সঙ্গে সঙ্গে চারটি মেয়েই ইট কুড়িয়ে এলোপাথাড়ি ছুড়তে শুরু করল।
পারতে হবে। পারতেই হবে, নইলে নামতে দেব না। উন্মাদের মতো দীপালি চিৎকার করে উঠল।
আর একটু বাকি। শিবু চেষ্টা করো, চেষ্টা করো। করুণা জোরে ইট ছুড়ল। শিবুর পাশ দিয়ে সেটা এবং এধারে শিবু, একসঙ্গে পড়ল। মাথাটা প্রথমে পাঁচিলে পড়ল, সেখান থেকে দেহটা ছিটকে এল হাত পাঁচেক দূর। বার কয়েক পা দুটো খিঁচিয়ে শিবু মরে পড়ে রইল।
ওরা কেউ কাছে এগোল না। সুপ্রিয়াই প্রথম জড়ানো স্বরে টেনে টেনে বলল, আমি মোটে দু-বার ছুড়েছিলাম, অনেক দূর দিয়ে চলে গেছে।
শীলা শান্ত গলায় বলল, কারুর ইটই ওর গায়ে লাগেনি। বোকার মতো ওঠার চেষ্টা করছিল, এটা অ্যাকসিডেন্ট।
তখন ঘুরে দাঁড়িয়ে সুপ্রিয়া ছুটতে ছুটতে সেই মাটির ঘরের দরজায় আছড়ে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। ব্যস্ত হয়ে ঘর থেকে অরুণ আর চিত্রা বেরোল। তারপর ছুটে এল শিবুর মৃতদেহের কাছে। তখুনি গাড়িতে তুলে ওরা রওয়না হল কলকাতার দিকে।
সুপ্রিয়া শুধু এক বার বলেছিল, যদি বাঘটা এখন বেরোয়! তাছাড়া পথে কেউ কথা বলেনি। সারাপথ ওদের পায়ের কাছে শাড়িটাকা শিবু শোয়ানো ছিল।
একটি মহাদেশের জন্য
আগামীকাল মধ্যরাত্রে ট্রেনে এই মফস্সল শহর থেকে সরকারি কলেজের ইতিহাসের প্রধান ড. প্রফুল্ল ঘোষাল ও তাঁর স্ত্রী করবী চলে যাবেন। ট্রেনে চার ঘণ্টার পথ, বিহার সীমান্তে একটি ক্ষুদ্র কলেজে অধ্যক্ষের পদ নিয়ে যাচ্ছেন। বিকেল থেকে ওঁরা গোছগাছ করছেন। আসবাব এবং ব্যবহার্য জিনিস নামমাত্র। এখানে এসে যে আসবাব কিনেছিলেন সেগুলি ওঁরা নিয়ে যাচ্ছেন না। বইয়ের ব্যাক ও টেবিলটি দিয়ে যাবেন বালিকা বিদ্যালয়ে প্রাইমারি বিভাগের হেডমিস্ট্রেস কুমারী গীতা বিশ্বাসকে; চৌকি ও টুল নেবে মুনসেফ অরুণ সোম; বেঞ্চ ও চেয়ারগুলি চেয়েছে এখানকার বৃহত্তম ওষুধের দোকান ও আড়তের মালিক পরিমল সাঁপুই; উকিল মৃগাঙ্ক বসুমল্লিক মৃদু হেসে মাথা নেড়েছে। দু-বছর এখানে থেকে ঘোষাল দম্পত্তির সঙ্গে এই ক-জনেরই শুধু পরিচয়।
বিকেল উতরে গেছে। ঘরে আলো জ্বলছে। প্রফুল্ল র্যাক থেকে বইগুলি নামিয়ে মেঝেয় রাখছেন। করবী সেগুলি গুছিয়ে একটা চটের থলিতে ভরছেন। প্রফুল্ল নাতিউচ্চ, বলিষ্ঠদেহী, কাঁচাপাকা অবিন্যস্ত চুলে মাথাভরা। চশমার কাচ পুরু। চোয়াল ভারী ও চওড়া। কথা বলেন ধীর ও মৃদু স্বরে; আচরণে শান্ত ও গম্ভীর। ছাত্ররা কলেজে ওঁকে দেখে আড়ষ্ট হয়ে সরে যায়।
পরিচিত কয়জনেই সন্ধ্যা বেলায় শহরের প্রান্তবর্তী এই এক তলা বাড়িতে গল্প করতে আসে। যেদিন কেউ আসে না ওঁরা স্বামী-স্ত্রী বাইরের বারান্দায় চেয়ারে বসে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বাসন্তীর মা রাত্রির আহার ঢাকা দিয়ে রেখে গৃহে ফেরার সময় অস্ফুটে মা যাচ্ছি বলে চলে যায়। করবী তখন বলে, গেটটা বন্ধ করে যেয়ো। করবীর কণ্ঠস্বর মিষ্টি হাসিটিও। হাসলে দুই গালে টোল পড়ে। সে ছিপছিপে, দীর্ঘাঙ্গী, প্রফুল্লর সমানই লম্বা। বোধ হয় উচ্চতা লুকোবার জন্যই ঈষৎ কুঁজো হয়ে থাকে। চুল কিছু পেকেছে। শ্যামবর্ণ গাত্রত্বক তৈলমসৃণ ও উজ্জ্বল, দীর্ঘ চোখ জোড়ায় কিছুক্ষণ তাকালে দর্শক ক্লান্তি ও বিষাদ অনুভব করে। প্রথম স্বামী মারা যাবার দেড় বছরের মধ্যে ওর দুটি ছেলেই মারা যায়। বড়োটি বিমানবাহিনীতে শিক্ষার্থী পাইলট ছিল, পুনার কাছে তার বিমান ভেঙে পড়ে; ছোটোটি ডায়মণ্ডহারবারে কলেজ-বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিক করতে গিয়ে গঙ্গায় ডুবে যায়। এর ছয় মাস পর করবী তার কলেজের সহপাঠী প্রফুল্ল ঘোষালকে বিয়ে করে এই মফসসল শহরে আসে।
এভাবে হবে না, জ কুঁচকে প্রফুল্ল বলল। বইগুলো বাঁধতে হবে, দড়ি আনি।
রান্নাঘরের পিছনে কলঘরসংলগ্ন অন্ধকার কুঠুরিটা অব্যবহৃত হঠাৎ দরকারি বিবিধ জিনিসে ভরা। সেখান থেকে প্রফুল্ল চেঁচিয়ে বলল, টর্চটা আননা তো, কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
টর্চ নিয়ে আসার সময় করবীর মুখে অদ্ভুত একটা হাসি ফুটে উঠল। রান্নাঘরে বাসন্তীর মা ব্যস্ত। কুঠুরির সামনে এসে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে করবী বলল, এই যে!
প্রফুল্ল পাশ থেকে নিঃসাড়ে দ্রুত ওর গলায় দড়ির ফাঁস পরিয়ে টান করে এঁটে ধরল। করবী ফাঁসটা আলগা করার চেষ্টায় দশ-বারো সেকেণ্ড টানাটানি করে ক্রমশ শিথিল হতে শুরু করল। প্রফুল্ল তখন চাপাস্বরে হেসে উঠে এটা চৌত্রিশ বলে ধীরে ধীরে ওকে ছেড়ে দিতেই করবী কাত হয়ে দেওয়ালে হেলে পড়ল। ঠিক এই সময়ই বাইরের বারান্দা থেকে উচ্চ পুরুষকণ্ঠে কে বলল, ডক্টর ঘোষাল আছেন নাকি?
প্রফুল্ল তাড়াতাড়ি বৈঠকখানার দিকে যেতে যেতে বলল, অরুণবাবু নাকি? আসুন আসুন।
প্রফুল্ল দরজা খুলে দিতেই টর্চ নিভিয়ে অরুণ সোম বলল, মিরাও সঙ্গে এল দেখা করে যেতে। বৈঠকখানার ভিতরে এসে বলল, ওরা কেউ আসেনি?
প্রফুল্ল একথার উত্তর না দিয়ে স্মিত হেসে মিরাকে বলল, আসুন, আপনি তো অনেক দিন পর এলেন। করবী বইগুলো গোছাচ্ছে, এখনি আসবে।
ঘোমটা আর একটু টেনে মিরা স্বামীর দিকে তাকিয়ে তারপর প্রফুল্লকে বলল, রোজই আসব আসব করি কিন্তু বাচ্চাদের জ্বরজারি তো নিত্যি লেগেই আছে। এখানকার দুধ-জল কিছুই ওদের সহ্য হচ্ছে না। ছোটোটা কাল থেকে আবার পড়েছে পেটের অসুখে।
মিরার কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ এবং ফ্যাসফেসে। সরু হাতে সোনার চুড়িগুলি এবং শাঁখাটি ঢলঢল করছে। সিঁথির চওড়া সিঁদুর ও কপালের টিপে ওর শুভ্র দেহের রক্তাল্পতা ও শীর্ণতা প্রকট। তুলনায় ছত্রিশ বছরের সুদর্শন অরুণকে অন্তত দশ বছরের ছোটো দেখায়। অরুণ প্রতিদিন ভোরে এক মাইল দৌড়ে এসে আধ সের দুধ খায়, রাতে ইংরেজি ডিটেক্টিভ বই পড়ে এবং নিয়মিত গল্প লিখে সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলোয় পাঠায়, দু-একটি ছাপাও হয়েছে।