়াও…হ্যাঁ, খুব দরকার আমার, খুবই…হ্যাঁ বাড়িতে থাকব।…আচ্ছা, আচ্ছা, ও ও ও কে এ এ।’
রিসিভার রেখে দিয়ে তিনি শুধু তাকিয়ে রইলেন রোহিণীর দিকে। ভাবখানা, সবই তো শুনলে।
‘হসপিটাল আর দু—জন, তার মানে?’
‘দু—জন কয়েদিকে হসপিটালে ভরতি করা হয়েছিল। দু—জনেই লাইফার, দু—জনেই একসঙ্গে পালিয়েছে। খবরটা চেপে যেতে চাইছে বলে নাম জানাচ্ছে না, অস্বীকার করছে।’
‘পাঁচ দিন আগে পালিয়েছে?’
গঙ্গাপ্রসাদ সচকিত হলেন। সর্দিতে গলা বসে যাওয়া বা তীব্র চিৎকারের শেষ প্রান্তে এসে দম ফুরিয়ে যাওয়ার মতো ভেঙে পড়া কণ্ঠস্বর। মুখের স্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য এই দু—তিন মিনিটের মধ্যেই বসে গেছে। তাঁকে তৃষ্ণার্ত, অভুক্ত এবং পরিশ্রান্ত লোকের মতো দেখাচ্ছে।
‘ও এখন কলকাতায়। কাল দুপুরে আমাকে খুঁজতে গেছিল।’
‘কে এখন কলকাতায়?’ গঙ্গাপ্রসাদের কৌতূহলী এবং চমকিত অভিব্যক্তি একই সঙ্গে প্রকাশ হল। ‘কে খুঁজতে গেছিল, শোভু?’
রোহিণী শুধু মাথাটা ঝোঁকাল।
‘সেকি!’ ভারী শরীরটা টেনে তুলে টেবলে ঝুঁকে পড়লেন। ‘তোমার ফ্ল্যাটে? তুমি ঠিক বলছ?’
রোহিণী চুপ করে রইল। ভাবহীন দৃষ্টি স্থির নিবদ্ধ গঙ্গাপ্রসাদের মুখে। নিজের মধ্যে ডুবে গিয়ে কী যেন আলোচনা সেরে নেওয়ায় মগ্ন।
‘তুমি তো তখন ছিলে না ফ্ল্যাটে!’
‘নতুন একটা কাজের মেয়ে রেখেছিলাম। সে ছিল।’
‘রেখেছিলাম মানে? এখন কি আর সে নেই?’
রোহিণী মাথা নাড়ল।
‘বরখাস্ত করেছ? কেন?’
রোহিণী চুপ। সে ঠিকই করে ফেলেছে, বেশি কথা আর বলবে না। নিজের সম্পর্কে কোনো খবর আর কাউকে জানাবে না। অন্যদের খবর এবার থেকে সে নেবে। সেজন্য মিথ্যা কথা বলতে হলেও বলবে।
‘সে কী বলল তোমায়? শোভু তাকে কী বলেছে?’
গঙ্গাপ্রসাদ টেবলে একটা চড় বসালেন, তাঁর কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত, প্রায়—চিৎকারের মতো একটা আওয়াজ গলা থেকে বার করে। তাঁর চোখে রাগের ছায়া, নাক ফুলে উঠেছে।
‘শোভনেশ বলেছে আবার আসবে।’
‘কেন? তোমার সঙ্গে কী সম্পর্ক আর? তোমার কাছে এসে কী লাভ?’
‘তা আমি জানি না, তবে আসবে। হয়তো কোনো দরকার আছে।’
‘কী দরকার, তোমার সঙ্গে তার কী দরকার? টাকাপয়সা চাইবে? কিন্তু ওর তো কোনো টাকা নেই, সম্পত্তিও নেই। বাড়িটা একজনের কাছে মর্টগেজ ছিল, তোমাদের বিয়েরও আগে থেকে। খেতে পেত না, ছবিটবি কী আর এমন বিক্রি হত? তোমরা ভাব, আর্টিস্টরা লক্ষ লক্ষ টাকা ছবির বিক্রি থেকে পায়। আরে, সে তো এই ছ—সাত বছর হল পাচ্ছে। তাও ভারতে মাত্র কয়েকজনই টাকা করেছে। শোভুর ছবি সবেমাত্র বাজার পাচ্ছে আর তখনই ও কাণ্ডটা করল। তার আগে ইলেকট্রিক বিল, বাড়ির ট্যাক্স বহুবার আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে গিয়ে দিয়েছে। পুরোনো আমলের সব ভাড়াটে, ভাড়াও ছিল সামান্য, আট—দশ মাস করে ভাড়া ফেলে রাখত, ঠিকমতো দিত না, তাই দিয়ে শুধু ভাতে ভাত খেয়ে চলত। ঝি—চাকর পর্যন্ত ছিল না। তিন পুরুষ ধরে গড়িয়ে গড়িয়ে কুঁজোর জল খেলে কিছু কী আর থাকে? একটা ফোঁটাও আর ছিল না। …আমাকে বলেছিল, ‘তোর ম্যাগাজিনের জন্য কিছু কাজ আমাকে দিয়ে করা। টাকার খুব দরকার।’ করিয়েছিলাম…অচল অচল, ম্যাগাজিনের পক্ষে অচল।’
‘ব্যাঙ্কে ওর টাকা ছিল।’
‘ছিল, হাজার সতেরো। কোর্টে দরখাস্ত করে আমি ম্যান্ডেট হোল্ডার হই ওরই অনুরোধে। ও তখন জুডিসিয়াল কাস্টডিতে। আমি চেয়েছিলাম তোমাকে করাতে, তাইতে ও প্রচণ্ড আপত্তি জানিয়েছিল। কী বলেছিল জান?’
‘না।’
‘রোহিণীকে ভালো চিনি না, বুঝি না। ও বাইরের লোক, অল্পদিনের আলাপ। তুই আমার বহুকালের বন্ধু, বহুকালের চেনা। আমি তোর ওপরই নির্ভর করি। এই হচ্ছে শোভনেশ, তোমার স্বামী! ব্যাঙ্কের টাকা মামলার জন্য উকিলকে দিয়েছি, আমি নিজেও অনেক টাকা খরচ করেছি। পাইপয়সা হিসেব রেখে দিয়েছি। যখন ওর ট্রায়াল চলছে, তুমি তখন দিগম্বর বর্ধন লেনের বাড়িতেই। কী করে তোমার থাকা—খাওয়া চলত, তার খোঁজ কি কখনো নিয়েছে?’
.
‘আমার ধারণা ছিল, শোভনেশের ব্যাঙ্কের টাকা আর ছবি বিক্রির টাকা—।’ রোহিণী ইচ্ছে করেই বাক্য অসম্পূর্ণ রাখল। তার বদলে সে নজরটা তীক্ষ্ন করে গঙ্গাপ্রসাদের হাবভাব লক্ষ করার কাজ শুরু করল।
‘ছবি! ছবিগুলো?’ ঝুঁকে গঙ্গাপ্রসাদ টেবলে বুক ঠেকালেন। যেন হামাগুড়ি দিয়ে ওধারে যাবেন। ‘ছবি কোথায় দেখলে?’
‘অনেক ছবি তো স্তূপ হয়ে ওর স্টুডিয়োতে পড়েছিল দেখেছি। প্রায় চল্লিশ—পঞ্চাশটার মতো, নানান সাইজের। একদিন তো আপনি খানচারেক নিয়েও গেলেন, বললেন মামলার খরচ তোলার জন্য বিক্রির চেষ্টা করবেন।’ অত্যন্ত নিরীহ, অনুগত কণ্ঠে, যাতে গঙ্গাপ্রসাদ আহত না হন, এমন ভঙ্গিতে রোহিণী বলল।
কিন্তু গঙ্গাপ্রসাদের মুখের ভাব নিমেষে বদলে থমথমে হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড রোহিণীর মুখের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘তুমি কি শোভনেশের বিষয়—আশয় নিয়ে দাবি জানাচ্ছ?’
‘না না গঙ্গাদা, আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমার কোনো লোভ নেই, আমি ওর একটা জিনিসও পেতে চাই না, ছুঁতেও চাই না।’
‘তাহলে আজ এসব কথা উঠছে কেন? ব্যাঙ্কের টাকা, ছবি বিক্রির টাকা, এসব কি তুমি এখন বলোনি?’
‘কথার পিঠে কথায় বলে ফেলেছি।’
‘যে ছবিগুলো স্তূপ হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছিলে, সেগুলির কী হাল হয়েছিল জান? পোকায় কেটে, ভাঙা জানলা দিয়ে বৃষ্টির জল এসে, তার একটারও আর টাঙাবার মতো অবস্থা ছিল না। পাঁচটা পয়সা দিয়েও কেউ তা কিনত না।’
ঘরে কিছুক্ষণের জন্য নীরবতা বিরাজ করল। রোহিণী মাথা নামিয়ে, গঙ্গাপ্রসাদ সিলিংয়ের দিকে মুখে তুলে।
‘শোভু আবার আসবে, হয়তো আশ্রয় কিংবা টাকা চাইবে। কী করবে তখন?’
‘গঙ্গাদা, এসব কিছুই হত না যদি বিয়ে না হত। আপনি যদি তখন আমাকে একবারও বলতেন—।’
‘কী বলতাম?’
‘ওদের পাগলের বংশ।’
‘তোমায় কে বলল?’
‘গত চার পুরুষ ধরে কেউ—না—কেউ পাগল হয়েছে ওদের বংশে।’
‘কে বলল তোমায়?’ গঙ্গাপ্রসাদ টেবলে চড় মেরে ধমকে উঠলেন। ‘এসব তো আমার কাছে নতুন কথা।’
রোহিণী বলতে যাচ্ছিল, সেদিন আপনার মুখ থেকেই কথাটা বেরিয়ে এসেছিল; ‘পাগলের বংশ তো, দেখো, হয়তো গোয়াবাগান থেকে মোমিনপুর পর্যন্ত বোশেখ মাসে হেঁটে আসতে কেমন লাগে বোঝার জন্য হয়তো—নাও অপেক্ষা করে লাভ নেই, আমরা খেতে বসে যাই।’ কিন্তু সে ঠিক করে ফেলেছে, বেশি কথা আর বলবে না। অন্যদের খবরই এবার থেকে নেবে নিজেকে আড়াল করে।
‘কথা বলছ না যে?’
‘আমার উপরের ফ্ল্যাটে একজন মহিলা থাকেন, যিনি একসময় দিগম্বর বর্ধন লেনের ওই বাড়ির একতলায় ভাড়া ছিলেন। তিনিই আজ আমায় বলেছেন।’
গঙ্গাপ্রসাদ চোখের চাহনি ত্যারচা করে কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভেবে নিলেন।
‘বুঝেছি। ওদের একতলায় হাজব্যান্ড—ওয়াইফের একটা ফ্যামিলি ছিল। বউটি সুন্দরী, শোভুরই বয়সি। আশ্চর্য, তিনিই এখন কিনা তোমার উপরের ফ্ল্যাটে! কী অদ্ভুত ব্যাপার। কিন্তু ওরা বাড়ি ছেড়ে উঠে গেল কেন?’
‘ওঁর স্বামী বদলি হলেন, তাই বাসা ছেড়ে দেন।’
বিন্দু বিন্দু হাসি গঙ্গাপ্রসাদের ঠোঁটের কসে জমে উঠল। তারপর ঠোঁটটা চওড়া করে সারা মুখে ছড়িয়ে দিয়ে দু—হাতের আঙুলের মধ্যে আঙুল জড়িয়ে নিলেন।
‘তাই বলেছে বুঝি?’
রোহিণী একটু অবাক হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, তাই তো বললেন।’
‘মিথ্যেবাদী।’ গঙ্গাপ্রসাদ একটা খুদে আগ্নেয়গিরির মতো হয়ে, জ্বালামুখ থেকে লাভাস্রোত বার করলেন। ‘সী ইজ এ লায়ার। চল্লিশ—বিয়াল্লিশ বছর পরও কিনা মিথ্যা কথা বলছে! শোভনেশের আজকের এই অবস্থার জন্য যদি কাউকে দায়ী করতে হয়, তাহলে ও—ই সেই লোক, যার থেকে এই মার্ডারের প্রথম সূত্রপাত।’
.
রোহিণীকে এখন যদি কেউ বলে, কাল থেকে কলকাতার ফুটপাথে একটিও হকার বসবে না, রাস্তাগুলোয় একটিও খানাখন্দ, ঢিপি থাকবে না, হাওড়া ও শেয়ালদা থেকে লোকাল ট্রেন কাঁটায় কাঁটায় সঠিক সময়ে ছাড়বে এবং পৌঁছবে, সে বিশ্বাস করতে রাজি। এমনকী যদি তাকে বলা হয়, গাওস্করের সব ব্যাটিং রেকর্ড রাজেন ভেঙে দেবে, তাও সে বিশ্বাস করবে। কিন্তু গঙ্গাপ্রসাদ যা বললেন, তার তো কোনো মাথামুণ্ডু সে হদিশ করতে পারছে না।
‘কী বলছেন গঙ্গাদা! কী শান্ত নিরীহ ভদ্রমহিলা, এই বয়সেও কী সুন্দরী, মার্জিত, পরিপাটি ব্যবহার, আর আপনি বলছেন মার্ডারের পিছনে এঁর হাত রয়েছে? কীভাবে সম্ভব?’
‘মেয়েদের শরীরের প্রতি শোভনেশের যে ঝোঁক, যে আগ্রহ, যে দুর্বলতা, যেটা ওকে ন্যুড স্টাডির দিকে টেনে নেয়, যেটা ওকে মেয়েদের দেহ সম্পর্কে বাতিকগ্রস্ত করে তোলে, আর তারই ফলে মডেলের সঙ্গে নানারকম মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, ইনভলভমেন্ট, সবশেষে যা কালমিনেট করে মার্ডারে, এর গোড়াপত্তন ওই তোমার উপরের মহিলাটি থেকেই। কী নাম ওঁর?’
‘জানি না। তবে ওরাও বদ্যি।’
‘ওঁর নাম সুজাতা গুপ্ত, ওঁর স্বামীর নাম হৃদয়রঞ্জন গুপ্ত। লোকটি স্ত্রীর মতোই ছোটোখাটো, বেঁটে, কিন্তু গায়ের রং স্ত্রীর বিপরীত, ঘোর কালো আর ডান পা—টা ছোটো একটু, খুঁড়িয়ে হাঁটেন।’
রোহিণীর শিরদাঁড়া বেয়ে সিরসিরানিটা চেয়ারে পৌঁছল। অবিশ্বাস্য বলে কোনো শব্দ যে এই গ্রহের কোনো অভিধানে আছে, আর সে তা মানতে পারছে না। এখন সে বিশ্বাস করতে রাজি, তুলে দেওয়া হকাররা আবার ফুটপাতে ফিরে আসবে না বা বিনা টিকিটে কেউ লোকাল ট্রেনে উঠবে না। গঙ্গাদা যা বললেন, ঠিক ওইরকমই মিশকালো, সামান্য খোঁড়া, নিরীহদর্শন এক বেঁটে লোককে সে কয়েকবার তাদের বাড়ির সিঁড়িতে দেখেছে।
‘এই পরিবারের সঙ্গে শোভুর খুবই হৃদ্যতা হয়, বিশেষ করে সুজাতার সঙ্গে। ভিজে কাপড় মেলা বা তোলার ছল করে উনি দিনে দু—তিনবার উপরে যেতেন। শোভুর আঁকার ঘরে, পরে যেটাকে ও স্টুডিয়ো বলত, সেখানে উনি গিয়ে গল্পটল্প করতেন। শোভুও ওদের ঘরে যেত। উনি প্রায়ই আবদার ধরতেন, ওঁর একটা ছবি এঁকে দেবার জন্য। ওঁর কয়েকটা পোর্ট্রেট স্কেচও করেছিল। সেগুলো অবশ্য ওঁকে দিয়ে দেয়। কিন্তু উনি চান ফুল ফিগারের ছবি, ক্যানভাসে। শোভু করছি করব বলে এড়িয়ে যাচ্ছিল। একদিন নীচে ওদের ঘরে গিয়ে সে সুজাতাকে—’
টেলিফোন বেজে উঠেছে।
‘হ্যাঁ বলছি, আচ্ছা ঠিক আছে, এখন আমি ব্যস্ত, পরে কথা বলব।’
রিসিভার রেখে গঙ্গাপ্রসাদ বললেন, ‘অত বছর আগের কথা, শোভু আমায় যা বলেছিল, তাই বলছি। ও তো ভালো করে গুছিয়ে কথা বলতে পারে না, খাপছাড়াভাবে বলেছিল। আমারও এখন সব মনে নেই।’
গঙ্গাপ্রসাদ কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে থেকে বললেন, ‘শোভুর তখন সবে বিয়ে হয়েছে, কিন্তু ছবিই তখন ধ্যানজ্ঞান। নামকরা মাস্টারদের ছবির অ্যালবাম এখান—ওখান থেকে চেয়ে এনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে স্টাডি করত, কপি করত। একটা কালেকশন এনেছিল, যাতে শুধুই মেয়েদের চান করার ছবি। নাম ছিল ‘বেদারস’। পৃথিবীর বিখ্যাত দশজনের আঁকা আঠারোটা ছবি। সবই ন্যুড, সেমি ন্যুড।
‘আর একটা অ্যালবাম ওর কাছে ছিল, নাম ‘রিক্লাইনিং উওম্যান’। বিছানায়, সোফায়, ডিভানে নানা ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে শোয়া ন্যুড মেয়েদের ছবি। অয়েলে পেনসিলে প্যাস্টেলে আঁকা। এতে ফ্রেঞ্চ আর্টিস্ট বালথাসের আঁকা একটা ছবি, নাম ‘দ্য রুম’ শোভুকে খুব আকর্ষণ করে। আমি ছবিটা দেখেছি। একটা ন্যুড মেয়ে ডিভানে চিত হয়ে হেলান দিয়ে, ডান পা মেঝেয় লম্বা করে ছড়ানো, হাঁটু মুড়ে বাঁ পা—টা ডিভানে উঁচু করে তোলা, ডান হাতটা আলগাভাবে ঝুলে রয়েছে, তার মাথাটা বোধ হয়…যতদূর মনে পড়ছে, পিছনদিকে করা, মুখটা সিলিংয়ের দিকে তোলা, কিংবা মুখটা সম্ভবত ডানদিকে ফেরানো…ঠিক মনে করতে পারছি না। ঘরের বিরাট উঁচু জানালার পর্দা সরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা বেঁটে বামনাকৃতির মেয়ে, মুখটা তেকোনা। প্রখর আলো জানলা দিয়ে এসে পড়েছে ন্যুড ফিগারটার উপর। ঘরের অন্ধকার কোণে টুলের উপর বসে আছে একটা কালো বেড়াল। ছবিটা অয়েলে আঁকা। ভীষণভাবে শোভুকে তখন ছেঁকে ধরেছিল চিন্তাটা, এইরকম একটা ছবি তাকে আঁকতেই হবে। আমায় বলেছিল, দিনরাত ছবিটা হন্ট করছে, রাতে ঘুমোতে পারি না। জিজ্ঞাসা করত, মেয়েটা ডেড না অ্যালাইভ, তোর কী মনে হয়? আমার কিন্তু মনে হয়েছিল…থাক তোমাকে তা আর বলা যায় না।’
‘না না বলুন।’ রোহিণী আগ্রহভরে বলল। তার উপরের ফ্ল্যাটের মহিলা সম্পর্কে জানার জন্য যে কৌতূহলটা চারাগাছের মতো গজিয়ে ছিল, সেটা এখন ডালপালা ছড়ানো একটা তদন্তের বিষয় হয়ে উঠেছে। গঙ্গাদা যা বলছেন, তাতে তো দু—জনের কথার মধ্যে অনেক অসংগতি দেখা যাচ্ছে! দু—জনেই ষাটের উপর, এই বয়সে ইচ্ছে করে তথ্য বিকৃতি কেউ করে না। কিন্তু একজন অবশ্যই করছে। কিন্তু কেন?
‘না থাক, ওটা খুব জরুরি কিছু বলার কথা নয়।’
‘সেক্সুয়াল কিছু কি?’
‘ওইরকমই। মুখটা আবছা অন্ধকার মাখানো, শরীরের ভঙ্গিতে মনে হয়েছিল রিল্যাক্সড অবস্থায় কিছু একটা যেন এনজয় করছে। যাকগে…আমাদের যা কথা হচ্ছিল, কী যেন বলছিলাম?’
‘শোভনেশ ছবির অ্যালবাম চেয়ে এনে স্ট্যাডি করত, কপি করত।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ…একদিন বেদারস নামের অ্যালবামটা খুঁজে পেল না। চেয়ে আনা পরের জিনিস, দুষ্প্রাপ্যও। খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে নীচে এল। সুজাতা স্টুডিয়োতে আসে, হয়তো সেই নিয়ে গিয়ে থাকতে পারে, এই ভেবেই শোভু গিয়েছিল। ওদের ঘরে ঢুকেই সে থমকে দাঁড়ায়। বালথাসের ছবিটার মতোই ঘরটা আধো অন্ধকার, শুধু জানলাটা দিয়ে আলো এসে পড়েছে খাটে, আর সুজাতা ঠিক সেই ন্যুড মেয়েটার মতো বালিশে পিঠ দিয়ে আধবসা অবস্থায়, মাথা পিছনে হেলিয়ে ঘরের সিলিংয়ের দিকে মুখ তুলে। বাঁ হাতটা ঝুলছে খাট থেকে। ডান হাঁটুটা মুড়ে উঁচু করা। তবে সুজাতার শরীর একটা চাদরে ঢাকা ছিল।
নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে অন্তত মিনিট পাঁচেক ধরে সে তাকিয়েছিল। তখন মনের মধ্যে কিছু একটা ঘটে যায়।’
‘কী ঘটে?’
‘সেটা আর ব্যাখ্যা করে আমায় বলেনি। শুধু বলেছিল, ‘এই ঘরটাকেই যেন বালথাসের রুম মনে হল।’ অ্যালবামটার কথা জিজ্ঞাসা করতে সুজাতা বলল, ‘হ্যাঁ সে নিয়ে এসেছে। বালিশের নীচে রয়েছে, শোভু বার করে নিক। তার নিজের উঠে বার করে দেবার ক্ষমতা নেই। ক্ষমতা না থাকার কারণ, স্বামী এমন বেধড়ক পিটিয়েছে যে, নড়ে বসার জোরটুকুও আর নেই।’
রোহিণীর মুখ থেকে একটা শব্দ বেরোল আঁতকে ওঠার মতো। ‘বলেন কী। লোকটাকে যতটা দেখেছি, তাতে তো খুব শান্ত, ভীরু ভীরু মনে হয়েছে।’
‘এই ধরনের লোকেরা শান্তশিষ্ট মার্কাই হয়। জেলাসি থেকেই এই হিংস্রতা। পছন্দ করত না সুন্দরী বউ একটা সুদর্শন ছেলের সঙ্গে মেলামেশা করুক বা কথা বলুক। অন্তত হৃদয়রঞ্জনের থেকে শোভু অনেক আকর্ষণীয় ছিল। অনেকবারই এই নিয়ে ওদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়েছে, লোকটা চড়চাপড়ও মেরেছে, কিন্তু বউ জেদ ধরেই স্বামীকে অগ্রাহ্য করে ওপরে গেছে। এরপর ঘরে অ্যালবামটা দেখেই লোকটা ক্ষেপে যায়। ওইরকম সব ছবি যে—মেয়েছেলে দেখে, তার তো চরিত্র বলে কিছুই নেই, সে তো সন্ধেবেলায় মুখে রং মেখে বউবাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে সিগারেটও খেতে পারে। শুরু হয় তর্কাতর্কি, তারপর লাঠি দিয়ে পেটানো।
‘সুজাতা গলা থেকে চাদর নামিয়ে শোভুকে দেখায়, তখন ওর ঊর্ধ্বাঙ্গে কোনো বস্ত্র ছিল না, মারের দাগড়া দাগড়া দাগ থেকে বোঝা যাচ্ছিল, কী ভয়ংকর বীভৎস রাগে লোকটা জ্বলছিল। দেখতে দেখতে শোভুর ব্রেইনে শর্ট সার্কিট হয়ে সে হঠাৎ সব অন্ধকার দেখতে থাকে।
‘আমাকে ও বলেছিল, ‘ইলেকট্রিক বালব ফিউজ হবার সময় যেরকম একটা শব্দ হয়, ঠিক সেইরকম যেন একটা শব্দ মাথার মধ্যে হল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, অবশেষে আমিই তাহলে পাগল হলাম।’ সেই অবস্থাতেই ও সুজাতাকে বলে, ‘ঠিক এইভাবে হেলান দিয়ে শোয়া তোমার ছবি আঁকব, পাগল হয়ে যাবার আগে।’
‘দিন সাতেক পর থেকে সুজাতা দোতলার স্টুডিয়োতে সিটিং দিতে শুরু করে।’ গঙ্গাপ্রসাদ কথা থামিয়ে রোহিণীর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে যোগ করলেন, ‘ন্যুড হয়ে।’
দপ করে রোহিণীর চোখের উপর ভেসে উঠল ষাট বছরের এক মিষ্টি শান্ত মহিলার মুখ। আশ্চর্য। কে বলবে উনি চল্লিশ বছর আগে এমন দুঃসাহসিক কাজ করেছিলেন।
‘স্বামীকে উপেক্ষা জানাবার জন্যই বোধহয়।’
‘তার থেকেও বেশি, ঘৃণা প্রকাশের জন্য। শোভুর মনে একটা বিশ্বাস তারপর বদ্ধমূল হয়ে যায়। সে যে পাগল হল না তার কারণ, ন্যুড মেয়ের ছবি আঁকার জন্য। ওর মনে হল এটা একটা তুক। নিজেকে রক্ষা করার জন্য এটা তাকে করে যেতেই হবে।
‘ওরা পাগলের বংশ এ কথাটা ঠিক নয়। সুজাতাই বোধ হয় তোমাকে বলেছে। কিন্তু ওকে এই ধারণাটা সম্ভবত শোভুই দিয়েছিল এই বলে যে, সে পাগল হয়ে যাচ্ছিল শরীরে ওইরকম অত্যাচারের নমুনা দেখে। আমাকেও তাই বলেছে। একটা ইন্সট্যান্ট রিয়্যাকশন থেকেই ও বলে ফেলে আর সেটাকেই কল্পনায় ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সুজাতা গুপ্তর মনে হয়েছে পাগলের বংশ! ক্র্যাপ, ব্লাডি ট্র্যাশ, মিথ্যাবাদী।’
‘ওঁর ক—টা ছবি শোভনেশ এঁকেছিল?’
‘ওই একটাই, কেননা স্বামী জানতে পেরে যায়। একদিন সকালে লোকটি উপরে স্টুডিয়োয় এসে বউয়ের ওইরকম ছবি দেখে ক্যানভ্যাসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফ্রেম ভেঙে ফেলে ছবিটাকে দু—পায়ে মাড়িয়ে শেষকালে শোভুকে অ্যাটাক করে। আমার বাড়িতে নিত্য নামে একজনকে তুমি বোধ হয় দেখেছ, মনে আছে কি?’
‘হ্যাঁ, খুব রোগা, টাক মাথা, কথা একটু বেশি বলে।’
‘এখন বাসুদেবপুরে থাকে। বাড়ি জমিজমা সব ওর জিম্মেতেই রয়েছে, চোর নয়। বাচ্চচা বয়স থেকে শোভুদের বাড়িতে চাকর ছিল। অবস্থা পড়ে যেতে ওরা ছাড়িয়ে দেয়, আমি নিয়ে আসি। বনেদি বাড়ির পুরোনো লোকজন এক রেয়ার অ্যান্টিক, সাজিয়ে রাখার জিনিস। তা সুজাতার স্বামী যখন পেপার ওয়েট দিয়ে শোভুকে মারতে যায় তখন নিত্য ওখানে ছিল, সে—ই হাতটা চেপে ধরে, ঠেলে ঘর থেকে বার করে দেয়। এর দু—মাসের মধ্যেই লোকটা অফিসের ট্রান্সফার নিয়ে কোথায় যেন বউ নিয়ে চলে যায়।’
‘জলন্ধরে, আমায় তাই বলেছেন। আচ্ছা, শোভনেশের তো তখন বিয়ে হয়ে গেছে। ওর বউয়ের কোনো রিয়্যাকশন হয়নি?’
‘হয়তো হয়েছিল। কমলা ভীরু, নিরীহ, কুনো ধরনের ছিল। চির রুগণ। সাত চড়ে রা কাড়ত না। ও বাড়িতে অতবার গেছি, একবারও চোখে দেখতে পাইনি। বাইরের ঘরেও আসত না।’
‘কীভাবে মারা গেল?’
‘প্রেগনান্ট ছিল। বাথরুমে পিছলে পড়ে গিয়ে প্রচণ্ড হেমারেজ হয়। ক্যাম্বেল হাসপাতালেই মারা যায়।’
রোহিণী আবার ধাক্কা খেল। কমলার মৃত্যুর তিন নম্বর কারণ। শোভনেশ বলেছিল ম্যালিগন্যান্ট টাইফয়েড, সুজাতা গুপ্ত বলেছেন দোতলা থেকে লাফিয়ে নীচে পড়ে এবং তাঁর সন্দেহ এটা নিছকই আত্মহত্যা নয়। আর গঙ্গাদা বলছেন অ্যাকসিডেন্ট। কিন্তু সে তো ঠিক করেই ফেলেছে, কথা না বলে নিজেকে আড়ালে রাখবে। তাই বিস্ময় গোপন করে রইল। একটু আগেও সে বিস্ময় গোপন করেছে, যখন গঙ্গাদা বললেন, শোভনেশদের পাগলের বংশ নয়। অথচ সিধারথ সিনহা তালিকা দিয়ে উলটোটাই লিখেছে, সুজাতা গুপ্তও বলেছেন, পাগল হবার ভয়ে শোভনেশরা সিঁটিয়ে থাকত।
‘ভস্মীভূত শিল্পীদের’ বাকি অংশটুকু পড়া বাকি রয়েছে। রোহিণী এখনই পড়ে ফেলার ইচ্ছায় চনমন করে উঠল। আরও কত অজানা খবর লেখাটায় লুকিয়ে রয়েছে কে জানে! ঝুলির মধ্যে ম্যাগাজিনটা, হাত ঢুকিয়ে তবু সে জেনে নিল রয়েছে কিনা। গঙ্গাদা কি এটা পড়েছেন? কেচ্ছা কেলেঙ্কারির কত রকমের কাঁড়ি কাঁড়ি ম্যাগাজিন যে এখন বেরোচ্ছে, সব কী কেউ পড়ে উঠতে পারে? ইস্টার্ন ম্যাগাজিন বহুরকম পিরিওডিক্যালই কেনে। এইটে,…আহ নামটা এখনও জানা হয়নি, মলাটটাই ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে, এইটে কেনা হয় না। হলে তার চোখে পড়তই।
রোহিণী যখন এই সব ভেবে চলেছে, গঙ্গাপ্রসাদ তখন কলম দিয়ে প্যাডে নিজের নাম সই করছেন আর ঘসে ঘসে সেটা কাটছেন অন্যমনস্ক হয়ে।
আবার ফোন বেজে উঠল। গঙ্গাপ্রসাদ রিসিভারটা কানে দিয়েই বাড়িয়ে ধরলেন, ‘তোমার।’
রোহিণী হাতে নেবার সময়ই বুঝে গেছে ওধারে কে।
‘বলছি। …একটু বসো, এখনি আসছি।’
‘তাহলে তুমি তো…আমায় তো ভাবনায় রাখলে। পাঁচদিন আগে হসপিটাল থেকে দু—জন পালিয়েছে। তাদের একজন যদি শোভু হয়, তাহলে ইতিমধ্যে কলকাতায় এসে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু চিনে তোমার ওখানে গেল কী করে? ঠিকানাটা পেল কোথা থেকে?’
গঙ্গাপ্রসাদের মতো রোহিণীও জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইল। কারোর কাছেই উত্তর জানা নেই। রোহিণী ঝোলাটা কাঁধে চড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। ‘আমি এখন আসি।’
‘তুমি আমার বাড়িতে গিয়ে থাকতে পার, কিংবা বাসুদেবপুরে। সাক্ষী দেবার সময় তুমি যেসব কথা বলেছিলে, আর তাইতে ও যেভাবে রিঅ্যাক্ট করে, সেটা আমিও লক্ষ করেছি। এখন তোমাকে সেফটির কথা ভাবতে হবে।
‘আমার উপরে একজন পালোয়ান থাকে। চিৎকার শুনলেই তিন লাফে হাজির হয়ে যাবে।’
‘ভোলা সাউকে কি তোমার সঙ্গে দেব আজ রাতের জন্য?’
‘না না ওসবের দরকার নেই। ওখানে দারোয়ানের একটা লোহার রড আছে দেখেছি, সেটা চেয়ে নেব। দরজা খোলার আগে দেখে নেব লোকটা কে! যদি ও হয়, তাহলে খুলবই না।’
রোহিণী বেরিয়ে যাচ্ছে ঘর থেকে, গঙ্গাপ্রসাদ ডাকলেন, ‘একটা কথা পরিষ্কার করে দেওয়া ভালো, শোভুর কোনো সম্পত্তি আর নেই। না বাড়ি, না ব্যাঙ্ক ব্যালান্স, না ছবিটবি।’
‘আমি তো বলেই দিয়েছি, ওর একটা কানাকড়িও আমি ছোঁব না। শুধু একটাই বলার ছিল, যদি বিয়ের আগে জানতাম’—রোহিণী বাক্য অসম্পূর্ণ রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। বন্ধ দরজার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গঙ্গাপ্রসাদের মুখ বিকৃত হয়ে উঠল।
আলমারি ঘেরা অফিসের জায়গাটায় একটা চেয়ারে রাজেন বসে। রোহিণীকে দেখে উঠে পড়ল।
‘হয়ে গেছে, চলো। গাড়ি এনেছ?’
‘হ্যাঁ।’
ওরা বেরোচ্ছে, তখন কমলের সঙ্গে দেখা।
‘এখন কেমন আছে?’
‘ভালোই। কাল কী পরশু ছেড়ে দেবে।’
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে রোহিণী বলল, ‘বাসের ধাক্কা খেয়ে কাল ওঁর ছেলের পাঁজরের তিনটে হাড় ভেঙেছে। ছেলেটি ইংরেজিতে এম এ পড়ছে। উনি এখানকার বেয়ারা। ইলিশ মাছ উনিই বাজার থেকে সকালে এনে দিয়েছেন।’
রোহিণীর মন্থর স্বরে শ্রান্তির রেশ। রাজেন আড়চোখে মুখের দিকে তাকাল। কিছু একটা সিরিয়াস ধরনের ব্যাপার যে ঘটেছে, সেটা বুঝতে পারছে। সে কথা বলল না।
একটু দূরে গলির মধ্যে গাড়িটা রাখা। কালো শরীরের, একত্রিশ বছরের পুরোনো হিলম্যান। বহু জায়গায় রংচটা, সামনের একটা মাডগার্ড তোবড়ানো। পিছনের দরজার একটায় দড়ি বাঁধা। এঞ্জিন, চারটে চাকা, ব্রেক ও হর্ন ছাড়া হিলম্যানের বাকি অঙ্গ—প্রত্যঙ্গের উপর মালিকের নিয়ন্ত্রণের কোনো গ্যারান্টি নেই। রাজেন ছাড়া আর কেউ এই গাড়ি চালাতে ভরসা করে না।
গাড়ির পিছনের সিটে পলিথিন মোড়া কয়েকটা পুঁটলি। সামনের দরজা খুলে সিটে বসার সময় রোহিণী ওগুলো দেখে বলল, ‘কী কিনলে?’
‘ক—টা ছোটোখাটো জিনিস, একটা টি—শার্ট, তোয়ালে, ব্লেড।’
রাজেন স্টার্ট দেবার জন্য চাবি ঘোরাল। কয়েকবার কঁকিয়ে উঠে হিলম্যান জানিয়ে দিল। সে অসুস্থ। রোহিণী সারাদিনে এই প্রথম হাসতে শুরু করল। প্রথমে নিঃশব্দে তারপর চাপা খুকখুক করে।
‘নামবো?’
কেন?
‘ঠেলতে হবে তো?’
‘সারাদিনই ওবিডিয়েন্ট ছিল। যেই তুমি উঠলে—’ বলতে বলতে বিব্রত রাজেন নামল। ‘কার্বুরেটরটায়…’। এঞ্জিনের বনেট তুলে সে ঝুঁকে পড়ল। একটু পরেই বনেট নামিয়ে হাতে পেট্রলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে ফিরে এসে চাবি ঘোরাল। বারকয়েক কেশে নিয়ে হিলম্যান চলতে রাজি হল।
‘বুড়ো হয়ে গেছে, রিটায়ার করিয়ে দাও।’
‘এঞ্জিনটা ওভারহল করিয়ে, বডিটাকে রং করিয়ে নিলে দেখবে মারুতি ছোকরারাও আমার বুড়োর সঙ্গে পারবে না।’ রাজেনের গলায় চাপা অভিমান এবং ক্ষোভও।
‘করাচ্ছ না কেন?’
‘টাকা নেই।’
টিরেট্টা বাজার আর চিৎপুরের মোড়ে ট্রাফিকের জন্য গাড়ি দাঁড় করাতে হয়েছে। ওরা পুবদিকে এগিয়ে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিন্যুতে পড়ে বাঁদিকে ঘুরল। গিরিশ পার্ক পর্যন্ত গিয়ে ডানদিকে বেঁকে তারপর বিবেকানন্দ রোড ধরে সোজা যাবে।
‘নেই কেন? হাজার তিনেক তো অফিস মাসে মাসে দিচ্ছে। কিপ্টেমিটা একটু শেখো, এটা শেখার জিনিস, একটা আর্টও বটে। বাড়িতে দাওটাও কিছু?’
‘মাকে হাজার দিই। বাকি দু—হাজার নিয়ে কিপ্টেমির আর্ট চর্চা করা যায় না। বড়দা তার অ্যাম্বাসাডার বেচে মারুতি কিনেছে। আমাকে বলল, তোমার মতোই বিদ্রূপ করে, এবার এটাকে রেহাই দে। টাকা দিচ্ছি, একটা নতুন কিছু কিনে নে। আমার ক্লার্কেরও যে এর থেকে ভালো গাড়ি রয়েছে। ব্যারিস্টার দাদা, কী আর বলব! একবার জজের সামনে দাঁড়ালেই আমার মাইনের টাকা মক্কেলের পকেট থেকে তুলে নেন।’
‘আমি বিদ্রূপ করিনি মোটেই। মায়া হচ্ছে বলেই বললাম।’
‘এখনকার চাকরিটা ছাড়ব ঠিক করেছি। খেলার জন্যই এতদিন ভালো ভালো অফার পেয়েও যাইনি। ওসব জায়গায় নাকে দড়ি দিয়ে খাটায়, খেলার জন্য ছুটিছাটা পাওয়া যাবে না। একটু আগে বুড়োকে রিটায়ার করাতে বললে, তাই মনে পড়ল। এবার নিজের কেরিয়ার দেখতে হবে। এবার খেলা ছাড়ব, এটাই শেষ সিজন। সম্ভব হলে ক্লাব ক্রিকেট ছাড়া আর কিছু নয়। বিসিআই একটা খুব বড়ো কেবল তৈরির কোম্পানি।’
ট্রাফিক ছেড়ে দিয়েছে। মন্থর গতিতে সামনের গাড়িকে অনুসরণ করে রাজেন হুঁশিয়ারভাবে হিলম্যানকে নিয়ে এগোচ্ছে। এঞ্জিন চালু না থাকলে আবার কী মুশকিলে এই ভিড়ের মধ্যে ফেলে দেবে কে জানে!
‘কম্প্যুটারে, টেলি—কমিউনিকেশনে, পাওয়ার স্টেশনে, ডিফেন্সে, স্যাটেলাইট লাঞ্চিংয়ে, রেলওয়েজ, এইরকম বহু কাজে এদের তৈরি ওয়্যারস অ্যান্ড কেবলসের ব্যবহার হয়। এখন এক্সপ্যানশন প্রোগ্রাম নিয়েছে। পেট্রোলিয়াম জেলি ফিল্ড কেবলস আর কয়েল কর্ড তৈরির জন্য, এসব টেলিফোন ইন্সট্রুমেন্ট—এ লাগবে। ওদের প্রোডাকশন ডিভিশনে জয়েন করব সামনের এপ্রিলে। পাঁচ হাজার মাসে, প্লাস গাড়ি, প্লাস ফ্ল্যাট। যাদবপুর থেকে বি টেক করে বেরোবার পরই জোকায় যদি তখন এমবিএ করার জন্য অ্যাডমিশান নিতাম আর এই ক্রিকেটের নেশায় না পড়তাম, তাহলে এখন বছরে লাখ টাকা স্যালারি তো হতই।’
‘এইসব হা—হুতাশ কবে থেকে শুরু করেছ? আমাকে তো কখনো বলোনি?’
‘এসব কাউকে বলা যায় না। একদিন তো বিয়ে হবে, ফ্যামিলি হবে। ক্রিকেটে এত রান জমা হয়নি যে, তাই ভাঙিয়ে জীবন চলে যাবে।’
‘বিয়ে করছ? কাকে?’
‘নিশ্চয়ই একটা মেয়েকে। …ভালো কথা, তখন ফোনে বললে নানারকম চাপ, শরীর—মন ক্লান্ত, ব্যাপার কী?’
‘বলছি, রাস্তাটা পেরিয়ে নাও।’
মহাত্মা গান্ধী রোড পেরিয়ে আসার পর রোহিণী বলল, ‘কাল খবরের কাগজে একটা পাঁচ—ছ লাইনের খবর পড়ার পর থেকেই অদ্ভুতভাবে সময় কাটছে। অবাস্তব অথচ ভয়ের একটা জগতে আমি যেন ঢুকে পড়েছি। শোভনেশ বহরমপুর জেলে আছে, তোমায় তো বলেছি, ওই খবরে রয়েছে বহরমপুর জেল থেকে এক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া আসামি পালিয়েছে।’
‘তাই নাকি?’ রাজেন আদৌ চমকাল না। চোরবাগানের কাছাকাছি এসে গেছে। জায়গাটাকে কলকাতার রাজস্থান বলা যায়। এখানে ট্র্যাফিকের নিয়মকানুন রাজস্থানি মতে চলে। সে রিকশা, ঠেলা, টেম্পো ইত্যাদির ঔদাসীন্যের প্রতি সম্ভ্রম দেখতে এখন যত্নবান। রোহিণীর জন্য কান ছাড়া আর কিছু এখন পাতা সম্ভব নয়।
‘বেশ তো, পালাবার সুযোগ পেলে ছাড়বে কেন?’
‘কিন্তু সে শোভনেশ।’ রোহিণী অধৈর্য হয়ে গলা তীক্ষ্ন করল।
‘তুমি ঠিক জান?’
রোহিণী অপ্রতিভ হয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করেও আর বলল না।
‘নাম দিয়েছে?’
‘না।’
‘ডেসক্রিপশন? কীসের আসামি ছিল?’
‘না, সেসব কিছুই নেই। গঙ্গাদা বহরমপুরে একজনকে ট্রাঙ্ক কলে খোঁজ নিয়েছেন। সে বলল একজন নয়, দু—জন যাবজ্জীবনের আসামি পালিয়েছে, তাও হাসপাতাল থেকে।’
রাজেন শিস দিয়ে উঠল। ‘সাবাস, দু—জন তাহলে! তোমার ধারণা, এদের মধ্যে একজন অবশ্যই শোভনেশ?’
‘যাবজ্জীবন পাওয়া লোক কি গন্ডা গন্ডা পাওয়া যায়?’
‘কাগজ পড়? খুঁটিয়ে পড় কি? আইন আদালতের কলামে চোখ ফেললেই বুঝতে পারবে, জজ হাকিম বিচারপতিরা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় লিখতে লিখতে হাতে টেনিস—এলবো করে ফেলেছে। গাদা গাদা খুন, ধর্ষণ, বউ মারা!’
‘কিন্তু আমার মন বলছে শোভনেশই পালিয়েছে, আর সে এখন আমার কাছে আসার চেষ্টা করছে। কাল একটা লোক দুপুরে ফ্ল্যাটে গিয়ে আমার খোঁজ করেছে। তার যা বর্ণনা শুনলাম, হুবহু শোভনেশ।’
এইবার রাজেন উদবিগ্ন হল। কাল ইডেনে সে রোহিণীকে ভীত—সন্ত্রস্ত হতে দেখেছিল। এখন তার কারণটা বুঝতে পারছে। হঠাৎই অকারণে রেগে উঠেছিল, আবেগভরে দু—চারটে কথা বলেছিল। মানসিক ভারসাম্য হারালে মানুষ যেমন আচরণ করে, তাই করেছিল। অথচ ও যথেষ্ট টাফ মেয়ে, সাহসীও।
গাড়ি গিরিশ পার্ক থেকে ঘুরে সিমলের কাছাকাছি। রাজেন স্টিয়ারিং ছেড়ে দু—হাত মাথায় ঠেকিয়ে কারও উদ্দেশে যেন প্রণাম জানাল রোহিণী অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকাল।
‘দু—জন বাঙালি প্রায় একই সময়ে জন্মেছিলেন, তাঁদের জন্মভিটের ঠিক মাঝামাঝি পয়েন্ট একই জায়গাটা, তাই একটা নমস্কারেই কাজ সারলাম।’ আড়চাখে রোহিণীর দিকে তাকিয়ে রাজেন বলল, ‘এবার রবীন্দ্রনাথের এলাকা ছেড়ে বিবেকানন্দের এলাকায় ঢুকলাম।’
‘জানি। ছোটোবেলায় বাবা আমাদের দু—বোনকে এনে দেখিয়ে গেছলেন বাড়ি দুটো। এরপর দীনবন্ধু মিত্র, ডি এল রায়, রাজা রামমোহন, বিদ্যাসাগর, সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায়, এরকম অনেকের বাড়ির অঞ্চল পড়বে রাজেন, তুমি বাপু কাজ সারতে আর স্টিয়ারিং ছেড়ো না।’
‘পুণ্য অর্জনেও বাধা!’ রাজেন স্বগতোক্তি করল রোহিণীকে শুনিয়ে। ‘ভেবেছিলাম মানিকতলায় মোড় পেরোবার সময় দূর থেকেই বসু বিজ্ঞান মন্দিরের দিকে একটা—।’
বিধান সরণির মোড়। ট্র্যাফিকে হিলম্যান দাঁড়িয়ে গেল। রোহিণী নীচু স্বরে বলল, ‘রাজেন, অদ্ভুত ব্যাপারটা কী জান? একটা ভয়, ছমছমে একটা অনুভব সত্যিই হচ্ছে। কিন্তু তার থেকেও বেশি আমি বিভ্রান্ত। টোটালি কনফিউজড। উলটোপালটা কথা শুনছি একই ঘটনার।’
এই বলে সে সুভাষ গায়েন, উপরের সুজাতা গুপ্ত, গঙ্গাপ্রসাদ আর ‘লালসার আগুনে ভস্মীভূত শিল্পীরা’ থেকে যা শুনেছে এবং পড়েছে, সবই একে একে রাজেনকে বলল। এমনকী নন্দার কাছে শোনা ‘ছেলেধরার মতো’ লোকটার কথাও বলল। আর হিলম্যান ততক্ষণে মানিকতলা মোড় পেরিয়ে, খালের ব্রিজ, বাগমারি, ছাড়িয়ে কাঁকুড়গাছি মোড় থেকে বাঁদিকে ঘুরেছে।
‘এইবার বলো, এখন আমি কী করব?’
‘বলছি। আচ্ছা এই হাসপাতালটার পাশ দিয়ে সল্টলেকে যাবার রাস্তা আছে না?’
‘হ্যাঁ আছে।’
রাজেনের হিলম্যান আচার্য সত্যেন বোস সরণি থেকে ডানদিকে বেঁকে ট্রাম লাইন অতিক্রম করে মানিকতলা ইএসআই হাসপাতালের পাশের রাস্তা ধরল। সন্ধে হয়ে এসেছে, রাস্তার আলো জ্বলে উঠেছে। বাঁদিকে দেবদারু গাছের বাগানওয়ালা গোলাপি রঙের বাড়ি, বোস ইন্সটিটিউট।
‘একটু দাঁড়াও তো এখানে।’
হিলম্যান থামল।
‘ওই বাগানের মধ্যে একজনের একটা কালো বাস্ট রয়েছে মুখটা নীচু করা, হাতে চারাগাছের দুটো পাতা। দারুণ মূর্তি। পুণ্যি করতে আর বাধা দেব না। ফার্স্ট বলে বোল্ড হয়ে এসে তারপর যে বলবে, আমার জন্যই—নাও কাজ সারো।’
‘কিন্তু কে?’ ভ্রূ তুলে, বড়ো বড়ো চোখ করে রাজেন তাকাল।
‘তার মানে! ভারতবর্ষে একটা মানুষের হাতেই তো গাছের পাতা থাকতে পারে!’
‘আমি বিভ্রান্ত। কনফিউজড।’ তারপরই ‘মাই গড’ বলে সে ধড়মড়িয়ে দরজা খুলে নেমে, ছুটে বাগানের রেলিংয়ের কাছে গেল। মিনিটখানেক পর ফিরে এসে স্টিয়ারিং ধরে ফিসফিস করে বলল, ‘গাছেরও প্রাণ আছে, মানুষের মতোই।’
‘মানুষও যদি গাছের মতো হত। মেঘ তৈরি করিয়ে, অক্সিজেন দিয়ে, ছায়া দিয়ে শীতল করে, ফল দিয়ে শুধু উপকার করা ছাড়া ওরা আর কিছু জানে না, পারে না। আর এই গাছকে আমরা—।’
‘মানুষের মতো নিষ্ঠুর জানোয়ার আর হয় না। বাঘ, সিংহীও অকারণে কখনো প্রাণীহত্যা করে না, শুধু খিদে পেলেই ওরা মারে। আর মানুষ?’
‘মানুষের সর্বনাশ করেছে তার ইমোশন। তাই থেকেই যত জটিলতা। নয়তো কী দরকার ছিল শোভনেশের এই খুনটা করার?’
বাঁদিকে বিধান শিশু উদ্যানের পাঁচিল, ডানদিকে বাগমারি কবরস্থানের ঝিল। তার মাঝের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গাড়ি পৌঁছাল ইস্টার্ন বাইপাসে।
রোহিণী নির্দেশ দিল, ‘ডানদিকে, তারপর একটু এগিয়েই বাঁদিকে সল্টলেকে ঢোকার পথ, আর সোজা মাইলখানেক চলে গেলে স্টেডিয়াম।’
‘ইমোশান আছে বলেই আমরা মানুষ। তোমার আমার আছে, তাহলে শোভনেশেরই বা থাকবে না কেন? কিন্তু কথাটা হল, কীভাবে কোনদিকে সেটা চালিত হচ্ছে। তাই তো? এই ধরো এখন আমার—।’
‘হ্যাঁ, তোমার? বলে ফ্যালো।’
‘থাক।’
‘আমি জানি, এখন তোমার কী ইচ্ছে করছে। এই নির্জন রাস্তা, তার উপর আলোগুলোও জ্বলছে না, এই পরিবেশ বিটলেমির ইমোশন ছাড়া তোমার মধ্যে আর কোনো ব্যাপার তৈরি করছে না।’
‘এক সেকেন্ড শুধু গাড়িটা থামাব।’
‘আধ সেকেন্ডও নয়। খবরদার, প্রথম বলে আউট হবার ভয় দেখাবে না।’ …হাত সরাও, অ্যাকসিডেন্ট করে বসবে।’
‘এই ফাঁকা রাস্তায় কীভাবে অ্যাকসিডেন্ট করব?’
‘যা হবার কথা নয়, সেটা হলে তাকে অ্যাকসিডেন্ট বলে।’
‘শোভনেশও তো অ্যাকসিডেন্টে মানুষ মারতে পারে।’
রোহিণী মুখ ঘুরিয়ে রাজেনের দিকে তাকাল। ‘তাই তো! এটা তো আমার মনে কখনো হয়নি!’
‘দিনে অন্তত পাঁচশো লোক এ দেশে গাড়ি চাপা পড়ে, তার একটাও কিন্তু গাড়িওয়ালার ইচ্ছাকৃত নয়। অথচ লোকে প্রথমেই তাদের পেটায় আর গাড়িতে আগুন ধরায়। আমরা ধরেই নিয়েছি, শোভনেশ খুন করেছে।’
‘পুলিশ ইনভেস্টিগেট করেছে, জজ সাক্ষ্য—প্রমাণ দেখেছেন, সবথেকে বড়ো কথা, আসামি নিজেই স্বীকার করেছে। এরপরও কোনো সন্দেহ থাকতে পারে কি?’
‘পারে। হয়তো পুলিশ ঠিকমতো তদন্ত করেনি আর শোভনেশ মানুষজনের কাছ থেকে সমাজ থেকে, নিজেকে সরিয়ে নেবার জন্যই নিশ্চয় প্রচণ্ড মেন্টাল প্রেশারে ছিল, হয়তো বাঁচার ইচ্ছেটা নষ্ট হয়ে গেছিল, তাই কনফেস করে।’
‘ও আমারও গলা টিপে ধরেছিল ন্যুড হয়ে সিটিং দিতে রাজি না হওয়ায়। বাড়িতে আমি পালিয়ে পালিয়ে থাকতাম। আমার ভয় করত, কখন আবার—’
গাড়ি থামাল রাজেন। তারা পৌঁছে গেছে। গেটের দু—ধারে আলো জ্বলছে। বাড়ির ভিতরে ড্রাইভওয়েতে তিনটে মোটর দাঁড়িয়ে, গাড়ি রাখার আর জায়গা নেই। গেটের কাছেই গাড়ি রেখে, পিছনের সিটে রাখা পলিথিন প্যাকেটের থেকে দুটো তুলে নিয়ে রাজেন বলল, ‘দুপুরে ভাত খাওয়ার পর এখনও পর্যন্ত পেটে কিছু পড়েনি।’
‘পথেই গাড়ি থামিয়ে কিছু খেয়ে নিলে পারতে।’
‘তাই তো চেয়েছিলাম, তুমিই তো খেতে দিলে না, উলটে অ্যাকসিডেন্টের ভয় দেখালে।’
‘হয়েছে। তোমার এই খাই খাই রোগটা সারাবার চিকিৎসা দরকার। ওপরে চলো।’
‘চিকিৎসার জন্য?’
রোহিণী কর্ণপাত না করে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করল। তিনতলায় পৌঁছে সে বলল, ‘এই নাও চাবি, ঢুকতে হয় ঢোক, আর নয়তো এখানে দাঁড়াও। আমি উপর থেকে মাছটা নিয়ে আসি।’
এই বলে সে চারতলার সিঁড়ি ধরল। ঘোরার মুখে আড়চোখে দেখল, রাজেন দেওয়ালে ঠেস দিয়ে সিঁড়িতে বসে পা ছড়িয়ে দিল।
দরজা খুললেন যিনি, তাঁকে রোহিণী চিনে নিল। গঙ্গাপ্রসাদের বর্ণনামতো ইনিই নিশ্চয় হৃদয়রঞ্জন। ভিতর থেকে দেখতে পেয়ে সুজাতা ডাকলেন, ‘এসো ভেতরে এসো, মাছটা নেবে তো?’
‘হ্যাঁ।’ বলেই ভিতরে ঢুকে রোহিণী কাঠ হয়ে গেল। খাওয়ার টেবিলে, পিছন ফিরে একজন বসে। দীর্ঘকায় রোগা, ঝাঁকড়া, কাঁচাপাকা চুল। টেবিলে একটা ছিটকাপড়ের তাপ্পি দেওয়া ঝোলা।
হৃদয়রঞ্জন দরজাটা বন্ধ করেছেন। রোহিণী সেটা আঁকড়ে ধরে কী একটা বলতে গেল। মুখ দিয়ে স্বর বেরোল না।
.
‘এসো ভেতরে এসো।’ সুজাতা আবার ডাকলেন।
চেয়ারে বসা লোকটি মুখ ঘুরিয়ে পিছনে তাকাল। হাতের চামচে মালাইয়ের ঢুকরো।
‘উনি আমাদের গুরুভাই। তোমায় বলেছিলাম না, কাল উনি এসেছিলেন।’
লোকটি দু—হাত জড়ো করে কপালে ঠেকাল আর তাই করতে গিয়ে চামচ থেকে মালাইয়ের টুকরোটা টেবিলের উপর পড়ল। রোহিণী তখনও ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। প্রতি—নমস্কার জানাবার বদলে সে ফ্যাল ফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে আছে। কোথায় শোভনেশ!
এই লোকটিকেই তা হলে চঞ্চলা আর নন্দা কাল দেখেছিল। কী নিশ্চিন্তি! আবার একটা ভয় থেকে সে বেরিয়ে এল। রোহিণী দু—হাত অনেক চেষ্টায় তুলল নমস্কার জানাতে। তার মনে হচ্ছে, সারা শরীরটাই একটা ঝরনাধারার মতো তিরতির করে নেমে যাচ্ছে। হাত পা মুখ গলে গলে নিশ্চিহ্ন হয়ে তাকে অদৃশ্য মানুষ বানিয়ে দিচ্ছে। সে দুটো অদৃশ্য হাত তুলে নমস্কার করল। এখন তো সে লোকটির পায়ের উপরও হুমড়ি খেয়ে পড়ে বলতে রাজি, আপনি বাঁচলেন শোভনেশ না হয়ে।
‘কাল আপনি বোধ হয় নীচের তলায় একটা বাচ্চচা মেয়ের কাছে ফ্ল্যাটের নম্বর জানতে চেয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ।’ গুরুভাই বিব্রতভাবে বললেন। ‘চশমাটা পরশু ট্রেনে ভিড়ের ধাক্কায় পড়ে গিয়ে দুটো কাচই ভেঙে গেছে। বনগাঁ লাইনের গাড়ি তো, লোকে বলে রাবণের গুষ্টির লাইন। তা ওটা দোকানে দিয়েছিলাম। কাল নিতে গেলাম, বলল হয়নি। চশমা বিনা ভালো দেখতে পাই না। ভুল করে তিনতলায় বেল বাজিয়ে ফেলি। লম্বা সেমিজ পরা একটি মেয়ে দরজা খুলল। তার পিছনে ছিল একটি ছেলে।’
‘অ্যাঁ!’ সঙ্গে সঙ্গে রোহিণী নিজেকে সংযত করে নিল। ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, মোটাসোটা, মুখটা গোল, গায়ের রং আমার মতোই কালো। পরনে ছিল গলা থেকে গোড়ালি পর্যন্ত হলুদে খয়েরিতে ছোপ দেওয়া ম্যাক্সি।’ সে নন্দার বর্ণনাই দিল এবং তার ম্যাক্সির।
‘হ্যাঁ, ওইরকমই। মেয়েটি প্রথমে বোধ হয় আমাকে চোর—ডাকাত কিছু ভেবেছিল, খুব ভয় পেয়ে গেছিল। দরজাটা খুলেই বন্ধ করে দেয়, তারপর ছেলেটি দরজা খুলে আমার নাম ধাম জিজ্ঞেস করে বলে দেয়, ভুলে করেছেন, ওপরের ফ্ল্যাটে যান।’
নন্দাকে তো বোঝা গেল, কিন্তু ছেলেটা কে? রোহিণী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, ডুপ্লিকেট চাবিটা আজই সে চেয়ে নেবে। দুপুরে ফাঁকা ফ্ল্যাট খুবই বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ফেলে দিতে পারে তার মালিককে।
‘আমার দিদির ছেলেমেয়ে এসেছিল।’ সুজাতা ও হৃদয়রঞ্জন তাকিয়ে আছে দেখে রোহিণীকে কথাগুলো বলতে হল। একটা কনফিউশন, আবার একটা মিথ্যার জাল বোনার ঘটনা। তবে ব্যাপারটা সে বুঝতে পেরেছে। নন্দাকে হুঁশিয়ার করে দিতে হবে।
‘মাসিমা ওটা দিন।’
সুজাতা ডীপ ফ্রিজের পাল্লা খুলতেই সাজানো কুলপিগুলো রোহিণী দেখতে পেল।
‘এখনও দেখছি অনেকগুলো রয়েছে।’
‘বোসো, একটা খেয়ে যাও।’
তার বলাটা বৃথা গেল না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে রাজি হওয়াটা ভালো দেখাল না। রোহিণী একটু বেশিরকম আটপৌরে গলায় বলল, ‘না মাসিমা, যাকে নেমন্তন্ন করেছিলাম, সে নীচে অপেক্ষা করছে।’ তারপরই যোগ করল, ‘আচ্ছা আমি যদি নিয়ে যাই?’
‘নিতে পার।’ মাছের প্যাকেটের সঙ্গে জমানো মালাই ভরা প্লাস্টিকের দুটো কুলপি রোহিণীর হাতে দিয়ে বললেন, ‘একটা তোমার আর একটা তোমার অতিথির। খেয়ে বোলো কেমন লাগল।’
‘নিশ্চয় বলব।’ হালকা ফুরফুরে খুশি এখন রোহিণীর সর্বাঙ্গ জুড়ে। লোকটা শোভনেশ নয়। বহরমপুর হাসপাতাল থেকে যে দুটো লোক পালিয়েছে, তাদের একজন যে শোভনেশই, এমন প্রমাণ সত্যিই তো মেলেনি। মিছেই সে ভয়ে মরছিল।
বহু বছর পর, অন্তত কুড়ি বছর তো হবেই, রোহিণী চার ধাপ বাকি থাকতেই জোড় পায়ে লাফ দিয়ে সিঁড়ির বাঁকের ল্যান্ডিংয়ে নামল। টালটা সামান্য একটু ঝুঁকেই সে কৈশোর দিনের মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, তিনতলার ল্যান্ডিংয়ের দিকে তাকাল। ভয়ের বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে এসে এখন সে আনন্দে আর এক ধরনের দিশাহারা।
রাজেন এখনও দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে পা ছড়িয়ে। তার ঝুলিটা কোলে, হাতে ফ্ল্যাটের দরজার চাবি। চোখ বন্ধ। যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। রোহিণী এবার আগের মতোই জোড় পায়ে ছ—টা সিঁড়ির উপর থেকে লাফ দিল এবং ধপ করে মেঝেয় পড়ে উবু হয়ে বসেই রইল, রাজেনের মুখোমুখি হয়ে।
রাজেন একটা চোখ খুলেই বন্ধ করল।
‘লাফটা ভালোই দিয়েছ।’ ঘুমের ঘোরে বলার মতো জড়িয়ে জড়িয়ে সে বলল, ‘কিন্তু এই বেরেদ্ধ বয়সে হাঁটুর জোর দেখানোটা কি উচিত হচ্ছে? ভেঙে—টেঙে তো যেতে পারে। তখন কে ঘরে বয়ে নিয়ে যাবে?’
‘তুমি।’
‘ওই বিশাল ওজন?’
‘মাত্র আটান্ন কেজি। কোনো যুবকের কাছে যদি এই সামান্য ওজনই বেশি হয়…দু—হাতে বউকে তোলার ক্ষমতা যদি না থাকে, তাহলে…।’
‘বউয়ের উচিত ওজনটাই কমিয়ে ফেলা।’ চোখ বন্ধ রেখেই রাজেন বলল।
‘তাহলে বিয়ে করার আগে তার বারবেল ভাঁজা উচিত।’
‘আমার তাহলে বিয়ে করা আর হল না। আমি বারবেল ভাঁজতে পারব না।’
‘তাহলে আমারও আর বিয়ে হল না।’
‘হবে। কথা দিচ্ছি আমি ভাঁজব।’
‘তাহলে প্রোপোজ করো।’
‘অনেকবার তো করেছি।’ রাজেন এখনও চোখ খোলেনি।
‘ভদ্রলোকের মতো করো, ইংলিশ নাইটরা যেভাবে—’ উঠে দাঁড়াল রোহিণী।
তার কথা শেষ হবার আগেই রাজেন তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। তারপর দুটি হাঁটু মুড়ে বসে, দু—হাত পাশে ছড়িয়ে, মাথাটা হেঁট করে নামিয়ে বলল, ‘মাই লেডি, উড য়্যু ম্যারি মী? প্রিয়ে তুমি কি আমায় স্বামিত্বে বরণ করবে?… রুনি এবার শকুন্তলার মতো ব্লাশ করো, ব্লাশ করো, মুখটা একটু আনত করো, আর চোখটা সামান্য পিটপিট, শ্বাস বন্ধ, নাকটা একটু স্ফীত—করছ?’
‘করছি। একটু কষ্ট হচ্ছে। তুমি এবার মাথা তোল।’
‘অ্যাকসেপ্ট করলে?’
জবাব না দিয়ে, ঝুঁকে রাজেনের চুলে রোহিণী মুখটা চেপে ধরল। আর রাজেনের মুখ চেপে বসল রোহিণীর বুকের মাঝে।
‘ইয়া হুউউ’। রাজেনের চিৎকারটা সিঁড়ি দিয়ে প্রতিধ্বনিত হতে হতে একতলায় নেমে গেল। চারতলাতেও পৌঁছল। তড়বড় করে সে সিঁড়ি দিয়ে দশটা ধাপ উঠে ঠিক রোহিণীর মতোই লাফ দিয়ে পড়ল পায়ের কাছে। দু—হাতে ঊরু দুটো জড়িয়ে ধরে সে রোহিণীকে তুলে ধরল।
‘এই হচ্ছে কি? হাত ব্যথা কোর না, দু—দিন পরই তো খেলা! ব্যাট তুলতে না পেরে বোল্ড হয়ে শেষে আবার ঘাড়ে দোষ চাপাবে।’
রোহিণীকে পাক দিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে রাজেন বলল, ‘আই উইল গেট আ সেঞ্চুরি ফর য়্যু, আই উইল স্কোর এ সেঞ্চুরি ফর য়্যু… আই অ্যাম আ ডন ব্র্যাডম্যান…।’
আর রোহিণী তখন উপরের ল্যান্ডিংয়ে নন্দার ছানাবড়া হওয়া চোখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, হায় আন্টি, আর তুমি কোন নৈতিক অধিকারে ওই কিশোরীকে জ্ঞান দেবে? হতচ্ছাড়া প্রেমই তোমাকে ডোবাল।
‘রাজেন, একজন দেখছে, নামাও।’ রোহিণী ফিসফিস করে বলল রাজেনের কানের কাছে মাথা ঝুঁকিয়ে।
‘কই?’ রাজেন ঘুরল। নন্দা ছুটে উপরে উঠে গেল।
‘তাই তো! এটা যদি এখন শোভনেশ দেখে ফেলত?’ রাজেন মজা করেই বলল রোহিণীকে নামিয়ে দিয়ে।
‘আমার হাত জোড়া, দরজা খোল।’
রাজেন দরজা খুলল। দু—জনে ভিতরে ঢুকল। খাবার টেবিলে বসল।
‘প্লিজ, ওই নামটা আর আমার কাছে কখনো উচ্চচারণ কোরো না।’ স্বাভাবিক অনুত্তেজিত রোহিণীর কণ্ঠ। ‘ওপারের মাসিমা দুটো মালাই দিয়েছেন, দুটোই তোমার।’
অপ্রতিভ রাজেন কুলপির ঢাকনা খুলে দেখল। গন্ধ শুঁকল। দুই তালুর মধ্যে কুলপি ঘসতে ঘসতে বলল, ‘দুটো প্লেট দাও, বার করে দিচ্ছি।’
এই ফ্ল্যাটে রাজেনের প্রথম আসা। কৌতূহলী চোখে সব কিছু সে দেখতে লাগল। কিছুক্ষণ পর চামচ দিয়ে মালাই খেতে খেতে সে বলল, ‘নামটা আমি না হয় উচ্চচারণ করলাম না, কিন্তু অন্যেরা তো করবে। এখনও তো সে তোমার স্বামীই। এখনও সে বেঁচে, এখনও তাকে নিয়ে অনেক কিছু ঘটতে পারে। হয়তো ওই দুই ফেরারিদের একজন…।’
সে নাম উচ্চচারণ না করে থেমে গেল। রোহিণী অনুনয় ভরা চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আর আমাকে ভয়ের দিকে ঠেলে দিয়ো না। অন্তত আজকের দিনটায় নয়।’
‘তাহলে ওই মালাইটা ফেলে না রেখে খেয়ে নাও। দারুণ হয়েছে, বলে দিয়ো।’
‘আর আমি ওপরে যাব না। কেন জানি অস্বস্তি লাগছে ওপর সম্পর্কে।’
‘গঙ্গাদার কথা শুনে? কিন্তু কে সত্যি কে মিথ্যে সেটা তো এখনও সাব্যস্ত হয়নি।’
রোহিণী উত্তর দিল না। রাজেন পলিথিন প্যাকেট থেকে খাবারের বাক্স বার করল।
‘আবার কী?’
‘ধোকলা।’ বাক্স খুলে রাজেন এগিয়ে ধরল।’ খেয়ে দ্যাখো। ডালের জিনিস, নোনতা নোনতা, টক টক, সঙ্গে লঙ্কাও রয়েছে তবে ঝাল নেই।’
পুডিংয়ের মতো জমানো। ধনেপাতা ছড়ানো। রোহিণী একটা টুকরো মুখে দিয়ে, চাহনি মারফত তার পছন্দটা জানিয়ে দিল। উঠে গিয়ে সে সন্দেশের বাক্স আনল।
‘এটা বাঙালি খাবার।’
‘হুমম।’ রাজেনের মুখে তখন আস্ত একটা কড়াপাক। সে দ্বিতীয় পলিথিন প্যাকেটটার দিকে হাত বাড়াল।
‘কী আছে ওতে?’
‘চকোলেট কেক।’
‘থাক ওটা। মালাই, ধোকলা তারপর সন্দেশ! এই সবই যদি খাবে, তাহলে ভাত খাবে কে? খাওয়ানোর কথা তো আমারই। আর তুমি—দাও সরিয়ে রাখি, চোখের সামনে থাকলে—।’
রোহিণী প্যাকেটটা নিয়ে উঠে যেতেই রাজেন পাখা খুলে রেগুলেটর এক পয়েন্টে রাখল।
‘বেশ গরম আজ, ঘেমে গেছি।’
‘আমি তো রোজ মাথা না ভিজিয়ে রাতে চান করি।’ রোহিণী প্লেট তুলে রান্নাঘরে যাবার সময় বলল।
‘আমিও আজ চান করব।’
‘অভ্যেস নেই, ঠান্ডা লেগে যাবে। খেলা রয়েছে না?’
‘মাথায় জল দেব না।’ রাজেন কলঘরের দরজায় গিয়ে ভিতরে উঁকি দিল।
‘ভাতটা চড়িয়ে, মাছগুলোয় সর্ষে লঙ্কা বাটা মাখিয়ে, আমি আগে সেরে নিই।’
‘ততক্ষণে আমার গায়ে জল ঢালা হয়ে যাবে।’ রাজেন সোয়েটার খুলতে খুলতে বলল।
‘ভাত ফুটতে দু—মিনিট লাগবে।’ রোহিণী হাত বাড়িয়ে সোয়েটারটা নিল।
‘টস করব, কয়েন দাও।’
‘কয়েন? বেশ।’ ঝুলির মধ্যে রেজগির ছোট্ট ব্যাগটা। রোহিণী প্রথমে কার্ডিগানটা বার করল, তারপর ম্যাগাজিনটা, তারপর ব্যাগটা। একটা আধুলি সে রাজেনকে দিল।
‘বলো।’ আধুলিটা রাজেনের ডান তালুতে পড়তে বাঁ তালু দিয়ে চেপে ধরে সে বলল।
‘টেইল।’ রোহিণী চোখ বুজে আছে। হঠাৎই তার মনে হয়েছে,এই টস দিয়ে