কলাবতী

কলাবতী – মতি নন্দী

স্পোর্টিংলি আমাকে বিচার করবেন

”কম্পিটিটারস ফর দ্য গো অ্যাজ ইউ লাইক ইভেণ্ট, প্লিজ বি রেডি।”

অ্যামপ্লিফায়ারে কথাটা দুবার গাঁক গাঁক করল। তাই শুনে লেডিজ পার্কের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা মেয়েরা তাড়াতাড়ি এগোল শামিয়ানার দিকে।

কাঁকুড়গাছি উচ্চচ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের বাৎসরিক স্পোর্টসের শেষ ইভেণ্ট টিচারদের ব্যালান্স রেস তখন শুরু হতে যাচ্ছে। এটা আসলে ছিল ১০০ মিটার দৌড়।

কিন্তু অনেকেই আপত্তি জানান, অতটা দৌড়তে গেলে তাদের দমে কুলোবে না। তিন দিন তর্কের পর ঠিক হয়, ৫০ মিটার ব্যালান্স রেস। এরপর চার দিন গভীর আলোচনা হয়, কী দিয়ে ব্যালান্স হবে? মাথায় কলসি, হাঁড়ি, সরা, বই—খাতা না দাঁতে চেপে থাকা চামচে রসগোল্লা নিয়ে?

দেশে খরা চলছে, দুঃস্থ মানুষদের কষ্ট বিবেচনা করে খরচ কমাবার কথা ভেবে অবশেষে মাটির সরা মাথায় রেখে ব্যালান্স দৌড়ই স্থির হয়, অবশ্যই বিঁড়ে ছাড়া।

শামিয়ানার নীচে একটা লম্বা টেবল। তাতে প্রাইজ সাজানো। প্লাস্টিকের রঙ—বেরঙের ঝুড়ি, বালতি, টিফিন বাক্স, স্টেইনলেস স্টিলের রেকাবি, ট্রে ইত্যাদি। ফোম রাবারের তিনটি মেয়েদের হাতব্যাগ আর একটা শিল্ড। সভাপতি একজন প্রবীণ সাংবাদিক। তিনি হাজির হওয়ামাত্রই, ওয়ার্ক এডুকেশনের টিচার অসীমা দত্ত শ’খানেক সার্টিফিকেট তাঁর সামনে রেখে যান সই করার জন্য। সভাপতি ঘাড় গুঁজে সই করতে করতে মাঝে মাঝে জিরোবার জন্য পাশের চেয়ারে বসা হেডমিস্ট্রেস মলয়া মুখার্জির সঙ্গে স্কুলের খেলার ব্যবস্থা নিয়ে দু’চার কথা জিজ্ঞাসা করছিলেন। হেডমিস্ট্রেসকে টিচাররা বড়দি বলেন। বয়স প্রায় চল্লিশ, দেখতে সুন্দরী, শিক্ষা বিষয়ে বিলিতি ডিগ্রি আছে। কেন যে বিয়ে করেননি টিচার বা ছাত্রীরা তাই নিয়ে প্রচুর মাথা ঘামিয়ে কিছুই আবিষ্কার করতে পারেনি।

”স্কুলের মাঠই নেই, খেলার ব্যবস্থা করব কী করে?” একটু থেমে ”তবে খেলাধুলোয় উৎসাহ আমরা দিই, খুবই দিই। আমাদের একটি মেয়ে… অসীমা, কী যেন নাম, ওই যে সাঁতারে…”

”সেভেন বি’র রেবা বাড়ুরি, স্টেট চ্যাম্পিয়ানশিপে দুটো রেকর্ড করেছে।”

”হ্যাঁ হ্যাঁ রেবা, ওকে আমরা খুব উৎসাহ দিই। প্র্যাকটিসে যায় বলে দু’ পিরিয়ড আগে ওকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর একটি মেয়ে, কলাবতী সিংহ, এবার মেয়েদের ক্রিকেটে বেঙ্গল টিমে খেলেছে। ক্লাস ইলেভেনে পড়ে, স্টেডি ব্যাট। ইউ.পি—র এগেনস্টে দু’ ঘণ্টা ক্রিজে থেকে বেঙ্গলকে জিতিয়েছে, দারুণ ড্রামাটিক ম্যাচ হয়েছিল, তাই না অসীমা?”

সভাপতি খুবই ঔৎসুক্য দেখিয়ে অসীমা দত্তর দিকে তাকালেন। সেই সময়ই ফিজিক্যাল সায়ান্স আর ইতিহাসের টিচার দু—জন মুখ ভার করে হাজির হলেন।

”কী কাণ্ড দেখুন তো বড়দি। ননীগোপালবাবু আর বসন্তবাবু বলছেন তাঁরাও ব্যালান্স রেসে নামবেন। ওঁরা বলছেন, পুরুষ টিচারদের নামা বারণ এ কথা তো কোথাও বলা নেই। শুধু মেয়েরাই নামবে আর প্রাইজ নেবে, এটা নাকি অগণতান্ত্রিক, তাই ওঁরা দুজন নামবেনই।”

”আচ্ছা, বড়দি, আমরা কি প্রাইজের দিকে তাকিয়ে রেসে নামছি? ওঁরা এমন একটা হিণ্ট দিলেন যে, সব মেয়ে টিচারই খুব রেগে গেছে, বলছে রেস বয়কট করবে।”

বিব্রত হেডমিস্ট্রেস, ”অ্যাঁ! তাই নাকি? কী কাণ্ড?” এই তিনটি শব্দ ছাড়া বলার মতো আর কথা পেলেন না। তিনি একটু ভয়ও পেয়ে গেলেন ‘অগণতান্ত্রিক’ আর ‘বয়কট’ শব্দ দুটোয়। দেশ হোক, রাজ্য হোক, আর মেয়েদের স্কুলই হোক, যাঁরাই এসব চালনার দায়িত্বে আছেন, তাঁদের কাছেই এইসব শব্দ এখন টাইমবোমার মতো। কখন যে ফাটবে কেউ তা জানে না।

”তাহলে কী করা যায়?”

হেডমিস্ট্রেস পরামর্শের আশায় সভাপতির দিকে তাকিয়ে রইলেন। সভাপতি না শোনার ভান করে সার্টিফিকেটগুলোয় সই করে যাচ্ছেন।

”মাত্র দু জন তো, নামুক না। পুরুষদের ব্যালান্স মেয়েদের থেকে কমই হয়।”

”বা রে, মেয়েদের সঙ্গে রেসে পুরুষরা নামবে, এ কেমন কথা?”

”তা ছাড়া ননীবাবুর বাড়ির কাছে পাতাল রেলের কাজ দু বছর ধরে চলছে, হাঁটাচলায় ওঁর ব্যালান্স অনেক বেড়ে গেছে। উনি ফার্স্ট হবেনই।”

”হয় যদি হোক, তাই বলে ওঁর পার্টিসিপেশন তো বন্ধ করা যায় না, সেটা খুবই অগণতান্ত্রিক হবে তাহলে!”

”কিন্তু উনি যে আনডিউ অ্যাডভাণ্টেজ নিয়ে নামবেন তাও আমরা হতে দেব না। বয়কট করব।”

হেডমিস্ট্রেস মলয়া মুখার্জি বিব্রত হয়ে আবার সভাপতির দিকে তাকালেন। সভাপতি মুচকি হাসছেন অর্থাৎ কথাবার্তা সবই তাঁর কানে গেছে। গলাখাঁকারি দিয়ে তিনি বললেন, ”অংশগ্রহণই আসল কথা, পুরস্কার পাওয়াটা নয়। ঘোষণা করে দিন, ব্যালান্স রেসে কোনো পুরস্কার নেই।”

”অ্যাঁ, প্রাইজ থাকবে না।”

ফিজিক্যাল সায়ান্স আর ইতিহাস হতাশায় ভেঙে পড়লেন। এই রেসের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করে একটু বেশি দাম দিয়ে তিনটি লেডিজ হ্যাণ্ডব্যাগ কেনা হয়েছিল। টেবলের একধারে সেগুলো সাজিয়ে রাখা। দুজনে ব্যাগগুলোর দিকে কটমট করে একবার তাকিয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন।

”বাঁচালেন। নইলে কী মুশকিলেই যে…”

হেডমিস্ট্রেসের কথা শেষ হবার আগেই গাঁক গাঁক শব্দে ঘোষণা হল: ”যথেষ্ট সংখ্যক প্রতিযোগীর অভাবে টিচারদের ব্যালান্স রেস শুরু করা যাচ্ছে না, মাত্র দুজন—ননীবাবু আর বসন্তবাবু স্টার্টিং লাইনে এসেছেন। অনুরোধ করা হচ্ছে বাকি টিচাররাও তাড়াতাড়ি আসুন।”

টিচাররা দৌড়বেন, কিংবা, বলা ভাল, মাথায় সরা নিয়ে হাঁটবেন, অতএব মেয়েরা প্রবল উৎসাহে স্টার্টিং লাইনের কাছে ভিড় করে দাঁড়াল। কিন্তু প্রতিযোগীরা অনুপস্থিত।

অ্যামপ্লিফায়ারে আবার অনুরোধ হল যাকে বিদীর্ণ হলোও বলা যায় : ”আবার অনুরোধ করা হচ্ছে…” ইত্যাদি।

”বড়দি, কেউ তো আসছে না।”

বিপন্ন মুখে অসীমা দত্ত বললেন। হেডমিস্ট্রেস ভীতমুখে তাকালেন সভাপতির দিকে। গোটা পনেরো সার্টিফিকেটে সই করা তখনও বাকি। এঞ্জিনের পিস্টনের মতো কলম চালাতে চালাতে সভাপতি মুখ না তুলেই বললেন, ”এক্ষেত্রে পাবলিক অর্থাৎ ছাত্রীদের হাতে রেসের ব্যবস্থাটা তুলে দিন। ওরাই টিচারদের টেনে নিয়ে দাঁড় করাবে। আপনি মেয়েদের সঙ্গে কথা বলুন। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, অফিসে যেতে হবে।”

হেডমিস্ট্রেস অসীমা দত্তর দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকালেন।

”বুঝেছি।” এই বলে অসীমা দত্ত মেয়েদের ভিড়ের দিকে হনহনিয়ে এগিয়ে গেলেন।

মিনিট দুই পরেই দেখা গেল টিচাররা যেখানে জটলা করে আলাদা দাঁড়িয়ে ছিলেন, অন্তত জনা কুড়ি ছাত্রী সেদিকে হইহই করে ছুটে যাচ্ছে।

”রেবাদি, আপনাকে ছুটতেই হবে।”

”অন্নপূর্ণাদি, নামতেই হবে।… আপনার ছোটা আজ দেখব।”

”না, না, কোনো কথা শুনব না আমরা, সেদিন ক্লাসে আপনি যে বললেন বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন!”

”বলেছিলাম। কিন্তু বড্ড মাথা ধরেছে…”

”ধরুক মাথা, এইটুকু তো দৌড়বেন।”

মেয়েরা টিচারদের ঘিরে হাত ধরে টানাটানি শুরু করল। একটু দূরে ননীগোপালবাবু আর বসন্তবাবু মিটমিট করে হাসছেন। মেয়েদের কলরব তখন কোলাহলে পৌঁছে গেছে। কী করে ওরা যেন জানতে পেরেছে, মেয়ে টিচাররা রেস বয়কট করেছেন। হঠাৎ একটি ছাত্রী মুঠোকরা হাত আকাশের দিকে তুলে চিৎকার করল : ”আমাদের দাবি মানতে হবে, দিদিদের রেসে নামতে হবে।”

সঙ্গে—সঙ্গে আর একজন চিৎকার করল: ”ব্যালান্স রেস, ব্যালান্স রেস।” জনা দশেক মেয়ে একসঙ্গে বলল: ”হবেই শেষ, হবেই শেষ।”

”ব্যালান্স রেস বয়কট…”

”মানছি না, মানব না।”

”কাঁকুড়গাছি উচ্চচ মাধ্যমিক…”

”জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ।”

এই সময় হঠাৎ অ্যামপ্লিফায়ার আর্তনাদ করে উঠল : ”গো অ্যাজ ইউ লাইকের প্রতিযোগীরা, তোমরা এবার শামিয়ানার সামনে এসো। তোমাদের প্রতিযোগিতা শুরু হচ্ছে।”

মেয়ে টিচাররা এতক্ষণ নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করছিলেন। হঠাৎ সাত আটজন একসঙ্গে এগিয়ে গেলেন স্টার্টিং লাইনের দিকে। ছাত্রীরা স্লোগান বন্ধ রেখে হইহই করে তাদের সঙ্গ নিল।

দুই পুরুষ টিচারের সঙ্গে সাতজন মেয়ে টিচার মাথায় এক হাতে সরা ধরে স্টার্টারের হুইসলের অপেক্ষায়। রেস শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সরাধরা হাতটা নামিয়ে ওঁরা এগোবেন।

সারা মাঠে রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা। ছাত্রীরা, সংখ্যায় প্রায় দেড়শো, তাদের সঙ্গে আসা বাড়ির লোকেদের ধরলে দুশো—কথা বন্ধ রেখে স্টার্টিং লাইনের দিকে তাকিয়ে। সভাপতি সই করা বন্ধ রেখে ফিসফিসিয়ে বললেন, ”আপনার স্কুলের মেয়েরা খুবই প্রগতিশীল।”

হেডমিস্ট্রেস মাথা হেলিয়ে আরো ফিসফিস করে তৃপ্তকণ্ঠে বললেন, ”কাল ওরা ছুটি চেয়েছে, ভাবছি দু—দিন দেব।”

হুইসল বাজল। মেয়েদের কণ্ঠ থেকে ”হা আ আ” একটা শব্দ পার্কের এবং আশপাশের কাক পায়রা চড়াইদের চমকে দিয়ে আকাশের দিকে উঠে গেল।

রেস শুরু হয়ে গেছে। পনেরো মিটার যাবার পরই অঘটন। চার ফুট দশ ইঞ্চির এবং পঁচাত্তর কিলোগ্রামের, সংস্কৃতের অন্নপূর্ণা পাইন কীভাবে যেন হোঁচট খেয়ে ননীগোপালবাবুর পিঠের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। দুজনের মাথা থেকে সরা তো ছিটকে গেলই, পিঠের উপর পঁচাত্তর কিলোর বোঝা নিয়ে জমি থেকে উঠতে গিয়ে ননীগোপালবাবুর ডান হাতের কবজিটাও মুচকে গেল।

বসন্তবাবু চমৎকার ব্যালান্সে সরা মাথায় রেখে দু—হাত পাশে ছড়িয়ে ধীরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর সামনে ছিলেন আরতি ঘটক এবং তিরিশ মিটারের মাথায় তাঁর সরা পড়ে যাবার উপক্রম হতেই হাত দিয়ে সরা ধরে ফেলে বাতিল হয়েছেন। পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির ও পঞ্চাশ কিলোগ্রামের ভূগোলের ব্রততী বেদজ্ঞ, যিনি ঠিক বসন্তবাবুর পিছনেই আসছেন, হঠাৎ তাঁর পদক্ষেপ দীর্ঘ করলেন। আর পায়ে পা জড়িয়ে বসন্তবাবু টলে পড়তে পড়তে সামলে নিয়ে দেখলেন সরাটা মাথা থেকে মাটিতে পড়ে চার টুকরো হয়ে গেল। ফিনিশং লাইন থেকে তখন তিনি সাত—আট মিটার দূরে।

রাগে ক্ষোভে বসন্তবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, ”ফাউল, ফাউল… ব্রততী আমারে ল্যাং মারসে। আমি প্রোটেস্ট করত্যাসি। দিস ইজ আনফেয়ার।”

”চোওপ, প্রোটেস্ট ফ্রোটেস্ট আবার কী… ল্যাং মেরেচে তো বেশ করেচে।”

প্রায় দুশো জোড়া চোখ বিস্ফারিত, দুশো হৃৎপিণ্ড কণ্ঠনালিতে আটকানো অবস্থায় দেখল ছিপছিপে পাতলা গড়নের একটি শ্যামলা রঙের ছেলে, চোখে কালো কাচের চশমা, মাথায় হলদে কাপড়ের টুপি—সাধারণত তাসা নাচের ছেলেরা যা পরে, টুপির তলায় কিছু চুল ঝুলে রয়েছে ঘাড় আর কানের উপর। শরীর ঢেকে ঢলঢলে ফুলহাতা লাল জামা আর জিনস। চিবুক ঢেকে হালকা ফ্রেঞ্চকাট দাড়িটা পাতলা মুখের গড়নকে কিছুটা ভারিক্কি করে তুলেছে। পরিষ্কার এক মস্তান। পার্কের দুধারেই বস্তি, সম্ভবত সেখান থেকেই উদ্ভূত। কোমরে হাত রেখে পা ফাঁক করে ওর দাঁড়ানোর ভঙ্গি থেকেই বোঝা যায়, হিন্দি ফিল্মের পোকা। বাঁ হাতে শিখদের মত একটি লোহার বালা।

”ল্যাং তো খাবেনই মাস্টারমোসাই, আপনিও কি পরীক্ষার খাতায় ল্যাং মারেন না?”

কোমর দুলিয়ে মস্তান এগিয়ে এল বসন্তবাবুর সামনে। বসন্তবাবু তিনপা পিছিয়ে ব্রততী বেদজ্ঞ নামক সুপুরিগাছের পাশে চলে এলেন।

”কিন্তু আপনি কেন ল্যাং মারলেন দিদি?”

মস্তান ডান হাতের তর্জনী তুলে ব্রততী বেদজ্ঞকে প্রশ্নটা করল। ব্রততী বটের গুঁড়ির অর্থাৎ অন্নপূর্ণা পাইনের পিছনে সরে গিয়ে বললেন, ”আ… আ… আমি আবার কখন ল্যাং মারলুম, অ্যাঁ… অন্নপূর্ণাদি, তুমি কি দেখেছ? আমি তো…”

”আলবাত, লেঙ্গি মেরেচেন।” মস্তান তার ঊরুতে ফটাশ করে চাপড় মেরে একটু কুঁজো হয়ে স্বরটা খসখসে ভীতিপ্রদ করে বলল, ”এখানে হচ্ছে স্পোটস আর আপনারা হচ্ছেন স্পোটসম্যান, স্পোটিং ইস্পিরিট নিয়ে আপনারা তো লড়বেন, ঠিক কিনা?”

স্তব্ধ ফ্যালফ্যালে মেয়েদের ভিড়ের দিকে তাকিয়ে মস্তান দুবার মাথা নাড়তেই কয়েকটি মাথা দ্রুত হেলে গেল।

”আপনারাই যদি আনস্পোটিং কাজ্যকলাপ করেন তাহলে মেয়েরা কী সিকবে আপনাদের দেকে? আমি পাঁচিলের ওধারে তকন থেকে দাঁড়িয়ে সব দেকচিলুম, অনেক কথা কানে আসচিল। আপনারা প্রাইজের লোভে স্পোট করতে নেমেছেন, তাই না?”

”না না, কে বলল আমরা প্রাইজের লোভে…” অন্নপূর্ণা পাইনের বেদনাহত স্বর আর কথা খুঁজে পেল না।

”ননীবাবু, আপনিই বলুন আমরা কি…” আর এক মেয়েটিচার বললেন।

”আমরা প্রাইজ নেবই না।”

”অন্যায়ভাবে নেব কেন, আমরা সবাই স্পোর্টসম্যান।”

”দিদি, স্পোর্টসউওম্যান হবে।” ভিড়ের মধ্য থেকে কে বলল।

মস্তানের এবার হাসার কথা। সুতরাং কোমরে হাত দিয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে ‘শোলে’—র গব্বর সিংয়ের মতো ‘হা হা’, হো হো’ করে বিকটস্বরে, দেহ কাঁপিয়ে সে হাসতে শুরু করল।

”প্রাইজ নেবে না… হা হা হা…, দিদিমণিরা বলচেন… হো হো হো… মাইকে অ্যালাউন্স করে দিন…।”

মস্তানের দাঁতগুলি সাজানো ঝকঝকে। তবে উপরের পাটিতে ডান কষের একটা দাঁত যে নেই, সেটা এবার দেখা গেল।

‘অ্যাই, অ্যাই,” ভিড়ের মধ্যে একটি মেয়ে পাশের জনের কানে ফিসফিস করে বলল, ”আমাদের কালু রে।”

”যাহ।”

”আমি বলছি। দাঁতটা ওর অনেকদিন ধরেই নড়ছিল, পরশু ছুটির পর আমরা একসঙ্গে যখন বাড়ি ফিরছিলুম, তখন এক হ্যাঁচকা টানে ও দাঁতটা উপড়ে ফেলল।”

”কী মেয়ে রে বাবা। কী দারুণ মেকআপ নিয়েছে। কোথা থেকে এভাবে সাজল বল তো? আমাদের কিচ্ছুটি বলেনি।”

”একেবারে ছেলের মতো দেখাচ্ছে।”

”একদম। কী সাহস বাব্বা, বসন্তকে শীত বানিয়ে দিয়েছে।”

”পাইন ফরেস্টও সাফ।”

”যখন জানতে পারবে, কী হবে।”

”এখন কাউকে বলিসনি, চেপে থাক।”

ওদিকে হেডমিস্ট্রেস হাত নেড়ে স্কুলের দরোয়ান মিশিরকে কাছে ডেকে ভয়ার্তস্বরে বললেন, ”করছ কী তুমি, তাড়িয়ে দাও গুণ্ডাটাকে। মেয়েদের সঙ্গে যদি অসভ্যতা করে তাহলে গার্জেনরা কী বলবেন আমাদের? যাও, বার করে দাও।” মিশির তার ভুঁড়িতে হাত রেখে করুণস্বরে বলল, ”বড়দিদি, এখানকার গুণ্ডারা বড় খারাপ আছে। এদের সঙ্গে চাকু, ক্ষুর, ছোটখাটো বন্দুকও থাকে।”

”তাহলে দৌড়ে পুলিশ ডেকে আনো।”

হেডমিস্ট্রেসের চেয়ারের হাত চারেক দূরে মাইক্রোফোনটা তখন সচল ছিল। লাউড স্পিকার থেকে আবছাস্বরে ওদের কথাগুলো সবাই শুনতে পেল।

”অ্যাই, দারোয়ান।” মস্তান চিৎকার করে দৌড়ে গেল শামিয়ানার দিকে। ”পুলিশ বোলানেকে লিয়ে যানেকা আগেই তুমহারা ভুঁড়িমে…” মস্তান হিপ পকেট থেকে ছুরি বার করে স্প্রিং টিপতেই ছয় ইঞ্চি ফলা ছিটকে বেরোল। কবজি নাড়িয়ে ফলাটা এপাশ—ওপাশ করে ঝিলিক দিতে দিতে কুঁজো হয়ে সে গুটিগুটি মিশিরের দিকে এগোতেই সে ”হায় রামজি, মর গিয়া” বলেই বড়দিদির চেয়ারের পিছনে আশ্রয় নিল।

সভাপতি প্রথমদিকে ভ্রূ কুঁচকে দেখছিলেন। এই রকম স্পোর্টসে বহুবার ‘সভাপতি’ বা ‘প্রধান অতিথি’ হয়ে এখন ঝানু। ব্যাপার বুঝতে তাঁর বিশেষ দেরি হয়নি। মুচকি হেসে পাশের ফ্যাকাসে মুখ হেডমিস্ট্রেসকে বললেন, ”দারুণ করছে, কী বলেন?”

কথাটা বড়দিদির কানে গেল না। তিনি কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলেন, ”চলে যাও, যাও এখান থেকে। মেয়েদের স্পোর্টসে এসব অসভ্যতা বাঁদরামি চলবে না। আমি পুলিশ ডাকব, অ্যারেস্ট করাব তোমায়।”

”আমাকে বাঁদর বললেন?”

”নিশ্চয় বাঁদর।”

”তাহলে আমার ন্যাজ কই?”

হেডমিস্ট্রেসের কানে মেয়েদের হাসির রোল পৌঁছতেই তিনি আরো রেগে উঠলেন। মিশির এই সময় পিছু হটতে হটতে হাত দশেক দূরে গিয়েই দৌড়বার জন্য সবে ঘুরেছে, আর তখনই মস্তান চেঁচিয়ে উঠল, ”অ্যাই মিশির, খাড়া রহো। এক কদম বাড়েগা তো এই চাক্কু ভুঁড়িমে…।” ছুরিটা বাতাসে বিঁধিয়ে ডান—বাম আড়াআড়ি চালিয়ে মস্তান বুঝিয়ে দিল পরের ঘটনা কী ঘটবে।

”দিদিমণিরা তো প্রাইজ নেবে না, তাহলে কী হবে?”

”যাই হোক, তুমি এখান থেকে দূর হও।”

”তাহলে আমিই নোব।”

মস্তান টেবল থেকে ব্যাগ তিনটি তুলে নিয়ে চোখের সামনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বলল, ”বাঃ, বাঃ, নিজেদের জন্য সুন্দর সুন্দর ব্যাগ আর মেয়েদের জন্য প্লাস্টিকের চিপ জিনিস, বাঃ, খুব ভাল।”

আর একবার মেয়েদের হাসির হলকা হেডমিস্ট্রেসকে ঝলসে মুখটা লাল করে দিল। তিনি প্রায় ঝাঁপিয়েই মাইক্রোফোনটা ধরে মুখের কাছে এনে চিৎকার শুরু করলেন, ”পুলিশ পুলিশ… হেল্প হেল্প, গুণ্ডা এসে মেয়েদের আক্রমণ করেছে, বাঁচান, আমাদের বাঁচান…।”

মেয়েদের বিশেষ করে গার্জেনদের মধ্যে এবার কলরব শুরু হল। কেউ কেউ দু—চার পা এগিয়ে এলেন। মস্তানকে এবার নার্ভাস দেখাল। ফলা মুড়ে সে ছোরাটা পকেটে রাখল। এধার ওধার তাকাচ্ছে বোধহয় পালাবার পথ খুঁজতে।

”বড়দি আমরা কি গুণ্ডাটাকে এবার ধরব?” একটি মেয়ে চেঁচিয়ে জানতে চাইল।

”না, না, ধরতে যেও না, সঙ্গে ছোরা আছে, পুলিশ এসে ধরবে।”

গো অ্যাজ ইউ লাইক—এর প্রতিযোগীরা একধারে দাঁড়িয়ে। তাদের মধ্যে রয়েছে ঝাড়ুদারনি, ভিখারী, বৈষ্ণবী, চানাচুরওলা, পাগলি, ডাকপিয়ন, বাসানউলি আর ত্রিশূল হাতে ভৈরবী। ওরা যে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। সব চোখ আর মন কেড়ে রেখেছে মস্তান।

এই সময় ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ ‘আঁ আঁ আঁ’ শব্দ শোনা গেল এবং সেই সঙ্গে মাটিতে একটি মেয়ে পড়ে গেল মূর্ছিতা হয়ে।

”ফেণ্ট ফেণ্ট, সুস্মিতা ফেণ্ট হয়েছে।”

”জল, জল আন… বাতাস কর। ভয়ে বোধহয় অজ্ঞান হয়েছে।”

গুণ্ডা থেকে সবার মনোযোগ চলে গেল সুস্মিতা নামের মেয়েটির দিকে। হুড়োহুড়ি, চেঁচামেচি শুরু হল। দিদিমণিরা ছুটে গেলেন, সেই সঙ্গে হেডমিস্ট্রেস মলয়া মুখার্জিও। সভাপতি কিন্তু চেয়ারে হেলান দিয়ে আবার মুচকি হাসতে হাসতে লক্ষ করলেন, মস্তানটি তীরবেগে পার্কের গেটের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে।

”গুণ্ডা পালাচ্ছে, বড়দি, গুণ্ডা পালাচ্ছে।”

সব চোখ যখন গেটের দিকে তাকাল, তখন লাল জামাটা গেটের বাইরে ডানদিকে ঘুরে অদৃশ্য হচ্ছিল।

মিনিট দুই পরে জলের ঝাপটা আর খাতার হাওয়া খাওয়ার পর সুস্মিতা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল।

তারপর এক গাল হেসে বলল, ”কেমন করলুম বল তো, নইলে কালুটা পালাতে পারত না।”

”যাক গুণ্ডাটা নিজেই তাহলে পালিয়ে গেল।” বড়দি আবার তাঁর প্রশান্তি ফিরে পেয়ে সভাপতিকে খবরটা দিলেন।

‘হ্যাঁ, ভালই হল। ফার্স্ট প্রাইজটা ওই পাবে।”

”কিসের ফার্স্ট প্রাইজ!”

”গো অ্যাজ ইউ লাইকের।”

হেডমিস্ট্রেস এমন ভাবে তাকিয়ে রইলেন যেন তাঁর স্কুলের পঁচাত্তর জন মেয়েরই ফার্স্ট ডিভিশনে উচ্চচ মাধ্যমিক পাশ করার খবর শুনলেন।

”গুণ্ডা কোথায়, ও তো মেয়ে!” সভাপতির বিস্ময় চোখমুখে ফুটে উঠল। ”আপনার স্কুলেরই নিশ্চয়, দারুণ করল কিন্তু।”

বলতে বলতে সভাপতি দেখতে পেলেন পার্কের গেট দিয়ে ঢুকছে সবুজ খয়েরি নকশার চুড়িদার ও কামিজ পরা এক শ্যামলা মেয়ে। ছিপছিপে বেতের মতো শরীর, মাথার চুল ছেলেদের মতো ছোট করে ছাঁটা, মিষ্টি মুখের গড়নটি পানের মতন। কয়েকটি মেয়ে ওকে দেখামাত্র ছুটে গেল। ও হাসতেই দুটি চোখ এবং দাঁতের সারি ঝকঝক করে উঠল। ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়ায় সভাপতি আর মেয়েটিকে দেখতে পেলেন না।

”আমার স্কুলে এমন মেয়ে?” হেডমিস্ট্রেস কাঁদো কাঁদো হয়ে সামনে মেয়েদের ভিড়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সেই সময় অসীমা দত্ত এসে বড়দির কানে কানে কিছু বলতেই তিনি, ”এত বছর ধরে ক্লাসে পড়াচ্ছ অথচ তোমরা কেউ চিনতেই পারলে না!” বলে গম্ভীর হয়ে গেলেন।

পুরস্কার প্রদান শুরু হল। একে একে প্রাপকরা নেবার পর সবশেষে ‘গো অ্যাজ ইউ লাইক’—এর প্রথম পুরস্কার নেবার জন্য নাম বলতে গিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে অসীমা দত্ত দুবার গলা খাঁকারি দিলেন এবং দুবার ঢোঁক গিলে বললেন, ”প্রথম হয়েছে, ইলেভেন বি—র কলাবতী সিংহ। ও সেজেছিল গুণ্ডা।”

তুমুল হাততালি আর চিৎকারের মধ্যে কলাবতী হাসিমুখে তার পুরস্কার নিল সভাপতির কাছ থেকে। তারপর সে অসীমা দত্তর কাছে গিয়ে বলল, ”দিদি মাইকটা দিন, আমি একটা কথা বলব।”

তিনি একবার বড়দির দিকে তাকিয়ে কী ভেবে সরে দাঁড়ালেন।

”মাননীয়া বড়দি এবং অন্যান্যরা,” কলাবতী সহজভঙ্গিতে কোনো কুণ্ঠা প্রকাশ না করে বলল, ”আজ আমার আচরণে, কথাবার্তায় যদি আপনারা আঘাত পেয়ে থাকেন, তাহলে সেজন্য ক্ষমা চাইছি। আমার সবটাই অভিনয়। একজন কম্পিটিটর হিসাবেই সব করেছি, এই কথা মনে রেখে আপনারা স্পোর্টিংলি আমাকে বিচার করবেন। গুরুজনরা সবাই আমার শ্রদ্ধাপ্রণাম নেবেন।”

সভাপতি মাথা দুলিয়ে মলয়া মুখার্জিকে বললেন,”আপনার স্কুলের শিক্ষা, রুচি, কালচার এই মেয়েটির মধ্যে ফুটে উঠেছে। অন্যসব স্কুলে যা দেখি সে আর কহতব্য নয়, টিচারদের সম্পর্কে কোনো শ্রদ্ধা নেই, ভালবাসা নেই, ডিসিপ্লিন নেই।”

শুনতে শুনতে হেডমিস্ট্রেস আনন্দে, গর্বে বরফের মতো একবার গললেন, আবার বাষ্পের মতো ভেসে বেড়াতে লাগলেন।

”কলাবতীর ঠাকুর্দা আটঘরার জমিদার, এখন অবশ্য জমিদারি নেই, কিন্তু বনেদী পরিবারের শিক্ষাটা তো আছে। আমাদের বকদিঘির পাশেই আটঘরা গ্রাম। ওদের সবই জানি, ওরাও আমাদের সব জানে। ওরা যেমন কালচার্ড তেমনি… ” মলয়া মুখার্জি থেমে গেলেন। তারপর গলা নামিয়ে বললেন, ”তেমনি জেদি।”

”আচ্ছা আচ্ছা! গ্রামের নামদুটো শোনা শোনা মনে হচ্ছে যেন, ওদের মধ্যে কি বছরে একবার একটা ক্রিকেট ম্যাচ হয়? কয়েক বছর আগে কাগজে খবর দেখেছিলাম মনে হচ্ছে।”

সভাপতির দিকে তাকিয়ে মলয়া মুখার্জি হাসতে শুরু করলেন। ”এই এক অদ্ভুত রেষারেষি দুই জমিদারবাড়ির মধ্যে। একেবারে ছেলেমানুষি কাণ্ড। বুড়ো বুড়ো লোকেরা যে কী রকম অবুঝ বাচ্চচা হয়ে যায় তখন, না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না।”

”বটে, তাই নাকি, তাহলে তো দেখতে হয়। এবারের ম্যাচটা কি হয়ে গেছে?”

”হয়নি, হবে, বোধহয় সামনের রবিবারেই।”

কয়েকজন মেয়ে টিচার এবং ননীবাবু খাবারের বাক্স হাতে শামিয়ানার পিছন দিক থেকে বেরোলেন।

”শুনুন ননীবাবু, শোনো ব্রততী, ইনি কী বলছেন।” হেডমিস্ট্রেস উত্তেজিত কণ্ঠে ওদের ডাকলেন। ”কলাবতী তো ওনাকে দারুণ ইমপ্রেস করেছে, ওর মধ্য দিয়ে নাকি আমাদের স্কুলের শিক্ষা রুচি কালচার ফুটে উঠেছে… সবাই ওকে দুষ্টু বলো, শুধুই ক্রিকেট খেলে একদমই পড়াশুনো করে না বলো, অথচ দ্যাখো উনি কত প্রশংসা করলেন।”

”না না, দুষ্টু তো নয়, অন্নপূর্ণাদি, আমরা কি কখনো তাই বলেছি?”

”সে কী! কলাবতীর মতো বাধ্য মেয়ে আমি তো কুড়ি বছরের টিচারি জীবনে একজনও দেখিনি।”

সভাপতির জন্য প্লেটভরা মিষ্টি আসতেই টিচারদের কলাবতী প্রশস্তি আর এগোল না।

.

তিন পুরুষে খেলে রেকর্ড করব

বাড়িটা ঊনবিংশ শতাব্দীতে তৈরি। একতলার দেয়ালগুলো তিন হাত চওড়া। ঢালাই লোহার নকশাদার ফটকের একটা পাল্লা বন্ধই থাকে। রাজশেখর সিংহ বছরে তিন—চারবার তাঁর ১৯২৮ সালে কেনা চালবিহীন ফোর্ড গাড়িটা নিজে চালিয়ে যখন বেরোন, শুধু তখনই দুটো পাল্লা খোলার দরকার হয়।

এবারের ভিণ্টেজ কার র‌্যালিতে চুয়াত্তর বছরের, সওয়া ছ’ ফুট, গৌরবর্ণ, দশাসই রাজশেখর জমিদারবেশে তাঁর ফোর্ড নিয়ে নেমেছিলেন। ডান হাতে স্টিয়ারিং, বাঁ হাতে গড়গড়ার নল। গাড়ি চালাতে চালাতে মাঝে মাঝে নল মুখে দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছিলেন। কাঁধে গামছা, ধুতি ফতুয়া পরা কলাবতী চাকর সেজে ছিলিমে ফুঁ দিয়ে যাচ্ছিল, পিছনের সিটে পাগড়ি মাথায় চাপকান পরা বেয়ারা সেজে কলাবতীর কাকা সত্যশেখর একটা কিংখাবের খয়েরি রঙের ছাতা জমিদারবাবুর মাথার উপর ধরে বসে। বছর পনেরো ব্যারিস্টারি করছে কলকাতা হাইকোর্টে, পসার কিছুটা জমেছে এবং অবিবাহিত।

গাড়িটা যখন মানিকতলা মেইন রোড দিয়ে বাগমারি হয়ে কাঁকুড়গাছির মোড় ঘুরছিল তখন দর্শকদের ভিড়ের মধ্যে কলাবতী দেখতে পায় ফুটপাথের কিনারে দাঁড়িয়ে বড়দি মলয়া মুখার্জি ক্যামেরায় চোখ লাগিয়ে তাদের গাড়িরই ছবি তুলছেন। সেই সময় তার ৪৫ বছর বয়সী ব্যারিস্টার কাকা বীরদর্পে বিশাল নকল গোঁফটা ডানহাতে চুমরোতে চুমরোতে জিভ বার করে ভেংচি কাটল। কলাবতীর মনে হয়েছিল ভেংচিটা বড়দির উদ্দেশেই, কেননা মোড় ঘোরার সময় গাড়ি যখন ফুটপাথ ঘেঁষে এসেছিল, বড়দি তখন ক্যামেরার শাটার টিপেই বেশ জোরে বলে উঠেছিলেন, ”বাঁদর কোথাকার।”

কথাটা রাজশেখরের কানেও পৌঁছয়।

”মলয়া না? মুখুজ্জেদের মেয়ে কাকে বাঁদর বলল?”

কলাবতী আড়াচোখে পিছনের সিটে তাকিয়ে দেখল, কাকা একমনে সি আই টি রোডের গাছগুলোর মগডাল পর্যবেক্ষণ করছে। সে ঝুঁকে দাদুর কানে কানে বলল, ”কাকাকে।”

”কেন?”

”কাকা বড়দিকে ভেংচি কেটেছে।”

”সতু।”

”আজ্ঞে।” পিছন থেকে ভয়ার্ত কণ্ঠ ভেসে এল।

”ভেংচি কেটেছ?… জবাব দাও। বুড়ো বয়সেও তোমার এই স্বভাবটা গেল না, চিরকাল তুমি … কোর্টে সওয়াল করার সময় কোনোদিন হয়তো জজকেও ভেংচি কেটে বসবে। … তাছাড়া মলয়া নিশ্চয় ওর বাবাকে এটা জানাবে। উফফ… হরিশঙ্কর মুখ বেঁকিয়ে শেয়ালের মতো হাসছে, এটা তো এখনই আমি দেখতে পাচ্ছি… আমি জানি ও বলবে ‘সিংগিবাড়ির ওরা বরাবরই ছোটলোক, হিংসুটে’। আমি শুনতে পাচ্ছি, হরিশঙ্কর এই কথাই বলছে আর … উফফ…।”

”দাদু সামনে… সামনের রাস্তায় চলো।”

রাজশেখর উল্টোডাঙার মোড়ে এসে স্টেশনের দিকে গাড়িটা চালিয়ে ফেলেছিলেন। ডানদিকে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে নজরুল ইসলাম সরণি ধরলেন এয়ারপোর্টের উদ্দেশে, যেখানে পৌঁছে র‌্যালি আবার ফিরে আসবে রাজভবনের সামনে।

রাজশেখরের ফোর্ড এই র‌্যালিতে চতুর্থ হয়েছিল।

কিন্তু সেইদিন রাতেই রাজশেখর দোতলার লাইব্রেরিতে বসে একটা চিঠি লিখে কলাবতীকে ডাকেন।

”এটা কাল তোমার হেডমিস্ট্রেস মলয়া মুখুজ্জেকে দেবে, স্কুল বসার আগেই। ভুলো না যেন।”

চিঠি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় সে থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, ”দাদু, শেয়ালের হাসি তুমি দেখেছ? কেমন দেখতে?”

”হরিশঙ্কর একটা শেয়াল। সে হাসলেই সেটা শেয়ালের হাসি। সেই ছোটবেলা থেকে ওকে জানি, এক স্কুলে পড়েছি, ক্রিকেটও খেলেছি ওর সঙ্গে। আমি টাউনে, ও এরিয়ানে। দারুণ ধূর্ত।”

নিজের ঘরে এসে কলাবতী চিঠিটা পড়েছিল। তাতে লেখা : ‘কল্যাণীয়া মলয়া, গতকাল আমার পুত্র তোমাকে জিহ্বা প্রদর্শন করায় আমি যৎপরোনাস্তি লজ্জিত ও সন্তপ্ত। সিংহসন্তানের পক্ষে এহেন মর্কটোচিত আচরণ অকল্পনীয়, জানি না কোথা হইতে সে এই কু—অভ্যাস অর্জন করিয়াছে। বিলাত গিয়া সে কীরূপ মানুষের সহিত মেলামেশা করিয়াছিল জানি না। আমি তাহার এবং আমার পূর্বপুরুষদের পক্ষ হইতে তোমার নিকট মার্জনা চাহিয়া লইতেছি। আশা করি তুমি আমার পুত্রের অভব্যতা ভুলিয়া যাইবে। আশীর্বাদক, ভবদীয়, রাজশেখর সিংহ।” পুনশ্চ—’বাঁদর অতিশয় বজ্জাত প্রাণী এবং ইহার একটি লাঙ্গুল আছে, আমার পুত্রের লাঙ্গুল নাই।’—রা সি

পরদিন প্রথম পিরিয়ডের আগেই কলাবতী দাদুর চিঠিটি বড়দির বেয়ারা মিশিরের হাতে দিল। শেষ পিরিয়ডে মিশির একটি খাম ক্লাসে এসে কলাবতীকে দিয়ে যায়। খামের উপরে লেখা : ‘পূজনীয় শ্রীরাজশেখর সিংহ!’ স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই সে খামটা দাদুর টেবলে রেখে দেয়। সন্ধ্যায় দাদু তাকে ডেকে পাঠান।

”মলয়া কী লিখেছে জান? সতু নাকি বিলেতেও ওকে দুবার জিভ দেখিয়েছিল। তার মানে আজ থেকে পনেরো বছর আগে। কিন্তু তার থেকেও মারাত্মক, আর কী বলেছে জানো? ‘লাঙ্গুলহীন সিংহসন্তানও যে সম্ভব, তা জানা ছিল না। আপনার ছেলেকে চিড়িয়াখানায় পাঠানো উচিত…’ টিপিক্যাল হরিশঙ্করের মেয়ে।”

”দাদু, তুমিই তো গোলমাল বাধিয়েছ। পুনশ্চটা ল্যাজের মতো জুড়তে গেলে কেন? তাহলে তো এই লাঙ্গুল ধরে টানাটানিটা হত না।”

রাজশেখর কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলেন। তারপর হঠাৎ বলে উঠলেন, ”এবার আমি ক্রিকেট ম্যাচে খেলব। মুখুজ্জেদের মুখ আমি পুড়িয়ে ছাড়ব।”

”মুখপোড়া হনুমান!”

”দ্যাটস ইট। হনুমান বানাব। আটঘরায় কালই চিঠি দিয়ে পরমেশ, মতি, নন্তু, ওদের ডেকে আনব। টিম করব।”

”এই বয়সে তুমি খেলবে?”

”কেন খেলব না? গ্রেস, হবস, রোডস, সি কে, দেওধর, ওরা কি পঞ্চাশের পরেও খেলেনি?”

”কিন্তু তোমার যে সত্তর হয়ে গেছে।”

”সে তো পাঁজিপত্তরের হিসেবে, কিন্তু মনের হিসেবে আমি তো পঁচিশের একদিনও বেশি নই, এখনো চল্লিশটা বৈঠক, দশটা ডন দিই, এক মাইল জগ করি। এখনকার কটা ছোকরা পারে? সুতরাং আমি খেলব। বহুদিন আটঘরায় যাওয়া হয়নি। লাস্ট খেলেছি তখন তুমি জন্মাওনি, তিন রানে হেরে গেছলাম।”

রাজশেখর আহত সিংহের মতো অস্থির পায়চারি শুরু করলেন। কলাবতীর তখন মনে হল, দাদুর বয়স সত্যিই পঁচিশ। উত্তেজনায় আর ক্রোধে শরীর থেকে পঞ্চাশটা বছর যেন খসে পড়েছে। লম্বা লম্বা দ্রুত পা ফেলে, শিরদাঁড়া খাড়া রেখে রাজশেখর দেয়াল থেকে দেয়াল পর্যন্ত যাতায়াত করে যাচ্ছেন। দেখে কলাবতীর বেশ অবাক লাগল। এত সামান্য ব্যাপারেই কী রাগ।

হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে রাজশেখর মুচকি হেসে ফেললেন। ”বুঝলি কালু, তোর বড়দি ইচ্ছে করেই সিংহের ল্যাজ মাড়িয়েছে। আমার ছেলেকে কিনা ল্যাজকাটা সিংহ বলল… অ্যাঁ, চিড়িয়াখানায় পাঠাতে বলল। আশ্চর্য, কী সাহস!”

দাদু ‘তুমি’ থেকে যখন ‘তুই’—এ চলে আসেন, কলাবতী তখন বুঝে যায় গুরুগম্ভীর রাশভারিত্বের জোব্বাটা মেজাজ থেকে খুলে এবার উনি নিজের আসল মজাদার হালকা স্বভাবে ফিরে এসেছেন। এখন তিনি বন্ধু।

”কিন্তু তোমার পুনশ্চটাই তো গোলমেলে। বাঁদরজাতীয় অনেকেরই তো ল্যাজ নেই—শিম্পাঞ্জি, গোরিলা, ওরাং ওটাং।”

রাজশেখর থমকে দাঁড়ালেন। তাঁকে বিচলিত দেখাচ্ছে। অবশেষে অপ্রতিভের মতো হেসে, মাথা চুলকে তিনি চেয়ারে বসলেন।

”এসব তো ভেবে দেখিনি। তাই তো … টার্জনের শিম্পাঞ্জিটাকে কতবার দেখেছি, ল্যাজ আছে বলে তো মনে পড়ছে না।”

”তাহলে ভুলে যাও সিংহের ল্যাজের কথাটাও। ক্রিকেট ম্যাচ খেলে তোমার দরকার নেই।”

”না, না, একবার যখন মুখ থেকে বেরিয়েছে, সে কথা রাখবই, আমি খেলবই। আর সতু খেলবে, তুইও খেলবি, তিন পুরুষে খেলে এই অ্যানুয়াল ম্যাচের রেকর্ড করব।”

”কিন্তু ওরা যদি আমাকে খেলতে না দেয়? পুরুষদের খেলায় কোনো মেয়ে খেললে প্রোটেস্ট তো করতেই পারে।”

রাজশেখর ধাঁধায় পড়লেন। আমতা—আমতা করে বললেন, ”তা বটে, তা বটে। রেকর্ডটা হলে অবশ্য খুবই ভাল হত। তবে দু’ পুরুষ এই ম্যাচে কখনও খেলেছে কিনা সেটাও খোঁজ নিতে হবে। আমি কালই আটঘরায় চিঠি দিচ্ছি, সতুকেও বলে রাখতে হবে যেন অতি অবশ্য খেলে।”

কলাবতীর কাকা সত্যশেখরের মামলা ছিল কৃষ্ণনগর কোর্টে। ফিরে এসেই অপেক্ষমাণ মক্কেলদের নিয়ে চেম্বারে বসে যায়। রাত দশটায়, এই বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী তাকে খাবার টেবলে আসতে হল।

”তোমাকে বিলেতে পাঠিয়েছিলুম বার—অ্যাট—ল হবার জন্য, ভেংচি কাটার জন্য নয়।”

”কিন্তু আমি তো…”

”একটি কথাও নয়।”

রাজশেখরের চাপা ধমকে সত্যশেখর মিইয়ে গেল।

”হরির মেয়েও তখন ওখানে কী যেন পড়তে গেছল। তাকে তুমি জিভ দেখিয়েছিলে। … দু’বার। থাক থাক, চাপা দেবার চেষ্টা কোরো না, সব আমি জেনে গেছি। কিন্তু কেন?”

ইতস্তত করে সত্যশেখর মুখ নিচু করে রুটি ছেঁড়ায় ব্যস্ত কালুর দিকে বার দুই তাকিয়ে বলল, ”সিংহিদের অপমান করেছিল। তোমার পাঠানো বড়ি আর লঙ্কার আচার থেকে ওকে খানিকটা দিতে চেয়েছিলুম, নেয়নি। বলেছিল সিংহিরা আবার বড়ি আচার তৈরি করতে শিখল কবে? এতে কি রাগ হবে না?”

কলাবতী হঠাৎ বিষম খেয়ে মুখটা আরো নামিয়ে ফেলল। দাদু তীব্রদৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন।

”কালু, এটা হাসির ব্যাপার নয়… আর দ্বিতীয়বার কীজন্য জিভ দেখিয়েছিলে?”

”কার্ডিফে গ্ল্যামোরগানের সঙ্গে পতৌদির টিম খেলছিল সোফিয়া গার্ডেন্সে। ভীষণ বৃষ্টি। দু’ দলের ফার্স্ট ইনিংসই পুরো খেলা হল না। খুব শীত, মলয়ার সঙ্গে ছিল একটা কাশ্মীরি শাল, আমায় বলল ভাঁজ করে ম্যাকিনটোসের নীচে গলায় জড়াতে।”

”তুমি নিলে?”

”হ্যাঁ।”

”ওফফ!”

”তারপর ল্যাঙ্কাশায়ারের সঙ্গে ইন্ডিয়ানসদের সাউথপোর্টে খেলা।”

”কাকা, ল্যাঙ্কাশায়ারের মাঠ তো ওল্ডট্র্যাফোর্ড, ম্যাঞ্চেস্টারে।”

”হ্যাঁ, কিন্তু বৃষ্টিতে মাঠের অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ায় ম্যাচটা সাউথপোর্টে হয়েছিল। খুব ভাল রোদ উঠেছিল। শালটা ফেরত দেবার জন্য নিয়ে গেছলুম। ও বলল ম্যাচ থেকে ফেরার সময় নেবে। এরপরেই লিডস—এ ফার্স্ট টেস্ট, তাই প্র্যাকটিস নিতে আমাদের ছেলেরা খুব কেয়ারফুলি ব্যাট করে। পতৌদি এক ঘণ্টার উপর ক্রিজে থেকে করে ছয়, সূর্তি তিন ঘণ্টায় চুয়ান্ন। মলয়া এই নিয়ে পাশের এক মেমসাহেবের সঙ্গে গলা মিলিয়ে খুব বিরক্তি দেখাচ্ছিল। তাইতে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। কথা কাটাকাটি হতে হতে আমি শালটা ছুঁড়ে দিই ওর দিকে। বলেছিলুম, ”মুখুজ্জেদের মেয়ে তো, তাই ক্রিকেটের ‘ক’—ও বোঝো না।’ ব্যস, আগুনে ঘি পড়ল। গটগট করে স্ট্যাণ্ড থেকে নেমে যাবার আগে বলল, ‘যে শালটা ছুঁড়ে দিলে, জানো কি, এইট্টিন এইট্টি ফোরে লখনৌর নবাব ওয়াজিদ আলি যখন মেটিয়াবুরুজে থাকতেন তখন নিজের হাতে ওটা বাবার ঠাকুর্দাকে দিয়েছিলেন? এসব জিনিসের কদর সিংহিবাড়ির লোকেরা কী বুঝবে?’ এই বলে ও একাই মাঠ থেকে বেরিয়ে গেল। মিনিট দশ পর আমি মাঠ থেকে বেরিয়ে ওকে খুঁজছি, তখন একটা বাসের জানলায় ওকে দেখি। বাসটা ম্যাঞ্চেস্টার যাচ্ছে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই … সেটাই দ্বিতীয়বার।”

রাজশেখর গুম হয়ে গেলেন। সত্যশেখর আমতা—আমতা করে বলল, ”শালটার যে হিস্টরিক ভ্যালু আছে তা আমি জানব কী করে?”

”তা বটে। তবে হরির ঠাকুর্দা যখন ওয়াজিদ আলি শাহের মেহফিলে বসে নাচ গান আর শায়ের শুনছে তখন আমার ঠাকুর্দা নাটোরের টিমে ক্রিকেট খেলছে।”

এই বলে রাজশেখর গর্বিত চোখে কলাবতীর পিছনের দেয়ালে তাকালেন। ওখানে ক্রিকেট ব্যাট হাতে বলেন্দ্রশেখরের অয়েল পেইন্টিং ঝুলছে। ‘ডবলু জি’—র মতো মুখ ভরতি দাড়ি। মাথায় কাউন্টি ক্যাপ। কোমরে বেল্টের বদলে কালো কাপড়ের পট্টি। হাঁটুর নীচে ছোট প্যাড। ভুঁড়িতেই শুধু ডবলু জি—র এক ষষ্ঠাংশ অনুপস্থিত। এর পাশে, হুবহু রঞ্জির মতো গোঁফওয়ালা, অ্যালবার্ট চুল, ফুল—হাতা জামাপরা ছিপছিপে সোমেন্দ্রশেখর। লেগ গ্লান্স করছেন। কলাবতীর দৃঢ় ধারণা গ্রেস ও রঞ্জির ছবি সামনে রেখে আর্টিস্ট মুখটুকু বাদে বাকি সব এঁকেছে।

”আমাদের হল ক্রিকেটিং ফ্যামিলি। ক্রিকেট ইজ দ্য নোবলেস্ট স্পোর্ট অব অল। শুধু মাঠেই নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রেই ক্রিকেটকে পাবে… ফর লাইফ ইজ এ গেম, আফটার অল—টু আস, স্পোর্টসমেন, অ্যাট অল ইভেন্টস।”

কলাবতী খুকখুক করে উঠল। রাজশেখর চকিতে তার দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কোঁচকালেন।

”ওহ, ইয়েস ইয়েস, ভুলেই গেছলাম, আমাদের বংশে এখন তো আবার একজন স্পোর্টসউওম্যানও এসে গেছে। ফিফথ জেনারেশন ক্রিকেটার। সতু তোর কী মনে হয়, কালু ইন্ডিয়া রিপ্রেজেন্ট করবে?”

সত্যশেখর উৎসাহে নড়েচড়ে বসল।

”নিশ্চয় করবে। আমি তো ওর দুটো ইনিংস এবার কানপুরে দেখলাম। শান্তা রঙ্গস্বামীও দারুণ প্রেইজ করল। গ্রিট, ডিটারমিনেশন, ক্যারেজ অ্যান্ড টেকনিক, সবই আছে, তবে হাতে আরো দু চারটে মার থাকা দরকার।”

”হবে হবে, আগে ডিফেন্সটা পোক্ত হোক। ভাবছি বাগানের উত্তরে বকুল গাছটার ধারে কালুর জন্য প্র্যাকটিস পিচ করে দেব।”

”দারুণ হবে দাদু।”

কলাবতী প্রায় লাফিয়ে উঠল, দু’ হাত তুলে। রাজশেখর মিটমিট করে তাকিয়ে বললেন, ”আমি এবার তোকে কোচ করব, নেটে আমি বল করব।”

সত্যশেখর হঠাৎ বিষম খেল।

”দাদু, কাকা কিন্তু হাসছে।”

”কেন?”

”মোটেই হাসিনি। মোটরে এসেছি, বেশ ঠাণ্ডা লেগে গেছে, যাই দেখি ট্যাবলেট কিছু যদি…”

সত্যশেখর টেবল থেকে উঠে দ্রুত বেরিয়ে গেল।

”দুই ছেলের একজনও ক্রিকেটার হল না।” রাজশেখর বিষণ্ণমুখে কলাবতীর দিকে তাকালেন। বড় ছেলে দিব্যশেখর সন্ন্যাসী হয়ে গেছে কলাবতীর মা মারা যাবার পরই। ছোট থেকেই সে ছিল কোমল ও ধীর স্বভাবের, পড়ুয়া ও ঈশ্বরবিশ্বাসী।

রাজশেখর চেষ্টা করেও তার হাতে ক্রিকেট ব্যাট ধরাতে পারেননি। মা—মরা দু’ বছরের কলাবতীকে তার মাসি পুনেতে নিয়ে যান। সে দাদুর কাছে ফিরে আসে দশ বছর বয়সে।

ছোট ছেলে সত্যশেখর সুদর্শন, মার্জিত, সুরসিক ও বুদ্ধিমান তো বটেই, এবং আড্ডাবাজও।

ছাত্র হিসাবে সাধারণ, কিন্তু জাগতিক নানান ব্যাপারে অল্পবিস্তর ধারণা রাখে। পসার বৃদ্ধিতে সম্প্রতি একটি ফিয়াট মোটরগাড়ি কিনেছে (বাবার অনুমতি নিয়ে) স্বোপার্জিত অর্থে। কোর্টে যাতায়াত ছাড়া গাড়িটি পারতপক্ষে সে ব্যবহার করে না। তবে ভাইঝিকে গাড়ি চালানো শিখিয়ে দেবার জন্য ইদানীং ভোরবেলায় তাকে বেরোতে হয়েছে। কলাবতীর ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার মতো মোটামুটি শিখে গেছে।

সত্যশেখর ব্যারিস্টার হয়ে আসার পর গত পনেরো বছরে রাজশেখর মাত্র তিনবার তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন সে বিয়ে করতে ইচ্ছুক কিনা। ‘এখন ইচ্ছে নেই’, ‘কালু একটু বড় হোক’, এবং তৃতীয়বারে কাঁচা পাকা চুলে আঙুল ডুবিয়ে বলেছিল, ‘তাড়াহুড়োর কী আছে’। বাবাকে সে শ্রদ্ধা করে, ভালবাসে এবং যমের মতো ভয় পায়। তবু ক্রিকেটে সে দ্বিতীয় ডিভিশন ক্লাবেরও উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারেনি। ঘুড়ি, লাট্টু, ডাংগুলি বা উড়ন তুবড়িতে তার যে দক্ষতা, তার সিকিভাগও সে ক্রিকেটে অর্জন করতে পারেনি।

”আমার ছেলেরা ক্রিকেট শিখল না। আরে, ক্রিকেট কি শুধু মাঠেই হয়? এটা একটা খেলা, যেমন জীবনটাও একটা খেলা… লাইফ ইজ এ গেম। সোলজাররা বলে, ব্যাটল অব লাইফ—এর কথা, তেমনিই নাবিকরা বলে সাগরের, অভিনেতারা বলে থিয়েটারের কথা, কবিরা জীবনস্বপ্নের গান গায়, আর সাধারণ খেটে—খাওয়া মানুষ একেই বলে জীবনের চলা। আমরা, যারা ব্যাট—বল খেলি, একে গেম অব লাইফ তাহলে বলব না কেন?”

কলাবতী মাথা হেলিয়ে সমর্থন করল।

”চল লাইব্রেরিতে গিয়ে বসি।”

ওরা খাবার টেবল থেকে উঠে লাইব্রেরিতে এসে বসল। দেয়াল—আলমারিতে সার দেওয়া তিন পুরুষের সংগ্রহ। এ—ঘরে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ, কলাবতীই শুধু ব্যতিক্রম।

”আমার কী মনে হয় জানিস, জীবনটা যেন সিঙ্গল—উইকেট ম্যাচ, সবার বিরুদ্ধে সবাই, প্রত্যেকেই এখন নয় তো পরে ব্যাট করার সুযোগ পাবে। সব ব্যাপারেই যেমন গুড লাক কি ব্যাড লাক কাজ করে, তেমনি এক্ষেত্রেও আছে, তবে কেউ যদি স্কোর করতে না পারে, সেজন্য দায়ী হবে সে নিজেই।”

কলাবতী মুখের সামনে হাত রেখে হাই তুলল। রাজশেখর সেটা লক্ষ করলেন।

”খেলায় ভাল মন্দ দু—রকম পার্টনারই আছে, যেমন জীবনেও থাকে, সব রকমের বোলিংই খেলতে হয়। কিন্তু ক্রিকেটে যে ট্রেনিং একটা লোক পায়, যেমন—চটপট বিচারবোধ গড়ে তোলার অভ্যাসটা আর সাহসভরে নিশ্চিতভাবে সেটাকে কাজে লাগানো কিংবা ইচ্ছাশক্তিকে জবরদস্ত করা যার ফলে লোপ্পাই বলের কি ফুলটসের টোপের লোভটা সামলে নিতে পারবে, কিংবা হঠাৎ মাথা গরম করে এলোপাথাড়ি ব্যাট যাতে না চালায়—এই যে সব গুণ, এর সঙ্গে সাহস আর ধৈর্য, এ সবই ওই ২২ গজের ঘাসের জমিটা থেকেই তো শেখে, সেটা জীবনের খেলার ক্ষেত্রেও অমূল্য সাহায্য করে।”

”দাদু তোমার বিচারবোধের এই মুহূর্তে চটপট একটা সিদ্ধান্তে আসা দরকার।”

”এসে গেছি। তুই এখন ঘুমোতে যাবি।”

”কারেক্ট ডিসিশন। কিন্তু তুমি ম্যাচটা খেলার যে সিদ্ধান্ত…”

”ওটা পাকা। তিন পুরুষের যদি না হয়, দু—পুরুষের খেলার রেকর্ডটা তো করে রাখি। আটঘরায় কালই পরমেশ, মতি, নন্তুদের চিঠি দিচ্ছি।”

কলাবতী যখন উঠে চলে যাচ্ছে, রাজশেখর পিছন থেকে বললেন, ”তোর আগামী দুষ্টুমির প্রোগ্রাম কী?”

”স্কুলের স্পোর্টসে… আমাদের ক্লাসের সুস্মিতার সঙ্গে একটু পরামর্শ করা দরকার।”

লেডিজ পার্কের গায়েই সুস্মিতাদের বাড়ি। দুজনের দিন—দুয়েক চাপা আলোচনা হয়। এরপরই স্পোর্টসের গো অ্যাজ ইউ লাইকে মস্তানবেশে কলাবতীর আবির্ভাব। সেদিন সে ছুটে পার্ক থেকে বেরিয়ে সুস্মিতার বাড়িতে গিয়ে মস্তানের ছদ্মবেশ খুলে ফেলে। চুড়িদার ও কমিজ পরাই ছিল প্যান্ট—শার্টের নীচে। তারপর সে আবার ভালমানুষের মতো পার্কে ফিরে আসে।

সুস্মিতাদের বাড়িতে দুপুরের খাওয়া সেরে বিকেল নাগাদ বাড়ি ফিরে সে দাদুর কাছে শুনল আটঘরা থেকে পরমেশ এসেছিল। টিম একটা মোটামুটি হয়ে গেছে। গতবছর যারা খেলেছে, তারাই খেলবে, তবে রাজশেখর ও সত্যশেখরের জন্য কোন দুজন বাদ পড়বে তাই নিয়ে একটু সমস্যা দেখা দিয়েছে।

”পরমেশ বলছে দারোগাবাবু, ব্যাঙ্ক—ম্যানেজার আর হেডমাস্টার খেলতে চায়, এরা সবাই নতুন। গোপীনাথ ঘোষ একসময় পার্লামেন্টের মেম্বার ছিল, জানিয়েছে তার ছোট ছেলের খুবই খেলার ইচ্ছে, ছেলেটি কলকাতায়ই বরাবর রয়েছে, সে নাকি কখনো আটঘরা দেখেনি, তাই… গোপীনাথ তো এখন এম.এল.এ, ওকে চটানো ঠিক হবে না।”

”দাদু এই ম্যাচে খেলার এলিজিবিলিটি তো আটঘরা বা বকদিঘিতে তেরাত্তির বাস, তা গোপীনাথ ঘোষের ছেলে কি তিন রাত কাটিয়েছে?”

”পরমেশ তো বলল কাটিয়েছে। তেরো বছর আগে গোপী ঘোষ যখন এম পি ছিল, তখন একবার আম্পায়ার হয়েছিল। ওখানকার লোকেরা আজও বলে আমপায়ারিং তো নয়, হয়েছিল গোপী ঘোষের ‘এমপিয়ারিং’। সেই সময় গোপী ঘোষের সঙ্গে ওর তিন বছর বয়সী ছেলেটি নাকি আটঘরায় গেছল আর দিন পাঁচেক তার পিসির বাড়িতে ছিলও। সে প্রমাণ নাকি আছে খেলার পর তোলা গ্রুপ ফোটোতে।”

”তাহলে কারা বাদ যাবে?”

”নন্তু আর মতিকেই শেষ পর্যন্ত বাদ দিতে হবে, ওরা নিজেদের লোক কিছু মনে করবে না। কিন্তু বকু বোস, ভুবনেশ্বর সিংহি বা তার কম্পাউণ্ডার চণ্ডীকে বাদ দিলে তো বিক্ষোভ মিছিল, ঘেরাও, অবস্থান, প্রতিরোধ, আর কীসব যেন হয়, তাই হয়ে যাবে। ওরা বহু যুদ্ধের হিরো তো!”

”কিন্তু তোমার তিন পুরুষ খেলার রেকর্ড গড়ার কী হবে?”

রাজশেখর বিমর্ষ থেকে আরো বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। মাথা চুলকোনো শুরু করতেই কলাবতী বলল, ”বুঝেছি, আমার খেলায় আপত্তি হবে।”

”মানে, পরমেশ বলল মতিকে একবার জিজ্ঞাসা করা দরকার, ও তো ক্রিকেটের আইনকানুনের বই বাংলায় লিখেছে, ব্যাপারটা বোঝে। ফোন করা হল মতির অফিসে। সে বলল, আইনে কিছু বলা নেই যে পুরুষ টিমে, কোনো মেয়ে খেলতে পারবে না। কিন্তু এরকম নজিরও তো কোথাও পাচ্ছি না, তবে বকদিঘি যদি রাজি হয়…। তাই পরমেশ বলল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে পতু মুখুজ্জেকে একবার সাউণ্ড করে দেখবে, পতুই তো বকদিঘির সব, ক্রিকেট আইন নাকি ভালই জানে টানে।”

”আইনে যদি কিছু বলা না থাকে তাহলে আমি খেলতে পারব না কেন?”

কলাবতী গোঁয়ারের মতো ঘাড় বেঁকাল।

”ক্রিকেট আইনে অনেক কিছুই বলা নেই। হতে হতে, চলতে চলতে সেগুলো প্রথায় দাঁড়িয়ে যায়। এই ধর পোশাকের ব্যাপারটা, সাদা শার্ট—ট্রাউজার্স গোড়া থেকে চলে আসছে তাই ওটাই প্রথা হয়ে গেছে। ছাপকা ছাপকা রঙিন জামা কি কেউ পরে, না পরার দাবি তুলেছে? আবার প্রয়োজনেও অনেক কিছু হয়। কেউ দশ বছর আগেও হেলমেট পরত না, কিন্তু এখন অনেকেই পরছে। তোর সম্পর্কে আপত্তি যদি হয় তো … সেইরকম আর কী।”

কলাবতী চুপ করে রইল। কিন্তু মনে—মনে সে যেন তখন কিছু একটা ভেবে চলেছে। রাজশেখর মিটমিট করে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, ”মনে হচ্ছে কালুর মাথায় দুষ্টুমি ঘুরপাক খাচ্ছে।”

ছেলেটাকে যেন চেনাচেনা লাগছে

ফিয়াট গাড়ি চালাচ্ছে সত্যশেখর। তার পাশে কলাবতী। পিছনের আসনে রাজশেখর। ওরা যাচ্ছে আটঘরায়। পৌঁছতে ঘণ্টা দুয়েকও লাগবে না। গাড়ির পিছনে বুটিতে আছে একটা সুটকেশ আর ব্যাটিং সরঞ্জাম। দর্জি তিন দিনের মধ্যে দুজনের শার্ট আর ট্রাউজার্স বানিয়ে দিয়েছে। মাপমতো বুট দোকানেই পাওয়া গেছে। কলাবতীর সবই আছে, নতুন কিছুর দরকার হয়নি।

দক্ষিণেশ্বরে বিবেকানন্দ সেতুর উপর পিছনে আর একটা গাড়ির হর্ন শুনে সত্যশেখর আয়নায় তাকিয়ে দেখল সবুজ একটা অ্যাম্বাসাডার অধৈর্য হয়ে পথ দেবার জন্য ফাঁক খুঁজছে আর হর্ন দিচ্ছে। ভ্রূ কুঁচকে উঠল সত্যশেখরের। নিজের গাড়ি রাস্তার মাঝখানে এনে গতি মন্থর করল। কলাবতী জানলা দিয়ে পিছনে তাকিয়ে নিচুস্বরে বলল, ”কাকা, বড়দিরাও যাচ্ছেন।”

”তাই নাকি!”

বিস্ময়টা বাড়াবাড়ি রকমের হওয়ায় সে বুঝে গেল, কাকা ইচ্ছে করেই অ্যাম্বাসাডারকে জব্দ করতে চাইছে।

কিন্তু মিনিট কয়েক পরেই রাজশেখর উত্তেজিত হয়ে বললেন, ”থামা, থামা!”

সত্যশেখর হকচকিয়ে রাস্তার কিনারে এনে মোটর থামাতেই অ্যাম্বাসাডারটা পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় কলাবতী দেখল পিছনের আসনে বসা বড়দি ঝুঁকে কটমটিয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে, আর তাঁর পাশে দাদুর মতো চেহারার এক বৃদ্ধ বুড়ো আঙুল তুলে তাদের কলা দেখালেন। ”হরি গেল না?”

”হ্যাঁ।”

”সঙ্গে কে, মলয়া?”

”বোধহয়।” সত্যশেখর গম্ভীরস্বরে বলল।

”হরি কলা দেখাল… আমি স্পষ্ট দেখেছি। বোধহয় আমাদের বাঁদর বলে গেল।”

রাজশেখর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ”একটা লোক ডাব বেচছে, দেখ তেষ্টা পেয়ে গেল।”

”দাদু, ফ্লাস্কে তো জল রয়েছে।”

‘কর্পোরেশনের জলে আর প্রকৃতির জলে অনেক তফাত।”

রাজশেখরের সঙ্গে তাঁরা হেঁটে খানিকটা পিছিয়ে এল যেখানে গণ্ডাচারেক ডাব নিয়ে একটা লোক বসে আছে।

ডাবের জল খেয়ে মিনিট দশ পর ওরা আবার রওনা হল। দিল্লি রোড ধরে এল দিয়াড়া মোড়। এরপর নসিবপুর, সিঙ্গুর হয়ে কামারকুণ্ডু। ঘড়ি দেখে সময় হিসাব করে রাজশেখর বললেন, ”খেলা শুরুর আগেই আমরা পৌঁছে যাব।”

দু’ধারে মাঠ, দূরে গাছপালার আড়ালে গ্রাম। সাইকেল আরোহী, পথচারী, মাঝে মাঝে যাত্রীভরা বাস আর ট্রাক ছাড়া পথে আর কিছুর সঙ্গে তাদের দেখা হল না।

রাস্তাটা এক জায়গায় ভাঙা। বড় বড় গর্তগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মতো সরু পথ রয়েছে। কুমড়ো বোঝাই একটা সাইকেল ভ্যান সরু পথটা দিয়ে আসছে। সত্যশেখর গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করল।

”কাকা, এইবার আমাকে দাও।”

”এটা পেরিয়ে গিয়ে।”

ভ্যানটা চলে যাবার পর গাড়িকে সন্তর্পণে ভাঙা জায়গার পাশ কাটিয়ে এনে সত্যশেখর নামল। কলাবতী স্টিয়ারিংয়ে বসল।

আধ কিলোমিটার পরেই বর্শাফলার মতো রাস্তাটা বেঁকে গেছে। কলাবতী একটা গোরুর গাড়িকে পাশ কাটিয়ে বাঁক ঘুরেই অচল সবুজ অ্যাম্বাসাডারের ঘাড়ে ফিয়াটকে নিয়ে ফেলত, যদি না তার কাকা পা বাড়িয়ে ব্রেকটা চেপে ধরত।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে মলয়া এবং হরিশঙ্কর। ড্রাইভার বনেট খুলে মুখ নামিয়ে কী করছে।

”শার্প বেণ্ডের মুখে এভাবে কেউ গাড়ি রাখে?” সত্যশেখর গলা বাড়িয়ে বলল, ”এখুনি একটা কাণ্ড ঘটে যেত।”

রাজশেখর গাড়ি থেকে নামলেন বেশ প্রসন্নমুখে। একটু দূরে গাছতলায় দাঁড়ানো হরিশঙ্করের কাছে গিয়ে কোমরে হাত রেখে এক মিনিট সেইভাবে তাকালেন, নতুন ব্যাটসম্যান ক্রিজে এসে যেভাবে সাজানো ফিল্ড পর্যবেক্ষণ করে। তারপর পিচে ব্যাট ঠুকে ঠুকে আর কাঁকরধুলো বাছাবাছি করে বাগান করার মতো ভঙ্গিতে বললেন, ”খেলা দেখতে যাচ্ছিস?”

”হ্যাঁ, তুই?”

”খেলতে।”

হরিশঙ্করের চোখদুটো এবার বড় হয়েই ভ্রূ কুঁচকে গেল। রাজশেখরের সাদা ট্রাউজার্স আর শার্টের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, ”হারবি।”

”বাজি!”

”বাজি।”

কলাবতী গাড়ি থেকে নেমে এসে মলয়ার দিকে এগোচ্ছিল, থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ”এক কাঁদি মর্তমান কলা।”

”সিংহরা এখন তাহলে নিরিমিষ্যি খাচ্ছে?”

হরিশঙ্করের বাঁকানো হাসির দিকে তাকিয়ে রাজশেখর বললেন, ”খাচ্ছে আর খাওয়াবে ভাবছে।”

ড্রাইভারের সঙ্গে মলয়াও উঁকি দিয়ে দেখার ভান করছিল, তার কাঁধের থেকে ঝুলছে নিক্কন ক্যামেরা। কলাবতী এসে বলল, ”বড়দি, কী হল?”

”ফ্যানবেল্ট ছিঁড়ে গেছে। সঙ্গে একস্ট্রাও নেই যে…”

সত্যশেখর গাড়ি থেকে নামেনি। সে চেঁচিয়ে বলল, ”কালু, দেরি হয়ে যাচ্ছে আমাদের, ঠিক সময়ে পৌঁছতে হবে।”

কলাবতী ছুটে এল। ”কাকা, ফ্যানবেল্ট ছিঁড়ে গেছে।”

”তা আমরা কী করব, ওঠ এখন, দাদুকে ডাক।”

”ওঁরা যাবেন কী করে?”

”হেঁটে, নয়তো অপেক্ষা করুক, যখন বাস আসবে উঠবে।”

‘যযআহ, এইরকম নির্জন জায়গায় ওরা পড়ে থাকবেন, তাই কি হয়? আমাদের গাড়িতে ওঁদের উঠিয়ে নাও।”

”বাঁদরদের গাড়িতে ওরা কি চড়বে?”

”এখন রাখো তো ওসব কথা, বিপদে পড়েছে না?” কলাবতী কাকাকে প্রায় ধমকে দিল। তারপর সে চেঁচিয়ে বলল, ”দাদু, ওঁরা আমাদের সঙ্গে চলুন।”

রাজশেখর এগিয়ে এলেন। ”আমিও তাই হরিকে বলছি, ড্রাইভার তারকেশ্বরে নেমে ফ্যানবেল্ট কিনে, বাসে এখানে ফিরে এসে যা করার করুক। আর তোদের আমরা বকদিঘিতে নামিয়ে দিচ্ছি। চেপেচুপে এঁটে যাবে, কী বলিস?”

”ছ’জন কেন ধরবে না? বড়দি, চলে আসুন।”

গম্ভীর মুখে মলয়া পিছনের আসনে বসল। গাড়ি স্টার্ট দেবার সময় কলাবতীর মনে হল কাকা আয়না দিয়ে পিছনে তাকাল আর জিবটা বার করতে গিয়েও করল না, শুধু বলল, ”পিছনের ডানদিকের অ্যাবজর্বারটা কাল একবার চেক করিয়ে নিতে হবে।”

”কেন, খারাপ হয়েছে?”

‘হবে।”

গাড়ির ডানদিকেই মলয়া বসেছে। তার মুখ আরো গম্ভীর হয়ে গেল।

তারকেশ্বরে ড্রাইভারকে আর বকদিঘিতে দু’জনকে নামিয়ে ওরা আটঘরার ফুটবল মাঠে যখন পৌঁছল, খেলা শুরু হতে তখন কুড়ি মিনিট বাকি। বকদিঘির অধিনায়ক পতু মুখুজ্জে অপেক্ষা করছে টস করার জন্য।

”এসে গেছে, এসে গেছে, আমাদের ক্যাপ্টেন এসে গেছে।”

শোরগোলে পড়ে গেল মাঠের পুবদিকে নীল শামিয়ানার চারধারে। কলাবতী এই প্রথম এসেছে, তাই প্রচণ্ড ভিড় আর উদ্দীপনা দেখে সে তো অবাক।

মাঠের পশ্চিমে হলুদ রঙের আর একটা শামিয়ানা। ওটা বকদিঘির। মাঠের ধারে মাঝামাঝি জায়গায় পাঁচ হাত লম্বা, আড়াই হাত চওড়া একটা টেলিগ্রাফিক স্কোরবোর্ড আট হাত উঁচু বাঁশের মাচায় বসানো। তার নীচে স্কোরারদের টেবল।

দুটো শামিয়ানাই আকারে ও প্রকারে দেখতে একইরকম। পক্ষপাতিত্বের দোষ কোনোক্রমেই দেওয়া যাবে না। শামিয়ানার সামনের দিকে কিছু চেয়ার প্লেয়ারদের জন্য। ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের বাড়ি থেকে চেয়ে এনে এবার একটা সোফা রাখা হয়েছে রাজশেখরের জন্য। পিছন দিকে কাপড়ে ঘেরা একটি ঘর—ড্রেসিং—রুম। তার দরজায় পর্দা ঝুলছে। এবার জলপানের বিরতির সময় মাঠে জল নিয়ে যাবার জন্য স্টিলের জগ ও ট্রে আর ফুল আঁকা কাচের গ্লাস দিয়েছেন দারোগাবাবু।

শামিয়ানার নীচ থেকে প্লেয়াররা মাঠে যাবে শতরঞ্চের উপর দিয়ে। অনেকে চেয়েছিল ডেকরেটরের কাছ থেকে গালিচা ভাড়া করে আনতে। কিন্তু পঞ্চায়েতপ্রধান পটল হালদারের আপত্তিতে তা আর হয়নি। তার বক্তব্য ছিল : দেশে মর্মান্তিক খরা চলছে, এখন বিলাসিতার সময় নয়।

শতরঞ্চের দু’ধারে সারি সারি বেঞ্চ পাতা। আটঘরা হায়ার সেকেণ্ডারি স্কুল থেকে, পঞ্চাশ টাকা ‘কশান মানি’ জমা দিয়ে সেগুলো আনা হয়েছে। গত বছর বকদিঘির আম্পায়ার এক ওভারেই চারজন আটঘরিয়াকে রান আউট দেওয়ায় যে কাণ্ড ঘটে, তাতে বেঞ্চ মেরামত করতে স্কুলের বিশ টাকা খরচ হয়ে যায়। এবার বেঞ্চ দিতে স্কুল রাজি হয়নি, কিন্তু পঞ্চায়েতপ্রধানের বিচক্ষণ সিদ্ধান্তে তা সম্ভব হয়েছে। তবে পরমেশের কাছে তিনি আড়ালে বলে রেখেছেন, সোফা ছাড়া আর কোথাও তিনি বসবেন না।

বেঞ্চে ঠাসাঠাসি দর্শক, তার তিন ভাগই গিন্নিবান্নি আর কুচোকাঁচা। যাত্রা দেখতে গিয়ে বসার জায়গা নিয়ে যে ঠেলাঠেলি, চিৎকার, ঝগড়া হয়, সেইরকমই হচ্ছে। দুই রঙের কাগজের শিকল জড়াজড়ি করে মালার মতো মাঠটাকে ঘিরে রয়েছে। পঞ্চায়েত প্রধান, যাকে আড়ালে বহু লোকই ‘পটল প্রধান’ বলে থাকে, তার নির্দেশে দুই গ্রামের মধ্যে সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের লড়াকু মোর্চা বজায় রাখতেই মাঠকে এই মাল্যদান। অ্যামপ্লিফায়ারে গতবছর ‘ডিসকো’ গান বাজানো হয়েছিল। পটল প্রধান সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ‘অপসংস্কৃতি’ আর চলবে না। দুই শামিয়ানার মাথায় লাগানো চোঙা থেকে এবার তাই বেরোচ্ছে ভূপেন হাজারিকা আর সুচিত্রা মিত্র।

কলাবতীর চোখে পড়ল, লম্বাচুল, তারই বয়সী তারই আকৃতির একটি ছেলে এক কোণে চেয়ারে পাংশুমুখে বসে। বারবার ঢোঁক গিলছে আর চেয়ারের হাতল আঁকড়ে ধরছে। তার মনে হল এই বোধহয় গোপীনাথ ঘোষের ছোট ছেলে।

”নাহ, হলো না।”

কলাবতী তার পাশে এসে দাঁড়ানো পরমেশের দিকে মুখ ফেরাল।

”পতু মুখুজ্জে রাজি নয়। তিন পুরুষে খেলার রেকর্ড করতে দেবে না। অপোনেন্ট আপত্তি করলে তোমায় নামাই কী করে বলো?”

রাজশেখর টস করে ফিরে এলেন। নিখুঁত ক্রিকেটের পোশাক, মাথায় যৌবনকালের ক্যাপ আর ঋজু দেহে তাঁকে টেস্ট ক্রিকেটারের মতো দেখাচ্ছে। সারা মাঠ তাঁর দিকেই তাকিয়ে।

”ওদের ব্যাট করতে দিলুম।… উইকেটকিপার, প্যাড আপ… এগারোজন ঠিক আছে তো? … সতু কোথায়? … পরমেশ; কে আমাদের ওপেনিং বোলার, ওয়ান চেঞ্জ কে? আমায় সব মাঠে বলে দেবে।”

রাজশেখর ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাঁকে দেখে অন্যরাও ব্যস্ত হবার জন্য ছোটাছুটি শুরু করে দিল, এমন কী সত্যশেখরও। সেই সময় কলাবতী গিয়ে বসল গোপীনাথ ঘোষের ছেলের পাশে।

”তুমি কি আজ খেলছ?”

”হ্যাঁ… তবে…”

”তবে কী, নার্ভাস লাগছে?”

”পেটের মধ্যে কী রকম গুলোচ্ছে!”

”বমি বমি ভাব আসছে তো?”

”হ্যাঁ হ্যাঁ, অনেকটা তাই।”

”তার মানে আজ তুমি ক্যাচ ফেলবে। ইজি সিটার মিস করবে।” কলাবতী নিশ্চিতস্বরে বলল। ”আজ তুমি নির্ঘাত পায়ের ফাঁক দিয়ে বল গলিয়ে বকদিঘিকে গোটা দশেক বাউণ্ডারি পাইয়ে দেবে।..ওহ, লিমিটেড ওভার ক্রিকেটে এক একটা রানের যা দাম! ফিল্ডিংই তো আসল ব্যাপার, আর তোমার জন্য যদি আটঘরা হেরে যায়!”

”তাহলে কী হবে?”

”গত বছরের ব্যাপার শোনোনি? লাস্ট ওভারে সিলি মিড—অন লোপ্পাই ক্যাচ ফেলে দেওয়ায় আটঘরা জেতা ম্যাচটা হেরেছে। খেলার পর এখানকার ছেলেরা সিলি মিড—অনের চুল খাবলা খাবলা করে কেটে রিকশায় চাপিয়ে সারা আটঘরা ঘুরিয়েছিল। উফফ, সে যে কী লজ্জার ব্যাপার না, তোমায় কী বলব।”

ছেলেটি আঁতকে উঠে তার সযত্নে তৈরি ‘অমিতাভ বচ্চচন’ চুলে হাত রেখে বলল, ”তাহলে?’

”তাহলে তুমি আর নেমো না, বরং ড্রেসিংরুমের বেঞ্চে গিয়ে শুয়ে পড়ো। বলবে হঠাৎ ম্যালেরিয়া ধরেছে। যাও যাও, শিগগিরি যাও। আর শোনো, এক—আধবার কোঁ কোঁ, হুঁ হুঁ শব্দ কোরো।”

”আম্পায়াররা মাঠে নেমে গেছে, হারি আপ, হারি আপ।”

উইকেটকিপার বকু বোস কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ”প্যাডের বকলেসটা ছিঁড়ে গেল নন্তুবাবু, একটা দড়িটড়ি…”

”অত জোরে টানতে গেলেন কেন… এখন কোথায় যে দড়ি পাই…”

”হারি আপ, হারি আপ।”

”ওরে, গোপী ঘোষের ছেলে যে ড্রেসিংরুমে শুয়ে ম্যালেরিয়ায় কঁকাচ্ছে, কী হবে এখন?

”টুয়েলফথম্যান কে হয়েছে?”

”সে তো হাবু ময়রার ছেলে বিশু। ডাক ডাক ওকে।”

বিশুর বেলবটম আকাশী—নীল রঙের প্যান্ট দেখেই রাজশেখর ভ্রূ কোঁচকালেন।

পরমেশ কানে কানে বলল, ”ছেড়ে দিন জ্যাঠামশাই, লাঞ্চের সন্দেশ আর দই হাবু দিচ্ছে। আমি গিয়ে ততক্ষণে অপোনেন্ট ক্যাপ্টেনের পারমিশনটা নিয়ে আসি সাবস্টিটিউট নামাচ্ছি বলে।”

পরমেশ ছুটে মাঠের মধ্য দিয়ে হলুদ শামিয়ানার দিকে চলে গেল। রাজশেখর তাঁর দল নিয়ে মাঠে নামলেন।

আড়াই ঘণ্টা পর ৪০ ওভারের শেষে বকদিঘির ইনিংস শেষ হল নয় উইকেটে ১৭৪ রানে। দুই দল নিজেদের শামিয়ানায় ফিরে গেল লাঞ্চের জন্য। বকদিঘি প্রথম পাঁচটি উইকেট হারায় ১৪ রানে—তিনটি রান আউট, দুটি স্টাম্পড।

দর্শকদের মধ্যে যাঁরা এই ম্যাচের রীতিনীতি জানেন তাঁরা আটঘরা তরফের স্থায়ী আম্পায়ার অঙ্কের শিক্ষক বুদ্ধদেবস্যারের অবিমৃশ্যকারিতায় ভয় পেলেন।

”বুদ্ধস্যার এটা কী করলেন, খেলার গোড়াতেই পাঁচটা উইকেট নিলেন! এবার বড় রান করার মতো যদি কেউ খেলে দেয়, তখন কী করবেন? তাকে কী করে আউট করবেন?”

ভয়টা সত্যি হল যখন ষষ্ঠ উইকেটে অতুল মুখুজ্জে আর বিষ্টু মিশির ৩১ মিনিটে ৬৯ রান তুলল। রান আউট, স্টাম্পড, এল বি ডবলু থেকে শুরু করে হিটিং দ্য বল টোয়াইস এমন, কী হ্যান্ডলড দ্য বল—কোনো আইনেই দু’জনকে আউট দেবার সুযোগ বুদ্ধদেবস্যার পেলেন না। ওরা প্রতি বল ব্যাটে খেলেছে এবং বেলচা ও কাস্তে চালানোর মতো ব্যাট চালিয়ে বলগুলো প্রায়শই বাউন্ডারির উপর দিয়ে ফেলেছে। তাই করতে গিয়ে অবশ্য মিশিরজি তিনবার ও অতুলবাবু একবার এক্সট্রাকভার, থার্ডম্যান, লং অন ও পয়েন্ট বাউন্ডারিতে ক্যাচ দেয় এবং প্রতিবারই হাবু ময়রার ছেলে বলের নিকটতম ফিল্ডার ছিল। বস্তুত দুটি ক্যাচ তার তালু থেকে ছিটকে গেছে, একটি তার মাথা চাপা দেওয়া হাতে পড়েছে, এবং শেষেরটি তার এক হাত পিছনে পড়ে এবং সে ধরার কোনো চেষ্টাই করেনি। প্রথম স্লিপ থেকে রাজশেখর বিষণ্ণ, স্তম্ভিত ও বিরক্ত হবার পর তাঁর শেষ ক্রুদ্ধ মন্তব্য দুই শামিয়ানার লোকেরাও শুনতে পায়।

”এটাকে কান ধরে বার করে দাও।” ওভার শেষে রাজশেখর বলেছিলেন।

পরমেশ কাতরস্বরে তখন বলেছিল, ”জ্যাঠামশাই, হাবুর দোকান থেকে এখনো একটা হাঁড়িও পৌঁছয়নি। আমি লক্ষ রেখেছি, হাঁড়িগুলো এলেই ওকে বসিয়ে অন্য কাউকে নামাব।”

ষষ্ঠ উইকেট জুটি ভেঙেছিল রাজশেখরের বলে। পাক্কা সাড়ে সাত মিনিট ধরে তিনি ফিল্ড সাজিয়ে এবং না ছুটে শুধু এক জায়গায় দাঁড়িয়েই বল করেন। প্রথম বলটি তাঁর হাত থেকে বেরিয়ে আকাশের দিকে উঠতে শুরু করে। বলের ওড়া দেখতে দেখতে অতুল মুখুজ্জের মুখ আকাশমুখো হয়ে যায় এবং বল তাঁর টাক লক্ষ করে অবতরণ করায় তিনি আত্মরক্ষার জন্য পিছিয়ে যেতে যেতে হিট উইকেট হন। নবাগত ব্যাটসম্যান একটা লেগবাই নেয়, যখন বলটা তাঁর পিঠের উপর পড়ে ফাইন লেগের দিকে যায়। মিশিরজি পরের বলেই উইকেটকিপারের পিছনে ওভার বাউন্ডারি মারার জন্য সিলি পয়েন্টের কাছে সরে গিয়ে ব্যাট চালায় এবং ফশকায়। বেলের উপর বল পড়ায় একটা বেল দু টুকরো হয়ে যায়।

ফিল্ডাররা ছুটে এসে রাজশেখরকে ঘিরে নানাভাবে বিস্ময়, প্রশংসা, উল্লাস জানায়। সত্যশেখর উত্তেজিত হয়ে বাবার হাত ধরে ঝাঁকিয়ে পিঠও চাপড়ে দেয়। তিনি সারা মুখে স্মিতহাসি ছড়িয়ে শুধু বলেন, ”তেত্রিশ বছর পর বল করলুম।” তারপর হলুদ শামিয়ানার দিকে মুখ করে ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা মাথার উপর তুলে ধরেন।

মুকুন্দ মালখণ্ডি রাজশেখরের পরের ওভারে পাঁচটি ওভার বাউন্ডারি মারায় তিনি নিজের উপর জবরদস্ত ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে আর বল করেননি। বকদিঘির সর্বোচ্চচ রান করেছিল ‘অতিরিক্ত’ মশাই। ৪৩ রানের অতিরিক্তে বাই ছিল ৩৯। স্থানীয়দের মতে বকু বোসের জীবনে এটাই তার সেরা কিপিং।

বুদ্ধদেবস্যারের অবিমৃশ্যকারিতাজনিত আশঙ্কা সত্যে পরিণত হল লাঞ্চের পর। আটঘরা প্রথম ওভারেই চারটি উইকেট হারাল এক রানে। চারটিই এল বি. ডবলু। তার মধ্যে একটি বল ভুবন সিঙ্গির কপালে, আর দুটি ফুল টস অফ স্ট্যাম্পের দু’ফুট বাইরে ছিল। চতুর্থটির ক্ষেত্রে বল শুধু প্যাড ‘ঘেঁষে’ ছয় ইঞ্চি বাইরে দিয়ে বেরিয়ে গেছল। আশ্চর্যের ব্যাপার, এরপরও স্কুলের বেঞ্চগুলো অক্ষত রইল।

বকদিঘির স্থায়ী আম্পায়ার হরিশ কর্মকার একবার শুধু ভ্রূ তুলে বুদ্ধুস্যারের দিকে তাকিয়ে ওভার শেষে স্কোয়্যার লেগে যাবার সময় মুচকি হাসে। কোথা থেকে এক ফাস্ট বোলার আনিয়েছে বকদিঘি (অবশ্যই খেলার কোয়ালিফিকেশন আছে), যার ছোটার এবং বলের গতি এক্সপ্রেস ট্রেনের মতো, তার তিন ওভারে একটি বল গুড লেংথে এবং উইকেট—সোজা পড়ে।

সত্যশেখর ওপেন করে শূন্য রানে নট আউট ছিল। চণ্ডী কমপাউন্ডার ক্রিজে আসার পরই দুজনে মিলে ৩০ ওভারে ঝড়ের মতো রান নিয়ে গেল ১৪৪—এ। বিষ্টু মিশির আর অতুল মুখুজ্জের স্ট্রোকগুলি একত্র করেই সত্যশেখর স্ট্রোক দিয়ে গেল। বল্লমের মতো ব্যাট চালিয়ে বোলারের মাথার উপর দিয়ে ত্রয়োদশতম ছয়টি নিয়ে সে ১০৪—এ পৌঁছয়।

উল্লাসে ভেঙে পড়ল মাঠ। পিলপিল করে লোক ছুটল মাঠের মধ্যে। সত্যশেখরকে কাঁধে তুলে নাচানাচি হল। তখন, কলাবতী দূর থেকেও দেখতে পেল, কাকার জিবটা হলদে শামিয়ানা লক্ষ করে বারচারেক বেরিয়ে এল। কলাবতীর চোখ পড়ল, বড়দি তার বাবার পাশে সামনের সারিতেই বসে। ক্যামেরাটা চোখের কাছে ধরা।

পটল হালদার উত্তেজিত হয়ে বলল, ”হিস্ট্রিতে এই প্রথম আটঘরার পক্ষে শত রান… আমার প্রধানত্বে এত বড় ব্যাপার ঘটল, কালই পঞ্চায়েত মিটিং ডাকব, চাঁদা তুলব, শত রান স্তম্ভ তৈরি হবে, উদ্বোধন করাব পূর্তমন্ত্রীকে দিয়ে, সংবর্ধনা দোব, মিছিল বেরোবে…”

”এখন খরা চলছে রে পটলা।” ভিড়ের মধ্য থেকে কে একজন ফোড়ন কাটল।

”হোক খরা… সে তো বহুবার হয়েছে, আবার হবে, কিন্তু এই শত রান, এই সেঞ্চুরি হয়তো এই সেঞ্চুরিতে আর ঘটবে না।” পটল হালদার উদ্দীপনায় সংগ্রামী ভঙ্গিতে বুক চিতিয়ে দাঁড়াল।

গোপীনাথ ঘোষের ছেলে হইচই হট্টগোলে ড্রেসিংরুম থেকে পর্দা সরিয়ে উঁকি দিচ্ছিল। কলাবতী ছুটে গিয়ে তাকে ঠেলে ভিতরে পাঠাল।

”করছ কী, ম্যালেরিয়া না তোমার?”

”সেই কোন সকালে খেয়েছি আর তোমরা তো লাঞ্চে রসগোল্লা খেলে।”

”বোধহয় হাঁড়িতে কয়েকটা এখনো রয়েছে, দাঁড়াও দেখছি।”

এক মিনিটের মধ্যে কলাবতী হাঁড়ি এনে বেঞ্চের নীচে রাখল।

”গোটা পনেরো আছে। ওদিকে মুখ করে শুয়ে হাত বাড়িয়ে একটা একটা করে তুলবে, কেউ যেন টের না পায়, কেমন?” এই বলে কলাবতী ড্রেসিংরুমের একটা কোণের কাপড় তুলে হামা দিয়ে বেরিয়ে সবার অলক্ষ্যে চলে গেল পিছনে রাখা তাদের ফিয়াট গাড়ির দিকে।

পতু মুখুজ্জে কটমট করে হরিশ কর্মকারের দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে দু—চারটে কথা বলার পরই আটঘরার ইনিংস ১৪৪—২ থেকে ১৫৮—৮ হয়ে গেল তিন ওভারের মধ্যে। সত্যশেখর ১০৪ আর চণ্ডী কম্পাউন্ডার ৩১ রানে ফিরে আসে স্টাম্পড ও রান আউট হয়ে। পা দিয়ে একটা স্নিক থামিয়ে গাঁটে চোট পাওয়ায় রানার নিয়ে ব্যাট করতে নামলেন রাজশেখর। তাঁর নিখুঁত কেতাবি স্টান্স, ব্যাট তুলে বল ছেড়ে দেওয়া, এগিয়ে—পিছিয়ে ডিফেন্স করা, প্রতি বল লাইনে গিয়ে খেলা দেখে মাঠে হঠাৎ গাম্ভীর্য নেমে এল। দারোগাবাবু এবং ব্যাঙ্ক—ম্যানেজার রান আউট হলেন ১৫৮ রানের সময়। ব্যাট করতে বাকি হেডমাস্টার আর গোপী ঘোষের ছেলে।

রাজশেখর ১১ রানে ক্রিজে। দুটি গ্লান্স ও একটি লেটকাট থেকে পাওয়া রান। দারোগাবাবু আউট হয়ে চলে যাবার সময় তিনি বলে দিলেন, ”আর সতেরো রান জিততে, ছেলেটাকে নামাতেই হবে।”

”ভাববেন না স্যার, আঠারো বছর পুলিশে আছি, কী করে নামাতে হয়…”

কিন্তু দারোগাবাবু বাউন্ডারি লাইন পেরোবার আগেই দেখা গেল গোপী ঘোষের ছেলে ব্যাট হাতে মাঠে নামছে। ম্যালেরিয়ায় একেবারে কাহিল। ফুলহাতা সোয়েটারে, ঘাড়, গলা, চিবুক ঢাকা মাফলারে আর কপাল ঢেকে চেপে বসানো পানামা টুপিতে ছেলেটার নাক আর চোখ ছাড়া মুখের কিছুই আর দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে ঠকঠকিয়ে কেঁপেও উঠছে।

ছেলেটি ক্রিজে আসতেই তাকে পরিস্থিতি বুঝে খেলার জন্য দু—চার কথা বলতে রাজশেখর এগিয়ে আসছিলেন। কিন্তু ছেলেটি হাত তুলে তাঁকে ফিরে যাবার নির্দেশ যে—ভঙ্গিতে দিল, তাতে তিনি হকচকিয়ে ফিরে গেলেন।

ঝানু ব্যাটসম্যানের মতো ‘লেগ—মিড’ গার্ড নিয়ে বুটের ডগা দিয়ে মাটিতে আঁচড় টানল। পতু মুখুজ্জের মুখে শেয়ালের ধূর্তামি ফুটে উঠেছে। সব ফিল্ডারদের ডেকে সে উইকেট ঘিরে দাঁড় করিয়ে দিল।

এক্সপ্রেস বোলারের ওভার চলছে। বল মুঠোয় নিয়ে সে বীভৎস দৃষ্টিতে গোপী ঘোষের ছেলের দিকে তাকাচ্ছে। প্রথম বলটা পিচের মাঝামাঝি পড়ে মাথাসমান উঠল। ছেলেটি কুঁজো হয়ে মাথা সরিয়ে নিল। বকদিঘির সমর্থকদের মুখে হাসি দেখা দিল। পরের বল গুড লেংথে পড়ে অফ থেকে সরে স্টাম্পের দিকে যাচ্ছিল। ইঞ্চি দুয়েক তোলা ব্যাটটা ঝপ করে নামিয়ে দিল। বলটা ব্যাটের কিনারে লেগে স্লিপের মধ্য দিয়ে বাউন্ডারিতে গেল। জেতার জন্য আর ১৩ রান দরকার। পরের দুটো বলও অবিশ্বাস্যভাবেই গুড লেংথে পড়ল এবং ছেলেটি পিছিয়ে গিয়ে ব্যাট বুকের কাছে তুলে আটকাল। রাজশেখর তারিফ জানাতে মাথা নাড়লেন। মাঠের দু’ধার থেকে দুরকম দীর্ঘশ্বাস পড়ল—আশাভঙ্গের এবং আশাতীতের।

পরের ওভারে মালখণ্ডীর অফস্পিনগুলোকে রাজশেখর সহজেই খেলে দিলেন। তবে একটা বল ব্যাট—প্যাড হয়ে সামান্য উঠেছিল। ফরোয়ার্ড শর্ট—লেগ ঝাঁপিয়ে মাটি থেকে বল তুলে ‘হাউজ দ্যাট’ বলে। হরিশ উপরদিকে আঙুল কিছুটা তুলেছে তখন রাজশেখরের কণ্ঠ থেকে বাজ ডাকার মতো ‘নট আউট’ গর্জে উঠতেই বজ্রাহত আঙুল নিঃসাড়ে নীচে পড়ে যায়।

এক্সপ্রেস বোলার ওভার শুরু করার আগে পতুর সঙ্গে গভীর পরামর্শ করে লংলেগে আর মিড উইকেটে দুজন ফিল্ডার রাখল। গোপী ঘোষের ছেলের আবার জ্বরের কাঁপুনি দেখা দিল। বুকের কাছে মুখ নামিয়ে কুঁকড়ে হিহি করছে। বকদিঘির ফিল্ডাররা তার দিকে তাকাচ্ছে সেইভাবে, বেড়াল ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে যেভাবে ইঁদুরের দিকে তাকায়।

পটল হালদার চুকচুক করে সহানুভূতি জানিয়ে তখন বি ডি ও—কে বলল, ”আটঘরার জন্য জীবন বিপন্ন করেও এই যে সংগ্রাম… জানলেন, আমাকেও উদ্বুদ্ধ করছে। আমি চাঁদা তুলব, স্তম্ভ গড়ব…”

বাবার অনুপস্থিতিতে বহুক্ষণ পর সিগারেট খাওয়ার সুযোগ পেয়ে সত্যশেখর সুযোগের সদ্ব্যবহার করছিল। সে শুধু মিটিমিটি হেসে বলল, ”ও বুর্জোয়া বাড়ির ছেলে।”

প্রথম বলটা যথারীতি শর্টপিচ। গোপী ঘোষের ছেলে ডান পা অফ স্ট্যাম্পের দিকে এনে বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটটা ঝলসাল আর মাথা থেকে টুপিটাও তখন পড়ে গেল। ফিল্ডাররা সবাই বলের দিকে তাকিয়ে। ছেলেটি তাড়াতাড়ি টুপি কুড়িয়ে মাথায় চেপে বসাল। রাজশেখরের চোখ অবাক হয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে। কিছু একটা বলতে গিয়ে ঢোঁক গিলে নিলেন।

চোখ থেকে ক্যামেরা নামিয়ে মলয়া মুখার্জি বিস্মিত কণ্ঠে পাশে—বসা বাবাকে বললেন, ”ছেলেটাকে যেন চেনাচেনা লাগছে!”

নিখুঁত হুক থেকে ছয় রান। আর দরকার সাত রান মাত্র। দ্বিতীয় বল অফ স্ট্যাম্পের বাইরে, আবার শর্টপিচ। কড়াত করে রাইফেল থেকে বুলেট বেরোবার মতো আওয়াজ হল। স্কোয়্যারকাট করা বলটা নিমেষে পয়েন্ট বাউন্ডারিতে পৌঁছেছে।

দরকার আর তিন রান। ঝপ করে একটা দমবন্ধ করা থমথমে নৈঃশব্দ্য মাঠটাকে ঘিরে ফেলল। উল্লাসের ঝড় ওঠার আগের অবস্থা।

এক্সপ্রেস বোলারের চোখে এবার ভয়ের আভাস। ফিল্ডাররা ত্রস্ত। পতু মুখুজ্জে দিশাহারা। নয়জন ফিল্ডার বাউণ্ডারি লাইনে দাঁড়িয়ে গেল তার নির্দেশে। গোপী ঘোষের ছেলে আবার হিহি করে কাঁপছে।

এক্সপ্রেস ঝড়ের গতিতে ছুটে এসে বল ছাড়ল। একেবারে মাথা লক্ষ করে ফুলটুস। রাজশেখর চোখ বন্ধ করে ফেললেন। মাঠের অনেক জায়গায় ইশশ শব্দ উঠল শিহরন জানিয়ে। কিন্তু ব্যাটসম্যান স্থির, অচঞ্চল। সে ব্যাটটাকে পাখায় বাতাস করার মতো মুখের সামনে ছোট্ট করে নাড়ল। বলটা মিড উইকেটের দিকে আকাশে উঠতে উঠতে বাউণ্ডারি যখন পেরিয়ে যাচ্ছে, এবং সবাই যখন মুখ তুলে হাঁ করে বলের উড়াল দেখছে, তখন গোপী ঘোষের ছেলে তীরবেগে নীল শামিয়ানার দিকে ছুটতে শুরু করল এবং তাকে কাঁধে তুলে নেবার জন্য যারা তাকে তাড়া করেছিল, তাদের পিছনে ফেলে ড্রেসিংরুমে ঢুকে গেল।

পটল হালদার দু’হাত ছড়িয়ে উচ্ছ্বসিত ভিড়ের সামনে বা বন্যার সামনে বাঁধের মতো দাঁড়িয়ে পড়লেন।

”অসুস্থ। ছেলেটির ম্যালেরিয়া হয়েছে, ওকে আপনারা বিশ্রাম করতে দিন…হবে হবে, পরে ওর সংবর্ধনার ব্যবস্থা হবে…।”

মাঠ থেকে রাজশেখর ফিরে এলেন ভিড় ঠেলে। সত্যশেখর এগিয়ে এসে আড়ালে ডেকে ফিসফিস করে কিছু বলল। রাজশেখরের অট্টহাসিতে শামিয়ানা ভরে গেল।

”তাহলে তিন পুরুষের খেলার রেকর্ড হল।”

ভিড়ের মধ্যে পতু মুখুজ্জের গলা শোনা গেল, ”কই গোপী ঘোষের ছেলে কোথায়, একবার তাকে দেখি।”

”সে ড্রেসিংরুমে শুয়ে আছে।” পটল হালদার বুক চিতিয়ে দাঁড়াল, ”এখন তাকে বিরক্ত করা উচিত নয়।”

”বিরক্ত করব না, শুধু চেহারাটা দেখব।”

কিছুক্ষণ তর্কাতর্কির পর পতু মুখুজ্জে ড্রেসিংরুমের পর্দা সরিয়ে উঁকি দেবার অনুমতি পেল আধ মিনিটের জন্য। পর্দা সরিয়ে সে দেখল, একটা আলোয়ানে আপাদমস্তক ঢাকা একটা শরীর, শুধু নাকটুকু দেখা যাচ্ছে। শরীরটায় মাঝে মাঝে কাঁপুনি ধরছে। আর ”অঃ অঃ” শব্দ শোনা যাচ্ছে। মাথার কাছে টুপি, ব্যাট, প্যাড, গ্লাভস ছড়ানো। ড্রেসিংরুমের কাপড়ের দেয়ালের তলার দিকে খানিকটা ফাঁক রয়েছে।

”রাজশেখর সিংগির নাতনি কোথায়?”

”আছে কোথাও।” পরমেশ উদাসীন ভাবে বলল। ”তাকে তো তোমরা খেলতেই দিলে না।”

পতু মুখুজ্জে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ”আমি প্রমাণ দেব সে খেলেছে। ছবি তোলা হয়েছে। প্রিন্ট হয়ে আসুক, তারপর দেখাব মজা। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কনফারেন্সে তুলব, এম সি সি—কে চিঠি দোব…কী করে রেকর্ড হয় দেখব।”

বাইরে সেই সময় পটল হালদারের নেতৃত্বে বিজয় মিছিল থেকে আওয়াজ উঠল, ”আটঘরার সংগ্রামী ক্রিকেট…জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ…”

ডায়েট চার্ট

পেটই হচ্ছে স্বাস্থ্যের মূল ঘাঁটি

কলাবতী রাতে খাওয়ার টেবিলে এল বড় একটা খাম হাতে।

দাদু তখন রুটির গোছা থেকে বেছে ফোস্কা—পড়া চারখানা রুটি প্লেটে তুলে নেওয়ায় ব্যস্ত। রাতে চারখানা রুটি নিজের জন্য বরাদ্দ করেছেন সত্তর বছরে পা দেওয়ার দিন থেকে। চার বছর আগেও তিনি ষোলখানি রুটি খেতেন, যে জন্য আধ কেজি আটা দরকার হত। আটা থেকে ভুষি বাদ দেওয়ার তিনি ঘোরতর বিরোধী। ভূষিতে প্রচুর নাকি পুষ্টি আছে। বয়োবৃদ্ধি এবং খাটুনি হ্রাস, ওই দু’য়ের সঙ্গে মানিয়ে পাকযন্ত্রকে ব্যবহার করলে শরীর অবাঞ্ছিত আচরণে মন দেয় না, আয়ুও বাড়ে, এইরকম একটা ধারণা রাজশেখর সিংহ চিরকালই পোষণ করে আসছেন। আর সেইজন্যই পুত্র সত্যশেখর এবং নাতনি কলাবতীর খাদ্যের পরিমাণ কতটা হবে সেটা তিনি ঠিক করে দিয়েছেন। দু’জনের জন্য কতটা ক্যালরি শরীরে দিলে কর্মক্ষমতা সতেজ থাকবে এবং চর্বি জমবে না, সে—সব তিনি নানান বইপত্র পড়ে এবং নামকরা এক খাদ্যবিশারদের সঙ্গে পরামর্শ করে (খাদ্যবিশারদকে ৬৪ টাকা ফি দিয়েছিলেন) ঠিক করে দিয়েছেন।

এজন্য তিনি ছেলে ও নাতনিকে জেরাও করেছিলেন। যেমন:

রাজশেখর: সতু, সারাদিনে তুমি কতক্ষণ চেয়ারে বসে কাটাও, কতটা পথ চলাফেরা করো, আর কতক্ষণ বিছানায় শুয়ে কাটাও?

সত্যশেখর হকচকিয়ে তারপর আমতা—আমতা করতেই রাজশেখর ধমক দিয়ে ওঠেন, ”অত মাথা চুলকোবার কী আছে আর কড়িকাঠ গোনারই বা দরকার কী? আমিই বলে দিচ্ছি, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তুমি দশ ঘণ্টা ঘুমোও, দু’ঘণ্টা মোটরে, আর চেম্বারে মক্কেলদের সঙ্গে চেয়ারে বসে, দু’বেলায় মোট ছ’ঘণ্টা, আর হাইকোর্টে বসে কাটাও ছ’ঘণ্টা। এ ছাড়া হাঁটাচলার বা দাঁড়িয়ে থাকার জন্য তোমার সারাদিনে সময় যায় এক ঘণ্টা। কেমন, ঠিক বলেছি?

সত্যশেখর অসহায়ভাবে ভাইঝি কলাবতীর দিকে তাকিয়ে বলল, ”কালু আমি কি দশঘণ্টা ঘুমোই?”

কলাবতী গম্ভীরমুখে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ”দাদুর হিসেবে একটু ভুল হয়ে গেছে। চব্বিশ ঘণ্টায় শোয়া—বসা—চলার যে হিসেব তুমি দিলে, সেটা যোগ করলে হয় পঁচিশ ঘণ্টা।”

”অ্যাঁ, পঁচিশ। বেশ তাহলে চেম্বার থেকে একঘণ্টা কমিয়ে দিচ্ছি।”

”আমি তো রোজই ঘুমোতে যাই এগারোটায় আর মুরারির কাছ থেকে খবরের কাগজ নিই ভোর ছ’টায়, বারান্দায় চা খেতে খেতে রোজই তো দেখি, তুমি আর কালু জগ করতে করতে ফিরছ। সাত ঘণ্টার বেশি আমি ঘুমোই না।”

রাজশেখর টেবিলে রাখা কাগজে কী যেন লিখে নিলেন। তারপর গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলেন, ”আলুকাবলি আর ফুচকা এখনও তুমি খাও, ঠিক কিনা? ঘুগনি? তাও নিশ্চয়?…ব্যস ব্যস, তর্ক করতে যেও না, গত বুধবার মুরারিকে দিয়ে কী কিনে আনিয়ে চেম্বারে বসে গপ গপ করে খেয়েছিলে তা কি আমি জানি না?”

সত্যশেখর প্রবলভাবে প্রতিবাদ জানাতে যাচ্ছিল, কিন্তু বাবার কঠিন দৃষ্টি তাকে ম্রিয়মাণ করে দিল, কেননা রাজশেখর একটুও মিথ্যে বলেননি।

”উফফ, এই সব বদভ্যাস এখনও ছাড়তে পারলে না। আজেবাজে রেস্তোরাঁয় নিশ্চয় চপ—কাটলেট গেলো?”

সত্যশেখর টেবিলের দিকে চোখ নামিয়ে চুপ।

”পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স তো হয়ে গেছে, এবার একটু স্বাস্থ্যের দিকে নজর দাও। খাওয়া দাওয়া রেস্ট্রিক্টেড করো, ব্যায়াম—টায়াম তো জীবনে করোনি…সেদিন কে যেন বলল, বাড়ি ফেরার পথে গাড়ি থামিয়ে তুমি নাকি শর্মার দোকানে ঢুকেছিলে?”

”মাত্র আড়াইশো গ্রাম রাবড়ি…”

”মাত্র হল! উফফ…ওই আড়াইশো গ্রাম হজম করতে কমপক্ষে আড়াই মাইল দৌড়নো দরকার।”

”আমার ওজন লাস্ট টেন ইয়ার্স একই আছে, সত্তর কেজি।” প্রায় বিদ্রোহ করার ভঙ্গিতে সত্যশেখর বলল।

”গুড, ভেরি গুড।”

রাজশেখর কাগজে আরও কিছু লিখে নিয়ে বললেন, ”ডায়েট চার্ট করে দোব, তাই ফলো করবে এবার থেকে।”

এরপর তিনি কলাবতীকে প্রশ্ন শুরু করেন।

”রাত বারোটা—একটা পর্যন্ত রোজ ঘরে আলো জ্বলে। তার মানে গল্পের বই। সকালে মাইল তিনেক দৌড়, টায়ার্ড অবস্থায় পড়ার টেবিলে মিনিট পনেরো, স্কুলে ঘণ্টা ছয়—সাত, বিকেলে জলে সাঁতারের নাম করে ঘণ্টাখানেক কাটানো, কিম্বা জুডো না ক্যারাটে কি যেন বলে, তাই শেখা, তারপর মাস্টারমশায়ের সামনে ঘণ্টা দুই বসে ঢুলুনি, এছাড়া…”

কলাবতী আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দু হাত তুলে ‘ব্যস, ব্যস’ বলে উঠতেই সত্যশেখর গম্ভীর মুখে বলল, ”কালুর জন্যও ডায়াট চার্ট দরকার।”

রাজশেখর দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে নিয়ে মুচকি হেসে বলেন, ”তিনজনের জন্যই চার্ট হবে। খাওয়া একটা গুরুতর ব্যাপার। ঠিকমতো, ঠিক সময়ে, ঠিক পরিমাণ না হলে শরীরের জোর কমে যায়, রোগ জন্মায়। তাছাড়া রান্নার মতো ভোজনও একটা শিল্পকলা, দেখার মতো একটা জিনিস। যখন তখন হাবিজাবি এটা ওটা গেলা, ফেলে ছড়িয়ে পাতটাকে নোংরা করা। আগেরটা পরে পরেরটা আগে খাওয়া, আঙুলগুলোকে সাজিয়ে বাটি থেকে খাবার তোলা, থালায় মাখা, মেপে হাঁ করা, গ্রাস মুখে দেওয়া, তারপর চিবোনো, আহ, দেখার মতো এসব ব্যাপার…এইজন্যই তো লোকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ায়।”

রাজশেখর যতক্ষণ কথা বলে যাচ্ছিলেন, সত্যশেখর আর কলাবতী তার মধ্যে চোখাচোখি করে মুচকি হেসেছিল। স্ত্রী মারা যাবার পর থেকে প্রায়ই উনি নানান বাতিকের মধ্যে ঢুকে পড়েন, আর হাতের কাছে যাদেরই পান নাজেহাল করে ছাড়েন। কলাবতীর মায়ের অকালমৃত্যু এবং কলাবতীর বাবা দিব্যশেখর সন্ন্যাস নিয়ে বাড়ি থেকে চলে যাওয়া তাঁকে যথেষ্ট আঘাত দিয়েছিল। এরপর তিনি নাতনিকে আশ্রয় করে নিজের জন্যে আলাদা একটা জগৎ বানিয়ে ক্রমশই ছেলেমানুষ হয়ে যেতে থাকেন। বাবার বেদনা আর নিঃসঙ্গতা বুঝে সত্যশেখর তালে তাল দিয়ে প্রশ্রয় দিয়ে যায়। বিরাট বাড়িতে ছেলে আর নাতনি ছাড়া ঝি, চাকর, বামুন নিয়েই তাঁকে দিন কাটাতে হয়। তিনি যে এককালের দোর্দণ্ড আটঘরার জমিদারদের বংশধর, এটা কখনও ভোলেন না এবং তাঁর রাশভারিত্ব ও আভিজাত্য থেকে কখনও টলেন না।

সত্যশেখর ও কলাবতী নিজেদের মধ্যে মুচকি হাসার তিন দিন পরেই ডায়াট চার্ট অনুযায়ী কাজ শুরু হয়ে যায়।

সকালে খবরের কাগজে চোখ রেখে সত্যশেখর হাত বাড়িয়ে মুরারির কাছ থেকে চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দিয়েই চেয়ার থেকে তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়।

”থানকুনি পাতার রস।”

মুরারির শান্ত সাদামাটা মুখে বা কণ্ঠস্বরে কোনোরকমে বিকার ফুটল না ছোড়দার লাফ দিয়ে দাঁড়ানো বা ‘ওয়াক ওয়াক’ করতে দেখে। মুরারি এ বাড়িতে আছে আটত্রিশ বছর। ব্যাপার স্যাপার বোঝে।

”রাস্কেল, এই কি চা?”

”না, এটা চা নয়। চা আসবে কাঁচা হলুদ, নিমপাতা, ভিজে ছোলা—আদার পর, অবিশ্যি কর্তাবাবু যদি মনে করেন।”

”মনে করেন মানে?”

”এসব খেয়ে তোমার কেমন লাগল, কেমন ব্যাভার করলে, সেসব আমার কাছ থেকে শুনে তারপর ঠিক করবেন চা না দুধ না কালমেঘের রস, কোনটা দেওয়া হবে।”

সত্যশেখরের চোখে জল এসে গেল। মুরারির দুটো হাত চেপে ধরে শুধু বলল, ”আমাকে বাঁচা।”

কলাবতীর হাতে থানকুনি রসের কাপ তুলে দিয়ে মুরারি পিরামিডের স্ফিঙ্কসের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে। গন্ধটা বারদুয়েক শুঁকে রসে আঙুল ডুবিয়ে কলাবতী জিভে ঠেকায়।

”উমম, টেস্টটা খুব খারাপ নয়। মুরারিদা, এই বস্তুটি কাকা খেয়েছে?”

”অদ্ধেক।”

কলাবতী এক ঢোঁকে রসটা খেয়ে নিল।

”দাদু খেয়েছে?”

”সবার আগে।”

কাঁচা হলুদ, নিমপাতা, ছোলা—আদা পর্ব শেষ হবার পর, রাজশেখর দুজনকে ডেকে পাঠালেন, এবং হর্ষোৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন, ‘সপ্লেন্ডিড। ভাবতেই পারিনি তোরা এত সিরিয়াস হবি হেলথ সম্পর্কে। এই তো চাই। একটা ডায়েট চার্ট করছি। সকাল থেকে রাতের খাওয়া চার্ট অনুযায়ী চলবে। কম খাবি, কিন্তু আসল জিনিসটা খাবি। এই যে চা খাওয়া, এতে কী লাভ। বরং বেলের পানা খাও।”

”অ্যাঁ, পানা!…বাবা, সাতটায় আমার মক্কেল আসার কথা আছে, আজ আর্লি আওয়ারেই হেয়ারিং হবে, তাই…।”

”তাহলে যাও। মুরারি চেম্বারে ফল আর দুধ দিয়ে আসবে’খন।”

”চা দেবে না?”

চা শব্দটা রাজশেখর যেন এই প্রথম শুনলেন এমনভাবে দশ সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললেন, ”কালমেঘের রস খুব উপকারী, চায়ের পর ওটা খেলে হজমে খুব সাহায্য করে।”

”না না,, চায়ে আমার খুব একটা আসক্তি নেই।” বলতে বলতে সত্যশেখর প্রায় দৌড়ে চলে গেল।

”কালমেঘ দারুণ লাগে আমার।” কলাবতী এমনভাবে জিভে আওয়াজ করল যেন সর্ষে দিয়ে কাঁচা আমবাটা নাকের সামনে ধরা হয়েছে।

রাজশেখরের দুটি চোখ ঝকঝক করে উঠল। ছ’ফুটের দশাসই কাঠামোটা টানটান করে পেটে আলতো কয়েকটা চাপড় মেরে বললেন, ”পেটই হচ্ছে স্বাস্থ্যের মূল ঘাঁটি। এটাকে জোরালো রাখতে হলে একটা রেজিমেন্টকে যে রকম ডিসিপ্লিন্ড হতে হয় সেই রকম হতে হবে খাওয়ায়। কালমেঘ, চিরেতা, ব্রাহ্মি শাক, ত্রিফলা এসব হচ্ছে বাংলার নিজস্ব জিনিস। ছোটবেলায় মা খাওয়াতেন, দ্যাখ আজও কেমন শরীরটা রয়েছে। সতুটা দিনদিন পেটুক হয়ে যাচ্ছে, শুনেছি কাঁচাগোল্লা খেতে নাকি মছলন্দপুর গেছল।”

সত্যশেখর সত্যিই গেছল এবং কলাবতীর জন্য প্রায় আধকিলো কাঁচাগোল্লা এনে দিয়েছিল। আর কলাবতীর কাছ থেকে ভাগ পেয়েছিল মুরারি। কিন্তু এ খবর তো দাদুর অজানা থাকারই কথা, তাই সে মনে মনে সাবধান হয়ে গেল।

”সত্যিই কাঁচাগোল্লা খুব বাজে জিনিস। লাখ টাকা দিলেও আমি খাব না। দাদুকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে কলাবতী ঘর থেকে বেরিয়ে এসে খুঁজতে লাগল মুরারিকে। দোতলায় উঠোনের বারান্দা থেকে সে দেখতে পেল, মুরারি একটা গ্লাসের উপর রেকাবি বসিয়ে কাকার চেম্বারের দিকে যাচ্ছে। এক নজরে সে চিনতে পারল রেকাবিতে কলা, শশা, কমলালেবু, আঙুর আর গ্লাসে বোধহয় বেলের পানা।

”মুরারিদা, দাদু জানল কী করে কাকার কাঁচাগোল্লা খাওয়ার কথা?”

সত্যশেখর ভীতিগ্রস্ত চাহনির নীচে রেকাবি আর গ্লাসটা টেবলে রেখে মুরারি ভারিক্কি চালে ”এগুলো শেষ করো” বলে যখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে, সেই সময় কলাবতী উত্তেজিত হয়ে চেম্বারে ঢুকল।

”তুমি বিট্রে করেছ।”

মুরারি আকাশ থেকে পড়ল। দু’হাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে কাঁদো—কাঁদো গলায় বলল, ”মা কালীর দিব্যি, আমি কিচ্ছুটি বলিনি। বিশ্বাস করো, কত্তাবাবুকে আমি…”

”হুমম।”

সত্যশেখর টেবলে যে ঘুঁষিটা বসাল, তাতে মহম্মদ আলি নকআউট হয়ে যেতে পারে।

”এবার বুঝলুম কে আমার সম্পর্কে বাবার কাছে লাগায়। মুরারি…” সত্যশেখর রক্ত জল করা হুঙ্কার দিল চাপা গলায়, ”পরশু তোকে পাঁচ টাকা দিয়েছিলুম ফেলুর দোকান থেকে রাধাবল্লভী আনতে। দশটার বদলে পেয়েছি আটটা, বাকি দুটো কী হল? পয়সা মেরেছিস না খেয়েছিস? মালাই বরফওলাকে ও—মাসের জন্য দিতে হবে বলে বাষট্টি টাকা নিয়েছিস অথচ আমার হিসেবে হচ্ছে বাহান্ন টাকা। কী ভেবেছিস আমাকে? গোরু ভেড়া না মন্ত্রী? বাবাকে এবার বলে দেব, নির্ঘাত বলে দেব।”

”ছোড়দা, তাহলে মরে যাব।”

মুরারির চোখ দিয়ে টপটপ জল ঝরতে শুরু করল।

”কাঁদলে কী হবে, এবার দাদুকে বলে তোমারও ডায়েট চার্ট করাব, কালমেঘের রস, চিরেতার জল, গিমে শাক, ব্রাহ্মীশাক…।”

”এই কান মুলছি, এই নাক খত দিচ্ছি…”

মুরারি কুঁজো হয়ে টেবলের এক ধার থেকে অন্য ধার পর্যন্ত নাক ঘষড়ে গেল।

”কত্তাবাবুর সামনে মিথ্যে বলতে কেমন ভয় ভয় করে। তবু তো রেখে ঢেকে বলি, নইলে তুমি যে চেম্বারে মক্কেল বসিয়ে রেখে রাস্তায় গিয়ে মালাই বরফ খাও, তা কি কখনো বলেছি?”

”বলবি কী করে, তুইও তো আমার সঙ্গে খাস।”

”কাকা তো চেম্বারে, বরফওলাকে ডেকে আনে কে?”

”আমি।”

আসামি অপরাধ কবুল করেছে, জজ এবার কী রায় দেবেন! এমন একটা কৌতূহলী ভঙ্গিতে কলাবতী তাকাল কাকার দিকে। সত্যশেখর রিভলভিং চেয়ারে ডাইনে—বাঁয়ে ঘোরাঘুরি করতে করতে ”হুমম…হুমম” শব্দ করে যেতে লাগল চোখ বুজে।

”ছোড়দা, নিত্যানন্দে আটটার পর আর কিন্তু জিলিপি ভাজে না, শিঙাড়া সাড়ে আটটা পর্যন্ত।”

সত্যশেখর চোখ খুলে দেয়াল—ঘড়ির দিকে তাকিয়েই ”অ্যাঁ, তাই তো”, বলেই ড্রয়ার থেকে মানিব্যাগ বার করল।

”কত দেব?”

”কালুও রয়েছে, টাকা দশেকই দাও। নরম বোঁদেও যদি দেখি…।”

টাকা নিয়ে মুরারি বেরিয়ে যাচ্ছিল, কালু হাত ধরে টানল।

”এগুলো কী হবে?”

”ঠিক মুরারি, এই কলা, শশা, বেলের পানা…সক্কালবেলায় এসব কী হবে?”

বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে মুরারি গ্লাস তুলে চোঁ—চোঁ করে বেলের পানা খেয়ে ফেলল।

”ওগুলো এখানেই থাক, পরে এসে খেয়ে নেব।”

”না, এখুনি তোকে খেতে হবে।”

মুরারি কথা না—বাড়িয়ে মিনিট তিনেকের মধ্যে সব ফল কচমচ করে খেয়ে ফেলে রেকাবি আর গ্লাসটা নিয়ে বেরিয়ে গেল।

একটু পরে রাজশেখর নাতনির কাছ থেকে জানলেন তাঁর ছেলে গোগ্রাসে সব ফল খেয়েছে আর এক চুমুকে বেলের পানা।

”ভাতের সঙ্গে উচ্ছে আর পেঁপে—সেদ্ধ, নিম—বেগুন, তারপর সুক্তো, মাগুর কিংবা শিঙ্গির ঝোল হবে মশলা ছাড়া, আনাজের খোসা একদম ছাড়ানো চলবে না। আর কম্পালসারি শাক, ডাঁটা, কচু কিংবা ওল কিংবা থোড় বা মোচা, বিচে কাঁচকলা, মাসকড়াই, গাজর, এইসবের একটা তরকারি আর টক দই। ভাজাভুজি একদম বন্ধ। একমাস পর দেখবি ডায়েট চার্ট ফলো করে লোহা চিবিয়ে তোরা হজম করে ফেলছিস।”

এ তো বিশ্বনাথের ইনিংস!

একমাস পর সেদিন রাত্রে কলাবতী খাওয়ার টেবলে এলে বড় একটা খাম হাতে। রাজশেখর তখন চারখানি রুটি নিজের প্লেটে রাখছিলেন।

”মলয়াদি কতকগুলো ছবি দিলেন তোমায় দেখাবার জন্য।”

”কে মলয়া?” রাজশেখর গভীর মনোযোগে রুটিগুলোর প্রতি—মিলিমিটার যথোপযুক্ত সেঁকা হয়েছে কিনা পরীক্ষা করতে করতে অন্যমনস্কের মতো জানতে চাইলেন। অবশ্য মলয়াকে তিনি খুব ভালোই চেনেন।

”আমাদের স্কুলের বড়দি, হেডমিস্ট্রেস মলয়া মুখার্জি।”

”হুঁ উ উ…হরিশঙ্করের মেয়ে?”

”হ্যাঁ।”

এখানে এবার কিছু পূর্বকথা জানিয়ে রাখা দরকার। হুগলি জেলায় আটঘরা আর বকদিঘি নামে পাশাপাশি দুটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম আছে। দুই গ্রামের দুই জমিদার—বংশ সিংহ ও মুখুজ্যেদের মধ্যে আকচাআকচি প্রবল। সামান্য বা অসামান্য সব ব্যাপারেই উভয়ের মধ্যে রেষারেষি। জমিদারি প্রথা উঠে যাবার পর সেটা কেন্দ্রীভূত হয়েছে দুই গ্রামের মধ্যে বছরে একবার একটি ক্রিকেট ম্যাচকে উপলক্ষ করে। মহা ধুমধামে দুর্গোৎসবের মতো এই বাৎসরিক ম্যাচ হয়। এক মাস আগে থেকেই দুই গ্রামের ছেলে—বুড়ো—মেয়ে পুরুষ টেনশ্যনে ভুগতে শুরু করে। প্রতিবার এই খেলায় একটা—না—একটা ঝঞ্ঝাট বাধেই, আর তাই নিয়ে হুলুস্থুলু পড়ে যায়।

আটঘরার জমিদারবাড়ির নাতনি কলাবতী বাংলার মেয়ে ক্রিকেট দলে খেলে। খুবই সম্ভাবনাময় ব্যাটসউওম্যান, টেস্টম্যাচ খেলার জন্য যে ডাক পাবেই তাতে সন্দেহ নেই। ওর খুবই ইচ্ছে, এবং রাজশেখরেরও, এই বাৎসরিক ম্যাচে খেলার। কিন্তু বকদিঘির অধিনায়ক পতু মুখুজ্যে সাফ জানিয়ে দেয়, কোনো মেয়েকে এই ম্যাচে তারা খেলতে দেবে না।

প্রাক্তন এম পি এবং বর্তমানে এম এল এ গোপীনাথ ঘোষের ছেলে ব্রজদুলাল ওরফে দুলু গতবারের ম্যাচে আটঘরা দলে ছিল। খেলা শুরুর ঠিক আগে কলাবতীর পরামর্শে দুলু ‘হঠাৎ’ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে ড্রেসিংরুমে শুয়ে থাকে। তার হয়ে ফিল্ড করে সাবস্টিটিউট হাবু ময়রার ছেলে বিশু। কিন্তু ব্যাটিংয়ের সময়, হাতে মাত্র দুটি উইকেট নিয়ে জয়ের জন্য আটঘরার যখন ১৭ রান দরকার, তখন ম্যালেরিয়ায় কাহিল দুলু ব্যাট হাতে নামে ফুলহাতা সোয়েটারে, মাফলারে এবং পানামা টুপিতে এমন ভাবে নিজেকে ঢাকাঢুকি দিয়ে যে, নাক আর চোখ দুটি ছাড়া তার আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। দুলুর ব্যাটিংই শেষ পর্যন্ত যখন জয় এনে দেয় তখন নন—স্ট্রাইকার ছিলেন ১১ রানে অপরাজিত রাজশেখর।

তবে এই জয়ে সত্যশেখরেরও অবদান ছিল। তেরোটি ওভারবাউন্ডারি মেরে আচমকা একটা সেঞ্চুরি করে ফেলে সে রীতিমতো নার্ভাস হয়ে যায়। আটঘরার জনতা মাঠের মধ্যে নেমে এসে তাকে কাঁধে তুলে নাচানাচি করে—এই বাৎসরিকীতে আগে কেউ সেঞ্চুরি করেনি। সুতরাং সেঞ্চুরিটি ঐতিহাসিক।

একটা বল হুক করার সময় দুলুর মাথা থেকে পানামা টুপিটা পড়ে গেছল। ফিল্ডাররা সবাই তখন বলের দিকে তাকিয়ে। সেই অবসরে দ্রুত টুপিটা কুড়িয়ে সে মাথায় পরে নেয়। বকদিঘি শিবিরে দর্শকদের মধ্যে ছিল হরিশঙ্কর এবং নিত্যসঙ্গী নিক্কন ক্যামেরাটি হাতে নিয়ে মলয়া। বহু ছবি সে ম্যাচ চলার সময় মাঠের চারপাশ ঘুরে—ঘুরে তোলে। বিশেষ করে সত্যশেখর ও ব্যাটসম্যান দুলুর।

ম্যাচশেষে পতু মুখুজ্যে আটঘরা শিবিরে এসে রাজশেখর সিংগির নাতনির খোঁজ করেছিল। কিন্তু কলাবতীকে পাওয়া যায়নি। তবে ড্রেসিংরুমে আপাদমস্তক মুড়ি দেওয়া ম্যালেরিয়ায় কাহিল দুলুকে কোঁকোঁ আওয়াজ করে কাঁপতে দেখা গেছল। পতু মুখুজ্যেকে অবশ্য বেশি কথা বলতে দেয়নি আটঘরা গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান পটল হালদার। তবে পতু বলে গেছল সে ছবি দিয়ে প্রমাণ করে দেবে, গোপী ঘোষের ছেলে দুলুর বদলে রাজশেখর সিংগির নাতনি কালু ব্যাট করেছে। পটল হালদার তখনই ঘোষণা করে সত্যশেখরের সেঞ্চুরিকে স্মরণীয় করে রাখতে সে একটা স্তম্ভ গড়ে দেবে।

রাজশেখর রুটি পরীক্ষা শেষ করে মুচকি হেসে বললেন, ”কীসের ছবি?…তুই ব্যাট করেছিলি তারই প্রমাণ?”

কলাবতী ঘাড় নাড়ল। দেয়াল—ঘড়িতে দশটা বাজছে। সত্যশেখর একতলা থেকে এইসময় উঠে এল। রাজশেখরের শেষ কথাটি কানে যাওয়ায় কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করল, ”প্রমাণ! কীসের প্রমাণ?”

কলাবতী খামটা থেকে একগোছা রঙিন ছবি বার করল। কয়েকটা দিল দাদুকে, কয়েকটা কাকাকে।

”হরির মেয়ের হাত দেখছি খুবই পাকা, ছবিগুলো ভালোই এসেছে।” রাজশেখরের চোখে তারিফ ফুটে উঠল। রুটিতে যতটা মনোযোগ দিয়েছিলেন, ছবিগুলোয় ততটাই দিলেন।

”হাত পাকা হবে না কেন, বিলেতেই তো ক্যামেরা কিনে শুরু করে। এতদিনে হাত পাকবে না!” সত্যশেখর হাতের ছবিগুলো টেবলে সাজিয়ে রাখল। এইসময় বারান্দার দিকের দরজায় মুরারির মুখ উঁকি দিতে দেখা গেল। সত্যশেখরের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সে হাত নাড়ছে।

”কাকা, এই ছবিটা কেমন?”

কলাবতী একটা ছবি নিজের মুখের কাছে ধরল। সত্যশেখর ছবি দেখার জন্য মুখ তুলতেই সে চোখের ইশারায় মুরারিকে দেখিয়ে দিল। সত্যশেখর তাকাতেই মুরারির হাতছানি দেখে বোঝা গেল জরুরি কিছু বলার আছে।

”ওহহো, দেখেছ, ড্রয়ারে চাবি দিয়ে আসতে ভুলে গেছি।”

সত্যশেখর ব্যস্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বারান্দার অন্ধকার কোনায় গিয়ে সে বলল, ”কী হল, ডাকছিস কেন?”

”বলতে একদমই ভুলে গেছি, আজ সকালে তোমাকে কালমেঘ দিইনি, কত্তাবাবু বারণ করিছে। মাঝে—মধ্যে সব বন্ধ থাকবে। ডাট চাট অনুযায়ী খাওয়া দাওয়া হঠাৎ বন্ধ রেখে কত্তাবাবু পরীক্ষা করবেন, তোমাদের খাওয়ার বহর কমিছে কি না, তোমাদের নোলা ঠিকঠাক তৈরি হইছে কিনা।”

”আজ সকালে তাহলে আমাকে কালমেঘের রস দিসনি? মানে খাইনি? বইটি www.boiRboi.blogspot.com থেকে ডাউনলোডকৃত।

”না।”

”কাঁচা হলুদ…”

”ওসব কিচ্ছু খাওনি।”

”কাল রাতে ইসবগুলও খাইনি তো?”

”না, তাও নয়।”

”কী ভাবে নোলা পরীক্ষা করবেন?”

”গাড়ি নিয়ে আজ বেইরেছিলেন। রয়েলের চাপ, সাবিরের রেজালা, মাধবের ঝাল আলুদ্দম, বিজলীর ফিশ ওর্লি, অম্বরের তন্দুরি চিকেন, অনাদির মোগলাই পরোটা, অমৃতের দই, নকুড়ের কড়াপাক…”

”থাম থাম।”

”আরো আছে যে…তপসে ভাজা, ভাপা ইলিশ।”

”মরে যাব উফফ, মরে যাবে।”

”সামনে থাকবে কিন্তু খাবে না, খেয়েছ কি ডাট চাট লম্বা হয়ে যাবে। তুমি কালুকে জানিয়ে দাও এখুনি।”

”এখন কী করে বাবার সামনে জানাব, আগে বলতে হয়তো, পাঁঠা কোথাকার।”

”ইশারা করে করে মানা করে দিও, কালুর খুব বুদ্ধি আছে, ধরে ফেলবে।”

সত্যশেখর পাংশু নার্ভাস অবস্থায় ফিরে এসে চেয়ারে বসল। কলাবতী জিজ্ঞাসু কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে দেখে সত্যশেখর বাবার দিকে চোখের ইশারা করে, মুখের কাছে আঙুল দিয়ে গ্রাস তুলে মাথা নেড়ে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করতে যাচ্ছিল, তখন রাজশেখর ছবি থেকে চোখ তুলে বেশ জোরেই হেসে উঠলেন। কলাবতী কাকার ইশারার মাথামুণ্ডু বুঝতে না পেরে খুবই ধাঁধায় পড়ে গেল।

”মেয়েটা টিপিক্যাল হরির মতোই হয়েছে বটে। সিংগিদের কী করে জব্দ করা যায় সেটা খুব ভালোই শিখে গেছে।”

”এজন্য তো কাকাই দায়ী। কাকাই তো বড়দিকে খেপিয়ে দেয় জিভ দেখিয়ে।”

”আমি, কক্ষনো না! লাস্ট ওকে জিভ দেখিয়েছি নাইন্টিন সিক্সটি সেভেনে, বিলেতে। তারপর ওর সঙ্গে আমার দেখা এই ক্রিকেট ম্যাচে।”

এখানে আবার একটা পূর্ব কথা বলে রাখা দরকার।

সত্যশেখর আর মলয়া তাদের বাবাদের মতোই বাল্যবয়স থেকেই পরিচিত। দুজনের যত ভাব, তত ঝগড়া। অবশ্য ঝগড়ার কারণগুলোর প্রত্যেকটাই ঠিক তাদের বাবাদের মতোই বংশগত মানমর্যাদাকে কেন্দ্র করে। দুজনের দেখা হলেই ওদের মধ্যে বুনো ওলের সঙ্গে বাঘা তেঁতুলের মতো একটা সম্পর্ক দেখা দেয়। সত্যশেখরের ছোটবেলার অভ্যাস জিভ দেখিয়ে মলয়াকে রাগিয়ে দেওয়া। চুলে পাক ধরলেও সে আজও অভ্যাসটা ছাড়তে পারেনি। ব্যারিস্টার হবার জন্য সে যখন বিলেত যায়, মলয়াও তখন সেখানে শিক্ষা ও মনস্তত্ত্ব বিষয়ে পড়াশুনো করতে গেছল। দুজনের প্রায়ই দেখাসাক্ষাৎ হত, এবং সাক্ষাৎগুলি অবশ্যম্ভাবী পরিণত হত ঝগড়ায়। একজন যদি বলে সূর্য পশ্চিমদিকে ওঠে তাহলে অন্যজন অবধারিত বলবে, ‘কিন্তু অস্ত যায় উত্তরে।’ দুজনে প্রায় একই সময়ে দেশে ফিরে আসে। একজন এখন প্র্যাকটিস করছে কলকাতা হাইকোর্টে আর অন্যজন কাঁকুড়গাছিতে মেয়েদের স্কুলে হেডমিস্ট্রেস এবং সেই স্কুলেই কলাবতী পড়ে। ছিপছিপে, চল্লিশের কাছাকাছি অবিবাহিতা বড়দি যে কালুকে একটু বেশিই স্নেহ করেন, এটা স্কুলের দারোয়ান থেকে টিচার্স—রুমের প্রত্যেকেই জানে।

রাজশেখর একটা ছবি তুলে বললেন, ”সতুকে যখন কাঁধে তুলে নাচছিল, তখন যে ওর জিভটা বেরিয়ে গেছল সেটা কি লক্ষ করেছিলিস কালু?”

”তখন কেমন যেন মনে হয়েছিল কাকা একবার না একবার জিভ বার করবেই। বড়দির হাতে ক্যামেরা অথচ কাকার জিভ শান্তশিষ্ট, তাই কখনো হয়।”

সত্যশেখরের হঠাৎ বিষম লাগায় দুজনে মুচকি হাসল।

”দাদু, এই ছবিটায় কি বোঝা যাচ্ছে এটা আমিই?”

রাজশেখর ঝুঁকে পড়লেন কলাবতীর হাতের ছবিটার উপর। সেই অবসরে সত্যশেখর আবার ইশারা করে বোঝাতে চাইল খাবার—দাবার সম্পর্কে খুব সাবধান, এখনি ডায়েট চার্টের প্রতিক্রিয়া জানার পরীক্ষা হবে, লোভ দমন করতে হবে। কিন্তু এবারও কলাবতী ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে আরও বিভ্রান্ত হয়ে গেল।

”কালু, তোর নাকটাই যা গোলমাল করছে। গোপী ঘোষের ছেলের নাক কি এত টিকোলো?” রাজশেখর চোখ তুলে নাতনির নাক দেখতে গিয়ে ভ্রূ কোঁচকালেন। ”কালু, মুখটা অমন করে আছিস কেন, পেট কামড়াচ্ছে? বাইরে কিছু খেয়েছিস নিশ্চয়?”

”কিচ্ছু খাইনি তো, শুধু—শুধু পেট কামড়াবে কেন!”

”কালুর বোধহয় খুব খিদে পেয়েছে। আচ্ছা বাবা, থানকুনি পাতার রসে কি খিদে বাড়ে?”

”নিশ্চয়! তা ছাড়া পেট ঠান্ডা রাখে, অম্বল—টম্বল হয় না।”

”তাই। আমার ইদানীং যা খিদে বেড়েছে কী বলব। কাঁঠালের বিচি আর ওল—ভাতে যে এত টেস্টফুল, কচুর মুখি যে এত প্যালেটেবল, জানতামই না। বোধহয় নিমপাতা আর কাঁচা হলুদের অ্যাকশন, তাই না?”

”হতে পারে।” রাজশেখর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। ঘাড় বেঁকিয়ে তিনি দরজার দিকে তাকাতেই অপেক্ষমাণ মুরারি এগিয়ে এল।

”সব রেডি আছে, আনব কি?”

”হ্যাঁ, এদের খুব খিদে পেয়েছে মনে হচ্ছে।”

মুরারি বেরিয়ে যাবার সময় করুণভাবে একবার সত্যশেখরের দিকে তাকিয়ে গেল।

”দাদু এই ছবিটা দিয়ে কি প্রমাণ করা যাবে আমিই খেলেছি?” কলাবতী একটা ছবি তুলে শূন্যস্থান পূরণের মতো টেবলে খাবার এসে পৌঁছবার আগের সময়টা ভরাট করার জন্যই বলল।

”ডিফিকাল্ট, ভেএরি ডিফিকাল্ট। দুলু আর কালু দৈর্ঘ্যে প্রস্থে প্রায় এক। তা যদি না হত, তাহলে সেদিনই ধরা পড়ে যেত। তবে এই ছবিটা দিয়ে পতু মুখুজ্যে হয়তো জল ঘোলা করার চেষ্টা করবে। তা এখানে তো একজন আইনজানা লোক রয়েছে, সে কী বলে?”

রাজশেখর ভ্রূ তুলে ব্যারিস্টার ছেলের দিকে ট্যারা চোখে তাকালেন।

সত্যশেখর দু’বার কেসে বাঁ হাতের তর্জনী দিয়ে কপালে টোকা মারতে মারতে প্রচণ্ড গম্ভীর হবার জন্য বারো সেকেন্ড সময় নিল।

”আইন বলতে এখানে ক্রিকেটের আইন।” সত্যশেখর ফিল্মি ব্যারিস্টারদের মতো কাল্পনিক একটা চশমা চোখ থেকে খুলে ফেলার ভঙ্গি করল। ”ইয়েস, ক্রিকেটের আইন আমি দেখেছি। কোথাও লেখা নেই যে, মেয়েরা খেলতে পারবে না পুরুষদের টিমে।”

”বাট, এটা তো ক্রিকেটের একটা সাধারণ আইন। কিন্তু প্রত্যেক টুর্নামেন্টেরই কিছু নিজস্ব আইন তো থাকে।” রাজশেখর প্রায় চিফ জাস্টিদের মেজাজে কথাটা বললেন। প্রসঙ্গত, গত কুড়ি বছরে তিনজন চিফ জাস্টিসের সঙ্গে তাঁর তুই তোকারির সম্পর্ক ছিল।

”হ্যাঁ থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে কি কোনো লিখিত আইন আছে এই ম্যাচ সম্পর্কে?”

রাজশেখর কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে মাথা নাড়তে লাগলেন।

”না, আই অ্যাম শ্যূওর, কোনো লিখিত আইন নেই। শুধু কনভেনশনের উপর খেলা চলে আসছে। আর কনভেনশন তো যে—কোনো সময় ভাঙা যায়।”

”কিন্তু তার একটা কারণ থাকা দরকার। ইচ্ছেমতো যখন খুশি তো প্রথা ভাঙা যায় না। কালু ইচ্ছে করলেই স্পোর্টিং ইউনিয়ন বা কালীঘাটের হয়ে কি লিগ ক্রিকেট খেলতে পারবে? যদিও ওর যোগ্যতা আছে।”

কলাবতী লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠতে পারল না যেহেতু তার গায়ের রঙ কালো। শুধু হাত তুলে বলল, ”আচ্ছা আচ্ছা, খুব হয়েছে। ভারী তো খেলি।”

”তোমার কথাটা ঠিকই, যখন খুশি প্রথা ভাঙা যায় না, কিন্তু আমি, তুমি আর কালু তিনপুরুষ একটা ম্যাচে খেলবে এটা কি একটা স্পেশাল অকেশন নয়? এটা তো একটা গৌরবের ব্যাপার এক্ষেত্রে কি…”

মুরারি এবং তার পিছনে আরও দুজন, বলরাম আর অপুর মা, প্রত্যেকের হাতে নানান আকারের নানান গড়নের চিনেমাটির স্টিলের, কাচের ও কাঁসার পাত্র দু’হাতে ধরা। একটার উপর আর একটা—কুতব মিনার, শহিদ মিনার, একটা তো পিসার হেলানো টাওয়ারের মতো।

টেবলের অর্ধেকটাই ভরে গেল। ঝুঁকে রাজশেখর প্রত্যেকটা থেকে ঢাকনা তুলে নিতে নিতে জোরে নিশ্বাস টেনে, ”আহহহ” বলে মাথা নাড়তে লাগলেন। কখনও বললেন, ”ডিলিশাস”, কখনও ”আহ, মার্ভেলাস।”

সত্যশেখর করুণ চোখে খাবারগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। কলাবতীর চোখ উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে। বেরিয়ে যাবার সময় মুরারি দুঃখভরা, বিষণ্ণ চোখ সবার মুখের উপর বোলাল।

”দাদু, এসব কী, অ্যাঁ, অ্যাত্তো…কই বলোনি তো আগে!”

”আগে বললে কি এমন মিষ্টি—অবাকটা পেতিস? আগে ভাজা দিয়ে শুরু, তুলে নে যত খুশি। মানিকতলা বাজারে টাটকা তপসেটা পেলাম, ইলিশটা শোভাবাজারের। কই, সতু, তোল তোল।”

সত্যশেখরের মুখটা দ্রুত সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো হয়ে গেল। খুবই শান্ত ভঙ্গিতে বলল, ”নাহ, এসব খাবার দেখলেই এখন গা গুলিয়ে ওঠে। মুখরোচক নিশ্চয়ই, কিন্তু পেটের পক্ষে একদমই ভালো নয়।”

শুনতে শুনতে রাজশেখর খুশিতে বারদুয়েক মাথা ঝাঁকালেন।

”কাকা, কী বলছ তুমি! এই তো কদিন আগে…” কলাবতী থেমে গেল সত্যশেখরের কটমট চাহনি দেখে। তারপর বলল, ”না খাও না খাবে, আমি কিন্তু খাব।”

সত্যশেখর প্রচণ্ড অনিচ্ছায় বেগুনির মতো দেখতে ফিশ ওর্লির আধখানা আর ইলিশের পেটি থেকে একচিমটে ভেঙে নিল। তপসে ছুঁলই না। আলুর দমের একটা আলু মুখে দিয়েই ”ওরে বাবা কী ঝাল” বলে ফেলে দিল। আর রেজালার মাংসে লাগা ঝোল রুটি দিয়ে চেঁছে ফেলে তবেই মুখে ঠেকাল।

”এত তেল—মশলা—ঘি, পেটের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর।” সত্যশেখর তার বাবার সামনে থেকে রেজালার পাত্রটা সরিয়ে নিয়ে বলল, ”বাবা এসব তুমি খেও না, বরং তন্দুরি চিকেনটা নাও, ওতে ঘি—মশলা নেই।”

রাজশেখর বিস্ময় চাপতে চাপতে আনন্দে প্রায় কেঁদে ফেলার মতো অবস্থায় পৌঁছে গেছেন। কলাবতী রেজালা শেষ করে আঙুলগুলো চাটতে চাটতে মটন চাপের প্লেটটার দিকে তাকিয়ে বলল, ”দাদু তুমি যে রয়্যালের গল্প করতে, সেখান থেকেই কি এনেছ?”

”নিশ্চয়, এখনও সেই টেস্ট, সেই ফ্লেভার।”

”কাকা যদি না খায়…খাবে তুমি?”

সত্যশেখর সভয়ে সঘৃণায় মাথা নাড়ল।

”তাহলে আমাকে সবটা দাও।”

রাজশেখর ভ্রূ তুলে গম্ভীরভাবে কলাবতীর দিকে পুরো প্লেটটাই এগিয়ে দিলেন। সত্যশেখরের করুণ চোখ যেন বলে উঠল: কালু করছিস কী? এই চাপ যে পরে চাপচাপ কচু, ওল, উচ্ছে, ঢ্যাঁড়স, কাঁচাপেঁপে হয়ে টেবলে ফিরে আসবে।

কলাবতীও অবাক হয়ে যাচ্ছে খাওয়ার প্রতি কাকার অরুচি দেখে। যে—সব জিনিস টেবলে সাজানো রয়েছে, কাকার তো ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। প্রত্যেকটাই ওর প্রিয় খাদ্য, অথচ কেমন মনমরা হয়ে রয়েছে। দু আঙুলে চিমটি দিয়ে তুলে কোনোরকমে জিভে ঠেকিয়েই ফেলে দিচ্ছে, যেন নিম বা উচ্ছে। দিন পাঁচেক আগে কোর্ট থেকে ফেরার সময় নিজামের আঠারোটা শিককাবাব আর দশটা পরোটা এনে মুরারিকে দিয়ে গরম করিয়ে গ্যারাজে মোটরের মধ্যে বসে কাকা একাই বারোটা শিক আর সাতটা পরোটা শেষ করার পর চেম্বারে গিয়ে বসে। বাকিগুলো ছিল তার আর মুরারির জন্য। অথচ পাঁচদিনের মধ্যেই কী পরিবর্তন। হয়তো আজ জজের কাছে ধমক খেয়েছে, মন খারাপ, কিংবা ফেরার পথে গাঙ্গুরাম বা গোল্ডেন ড্র্যাগন কী ওয়ালডর্ফে ঘুরে এসেছে।

সত্যশেখর একটার পর একটা প্লেট ঠেলে সরিয়ে দিল, আর কলাবতী সেগুলো টেনে নিল। দই আর কড়াপাক যখন এল, কলাবতীর তখন আইঢাই অবস্থা।

”কতদিন পর এমন দারুণ দারুণ জিনিস…উফ।”

কলাবতী হাঁফাচ্ছে। কপাল থেকে দরদর ঘাম চিবুকে নেমে এসেছে। সিলিং পাখার দিকে তাকিয়ে হাওয়াটা মুখে লাগাতে লাগাতে বলল, ”দাদু, তোমার ডায়েট চার্ট ফলো করতে করতে কাকার খিদে মরে গেছে, আর আমার খিদে বেড়ে গেছে।”

”মোটেই আমার খিদে মরেনি।” সত্যশেখর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে দই আর কড়াপাকের দিকে সেইভাবে তাকাল, বাউন্সার—হুক—করা ব্যাটসম্যানের প্রতি ফাস্ট বোলার যে—ভাবে তাকায়।

”আসলে স্বাস্থ্যকর, পুষ্টিকর খাদ্য খেয়ে খেয়ে আমার এখন অন্য কিছু বিশেষত ভাজাভুজি, ঝালঝোল, মশলা দেওয়া কিছু আর মুখে তুলতে ইচ্ছে করে না। বাঙালিরা এই সব খায় বলেই তো যত রাজ্যের পেটের রোগে ভোগে, অকালে বুড়িয়ে যায় আর অল্পবয়সে মারা যায়, তাই না বাবা?”

”তার থেকে বড় কথা, সতু”, রাজশেখর এক কেজি ভাঁড় থেকে এক চামচ দই তুলে প্লেটে রাখতে রাখতে বললেন, ”খারাপ স্টমাক নিয়ে পরিশ্রম, চিন্তা, কল্পনা কোনোকিছুই করা যায় না, তাই তো বাঙালি ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে।”

রাজশেখর দইয়ের প্লেট নাতনির দিকে এগিয়ে দিলেন। সত্যশেখরের মুখ কুঁকড়ে গেল। জিভ দিয়ে গত আধঘণ্টায় ষোড়শতম ঠোঁট চাটা শেষ করে সে কাতর চোখে ভাইঝির দিকে চেয়ে রইল।

”খাওয়া মরে গেছে বললে ভুল হবে, সুষম খাদ্য মানে ব্যালান্সড ডায়েটের জন্য খিদেটাও ব্যালান্সড মানে পরিমিত হয়ে গেছে। বাবা, কালুর খিদেটা অপরিমিত হল কেন বলো তো?”

”হুমম সেটাই তো বোঝার চেষ্টা করছি। এবার বোধহয় ওর কালমেঘের ডোজটা বাড়াতে হবে, সেইসঙ্গে এককাপ করে আনারস—পাতার রসের সঙ্গে তুলসীপাতার রস, দুবেলা। বাগানের যেদিকটায় কালুর জন্য প্র্যাকটিস পিচ করব ভাবছি, তার পিছনে দেয়াল ঘেঁষে আনারস আর তুলসী গাছ লাগাব।”

”দাদু, খিদে হওয়াটা তো হেলথেরই লক্ষণ, পাকযন্ত্র যে দারুণ ফর্মে আছে, সেটাই তো প্রমাণ করছে পারফরম্যান্স দিয়ে। কোথায় তুমি প্রশংসা করবে, তা না, ডোজ বাড়াবার কথা বলছ!”

কলাবতী রীতিমতো ক্ষুব্ধ হয়ে খাবলা দিয়ে দই তুলে মুখে ভরল।

”একগাদা খাওয়াকে পারফরম্যান্স বলে না।” রাজশেখর ন্যাপকিনে গোঁফের দই মুছলেন। সন্দেশের প্লেটটা ছেলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ”গাওস্কর গাদাগাদা রান করেছে, কিন্তু সেভেন্টি ফাইভে মাদ্রাজে বিশ্বনাথের নট আউট নাইন্টিসেভেন অন এ ফায়ারি পিচ এগেনস্ট এ ডেডলি অ্যান্ডি রবার্টস, একেই বলে পারফরম্যান্স। এই এখন, সতু যেভাবে বেছে বেছে খাবার চুজ করল, পিক করল, এ তো বিশ্বনাথের ইনিংস। কী বিস্ময়ের সঙ্গে, ক্যাজুয়ালি অথচ কত প্রচণ্ডভাবে তন্দুরি চিকেনের শুধু পিছনের একটা ঠ্যাং ছিঁড়ে নিয়ে পরিচ্ছন্নভাবে খেল, যেন পারফেক্ট একটা বিশ্বনাথ—ফ্লিক টুয়ার্ডস মিড উইকেট। অফ স্টাম্পের ওপর আউটসুইঙ্গারটা নিখুঁত হিসেব কষে ছেড়ে দেওয়ার স্টাইলে রেজালার ঝোলটা কেমন ছেড়ে দিল। তপসে ভাজাটাকে তো লাস্ট মোমেন্ট পর্যন্ত দেখে নিয়ে ডেড ব্যাটে নামিয়ে দিল। নকুড়ের কড়াপাক মানে র‌্যাঙ্ক লংহপ। দ্যাখো কী এলিগ্যান্টলি পরপর দুটোকে ডেসপ্যাচ করল পয়েন্ট বাউন্ডারিতে।”

রাজশেখর যতক্ষণ ধরে তাকে পারফরম্যান্স বোঝাচ্ছিলেন, কলাবতী তার মধ্যেই গোটা ছয়েক সন্দেশ শেষ করে ফেলল, সত্যশেখরের লোলুপ চাহনি অগ্রাহ্য করে।

”সত্যি দাদু, কাকার স্টাইল, এলিগ্যান্স, ক্যাজুয়াল অ্যাপ্রোচ, এ সব কিছুরই তুলনা একমাত্র বিশ্বনাথ। আমি কিন্তু গাওস্করপন্থী। ভালো ব্যাটিং উইকেট পেলে গপাগপ রান তুলব।” চেয়ার থেকে উঠে হাত ধোবার জন্য বেসিনের দিকে যেতে—যেতে কলাবতী আর একটু যোগ করল, ”কিন্তু খিদে হওয়াটা যে হেলথেরই লক্ষণ এটাকে তোমার অস্বীকার করা উচিত হবে না।”

তখন রাজশেখর মুখ ফিরিয়ে দেখলেন তাঁর ছেলে তাকিয়ে আছে টেবলে ছড়ানো খালি পাত্রগুলোর দিকে। তার চাহনি ছলছলে, জিভটা ঠোঁটের উপর তুলির মতো বোলাচ্ছে, একটা ভারী দীর্ঘশ্বাস আটকে থাকায় মুখটা লাল।

”তোর এমন বিচক্ষণতা আগে কখনও দেখিনি সতু, কিপ আপ বয়, কিপ আপ।”

হাফভলিতে রসগোল্লা তুলবে আর মুখে ফেলবে

গোপীনাথ ঘোষের বড় মেয়ের বিয়ে। আটঘরা, বকদিঘির বহু লোককেই তিনি নিমন্ত্রণ করতে ইচ্ছুক, বিশেষত বাৎসরিক ক্রিকেট ম্যাচের খেলোয়াড় এবং আয়োজকদের। এই ম্যাচ উপলক্ষেই তো তাঁর আম্পায়ারিং সিদ্ধান্ত হৈচৈ ফেলে তাঁকে বিখ্যাত করে দিয়েছে। সুতরাং সবাইকে একসঙ্গে জড়ো করে আপ্যায়িত করার এই সুযোগটা তিনি হাতছাড়া করতে চান না।

রবিবারের সকালে তিনি এবং পুত্র দুলু, হাতে একগোছা নিমন্ত্রণপত্র আর ঠিকানা লেখা একটা ফর্দ নিয়ে গাড়িতে চেপে বেরিয়েছেন। একদিনেই সব সেরে ফেলবেন তাই প্রথমেই গাড়ির ট্যাঙ্ক পেট্রলে ভরে নিলেন। তাঁর হিসেব ছিল প্রতিটির জন্য আট মিনিট সময় দিয়ে একদিনে গড়ে পঁচাত্তরটি হিসেবে দুশো পঁচিশজনকে নিমন্ত্রণ তিনদিনে সারবেন। তারপর গাড়ি নিয়ে বেরোবেন দুলুর মা আত্মীয়স্বজনদের নিমন্ত্রণ করতে।

গোপী ঘোষ তেত্রিশতমটি পর্যন্ত গড় ঠিক রেখে বকদিঘির হরিশঙ্কর মুখুজ্যের কাছে গিয়ে স্টাম্পড হলেন। সেখানে আধঘণ্টারও বেশি সময় দিয়ে সোজা এলেন আটঘরার জমিদারবাড়িতে।

রাজশেখর তখন বাগানে বকুলগাছ তলায় টুলে বসে প্র্যাকটিস পিচ তৈরি করার তদারকিতে ব্যস্ত। দড়ি দিয়ে ঘিরে রাখা ১০×৬ ফুট জমি মুরারি কোদাল দিয়ে সকালেই কুপিয়েছে। এখন বলরাম কোপানো জমি থেকে অবাঞ্ছিত বস্তু বাছাইয়ের কাজে ব্যস্ত। রাজশেখরের তীক্ষ্ন নজর এই কাজের উপর। একটু দূরে দু’বালতি গোবর পড়ে রয়েছে।

”বলরাম, প্র্যাকটিস পিচ ইজ দ্য মোস্ট ভাইটাল থিং ইন দ্য মেকিং অফ এ ক্রিকেটার। এখান থেকেই ব্যাটসম্যান গড়ে ওঠে, পিচের বাউন্স যদি অসমান হয়, পিচে যদি একটা সর্ষেদানার মতোও কাঁকর থাকে…” রাজশেখর একটা অ্যাম্বাসাডারকে ফটক দিয়ে ঢুকতে দেখে কথা বন্ধ করলেন।

একটু পরেই মুরারি এসে গোপীনাথ ঘোষের আগমন বার্তা জানাল।

”বসিয়েছিস?…শরবত দে।”

মিনিট পাঁচেক বাদে রাজশেখর বৈঠকখানায় এলেন। গোপী ঘোষ আর দুলুর হাতে কাঁচা আমের শরবতের গ্লাস। সত্যশেখর কথা বলছে ওদের সঙ্গে।

”আরে গোপীবাবু যে, কী সৌভাগ্য আমার…বসুন বসুন…বোসো খোকা। তারপর?”

”আমার বড়মেয়ের বিয়ে এই সামনের আঠাশে, অনুগ্রহ করে আপনাকে পায়ের ধুলো দিতে হবে।” গোপী ঘোষ জোড়হাতে নিবেদন করলেন।

”কিন্তু বিয়েবাড়ি যাওয়া তো আমি অনেকদিনই বন্ধ করেছি।”

”বাবা, সেই কথাই তো আমি ওঁকে বলছিলাম যে, গত পঁচিশ বছর আপনি কোনো বিয়েবাড়িতে যাননি।”

”তা না যান, আমার মেয়ের বিয়েতে কিন্তু যেতেই হবে। এই তো একটু আগে হরিশঙ্করবাবুও বললেন তিনি কোথাও যান না। সবাই যদি না যান বলেন…মতি, নন্তু, পরমেশ ওইদিনই ওদের নেমন্তন্ন আত্মীয়বাড়িতে, কেউই আসতে পারছে না, হরিশঙ্করবাবুও…”

”কে? হরিশঙ্কর…হরি?”

”আজ্ঞে হ্যাঁ, বকদিঘির।”

”কতদিন যায় না বলেছে?”

”তা জিজ্ঞেস করিনি।”

”করে আসুন। খাওয়ার নেমন্তন্ন পেলে ওই পেটুকটা যাবে না আবার? বুঝলি সতু…”

এই সময় কলাবতী বৈঠকখানার পাশ দিয়ে বাড়ির ভিতরে যাচ্ছিল। দুলুকে দেখতে পেয়ে সে থমকে দাঁড়াল। তারপর ঘরে ঢুকে ”হাই” বলে সে কাকার পাশে বসল।

”সেই ম্যাচের পর এই প্রথম দেখা…সেদিন আমরা চলে আসার পরেই নাকি মাঠে খুব ঝঞ্ঝাট হয়েছিল?” কলাবতী জিজ্ঞাসা করল দুলুকে।

”ঝঞ্ঝাট তো বাধালে তুমিই। এমন প্যাঁচে ফেললে যে আমায় ম্যালেরিয়ার রুগি সেজে কাঁপতে হল সারাক্ষণ বকদিঘির লোকেদের দেখিয়ে। তার উপর লাঞ্চটাও খেতে পেলাম না। তিনদিন গায়ে ব্যথা ছিল শরীর কাঁপাতে গিয়ে।”

”সরি, ভেরি সরি। কিন্তু ড্রেসিংরুমে যে বেঞ্চে তুমি শুয়ে ছিলে তার তলায় একটা রসগোল্লার হাঁড়ি লাঞ্চের পর চুপিচুপি রেখে এলাম যে? তাতে তো গোটা পনেরো অন্তত ছিল।”

”মাত্র পনেরোটায় কিছু হয়?”

”কারেক্ট, ঠিক বলেছ ওইটুকু টুকু পিং পং বল সাইজের রসগোল্লায় কী হয়? সাইজ হবে এইরকম ডিউজ বলের মতো।” প্রবল উৎসাহে সত্যশেখর ডান হাতের তালু দিয়ে আকারটা বোঝাল। ”তাহলে ওভারবাউন্ডারি হাঁকিয়ে সুখ আছে। হাফভলিতে আঙুলে তুলবে আর টকাস করে মুখে ফেলবে।”

বিরাট হাঁ করে সত্যশেখর কাল্পনিক রসগোল্লাটা মুখের মধ্যে ফেলতে গিয়ে চোখাচোখি হল রাজশেখরের সঙ্গে। হাতটা ধীরে—ধীরে নেমে এল আর গলা দিয়ে অস্ফুট আর্তনাদের মতো বেরিয়ে এল, ”রসগোল্লা কিন্তু আমার একদমই ভালো লাগে না।”

”সিংগিমশাই, তাহলে আপনি কিন্তু আসছেন।”

”হরি শেষ পর্যন্ত কী বলল, আসবে?”

”জিজ্ঞেস করলেন কী কী আইটেম হবে। শুনে উনি সাজেস্ট করলেন ফুলকপির রোস্ট আর পেস্তার বরফি। কিন্তু আসবেন কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চয়তা দিতে পারলেন না। ওইদিনই আবার ওনার বন্ধুর নাতনির বিয়ে। সেখানে ওঁকে যেতে হবেই।”

”হরি আসবে। বছর চল্লিশ আগে জানি একরাতে তিন জায়গায় বিয়ের নেমন্তন্ন খেয়েছিল। বাজি ধরে বলতে পারি, হরি আপনার মেয়ের বিয়েতে খেতে আসবে।”

”তাহলে আপনি…”

”হরি আইটেম সাজেস্ট করবে আর আমি তাই খেতে যাব?”

”না না সে কী কথা!” গোপী ঘোষ জিভ কেটে শিউরে উঠলেন। ”আমি আটঘরার লোক, আমি কেন বকদিঘির সাজেশান মানতে যাব। তবে বকদিঘি তো আমার কনস্টিটিউয়েন্সির মধ্যেই তাই ভাবছি ফুলকপি রেখে রোস্ট বাদ দেব আর পেস্তা বাদ দিয়ে বরফি রাখব। ফুলকপির বরফি করা যায় কি না এ সম্বন্ধে হালুইকরের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ভাবছি নতুন একটা খাদ্য তৈরি করব।”

”আমি যাব কি না সে সম্পর্কে হরি কিছু বলল?”

”আবার সেই ছেঁদো কথা। বললেন, আটঘরা জোচ্চচুরি করে ম্যাচ জিতেছে। একজনের বদলে এমন একজন খেলেছে, টিমের লিস্টেই যার নাম নেই। পতু মুখুজ্যে নাকি কোর্টে যাবে।”

”প্রমাণ আছে?”

”ছবি তোলা আছে।”

”সে—ছবি দেখেছি। কালুর নাকটা ছাড়া আপনার ছেলের সঙ্গে ওর কোনো অমিল নেই।” রাজশেখর কলাবতীর মুখের দিকে চোখ সরু করে তাকালেন। কলাবতী নিজের নাক দু আঙুলে ধরে দুলুর পাশে গিয়ে বসল।

”আমারটা কি খুব লম্বা?”

সত্যশেখর নানান দিক থেকে দুজনের নাক পরীক্ষা করে মাথা নেড়ে বলল, ”প্রমাণ করা শক্ত।”

গোপী ঘোষ বললেন, ”আগে কোর্টে যাক তো, তারপর দেখা যাবে…তাহলে আপনারা, সতুবাবু কলাবতী সবাই আসছেন। …না না, কোনো আপত্তি শুনব না, আঠাশে বুধবার…আইটেমে রাজভোগ আছে, তবে ওটাকে ডিউজ বল সাইজের করতে বোধহয় অসুবিধে হবে না, হালুইকরের সঙ্গে একবার কথা বলব…আর ফুলকপির বরফিটা যদি করা যায়, একটা নতুন আবিষ্কার হবে…আটঘরার টুপিতে আর একটা নীল ফিতে!”

কলাবতী গাড়ি পর্যন্ত এল ওদের সঙ্গে। দুলুকে সে জিজ্ঞাসা করল, ”পরীক্ষা তো হয়ে গেল এখন কী করছ?”

”ম্যাজিক শিখছি।”

”ম্যাঅ্যাঅ্যা…জিক। দারুণ, কার কাছে, কোথায় শিখছ?”

”পাড়াতেই একজন বুড়ো লোক আছেন, অনেক রকমের ম্যাজিক জানেন।”

”আমার খুব ইচ্ছে করে শিখতে।”

”জিজ্ঞেস করব। যদি তোমাকে শেখাতে রাজি হন তো জানাব।”

”ঠিক?”

”ঠিক।”

ফাঁসির খাওয়া খাব

বাড়ির সামনের ফুটপাথ রঙিন কাপড়ে ঘিরে চেয়ার পেতে অভ্যাগত আর বরযাত্রীদের বসার ব্যবস্থা হয়েছে আর বাড়ির লাগোয়া খালি জমিটা তাদের খাওয়ানোর ব্যাপারে লেগেছে। বাড়ির রকে সানাই বসেছে।

নাতনিকে পাশে নিয়ে রাজশেখর ১৯২৮—এর ফোর্ড গাড়িটা চালিয়ে যখন পৌঁছলেন, তখন গিজগিজে ভিড়। বর এসে গেছে। তিনটে মিনিবাস রাস্তার মোড়ে। তাছাড়া গোটা পঁচিশ মোটর সার দিয়ে রাস্তার দুধারে। রাজশেখর তাঁর ফোর্ডকে কোথায় রাখবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। সামনে কোথাও রাখার স্থান না পেয়ে গাড়িটাকে পিছু হটিয়ে আনছিলেন কলাবতীর নির্দেশ অনুসরণ করে।

”দাদু, বড়দিদের গাড়ি।” কলাবতী গলা নামিয়ে চাপাস্বরে বলল।

”কই?”

রাজশেখর ব্রেক প্যাডেলে পা চাপলেন।

”ওপারে, সবশেষের সবুজ অ্যাম্বাসাডারটা।”

”ঠিক দেখেছিস, হরিরই তো?”

”হ্যাঁ ঠিক দেখেছি। বড়দি তো ওটাতেই রোজ স্কুলে আসেন।”

মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ফোর্ড এসে সবুজ অ্যাম্বাসাডারের পিছনে এমনভাবে দাঁড়াল যে, উভয়ের বাম্পারের মধ্যে দূরত্ব রইল ইঞ্চি—ছয়েক। সামনের স্টেশন ওয়াগনটা বা পিছনের ফোর্ড জায়গা না দিলে অ্যাম্বসাডার বেরোতে পারবে না।

”সতুর আজকেই কিনা মক্কেলদের দিয়ে গুজুর—গুজুর করার তাড়া পড়ল। একসঙ্গে এলে কত ভালো দেখাত।” গাড়ি থেকে নেমে লুটোনো কোঁচাটা বাঁ হাতের দু’ আঙুলে আলতো তুলে ধরে রাজশেখর কাঁধের মুগার চাদরটা ডান হাতে গুছিয়ে নিতে নিতে ক্ষুব্ধ কণ্ঠেই বললেন।

”কাকার এখন নাম হয়েছে, পসার হচ্ছে,” কলাবতী বিজ্ঞের মতো সান্ত্বনা দেবার স্বরে বলল, ”এখন ফাঁকি দেওয়াটা ঠিক হবে না।”

উপহারের জন্য শাড়ির বাক্সটা সে গাড়িতেই ফেলে রেখে নেমে পড়েছিল। রাজশেখর মনে করিয়ে দিতেই সে ”ইসস” বলে জিভ কাটল।

দু’জনে বিয়েরবাড়ির সামনে পৌঁছতেই গোপী ঘোষ এগিয়ে এলেন দুই কর জোড়া করে।

”আমার কী সৌভাগ্য, আপনি এলেন….এইমাত্র হরিশঙ্করবাবুও পৌঁছলেন আর এক জায়গায় নেমন্তন্ন সেরে….হেঁ হেঁ, ঠিকই আপনি বলেছিলেন…যাও মা, তুমি ভিতরে যাও, ওরে, দুলুকে ডাক। …আপনি এদিকের ঘরে এসে বসুন, ওদিকটা বরযাত্রীদের জন্য।”

রাজশেখরকে তিনি যে—ঘরে আনলেন, সেটি তাঁর আম দরবার। তাঁর বিধানসভা এলাকার লোকেদের সঙ্গে এই ঘরে দেখা করেন। ঘরের তিন দেয়াল ঘেঁষে লম্বা সোফা। একটা বিরাট টেবল। সোফায় বসে আছেন হাইকোর্টের এক জজ, খবরের কাগজের একজন সম্পাদক, আর হরিশঙ্কর।

”আয় রাজু, আয়।”

হরিশঙ্কর উৎফুল্লভাবে সোফায় তাঁর পাশের খালি জায়গাটা চাপড়ে বললেন। ঘরের সবাই গৌরবর্ণ দশাসই চেহারার দিকে তাকিয়ে রইল। তিনি হরিশঙ্করের পাশে গিয়ে বসলেন।

”একটা তো সেরে এলি, আবার এখানেও খাবি?”

”ভগবান একটা পেট দিয়েছেন, সেটার সেবা করতে হবে তো!”

”ভগবান সবাইকেই পেট দিয়েছেন, কিন্তু তাই বলে….”

এইভাবে দেখামাত্র দুজনে তর্ক বাধিয়ে যখন কথার পিঠে কথা চাপাতে লাগলেন, তখন দুলু কলাবতীকে পৌঁছে দিয়েছে কনের ঘরে। সাজগোজ করা মেয়েদের ভিড়ের মধ্যে ঘরের এককোণে বড়দিকে দেখে কলাবতী তো স্তম্ভিত। হেডমিস্ট্রেস মলয়া মুখার্জি যে এত সুন্দরী, সে এতদিন বুঝতে পারেনি।

বড়দির হাতছানিতে সে ভিড় কাটিয়ে পাশে গিয়ে বসল।

”কী দারুণ আপনাকে দেখাচ্ছে না!”

মলয়া বিব্রত এবং রক্তিম মুখ সামলাতে সামলাতে বলল, ”আচ্ছা আচ্ছা, তোমাকেও তো সুন্দর দেখাচ্ছে….কখন এলে, সবাই এসেছ?”

”এইমাত্র, দাদু আর আমি এসেছি।”

”শুধু দুজনে!”

কলাবতীর মনে হল, বড়দির মুখটা পলকের জন্য যেন হতাশ ম্লান দেখাল।

”কাকা চেম্বারের কাজ শেষ করেই আসবে, হয়তো ইতিমধ্যে এসেও গেছে।”

তার মনে হল, বড়দির মুখ এবার আগের থেকেও ঝকঝকে হয়ে উঠল।

”ওহ, তোমার কাকাও আসবে বুঝি?”

”তাই তো কথা আছে।”

ওরা দুজন যখন ঘরের মধ্যের প্রভূত সোনা, বেনারসি ও সুগন্ধী নির্যাসে ডুবে গিয়ে গলা নামিয়ে কথা বলছে তখন গোপী ঘোষের আমদরবারে রাজশেখর আর হরিশঙ্করের দিকে সারা ঘরের চোখ আর কান তটস্থ হয়ে নিবদ্ধ।

”খাওয়ার তুই কী বুঝিস? কচুরি আর রাধাবল্লভীর তফাত জানিস? মুলো—ছেঁচকি আর থোড়—ছেঁচকি খেতে দিলে বলতে পারবি কোনটে কী? ছানাবড়া আর কালোজামের কথা তো ছেড়েই দিলাম।”

রাজশেখর মিটমিটিয়ে হাসছিলেন আর শুনছিলেন। বললেন, ”সব জিনিস কি আর সবাই জানে, আইনের ব্যাপারে জজসাহেব যতটা জানবেন, কাকে খবর বলে সেই সম্পর্কে সম্পাদকমশাই যতটা জানেন, তুই—আমি কি ততটা জানব? ক্রিকেটের আমি কিছুই জানি না, তবু যতটা জানি, তুই তো তাও জানিস না। হ্যাঁ, রান্নার তুই কিছু—কিছু বুঝিস এটা আমি মানব, কিন্তু রান্না আর খাওয়া তো দুটো আলাদা ব্যাপার, একেবারেই এক জিনিস নয়। রেঁধে পাতে সাজিয়ে দেওয়া পর্যন্ত একটা পর্ব। তারপর শুরু হয় বাকি পর্ব। এই শেষেরটা সম্পর্কে তোর থেকে আমি ভালোই জানি। কচুরি—রাধাবল্লভীর মধ্যে তফাত জানতে একবার করে কামড় দিলেই তো জানা যাবে, সেজন্য কি গবেষণার দরকার হয়? রসগোল্লা আর রাজভোগের মতোই একটা হুক আর একটা পুলের মধ্যে তফাত বুঝতে কি মাথার চুল ছিঁড়তে হবে? চোখ থাকলেই বোঝা যায়।”

এই সময় দরজার কাছে সত্যশেখরকে হাসি মুখে উঁকি দিতে দেখা গেল। কিন্তু ঘরের মধ্যে টাকমাথা এবং আশু মুখুজ্যে—গোঁফ সম্বলিত জজসাহেবকে দেখেই সে জিভ কেটে শটকান দিল। রাজশেখর সঙ্গে সঙ্গে ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন। জজসাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ”এইমাত্র যে উঁকি দিল…ব্যারিস্টার সিনহা, গতকাল আমার বেঞ্চেই আর্গু করতে করতে অন্তত পাঁচবার আমাকে জিভ দেখিয়েছে।”

হরিশঙ্কর মুচকি হেসে চোখ টিপলেন রাজশেখরকে।

‘আপনি কিছু বলেননি?” হরিশঙ্কর খুবই ভালোমানুষী গলায় বললেন।

”নিশ্চয়। বলেছি ফারদার জিভ বার করলে আমার এজলাসে আর ঢুকতে দেব না।”

”তারপরও কি আর জিভ বেরিয়েছে ?” রাজশেখর গম্ভীরভাবে জানতে চাইলেন।

”না, তারপর এখানে এইমাত্র দেখলুম।”

”ব্যারিস্টার সিনহা এরই ছেলে।” হরিশঙ্কর ভিজে বেড়ালের মতো চোপসান স্বরে এবং মুখটি নিরীহ করে বললেন। রাজশেখর কটমটিয়ে তাঁর দিকে তাকালেন। জজসাহেব অপ্রতিভ হয়ে টাকে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ”ইয়ে, কিছু মনে করবেন না, আমি জানতাম না যে….”

”মনে করব কেন।” রাজশেখর ধমকের ধমকের মতো কণ্ঠে বললেন, ”ঠিকই বলেছেন ওকে, আমি হলে তো, তিনবারের পরই এজলাস থেকে বার করে দিতাম। …উফফ, কতদিন আমি এটাই ভয় করেছি যে, সতু এমন কাণ্ড করবে। ওর এই বদ অভ্যাসটা তৈরি করেছে তোর মেয়ে।”

”মলয়া!”

”নিশ্চয়। হাতে সব সময় ক্যামেরা, আর সতু জিভ বার করলেই ছবি তুলে নেয়। ছবি তোলাবার লোভ থেকে সতুর তাই জিভ বার করার অভ্যাসটা দাঁড়িয়ে গেছে।”

”তোর ছেলে তো সিংগি, তাহলে ষাঁড়েদের মতো স্বভাব কেন?”

”মানে?”

”ষাঁড়ের সামনে লাল কাপড় নাড়লেই খেপে যায়। তোর ছেলের সামনে ক্যামেরা ধরলেই…”

”কিনিয়ার সাফারি পার্কে আমি খুব কাছের থেকে সিংহদের ছবি তুলেছি, কিন্তু সিংহরা তো একবারও খেপে যায়নি!” খবরের কাগজের সম্পাদক বললেন।

”আফ্রিকার সিংহরা একরকম আটঘরার সিংহরা আর—একরকম।” হরিশঙ্কর বিনীত ভঙ্গিতে জানালেন, ”ওরা হরিণ খায়, শুওর খায়, জেব্রা খায়, আর এরা খায় কলা!”

”সিংহ খায় কলা!” ঘরের সবাই বিস্ময়ে একসঙ্গে বলে উঠলেন।

”ওঁকেই জিজ্ঞেস করুন। ক্রিকেট ম্যাচে বাজি ধরেছিল রসগোল্লা বা সন্দেশ নয়…কলা।”

রাজশেখর মুখ লাল করে নীরব রইলেন।

ঘরের অনেকেই মুচকি হাসলেন। এইসময় বাইরে সামান্য কোলাহল শোনা গেল। একব্যাচ খেয়ে উঠে বেরিয়েছে, সম্ভবত এরা বরযাত্রী। শামিয়ানা—ঘেরা বসার জায়গায় কন্যাপক্ষের লোকদের মধ্যে বকদিঘির বিষ্টু মিশির, ক্যাপ্টেন পতু মুখুজ্যে আর হরিশ কর্মকারকে দেখা যাচ্ছে। একটা ম্যাচে হরিশ এবং গোপী ঘোষ আম্পায়ার ছিল। তাই হরিশের নিমন্ত্রণ। মিশিরের স্টোরেজে গোপী ঘোষের খেতের আলু থাকে।

আটঘরার চণ্ডী কম্পাউন্ডার, পঞ্চায়েত—প্রধান পটল হালদার রয়েছে ওদের সামনের সারির চেয়ারে।

”পটলবাবু, এবারের ম্যাচে লাঞ্চের জন্য হাবু ময়রা নাকি মাত্র দু’ হাঁড়ি রসগোল্লা দিয়েছিল?”

পতু মুখুজ্জে কী বলতে চায়, তা বুঝতে না পেরে পটল হালদার সাবধান হয়ে গেল।

”দু হাঁড়ি কি দশ হাঁড়ি তাতে কী এসে যায়, সবাই পেটভরে তৃপ্তি করে খেয়েছে কি না, সেটাই বড় কথা।”

”তা তো ঠিকই, নিশ্চয়, আসলকথা হল তৃপ্তি। কিন্তু আমি শুনেছিলাম রসগোল্লা কম পড়ে গেছল? আর তাইতে নাকি আধপেটা সতু সিংগি রেগে বকদিঘির বোলারদের পিটিয়ে সেঞ্চুরি ভক্ষণ করে!”

”একদম বাজে কথা।” পটল হালদারের উত্তেজিত কনুই পাশে বসা আটঘরার মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান চণ্ডী কম্পাউন্ডারকে খোঁচা দিল। চণ্ডী তখন ব্যাকুল চোখে শামিয়ানার প্রবেশপথের ফাঁক দিয়ে খাওয়া দেখছিল। হঠাৎ পাঁজরে খোঁচা খেয়ে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ”রসগোল্লার সাইজটা বেশ ভালোই মনে হচ্ছে।”

”দূর মশাই রসগোল্লার সাইজ, পতুবাবু কী বললেন তা শুনেছেন?”

”শুনিনি মানে? রসগোল্লা কম খেলে রাগ হয়, আর তাহলেই সেঞ্চুরি ভক্ষণ করে রাগ মেটাতে হয়। তাই তো?”

এই সময় দেখা গেল সত্যশেখর কাঁচুমাচু মুখে কেমন জড়োসড়ো ভঙ্গিতে বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। ওকে দেখেই পটল হালদার উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে উঠল।

”সতুবাবু….এদিকে, এই যে, এখানে একবার আসুন তো।”

মনে হল সত্যশেখর এই আহ্বান শুনে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কোঁচাটা হাঁটু পর্যন্ত তুলে প্রায় ছুটে এল।

”আচ্ছা বলুন তো, আপনার সেঞ্চুরি করার পিছনে কীসের প্রেরণা ছিল?”

এমন একটা প্রশ্নের সামনে যে পড়তে হবে, সত্যশেখর তা ভাবেনি। ফ্যালফ্যাল করে সে সদাসংগ্রামশীল ও বিপ্লবী আটঘরা অঞ্চল সমিতির প্রধান পটল হালদারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

”আমার তো মনে হয় আটঘরার প্রগতিশীল মেহনতি মানুষের ঐক্য জোরদার করার জন্যই, তাদের বুর্জোয়া বিরোধী চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই আপনি ব্যাট হাতে দেখিয়ে দিয়েছেন কী করে শত্রুর মোকাবিলা করতে হয়। আর এর পিছনে ছিল আটঘরার জনগণের সমবেত শুভেচ্ছা ও শত্রুর প্রতি বৈপ্লবিক ঘৃণা, যা সংগ্রামের সঠিক পথে চালিত হবার জন্য মদত দিয়েছিল। ঠিক বলছি কিনা?”

সত্যশেখর মুহূর্ত বিলম্ব না করে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল।

”আপনার সেঞ্চুরি যে জনগণকে সঠিক পথ দেখাবে, এটা নিশ্চয় আপনি জানতেন?”

”নিশ্চয় জানতুম।”

”আপনার সেঞ্চুরি যে প্রতিক্রিয়াশীলদের কবর খুঁড়বে, তা নিশ্চয় আপনি জানতেন?”

”অবশ্যই জানতুম।”

”অথচ দেখুন এরা তথ্যকে বিকৃত করে প্রচার করছে আপনি নাকি বুর্জোয়া সংস্কৃতির অন্যতম ধারক যে রসগোল্লা, শোষক সম্প্রদায়ের লোভ দেখানোর বস্তু যে রসগোল্লা, তাই ভক্ষণ থেকে বঞ্চিত হয়ে নাকি সেদিন সেঞ্চুরি করেছিলেন, শত্রুকে প্রহার করে অতৃপ্তির শোধ নিয়েছিলেন?”

”হতে পারে।”

”সে কী, জনগণের প্রতি নিবিড় ভালোবাসা কি আপনার প্রেরণা ছিল না? আপনি কি বকদিঘির অপপ্রচারকে সমর্থন করবেন?”

”অ্যাঁ! বকদিঘি এই রকম কথা বলছে?” সত্যশেখর বিপন্ন হয়ে তাড়াতাড়ি যোগ করল, ”রসগোল্লা আমি যে মোটেই ভালোবাসি না, পতুবাবু আপনি কি তা জানেন না?”

”আমি কী করে জানব! আপনি উচ্ছে ভালোবাসেন না করলা ভালোবাসেন, তা কি আমার জানার কথা?”

এই সময় চণ্ডী কম্পাউন্ডার ঝুঁকে হরিশ কর্মকারকে বলল, ”লক্ষ করলি, সন্দেশের মতো কী একটা দুবার রিপিট করল, কিন্তু কেউ নিল না! শুঁকেই পাতে ফেলে রাখছে।”

”বোধহয় মিষ্টি বেশি হয়ে গেছে।”

”এটা উচ্ছে—করলার প্রশ্ন নয়, পতুবাবু।” অঞ্চল—প্রধান চোখ বুজে দু’হাত নাড়ল। ”আপনি রসগোল্লাকে প্রেরণা বলছেন, অথচ উনি রসগোল্লাই ভালোবাসেন না, খান না….দেখতে পর্যন্ত পারেন না। আপনি ভুল তথ্য দিয়ে আমাদের বিভ্রান্ত করছেন।”

”পটলদা, তুমি যে বলেছিলে সতুবাবুর সেঞ্চুরির জন্য সভা করবে, মিছিল করবে, শতরান—স্তম্ভ গড়বে, সে—সবের কী হল?” হরিশ সরল বোকাবোকা মুখ করে জানতে চাইল।

”হবে। সভা হবে, মিছিলও হবে। সতুবাবু ব্যস্ত মানুষ, সময় যেদিন দিতে পারবেন সেদিনই….” সত্যশেখরকে কিছু একটা বলার জন্য হাঁ করতে দেখেই পটল হালদার দ্রুত যোগ করল, ”জানি জানি আপনি কাজের লোক, তাই তো বিরক্ত করিনি।”

”পটলদা, স্তম্ভটা?”

”হাইট কতটা হবে তাই নিয়ে নিয়মিত আলোচনায় বসছি। আপাতত তিন ফুট থেকে চার ফুটে আমরা উঠেছি।”

বাড়ির ভিতর থেকে এই সময় একটা চিৎকার ভেসে এল ”আর দু’মিনিট পর মেয়েদের নামতে বলরে, পাত রেডি হচ্ছে।”

বিষ্টু আর চণ্ডী একসঙ্গে উঠে দাঁড়াল। পান চিবোতে চিবোতে লোকেরা বেরিয়ে আসছে।

”বেশ খাইয়েছে…..ফ্রাইটা জোর সাঁটিয়েছি।”

”আমি তেরোটার বেশি আর টানতে পারলুম না।”

”আরে মিহিদানাটা অত খাচ্ছিলিস কেন বোকা! সরভাজা আছে জানতিস না?”

”বিরিয়ানিটাই বেস্ট….কী একটা বরফি বলে দিল, মাগো, যা বোঁটকা গন্ধ! অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসছিল।”

শুনতে শুনতে চণ্ডীর চোখমুখ কখনও উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল, কখনও চুপসে যাচ্ছিল। কাতর স্বরে সে বলল, ”পটলদা, পেটের মধ্যে খিদের স্তম্ভটা যে দশ ফুট ছাড়িয়ে গেছে। এবার তো দেখছি মেয়েরা বসবে…ভেতরে গিয়ে হালচাল বুঝে এসো না।”

বিষ্টু বলল, ”তুমি হলে গিয়ে অঞ্চল—প্রধান, দেখবে না আমাদের? হলামই বা আমরা বকদিঘির।”

পতু মুখুজ্যের পাকস্থলিতেও মোচড় দিচ্ছে। সে গাম্ভীর্য বজায় রেখে উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে বলল, ”যাদের ট্রেন ধরতে হবে, তাদের আগে ছেড়ে দেওয়া উচিত।”

পটল হালদার আমতা—আমতা করে বলল, ”কিন্তু আমি তো কাউকে দেখতে পাচ্ছি না….”

”বাড়ির ভেতরে যান। গোপীবাবু ভেতরে আছেন আর তিনি তো আপনাকে বিলক্ষণই চেনেন।” পতু মুখুজ্যে সেকেন্ড স্লিপকে থার্ডম্যানে যেতে বলার মতো বাড়ির দরজার দিকে আঙুল দেখাল।

পটল হালদার গুটিগুটি এগোল। তখন সত্যশেখর খপ করে তার হাত টেনে ধরে বলল, ”ঢুকেই বাঁ দিকের ঘরে বাবা, হরিকাকা বসে আছেন। দেখবেন ফর্সা, টেকো, গুঁপো, একটা প্যাঁচামুখো লোকও আছে। লোকটা কখন বিদেয় হবে সেটা কায়দা করে জেনে আসতে হবে, পারবেন?”

”হেঁ হেঁ হেঁ, কায়দাই যদি না জানি, তা হলে কি অঞ্চল প্রধান হতে পারতুম। নিশ্চিন্ত থাকুন, দু’ মিনিটে খাওয়ার ব্যবস্থা আর আপনার খবর…”

সত্যশেখর তাকিয়ে রইল পটল হালদার বাঁ দিকের ঘরটায় না ঢোকা পর্যন্ত। তখন দোতলা থেকে মেয়েরা আর বাচ্চচারা কলকল করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। কে চেঁচিয়ে বলে উঠল, ”এখনও রেডি হয়নি…একটু অপেক্ষা করুন, আর দু’ মিনিট।”

দুলু এবং ক্যামেরা হাতে একটি ছেলের সঙ্গে কলাবতী গল্প করতে করতে নামছিল। দূরে কাকাকে দেখে সে মুখের কাছে গরাস ধরে ইশারায় জানতে চাইল খাওয়া হয়েছে কি না। পেটে হাত রেখে সত্যশেখরের বিষণ্ণ মাথা নাড়া দেখে কলাবতী পিছনে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ”বড়দি, এখনও কাকার খাওয়া হয়নি।”

”এসেছেন বুঝি?”

”হ্যাঁ। মনে হচ্ছে খুবই কষ্ট পাচ্ছে। দাদুর ডায়েট চার্টের এফেক্ট শুরু হয়ে গেছে। আজকাল যা খিদে পায় না কী বলব!”

”এই যে বললে লুকিয়ে লুকিয়ে তোমরা খাও।”

”খেলেই বা! ইদানীং দাদুর কেমন যেন সন্দেহ হয়েছে আমরা ডায়েট চার্ট ফলো করছি না। মুরারিদাকে প্রায় সাসপেন্ড করে রেখেছেন। বাড়ির বাইরে এক পা—ও যেতে দেন না। বলরাম দোকান—বাজার করে। দাদু নিজের হাতে এখন আমাদের ভোর থেকে রাত পর্যন্ত সামনে বসে খাওয়ান…উফফ বড়দি, সে যে কী ভীষণ, বোঝাতে পারব না! এখন রাক্ষসের মতো খিদে হয়েছে, কাকার তো আরও বেশি! আজই বলছিল, ফাঁসির খাওয়া খাব।”

সিঁড়ির মুখে ভিড় জমে গেছে। পাশের ঘরে দাদুকে দেখতে পেয়ে কলাবতী বড়দিকে বলল, ”ভিতরে যাবেন?”

মলয়া একটু ইতস্তত করে বলল, ”বড্ড গরম লাগছে, আমি বাইরেই থাকি, তুমি দেখা করে এসো বরং।”

কলাবতী তখন দুলু আর তার ক্যামেরা—হাতে বন্ধুটিকে বলল, ”চলো মজার ব্যাপার দেখবে, দুই বুড়োর ঝগড়া!”

”মজা!” দুলু অবাক হয়ে ঘরের ভিতরে তাকিয়ে বলল, ”জীবনে এই প্রথম বাবাকে ধমক খেতে দেখছি, ওই দ্যাখো।”

ফুলকপির বরফি সেম অ্যাজ লেগ গ্লান্স

ওরা তিনজন ঘরের মধ্যে ঢুকে একধারে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়াল। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ বহুবার ঝলসাল, কিন্তু ঘরের কেউ তাতে ভ্রূক্ষেপ করল না।

”বলেন কী, আমার অ্যাডভাইস আপনি নিলেন না?” হরিশঙ্করের গর্জনে গোপী ঘোষ আর—একটু কুঁকড়ে গেলেন। ”ফুলকপির রোস্ট আর পেস্তার বরফি করেননি?”

”ভাবলুম নতুন একটা কিছু করি, তাই দুটো থেকে আধখানা করে মানে রোস্ট আর পোস্তাটা বাদ দিয়ে করেছি ফুলকপি বরফি….অসাধারণ, নতুন ব্যাপার। ষাট ঘণ্টা ফুলকপিগুলো ভিজিয়েছি পোস্তবাটা জলে। ধুয়ে নিয়ে মাখিয়েছি গোলমরিচ, হিং আর আদা; এগারো ঘণ্টা ধুয়ে সেদ্ধ করে চটকে মাখন মাখিয়ে ছ’ঘণ্টা উনুনে শুধু পাক হয়েছে। তারপর খোয়া ক্ষীর, ছানা, কাঁচা আলু বাটার সঙ্গে মিশিয়ে আবার পাক। তারপর চিনেবাদাম বাটা, চিঁড়ে বাটা….।”

”থাক থাক আর বলতে হবে না।” দু’ হাত মাথার উপর তুললেন হরিশঙ্কর।

”এটা আটঘরার একটা আবিষ্কার।” রাজশেখর উদাসীন ভঙ্গিতে প্রথম জজসাহেবের দিকে তাকিয়ে কথাটা শুরু করে মুখটা সম্পাদকের দিকে ফিরিয়ে ”এডিটোরিয়ালের জন্য ভালো সাবজেক্ট” বলে শেষ করলেন।

”আটঘরার আবিষ্কার মানে তো অখাদ্য। ইসস, পেস্তার বরফিটাই খাব বলে বন্ধুর বাড়িতে কিছুই খেলাম না, শুধু আটটা ফ্রাই আর গোটা দশেক কড়াপাক…ওহ, কী ভুলই করেছি!” হরিশঙ্কর কপালে করাঘাত করার জন্য হাত তুলেই নামিয়ে নিলেন পটল হালদারকে দেখে।

”গোপীবাবু,” পটল পিছন থেকে ঝুঁকে গোপী ঘোষের কানে ফিসফিসিয়ে বলল। হরিশঙ্করের ক্রোধ—গর্জনে গোপী ঘোষ নার্ভাস হয়ে পড়েছেন। চমকে পিছন ফিরে পটলকে দেখেই রেগে উঠলেন।

”গোপীবাবু কী করবে? এ ঘরে অঞ্চল—প্রধানের কী দরকার? অ্যাঁ….এখানে শ্রেণীসংগ্রাম চলবে না বলছি।”

”আজ্ঞে সংগ্রাম নয়, আমাদের খিদে পেয়েছে।”

”পেয়েছে তো বসে পড়ুন।”

পটল হালদার বসার জায়গার জন্য এধার—ওধার তাকাতে লাগল। জজসাহেবের পাশের খালি জায়গাটুকু নজরে পড়তেই সে এগিয়ে এসে ‘একটু সরুন তো’ বলেই জজের পাঞ্জাবির হাতা চটকে, লোটানো ধুতির কোঁচা মাড়িয়ে সোফায় বসল।

জজসাহেবের গোঁফের ফাঁক থেকে কোলাব্যাঙ ডাকার মতো একটা শব্দ বেরিয়ে এল। পটল হালদার লজ্জিত হয়ে বলল, ”মাপ করবেন….আমি দেখতে পাইনি, ক্ষমা চাইছি।”

”দেখতে পাননি? কী নাম আপনার?”

”পটল হালদার।”

”কী করেন।”

”আটঘরা অঞ্চল সমিতির প্রধান। …আপনি?” বিনীতভাবে পটল জানতে চাইল।

”আমি হাইকোর্টের একজন বিচারপতি।”

”অ।” বলেই পাঁচ সেকেন্ড পর পটল হালদার স্প্রিংয়ের মতো সিধে হয়ে বসল। ”তাই বলুন! আপনিই সেই জজ, যার কথা সতুবাবু বলে দিলেন।”

”কে সতুবাবু? কী বলেছেন?”

”সত্যশেখর সিংহ, চেনেন না? আপনাদের হাইকোর্টেরই তো ব্যারিস্টার। ….আহা, কী ব্যাটটাই না এবার করলেন। শতরান—স্তম্ভ আমি তুলবই, স্যার আপনাকে গিয়ে উদ্বোধন করতে হবে…না না, কোনো কথা শুনব না….আটঘরার জনগণ আপনাকে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে।” পটল হালদার জজসাহেবের ঊরুতে দু’হাতের তালু রেখে মিনতি জানাল।

”উহুহু, করছেন কী?”

”আপনাকে যেতেই হবে। আমার প্রধানত্বে আটঘরায় কিনা হাইকোর্টের জজ! ….উহহ, ভাবতে পারেন কতবড় প্রাপ্তি হবে সেটা?”

দুই তালু দিয়ে এবার সে ঊরু খামচে ধরল। জজসাহেব রেগে হাতদুটো সরিয়ে দিলেন।

”আপনি বড্ড বেয়াড়া লোক তো!”

”যেতেই হবে। নইলে হাইকোর্টে মিছিল আনব, ধর্না দেব, ঘেরাও করব।”

”তিনমাসের জন্য তাহলে চালান করব।”

”মানে?”

”মানে ঘানি ঘোরাবার ব্যবস্থা করব। ….হাত সরান।”

পটল হালদার মাথাটা কাত করে সরু চোখে আট সেকেন্ড জজসাহেবের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ”আপনি কেমন বিচারপতি, মশাই, জনগণের ইচ্ছাকে….সতুবাবু দেখছি ঠিকই বলেছিল, আপনি প্যাঁচামুখোই বটে।”

”কে, কে, কে বলেছে।”

ঘরের অন্যদিকে তখন হরিশঙ্করের মুখের কাছে মুখ এনে রাজশেখর দাঁত চেপে গজরালেন, ”আটঘরার আবিষ্কার অখাদ্য? আবিষ্কার কথাটার মানে জানিস? আবিষ্কার হচ্ছে নতুন জিনিস, ইনভেনশন, যা আগে কখনও পৃথিবীতে ছিল না….সুইং বোলিং আর গুগলি কী করে খেলতে হয়, প্রথম দেখাল জ্যাক হবস, লেগ গ্লান্স প্রথম দেখাল রঞ্জি, একেই বলে আবিষ্কার। আটঘরার ফুলকপির বরফিও সেম অ্যাজ লেগ গ্লান্স….লোকের পাতে পড়বে আর গণ্ডায় গণ্ডায় বাউন্ডারি পেরিয়ে যাবে। গোপীবাবু, গোটাকতক হরিকে এনে দিন তো।”

”এখুনি মেয়েদের ব্যাচ বসবে, একেবারে সেখানেই তো….”

”না না, মেয়েদের সঙ্গে বসে নয়। এখানে এখুনি ওকে দিন। আটঘরার আবিষ্কার অখাদ্য কি না সেটা জজসাহেব রয়েছেন, এডিটার রয়েছেন, ওঁদের সামনেই প্রমাণ হয়ে যাক।”

”হ্যাঁ, এঁদের থেকে যোগ্য ব্যক্তি….হাইকোর্টের জজ, কাগজের এডিটার….আর কে হতে পারেন?” পটল হালদার ছিলে—ছেঁড়া ধনুকের মতো দাঁড়িয়ে উঠল। ”যদি হরিশঙ্করবাবু বলেন অখাদ্য, তাহলে এনারা চেখে দেখবেন। এনারা যদি বলেন সুস্বাদু, তাহলে আমি কথা দিচ্ছি, আটঘরা অঞ্চল সমিতি তার এলাকার প্রতিটি মেহনতি মানুষকে এক কেজি করে এই আবিষ্কার উপহার দেবে এবং সেই উপহার—অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন…” পটল মুখ নামিয়ে বলল, ”স্যার অনুষ্ঠানে আপনাকে যেতেই হবে…না না, আর আপত্তি করবেন না, এবার রাজি হয়ে যান।”

”আগে তাহলে বলুন, আমাকে প্যাঁচামুখো কে বলেছে?”

পটল হালদার ফ্যাকাসে বিব্রত মুখে গোপী ঘোষের দিকে তাকিয়ে দেখল তিনি দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন, কলাবতীরা হাসি চাপছে, রাজশেখর ব্যস্ত হয়ে সম্পাদকের দিকে ঝুঁকে আফ্রিকার সিংহদের কেশর গির—সিংহদের থেকে ঝাঁকড়া কিনা জানতে চাইলেন।

হরিশঙ্কর নখ খুঁটতে খুঁটতে আনমনে বললেন, ”পটলবাবু তখন যেন সতুর নাম বললেন বলে মনে হল।”

”সতু কে? ডাকুন তো তাকে।” জজসাহেবের কণ্ঠে এজলাসের স্বর ফুটে উঠল।

হরিশঙ্কর টিপ্পনী কাটলেন, ”আসবে কি?”

”সতু আমার ছেলে, একটু আগেই তাকে দেখেছেন।” রাজশেখর কেশর—ফোলানো সিংহের মতো তেজি ভঙ্গিতে হরিশঙ্করের দিকে তাকালেন। ”নিশ্চয় সে আসবে, সিংগিবাড়ির ছেলে যখন, ভয় পাবে কেন…কালু, ডেকে আন তো কাকাকে।”

সেই সময় বাইরে থেকে শোনা গেল : ”দুটো পাত খালি রয়েছে, আর—কেউ থাকেন তো পাঠিয়ে দাও।”

তাই শুনে বিষ্টু আর চণ্ডী একসঙ্গে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। দুজনের চোখ হরিশ অর পতু মুখুজ্যের উপর। কী দেখল কে জানে, ওরা দুজন আবার ধীরে—ধীরে চেয়ারে বসে পড়ল।

”মাত্র দুটো পাত।”

”আমরা চারজন।”

”পটলদা সেই যে গেল!”

উদ্বোধন ভক্ষণ সেঞ্চুরি দিয়ে

ঘরের মধ্যে তখন ঘোর উত্তেজনা। কাগজের রেকাবিতে মাখা—ময়দার মতো দেখতে হরতন—আকৃতির পাতলা কয়েকখণ্ড বরফি নিয়ে গোপী ঘোষ দাঁড়িয়ে। মুখে গদগদ ভাব। হরিশঙ্কর দুই আঙুলে চিমটের মতো একটি বরফি সন্তর্পণে তুলে নাকের কাছে এনেই মুখ বিকৃতি করলেন। কয়েক সেকেন্ড রাজশেখরের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার শুঁকলেন। ঘরের সবাই প্রবল উৎকণ্ঠায় তাঁর মুখভাব লক্ষ করে যাচ্ছে। হরিশঙ্করের নাক কুঁচকে রয়েছে, শরীর যেন ঘোলাচ্ছে।

”হরিবাবু তো বিরোধী পক্ষ, ওনার কাছে আটঘরার আবিষ্কার তো খারাপ লাগবেই।”

পটল হালদার তার সুবিজ্ঞ সিদ্ধান্ত পেশ করে মিটিমিটি হাসতে লাগল।

”তা বটে। নিরপেক্ষ কারুর মতামতই এক্ষেত্রে গ্রাহ্য হওয়া উচিত, কী বলেন জজসাহেব?” সম্পাদক বললেন।

”তার আর দরকার হবে না।” ফুলকপির বরফি খুবই পরিতোষের সঙ্গে চিবোতে চিবোতে হরিশঙ্কর জানালেন। ”অসাধারণ, সত্যিই আবিষ্কার! নেহাত একটা নেমন্তন্ন খেয়ে এখানে এসেছি, নইলে…” হরিশঙ্কর কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আবার বললেন, ”….নইলে এখুনি খাওয়ার সেঞ্চুরি করে দিতাম। অদ্ভুত জিনিস, সত্যিই একটা আবিষ্কার।”

”সেঞ্চুরি করা সোজা ব্যাপার নয় হরিশঙ্করবাবু, সেজন্য প্রেরণা চাই…চাই জনগণের শুভেচ্ছা। সতুবাবুর সেঞ্চুরির পিছনে আছে জনগণকে সঠিক পথ দেখাবার ইচ্ছা।”

”তাহলেই সেঞ্চুরি করা যাবে?” জজসাহেব কৌতূহলী হয়ে উঠলেন।

”নিশ্চয় যাবে। বকদিঘি থেকে রটনা হচ্ছে, লাঞ্চে রসগোল্লা খেতে না পেরে সতুবাবু নাকি সেই রাগে বেধড়ক ব্যাট চালিয়ে সেঞ্চুরি করেছেন…..এটা কি একটা যুক্তি হল?”

”রাগটা নিশ্চয় খুব মহান ছিল!” তির্যক মন্তব্য করলেন হরিশঙ্কর।

”খিদের চোটে মানুষ অবশ্য অনেক কিছু অবিশ্বাস্য কাজ করে ফেলে।” সম্পাদক টীকা যোগ করলেন।

”পৃথিবীতে বিপ্লবের জন্মই তো খিদে থেকে।” পটল হালদারের কণ্ঠ থেকে দৃপ্ত শব্দগুলি বেরিয়ে আসতে না আসতেই দরজার কাছ থেকে কাতর স্বর ভেসে এল, ”পটলদা!”

সবাই চমকে উঠে দেখল চারটি লোক বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে। তাদের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে আর—একটি ভীত মুখ। পটল হালদার হাত তুলে তাদের অপেক্ষা করতে বলল।

”বাবা, তুমি ডাকছ আমায়?” জড়োসড়ো সত্যশেখরের ক্ষীণ স্বর ঘরে ভেসে এল।

”এখানে এসো।” সিংহ—গর্জনে আহ্বান গেল।

মেঝেয় চোখ রেখে সত্যশেখর এগিয়ে এল রাজশেখরের সামনে। তার পিছনে কলাবতী এবং মলয়া।

”জজসাহেবকে জিভ দেখিয়েছিলে আর্গু করার সময়?”

সত্যশেখর মাথা হেঁট করে রইল। রাজশেখর কড়া চোখে মলয়ার দিকে তাকালেন। ”সঙ্গে ক্যামেরা এনেছ নাকি?”

বিভ্রান্ত মলয়া মাথা নেড়ে বলল, ”না তো!”

”জজসাহেবকে প্যাঁচামুখে বলেছ?”

চমকে পটল হালদারের দিকে তাকাল সত্যশেখর।

পটল কুঁকড়ে গেল। পাংশু মুখটা ফিরিয়ে সে দরজায় দাঁড়ানো চারজনের দিকে অসহায় চোখ রাখল।

”হ্যাঁ।” সত্যশেখর ঢোঁক গিলে কাঁদোকাঁদো মুখে জজসাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল।

রাজশেখর গর্বভরে হরিশঙ্করের দিকে এমনভাবে ভ্রূ তুললেন যেন বলতে চান, একেই বলে সিংহ।

”কিন্তু জজসাহেবের মোটেই প্যাঁচার মতো মুখ নয়। এখনও ওনাকে বাংলা ফিল্মের নায়কের ভূমিকায় নামানো যায়। তোমার অবজার্ভেশন যে এত খারাপ, আমি জানতুম না। কী করে যে আইন নিয়ে….যাক গে, জজসাহেব, আপনি যা শাস্তি দিতে চান দিন।”

জজসাহেব বিমূঢ় হয়ে আমতা—আমতা শুরু করলেন। ব্যাপারটা যে এই পর্যায়ে আসবে বুঝতে পারেননি। রুমালে ঘনঘন মুখ মুছতে লাগলেন।

গলা খাঁকারি দিয়ে হরিশঙ্কর বললেন, ”শাস্তি কেন? এই সত্যবাদিতার জন্য সত্যশেখরকে তো তারিফ করা উচিত।”

”ঠিক, ঠিক।” জজসাহেব যেন অকূলে কূল পেলেন। ”শাস্তি নয়, বরং অভিনন্দন জানানোই ভালো।”

”মানপত্র দেওয়া যেতে পারে।” পটল হালদারের মুখে স্বাভাবিক রঙ ও কণ্ঠস্বরের উদ্দীপনা ফিরে এসেছে।

”আটঘরা—বকদিঘি বাৎসরিক ক্রিকেট ম্যাচ এতবছর ধরে চলছে। কিন্তু সত্যশেখর ছাড়া কেউই আজ পর্যন্ত সেঞ্চুরি করতে পারেনি।” হরিশঙ্কর যেন বকদিঘির নয়, আটঘরার লোক, এমনভাবে কথাগুলো বললেন। ”আমার মনে হয় এই প্রথম এবং একমাত্র কৃতিত্বকে যথার্থ সম্মান দেওয়া হবে যদি আটঘরার আবিষ্কার ফুলকপির বরফি দিয়ে প্রথম সেঞ্চুরি করার সুযোগটাও সত্যশেখরকে দেওয়া হয়। এই সুস্বাদু আবিষ্কারের জন্য ব্যাপক পাবলিসিটিও তো দরকার।” সম্পাদকের দিকে তাকিয়ে হরিশঙ্কর মাথা দোলালেন। সম্পাদকের মাথাও দুলে উঠল সায় দিয়ে, ”নিশ্চয় নিশ্চয়, স্পেশাল স্টোরি করা উচিত।”

”আমাদের কিন্তু খুব খিদে পেয়েছে।” দরজার কাছ থেকে কথাগুলো ভেসে এল।

”পাক। আর—একটা সংগ্রাম সামনে, আটঘরার আবিষ্কারের উদ্বোধন—ভক্ষণ হবে সেঞ্চুরি দিয়ে আর সতুবাবুর থেকে সুযোগ্য কেই বা আছেন এই কাজের জন্য? ….উফফ, দু’দুটো স্তম্ভ গড়তে হবে…স্যার, আপনাকে কিন্তু দুটোরই…না না, কোনো আপত্তি শুনব না।”

সত্যশেখর বলল, ”বাবা, এসব খাওয়া কি উচিত হবে? ডায়াট চার্টে তো বরফি নেই!”

রাজশেখর একটু ভেবে গম্ভীর হয়ে বললেন, ”আটঘরা বা সিংগিবাড়িরই নয়, তোমার নিজের সম্মানও বিপন্ন। জিভ দেখিয়ে, প্যাঁচামুখো বলে যে গোলমাল পাকিয়েছ, তাতে সেঞ্চুরি না করলে…” হরিশঙ্করের দিকে তাকিয়ে কথা শেষ করলেন, ”মুখ দেখানো যাবে না।”

”আমি কি বরফি এখানেই আনতে বলব?” গোপী ঘোষ জজসাহেবকেই প্রশ্ন করলেন।

”তাই বলুন।”

চিরেতা, ত্রিফলা, থানকুনি হল গিয়ে নেট প্র্যাকটিস

সত্যশেখরের মুখ ইতোমধ্যে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। শুধু তাই নয়, একটু ঔজ্জ্বল্যও যেন ফুটে উঠেছে। ঘাড় ফিরিয়ে কলাবতীর দিকে তাকাল, তারপর মলয়ার দিকে। তখন জিভটা ঠোঁটের বাইরে একটু বেরিয়ে এসেছিল। জজসাহেব সেটা লক্ষ করে গম্ভীর হলেন।

”পটলদা, উনি একা—একা সেঞ্চুরি করবেন কী করে?” হরিশ মরিয়া হয়ে শেষ চেষ্টা করল। ”বল করবে কে? ফিল্ড করবে কে? নো—বল কিংবা ওয়াইড হলে ডাকবে কে? অন্তত জনাচারেক যদি মাঠে না থাকে…।”

”ঠিক কথা, তোমরাও তাহলে সতুর সঙ্গে নেমে পড়ো।” রাজশেখর চারজনকে ঘরের মধ্যে আসার জন্য হাত নাড়লেন।

”ব্যাট তো দুজনে করবে, তাহলে আর একজন….?” জজসাহেব সারা ঘরে চোখ বোলালেন।

”আমি হব কাকার পার্টনার।” কলাবতী এগিয়ে এল।

”আসল লোককেই ঠিক করা হল না, স্কোরার, গুনবে কে?”

মিনিট কয়েক বাদানুবাদ চলল। অবশেষে মলয়া বলল, ”আমি স্কোরার হব। স্কুলে অঙ্কের টিচার না এলে আমিই ক্লাস নিই, যোগ—বিয়োগে কোনো অসুবিধা হয় না। অবশ্য কেউ যদি আপত্তি তোলেন…।” মলয়া কথা শেষ করল সত্যশেখরের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে।

মলয়াই স্কোরার নিযুক্ত হল পটল হালদারের আপত্তি সত্ত্বেও, কেননা জজসাহেব বা সম্পাদক ছাড়া রাজশেখরও মলয়ার পক্ষে সায় দেন।

কলাবতী ফিসফিস করে বলল, ”কাকা, বড়দিকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে।”

সত্যশেখর একটু গলা চড়িয়ে বলল, ”সিংগিদের জব্দ করার ব্যবস্থা হলেই কেউ কেউ সুন্দর হয়ে যায় মজা দেখব বলে। কিন্তু শেষপর্যন্ত তা দেখতে দেব না।”

হঠাৎ সারা ঘরে একটা হালকা কিম্ভূত ধরনের দুর্গন্ধের সঞ্চার হল। গোপী ঘোষ ঘরে ঢুকলেন, তার পিছনে দুটি লোকের কাঁধে ট্রে ভর্তি বরফি। ট্রে দুটি তারা টেবলে রেখে চলে গেল। সারা ঘরের চোখ ট্রের উপর।

”গন্ধ কীসের?” জজসাহেব রুমাল দিয়ে নাক মুছলেন।

”আজ্ঞে, গোলাপজলের।” গোপী ঘোষ একগাল হাসলেন।

”উঁহু।” সম্পাদক পকেট থেকে রুমাল বার করলেন। ”শুধু গোলাপজল নয়, আরও কিছু যেন….বলুন তো কীসের?” প্রশ্নটা জজসাহেবকে।

”বোকা পাঁঠার।”

”তাই কি?” সম্পাদক পতু মুখুজ্যের দিকে তাকালেন।

”মনে হচ্ছে গোবর—পচানো সারের।”

পটল নড়ে—চড়ে বসল। ডান হাতের মুঠি এক গজ উপর থেকে নামিয়ে বাম তালুতে সশব্দে রাখল। ”এসব অপপ্রচার। আমি তো গোলাপজলের ছাড়া অন্য কোনো গন্ধ পাচ্ছি না।”

”কিন্তু জজসাহেব পেয়েছেন।” পতু হুঙ্কার দিল। পটলের মুখ শুকিয়ে গেল।

”বোধহয় একটু ভেপসে গন্ধ হয়েছে।” গোপী ঘোষ কাঁচুমাচু হয়ে জানালেন।

”আমি দেখেছি, কেউ খাচ্ছিল না….সবাই পাতে ফেলে রাখছিল।” চণ্ডী কম্পাউন্ডার একটা গূঢ় রহস্য ফাঁস করার মতো ফিসফিস স্বরে বলল।

”চঅন…ডী।” পটল হালদার দাঁতে দাঁত চেপে ক্রোধ সংবরণ করল। ”মনে রাখিস, তুই আটঘরার লোক….এটা আটঘরার আবিষ্কার।”

চণ্ডীর ফ্যাকাসে মুখে ভয় ছড়িয়ে গেল। বিভ্রান্তের মতো বলল, ”আমি তো….আমি তো বলিনি বরফি খাচ্ছিল না। নিশ্চয় খেয়েছে, আলবাত খেয়েছে।”

হরিশঙ্কর মুচকি হেসে বললেন, ”চণ্ডী হয়তো ভুল দেখেছে। আলবাত খেয়েছে, রাজু তো বলল রান্না এক জিনিস আর খাওয়া আর—এক জিনিস। রান্নার পর্ব তো হয়েই গেছে, এবার খাওয়ার পর্ব আমরা দেখব। সবাই তো শুনেছেনই রাজু বলছে এটা আবিষ্কার, এডিটোরিয়াল লেখার সাবজেক্ট! ভালো কথা। খাওয়ার ব্যাপারটা নাকি সিংগিরাই ভালো বোঝে! হবেও বা। এখুনি তা প্রমাণ হয়ে যাবে।”

কথাটা কীভাবে যেন ছড়িয়ে পড়েছিল। দরজার কাছে ভিড়, ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে গেছে। জানালা ভরে গেছে উঁকি—দেওয়া মুখে। যারা পরিবেশন করছিল, তাদের কয়েকজনকে ভিড়ের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। দুলু দু’হাত ছড়িয়ে ভিড় ঠেলতে—ঠেলতে বলল, ”আপনারা কেউ ঘরের মধ্যে ঢুকবেন না, তাহলে কনসেন্ট্রেশন নষ্ট হয়ে যাবে।”

দুলুর বন্ধু ইতোমধ্যে কয়েকটা ছবি তুলে ফেলেছে। টেবলের ধারে কলাবতী আর সত্যশেখর দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে কথা বলছে।

”কাকা, পারবে তো?”

ঠোঁট বেঁকিয়ে সত্যশেখর তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। ”কালমেঘের থেকেও খারাপ লাগবে কি? গ্যাঁদাল পাতা, ব্রাহ্মী শাক, চিরেতা, ত্রিফলা, থানকুনি…এই সব হল গিয়ে নেট প্র্যাকটিস। তুই শুধু মেডেন ওভার দিয়ে যাবি আর নজর রাখবি মলয়ার দিকে, মনে হচ্ছে স্কোরে গোলমাল করবে।”

”সাইলেন্স….সাইলেন্স।” জজসাহেবের প্রচণ্ড স্বর গমগম করে উঠতেই ঘরটা স্তব্ধ হয়ে গেল। ”হরিশঙ্করবাবুকে অনুরোধ করছি, এই ভক্ষণ—ম্যাচের রুলস সম্পর্কে আমাদের অবহিত করতে।”

”খুবই সরল আইন।” হরিশঙ্করকে সিরিয়াস হতে দেখা গেল। ”বকদিঘির বিষ্টু মিশিরজি ছ’টা বরফি তুলে দেবে আটঘরার সত্যশেখরের হাতে। হরিশ দেখবে বরফিগুলো আস্ত না ভাঙা, ঠিকমতো মুখের মধ্যে গেল কি না, বা মুখ থেকে ফেলে দেওয়া হল কি না, খেতে অযথা দেরি করা হচ্ছে কি না। মলয়া গুনবে কটা খাওয়া হল। সময় রাখবেন গোপীবাবু। জলপান—বিরতির ব্যাপারটা খুবই ভাইটাল। সারা দিনে তিনবার মাঠে জল আসে, তাছাড়া লাঞ্চ অ্যান্ড টি আছে। এখানে তাই পাঁচবার জল দেওয়া যাবে আর দশ মিনিট আর পাঁচ মিনিটের দুটো ব্রেক। মিশিরজির পর পতু বরফি দেবে কালুকে। মানে কলাবতীকে।” ঘরের সকলের দিকে চোখ বুলিয়ে হরিশঙ্কর অনুমোদন প্রত্যাশা করলেন। অনেকেই মাথা নাড়িয়ে তাঁকে সমর্থন জানাল।

”এখানে কি আউট নেই?” জানলার বাইরে থেকে অজানা কণ্ঠস্বরে প্রশ্ন এল।

”নিশ্চয় আছে। এদের মধ্যে কেউ খাওয়ায় নিবৃত্ত হলে আটঘরার অন্য কেউ নামবে। এই তো চণ্ডী রয়েছে, পটলবাবু রয়েছেন….।” হরিশঙ্করের আঙুল পটল হালদারের দিকে উঁচিয়ে রইল।

”অ্যাঁ! আআআ…মি!” পটল হালদার বরফির স্তূপের দিকে সভয়ে তাকিয়ে বলল। ”আমি তো ক্রিকেট কখনও খেলিনি।”

”খেলেননি ঠিক কথা। কিন্তু কখনও কি কিছু খাননি…..ভাত ডাল তরকারি মাছ এইসব?” জজসাহেব তার বিপুল গোঁফের ভেতর থেকে একটা মুচকি হাসি বার করলেন।

”তা খেয়েছি। কিন্তু তাতে তো এমন গন্ধ…মানে এটা নতুন জিনিস তো, সমিতির নির্দেশ না পেলে….”

”পটলদা, এটা সংগ্রাম, ঝাঁপিয়ে পড়ো।” চণ্ডীর আবেদন পটল হালদারকে বিচলিত করার আগেই রাজশেখর জলদকণ্ঠে বললেন, ”থাক, আমি তো আছি।”

চণ্ডী বিড়বিড় করল। শোনার জন্য বিষ্টু মিশির গলা বাড়িয়ে দিল।

”অ্যাঁ। কী বললি? দুর্গন্ধ? এমন আবিষ্কার কি কেউ বিয়েবাড়িতে খাইয়ে বউনি করে?”

”গোলাপজল ঢেলে গন্ধ চাপতে গিয়েই কেস খারাপ করে ফেলেছে। ওদিকে পাতে এতক্ষণ বিরিয়ানি নিশ্চয় এসে গেছে। ব্যাচটা উঠলেই বসে পড়ব।”

”আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাস ভাই।”

মেলবোর্ন টাই—টেস্টের মতো এক্সাইটিং

হঠাৎ নির্ঘোষ শোনা গেল হরিশের গলায়, ”প্লে”।

নাক কুঁচকে বিষ্টু গুনে গুনে ছ’টা বরফি ট্রে থেকে তুলে বাড়িয়ে ধরল। সত্যশেখর ছ’টাই খপ করে তুলে নিয়ে মুখে পুরে কোঁত করে গিলে ফেলল। সবিস্ময়ে হর্ষধ্বনি উঠল দরজায়, জানলায়।

”ছক্কা, প্রথমে ওভারেই ছক্কা!”

”জনগণ আপনার সাথে আছে; সতুবাবু, চালিয়ে যান।” পটল হালদার প্রবল উদ্দীপনায় তার পাশের ঊরুতে চাপড় মারল।

”আবার আপনি…”

”আর হবে না, স্যার….কিন্তু আপনাকে আমি আটঘরায় নিয়ে যাবই।”

কলাবতী অবাক হয়ে কাকার মুখের দিকে তাকিয়ে। সত্যশেখর তাচ্ছিল্যের ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ”বাটা নিমপাতা এর থেকেও কুইক গিলতে পারি।”

এবার পতু মুখুজ্যের পালা। মুখবিকৃতি করে সে ছ’টা বরফি তুলল। কলাবতী প্রত্যেকটা থেকে সামান্য ভেঙে মুখে দিয়ে হাত নেড়ে জানাল আর খাবে না।

”মেডেন দিল। খুব চালাক মেয়ে তো!” সম্পাদক ফিসফিস করে জজসাহেবকে বললেন। হরিশঙ্করের মুখে মৃদু হাসি ভেসে বেড়াচ্ছে। আপনমনে বললেন, ”দেখা যাক।”

সাত মিনিট পর দেখা গেল সত্যশেখর সাতটি ওভার বাউন্ডারি এবং একটি বাউন্ডারি গিলে হাফ সেঞ্চুরির দরজায় পৌঁছে গেছে। স্টাইল দেখাতে ছুঁড়ে মুখের মধ্যে পাঠাতে গিয়ে দুটো বরফি ঠোঁটে লেগে মাটিতে পড়ে না গেলে সে আটচল্লিশে পৌঁছে যেত। কলাবতী এখনও স্কোর করেনি।

”দারুণ চালাচ্ছে তো আপনার ছেলে।” জজসাহেব ঝুঁকে রাজশেখরকে বললেন। ”মনে হচ্ছে সেঞ্চুরি করবে।”

”মনে হচ্ছে মানে?” পটল হালদার সোফা থেকে এক বিঘত উঠে দুই মুঠো ঝাঁকিয়ে বলল, ”দুটো স্তম্ভের আবরণ আপনাকে উন্মোচন করতে হবে। ….সতুবাবু, এগিয়ে চলুন।”

স্কোর পঞ্চাশ পার হতেই তুমুল হাততালির কোলাহলের এবং ঘনঘন ক্যামেরার আলোর ঝলসানির মাঝে বাইরে শোনা গেল : ‘ওরে, বরকে ছাঁদনাতলায় নিয়ে আয়!”

”গোপীবাবুকে তো এবার যেতে হবে।” সম্পাদক বললেন। বাইরে সানাই বেজে উঠল।

”অসম্ভব! আটঘরার প্রেস্টিজ এখন কঠিন সঙ্কটে।”

চণ্ডী ফিসফিস করল, ”হ্যাঁ রে, মনে হল ওদিকে যেন পান আনতে বলল। এবার তো রেডি হতে হয়।”

বিষ্টু ঝুঁকে হরিশের কানে কানে বলল, ”নতুন ব্যাচ বসবে, তাড়াতাড়ি শেষ করে না দিলে…”

হরিশ বলল, ”তিনটে তিনটে দিয়ে ওভার করুন….আর পতু মুখুজ্যে যেন টের না পায়।”

কলাবতী তার কাকাকে তখন বলল, ”স্কোরিং রেট খুব ফাস্ট হচ্ছে, এবার গোটাকতক মেডেন দাও।”

”উঁহু, তাহলে ওরা মাথায় চড়ে বসবে।” এই বলে সত্যশেখর তার জিভ ইঞ্চি তিনেক বার করে মলয়ার দিকে ঘুরে তাকাল। মলয়ার চোখ কটমট হয়ে উঠতেই জজসাহেব স্মিত হেসে বললেন, ”পারমিসিবল, ফিফটি হয়ে গেছে তো; তবে সেঞ্চুরির পর উনি আর একবার মাত্র দেখাতে পারবেন।”

এরপর প্রবল উত্তেজনা আর চিৎকারের মধ্য দিয়ে স্কোর ষাট থেকে সত্তরের কোঠায় উঠল। সত্যশেখরকে অবশ্য এর মধ্যে কয়েকবার বিস্মিত হয়ে বিষ্টুর দিকে তাকাতে দেখা গেছল।

ছিয়াত্তর থেকে বিরাশিতে পৌঁছতেই সম্পাদক বলে উঠলেন, ”উফফ, এ যে মেলবোর্ন টাই—টেস্টের মতো এক্সাইটিং লাগছে।”

রাজশেখর আড়চোখে হরিশঙ্করের দিকে তাকিয়ে গলা খাঁকারি দিলেন। হরিশঙ্করের গম্ভীর মুখ আরও গম্ভীর হল।

নিরানব্বুই! পটল হালদার দু’হাত বাড়িয়ে সত্যশেখরের দিকে ছুটে যাচ্ছিল। জজসাহেব তার কাছা টেনে ধরলেন।

”এখনও শেষ হয়নি, একটা বাকি রয়েছে যে!”

পটল হালদার সোফায় ফিরে এল কাছাটা জজসাহেবের মুঠো থেকে ছাড়াতে না পেরে।

”আপনি যাবেন তো, জোড়া স্তম্ভ…”

”যাব যাব, সুস্থির হয়ে বসুন তো।”

পতু মুখুজ্যে খুঁতখুঁতে গলায় হরিশ কর্মকারকে বলল, ”ঠিকমতো দেখেছ তো? ষাট থেকে স্কোরটা বড্ড ফাস্ট উঠল যেন!”

”উঠবেই তো, চোখ….মানে স্টমাকটা সেট হয়ে গেছে তো।”

নিরানব্বুই!

জজসাহেব রুমালে কপাল মুছলেন, ঠোঁট চাটলেন। সম্পাদক হাতছানি দিয়ে দুলুর বন্ধুকে ডেকে বললেন, ”সেঞ্চুরি করছে….সবে মুখের মধ্যে দিয়েছে, এমন একটা ছবি চাই, এক্সক্লুসিভ।”

সত্যশেখর একটা বরফি পতুর হাত থেকে তুলে কী ভেবে আর—একটা তুলল। পেটে হাত বুলিয়ে ঘরের চারপাশে তাকিয়ে হাসল। তারপর একসঙ্গে কপাত করে মুখে পুরে ঢোঁক গিলে বিরাট হাঁ করে মুখের মধ্যে পুরে ভিতরটা দেখাল। ক্যামেরার আলো ঝলসাল বারবার।

এরপর ঘরের মধ্যে কী হুলুস্থুলু কাণ্ড ঘটল তা বর্ণনা করা সম্ভব নয়।

সর্বাগ্রে হরিশ, বিষ্টু আর চণ্ডী খ্যাপা ষাঁড়ের মতো ভিড় ঠেলে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেছল। পটলের কাছা জজসাহেবকে দু’হাতে টেনে রাখতে হয়েছিল। সম্পাদক গোপী ঘোষকে আগামীকাল সকালে রেডি থাকতে বললেন, চিফ রিপোর্টার আসবে ইন্টারভ্যু করতে। পতু বারবার মলয়াকে জিজ্ঞাসা করেছিল ঠিকমতো গোনা হয়েছে কি না। রাজশেখরের চোখ দিয়ে শুধু কয়েক ফোঁটা জল ঝরেছিল। জজসাহেব রুমালটা এগিয়ে দিতে তিনি ধন্যবাদ জানিয়ে সেটি নিয়ে চোখ মোছেন, আর বলেন, ”আশা করি ওর জিভ বার করা মার্জনা করবেন।” জজসাহেব জিভ কেটে বললেন, ”কী যে বলেন। এত বড় গুণী আমি জানতাম না। নিশ্চয় জিভ দেখাবে…কিন্তু আপনি কি সিরিয়াসলি মনে করেন সিনেমায় নায়ক হওয়ার মতো…”

রাজশেখর ততক্ষণে হরিশঙ্করের দিকে তাকিয়ে হাসছেন।

”রাজু, তোর ছেলে পারল কী করে বল তো? সত্যি বলছি, এমন উৎকট গন্ধওলা জিনিস আমি জীবনে দেখিনি!”

”সিংগিবাড়ির ছেলে তো….বংশের মান রাখতে…”

”না না, ভুল বলছেন, আটঘরার জনগণের নিবিড় প্রেরণা….জনগণকে সঠিক পথ দেখাবার…”

.

বাড়ি ফেরার সময় রাজশেখর ট্র্যাফিকের লাল আলো দেখে গাড়ি থামাতেই কলাবতী বলল, ”দাদু, সেঞ্চুরির জন্য আমাদের কোনো উপহার দেবে না?”

”নিশ্চয় নিশ্চয়, কী চাই তোদের?”

পাশে একটা সবুজ অ্যাম্বাসাডার এসে থামল। রাজশেখর মুখ ফিরিয়ে তাকালেন।

”তোমার ডায়েট চার্ট এবার বন্ধ হোক।”

”অ্যাঁ! আমি তো ভাবছিলাম কাল থেকে চার্টে আরও কয়েকটা…”

”চার্ট বন্ধ না করলে কাল থেকে আমি আর কাকা অনশন শুরু…”

বলতে বলতে কলাবতী পিছনের সিটের দিকে মুখ ঘুরিয়ে দেখল সত্যশেখর জিভ বার করেছে আর পাশের গাড়ির জানালা দিয়ে বড়দি গম্ভীর মুখে আকাশের দিকে তাকিয়ে।

কলাবতী ও খয়েরি (১৯৯৯)

কলাবতী ও খয়েরি (১৯৯৯) – মতি নন্দী / প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ১৯৯৯ / আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। কলকাতা ৯ পৃ. ১১৮ / মূল্য ৪৫.০০। প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায় / উৎসর্গ: সুলেখক ডাঃ অনিরুদ্ধ ঘোষ স্নেহাস্পদে

খয়েরির সঙ্গে কলাবতীর পরিচয় হয় রাস্তায়। সেদিন স্কুল থেকে সে প্রতিদিনের মতো হেঁটে বাড়ি ফিরছিল। পিঠে স্কুলব্যাগ, তার মধ্যে টিফিন বক্স, কাঁধে ঝুলছে ওয়াটার বটল। সেদিন টিফিন বক্সটা খোলার তার দরকার হয়নি, খাবার যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেছে। তাদের ক্লাসের মিঞ্চুর মা এন্তার পাটিসাপটা বাড়িতে তৈরি করেছিলেন, তারই অনেক পলিথিন ব্যাগে ভরে মিঞ্চু নিয়ে এসেছিল তাই খেয়েই কলাবতীর টিফিন করা হয়ে যায়।

দুপুরে টিফিনে পাউরুটি চিবোতে তার একদমই ভাল লাগে না। জেলি আর মাখন লাগানো রুটির স্লাইস সে প্রায় রোজই মিঞ্চুকে দিয়ে দেয়। পাউরুটি খেতে মিঞ্চুর খুব ভাল লাগে, স্কুল থেকে বাড়ি আসার পথে স্কুটার—মোটরবাইক সারাবার দোকানটার পাশে পাঁঠার মাংসের একটা দোকান, তার পেছনে টিনের এবং টালির চালের অনেক বাড়ি। মাংসের দোকানের সামনে ফুটপাথে কয়েকটা ষণ্ডামার্কা কুকুরকে কলাবতী রোজই দু’বেলা দেখে, ওরা রাস্তা দিয়ে যাওয়া লোকজনের দিকে ফিরেও তাকায় না। বেশ নিরীহ বলেই মনে হয়। তবে দোকান থেকে হাড় বা মাংসের ছাল ছুড়ে দিলে সেটা খাওয়ার জন্য ওরা নিজেদের মধ্যে তুলকালাম ঝগড়া ও কামড়াকামড়ি শুরু করে দেয়।

সেদিন বাড়ি ফেরার সময় কলাবতী ওই কুকুরগুলোর থেকে একটু তফাতে নতুন একটি কুকুরকে বসে থাকতে দেখল। তার রং খয়েরি কিন্তু মাথার তালুর লোম সাদা, খুবই রুগণ, কোমরের ও বুকের হাড় প্রকট। মাংসওলা একটা ছোট হাড় ওর দিকে দয়াপরবশ হয়ে ছুড়ে দিল। সে হাড়টা মুখে নিতে যাচ্ছে তখন দুটো ষণ্ডা কুকুর ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। তাকে ফুটপাথে ফেলে একটা কুকুর ঘাড় কামড়ে দিতেই সে পরিত্রাহি আর্তনাদ তুলে লেজটা দু’পায়ের ফাঁকে গুটিয়ে ছুটে পালাল সেইদিকে যেদিকে কলাবতী যাবে।

হাঁটতে হাঁটতে কলাবতী সব লক্ষ করল। তার মনে হল, কুকুরটা বোধ হয় অন্য এলাকার, খিদের জ্বালায় এই এলাকায় খাবার খুঁজতে এসেছিল। বাড়ির কাছাকাছি এসে সে কুকুরটিকে আবার দেখতে পেল সত্যানন্দ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনে ফেলে দেওয়া মালসা থেকে দই চেটে খাচ্ছে। বেচারা! নিশ্চয় সারাদিন খাওয়া জোটেনি।

কলাবতী দাঁড়িয়ে পড়ল। স্কুলব্যাগ থেকে টিফিন বক্স বার করে তাই থেকে মাখন লাগানো পাউরুটির দুটো স্লাইস নিয়ে হাতে ধরে ওকে ডাকল, ”আয় আয়” বলে জিভ দিয়ে ”চুক চুক” শব্দ করল। কুকুরটি হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইল। কলাবতীর মনে হল, ও বিশ্বাস করতে পারছে না মাখন লাগানো রুটি নেওয়ার জন্য তাকেই ডাকা হচ্ছে। কলাবতী আবার ডাকল। এবার সে ছোট্ট করে ল্যাজ নাড়ল। চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। একটা ‘কুঁই’ শব্দ মুখ থেকে বেরিয়ে এল, বোধ হয় বুঝতে পেরেছে তাকেই খেতে ডাকছে। কিন্তু তাই বলে মাখন—রুটি! তার অবিশ্বাসের ঘোর তখনও কাটেনি। কলাবতী দু’পা এগিয়ে গেল। ”আয়, আয়,” মিষ্টি নরম স্বরে সে আবার ডাকল।

কয়েকজন পথিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে চলে গেল। একজন যেতে যেতে মন্তব্য করে গেল, ”মানুষ খেতে পায় না, কুকুরকে খাওয়াচ্ছে!” কথাটা কানে যেতেই তার মাথা গরম হয়ে উঠল। লোকটা দূরে চলে গেছে নইলে সে বলত, ”মানুষ তো তার নিজের খাবার ভিক্ষে করেও জোগাড় করে নিতে পারে। কিন্তু কুকুর কি তা পারে?”

কলাবতী আরও দু’পা এগিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। কুকুরটি দুটো কান ঘাড়ের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে মুখটা নামিয়ে ঘন ঘন লেজ নাড়তে লাগল! কলাবতী একটা স্লাইস ওর মুখে ঠেকাল। কপ করে সেটা কামড়ে নিয়ে মুখে ঢুকিয়ে ফেলল এবং দুই ঢোকে গিলে নিল। অন্য স্লাইসটারও একই অবস্থা হল। টিফিন বক্সে আছে আপেল আর ছানা। কুকুর আপেল খায় কিনা কলাবতীর জানা নেই। ছানা বোধ হয় খেতে পারে, এই ভেবে সে মুঠোয় ছানা নিয়ে খয়েরির মুখের সামনে ধরল। একবার গন্ধটা শুঁকে নিয়ে তার তালু থেকে ছানা খেয়ে তালুটা চেটেও দিল। সুড়সুড়ি লাগতে কলাবতী মজা পেয়ে হাত বাড়িয়ে রইল, খয়েরি আরও তিন—চারবার চাটল। টিফিন বক্স কিছুটা হালকা করতে পেরে সে স্বস্তি পেল। বক্স খুলে অপুর মা যদি দেখে সে টিফিন খায়নি তা হলে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার গজগজানি থামবে না।

কুকুরটিকে পাউরুটি আর ছানা খাইয়ে কলাবতী বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। একবার পেছনে তাকিয়ে দেখল হিজ মাস্টার্স ভয়েস গ্রামোফোন রেকর্ডে ছাপমারা কুকুরটির মতো দুটো পা সামনে রেখে উবু হয়ে বসে তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। কলাবতীকে তাকাতে দেখে সে লেজ নেড়ে উঠে দাঁড়াল, কিছুটা গিয়ে কলাবতী আবার মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখল কুকুরটি তাকে অনুসরণ করে পিছু পিছু আসছে। বাড়ির ফটক দিয়ে ভিতরে ঢুকে বাগান পেরিয়ে বাড়ির সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলাবতী ফটকের দিকে তাকিয়ে রইল, সাত—আট সেকেন্ড পরে কুকুরটি ফটকের সামনে এসে হাজির হয়ে ভেতর দিকে তাকিয়ে কলাবতীকে দেখতে পেয়ে লেজ নেড়ে যেতে লাগল কিন্তু ভেতরে ঢুকল না।

”ভাগো এবার।” চেঁচিয়ে বলার সঙ্গে সঙ্গে সে হাত নেড়ে চলে যেতে বলল, ”অনেক দিয়েছি, আর দিতে পারব না।”

কলাবতী বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল, দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল মুরারি। সে বলল, ”কাকে কী দিতে পারবে না কালুদি?” কলাবতী বলল, ”একটা কুকুরকে, খাবার।… দ্যাখো তো মুরারিদা, এখনও গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কিনা, খয়েরি রঙের।” উঁকি দিয়ে দেখে মুরারি বলল, ”কই কেউ নেই তো!”

”খয়েরি” শব্দটি মুখ থেকে বেরোতে তখনই কলাবতী মনে মনে নামকরণ করে ফেলে— খয়েরি!

এইভাবেই খয়েরির সঙ্গে কলাবতীর প্রথম আলাপ। পরদিন স্কুলে টিফিন খাওয়ার সময় কলাবতীর মনে ভেসে উঠেছিল খয়েরির ক্ষুধার্ত চাহনি। আর খাবার পেয়ে কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে থাকার ছবিটা। সে পাউরুটির দুটো স্লাইস না খেয়ে রেখে দেয় যদি আবার দেখা হয় রাস্তায় তা হলে খেতে দেবে।

আবার তাদের দেখা হল সত্যানন্দ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনে। উবু হয়ে বসে ছিল খয়েরি, তাকে দেখেই লেজ নাড়ল। কলাবতী ওকে না—দেখার ভান করে পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল। মুখটা সামান্য ফিরিয়ে আড়চোখে দেখল খয়েরি বসেই আছে এবং তাকে লক্ষ করে যাচ্ছে। কলাবতী ঘুরে তাকাল। খয়েরিও সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। এগোবে কি এগোবে না, ইতস্তত করছে। তারপর অনুভূতি থেকে কী বুঝল খয়েরি প্রায় পা টিপে টিপে কলাবতীর দিকে এগিয়ে এল। কলাবতীর ভাল লাগল ওর কাছে আসাটা। একটা পশু তাকে ভাল লোক হিসেবে বুঝেছে বলেই তো তার কাছে আসছে। ওরা মানুষ চেনে। স্বার্থপর, নিষ্ঠুর লোক দেখলে পশুপাখি দূরে সরে যায়। দাদুর কাছে শুনেছে মানুষের থেকে ওদের নাকি একটা বাড়তি ইন্দ্রিয় আছে, খয়েরিরও তা হলে আছে।

খয়েরি কলাবতীর কাছে এসে মুখ তুলে লেজ নাড়তে লাগল। তার মনে হল খয়েরি যেন বলছে, ”তোমার ওই ব্যাগের মধ্যে কৌটোটায় কিছু আছেটাছে নাকি? থাকলে বার করো না, খুব খিদে পেয়েছে।” কলাবতী বলল, ”এখানে দেব না, আয় আমার সঙ্গে।” এই বলে কলাবতী বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। তার পিছু নিল খয়েরি।

কলাবতীর মজা লাগল একটা কথা ভেবে, তার মনে হচ্ছে, কুকুরের মনে মনে বলা কথা সে বোধ হয় বুঝতে পারে। নয়তো ”এখানে দেব না’ বলে হাঁটতে শুরু করামাত্র খয়েরি তার পিছু নিল কেন! সে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেল, খয়েরিও তার কথা বুঝতে পারে। বোঝাপড়াটা হল খাওয়ার অর্থাৎ পেটের টানে।

ফটকের কাছে এসে কলাবতী রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে বাড়ির দিকে তাকাল কেউ তাকে দেখছে কিনা দেখার জন্য। অপুর মা বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফটকের দিকে আসছে, হাতে ঝুলছে বাজার করার প্লাস্টিকের ব্যাগ।

কলাবতী বলল, ”চললে কোথায় অপুর মা?”

ঘোর কৃষ্ণবর্ণ অপুর মা দশাসই মাঝবয়সী বিধবা। অপু তার একমাত্র ছেলে। কলাবতীদের আটঘরাতেই দেশ। দেশের বাড়িতে অপু থাকে মামাতো ভাইবোনেদের সঙ্গে। অপুর মার ভাগের পুকুর, সামান্য জমিজমা তারাই ভোগ করে। এই বাড়িতে সে যা মাইনে পায় সবই দেশে পাঠিয়ে দেয়। মাতৃহারা কলাবতীকে কোলেপিঠে না হোক যত্নে ও যতদূর সম্ভব শাসনে সে দেখাশোনা করে। রান্নাঘরটা অপুর মা’র নিজস্ব সাম্রাজ্য। অসম্ভব সুস্বাদু তার রান্নার হাত। প্রথম প্রথম মুরারি রান্নার বিষয়ে তাকে অযাচিত পরামর্শ দিতে গিয়ে এমন দাবড়ানি খেয়েছিল যে, সঙ্গে সঙ্গে রাজশেখরের কাছে গিয়ে মৃদুস্বরে নালিশও করেছিল।

”কত্তাবাবু আপনার দেশের এই মেয়েটার জিভ বড্ড খরখরে। বললুম ধোঁকায় অত লঙ্কাবাটা দিস না। তা কী বলল জানেন, এ—বাড়ির লোকের কার কেমন জিভের তার আমার জানা আছে। এই বলে আরও এক খাবলা লঙ্কাবাটা দিয়ে বলল, এটা ছোটবাবুর জন্য। কর্তাবাবু আজ রাতে আপনাদের কিন্তু ঝালের চোটে বাপরে মারে বলে টেবিল থেকে উঠে পড়তে হবে। রসগোল্লা কিনে এনে রেখে দেব?”

”কিনবি?” রাজশেখর সেকেন্ড দশেক চিন্তা করে বললেন, ”আটঘরার মেয়ে, ঝালের হাত একটু বেশি তো হবেই, তবে কি জানিস আটঘরার লোকেরা ঝাল একটু বেশিই খায়, তেমনই মিষ্টিটাও। ঠিক আছে, রসগোল্লা এনে রাখ।”

”কতটা আনব?”

”আমার আর কালুর জন্য গোটা আষ্টেক আর সতুর জন্য কুড়িটা হলেই চলে যাবে।”

সেদিন রাতে খাওয়ার টেবলে রান্না করা খাবার রেখে অপুর মা ঘরের বাইরে সিঁটিয়ে থেকে দুরু দুরু বুকে দাঁড়িয়ে রইল। মুরারিদা তাকে রসগোল্লাভরা মালসা দেখিয়ে বলেছে, ”এই দ্যাখ, তোর ধোঁকা খেয়ে সবাই যখন বাবাগো—মাগো করবে তখন এটার দরকার হবে।”

ধোঁকার ডালনার বাটি থেকে চৌকো একটা খণ্ড তুলে প্রথমে সত্যশেখর দাঁতে একটা টুকরো ভেঙে মুখে পুরল। কয়েকবার চিবোল। দুটো চোখ ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠল। রাজশেখর তার মুখের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে, মুরারি এবং কলাবতীও।

রাজশেখর দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ”সতু খুব ঝাল কি? রসগোল্লা আছে খাবি?”

সত্যশেখর ধোঁকার বাকিটুকু মুখে পুরে চোখ বুজে চিবোতে—চিবোতে মাথা নাড়তে লাগল, ”ফাসক্লাস, ফাসক্লাস, কালু খেয়ে দ্যাখ। বাবা একটা মুখে দাও, ডিলিসাস। কতদিন পর যে রান্নার মতো একটা রান্না খাচ্ছি।” বলতে বলতে সত্যশেখর একটা আস্ত ধোঁকা মুখে চালান করল।

কলাবতী তখন খুবই ছোট, কাকার দেখাদেখি সেও ধোঁকায় কামড় দিয়ে মন্তব্য করল, ”ঝাল কোথায়! এ তো আমাদের বিরিঞ্চির ঘুগনি আর লালু প্রসাদের আলুকাবলির মতোই।” কথাটা শুনে সত্যশেখর ভাইঝির দিকে সপ্রশংস চোখে তাকায়।

মুরারি ব্যাজার মুখে খাওয়ার ঘর থেকে বেরিয়েই পড়ল অপুর মা’র সামনে। উদ্বিগ্ন স্বরে সে জানতে চাইল, ”হ্যাঁগো মুরারিদা, ছোটবাবু যে ফাসক্লাস ফাসক্লাস বলল, কথাটার মানে কী?”

”মানে, জঘন্য জঘন্য।” মুরারি মুখবিকৃত করে মানেটা আরও স্বচ্ছ করে বুঝিয়ে দিল।

অপুর মা ঘরের ভেতর উঁকি দিয়ে বলল, ”ওম্মা ছোটবাবু তো সবটাই খেয়ে নিল।”

সিংহি বাড়িতে লোকজন কম, কেউ গলা চড়িয়ে কথা বলে না তাই শান্ত শব্দহীন থাকে কিন্তু এর পর থেকে অপুর মার দাপুটে গলা একতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত মাঝে মাঝে পৌঁছতে লাগল।

.

এহেন অপুর মা সেদিন প্লাস্টিকের বাজার করার ব্যাগ হাতে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় স্কুল—ফেরত কলাবতীর মুখোমুখি হয়ে পড়ল। কলাবতী একবার পেছনে তাকিয়ে দেখে নিল খয়েরি কোথায়, তারপর বলল, ”অপুর মা, এমন সময় কোথায় যাচ্ছ?”

”ছোটবাবু টেলিফোন করে বলল, অপুর মা কাবলে ছোলার ঘুগনি খাব, বিরিঞ্চির থেকেও বেশি ঝাল দিয়ে। ঘরে তো কাবলে ছোলা নেই, মুরারিদা যে কোথায় গেছে দুপুর থেকে, যাই আমিই কিনে আনি। ওম্মা এ কুকুরটা কোথা থেকে এল!” কলাবতীর পাশে এসে দাঁড়ানো খয়েরিকে দেখে অপুর মা বলল। তার স্বরে প্রশয়ের আভাস পেয়ে কলাবতী উৎসাহিত হয়ে বলল, ”দ্যাখো না, কাল ওকে আমার টিফিনটা খাইয়েছি, আজও আমার পিছু নিয়েছে, আজও ওর চাই।”

”টিফিনটা খাইয়েছ মানে? তুমি খাওনি?”

অপুর মার স্বরে ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়ে কলাবতী ঢোক গিলে বলল, ”অত অত টিফিন দিলে কি সব খাওয়া যায়, একটু পড়ে ছিল সেটাই দিয়েছি। রোজ রোজ পাউরুটি—মাখন কি ভাল লাগে? কাল বরং ঘুগনি দিও।”

”তা দেব, এখন এটাকে কী খেতে দেবে?”

”কিচ্ছু না। অ্যাই ভাগ ভাগ।” কলাবতী ফুটপাথে’ক্রুদ্ধভাবে পা ঠুকে এগিয়ে গেল খয়েরির দিকে। কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে খয়েরি দাঁড়িয়ে রইল। লেজটা নড়ছে। জেনে ফেলেছে কলাবতীর রাগটা নকল।

”ও এখন তোমায় ছাড়বেনি। রান্নাঘরে বাসী রুটি আছে, তাই দুটো এনে দাও।” এই বলে অপুর মা মুদির দোকানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল।

অপুর মা একটু দূরে যেতেই কলাবতী ”আয়।” বলে ফটক পার হয়ে পাঁচিলের ধারে লুকিয়ে দাঁড়াল। খয়েরি ফটকের সামনে এসে ভেতর দিকে তাকিয়ে কলাবতীকে দেখতে না পেয়ে মৃদু স্বরে ”ভুক ভুক” শব্দ করে উবু হয়ে বসে পড়ল। মিনিটখানেক পরে কলাবতী উঁকি দিল। খয়েরি তাকে দেখতে পেয়েই ”ঘৌওউওউ” করে ডেকে উঠে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে শুরু করে দিল।

”ভেতরে আয়।” কলাবতীর ডাক শুনেও খয়েরি ইতস্তত করল। ”আয় আয়, ভয় কী। এই দ্যাখ,” কলাবতী স্কুলব্যাগ থেকে টিফিন বক্সটা বার করে বাগানের চাঁপা গাছের তলায় ঘাসে বসল।

মাথা নিচু করে পায়ে পায়ে খয়েরি এই প্রথম ফটক পার হল। গুটি গুটি সে কলাবতীর সামনে এল। মাখন লাগানো পাউরুটি খপ করে কামড়ে ধরে কোঁৎ কোঁৎ করে দুই ঢোকে পেটে চালান করে দিল। পরের পাউরুটির টুকরোটা কামড়ে ধরে ঘাসে উপুড় হয়ে পা দুটো সামনে ছড়িয়ে টুকরোটা দুই থাবায় চেপে ধরে দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে চিবিয়ে খেল।

জিভটা দুই ঠোঁটে চাটাচাটি করে খয়েরি আরও কিছু পাওয়ার আশা নিয়ে তাকিয়ে রইল। কলাবতী বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল নাড়তে নাড়তে বলল, ”আর তো কিছু নেই, এবার কেটে পড়ো, তবে বাসী রুটি যদি খেতে চাও তো লক্ষ্মী মেয়ের মতো বসে থাকো, আমি এনে দিচ্ছি। তার আগে তুমি আমার আপেল খাওয়া দ্যাখো।”

টিফিন বক্সে ছিল চার টুকরো করে কেটে রাখা একটা আপেল। এই ফলটি খেতে একদমই তার ভাল লাগে না। কিন্তু দাদুর নির্দেশ, ”আপেল মাস্ট। দারুণ ভিটামিন আছে।” কলাবতী আমতা আমতা করে বলেছিল, ”বড়দি বলেছেন ডাঁসা পেয়ারায় আপেলের থেকেও ভিটামিন বেশি আছে।”

বড়দি অর্থাৎ আটঘরার সিংহিদের বংশপরম্পরা প্রতিদ্বন্দ্বী (এবং এখনও) পাশের গ্রাম বকদিঘির জমিদার হরিশঙ্কর মুখুজ্জের একমাত্র মেয়ে মলয়া, যে ডক্টরেট করতে অক্সফোর্ডে যায়। (তখন সত্যশেখরও ব্যারিস্টার হতে লন্ডনে ছিল), যে ডক্টর হয়ে ফিরে কোনও বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারি কলেজে অধ্যাপনা না করে কাঁকুড়গাছি উচ্চচ বালিকা বিদ্যালয়ে হেডমিস্ট্রেসের চাকরি নেয়। মাতৃহীনা কলাবতীকে অবিবাহিতা মলয়াই রাজশেখরের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে নিজের স্কুলে ভর্তি করায়।

কলাবতী সিংহকে হেডমিস্ট্রেস একটু বেশি স্নেহ করেন, শিক্ষিকা মহলে এমন একটা কথা চাউর হয়। কথাটা মলয়ার কানে পৌঁছতেই সে স্কুলে কলাবতীর যাবতীয় ব্যাপারে এত কড়া হয়ে যায় যে অ্যানুয়াল পরীক্ষার খাতা আনিয়ে নিজে স্ক্রুটিনি করে প্রতি সাবজেক্টে পাঁচ নম্বর কমিয়ে দিয়েছিল। গতবছর মলয়ার স্কুলের বিরাশিটি মেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়, আশিজন ফার্স্ট ডিভিশন, একজনও ফেল হয়নি। পঞ্চাশটি স্টার পাওয়া স্কুলের বড়দির রংচটা অ্যাম্বাসাডার মোটরটা যখন কাঁকুড়গাছির মোড়ের আইল্যান্ডটা ঘোরে তখন ট্র্যাফিক হোমগার্ডও গাড়িটাকে স্যালিউট ঠুকে দেয়।

এহেন বড়দি বলেছে আপেলের থেকে পেয়ারায় ভিটামিন বেশি আছে। রাজশেখর কথাটার প্রতিবাদ না করে দোতলায় লাইব্রেরিতে চলে যান। খাদ্যের গুণাগুণ সম্পর্কিত গোটাদুয়েক বই খুলে পড়ে, কলাবতীকে জানান, ”হরির মেয়েটা অ্যাত সব জানল কী করে বল তো? ওদের তো মুখ্যুর বংশ।” রাজশেখর দু’চক্ষে হরিশঙ্করকে দেখতে পারেন না বটে কিন্তু মলয়া বা মলুকে স্নেহ করেন নিজের মেয়ের মতো।

কলাবতী আপেলের একটা টুকরোয় কামড় দিয়ে মুখবিকৃত করল, টক। মুখ থেকে টুকরোটা বার করে ঘাসে ছুড়ে ফেলতেই খয়েরি এগিয়ে গিয়ে সেটা মুখে পুরে চিবিয়ে খেয়ে নিল। কলাবতী তো অবাক। কুকুর মাংসাশী প্রাণী বলেই সে জানে। এরা যে নিরামিষভোজীও সেটা এবার জানল, আপেলের বাকি টুকরোগুলো সে ছুড়ে ছুড়ে দিল। খয়েরি চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে নিল।

দোতলার গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাজশেখর যে অনেকক্ষণ ধরেই তাদের লক্ষ করে যাচ্ছিলেন, কলাবতী সেটা দেখেনি।

”কালু ওকে কোথায় পেলে?” রাজশেখরের গম্ভীর গলার প্রশ্নে কলাবতীর বুক দুরদুর করে উঠল। নিশ্চয় বকুনি দেবেন।

”আমার সঙ্গে সঙ্গে এল দাদু। ওর খুব খিদে পেয়েছিল তাই খেতে দিলুম। এই এবার ভাগ।” কলাবতী হাত তুলল। খয়েরি এক—পা পিছিয়ে গিয়ে আড়চোখে কলাবতীর দিকে দু’বার তাকিয়ে ধীরে ধীরে ফটক দিয়ে বেরিয়ে গেল।

কলাবতী দোতলায় উঠে আসতেই রাজশেখর বললেন, ”এ বাড়িতে এই দ্বিতীয়বার কুকুর ঢুকল। তোর জন্মের আগে সতুর একটা আলসেশিয়ান ছিল, হিটলার। নামের মতো মেজাজটাও ছিল হিটলারি। সারারাত বাগানে ঘুরে বেড়াত। একবার একটা চোরের পিঠ থেকে কামড়ে এক খাবলা মাংস ছিঁড়ে নিয়েছিল। দিনের বেলায় একতলার সিঁড়ির নীচে চেন দিয়ে বাঁধা থাকত। তবু বাইরের লোক ঢুকতে ভয় পেত। সতু ছাড়া কাউকে গায়ে হাত দিতে দিত না। সেই চোরটার দলের লোকেরা, এই আমাদের পেছনেই মালোপাড়া বস্তিতে থাকে, প্রতিশোধ নিতে একদিন রাতে বিষমাখা মাংস খাইয়ে হিটলারকে মেরে ফেলল। সতু সাতদিন কিছু মুখে দেয়নি, বিছানায় শুয়ে ছিল। তারপর থেকে বছর পঁচিশ এ—বাড়িতে আর কুকুর পোষা হয়নি। হিটলারের এক বোন ছিল লিজা, এলিজাবেথ। তাকে নিয়েছিল মলয়া। এখন লিজার নাতনি আছে মুখুজ্জে বাড়িতে।”

কলাবতী বলল, ”হ্যাঁ দেখেছি, মঙ্গলা, খুব ঠাণ্ডা স্বভাবের। ওকে আমার খুব ভাল লাগে। কিন্তু ওর দিদিমা না ঠাকুমা, হিটলারের বোন ছিল এটা তো জানতুম না।”

একটু পরেই অপুর মা ফিরল।

”কালুদি কুকুরটাকে রুটি দিয়েছ? দেখলুম ফটকের বাইরে পাঁচিল ঘেঁষে শুয়ে রয়েছে। বাব্বা, কী মেঘ করেছে! পশ্চিমের আকাশটা মোষের মতো কালো হয়ে গেছে।”

”সে কী!” কলাবতী ছুটে বারান্দায় ঘিরে আকাশ দেখে এসে বলল, ”পাঁচ মিনিট আগেও তো আকাশ পরিষ্কার ছিল। খুব ঝড় আসবে মনে হচ্ছে। জানলাগুলো বন্ধ করে দাও শিগগির।”

মুরারি, অপুর মা, কলাবতী তিনজনে মিলে গোটা তিরিশ জানলা ও দরজা বন্ধ করতে—না—করতেই প্রবল ঝড় আছড়ে পড়ল বাড়িটার ওপর। মিনিটদশেক হাওয়ার মাতামাতি চলার পরই নামল তোড়ে বৃষ্টি। মিনিট কুড়ি পর হাওয়া আর বৃষ্টির দাপট কমে এলে কলাবতী ছাতা মাথায় গাড়ি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। চাঁপাগাছের কচি ডালগুলো ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে আছে। রাস্তার ওপারে ডেকরেটরের দোকানের সাইনবোর্ড আর দুটো লাইট পোস্টে বাঁধা ওয়ান ডে নক আউট ফুটবল প্রতিযোগিতার ফেস্টুন ঝুলে রয়েছে। একটা পুরনো টিনের চালা কোথা থেকে উড়ে এসে বাগানে পড়েছে। টগরগাছটা পাঁচিলে ঠেস দিয়ে কোনওক্রমে দাঁড়িয়ে।

কলাবতী গাড়ি বারান্দার পশ্চিম দিকে সরে গেল। বাগানের এই দিকটা বহু বছর ধরে অবহেলিত। একসময় রাজশেখরের একটা ফিটন ছিল। প্রায়ই তিনি স্ত্রী আর দুই ছেলে, কলাবতীর বাবা দিব্যশেখর ও সত্যশেখরকে নিয়ে বিকেলে গঙ্গার ধারে ফিটনে চড়ে হাওয়া খেতে যেতেন। বাগানের পশ্চিম দিকে ফিটন ও ঘোড়া রাখার জন্য পাকা একটা ঘর তৈরি করেছিলেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ফিটন ও ঘোড়া বিক্রি করে দেন। ঘরটা ফাঁকা পড়ে থাকতে থাকতে ওর অস্তিত্বটাই সবাই ভুলে যায়। বাগানের ওদিকটায় বহু বছর কেউ না যাওয়ায় বড় বড় ঘাস আর ঝোপ গজিয়ে গেছে। বাগানের পাঁচিল ফিটনের ঘরটার পেছনের দেওয়াল আর দু’ধারের দেওয়ালে দুটো মাত্র জানলা। এখন তার কোনও পাল্লা নেই, গরাদও নেই, আছে শুধু জীর্ণ দুটো কাঠের ফ্রেম। ঘরের সামনের দিকে ছিল দুই পাল্লার চওড়া দরজা, যা দিয়ে ফিটনটা ঢুকত, ও বেরোত। পাল্লা দুটোর একটা নেই, অন্যটার থেকে অর্ধেক কাঠ খসে পড়েছে। মেঝের সিমেন্ট ভেঙেচুরে ইট ও মাটি বেরিয়ে রয়েছে।

আকাশে ঘোলাটে মেঘ, আলো খুবই কম, সন্ধ্যা নামার সময় এগিয়ে আসছে। বারান্দা থেকে কলাবতী আলতো দৃষ্টিতে তাকাল ফিটন রাখার ঘরটার দিকে। ঘরের দরজার ভাঙা পাল্লার কাছে কী যেন একটা নড়ে উঠল বলে তার মনে হল। কৌতূহলী চোখে সে তাকিয়ে রইল। ঘরের মধ্যে আলো এত কম, যে সে কিছুই বুঝতে পারল না। কাকার ঘর থেকে বায়নাকুলার এনে চোখে লাগিয়ে সে খয়েরিকে দেখতে পেল। ঝাঁকুনি দিয়ে গা থেকে জল ঝরিয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করছে।

কলাবতীর এতক্ষণ ওর কথা মনেই ছিল না। অপুর মা বলেছিল ফটকের বাইরে পাঁচিল ঘেঁষে শুয়ে আছে। ঝড়—বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয় খুঁজতে ফিটনের ঘরে ঢুকে পড়েছে। তার মনে হল, ভালই করেছে। বৃষ্টি ধরার কোনও লক্ষণ নেই সারারাত যদি ওখানেই থাকে তো থাকুক।

মাস্টারমশাই ক্ষুদিরামবাবুর কাছে কলাবতী অঙ্ক বুঝে নিচ্ছিল যখন সত্যশেখর বাড়ি ফিরল। কাকার সেরেস্তার পাশেই তার পড়ার ঘর। হঠাৎ তার কানে এল কাকা সদর দিয়ে ঢুকেই চেঁচাচ্ছে, ”আরে আরে এটা আবার এল কোত্থেকে। মুরারি, মুরারি শিগগির এটাকে তাড়া, অ্যাই ভাগ, ভাগ।” এর পরই ‘কেঁউ, কেঁউ’ শব্দ উঠল আর্তনাদের। কলাবতী বুঝল কাকা কিছু একটা দিয়ে আঘাত করেছে খয়েরিকেই।

”আসছি সার।” কলাবতী ক্ষুদিরামবাবুর অনুমতির জন্য অপেক্ষা না করেই ছুটে ঘর থেকে বেরোল। সদর দরজায় পৌঁছে দেখল ফটক দিয়ে খয়েরি ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে। সে চেঁচিয়ে ডাকল, ”আয়, আয়।” খয়েরি থমকে পেছন ফিরে তাকাল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। কলাবতী ছুটে গেল। ততক্ষণে খয়েরি ফটক পার হয়ে গেছে।

বিষণ্ণ মনে ফিরে এল কলাবতী। অপুর মার দেওয়া কাবলি ছোলার ঘুগনি সে মুখে দিল না। ক্ষুদিরামবাবু এক চামচ মুখে দিয়েই ”উহহ, কী ঝাল।” বলে প্লেটটা সরিয়ে রাখলেন। একটু পরে খালি প্লেট নিতে এল মুরারি। ”এ কী! কেউই তো খাননি, খুব ঝাল হয়েছে বুঝি। অপুর মা’র হাতের রান্না তো!”

মুরারি প্লেট দুটো তুলে মুচকি হেসে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কলাবতী বলল, ”কাকা খেয়েছে।”

চোখ দুটো বিস্ফারিত করে মুরারি বলল, ”খেয়েছে মানে! চেয়ে চেয়ে দু’বার খেয়েছে। তারপরই ”আঃ উঃ’ করতে করতে সেরেস্তায় দৌড়ল, এক ঘণ্টা ধরে মক্কেল বসে।”

ক্ষুদিরামবাবু চলে যাওয়ার পর অপুর মা’র কাছ থেকে দুটি রুটি চেয়ে নিয়ে কলাবতী ফটকের বাইরে এসে দু’দিকে তাকাল, কাদা আর গাছের পাতায় ফুটপাথ নোংরা হয়ে রয়েছে। ঝড়ের দাপটে রাস্তার আলো জ্বলছে না। সে খয়েরির কোনও চিহ্ন খুঁজে না পেয়ে, ”আয় আয় আয়, চুক চুক” করে ডাকল দু—তিনবার। হঠাৎ দেখল অন্ধকার ফুটপাথ ধরে খয়েরি এগিয়ে আসছে। কলাবতী উবু হয়ে বসে রুটি ছিঁড়ে ওর মুখের সামনে ধরল। খয়েরি ল্যাজ নাড়তে লাগল কিন্তু রুটি কামড়াল না। ”খুব হয়েছে আর রাগ করতে হবে না। কাকাটা খুব পাজি, আমি বকে দেব, এখন খা।”

রুটির টুকরোটা সে খয়েরির মুখে ঠেকাল। খয়েরি কামড়ে ধরে সামনে দু’পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে খেল। ”এই তো লক্ষ্মী মেয়ে।” রুটি দুটো খাইয়ে কলাবতী খয়েরিকে জিজ্ঞেস করল, ”রাতে থাকবি কোথায়? যদি আবার বৃষ্টি আসে!” খয়েরি কী বুঝল কে জানে, ল্যাজ নেড়ে যেতে লাগল।

”আয় আমার সঙ্গে, যে ঘরটায় বিকেলে শেল্টার নিয়েছিলি সেখানেই রাতটা কাটিয়ে দিবি, তারপর সকালে যেখানে তোর ইচ্ছে সেখানে চলে যাবি। আয়।”

কলাবতী ফটক দিয়ে বাড়িতে ঢুকল, তার সঙ্গে খয়েরিও। বাগানটা অন্ধকার। পশ্চিমে ফিটন রাখার ঘরটা আরও অন্ধকার দেখাচ্ছে। দূর থেকে মনে হচ্ছে যেন একটা হাতি দাঁড়িয়ে আছে। সে খয়েরির কোমরে চাপ দিয়ে ঠেলে দিল। ”যা এবার কোনও ভয় নেই।” খয়েরি দু—তিন পা গিয়ে ফিরে তাকাল। ”যা, যা, ভয় কী?”

গাড়ি বারান্দায় আলো জ্বলে উঠল। আলোয় বাগানের অনেকখানিই দেখা যাচ্ছে। রাজশেখরের গলা শোনা গেল, ”কালু কী করছিস বাগানে এই অন্ধকারে?”

”ওর থাকার ব্যবস্থা করছি দাদু।”

”ও—টা কে?”

”দেখতে পাচ্ছ না, ওই তো দাঁড়িয়ে।” আঙুল তুলে কলাবতী দেখাল। রাজশেখর দেখতে পেলেন।

”ওর থাকার কথা তোকে ভাবতে হবে না, চলে আয়।” গলার স্বর একটু কঠিন করে রাজশেখর বললেন। কলাবতী বার দুই খয়েরির দিকে তাকিয়ে ফিরে এল বাড়ির মধ্যে। খয়েরি মিনিটখানেক অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থেকে পায়ে পায়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে এসে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

কলাবতী পরদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় খয়েরিকে যেখানে দেখবে ভেবেছিল, সেই সত্যানন্দ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে রাস্তার এপার—ওপার চোখ বোলাল। দেখতে পেল না। টিফিন বক্সে জেলি মাখানো দু’স্লাইস পাউরুটি রাখা আছে। মিনিট দুই অপেক্ষা করে সে বাড়ির দিকে রওনা হল। পথে যত গলি পড়ল সে থমকে দাঁড়িয়ে যতদূর চোখ যায় গলির মধ্যে তাকাল। দেখতে পেল না। বাড়ির ফটকে পৌঁছে পাউরুটির স্লাইস দুটো ফটকের ধারে রেখে দিল। যদি খয়েরি আসে!

পরদিন ভোরে কলাবতী ছুটে গিয়ে দেখল পাউরুটির স্লাইস দুটো যে ভাবে রাখা ছিল তেমনই রয়েছে। এইভাবে পাঁচটি দিন কেটে গেল। সে খয়েরির দেখা আর পেল না। তখন সে মনে মনে বলল, রাস্তার কুকুর তো, কত আর ভাল হবে! আঁস্তাকুড়ের খাবার না পেলে ওদের পেট ভরে না। ভেবেছিলুম দাদুকে বলে খালি ফিটনের ঘরটায় ওকে থাকতে দেব। তা তো পছন্দ নয়। যাকগে, যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াক। আর কখনও দেখা হলে ওকে কিছু খেতে দেব না।

.

শুক্রবার রথযাত্রা, স্কুলের ছুটি। তার আগের দিন ছুটির পর কলাবতী যখন স্কুল থেকে বেরোচ্ছে, গেটে তাকে ধরল ধূপছায়া ওরফে ধুপু।

”এই কালু, তোর জন্যই দাঁড়িয়ে, কথা আছে। চল, হাঁটতে হাঁটতে বলছি।” ধুপু একই ক্লাসের, তবে অন্য সেকশনে পড়ে। একটু মোটাসোটা কিন্তু অসম্ভব চটপটে, সবসময় হাসিখুশি মুখ। স্কুলে ছোট—বড় সবার সঙ্গে ওর ভাব। স্কুলের স্পোর্টসে ১০০, ২০০ মিটার দৌড়ে তৃতীয় বা চতুর্থ স্থান ওর বাঁধা। দড়ি—টানাটানি আর ক্রিকেট বল ছোড়ায় ধুপু ছাড়া প্রথম আর কাউকে ভাবাই যায় না। ওর গায়ে যেমন জোর মনটিও তেমনই নরম।

”তুই জানিস পূর্ব কলকাতা ক্রিকেট ক্লাবে আমি খেলি।” হাঁটতে হাঁটতে ধুপু বলল।

কলাবতী বলল, ”শুনেছি, তবে কখনও খেলতে দেখিনি।”

”এবার আমাদের পাড়ায় মেয়েদের নিয়ে একটা ক্রিকেট টিম তৈরি করা হবে, তুই খেলবি?”

কলাবতী দাঁড়িয়ে গেল, অবাক হয়ে বলল, ”আমি! আমি তো জীবনে ব্যাটই ধরিনি, টিভিতে শুধু ওয়ান—ডে দেখেছি।”

”তার মানে ক্রিকেটে তোর ইন্টাররেস্ট আছে, ওতেই হবে। এবার খেলাটা শিখে নে, তারপর খেলতে খেলতে ক্রিকেটার হয়ে যাবি। আমিও তো কিছু জানতুম না। এখন আমি ব্যাটে ওপেন করি, লেগব্রেকও দিতে পারি। তবে গুগলিটা এখনও পারি না, চেষ্টা করছি।”

শুনে ধুপুর প্রতি সমীহ জাগল কলাবতীর। স্কার্টের পকেট থেকে চুইংগাম বার করে ধুপুকে একটা দিয়ে নিজে একটা মুখে পুরল।

”তুই গুগলির চেষ্টা করছিস! আমার দাদুও দিত। দেওয়া নাকি খুব শক্ত।”

ধুপু গম্ভীর মুখে বলল, ”ভীষণ শক্ত। গাদা গাদা অফব্রেক বোলার পাবি কিন্তু ভাল লেগব্রেক গুগলি বোলার মেরেকেটে একটা—দুটো। বেঙ্গলে একটাও মেয়ে নেই, যে গুগলি দিতে পারে।”

”তুই কবে পারবি?” কলাবতী খুবই সম্ভ্রমভরে জানতে চাইল।

ধুপু আকাশের দিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে বলল, ”পাঁচ বছর যদি একনাগাড়ে প্র্যাকটিস করি তা হলে পারব।”

”তোদের ক্লাবের মাঠটা কোথায়?”

”মানিকতলা হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের মাঠে প্র্যাকটিস হত। ওরা আর বাইরের ক্লাবকে মাঠ দেবে না তাই আমরা সল্ট লেকের একটা মাঠে এবার থেকে খেলব। তবে এই যে নতুন ক্রিকেট সেন্টারটা নভিসদের জন্য করা হবে সেটা রেল লাইনের ধারে সি আই টি কোয়ার্টারের ভেতরের মাঠে। ওটা তুই চিনিস?” ধুপু প্রশ্ন করে দাঁড়িয়ে পড়ল। এখান থেকে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে গেলে তার বাড়ি।

কলাবতী বলল, ”হ্যাঁ চিনি। খুব আলোয় সাজিয়ে দুর্গাপুজো হয় মাঠে।”

”ওখানে প্রগতি সঙ্ঘ বলে কোয়ার্টারের একটা ক্লাব আছে, ফুটবল ক্রিকেট খেলে। ফণীদা ওদের সঙ্গে ব্যবস্থা করে মেয়েদের শেখাবার দায়িত্ব নিয়েছেন। আমাকে বলেছেন কিছু মেয়ে জোগাড় করে দিতে। স্কুলে অনেককে বললুম, কেউ রাজি নয়।”

কলাবতী জিজ্ঞেস করল, ”ফণীদা কে?”

ধুপু চুইংগাম মুখ থেকে ফেলে দিয়ে বলল, ”একজন রিটায়ার্ড লোক, দেখে বয়স বোঝা যায় না। পঞ্চাশ হতে পারে, আবার সত্তরও। কোয়ার্টারেই চারতলায় থাকেন, শুধু বউ আছে। ছেলেপুলে নেই। অনেক ক্লাবে খেলেছেন, শেষ খেলেছেন সান স্পোর্টিংয়ের হয়ে ফিফটি নাইনে। চল তোর সঙ্গে আর একটু হাঁটি।”

কলাবতী বলল, ”আমার দাদুও তো ওই সময়ে টাউন ক্লাবে খেলতেন। দেখেছিস আমার দাদুকে? গায়ের রং ঠিক আমার উলটো, খুব ফর্সা, সাড়ে ছফুট, তেমনই স্বাস্থ্য, ভীষণ খাইয়ে কিন্তু ভুঁড়ি নেই, রোজ জগ করেন। খুব মজা করে কথা বলেন।”

কথা বলতে বলতে দু’জনে কলাবতীদের ফটকের সামনে পৌঁছল। কলাবতী বলল, ”ভেতরে আয় না, দাদুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব।”

ধুপু বলল, ”আজ থাক, এখন যাব রাধারানীদের বাড়ি। ওর খুব ক্রিকেট শেখার ইচ্ছে কিন্তু মা পারমিশন না দিলে খেলতে পারবে না। মাসিমার সঙ্গে কথা বলব। উনি চান মেয়ে মাধ্যমিকে প্রথম দশজনের মধ্যে যেন থাকে। তাঁর ধারণা খেলাধুলো করলে পড়ার ক্ষতি হবে। রাধু আমায় ধরেছে ওর মাকে গিয়ে বোঝাতে। কী বোঝাব বল তো? বছর বছর ফার্স্ট হয়ে রাধু তো নিজের সর্বনাশ নিজেই করেছে। মা বলেছে দশজনের মধ্যে না থাকলে বিষ খেয়ে মরবে, বাবা বলেছে ঝি ছাড়িয়ে ওকে দিয়ে বাসন মাজাবে, ঘর মোছাবে। আমি বলেছি, এখনও মাধ্যমিকের জন্য তিন বছর হাতে আছে, তুই রেজাল্ট খারাপ করতে শুরু কর, বাবা—মার পাগলামিটাকে আস্তে আস্তে নর্মাল করে দে।”

কলাবতী বলল, ”আমার দাদু কি কাকা ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়ার জন্য একটুও চাপ দেন না। দাদু বলেন, ভালমতন একটা মানুষ হয়ে ওঠো আগে, সেজন্য খেলাধুলোটা খুবই জরুরি। ক্রিকেট খেলতে চাই শুনলে দাদু খুশিই হবেন। আমি কাল যাব। আচ্ছা ধুপু এই জুন মাসের গরমে কেউ ক্রিকেট খেলে? এখন তো ফুটবল সিজন!”

”হোক না ফুটবল সিজন। মেয়েরা তো দুপুরে ম্যাচ খেলতে মাঠে নামছে না। ফণীদা বলেছেন, এখন শুধু সকালে এক ঘণ্টা ব্যাট বল নিয়ে নাড়াচাড়া করা, একটা ধারণা পাইয়ে দেওয়া। এজন্য ক্রিকেট সিজনের অপেক্ষায় থাকার কোনও দরকার নেই।”

সেদিন রাতে খাওয়ার টেবলে বসেই কলাবতী ঘোষণা করে দিল, ”দাদু, কাকা, আমি কাল থেকে ক্রিকেট শিখব।”

সত্যশেখর ডিমের কালিয়ার বাটিতে তর্জনী ডুবিয়ে ঝোল চাখবার জন্য আঙুলটা মুখের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, থমকে গেল। ”কী বললি, ক্রিকেট? কেন পৃথিবীতে কি আর খেলা নেই? স্নুকার আছে, বিলিয়ার্ডস আছে, রাইফেল শুটিং আছে, শেখার আরও কতরকমের খেলা রয়েছে, তা নয়—” সত্যশেখর আঙুলটা মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে চুষতে শুরু করল।

”নিশ্চয় নিশ্চয় আরও কতরকমের খেলা রয়েছে—ব্যাগাটেলি, লুডো, তাস, দাবা, ক্যারম।” রাজশেখর খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন, ”সতু, এগুলোতেও তো ছোটাছুটি করে ঘাম ঝরাবার দরকার হয় না, বেশ আরামেই খেলা যায়।” রাজশেখর চোখ পিটপিট করে হাসি চেপে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সত্যশেখর কালিয়ার ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি মুখটা বাটির ওপর নামাল।

”কোথায় শিখবি?” রাজশেখর জিজ্ঞেস করলেন কলাবতীকে।

কলাবতী এর পর দুপুর কাছে যা যা শুনেছে সবিস্তারে দাদুকে বলল।

”ফণীদাটা কে?” সত্যশেখর জানতে চাইল।

”দাদু তুমি বোধ হয় চিনতে পারো। নাইনটিন ফিফটি নাইনে উনি সান স্পোর্টিংয়ে শেষবার খেলেছেন, তখন তো তুমি টাউন ক্লাবে।”

”ফণী ঘোষ!” রাজশেখর টেবলে জোরে থাবড়া মেরে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন। ”ফণীদা যদি সেই ফণী ঘোষ হয় তা হলে চিনি। বাপস কী ছয় হাঁকাত। আমার ছ’টা বলে ছ’টা ওভার বাউন্ডারি মেরেছিল গ্রিয়ার মাঠে। এই রোগা লম্বা চেহারা।” রাজশেখর ডান হাতের তর্জনীটা নাড়ালেন। ”অদ্ভুত টাইমিং ছিল আর ব্যাটের ঠিক শাঁসে বল লেগে বুলেটের মতো যেত বাউন্ডারিতে। আর সেই এক ওভারে ছত্রিশ রান নেওয়ার খবর কী করে যেন তোর বড়দির বাবা হরিশঙ্করের কানে পৌঁছে যায়। কানে ঠিক নয়, চোখে পড়ে যায়, পরদিন সব কাগজে খবরটা বেরিয়েছিল। অবশ্য বেরোবার মতোই খবর—একটা ছোট ম্যাচে ব্র্যাডম্যান বাইশ বলে সেঞ্চুরি করেছিলেন। আর ফণী ঘোষ সেদিন বাইশ বলে নিরানব্বুই করে বোল্ড হয়।”

”কে বোল্ড করল?”

”আর, সিনহা।” রাজশেখর নিস্পৃহ স্বরে নামটা বলে মুখ নিচু করে রুটি ছিঁড়ে কালিয়ার বাটিতে ডোবালেন।

”তারপর হরিকাকা কী করল? নিশ্চয় বাড়িতে কেত্তন লাগিয়ে দিল।” সত্যশেখর দ্বিতীয় ডিম শেষ করে তৃতীয়টা হাতে নিয়ে জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটল।

”না, কেত্তন বসায়নি। চারটে খবরের কাগজের কাটিং একটা ফ্রেমে বাঁধিয়ে আমাকে পাঠিয়ে দেয়, সঙ্গে একবাক্স ভীমনাগের সন্দেশ। বাক্সের মধ্যে ছিল একটা চিরকুট, তাতে লেখা : ”সার ডনের তরফ থেকে এই উপহার।”

”উফফ কী সাঙ্ঘাতিক লোক এই মলয়ার বাবা হরিশঙ্কর মুখুজ্জে।” সত্যশেখর দাঁতে দাঁত চেপে বলল। ”আমার সঙ্গে যখনই দেখা হয় খালি খাওয়ার কথা তোলে—সতু ফুচকার ইনিংসে হায়েস্ট স্কোর তোমার কত? সতু আলুর চপের ম্যারাথনে তোমার বেস্ট টাইম কত? সতু মিহিদানার পাওয়ার লিফটিংয়ে কত কেজি তুলেছ?”

”যাকগে হরির কথা।…কালু আমি তোর সঙ্গে সকালে গিয়ে দেখব লোকটা সেই ফণী ঘোষ কি না। কিন্তু তোর তো ক্রিকেটের ড্রেস নেই, ব্যাট প্যাড গ্লাভসও নেই। ওগুলো তো কিনতে হবে।” রাজশেখর উদ্বিগ্ন চোখে তাকালেন কলাবতীর দিকে।

”কেন, আমার তো জিনস আর টপ রয়েছে, তাই পরেই নেট প্র্যাকটিস চলে যাবে, যাবে না?” কলাবতী যতটা হালকা সুরে বলল, ততটাই গম্ভীর স্বরে রাজশেখর বললেন, ”একদম নয়। ওয়ান ডে ক্রিকেট দেখে দেখে তোর রুচিটা বদলে গেছে। ট্র্যাডিশনের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে কখনওই সেটা ক্লাসিক হয়ে উঠতে পারে না। লাল নীল হলুদ ট্রাউজার্স, চকরাবকরা জামা, সাদা বল দিয়ে ধুমধড়াক্কা ব্যাট চালিয়ে কি ক্রিকেট খেলা হয়? পা থেকে গলা পর্যন্ত ধবধবে সাদা, সেটাই হল ক্রিকেটারের পোশাক, হ্যাঁ নেটেতেও ওই পোশাকে প্র্যাকটিস করতে হয়।”

”দাদু, ফণী ঘোষের বাইশ বলে নিরানব্বইটা কোন ধরনের ক্রিকেট ছিল?” কলাবতী চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে রইল।

রাজশেখরের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল শান্ত হাসি। ”ক্লিন অ্যান্ড ক্ল্যাসিকাল হিটিং। প্রত্যেকটা স্ট্রোকে ছিল ব্যাটিংয়ের গ্রামার। এখনও চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফণী ঘোষের লম্বা রোগা শরীরটা এক পা বেরিয়ে এসে গুডলেংথ বলটা তুলে দিচ্ছে একস্ট্রা কভারের মাথার ওপর দিয়ে। মার খেয়েছি বটে, কিন্তু ওর ব্যাটিং দেখে সুখও পেয়েছি।”

পরদিন সকালে জগ করতে করতে দাদু আর নাতনি প্রগতি সঙ্ঘের মাঠে পৌঁছল। মাঠটির তিনদিকে টানা বারান্দার তিনটি চারতলা বাড়ি। বারান্দার সঙ্গেই পাশাপাশি এক কামরার ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাট আছে মোট আশিটি। মাঠের আর একদিক পাঁচিল ঘেরা, তারপরই রেল লাইন। কলাবতীদের বাড়ি থেকে মাঠটি প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। মাঠের একধারে একটা ছোট ঘর তাতে ট্যাঙ্কে জল তোলার জন্য পাম্প আছে। তার পাশে কম্যুনিটি হল। এটাই ক্লাবঘর। নাটক হলে এখানেই হয় রিহার্সাল। দুর্গাপুজোর অষ্টমীতে এই হলঘরে টেবল পেতে আশিটি ফ্ল্যাটের লোক খিচুড়ি খায়। মাঠটিতে সিক্স—আ—সাইড ফুটবল টুর্নামেন্ট হয় প্রতি বছর।

কোয়ার্টারের দুই লোহার পাল্লার চওড়া বড় একটা প্রধান দরজা আছে। অধিকাংশ সময়ই সেটা বন্ধ থাকে। বাইরে থেকে মাঠে আসার জন্য আছে ছোট্ট লোহার গেট, যা দিয়ে একজন মানুষ ঢুকতে বা বেরোতে পারে। ওরা দু’জন মাঠে এসে দেখল লম্বা রোগা মাথাভরা পাকা চুল, সাদা ট্রাউজার্সে গোঁজা সাদা টি শার্ট, সাদা কেডস, কুচকুচে কালো গায়ের রং, একটি লোক তাকে ঘিরে জনাপনেরো কিশোরী। বেশিরভাগ মেয়ের পরনে স্কার্ট ব্লাউজ। দু—তিনজন পরেছে সালোয়ার কামিজ। লোকটির হাতে একটি ক্রিকেট ব্যাট। তিনি মেয়েদের কী যেন বলছেন। কলাবতী ধুপুকে দেখতে পেল না।

রাজশেখর উত্তেজিত চাপা গলায় বললেন, ”কালু, এই লোকটাই ফণী ঘোষ। ” বলেই তিনি এগিয়ে গেলেন।

”তোমরা কেউ কি কখনও ক্রিকেট খেলেছ।” ফণী ঘোষ মেয়েদের জিজ্ঞেস করলেন।

সবাই চুপ। শুধু একজন বলল, ”বারান্দায় ছোট ভাইকে গড়িয়ে গড়িয়ে বল করেছি।”

ফণী ঘোষ সবার মুখে একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, ”আগে সবাই ব্যাট হাতে নিয়ে ফিল করে দ্যাখো জিনিসটা কেমন। তারপর শিখবে কেমন করে ব্যাট ধরতে হয়, কেমন করে ব্যাট হাতে দাঁড়াতে হয়, কিন্তু সবার আগে দৌড়নোটা শিখতে হবে, একটু ব্যায়াম করে নিতে হবে।” ফণী ঘোষ ব্যাটটা সামনের মেয়েটির হাতে তুলে দিলেন।

”আরে ফণী। তুমি এখানে?” রাজশেখর এগিয়ে মুখোমুখি হলেন ফণী ঘোষের।

”দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল লোকটাকে ঠিক যেন রাজুর মতো দেখতে। তুমি কিন্তু মোটা হয়ে গেছ।” ফণী ঘোষ দু’হাত দিয়ে রাজশেখরের ডান হাতটা চেপে ধরে ঝাঁকাতে লাগলেন।

”তুমি দেখছি আর একটু রোগা হয়েছ।”

”কত বছর পর দেখা হল!” ফণী ঘোষ আপ্লুত গলায় বললেন, ”ভাবতেই পারছি না সত্যি সত্যিই দেখা হয়ে গেল।”

কলাবতী অবাক হয়ে দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। মেয়েদের হাত ঘুরে ঘুরে ব্যাটটা তার হাতে এল। জীবনে এই প্রথম সে ক্রিকেট—ব্যাট হাতে নিল। বেশ ভারী ভারী লাগল। পুরনো ব্যাট তাতে দু—তিনটে লাল ছোপ। হ্যান্ডেলের রাবারটা জীর্ণ হয়ে গেছে। ব্লেডের তলার দিকটায় সামান্য চকলা ওঠা। ব্যাটটা দাদুর হাতে তুলে দিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, ”ধুপুকে দেখছি না যে?”

ফণী ঘোষ বললেন, ”ধুপু কাল সন্ধেবেলা সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে পা মচকেছে। বিছানায় শুয়ে। আজ এক্স—রে হবে, ওর যমজ ভাই ধুজু রাতে জানিয়ে গেছে।”

”ফণী এটা কি সেই ব্যাট, যেটা দিয়ে ব্র্যাডম্যানের রেকর্ড ভাঙতে যাচ্ছিলে?”

ফণী ঘোষ হেসে মাথাটা হেলালেন শুধু। ”তুলে রেখেছিলুম আজ বার করলুম।”

রাজশেখর ব্যাটটা কলাবতীর হাত থেকে নিয়ে কপালে ঠেকালেন। ফণী ঘোষ পকেট থেকে পুরনো একটা ক্রিকেট বল বার করলেন।

”এবার তোমরা এটা হাতে নিয়ে দ্যাখো কেমন লাগে।”

বলটা হাতে হাতে ঘুরল।

”কেমন লাগল?”

”বড্ড শক্ত ফণীদা,” একজন বলল। ”গায়ে লাগলে হাড় ভেঙে যাবে।”

”গায়ে লাগবে কেন? লাগার আগে সরে যাবে নয়তো লুফে নেবে। সেজন্য আগে লোফাটা শিখে নিতে হবে। প্রথমে শুরু করবে রাবারের বল দিয়ে। সবাই একটা করে রাবারের বল কিনে নাও। দেওয়ালে বল মেরে সেটা ক্যাচ করো। কীভাবে ধরবে সেটা তোমাদের দেখিয়ে দেব। আচ্ছা, এবার তোমরা মাঠটায় চক্কর দিয়ে চারপাক দৌড়ও দেখি, আস্তে—আস্তে, বেশি জোরে নয়। তারপর কিছু এক্সারসাইজ, এসব কিন্তু রোজ তোমাদের করতে হবে।” বলেই ফণী ঘোষ নিজে প্রথম দৌড় শুরু করলেন তাকে অনুসরণ করে মেয়েরা ছুটতে শুরু করল, তার মধ্যে কলাবতীও আছে। ওরা যখন প্রায় চল্লিশ মিটার এগিয়েছে তখন রাজশেখর আর থাকতে পারলেন না। চনমন করে উঠে দৌড়তে শুরু করলেন। দৌড় মানে জগিংই প্রায়।

বাড়ি থেকে জগ করে মাঠে এসেছেন তারপর আবার এই পরিশ্রম, রাজশেখর দু’পাকের পর দাঁড়িয়ে পড়লেন। ফণী ঘোষ একই তালে পা ফেলে, ছোটার গতি একটুও না কমিয়ে চারপাক শেষ করে রাজশেখরের পাশে এসে দাঁড়ালেন।

”তোমার ছোটা দেখে মনে হচ্ছে তোমার অভ্যেস আছে।” রাজশেখর প্রশংসামেশানো গলায় বললেন বুকে বাতাস টানতে টানতে। শুনে ফণী ঘোষ শুধু বললেন,

”রাজু এই মেয়েরা কিন্তু একদমই দৌড়তে জানে না। দৌড়নোটা শেখার জিনিস। এমনকী হাঁটাও। প্রায়ই চোখে পড়ে লোকে কী বিশ্রীভাবে হাঁটছে। কেউ ঝুঁকে, কেউ বেঁকে, কেউ ডাইনে—বাঁয়ে দুলে দুলে, কেউ থপ থপ করে। এজন্য দশ—বিশ বছর পর হাড়ের রোগ হয় সেটা কেউ ভেবে দেখে না। দৌড়নো কি হাঁটা, সে আবার শিখতে হবে নাকি; এই হচ্ছে মনোভাব!” ফণী ঘোষ বললেন একটু গলা তুলে, যাতে মেয়েরা শুনতে পায়।

রাজশেখর বললেন, ”ঠিক একই ব্যাপার আমাদের বাংলা শেখার ক্ষেত্রেও ঘটে। বাঙালি আমরা, জন্ম থেকেই বাংলায় কথা বলি, বাংলা বই পড়ি, আমাদের আবার এটা শিখতে হবে নাকি? অথচ কী গাদা গাদা ভুল বাংলায় যে লিখি, কত যে বানান ভুল করি তার ঠিকঠিকানা নেই। ব্যাকরণটাও ভাল করে পড়ি না। যাক গে এসব কথা, তোমায় বলি এই মেয়েদের মধ্যে আমার নাতনিও আছে তবে সে কোনজন তা কিন্তু তোমায় বলব না।”

”না বললেও আমি জানি, তোমার সঙ্গে যে কালো মেয়েটি এল, সেই তো? ওর চালচলন অ্যাথলিটদের মতো, সবার মধ্যে আগে চোখে পড়ে যায়।”

এই সময় একটি মেয়ে ফণী ঘোষকে জিজ্ঞেস করল, ”ফণীদা নেট তো লাগানো হয়নি। আমাদের প্র্যাকটিস কখন শুরু হবে?”

”আগে দৌড়তে শেখো, এক্সারসাইজ করে মাসলগুলোকে চাঙ্গা করে তোলো, দু’হাতে বল ধরতে শেখো, থামাতে শেখো, ছুড়তে শেখো, ধৈর্য ধরতে শেখো, তারপর বল করতে ব্যাট করতে শিখবে, তারপর নয় নেটের কথা ভাবা যাবে। আজ তোমাদের শুধু দেখে নিলাম, কাল ঠিক ছ’টায় আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকব, তোমরা আসবে, দৌড় শেখাব। যা বলেছি, সঙ্গে একটা রবারের বল আনবে। কেডস পরে আসবে। সালোয়ার কামিজ চলবে না।”

একটি ছোট্ট মেয়ে বলে উঠল, ”ফণীদা, ছবিতে দেখেছি ইন্ডিয়ান টিম হাফপ্যান্ট পরে দৌড়চ্ছে। আমি হাফপ্যান্ট পরে আসব?”

”বাড়িতে আপত্তি না থাকলে সবাই পরে আসতে পারো। গরমে সেটাই তো ভাল। আপত্তি থাকলে স্কার্ট পরবে। আজ তোমরা বাড়ি যাও। মনে রেখো কাল ছ’টায়।”

.

মেয়েরা সবাই চলে যাচ্ছে, সেদিকে তাকিয়ে ফণী ঘোষ রাজশেখরকে বললেন, ”বাচ্চচাদের উৎসাহটা দেখলে, এখনই নেট চাই! গাছে না উঠেই এককাঁদি, এই মনোভাবটা বদলানো দরকার। ক্রিকেট ধৈর্যের খেলা, গাওস্করের একটা ইনিংস যদি এদের দেখাতে পারতুম।” ফণী ঘোষ আফসোসে মাথা নাড়ালেন।

রাজশেখর বললেন, ”এই মনোভাবটাই শেষ করে দিয়েছে একদিনের ক্রিকেট। ক্রিকেট এখন দেড় ঘণ্টার ফুটবল ম্যাচের মতো খেলা হচ্ছে। আরে বাবা বিজয় হাজারের হাত জমাতেই তো দেড় ঘণ্টা লেগে যেত।”

দুই বৃদ্ধ যখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরনো আমলের গৌরব রোমন্থনে ব্যস্ত তখন কলাবতীর চোখ পড়ল কমিউনিটি হল ও পাম্পঘরের মাঝে তিন হাত চওড়া গলির মতো ফাঁকা জায়গাটার দিকে। মিশরের পিরামিডের পাশে দুটি পা সামনে রেখে বসে থাকা সিংহের দেহ আর মানুষের মাথাওলা স্ফিংসের মতো বসে কিছু একটা মুখে নিয়ে চিবোবার চেষ্টা করছে যে কুকুরটি তাকে সে দূর থেকেই চিনতে পারল মাথার সাদা টুপিটি দেখে—খয়েরি। খয়েরিকে যে সে আবার দেখতে পাবে কখনও মনে হয়নি। তাই সে খুব অবাক হল। তার মনে হল এটা যেন ভাগ্যের লুকোচুরি খেলা।

সে দ্রুত হেঁটে খয়েরির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মুখ নিচু করে খয়েরি সাদা একটা হাড় কামড়ে ভাঙার চেষ্টা করছে। হাড়টা একটা পাঁঠার টেংরি, তাতে এককণাও মাংস লেগে নেই। কলাবতী বুঝল খিদের জ্বালায় ওই হাড়টাই ভেঙে খাওয়ার চেষ্টা করছে। হাড়টা মোটা তাই পারছে না। হঠাৎ একজনকে সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে খয়েরি চোখ কপালের দিকে তুলে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড পর চিনতে পেরে ল্যাজ নাড়ল, উঠে বসল। কলাবতী দেখল খুব রোগা হয়ে গেছে খয়েরি। কোমরের দুটো হাড় প্রকট হয়ে উঠেছে। বুকের পাঁজরের হাড়ও দু—তিনটে গোনা যায়।

খয়েরির সামনে উবু হয়ে হাঁটু ভেঙে বসল কলাবতী। ডান হাত ওর মাথায় রাখতেই আহ্লাদে কান দুটো ঘাড়ের সঙ্গে মিশিয়ে জোরে জোরে ল্যাজটা নাড়তে লাগল। মুখ দিয়ে ”কুঁই—কুঁই’ শব্দ বেরিয়ে এল। তারপর সে মাথায় রাখা কলাবতীর হাত চাটার জন্য মুখটা এপাশ—ওপাশ করতে লাগল।

”খুব খিদে পেয়েছে।” কলাবতী জানতে চাইল। ”আয় আমার সঙ্গে। বাড়িতে রুটি আছে। মাখন, জেলি, ডাল, ভাত, মাছ, দুধ সব আছে। খাবি তো আমার সঙ্গে আয়।” এই বলে সে হাঁটতে শুরু করল দাদুকে লক্ষ করে। কয়েক পা গিয়ে সে ফিরে তাকিয়ে দেখল খয়েরি আসছে না।

”আয়, আয়” বলে সে কয়েকবার ডাকল। খয়েরি ল্যাজ নাড়ল কিন্তু এগিয়ে এল না। কলাবতী দাদুর কাছে এসে বলল, ”দুটো টাকা দাও তো।”

”কী হবে টাকা?” রাজশেখর বললেন।

”দাও না, দেখতেই পাবে।” বায়নাধরা আদুরে গলায় কলাবতী বলল।

রাজশেখর ট্রাউজার্সের পকেট থেকে কয়েকটা নোট বার করে তার থেকে একটা নোট নাতনির হাতে দিলেন। ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে কলাবতী তীরবেগে কোয়ার্টারের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। এখানে আসার সময় সে দেখেছে কোয়ার্টারের পাঁচিলের লাগোয়া একটা ছোট্ট স্টেশনারি দোকানের কাউন্টারে থাক দিয়ে পাউরুটি সাজানো।

যাওয়ার মতোই তীরবেগে সে ফিরে এল। খয়েরি আবার হাড়টা নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু করেছে।

”থাক ওটা আর খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে না, এবার এটা খা।” মোড়ক থেকে পাউরুটি বার করে আধখানা ভেঙে সে খয়েরির মুখের সামনে ধরল। সঙ্গে—সঙ্গে সেটা পেটের মধ্যে চালান হয়ে গেল। বাকি আধখানারও একই হাল হল। এর পর খয়েরি জুলজুল করে তাকিয়ে আছে দেখে কলাবতীর মন কষ্টে ভরে গেল। বেচারা, এখনও খিদে যায়নি। সে ভাবল, আবার একটা পাউরুটি কিনে আনবে কি?

তখনই রাজশেখর চেঁচিয়ে ডাকলেন, ”কালু এবার বাড়ি চল।”

”আয় আমার সঙ্গে, কিনে দেব আর একটা”—কলাবতী চাপাস্বরে বলল খয়েরিকে। খয়েরি বুঝতে পারল কলাবতীর মমতাভরা কথার মানেটা। তাকে অনুসরণ করে সে রাজশেখরের কাছে এসে কলাবতীর পেছনে দাঁড়িয়ে রইল।

”আবার এসো রাজু। বাচ্চচাদের সঙ্গে দৌড়লে ওরা উৎসাহ পাবে, সিরিয়াস হবে, তোমারও উপকার হবে।” ফণী ঘোষ বললেন।

”উপকার মানে তো খিদে বাড়বে।” রাজশেখর বললেন, ”আসব, তবে রোজ আসতে পারব না।”

ফণী ঘোষ কলাবতীকে বললেন, ”তুমি কিন্তু রোজ আসবে। বাড়িতে এমন এক দাদু থাকতে তোমাকে আমি আর কী ক্রিকেট শেখাব। গোড়ার ব্যাপারগুলো ওর কাছেই শিখে নিও। কীগো রাজু, শেখাতে পারবে না?”

রাজশেখর হাসলেন, ”চল কালু, বেলা বাড়ছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে।”

ওরা কোয়ার্টারের গেট থেকে বেরোচ্ছে, তখন খয়েরি ছুটে এল। রাজশেখর আগেই খয়েরিকে লক্ষ করেছিলেন, বললেন, ”সেই কুকুরটা মনে হচ্ছে। ওকে তো খাওয়ালি, এবার আর তোকে ছাড়বে না। ও তোকে বুঝে গেছে।”

”কী বুঝে গেছে?” কলাবতী জানতে চাইল।

”তুই ওকে ভালবাসিস। জন্তু—জানোয়ার, পাখিরা মানুষ চেনে। কে ভাল, কে দুষ্টু ওরা ঠিক বুঝতে পারে।” রাজশেখরের মুখে হাসি ফুটে উঠল। ”তুই পাশ করে গেছিস।”

দাদুর কথায় কলাবতীর মন আনন্দে ভরে গেল। খয়েরি জানিয়ে দিয়েছে সে ভাল লোক। ”দাদু ওকে আর একটা পাউরুটি কিনে দাও না! একটা খেয়ে ওর খিদে যায়নি। দেখছ কী রোগা হয়ে গেছে না খেতে পেয়ে।”

নাতনির চোখেমুখে দয়া করুণা মমতা উপচে উঠছে দেখে রাজশেখর মনে—মনে অত্যন্ত প্রীত হলেন। তিনি এটাই তো দেখতে চান, কলাবতী সুন্দর একটা মন পাক, চমৎকার স্বাস্থ্য পাক।

বাড়ি ফেরার পথে আর একটা দোকান থেকে রাজশেখর বড় সাইজের একটা পাউরুটি কিনলেন।

”রাস্তায় নয়, বাড়ি গিয়ে ওকে খেতে দেব।”

”ওকে বাড়ি নিয়ে যাব?” অবিশ্বাসের সুর কলাবতীর প্রশ্নে গোপন রইল না।

”ওকে পুষতে তোর ইচ্ছে করছে?”

”হ্যাঁ।” কলাবতী মাথাটা হেলিয়ে কাঁধে ছুঁইয়ে দাদুর হাত ধরল।

ক্ষুধার্ত খয়েরি ওদের দু’জনের সঙ্গে এবং পাউরুটির পিছু নিয়ে সিংহিবাড়ির ফটক পেরিয়ে ঢুকল। বাড়ির সদর দরজার সামনে পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়ে পড়ল।

”বাড়ির মধ্যে ঢোকাসনি, গায়ে ভীষণ নোংরা। এখানেই খেতে দে।” রাজশেখর মোড়কে মোড়া পাউরুটিটা কলাবতীর হাতে দিয়ে বললেন, ”সবটা খাইয়ে দিসনি।”

”দাদু ওকে চান করাব?” কলাবতী মোড়ক খুলে পাউরুটির খানিকটা ছিঁড়ে খয়েরির মুখের সামনে ধরে বলল।

”রাস্তার কুকুর, চান করার অভ্যেস তো নেই। গায়ে জল ঢাললেই ছুটে পালাবে। ধরেবেঁধে করাতে গেলে চেঁচামেচি করবে, কামড়ে দিতেও পারে। বাচ্চচা কুকুর তো নয়।”

পাউরুটির আর একটা টুকরো ছিঁড়ে কলাবতী বলল, ”বড়দির মঙ্গলার মতো একটা বকলেস আর চেন কিনে দেবে দাদু?”

”চেন দিয়ে বেঁধে রাখার মতো কুকুর তো এরা নয়, এরা ছাড়া থাকলেই ভাল থাকে। তবে একটা বকলেস পরালে লোকে জানবে ও বাড়ির পোষা কুকুর, আচ্ছা কিনে এনে দেব।” এই বলে রাজশেখর বাড়ির মধ্যে ঢুকতে গিয়ে থেমে গেলেন। ”আর একটা রবারের বল।”

সত্যশেখর সকালে একবার সেরেস্তায় বসে কোর্টে বেরোনোর আগে। সেদিন যার মামলা পড়েছে এমন দু—তিনজন মক্কেল তখন আসে। দোতলা থেকে নেমে সেরেস্তায় ঢোকার সময় খোলা সদর দরজার দিকে তার চোখ পড়ল।

”আরে কালু, ওটা আবার এসেছে আর তুই ওকে খাওয়াচ্ছিস?”

”আমি নয়, দাদু খাওয়াচ্ছে। দাদুই তো পাউরুটি কিনে ওকে ডেকে আনল।” কলাবতী জানে চুলে পাক ধরলেও কাকা এখনও ভয় পায় দাদুকে। সে তাই বর্মের মতো দাদুকে সামনে রেখে খয়েরিকে আড়াল করল।

”বাবা, ডেকে আনল।” সত্যশেখর ভ্রূ কুঁচকে সেরেস্তায় ঢুকে গেল।

মুরারি বেরিয়ে এল ভেতর থেকে। কলাবতী তাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, ”চললে কোথায় মুরারিদা?”

”মুদির দোকানে। আজ রথযাত্রা, ছোটবাবু তেলেভাজা খাবে। পাঁপড় আর ব্যাসম কিনতে যাচ্ছি।” মুরারির চোখমুখ কুঁচকে গেল খয়েরিকে দেখে। ”রথের দিন প্রাণীকে খাওয়ালে পুণ্যি হয়। খাওয়াও। জগন্নাথ বাবা খুশি হবেন।”

”শুধু আজ নয়, খয়েরি রোজ দু’বেলা খাবে। ও এবার থেকে এখানেই থাকবে, আমি ওকে পুষব।”

”য়্যা!” মুরারি প্রায় বজ্রাহতের মতো সাত—আট সেকেন্ড তাকিয়ে রইল খয়েরির দিকে। ”এই চিমড়ে রাস্তার নেড়ি কুকুরাকে পুষবে তুমি? মাথা খারাপ হয়েছে তোমার! কত ভাল—ভাল লোমওলা সুন্দর—সুন্দর বিলিতি কুকুর থাকতে শেষে কিনা—কত্তাবাবু জানে?”

”জানে মানে। দাদুই তো ওকে নিয়ে এল। খাইয়ে দাইয়ে মোটা করে দেব। দেখবে তখন বিলিতি কুকুরের থেকেও সুন্দর হয়ে যাবে, তাই না রে খয়েরি?” কলাবতী ওর মাথার হাত বুলিয়ে দিল, খয়েরি লেজ নাড়ল।

”ও বাব্বা, নামকরণও হয়ে গেছে, খয়েরি!” আকাশের দিকে তাকিয়ে মুরারি বলল, ”বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে, যাই দোকানটা সেরে আসি।”

”এখানে বোস। জল এনে দিচ্ছি।”

খয়েরিকে বসতে বলে কলাবতী ভেতরে গেল। অপুর মা রান্নাঘরে।

”একটা বাটিতে জল দাও তো, খয়েরি খাবে।”

অপুর মা অবাক হয়ে বলল, ”খয়েরি কে?”

”সেই কুকুরটা, যাকে সেদিন তুমি গেটের কাছে দেখেছিলে।”

”আবার এসেছে। জানতুম আসবে। ডেকে খাইয়েছ যখন, তখন রোজ আসবে। পেলাসটিকের ওই মগটায় করে জল দাও।”

”খয়েরি মোটেই হ্যাংলা নয়। ও তো আসতেই চাইছিল না। দাদুই তো ওকে সঙ্গে করে আনতে বলল।”

”কত্তাবাবু বলেচেন! ভালই হল। বাগানটা ফাঁকা পড়ে থাকে। রেতে পাহারা দেবে। আটঘরায় আমাদের ময়রা পাড়ায় এই কুঁদো কুঁদো পাঁচ—ছ’টা কুকুর আছে। দিনের বেলা ঘুমোয় আর রেতে জেগে ঘোরাঘুরি করে। চোর—ছ্যাঁচোড় ভয়ে ও পাড়ার ধারেকাছে ঘেঁষে না। কিন্তু পাড়ায় মানুষকে ঠিক চেনে। কিচ্ছু বলে না। কালু দিদি তোমার মতো বয়সে আমার একটা সাদা কুকুর ছিল, নাম রেখেছিনু সায়েব। আমার হাতে ছাড়া কারুর হাতে ভাত খেতনি।” হঠাৎ অপুর মা’র গলা ধরে এল। ”বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি চলে গেনু। সায়েব আমাকে দেখতে না পেয়ে খাওয়া বন্দো করে দিল। তিনদিন খায়নি।” অপুর মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছল। ”বুঝলে গো বড্ড মায়া পড়ে যায়।”

”তারপর ভাতটাত খেত?” কলাবতীর স্বরে উৎকণ্ঠা ফুটে উঠল।

”খাবেনি কেন। তবে আগের মতো আর ছেল না। লাপানি—ঝাঁপনি, চিৎকার চেঁচামেচি কমে গেছল। আমি বাপের বাড়ি এলে তখন সবসময় আমার কাছে কাছে থাকত। বুড়ো হয়ে দু’দিনের অসুখে সায়েব মরে গেল। খবর পেয়ে আমি দু’দিন খেতে পারিনি।” অপুর মা আবার চোখে আঁচল দিল।

”এবার তুমি আমার খয়েরিকে দেখো।”

”দেখব।”

.

নাতনিকে ক্রিকেটের অ আ ক খ শেখাতে গিয়ে রাজশেখরের বয়স যেন পঞ্চাশ বছর কমে গেল। প্রতিদিন কলাবতীর সঙ্গে প্রগতি সঙ্ঘের মাঠে যান। মেয়েদের সঙ্গে থপ থপ করে একপাক দৌড়েই হাঁফিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। ফণী ঘোষকে ঘিরে মেয়েরা দশ মিটার দূরত্বে গোল হয়ে দাঁড়ায়, তাদের সঙ্গে রাজশেখরও থাকেন। ফণী ঘোষ এক—একজনকে রবারের বল ছুড়ে দেন। প্রথম প্রথম বেশিরভাগ মেয়েরই হাতে লেগে বল ছিটকে যেত, রাজশেখরেরও তাই হত। পরে মেয়েরা ক্যাচ ধরাটা রপ্ত করে ফেলে, এমনকী তিনতলা উঁচু বল ছুড়ে দিলে এখন প্রায় সব মেয়েই লুফতে পারে। যারা পারে না ফণী ঘোষ তাদের দেখিয়ে দেন দুটো তালু ক্যাচ ধরার সময় কেমনভাবে রাখতে হবে, শরীরের অবস্থান তখন কেমন হবে আর বারবার বলে দেন বলের থেকে একদম নজর সরাবে না।

বল লোফা, জোরে গড়িয়ে দেওয়া বল ছুটে এসে কুড়িয়ে তুলে ছুড়ে ফেরত দেওয়া আর ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম কিছুদিন করার পর একটি মেয়ে সবার হয়ে একদিন বলল, ”ফণীদা, আমরা কবে ব্যাট করব?”

ফণী ঘোষ ওদের আশ্বস্ত করে বললেন, ”হবে হবে। আগে ব্যাট ধরা, ব্যাট হাতে ক্রিজে দাঁড়ানো, ব্যাট তোলা, এগিয়ে পিছিয়ে বল থামানো এগুলো না শিখলে ব্যাট করা যায় না। তোমাদের কারুর ব্যাট আছে?”

সবাই চুপ, কলাবতীও। দাদুর ছিল পঞ্চাশ বছর আগে। এক বন্ধুর ছেলেকে সেটি দিয়ে দেন খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর।

একটি ছোট্ট মেয়ে বলল, ”আমার দাদার ব্যাট আছে। আমাকে একদম হাত দিতে দেয় না। ছাদে একা—একাই ব্যাট চালায় আর বলে এই দ্যাখ শাস্ত্রীর চাপাটি শট, এই দ্যাখ কপিলদেবের নটরাজ শট।”

ফণী ঘোষ বললেন, ”তুমি যেন এখনি চাপাটি—নটরাজ করতে যেও না। আগে অ—য় অজগর আসছে তেড়ে, তারপর রাখাল অতি সুবোধ বালক, তারপর ঐক্য বাক্য মাণিক্য—এইভাবে ধাপে ধাপে শিখতে হবে।”

কমিউনিটি হলের সামনেটা সিমেন্ট করা একটা চাতালের মতো। ফণী ঘোষ একদিন একটা টেনিস বল আর নিজের ব্যাটটা নিয়ে শুরু করলেন সেই চাতালে ব্যাটিং শেখানো। কয়েক মিনিটেই হতাশ হয়ে পড়লেন। ব্যাটটা ওদের পক্ষে বড়। লম্বা কলাবতী এবং আর একটি মেয়ে ছাড়া আর একজনও ব্যাট সোজা রেখে খেলতে পারছে না। অনেকের পক্ষে ব্যাটটা ভারীও।

ব্যাটিং শেখানো বন্ধ করে ফণী ঘোষ বললেন, ”রবারের বল খেলার জন্য কম দামি ছোট সাইজের চল্লিশ—পঞ্চাশ টাকার ব্যাট দোকানে পাওয়া যায়। তোমরা তাই কিনে আনো।”

তিনদিন পরে একটিমাত্র মেয়ে ব্যাট হাতে এল। একজন জানাল, ”বাবা বলেছে এই তো জুতো, প্যান্ট কিনে দিলুম, এখন আর ব্যাট কিনে দিতে পারবে না।” অন্যরা প্রায় একই ধরনের কথা বলল।

একদিন রাজশেখরের খেয়াল হল শুধু ব্যাট, বল, ফিল্ডিং করে তো একটা টিম খেলতে পারে না, একজন উইকেটকিপারও তো চাই। কথাটা ফণী ঘোষকে বলতে, তারও ভ্রূ কুঁচকে উঠল। ”এটা আমি অনেকদিন আগেই ভেবেছি।” ফণী ঘোষ বললেন, ”গোলকিপারের মতো উইকেটকিপারও জন্মায়। ওদের তৈরি করা যায় না। আমি লক্ষ করেছি তোমার নাতনিটির মধ্যে উইকেটকিপার হওয়ার গুণগুলো আছে, ওকে উইকেটকিপিং প্যাড আর গ্লাভস কিনে দাও আর বাড়িতে প্র্যাকটিস করাও আলাদা ভাবে।”

রাজশেখর অসহায়ভাবে বললেন, ”কিন্তু আমি তো উইকেট কিপিংয়ের বিন্দুবিসর্গও জানি না।”

ফণী ঘোষ বললেন, ”কালীঘাটের মনা ভটচাযকে মনে আছে? গোটা দশেক রঞ্জি ম্যাচে উইকেটকিপ করেছে। এখন লাঠি নিয়ে হাঁটে, বাতে পঙ্গু। টেকনিক্যালি সাউন্ড ছিল। ফিফটি নাইনে পুনা ক্যাম্পে একটা ট্রায়াল ম্যাচে সুভাষ গুপ্তের বলে দাত্তু গায়কোয়াড়ের স্টাম্পিং মিস করে ওর ইংল্যান্ড ট্যুরে যাওয়া হয়নি, গেল নানা জোশি। মনার টেলিফোন নাম্বার দিচ্ছি, ওর সঙ্গে কথা বলে নাতনিকে নিয়ে ওর কাছে যাও। খুব খুশি হবে।”

সেদিনই সন্ধ্যায় রাজশেখর ফোন করলেন মনা ভটচাযকে।

”আমি রাজশেখর সিংঘি বলছি। মনে পড়ছে, টাউন ক্লাবের রাজু সিংঘি।”

মনা ভটচায উচ্ছ্বসিত স্বরে বললেন, ”হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে আছে। ফণী আজ দুপুরে ফোন করেছিল। তোমার নাতনিকে উইকেট—কিপার করতে চাও। এটা তো একটা থ্যাঙ্কলেস জব, তাও আবার মেয়েদের ক্রিকেট! মাঠে খেলা দেখার লোক হয় না, কাগজে রিপোর্টও করে না, আমি তো ভাল করে হাঁটতে পারি না, ওকে নিয়ে কাল বিকেলে আমার বাড়িতে এসো, যা বলার বলে দেব, করে দেখাতে তো পারব না। হাঁটু মুড়তে পারি না, আমার ঠিকানাটা লিখে নাও।”

রাজশেখর ঠিকানা লিখে নিয়ে বললেন, ”কাল বিকেলেই যাচ্ছি। খুঁজে বার করতে অসুবিধে হবে না, পার্ক সার্কাসের ওদিকটা আমার চেনা। আমার ছেলে সতু ডন বস্কোয় পড়ত।”

পরদিন কলাবতী স্কুল থেকে ফিরে পোশাক বদল করেই বেরিয়ে পড়ল। ১৯২৮ সালে তার ঠাকুর্দার বাবার কেনা হুড খোলা লম্বা পাদানি থাকা নিয়মিত ঝাড়মোছ করা ফোর্ড গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসে রাজশেখর, তার পাশে গিয়ে বসল কলাবতী।

রাজশেখর ”পঁক পঁক” শব্দে বল হর্ন বাজাতেই মুরারি ছুটে গিয়ে ফটকের দুটো পাল্লা খুলে দিল। গাড়ি বেরিয়ে গিয়ে থামল। মুরারি আবার ফটক বন্ধ করে গাড়ির পেছনের সিটে এসে বসল। মানিকতলার মোড়ের কাছে রাজশেখর মোটর থামিয়ে পাঞ্জাবির বুক পকেট থেকে একশো টাকার একটা নোট বার করে কলাবতীর হাতে দিয়ে বললেন, ”ওই যে ছোট্ট মিষ্টির দোকানটা দেখছিস, কড়াপাক নিয়ে আয়, মুরারি সঙ্গে যা।”

কলাবতী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ”একশো টাকার?”

জবাব দিল মুরারি, ”তবে না তো কী?”

দোকানের দিকে যাওয়ার সময় মুরারি চাপা গলায় চলল, ”কত্তাবাবু যখন বলে দেননি কত টাকার কিনতে হবে তখন ধরে নেবে সব টাকারই কিনতে হবে।”

দোকানটা সত্যিই ছোট্ট। একটা লম্বা কাচের শো—কেস। ওপরের তাকে স্টিলের ট্রেতে থরে থরে সাজানো সন্দেশ। নীচের তাকে গামলায় রসগোল্লা, রাজভোগ, ছোট একটা ক্যাশবাক্স নিয়ে দেওয়াল ঘেঁষে চেয়ারে বসে শীর্ণকায়, সাদা কদমছাঁট চুল, ফতুয়া গায়ে এক প্রৌঢ় বসে।

মুরারি তাকে বলল, ”নমস্কার ঘোষমশাই, কত্তাবাবু পাঠালেন। কড়াপাক দিন একশো টাকার। উনি গাড়িতে বসে। এই ওঁর নাতনি, দোকানটা চেনাতে পাঠালেন।”

ঘোষমশাই দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন শশব্যস্ত। গাড়ির কাছে এসে দু’হাত জোড় করে দাঁড়ালেন।

রাজশেখর বললেন, ”কেমন আছো গো ফেলু।”

ফেলু ঘোষ জানালেন, ”ভগবান আর আপনাদের দয়ায় ভালই আছি। আপনি ভাল তো? ছোটকর্তার বিয়ে হয়েছে?”

”হলে তো তুমিই আগে জানতে পারতে।”

”সন্দেশটা আজ নেবেন না বড়কর্তা। ছানাটা টিউকলের জলের কাটানো, বরং ক্ষীরের চন্দ্রপুলি আছে, সেটাই দিয়ে দিই।”

”চন্দ্রপুলি! এ আবার জিজ্ঞেস করে? দাও দিয়ে দাও, সন্দেশ থাক।”

এক—একটা পাঁচ টাকা। কুড়িটা চন্দ্রপুলির বাক্স একটা পলিথিন ব্যাগে হাতে ঝুলিয়ে মুরারি কলাবতীকে সঙ্গে নিয়ে ফিরল। মনা ভটচাযের বাড়ি খুঁজে নিতে ওদের অসুবিধে হল না। কোলাপসিবল গেটের পাশে কলিং বেলের বোতাম। গাড়ি থেকে নেমে মুরারি সেটা টিপতেই ভেতর থেকে ভারী গম্ভীর গলায়, ”ঘৌ ঘৌ ঘৌ” শব্দ উঠল। শুনলেই বোঝা যায় বড় বিদেশি কুকুরের ডাক। কেউ একজন চুপ করতে বলছে ওকে। আর কুকুরের ডাক শোনা গেল না।

মুরারি বলল, ”নির্ঘাত বিলিতি কুকুর। তাই এত সভ্য, চুপ করতে বললে চুপ মেরে যায়।”

কলাবতী বুঝল কথাটা খয়েরিকে ঠেস দিয়ে বলা হল। রাতে এক—একদিন ফটকের কাছে গিয়ে রাস্তার দিকে মুখ করে খয়েরি তারস্বরে চিৎকার করে রাস্তার কুকুরদের বাড়ির সামনে থেকে তাড়ায়। মুরারির ধমকানিকে সে তখন গ্রাহ্য করে না।

ভেতর থেকে গেটে এসে যে দাঁড়াল তাকে দেখেই বোঝা যায় সে এই বাড়ির মুরারি। গাড়িতে বসেই রাজশেখর ভারী গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ”এটা কি মণীন্দ্র ভটচাযের বাড়ি?”

”আজ্ঞে হ্যাঁ।”

”আছেন?”

”আজ্ঞে হ্যাঁ। অপেক্ষা করছেন।”

কলাবতী বুঝল, তারা যে আসবে সেটা বলে রাখা আছে। মুরারি পলিব্যাগটা হাতে নিয়ে দু’জনের পেছনে থেকে বাড়ির মধ্যে ঢুকে বৈঠকখানায় দরজা পর্যন্ত এসে ব্যাগটা কলাবতীর হাতে দিয়ে গাড়িতে ফিরে গেল।

”এসো, রাজু, এসো, কতকাল পরে—” মনা ভটচায সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন লাঠিতে ভর দিয়ে, দু’হাত বাড়ালেন। মাঝারি উচ্চচতা, টাক মাথা, বড় ভুঁড়ি, থলথলে চেহারা। কলাবতী হতাশ হল প্রাক্তন উইকেটকিপারের বপু দেখে। রাজশেখর ওকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ”তা তিরিশ—পঁয়ত্রিশ বছর তো হল।”

কলাবতী চন্দ্রপুলির বাক্স ভরা ব্যাগটা টেবলে রেখে মনা ভটচাযকে প্রথমে তারপর দাদুকে প্রণাম করল।

”এই বুঝি নাতনি, কী নাম গো তোমার?”

”কলাবতী সিংহ।”

”উইকেটকিপিং শিখবে? কিন্তু আমি তো ভাই, দেখছই, নড়াচড়া করতে পারি না লাঠি ছাড়া। এটা কী আনলে?”

পলিব্যাগ থেকে বাক্সটা বার করে রাজশেখর বললেন, ”তোমাকে কালুর প্রণামী—চন্দ্রপুলি। খেয়ে দেখো।”

”চন্দ্রপুলি! ওহহ, এ তো আজকাল চোখেই দেখা যায় না। খোঁজ করেছি, আমাদের এদিককার একটা দোকানেও নেই। নারকেলের মিষ্টি খাওয়ার লোক নাকি এখন আর পাওয়া যায় না।”

গলায় চাপা গর্ব মাখিয়ে রাজশেখর বললেন, ”থাকবে কী করে, এসব পুরনো কলকাতার আদি জিনিস। সকালবেলায় মাথায় হাঁড়িতে চন্দ্রপুলি, তিলকূট নিয়ে হাজির হত কেশবচরণ। বাবা খুব খেতেন। তাঁর কাছ থেকেই খাওয়াটা শিখেছি।”

”পুরনো কলকাতা, আমাদের ছোটবেলার দিনকালের কথা, রাজু, মাঝে মাঝে ভাবি। আর অবাক হয়ে যাই। তোমার কি মনে আছে ইডেন গার্ডেনস আগে কীরকম ছিল? দেবদারু গাছে ঘেরা খোলা মাঠ। গঙ্গা থেকে বয়ে আসত বাতাস, কাঠের প্যাভিলিয়ন, বিরাট একা গোল ঘড়ি, তার তলা দিয়ে প্লেয়াররা মাঠে নামত। একটা কাঠের দোতলা স্কোর বোর্ড, তার একতলায় ছোট একটা ট্রেডল মেশিন নিয়ে ছাপাখানা, সেখানে স্কোর কার্ড ছাপা হত খেলা শুরুর আগে, লাঞ্চের সময় আর টি—এর সময় স্কোর ছাপা কার্ড বিক্রি হত। মোটা কাছির রোপ—এর ধারে ঘাসে হাত—পা ছড়িয়ে বসে আমি জীবনে প্রথম রঞ্জি ট্রফি ম্যাচ দেখি। মেজোকাকা নিয়ে গেছলেন তখন আমার বয়স বারো বছর।” একটানা বলতে বলতে মনা ভটচায ষাট বছর পিছিয়ে গিয়ে তার প্রথম দেখা রঞ্জি ম্যাচটাকে চোখের সামনে ভাসিয়ে তোলার চেষ্টায় চোখ মুছলেন। কলাবতী লক্ষ করল তার দাদুর চোখ অন্যমনস্কের মতো মনা ভটচাযের হাতের লাঠিতে তাকিয়ে।

”মনা, সেটায় বেঙ্গল খেলেছিল কার সঙ্গে বলো তো?”

”সেন্ট্রাল ইন্ডিয়ার সঙ্গে।”

”আরে আমিও তো ম্যাচটা দেখেছি। তিনদিনের ম্যাচ আড়াই দিনেই শেষ, থার্ড ডে লাঞ্চের পর। মুস্তাক আলির ওভারের শেষ বলে এক রান নিয়ে কার্তিক বোস এ—ধারে এল। বেঙ্গলের তখন জিততে দুটো রান দরকার, হাতে আটটা উইকেট। ক্যাপ্টেন ওয়াজির আলি বল করতে এল। কার্তিক বোস পুল করলে শর্ট স্কোয়্যার লেগে বিজয় হাজারে বলটা থামাল। পরের বলেই লেট কাট—বল থার্ডম্যান বাউন্ডারিতে যাচ্ছিল, ভায়া পয়েন্ট থেকে ছুটে গিয়েছিল বলটা ধরতে। অ্যালেক হোসি চিৎকার করে বলছিল, ‘বোস রান।’ ছুটে ওরা দুটো রান নেয়। ভায়া বলটা উইকেটকিপারের হাতে ছুড়ে দেওয়ার আগেই।” বলতে বলতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল রাজশেখরের মুখ। কলাবতী ভাবল, ছোটবেলা কী অদ্ভুত সময়, এত বছর পরও দুই বুড়ো হুবহু সব মনে রেখেছে। তাকেও সব মনে রাখতে হবে, এদের কথাবার্তাও। কে হাজারে, কে মুস্তাক আর ওয়াজির আলি সে জানে না তবে দাদু যেরকম সম্ভ্রম করে নামগুলো উচ্চচারণ করলেন তাতে তার মনে হল তিনজন খুবই বড় খেলোয়াড় ছিলেন।

”জানো রাজু, এই ম্যাচ দেখেই আমার ইচ্ছে হয়, উইকেটকিপার হব। বাংলার কিপার ছিল ভ্যান্ডারগুচ সাহেব। রোগা, সাড়ে ছ’ফুট লম্বা। মনে হত একটা সারস উইকেটের পেছনে উবু হয়ে বসে। ফার্স্ট ইনিংসে সুঁটে ব্যানার্জির বলে হাজারের যে ক্যাচটা ডান দিকে ঝাঁপিয়ে নিল, দেখে মনে হয়েছিল সারস উড়ল। সেকেন্ড ইনিংসে হাজারেকে স্টাম্পড করল টম লংফিল্ডের মিডিয়াম পেস বলে, ভাবতে পারো! আর একটা স্টাম্পড করল কমল ভটচাযের বলে ওয়াজির আলিকে।” বৃদ্ধ মনা ভটচায উৎসাহে উঠে দাঁড়ালেন লাঠি না ধরেই। রাজশেখর তাকে টেনে বসালেন।

”বোসো তো, মনা তোমার স্মৃতিশক্তি কেমন এবার তার পরীক্ষা নেব। বলো তো ওই ম্যাচে ক’টা বাঙালি খেলেছিল? বাংলা আট উইকেটে জিতে পরে কার সঙ্গে খেলে?”

মনা ভটচায মুখভরা হাসি নিয়ে বললেন, ”এ আর বলতে পারব না, ম্যাচটা হয়েছিল জানুয়ারির গোড়ায় আর পরের ম্যাচ জানুয়ারির শেষে ইডেনেই হায়দরাবাদের সঙ্গে, সেটা রঞ্জি সেমিফাইনাল। আর সেন্ট্রাল ইন্ডিয়ার সঙ্গে ম্যাচে তো বাঙালি ছিল। কার্তিক বোস, কমল ভটচায আর সুঁটে ব্যানার্জি, তিনজন। এ কামাল নামে একজন ছিল, তবে বাঙালি নয়। পরের ম্যাচেও ছিল এই তিন বাঙালি, আর এক সাহেবকে বাদ দিয়ে এল সুশীল বোস, চারজন।”

”এই হায়দরাবাদ ম্যাচেই বাংলার পক্ষে প্রথম একটা ব্যাপার হয়েছিল, বলতে পারো সেটা কী? আমার অবশ্য তখন অতশত বোঝার মতো বয়স ছিল না, পরে বাবার কাছে শুনি।” রাজশেখর মিটমিট হেসে তাকিয়ে রইলেন মনা ভটচাযের দিকে। তিনি চোখ কুঁচকে মুখ তুলে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। দশ সেকেন্ড পর মুখ নামিয়ে আনলেন চন্দ্রপুলির বাক্সে। আনমনে বাক্সের ঢাকনা রাবার ব্যান্ড থেকে মুক্ত করে খুললেন। কিশমিশ বসানো আধফালি চাঁদের মতো থাক দেওয়া পুলির একটা তুলে তিনি রাজশেখরের দিকে এগিয়ে ধরলেন। রাজশেখর আড়চোখে লাজুক ভাবে নাতনির দিকে তাকিয়ে চন্দ্রপুলিটা হাতে নিলেন। কলাবতী আগে কখনও এইভাবে কারও হাত থেকে দাদুকে খাবার জিনিস নিতে দেখেনি।

বাক্সটা কলাবতীর সামনে ধরে মনা ভটচায বললেন, ”নাও।” সে দাদুর দিকে তাকাল।

রাজশেখর তখন চন্দ্রপুলিতে কামড় দিচ্ছেন। মাথা নেড়ে বললেন, ”তুলে নে। ফেলু ঘোষ দারুণ বানিয়েছে। মনা তুমিও তোলো।”

কলাবতী চন্দ্রপুলি তুলে নিয়ে তার একটা কোণ দাঁতে কাটল। মিহি করে বাটা নারকেল, ছানা আর ক্ষীর দিয়ে তৈরি পুলি মুখের মধ্যে দিয়ে চুষতেই মিলিয়ে গেল। কলাবতী অবাক হয়ে ভাবল, এমন একটা জিনিস আগে কখনও কেন খাইনি! সে অন্য দু’জনের দিকে তাকাল। মনা ভটচাযের হাতেরটা আধখানা, দাদুর হাত শূন্য।

”রাজু বসে আছ কেন, হাত চালাও।” নিজেরটা শেষ করে মনা ভটচায বাক্সের দিকে হাত বাড়ালেন। ”আমি কিন্তু আর খাব না, ডায়বিটিসটা একটু বেশির দিকেই।”

”মনা, আমার প্রশ্নের জবাবটা কিন্তু এখনও পেলাম না।”

”দেব, দেব, একটু ভাবতে দাও। নাও, আর একটা তোলো। কলাবতী লজ্জা কোরো না। আর একটা নাও। এত চন্দ্রপুলি খাবে কে? বাড়িতে তো আমি আর আমার বউ, তিনি তো মেয়ের বাড়ি গেছেন।…নাহ মনে পড়ছে না, তুমিই বলো।” মনা ভটচায হাল ছেড়ে দিলেন।

”ওই এ কামাল একটা সেঞ্চুরি করেছিল, ন’নম্বরে ব্যাট করতে নেমে। বাংলার পক্ষে ওটাই প্রথম রঞ্জি সেঞ্চুরি।”

”হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়ছে রাজু। সুঁটে ব্যানার্জি ছিল দশ নম্বরে। দারুণ একটা স্ট্যান্ড দিয়েছিল কামালকে। সুঁটেদা নট আউট ছিল, তিন রানের জন্য হাফ সেঞ্চুরিটা হয়নি। কী, ঠিক বলেছি?” মনা ভটচাযের মুখ ঝলমল করে উঠল নিজের স্মৃতিকে আবার সবল করে তুলতে পেরে। ”আরও বলছি, বাংলা সেই প্রথম ফাইনালে উঠে খেলতে গেল বোম্বাইয়ে নওনগরের সঙ্গে। ভিনু মানকাদ তখন অল্পবয়সী ছেলে। কী মারটাই না দিল বেঙ্গলের বোলারদের। প্রথম দিনেই একশো পঁচাশি করে কমল ভটচাযের বলে ক্যাচ আউট হল। কাগজে মানকাদের ছবি দেখেছি। ব্লেজার পরা, গলায় সিল্কের স্কার্ফ। তখন ওটাই স্টাইল ছিল।” কথা শেষ করে মনা ভটচায বাক্সের দিকে হাত বাড়ালেন, রাজশেখরও পিছিয়ে রইলেন না।

”রোজ সকালে কাগজ এলেই ঝাঁপিয়ে পড়তুম। চারদিনের ম্যাচটা যেন চার ঘণ্টায় শেষ হল বলে তখন মনে হয়েছিল।” রাজশেখর স্মৃতি এবং চন্দ্রপুলি রোমন্থন করতে করতে বললেন। ”মনা, তোমার ভ্যান্ডারগুচ ফাইনালে ছিল বাংলার ক্যাপ্টেন, আর নওনগরের ক্যাপ্টেন ছিল আর এক সাহেব, যার কাছে মানকাদ বোলিং শিখেছিল, বার্টি ওয়েন্সলি। ফার্স্ট ইনিংসে ভ্যান্ডারগুচ দারুণ ব্যাট করে প্রায় আশি রান করেছিল। তবু বাংলা একশোরও বেশি রানে পিছিয়ে পড়েছিল। সেটা খানিকটা সামলায় সেকেন্ড ইনিংসে স্কিনার সাহেব একটা সেঞ্চুরি করায়। তবু আড়াইশোর মতো রানে বাংলা হেরেছিল।”

মনা ভটচাযের সঙ্গে রাজশেখরেরও চোখে বিষাদের ছায়া পড়ল। কলাবতীর মনে হল দু’জনে যেন বোম্বাইয়ে মাঠের ধারে বসে এই মাত্র বাংলাকে হেরে মাঠ থেকে ফিরতে দেখছেন।

রাজশেখর বললেন, ”সুঁটে ব্যানার্জি খেললে অবশ্য শেষ পর্যন্ত কী হত বলা যায় না। নওনগর ওকেই ভয় পাচ্ছিল তাই জামসাহেব ভাল চাকরির টোপ দিয়ে ওকে ফাইনালের ঠিক আগেই তুলে নিয়ে গেল। সুঁটে বলল ফাইনালে বাংলার এগেনস্টে খেলব না। জামসাহেব বলল, ঠিক আছে তবে বাংলার পক্ষেও খেলতে পারবে না। তখন তো এখনকার মতো আইনের বাঁধাবাঁধি ছিল না। যখন—তখন স্টেট বদল করা যেত।”

ওদের কথাবার্তা শুনতে শুনতে কলাবতী একঘেয়ে বোধ করল। দু’জনে যেসব ঘটনার কথা বলে যাচ্ছে তার কিছুই সে বুঝতে পারছে না। কে মানকাদ, কে স্কিনার, কে সুঁটে, তারা কেমন খেলত তার বিন্দুবিসর্গ সে জানে না। তাদের কথা শুনতে তার একটুও আগ্রহ হচ্ছে না। বরং যেজন্য তার এখানে আসা সেই উইকেটকিপিং নিয়ে তো একটা কথাও এখন পর্যন্ত হল না।

এই সময় বাইরের দরজায় বেল বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ”ঘৌ ঘৌ” ডাক শোনা গেল। মনা ভটচায ঘর থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন, ”কোয়ায়েট, কোয়ায়েট।” ডাক থেমে গেল।

কৌতূহলে কলাবতী বলল, ”মনাদাদু, আপনার কুকুরটা কোন জাতের।”

”ডোবারম্যান।” মনা ভটচায ভারী গলায় জানালেন।” ”এক বছর বয়স, দেখতে চাও যদি দেখে এসো, এই পাশের প্যাসেজেই বাঁধা আছে।”

কলাবতী ঘর থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে উঠোন, তার ধার ঘেঁষে সাদা পাথরের একটা রোয়াকে ভেতর দিকে চলে গেছে দোতলার সিঁড়ি পর্যন্ত। তার মনে হল সিঁড়ির পেছনে অন্ধকারপ্রায় জায়গাটায় কুকুরটা বোধ হয় বাঁধা রয়েছে। সে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। একটা ”গরর গরর” আওয়াজ শুনেই সে আর এগোল না। উঁকি দিতেই চোখাচোখি হল কুকুরটার সঙ্গে। লম্বা পা, ছিপছিপে কিন্তু স্বাস্থ্যবান, চকোলেট রঙের শরীর, লোম মখমলের মতো ঝকঝকে, ল্যাজটা কারা। দুটো চোখের ঠাণ্ডা চাহনির আড়ালে যেন ভর করে রয়েছে নিষ্ঠুরতা। ভয়ে গা শিরশির করল কলাবতীর। মোটা চেন দিয়ে বাঁধা থাকলেও সে আর কাছে গেল না।

তার মনে পড়ল খয়েরিকে। কাকার কাছে তো কত মক্কেলই আসে, সবাই খয়েরির অচেনা। গেট থেকে বাড়ির সদরের মধ্যের রাস্তাটায় ও বসে বা শুয়ে থাকে। অচেনা লোকেরা ওর পাশ দিয়ে নির্ভয়ে যাতায়াত করে। একদিন সকালে সে গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখেছিল এক মক্কেল গেট দিয়ে ঢুকে ওকে দেখে অস্বস্তিতে দাঁড়িয়ে পড়ল। খয়েরি এখন অপুর মার যত্নে নাদুসনুদুস তাগড়াই হয়ে উঠেছে। নতুন কেউ ওকে প্রথম দেখলে ভয় পাওয়ারই কথা। কিন্তু আশ্চর্য ওর বোধশক্তি, ঠিক বুঝে যায় কে ভাল আর কে দুষ্টু লোক। সেদিন মক্কেলটি আড়ষ্ট হয়ে যেতে খয়েরি একটু একটু ল্যাজ নেড়ে জানিয়ে দিল, ভয় নেই গো আমি কামড়াব না। লোকটি তারপর সদর দরজার দিকে এগোলে খয়েরি তার পিছু নিয়ে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসে।

কলাবতী ঘরে ফিরে আসতেই মনা ভটচার্য জিজ্ঞেসা করলেন, ”কেমন দেখলে?”

”দারুণ। এত ভাল কুকুর আমি আগে দেখিনি।” কলাবতী গলায় আন্তরিকতা ঢেলে দিয়ে বলল।

”সে কী দেখোনি! কলকাতায় বহু লোকই তো পুষছে। যেমন ইন্টেলিজেন্ট তেমনই ফেরোসাস আবার ডিসিপ্লিনডও। দেখলে তো, বেল বাজতেই ডেকে উঠল, আবার ‘কোয়ায়েট’ বলতেই চুপ করে গেল। আমি খুব সস্তায়ই পেয়েছি, তিন হাজারে।”

”আপনি ওকে আদর করেন?”

”আমি! না না, আমার কাজের লোক মৃত্যুঞ্জয় ওকে দেখাশোনা করে, খেতেটেতে দেয়। অ্যাঞ্জেলার গায়ে ও ছাড়া আর কেউ হাত দেয় না, দিতে দেয় না।”

কলাবতীর মনে পড়ল পুরনো খবরের কাগজ বিক্রি করার জন্য মুরারিদা একটা লোককে ডেকে এনেছিল। তার পিঠে ছিল থলি। ওজন করে সেগুলো থলিতে ভরে, মুরারিদার হাতে টাকা দিয়ে লোকটি থলি কাঁধে যখন বেরিয়ে যাচ্ছে তখন কোথা থেকে খয়েরি ঘেউ ঘেউ করে ছুটে এল লোকটার দিকে। ভয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। খয়েরিও তার তিন হাত দূরে থেমে গিয়ে হিংস্রভাবে ডেকে যেতে লাগল। মুরারিদা চেঁচিয়ে লোকটিকে আশ্বাস দিয়ে বলল, ”ভয় পেও না, এ হচ্ছে নেড়িকুত্তা, এরা থলে হাতে লোক দেখলেই অমন করে ছুটে আসবে। আস্তে আস্তে গেটের দিকে এগিয়ে দাও।” লোকটি তাই করল। খয়েরি চিৎকার করতে করতে গেট পর্যন্ত গেল কামড়াবার ভয় দেখাতে দেখাতে, কিন্তু কামড়ায়নি।

কলাবতী একতলার ঘরের জানলা থেকে সব দেখছিল। মুরারির তাচ্ছিল্যে বলা ‘এ হচ্ছে নেড়িকুত্তা’ শুনে তার মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠেছিল। ছুটে বেরিয়ে এসে সে খয়েরির গলার বকলস ধরে তাকে এলোপাতাড়ি চড়চাপড় মারতে মারতে ‘নেড়ি, নেড়িকুত্তা’ বলে চেঁচিয়ে যেতে লাগল। খয়েরি প্রথমে অকারণ প্রহারে হকচকিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে ‘আঁউ আঁউ’ শব্দ করে কলাবতীর হাত ছাড়িয়ে পালাতে চাইল। কিন্তু এত শক্ত করে কলাবতী বকলসটা ধরে ছিল যে, সে পারল না। এক্ষেত্রে অন্য কুকুর হলে মুখ ঘুরিয়ে কলাবতীর কবজির কাছে হাতটায় কামড় দিত। তা না করে খয়েরি তার পা মাটিতে ছড়িয়ে বসে পড়ে মাথায় পিঠে চড় খেয়ে যেতে লাগল আর ”উঁ উঁ” আওয়াজ করে গেল। মুরারি ছুটে এসে কলাবতীর হাত চেপে ধরে বলল, ”করছ কী কালুদিদি, থামো।” কলাবতী তখন বকলস ছেড়ে দেয়। ছাড়া পেয়েই ছুটে ফটক দিয়ে বেরিয়ে যায় রাস্তায়।

রাত্রে অপুর মা ফটকের বাইরে থেকে খয়েরিকে বকলস ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসে।

”কালুদিদি এই নাও তোমার খয়েরিকে। রাগ করে ফটকের বাইরে বসে ছিল। ওকে তুমি নিজে হাতে খেতে দাও। মুরারিদা বলল, তুমি নাকি ওকে চোরের মার মেরেছ। করেছিল কী?”

”কিছু নয়। ও কেন বিলিতি কুকুর হয়ে জন্মাল না। তা হলে সবাই ওকে খাতির করত, ভয় পেত, ওকে ‘নেড়ি’ বলে তাচ্ছিল্য করার সাহস পেত না।” কলাবতী ঝাঁঝালো স্বরে বললেও, গলায় ছিল অভিমান আর অকারণে মারার জন্য অনুশোচনা।

কলাবতী সেদিন রাতে নিজের হাতে রুটি খাইয়েছিল এক হাতে খয়েরির গলা জড়িয়ে ধরে। খাওয়ার পর তার হাতটা বাড়িয়ে দেয় খয়েরির দিকে চাটার জন্য। অবশ্যই সে চেটেছিল, কেননা এভাবেই সে আদর জানায়।

গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছিলেন রাজশেখর। তিনি পাশে দাঁড়ানো সত্যশেখরকে তখন বললেন, ”ঠিক যেন মা আর মেয়ে।”

.

কলাবতী অন্যমনস্ক হয়ে গেছল খয়েরির কথা ভাবতে—ভাবতে। মনা ভটচাযের কথায় তার হুঁশ ফিরে এল।

”তুমি পুষবে? অ্যাঞ্জেলার বাচ্চচা হলে তোমায় একটা দেব।”

”দরকার নেই, আমার আছে।” কলাবতী ছোট্ট জবাব দিয়ে হাসল।

”বটে, বটে, কী জাতের?” মনা ভটচায উৎসাহী হয়ে উঠলেন।

”নেড়ি।”

মনা ভটচাযের মুখ দেখে কলাবতীর মনে হল এমন জাতের নাম কখনও শোনেননি। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলেন।

”ওকে কিনতে হয়নি। নিজের থেকেই এসেছে। ওকে বেঁধে রাখা হয় না, ও বাঁধা থাকতে চায় না। যে কেউই ওর গায়ে হাত দিতে পারে।” চাপা একটা গর্ব কলাবতীর স্বরে ফুটে উঠল। রাজশেখর প্রসঙ্গটা ঘোরাতে বলে উঠলেন, ”মনা, যেজন্য আসা। তুমি কালুকে কিছু টিপস দাও, যাতে ও উইকেটকিপার হতে পারে।”

”দ্যাখো, আমাদের সময়ে এখানকার মতো কোচিংটোচিং ছিল না। ব্যাট বা বলের জন্য তবু কোচ পাওয়া যেত কিন্তু উইকেটকিপারদের জন্য কিছুই ছিল না। একটু—আধটু যেটুকু শেখার শিখেছি ভাল উইকেটকিপারদের দেখে দেখে। আর বাকি বেশির ভাগটাই নিজের বোধবুদ্ধি দিয়ে আর অনবরত প্র্যাকটিস করে করে। উইকেটকিপিংয়ের ছকবাঁধা কোনও নিয়ম নেই। সুভাষ গুপ্তের বলে কোনদিকে কীভাবে ক্যাচ উঠবে কেউ জানে না; মুহূর্তের জন্যও কনসেনট্রেশন হারাবে না, বল থেকে চোখ সরাবে না। দিনে পঞ্চাশ ওভারের খেলায় একস্ট্রা বল বাদ দিয়ে তিনশো বল করা হয়, তার মানে তিনশো ওঠবোস। এজন্য আগে পায়ের, কোমরের জোর চাই। সারা ইনিংসে পাবলিক তোমার কথা ভুলে থাকবে, যেই একটা ক্যাচ কি স্টাম্প মিস করবে তখন তাদের তোমাকে মনে পড়বে আর সাতদিন ধরে খোঁটা শুনে যেতে হবে। আর একটা শক্ত ক্যাচ নিলে বা স্ট্যাম্প করলে জুটবে শুধুমাত্র কিছু হাততালি। যাক তোমাকে এইসব বলে নিরুৎসাহ করব না। দেখি তো উইকেটের পেছনে তুমি কীভাবে স্টান্স নাও।”

কলাবতী ঘরের ফাঁকা জায়গায় গিয়ে উবু হয়ে বসে, দু’পায়ের ফাঁকে মেঝের ওপর দুই হাতের মুঠি ঠেকিয়ে রাখল ঠিক সেইভাবে টিভি—তে যেরকমটি দেখেছে দেশি ও বিদেশি উইকেটকিপারদের। মন ভটচায চোখ দুটো সরু করে ওর বসার ভঙ্গি দেখে বললেন, ”নড়াচড়া চট করে করতে তোমার সুবিধে হয় এমনভাবে বসবে। পা দুটো অত কাছে রাখলে ডাইনে কি বাঁয়ে কুইক সরে যেতে পারবে না, দেরি হয়ে যাবে। আর বাটিংয়ের সময় যেমন স্টান্স নেয় তেমনই শরীরের ভর থাকবে পায়ের পাতার সামনের দিকে, গোড়ালি দুটোর ওপর ভর থাকলে ফুট ওয়ার্কে দেরি হয়ে যাবে। আচ্ছা এবার গ্লাভসে বলধরাটা দেখি।”

কলাবতী দু’হাতের চেটো পাশাপাশি জড়ো করে দেখাল।

”আঙুলগুলো আর একটু ফাঁক করে বল জমানোর জায়গাটা বড় করো আর একটা হাতের কড়ে আঙুলের ওপরে অন্য কড়ে আঙুলটা রাখলে বল গলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। আঙুল কখনও বল রিসিভ করার সময় বলের দিকে উঁচিয়ে রাখবে না, গ্লাভস জোড়া পেতে রাখবে, বলটাকে গ্লাভসে আসতে দেবে, জমা পড়লে হাত পেছন দিকে টেনে নিয়ে বলটা জমতে দেবে।” বলার সঙ্গে সঙ্গে মনা ভটচায সোফায় বসেই যথাসাধ্য দেখালেন। ”তোমাকে কিন্তু প্যাড আর গ্লাভস পরে বাড়িতে দু’হাত দিয়ে বল ধরার জন্য ডাইনে—বাঁয়ে ঝাঁপিয়ে পড়াটা প্র্যাকটিস করে যেতে হবে। প্রথমে ক্যাম্বিস কি রবারের বলেই কোরো, তারপর ক্রিকেট বলে।”

কলাবতী মন দিয়ে শুনল। রাজশেখর জানতে চাইলেন, ”মনা এই যে বললে যেটুকু শিখেছি দেখে দেখে। কাকে দেখে শিখেছিলে।”

”খোকনদাকে।”

কলাবতী জিজ্ঞেসা করল, ”কে খোকনদা?”

রাজশেখর জানালেন, ”প্রবীর সেন, ডাকনামেই সবাই চিনত। প্রথম বাঙালি যিনি টেস্ট ম্যাচ খেলেন তাও আবার অস্ট্রেলিয়ার ব্র্যাডম্যানের টিমের এগেনস্টে।”

কলাবতী এবার লক্ষ করল বাক্সে চন্দ্রপুলি তলানিতে এসে ঠেকেছে। দুই বুড়োই কথার সঙ্গে মুখ চালিয়ে গেছে। সে হাত বাড়িয়ে বাক্সের ঢাকনা বন্ধ করে বলল, ”মনা দাদুর জন্য এনে তুমি নিজেই শেষ করে দিচ্ছ, আর নয়।”

বিব্রত এবং লজ্জিত রাজশেখর বললেন, ”শুনলি না মনা বলল ওর ডায়বিটিসটা বেশির দিকে, তাই যাতে আর বেশির দিকে না যায় সেজন্য চন্দ্রপুলি কমিয়ে দিলুম। বাড়িতে তো খাবার লোক নেই।”

.

ফণী ঘোষ সমস্যায় পড়েছেন। বোধ হয় মেয়েদের কোচিং করা আর সম্ভব নয়। ক্রিকেটের মতো খরচের খেলার জন্য প্রাথমিক যা—যা দরকার—বুট, ট্রাউজার্স, ব্যাটিং গ্লাভস, সম্ভব হলে নিজের ব্যাট এগুলো কিনে দেওয়ার মতো আর্থিক অবস্থা দু—তিনজন ছাড়া কোনও মেয়ের পরিবারের নেই। প্রগতি সঙ্ঘ তাদের মাঠ ব্যবহার করতে দিচ্ছে, তিনটে স্টাম্প, পুরনো একজোড়া ব্যাটিং প্যাড, গ্লাভস, দুটো পার্চমেন্ট মোড়া ফাটা প্র্যাকটিস ব্যাট আর দুটো পুরনো ক্রিকেট বল, যা বহুবার ব্যবহারে নরম এবং ফুলে বড় হয়ে গেছে, মেয়েরা পাঁচ আঙুলে ভাল করে ধরতে পারে না। প্রগতি সঙ্ঘের আর্থিক অবস্থাও ভাল নয়। সিনেমা শো, যাত্রাপালা, দুর্গাপুজোর সুভেনিরের বিজ্ঞাপন ও কয়েকজন ডোনারের টাকায় তাদের নেতাজি ও রবীন্দ্র জন্মোৎসব এবং ফুটবল ও ক্রিকেট বিভাগ চলে। সিজনের সময় একজন পার্ট টাইম মালী রাখা হয়। স্থানীয় কাউন্সিলারের বদান্যতায় দুর্গাপুজোর পর কর্পোরেশনের রোড রোলার এসে মাঠের মাঝখানটা রোল করে দেয়। সারা সিজন তাতেই চলে যায়। ম্যাচের দিন লাঞ্চের পাউরুটি—আলুর দম দেওয়া হয় কোয়ার্টার থেকে চাঁদা তুলে।

ক্লাবের সচিব তপন তরফে তপা বাগচি পরিশ্রমী এবং কাটখোট্টা ধরনের মানুষ। একদিন ফণী ঘোষকে বললেন, ”ফণীদা, মেয়েদের কাছ থেকে চাঁদা তুলুন। ওদের বলুন বিনা পয়সায় কিছু শেখা যায় না। ক্লাবই সব দেবে তা তো হয় না, স্কুলে পড়ার জন্য মাইনে দিতে পারে, ক্লাবে শেখার জন্য চাঁদাও দিতে হবে। ছেলেদের ব্যাট প্যাড গ্লাভস বেশিরভাগ মেয়েরই তো দেখছি ভারী হয়ে যাচ্ছে, ওরা তো ব্যাট তুলতেই পারছে না, প্যাড পরে ছুটতেও পারছে না। সবকিছুই একটু ছোট সাইজের কিনতে হবে, সেজন্য টাকার দরকার। যেমন—তেমন একজোড়া ব্যাট, দু’জোড়া করে প্যাড আর গ্লাভস কিনতেই তো আড়াই—তিন হাজার টাকা লাগবে। তার ওপর আছে বল। এতসব দেওয়া আমার ক্লাবের পক্ষে সম্ভব নয়, আপনি টাকা তুলুন, ডোনার খুঁজুন।”

ফণী ঘোষ অতঃপর স্থির করলেন যে—ক’টি মেয়ে এখনও আছে তাদের বাবা—মায়ের সঙ্গে কথা বলবেন, চারশো টাকা করে প্রত্যেকের কাছে চাইবেন। চারদিন ধরে তিনি তিনজন বাবা, একজন দাদু, একজন মায়ের সঙ্গে কথা বললেন। বাবারা সোজা বলে দিলেন, দিতে পারবেন না। একজন বাবা বললেন, ”ভেবে দেখি। ক্রিকেট খেলতে গিয়ে লেখাপড়ার কতটা ক্ষতি হবে সেটা তো আগে ভেবে দেখা দরকার।”

আর একজন বললেন, ”প্রাইভেট টিউটরের মাইনে, তার ওপর ক্রিকেটের খরচ। না দাদা, পারব না।”

এক মা বললেন, ”অত শক্ত বলে খেলা! সেদিন মেয়ের আঙুলে বল লাগল, আজ তিনদিনেও ভাল করে আঙুল বাঁকাতে পারছে না। কলম ধরতে পারছে না। না বাপু ক্রিকেট খেলে কাজ নেই তার থেকে বরং টেনিস—মেনিস খেলা শেখাতে পারেন যদি তার ব্যবস্থা করুন। সেদিন টিভি—তে স্টেফিকে দেখছিলুম, কী সুন্দর যে লাগছিল। আপনি ডোনেশনের জন্য ভাববেন না।”

দাদু বললেন, ”ক্রিকেট খেলে কী হবে, মেয়েদের ক্রিকেটে কি টাকা আছে? চাকরি পাওয়া যাবে? ছেলেদের যত নাম বেরোয় কাগজে কই মেয়েদের নাম তো দেখি না? না মশাই, টাকাফাকা দিতে পারব না, যতটুকু শিখেছে তাই যথেষ্ট।”

অবশ্য একজন বাবা এককথার দিতে রাজি হলেন, আর একজন বললেন, ”জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে একটু টানাটানির মধ্যে পড়ে গেছি। বড় জামাইবাবুর বাইপাস সার্জারিতে অনেক টাকা দিতে হল। হাত এখন একদম খালি। তবে মাসে পঞ্চাশ টাকা করে চার মাসে দিতে পারি।”

ফণী ঘোষ আর কোনও অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলতে উৎসাহ বোধ করলেন না। সকালে মেয়েরা মাঠে আসতে তিনি তাদের জড়ো করে বললেন, ”ক্রিকেট কী করে খেলতে হয় সে সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা আশা করি তোমাদের হয়েছে। একদমই খেলতে জানতে না, এখন তবু ব্যাট ধরা, বল করা, ফিল্ড করাটা তোমরা শিখেছ। এটা হল ভিত। এর ওপর একতলা, দোতলা তৈরি করতে করতে উঁচু বাড়ি তৈরি করা। এজন্য আসল ক্রিকেট সরঞ্জাম নিয়ে আসল প্র্যাকটিস করে যেতে হবে। সেই জিনিসগুলো পেতে হলে টাকা দিয়ে কিনতে হবে, কিন্তু টাকা আমাদের নেই। আমি চেষ্টা করেছি টাকা জোগাড়ের। তা তো তোমরা জানোই। তোমাদের বাড়ি বাড়ি গেছি কিন্তু—” ফণী ঘোষ মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেলেন। তিনি নিজেও বিষণ্ণ বোধ করছেন। উৎসাহে টগবগ করা, খেলা শিখে বড় খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন দেখা উজ্জ্বল চোখগুলিকে ঝিমিয়ে যেতে দেখে তার মন দুঃখে ভরে গেল।

মেয়েদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল কলাবতীও। শুনে তারও মন খারাপ হয়ে গেল, শুধু টাকার অভাবে ক্রিকেট খেলার এই সুযোগটা, এত মেয়ের বন্ধুত্ব তাকে হারাতে হবে ভেবে। ক্রিকেট তো একা খেলা যায় না, একটা দল থাকতে হবে। দল না থাকলে তার খেলাও নেই। সেই দল গড়ে উঠছিল কিন্তু গড়ার মুখেই ভেঙে যেতে বসেছে।

সে জিজ্ঞেস করল, ”ফণীদা, কত টাকা হলে আমাদের আসল প্র্যাকটিস শুরু করা যাবে?”

ফণী ঘোষ মুখে ক্ষীণ ফুটিয়ে বললেন, ”তিন হাজার হলেই এখন চলবে।”

কলাবতী আর কিছু জিজ্ঞেস করল না, শুধু ভ্রূদুটো একবার ওপরে তুলে, কী যেন ভাবল।

রাজশেখরের ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছে শুনেছিলেন ফণী ঘোষ। জিজ্ঞেস করলেন, ”কালু, এখন রাজু কেমন আছে?”

”সেরে গেছেন, তবে বেশ দুর্বল। আজ বলছিলেন আসবেন, আমি বারণ করলুম। এতটা পথ হেঁটে আসার জন্য শরীরে যথেষ্ট জোর এখনও ফিরে পাননি।”

”আজ বিকেলের দিকে রাজুকে দেখতে যাব আর সেইসঙ্গে দেখে আসব তোমাদের বাগানে তুমি কীরকম উইকেটকিপিং প্র্যাকটিস করছ।”

সিংহি বাড়ি ও বাগান প্রায় দু’বিঘে জমিতে। কলকাতা শহরে এতবড় জমিসমেত বাড়ি খুব কমই আছে। বাড়িতে থাকেন মাত্র পাঁচটি লোক। আর সবই ঠিকে ঝি—চাকর। বাড়ির সঙ্গের বাগানটি অযত্নেই পড়ে ছিল এতদিন। কলাবতীর প্র্যাকটিসের জন্য ঝোপঝাড় কেটে, ইটকাঠ সরিয়ে রাস্তার দিকের পাঁচিলের কাছে চাঁপাগাছের ধারে প্রায় দশ বর্গফুট জমি থেকে জনমজুর লাগিয়ে কাঁকর বেছে তুলে ফেলে, বড় বড় ঘাস ছাঁটাই করে এবং জল ঢেলে মাটি দুরমুশ দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে ক্রিকেট পিচ বানানোর চেষ্টা হয়েছে। সেখানে দশটা বল পড়লে অন্তত তিনটে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে ছিটকে যাবে, দুটো লাফিয়ে বুকের কাছে আসবে, দুটো আসবে জমি ঘষড়ে। বাকি তিনটে আসবে ঠিক উচ্চচতায়। এই পিচেই তিনটি স্টাম্প পুঁতে কলাবতী উইকেটকিপিং প্র্যাকটিস করে আসল ক্রিকেট বল দিয়ে। প্রথম দিন রাজশেখর নিজে আটটা লেগ ব্রেক বল করে হাঁফিয়ে পড়েন। আটটার মধ্যে চারটে কলাবতীর মাথার অনেক ওপর দিয়ে গিয়ে পাঁচিলে ঠকাস করে লাগে। বাকি চারটের মধ্যে দুটো রাজশেখরের থেকে পাঁচ হাত দূরে পিচ পড়ে তিনটে ড্রপ খেয়ে উইকেটকিপারের কাছে পৌঁছয়। আর দুটো গালির দিকে যেতে যেতে চাঁপাগাছের গুঁড়িতে ধাক্কা মারে।

মুরারি, অপুর মা কাছেই দাঁড়িয়ে ”কিরকেট” নামক এই অদ্ভুত খেলাটা দাদু ও নাতনি কেমন করে খেলে তাই দেখছিল। পাশে ছিল আর এক দর্শক, খয়েরি। ওদের শুনিয়ে লাজুক স্বরে রাজশেখর জানালেন, ”নাহ শরীরটা দুর্বল লাগছে। পঁয়তাল্লিশ বছর খেলা ছেড়েছি তারপর ক্রিকেট বল তো আর ছুঁইনি।…..মুরারি পারবি বল করতে? যা, কালু দিদিকে প্র্যাকটিস দে।”

আদেশটা প্রথম হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি মুরারি। সে শুধু দাঁত বার করে হেসে দাঁড়িয়ে রইল।

”মুরারি, কথাটা কানে গেল কী? বলটা নিয়ে এইভাবে কালুদিদির দিকে ছুড়ে ছুড়ে দিবি। ঠিক ওই জায়গাটায় যেন পড়ে।” এই বলে রাজশেখর বলটা ঢিল ছোড়ার মতো জোরে ছুড়ে কলাবতীর প্রায় দশ ফুট সামনে ফেললেন। উইকেটের পেছনে উবু হয়ে বসা কলাবতী অফস্টাম্পের এক হাত বাইরে পরিচ্ছন্ন ভাবে কোলের কাছে বলটা গ্লাভসে জমিয়ে নিল।

”দেখলি তো, এইভাবে ছোড় ঠিক ওইখানটায়।” রাজশেখর আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। কলাবতী বলটা গ্লাভসে ধরে বোলারকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য উঁচু করে তুলে ছুড়ে দিয়েছে। বলটা রাজশেখরের দিকে না গিয়ে উঠল মুরারির মাথার ওপর। সে ‘হাই হাই’ বলে দু’হাত মাথার ওপর তুলল হরিনাম সঙ্কীর্তন করার মতো। বলটা তার মাথার ওপর পড়ত কিন্তু পড়ল কাঁধে, সেখান থেকে ছিটকে খয়েরির পাশ দিয়ে যেতেই, খয়েরি তাড়া করে বলটা কামড়ে ধরে দাঁড়িয়ে লেজ নেড়ে যেতে লাগল।

কলাবতী হাত বাড়িয়ে তাকে ডাকল, ”আয়, খয়েরি আয়, বলটা দে।”

বল মুখে নিয়ে খয়েরি ছুটে এল কলাবতীর কাছে। ওর মুখ থেকে ক্রিকেট বলটা বার করে নিয়ে কলাবতী সেটা গড়িয়ে দিয়ে ”ধর ধর” বলে চেঁচিয়ে উঠল। খয়েরি বলের পেছনে ছুটল। বারো—চোদ্দো মিটার বলটা গেছে তখন গিয়ে বলটা মুখে ধরল যেভাবে সে তাড়া করে ইঁদুর ধরে বাগানে। বল মুখে সে ফিরে এল কলাবতীর কাছে। বলটা মুখ থেকে জমিতে নামিয়ে রেখে সে লেজ নাড়তে থাকল। লেজ নাড়াটা তার খুশির প্রকাশ। এখন সে একটু বাহবা চায়। অপুর মা ওর মাথা নেড়ে দিল।

উচ্ছ্বসিত কলাবতী বলল, ”দাদু, দেখো একটা ফিল্ডার পেয়ে গেছি।”

সে বলটা এবার আলতো করে তুলে নিল দাদুর দিকে। রাজশেখর লুফলেন। খয়েরি ধরবে বলে ছুটে গেল বল অনুসরণ করে। বল না পেয়ে খয়েরি দু—তিনবার ”ভৌ ভৌ” করে ডেকে বলটা চাইল। রাজশেখর খয়েরির মাথা চাপড়ে দিলেন। ”কী রে, হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন!” তিনি ধমক দিলেন মুরারিকে।

মুরারি দু’বার ঢোক গিলে, অপুর মার আঁচল চাপা মুচকে হাসা মুখের দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে রাজশেখরের হাত থেকে বলটা নিল। চোখ সরু করে রাজশেখরের দেখিয়ে দেওয়া জায়গাটার দিকে দশ সেকেন্ড একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বলটা মিডিয়াম পেসে ছুড়ল। ঠিক জায়গাতেই পড়ে অফ কাটারের মতো লেগের দিকে বলটা প্রায় এক ফুট সরে গেল। কলাবতী বাঁ দিকে হাত বাড়িয়ে বলটা ধরে রাখতে না পারলেও থামিয়ে ফেলল।

রাজশেখর অবাক হয়ে বললেন, ”আরে, মুরারি তো ভালই বলটা করল! নে, আবার কর।”

কত্তাবাবুর প্রশংসা শুনে মুরারি এক বুক শ্বাস নিয়ে ছাতি ফুলে গেল। প্রায় একই জায়গায় সে পরপর চারটে বল ফেলল। কলাবতী এবার সবক’টাই গ্লাভসে ধরে রাখল। সে চেঁচিয়ে বলল, ”দারুণ মুরারিদা, দারুণ। করে যাও, আরও করে যাও।”

মুরারি মুখ করুণ করে বলল, ”কত্তাবাবু এসব কাজ করা তো ওব্যেস নেই। কাঁধে ব্যথা লাগছে।”

রাজশেখর বললেন, ”ব্যথা না হওয়ার ওষুধ দিচ্ছি, কালুদিদিকে যতবার বল করবি, প্রত্যেক বলের জন্য পাঁচ পয়সা করে পাবি। যা, এবার বল কর।”

মাথা চুলকে মুরারি বলল, ”আজ্ঞে, ওটা ছ’পয়সা করুন।”

রাজশেখর একটুও না ভেবে বললেন, ”ঠিক আছে। দিনে তা হলে ক’টা করে বল ছুড়বি?”

”চল্লিশ—পঞ্চাশটা তো পারবই।” মুরারি নিশ্চিত স্বরে বলল।

সন্ধেবেলায় অপুর মা জিজ্ঞেস করল মুরারিকে, ”চল্লিশ—পঞ্চাশটা বল ছুড়ে ক’পয়সা পাবে মুরারিদা?”

মুরারি বলল, ”সে মেলা পয়সা, হিসেব না করে বলতে পারব না।”

”তুমি তো দেখছি ভাল বল ছুড়তে পারো।”

”পারব না কেন। ছেলেবেলার ঢিলিয়ে কত আম পেড়েছি জানিস? এক টিপে এক—একটা আম পড়ত।”

এরই চারদিন পর ফণী ঘোষ সকালে কলাবতীকে বলেন, ”আজ বিকেলের দিকে রাজুকে দেখতে যাব।” তিনি বিকেলে সিংহিবাড়ির ফটক দিয়ে ঢুকেই দেখলেন রাজশেখর একটা টুলে বসে তার পাশে গলায় বকলস দেওয়া একটা খয়েরি কুকুর সামনের দু’পা জমিতে ছড়িয়ে বসে, ধুতি আর গেঞ্জি পরা একটি কাঁচাপাকা চুলের লোক ক্রিকেট বল ছুড়ছে কলাবতীকে। তিনটে স্টাম্পের পেছনে গ্লাভস আর প্যাডে সজ্জিত ট্রাউজার্স পরা কলাবতী বল ধরতে ডান দিকে ঝাঁপাল। ফণী ঘোষ আর না এগিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন দূর থেকেই দেখার জন্য।

রাজশেখরের হাতে ফর্দের মতো লম্বা কাগজ আর কলম। মুরারি একটা করে বল ছুড়ছে আর ফর্দে তিনি টিক দিচ্ছেন। তেরো নম্বর টিক দিয়েছেন যখন কলাবতী চেঁচিয়ে উঠল, ”দাদু দেখো দেখো কে এসেছেন।”

রাজশেখর মুখ ফিরিয়ে দেখে বললেন, ”আরে ফণী, ওখানে দাঁড়িয়ে কেন, এসো এসো। কেমন দেখছ বলো।”

‘ফণী ঘোষ কাছে এসে বললেন, ”কালু তো ভালই কালেক্ট করছে। তবে একটা মুশকিল কী জানো রাজু, ম্যাচে যখন কিপ করবে তখন তো সামনে ব্যাট হাতে একজন থাকবে। তখন কিন্তু কিপিংটা এমন সোজা ব্যাপার হবে না। কিন্তু তোমার এখানে তো কারুর ব্যাট করা সম্ভব নয়, ওকে এবার মেয়েদের ভাল ক্লাবে দিতে হবে সেখানে সত্যিকারের প্র্যাকটিস হয়।”

”মেয়েদের ক্লাব! কোথায় পাব?” রাজশেখরকে অসহায় দেখাল। তারপরই তাড়া দিলেন মুরারিকে। ”হাঁ করে কথা গিলছিস কী? বল ছোঁড়। অপুর মা এটা ধরো।” রাজশেখর বল ছোড়ার ফর্দ আর কলমটা ওর হাতে দিয়ে বললেন, ”যেভাবে টিক দিয়েছি, গুনে গুনে সেইভাবে দিয়ে যাও। আমি বৈঠকখানায় যাচ্ছি।”

ফণী ঘোষকে নিয়ে রাজশেখর বাড়ির দিকে চলে গেলেন।

”ঠিক করে টিক দিবি।” মুরারি হুঁশিয়ার করে দিল অপুর মাকে। একটা বড় কাজের দায়িত্ব পেয়ে অপুর মার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। মুরারি একটা করে বল ছোড়ে আর বলে, ”টিক মার।” অপুর মা একটা টিক দেয় দুটো বল ছোড়ার পর।

আধঘণ্টা পর কলাবতী ফিরল। তখন ফণী ঘোষ বলছেন, ”ধুপুদের ক্লাবটা ভাল। টাকাকড়িও আছে, নইলে নেট খাটিয়ে প্র্যাকটিস করতে পারে? এই যে কালু, শোনো তুমি ধুপুদের ক্লাবে জয়েন করো। প্রগতি সঙ্ঘে থাকলে তোমার কিছু হবে না। উইকেট কিপিংয়ে তোমার একটা সহজাত ঝোঁক মানে—” বোঝাবার জন্য সঠিক কথাটা তিনি খুঁজতে শুরু করলেন।

রাজশেখর বললেন, ”সহজাত দখল আছে।”

”হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি দেখছিলুম ওর বডি মুভমেন্ট। এটা তো কেউ ওকে শেখায়নি কিন্তু ঠিক বলের লাইনে মুভ করছিল।” ফণী ঘোষ তারিফের ভঙ্গিতে চোখ বুজে মাথা হেলালেন।

রাজশেখর বললেন, ”কালু, ফণী আজ প্রথম এল, মিষ্টিমুখ তো করাতে হবে।”

কলাবতী মুখ টিপে হেসে জানাল, ”মুরারিদাকে আমি বলে দিয়েছি।”

সিংহিবাড়ির দুটো ফ্রিজ সবসময়ই ভর্তি থাকে মরসুমি ফল আর নানাবিধ মিষ্টান্নে। একটু পরেই ট্রে হাতে মুরারি এল। প্লেট ভরা কাটা ল্যাংড়া আম আর কড়াপাকের সন্দেশ।

”চা দেব না লস্যি?” মুরারি রাজশেখরের কাছে জানতে চাইল।

”লস্যিই দিক।” রাজশেখর অনুমোদনের জন্য ফণী ঘোষের দিকে তাকালেন, মাথা হেলিয়ে তিনি সম্মতি জানালেন।

পরদিন স্কুলে টিফিনের সময় কলাবতী খুঁজে বার করল ধুপুকে। ”তোর সঙ্গে একটা কথা আছে, চালতাতলায় আয়।” স্কুলের উঠোনে একটা চালতাগাছ আছে, তার গুঁড়ি ঘিরে সিমেন্টের রক। সেটাই চালতাতলা।

দু’জনে এসে রকে বসল। কলাবতী টিফিন বক্স খুলে ধুপুর সামনে ধরে বলল, ”নে তোল।” ধুপু খুঁটিয়ে দেখে সিদ্ধ ডিমটা তুলে নিয়ে আধখানা কামড়ে চিবোতে চিবোতে বলল, ”বল এবার।”

ভণিতা না করে কলাবতী বলল, ”তোদের ক্লাবে ভর্তি হব, উইকেটকিপিং প্র্যাকটিস করব।”

ধুপু বলল, ”আমাদের ক্লাবে একজন উইকেটকিপার আছে।”

”দু’জন থাকলে অসুবিধে হবে কি? একজন যদি কোনও কারণে না খেলতে পারে?” কলাবতী জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

ধুপু ভ্রূ কুঁচকে কয়েক মুহূর্ত ভেবে বাকি ডিমটা মুখে পুরে বলল, ”আমাদের সেক্রেটারি ইন্দুদিকে জিজ্ঞেস করে পরশু তোকে বলব। তুই বল—টল ধরতে বা থামাতে পারিস তো?

”আজ বিকেলে আয় না আমাদের বাড়িতে, তোকে দেখিয়ে দেব বল ধরতে পারি কি না। আর কিছু খাবি না?” কলাবতী টিফিন বক্সটা আবার এগিয়ে ধরল। ধুপু ইতস্তত করে চমচমটা তুলে নিল।

বিকেলে কলাবতী বাগানে মুরারির ছোড়া বল ধরছে। টুলে বসে রাজশেখর, তার পাশে খয়েরি। অপুর মা অনুপস্থিত। সে তখন বাড়ির মধ্যে বাসন মাজার ঠিকে কাজের লোকের সঙ্গে কী একটা ব্যাপারে হেস্তনেস্ত করায় ব্যস্ত। তখন ধুপু এল। ফটক দিয়ে ঢুকে এধার—ওধার তাকিয়ে কলাবতীকে চোখে পড়তেই এগিয়ে গেল। খয়েরি এগিয়ে এসে ধুপুর জুতো শুঁকল। একটা হাই তুলে আগের জায়গায় ফিরে এল।

”দাদু, এই আমার বন্ধু ধুপু, ভাল নাম ধূপছায়া। ব্যাটে ওপেন করে। দাদুর কথা তো তোকে বলেইছি।”

ধুপু বলল, ”বাহ, প্র্যাকটিসের তো ভাল ব্যবস্থা। গ্লাভস প্যাড সবই নিজের! দেখি তো কেমন ফিল্ড করিস।” এই বলে ধুপু মুরারির কাছ থেকে বলটা চেয়ে নিল। কলাবতী উইকেটের পেছনে গেল। খুবই স্লো লেগব্রেক কিন্তু বল ভালই ঘুরল জমি থেকে। দুটো স্টাম্পে লাগল। চারটে মিডল স্টাম্প থেকে অফের দিকে গেল, কলাবতী ধরল এবং লেগ স্টাম্পের বাইরের তিনটেও।

চমৎকৃত ধুপু বলল, ”বাহ, তুই তো সবক’টা বলই ধরলি! ধরে আবার স্টাম্পও করলি। শিখলি কোত্থেকে?”

”টিভিতে দেখে দেখে উইকেটকিপারের কাজটা বুঝে গেছি, তারপর প্র্যাকটিস।” কলাবতী হাসতে শুরু করল। ”কী রে, আমাকে দিয়ে তোদের চলবে?”

”সেটা ঠিক করবেন বাবুদা, ভাল নাম সুবীর ব্যানার্জি। রঞ্জি ট্রফি খেলেছেন, এখন আমাদের কোচ। আমাদের নেট হয় একদিন অন্তর দু’বেলা এক ঘণ্টা করে, কাল হবে সকাল সাতটায় আর বিকেল চারটেয়, তারপর আবার তরশু হবে। ছুটির দিনে একবেলা সকালে তিন ঘণ্টা হয়। আমি কালই সেক্রেটারিকে বলব, হাসিদির একজন বদলি থাকা দরকার।”

কলাবতী জিজ্ঞেস করল, ”হাসিদি কে?”

”আমাদের উইকেটকিপার। থাকে বাগুইহাটিতে। তুই আয়, ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব, খুব ভাল মেয়ে।”

পরদিন স্কুল শুরুর আগে কলাবতী অধীর উৎকণ্ঠা নিয়ে স্কুলের ফটকে অপেক্ষা করছিল ধুপুর জন্য।

”কী বললেন, ইন্দুদি?” কলাবতী শ্বাস বন্ধ করে ধুপুর দিকে তাকিয়ে ওর মুখভাব লক্ষ করে যেতে লাগল। মুখটা গম্ভীর লাগছে যেন। ধুপু না দাঁড়িয়ে হাঁটতে লাগল।

”বল কী বললেন?” কলাবতী হতে চেপে ধরে ধুপুকে থামাল।

”বললেন পরশু সকালে যেতে, তোকে দেখবেন।”

হতভম্ব কলাবতী বলল, ”দেখবেন? আমাকে দেখে কী হবে।”

”বাঃ, দেখবেন না, তুই ব্যাকস্টপার না সত্যিকারের উইকেটকিপার?”

”আমি তো এখনও উইকেটকিপারই হইনি। ভাল করে শেখার অন্য ভাল বোলারদের বলে প্র্যাকটিস করতে চাই ভাল উইকেটে। দেখেছিস তো আমাদের বাগানে কী রকম এবড়োখেবড়ো জমিতে কীরকম বোলিংয়ে শিখি। এই বিদ্যে নিয়ে কি উইকেটকিপিং পরীক্ষায় পাশ করা যায়!” কলাবতীকে নিরুৎসাহ দেখাল।

ধুপু ওর কাঁধে হাত রেখে শান্ত নরম স্বরে বলল, ”এটাকে ক্লাসের পরীক্ষা ভাবছিস কেন, স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য যে পরীক্ষা দিতে হয় এটা সেইরকম। আমাকেও দিতে হয়েছিল। অনেক এলেবেলে আসে তো, সবাই বলে দারুণ ব্যাট করি, দুর্দান্ত বল করি। বাবুদা তাদের এক ওভার দেখে নিয়েই ইন্দুদিকে বলে দেন, ‘এর কোনওকালে হবে না’, কারুর সম্পর্কে বলেন, ”তিন বছর রগড়ালে যদি কিছু হয়’, কিংবা বলেন, ‘এই মেয়েটার ক্রিকেট সেন্স আছে, একে রেখে দিন, খাটলে দাঁড়িয়ে যেতে পারে।’ বাবুদা একজন উইকেটকিপার চাইছেন, যে হাসিদির স্ট্যান্ডবাই থাকবে।”

”তোর কথা শুনে তো ভয় লাগছে, যদি বাবুদা বলে দেয় এর কোনওকালে কিসসু হবে না কিংবা তিন বছর রগড়াতে হবে।”

”তা বলে দিতে পারেন। কিন্তু পরীক্ষায় না নেমেই তুই ধরে নিচ্ছিস কেন ফেল করবি? কাল ঠিক সকাল সাড়ে ছ’টায় তোদের বাড়ির সামনের বাসস্টপে দাঁড়াবি, আমি এসে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। ব্যাট গ্লাভস প্যাড নিতে ভুলিসনি।”

ধুপু ক্লাসে চলে গেল, কলাবতীও। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে অন্যদিনের মতো মুরারির ছোড়া বল ধরার প্র্যাকটিসে সে নামল না। তার বদলে বাগানে ফ্রিহ্যান্ড ব্যায়াম আর পাঁচশো স্কিপিং করল দড়ি দিয়ে। দাদুকে বাড়ি ফিরেই বলেছে সকালে সল্টলেকে যাবে পূর্ব কলকাতার নেটে পরীক্ষা দিতে। রাতে খাবার টেবলে রাজশেখর ছেলেকে বললেন, ”সতু কাল সকালে তোর একটা কাজ আছে, কালুকে সল্টলেকে গাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবি, ও পরীক্ষা দিতে যাবে।”

সত্যশেখর অবাক হয়ে বলল, ”পরীক্ষা! কীসের?”

”উইকেটকিপিংয়ের। এ—কে ব্লকের পার্কে পূর্ব কলকাতার নেট পড়ে, সেখানে কালু পরীক্ষা দিতে যাবে, সাড়ে ছ’টায় বেরোবে।”

সত্যশেখর বলল, ”সল্টলেকের রাস্তা আমার গুলিয়ে যায়, ব্লক—টলকও আমি চিনি না। ওখানে তো জলের ট্যাঙ্কের নম্বর দিয়ে পাড়া চিনতে হয়।”

কলাবতী বলল, ”ধুপু চেনে। ও সঙ্গে যাবে।”

মাঝরাত পর্যন্ত কলাবতী বিছানায় এ—পাশ ও—পাশ করল। তার মাথায় শুধু ঘুরছিল কথাগুলো ‘এর কোনওকালে হবে না হবে না হবে না।’ স্কুলের অ্যানুয়াল পরীক্ষার দিনও সে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে, এমন অস্থির কখনও হয়নি। অ্যালার্ম দেওয়া ঘড়িটা সাড়ে পাঁচটায় তার ঘুম ভাঙিয়ে না দিলে হয়তো সে সাতটা পর্যন্ত ঘুমোত।

সত্যশেখর চা খেয়ে গাড়ি বার করল ঠিক সাড়ে ছ’টায়। ভোজনপটু, অলস কাকাকে শর্টস, কেডস আর টি—শার্ট পরা দেখে কলাবতী একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ”কী ব্যাপার, তুমি দৌড়বে নাকি?”

”ভাবছি একটু ছুটলে টুটলে কেমন হয়। খিদেটা একটু বাড়ে তা হলে, কাল পাঁচু রায় হাইকোর্টের বার লাইব্রেরিতে আমাকে কুলপি মালাই খাওয়ার চ্যালেঞ্জ দিল, বলল দু’ ঘণ্টার একটা সেশনে ও নাকি পনেরোটা খেয়েছে বড়বাজারের কোন এক দোকানে। নে ওঠ।”

পাশবালিশের খোলের মতো একদিকে দড়ি লাগানো একটা কাপড়ের থলিতে ব্যাট প্যাড গ্লাভস ইত্যাদি নিয়ে কলাবতী গাড়িতে উঠতে যাচ্ছে তখন লেজ তুলে ঘৌ ঘৌ করে ডাকতে ডাকতে ফিটনের ঘর থেকে ছুটে এল খয়েরি। ওর গলা জড়িয়ে আদর করে কলাবতী বলল, ”এখন যা, আমি বেরোব।” খয়েরি শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে শুধু লেজ নেড়ে যেতে লাগল।

”লোমগুলোয় চেকনাই ধরেছে, কালু তোর কুকুরটা দেখছি বেশ তাগড়াই হয়েছে, খুব খাওয়াচ্ছিস!” সত্যশেখর মন্থর গতিতে গাড়িটাকে ফটক থেকে বার করার সময় বলল।

”কুকুর নয় কাকা, ওর একটা নাম আছে।” গম্ভীর মুখে কলাবতী বলল, খয়েরিকে কেউ কুকুর বললে তার রাগ হয়। ”আমরা যা খাই, ডাল ভাত তরকারি, খয়েরিও তাই খায়। ওর জন্য আলাদা করে কিছুই কেনা হয় না। ও তো বিলিতি মেমসাহেব নয়। ওই যে ধুপু দাঁড়িয়ে।”

একটা ব্যাট হাতে নিয়ে সাদা ট্রাউজার্স পরা ধুপু বাসস্টপে দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়িটা ওর সামনে এসে দাঁড়াতে অবাকই হল।

কলাবতী বলল, ”উঠে আয়, কাকার খিদে হচ্ছে না তাই একটু ছুটতে যাবে।”

”ভালই হল।” গাড়িতে উঠে ধুপু বলল, ”একটু আরাম করে আজ যাওয়া যাবে।”

সকালে রাস্তা ফাঁকাই। গাড়ি সাত—আট মিনিটেই পৌঁছে গেল এ—কে ব্লকের পার্কে। কোমর সমান উঁচু পাঁচিলে সারা পার্কটা ঘেরা। মাঠে কোনও লোক নেই। ওরা ছোট লোহার ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকল । মাঠের একধারের পাঁচিলের দিকে কুড়ি গজের একটা জালকে লম্বা করে ছড়িয়ে বাঁশে বেঁধে দাঁড় করানো।

কলাবতী বলল, ”আমরা একটু আগেই এসে পড়েছি। ধুপু নেটটা এভাবে খাটানো কেন রে?”

ধুপু বলল, ”বাবুদা ব্যাটসম্যানের দু’ধারে নেট রাখতে চান না। বলেন, যেভাবে ম্যাচে খোলা মাঠে ব্যাট করবে, বল করবে, উচিত নেটেও সেইভাবে খেলে যাওয়া। ফাইন লেগ থেকে থার্ডম্যান পর্যন্ত জাল, বল ফস্কালে জালে আটকে যাবে।”

জালের চার—পাঁচ গজ সামনে স্টাম্প পোঁতার গর্ত আর পপিং ক্রিজ চুন দিয়ে দাগানো। কলাবতী দেখল মাটির মসৃণ পিচ, তাকে ঘাস নেই। একটি—দুটি করে মেয়েরা এসে পৌঁছতে শুরু করল। মাঠটাকে পাক দিয়ে মন্থর গতিতে তারা যখন ছুটছে ধুপু বলল, ”কালু দাঁড়িয়ে থাকিসনি, আয়।” কলাবতী ওদের সঙ্গে যোগ দিল।

সত্যশেখরও তার খিদে—বাড়াবার—দৌড় মেয়েদের পঞ্চাশ মিটার পেছনে থেকে শুরু করে দিল। একটা পাক শেষ হতে দেখা গেল মেয়েদের থেকে তার ব্যবধান সত্তর মিটার, দেড় পাক সম্পূর্ণ হওয়ার সময় সেটা দাঁড়াল প্রায় একশো মিটারে, অবশেষে সত্যশেখর হাল ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে বড় বড় শ্বাস নিতে লাগল। কলাবতী নজরে রেখেছিল কাকাকে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলল, ”কাকা, চ্যালেঞ্জ নিতে হলে আর একটা রাউন্ড দিতে হবে।” শুনেই সত্যশেখর ছোটা শুরু করে দশ পা গিয়েই হাঁটতে লাগল।

ইন্দুদি অর্থাৎ ইন্দিরা বসাক মাঠে এলেন, উচ্চচতা টেনেটুনে পাঁচ ফুট, ওজন কম করে আশি কেজি, ঘোর কৃষ্ণ গায়ের রং, বয়স চল্লিশের মাঝামাঝি। চোখে চশমা, মিষ্টি মুখশ্রী। তার পেছনে চাকরের পিঠে বড় একটা ক্যানভাসের খোল, তাতে আছে প্র্যাকটিসের জন্য ব্যাট, প্যাড, স্ট্যাম্প, গ্লাভস আর বল।

”ধুপু ইনি কে রে?”

”ইন্দুদি, আমাদের ক্লাবের সব খরচ ইনিই দেন, কাছেই থাকেন। গিয়ে একটা প্রণাম কর।”

কলাবতী পায়ে পায়ে ইন্দুদির সামনে গিয়ে বলল, ”আমার নাম কলাবতী সিংহ। আমাকে আপনি আসতে বলেছেন, আমি উইকেটকিপিং প্র্যাকটিস করব।” এই বলে সে প্রণাম করল। ইন্দুদির মুখে প্রসন্নতার ছায়া ভেসে উঠল।

”ভাল কথা, প্র্যাকটিস করো, আমাদেরও একজন সেকেন্ড উইকেটকিপার দরকার।” ইন্দুদির কণ্ঠস্বর তার মুখের মতোই মিষ্টি। ”তোমার উইকেটকিপিং গ্লাভস, প্যাড আছে?”

”সঙ্গে করে এনেছি।”

”রেডি হয়ে নাও।” ইন্দুদি একটি মেয়েকে বললেন, ”সাবিনা প্যাডআপ।” তিনি চারটে বল গড়িয়ে দিলেন চারটি মেয়ের দিকে। বাকি মেয়েরা ছড়িয়ে দাঁড়াল ফিল্ড করার জন্য।

কলাবতী প্যাড আর গ্লাভস পরে তিনটে স্টাম্পের পেছনে দাঁড়াল, সামনে সাবিনা। তার বুকের মধ্যে দুরু দুরু কাঁপন শুরু হয়ে গেছে, উবু হয়ে উইকেটের কতটা পেছনে বসতে হবে বুঝতে পারছে না। যে বল করবে সে কী ধরনের বোলার—পেসার না স্পিনার সে জানে না। সাবধান হওয়ার জন্য সে উইকেট থেকে প্রায় দু’গজ পিছিয়ে দাঁড়াল, প্রথম বোলারটি বল করল ফ্লাইট করিয়ে, অফ স্পিনার, অফ স্টাম্পের দেড় ফুট বাইরে, সাবিনা স্কোয়ার কাট করতে গেল, ব্যাট বলে লাগল না, বলটা স্পিনও করেনি, ব্যাটের তলা দিয়ে এসে দ্বিতীয়বার পিচ খেল কলাবতীর দেড় গজ সামনে। সে তড়িঘড়ি সামনে ঝাঁপিয়ে ধরতে গিয়ে ফস্কাল। উঠে দাঁড়িয়ে সে আড়চোখে ইন্দুদির দিকে তাকাল। মুখে একচিলতে হাসি ফুটে রয়েছে দেখে সে বোঝার চেষ্টা করল হাসিটা সহানুভূতির না হতাশার।

এবার সে এগিয়ে গিয়ে স্টাম্পের পেছনে বসল। মেয়েটি দশ কদম ছুটে এসে বল করল। সাবিনার লেগের দিকে পিচ পড়ল। বলটা বেশ জোরেই এসেছে এবং ওভারপিচ। সাবিনা ব্যাট চালাল কিন্তু বলে তা লাগল না। কলাবতী বাঁ—হাত বাড়াল বলটা ধরতে বা থামাতে। সে দেখল হুসস করে বলটা বেরিয়ে গেল গ্লাভসের পাশ দিয়ে। অপ্রতিভ হয়ে সে জালের নীচে পড়ে থাকা বলটা কুড়িয়ে আনতে গেল।

”উইকেটের অত কাছে থাকলে তো ফস্কাবেই।”

জালের ওধারে দাঁড়িয়ে থাকা যে লোকটি কথাগুলো বলল কলাবতী তাকে এই প্রথম দেখল।

”কে কী ধরনের বোলার তা তো আমি জানি না।” কলাবতী কৈফিয়ত দেওয়ার সুরে বলল।

”আজ প্রথম?”

”হ্যাঁ”।

লোকটি জালের এধারে আসার জন্য হাঁটতে শুরু করল। ফরসা গায়ের রং, মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে। নাতিদীর্ঘ, দোহারা, বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। পরনে সবুজ টি—শার্ট সাদা টাউজার্স ও স্নিকার। কলাবতীর মনে হল, ইনিই বোধ হয় সেই বাবুদা।

বোলারদের কাছে গিয়ে বাবুদা দুটি মেয়ের কাছ থেকে বল চেয়ে নিয়ে অন্য দুটি মেয়েকে দিলেন। তারপর চেঁচিয়ে কলাবতীকে বললেন, ”সবাই মিডিয়াম পেসে বল করে।” শুনে সে এবার চার গজ পিছিয়ে গেল। মনে মনে বলল, কপিলদেব তো আর নয়, কত জোরে আর বল করবে!

সাবিনা আবার ব্যাট নিয়ে দাঁড়াল, একটা বল পিছিয়ে এসে আটকাল, পরেরটা পুল করল, তৃতীয়টা ফুলটস, কাঁধের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে পড়ল কলাবতীর দু’গজ সামনে, সে বলের লাইনে সরে এসেছিল। পিচ পড়ে বলটা লাফিয়ে তার কপালে লেগে ছিটকে উঠল। ‘ঠকাস’ একটা শব্দ হল। ছুটে গেল সাবিনা, ইন্দুদি, ধুপু ও বাবুদা।

কপাল ফাটেনি, রক্ত বেরোয়নি, আঘাতের জায়গাটা ফুলে উঠেছে, একটা টনটনে ব্যথা শুরু হয়েছে, কিন্তু এটা ছাপিয়ে কলাবতীর শুরু হল লজ্জা পাওয়ার যন্ত্রণা। কী ভাবছে সবাই! বড় প্লেয়ারের মতো সাজগোজ করে নেমে শেষে কিনা বলই ধরতে পারল না। চাল মারতে ক্রিকেট খেলছে। সবাই মুখে আহা উহু করবে কিন্তু মনে মনে নির্ঘাত মুচকি হাসবে। প্রথম দিনে চার—পাঁচটা মাত্র বল হতেই এই লজ্জায় ফেলে দেওয়ার মতো ব্যাপারটা ঘটে গেল, তাও যদি একটা বলও সে ঠিকমতো ধরতে পারত!

ইন্দুদি আলতো করে কপালে আঙুল বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ”লাগছে?”

কলাবতী মুখে হাসি টেনে মাথা নাড়ল, ‘একটুও না।’

বাবুদা বলল, ”আজ থাক, আর উইকেটের পেছনে গিয়ে কাজ নেই।”

”না, না, আমি ঠিক আছি, একটু—আধটু তো ক্রিকেট খেলতে গেলে লাগবেই।” কলাবতী তাচ্ছিল্য দেখিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল। কপালে টনটনে যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। কিন্তু সে ঠিক করেই ফেলেছে লজ্জা নিয়ে সে বাড়ি ফিরবে না।

ধুপু এসে ফিসফিস করে বলল, ‘তোর কপালে তো একটা ছোট্ট আলু ফলেছে রে! কালু, আজ তুই চলে যা।”

”না।” কঠিন গলায় কথাটা বলে কলাবতী উইকেটের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। ইন্দুদি একটি মেয়েকে বললেন, ”দৌড়ে গিয়ে ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে এসো।” বাবুদা আগাগোড়া কলাবতীর ভাবভঙ্গি লক্ষ করে যাচ্ছিল। বলল, ”ঠিক আছে, তুমি কিপ করো।” সত্যশেখর দূরে বসে ছিল ঘাসের ওপর। ভাইঝিকে ঘিরে একটা জটলা দেখে সে অবাক হয়ে উঠে পড়ল। কিন্তু আবার কলাবতী উইকেটের পেছনে যাওয়াতে সে বসে পড়ল।

সাবিনা ব্যাট হাতে ফ্রিজে স্টান্স নিল। কলাবতী অনেকটা পিছিয়ে দাঁড়াল। অফস্টাম্পে বল, সাবিনা ড্রাইভ করল, ব্যাটের কানায় লেগে বল সেকেন্ড স্লিপের দিকে যাচ্ছে। কলাবতী ডান হাত বাড়িয়ে ঝাঁপাল এবং একবার জমিতে শরীরটা গড়িয়ে বল হাতে নিয়ে উঠল। বলধরা হাতটা তুলে চেঁচিয়ে উঠল, ”হাউস দ্যাট।”

ধুপু ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল। ইন্দুদির মুখ ভরে গেল হাসিতে। বাবুদা নীচের ঠোঁট কামড়ে মাথা নেড়ে যাচ্ছে। আর কলাবতীর সারা দেহ গরম হয়ে উঠেছে লজ্জা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠায়। তার মাথার মধ্যে ঝাঁ ঝাঁ করছে একটা কথাই, ”দেখিয়ে দিতে হবে, দেখিয়ে দিতে হবে।”

এর পর সে আরও কয়েকটা বল ধরল এবং ফস্কালও। মেয়েটি একটা রুমালে বেঁধে বরফ এনেছে। কলাবতী সেটা কপালে ঘষল। চারজনের ব্যাটিং হয়ে যাওয়ার পর বাবুদা বলল, ”ব্যাট করতে পারবে?”

”পারব।”

নিজের থলি থেকে ব্যাট আর ব্যাটিং গ্লাভস বার করে নিয়ে কলাবতী ক্রিজে এল। মাথার মধ্যে এখনও আগুন জ্বলছে। উইকেটকিপারকে ব্যাটটাও করতে হয়। যার বল তার কপালে লেগেছে সে প্রথমেই তাকে বল করতে এল। অফ স্টাম্পে পিচ। একটু পেছনে হেলে মারার জন্য জায়গা করে নিয়ে কলাবতী কাট করল। বল গেল গালির দিকে। পরের বলটাকে প্রচণ্ড আক্রোশে এক পা বেরিয়ে গিয়ে তুলে দিল বোলারের মাথার ওপর দিয়ে। পরের বলটারও একই অবস্থা হল। চতুর্থ বলটাকে পুল করল, একটি মেয়ে হাত বাড়িয়ে ধরতে গিয়েও হাত টেনে নিল। সে ষোলোটা বল খেলল, ষোলোটাই তার মার—মার করা ব্যাটের ধাক্কায় মাঠের সর্বত্র ছিটকে ছিটকে গেল, একটা বল গেল পয়েন্টে যেখানে সত্যশেখর বসে ছিল। সে বলটা কুড়িয়ে ছোড়ার জন্য হাতটা তুলে বুঝল বলটা যথাস্থানে পৌঁছে দিতে পারবে না। বল হাতে সে বোলারের কাছে এসে আলতো করে ছুড়ে দিল।

”সতু না?” বাবুদা চোখ কুঁচকে বলল, ”তাই বলি! কুমড়োর মতো বসে থাকা লোকটাকে যেন চেনা—চেনা মনে হচ্ছিল! এখানে কী করতে?”

”আমি কিন্তু অনেকক্ষণ আগেই তোকে চিনতে পেরেছি। ওই মেয়েটা, যে তোর বোলারদের ছাতু করছে, আমার ভাইঝি।” সত্যশেখর ক্রিজে থাকা কলাবতীর দিকে আঙুল তুলল।

”তোর ভাইঝি!” বাবুদার গলায় সুস্পষ্ট অবিশ্বাস। ”এমন একটা অ্যাথলিট মেয়ে তোর ভাইঝি? বিশ্বাস হচ্ছে না।”

”বিশ্বাস না হয় তুই মলুকে জিজ্ঞেস করিস, ওর স্কুলেই পড়ে।”

”মেয়েটার দিকে নজর রাখিস, দারুণ সম্ভাবনা আছে। বহু বছর পর তোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। এখনও আগের মতো খাচ্ছিস?” বাবুদা সত্যশেখরের পেটে হাত বোলাল।

”কুড়ি বছর পর দেখা আর অমনই খাওয়ার কথা! তোর কি আর কিছু মনে পড়ে না?” অভিযোগের সুরে সত্যশেখর বলল।

”মনে পড়বে কী করে, তোর সঙ্গে শেষ দেখা তো মামিমার, মানে মলুর মার শ্রাদ্ধে। তোর পাশে খেতে বসেছিলুম নিয়মভঙ্গের দিন, তখন দু’জনেই কলেজে পড়ি। খাওয়া শেষ হওয়ার পর তুই বাজি ধরলি তিরিশটা রাজভোগ খাবি, প্রত্যেকটার জন্য দশ পয়সা। তিনটে টাকা আদায় করে ছেড়েছিলি। দেখ দেখ, তোর ভাইঝি চালাচ্ছে কেমন। কপালে একটা বল ভালই লেগেছিল কিন্তু বসে যায়নি। মেয়েটা খুব রোখা।” বাবুদার স্বর তারিফে ঘন হয়ে উঠল। ”ওর নাম কী?”

”কলাবতী। কালু বলে ডাকি। তুই থাকিস কোথায় রে?”

”এই তো বি—জে ব্লকে। আয় না একদিন।”

ঠিক আটটায় প্র্যাকটিস শেষ হল। বিদায় নেওয়ার সময় বাবুদা কলাবতীকে বলল, ”তুমি কিন্তু রেগুলার এসো। বিকেলের প্র্যাকটিসে আসতে যদি বেরোতে দেরি হয় তা হলে মলুকে বলে তোমাকে লাস্ট পিরিয়ডে ছুটির ব্যবস্থার চেষ্টা করব, ধুপুর জন্যও।”

ইন্দুদি বললেন, ”তোমার কিটসগুলো এখানেই রেখে যাও, রোজ রোজ বয়ে আনবে কেন! কপালটা বড্ড ফুলেছে, বাড়িতে গিয়ে বরফ দিও।”

ফিরে আসার সময় কলাবতী জিজ্ঞেস করল, ”কাকা তুমি বাবুদাকে চেনো?”

”চিনব না? ও তো মলুর পিসতুতো ভাই, মলুদের কলকাতার বাড়িতে থেকেই তো কলেজে পড়েছে।”

.

ধুপুকে বাসস্টপের কাছে নামিয়ে দিয়ে ওরা বাড়ি ফিরল। প্রতিদিনের মতো কলাবতী রান্নাঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ”খয়েরিকে দুধ দিয়েছ অপুর মা?”

থোড় কাটতে কাটতে ঝাঁঝিয়ে উঠল অপুর মা, ”না, দিইনি, অপুর মা নিজেই সব গিলেছে।” এর পর মুখ তুলে তাকিয়েই সঙ্গে সঙ্গে চোখ স্থির হয়ে গেল। ”কপালে তোমার ওটা কী কালুদি?”

”কিছু না, বল লেগেছে।”

”ওমমা গো, এ কী কাণ্ড গো।” প্রায় মড়াকান্নার মতো চিৎকার করে উঠল, অপুর মা। ঠিকে ঝি, চাকররা মুরারি, এমনকী দোতলার বারান্দায়ও রাজশেখর ছুটে এলেন। সবার মুখে এক কথা, ”কী হল, কী হয়েছে অপুর মা?”

”ওই দ্যাকো।” আঙুল তুলে সে কলাবতীর কপালটা দেখাল।

সবাই দেখল, ঠিকে ঝি বলল, ”মাথাটা কোথাও ঠুকেটুকে গেছল হয়তো, জলপটি দাও।” এই বলে সে কাপড় কাচতে কলঘরে চলে গেল।

”চুন—হলুদ গরম করে লাগিয়ে দাও গো অপুর মা।” মুরারি বিজ্ঞের মতো বলল।

”হয়েছে কী?” উদ্বিগ্ন স্বর রাজশেখরের, ”কালু ওপরে আয়।”

কলাবতী ওপরে এসে বলল, ”কিসসু হয়নি দাদু, একটু যা টনটন করছে।” আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে আলতো করে কপালের ফুলো জায়গাটায় আঙুল ছুঁইয়ে একটু চাপ দিল। মুখটা ব্যথায় বিকৃত করল। রাজশেখর সেটা লক্ষ করে বললেন, ”আজ আর স্কুলে গিয়ে কাজ নেই, ধাক্কাটাক্কা লাগাতে পারে। ডাক্তার বোসকে ফোন করি, ওষুধ খেতে বলেন যদি।”

কলাবতী অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাড়িতে রইল। ডাক্তার যে ট্যাবলেট খেতে বলেছেন তাই খেয়ে দুপুরে শুয়ে রইল। বিকেল চারটে নাগাদ স্কুল থেকে বড়দির ফোন এল।

”আজ স্কুলে আসোনি কেন? তনিমা বলল আজ সে তোমাকে ক্লাসে দেখতে পায়নি, মিসেস ঘোষও তাই বললেন, হয়েছে কী?” মলয়ার স্বরে উদ্বেগ। ”আমার পিসতুতো দাদা একটু আগে ফোন করেছিল, বলল ধূপছায়া আর তোমাকে লাস্ট পিরিয়ডে ছুটি দিতে পারি কিনা ক্রিকেট প্র্যাকটিসের জন্য। কেউ খেলতে চাইলে আমি বাধা দেব না। কিন্তু তারপর ও বলল, আজ সকালে তোমার কপালে খুব জোরে একটা বল লেগেছিল তা সত্ত্বেও তুমি উইকেটকিপিং করেছ, ব্যাটও করেছ। অন্য মেয়ে হলে বসে পড়ত। কিন্তু তুমি ইনজুরির পরোয়া না করেই নাকি খেলে গেছ। বাবুদা তোমার জেদ আর রোখ নিয়ে প্রশংসা করলেও আমি কিন্তু প্রশংসা করতে পারছি না। আমি তোমাকে ছুটি দিতে পারব না আর ক্রিকেট খেলতে বারণই করব। জানো, ওরকম লোহার মতো শক্ত বল দেড়শো গ্রাম ওজন, ঘণ্টায় তিরিশ মাইল স্পিডেও যদি এসে লাগে তা হলে মানুষ মারাও যেতে পারে। না, তোমাকে খেলতে হবে না।” মলয়ার শেষ বাক্যে যে দৃঢ়তা ফুটে উঠল তাতে কলাবতী প্রমাদ গুনল। দু’জনের কথা সে অমান্য করতে পারে না, দাদু আর বড়দির। তার যত কিছু আবদার আর অনুরোধ এই দুটি মানুষের কাছে এবং তা পূরণ হয়।

কলাবতী বুঝল খুব হুঁশিয়ার হয়ে তাকে এখন কথা বলতে হবে, আবদার—টাবদার চলবে না।

”বড়দি, মঙ্গলা এখন কেমন আছে? শুনেছিলাম ওর সর্দি হয়েছে।”

”হঠাৎ মঙ্গলার খবর জানতে তোমার ইচ্ছে হল কেন? ওর তো তিন মাস আগে একটু ঠাণ্ডা লেগেছিল, তোমায় কে বলল?”

”কাকা।”

”কোর্টে মিথ্যে কথা বলে—বলে ওটাই ওর স্বভাবে দাঁড়িয়েছে।”

”বড়দি, অনেকদিন মঙ্গলাকে দেখিনি, খুব দেখতে ইচ্ছে করছে, আজ যাব?”

”এসো। তবে মাথা ঘুরলে কি যন্ত্রণা হলে আসতে হবে না। ডাক্তার দেখিয়েছ?”

”দাদু ট্যাবলেট এনে দিয়েছেন। এখন একদম ব্যথা নেই। একটু শুধু ফুলে রয়েছে।”

”ক্ষুদিরামবাবু পড়িয়ে যান কখন?”

”আটটায়।”

”ঠিক আটটায় আমি গাড়ি পাঠাব। ভাল কথা, তুমি নাকি একটা কুকুর পুষেছ? দিশি কুকুর।”

”খয়েরি, ওর গায়ের রঙে নামটা রেখেছি।” এর পর গলায় উচ্ছ্বাস ঝরিয়ে কলাবতী বলল, ”বড়দি ওকে আপনি দেখবেন? তা হলে ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব।”

”নিয়ে এসো।”

ঠিক আটটায় মলয়ার পাঠানো গাড়ি এল। কলাবতী বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে দেখল সদর দরজা থেকে একটু দূরে খয়েরি গোল হয়ে শুয়ে রয়েছে। গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে কলাবতী ডাকল, ”আয় আমার সঙ্গে।” খয়েরি ওর পিছু নিল।

গাড়ির পেছনের দরজা খুলে কলাবতী বলল, ”ওঠ।”

খয়েরির কথাটা বোধগম্য হল না, সে লেজ নাড়ল শুধু। কখনও সে মোটরগাড়িতে চড়েনি। কলাবতী আবার বলল, ”ওঠ ওঠ।” খয়েরি লেজ নেড়েই চলল, কলাবতী ওর কোমর দু’ হাতে ধরে খোলা দরজার দিকে ঠেলল, ”ওঠ, ভেতরে চল।” খয়েরি শক্ত হয়ে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। এবার কলাবতী ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে গাড়ির মধ্যে তুলে দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠেই দরজা বন্ধ করে দিল, যাতে খয়েরি নেমে যেতে না পারে।

ড্রাইভার রামভরোসা হাসছিল, বলল, ”মংলাকে নিয়ে কোনও তকলিফ হয় না, দিদি গাড়িতে বসে একবার ডাকলেই উঠে আসে।”

”ওর অভ্যেস আছে গাড়ি চড়ার।” কলাবতী শুকনো স্বরে বলল।

গাড়িতে তিন মিনিটের পথ। খয়েরিকে সিটের পাশে বসিয়ে কলাবতী জড়িয়ে ধরে রইল। খয়েরি জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দ্রুত সরে যাওয়া দোকানের উজ্জ্বল আলো দেখতে দেখতে, আর পাশ দিয়ে যাওয়া গাড়ির হর্ন শুনতে শুনতে ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়ে করুণ চোখে কলাবতীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। অভিজ্ঞতাটা তার কাছে ভীতিকর ঠেকছে।

মলয়াদের বাড়ি আকারে—প্রকারে সিংহিবাড়ির মতো বড় না হলেও, বেশ বড়। ফটক থেকে ঢুকেই সিমেন্টের চওড়া পথ। বাঁ দিকে লম্বা পাঁচিল, ডান দিকে বাড়ি। বাড়ির সদরে গিয়ে গাড়ি থামল। রামভরোসা নেমে পেছনের দরজা খুলে দিল। কলাবতী নেমে ডাকল, ”আয়।”

খয়েরি গাড়ি থেকে সবেমাত্র নেমেছে আর তখনই একটা ”ঘৌ” নির্ঘোষ সদর দরজার ওপরের বারান্দা থেকে তাদের অভ্যর্থনা জানাল। কলাবতী মুখ তুলে দেখল চার নম্বর ফুটবলের আকারের মঙ্গলার মাথাটা বারান্দার রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে। আরও তিনটে ”ঘৌ” শোনা গেল। খয়েরি সরে এল কলাবতীর পেছনে।

বাড়িতে ঢোকার জন্য পা বাড়িয়ে কলাবতী ডাকল, ”আয় আমার সঙ্গে।” আসার কোনও ইচ্ছা খয়েরির ভঙ্গিতে ফুটল না। কলাবতী আর ডাকাডাকি না করে ওর বকলেসটা শক্ত করে ধরে অনিচ্ছুক খয়েরিকে হিঁচড়ে টেনে দোতলার সিঁড়ি পর্যন্ত নিয়ে গেল। এভাবে সিঁড়ি দিয়ে তোলা যাবে না তাই খয়েরিকে সে কোলে তুলে উঠতে শুরু করল। বাঁক নিয়েই দেখল মঙ্গলা সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে। কান দুটো খাড়া, প্রায় পাঁচ ইঞ্চি লম্বা জিভটা ঝুলছে। পাঁশুটে আর কালো রঙের ঘন বড় বড় লোম, দীর্ঘ লেজ, বিশাল ভারী শরীর। ওদের দেখে সে আবার ডেকে উঠল এবং তা সারা বাড়িতে প্রতিধ্বনিত হল।

কলাবতী ওর পেল খয়েরির কথা ভেবে। অচেনা একটা কুকুর তার নিজের এলাকায় ঢুকেছে এটা হয়তো মঙ্গলা সহ্য নাও করতে পারে। যদি ঝাঁপিয়ে পড়ে খয়েরিকে কামড়ে মেরে ফেলে। খয়েরি আকুপাকু করছে কলাবতীর কোল থেকে নামার জন্য।

”বড়দি, বড়দি।” কলাবতী চেঁচিয়ে উঠল।

ঘর থেকে মলয়া বেরিয়ে এল। ”দাঁড়িয়ে আছ কেন, ওপরে এসো। এই তোমার খয়েরি, বাঃ বেশ দেখতে তো!”

”মঙ্গলাকে সরান বড়দি, খয়েরি ভয় পাচ্ছে।”

মলয়া মৃদু কিন্তু দৃঢ় স্বরে ডাকল, ”মঙ্গলা….কাম হিয়ার।” শোনামাত্র সে মলয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ”সিট ডাউন।” মঙ্গলা উবু হয়ে বসে খয়েরির দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে ছোট্ট একটা ”ঘৌ” করল।

এগিয়ে এসে মলয়া কলাবতীর কোল থেকে খয়েরিকে দু’ হাতে নিয়ে বলল, ”মাথার সাদাটা খুব সুন্দর। বয়স কত?”

”তা তো জানি না বড়দি। রাস্তায় পেয়েছি, খুব রোগা ছিল। অপুর মা খাইয়ে—দাইয়ে ওকে নাদুসনুদুস করে দিয়েছে! কী ঝকঝকে হয়েছে ওর লোমগুলো!”

কথা বলতে—বলতে ওরা ঘরে এসে খাটে বসল। যেখানে বসতে বলা হয়েছিল, মঙ্গলা সেখানে বসেই রইল।

”তোমার কপাল তো এখনও ফুলে রয়েছে। ইসস ঠিক রগের কাছটায়, যদি ওখানে লাগত?”

হালকা সুরে কলাবতী বলল, ”লাগলে কী আর হত অজ্ঞান হয়ে যেতুম। তারপর হাসপাতালে দু’দিন পরে মরে যেতুম।” বলতে বলতে সে মলয়ার কোলে থাকা খয়েরির পিঠে হাত বুলোল। মঙ্গলা ঘরের দরজা থেকে উসখুস করে ”আঁউ আঁউ” করে উঠল। কলাবতী তাকে ডাকল, ”আয় মঙ্গলা।” মঙ্গলা ইতস্তত করে ঘরে ঢুকল।

কলাবতীর কথা শুনে রেগে মলয়া বলল, ”ফাজলামো করতে হবে না। ক্রিকেট একটা মারাত্মক খেলা।”

”বড়দি, হাজার হাজার ছেলে ক্রিকেট খেলছে কিন্তু ক’জন মরছে?”

”একজনও মরছে না, কেমন?” মলয়া উত্তেজিত হয়ে বলল, ”কিন্তু তুমি এখনও এই খেলার উপযুক্ত হওনি। হাজার হাজার ছেলে রবারের বল দিয়ে খেলছে। এই তো সেদিন কীসের জন্য, যেন একটা বনধ হল, রাস্তায় ছেলেরা রবারের বলে ক্রিকেট খেলছিল। তুমিও তো রবারের বলে খেলতে পারো।”

”কিন্তু বড়দি, আমি সত্যিকারের ক্রিকেটার হতে চাই। রবারের বল খেলে কখনওই তা হওয়া যাবে না।” বলতে বলতে কলাবতী লক্ষ করল মঙ্গলা দু’পা এগিয়ে মুখটা বাড়িয়ে দিল বড়দির কোলে গুটিয়ে থাকা খয়েরির মুখের দিকে। খয়েরি ভয়ে ”কুঁই কুঁই” করে উঠে মুখটা গুঁজে দিল বড়দির কোলে। এতবড় একটা অ্যালসেশিয়ানকে সে জীবনে কখনও এত কাছ থেকে দেখেনি। মঙ্গলা খয়েরির কানের কাছে শুঁকল। জিভ দিয়ে কানটা চাটল। বড়দি কলাবতীকে জবাব দিতে গিয়ে মঙ্গলার কাণ্ডটা নজর করে ঠোঁট টিপে হাসল।

”ভাব করতে চাইছে।” মৃদু গলায় মলয়া বলল। ”ভয় কী খয়েরি, দিদি হয় তোমার, কিচ্ছু বলবে না।” খয়েরিকে সে একটু ঠেলে ধরল মঙ্গলার দিকে। মঙ্গলা খয়েরির নাকের কাছে নিজের নাকটা নিয়ে গিয়ে শুঁকল। নাক ঝাড়ার মতো ”ফোঁত ফোঁত” শব্দ করল, খয়েরি ভয়ে ভয়ে ট্যারা চোখে ওর দিকে তাকাল। মঙ্গলা দু’বার চেটে দিল ওর মাথা।

কলাবতীর মনে হল খয়েরির ভয়টা কেটে গেছে, কেননা মুখটা নামিয়ে সে মঙ্গলার দেওয়া আদর নিরুদ্বেগে মাথায় নিয়ে চলেছে।

”ক্রিকেটে খেলা ছাড়া আরও অনেক কিছু আছে, সেসব তো করতে পারো।” মলয়া আবার ক্রিকেটের কথায় ফিরে এল। ”স্কোর লেখাও তো একটা বড় কাজ। মাঠে নামতে হবে না অথচ খেলার সঙ্গেও রইলে। আমি বরং বাবুদাকে বলে দেব তোমাকে স্কোরার হওয়ার ট্রেনিং দিতে।”

কলাবতী ব্যগ্র স্বরে বলল, ”তা হলে আমাকে লাস্ট পিরিয়ডে ছেড়ে দেবেন?”

”কেন?” মলয়া ভ্রূ কোঁচকাল। ”স্কোর লেখা তো বাড়িতে বসেও শেখা যায়। তুমি ক্রিকেট আইনের বইতেই পাবে স্কোরারদের কী কী কাজ করতে হবে। কার্ডিফে গ্ল্যামোরগান আর ইন্ডিয়ান টিমের খেলা দেখতে যাওয়ার আগে আমি ক্রিকেট আইনের বইটা উলটে—পালটে দেখেছিলুম।”

”স্কোরিংয়ের একটা প্র্যাকটিক্যাল দিকও তো আছে। সেটা মাঠে বসে না করলে শেখা যাবে না।” কলাবতী মরিয়া হয়ে এবার শেষ চেষ্টা করল।

মলয়া খয়েরির পিঠে হাত বুলোতে—বুলোতে আলোচনায় শেষ পেরেকটা পুঁতে দিল। ”নেট প্র্যাকটিসে স্কোর লেখার দরকার হয় এমন কথা কখনও তো শুনিনি।”

কলাবতী বুঝে গেল শেষ পিরিয়ডে তার ছুটি পাওয়ার দফা—রফা হয়ে গেছে। তারপরই দেখল অদ্ভুত জিনিস, মঙ্গলা চোখ বুজে মুখটি তুলে আর খয়েরি তার চোয়াল—থুতনি চেটে দিচ্ছে। ভয় ভেঙে গেছে খয়েরির। মলয়া কোল থেকে ওকে মেঝেয় নামিয়ে দিয়ে বলল, ”বিস্কিট দিই খয়েরিকে।”

মলয়া ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মঙ্গলা তার পিছু নিল। খয়েরিও যাচ্ছিল, কলাবতী ধমকে উঠতে থমকে পড়ল। মিনিট দুই পরে মলয়া ফিরল, হাতে দুটি চৌকো আকারের বিস্কুট। একটি মুখের সামনে ধরতেই খয়েরি টেনে নিয়ে খেতে শুরু করল। মঙ্গলা ঘাড় বাঁকিয়ে খাওয়া দেখতে লাগল।

”কালু, মাংসের চপ ভাজছে ঠাকুর, হাতটা ধুয়ে এসো।”

কলাবতী বাইরে দালানের বেসিনে হাত ধুয়ে এল। ”বড়দি, মঙ্গলাকে বিস্কুট দিলেন না?”

”ওর রাতের খাওয়া হয়ে গেছে। তারপর আর কিছু খেতে দেওয়া হয় না।” মলয়া সস্নেহে মঙ্গলার মাথায় হাত বুলোল, ”ওর সবকিছুই চলে নিয়ম মেনে। খয়েরি খায় ক’টার সময়?”

কলাবতী ঢোক গিলল। সবার খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর অপুর মা রাত দশটা নাগাদ সবার উচ্ছিষ্ট যা পড়ে থাকে সেগুলোই ফিটনের ঘরে খয়েরির থালায় রেখে আসে। একথা জানাতে কলাবতীর লজ্জা করল। সে শুধু বলল ”দশটার সময় খায়।”

একটা প্লেটে দুটো বড় আকারের চপ আর স্যালাড নিয়ে এল ঠাকুর। কলাবতী একটা চপ থেকে একটু ভেঙে মঙ্গলার মুখের কাছে ধরল, কতটা নিয়ম মানে সেটা পরীক্ষা করার জন্য।

”ভাজাভুজি কখনও মঙ্গলাকে খাওয়ানো হয়নি। দেখো ও খাবে না।”

সত্যিই তাই হল। চপের টুকরোটা একবার শুঁকেই মঙ্গলা মুখ সরিয়ে নিল। কলাবতী সেটা খয়েরির মুখের সামনে ধরতেই সে শোঁকাশুঁকি না করেই কপাত করে মুখে পুরে দিল।

”কালু, এসব জিনিস ওকে খাইও না।” মলয়া বিচলিত করে বলল, ”পেটের গোলমাল হবে, লোম ঝরে যাবে।”

”কিচ্ছু হবে না খয়েরির। ও তো ভুখা পার্টি থেকে এসেছে, যা খাবে হজম করে ফেলবে।” কলাবতী নিশ্চিন্ত গলায় বলল।

ওরা ফিরে আসার জন্য যখন গাড়িতে উঠছে মঙ্গলা তখন বারান্দার রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে মাথা বার করে ডাকাডাকি শুরু করে দিল। কলাবতীর মনে হল, খয়েরি চলে যাচ্ছে বলে মঙ্গলার মনখারাপ হয়ে গেছে।

”খয়েরি আবার আসবে।” কলাবতী হাত তুলে মঙ্গলাকে বিদায় জানাল। গাড়ি যখন ফটক পেরিয়ে রাস্তায় পড়ল তখনও ঘৌ ঘৌ ডাক সে শুনতে পাচ্ছে।

.

কলাবতী বাবুদাকে জানিয়ে দিল বড়দি খেলার জন্য ছুটি দেবেন না।

”না দিক, তুমি স্কুলের পর বাসে উঠে সোজা চলে এসো। হয়তো একটু দেরি হবে, প্র্যাকটিসের সময় খানিকটা কমে যাবে। তা হোক, যতটুকু হয় সেটাই লাভ। আমাদের স্কুলগুলোর ছুটির সময়টা এমন, ছেলেমেয়েরা খেলাধুলো করবে কখন, শিখবেই বা কখন, আমি বরং মলুকে জানিয়ে দেব তুমি স্কোরার হওয়ার জন্য বাড়িতে প্র্যাকটিস করছ।” তারপর ধুপুকে বলল, ”খবরদার স্কুলে একদম মুখ খুলবে না।”

এইভাবে বড়দিকে লুকিয়ে সল্টলেকের নেটে চলল কলাবতীর প্র্যাকটিস। বাড়িতে সে নানাদিকে ঝাঁপিয়ে বল ধরার কসরত চালিয়ে যেতে লাগল দাদুর বা মুরারির ছোড়া বলে। তার দুটো কনুই ও পুরো বাহু ছড়ে গিয়ে রক্ত বেরোল, বেকায়দায় পড়ে গিয়ে ব্যথা হল কিন্তু সে এইসব ঝামেলা গ্রাহ্যে আনল না। তাকে উইকেটকিপার হতেই হবে।

স্কুলের প্রতিষ্ঠা বছরের সুবর্ণজয়ন্তী, তাই সোমবার স্কুলের ছুটি। দুপুরে সভা, বিকেলে নানা অনুষ্ঠান ও নাটক হবে। নাটকে কলাবতীর ছোট্ট একটা পার্ট আছে ঝগড়ুটে এক বিধবা বুড়ির। সকাল থেকে ঘরে আয়নার সামনে সে একাই মহড়া দিয়ে যাচ্ছিল, তখন সত্যশেখর কোর্টে বেরোবার মুখে ব্যস্ত হয়ে ঘরে ঢুকে বলল, ”কালু, আমার একটা কাজ করে দিবি, ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতে হবে। আজ সন্ধেবেলায় আমাদের কোর্টের এক বেয়ারাকে এক হাজার টাকা দিতে হবে, কাল ওর ছেলে মুম্বইয়ে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাবে, এদিকে হাতে একটা পয়সাও নেই, ধার করার অনেক চেষ্টা করেও জোগাড় করতে পারেনি। শেষে আমার কাছে চাইল। মানুষটা খুব ভাল, বলেছি সোমবার এসে যেন নিয়ে যায়। তুই টাকাটা তুলে মুরারির কাছে রেখে দিস।”

এই বলে সত্যশেখর চেকটা কলাবতীর হাতে দিল। সে এর আগে ব্যাঙ্ক থেকে কয়েকবার চেক ভাঙিয়েছে। তাদের বাড়ির খুব কাছেই ক্যালকাটা ব্যাঙ্কের শাখা। ব্যাঙ্কের কর্মচারীদের অনেকে তাকে চেনে। সাড়ে দশটায় কলাবতী ব্যাঙ্কের কোলাপসিবল গেটে এল। এক মানুষ গলে যাওয়ার মতো ফাঁক রেখে গেটটা মোটা লোহার শিকল জড়িয়ে সেটায় তালা লাগিয়ে বন্ধ। একনলা বন্দুক হাতে দরোয়ান ভেতরে দাঁড়িয়ে। ভেতরে বেশ ভিড়। কলাবতী বুকসমান উঁচু খোলা কাউন্টারে বসা লোকটিকে চেক দিয়ে পেতলের একটা চাকতি টোকেন নিল। তাতে নম্বর লেখা সতেরো। সে পেমেন্ট লেখা লোহার খাঁচার মতো জাল ঘেরা কাউন্টারের সামনে ছোট ভিড়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। খাঁচার মধ্যের লোকটি টোকেন নাম্বার ডাকছে, টোকেন নিচ্ছে, নোট গুনে ফোকরের মধ্যে দিয়ে সেগুলো এগিয়ে দিচ্ছে, টাকা পেয়ে নোট গুনে নিচ্ছে। কলাবতী দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছে এবং দেখতে তার ভালই লাগছে। ব্যাঙ্কের লোকেরা কী অদ্ভুত দ্রুত নোট গোনে এবং ভুল করে না। এটা তাকে অবাক করে। সে এর আগে যে ক’বার টাকা তুলেছে কখনও কাউন্টারে দাঁড়িয়ে গুনে মিলিয়ে নেয়নি। বাড়ি এসে গুনে দেখেছে একটা টাকাও বেশি বা কম নেই।

.

নিবিষ্ট হয়ে সে পিঁপড়ের শুঁড় নাড়ানোর মতো নোট গোনা আঙুলের নড়াচড়া দেখছিল তখনই একটা ভারী গলার চিৎকার করে বলা কথা সে শুনতে পেল, ”কেউ নড়বেন না। যে যেখানে যেমনভাবে আছেন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকুন। বাধা না দিলে আপনাদের কোনও ক্ষতি আমরা করব না।” ব্যাঙ্কের ভেতরে দাঁড়িয়ে কোলাপসিবল গেট টেনে বন্ধ করে দিয়ে লোকটি হাতের রিভলভার দারোয়ানের পেটে ঠেকিয়ে বন্দুকটা ছিনিয়ে নিয়ে তাকে ভয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া ভিড়ের মধ্যে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দিল।

লোকটির মাথায় সাদা ক্যাপ যেমনটি ক্রিকেটাররা পরে। চোখের নীচ থেকে গলা পর্যন্ত মুখ একটা সবুজ রুমাল বেঁধে ঢেকে রাখা। পরনে বিবর্ণ জিনস আর গোলগলা নীল গেঞ্জি, স্বাস্থ্যটা মোটেই কলাবতীর পড়া বিশেডাকাত বা রোঘোডাকাতের মতো নয়, খুবই ছিপছিপে পাতলা।

কলাবতীর পাশ থেকে কেউ ফিসফিস করে বলল, ”ডাকাত পড়েছে। কেউ যেন না বাধা দেয়। ওরা ব্যাঙ্ক লুট করেই চলে যাবে।”

ব্যাঙ্কের ভেতরে তখন প্রায় তিরিশজন লোক। তার মধ্য থেকে তিনজন দ্রুত মুখে কালো রুমাল বেঁধে নিয়ে ছুটে কাডন্টারের ওধারে হলঘরে ঢুকে পড়ল। তাদের দু’জনের হাতে পাইপগান, অন্যজনের হাতে বড় একটা সাদা ক্যাম্বিসের ব্যাগ। ব্যাগ থেকে সে দু’হাত লম্বা একটা মোটা রড বার করে হলঘরের একমাত্র টেলিফোনটাকে পেটাল। ভেঙে ছত্রাকার হয়ে গেল টেলিফোনটা। তারপরই সে হাত বাড়াল সেই টেবলে বসা অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের দিকে। তিনি ভয়ে—ভয়ে মাথা নাড়লেন। ডাকাতটি তার টেবলের খোলা ড্রয়ারটা টেনে একটা চামড়ার ওয়ালেট বার করে খুশিতে মাথা নাড়ল।

ইতিমধ্যে দুই পাইপগানধারী একজন ম্যানেজারের ঘরে ঢুকে পড়েছে। কলাবতী তারপরই টেলিফোন আছড়ে ভাঙার শব্দ পেল। কয়েক সেকেন্ড পর ম্যানেজার পিঠে ঠেকানো পাইপগান—সহ নিরক্ত মুখে কাঁপতে—কাঁপতে বেরিয়ে এলেন, স্ট্রংরুমের চাবি রাখা ওয়ালেটটি ম্যানেজারের হাতে দিয়ে ব্যাগধারী তাকে কী যেন বলল। পাশেই তালা দেওয়া একটা ভারী দরজার দিকে ম্যানেজার এগোলেন। তাকে অনুসরণ করল দু’জন।

”হারি আপ, হারি আপ, ডোন্ট ওয়েস্ট টাইম।” গেটে দাঁড়ানো নেতা অধৈর্য হয়ে চিৎকার করে উঠল। সারা ব্যাঙ্ক পাথর, বোবা। টেবলে বসা কর্মচারীরা ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে। কিছু করতে গেলেই গুলি খেতে হবে। কলাবতী লক্ষ করছিল নেতাকে। একটা মশা বা কোনও পোকা নেতার বাঁ চোখের পাশে কামড়েছে বোধ হয়। মুখে বাঁধা রুমালটা টেনে নামিয়ে সে চুলকোতে শুরু করল। কলাবতী দেখল ওর বাঁ চোখের নীচেই একটা বড় আঁচিল আর বাঁ চোখের ওপর পাতাটা অর্ধেক নেমে, ঘুম পেলে যেমন আধবোজা হয় অনেকটা সেইরকম। নেতার চোখ হঠাৎ পড়ল কলাবতীর ওপর, ভ্রূ তুলে মেয়েটি তার মুখের দিকে তাকিয়ে। সে দ্রুত রুমালটা টেনে তুলে দিয়ে অস্বস্তিভরে বারকয়েক কলাবতীর দিকে তাকাল।

”ম্যানেজারের টেবলের নীচে তো অ্যালার্মের বাটন আছে, টিপে দিল না কেন?” ফিসফিস করে একজন বলল।

”টিপুক আর গুলি থাক।” সঙ্গে—সঙ্গে আর একটা ফিসফিস হল। ”আগে ব্যাঙ্ক না আগে প্রাণ?”

কলাবতীর কানে আরও কিছু কথা এল :

”দেখলেন, সব আগে থেকে ওরা অবজার্ভ করে রেখেছে, চাবির ব্যাগটা কীরকম ভাবে ড্রয়ার থেকে বার করে নিল!”

”আরে মশাই, ভেতরে ওদের লোক আছে খবর দেওয়ার। ঠিক জানে ভল্ট খুলতে দুটো চাবি লাগে আর সে দুটো কার কার কাছে থাকে।”

ডাকাতদুটো মিনিট তিনেকের মধ্যেই ছুটে স্ট্রংরুম থেকে বেরিয়ে এল। তিনজন হলঘরের মধ্য দিয়ে দৌড়ে কাউন্টারের এদিকে এসে গেটের দিকে এগোল। ভিড় বিভক্ত হয়ে ওদের জন্য যাওয়ার পথ করে দিল। গেটটা ফাঁক করে নেতা দাঁড়িয়ে। ক্যাম্বিসের ব্যাগটা রুগণ অবস্থায় স্ট্রংরুমে ঢুকেছিল, বেরোল এমনই নধর হয়ে যে, গেটের ফাঁক দিয়ে তাকে গলাতে গিয়ে পেটটা আটকে গেল। অবশেষে একটা হ্যাঁচকা টানে তাকে বার করা গেল।

সবশেষে বেরোল নেতা। বেরোবার আগে সে কলাবতীর দিকে একঝলক তাকিয়ে নিল। বেরিয়ে গেটটা টেনে বন্ধ করেই সে ছুটে গিয়ে, ইঞ্জিন চালিয়ে রেখে অপেক্ষা করা একটা মোটরবাইকে উঠে পড়ল। তাতে চালক ছাড়াও বসে ছিল ব্যাগ কোলে নিয়ে অন্য ডাকাতটি। নেতা ওঠামাত্র তিনজনকে নিয়ে বাইকটা পশ্চিম দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট লাগাল। বাকি দুই ডাকাতকে নিয়ে আর একটা বাইক আগেই রওনা দিয়েছে পূর্ব দিকে। পুরো ব্যাপারটা ঘটতে সময় লাগল মিনিট সাতেক।

মোটরবাইক দুটো চলে যাওয়ার সঙ্গে—সঙ্গে ”ডাকাত, ডাকাত” রব যথারীতি উঠল। লোকজন বাইরে থেকে ছুটে এল। সবাই জানতে চায় কত টাকা ডাকাতি হয়েছে, কেউ মরেছে কিনা। ম্যানেজার মুহ্যমানের মতো হলঘরে বসে শুধু মাথা নেড়ে যাচ্ছেন। থানায় ও লালবাজারে খবর দেওয়া হয়েছে, পুলিশ আসছে। আজ আর ব্যাঙ্কের কোনও কাজকর্ম হবে না। টাকা নেওয়াও নয়, দেওয়াও নয়।

টোকেনটা সঙ্গে নিয়ে কলাবতী বাড়ি ফিরে এল। তার মন খুব খারাপ লাগছে কাকার সেই বেয়ারাটির কথা ভেবে, যে আজ সন্ধ্যায় এক হাজার টাকা নিতে আসবে। তার ছেলে কাল মুম্বই যাবে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে, হাতে একটা টাকাও নেই। মুম্বই তো আর রানাঘাট কি বর্ধমানের মতো একদিনেই যাতায়াত করা যায় না, হাজার—বারোশো মাইল দূরে তো হবেই। অতদূরে যেতে হলে কিছু টাকা তো সঙ্গে রাখা উচিত।

আজই স্কুলের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব। সন্ধ্যাবেলায় তাকে নাটকে নামতে হবে। তার ইচ্ছে করছে না স্কুলে যেতে। দাদুকে সে ব্যাঙ্ক ডাকাতির ঘটনাটা সবিস্তারে বলল। আর বলল, কেন সত্যশেখর টাকাটা তুলতে তাকে পাঠিয়েছিল।

”সতুর কাছে এক হাজার টাকা নেই! আশ্চর্য! এক হাজার টাকা দেওয়ার জন্য সিংহিবাড়ির ছেলে কিনা চেক কাটল?” রাজশেখর রাগে গরগর করে কথাগুলো বলে শোয়ার ঘরে গিয়ে সিন্দুক থেকে দশটা একশো টাকার নোট বার করে এনে কলাবতীর সামনে ধরে বললেন, ”যা, মুরারির কাছে রেখে আয়।”

স্কুলের অনুষ্ঠানের পর রাত্রে বাড়ি ফিরে সদর দরজা পেরোতেই কলাবতী সেরেস্তা থেকে চাপা গলায় কাকার ডাক শুনল, ”কালু, একটু দাঁড়া।”

ঘর থেকে বেরিয়ে এল সত্যশেখর। কলাবতীর মুখে নাটকের মেকআপ, সত্যশেখরের মুখে বিপক্ষ কৌঁসুলির আচমকা তোলা নতুন এক পয়েন্ট। ”বাবাকে তুই বলেছিস আমার কাছে টাকা নেই?”

অবাক কলাবতী বলল, ”তা তো বলিনি। শুধু বলেছি চেকে টাকা তোলার জন্য আমাকে ব্যাঙ্কে পাঠিয়েছ। তোমার লোক টাকা নিতে এসেছিল?”

”এসেছিল, নিয়ে গেছে। নাটক কেমন হল?”

কলাবতী উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ”দারুণ হয়েছে। সবচেয়ে ভাল হয়েছে বড়দির, উকিলের পার্ট করেছিল। আমি করেছি মিথ্যে সাক্ষী দিতে আসা এক বুড়ির।”

”ব্যাঙ্কের টোকেনটা তোর কাছে রয়েছে, কাল গিয়ে টাকাটা নিয়ে আসবি।” এই বলে সত্যশেখর ব্যস্ত হয়ে সেরেস্তায় ঢুকে গেল।

রাতে খাওয়ার টেবলে ব্যাঙ্ক ডাকাতি এবং স্কুলের নাটক নিয়ে কথাবার্তা হল। সত্যশেখর জানতে চাইল, ”কালু তুই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলি তো? এতদিন তো শুধু বইয়ের পাতায় আর সিনেমাতেই ডাকাত দেখেছিস, এবার রক্তমাংসের ডাকাত দেখা হয়ে গেল। কেউ যে রেজিস্ট করতে যায়নি এটাই বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছে।”

রাজশেখর গর্জন করে উঠলেন, ”বুদ্ধিমান না ছাই। কাপুরুষের মতো কাজ হয়েছে। আটঘরার বাড়িতে একবার ডাকাত পড়েছিল। আমাদের শ্যামা পাইক লাঠি আর সড়কি নিয়ে একা মহড়া দিয়েছিল সেই ডাকাত দলের সঙ্গে, শেষে পালাবার পথ পায় না। গ্রামের লোক তাড়া করে চারটেকে ধরে ফেলে গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে দেয় তিনদিন। শেষে মাফ চেয়ে নাকখত দিয়ে বলল, জীবনে আর ডাকাতি করবে না। তখন ওদের ছেড়ে দেওয়া হয়।”

”বাবা, এটা কোন সময়ের ঘটনা।” সত্যশেখর তেরছা চোখে তাকাল বাবার দিকে।

কলাবতী বলল, ”শুনলে না, লাঠি—সড়কি নিয়ে ডাকাতদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল, নাকখত দিইয়ে চারজনকে ছেড়ে দিয়েছিল। দাদু, এটা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের ঘটনা, তাই না?”

”এইট্টিন ফিফটি নাইনের। সিপাহি বিদ্রোহের দু’ বছর পরে।” রাজশেখরের গলায় বনেদি আভিজাত্য ঝলসে উঠল। ”তখন বাঙালির সাহস ছিল।”

সত্যশেখর বলল, ”এখন পাইপগান—বোমা আর পিটিয়ে মেরে ফেলার আমল। এখন সাহস দেখায় শুধু ডাকাতরাই। লড়াই করার জন্য এখন কাছে আসতে হয় না। দূর থেকেই গুলি করে দেয়, বোমা ছোড়ে। মানুষ ভয় পায় বলেই ওরা সাহসী।”

এই শুনে রাজশেখরের মুখের উদ্দীপ্ত ভাবটা ধীরে—ধীরে ম্লান হয়ে গেল। গলা নামিয়ে শুধু বললেন, ”অনেক কিছুই আমাদের হারিয়ে গেছে।”

দাদুর মুখ দেখে কলাবতী দুঃখ পেল। এই সময় তার মনে পড়ে গেল একটা কথা। চোখ বড় করে সে বলে উঠল, ”জানো দাদু, নাটকের পর গ্রিনরুমে বড়দি চুপি চুপি আমাকে কী বলল?…মঙ্গলার বাচ্চচা হবে আর তিন মাস পরেই।”

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল অপুর মা। সে ঘরে ঢুকল, চোখ চকচক করছে, গলায় চাপা উত্তেজনা, বলল, ”আমাদের খয়েরিরও বাচ্চচা হবে কালুদি।”

শোনামাত্রই কলাবতী দু’হাত তুলে লাফিয়ে উঠল, রাজশেখরের মুখে হাসি ফুটল আর সত্যশেখর মাথা চুলকোতে শুরু করে দিল।

পরের দিন খবরের কাগজে দশ লাইন বেরোল এই ডাকাতির খবর। খবরের শেষে লেখা: ‘ডাকাতির কোনও সূত্র পুলিশ পায়নি, কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। ডাকাতি হওয়া ছয় লক্ষ টাকা উদ্ধার করতে পারবে বলে পুলিশ আশা করছে। জোর অনুসন্ধান চলছে।’

সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের জন্য পরদিনও স্কুলের ছুটি। কলাবতী ব্যাঙ্কে গিয়ে জানল যারা গতদিন টোকেন নিয়ে টাকা তুলতে পারেনি তারা আজ পাবে, ব্যাঙ্কের ফটকে রাইফেল হাতে দু’জন পুলিশ, যারা ঢুকছে তাদের দিকে তীক্ষ্ন চোখে তাকাচ্ছে। ভেতরে যথারীতি কাজকর্ম চলছে, পরিবেশ থমথমে। কলাবতী গতকালের টোকেনটা কাউন্টারে যাকে দিল তিনি মুখচেনা। নতুন একটা টোকেন তাকে দিয়ে তিনি বললেন, ”কাল অত তাড়াতাড়ি চলে গেলে কেন, পুলিশ এসে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করল।

কলাবতী আলগোছে বলল, ”জিজ্ঞেস করলে আমি বলতুমই বা কী? সবাই যা দেখেছে আমিও তাই দেখেছি। কী জিজ্ঞেস করল পুলিশ?”

”কাউকে চেনা মনে হল কি না, দেখলে চিনতে পারবেন কি না, এইসব। আজও তো ওরা এসে জিজ্ঞেস করছে, ঘুরে—ঘুরে দেখছে, ওই দ্যাখো না দুটো লোক। ডাকাতরা কি আর কোনও ক্লু রেখে গেছে যে, চাইলেই পেয়ে যাবে।” লোকটি তাচ্ছিল্যভরে তাকাল।

কলাবতী দেখল হাওয়াই শার্ট পরা সাধারণ চেহারার দুটি লোককে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার টেবলের ড্রয়ার টেনে খুলে—খুলে দেখাচ্ছেন। এর পর ওই দু’জনের একজন নিজে ড্রয়ার টানাটানি শুরু করল।

ব্যাঙ্কে আজও বেশ ভিড়। কলাবতী সরে গিয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় দাঁড়াল। তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, লোকটির কথাগুলো—কাউকে চেনা মনে হল কি না, দেখলে চিনতে পারবেন কি না। নাহ, চেনা মনে হওয়ার কোনও উপায়ই ছিল না। সবাই মুখ ঢেকে রেখেছিল রুমালে, শুধু চোখদুটো দেখা যাচ্ছিল। তাই দিয়ে কাউকে পরে চেনা সম্ভব নয়, কেউ কথা বলেনি শুধু লিডার ছাড়া। গলার আওয়াজটা তার মনে আছে শুনলে হয়তো চিনতে পারবে।

একটু পরেই তার টোকেন নাম্বার ধরে ডাক হল। কলাবতী পেমেন্ট কাউন্টারের দিকে এগোল। তার আগের লোক টাকা পেয়ে তখন কাউন্টারে দাঁড়িয়ে গুনছে। গুনতে—গুনতে লোকটি আঙুল দিয়ে দু’—তিনবার চোখের কোণ ঘষল। তাই দেখে কলাবতীর হঠাৎই ডাকাতদের নেতার কথা মনে পড়ে গেল, সেও চোখের নীচে চুলকোচ্ছিল, একটা আঁচিল, চোখটা আধবোজা…এই তো ক্লু!

.

টাকা নিয়ে সে কাউন্টার ঘুরে ব্যাঙ্কের ভেতরে ঢুকল। কোথায় পুলিশের লোক দু’জন? সে এধার—ওধার তাকিয়ে তাদের দেখতে পেল না। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করল, তিনি বললেন, ”ওরা তো এইমাত্র চলে গেল। কেন, কী দরকার?”

”দরকার আছে।” বলেই কলাবতী ছুটল কোলাপসিবল গেট লক্ষ করে। লোক দু’টি তখন একটা জিপে উঠতে যাচ্ছে।

”এই যে, এই যে, শুনুন।” হাত তুলে সে দৌড়ে গেল। লোকদুটি ফিরে তাকাল।

হাঁফাতে—হাঁফাতে কলাবতী বলল, ”আপনাদের আমি একটা ক্লু দিতে পারি। কাল যে ডাকাতিটা হল তার লিডারের বাঁ চোখের নীচেই একটা বড় আঁচিল আছে আর লোকটার বাঁ চোখটা আধবোজা।”

ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করার পর একজন বলল, ”চলো, ভেতরে চলো।”

লোকদুটি কলাবতীকে নিয়ে ব্যাঙ্কের ভেতরে এসে ম্যানেজারের ঘরে ঢুকল। একজন বিনীতভাবে ম্যানেজারকে বলল, ”আপনার কাজে একটু ব্যাঘাত ঘটাব। আমরা এই মেয়েটির সঙ্গে একটু কথা বলব। জরুরি গুরুত্বপূর্ণ কথা, বাইরে বসে বলতে চাই না।”

ম্যানেজার শশব্যস্ত বললেন, ”বসুন, বসুন। যতক্ষণ ইচ্ছে কথা বলুন।”

লোকদুটির একজন নোটবই বার করল পকেট থেকে। কলাবতীর নাম, বাড়ির ঠিকানা, কে কে আছে বাড়িতে, কোন স্কুলে কোন ক্লাসে পড়ে, কীজন্য কাল ব্যাঙ্কে এসেছিল, চেকটা কার ছিল ইত্যাদি জেনে নিয়ে প্রশ্ন করল, ”তুমি ঠিক দেখেছ বাঁ চোখের নীচে আঁচিল আছে আর চোখটা ডিফেক্টিভ।”

কলাবতী জোর দিয়ে বলল, ”হ্যাঁ, ঠিক দেখেছি। লোকটা যখন দেখল আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি তখন তাড়াতাড়ি রুমালটা টেনে তুলল আর বারকয়েক আমার দিকে তাকাল। আমি যে আঁচিলটা দেখে ফেলেছি সেটা ও বুঝতে পেরেছে মনে হল।”

লোকটি খসখস করে তার কথাগুলো লিখে নিয়ে বলল, ”আমাদের কাছে ডাকাতদের যেসব ছবি আর চেহারার বর্ণনার ফাইল আছে তোমার কথামতো সেখানে আমরা খুঁজব। আমাদের যা বললে সেসব কথা আর কাউকে কি বলেছ?”

”আপনাদেরই প্রথম বললুম।”

অন্য লোকটি বলল, ”একদম এই নিয়ে কাউকে একটি কথাও বলবে না। বললে বিপদ হতে পারে। এখন তুমি আসতে পারো, অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।”

বাড়ি ফিরে কলাবতী ব্যাঙ্ক থেকে তোলা টাকাগুলো দাদুকে দিয়ে পুলিশ দু’জনকে সে যেসব কথা বলেছে তা বলল। শুনে রাজশেখরের মুখ উদ্বেগে ভরে গেল।

”তুই বলে ভালই করেছিস কিন্তু ওই যে বিপদের কথা বলল সেটা কিন্তু উড়িয়ে দেওয়ার নয়। তুই যেমন ডাকাতটার মুখ দেখেছিস তেমনই ডাকাতটাও তোর মুখ দেখে রেখেছে। যদি ও জানতে পারে তুই পুলিশকে বলে দিয়েছিস মুখে কী কী চিহ্ন আছে, তা হলে কিন্তু লোকটা তোকে আঘাত করতে পারে।” রাজশেখর থেমে—থেমে চিন্তিত স্বরে বললেন।

কলাবতীর বুকের মধ্যে হালকা একটা ভয় মেঘের মতো উড়ে গেল। ফুঁ দিয়ে সেটা সরিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে সে বলল, ”লোকটা জানবে কী করে পুলিশকে আমি বলেছি। সেখানে তো ছিলেন শুধু ম্যানেজার, তিনি নিশ্চয় ডাকাতটাকে বলতে যাবেন না।”

”পুলিশের মধ্যেও গুণ্ডাবদমাশদের লোক আছে, তারা জানিয়ে দেবে।”

তিনদিন পর বিকেলে একটা টেলিফোন এল। রিসিভার তুলে রাজশেখর বললেন, ”রাজশেখর বলছি।”

ওধার থেকে একজন পুরুষ শান্ত গলায় বলল, ”কলাবতী আপনার কে হয়?”

”নাতনি।”

শীতলকণ্ঠে লোকটি বলল, ”ওকে বারণ করে দেবেন যেন ডাকাত চেনাবার জন্য উৎসাহ না দেখায় আর সাবধানে থাকতে বলবেন।”

রেগে উঠে বললেন রাজশেখর, ”যদি উৎসাহ দেখায় তা হলে কী করবেন?”

আরও ঠাণ্ডা গলায় উত্তর এল, ”তা হলে চিরকালের মতো উৎসাহ দেখানো বন্ধ করে দেব।”

রাজশেখর জবাব দেওয়ার আগেই ওধারে ফোন রেখে দিল। এই ফোন পাওয়ার কথাটা তিনি কাউকে বললেন না, কলাবতীকেও না। তাঁর মনে হল, ডাকাতরা এখনও জানে না কালু পুলিশকে ঠিক কী বলেছে। ফোনটা করেছে আন্দাজে, আগাম একটা হুমকি দিয়ে, ভয় দেখাতে। তবে কালু কী বলেছে সেটা ওরা ঠিকই জেনে যাবে।

এর দু’দিন পর কলাবতী স্কুল থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরছে। আজ বিকেলে তার সল্টলেকে প্র্যাকটিসে যাওয়ার দিন নয়। হাওয়াই শার্ট পরা পাতলা গড়নের একটা লোক, যে তাকে স্কুলের গেট থেকে পিছু নিয়েছে তা সে জানে না। বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে—করতে সে আসছিল। বন্ধুরা যে যার বাড়ির পথে চলে যেতে সে একাই সিংহিবাড়ির ফটকে পৌঁছল। দূর থেকেই সে দেখেছিল ফটকের সামনে রাস্তায় খয়েরি তার জন্য বসে আছে। প্রতিদিনই বসে থাকে তাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির সদর দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসার জন্য। সদর দরজা পর্যন্ত গিয়ে কলাবতী স্কুল ব্যাগ থেকে টিফিনবক্স বার করবে। খয়েরি তখন দ্বিগুণ বেগে লেজটা নাড়তে—নাড়তে সামনের দু’ পা কলাবতীর কোমরে রেখে দাঁড়িয়ে উঠে, ”উঁ উঁ” শব্দ করে খাবার চাইবে। না খেয়ে ওর জন্য রেখে দেওয়া টিফিনের খাবার কলাবতী যতক্ষণ না মুখে তুলে দিচ্ছে, খয়েরি নাছোড়বান্দার মতো বারবার দাঁড়িয়ে উঠে খাবার চাইবে। অবশ্য এই সামান্য খাবারে ওর পেট ভরবে না। কিন্তু এটা প্রতি বিকেলে ওর করা চাই—ই। খয়েরি মনে করে রেখে দিয়েছে কলাবতীর সঙ্গে তার প্রথম ভাব হয়েছিল এই টিফিন খাওয়া থেকেই। আজও সে যত অল্পই হোক কলাবতীর হাত থেকে টিফিন খাবেই আর কলাবতীও ওর জন্য টিফিনের ভাগ রেখে দেবেই।

আজও কলাবতী দূর থেকে দেখল ফটকের সামনে খয়েরি উঠে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ছে। সে কাছাকাছি এলে খয়েরি ফটক দিয়ে আগে ঢুকে কয়েক পা গিয়ে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে তারপর সঙ্গে—সঙ্গে যাবে সদর দরজা পর্যন্ত। এটাই রোজ হয়ে থাকে। কলাবতী ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকল। তার পিছু নেওয়া লোকটি ফটক পর্যন্ত এসে থমকে দাঁড়াল, দু’পাশে ও ভেতরে তাকিয়ে দেখে নিল লোকজন আছে কিনা। রাস্তা দিয়ে দু’চারজন যাচ্ছে বটে কিন্তু ভেতরের বাগানে একটা কুকুর ছাড়া আর কাউকে সে দেখতে পেল না। লোকটা চট করে ফটক পেরিয়ে ঢুকল।

”অ্যাই অ্যাই, দাঁড়াও তো।”

কর্কশ গলায় ধমকের মতো কথাগুলো শুনে অবাক কলাবতী ঘুরে দাঁড়াল। চকরাবকরা হাওয়াই শার্ট পরা, বেঁটে, কালো বিশ্রী মুখের একটা লোককে সে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখল।

”কী বলেছ তুমি পুলিশকে, অ্যাঁ?” লোকটা বাঁ হাতে কলাবতীর ব্লাউজের কলার ধরে খুব জোরে ঝাঁকুনি দিল। কলাবতীর গলায় ও ঘাড়ে ব্যথা লাগল। তার মধ্যেই সে ”গররর” একটা আওয়াজ শুনতে পেল।

লোকটা কলার ছাড়েনি। আরও দু’—তিনবার ঝাঁকুনি দিয়ে চাপা গলায় হিংস্র স্বরে বলল, ”কী বলেছ, অ্যাঁ কী বলেছ?”

কলাবতী বুঝে গেছে গায়ের জোরে সে এই গুণ্ডার সঙ্গে পারবে না। মুখটা নিচু করে সে গুণ্ডার হাতটা কামড়ে ধরল সজোরে। দাঁত বসে গেল আঙুলের ওপর দিকে।

”আহহহ।” চিৎকার করে উঠেই গুণ্ডাটা ডান হাতে কলাবতীর গালে ঘুসি মারল। টলে পড়ে গেল কলাবতী। পড়ার সময় তার কানে এল, ”খ্যা খ্যা খ্যা খ্যা” একটা শব্দ।

গুণ্ডাটা জামা তুলে প্যান্টে গুঁজে রাখা একটা ছোরা বার করে কলাবতীর গলার কাছে ধরে বলে উঠল, ”কী বলেছ পুলিশকে, কী বলেছ? না বললে এই ছোরা গলায় ঢুকিয়ে দেব।”

কলাবতী চোখে অন্ধকার দেখছে। চিৎকার করে কাউকে যে ডাকবে সে জোরও তার গলায় নেই। শুকিয়ে গেছে গলা। ছোরার ঠাণ্ডা ছুঁচোলো আগাটা তার গলায় খোঁচা দিচ্ছে। সে হাঁটু গেড়ে বসা গুণ্ডাটার চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেল। তার মনে হচ্ছে ছোরাটা তার গলায় সত্যিই ঢুকিয়ে দেবে। অজ্ঞান হয়ে পড়ার আগে শুনতে পেল খয়েরির গলায় যা কখনও শোনেনি এমন একটা হাড়কাঁপানো হিংস্র গর্জন— ”ঘউউঅউঅউ।”

গুণ্ডাটার ডান পায়ের ডিমের কাছটায় খয়েরি কামড়ে ধরে মুখটা ঝাঁকাচ্ছে। প্যান্টের মধ্য দিয়ে তার দাঁত বসে গেছে মাংসে। ছোরা ধরা হাতটা সে ঘুরিয়ে সজোরে চালাল খয়েরির উদ্দেশ্যে। ছোরাটা লাগল খয়েরির সামনের বাঁ পায়ের থাবার ওপরে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছিটকে বেরোল। কিন্তু খয়েরি তার কামড় আলগা করল না।

ঠিক এই সময় বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল অপুর মা। চোখের সামনে কলাবতীকে শুয়ে থাকতে, একটা লোককে ছোরা হাতে এবং খয়েরি তাকে কামড়ে ধরে আছে দেখে সে তার বিখ্যাত আকাশ ফাটানো গলায় চিৎকার করে উঠল, ”ওগো কে কোথায় আছ গো, ডাকাতে কালুদিদিকে মেরে ফেলল গো।” বলতে—বলতে অপুর মা ছুটে গেল গুণ্ডাটার দিকে। চিৎকার শুনে রাস্তা দিয়ে যাওয়া দুটি লোক ফটকের সামনে থমকে দাঁড়াল, গাড়ি বারান্দায় ছুটে এলেন রাজশেখর। অপুর মা একটা আধলা ইট কুড়িয়ে নিয়ে ছুটলেন গুণ্ডাটার দিকে।

গতিক সুবিধের নয় বুঝে, কুকুরের কামড়ের যন্ত্রণা এবং সেকেলে ডাকাতদের মতো পিলে চমকানো হাঁক দিয়ে আসা রণরঙ্গিণী মূর্তিটিকে দেখে গুণ্ডাটি ফটকের দিকে দৌড় দিল। খয়েরি তাড়া করতে গিয়ে কয়েক পা দৌড়ে লুটিয়ে পড়ল। রাজশেখর তার দোনলা বন্দুকে কার্তুজ ভরে আবার যখন গাড়ি বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন তখন অপুর মার ছোড়া ইটটা ফটকের লোহার গরাদে লেগে ‘ঠং’ করে শব্দ তুলেছে আর গুণ্ডাটা খোঁড়াতে—খোঁড়াতে তখন রাস্তা দিয়ে দৌড়চ্ছে এবং একদল লোক তার পেছনে ছুটছে।

কলাবতীর জ্ঞান একটু পরেই ফিরে এল। প্রথমেই সে বলল, ”খয়েরি কোথায়?”

মুরারি কলাবতীকে দাঁড় করিয়ে পিঠ থেকে স্কুলব্যাগটা খুলে নিয়ে বলল, ”অপুর মা ওকে তুলে ঘরে নিয়ে গেছে, কত্তাবাবু পুলিশ আর ডাক্তারকে ফোন করছেন, তুমি কি পারবে আস্তে—আস্তে হেঁটে বৈঠকখানা পর্যন্ত যেতে?”

”আমার হয়েছে কী যে, পারব না?” এই বলে কলাবতী সটান হয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকল। অপুর মা তার নিজের ঘরের মেঝেয় খয়েরিকে শুইয়ে একটা ন্যাকড়া দিয়ে পা—টা বেঁধে রেখেছে। কলাবতী ঘরে ঢুকতেই খয়েরি মুখ তুলে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে লেজটা নাড়ল। হাড় ভেঙে ওর বাঁ পায়ের থাবাটা ঝুলে পড়েছে।

রাজশেখর ঘরে ঢুকে বললেন, ”ডাক্তার গুপ্ত অর্থোপেডিক সার্জন। তাকে ফোন করে পেলুম না, এখন কী করি?”

কলাবতী বলল, ”উনি তো মানুষের ডাক্তার। এখন দরকার ভেটারিনারি সার্জন, তুমি বরং বড়দিকে ফোন করো, মঙ্গলাকে যে ডাক্তার দেখেন তাকে কল করো।”

রাজশেখর ফোন করলেন মলয়াদের বাড়িতে। ফোন ধরলেন মলয়ার বাবা হরিশঙ্কর মুখুজ্জে।

”বলছিস কী রে রাজু, একটা নেড়িকুত্তার চিকিচ্ছের জন্য মঙ্গলার ডাক্তারকে চাই! অবাক করলি। বাড়িতে গেলে ডাক্তার পাল তিনশো টাকা নেন। দিবি?”

”হরি, তিনশো বলছিস কী রে তিন হাজার, তিন লক্ষ দেব। এই নেড়ি কুত্তাটাকে বাঁচাতেই হবে। ও আমার একমাত্র নাতনির প্রাণরক্ষা করেছে। হরি এসব বোঝার মতো ঘিলু তোর মাথায় নেই। মলু কোথায়, ফোনটা ওকে দে।”

আধঘণটার মধ্যে ডাক্তার পালকে নিয়ে মলয়া হাজির হল সিংহি বাড়িতে। শেষবার সে এ বাড়িতে এসেছিল মাধ্যমিকে থার্ড স্ট্যান্ড করে রাজশেখরকে যখন প্রণাম করতে আসে। ডাক্তার পাল খয়েরির পা দেখে বললেন, হাড় ভেঙেছে, অপারেশন করে ঠিক করতে হবে।

লোকাল অ্যানাসথেসিয়া করে ডাক্তার পাল ভাঙা হাড় জুড়লেন। সারাক্ষণ অপুর মার কোলে মাথা রেখে খয়েরি ঘরের লোকেদের মুখগুলো শুধু দেখে গেল। তার মুখ দেখে মনে হল সে যেন বুঝতে চাইছে—আমাকে নিয়ে আবার এত বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে কেন!

অপুর মা বলল, ”ডাক্তারবাবু খয়েরি মা হবে, ওর পেটের বাচ্চচাদের কোনও ক্ষেতি হবেনি তো?”

খয়েরির পায়ে প্লাস্টার করতে—করতে ডাক্তার বললেন, ”কোনও ক্ষতি হবে না। তবে বোধ হয় খোঁড়া হয়ে যাবে। অসম্ভব শান্ত আমাদের দিশি কুকুররা। পৃথিবীর যে—কোনও দেশের কুকুরদের সঙ্গে টক্কর দিতে পারে। আপনি কিছু ভাবছেন না।” ডাক্তার পাল খয়েরির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন।

সেই গুণ্ডাটি পালাতে গিয়ে সিংহিবাড়ির কাছেই জনতার হাতে ধরা পড়ে এবং গণপ্রহারে মারা যায়। পুলিশ একজনও ডাকাত ধরতে বা ছ’ লাখ টাকা উদ্ধার করতে এখনও পারেনি।

পায়ে প্লাস্টার করা খয়েরি আশ্রয় পেল সিংহিবাড়ির ভেতরে একতলায় সিঁড়ির নিচে। আগে এই জায়গায় সত্যশেখরের প্রিয় জার্মান শেফার্ড কুকুর হিটলার থাকত। জায়গাটাকে সে বলত, ‘হিটলারের বাঙ্কার।’ পঁচিশ বছর পর বাঙ্কারে এল আদ্যন্ত বাঙালি খয়েরি, তবে দেড়মাসের জন্য। পায়ের প্লাস্টার কাটার পর ক্ষতস্থান শুকোতেই সে আবার ফিরে যায় নিজের আস্তানা ফিটনের ঘরে। খোঁড়াতে—খোঁড়াতে সে বাগানে ঘুরে বেড়ায় আর ফটক পর্যন্ত গিয়ে কলাবতীর জন্য বিকেলে অপেক্ষা করে।

.

সকালে খাওয়ার টেবলে একবাক্স দানাদার দেখে সবাই অবাক! মুরারি মাথা চুলকে বলল, ”অপুর মার কাণ্ড। বলল মুরারিদা এমন একটা শুভদিনে সবাইকে মিষ্টিমুখ না করালে কি চলে? ও দশটা টাকা দিল, আমিও দশটা টাকা দিলুম।”

রাজশেখর অবাক হয়ে বললেন, ”কীসের শুভদিন?”

সত্যশেখর আর কলাবতী জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইল মুরারির দিকে। একবার দরজার দিকে তাকিয়ে মুরারি বলল, ”কত্তাবাবু, আপনার আটঘরার মেয়েই বলুক। আয় রে খবরটা তুই দে।”

অপুর মা ঘরে ঢুকে কোনও ভণিতা না করে যথাসম্ভব তার বিখ্যাত গলাটা চেপে বলল, ”খয়েরি আজ ভোরে মা হয়েছে, পাঁচটা বাচ্চচা।”

কলাবতীর আগেই রাজশেখর চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। সত্যশেখর বাক্স থেকে দানাদার তুলে মুখে ঢোকাতে গিয়ে থমকে বলল, ”পাঁচ—পাঁচটা?”

”সতু, তোমার কাছে তো নগদ টাকা থাকে না কিন্তু এখন কি তোমার পকেটে কয়েকটা টাকা আছে চন্দ্রপুলি কেনার মতো?” রাজশেখর গম্ভীর সিরিয়াস গলায় বললেন।

সত্যশেখর পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে কয়েকটা নোট বার করে কাঁচুমাচু মুখে বললেন, ”বাবা শ’ তিনেক হবে।”

”মুরারি ফেলু ঘোষের দোকানে এক্ষুনি যা। চন্দ্রপুলি বাসী হলেও নিয়ে নিবি, না থাকলে কড়াপাক। ফেরার সময় অর্ধেকটা মলয়াকে দিয়ে খবরটা দিবি।”

এর পর সারা সিংহিবাড়ি ফিটনের ঘরে গিয়ে হাজির হল। একটা চটের ওপর খয়েরি হাত—পা ছড়িয়ে পাশ ফিরে শুয়ে। কালো খয়েরি সাদা লোমের, ধাড়ি ইঁদুরের সাইজের পাঁচটা চোখ—না—ফোটা বাচ্চচা তার বুকের কাছে কিলবিল করে বেড়াচ্ছে। কলাবতী একটা বাচ্চচা নেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই অপুর মা ধমকে উঠল, ”হাত দিউনি, গায়ে নোনা লাগবে। আর একটু বড় হোক।”

সত্যশেখর বলল, ”একটা বেবি কটে বাচ্চচাগুলোকে রাখলে কেমন হয়, কালু কী বলিস?”

”অপুর মাকে জিজ্ঞেস করো।”

কথাটা বুঝে নিয়ে অপুর মা বলল, ”কটমট আবার কী, মায়ের পাশে না থাকলে ওরা দুধ খাবে কী করে?”

সন্ধ্যায় ফোন এল কলাবতীর কাছে, করেছে মলয়া। তার গলায় দুশ্চিন্তা, ”কালু, কাল রাত থেকে মঙ্গলার লেবার পেন উঠেছে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। ডাক্তার পাল দুপুরে এসেছিলেন, বললেন আরও চব্বিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করে দেখতে, নাহলে সিজারিয়ান করবেন।”

”বড়দি শুনেছেন তো খয়েরির বাচ্চচা হয়েছে, পাঁচটা।” উচ্ছ্বাস চেপে কণ্ঠস্বর যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে কলাবতী বলল। মঙ্গলার কষ্টের কথা শোনার পর আনন্দ প্রকাশ করা যায় না।

”বাচ্চচা হওয়ার খবর তো সকালেই মুরারি দিয়ে গেছে, সেইসঙ্গে সন্দেশও। কেমন আছে খয়েরি, বাচ্চচারা দেখতে কেমন হয়েছে?”

”মায়ের মতো অত সুন্দর কেউ নয়।”

”আমার মন খুব খারাপ। কাল স্কুলে যাব না। মঙ্গলার কাছেই সারাক্ষণ রয়েছি, বেচারা খালি কাঁদছে। কী যে হবে জানি না।” মলয়া ভিজে গলায় কথাগুলো বলে ফোন রেখে দিল।

পরদিন সকালে কলাবতী মলয়াকে ফোন করে জানল, মঙ্গলার কষ্ট আরও বেড়েছে। ডাক্তার বলছেন আর দেরি নয়, বাড়িতেই সিজারিয়ান অপারেশন করবেন। একতলায় একটা ফাঁকা ঘর আছে, সেখানে একটা বড় টেবল নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ডাক্তারের সঙ্গে থাকবেন দু’জন সহকারী। মঙ্গলার হার্টের অবস্থা খুব ভাল নয়।

কলাবতী ভাবল স্কুল ছুটির পর মঙ্গলাকে দেখে আসবে। ছুটির পর মলয়াদের বাড়ির দিকে কিছুটা হেঁটে হঠাৎ কী এক অজানা ভয় তার মনে ধরল। সে আর না এগিয়ে বাড়ি ফিরে এল। ফটকে আজ খয়েরি তার জন্য অপেক্ষায় ছিল না। সে ফিটনের ঘরে গিয়ে দেখল পাঁচটা বাচ্চচা জড়ামড়ি করে একের ঘাড়ে অন্যজন ওঠার চেষ্টা করছে। দুটো বাচ্চচা খুবই রুগণ, বোধ হয় বাঁচবে না। খয়েরি জিভ দিয়ে ওদের গা চেটে চলেছে। কলাবতীকে দেখে শুধু একবার চোখ তুলে তাকাল। খয়েরির ভাতের থালাটা পরিষ্কার একটা কণাও পড়ে নেই। সে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে টিফিনবক্স বার করল। খয়েরির লেজ নড়ে উঠল।

সন্ধ্যায় ক্ষুদিরামবাবুর কাছে কলাবতী যখন পড়ছে তখন মলয়াদের বাড়ি থেকে ফোন এল, ধরলেন রাজশেখর। অপর প্রান্তে মলয়ার গলায় তিনি শুনলেন শুধু একটি বাক্য, ”জ্যাঠামশাই মঙ্গলা আর নেই।” এর পর হাউহাউ করে কান্নায় শব্দ এবং ফোন রেখে দেওয়া।

রাজশেখর খবরটা বাড়ির কাউকে তখন দিলেন না। কলাবতীর পড়া শেষ হওয়ার পর তিনি তাকে ডেকে বললেন, ”সতুকে গাড়ি বার করতে বল কালু, হরির বাড়িতে যাব। মঙ্গলা মারা গেছে।”

শোনামাত্রা কলাবতীর মুখ থেকে আর্তনাদের মতো একটা শব্দ বেরিয়ে এল। সে ছুটে গেল কাকার সেরেস্তায়। একটু পরেই হন্তদন্ত হয়ে সত্যশেখর দোতলায় উঠে এল। ”বাবা এ কী শুনছি?”

”মলয়া ফোন করে আমায় জানিয়েছে কিছুক্ষণ আগে।’ ধীর স্তিমিত গলা রাজশেখরের।

দশ মিনিটের মধ্যে ওঁরা তিনজন মলয়াদের বাড়ি পৌঁছলেন। রাজশেখর তিরিশ বছর আগে হরিশঙ্কর মুখুজ্জের মায়ের শ্রাদ্ধে শেষবার এই বাড়িতে এসেছিলেন তারপর আজ এলেন। বাড়ির বাইরের আলোগুলো নেভানো। ভেতরেও টিমটিম করছে একটি—দুটি। সাড়াশব্দ নেই কোথাও।

”আয়।” হরিশঙ্কর ডাকলেন রাজশেখরকে, নিয়ে বসালেন, বৈঠকখানায়।

”মলয়া কোথায়?” রাজশেখর নিচুগলায় জিজ্ঞেস করলেন।

”পাশের ঘরে।”

সত্যশেখর আর কলাবতী পাশের ঘরে গিয়ে দেখল, মঙ্গলাকে টেবলেই শুইয়ে রাখা হয়েছে গলা পর্যন্ত একটা সাদা চাদরে ঢেকে। তার পাশে দাঁড়িয়ে মলয়া হাত বুলিয়ে যাচ্ছে মৃত মঙ্গলার মাথায়।

ঘরের একধারে একটা বড় প্লাস্টিকের গামলায় মঙ্গলার বাচ্চচারা স্তূপ হয়ে রয়েছে। পলতে পাকানো ন্যাকড়া গোরুর দুধে ডুবিয়ে চাকর চেষ্টা করছে ওদের খাওয়াতে। কয়েক ঘণ্টা বয়সী বাচ্চচারা পারছে না পলতে চুষে দুধ খেতে।

কলাবতী ফিসফিস করে চাকরটিকে জিজ্ঞেস করল, ”ক’টা বাচ্চচা হয়েছে?”

”সাতটা। তার মধ্যে দুটো মরা।”

”এভাবে কি ওরা খেতে পারে? ড্রপারে করে খাওয়াতে হবে।” কলাবতী পরামর্শ দিল।

”চেষ্টা করেছি, মুখ থেকে ফেলে দিল।” চাকরটির অসহায়ত্ব গলায় ফুটল।

সত্যশেখর বলল, ”ফিডিংবটলে করে খাইয়ে দেখা যেতে পারে। তুমি দৌড়ে স্টেশনারি দোকান থেকে একটা কিনে আনো।”

ম্যানিব্যাগ থেকে সে টাকা বার করে দিল। রাজশেখর ঘরে এলেন, সঙ্গে হরিশঙ্কর। মলয়ার মাথায় হাত রেখে রাজশেখর বললেন, ”মঙ্গলা যাদের রেখে গেল এবার তাদের তো দেখতে হবে। ওদের মধ্য দিয়েই মঙ্গলা বেঁচে থাকবে।”

.

মুখ ফিরিয়ে মলয়া গামলাটার দিকে তাকাল। তার চোখ দিয়ে টপটপ জল ঝরে পড়ল। চাকরটি একটি দুই খাওয়াবার ফিডিং বটল আনল। তাতে দুধ ভরে সে নিপলটা একটা বাচ্চচার মুখে ঢোকাল। কিন্তু অত বড় মোটা নিপল মানুষের বাচ্চচাকে দুধ খাওয়াবার জন্য। অতটুকু সদ্যোজাত কুকুরের বাচ্চচা চুষে দুধ বার করতে পারল না।

”তাহলে কী হবে?” হরিশঙ্কর দুশ্চিন্তায় পড়লেন। ”এরা তো না খেয়ে মারা যাবে।”

গামলার মধ্যে পাঁচটা দৃষ্টিহীন বাচ্চচা নড়াচড়া করছে, কলাবতীর মনে হয় ওরা খিদেয় ছটফটাচ্ছে। কিন্তু কীই—বা তারা এখন করতে পারে! বাচ্চচাগুলো না খেতে পেয়ে হয়তো একে—একে মরে যাবে। এ—কথা ভেবে তার চোখে জল এসে গেল। সে আর এখানে থাকতে চাইল না, রাজশেখরকে কানে—কানে বলল, ”দাদু বাড়ি চলো।”

ওরা বাড়ি ফিরে আসতেই অপুর মা ব্যস্ত হয়ে জানতে চাইল, মঙ্গলা মারা গেল কেন? কলাবতী তাকে কারণটা বলল, হার্টফেল। তারপর অপুর মা জিজ্ঞেস করল, ”বাচ্চচাক’টার কী হবে?”

মনের কষ্ট চেপে কলাবতী উদাসীন ভাবে বলল, ”কী আবার হবে, মায়ের দুধ না পেয়ে একসময় মরে যাবে।”

অপুর মা অবাক হয়ে কয়েক সেকেন্ডে কলাবতীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ”সে কী। মরে যাবে কেন? এই তো আমি দিব্যি বেঁচে আছি। আমাকে জম্মো দিয়েই তো মা মরে গেল। সেই সময় মাসির ছেলে হয়েছে। মাসিই তো আমাকে আর নিজের ছেলেকে একসঙ্গে বুকের দুধ খাওয়াত।”

”তুমি বলতে চাও কী?” কলাবতীর খটকা লাগল কথাগুলো শুনে। নিশ্চয় কিছু একটা ভেবে অপুর মা কথাটা বলল।

”বলতে চাই খয়েরিকে মঙ্গলার বাচ্চচাদের কাছে নিয়ে যাও।” দু’ হাত শূন্যে তুলে কলাবতী চেঁচিয়ে উঠল, ”দি আইডিয়া।” সে ছুটে গেল সত্যশেখরের ঘরে। ”কাকা, প্রবলেম সলভড। এখনই খয়েরিকে নিয়ে যেতে হবে বড়দির বাড়ি, মঙ্গলার বাচ্চচাদের ও দুধ খাওয়াবে। এটা অপুর মার সাজেশন। আবার তুমি গাড়ি বার করো।”

ফিটনের ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। টর্চ জ্বেলে হাজির হল অপুর মা আর কলাবতী। খয়েরি কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল। বাচ্চচারা ছড়িয়ে—ছিটিয়ে ঘুমোচ্ছে। খয়েরি উঠে দাঁড়াল ওদের দেখে।

অপুর মা ডাকল, ”খয়েরি, আয় আমার সঙ্গে।” কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে সে আবার ডাকল। ”আয়, আয়।”

খয়েরি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অপুর মা’র পিছু নিল। কলাবতী তাকে পাঁজাকোলা করে মোটরে তুলল। ইতিমধ্যে রাজশেখর টেলিফোনে হরিশঙ্করকে জানিয়ে দিয়েছেন খয়েরিকে নিয়ে কালু আর অপুর মা যাচ্ছে। ওরা পৌঁছেই দেখল দরজার ব্যগ্র মুখে হরিশঙ্কর দাঁড়িয়ে তাদের জন্য।

গাড়ি থেকে নেমেই খয়েরি মুখ তুলে ”ঘৌ উ উ উ উ” ডাক দিল। কলাবতীর মনে হল ও মঙ্গলাকে যেন বলছে আমি এসেছি। গামলাভরা বাচ্চচাগুলিকে বৈঠকখানায় এনে রাখা হয়েছে। খয়েরি এগিয়ে গিয়ে বাচ্চচাগুলোকে প্রথমে শুঁকল, তারপর কলাবতী আর অপুর মার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে রইল। অপুর মা ওর গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে চাপ দিয়ে কাত করে শুইয়ে দিল। তারপর সে গামলা থেকে একটি একটি করে বাচ্চচা তুলে খয়েরির বুকের কাছে রেখে দিল। ক্ষুধার্ত বাচ্চচাগুলো আঁকুপাঁকু করে হামলে পড়ল খয়েরির ওপর। মাথা ঘুরিয়ে খয়েরি ওদের গা চাটতে শুরু করল।

হরিশঙ্কর পাশের ঘর থেকে মলয়াকে ডেকে আনলেন দেখার জন্য। বাচ্চচাদের দুধ খাওয়াতে দেখে মলয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠল।

সত্যশেখর বলল, ”এখনকার মতো তো সমস্যা মিটল, কিন্তু এর পর?”

অপুর মা বলল, ”ওর নিজের তো বাচ্চচা রয়েছে, তাদেরও তো দুধ খাওয়াতে হবে। অত বাচ্চচাকে পারবে কি?”

হরিশঙ্কর বললেন, ”খয়েরি আজ রাত্তিরটা এখানেই থাকুক, কাল সকালে ওকে দিয়ে আসব।”

তার কথামতো খয়েরি রয়ে গেল। খয়েরির বাচ্চচারা সারারাত একা—একা কাটাল। খিদের জ্বালায় মাকে খোঁজার উদ্দেশ্যে ওরা ফিটনের ঘর থেকে রাত্রে বেরিয়ে আসে দরজার বাইরে। সকাল ন’টা বেজে গেল তবুও খয়েরিকে ওরা পাঠাচ্ছে না দেখে কলাবতী ফোন করল। ওধার থেকে হরিশঙ্কর বললেন, ”এই পাঠাচ্ছি। খয়েরি এখন বাচ্চচাদের দুধ খাওয়াচ্ছে।”

ইউনিফর্ম পরে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে কলাবতী গাড়ি বারান্দায় এসে দাঁড়াল। খয়েরিকে এখনও ওরা পাঠায়নি। সে অধৈর্য বিরক্ত হয়ে মনে মনে বলল, রাতে ওকে না রেখে এলেই হত। ওর নিজের বাচ্চচাদেরও তো খাওয়া দরকার। পায়চারি করতে করতে হঠাৎ তার চোখ পড়ল ফিটনের ঘরের দিকে। গোটা কুড়ি কাক ঘরের মাথায়, পাঁচিলের ওপর আর গাছের ডালে বসে তারস্বরে চিৎকার করে ওড়াউড়ি করে চলেছে। রেলিংয়ে ঝুঁকে সে ফিটনের ঘরের দরজাটা দেখার চেষ্টা করল। যা দেখল তাতে তার রক্ত হিম হয়ে গেল। দুটো চিল ঠুকরে ঠুকরে ছিঁড়ে কী যেন খাচ্ছে।

চিৎকার করে, ”দাদু, অপুর মা, মুরারিদা” বলে উঠে কলাবতী সিঁড়ির দিকে ছুটল। ছ—সাতটা লাফে একতলায় পৌঁছে, ”মেরে ফেলল, মেরে ফেলল” বলে চেঁচাতে চেঁচাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফিটনের ঘরের দিকে পাগলের মতো ছুটে গেল। তার পেছনে ছুটল অপুর মা, মুরারি আর এক ঠিকে ঝি।

পাঁচটা বাচ্চচা নিথর হয়ে পড়ে আছে। চিল দুটো বাচ্চচার পেট ঠোঁট দিয়ে চিরে নাড়িভুঁড়ি বার করে খাচ্ছে। কয়েকটা কাক চিল দুটোর তিন—চার হাত দূরে কা—কা করে ওড়াউড়ি করছে। কলাবতী এধার—ওধার তাকিয়ে একটা বাঁশের টুকরো দেখতে পেয়ে তুলে নিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে, ”ভাগ ভাগ” বলে এগিয়ে গেল চিলদুটোর দিকে।

”হায় হায় হায়, কী সব্বোনাশ হল গো।” অপুর মা এই বলে ঝুঁকে পড়ল বাচ্চচাগুলোর ওপর। ”এখন আমি খয়েরির কাছে মুখ দেখাব কী করে কালুদি। ওকে তো আমিই বাচ্চচাদের কাছ থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ও—বাড়িতে দিয়ে এনু। রেতে যদি ওকে আনতুম তাইলে এই সব্বোনাশটা হতনি গো।” অপুর মা কপাল চাপড়াতে লাগল।

মুরারি বলল, ”দ্যাখ তো এখনও একটা যেন বেঁচে আছে মনে হচ্ছে।” পেটের কাছটা সাদা তা ছাড়া আগাগোড়া খয়েরি লোমের বাচ্চচাটার মাথা নড়ছে, মুরারি আঙুল দিয়ে দেখাল। সন্তর্পণে আলগোছে অপুর মা বাচ্চচাটাকে তুলে নিল। ‘দেখি বাঁচাতে পারি কি না।’

কলাবতীর তাড়া খেয়ে কাক—চিলেরা উড়ে গিয়ে ছাদের ওপর বসল। গাড়ি বারান্দা থেকে রাজশেখর বললেন, ”মুরারি ওখানেই মাটি খুঁড়ে ওদের কবর দিয়ে দে, খয়েরি এসে বাচ্চচাদের মরামুখ যেন না দেখে।”

মৃতপ্রায় বাচ্চচাটিকে অপুর মা বাড়ির মধ্যে নিয়ে গেল, মুরারি একটা কোদাল এনে জমি খুঁড়তে শুরু করল। কলাবতী একদৃষ্টে মরা বাচ্চচাগুলোর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে। চারটে বাচ্চচাকে গর্তে শুইয়ে মুরারি মাটিচাপা দিল।

তার মিনিটখানেক পরেই মলয়ার মোটর সিংহিবাড়িতে ঢুকল। গাড়ি থেকে নামল মলয়া আর খয়েরি। নেমেই খয়েরি খোঁড়াতে খোঁড়াতে ছুটে গেল ফিটন ঘরের দিকে, ঘরের ভিতরে ঢুকে বাচ্চচাদের দেখতে না পেয়ে ঘরের এধার—ওধার ঘুরে ঘুরে মেঝেয় কিছুক্ষণ শোঁকাশুঁকি করে বেরিয়ে এসে চাপা গলায় বাচ্চচাদের ডাকল।

একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল কলাবতী। মলয়া তার কাছে এসে কৈফিয়ত দেওয়ার স্বরে বলল, ”বাচ্চচাগুলোকে সকালে পেটভরে খাইয়ে দিয়ে ওকে ফিরিয়ে দিয়ে যাব, এই ভেবেই খয়েরিকে রেখে দিয়েছিলুম। একটু দেরি হয়ে গেল, এবার ও নিজের বাচ্চচাদের খাওয়াক।”

কলাবতী শান্ত স্বরে বলল, ”তার আর দরকার হবে না বড়দি। খয়েরি তার বাচ্চচাদের আর দুধ খাওয়াতে পারবে না, ওরা মরে গেছে, ওই দেখুন কবর।”

কলাবতী আঙুল তুলে যেখানটা দেখাল তার ধারেই দাঁড়িয়ে খয়েরি মুখটা আকাশের দিকে তুলে করুণ সুরে দু’বার ডাকল—”ও ঔ ঔ ঔ, অউ অউ অউ”। তারপর সে কলাবতীর কাছে এগিয়ে এল। কলাবতীর মনে হল খয়েরি যেন জিজ্ঞেস করছে—আমার বাচ্চচারা কোথায়! তুমি জানো কী?

হতভম্ভ মলয়াকে দাঁড় করিয়ে রেখে কলাবতী ছুটতে ছুটতে বাড়ির মধ্যে ফিরে এল। রান্নাঘরে সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ার্ত চোখে সে সদর দরজার দিকে তাকাল, খয়েরি তার পিছু নিয়ে আসছে কি?

খয়েরি নয়, এল মলয়া।

”কালু, আমি মঙ্গলার বাচ্চচাদের কথাই শুধু স্বার্থপরের মতো ভেবেছি, খয়েরির বাচ্চচাদের কথা ভাবিনি।” অনুতপ্ত স্বরে সে বলল।

রাজশেখর সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মলয়ার কথাগুলি শুনতে পেলেন। তিনি বললেন, ”খয়েরির মুশকিল কী জানো, ও অবোলা, মানুষের মতো কথা বলতে পারে না, পারলে অনেক কিছু বলত।”

সদর দরজার কাছ থেকে শোনা গেল, ”ভুক ভুক ভ উ উ উ।”

রাজশেখর বললেন, ”কী বলল বলো তো?”

সবাই চুপ করে রইল।

কালু ওকে ডেকে আনো, না ডাকলে তো বাড়ির মধ্যে ঢুকবে না।”

কলাবতী সদরে গিয়ে খয়েরিকে সঙ্গে করে ফিরে এল। এত চেনা মানুষকে একসঙ্গে দেখে সে লেজ নাড়তে লাগল। অপুর মা ওকে বকলস ধরে সিঁড়ির নীচে টেনে নিয়ে গেল, ”এই নে তোর বাচ্চচা, ওকে বাঁচিয়ে তোল।”

রাজশেখর বললেন, ”অপরাধ যা হওয়ার তা তো হয়েছেই, আর সংশোধন করতে পারে বলে মানুষকে মানুষ বলা হয়। মলু তোমার বাড়ির বাচ্চচাগুলোকে এবার বাঁচাতে হবে, ওরা যেন না মরে যায়। এই বাড়িতে ওর পা গেল, বাচ্চচাদের হারাল, আর নয়—এবার খয়েরিকে তুমি নিয়ে যাও।”

অপুর মা জুড়ে দিল, ”সঙ্গে ওর বাচ্চচাটাকেও নিয়ে যেও।”

মলয়া তাই নিয়েই বাড়িতে ফিরল।

.

ছ’মাস পর পূর্ব কলকাতা ক্রিকেট ক্লাব লখনউ, কানপুর, দিল্লি দু’সপ্তাহের জন্য সফরে যাচ্ছে আটটি ম্যাচ খেলতে। কলাবতীকে হাওড়া স্টেশনে মোটরে পৌঁছে দিতে যাচ্ছে সত্যশেখর, সঙ্গে ধুপুও চলেছে। সিংহিবাড়ি থেকে গাড়ি বেরোতেই কলাবতী বলল, ”কাকা একবার বড়দির বাড়ি হয়ে যাবে, এখনও তো ট্রেনের জন্য হাতে অনেক সময় রয়েছে।”

সত্যশেখর বলল, ”বড়দির বাড়িতে আবার কেন!”

কলাবতী বলল, ”খয়েরিকে একবার দেখব।”

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সত্যশেখর বলল, ”যাবি তো, তারপর বড়দি যদি তোর খেলতে যাওয়া বন্ধ করে দেয়? দেড়শো গ্রাম ওজনের লোহার মতো শক্ত বল ঘণ্টায় তিরিশ—চল্লিশ মাইল স্পিডে আসবে, সেই বল ধরতে তোকে বারণ করেছিল না?” গাড়িটা মলয়াদের বাড়ির পথে ঘুরিয়ে সত্যশেখর বলল।

”সেই বড়দি এখন আর নেই, একদম বদলে গেছে। আমি প্র্যাকটিসে ঠিকমতো যাচ্ছি কিনা বাবুদার কাছে প্রায়ই খোঁজ নেন।”

মলয়াদের বাড়ির ফটক দিয়ে গাড়িটা ঢুকে সদর দরজার সামনে দাঁড়াল। গাড়ির শব্দে দোতলার বারান্দার রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে তিনটি অ্যালসেসিয়ান ও একটি দেশি কুকুরের মুখ বেরিয়ে এল। মোটর থেকে নামল শুধু কলাবতী। তাকে দেখেই ওরা চেঁচামেচি শুরু করে দিল। কলাবতী কলিং বেল বাজাতে কাজের লোক এসে দরজা খুলল।

”বড়দি, কী করছে?”

”বেরিয়েছেন।”

”খয়েরি কোথায়?”

”ঘুমোচ্ছে।”

ভৃত্যটির কথা শেষ হওয়ামাত্র কলাবতীর কানে এল ভেতরের ঘর থেকে ”ভুক ভুক ঘৌ উ উ উ” একটা চাপা ডাক। খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেরিয়ে এল খয়েরি। কলাবতীকে দেখেই সে ছুটে এসে সামনের দু’ পা তুলে দিল ওর কোমরে। কলাবতী মুখ নামাল, খয়েরি ওর গাল চেটে কুঁই কুঁই শব্দ করে লেজ নাড়তে লাগল, কান দুটো ঘাড়ে মিশিয়ে দিয়ে। কলাবতী আড়চোখে দেখল সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে পাঁশুটে ও কালো রঙের একটু বড়সড় চেহারার পাঁচটি আর তাদের মাঝে ছোটখাটো চেহারার খয়েরি কিন্তু পেটের কাছে সাদা রঙের একটি কুকুর। এখন আর ওদের বাচ্চচা বলা যায় না। ওরা নেমে এসে খয়েরির পেছনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে।

বাইরে থেকে গাড়ির হর্নের শব্দ এল।

”এখন কেমন আছিস?” কলাবতী জানতে চাইল খয়েরির গলা জড়িয়ে ধরে।

”ঘেউ।”

”এবার আমি যাই। আবার আসব।”

”ঘেউ ঘেউ।”

দরজা থেকে বেরিয়ে কলাবতী পেছন ফিরে তাকাল। দেখল, ছ’টি সন্তান নিয়ে খয়েরি তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

কলাবতী ও মিলেনিয়াম ম্যাচ (২০০৩)

কলাবতী ও মিলেনিয়াম ম্যাচ (২০০৩) – মতি নন্দী / প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ২০০৩ / আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। কলকাতা ৯ পৃ. ১২৮ / মূল্য ৭৫.০০ / প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: কৃষ্ণেন্দু চাকী / উৎসর্গ: প্রশান্ত মাজি-কে

বকদিঘিকে চ্যালেঞ্জ দিলেন রাজশেখর

চারদিন আগে আটঘরা থেকে রাত্রে টেলিফোনে খবর এসেছিল অপু ফুটবল খেলতে গিয়ে বাঁ পায়ের গোছ ভেঙেছে। পরদিন সকালে সত্যশেখর মোটরে করে অপুর মাকে হাওড়া স্টেশনে নিয়ে গিয়ে তারকেশ্বর লোকালে তুলে দিয়ে আসে। যাওয়ার সময় রাজশেখর বলে দেন, ”যদি বোঝো ব্যাপারটা গুরুতর, তা হলে অপুকে মোটরে কলকাতায় নিয়ে আসবে। খরচের জন্য চিন্তা করবে না।”

অপুর মা’র চিন্তা একটাই, তিনমাস পর তার ছেলের মাধ্যমিক পরীক্ষা। ততদিনে ভাঙা পা সারিয়ে পরীক্ষায় বসতে পারবে কি না বাবা তারকনাথই জানেন। রাজশেখরকে সে তার দুশ্চিন্তার কথা জানিয়ে বলেছিল, ”তারকেশ্বরে নেমেই বাবার পুজো দিয়ে চন্নমেত্ত নিয়ে গিয়ে অপুকে খাওয়াব। বাবার ইচ্ছে থাকলে অপু সাতদিনেই হাঁটতে পারবে।”

শোনামাত্র সত্যশেখর বলে, ”অপুর মা বাবার চরণামৃত খেয়ে অপু হয়তো সাতদিনে হাঁটতে পারবে, তারপর ওকে আবার বিছানা নিতে হবে জন্ডিস কিংবা হেপাটাইটিসে।”

”ডিসটিস কী বলছ ছোটকত্তা?” অপুর মা হতভম্বের মতো তাকিয়ে থেকেছিল।

কলাবতী বলেছিল, ”দুটো খুব খারাপ অসুখ পিসি, এতে মানুষ মারাও যেতে পারে, দূষিত জল থেকে এইসব রোগ হয়।”

অপুর মা নিরুপায় চোখে রাজশেখরের দিকে তাকায়। ”হ্যাঁ কত্তাবাবা, কালুদি যা বলল সত্যি?”

”একশো ভাগ সত্যি।” রাজশেখর খবরটা কঠিন করে জানিয়ে দেন। ”তারকনাথের পুজো দাও, ঠিক আছে। পুজোর ফুলপাতা অনুর মাথায় ঠেকাও, ঠিক আছে। মুখে প্রসাদ দাও, ঠিক আছে কিন্তু ওই পর্যন্ত। আর কিছু ওর পেটে যেন না যায়।”

অপুর মা মাথা কাত করে রাজশেখরের নির্দেশ মেনে নিয়েছিল।

অপুর মা’র অবর্তমানে রান্নার দায়িত্ব নিয়েছে তার রান্নাঘরের সহকারী শকুন্তলা। অপ্রত্যাশিত এই প্রোমোশনে শকুন্তলার কথাবার্তা, চলাফেরা বদলে গেছে। মুরারি তাকে জানিয়েছে, ”ভাল করে রাঁধ, ছোটকত্তার জিভে রুচলে তোর মাইনে দুশো টাকা বাড়িয়ে দিতে বলব।” তাই শুনে শকুন্তলা বলে, ”মাইনে বাড়লে কী হবে, পারমেন্ট তো করবে না। দেশ থেকে দিদি ফিরলেই তো আবার বাটনা বাটতে হবে।”

”তা তো হবেই।” মুরারি নিশ্চিত স্বরে বলেছিল, ”তুই কি ভেবেছিস অপুর মা বাটনা বাটবে আর তুই রাঁধবি আর কত্তাবাবু তাই দেখবে? আমি বরং কত্তাবাবুকে বলে যতদিন না অপুর মা ফিরে আসে বাটনা বাটার কাজটা কান্তির মাকে করতে বলব।”

”ওকে বলে দিয়ো যেভাবে বাটতে বলব ঠিক সেইভাবে যেন বাটে। দিদি আমাকে দিয়ে দু’বার করে কতদিন যে বাটিয়েছে। বড্ড মুখ করে কান্তির মা। আর ওকে বলে দিয়ো এটা টেম্পোরি কাজ, পারমেন্ট নয়।”

শকুন্তলার রান্না প্রথমদিন কয়েক গ্রাস খেয়েই সত্যশেখর বলেছিল, ”হ্যাঁ রে কালু, অপুর মা কবে আসবে বলে গেছে?”

রাজশেখর ভ্রূ তুলে বলেন, ”কেন? শকুন্তলার রান্না কী এমন খারাপ, বেশ তো খেতে লাগছে।”

সত্যশেখর কথা না বাড়িয়ে মুখ নামিয়ে বিড়বিড় করে, ”বিশ্বনাথের ব্যাটিংয়ের পর বিষাণ বেদির ব্যাটিং।”

কাকার রসনা অপুর মা’র হাতের রান্নার অভাবে বিষণ্ণবোধ করলেও ভাইঝির রসনাকে তেল ও লঙ্কায় মাখামাখি তেঁতুলের বা কাঁচা আমের আচারে, যা স্কুল গেটের বাইরে বিক্রি হয়, পুলকিত করে তোলার সুযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। অপুর মা বরাবর সন্দেহ প্রকাশ করে এসেছে, স্কুল থেকে ফিরে কলাবতীর ”খিদে নেই” ঘোষণার একমাত্র কারণ ‘টিপিনের সময় হজমি চাটনি আচার আলুকাবলি, ঝালমুড়ি ইত্যাদি অখাদ্য’ গিলে আসা।

অপুর মা এখন আটঘরায়, তাই সেদিন স্কুল ছুটির পর নির্ভয়ে কিনে আনা জলপাইয়ের আচার কলাবতী মুখে রেখে চুষছিল গাড়িবারান্দায় দাঁড়িয়ে। জিভ ও টাকরায় টক আর ঝালের ছোঁয়া লাগিয়ে চোখমুখ কুঁচকে সে, মাঘ মাসে পুকুরে নামার মুহূর্তে যেমন হিহি কাঁপুনি দেয় সেইরকম একটা কম্পন উপভোগ করতে করতে সে আচার খেয়ে যাচ্ছিল।

গাড়িবারান্দাটা একটা উঠোনের মতো। তিনদিকে কোমরসমান উঁচু ঢালাই লোহার নকশাকাটা রেলিং। বারান্দা থেকে প্রায় চল্লিশ মিটার দূরে দেড়শো বছরের পুরনো লোহার গেট, যাকে সবাই বলে ফটক। বাড়ির সদরে দশ ফুট উঁচু ছ’ফুট চওড়া কাঠের দরজা। পাঁচিল ঘেরা বাড়িতে দুটো টেনিস কোর্ট হওয়ার মতো জমি। দেবদারু, পাম, কাঁঠালি চাঁপা, পেয়ারা, বকুল, বাতাবি ও পাতিলেবুর গাছ পাঁচিল ঘেঁষে। সদর দরজা থেকে মোরামের রাস্তা গেছে ফটক পর্যন্ত। কলাবতী জলপাইয়ের আচার খেতে খেতে দেখল সাদা হাফশার্ট ধুতি পরা, পায়ে পাম্পশু, লম্বা, রোগা, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, পাতাকাটা চুল একটি লোক ফটক দিয়ে ঢুকল। পকেট থেকে চিরুনি বার করে চুল ঠিক করল, সবুজ রুমাল দিয়ে মুখটা রগড়ে মুছল।

কলাবতীর মনে হল লোকটিকে সে দেখেছে। কোথায়? এই বাড়িতে, না অন্য কোথাও? সে ভেবে চলেছে ততক্ষণে লোকটি সদর দরজায় পৌঁছে কলিংবেল বাজিয়েছে। তখনই মনে পড়ে গেল তার। সে ছুটে লাইব্রেরি ঘরে গিয়ে উত্তেজিত স্বরে বলল, ”দাদু, দাদু, আটঘরার সেই পটল প্রধান এসেছে। নীচে বেল বাজাল বোধ হয় মুরারিদা সদর দরজা খুলেছে।”

রাজশেখর চিঠি লিখছিলেন, ”একটু অবাক হয়ে বললেন, ”পটল প্রধান?…ওহো গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান পটল হালদার, তাই বল। মুরারিকে বলো ওকে এখানে পাঠিয়ে দিতে, লোকটা খুব সরল আর সৎ, শুধু বুদ্ধিটা—” রাজশেখর থেমে গিয়ে হাসলেন, তারপর বললেন, ”দিদি, তুমি আর আঙুল চেটো না, এবার সাবান দিয়ে ধুয়ে নাও। অপুর মা ফিরে এসেই তোমার আঙুলের গন্ধ শুঁকবে, তারপর কী কাণ্ড যে হবে।” বলেই তিনি শিউরে ওঠার ভাব দেখালেন।

মুরারি এসে দাঁড়াল। কলাবতী বলল, ”কে এসেছে আমরা জানি মুরারিদা, তুমি ওকে এখানে নিয়ে এসো।” বলেই সে হাত ধুতে বেসিনের দিকে চলে গেল।

পটল হালদার এসেই রাজশেখরের পদধুলি নিয়ে (যা তাঁর পায়ে কখনও থাকে না) মাথায় ঠেকাল।

”বাড়ির খবর সব ভাল? বোসো বোসো ওই চেয়ারটায়।”

সঙ্কুচিত হয়ে বসে পটল হালদার বলল, ”আপনার আশীর্বাদে ভালই আছি। শুধু মুশকিল হয়েছে ধানের ফলনটা এবার বেশি হয়ে দাম পড়ে গেছে। চাষি দায়ে পড়ে কম দামে ধান বেচে দিতে বাধ্য হচ্ছে। এদিকে পঞ্চায়েত ভোট এসে গেল। মানুষ আমাদের ওপর খুবই অসন্তুষ্ট।”

রাজশেখর বললেন, ”মানুষের আর দোষ কী? আয় কমে গেলে তুমি কি ভেবেছ লোকে সন্তুষ্ট থাকে?”

চুলে হাত বুলিয়ে পটল হালদার বলল, ”তা অবশ্য থাকে না, তবে এ ব্যাপারে আমার তো কিছু করার নেই। ধানের দাম তোলার মতো শক্তি আমার পঞ্চায়েত পাবে কোথা থেকে। সামনের ভোটে বোধ হয় আর জিততে পারব না। জিতলে হ্যাটট্রিক হবে।” দীর্ঘশ্বাস পড়ল প্রধানের।

করুণ অসহায়ভাবে তাকিয়ে পটল হালদার। রাজশেখর দেখে কষ্ট পেলেন। দাঁড়িয়ে থাকা মুরারির দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করলেন। মুরারি মাথা হেলিয়ে বেরিয়ে গেল।

”এবার বলো, হঠাৎ আমার কাছে কেন?”

”বড়দিন দিন তো এসে পড়ল বড়বাবু তাই ক্রিকেট ম্যাচটার কথা মনে করিয়ে দিতে এলুম। গতবার হয়েছিল বকদিঘিতে, এবার হবে আমাদের মাঠে। হরিবাবুর মানিকতলার বাড়ি হয়ে আপনার কাছে আসছি।” হরিশঙ্কর মুখুজ্যে হলেন বকদিঘির প্রাক্তন জমিদার। রাজশেখরের সমবয়সি।

”হরি কী বলল?”

”বললেন পতু মুখুজ্যে এসে ওর সঙ্গে দেখা করে গেছে। গত বছরের মতো এবারও ওরা আমাদের হারাবে বলে নতুন টিম করছে।”

রাজশেখর বললেন, ”নতুন আবার কী? গতবার যারা খেলেছিল, তারাই তো খেলবে।”

”না না, ফুটবলের মতো ক্রিকেটার হায়ার করে আনবে কলকাতা থেকে। হরিবাবু বললেন, ইস্টবেঙ্গল থেকে ফাস্ট বোলার খোকন ব্যানার্জি আর মোহনবাগান থেকে ওপেনিং ব্যাট মদন গুহকে আনবেন, কথাবার্তা নাকি চলছে। আমি বললুম, তা কী করে হয়, আমাদের এই বাৎসরিক ম্যাচের তো নিয়ম, যে গ্রামের হয়ে খেলবে সেই গ্রামে পূর্বপুরুষের বসতবাড়ি থাকতে হবে আর ম্যাচের আগে কম করে টানা তেরাত্তির বাস না করলে সে খেলার যোগ্যতা পাবে না। তাতে উনি বললেন, সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”

রাজশেখর অবাক হয়ে বললেন, ”আশ্চর্য! হরিটা এত নীচে নেমে গেছে। এটা কি টুর্নামেন্ট যে, ট্রফি জেতার জন্য প্লেয়ার ভাড়া করতে হবে। এটা তো বাৎসরিক একটা ফেস্টিভ্যাল ম্যাচ, শুধু দুটো গ্রামের মধ্যে খেলা হয়। না না, পটল এসব করলে খেলার মজাটা আর থাকবে না। কত বছর ধরে হয়ে আসছে বল তো এই খেলাটা, শুধু আমাদের দুটো কেন, আশপাশের গ্রামের লোকেরাও মুখিয়ে থাকে, উৎসবের মেজাজে শীতের সারাদিন হইচই করে কাটাবার জন্য ইডেনে টেস্টম্যাচের থেকে কি কম গুরুত্বপূর্ণ এই ম্যাচ গ্রামের লোকের কাছে।”

রাজশেখর সখেদে মাথা নাড়লেন এবং তাই দেখে পটল হালদারও। রাজশেখর টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিয়ে বললেন, ”হরির সঙ্গে একবার কথা বলি।” পুশবাটন টিপতে টিপতে পটলের দিকে তাকালেন, ”তুমি ঠিক বলছ তো, দুটো প্লেয়ার ভাড়া করে আনবে বলেছে?”

”উনি আমাকে দু’জনের নামও বলেছেন, খোকন আর মদন।”

ওদিক থেকে সাড়া পেয়ে রাজশেখর জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, ”হরিশঙ্কর মুখুজ্যের সঙ্গে কথা বলতে চাই।… আমি রাজশেখর সিংহি। কী শুনলুম পটল হালদারের কাছে, তুই নাকি দুটো প্লেয়ার কলকাতা থেকে ভাড়া করে আনবি? ছি ছি ছি হরি, তুই ক্রিকেটে এইসব ফুটবলের জিনিস আনছিস। ক্রিকেটের জাত মারবি? ক্রিকেটটা বুঝিস না তা আমি জানি কিন্তু এই বাৎসরিক ম্যাচটায় ভাড়াটে প্লেয়ার ঢুকিয়ে বকদিঘির লোকের আনন্দটা নষ্ট করিসনি। হাতজোড় করে বলছি, হরি হারজিতটা বড় কথা নয়। এগারোজনই গ্রামের লোক খেলবে হইহই করে, এটাই বড় কথা।…কী বললি? কালু ছেলের ছদ্মবেশে খেলে আটঘরাকে জিতিয়ে দিয়েছিল, তারই বদলা নিবি? দুটো কি একরকম ব্যাপার?”

রাজশেখরের গলা উত্তেজিত। হাত মুঠো, চোয়ালের পেশি শক্ত, ভ্রূ কুঞ্চিত। ওধার থেকে হরিশঙ্করের জবাব শুনে বললেন, ”কালুর খেলাটা বেআইনি কেন? ক্রিকেট আইনে কোথাও কি বলা আছে, মেয়েরা ছেলেদের টিমে খেলতে পারবে না? বলবি কনভেনশন, প্রথা, ঐতিহ্য, বেশ, তা হলে এই আটঘরা—বকদিঘি ম্যাচেরও একটা কনভেনশন আছে, আশা করি সেটা তুই ভাল করেই জানিস…অ্যাঁ, কী বললি? দরকার হলে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এসব প্রথাটথা ভাঙতে হবে! বেশ, তুই ভাঙ। আমিও দেখব কেমন করে তোরা জিতিস। এই ম্যাচের আনন্দ আমি নষ্ট হতে দেব না।”

খটাস করে রাজেশেখর রিসিভার রেখে পটলের দিকে তাকালেন, রাগে থমথমে চাহনি, অবাক গলায় পটল বলল, ”আপনি বলে দিলেন, দেখব কী করে তোরা জিতিস? এটা তো চ্যালেঞ্জ!”

”হ্যাঁ, সিংহিবাড়ির চ্যালেঞ্জ, আটঘরার চ্যালেঞ্জ।”

ঘরে ঢুকল মুরারি, হাতে ট্রে। উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল পটল হালদারের চোখ। তবে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার উদ্দীপনায়, না ট্রে—তে রাখা প্লেটের সন্দেশ ও শিঙাড়া দেখে, সেটা বোঝা গেল না।

”আবার এসব কেন।”

”হরির বাড়িতে কী খেয়ে এসেছ।” রাজশেখর গম্ভীর স্বরে জানতে চাইলেন। পটল ইতস্তত করে বলল, ”একটা ভেজিটেবল চপ, দুটো দরবেশ আর চা।”

রাজশেখর ঠোঁট মোচড়ালেন। ”প্লেটটা শেষ করো। মুরারি, ডাব আছে?”

”আছে।”

রাজশেখবকে আর কিছু বলতে হল না, মুরারি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

”দু’বছর আগের হারের জ্বলুনিটায় এখনও জ্বলছে। সত্যি বলতে কী, আমি পর্যন্ত জানতুম না কালু ওইভাবে গোপী ঘোষের ছেলের জায়গায় ব্যাট হাতে নামবে।”

”আপনি জানবেন কী করে,” শিঙাড়ার অর্ধেকটা মুখের মধ্যে, দু’বার দাঁতে পিষে গলার স্বর বার করার জায়গা তৈরি করে নিয়ে পটল বলল, ”তখন তো আপনি ব্যাট করছেন মাঠে। কাকপক্ষীতে জানতে পারেনি, এমনকী আমিও না। উফফ, তলে তলে কী ফন্দিটাই না এঁটেছিল আপনার নাতনি! একটা বাচ্চচা মেয়ে যে এত ভাল ব্যাট করে কে জানত বলুন তো?”

”আমি জানতুম, সতুও জানত। তোমার অবশ্য জানার কথা নয়। কালু বাংলার মেয়ে টিমে খেলেছে।” মুরারিকে কাচের গ্লাসে ডাবের জল নিয়ে ঢুকতে দেখে তিনি থামলেন।

দ্বিতীয় শিঙাড়াটা তুলে নিয়ে পটল বলল, ”আপনি, সতুবাবু আর কলাবতী তিনজনে একই ম্যাচে খেললেন। আচ্ছা, তিন পুরুষের একই ম্যাচে খেলাটা বিশ্বরেকর্ড কি না সেটা কি খোঁজ করে দেখেছেন? হলে আমি বিশ্বরেকর্ড স্তম্ভ গড়ব আটঘরা বাজারে, ভোটের আগেই।”

”হ্যাঁ, দেখেছি। আসামের এক চা—বাগানের মালিক, তার ছেলে আর নাতি মিলে একটা ম্যাচ খেলেছিল নাইনটিন থার্টিফোরে। মালিক ছিল ইংলিশম্যান। খেলাটা হয়েছিল শিলংয়ে, ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টরের টিমের সঙ্গে।”

আধখাওয়া শিঙাড়া হাতে পটল লাফিয়ে উঠল। ”কী বললেন, নাতি? নাতনি তো নয়। আরে, এটাই তো বিশ্বরেকর্ড! কী আশ্চর্য, আগে কেউ আমায় জানায়নি, তা হলে তো দু’বছর আগেই স্তম্ভ গড়ে ফেলতুম। সেই ম্যাচে সতুবাবু একটা সেঞ্চুরি করেছিলেন যা এই বাৎসরিক খেলার ইতিহাসে এখনও কেউ করতে পারেনি…।”

রাজশেখর গম্ভীর মুখে বললেন, ”পটল শিঙাড়াটা শেষ করে কথা বলো, তারপর সন্দেশগুলোর গতি করো।”

”নিশ্চয়ই করতে হবে। পতু মুখুজ্যে তো এখন থেকেই ভোটের প্রচার শুরু করে দিয়েছে আমার এগেনস্টে। এবার তো আমাকেও শুরু করতে হবে। আচ্ছা, যদি দুটো স্তম্ভ গড়ে ফেলি তা হলে কেমন হয়, একটা আটঘরার বাজারে, অন্যটা বাসস্টপে, অনেক লোকের চোখে পড়বে।” পটল সন্দেশ তোলার জন্য বাড়ানো হাতটা থামিয়ে সমর্থন পাওয়ার আশায় তাকাল।

রাজশেখর বললেন, ”দুটো কীসের কীসের?”

পটল সন্দেশ তুলে নিয়ে বলল, ”সতুবাবু যে তেরোটা ছক্কা হাঁকড়ে একশো চার করেছিলেন, আটঘরার হিস্ট্রিতে এটাই প্রথম সেঞ্চুরি। এখনও লোকে বলে, বাব্বা, এক—একটা ছক্কা তালগাছের মাথায় চড়ে যাচ্ছিল। পরের বছর ইস্কুলের কত ছেলে ওর অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছিল কিন্তু উনি তো আর গেলেন না।” পটল ক্ষুব্ধ মুখের মধ্যে সন্দেশ পুরে দিল।

”আর দ্বিতীয় স্তম্ভটা?”

পটল সন্দেশটার গতি করার জন্য একটু সময় নিল। এক ঢোক ডাবের জল খেয়ে বলল, ”দ্বিতীয়টা তিনপুরুষ স্তম্ভ। স্তম্ভে পাথর লাগানো থাকবে, তাতে থাকবে তিনজনের নাম আর তাদের কীর্তির কথা। আমাদের বাংলার টিচারকে দিয়ে লেখাব, বড় ভাল বাংলা লেখে।”

রাজশেখর গম্ভীর হয়ে গেলেন শুনতে শুনতে। ধীরস্বরে বললেন, ”পটল, চালের দাম পড়ে গেছে। মানুষ অসন্তুষ্ট। এখন এসব করলে তুমি একটাও ভোট পাবে না।”

গলা নামিয়ে চুপিসারে পটল বলল, ”এই সময়েই তো এসব করতে হয় বড়বাবু। দেখেননি দেশের অবস্থা খারাপ হলে রায়ট কিংবা যুদ্ধ লাগিয়ে দেশবাসীর নজর অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। আমিও ক্রিকেটের হুজুগ তুলে…কী বলব আপনাকে, ওয়ান ডে ক্রিকেট টিভিতে দেখানো শুরু হলেই আটঘরা একেবারে সুনসান হয়ে যায়, বাজারে বেচাকেনা লাটে ওঠে, ইস্কুলে মাস্টারমশাইরাও কামাই করেন, ফুটবল মাঠে ছেলেরা সারা বছর এখন ক্রিকেট খেলছে। বড়দের মুখে শুধু ক্রিকেটের কথা। চালের দামটাম সব ভুলিয়ে দেওয়া যাবে স্তম্ভ গড়ার জন্য শোরগোল তুলে দিয়ে।”

রাজশেখর আর কথা বললেন না। পটলের সন্দেশ খাওয়া দেখতে লাগলেন। ডাবের জলটা খেয়ে পটল গ্লাস রেখে বলল, ”বকদিঘিকে যে চ্যালেঞ্জটা দিলেন, সেটাকেই মূলধন করে কাল থেকেই আটঘরাকে তাতাবার কাজ শুরু করব। বাইরের লোক এনে খেলানো তো ভ্রষ্টাচার, বাৎসরিক ম্যাচটাকে তো অপবিত্র করে দেওয়া। এর মূলে পতু মুখুজ্যের বুদ্ধি কাজ করছে। উদ্দেশ্য একটাই। আটঘরাকে নয়, আমাকে হারানো।”

রাজশেখর চিন্তিত স্বরে বললেন, ”সেবারের ম্যাচ দেখে তো মনে হয়েছিল দুই আম্পায়ারের মধ্যেই যেন খেলাটা হচ্ছিল। আমাদের আম্পায়ার—কী যেন নাম?”

”বুদ্ধুস্যার, বুদ্ধদেব ঘোষ অঙ্কের টিচার, ওদের আম্পায়ার হরিশ কর্মকার, বকদিঘি ড্রামাটিক পার্টির প্রম্পটার।”

”বুদ্ধদেব প্রথম দু’ওভারেই তিনটে রান আউট আর দুটো স্টাম্পড দেন। ওদের হরিশ কর্মকারও প্রথম ওভারেই চারটে এল বি ডবলু দিয়েছিল। দেখো পটল, এভাবে খেলা হয় না। নিজেদের গ্রামের লোককে আম্পায়ার রাখলে পুকুরচুরি হবেই। এবার থেকে নিউট্রাল আম্পায়ার রাখার ব্যবস্থা করো পারলে কলকাতা থেকে নিয়ে যাও।”

”আবার কলকাতা! বকদিঘি কলকাতা থেকে প্লেয়ার আনাচ্ছে বলে আপনি আপত্তি তুলছেন, আর—।”

”দুটো এক ব্যাপার নয় পটল। আম্পায়াররা তো আর ব্যাট—বল নিয়ে খেলবে না। ওরা শুধু খেলাটা পরিচালনা করবে। খেলার আইনে বলেছে, ইনিংসের জন্য টস করার আগে আইনের প্রয়োজন অনুযায়ী চরম নিরপেক্ষতা সহকারে খেলাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রতি প্রান্তে একজন করে, দু’জন আম্পায়ার নিয়োগ করতে হবে। এবার তুমিই বলো, ওইসব রানআউট, স্টাম্পড আর এল. বি. ডবলুগুলো কি চরম নিরপেক্ষতার নমুনা? ও তো রেষারেষি করে আউট দেওয়া দিনে ডাকাতি। ব্যাপারটা তা হলে তো স্রেফ ভাঁড়ামিতে দাঁড়াল। তুমি ওদের বলো, কলকাতা থেকে আম্পায়ার আনতে। আমরাও নিয়ে যাব আম্পায়ার।”

”বড়বাবু, আম্পায়ারকেও ম্যানেজ করা যায়।”

”করা গেলে আর কী করা যাবে। তবু তো ম্যাচটাকে ডিগনিফায়েড করা যাবে।”

”কিন্তু বড়বাবু হায়ার করে প্লেয়ার আনার ব্যাপারটার কী হবে? আমরাও তা হলে কালীঘাট কি এরিয়ান থেকে তিনচারজনকে আনব।”

”একদম নয়। ভুবনডাক্তার কি তার কম্পাউন্ডার চণ্ডী, বকু বোস আর দারোগাবাবু, ওরা এখন কীরকম ফর্মে আছে?”

”পুরনো বড়বাবু বদলি হয়ে গেছেন, নতুন বড়বাবু সবে এসেছেন, ক্রিকেট পছন্দ করেন না। তবে শুনেছি মেজোবাবু ভাল খেলেন, ভুবনডাক্তার খেলবেন। দু’মাস আগে লক্ষ্মীপুজোর দিন যে ম্যাচটা হয়েছিল তাতে তিনি পাঁচটা ছক্কা হাঁকিয়েছেন আর বকু বোস তিনটে স্ট্যাম্প আউট করেছে শুধু চণ্ডী কম্পাউন্ডারই রানআউট হয়ে গেছে নয়তো সবাই বেশ ভাল ফর্মেই আছে। এবার সতুবাবু আর আপনার নাতনি যদি খেলে তা হলে আটঘরা টিমটা খুব স্ট্রং হবে।”

পটল হালদার আর বেশিক্ষণ বসল না। ছ’টা চল্লিশের তারকেশ্বর লোকাল ধরতে হবে তাই উঠে দাঁড়াল। ”আমি আবার আসব সবকিছু ফাইনাল করে। পরমেশ আর নন্তু বলেছিল আপনার সঙ্গে দেখা করবে।”

পঞ্চায়েত প্রধান চলে যাওয়ার পর রাজশেখর গাড়িবারান্দায় এসে বসলেন একটা বেতের ডেক চেয়ারে। এখন তিনি একাকী বসে ভাবতে চান এই ঐতিহ্যপূর্ণ ম্যাচটার ভবিষ্যৎ নিয়ে। হরি মুখুজ্যে তাঁকে বিপদে ফেলে দিয়েছে!

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় থেকে প্রতিবছরই চলে আসছে এই ম্যাচটা। প্রথমদিকে ছিল ক্রিকেট নামক ব্যাটবল খেলার প্রতি শুধুই গ্রামবাসীদের কৌতূহল, খেলাও হত নিজস্ব নিয়মে। ধীরে—ধীরে আগ্রহের সঞ্চার হতে থাকে রেডিয়োয় বাংলা রিলে আর খবরের কাগজের ছবি এবং টেস্ট ক্রিকেটের রিপোর্টিংয়ের সুবাদে। নতুন এক ক্রিকেটপ্রেমী শ্রেণী গড়ে ওঠে আটঘরায়। বাৎসরিক ম্যাচটা ঘিরে নিস্তরঙ্গ গ্রামজীবনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার উত্তেজনাটা দুটি গ্রামেরই লোকেদের নেশা ধরাতে শুরু করে, যেমন ইস্টবেঙ্গল—মোহনবাগান নিয়ে সারা বিশ্বের বাঙালি এই দুই দলের ম্যাচের দিন দু’ভাগ হয়ে যায়, তেমনিই আটঘরা—বকদিঘি এই ক্রিকেট ম্যাচের দিন দুটি গ্রামের মানুষ একদিনের জন্য পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়।

ম্যাচটি এখন এতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও এখন আর একে উপেক্ষা করতে পারছে না। তারা সমীক্ষা করে দেখেছে এই ম্যাচের ফলাফলে তাদের আধিপত্য বাড়ে এবং কমে এবং এও তারা দলীয় লোক মারফত জেনেছে সারা মহকুমাই নাকি এই ম্যাচের খবর জানার জন্য উদগ্রীব থাকে।

রাজশেখর এসব খবর সবই পান আটঘরার দুটি যুবক পরমেশ ও নন্তুর কাছ থেকে। এই দু’জন রাজনীতির ধারেকাছে নেই, বাস্তববোধ ও কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন, শিক্ষিত। দু’জনে টেলিফোনে আটঘরা থেকে তাঁর সঙ্গে কথা বলে থাকে।

ডেকচেয়ারে বসে রাজশেখর সামনে ফটকের দিকে তাকিয়ে। রাস্তা দিয়ে মানুষের আনাগোনা, গাড়ির যাতায়াত অন্যমনস্কের মতো দেখে যাচ্ছেন। আসলে তিনি স্মৃতিমন্থন করছেন। দু’বছর আগের সেই ম্যাচটাকে তিনি মনের মধ্যে আবার ফিরে পেতে চাইছেন। ওটাই তাঁর জীবনে শেষবার ব্যাট হাতে খেলতে নামা। মলয়ার অর্থাৎ হরিশঙ্করের মেয়ে, কলাবতীর স্কুলের বড়দির তাঁকে লেখা কৌতুকপূর্ণ কিন্তু চিমটি—কাটা একটা চিঠি পড়ে রাজশেখর তেতে ওঠেন। মলয়ার চিঠিটা ছিল বিদ্বেষহীন রসিকতায় মাখা। পনেরো বছর আগে মলয়া ও সত্যশেখর লেখাপড়ার জন্য ইংল্যান্ড যায়। সেখানে সত্যশেখর ছোটবেলার অভ্যেস মতো তার বাল্যবান্ধবী মলয়াকে কয়েকবার জিভ দেখায় বা ভ্যাংচায়। সেই কথাটাই মলয়া লিখেছিল। এর পর রাজশেখর তাঁর পুত্রকে তুলোধোনা করেন, কারণ চিঠির শেষে মলয়া লেখে, ‘ওই লাঙ্গুলহীন সিংহসন্তানকে চিড়িয়াখানায় পাঠানো উচিত।’ এর পর খেপে উঠে তিনি বলেন, ”এবার আমি ক্রিকেট ম্যাচে খেলব, মুখুজ্যেদের মুখ পুড়িয়ে ছাড়ব।” কলাবতী অবশ্য তাঁকে নিরস্ত করার জন্য মনে করিয়ে দিয়েছিল, ‘বয়স সত্তর হয়ে গেছে। এই বয়সে খেলবে?’

রাজশেখর শ্বাস টেনে বুক ফুলিয়ে বলেছিলেন, ”কেন খেলব না? গ্রেস, হবস, রোডস, সি কে, দেওধর ওরা যদি পঞ্চাশের পরও ফার্স্টক্লাস ম্যাচ খেলতে পারে…আরে সত্তর তো পাঁজির হিসেবে কিন্তু মনের বয়সের হিসেবে আমি পঁচিশের একদিনও বেশি নই।”

ডেকচেয়ারে বসে কথাগুলো মনে পড়ায় রাজশেখর মনে মনে খুব একচোট হাসলেন। এধার—ওধার তাকিয়ে দেখলেন তাঁকে কেউ হাসতে দেখল কি না। তখনই চোখে পড়ল রেলিংয়ের থামের উপর একটা কাগজের মোড়ক। কৌতূহলে চেয়ার থেকে উঠলেন। মোড়কের দুটো পাট খুলতেই বেরিয়ে পড়ল জলপাইয়ের আচার। কলাবতী ভুলে ফেলে রেখে গেছে। চকচক করে উঠল রাজশেখরের চোখ, সপসপ করে উঠল জিভ। আঙুল দিয়ে খানিকটা তুলে মুখের মধ্যে পাঠিয়ে চোখ বুজে চুষতে লাগলেন। মিনিট তিনেকেই মোড়কটা শেষ করে আবার চেয়ারে বসে ভাবলেন, কালু ক্রিকেট প্র্যাকটিস করতে সল্টলেকে গেছে, ফিরে এসে নিশ্চয় ফেলে যাওয়া আচারের খোঁজ করবে।

আচারটা খেয়ে তেমন তৃপ্তি পেলেন না। সবকিছুই যেন কম কম। তেল ঝাল টক কেনা আচারে কমই থাকে, বাড়ির তৈরি আচারে বেশি বেশি জিনিস পড়ে তাই টেস্টফুল হয়। একবার মলয়া আচার তৈরি করে পাঠিয়েছিল। রাজশেখর চেটে চেটে শিশি ক্ষইয়ে দিয়েছিলেন। অসাধারণ আচার করতে পারে মুখুজ্যেবাড়ির মেয়েটা। মায়ের কাছ থেকে শিখেছিল।

কিছুক্ষণ ইতস্তত করে রাজশেখর লাইব্রেরিতে এসে ফোনের রিসিভার তুললেন। ওধার থেকে নারীকণ্ঠে ”হ্যালো।”

রাজশেখর বুঝে গেলেন যার সঙ্গে কথা বলতে চান রিসিভার সে—ই তুলেছে। ”মলু, আমি রাজুজেঠু বলছি। কালু স্কুল থেকে বেরিয়ে, বোধ হয় তোমাদের স্কুলের গেটের সামনে আচার—টাচার বিক্রি হয়, খানিকটা কিনে এনেছিল, আমি তার কিছুটা খেয়ে দেখলাম।”

রাজশেখর আর কথা বলার সুযোগ পেলেন না। ওদিক থেকে হেডমিস্ট্রেসের মেশিনগান ফায়ারিং শুরু হয়ে গেল, ”কতবার কতদিন আমি মেয়েদের পইপই বলেছি বাইরের কিচ্ছু কিনে খাবে না, না প্যাটিস না আচার না ফুচকা, না হজমি, কী আনহাইজেনিক নোংরাভাবে ওগুলো তৈরি হয় তা তো ওরা জানে না; ওসব খেলে অবধারিত জন্ডিস, হেপাটাইটিস, এনসেফেলাইটিস, টিবি, কালাজ্বর, কলেরা, হেন রোগ নেই যা না হবে। তবু কালু ওই জিনিস কিনে নিয়ে আপনাকে খাওয়াচ্ছে। আপনি প্রবীণ, বিবেচনাবোধ আছে। আপনিও ওকে দিয়ে কিনে আনিয়ে খাচ্ছেন?” মলয়া থামল।

রাজশেখর বুঝলেন, ওর ম্যাগাজিনের গুলি ফুরিয়ে গেছে। এবার তিনি শুরু করলেন, ”মলু, তোমার একটা ভুল প্রথমেই ভেঙে দিতে চাই। কালুকে দিয়ে কিনে আনিয়ে আমি মোটেই জলপাইয়ের আচার খাইনি। ওটা কালু ভুলে ফেলে গেছিল তাই হঠাৎ পেয়ে গিয়ে খেলুম আর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল তোমার পাঠানো ঝাল তেঁতুলের আচারটার কথা, এখনও জিভে তার স্বাদ লেগে আছে। তোমার হাতের যখন, নিশ্চয় হাইজিন মেনে তৈরি করেছ। তুমি কি এখনও তৈরি করো?”

মলয়া বুদ্ধিমতী, কথা না বাড়িয়ে সোজা আসল প্রসঙ্গে এসে গেল। ”জ্যাঠামশাই, এখনও তিনটে শিশিতে তেঁতুল, আম আর লেবুর আচার রয়েছে। আপনি গেটের কাছে এসে দাঁড়ান, দশ মিনিটের মধ্যেই তিনটে শিশি দিয়ে আসছি কিন্তু একটা শর্তে। কালুকে এর থেকে ভাগ দিতে পারেন। কিন্তু আর কাউকে নয়।”

রাজশেখর বুঝলেন, আর কাউকেটা হল সতু।

রাজশেখর নেমে এসে গেটে দাঁড়ালেন। সন্ধে হয়ে এসেছে, রাস্তার আলো জ্বলছে। হাইকোর্ট ফেরত সত্যশেখরের ফিয়াট সিয়েনা গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল।

”বাবা, তুমি এখন এখানে?” গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বার করে সত্যশেখর বলল।

থতমত রাজশেখর কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। এখুনি তো মলয়া আচারের শিশি নিয়ে হাজির হবে। সতুকে দেখলে হয়তো গাড়ি না থামিয়েই চলে যাবে কিংবা গাড়ি থেকে নেমে গটগটিয়ে এসে আচারের শিশিগুলো হাতে দিয়ে বলবে, ‘জেঠু, এগুলো আপনার জন্য, শুধুই আপনার জন্য।’ তারপর কোনওদিকে না তাকিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসবে।

রাজশেখর যা ভাবছিলেন তেমনটি অবশ্য হল না। মলয়া এসে পৌঁছয়নি।

পরিস্থিতি সামলাতে সত্যি—মিথ্যে মিশিয়ে তিনি বললেন, ”আটঘরা থেকে পটল হালদার এসেছিল। কথা বলতে বলতে ওকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলুম। তুই ভেতরে গিয়ে পোশাকআশাক বদলা, আমি আসছি। ক্রিকেট ম্যাচটা নিয়ে তোর সঙ্গে কথা বলব।”

সত্যশেখর গাড়ি নিয়ে ভিতরে ঢুকে যাওয়ামাত্র মলয়ার অ্যাম্বাসাডর এসে গেটের সামনে থামল।

মলয়া গাড়ি থেকে নেমে রাজশেখরকে প্রণাম করে বলল, ”লেবুর আচারটা নষ্ট হয়ে গেছে, তবে তেঁতুলের আর আমেরটা মনে হয় আপনার পছন্দ হবে।”

সে দুটো শিশি রাজশেখরের হাতে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ”কালু কোথায়, পড়তে বসেছে কী?

কলাবতী সেই যে স্কুল থেকে ফিরে সল্টলেকে গেছে ক্রিকেট প্র্যাকটিস করতে, এখনও ফেরেনি। এ—কথা মলয়াকে বললেই তো আগুনে ঘি পড়বে। সন্ধে হয়ে গেছে এখনও পড়তে বসেনি। আজ বাদে কাল মাধ্যমিক পরীক্ষা! তারপর বলবে জেঠু এ—সবই আপনার প্রশ্রয়ে হচ্ছে। আপনারাই আদর দিয়ে দিয়ে ওর মাথাটা খাচ্ছেন।

রাজশেখর মনের মধ্যে মলয়ার ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন এবং পরিষ্কার মিথ্যে কথাটা বললেন, ”কালু তো ক্ষুদিরামবাবুর কাছে বসে অঙ্ক করছে, আমি তো দেখে এলুম।”

মলয়ার মুখে স্বস্তি ফুটল। গাড়ি গ্যারাজে রেখে চাবি হাতে সত্যশেখর বাড়ির দরজার দিকে যেতে যেতে গেটের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়াল।

”বাবা কার সঙ্গে কথা বলছ?’ চেঁচিয়ে সে বলল।

”জেঠু, আমি আসছি। আচারগুলো শুধু আপনার জন্য, আর কাউকে দেবেন না।”

”কালুকে?”

”হ্যাঁ, শুধু কালুকে।”

মলয়া গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করল। আর রাজশেখর শিউরে উঠে দেখলেন কলাবতী গেটের কাছে দাঁড়িয়ে, কাঁধে কিটব্যাগ। মলয়ার সবুজ গাড়িটা সে ভালভাবেই চেনে। বিরাট জিভ কেটে কলাবতী পিছন ফিরেই দৌড় লাগাল। হাঁফ ছাড়লেন রাজশেখর। মলয়া দেখতে পায়নি কলাবতীকে। তার গাড়ি রাস্তায় বেরিয়ে ডান দিকে ঘুরতেই বাঁ দিকে ফুটপাথের রাধাচূড়া গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল কলাবতী।

”খুব বাঁচান বেঁচে গেছি দাদু। বড়দি যদি দেখতেন আমি এখনও পড়তে বসিনি,তা হলে আর আস্ত রাখতেন না। তোমার হাতে ও দুটো কী?”

সত্যশেখর তখন কৌতূহলী হয়ে গেটের দিকে এগিয়ে আসছে। রাজশেখর তাড়াতাড়ি শিশিধরা দুটো হাত কোমরের পিছনে নিয়ে গেলেন আর কলাবতী দাদুর হাত থেকে চট করে শিশি দুটো তুলে নিল।

”মুখুজ্যেদের গাড়ি দেখলুম, হরিকাকা এসেছিলেন নাকি?”

সত্যশেখরের নিরাসক্ত কণ্ঠস্বর রাজশেখরকে বুঝিয়ে দিল, সতু ঠিকই দেখেছে মলয়াকে।

”হরি নয়, মলয়া এসেছিল। এখান দিয়ে যাচ্ছিল। গেটে আমাকে দেখতে পেয়ে গাড়ি থেকে নামল।”

”কেন?”

”কালু পড়তে বসেছে কি না জানতে চাইল।”

”এটা তো টেলিফোন করেই জানা যেত, সেজন্য বাড়ি বয়ে জানতে আসার দরকার ছিল না। আসলে মুখুজ্যেদের বুদ্ধিটা মোটা।”

গেট দিয়ে ক্ষুদিরামবাবু ঢুকছেন দেখে কলাবতী ছুটল বাড়ির দিকে। এর পর বাবা ও ছেলে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল।

”ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে কী যেন বলবে বলছিলে?”

”হরি এবার কলকাতা থেকে প্লেয়ার ভাড়া করে এনে খেলাবে, পটল বলে গেল।”

”আনাবে তো আনাক না, আমরাও ভাড়া করে আনব।”

”তুই এ—কথা বলছিস?”

”হ্যাঁ, বলছি!” তুমি ঐতিহ্যের কথা বলবে, মোহনবাগানও তাই বলত। বিদেশিকে খেলালে ঐতিহ্য নষ্ট হয়ে যাবে। তারপর তো চিমাকে খেলাল। বাবা, এখন জেতাটাই আসল ব্যাপার। জিতলে তখন আর কেউ ঐতিহ্য নিয়ে টানাটানি করবে না।”

রাতে খাওয়ার টেবলে পটল হালদার আলোচনার বিষয় হয়ে উঠল। রাজশেখর বললেন, ”সামনেই পঞ্চায়েত ইলেকশন, বেচারা খুব দমে গেছে। ধানের দাম পড়ে যাওয়ায় ভোটাররা অসন্তুষ্ট, ওর বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করে দিয়েছে পতু মুখুজ্যে।”

কলাবতী ঠাট্টার সুরে বলল, ”ধানের দাম কমল কেন, পটল হালদার জবাব দাও,জবাব দাও—এই বলে?”

রাজশেখর বললেন, ”না, না, এভাবে নয়, পতু বলেছে এবার আটঘরাকে ক্রিকেট ম্যাচে গোহারান হারিয়ে সতুর সেঞ্চুরি আর কালুর শেষ উইকেটে নেমে উইনিং স্ট্রোক দেওয়ার বদলা নিয়ে পটলের মাতব্বরি ঘোচাবে।” ওদের দু’জনকে তাতিয়ে দেওয়ার জন্য রাজশেখর রং চড়িয়ে বাড়িয়ে বললেন।

শুনেই সত্যশেখর তেতে উঠে বলল, ”বাবা, তোমার মনে আছে প্রথম ওভারেই চারজনকে এল বি ডবলু আউট করেছিল ওদের আম্পায়ার? তাইতেই মাথায় রক্ত চড়ে গেল, ঠ্যাঙাতে শুরু করলাম। সেঞ্চুরিটা কখন যে হয়ে গেল, টেরই পেলুম না।”

কলাবতী বলল, ”আমি গোপী ঘোষের ছেলেকে ভয় দেখালুম, ছেলেটা ভীষণ ভিতু, কখনও ক্রিকেট খেলেনি। বাবা এম এল এ, তাই ওকে টিমে রাখা হয়েছিল। আমায় বলল, ভীষণ নার্ভাস লাগছে। আমি বললুম, তা হলে তো তুমি আজ সহজ ক্যাচও ফেলবে, পায়ের ফাঁক দিয়ে বল গলাবে। আটঘরা হেরে গেলে গ্রামের লোক তোমাকেই দায়ী করবে। তারপর ভয় পাওয়াতে বললুম, গত বছর সিলি মিড অন লোপ্পাই ক্যাচ ফেলে দেওয়ায় আটঘরা জেতা ম্যাচ হেরেছিল। খেলা শেষ হতেই গ্রামের ছেলেরা সিলি মিড অনের চুল খাবলা খাবলা করে কেটে সাইকেল রিকশায় চাপিয়ে সারা আটঘরা ঘুরিয়েছিল। ওহহ দাদু, তখন যদি তুমি ওর মুখটা দেখতে, ভয়ে সাদা হয়ে গেল।

”তখন ওকে বললুম তুমি আর খেলো না। হঠাৎই ম্যালেরিয়া ধরেছে বলে ড্রেসিং ঘরের বেঞ্চটায় শুয়ে কাঁপতে থাকো, মুখে কোঁ কোঁ শব্দ করে যাও। তোমার বদলে টুয়েলফথ ম্যান মাঠে নামবে। ছেলেটা আমার কথামতো সত্যিসত্যিই ম্যালেরিয়া রুগি সেজে বেঞ্চে শুয়ে পড়ল। আমিও তখন আমাদের ড্রেসিং ঘরের পিছনে রাখা গাড়িতে বসে বুট, প্যাড, ফুলহাতা সোয়েটারটা, পানামা টুপিটা কপাল পর্যন্ত নামিয়ে মাফলার দিয়ে ঘাড় গলা ঢেকে নিলুম। তোমরা কিন্তু এসবের কিচ্ছুটি তখন জানতে পারোনি।”

উৎসাহভরে রাজশেখর বলে উঠলেন, ”আরে, তখন তো আমিই ক্রিজে ছিলুম। গোপী ঘোষের ছেলের ব্যাট করতে নামার কথা। ম্যালেরিয়ার অ্যাটাকে বেঞ্চে শুয়ে হিহি করে কাঁপছিল আর মুখে কোঁ কোঁ শব্দ করছিল। ছেলেটাকে নামতে দেখে তো আমি অবাক। একদম বুঝতে পারিনি ওটা কালু। একটা শর্ট পিচড বল হুক করার সময় মাথা থেকে টুপিটা পড়ে যেতেই তখন চিনতে পারলুম ওকে।”

”আর ঠিক তখনই বড়দির ক্যামেরা ক্লিক করল, আমিও ধরা পড়ে গেলুম।”

”আর সেই ছবি নিয়ে জলঘোলা করল বকদিঘি।” রাজশেখর গভীর হয়ে গেলেন। ”হরির উসকানিতেই পতু মুখুজ্যে আটঘরার বদনাম রটাতে শুরু করে বলতে থাকে, শেষকালে কিনা একটা মেয়েকে খেলিয়ে আটঘরা জিতল, ছ্যা ছ্যা ছ্যা।”

টেবলে একটা ঘুসি বসিয়ে সত্যশেখর জ্বলন্ত চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, ”বেশ করেছে কালু ব্যাট করে জিতিয়েছে, একটা মেয়ে ব্যাট করে হারিয়ে দিল। এতে তো ওদেরই লজ্জা পাওয়ার কথা। এবারও কালু খেলবে, দেখি তোর বড়দি কত ছবি তুলতে পারে। কলকাতা থেকে প্লেয়ার ভাড়া করে আনবে? আনুক, তেণ্ডুলকরকে আনুক, সৌরভকে আনুক, পন্টিং, বেভান, ব্রায়ান লারাকে আনুক তাতে সিংঘিরা ভয় পায় না। এটা ওদের এবার বুঝিয়ে দিতে হবে।” সত্যশেখর তার গর্জন শেষ করল এই বলে, ”এবার আমিও খেলব।”

রাজশেখর মনে মনে খুশি হলেও সেটা চেপে রেখে বললেন, ”হরিকে আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছি তোরা এই ম্যাচের ট্র্যাডিশন ভাঙতে চাস তো ভাঙ কিন্তু আমি ভাড়া করা প্লেয়ার দিয়ে ম্যাচ খেলে আটঘরার মনের আনন্দ সুখ নষ্ট করব না। দেখি তোরা কেমন করে জিতিস।”

”এই তো সিংহের মতো কথা!” কলাবতীও কাকার মতো টেবলে ঘুসি বসাল।

সত্যশেখরের ফিটনেস প্রস্তুতি

শুধু রবিবারই সকালে সল্ট লেকে এ কে ব্লকের পার্কে মেয়েদের ক্রিকেট প্র্যাকটিস হয় নেট খাটিয়ে। সপ্তাহে তিনদিন হয় দু’বেলা। কলাবতী রবিবার প্র্যাকটিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে আমের আচারের শিশিটা হাতে নিয়ে সত্যশেখরের ঘরের পর্দা সরিয়ে বলল, ”কাকা, আসব?”

খালি গায়ে খাটে পা ঝুলিয়ে মাথা নামিয়ে বসে সত্যশেখর। ধীরে ধীরে মুখ তুলল, চোখে বিষণ্ণ চাহনি। ভাইঝির হাতে শিশিটা দেখেই চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

”ছুটির দিন সকালে এমন মনমরা হয়ে বসে আছ যে?”

”বলছি, তোর হাতে ওটা কীসের শিশি, মনে হচ্ছে আচার টাচার?”

”আমের। বড়দি দিয়েছেন দাদুকে। দেওয়ার সময় বলে গেছেন শুধু আপনার আর কালুর জন্য, আর কাউকে দেবেন না।”

”ঠিক আছে, দে।” সত্যশেখর হাত বাড়াল।

কলাবতী বলল, ”দাদুও বারণ করেছেন তোমাকে দিতে, মারাত্মক ঝাল!”

”কেন, ঝাল তো আমি খাই।” বলেই সত্যশেখর শিশিটা কলাবতীর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ঢাকনা খুলে প্রথমে গন্ধ শুঁকে চোখ বুজে তারিফ জানিয়ে একটা আঙুল ঢুকিয়ে মশলা—মাখানো আমের টুকরো তুলে মুখে পুরে চুষতে শুরু করল।

”দারুণ!” তারপরই শিশিটা ভাইঝির হাতে ফিরিয়ে দিল। কলাবতী দেখল, কাকার চোখ গোল হয়ে ঠেলে বেরিয়ে আসছে। কপালে বিনবিনে ঘাম ফুটছে। ভিজ বার করে ফেলেছে। ছুটে ঘরের বাইরে গিয়ে বেসিনে কুলকুচি করে ফিরে এল।

”ঝাল কোথায়, এ তো বিষ! উফফ আমার যে মাথায় রক্ত চড়ে গেল! পাখাটা ফুলস্পিড করে দে।” বলতে বলতে সত্যশেখর চিত হয়ে খাটে শুয়ে পড়ল।

”কাকা, চিনি এনে দোব?” নিরীহ স্বরে কলাবতী বলল।

”চিনি দিয়ে কী হবে বরফ আন মাথায় আগুন জ্বলছে। এমন জিনিস তুই খেয়েছিস? বাবা খেয়েছে?”

”হ্যাঁ। আমাদের তো ঝালটাল তেমন লাগল না! বড়দি তেঁতুলের আচারও দিয়েছেন, ওটা একটু চেখে দেখবে?”

”না, না না”। সত্যশেখর আঁতকে উঠে খাট থেকে নেমে পড়ল। ”ফ্রিজ থেকে বরফ আন।”

কলাবতী প্লেটে বরফের দুটো কিউব এনে দিল। সত্যশেখর মুখে একটা কিউব পুরে চুষতে শুরু করল। কলাবতী বলল, ”তুমি অমন মনমরা হয়ে বসে ছিলে কেন?”

”কেন? ঘুম থেকে উঠে মনে এল আমি আনফিট মানে ক্রিকেট খেলার জন্য যে ফিটনেস থাকা দরকার সেটা আমার নেই। এদিকে তো বলে ফেলেছি আমি খেলব।” সত্যশেখর অসহায় চোখে ভাইঝির দিকে তাকিয়ে থেকে যোগ করল, ”বকদিঘির বোলিংকে ঠেঙিয়ে বিষ ঝাড়ার জন্য কী করে ফিট হওয়া যায় বল তো?”

চিন্তিত স্বরে কলাবতী বলল, ”ব্যাট হাতে শুধু ঠ্যাঙালেই তো হবে না, ফিল্ডিংও করতে হবে, মানে দৌড়োদৌড়ি আর ক্যাচধরার ব্যাপারগুলোও রয়েছে।”

”তা হলে।” কী হ্যাপা বল তো। ব্যাটিং, ফিল্ডিং, ক্যাচ ধরা এতসব কাজ একটা লোকের দ্বারা করা কি সম্ভব।” জানি জানি তুই বলবি টুয়েলফথম্যানকে নামিয়ে দিলেই হবে, কিন্তু সেটা কি সিংঘিদের পক্ষে লজ্জার কারণ হবে না? টিভিতে ক্রিকেট দেখে দেখে গ্রামের লোকেরাও এখন অনেক কিছু বোঝে, টুয়েলফথম্যানকে দেখলেই হাসাহাসি শুরু করবে আর সব থেকে আগে সব থেকে বড় করে হাসবে তোর বড়দির বাবা হরিশঙ্কর মুখুজ্যে। উফফ সহ্য করা যাবে না।”

কলাবতী বলল, ”কাকা তা হলে তুমি ফিটনেস ট্রেনিং শুরু করে দাও আর শুরুটা হোক আজ থেকেই। চলো আমার সঙ্গে, ওখানে আমাদের কোচ বাবুদা আছেন তোমার কলেজের বন্ধু, আর—।”

”আর মলয়ার পিসতুতো দাদা।” সত্যশেখর হতাশ স্বরে বলল। প্লেটের দ্বিতীয় কিউবটা গলে অর্ধেক হয়ে গেছে। সেটা মুখে পুরে সে বলল, ”চল।”

মোটরে যেতে যেতে কলাবতী জিজ্ঞেস করল, ”মাথাটা ঠাণ্ডা হয়েছে।”

”না। ভেতরটা দপদপ করছে, ভীষণ রেগে গেলে যেমনটা হয়। তবে জিভটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।”

”বাঁচা গেল।” কলাবতী স্বস্তির শ্বাস ফেলল।

”তার মানে?”

”মানে জিভ ঠাণ্ডা হলে পেটও ঠাণ্ডা থাকে। ফিট হওয়ার জন্য প্রথম কাজ ওজন কমানো, তার মানে খাওয়া কমানো।”

সত্যশেখর আর কথা বলল না, শুধু মুখে ফুটে উঠল বিব্রত ভাব।

ওরা যখন পৌঁছল তখন দশ—বারোটি মেয়ে পার্কের কিনারা ঘিরে ছুটছে। মাঠের মাঝে বাবু অর্থাৎ সুবীর ব্যানার্জি দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছে।

”সাবিনা হাঁটু আর একটু তুলে দৌড়ও…হাসি এটা অলিম্পিক নয় আর একটু স্পিডটা কমাও, মনে রেখো পাঁচ পাক দৌড়তে হবে… ধুপু, খোঁড়াচ্ছ কেন, পায়ে কী হয়েছে? আর দৌড়তে হবে না…কালু দাঁড়িয়ে আছ কেন, ওদের সঙ্গে জয়েন করো, এত দেরি করে এলে সাত পাক দিতে হবে।

এবার বাবুর চোখে পড়ল সাদা শর্টস আর সবুজ স্পোর্টস শার্ট পরা সত্যশেখরের উপর।

”আরে সতু কতদিন পর আবার দেখা। সেই কবে যেন যেদিন কালু প্রথম এখানে এল সেদিন তুইও ওর সঙ্গে এসেছিলি তারপর আজ, কী মনে করে?”

”কী আবার মনে করে, পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখাটেখা তো হয় না, আজ ছুটির দিন ভাবলুম যাই বাবু কীরকম কোচিং করায় একটু দেখে আসি। একসময় আমিও তো ক্রিকেটটা খেলেছি।”

বাবু অবাক হয়ে বলল, ”তুই আবার কবে ক্রিকেট খেললি।”

”কবে খেললি মানে? আমাদের পাড়ার টিম বালক সঙ্ঘের হয়ে রীতিমতো ওপেন করতুম। এখনও বাগমারি পার্কে ছক্কা মারার রেকর্ডটা আমার নামেই রয়ে গেছে।” সত্যশেখরকে রীতিমতো ক্ষুব্ধ দেখাল এই তথ্যটি বাবুর না জানা থাকার জন্য। ”এগারোটা ম্যাচ একশো তেত্রিশটা সিক্সার।”

বাবু বলল, ”তুই তো সি কে নাইডুর থেকেও বড় ব্যাটসম্যান। কী বলে খেলতিস, রবারের, না ক্যাম্বিসের বলে?”

”ক্যাম্বিসের বলে।” সত্যশেখর চোখ দুটো সরু করে বলল, ”তাতে হয়েছে কী? ক্রিকেট বল হলে তবেই ছয়গুলো মান্যিগন্যি হবে আর ক্যাম্বিস বলের ছয়গুলো হরিজন সম্প্রদায়ের হয়ে যাবে? যে বলেই হোক ছয় মারতে গেলে তো টাইমিংটা ঠিক রাখতে হয়। পা ঠিক জায়গায় নিয়ে যেতে হয়। মারব কি মারব না এই বিচারটাও তো করে নিতে হয়। তা হলে কী বলে খেলেছিস, এই প্রশ্ন আসছে কেন?”

বাবুকে এখন দেখাচ্ছে গুগলিতে বিভ্রান্ত ব্যাটসম্যানের স্টাম্পড হওয়ার মতো। ঢোক গিলে বলল, ”আচ্ছা, আচ্ছা মানছি, তুই সি কে—র থেকেও বড় ব্যাটসম্যান। ব্যারিস্টারি করিস যুক্তির জাল ছড়িয়ে, জজেদের মাথায় টুপি পরানো তোর পেশা। তা হঠাৎ ফিট হওয়ার ইচ্ছেটা হল কেন? বিয়েবাড়ি কি শ্রাদ্ধবাড়িতে নেমন্তন্নটন্ন, পেয়েছিস নাকি?”

”অই তোর এক কথা। কবে সেই মলুর মায়ের শ্রাদ্ধে রাজভোগ পিছু দশ পয়সা বাজি রেখে তিরিশটা খেয়েছিলুম, সেটা নিয়ে আজও খোঁটা দিয়ে যাচ্ছিস।” সত্যশেখরের গলায় অভিমান ফুটে উঠল।

”দেবে না খোঁটা? তিন—তিনটে টাকা পকেট থেকে বার করে দিতে হল। তখন কলেজে পড়ি, হাতখরচ পাই তিরিশ টাকা, তার থেকে তিন টাকা চলে গেলে কী অসুবিধায় পড়তে হয়, তা তুই বুঝবি না,” এই বলেই বাবু চক্রাকারে দৌড়ানো মেয়েদের দিকে তাকিয়ে দেখল, দৌড় এখন জগিংয়ের পর্যায়ে নেমে এসেছে। বাবু আপন মনে বলল, ”পাঁচ পাক মানে প্রায় এক মাইল, তাও পারে না।” তারপর সে সত্যশেখরকে বলল, ”সতু, ওরা এখন লাস্ট ল্যাপে, তুই ওদের পিছু নিয়ে ছোট। হারি আপ।”

চার পাক শেষ করে মেয়েরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এখন তারা ওয়াকিং রেসের থেকে জোরে এবং দৌড়ের মাঝামাঝি অবস্থায়। সত্যশেখর সবার পিছনে থাকা মেয়েটির সঙ্গ নিল। মেয়েটি হঠাৎ একটি বয়স্ক ভারিক্কি লোককে তার পাশে দৌড়তে দেখে দৌড়ের গতি বাড়িয়ে দিল। সত্যশেখরও গতি বাড়াল এবং পঞ্চাশ মিটার পর্যন্ত গতি বজায় রেখে বুঝল খুবই ভুল করে ফেলেছে। বুক ধড়ফড় করছে, ঊরু দুটোয় মনে হচ্ছে দু’টন লোহা ঝুলছে। পা আর চলছে না, আরও তিরিশ মিটার ছুটে সে দাঁড়িয়ে পড়ল।

বাবু হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকল। সত্যশেখর কাছে আসতে সে বলল, ”কতবছর পর দৌড়লি, কুড়ি, পঁচিশ?”

সত্যশেখর একটু ভেবে নিয়ে বলল, ”পঁচিশ নয়, কুড়ি বছর হবে বোধ হয়। একবার একটা ষাঁড় খেপে গিয়ে তাড়া করেছিল, এর থেকে বেশি জোরে ছুটেছিলুম। মনে পড়েছে, মনে পড়েছে, এম. এ ফাইনাল ইয়ার, ইউনিভার্সিটির গেট থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজের গেট পর্যন্ত ছুটেছিলুম।

”ষাঁড়টা কি তোকে শেষ পর্যন্ত তাড়া করেছিল?”

”জানি না, আমি তো পিছন ফিরে দেখিনি।”

”হঠাৎ তোর ফিট হওয়ার ইচ্ছে হল কেন সেটা তো বললি না।”

”আটঘরা—বকদিঘি এ বছরের ম্যাচটায় খেলব বলে। তুই তো জানিস এই ম্যাচের গুরুত্ব কী ভীষণ দুটো গ্রামের লোকের কাছে। এ বছর হরিকাকা দুটো প্লেয়ার কলকাতা থেকে ভাড়া করে আনবে বলেছে। অনৈতিক, একদম ইমমরাল, কনটেস্টের স্পিরিটটাই নষ্ট হয়ে যাবে। ভাড়াটে প্লেয়ার খেলিয়ে জিতলে বকদিঘির লোকেরা কি সেই নির্মল আনন্দটা পাবে, যেটা পেত গ্রামের লোককে দিয়ে খেলে জিতলে? তুই বল, এটা কি হরিকাকার উচিত?”

বাবু চুপ করে রইল। সত্যশেখর ওর দ্বিধাগ্রস্ত মুখ দেখে যথেষ্ট ভরসা পেল। ডান হাতটা মুঠো করে তুলে ঝাঁকিয়ে বলল, ”আমরা এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। আনুক ওরা ভাড়াটে প্লেয়ার, আমরা আটঘরার লোক দিয়েই টিম করব আর জিতবও।”

”তুই খেলবি।” বাবু কৌতূহলী স্বরে বলল।

”অবশ্যই। কালুও খেলবে। দু’বছর আগে এই ম্যাচে আমার একটা সেঞ্চুরি আছে—তেরোটা সিক্সার মেরে।”

বাবু মুচকি হেসে বলল, ”এবারও মারবি নাকি?”

উত্তেজিত হয়ে উৎসাহভরে সত্যশেখর বলল, ”তেরোটা কেন, তার বেশি—” বলেই হোঁচট খেল। স্তিমিত গলায় বলল, ”ফিটনেসটা ঠিক আগের মত নেই রে! তা ছাড়া তারপর আর তো ব্যাট ধরিনি। ছয়গুলো সব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নয় মারলুম কিন্তু এক রান, দু’রান নিতে হলে তো দৌড়তে হবে। স্লিপে দাঁড়ালেও তো ঝাঁপাতে—টাপাতে হবে।”

বাবু হেসে হালকা সুরে বলল, ”এখন তোর ওজন কত?”

”পঁচাশি কেজি।”

”হাইট?”

”বাবার থেকে দু’ইঞ্চি কম, ছ’ফুট এক ইঞ্চি।”

”শোন সতু, দু’তিন সপ্তাহের মধ্যে তোর ওজন কম করে পনেরো কেজি কমাতে পারব না। আর ওজন না কমালে যে ফিটনেস চাইছিস সেটা পাবি না। তার থেকে বরং ওই মেয়েগুলো এখন যে ব্যায়াম করছে সেগুলো কর।”

সত্যশেখর চোখ কুঁচকে ফ্রিহ্যান্ড ব্যায়ামে রত মেয়েদের কিছুক্ষণ দেখে বলল, ”ঠিক আছে, তবে ওদের সঙ্গে করব না, বাড়িতে ছাদে করব।”

”তাই করিস, কালু তোকে দেখিয়ে দেবে।”

বিব্রত হয়ে সত্যশেখর বলল, ”আবার কালু কেন? ও তো সঙ্গে সঙ্গে ওর বড়দিকে টেলিফোনে জানাবে আর সেটা হরিকাকার কানে পৌঁছে যাবে। উফফ। তোর মামা তো বকদিঘিতে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে সেটা চাউর করবে।”

হাসি চেপে বাবু বলল, ”তুই ছয় মারা প্র্যাকটিস কর। মেয়েদের ক্যাচিং প্র্যাকটিস দরকার। আমি বল করছি, তুই তুলে তুলে মার, ওরা লুফুক। প্যাড পরে নে।”

মেয়েদের জন্য খেলার যাবতীয় সরঞ্জাম পার্কের পাশেই একটা বাড়িতে রাখা থাকে। প্র্যাকটিসের আগে ব্যাট প্যাড গ্লাভস স্ট্যাম্প ও বল একটা বিশাল ক্যানভাসের থলিতে ভরে সেগুলো বয়ে আনে মেয়েরাই। সত্যশেখর সেই থলি থেকে প্যাড ব্যাট গ্লাভস বার করে পরে নিয়ে নেটের ক্রিজে এসে দাঁড়াল।

বাবু মেয়েদের উদ্দেশ্যে বলল, ”এবার ক্যাচিং প্র্যাকটিস। সবাই দূরে দূরে ছড়িয়ে যাও। লং অনে আর লং অফে দু’জন করে, মিড উইকেটে তিনজন, ডিপ ফাইন আর স্কোয়্যার লেগে দু’জন করে। একস্ট্রা কভারে দু’জন। কলাবতী গ্লাভস পরো, উইকেটের পিছনে দাঁড়াও। ফসকালেই স্ট্যাম্পড করবে।”

বাবুর নির্দেশমতো মেয়েরা ছড়িয়ে গিয়ে জায়গা নিল। বাবুর প্রথম বল লেগব্রেক। লেগস্টাম্পের দু’ ইঞ্চি বাইরে আলতো করে তুলে দেওয়া গুড লেংথে। সত্যশেখর শূন্য থেকে বলের অবরোহণ মুখ তুলে দেখতে দেখতে এক কদম বেরিয়ে বিশালভাবে পিছনে তোলা ব্যাট দিয়ে কপিবুক অন ড্রাইভ করল এবং ফসকাল।

”হাউজ দ্যাট।”

কলাবতী কাকাকে স্টাম্পড করার আনন্দে একটু বেশিই চেঁচিয়ে ফেলল। সত্যশেখর এক চোখ বন্ধ করে ভাইঝির দিকে তাকিয়ে ভারী গলায় বলল, ”বাইফোকাল চশমার জন্য ফ্লাইটটা কেমন যেন গোলমাল হয়ে গেল। অতটা ফ্লাইট করাবে বুঝতে পারিনি। কনট্যাক্ট লেন্স না পরে ভুল করেছি। বাড়ি গিয়েই পরে নেব।” তারপর সে চেঁচিয়ে বাবুকে বলল, ”একটু জোরে দে।”

বাবুর ডেলিভারটা জোরেই এল এবং ঈষৎ ওভারপিচ। সত্যশেখর আগের মতোই ব্যাট পিছনে তুলে চালাল। ব্যাট বলে লাগল আর বলটা প্রায় আটতলা বাড়ির উচ্চচতায় লং অনের দিকে উঠল। সেখানে দুটি মেয়ের একজন অন্যজনকে চিৎকার করে ”লিভ ইট” বলেই বলের নেমে আসার পথটা আন্দাজ করতে করতে ডাইনে বাঁয়ে, সামনে পিছনে কয়েক পা করেই ছুটে পাঁচ হাত সরে গিয়ে হাত মাথায় চাপা দিল এবং বলটা চার হাত দূরে জমিতে পড়ল।

বাবু চেঁচিয়ে বলল, ”নমামি কী হল? ক্যাচটা ধরার চেষ্টা করলে না কেন?”

”বাবুদা, মেয়েদের ক্রিকেটে অত উঁচুতে ক্যাচ ওঠে না, ধরার তো ওভ্যেসই নেই। ওনাকে একটু কমজোরে মাতে বলুন।”

বাবু এর পর বল করল শর্টপিচ। সত্যশেখর এক—পা পিছিয়ে পরম সুখে পুল করল। বল বিদ্যুৎগতিতে জমি দিয়ে গড়িয়ে স্কোয়্যার লেগে গেল। সেখানে ফিল্ড করছিল অলিপ্রিয়া। কামানের গোলার মতো বলটাকে আসতে দেখে সে হাত পেতেও তুলে নিল।

বাবু চেঁচিয়ে বলল, ”এভাবে ফিল্ড করলে তো চারের মিছিল চলবে।”

অলিপ্রিয়া বলল, ”বাবুদা, এত জোরে মেয়েদের ক্রিকেটে বল মারা হয় না।”

এর পর বাবু এগিয়ে এসে সত্যশেখরকে বলল, ”সতু, তোর রিফ্লেক্স পারফেক্ট, তোর বডি কো—অর্ডিনেশনও ঠিক আছে। তোকে দেখে আমার ইনজামাম উল—হককে মনে পড়ে যাচ্ছে, চালিয়ে যা।”

এর পর দুটি মেয়ে সত্যশেখরকে চার ওভার বল করল। চব্বিশটা বলের দশটা পার্ক পার হয়ে রাস্তায় পড়ল। ভাগ্য ভাল, রাস্তা দিয়ে তখন লোকজন কমই চলছিল।

”সতু, সব বলই যদি পার্ক পেরিয়ে যায়, তা হলে আমার মেয়েরা লুফবে কী? ওদের তৈরি করার জন্যই তো এই ক্লাব।”

সত্যশেখর বাবুর সমস্যাটা বুঝতে পারল। একটু ভেবে সে বলল, ”ব্যাপারটায় খেয়াল রাখব। বাবু এবার বল, আমি কি পারব।”

”কী, পারবি?”

”তোর মামার ভাড়াটে বোলারকে ঠ্যাঙাতে।”

”কী নাম বল তো বোলারটার, কোন ক্লাবের?”

”ইস্টবেঙ্গলের কে এক খোকন ব্যানার্জি।” সত্যশেখর প্যাড খুলে দুটো পা টানটান করে ঝাঁকিয়ে নিতে নিতে বলল।

”খোকন।” বাবু অবাক হয়ে তাকাল। ”কে এক বলছিস কী রে, খোকন তো এবারই রঞ্জি ট্রফিতে ত্রিপুরার এগেনস্টে ম্যাচে এগারোটা উইকেট নিয়েছে। একেই তুই ‘কে এক’ বলছিস। বাংলা খববের কাগজ কি তুই পড়িস না? খোকনকে ওয়ান ডে ইন্টারন্যাশনাল দলে না নেওয়ার জন্য কাগজগুলো সিলেক্টরদের মুণ্ডুপাত করছে।”

সত্যশেখর টেরিয়ে তাকাল বাবুর দিকে। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ”এ—গা—রো—টা! কী বল করে? শোয়েব আখতার না শোন ওয়ার্ন? ফাস্ট, না স্লো?”

”মিডিয়াম ফাস্ট।”

”ওহহ তা হলে তো হেসেখেলে ছক্কা চালাব। মিডিয়াম পেসারদের বল ব্যাটের ঠিক জায়গায় টাইমিং মতো লাগালেই আর দেখতে হবে না। দেখলি তো কেমন মারলুম।”

”সতু, আমি যে বল করলুম সেটা ক্যাচিং প্র্যাকটিসের বল। ওগুলো হাঁকড়ে মনে করছিস খোকনকেও হাঁকড়াবি? ভাল। ক’টা ছয় মারিস সেটা হরিমামা কি কালুর কাছ থেকে জেনে নেব।”

এবার মেয়েদের ব্যাটিং ও বোলিং এবং কলাবতীর উইকেটকিপিং প্র্যাকটিস শুরু হবে। সত্যশেখরকে সোমবার একটা গুরুত্বপূর্ণ মামলার সওয়াল করতে হবে হাওড়া কোর্টে, মক্কেল আসবে আর ঘণ্টাখানেক পর, সে ব্যস্ত হয়ে কলাবতীকে বলল, ”কালু আমি চললুম। আচারটা খেয়ে ঝালের চোটে মাথা সেই যে গরম হয়ে উঠল, বাড়ি গিয়ে ঠাণ্ডা জলে চান করতে হবে।” তারপর গলা নামিয়ে বলল ”আচার খেয়েছি সেটা বাবাকে বলিসনি, আর অন্য কাউকেও নয়।”

বিকেলে কলাবতী গাড়িবারান্দা থেকে দেখল কাকা গাড়ি নিয়ে বেরোল এবং একঘণ্টা পরই ফিরে এসে তার সেরেস্তায় ঢুকল, হাতে একটা পলিব্যাগ। সে বুঝে গেল কাকা কোথাও থেকে খাবার কিনে এনেছে। কলাবতী নীচে নেমে এল।

সে সেরেস্তায় ঢুকে দেখল কাকা গভীর মনোযোগে একটা ব্রিফ পড়ছে। কলাবতী এবার—ওধার তাকিয়ে পলিব্যাগটা খুঁজল কিন্তু দেখতে পেল না।

ব্রিফ থেকে মুখ না তুলে সত্যশেখর বলল, ”জানতুম আসবি। গাড়ি থেকে নামার সময়ই দেখেছি তুই বারান্দায় এসে দাঁড়ালি। যা, চট করে দুটো প্লেট নিয়ে আয়। আটটার সময় গণেন আসবে, তার আগেই শেষ করে ফেলতে হবে।”

গণেন টাইপিস্ট। সত্যশেখর ডিকটেশন দেয় আর শুনতে শুনতে সে ঝড়ের বেগে টাইপ করে যায়। যেদিন থেকে সত্যশেখর সেরেস্তা খুলে ওকালতি শুরু করেছে গণেন সেইদিন থেকেই সন্ধ্যায় এসে টাইপরাইটারে বসছে।

কলাবতী দুটো প্লেট নিয়ে এসে দেখল টেবলে পলিব্যাগটা বসানো, তার ভেতরে কাগজের দুটো বাক্স, বাক্স বার করতে করতে সত্যশেখর বলল, ”বাবা কোথায় রে?”

”দাদু ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক দেখছেন… কাকা এটা কী খাবার?” কলাবতী কৌতূহলে কাকার পাশে এসে দাঁড়াল।

”হুঁ, হুঁ, এখন কলকাতায় কতরকম বিদেশি খাদ্যবস্তু যে তৈরি হচ্ছে। চিনে খাবারটাবার একঘেয়ে হয়ে গেছে, এর নাম পিজ্জা, জাতে ইতালিয়ান।”

ত্রিভুজের আকারে কাটা ইস্ট দিয়ে মাথা ময়দার রুটি ওভেনে বেকড হয়ে মুড়মুড়ে, তার উপরে চিজ, মাংসের পরত, ক্রিম, টম্যাটো সস, ক্যাপসিকাম, চেরি ইত্যাদি। সত্যশেখর দুটো ত্রিভুজ আলতো করে প্লেটে রেখে বলল, ”খেয়ে দ্যাখ।” আঙুলে ক্রিম লেগে গেছে, চেটে নিয়ে সে দুটো পিজ্জা অন্য প্লেটে রেখে তাকাল ভাইঝির দিকে। কলাবতী দু’আঙুল দিয়ে পিজ্জা তুলে বড় হাঁ করে আধখানা মুখে পুরে কামড় বসাল, মুড়মুড়ে পিজ্জা ভেঙে যেতেই সে চিবোতে শুরু করল। সত্যশেখর গভীর উৎকণ্ঠায় খাওয়ার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করছে। কলাবতী চোখ বুজে তৃপ্তি করে ঘাড় নাড়তেই হাঁফ ছেড়ে বলল, ”আগে কখনও খাসনি তো। আমাদের এদিকে এসব পাওয়া যায় না, তবে পাওয়া যাবে।”

বলতে বলতে সত্যশেখর নিজের প্লেট থেকে তুলে খেতে শুরু করল। কলাবতী দ্বিতীয় পিজ্জা শেষ করে আঙুল চেটে কাকার খাওয়া দেখতে লাগল।

”কী, আর একটা? তুলে নে। কিন্তু এটাই শেষ।”

”ক’টা এনেছ?” দ্বিতীয় বাক্স থেকে একটা তুলে নিয়ে কলাবতী বলল।

”আটটা।”

”তুমি একাই পাঁচটা খাবে।” অবাক ও ক্ষুব্ধস্বরে বলল কলাবতী।

”কেন, আমার কি পাঁচটা খাওয়ার ক্ষমতা নেই।” সত্যশেখর বলল চ্যালেঞ্জের সুরে।

”ক্ষমতা তো আমারও আছে। আমি তো সিংহি বাড়ির মেয়ে, আমি কি বকদিঘির মুখুজ্যেবাড়ির মেয়ে নাকি যে, এইটুকু টুকু খুঁটে খুঁটে খাব?”

কলাবতী যা আশা করেছিল সেটাই দেখতে পেল। কাকার মুখ প্রসন্নতায় ভরে উঠল। স্মিত চোখে তাকিয়ে বাক্সের দিকে আঙুল দেখিয়ে সত্যশেখর বলল, ”নে একটা, তবে এটাই লাস্ট।”

খাওয়া শেষ করে জিভ দিয়ে ঠোঁট ও আঙুল থেকে ক্রিম চেটে নিয়ে সত্যশেখর বলল, ”ছোটবেলা থেকেই দেখেছি মলু একদমই খেতে পারে না, পাখির আহার।”

”সেজন্যই বড়দির ফিগারটা অত ভাল। চলাফেরায় চটপটে, মেঝেয় কিছু পড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকে তুলে নিতে পারে। স্কুলের বারান্দায় বৃষ্টির জল জমলে লাফ দিয়ে ডিঙিয়ে যায়…।”

”হয়েছে হয়েছে।” সত্যশেখর থামিয়ে দিয়ে বলল, ”প্লেট দুটো নিয়ে যা, এখুনি গণেন আসবে।”

ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে কলাবতী বলল, ”বাবুদার কথাটা মনে আছে? ওজন না কমালে যে ফিটনেস তুমি চাইছ সেটা পাবে না। ওজন কমাতে গেলে খাওয়া কমাতে হবে, আর ব্যায়াম শুরু করতে হবে।”

কটমট করে তাকিয়েই সত্যশেখরের চাহনি কোমল হয়ে গেল। ঘরে গণেন ঢুকেছে।

.

মিলেনিয়াম ম্যাচের তোড়জোড়

রাজশেখরের সঙ্গে পঞ্চায়েত প্রধান পটল হালদারের কথাবার্তার চারদিন পর রাত্রে আটঘরা থেকে পরমেশের টেলিফোন এল। সিংহিরা তখন খাওয়ার টেবলে। মুরারি হ্যান্ডসেটটা এনে রাজশেখরকে দিয়ে বলল, ”আটঘরা থেকে।”

শুনেই সত্যশেখর ও কলাবতী খাওয়া বন্ধ রেখে উৎসুক চোখে তাকাল। এর পর যে সংলাপ বিনিময় হল তার একপক্ষেরটা ওরা দু’জন শুনতে পেল। তবে পাঠকদের সুবিধের জন্য দু’পক্ষের কথাই লেখা হল এখানে :

”হ্যালো, কে?”

”জ্যাঠামশাই, আমি পরমেশ।”

চুঁচুড়া কোর্টে চাকরি করে পরমেশ এবং আটঘরা থেকেই সে বাসে যাতায়াত করে। আটঘরার ক্রিকেট উন্নয়নের দায়দায়িত্ব তার হাতে এবং বাৎসরিক ম্যাচটিরও অন্যতম সংগঠক। নিজে ক্রিকেট খেলে না।

”বলো পরমেশ কেমন আছ, এই ক’দিন আগে পটল এসেছিল। বলল হরি মুখুজ্যে এবার কলকাতা থেকে দু’জন ক্রিকেটার ভাড়া করে আনবে। একজন মোহনবাগানের, অন্যজন ইস্টবেঙ্গলের। আমি হরিকে বললুম, এই ম্যাচে আজ পর্যন্ত কখনও ভাড়া করে এনে কাউকে খেলানো হয়নি। দুটো গ্রামের লোকেদের থেকে টিম করে খেলা হয়। এই ঐতিহ্য বকদিঘি যদি ভাঙতে চায় ভাঙুক, আটঘরা ভাঙবে না। দেখি বকদিঘি কেমন করে জেতে। পরমেশ, ওকে আমি চ্যালেঞ্জ দিয়েছি।”

”আর সেই চ্যালেঞ্জের কথা পটলদা এখানে হাটেবাজারে, শিবতলায়, রিকশা স্ট্যান্ডে পথসভা করে দু’দিন ধরে বলে বেড়াচ্ছে। আপনিও খেলবেন, কলাবতীও খেলে ম্যাচ জেতাবে। এইসব বলে যাচ্ছে। সতুদা আবার সেঞ্চুরি করবেন আর রেকর্ড গড়বেন। লোকে বেশ তেতে উঠেছে।”

কলাবতী দেখল, শুনতে শুনতে দাদুর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে।

”বল কী, আমিও খেলব বলে বেড়াচ্ছে। ওকে থামাও, থামাও। এ তো মহাবিপদ হল! সতু আর কালু খেলবে, বাকি ন’জন তোমরা ঠিক করবে।”

”টিম এবার ঢেলে সাজানো হবে। আটঘরা স্কুলের ভেতরের ছোট্ট মাঠটায় গত বছর থেকে ক্রিকেট কোচিং চালু হয়েছে। ভানু ঘোষাল ডিস্ট্রিক্ট টিমে খেলেছে, সে—ই কোচ। খরচ দিচ্ছে মোহিনী রাইস মিল আর কালীমাতা কোল্ড স্টোরেজ। তাই কোচিং সেন্টারের নাম মোহিনী কালীমাতা আটঘরা ক্রিকেট অ্যাকাডেমি। সংক্ষেপে এম কে এ ক্রিকেট অ্যাকাডেমি। ভুবনডাক্তার অ্যাকাডেমিকে অকাদেমি করতে চেয়েছিলেন, ভোটে বাতিল হয়ে যায়। অ্যাকাডেমি সামনের বছর কলকাতায় অম্বর রায় সাব জুনিয়ার টুর্নামেন্টে নাম দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। এদেরই চারটে ছেলেকে খেলাব বলে ঠিক করেছি।”

সত্যশেখর ভ্রূ কুঁচকে প্রায় ধমকে উঠলেন, ”চারটে কেন? ন’জনকে খেলাও।”

”না জ্যাঠামশাই, তা হলে মুশকিলে পড়ে যাব। বকু বোসের জায়গায় যদি কলাবতী উইকেট কিপিং করে, তা হলে তো ওকে বসাতে হবে। ওকে বসালে ডেকরেটরের বিল ডবল হয়ে যাবে।”

”কেন, বকু বোস কি ডেকরেটিংয়ের ব্যবসা করে?”

”ওর শালা করে। সুতরাং ওকে রাখতেই হবে। হাবুময়রা লাঞ্চে এবারও দই মিষ্টি দেবে বলেছে, ওর ছেলে বিশুকে তো রাখতেই হবে।”

”বিশু মানে সেই নীল বেলবটম পরা সাবস্টিটিউট ছেলেটা, ক্যাচ ধরতে গিয়ে যার মাথার উপর বল পড়েছিল?”

”হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনার দেখছি মনে আছে। বিশু সাদা প্যান্ট—শার্ট করিয়েছে, ক্যাচ লোফার প্র্যাকটিস হপ্তায় এক ঘণ্টা করে করছে। খুব সিরিয়াস ছেলে। আগের দারোগাবাবু বদলি হয়ে গেছেন, মেজোবাবু কবমবয়সি একজন, বললেন তো কলেজ টিমে খেলেছেন এগারো বছর আগে। লেগ স্পিনার।”

”তোমাদের ওই ভুবন ডাক্তারটিকে বাদ দিতে পারো?”

”পারি। তা হলে ওর কম্পাউণ্ডার চণ্ডীকেও বাদ দিতে হয়। কেন না ডাক্তারবাবু খেলবেন না অথচ তার কম্পাউণ্ডার খেলবে তা তো হতে পারে না। এতে তো ডাক্তারের প্রেস্টিজে লাগবে। ডাক্তারের প্রেস্টিজ চলে গেলে সে তো আর ডাক্তারই থাকবে না, হাতুড়ে হয়ে যাবে। জ্যাঠামশাই, আটঘরায় কি আপনি হাতুড়ে চাইবেন।”

”না, না, ডাক্তার থাকুক, একমাত্র এম বি বি এস তো ওই একজনই। তা হলে চণ্ডীকে বাদ দাও।” নিশ্চিন্ত স্বরে রাজশেখর নির্দেশ পাঠালেন।

”জ্যাঠামশাই তাতে সামান্য অসুবিধে আছে। চণ্ডী সত্যিই ভাল ক্রিকেটার। জোরের ওপর অফস্পিন করায় লেংথ রেখে, মোটামুটি ভাল ফিল্ড করে। ব্যাটে একটা দিক ধরে রাখতে পারে।”

”ঠিক আছে রাখো। ক’জন হল তা হলে—সতু, কালু, বকু, বিশু ডাক্তার, দারোসা, কম্পাউন্ডার, সাতজন আর অ্যাকাডেমির চারজন। টিম তো হয়েই গেল। ভাল কথা, টুয়েলফথ ম্যান কে হবে? ভাল দৌড়তে পারে, গ্রো করতে পারে, ক্যাচট্যাচ ধরতে পারে এমন কেউ আছে?”

”এইখানেই একটু বিপদে পড়েছি জ্যাঠামশাই। ক্যান্ডিডেট তিনজন, পঞ্চায়েত সদস্য ভোলানাথ, সে আবার পটলদার ভাইপো, ফিশারিজ অফিসের পাঁচকড়ি আর স্কুলের গেমস টিচার। তবে ভোলানাথ ছাড়া কারুর রেসিডেন্সিয়াল কোয়ালিফিকেশন নেই, দু’জনেই বাইরে থেকে এসে চাকরি করে চলে যায়। সুতরাং দু’জনকে বাদ দেওয়া যায়।”

রাজশেখর এবার ব্যস্ত হয়ে বললেন, ”বকদিঘি যে দু’জন প্লেয়ার ভাড়া করে আনছে তাদের কোয়ালিফিকেশন আছে কি না, খোঁজ নিয়েছ? এটা কিন্তু খুব জরুরি ব্যাপার।”

”কাল নন্তুকে বকদিঘি পাঠিয়েছিলুম। ওখানে ওর দাদার শ্বশুরবাড়ি। ফিরে এসে বলল, খোকন ব্যানার্জিদের পৈতৃক বাড়ি বকদিঘিতে। চল্লিশ বছর আগে ওর ঠাকুর্দা কলকাতায় গিয়ে বসবাস শুরু করে। একটা ঘর নাকি এখনও ওদের অংশে আছে। পুজোর সময় খোকনরা আসে। আর মদন গুহ বকদিঘির কেউ নয়, ওর দিদির বিয়ে হয়েছে ওখানে। তবে শোনা যায় একবার মদন গুহ এক সপ্তাহ দিদির শ্বশুরবাড়িতে এসে থেকেছিল, মাছধরার শখ আছে, ছুটিছাটায় ছিপ নিয়ে আসে।”

রাজশেখরকে হতাশ দেখাল, স্তিমিত স্বরে বললেন, ”তা হলে তো কিছু আর করার নেই। এক সপ্তাহ বাস করলে তো যোগ্যতা পেয়েই গেল। আর পতু মুখুজ্যে সেটা ঠিক প্রমাণও করে দেবে।”

”পটলদা পথসভায় বলেছে কোয়ালিফিকেশন টোয়ালিফিকেশন বুঝি না, ঐতিহ্য যখন ভাঙা হবেই তখন আমরাও পালটা ঐতিহ্য গড়ব।”

বিভ্রান্ত রাজশেখর বললেন, ”পালটা ঐতিহ্য। সেটা আবার কী?”

”অবরোধ। পটলদা পথ অবরোধ করবেন। যে পথ দিয়ে ভাড়াটে সৈনিকরা মোটরে আসবে খেলার দিন, তিনি সেই পথ সকাল থেকে একশো ছেলেমেয়ে দিয়ে বন্ধ করে দেবেন, যাতে ওই দু’জন কোনওভাবে মাঠে পৌঁছতে না পারে। আর এটাও জানিয়ে দিয়েছেন, এই কাজ গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে, সংবিধানে নাকি লেখা আছে।”

সন্ত্রস্ত হয়ে রাজশেখর খাড়া হয়ে বসলেন। ”পথ অবরোধ গণতান্ত্রিক অধিকার। বলো কী পরমেশ, এই বাৎসরিক ম্যাচটা এবার তো বন্ধ করে দিতে হয়, আর পটলকে নয় তো পাগলা গারদে পাঠাতে হয়। কোনটা করা উচিত?”

”কোনওটাই নয়, পটলদাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, এসব কী বলছেন? তাইতে উনি বললেন, একটা কুকুর গাড়ি চাপা গেলে কলকাতায় পথ অবরোধ হয়, কেউ কিচ্ছু বাধা দেয় না, সবাই মাথা নিচু করে মেনে নেয়, আর এটা তো কুকুরের থেকেও বড় ব্যাপার, ঐতিহ্যের বিনাশ। জ্যাঠামশাই এর পর আর কী বলব বুঝে উঠতে পারলুম না। ঐতিহ্যটাকে ইস্যু করে পোস্টার মারা শুরু হয়ে গেছে। সত্যশেখর সিংহর শতরানকে এই ম্যাচের শতাব্দীর সেরা ব্যাটিং কৃতিত্ব বলে তাকে অমর করে রাখতে স্তম্ভ গড়ার জন্য সাহায্যের আবেদন জানানো হচ্ছে। জ্যাঠামশাই ওকে থামাতে পারবেন না, পঞ্চায়েত নির্বাচনে জিতে পটলদা এই বাৎসরিক ম্যাচকে তুরুপের তাস করেছে। পোস্টারে, মিছিলে, জ্বালাময়ী বক্তৃতায় আটঘরা এমন তেতে উঠেছে যে, ধানের দাম পড়ে যাওয়া নিয়ে কেউ আর কোনও কথা তুলছে না। পোস্টারে এবারের ম্যাচকে মিলেনিয়াম ম্যাচ বলে লাল কালিতে বড় বড় অক্ষরে লেখা হয়েছে।”

রাজশেখর হতভম্ব হয়ে বললেন, ”মিলেনিয়াম? শব্দটা পটলের মাথায় ঢুকল কীভাবে।”

”বোধ হয় বাবুঘাটে গঙ্গার ধারে মিলেনিয়াম পার্ক দেখে ওর মাথায় এটা খেলে গেছে। ম্যাচের তিনদিন আগে থেকে রথতলা মাঠ ঘিরে মেলা বসাবার ব্যবস্থা হয়েছে। নাগরদোলা, মেরি গো রাউন্ড তো থাকবেই, আর থাকবে নতুন খাবার চাউমিন আর রোলের দোকান, তাই শুনে এখানকার মিষ্টির দোকানদাররা প্রবল প্রতিবাদ জানাতে এই ফরেন খাবারের অনুপ্রবেশ রুখতে ঠিক করেছে খেলার আগের দিন দোকানের ঝাঁপ ফেলে রাখবে।”

রাজশেখর এতক্ষণ বুকে ধরে রাখা বাতাস মুখ দিয়ে বার করে বললেন, ”আমার চ্যালেঞ্জ জানানোটা দেখছি ভুল হয়ে গেছে। পরমেশ, এবার আমরা হারব মনে হচ্ছে। আম্পায়ার কারা হবে তুমি সেটা তো বললে না?”

”পতু মুখুজ্যেকে আমরা বলেছি সি এ বি—র পাশকরা নিরপেক্ষ আম্পায়ার দিয়ে এবার খেলাতে হবে। উনি রাজি হয়েছেন। আমাদের হেডমাষ্টার মশাইয়ের বন্ধুর ভাই প্রশন্ত রায় সি এ বি আম্পায়ার, তাঁর সঙ্গে উনি টেলিফোনে কথা বলেছেন। প্রশান্ত রায় আসবেন বলেছেন। অন্য আম্পায়ার আনার দায়িত্ব বকদিঘির। জানি না কাকে আনবে।”

”ঠিক আছে, যদি কিছু বলার থাকে ফোন কোরো। আমারও কিছু জানার থাকলে আমি করব। তবে পথ অবরোধ টবরোধের মতো কিছু যেন না হয় সেটা দেখো।”

এই বলে রাজশেখর রিসিভার রেখে হাঁফ ছাড়লেন। সত্যশেখর ও কলাবতী উদগ্রীব হয়ে তাঁর কথা ও মুখভাব লক্ষ করে যাচ্ছিল এবং অনুমান করছিল অপরদিক থেকে কী বলা হচ্ছে। রাজশেখর নিজে থেকেই সংক্ষেপে পরমেশ যা জানিয়েছে সেটা বলে যোগ করলেন, ”পটল, এই বাৎসরিক খেলাটার একটা নাম দিয়েছে—মিলেনিয়াম ম্যাচ।”

”বাঃ, চমৎকার নাম দিয়েছে তো।” সত্যশেখর উৎফুল্ল স্বরে বলল। ”এইসঙ্গে একটা মিলেনিয়াম ট্রফি চালু করলে কেমন হয় বাবা? যেমন ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে ফ্রাঙ্ক ওয়ারেল ট্রফি, ভারত অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে বর্ডার গাওস্কর ট্রফি, ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে অ্যাশেজ। তেমনি আটঘরা বকদিঘির মধ্যে মিলেনিয়াম ট্রফি।” প্রস্তাবটা দিয়ে সে উৎসুক চোখে বাবা ও ভাইঝির দিকে তাকিয়ে রইল।

কলাবতী খুশিতে ঝকমক করে বলল, ”দারুণ হবে। মিলেমিয়াম ট্রফি ডোনেটেড বাই রাজশেখর সিনহা অফ আটঘরা, ট্রফির গায়ে লেখা থাকবে।”

সত্যশেখর চোখ বন্ধ করে কপালে আঙুলের টোকা দিতে দিতে চিন্তিত স্বরে বলল, ”কিন্তু একটা মুশকিল আছে। বকদিঘি মানে হরিকাকা কি এটা মেনে নেবে? এতে তো ওদের প্রেস্টিজ ঢিলে হয়ে যাবে। আমার মনে হয় পটল হালদারকে দিয়ে এটা প্রপোজ করালে ভাল হয়। বাবা আমিই বরং ওকে বলব আপনি পতু মুখুজ্যেকে গিয়ে বলুন আটঘরা পঞ্চায়েত মিলেনিয়াম ট্রফি ডোনেট করবে রুপোর জলকরা এক হাত উঁচু, রঞ্জি ট্রফির আদলে একটা ট্রফি। শর্ত একটাই, ওতে রাজশেখর সিংহের নাম থাকবে।”

কলাবতী বলল, ”আমি একশো পার্সেন্ট সিওর বকদিঘি মানে হরিদাদু তাতে রাজি হবেন না। আটঘরা টেক্কা দিয়ে যাবে এটা উনি কিছুতেই মানবেন না। আমি বলি কী, এই ট্রফি জয়েন্টলি ডোনেট করার প্রস্তাব দিলে হয়তো উনি মেনে নেবেন।”

সত্যশেখর বলল, ”বাবা তুমি কী বলো?”

রাজশেখর শুকনো গলায় বললেন, ”আমি আবার বলব কী। তোরা নিজেরাই প্রস্তাব দিচ্ছিস, নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিচ্ছিস। ব্যাপারটা শোভন হয় যদি দুটো গ্রামের মানুষ মিলিতভাবে এই ট্রফি দান করে। কোনও ব্যক্তির নাম এর গায়ে খোদাই করলে খেলাটা তার চরিত্র হারিয়ে ফেলবে। সতু তুই নিজে গিয়ে হরিকে বল, পটলকে দিয়ে বলালে ব্যাপারটার গুরুত্ব কমে যাবে।”

সত্যশেখর সন্ত্রস্ত হয়ে বলল, ”হরিকাকার কাছে আমি? ওরে ব্বাবা। চিমটি কেটে কেটে এমনভাবে কথা বলবে, তাতে মেজাজ ঠিক রাখাই দায় হয়ে পড়বে।”

”কিচ্ছু দায় হবে না, আমি তোমার সঙ্গে থাকব।” কলাবতী আশ্বস্ত করল কাকাকে। ”তার আগে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে যাওয়াই ভাল।”

হ্যান্ডসেটটা রাজশেখরের সামনে টেবলের উপর, কলাবতী রিসিভার তুলে পট পট বোতাম টিপল। বড়দির বাড়ির ফোন নম্বর তার মুখস্থ।

”হ্যালো, কে প্রভাদি? কালুদি বলছি, দিদিমণিকে দাও তো।”

একটু পরেই মলয়ার গলা ভেসে এল কলাবতীর কানে, ”কী ব্যাপার কালু, হঠাৎ ফোন?”

”বড়দি হরিদাদুর সঙ্গে একবার দেখা করব, ওই বাৎসরিক ম্যাচটা সম্পর্কে কথা বলার জন্য। কবে ওনার সময় হবে সেটা জানতেই ফোন করলুম।”

”ম্যাচ সম্পর্কে তুমি ওইটুকু মেয়ে কী কথা বলবে, এটা তো বড়দের ব্যাপার। বড় কাউকে কথা বলতে বলো।”

”বড় একজন নিশ্চয় কথা বলবে কিন্তু হরিদাদুর সঙ্গে কথা বলতে তিনি একদমই স্বস্তিবোধ করেন না তাই আমাকে সঙ্গে থাকতে হবে।”

”বাবার সঙ্গে কথা বলতে হলে তোমার সঙ্গী বড় লোকটির তো রাতে ছাড়া সময় হবে না। কাল রাতেই এসো, আসার আগে একটা ফোন কোরো।”

রিসিভার রেখে কলাবতী বলল, ”কাকা, কাল রাতে। মক্কেলদের তাড়াতাড়ি বিদায় করে দিয়ো।”

পরদিন রাত আটটায় সত্যশেখর তার সেরেস্তার ঝাঁপ ফেলে দিয়ে ভাইঝিকে বলল, ”কালু চল মুখুজ্যেবাড়িতে। ভাল কথা, সেই আমের আচারের শিশিটা কোথায় রে?”

”ওটা তো দাদুর, দাদুকে দিয়ে দিয়েছি।”

”দ্যাখ তো একটু আছে কি না।”

”কাল দেখেছি সামান্য একটু পড়ে আছে। হঠাৎ এখন আচার খাওয়ার ইচ্ছে হল যে।”

”সেদিন খেয়ে যে ঝালটা লাগল তাতে রক্ত টগবগিয়ে উঠে মাথাটা এমন গরম করে দিল যে, মনে হচ্ছিল আমি একটা বুলডোজার, সামনে যা পড়বে ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে দোব। তারপরই তো বাবুর বলগুলো পার্কের বাইরে ফেলতে লাগলুম। এখন হরিকাকার সামনে বুলডোজার হয়ে যাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে। দ্যাখ না শিশিটা।—”

”না না একদম বুলডোজার হবে না।”

কলাবতী আঁতকে উঠে বলল, ”তুমি কি সিক্সার মারতে যাচ্ছ? তুমি যাচ্ছ হরিদাদুকে বুঝিয়ে মিলেনিয়াম নামে একটা ট্রফি চালু করার জন্য। দাঁড়াও, রওনা হওয়ার আগে একটা ফোন করার কথা আছে।”

”গাড়ি বার করছি, তাড়াতাড়ি আয়।” বলে সত্যশেখর নীচে নেমে গেল।

কলাবতী ফোন করল, ওধারে মলয়া। ”বড়দি, আমরা এবার বেরোচ্ছি। …দেরি হল? সে তো কাকার জন্য, মক্কেলদের সঙ্গে বসলে সময়জ্ঞান থাকে না। তারপর বায়না ধরল তোমার সেই আমের আচারটা খাবে…অ্যাঁ? কী করে আচারের কথা জানল? আমার হাতে শিশিটা দেখে কেড়ে নিয়ে একটুকরো মুখে দেয়, ভীষণ ভাল লেগেছে, তারপর অবশ্য শিশিটা দাদুর কাছে চালান করে দিই। বড়দি কাকা হর্ন দিচ্ছে, রাখছি।”

গাড়িতে যেতে যেতে সত্যশেখর গম্ভীরস্বরে বলল, ”কালু, একটা কথা বলে রাখছি। যখন দেখবি আমি রেগে উঠছি তখন আমার হাতে চিমটি কাটবি কিংবা পা দিয়ে আমার পায়ে একটা ঠোক্কর দিবি। যখন দেখবি কথা বলতে বলতে আমি ভুল রাস্তায় চলে যাচ্ছি তখন হ্যাঁচ্চেচা করে হাঁচবি। আর একটা কথা, নিশ্চয় খেতেটেতে দেবে। দিলে ওদের সম্মান রাখতে একটুখানি খাবি।”

কলাবতী বলল, ”একটুখানিটা কীরকম? পাখির আহার?”

”হ্যাঁ ধর, চারটে সন্দেশ দিল, খাবি একটা।”

”সন্দেশ না দিয়ে যদি বাড়ির তৈরি ফিশফ্রাই দেয়? বড়দি দারুণ করে।”

”যদি খুব বড় সাইজের দেয় তা হলে বলবি, না না এতবড় খেতে পারব না। বলে প্লেটটা সরিয়ে রাখবি। ছোট হলে নিশ্চয় দুটো দেবে, খাবি একটা। মিষ্টি দেবেই, ওই যা বললুম একটা সন্দেশ কিংবা একটা রসগোল্লা। বুঝিয়ে দিবি আমরা খেতে আসিনি, একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করতে এসেছি।”

”তুমিও কি প্লেট সরিয়ে রাখবে?”

”আমি?” সত্যশেখর মুখুজ্যেবাড়ির গেট দিয়ে গাড়ি ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, ”আমিও তাই করব।”

.

শর্ত প্রত্যাহারে সিংহের আহার

বৈঠকখানায় সোফায় হেলান দিয়ে কাচের নিচু টেবলে পা ছড়িয়ে হরিশঙ্কর টিভি দেখছিলেন। টেবলের ওধারে আর একটা সোফা। দু’—তিনটি গদি মোড়া চেয়ার বড় ঘরটায় ছড়ানো রয়েছে। মেঝের অর্ধেকটা কার্পেটে ঢাকা। ওদের দু’জনকে ঢুকতে দেখে রিমোট কন্ট্রোলে টিভি বন্ধ করে দিয়ে পা নামিয়ে হরিশঙ্কর উদারস্বরে বললেন, ”এসো এসো, কী সৌভাগ্য আমার। বোসো বোসো ওই সোফাটায় বোসো। দুটো সিংহ বাড়িতে ঢুকেছে একা তো সামলাতে পারব না, দাঁড়াও মলুকে ডাকি।” এই বলে তিনি উঠতে যাচ্ছিলেন। তখনই মলয়া ঘরে ঢুকল। তার পিছনে প্রভা। প্রভার হাতে ট্রে। তাতে দুটো কাচের গ্লাস।

টেবলে ট্রে রাখল প্রভা। হালকা ঘোলাটে রঙের পানীয়। মলয়া গ্লাস দুটো দু’জনের সামনে রেখে কলাবতীকে বলল, ”জলজিরা, খেয়ে নাও। বাড়িতেই তৈরি করা।” তারপর সত্যশেখরের দিকে তাকিয়ে বলল, ”ও কী, চুপ করে বসে আছ যে? গ্লাসটা তোলো।”

সত্যশেখর আড়চোখে দেখল ভাইঝি গ্লাসের দিকে হাত বাড়িয়েছে। সে গলাখাঁকারি দিল। কলাবতী হাত টেনে নিল। মলয়া লক্ষ করে যাচ্ছিল, এবার সে গলা থেকে বড়দিকে বার করে বলল, ”খেয়ে নাও কালু, দেরি কোরো না।” তারপর সত্যশেখরকে বলল, ”তুমিও।”

দু’জনেই গ্লাস তুলে নিল। চুমুক দেওয়ার আগে সত্যশেখর বলল, ”হরিকাকার গ্লাস কই।?”

হরিশঙ্কর ব্যস্ত হয়ে বললেন, ”আমি সন্ধেবেলাতেই একগ্লাস খেয়েছি, ও—ই যথেষ্ট। বুঝলে, দারুণ খিদে হয়। জিরেভাজা, পুদিনা, কাঁচালঙ্কা বাটা লেবুর রস, সন্ধব নুন এইসব দিয়ে যা টক ঝাল নোনতা একটা জিনিস তৈরি হয় না, কী বলব। বড্ড দেরি করে তোমরা এলে।”

দু’ চুমুকে ওরা দু’জন গ্লাস শেষ করে টেবলে রাখল। দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল মলয়া। বুঝল ভাল লেগেছে, ”আর এক গ্লাস করে হয়ে যাক।”

মলয়া ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই কলাবতী ফিসফিস করে বলল, ”কাকা, খাব?”

”হুঁ।” সত্যশেখর চাপাস্বরে বলল।

”তারপর সতু, ম্যাচটা সম্পর্কে কী যেন বলবে শুনলুম মলুর কাছে। রাজু তো আমাকে চ্যালেঞ্জ দিল এবার আটঘরার জিত কেউ ঠেকাতে পারবে না। তুমি আবার নতুন কোনও চ্যালেঞ্জ—ট্যালেঞ্জ দেবে নাকি।” হরিশঙ্কর সোফায় দেহ এলিয়ে দিয়ে বললেন।

”না হরিকাকা, আপনাকে চ্যালেঞ্জ দেওয়ার মতো ক্ষমতা বা স্পর্ধা আমার নেই।” বিনীত ও মৃদুস্বরে সত্যশেখর বলল, ”আমি এসেছি একটা প্রস্তাব নিয়ে।”

সত্যশেখরের কথা শুনে হরিশঙ্কর সিধে হয়ে বসলেন আর মলয়া বসে পড়ল একটা চেয়ারে।

”পৃথিবীর বয়স তো টু মিলেনিয়াম মানে দু’হাজার বছর হল। একটা হাজার বছর পূর্তি দেখা তো মানুষের জীবনে চট করে ঘটে না। এটা একটা বিশেষ ব্যাপার আমাদের মানে আটঘরা আর বকদিঘির জীবনে। তাই বলছিলুম—”

সত্যশেখরকে হাত তুলে থামিয়ে মলয়া বলল, ”সতু তুমি কি নিশ্চিত পৃথিবীর বয়স দু’ হাজার বছর? আমি তো জানি জিওলজিস্টরা পাথর পরীক্ষা—নিরীক্ষা করে বলেছেন প্রায় ৪৬০ কোটি বছর। তুমি বোধ হয় খ্রিস্টাব্দের কথা বলতে চাও।”

”হ্যাঁ হ্যাঁ, খ্রিস্টাব্দ। মলু ঠিক বলেছে।” সত্যশেখর এই ডিসেম্বরে ঘেমে উঠে পকেট থেকে রুমাল বার করে কপাল মুছল।

”ঠিক আছে, মিলেনিয়াম তো বুঝলুম। এর সঙ্গে আটঘরা—বকদিঘির কী সম্পর্ক?” হরিশঙ্করের গলায় কৌতুক ফুটে উঠল।

”সম্পর্ক মানে, পৃথিবীর জীবনে এতবড় একটা ব্যাপার ঘটল, আমরা এটাকে স্মরণীয় করে রাখতে কিছু একটা তো করতে পারি?”

”যেমন?” হরিশঙ্কর ভ্রূ কোঁচকালেন।

”যেমন আমাদের বাৎসরিক ম্যাচটার নাম দিতে পারি মিলেনিয়াম ম্যাচ।” বলেই সত্যশেখর ঝুঁকে পড়ল হরিশঙ্করের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করার জন্য।

”চমৎকার নাম।” হরিশঙ্কর কিছু বলার আগে মলয়া তার মত জানিয়ে দিল, উৎফুল্ল কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে সত্যশেখর তাকাল মলয়ার দিকে। একটু আগে মলয়া পৃথিবীর বয়স নিয়ে তাকে অপ্রতিভ করায় যে লজ্জায় পড়েছিল সেটা থেকে যেন উদ্ধার পেল।

”একটা নাম দেবে? বেশ তো, দাও। এতে আমার কোনও আপত্তি নেই। এটা কার মাথা থেকে বেরোল, তোমার?”

প্রসঙ্গটা ঘোরাবার জন্য মলয়া বলে উঠল, ”তোমরা আসবে বলে জলখাবার তৈরি করেছি। যাই, প্রভাকে বলি লুচি ভাজতে।”

মলয়া ঘর থেকে বেরোতেই কাকা—ভাইঝি দৃষ্টি বিনিময় করল।

”নামটা পট—” সত্যশেখর পটল শব্দটা সম্পূর্ণ করার আগেই কোমরে কলাবতীর চিমটি পেয়ে চমকে উঠে চুপ করে গেল।

”কী ব্যাপার, পট বলে থেমে গেলে যে?” হরিশঙ্কর অবাক হয়ে বললেন।

কলাবতী বলল, ”কাল রাতে খাওয়ার সময় কাকার মাথায় পট করে নামটা এসে গেল, সেটাই বলতে যাচ্ছিল। দাদু, আমারও একটা প্রস্তাব আছে।”

”ওরে বাবা, তোমারও একটা আছে? বলে ফেলো।”

”বছর বছর ম্যাচ তো হয়, কিন্তু উইনিং টিম তো কিছু পায় না। এবার থেকে উইনাররা একটা ট্রফি পাবে। তার নাম হবে মিলেনিয়াম ট্রফি।” কলাবতী প্রস্তাব দিয়ে উজ্জ্বল চোখে তাকাল।

”এটা কার মাথা থেকে বেরোল, রাজুর? ওর তো খেয়েদেয়ে কাজ নেই। এখন এইসব নিয়ে মাথা ঘামায়। ট্রফিটা দেখতে কেমন হবে, কত বড় হবে, কী দিয়ে তৈরি হবে, এর দাম দেবে কে, এসব নিশ্চয় ভেবে ফেলেছে। শুধু একটা শর্তে আমি রাজি হব আর ট্রফি তৈরির পুরো খরচও দেব, যদি ট্রফির গায়ে খোদাই করা থাকে ‘বকদিঘির হরিশঙ্কর মুখোপাধ্যায় কর্তৃক প্রদত্ত’ এই ক’টি কথা।”

ঠিক তখনই ঘরে ঢুকল প্রভা। দু’হাতে দুটি ঝকঝকে কাঁসার বগি থালা। থালা দুটি সে টেবলে দু’জনের সামনে রাখল। থালায় বড় একটা বাটিতে ফুলকপি আলু কড়াইশুঁটি আর টমাটোর মাঝখানে বিরাজ করছে একটা বৃহৎ গলদা চিংড়ি। বাটির পাশে চাকা করে কাটা বেগুনভাজা। প্রভার পিছনে এসেছে মলয়া। তার হাতে বড় একটা স্টিলের গামলায় পাউডার পাফ—এর মতো ফুলকো লুচির স্তূপ। মলয়া বাটিটা থালা থেকে নামিয়ে টেবলে রেখে সত্যশেখরের থালায় সাজিয়ে রাখল দশটি লুচি আর কলাবতীর থালায় চারটি।

পুরো আয়োজনটা ওরা দু’জন নির্বাক হয়ে বিস্ফারিত চোখে শুধু দেখে যাচ্ছিল। মলয়া নির্বিকার নিশ্চিত গলায় বলল, ”নাও, শুরু করো। ভেতরে গিয়ে বেসিনে হাত ধুয়ে এসো।”

”বড়দি, এসব কী! এর নাম জলখাবার?” কলাবতী রুদ্ধশ্বাসে বলল। আড়চোখে দেখল কাকার নাকের পাটা ফুলে রয়েছে। সত্যশেখর তখন চোখ বন্ধ করে শুঁকছে গরম মশলা আর গাওয়া ঘিয়ের গন্ধ।

”জলখাবারই তো, সামান্য ক’টা লুচি আর… নাও নাও হাত ধুয়ে এসো।”

হরিশঙ্কর বললেন, ”জলজিরা কী আর এমনি এমনি দিয়েছে মলু। এতক্ষণে সতুর পেটে নিশ্চয় অ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে। মলু প্রভাকে বল, ডজন দুয়েক বেলে রাখতে।”

কলাবতী পা দিয়ে কাকার পায়ের উপর চাপ দিল, অর্থাৎ এখন কী করব।

”মলু, এত খাবার রাতেও আমরা খাই না।” সত্যশেখর গম্ভীর মুখে বলল, ”বাড়ি গিয়ে তো আমাদের আবার খেতে হবে। তুমি অর্ধেক তুলে নাও।”

বাড়ি গিয়ে আজ নাই বা খেলে! আমি জ্যাঠামশাইকে টেলিফোন করে বলে দিচ্ছি তোমরা আজ রাতে বাড়িতে খাবে না।” বলেই সে দরজার পাশে র‌্যাকের উপর রাখা টেলিফোনের দিকে এগিয়ে গেল।

সত্যশেখর এবার ভাইঝির পায়ের উপর পা রাখল যার অর্থ ঠিক আছে, মেনে নে। মুখে বিব্রত নিরুপায় ভাব ফুটিয়ে সে বলল, ”হরিকাকা, এ তো মহাবিপদে পড়লুম। আজ একমাস হল খাওয়া কমিয়েছি। রাতে দুটো মাত্র রুটি আলুছেঁচকি দিয়ে, আর দেখুন কীসব দিয়েছে। আমাকে বাঁচান।”

”বলো কী, তোমাকে বাঁচাব আমি! তবে কুড়িটা লুচি যদি খেতে পারো তা হলে আমি শর্ত বদলাব।” হরিশঙ্কর মজা করে বললেন।

”বদলাবেন মাত্র! প্রত্যাহার করবেন না?” সত্যশেখর এবার ঝাঁঝালো স্বরে বলল, ”আপনি কী করে ভাবলেন ট্রফিতে শুধু আপনারই নাম থাকবে আর আমরা সেটা মেনে নেব?”

”মেনো না। আমি তো মাথার দিব্যি দিইনি মানতে হবে বলে। ট্রফির কথা তো তোমরাই তুলেছ। তবে তোমরা একতরফা যদি ট্রফি দেওয়ার চেষ্টা করো তা হলে ম্যাচ জিতলেও সেটা আমরা নেব না।” হরিশঙ্কর দৃঢ় স্বরে বললেন।

কলাবতী উশখুশ করছিল কিছু বলার জন্য। এবার সে বলল, ”আচ্ছা, কারুরই নাম নয় যদি দুটো গ্রামের নাম শুধু লেখা হয়! যেমন আটঘরা ও বকদিঘির বাসিন্দাবৃন্দ কর্তৃক প্রদত্ত।”

”কালু, এ কী বাংলা!” টেলিফোন সেরে ফিরে এসেই মলয়া শুনল কলাবতীর বলা শেষ বাক্যটি। ”তুমি কি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ো যে বাসিন্দাবৃন্দ বলছ? বাসিন্দাদের দ্বারা বা অধিবাসীবৃন্দ কর্তৃক প্রদত্ত বলতে পারতে। তুমি এখনও কিন্তু হাত ধোওনি। এই খারাপ অভ্যাসটা কালু তোমার কাছ থেকে অন্তত আশা করি না।”

ধড়মড় করে প্রথমেই উঠে পড়ল সত্যশেখর। বেসিনের দিকে যেতে যেতে মলয়াকে শুনিয়ে গজগজ করল, ”হাত ধুই না তোমায় কে বলল?”

”কে আবার বলবে, বরাবরই দেখেছি নোংরা হাতে খাও।” চাপা গলার বলেই মলয়া হরিশঙ্করের দিকে তাকিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, শুনলে বাবা কালুর কথা! এই বয়সেই কি ম্যাচিওরড ওর চিন্তা, কোনও ব্যক্তির নামে নয়, দুটো গ্রামের লোককে সম্মান দিতে এই ট্রফি। ঠিক বলেছে।”

বড়দির কাছ থেকে এমন প্রশংসা শুনে কলাবতী প্রজাপতির মতো উড়ে ভিতরে গিয়ে বেসিনে কাকার পাশে দাঁড়াল।

”কালু, এটা খুব অন্যায় করলি। কাল রাতে বাবাই খাবার টেবলে বলেছিলেন, ব্যাপারটা শোভন হয় যদি দুটো গ্রামের মানুষ মিলিতভাবে এই ট্রফি দান করে। আর তুই কিনা কথাটা নিজের নামে চালিয়ে মলয়ার প্রশংসা নিলি।” ক্ষুব্ধ স্বরে সত্যশেখর ভাইঝিকে মৃদু ভর্ৎসনা করল।

”কাকা, হরিদাদুকে যদি বলতুম এটা রাজশেখর সিংহের মাথা থেকে বেরিয়েছে, তা হলে কি হরিদাদু প্রস্তাবটা এককথায় বাতিল করে দিতেন না?”

”কোথায় বাতিল করেছেন, এখনও তো এই নিয়ে কথাই বলেননি।”

”বড়দি যে বললেন ঠিক বলেছে।” কলাবতী অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, ”আর বড়দি ঠিক বললে হরিদাদুর সাধ্যি আছে সেটাকে বেঠিক করার?”

”তা বটে। এখন কুড়িটা লুচি খেয়ে হরিকাকাকে শর্ত বদলাতে রাজি করাতে হবে।”

”জলজিরা কাজ করেনি?” উদ্বিগ্নস্বরে বলল কলাবতী। ”আমার তো বেশ খিদে খিদে লাগছে।”

”আমারও লাগছে, দেখি কতটা পারি। গলদা একটাই দিয়েছে না রে?” তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে বলল সত্যশেখর।

ওরা ঘরে ফিরে আসতেই হরিশঙ্কর বলে উঠলেন, ”সতু, একটা তো ঠিক হয়েই গেল। কালুমার কথা তো ফেলে দিতে পারব না। কিন্তু ট্রফি তৈরির খরচ আমি দোব। তবে এই শর্ত প্রত্যাহার করব কি না সেটা নির্ভর করছে—” তিনি মলয়ার দিকে তাকালেন। ”ভাজতে শুরু করেছে?”

”আগে এগুলো শেষ করুক। প্রভা নজর রাখছে।” মলয়া চেয়ারে বসল।

কলাবতী লুচি ছিঁড়ে বেগুনভাজা থেকে খানিকটা নিয়ে মুখে দিল। সত্যশেখর একটা লুচির উপর একটা আস্ত ভাজা রেখে পাটিসাপটার মতো ভাঁজ করে আধখানা মুখে ঢুকিয়ে ছিঁড়ে চিবোতে চিবোতে বাকি আধখানাও ঢুকিয়ে দিল। চারটে বেগুনভাজা ও লুচি সে প্রায় তিন মিনিটে শেষ করল। কলাবতীকে দুটো বেগুনভাজা দেওয়া হয়েছে। সে দুটো লুচি দিয়ে একটা ভাজা খাওয়া শেষ করে বলল, ”বড়দি, বেগুনভাজা দিয়ে লুচি খেতে বেশ লাগে।”

”তাই বলে আর কিন্তু পাবে না।” হেডমিস্ট্রেস মলয়া বলল। ”ভাজাভুজি বেশি খেলে মোটা হয়ে যাবে।”

”আমারও কিন্তু খুব ভাল লাগে। স্কুল থেকে ফিরে বেগুনভাজা পরোটা না পেলে পেট তো ভরতই না, মনও ভরত না।” হরিশঙ্কর উৎসাহভরে বললেন, ”সতু, তোমার কেমন লাগে বেগুনভাজা?”

সত্যশেখর গলদা চিংড়িটা বাটি থেকে থালায় নামিয়ে মুড়োটা ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন করতে করতে বলল, ”একটা কাঁচলঙ্কা পেলে আরও ভাল লাগত।” বলে সে মলয়ার দিকে তাকাল।

”বুঝেছি।” বলেই মলয়া চেয়ার থেকে উঠে ভিতরে চলে গেল। চিংড়ি দিয়ে সত্যশেখর ফুলকপি সহযোগে ছ’টা লুচি শেষ করেছে তখন মলয়া আরও চারটি বেগুনভাজা কড়াই থেকে নামিয়ে এনে ঘরে ঢুকল, সঙ্গে দুটি কড়ে আঙুলের মাপের কাঁচালঙ্কা।

”সতু ভীষণ গরম, একটু ঠাণ্ডা হতে দাও। ওমা! তোমার পাতে তো লুচি নেই! প্রভা, প্রভা।” ব্যস্ত হয়ে মলয়া ডাকাডাকি শুরু করতেই সঙ্গে সঙ্গে প্রভা গামলা হাতে ঢুকল। ততে স্তূপাকার লুচি।

মলয়া বলল, ”ওটা টেবলে রাখ, সতু তুমি লুচি নিজের হাতে তুলে নাও। ক’টা দিয়েছ?”

প্রভা বলল, ”তেরোটা। আর ভাজব?”

”নিশ্চয় ভাজবে।” হরিশঙ্কর বললেন, ”শুধু সতু নাকি, কালুও তো রয়েছে। সিংহের আহার কি এই ক’টা লুচি দিয়ে সারা হয়?”

গম্ভীর হয়ে গেল সত্যশেখর। লুচির উপর বেগুনভাজা রেখে মুড়ল এবং মুখে তোলার আগে বলল, ”ঠিক বলেছেন হরিকাকা, সিংহিরা একটু বেশিই খায়, যদি পরিবেশনটা একটু দরাজ হয়। মলু, চিংড়ি কি একটাই রান্না হয়েছে?”

”সে কী, একটা হবে কেন!” মলয়া ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। সে আর কিছু বলার আগেই প্রভা ঘরে এল হাতে একটা জামবাটি নিয়ে। তাতে আলু—কপির মধ্যে শুয়ে আছে দুটি গলদা।

”হরিকাকা কুড়িটা লুচি খেলে শর্ত বদলাবেন বলেছেন। কুড়িটা যদি খাই তা হলে শর্ত তুলে নিতে হবে, মানে প্রত্যাহার করতে হবে। এই কথা না পেলে আমি আর লুচি ছোঁব না।” বলেই সত্যশেখর থালা থেকে হাত তুলে নিল।

”এ আবার কী কথা।” মলয়া বিপন্ন মুখে বলল, ”আমি নিজে বাজারে গিয়ে মাছ কিনেছি, নিজে হাতে রেঁধেছি। আর এখন বলছ খাব না!” বাষ্পরুদ্ধ গলায় কথাগুলো বলে সে করুণ চোখে বাবার দিকে তাকাল।

হরিশঙ্করের মুখ থমথমে হয়ে গেল। ”সতু এটা কিন্তু ব্ল্যাকমেলিং। ঠিক আছে, ট্রফির গায়ে আমার নাম থাকবে না আর—।”

কলাবতী বলল, ”আর ট্রফি তৈরির খরচটা দুই দাদু ভাগাভাগি করে দেবেন।”

মলয়ার চোখ উজ্বল হয়ে উঠল। উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ”দেখলে বাবা কালু কত বুদ্ধিমতী। কী সুন্দর সমাধান করে দিল। সতু এবার কিন্তু ছোঁব না বললে সত্যিসত্যিই থালাবাটি সব তুলে নিয়ে যাব। শুরু করো।” মলয়ার আঙুল বেগুনভাজার দিকে তোলা।

”থালাবাটি তুলে নেওয়ার হুমকিটাও ব্ল্যাকমেইলিং।” বলেই সত্যশেখর বেগুনভাজার লুচিসাপটা মুখে ঢুকিয়ে কাঁচালঙ্কা দাঁতে কাটল।

অতঃপর ঘরের সবাই অবাক চোখে দেখল, গামলার লুচির সঙ্গে বেগুনভাজা কপি আলু কড়াইশুঁটি এবং দুটি গলদার দ্রুত অদৃশ্য হওয়া। প্রভা একটি থালায় আর একপ্রস্থ লুচি এনে গামলায় ঢেলে দিয়ে গেল।”

”কাকা, পারবে?” কলাবতী ভীতস্বরে বলল।

সত্যশেখর ভাইঝির দিকে তাকিয়ে বলল, ”হরিকাকাকে সিংহের আহার দেখাতে হবে না? তুই হাত চালা।”

”আমি আর খেতে পারব না।” কলাবতী হাত গুটিয়ে নিল।

মলয়া বলল, ”সতু এখনও রান্নাকরা দুটো মাছ আছে। লুচিগুলোর সদগতি করে দাও।”

”মুখ মেরে দিয়েছে আর মাছ নয়, চিনি দাও। গরম লুচি চিনি দিয়ে খেতে দারুণ লাগে।”

প্রভা তখন মলয়াকে বলল, ”দিদিমণি, বকদিঘির নলেন গুড় তো রয়েছে। দাদাবাবু চিনি খাবেন কেন?”

”নলেন গুড়!” সত্যশেখর সোফা থেকে ছয় ইঞ্চি উঠে বসে পড়ল।

কলাবতী বলল, ”কাকা আঠারোটা হয়ে গেছে কিন্তু।”

তাই শুনে হরিশঙ্কর দু’হাত তুলে বললেন, ”দুটো এখনও বাকি তবু তার আগেই সব শর্ত প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। মেনে নিচ্ছি নাম হবে মিলেনিয়াম ট্রফি, তার গায়ে খোদাই থাকবে বকদিঘি ও আটঘরার, না কি আটঘরার ও বকদিঘির, কাদের গ্রামের নাম আগে থাকবে তাই নিয়ে তো পতু আর পটলের মধ্যে গজকচ্ছপের যুদ্ধ বেধে যাবে।”

”দাদু, একটা কাজ করলে তো হয়। যুদ্ধু করার বদলে দুই গ্রামের বয়স্কদের সাক্ষী রেখে ওরা টস করে ঠিক করে নিক।”

”খুব ভাল সিদ্ধান্ত।” নলেন গুড়ের বাটিটা টেবলে নামিয়ে রাখার আগেই প্রভার হাত থেকে সত্যশেখর প্রায় ছোঁ মেরে তুলে নিতে নিতে বলল।

”দেখলে বাবা, কী ক্লিয়ার হেডেড মেয়ে কেমন প্রম্পট ডিসিশন নিল।” মলয়ার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেই সরু হয়ে গেল, ”সতু চুমুক দিয়ে খেয়ো না, লুচি দিয়ে খাও।”

”সব তো ঠিক হয়ে গেল, খরচটা আমি আর রাজু ভাগাভাগি করেই দোব।” হরিশঙ্কর যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। ”কালকেই পতুকে ফোন করে বলছি পটলের সঙ্গে কথা বলুক।”

মিনিট কুড়ি পর ওরা যখন গাড়িতে উঠছে, মলয়া কলাবতীকে ডেকে চুপিচুপি একটা শিশি তার হাতে দিয়ে বলল, ”এটায় ঝাল আরও বেশি।”

কলাবতী চটপট শিশিটা তার জিনসের পকেটে ঢুকিয়ে নিল। গাড়িতে যেতে যেতে সত্যশেখর বলল, ”গুনেছিলিস?”

”আঠাশটা।”

”আরও পারতুম। মুখুজ্যেদের দেখিয়ে দিতুম সিংহের আহার কাকে বলে! আসলে গুড়টা তো বকদিঘি থেকে পাঠিয়েছে। চেয়ে গেলে হরিকাকা রটাবে আটঘরার লোক চেয়ে চেয়ে বকদিঘির গুড় খেয়েছে। আমাদের খেজুর গাছ অনেক ভাল আটঘরার থেকে।”

”বড়দি দারুণ রান্না করে। ভেবেছিলুম তুমি চিংড়িটা আরও খাবে।”

”না, না, না, সব খেয়ে নিলে মলু আর হরিকাকা খাবে কী? অতবড় চিংড়ি বাড়িতে ক’টা আর রান্না হয়। আমরা তো আর নেমন্তন্ন খেতে যাইনি।”

বাড়ি পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমেই সত্যশেখর বলল, ”কালু, তোর প্যান্টের পকেটে উঁচুমতো ওটা কী রে? শিশি মনে হচ্ছে।”

”বড়দি টোম্যাটোর জেলি করেছেন, খানিকটা খেতে দিলেন। বললেন, মিষ্টিটা বেশি হয়ে গেছে।”

.

মোহিনী কালীমাতা আটঘরা ক্রিকেট অ্যাকাডেমি

দিনচারেক পর রাজশেখর টেলিফোন করলেন নন্তুকে। বাৎসরিক ম্যাচের জন্য যে সংগঠক সমিতি হয় নন্তু তার আহ্বায়ক, প্রধান পৃষ্ঠপোষক রাজশেখর, কার্যনিবাহী সভাপতি পটল হালদার এবং সচিব পরমেশ।

ফোন ধরেই নন্তুর প্রথম কথা, ”জ্যাঠামশাই, এইমাত্র আপনাকেই ফোন করতে যাচ্ছিলুম। পটলদা মাথা ঘুরে পড়ে গেছে, ডাক্তারবাবু দেখছেন, বলেছেন ভয়ের কিছু নেই। রাতটা রেস্ট পেলে ঠিক হয়ে যাবে, ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন।”

রাজশেখর উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, ”হল কী পটলের?”

”টসে হেরে গিয়ে প্রচণ্ড শক পেয়েছেন। ‘বকদিঘির নাম আগে থাকবে!’ এই বলেই ধড়াস করে পড়ে গেলেন।”

”টসটা হল কোথায়? কে টস করল?”

”আটঘরা—বকদিঘি গ্রামের সীমানায় কালভার্টের ওপর। দুই গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টারের সামনে একটা টাকা নিয়ে পটলদা টস করে, পতু মুখুজ্যে ডাকে হেড, আমাদের হেডমাস্টার জমি থেকে টাকা তুলে নিয়ে বললেন ‘হেড পড়েছে।’ আর শোনামাত্রই কথাটা বলে পটলদার মাথা ঘুরে গেল।

”যাক, ডাক্তার বলেছে ভয়ের কিছু নেই, এইটাই রক্ষে। আমাদের প্রিপারেশন কেমন হচ্ছে?”

”দারুণ উৎসাহ জ্যাঠামশাই। একদিন এসে দেখে যান না। আটঘরা স্কুলে অ্যাকাডেমির নেটে রোজ প্র্যাকটিস চলছে। ডাক্তারবাবু সঙ্গে নিয়ে আসেন ব্র্যাডম্যানের আর্ট অব ক্রিকেট বইটা, নেটের পাশে ওঁর চাকর বইয়ের পাতা খুলে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। উনি একটা বল খেলেন আর নেটের ধারে গিয়ে বইয়ের ছবি দেখেন, ছবি দেখে এসে আবার ব্যাট করেন। একদিন আমায় বললেন, ”তোমাকে ব্র্যাডম্যানের অফ ড্রাইভ দেখাব, রোববার বিকেলে এসো। এখন লেট কাটটা ধরেছি, দিন তিনেক লাগবে, খুবই রিস্কি ডেলিকেট শট। পৃথিবীতে এখন তিনচারজন মাত্র কনফিডেন্টলি লেটকাট করতে পারে। আমি জানতে চাইলুম সেই তিন—চারজন কে? উনি বললেন, সচিন, শ্রীনাথ, লারা। জ্যাঠামশাই রোববার আসুন না, লেটকাটের সঙ্গে অ্যাকাডেমির ছেলেদেরও দেখবেন।”

”পারি তো যাব।” রাজশেখর ফোন রাখলেন। রাতে খাওয়ার টেবলে তিনি পটলের টস করার ও মাথা ঘুরে পড়ার কথা বললেন। সত্যশেখর বলল, ”স্ট্রোক হয়নি এই যা রক্ষে।” কলাবতী বলল, ”মিলেনিয়াম ম্যাচে আটঘরা যদি হেরে যায় তা হলে অবধারিত স্ট্রোক হবে। কাকা, পটল হালদারকে বাঁচাতে মাচটা আমাদের জিততেই হবে। তুমি ফিটনেসটা বাড়াও।”

রাজশেখর বললেন, ”অপুর মা’র কী হল বল তো? দশদিন আগে ফোন করে বলল, অপুর পায়ের প্লাস্টার দু’দিন আগে কাটা হয়েছে। ছেলে চলাফেরা করতে শুরু করলেই ফিরে আসবে। প্লাস্টার নিশ্চয় কাটা হয়েছে, চলাফেরায় অসুবিধে হচ্ছে কি না কে জানে।” চিন্তিত মুখে তিনি রুটি ছিঁড়ে বাঁধাকপির তরকারি দিয়ে আবার খাওয়া শুরু করলেন।

সত্যশেখর বলল, ”মনে হচ্ছে চলাফেরায় অপুর হয়তো অসুবিধে হচ্ছে, হয়তো হাড় ঠিকমতো জোড়েনি। ভুবন ডাক্তার জুড়েছে তো।”

ভুবন ডাক্তারের কথায় রাজশেখরের মনে পড়ল স্কুলে অ্যাকাডেমির নেটের কথা। নন্তু বলল, রোববার আসুন না। তিনি একচুমুক জল খেয়ে বললেন, ”সতু রোববার চল একবার আটঘরায় যাই। ওখানে কীরকম তোড়জোড় করে প্র্যাকটিস হচ্ছে সেটা দেখা হবে, পটলের সঙ্গেও দেখা করে শরীরের খবর নেওয়া যাবে আর অপুর মা ফিরতে দেরি করছে কেন সেটাও জেনে নেওয়া যাবে।”

কলাবতী বলল, ”রান্নাঘর শকুন্তলাদির হাতে ছেড়ে দিয়ে পিসি এতদিন যখন বাড়িতে রয়েছে তা হলে নিশ্চয় সিরিয়াস কিছু হয়েছে। কাকা, রোববার তাড়াতাড়ি ভাত খেয়ে রওনা হলে দুপুরেই পৌঁছে যাব।”

ওরা আটঘরায় পৌঁছল দুপুর দেড়টা নাগাদ। প্রথমে গেল নিজেদের বাড়িতে। বাৎসরিক ম্যাচে কলকাতা থেকে বড়কত্তা তাঁর ছেলে আর নাতনি আসবে এই খবর আগেই জেনেছিল সিংহিদের বাড়ি ও সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক শচিন হালদার। ওরা যখন গাড়ি থেকে নামল শচিন তখন মালি ও চাকরকে দিয়ে বাগানের ঝোপঝাড় উপড়ে ফেলার কাজ তদারক করছিল। সে ছুটে গেল গাড়ির দিকে। রাজশেখরকে প্রণাম করে বলল, ”কোনও খবর না দিয়ে হঠাৎ চলে এলেন, স্নান খাওয়ার ব্যবস্থা করি। ওপরের শোয়ার ঘর গোছগাছ করে রাখা আছে।”

”কিছু দরকার নেই।” রাজশেখর হাত তুলে বললেন, ”বাড়িতে ঢুকবও না, খেয়ে এসেছি এখন কিছু খাব না। আমরা দু’—একটা জায়গা ঘুরে কলকাতায় ফিরে যাব। তুমি গাড়িতে ওঠো, পটলের বাড়িটা দেখিয়ে দাও।”

কলাবতী আর সত্যশেখর দাঁড়িয়ে বাড়ির দিকে তাকিয়ে। কলাবতী বলল, ”এতবড় বাড়ি, এত গাছ। কী শান্ত জায়গাটা। পাখি ডাকছে শুনতে পাচ্ছ কাকা?”

”ঘুঘুপাখি ডাকছে। কলকাতায় আমাদের বাড়ির বাগানে ছোটবেলায় বুলবুলি ঘুঘু আসত। এখন কাক শালিক চড়াই ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না।” সত্যশেখরের স্বরে বিষাদের ছোঁয়া লেগে।

রাজশেখর ডাকলেন, ”সতু, কালু আয়, আগে পটলকে দেখে আসি।”

কলাবতী বলল, ”দাদু, তোমরা যাও, আমি এখন পিসির বাড়ি যাব। সেখান থেকে স্কুলে অ্যাকাডেমির নেটে চলে যাব।”

আটঘরার ভুগোল কলাবতীর জানা। সে হাঁটতে শুরু করল। সিংহিবাড়ির গা ঘেঁষে সরু গলি দিয়ে বেরিয়ে সে কয়েকটা একতলা পাকাবাড়ি, ফণিমনসা আর আশশ্যাওড়া গাছে ভরা ছোট একটা পোড়ো জমি পেরিয়ে বিশাল অশ্বত্থ গাছের গুঁড়ির পাশে বিসর্জন দেওয়া রং ধুয়ে যাওয়া দুটি শীতলা মূর্তির সামনে দাঁড়াল। শীতলা গাধার পিঠে বসে। জন্তুজানোয়ার পাখি আমাদের দেবদেবীর বাহন কেন যে হল এটা তার কাছে হেঁয়ালির মতো লাগে। যমের বাহন মহিষ, শিবের ষাঁড়, গণেশের ইঁদুর, নিশ্চয় এর কারণ আছে। দাদুর কাছে জেনে নিতে হবে। আবার সে হাঁটতে শুরু করল, লালচে পানায় ঢাকা পুকুরের পাশ দিয়ে পথটা ঢালু হয়ে নেমে বেগুন খেতের ধার ঘেঁষে ঢুকেছে ময়রাপাড়ায়। পাঁচ—ছটা কলাগাছ গোছা হয়ে প্রথম মাটির বাড়ির বেড়ার ধারে, আর একটু এগিয়ে ছোট একটা বাঁশঝাড়, তার পাশ দিয়ে ভিতরদিকে ঢুকে গেছে একটা পথ। পথের শেষে অপুর মা’র ঘর। তার দু’পাশে ওর দাদাদের ঘর। ঘরগুলোর মাঝে মাটির উঠোন, উঠোনে দাঁড়িয়ে কলাবতী ডাকল, ”পিসি…পিসি।”

ঘরের দরজা খোলাই ছিল। হাতচারেক লম্বা সরু একটা বাঁশ দু’হাতে ধরে লাফ দিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এল তারই বয়সি কালোরঙের ছিপছিপে একটি ছেলে। বাঁ পায়ের গোছে ব্যান্ডেজ এবং চোখে বিস্ময়। কলাবতী একে আগে দেখেছে, বলল, ”অপু, তোমার মা কোথায়?”

”ঘরে শুয়ে, ম্যালেরিয়া হয়েছে, আজ নিয়ে পাঁচদিন।”

কলাবতী লাফিয়ে দাওয়ায় উঠে জুতো খুলে ঘরে ঢুকল। তক্তাপোশে কাঁথা মুড়ি দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে অপুর মা। বিছানায় বসে ঝুঁকে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কলাবতী বলল, ”পিসি, আমি কালু।”

অপুর মা সাড়া দিল না। কলাবতী এবার গলা চড়িয়ে বলল, ”তোমার কালুদিদি।”

কলাবতীর কথা যেন অসুস্থ মাথার মধ্যে একটু একটু করে ঢুকছে। সামান্য নড়ে উঠল অপুর মা’র দশাসই দেহটা। তারপর হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে বসল, ”কে কালুদিদি, তুমি এখানে।”

দু’হাতে অপুর মাকে জড়িয়ে ধরে কলাবতী বলল, ”আমাদের ফেলে রেখে এসেছ একমাসের ওপর, বেঁচে আছি কি না সে খোঁজটাও নাও না।”

”বালাই ষাট। এই তো ম্যালোরি ধরার আগে পরমেশ ঘোষের বাড়ি থেকে কত্তাবাবাকে ফোন করলুম। শকুন্তলা ঠিকঠাক রাঁধছে কি না, ছোটকত্তা পেটভরে খাচ্ছে কি না খোঁজ নিলুম। তুমি ইস্কুলে টিপিন নিয়ে রোজ যাচ্ছ কি না তাও জিজ্ঞেস করলুম। তারপরই কম্প দিয়ে জ্বর এল।”

”জ্বর এখন কত? ডাক্তার দেখাচ্ছ?” কলাবতী অপুর মা’র কপালে আঙুল রেখে তাপ বোঝার চেষ্টা করে বলল, ”জ্বর তো বেশি নয় দেখছি।”

অপু বলল, ”সকালে দেখেছি একশো ছিল।”

”কাকে দেখিয়েছ, ভুবন ডাক্তার?”

”হ্যাঁ। উনি ম্যালেরিয়া আর পেটের রোগের চিকিৎসায় ধন্বন্তরি।”

অপু বলল, ”ওনার ডাক্তারখানায় দূর—দূর থেকে আসা রুগির ভিড় লেগেই আছে। ওনার ওষুধ খেয়েই তো মা’র জ্বর পরশু একশো তিন থেকে একশোয় নেমে আসে। তারপর অবশ্য আর নামেনি।”

”তোমার পা কি উনি সেট করেছেন?”

”না, না, ভুবন ডাক্তার হাড়গোড়ের কিচ্ছু জানে না।” অপুর মা’র শ্রান্ত মন ও শরীর হঠাৎই যেন তেজ ফিরে পেল। ”বকদিঘির ছোকরা ডাক্তার অমল বিশ্বাসের কাছে নিয়ে যাই সাইকেল রিসকা করে। তিনি পায়ের ছবি তোলাতে বললেন, সেই তারকেশ্বরে নিয়ে গিয়ে ছবি তোলালুম। হ্যাঁ রে অপু, কী যেন ছবির নাম?”

”এক্স—রে”। অপু বলল।

”তাই দেখে উনি বললেন, ভালই চিড় ধরে গেছে, বিছানায় দু’হপ্তা শুয়ে থাক, হাঁটাচলা করতে হলে হাঁটবে খুব কম। এই বলে তো পেলাসটার করে দিলেন।” অপুর মা নিজের অসুখের কথা ভুলে অপুর কথা বলতে বলতে হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় জিজ্ঞেস করল, ”গাড়িতে এসেছ? কত্তাবাবা আর ছোটকত্তা কোথায়?”

”ওরা পটল হালদারের বাড়ি গেছে। তারপর স্কুলে যাবে। সেখানে প্র্যাকটিস হচ্ছে। আর ক’দিন পরেই তো এখানে বকদিঘির সঙ্গে আমাদের খেলা। তার আগেই কিন্তু তোমাকে অসুখ থেকে সেরে উঠতে হবে। মাঠে গিয়ে খেলা দেখবে তারপর আমাদের সঙ্গেই গাড়ি করে কলকাতায় যাবে। ততদিনে অপু নিশ্চয় হাঁটাহাঁটি করতে পারবে, তাই না অপু?” কলাবতী তার সাজানো দাঁতের ঝলসানি দিয়ে হাসল। পালটা হেসে অপু মাথা নাড়ল।

অপুর মা হতাশ স্বরে বলল, ”তুমি কত দিন পরে এলে অথচ ঘরে খেতে দেওয়ার মতো কিছু নেই।”

”পিসি, আমারও তো উচিত ছিল হাতে করে কিছু আনা। তুমি খাচ্ছ কী?”

”আর খাওয়া, ভুবন ডাক্তার বলেছিল বিস্কুট আর বার্লি খেতে। খেতে পারলুম না। মুখে অরুচি।”

”আমি উঠি পিসি, দাদু আর কাকা অপেক্ষা করবেন। খেলার দিন মাঠে আবার তা হলে দেখা হচ্ছে। ওষুধ ঠিকমতো খেয়ো। তুমি তৈরি থেকো, কলকাতায় ওইদিনই নিয়ে যাব। শকুন্তলাদি রান্নাঘরটার যা অবস্থা করে রেখেছে।” বলে কলাবতী মনে মনে হাসল।

অপুর মা বিরক্ত স্বরে বলল, ”আনাজের খোসা মাছের আঁশ মেঝেয় ছড়িয়ে রাখে তো? ফিজ খুলে ফিজের দরজা বন্ধ করতে ভুলে যায় আমি জানি। রান্নাঘর দু’বেলা কান্তির মাকে দিয়ে মোছায় না সেটাও আমি এখান থেকে টের পাই।” অপুর মা তার রান্নাঘরের দুর্দশার কথা ভেবে বিষণ্ণ হয়ে পড়ল। তারপরই মনে পড়ল কথাটা, ”কত্তাবাবাকে বোলো আমি অপুর মাথায় তারকনাথকে পুজো দেওয়া ফুল ছুঁইয়েছি, চন্নমেত্তর খাওয়াইনি। মনে করে বোলো কিন্তু।”

এখন অপুর মাকে দেখে কলাবতী একশো ডিগ্রি ম্যালেরিয়া জ্বরের চিহ্নমাত্রও খুঁজে পাচ্ছে না। ঘর থেকে সে বেরিয়ে আসছে, অপু তার সঙ্গ নিল। ওর বাঁশ আঁকড়ে লাফিয়ে চলা দেখে কলাবতী বারণ করল। ”তোমাকে আর সঙ্গে আসতে হবে না। পা—টাকে রেস্ট দাও।” বলেই সে অপুকে রেখে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল।

আটঘরা উচ্চচ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মূল ফটকের পাশে সীমানা পাঁচিলে এক হাত চওড়া ও দু’হাত লম্বা টিনের হলুদ বোর্ড সাঁটা। তাতে সবুজ অক্ষরে লেখা ”মোহিনী কালীমাতা আটঘরা ক্রিকেট অ্যাকাডেমি।” তার তলায় লেখা ”প্রতি শনি ও রবি। সকাল ও বৈকাল। অনুসন্ধান। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ভানু ঘোষাল।”

কলাবতী পৌঁছে দেখল একটি নেট খাটানো রয়েছে। জনা আষ্টেক ছেলে আর দু’—তিনজন বয়স্ক লোক নেটের আশেপাশে। ব্যাট করছে একটি ছেলে, বল করছে তিনজন। তাদের একজনকে সে চিনল, চণ্ডী কম্পাউণ্ডার। দু’বছর আগে কলাবতী এই ম্যাচ খেলতে এসে এদের অনেককেই দেখেছে। যেমন সে এখন চিনতে পারল বকু বোস আর রাজশেখরের পাশের চেয়ারে বসা ভুবন ডাক্তারকে। বোলিং ক্রিজে একটা স্টাম্পের পিছনে দাঁড়িয়ে বেঁটেখাটো সাদা ট্রাউজার্স আর সবুজ টি শার্ট পরা যে লোকটি প্রতিটি ডেলিভারির পর হাত নেড়ে ব্যাটসম্যানকে কিছু বলছে আর কাল্পনিক একটা ব্যাট দিয়ে খেলে দেখাচ্ছে, কলাবতী অনুমান করল ইনিই কোচ ভানু ঘোষাল।

রাজশেখরের চেয়ারের পিছনে গিয়ে কলাবতী নিচু স্বরে বলল, ”পিসির ম্যালোরি হয়েছে, এখন ভাল আছে, সেরে উঠছে।”

”ডাক্তারবাবু একে চেনেন কী? আমার নাতনি কালু, কলাবতী। সালোয়ার—কামিজ পরা, ছেলেদের মতো করে কাটা চুল, কাঁধের থেকে চামড়ার ব্যাগ ঝোলানো, টিকোলো নাক, শ্যামবর্ণ কিশোরীকে দেখিয়ে রাজশেখর হাসলেন। ভুবন ডাক্তার চোখ—মুখ কুঁচকে স্মৃতি হাতড়াতে শুরু করল।

”আগে দেখেছি কী?”

”দেখেছেন, তবে অন্যভাবে। যে ম্যাচটায় সতু সেঞ্চুরি করল সেই ম্যাচটার উইনিং স্ট্রোক দিয়েছিল কালু।”

”সে তো গোপি ঘোষের ছেলে!” ভুবন ডাক্তার হাঁ করে কলাবতীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কলাবতী তাড়াতাড়ি বলল, ”ডাক্তারবাবু, আপনার হাতের বইটা কীসের?”

”ক্রিকেটের বাইবেল, গত বছর কিনেছি। স্যার ডোনাল্ড জর্জ ব্র্যাডম্যানের—নাম শুনেছ তো?”

”না তো!” কলাবতী আকাশ থেকে যেন পড়ল।

ডাক্তার গদগদ কণ্ঠে বলল, ”বিরাট ব্যাটসম্যান, বিরাট বিরাট, বলে বোঝাতে পারব না। হাজার হাজার রান করেছেন। ওঁর লেখা এই বই, ক্রিকেট শেখার বই, এই বই পড়ে গাওস্কর, তেণ্ডুলকর, সৌরভ, রাহুল সবাই ব্যাট করা শিখেছে।”

”আপনিও শিখেছেন।” কলাবতী উৎসাহিত হয়ে বলল।

”নিশ্চয়। অফ ড্রাইভ অন ড্রাইভ কভার ড্রাইভ সব এই বই থেকে শিখেছি। লেট কাটটা বড় ভোগাচ্ছে, ঠিক কবজা করতে পারছি না।” বিব্রত স্বরে বলল ভুবন ডাক্তার।

”ডাক্তারবাবু ব্র্যাডমানের অফ ড্রাইভ দেখবেন বলেছিলেন, সেটা দেখান না।” নন্তু বলল, কখন যে সে চুপচাপ এসে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিল কেউ তা লক্ষ করেনি।

”তোমাকে দেখাব বলেছিলুম না? ছেলেটার ব্যাট করা হোক।” নেটে ব্যাট করছিল একটি ছেলে, ফরওয়ার্ড ডিফেন্সিভ খেলার তালিম নিচ্ছে। ভানু ঘোষাল এগিয়ে এসে ওর হাত থেকে ব্যাট নিয়ে নিজে ফরওয়ার্ড খেলে দেখিয়ে দিয়ে বলল, ”বলের পিচের কাছে সামনের পা নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটটা এইভাবে নামাবি, চোখ সবসময় বলের দিকে, মাথাটা নাড়ানাড়ি যেন না হয়। আবার খেল।”

ভুবন ডাক্তারের চেয়ারের পাশে জমিতে একটা আড়াই হাত লম্বা ক্যানভাসের ব্যাগ পড়ে ছিল। একটু দূরে ধুতি—শার্ট পরা শীর্ণ একটা লোককে ”ছিরু” বলে ডেকে হাতের বই চেয়ারে রেখে ডাক্তার আঙুল দিয়ে ব্যাগটা দেখিয়ে হাঁটতে শুরু করল। ছিরু ব্যাগটা তুলে নিয়ে অনুসরণ করল তার মনিবের। দু’জনে ঢুকে গেল স্কুলের এক তলার ঘরে। এটাই অ্যাকাডেমির ড্রেসিংরুম।

কলাবতী বলল, ”দাদু, কাকাকে দেখছি না যে?”

”আমাকে এখানে নামিয়ে দিয়ে বলল, আসছি। বলেই শচিনকে সঙ্গে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে কোথায় যে গেল।” রাজশেখর বিভ্রান্ত মুখে নাতনির দিকে তাকালেন।

নন্তু বলল, ”জ্যাঠামশাই, ছেলেদের উৎসাহটা দেখছেন। ওই যে ঢ্যাঙা ফরসা ছেলেটা রত্নাকর, রতু, ওকে টিমে নিয়েছি। ওয়ান ডাউন ব্যাট, আর বলটাও ভাল করে। ওর পাশে দাঁড়িয়ে অনিন্দ্য, ভাল ব্যাট। দু’জনেই ভাল ফিল্ড করে। আরও দু’জন নেব, তবে সেটা ভানুবাবুর সঙ্গে কথা বলে ঠিক করব। আপনি রতুর ব্যাট দেখবেন?”

”থাক এখন, তোমরা যখন বেছে নিয়েছ তখন নিশ্চয়ই ভাল। পুরনো লোকেরা কে কীরকম ফর্মে রয়েছে সেটা দেখব বলেই এসেছি। আমাদের উইকেটকিপার তো বকু বোস, তাকে তো দেখছি না, চণ্ডী তো রয়েছে দেখছি, ওকে একটু বলটা করতে বলো। থানার মেজোবাবুও তো নেই।”

”বকুদা ডাইভ দিয়ে কাল একটা ক্যাচ ধরতে গিয়ে কাঁধে চোট পেয়েছে। আজ সকালে দেখলুম সেঁক দিচ্ছে। বড়বাবু চুঁচড়োয় গেছেন, এস পি ডেকে পাঠিয়েছেন। থানা ফেলে রেখে মেজোবাবু আসতে পারছেন না। কালও এসেছিলেন, কিছুক্ষণ বলও করলেন।”

রাজশেখর জানতে চাইলেন, ”কেমন বল করে? তুমি তো বলেছিলে লেগস্পিনার।”

ঢোক গিলল নন্তু। এধার—ওধার তাকিয়ে মুখ নামিয়ে এনে বলল, ”অনিল কুম্বলের বল ওর থেকে বেশি ঘোরে।”

”তাতে কী হয়েছে। বলটা ঠিক জায়গায় রাখতে পারে তো?”

”যে কটা বল করলেন তার অর্ধেক পিচের মাঝখানে পড়ল। রতু সবক’টা পুল করল। বাকি অর্ধেক ফুলটস।”

রাজশেখর মাছি তাড়াবার মতো করে হাতটা নেড়ে বললেন, ”বাদ দিয়ে দাও।”

নন্তু সিঁটিয়ে গিয়ে বললে, ”মেজোবাবুকে? বড়বাবু হলে নয় কিছু একটা বলে বাদ দেওয়া যেত, মেজো সেজোবাবুদের বাদ দেওয়া যায় না, উনি বরং থাকুন। ধরে নিন আমরা দশজনে খেলছি। বকদিঘির টিমেও তো মেজোবাবুর মতো প্লেয়ার থাকবে।”

”খবর নিয়েছ?”

”নিয়েছি। বকদিঘি স্কুলের হেডমাস্টারের ছেলে রাহুল, লেখাপড়ায় খুব ভাল। মাধ্যমিকে ঊনচল্লিশ প্লেস পেয়েছিল, চশমার পাওয়ার মাইনাস নাইন, প্রায় অন্ধ। স্টেশনারি দোকানের অরুণাভ মিডিয়াম পেসার, পায়ের বুড়ো আঙুলে চোট, জুতো পরলে ব্যথা লাগে। খেলবে বলে সেটা চেপে রয়েছে। গদাই জানা ওর সঙ্গে পতু মুখুজ্যের ঝগড়া একটা নালা কাটা নিয়ে। গদাই ওদের একমাত্র উইকেটকিপার। ওকে তাতালে দু’—চারটে কাচ ছেড়ে দেবে।” নন্তু ফর্দ পড়ার মতো গড়গড়িয়ে বলে যাচ্ছিল। রাজশেখর হাত তুলে থামালেন।

স্কুলের ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে ভুবন ডাক্তার। কালো ট্রাউজার্স পরেছিলেন, এখন সেটা সাদা। নীল—কালো ডোরা দেওয়া বুশশার্ট পরেছিলেন, এখন সেটা সাদা। দু’পায়ে প্যাড, দু’হাতে গ্লাভস, হাতে ব্যাট। পাক্কা ক্রিকেটারের মতো দেখাচ্ছে।

চেয়ার থেকে বইটা তুলে রাজশেখরের হাতে দিয়ে ভুবন ডাক্তার বলল, ”শেখার কি কোনও বয়স আছে, চল্লিশ চলছে, দেখুন এখনও শিখে যাচ্ছি। ব্র্যাডম্যানের কভার না অফ কোন ড্রাইভটা দেখবেন? আচ্ছা আগে অফটা দেখুন, খুলুন, অফ ড্রাইভের পাতাটা খুলুন, ব্র্যাডম্যান ড্রাইভ করছে ছবিটা দেখুন আর আমারটা দেখুন, মিলিয়ে নেবেন।”

ভুবন ডাক্তার গম্ভীর মুখে নেটের দিকে এগোল। রাজশেখর হতভম্ব চোখে কলাবতীর দিকে তাকালেন। ঢোক গিলল কলাবতী। নন্তু মিটমিটিয়ে হাসছে। ডাক্তার ভানু ঘোষালের কাছে গিয়ে বলল, ”অফ ড্রাইভ করব।” তাই শুনে ভানু একট সাড়ে চার ফুট উচ্চচতার ছেলেকে ডেকে তার হাতে বল দিল। নেটে ব্যাট করছিল একটি ছেলে, সে নেট থেকে বেরিয়ে এল। ভুবন ডাক্তার গুড লেংথের কাছে গিয়ে ব্যাট দিয়ে মাটি কয়েকবার ঠুকে ক্রিজে এসে গার্ড নিতে ব্যাটটা লেগ স্ট্যাম্পের সামনে ধরে একটা আঙুল তুলে দেখাল ভানুকে। ঝুঁকে গভীর মনোযোগে দশ সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে ভানু আঙুল তুলে বলল, ”ইওর লেগ স্টাম্প।”

ভুবন ডাক্তার বলল, ”থ্যাঙ্ক ইউ।”

পুরো ব্যাপারটা দমবন্ধ করে কলাবতী দেখছিল আর মনে মনে ভাবছিল, আটঘরার ডাক্তার এসব শিখল কোত্থেকে। সাড়ে চার ফুটের ছেলেটি ছুটে এসে কোনওক্রমে বল ডেলিভারি করল। বলটা উঁচু হয়ে জমিতে পড়ার আগেই ভুবন ডাক্তার বাঁ পা এক গজ বাড়িয়ে ব্যাট তুলে ড্রাইভের জন্য তৈরি। বলটা পিচের মাঝামাঝি পড়ে তার বুকের কাছে উঠে আসছে দেখে ডাক্তার চাপড়ে বলটা জমিতে ফেলে দিয়ে বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ”ভানু, চেঞ্জ বোলার।”

পরের বোলার তার কম্পাউন্ডার চণ্ডী। এবারও ডাক্তার বল ডেলিভারির আগেই এক পা বাড়িয়ে ব্যাট পিছনে তুলে ড্রাইভের জন্য তৈরি। চণ্ডী একটু জোরে বল করে, বল প্রায়শই লেংথে পড়ে এবং উইকেট থেকে উইকেটে সোজা থাকে। তার এই বলটা পিচ পড়ে ডাক্তারের ব্র্যাডম্যানীয় অফ ড্রাইভ করতে যাওয়া ব্যাটের পাশ দিয়ে বেরিয়ে এসে অফ স্টাম্প ফেলে দিল।

ঠোঁট কামড়ে ভুবন ডাক্তার কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে রাজশেখরের দিকে তাকিয়ে বলল, ”লক্ষ করলেন বলটা জমি থেকে তিন ইঞ্চির বেশি উঠল না, স্কিড করে এল। বলটা ছেড়ে না দিলে এল বি ডবলু হয়ে যেতুম।”

রাজশেখর গম্ভীর মুখে বললেন, ”তিন ইঞ্চি কী, আমার তো মনে হল দেড় ইঞ্চি উঠেছিল। এরকম বলে ব্র্যাডম্যানও ড্রাইভ করতে পারতেন না, ছেড়ে দিয়ে ঠিক করেছেন।”

অফ স্টাম্পটা ব্যাটের হ্যান্ডেল দিয়ে ঠুকে বসিয়ে ভুবন ডাক্তার আবার স্টান্স নিল। এবার বল করল আর একটি ছেলে। ডেলিভারিটা কিঞ্চিৎ ওভারপিচ। ভুবন ডাক্তার যথারীতি পা বাড়িয়ে দিয়েছিল। বলটা কোথায় পড়ছে, না দেখেই সে সপাটে ব্যাট চালাল। বাটের কানায় লেগে লাট্টুর মতো ঘুরতে ঘুরতে বলটা ডাক্তারের মাথার উপর দিয়ে আট ফুট উঁচু নেট টপকে পিছনদিকে চলে গিয়ে দেওয়ালে খটাস করে লাগল।

”চার, ডাক্তারবাবু এটা নির্ঘাত চার।” কলাবতী হাততালি দিয়ে বলে উঠল।

রাজশেখর বললেন, ”অফ ড্রাইভ করে ব্যাডম্যানও তো চার রানই পেতেন, আপনিও তাই পেলেন। রান পাওয়ার জন্যই তো ব্যাট করা, আপনি বরং এই ব্যাক ড্রাইভটাই প্র্যাকটিস করুন। এটা অবশ্য এই বইয়ে নেই, তাতে কী হয়েছে। এটা তো নতুন জিনিস, আবিষ্কারও বলতে পারেন।”

খুশিতে ঝলমল করে উঠল ডাক্তারের মুখ, বলল, ”বলছেন নতুন জিনিস? এটা তা হলে এবার ম্যাচে ছাড়ব।”

”ছাড়ুন, তবে অল্প করে।” রাজশেখর গম্ভীর মুখে বললেন।

ডিসেম্বর মাসে বেলা তাড়াতাড়ি পড়ে আসে। সূর্যের আলো ম্লান হয়ে আসছে। নন্তু বলল, ”জ্যাঠামশাই, আরও কি দেখবেন?”

”না নন্তু, আর কিছু দেখার নেই। চারটে ছেলেকে তো দেখলুম, খুবই অল্প বয়স, তবে ফিল্ডিংটা উৎসাহ নিয়ে করে, ক্যাচট্যাচও মন্দ ধরল না। আর তো এগারো দিন বাকি রয়েছে, এর মধ্যে কতটুকু আর উন্নতি করবে! পটলকে বললুম তোমার সভা মিছিল পোস্টার পথ অবরোধ এসব বন্ধ করো। এই ম্যাচটা সংগ্রাম নয়—বাৎসরিক মিলনোৎসব, এই ভেবে তৈরি করো প্রীতির পরিবেশ। শুনে বেচারা কেমন যেন মনমরা হয়ে গেল। তবে দুটো স্তম্ভ গড়ার জেদ কিন্তু ছাড়ল না। একটা সতুর সেঞ্চুরির জন্য, অন্যটা আমাদের তিন পুরুষের একই ম্যাচ খেলার জন্য। এটা ছেলেমানুষি না পাগলামি, বুঝে উঠতে পারছি না। আচ্ছা নন্তু, এসব করে কি ও পঞ্চায়েত ইলেকশনে জিততে পারবে?”

নন্তু বলল, ”জ্যাঠামশাই, গ্রামের লোকের জীবনে রেষারেষি একটা গুরুতর ব্যাপার। আটঘরা বকদিঘির মধ্যে আকচাআকচি তো আমার ঠাকুর্দা বলতেন তাঁর জন্ম থেকে দেখে এসেছেন। এবার তো মিলেনিয়াম ম্যাচ, এই প্রথম উইনারকে ট্রফি দেওয়া হবে। বুঝতেই পারছেন, টেম্পারেচার চড়ে গেছে। ট্রেনে দুই গ্রামের ডেইলি প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে হাতাহাতিও হয়ে গেছে। পটলদা এখন থামাতে গেলেও থামাতে পারবে না।”

এই সময় সত্যশেখর এসে হাজির হল।

”বাবা, দেখলে অ্যাকাডেমি? কালু কেমন দেখলি, ট্যালেন্ট আছে বলে মনে হল?”

”ট্যালেন্ট!” কলাবতী চোখ কপালে তুলল। ”ব্র্যাডম্যানকে কি তুমি ট্যালেন্টেড বলবে?”

”জিনিয়াস বলব।”

”তা হলে আজ জিনিয়াসকে দেখলুম, তুমিও তাকে দেখবে ম্যাচের দিন।”

রাজশেখর বললেন, ”সতু, এতক্ষণ কোথায় ছিলিস?”

”এই কাছেই, বকদিঘিতে গেছলুম, ননী ঘোষের মাখা সন্দেশ, ছানা আর নলেন গুড় দিয়ে তৈরি, সেই ছোটবেলায় মুখুজ্যেদের বাড়িতে খেয়েছিলুম তারপর আর খাইনি। এদিকে এসেছি যখন, ভাবলুম যাই একবার মহামায়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে। ওরাই তো এর ইনভেন্টর।”

”সতু, তুই বকদিঘি গিয়ে মিষ্টি কিনলি? এ—খবর হরির কানে ঠিক পৌঁছে যাবে। তারপর প্রচার হবে আটঘরার সিংঘিরা নিজেদের ময়রার বাসি গন্ধওলা মিষ্টি না খেয়ে বকদিঘি থেকে টাটকা জিনিস কিনে খায়। এতে ইলেকশনে পটলের কত ক্ষতি হবে জানিস?” রাজশেখর রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে ধমক দিলেন ছেলেকে।

সত্যশেখর দু’হাত তুলে শান্ত হওয়ার জন্য আবেদনের ভঙ্গি করে বলল, ”আমাকে কেউ কিনতে দেখেনি। দোকানের অন্তত আড়াইশো গজ আগে গাড়ি রেখে টাকা দিয়ে সচিনকে কিনতে পাঠিয়েছি। সচিন তো আর সিংঘি নয়।”

কাছের এক চায়ের দোকান থেকে একটি ছেলে একটি কেটলি আর তিনটে কাপ হাতে নিয়ে হাজির হল। নন্তু কুণ্ঠিত স্বরে বলল, ”জ্যাঠামশাই, চা।”

”না, না, আমি খাব না। ওদের দাও।”

সত্যশেখর চায়ে চুমুক দিয়ে ভাইঝিকে নিচু গলায় বলল, ”এটা কী খাচ্ছি বল তো? তুই বলবি চা। আসলে একটা নতুন পানীয়।”

ফেরার জন্য মোটরে উঠেই রাজশেখর জিজ্ঞেস করলেন, ”কালু, তুই তো ভাল করে বললি না অপুর মা’র খবর। কলকাতায় আসবে কবে? ছেলের পা কি এখনও ঠিক হয়নি?”

”বলছি, বলছি, ভুবন ডাক্তারের ব্যাটিং দেখে কেমন যেন গুবলেট হয়ে গেল সবকিছু। পিসির ম্যালোরি হয়েছে। এখানকার ধন্বন্তরি ভুবন ডাক্তারের চিকিৎসায় রয়েছে, জ্বর কমেছে। শকুন্তলা নামের টনিক দিয়েছি, এবার হু হু করে জ্বর নেমে যাবে। বলেছি, ম্যাচের দিন তৈরি থেকো, নিয়ে যাব। অপু এখনও অল্প খোঁড়াচ্ছে, হাড় ভাঙেনি।”

সত্যশেখর বলল, ”ব্ল্যাড টেস্ট করিয়েছে?”

কলাবতী বলল, ”মনে তো হয় না এখানে ওসব টেস্ট করার ব্যবস্থা আছে, তা ছাড়া হুগলি জেলার সবাই জানে কম্প দিয়ে জ্বর এলে সেটা কী অসুখ। ভাল কথা, পিসি দাদুকে বলতে বলেছে অপুকে তারকনাথের চন্নামেত্তর খাওয়ায়নি, পুজোর ফুল শুধু কপালে ছুঁইয়েছে।”

রাজশেখর স্নেহের হাসি হেসে বললেন, ”মেয়েটা বড় ভাল। ছোটবেলায় ওর বাবা সাতকড়ি মোদক আটঘরায় ছিল আমার খেলার সঙ্গী।” কিছুক্ষণ পর রাজশেখর বললেন, ”সতু, মিলেনিয়াম কাপের নকশাটা হরিকে দেখিয়ে অ্যাপ্রুভ করিয়ে নিস, নইলে পরে ঝামেলা পাকাতে পারে।”

”আমি যাব না, কালুকে দিয়ে পাঠিয়ে দোব। ও কথাবার্তায় খুব ম্যাচিওরড, বুদ্ধিমতী, ক্লিয়ার হেডেড, আর যেন কী—কী বলল তোর বড়দি?” সত্যশেখর মুখ টিপে হেসে বলল। ”হরিদাদু পর্যন্ত যেতে হবে না, বড়দিকে দিয়ে অ্যাপ্রুভ করালেই হবে।”

বাড়ি পৌঁছে মহামায়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কাগজের বাক্স থেকে বেরোল এক কিলোগ্রাম মাখা সন্দেশ। রাজশেখর ও কলাবতী তার এক—তৃতীয়াংশ খেয়ে আর পারল না।

”কাকা, তোমার ছোটবেলার মাখা সন্দেশ আর এই জিনিসটা কি এক?”

”এক কী করে হবে! ননী ঘোষ তো কবেই মারা গেছে। এখন তো ওর ছেলে দোকান চালাচ্ছে। গ্রামের লোক বেশি মিষ্টি পছন্দ করে, তাই বেশি গুড় ঢেলেছে। সত্যিই রে বড্ড মিষ্টি, আমিও আর পারছি না।” সত্যশেখর প্রায় আধ কেজি খাওয়ার পর সন্দেশের বাক্সটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলল, ”মুরারির জন্য রইল।”

অঘ্রানের শেষ। সন্ধে থেকেই চেপে ঠাণ্ডা পড়েছে, উত্তুরে বাতাস বইছে। সত্যশেখর শীতকাতুরে। ফুলহাতা সোয়েটার পরে গরম কফির কাপ হাতে নিয়ে সে কলাবতীর ঘরের দরজায় টোকা দিল, ”কালু, আসতে পারি?”

”এসো!” বিছানায় কাত হয়ে কলাবতী বই পড়ছিল, উঠে বসল।

”কী বই পড়ছিস?” কলাবতীর খাটে বসে কফিতে চুমুক দিয়ে সত্যশেখর বলল।

”দাদুর কাছ থেকে আনলুম ব্র্যাডম্যানের আত্মজীবনী ফেয়ারওয়েল টু ক্রিকেট। পড়েছ।”

”কব্বে পড়েছি, তুই এখন পড়ছিস। ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা না থাকলে অমন ব্যাটিং সম্ভব নয়।”

”এটা যদি ভুবন ডাক্তার বুঝত!” কলাবতী আক্ষেপের স্বরে বলে মাথা নাড়ল।

”কালু, বড্ড শীত করছে রে। মলু সেদিন তোকে যে ঝাল আচারটা দিল সেটা কি শেষ করে ফেলেছিস? থাকলে একটু দিবি? বকদিঘির মিষ্টিটা খেয়ে কেমন গা গুলোচ্ছে।” করুণ স্বরে সত্যশেখর বলল।

”এক মিনিট বোসো,” কাকাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে কলাবতী, পড়ার টেবলের ড্রয়ার থেকে আচারের শিশি বার করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। দু’ মিনিট পর সে এক হাতে চামচে মশলামাখা আমের আচারের টুকরো, অন্য হাতে প্লেটে বরফের কিউব নিয়ে ফিরে এল।

সত্যশেখর আচার মুখে ঢুকিয়ে চোখ কুঁচকে চুষতে চুষতে বলল, ”জানিস কালু, এই ঝাল আচারটা খেলেই আমার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। ইচ্ছে করে পেটাই, যে সামনে পড়বে তাকেই আচ্ছাসে পেটাই।” বলতে বলতে সত্যশেখর ছুটল বেসিনের দিকে। মুখ ধুয়ে ফিরে এসে বরফের টুকরো জিভে রেখে বলল, ”আটঘরায় ব্যাট করতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু সন্দেশ কিনতে গিয়ে এত দেরি করে ফেললাম। তোর ব্যাটটা কোথায় রে?” সে ঘরের চারধারে চোখ বোলাল।

”ব্যাট দিয়ে কী করবে!” অবাক কলাবতী বলল।

”শ্যাডো প্র্যাকটিস করব।”

আলমারির পাশ থেকে ব্যাট এনে দিল কলাবতী। ব্যাট নিয়ে সত্যশেখর বেরিয়ে গাড়িবারান্দায় গেল। কিছুক্ষণ পর কলাবতীর কানে এল, ”হাই”, ”হুশশ,” ”ইয়া”, ”ওহহ” শব্দগুলো। কৌতূহলী হয়ে সে অন্ধকার বসার ঘরে এল। সেখান থেকে আলো—জ্বলা গাড়িবারান্দা দেখা যায়। দেখল কাকা একজায়গায় দাঁড়িয়ে মুখের সামনে থেকে মশা তাড়াবার মতো করে ব্যাট চালিয়ে বলে উঠল ”কড়াক ছয়।” আবার স্টান্স নিল। একটু ভেবে নিয়ে বাঁ পা বাড়িয়ে ব্যাট যতদূর সাধ্য পিছনে তুলে সবেগে নামিয়ে এনে সামনে তুলে বলে উঠল, ”আবার ছয়।” সত্যশেখর স্টান্স নিল আবার। এবার মারল স্কোয়্যার কাট ”কড়াক চার।” এবার সে একহাঁটু ভেঙে বসে সুইপ করতে গেল। টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে মেঝেয় গড়িয়ে পড়ল। কলাবতী তাই দেখে নিঃশব্দে নিজের ঘরে ফিরে গেল।

.

তিনদিন পর টিফিনের সময় কলাবতী হেডমিস্ট্রেসের ঘরে গেল মিলেনিয়াম ট্রফির নকশা নিয়ে। ”বড়দি, কাকা পাঠিয়ে দিল। আপনি অ্যাপ্রুভ করে দিন।”

”আমি কেন, বাবাকে গিয়ে দেখাও।”

”কাকা বলল, আপনি ঠিক আছে বললে হরিদাদু সেটা মেনে নেবেন।”

হেসে মলয়া নকশার নীচে ”অনুমোদিত” লিখে নাম সই করে বলল, ”রবিবার তোমরা আটঘরা গেছলে? তোমার কাকা বকদিঘিতে গিয়ে এক কিলো মাখা সন্দেশ কিনেছে, কেমন লাগল খেতে?”

কলাবতী অবাক হয়ে বলল, ”আপনি জানলেন কী করে?”

”রবিবার রাতেই পতু মুখুজ্যে বাবাকে ফোন করেছিল। এক সময় ভাল করত, এখন বিশ্রী সন্দেশ তৈরি করে মহামায়া। তোমার কাকা নিশ্চয় সিংহভাগটা খেয়েছে।” মলয়া টেবলে রাখা একটা চিঠির উপর ঝুঁকে পড়ল। কলাবতী বড়দির কথার জবাব না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

মিলেনিয়াম ম্যাচের দিনে আটঘরা

বড়দিনের দু’দিন আগে/সত্যশেখর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরল একটা পেস্টবোর্ডের বড় কার্টন মহাত্মা গান্ধি রোডের দোকান থেকে ডেলিভারি নিয়ে। দু’হাতে সেটা ধরে দোতলায় বসার ঘরে এসে টেবলে রেখে বলল, ”এই হল মিলেনিয়াম ট্রফি, কেমন হয়েছে দেখো।”

রাজশেখর টিভি—তে খবর শুনছিলেন, পাশে মেঝেয় বসে মুরারি। কলাবতীকে অঙ্ক করাতে ক্ষুদিরামবাবু আজ আসবেন না, তাই সে নিজের ঘরে টেবলে বসে হোমটাস্ক করছিল। সত্যশেখর কার্টনের ঢাকনা খুলতে খুলতে ”কালু, কালু” বলে ডাকল। ভিতরে রাখা কুচো কাগজের মধ্য থেকে দু’হাতে ট্রফিটা বার করে সে টেবলে রেখে বিজয়ীর মতো হাসিতে মুখ ভরিয়ে বাবার দিকে তাকাল।

উজ্জ্বল হয়ে উঠল রাজশেখরের চোখ। বললেন, ”বাহ, চমৎকার তো।”

”কাঠের ওপর রাখলে দু’ফুট।” রুপোর মতো ধবধবে ট্রফির গায়ে সন্তর্পণে হাত বুলিয়ে সত্যশেখর বলল।

”ছোটকত্তা, এটা কি রুপোর?” মুরারি জ্বলজ্বল চোখে তাকিয়ে ছোঁয়ার জন্য আঙুল বাড়িয়ে টেনে নিল।

”পেতলের ওপর রুপোর জল করা। রুপোর হলে পাঁচ হাজার টাকায় হত না।”

কলাবতী ঘর থেকে বেরিয়ে ট্রফিটা দেখে থমকে গিয়ে ”উইইআ” বলে চেঁচিয়ে উঠে ছুটে এসে কানের মতো দুটো হাতল ধরে ট্রফিটা তুলে মাথার উপর বসাল। উচ্ছল স্বরে বলল, ”কাকা, এটা যে একেবারে রঞ্জি ট্রফি!”

রাজশেখর বললেন, ”কালু, তুই রঞ্জি ট্রফি কি নিজের চোখে দেখেছিস? বছর দশেক আগে কোশেন্ট ফোশেন্ট কীসব অঙ্কটঙ্ক করে বাংলা জিতেছিল, তুই তখন অ্যাত্তোটুকু, ট্রফিটা চোখে দেখিসনি। আমি দেখেছিলুম স্বচক্ষে তখন স্কুলে পড়ি, বাবার সঙ্গে মাঠে গেছলুম। বাংলা সেবারই প্রথম রঞ্জি ট্রফি জেতে উনচল্লিশের ফেব্রুয়ারিতে সাদার্ন পাঞ্জাবকে হারিয়ে। আনন্দটা দারুণভাবে এনজয় করতে পারতুম যদি না বাংলার এগারোজনের মধ্যে চারজন মাত্র বাঙালি থাকত। সতু, আর তোকেও বলছি কালু, ঘরের ছেলেদের নিয়ে গড়া দল যখন লড়াই করে জেতে, তখন যে গভীর সুখ বুকের মধ্যে জমা হয়, ভাড়াটেদের দিয়ে জেতা ট্রফিতে তা হয় না। হরিকে এটাই বোঝাতে চেয়েছি।”

কলাবতী বলল, ”দাদু, রঞ্জি ট্রফির চেহারাটা ঠিক যেন এদেশি নয় মনে হচ্ছে।”

রাজশেখর বললেন, ”গ্রিসিয়ান আর্ন—এর ডিজাইনে তৈরি রঞ্জি ট্রফি। পাতিয়ালার মহারাজা টাকা দেন, তখনকার আমলের পাঁচশো পাউন্ড দিয়ে তৈরি সোনার ট্রফি। এখন এই রুপোর জল করা ট্রফির দামই পাঁচ হাজার টাকা! দিনকাল কীরকম বদলে গেছে দেখেছিস? তখন কি কেউ স্বপ্নেও ভেবেছিল মেয়েরা টেস্ট ক্রিকেট খেলবে!” রাজশেখর ঝুঁকে ট্রফির গায়ে খোদাই করা লেখা পড়তে লাগলেন।

সত্যশেখর বলল, ”কালু, যেভাবেই হোক ভাড়াটে প্লেয়ারদের হারাতেই হবে।”

”মাত্র দু’জন তো ভাড়াটে প্লেয়ার। কাকা, এটা ক্রিকেট, চণ্ডী কম্পাউন্ডারের একটা বল কি ভুবন ডাক্তারের এক ওভার ব্যাটিং ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে যেতে পারে।” কলাবতী বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলল, ”তা ছাড়া তুমি তো আছই।”

ট্রফিটা কার্টনের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে সত্যশেখর বলল, ”খেলার দিনই এটা সঙ্গে করে নিয়ে যাব। বাবা, তুমি পরমেশ কি নন্তুকে আজই ফোন করে নিশ্চিত থাকতে বলো। ভাল কথা, আমাদের ক্যাপ্টেন কে?”

”সেটা ম্যাচের আগে নন্তু পরমেশ ঠিক করবে।”

.

রাতে সত্যশেখর আচার চেয়ে নিয়ে খেয়ে ব্যাট হাতে গাড়িবারান্দায় যাওয়ার সময় বলল, ”আজই শেষ প্র্যাকটিস।”

কিছুক্ষণ পর কলাবতী শুনল, ”হুউউস”, ”কড়াত”, ”ফটাস।”

বড়দিনের সকালে ভারী জলখাবার খেয়ে ওরা তিনজন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। কলাবতী ও সত্যশেখর সাদা ট্রাউজার্স সাদা শার্ট এবং বুট পরেই গাড়িতে উঠেছে। যাতে আটঘরায় গিয়ে পোশাক পালটাতে না হয়। হিসেব করে দেখেছে সাড়ে দশটার মধ্যে পৌঁছতে পারবে। খেলা শুরু এগারোটায়। কলাবতী তার খেলার সরঞ্জাম, ব্যাট, প্যাড, ব্যাটিং গ্লাভস এবং উইকেটকিপিং গ্লাভস একটা কিট ব্যাগে ভরে সঙ্গে নিয়েছে। বকু বোসের কাঁধ ঠিক হয়েছে কি না সেটাও এখনও অজানা রয়েছে গেছে। দরকার হলে সে উইকেট কিপ করবে।

বাড়ি থেকে বেরনোর সময় সত্যশেখর বলেছিল, ”কালু, তোর ব্যাটটা দিয়ে ব্যাট করব।”

কলাবতী সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়, ”একদম নয়। শ্যাডো করা পর্যন্ত ঠিক আছে। ব্যাটটা ভাঙতে দেওয়ার কোন ইচ্ছে আমার নেই।”

শুনেই গোমড়া হয়ে যায় সত্যশেখরের মুখ। রাজশেখর বলেন, ”সতু, কমলালেবু বিক্রি হচ্ছে দেখলে একবার দাঁড় করাবি। আগের বার ডাব কিনে খেয়েছিলুম মনে আছে?”

শ্রীরামপুরে পৌঁছে জি টি রোডের ধারের দোকান থেকে ক্রিকেট বলের আকারের এক ডজন কমলা কিনল সত্যশেখর।

”কালু, খোসা ছাড়িয়ে খাওয়া আর গাড়ি চালানো একসঙ্গে হয় না, তুই ছাড়িয়ে দুটো দুটো করে কোয়া আমার মুখে দিয়ে দে।”

সিঙ্গুর পার হয়ে কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পর রাস্তা বন্ধ করে লাঠি—বাঁশ নিয়ে ভিড় আর তড়পানি দেখে গাড়ি থামিয়ে সত্যশেখর স্বগতোক্তি করল। ”পটল হালদারের পথ অবরোধ নয় তো?”

রাজশেখর বললেন, ”আটঘরা থেকে এতদূরে পটলের এসব করার ক্ষমতা নেই। অন্য কোনও ব্যাপার, নেমে দেখ, ঠিক সময়ে আমাদের পৌঁছতে হবে।”

মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে সত্যশেখর এগিয়ে গেল। ওর সাদা পোশাক ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ ভারিক্কি চেহারা দেখে ভিড়টা নিজেদের তড়পানি থামিয়ে অবাক ও বিভ্রান্ত হয়ে তাকিয়ে রইল।

জলদগম্ভীর স্বরে সে বলল, ”ব্যাপার কী? রাস্তা বন্ধ করেছ কেন? আমি জেলা জজ, তারকেশ্বর যাচ্ছি বাবার পুজো দিতে।” শোনামাত্র সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল ভিড়।

গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরা বয়স্ক একজন আঙুল তুলে ধুতিপরা এক প্রৌঢ়ের দিকে দেখাল, ”হুজুর, ওই হল অমর পাড়ুই, ওর ছাগল আমার খেতের মুলো, কপি পরপর দু’দিন মুড়িয়ে সাফ করেছে। আমি প্রতিবাদ করায় ও আমার বলদটাকে বেঁধে রেখেছে। বলদটা ফেরত নিতে গেলে বলেছে, ফেরত দেব না, যা করতে পারিস কর, পঞ্চায়েতে গিয়ে নালিশ কর। হুজুর, পঞ্চায়েত ওর হাতের মুঠোয়। আজ আমি বলদ ফিরিয়ে নিয়ে যাব বলে পাড়ার লোকজন নিয়ে যাই। পাড়ুই পাড়ার লোকেরা লাঠিসোটা নিয়ে আমাদের মারতে শুরু করে।”

গম্ভীর মুখে শুনে সত্যশেখর জিজ্ঞেস করল, ”তোমার নাম কী?”

”হান্নান শেখ। কলকাতায় ছুতোর মিস্তিরির কাজ করি।”

অমর পাড়ুই নামক লোকটি এবার মুখ খুলল, ”হুজুর, শেখ পাড়ার গোরু—ছাগল এসে আমাদের বাগান, খেতের আনাজপাতি ধ্বংস করে যায় নিয়মিত। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য আমরা এসব সহ্য করে গেছি। কিন্তু ব্যাপারটা এখন চরমে পৌঁছেছে। আপনি একটা বিহিত করুন।”

”সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি” শুনেই সত্যশেখর বুঝল অমর মিটিং—মিছিল করা লোক। সে বলল, ”এসব ব্যাপারের বিহিত রাস্তায় হয় না। কাল কোর্টে এসো, আমি তো সব দেখলুম মনে হচ্ছে সেকশান ওয়ান ফর্টিফোর জারি করতে হবে। সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘর্ষ আমার জেলায় আমি হতে দেব না। এখন পথ ছাড়ো। দেখো বাস লরি ট্রেকার রিকশা দাঁড়িয়ে গেছে। কাল অবশ্যই কোর্টে আসবে, আমি নিজে হেয়ারিং করব। যাওও।” হুঙ্কার দিয়ে সত্যশেখর কথা শেষ করে গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিল। ভিড় দু’ভাগ হয়ে সরে রাস্তা ছেড়ে দিল। সত্যশেখর নির্বিঘ্নে গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখল অমর ও হান্নান নমস্কার করছে।

”সতু কী বললি অতক্ষণ ধরে, ব্যাপারটা কী?”

সত্যশেখর সংক্ষেপে যা কথাবার্তা হয়েছে বলল, শুনে রাজশেকর অট্টহাস্য করলেন। কলাবতী লেবুর দুটো কোয়া কাকার মুখে ঢুকিয়ে দিল। সত্যশেখর বললে, ”গল্পটা তোর বড়দিকে বলিস, ও তো সবাইকে বলে বেড়ায় আমার বুদ্ধি নেই।”

”আরও বলেন, তোমার নাকি ফিটনেস নেই। আজ দেখিয়ে দিয়ো ফিটনেস কাকে বলে।”

তারকেশ্বর থেকে আটঘরার কাছাকাছি মসৃণভাবে তারা চলে গেল। মাইল দুয়েক আগে তারা সামান্য ভিড় পেল। ভ্যানরিকশায়, সাইকেলে, হেঁটে অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে, প্রৌঢ়, যুবক চলেছে আটঘরার দিকে।

”দাদু, সার বেঁধে এত লোক যাচ্ছে কোথায় বল তো?”

রাজশেখর সামনের সিটে সত্যশেখরের পাশে বসে। আঙুল তুলে রাস্তার উপর আড়াআড়ি টাঙানো একটা ফেস্টুন দেখালেন:

”মিলেনিয়াম ম্যাচ! মিলেনিয়াম ম্যাচ!!

সহস্রাব্দের শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট সংগ্রাম

আটঘরা বনাম বকদিঘি, তৎসহ মিলেনিয়াম মেলা

দলে দলে আসুন। আপনার প্রিয় আটঘরাকে সমর্থন করুন।”

রাজশেখর বললে, ”এবার বুঝেছিস।’

”বুঝেছি।” কলাবতী মজা পেয়ে জানলা দিয়ে তাকাল। রাস্তার ধারে একটা তালগাছের গায়ে লাল কালিতে বড় বড় অক্ষরে লেখা বিজ্ঞাপন:

সুলভে রসনার সেরা স্বাদ নিন। এই প্রথম

কলকাতার নামী হোয়াং হো চিনা রেস্টুরেন্ট আটঘরায়

পাবেন নানাবিধ চাউমিন

চিকেন! প্রণ! ভেজিটেবল!

কলাবতী বলল, ”কাকা, খাবে নাকি হোয়াং হো রেস্টুরেন্টের চাউমিন?”

”খাই আর দুঃখের নদীতে ভেসে যাই! রক্ষে করো।”

রাজশেখর বললেন, ”ছোটবেলায় রথের মেলা এখানে দেখেছি। এ তো দেখি সেইরকম ভিড়। সতু একটু দেখেশুনে চালা।”

আটঘরা গ্রামের চৌহদ্দিতে ঢোকামাত্র ঝকঝকে গাড়ি দেখে কিছু কিশোর ও তরুণ গাড়ির সামনে হাত তুলে দাঁড়াল।

সত্যশেখরকে একজন বলল, ”আপনি তো সতু সিংহি। সেবার সেঞ্চুরি করেছিলেন। আজও কিন্তু করা চাই।”

সঙ্গে সঙ্গে এক কিশোর বলল, ”না করলে কিন্তু এই গাড়ি এখানেই জ্বালিয়ে দোব।’

”নিশ্চয় করব, কোনটে চাই, সিঙ্গল না ডাবল?” স