এটা কারখানার জমি নয়, খেলার মাঠ। এ-জমির মালিক বটতলা ইনস্টিটিউট।
হবে। ড্রাইভার নিরাসক্ত স্বরে বলল।
রেগে উঠল আনন্দ। প্রায় চিৎকার করে সে বলল, লরি হটাও।
লোকটি বিড়ি ধরাল। জবাব দিল না।
এটা খেলার জায়গা, লরি হটাও এখান থেকে।
রাগে হাত কাঁপছে, সেই সঙ্গে আনন্দ অনুভব করল, বুকের মধ্যে অস্বস্তিকর একটা কিছু জমছে। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, উত্তেজনা আসতে পারে এমন কোনও ব্যাপারে যাবে না, চিন্তাও করবে না। উচিত হয়নি, এভাবে রেগে যাওয়ার মতো ব্যাপারে নাক গলানো ঠিক হয়নি। কিন্তু সরে আসি কী করে। মেয়েরা যে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
আমাকে বলে কী হবে, ম্যানেজারবাবুকে বললাগে যাও।
লোকটা বিড়িতে টান দিয়ে কারখানার গেটে দয়ানিধির দোকানের দিকে চলে গেল। আনন্দ ভেবে পেল না এইবার তার কী করা উচিত। মেয়েরা কোনও কথা না বলে চলে যাচ্ছে। অসহায়ের মতো সে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ চিৎকার করে বলল, টায়ার ফাঁসিয়ে দোব। লরি কী করে চলে দেখব।
মাল খালাস করা মজুররা কৌতূহলভরে তার দিকে তাকাল। দপ দপ করে উঠল আনন্দর রগটা। কিছু করার নেই তার। লরিটাকে টান মেরে লোহাগুলোকে ছুড়ে ছুড়ে রাস্তায় ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে। মেয়ে কটি জেনে গেল, সে একটা অপদার্থ, হামবাগ। ডগুদাকে বলতে হবে, শিবা দত্ত নাকি কথা দিয়েছিল বিকেলে লরি ঢুকবে না, মাঠেও মাল রাখা হবে না! কী হল সে কথার?
রাগে ফুসতে ফুসতে আনন্দ ফিরে এল। অনেকদিন পর আবার বুকে সেই ব্যাপারটা শুরু হয়েছে। নিজের ঘরে এসে সে শুয়ে পড়ল। আর তখনই জলার দিক থেকে ভেসে এল মিষ্টি শিস। তাড়াতাড়ি উঠে বসতে গিয়েই সে বুকের মধ্যে তীক্ষ্ণ একটা খোঁচা দেওয়া যন্ত্রণায় অসাড় হয়ে চাপা আর্তনাদ করল। পলকের জন্য তার মনে হল, এইবার সে মারা যাবে। টপটপ করে চোখ থেকে জল পড়তে শুরু করল তার। সে ভাবল, আমি আর কখনও সেরে উঠব না। এই ঘরটায় চিরজীবন একা পড়ে থাকব। ভগবান, কেন আমায় অন্য কোনও অসুখ দিলে না?
গভীর রাত্রে বৃষ্টি নামল। হাবুর মা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। হাত বাড়িয়ে উত্তরের জানলাটা বন্ধ করতে পারে আনন্দ। ঠাণ্ডা লেগে সর্দিকাশি হবে। ডাক্তারবাবুর বারণ, বলেছিলেন ব্রংকাইটিস যেন না হয়। তা হলে কিন্তু আর কখনও সারবে না।
জানলাটা বন্ধ করার জন্য আনন্দ হাত বাড়াল। তখনই তার মনে হল শিসটা যেন আবার ভেসে এল। বৃষ্টির ছাট মুখে লাগছে। গলা বুক ভিজে গেছে। একটা অস্ফুট স্বর তার বুকের মধ্যে বলছে, আন্দ, আন্দ, লক্ষ্মী হয়ে থাকিস।
হাতটা টেনে নিয়ে আনন্দ ফিসফিস করে অভিমানী গলায় বলল, থাকব না।
আমার আনন্দ খুব লক্ষ্মী, খুব ভাল ছেলে।
আমি ভাল ছেলে হতে চাই না। আমি বেরোতে চাই, খেলতে চাই, এই ঘর থেকে মুক্তি চাই।
না আনন্দ, মেজদা যা চায় তাই করিস। তোর ভালর জন্যই ও শক্ত হয়েছে।
আমি একা থাকতে পারছি না। এভাবে একা থাকলে আমি মরে যাব। তুমি এসে থাকো না আমার সঙ্গে?
আমার আনন্দটা একদম পাগল, থাকব কী করে, আমি যে মরে গেছি। আমিও মরে তোমার কাছে যাব।
না আন্দ, না। তোর কথা শুনে আমার কষ্ট হচ্ছে। তোর দুঃখ দেখে আমার চোখে জল আসছে।
হাতের উপর বৃষ্টির ফোঁটা। আনন্দ চাটতে শুরু করল। মায়ের চোখের জল। মা মেঘ হয়েছে দুঃখটা যখন বাষ্পে রূপান্তরিত হল। আনন্দ বৃষ্টির ছাটের দিকে মাথাটা এগিয়ে আনল।
.
০৬.
সকালে চোখ খুলেই আনন্দ বুঝল তার গা-গরম, চোখ জ্বালা করছে, মাথা ভার। জ্বর আসবে নয়, এসে গেছে। বিছানা থেকে নামল। জানলা দিয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। দৌড় শেষ করে মেয়েরা বোধহয় চলে গেছে। লেডি সোবার্স হয়তো এখনও প্র্যাকটিস করে চলেছে। হাবুর মার গলার স্বর আসছে। রান্নাঘর থেকে। মেজদার নিশ্চয় ঘুম ভাঙেনি। বাবা এতক্ষণে সেরেস্তায় বসে পড়েছে। আনন্দর মনে হল এখনি কাল বিকেলের কথাটা ডগুদাকে বলতে হবে।
ব্লাউজের মতো জামা আর হাফপ্যান্ট পরে কোমরে হাত দিয়ে গীতা হাঁফাচ্ছে। সকালের রোদে চিকচিক করছে ঘামে ভেজা শরীর। জমিতে আঁচড় কেটেই অমল চেঁচিয়ে উঠল।
এক বিঘৎ বেশি!
গীতা হাসল। চোখে অবিশ্বাস।
সত্যি বলছি, তুমি এসে দেখে যাও।
এগিয়ে এসে গীতা ঝুঁকে দেখল। অবিশ্বাস বদলে হল বিস্ময়।
তুমি তো আমায় বিশ্বাসই করো না।
কেন করব? কাল তুই তো কমিয়ে দাগ কেটেছিলি। এক বিঘৎ না আর-কিছু, ইঞ্চি চারেক হবে।
আমার বিঘতের মাপে বলেছি।
অমল হাসতে হাসতে কাছে এসে দাঁড়ানো আনন্দকে বলল, মায়ের আঙুলগুলো কত লম্বা দেখেছ?
গীতার হাতটা সে তুলে ধরল আনন্দর দিকে। ছাড়িয়ে নিয়ে গীতা লোহার শটটা কুড়িয়ে সার্কলে ফিরে গেল।
কাল বিকেলে তুমি চেঁচামেচি করেছিলে লরি দাঁড়ানোর জন্য?
মাথা নেড়ে আনন্দ তাকাল লাইব্রেরির দিকে। দরজা বন্ধ।
ডগুদা আজ সকালে শুনেই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেছে শিবা দত্তর বাড়িতে যাবার জন্য। আমাকে দেখতে বলে গেছে লাইব্রেরি। দারুণ রেগেছে।
একটি লোক বই হাতে আসছে। দেখেই অমল তার নিজস্ব ভঙ্গিতে ছুটল লাইব্রেরির দিকে।
লেডি সোবার্স শট গালে ঠেকিয়ে কুঁজো হয়ে তৈরি। আনন্দ পিছিয়ে এল। মাথাটা আরও ভার লাগছে। শরীরটা দুর্বল, কনুই আর হাঁটুতে ব্যথা। অন্তত একশো জ্বর।
আ আ আহ্….আঁক।
ধপ শব্দ করে লোহার গোলাটা ভিজে মাটিতে বসে গেল। আনন্দ আপনা থেকেই দু-তিন পা এগিয়ে থেমে পড়ল। হাতে করে গোলাটা ওর কাছে পৌঁছে দেবে কি না। ইতস্তত করে ভাবছে। ততক্ষণে গীতা এগিয়ে এল। ভ্রূ কুঁচকে মাটির দিকে ঝুঁকে ইটের টুকরোটা দিয়ে দাগ কেটে, গোলাটা তুলে নিয়ে ফিরে গেল। আনন্দকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনল না। আনন্দ কেমন যেন অপ্রতিভ বোধ করল।