- বইয়ের নামঃ রায়হান
- লেখকের নামঃ লুৎফর রহমান
- প্রকাশনাঃ জোনাকী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১-০৫. ডোবা থেকে এক বদনা পানি
প্রথম পরিচ্ছেদ
মা বলিলেন–“আমেনা, ডোবা থেকে এক বদনা পানি নিয়ে এস তো মা।”
আমেনা বদনা হাতে লইয়া ডোবায় পানি আনিতে গেল এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ফিরিয়া আসিল।
মা বলিলেন–“লক্ষ্মী মেয়ে–চাঁদ মেয়ে। আচ্ছা, ঘর থেকে লবণ আর মরিচ নিয়ে এস দেখি।”
আমেনা দৌড়াইয়া গিয়া ঘর হইতে মরিচ ও লবণ লইয়া আসিল। হাটের দিন খোরশেদ যে মাছ আনিয়াছিল তাহারি কয়েকখানা অবশিষ্ট ছিল। আমেনার মা ঠিক করিলেন বেগুন আর সেই মাছ রান্না হইবে।
ওমেদপুরে মজিদ মিঞার স্ত্রী আজ তিন বৎসর হইল বিধবা হইয়াছেন। মজিদ মিঞা যখন মারা যান তখন তার বিধবা পত্নী নফিসার এক ছেলে আর এক মেয়ে। মেয়ের নাম আমেনা। আমেনার বয়স এখন এগার–বড় লক্ষ্মী। শিক্ষার গুণে মেয়ে মার কথা অমান্য করতে জানে না।
পিতার মৃত্যুকালে খোরশেদের বয়স ছিল পনর। এখন তার বয়স আঠার হইয়াছে। ইংরেজি স্কুলে সেকেন্ড ক্লাসে পড়ে। উনুনে ফুঁ দিয়া নফিসা মেয়েকে আবার কহিলেন–তরকারি কখানা কুটে নাও তো মা!
আমেনা ঘাড় নাড়িয়া বেগুন কুটিতে বসিল। বেগুন কুটিতে কুটিতে আমেনা শিশুর সরলতায় জিজ্ঞাসা করিল–“ভাই কোথায় গিয়েছে, মা?”।
নফিসা বিরক্ত হইয়া কহিলেন–“জালেম, গিয়াছে আবদুল হামিদের কাছে। বইয়ের পড়া কোন্খানে তা নাকি তার মনে নাই। আবদুল হামিদের কাছে থেকে পড়া শুনে আসবে। স্কুল তো বাড়ি নয়, মাষ্টার মাও নয়, বোনও নয়। সেখানে তো আর দুরন্তপনা খাটে না। পড়া না করলে মাষ্টার বেত মারেন। সে ভয় তার আছে।”
মা যে পুত্রের উপর বিরক্ত ছিলেন সেটা মিথ্যা নয়। বাড়িতে তার দৌরাত্ম মাঝে মাঝে এত ভয়ানক হইত যে নাফিসাকে সেজন্য চোখের জল ফেলিতে হইত। ছোট বোন আমেনা দিনের মধ্যে অন্তত দুইবার ভাইয়ের হাতে কিল-চড় খাইত।
আমেনা কিল-চড় খাইয়াও ভাইয়ের উপর রাগিত না। খানিক কাঁদিয়া আবার সেই ভাইকে ভাই বলিয়া ডাক দিত। সেই ডাকে নির্ভরশীলতা কানায় কানায় মাখান।
পাড়ার ছেলেরা সেদিন সকালবেলায় ডোবায় বড়শি ফেলিয়া মাছ ধরিয়াছিল। আমেনা তাহা দেখিয়াছিল। যখন দুপুরবেলা, মা শুইয়াছিলেন, তখন সে চুপে-চুপে ভাইয়ের ছিপ লইয়া সেইখানে গেল। ইচ্ছা, সেও মাছ ধরিবে। বড়শিতে যে টোপ গাঁথিতে হয় তা সে জানে না। খালি বড়শি ফেলিয়া প্রায় ১৫ মিনিট অপেক্ষা করিয়াও যখন সে দেখিল মাছ ধরে না তখন সে বিরক্ত হইয়া বড়শি ফেলিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিল। বড়শি চুরি করিয়া যে কী বিপদে পড়িতে হইবে তা সে একটুও তখন ভাবে নাই।
ইহারই মধ্যে খোরশেদ আসিয়া উপস্থিত। সন্ধ্যাবেলা, খোরশেদ পড়িতে না বসিয়াই জিজ্ঞাসা করিল–“মা, ভাত হয়েছে?”
নফিসা কহিলেন–“পড়া না করেই ভাত বাবা? খানিক পড়–ইত্যবসরে মায়ে-ঝিয়ে রান্না করে নিয়ে আসি।”
“ভাত কোন্ দুপুরে খেয়েছি, তার পর বিকেলে দুটো মুড়ি ছাড়া আর কিছু খাই নাই। ক্ষুধাপেটে কি পড়া যায়?”
“খেলেই পড়া হয় না। খালি পেটে খুব পড়া হয়।”
“তুমি কচু বোঝ কি না? শাস্ত্রে বলে মেয়ে মানুষের বুদ্ধি নাই–সেটা কি আর মিছে কথা?”
এই কথা বলিয়া খোরশেদ পড়িতে বসিল। মা পুত্রের কথায় উত্তর দিলেন না।
ইংরেজি বইটা খুলিয়া দুই একবার রিডিং পড়িয়া সে দেখিল ইংরেজি বড় সুবিধা বোধ হইতেছে না। বইখানা বিরক্তির সহিত বন্ধ করিয়া সে গ্রামার খুলিয়া বসিল। গ্রামারের পড়া ছিল কারকের অধ্যায়। ক্রিয়া কাহাকে বলে তাই যে বুঝিল না কারকের সে কি বুঝিবে? বিরক্ত হইয়া গ্রামার ফেলিয়া বাংলা পাড়িতে গেল। তাহাও সে অধিকক্ষণ পড়িতে পারিল না।
সহসা তাহার ইচ্ছা হইল, বড়শির ছিপখানা ঠিকমতো আছে কিনা একবার দেখিয়া আসে। অতঃপর ঘর হইতে বাহির হইয়া অন্ধকারে সে ছিপ হাতড়াইতে লাগিল।
ছিপ সেখানে ছিল না। দুপুরে ছিপ লইয়া আমেনা মাছ ধরিতে গিয়াছিল। ফেরত আনিতে তাহার মনে ছিল না।
যথাস্থানে ছিল না দেখিয়া খোরশেদ চিৎকার করিয়া কহিল–“কে আমার ছিপ নিয়েছে রে?” রান্নাঘরে আমেনা তখন বাটনা বাটিতেছিল। ভাইয়ের গলার কঠিন আওয়াজ শুনিয়া সে নোড়া ফেলিয়া মুহূর্তের মধ্যে মাকে না বলিয়াই অন্ধকারে বাহির হইয়া গেল।
পাছ ফিরিয়া নাফিসা ঝাপির ভিতর মসলা খুঁজিতেছিলেন। ফিরিয়া দেখিলেন–মেয়ে বাটনা ফেরিয়া বাহিরে গিয়াছে।
“ও মা-আমেনা” বলিয়া তিনি ডাকিলেন।
আমেনা উত্তর দিল না।
নফিসা আবার ডাকলেন–“আমেনা!”
তবুও আমেনা উত্তর দিল না।
একটু শঙ্কিত হইয়া নফিসা উনুনে ভাত ফেলিয়া বাহিরে আসিলেন।
সহসা ডোবার ধার হইতে আমেনা আর্ত ও ভীতস্বরে চীৎকার করিয়া ডাকিল–মা, মা!
অত্যন্ত ভীত হইলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যেমন চিৎকার করে, আমেনা ভয়ে তেমনি করিয়া চিৎকার করিতেছিল। সেই সময়ে রাস্তা দিয়া রায়হান যাইতেছিলেন। রায়হান চিৎকার করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কী হয়েছে? কী হয়েছে?
নফিসা প্রদীপ লইয়া বাহিরে দৌড়াইয়া গেলেন এবং দূর হইতেই ব্যগ্র আর্তস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী হয়েছে? কী হয়েছে?” ততক্ষণে রায়হান আমেনার স্বর লক্ষ্য করিয়া দৌড়াইয়া ডোবার ধারে আসিয়া ভীত অর্ধ-মূৰ্ছিতা আমেনার সিক্ত-শীতল দেহ কোলে লইয়া নফিসার দিকে আসিতেছিল।