- বইয়ের নামঃ কিশোর সাহিত্য সমগ্র ১ম খণ্ড
- লেখকের নামঃ মতি নন্দী
- প্রকাশনাঃ দীপ প্রকাশন (ভারত)
- বিভাগসমূহঃসমগ্র
স্ট্রাইকার
স্ট্রাইকার – মতি নন্দী – কিশোর উপন্যাস
।।১।।
কাল রাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি।
আমাদের গলিটা এঁকেবেঁকে তিনটে মোড় ঘুরে যেখানে বড় রাস্তায় পড়েছে, একটা বিরাট সাদা মোটর গাড়ি সেখানে এসে থামল। অত বড় গাড়ি আমাদের পাড়ার লোকেরা কখনও দ্যাখেনি। তাই তারা ভিড় করে গাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে নামল কুচকুচে কালো এক মধ্যবয়সী বিদেশি। মুখে চুরুট, চোখে কালো চশমা, গাড়ির রঙের মতনই পরনে সাদা কোট ও ট্রাউজারস। চুল কাঁচা—পাকায় মেশা।
ভিড়ের দিকে তাকিয়ে, বিদেশি হাত নেড়ে পোর্তুগিজ ভাষায় কী বলল। আমার পাড়ার লোকেরা বাংলা এবং একটুআধটু ইংরেজি, হিন্দি আর ওড়িয়া ছাড়া কোনও ভাষা বোঝে না। তারা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকল। বিদেশি আবার কথা বলল। কথার ভঙ্গিতে বোঝা যায়, কিছু একটা জানতে চাইছে বা খোঁজ করছে।
ভিড় থেকে নুটুদা এগিয়ে গেলেন, ”কেয়া মাঙতা, কী চাই?” তারপর মনে মনে কয়েকটা কথা তর্জমা করে বললেন, ”হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?”
এবার বিদেশি পরিষ্কার বাংলায় বলল, ”প্রসূন ভট্টাচার্য নামে একটি ছেলে কি এই রাস্তায় বাস করে?”
বিদেশির মুখে বাংলা শুনে ওরা থতমত হয়ে অবাক হল, ভরসাও পেল। সঙ্গে সঙ্গে কৌতূহলে ভনভন করে বলে উঠল—প্রসূন? প্রসূন! প্রসূন!! কী দরকার? কেন এসেছে লোকটা?
”প্রসূন, মানে অনিল ভটচাজের বড় ছেলে?”
”হ্যাঁ, তার সঙ্গে দেখা করতে চাই।” বিদেশি আশ্বস্ত হয়ে নুটুদাকে বলল। নুটুদা আমাদেরই পাশের ঘরের আর এক ভাড়াটে। ছাপাখানায় কমপোজিটরের কাজ করেন। বছর দুয়েক আগে ওঁর স্ত্রী মারা গেছেন। সংসারে একমাত্র মেয়ে নীলিমা ছাড়া আর কেউ নেই। মানুষটি অতি সরল, সাদামাটা। দোষের মধ্যে অযাচিত উপদেশ দেন; বারোয়ারি একটা কিছুর, রবীন্দ্রজয়ন্তী বা শীতলা পুজোর সুযোগ পেলেই চাঁদা তুলতে শুরু করেন। ছেলে—বুড়ো সবাই ওঁকে ‘নুটুদা’ বলে ডাকে। নীলিমা প্রায় আমারই বয়সী। ক্লাস টেন—এ পড়ে, সারাদিন পরিশ্রম করে ঘরে—বাইরে। ওর সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব।
নুটুদা সন্দিহান চোখে সেই বিদেশিকে বললেন, ”প্রসূনের সঙ্গে কেন দেখা করবেন?”
বিদেশির চুরুটটা নিভে গেছিল। লাইটার জ্বেলে সেটা ধরাতে ধরাতে বলল, ”আমি ব্রাজিল থেকে আসছি। স্যানটোস ফুটবল ক্লাবের নাম শুনেছেন বোধ হয়। আমি সেই ক্লাবের ম্যানেজার। প্রসূন যদি রাজি হয়, আমরা ওকে নেব।”
নুটুদা বললেন, ”নেবেন মানে?”
বিদেশি ব্যস্ত হয়ে বলল, ”এজন্য নিশ্চয়ই টাকা দেবে আমার ক্লাব। বছরে একবার বাড়ি আসার প্লেন ভাড়াও।”
”কত টাকা দেবেন শুনি?”
বিদেশি সতর্কভাবে বলল, ”সেটা ওর বাবার সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করব। প্রসূন তো এখনও নাবালক। আমরা সব খবর সংগ্রহ করেছি। ওর বয়স এখন সতেরো বছর চার মাস।”
নুটুদা বিদেশিকে নিয়ে আমাদের বাড়ির দিকে রওনা হলেন। পিছনে পাড়ার লোকের মিছিল। আমাদের বাড়িতে যেতে হলে আড়াই হাত চওড়া একটা মাটির গলিতে ঢুকতে হয়। একতলায় আমরা আর নুটুদারা ভাড়া থাকি দেড়খানা করে ঘর নিয়ে। দোতলায় থাকে বাড়িওয়ালা বিশ্বনাথ দত্ত। তার চার মেয়ে। দুজনের বিয়ে হয়ে গেছে।
বিশ্বনাথ বা বিশুবাবু বাড়ি থেকে তখন বের হচ্ছিলেন, হঠাৎ একজন বিদেশির পিছনে সারা পাড়ার লোককে গলিতে ঢুকতে দেখে ভড়কে গেলেন। তাড়াতাড়ি বাড়ির মধ্যে ঢুকে সেজো মেয়ে সোনামুখীকে পাঠিয়ে দিলেন। বিশুবাবুর পুলিশকে ভীষণ ভয়।
বাবা ঘরে চৌকিতে বসে দেয়ালে ঠেস দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। মা রান্নাঘরে। আমরা দুই ভাই এক বোন। আমার পর পিন্টু, তার পর পুতুল। নুটুদা বাড়িতে ঢুকেই ”অনিলবাবু! অনিলবাবু!” —বলে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে চেঁচাতে শুরু করলেন। বাবা গম্ভীর প্রকৃতির, অত্যন্ত কম কথা বলেন। অধিকাংশ দিন আমার সঙ্গে তো একটাও কথা হয় না। আমি ওঁকে এড়িয়ে চলি।
”অনিলবাবু, সন্তাোষ ক্লাবের ম্যানেজার এসেছে!” নুটুদা উত্তেজনায় হাঁফাচ্ছেন। ”জানেন তো, পেলে ওই ক্লাবের প্লেয়ার!”
”কে পেলে?’ বাবা ভারী গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন, ”কোথায় বাড়ি?”
নুটুদা থতমত হয়ে গেলেন। বিদেশি মৃদু হেসে এগিয়ে এসে বলল, ”স্যানটোস ক্লাব ব্রাজিলে। স্যানটোস খুব নামকরা বন্দর, সেখান থেকে কফি চালান যায় সারা পৃথিবীতে। আমাদের ক্লাব পৃথিবীর সেরা ক্লাবগুলোর একটা। পেলে পৃথিবীর সেরা ফুটবলার। অত বড় গুণী প্লেয়ার এখনও দেখা যায়নি।”
বাবা পিছনের ভিড়ের উপর আলতোভাবে চোখ বুলিয়ে বললেন, ”আমি ফুটবলের কোনও খবর রাখি না। আপনার কী প্রয়োজন, বলুন।”
”আপনার ছেলে প্রসূনকে আমাদের ক্লাবে খেলাতে চাই।”
”প্রসূনের সঙ্গে কথা বলুন। এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।” বাবা এই বলেই ঘরে ঢুকে গেলেন। বিদেশিও সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকল এবং পিছনে নুটুবাবু। বিশুবাবু ইতিমধ্যে পুলিশ নয় জেনে এগিয়ে এসে আমাদের ঘরের দরজায় দাঁড়ালেন।
বিদেশি বলল, ”প্রসূন নাবালক, ও তো কনট্রাক্ট সই করতে পারবে না, ওর অভিভাবক হিসেবে আপনাকেই তা করতে হবে।”
”না। আমি ফুটবল খেলার কোনও কিছুতে সই করব না। আমি ছেলের সর্বনাশ করে তার অভিশাপ কুড়োতে চাই না।”
নুটুদা ফিসফিস করে বিদেশিকে বললেন, ”অনিলবাবু এক সময়ে ফুটবল খেলতেন। কলকাতার সব থেকে বড় টিম ‘যুগের যাত্রী’—র দুর্ধর্ষ লেফট—ইন ছিলেন। তার পর রোভারস খেলতে গিয়ে বাঁ হাঁটুতে চোট লাগল, খেলা ছেড়ে দিলেন।”
”কে বলেছে খেলা ছেড়ে দিই?” বাবা হঠাৎ তীক্ষ্ন কর্কশ স্বরে বলে উঠলেন, ”খেলা আমি ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। সেই ইনজুরির কোনও চিকিৎসা হয়নি। আমার নিজের সাধ্য ছিল না, ক্লাবও ট্রিটমেন্ট—এর জন্য একটা পয়সা দেয়নি। ছেঁড়া কারটিলেজ নিয়ে আজও আমি চলছি। ক্লাব আমাকে সেই চোট নিয়েই জোর করে খেলাল। আই এফ এ শিল্ড ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে। খেলা ভাঙার তিন মিনিট আগে, তখনও গোললেস। ওপেন নেট গোল আমার সামনে, তাজ মহম্মদ মাটিতে, ব্যোমকেশ বোস ছুটে আসছে, ঘটক গোল ছেড়ে বেরোবে কি না ঠিক করতে পারছে না, সারা মাঠ আকাশ কাঁপিয়ে গোলের জন্য চিৎকার করে উঠেছে, আর মাত্র ছ’ গজ দূর থেকে আমি বাইরে মারলাম।”
উত্তেজিত হয়ে এত কথা বলে বাবা যেন লজ্জা পেলেন। মাথা নিচু করে বাঁ পা মেঝেতে ঘষড়ে ঘষড়ে তক্তপোশে গিয়ে বসলেন। তার পর ফ্যাকাশে হেসে মুখ তুলে বললেন, ‘আমি বলেছিলাম, পারব না, খেলতে পারব না। জোর করে আমায় খেলাল ইনজেকশান দিয়ে। বলেছিল, খেললে একটা চাকরি করে দেবে। আমি কিন্তু অনেক, সত্যিই অনেক চেষ্টা করেছিলাম গোলে মারতে।” বাবা চুপ করে যেতে যেতে অস্ফুটে বললেন, ”আমার সারা মুখে থুথু দিয়ে ওরা বলল, ঘুষ খেয়েছি। বাড়ি ফেরার সময় মেরে আমার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল।” বাবা অন্যমনস্কের মতো কপালের ঠিক মাঝে টিপের মতন কাটা দাগটায় আঙুল বোলালেন।
বিদেশি সহানুভূতির স্বরে বলল, ”পৃথিবীর সব জায়গায়ই ফুটবলারদের এই ভাগ্যই হয়।”
”কেন হবে?” বাবা জ্বলজ্বলে চোখে প্রশ্ন করলেন। ভয়ংকর রাগ আর ঘৃণা তাঁর চোখ থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে। ”আমি যখন হাঁটু চেপে মাটিতে গড়িয়ে পড়লাম—সবাই বলল, ভান করছি। ওরা একবার ভেবে দেখল না, যে লোকটা ছ’ গজ থেকে শট নিতে পারল না, সে এত দিন ২৫—৩০ গজ থেকে অনায়াসে গোল করেছে, সে দু’ বছর টপ স্কোরার হয়েছে লিগে! ওরা নিষ্ঠুরের মতো অপমান করল। অথচ শিল্ড উইনারের মেডেলের জন্য আমি কত দিন স্বপ্ন দেখেছি। আমার গোলে ক্লাব শিল্ড পাচ্ছে—”
বাবা চুপ করলেন।
”আমরা ভাল টাকা দেব। প্রথম সিজন—এ মাসে যা দেব, ভারতীয় মুদ্রায় তার মূল্য দু’ হাজার টাকা। সেকেন্ড টিমে আমরা এই রকমই দিই। খেলা দেখিয়ে ফার্স্ট টিমে এসে যদি ভাল খেলে—তবে মাইনে, বোনাস, বিজ্ঞাপন থেকে রোজগার সব মিলিয়ে বছরে দু’ লক্ষ টাকা তো পাবেই।”
তখন বিশুবাবু ‘অ্যাঁ’ বলে ঘরে ঢুকে এলেন। নুটুদা ফ্যালফ্যাল করে বিদেশির মুখের দিকে তাকিয়ে, কথা বলতে পারছেন না। দরজার বাইরে ভিড়টা সরব হয়ে উঠল।
”প্রসূনের এত এলেম, অ্যাঁ, ছোঁড়াটাকে দেখে তো কিছু বোঝা যায় না!” বিশুবাবু বললেন।
বাবা অরুণা গ্লাস ফ্যাকট্রিতে টাইম—কিপারের কাজ করেন, তিন মাসের ওপর লক আউট চলছে। পঁয়ত্রিশ টাকা ঘর ভাড়া কিন্তু বাবা এক মাসের জন্যও বাকি ফেলেননি। অসম্ভব আত্মসম্মানবোধ। বাড়িওয়ালা অপমান করবে এটা তাঁর কাছে অসহ্য ব্যাপার। মা’র কাছে শুনেছি একটা ওষুধের দোকানে কাজ করেন। প্রতিদিন দুপুরে বাবা কাজে বেরিয়ে যান। ফেরেন অনেক রাতে, তখন আমি ঘুমিয়ে থাকি।
”আপনি প্রসূনের সঙ্গেই কথা বলুন। গত কুড়ি বছর আমি ফুটবল মাঠে যাইনি। খবরের কাগজে খেলার পাতা পড়ি না। আমি এ ব্যাপারে হাঁ বা না, কোনও কথাই বলব না।”
”অনিলবাবু!” নুটুদা চাপা স্বরে মিনতি করলেন, ”লক্ষ টাকা পর্যন্ত রোজগার করবে প্রসূন। আপনি রাজার হালে থাকবেন।”
”ভাবা যায় না, অ্যাঁ, বলে লাথি মেরেই এত টাকা! লোকটা যা বলছে রাজি হয়ে যান মশাই, রাজি হয়ে যান।” বিশুবাবু বললেন।
”ফুটবলারের আত্মসম্মানবোধ আছে বিশুবাবু। আমি কোনও দিন প্রসূনকে ফুটবল খেলতে বলিনি। সে নিজের আগ্রহে খেলে। আমি কোনও দিন তার খেলা দেখিনি। ফুটবল সম্পর্কে কোনও কথা আমি শুনতে চাই না। আমার যা বলার বলে দিয়েছি।”
বিদেশি অনেক কথা বাবাকে বলল। বাবা শুধু ঘাড় হেঁট করে একগুঁয়ের মতো মাথা নেড়ে গেলেন। নুটুদা, বিশুবাবু বাবাকে বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। অবশেষে বিদেশি একটা কার্ড বাবার হাতে দিয়ে বলল, ”এতে আমার ঠিকানা লেখা আছে। আপনি চিন্তা করুন। তার পর আমাকে চিঠি দেবেন। পেলে রিটায়ার করবে শিগগিরই! আমরা সেই জায়গায় প্রসূনকে খেলাব বলে এখনই ওকে তৈরি করে নিতে চাই।”
বিদেশি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তার সঙ্গে সবাই। ফাঁকা ঘরে বাবা একা বসে। হাতে কার্ডটা। তার পর উঠে জানলায় এলেন। কার্ডটা কুচিকুচি করে জানলা দিয়ে ছুড়ে দিলেন উঠোনে। একরাশ শিউলিফুলের মতো কুচিগুলো ছড়িয়ে পড়ল। মা রান্নাঘর থেকে ছুটে গিয়ে কার্ড—এর টুকরোগুলো কুড়োতে শুরু করলেন, তাঁর পিছনে নীলিমা। কুড়োতে কুড়োতে নীলিমা আমার ঘরের জানলার কাছে এসে ফিসফিস করে ডাকল, ‘প্রসূন, এই প্রসূন! ওঠো, ওঠো, পাঁচটা যে বাজে।”
।।২।।
ধড়মড় করে উঠে বসলাম। জানলায় তাকিয়ে দেখি নীলিমা। ও বলল, ”ডেকে দিতে বলেছিলে না?”
আমাদের ঘড়ি নেই। নীলিমাকে কাল রাতে বলে রেখেছিলাম ভোর পাঁচটায় ডেকে দিতে। ওর স্কুল সকালে। খুব ভোরে উঠে জল তুলে, উনুন ধরিয়ে বাবার জন্য ভাত রেঁধে ও স্কুলে যায়। আজ সকালে শোভাবাজার ইউনিয়নের মাঠে আমি, নিমাই আর আনোয়ার ট্রায়াল দিতে যাব। হর্ষদা ইউনিয়নের কোচ বিপিন সিংহকে বলে রেখেছেন।
বিছানায় কিছুক্ষণ বসে স্বপ্নের কথা ভাবলাম। ভাবতে ভাবতে লজ্জা পেলাম। এ রকম অবাস্তব উদ্ভট স্বপ্ন যে কেন দেখতে গেলাম ভেবে অবাক লাগল। তবে স্বপ্নে অবাস্তব অকল্পনীয় ব্যাপারই ঘটে। পোর্তুগিজভাষী ব্রাজিলের লোক কিনা বাংলায় কথা বলছে! এমন না হলে আর স্বপ্ন বলা হয় কেন! কিন্তু শুনেছি অকারণে কেউ স্বপ্ন দেখে না; কোনও না কোনও সময়ে যা ভাবি বা মনে মনে পেতে বা হতে ইচ্ছে করে, সেটাই স্বপ্ন হয়ে ফুটে ওঠে।
তা হলে আমি কি পেলে হতে চাই? উফ কী সাহস আমার! ‘পে—এ—লে।’ নামটা খুব নরম স্বরে ফিসফিসিয়ে বার কয়েক উচ্চচারণ করলাম। ওর গল্প হর্ষদার কাছে বহুবার শুনেছি। হর্ষদা ভীষণ বই পড়েন আর খেলা দেখেন, জীবনে কখনও ফুটবল খেলেননি। আগে আমাদের পাড়ায় থাকতেন। ছোটবেলা থেকে আমায় চেনেন। হর্ষদাই প্রথম আমায় বলেন—’প্রসূন, তোমার মধ্যে ফুটবল খেলা আছে, মন দিয়ে খেলো, বড় হতে পারবে।’ কিন্তু পেলে হবার ইচ্ছেটা কখন যে মনের মধ্যে গজিয়ে উঠেছে, সেটা তো একদমই টের পাইনি। আমার ডান পায়ে প্রচণ্ড শট, কিন্তু বাঁ পা ভাল চলে না, বল নিখুঁতভাবে ট্র্যাপ করতে পারি না, হেড করার সময় চোখ বুজে কুঁকড়ে যাই। সবাই বলে বটে আমি খুব স্পিডি আর ভাল ড্রিবলও করতে পারি, কিন্তু সত্তর মিনিট খেলার দম আমার নেই। কখন ফাঁকা জমিতে গিয়ে বলের জন্য অপেক্ষা করব তাও জানি না।
আরও অনেক ঘাটতি আমার আছে অথচ, আমি কিনা পেলে—র জায়গায় খেলার স্বপ্ন দেখছি। আমি যে আস্ত গাড়োল, তাতে সন্দেহ নেই। নিজের ওপর খানিকটা রাগও হতে লাগল। স্বপ্নের কথা যদি নিমাইটা শোনে, তা হলে আমায় নিয়ে হাসাহাসি তো করবেই। দু’ লক্ষ টাকা বছরে! রীতিমতো মাথা খারাপ হলে তবেই এত টাকার কথা কল্পনা করা যায়।
কালও দুপুরে আমরা ছ’ খানার বেশি রুটি কেউ খাইনি, রাত্রে চারখানা। নাড়িভুঁড়ি জ্বলে যাচ্ছিল, তবু রাত্রে পুতুল আর পিন্টুকে আমার থেকে একখানা ছিঁড়ে দু’ ভাগ করে দিয়েছি। মাকে বলে রেখেছিলাম, আমার জন্য আজ সকালে দু’খানা রুটি যেন রেখে দেয়। আজ ট্রায়ালের দিন। একদম খালি পেটে মাঠে নামতে ভরসা হচ্ছে না, যদি ব্যথা খিমচে ধরে। মাকে অবশ্য ট্রায়ালের কথা বলেছি, আর জানে নীলিমাও।
আমার ঘরটা স্যাঁতসেঁতে আর দুপুরেও মনে হয় যেন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। অর্ধেক দেয়ালের বালি খসে গেছে, কড়িকাঠে উই, একমাত্র জানলাটার দুটো কপাটেরই কবজা ভাঙা। বৃষ্টি হলে বেশ অসুবিধা হয়। এই ঘরটাকে পুরো—ঘর কোনওভাবেই বলা যায় না। লম্বায় আট ফুট, চওড়ায় পাঁচ ফুট। আমি একা থাকি। একটা টুলও রাখার জায়গা নেই। দেয়ালে তাক আছে। আমার স্কুলের কয়েকটা বই সেখানে পড়ে আছে। দুটো প্যান্ট আর জামা দড়িতে ঝুলছে।
মা ঘরে ঢুকলেন। আমার মা’র মতন মা পৃথিবীতে আর দুটি আছে কি না জানি না। আমাদের এত কষ্টের সংসার, মাঝে মাঝে মাথা খারাপ হয়ে যায় ক্ষিধেয়, গরমে অপমানে আর হতাশায়। মা’র কিন্তু সব সময় হাসিমুখ। কম কথা বলেন। মিষ্টি মৃদু স্বর শুনলে মনে হয় দুঃখ বলে কোনও জিনিস পৃথিবীতে নেই। মা ঘরে ঢুকেই বললেন, ”খোকা, উঠে পড়েছিস! এখুনি বেরোবি?”
”হ্যাঁ। বাবা উঠেছে?” আমি ঘর থেকে বেরোবার সময় বললাম।
”না, গা—টা কেমন গরম গরম, জ্বর আসবে বোধ হয়। তোর জন্য রুটি রেখেছি।”
মা আমায় চারখানা রুটি দিলেন। আমার বরাবরই মনে হয়, সকলের থেকে মা আমাকেই বেশি ভালবাসেন। রাত্রে নিশ্চয় না খেয়ে আমার জন্য রুটি রেখে দিয়েছেন। অন্য সময় এই নিয়ে রাগারাগি শুরু করে দিতাম, আজ করলাম না। সাতটার মধ্যে মাঠে পৌঁছতে হবে। নিমাই আর আনোয়ার বটতলা বাস স্টপে আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে।
বেরোবার সময় মাকে হঠাৎ প্রণাম করলাম। ফার্স্ট ডিভিশন ক্লাবে খেলতে যাচ্ছি না, ট্রায়াল দিতে যাচ্ছি মাত্র। যদি বিপিন সিংহের পছন্দ হয়, তা হলে ময়দানের ঘেরা মাঠে খেলার সুযোগ আসবে। ফুটবল আমার কাছে রূপকথার একটা প্রাসাদ। যে আশা মনে মনে বহু দিন ধরে লালন করে আসছি, আজ তার দরজায় পৌঁছোতে যাচ্ছি মাত্র। যদি ঢুকতে পারি, তা হলে এক একটা তলা নীচে ফেলে উপরতলায় উঠবই, উঠতেই হবে। সে জন্য যত পরিশ্রম করা দরকার, করবই। মা আমাকে বুকে চেপে ধরে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালেন। তারপর বললেন, ”খোকা, মন দিয়ে চেষ্টা করবি।”
।।৩।।
কিট ব্যাগটা হাতে নিয়ে হনহনিয়ে যখন বটতলার দিকে যাচ্ছি, তখন মনের মধ্যে মা’র কথাটাই গুনগুন করছিল। মন দিয়ে কেন, প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করব, মা সারা জীবন কষ্টে কাটিয়েছেন, ওঁকে সুখী করবই। ফুটবলাররা চাকরি পায়, ক্লাব থেকে টাকাও পায়। আমি জানি শোভাবাজার ইউনিয়ন টাকা দেবে না, দেবার সামর্থ্যও নেই। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল বা যুগের যাত্রীতে আমাকে যেতেই হবে। যাবার প্রথম ধাপ শোভাবাজার। এক কী দু’বছরের মধ্যে চোখে পড়াতেই হবে আমার খেলা। খেলা দেখিয়েই বড় ক্লাবে যেতে চাই, তার পর একদিন ইন্ডিয়ার জারসি—ও পরব। টাকা আর খ্যাতি দুটোই আমার চাই, তবে এখন দরকার শেষেরটা।
নিমাই আর আনোয়ার বটতলায় দাঁড়িয়ে। আমি পৌঁছনো মাত্র আনোয়ার হাতঘড়িতে সময় দেখে বলল, ”সাড়ে ছ’টার মধ্যেই পৌঁছে যাব।”
আমরা তিনজনেই যে উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনার শিকার হয়েছি সেটা বোঝা গেল, কেউ আমরা কথা বলতে চাইলাম না। সব থেকে বেশি কথা বলে নিমাই। লোকের পিছনে লাগতে কিংবা কারুর ভঙ্গি বা গলার স্বর নকল করে হাসাতে নিমাই ওস্তাদ। আমাদের বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে শান্তিপল্লি নামে এক জবর—দখল কলোনিতে থাকে। বাবা নেই, দাদার কাপড়ের দোকান আছে হাতিবাগানে। নিমাই ক্লাস ফাইভে ফেল করার পর আর স্কুলে যায়নি।
বন্ধুদের মধ্যে অবস্থা ভাল আনোয়ারের। টকটকে রং, ছ’ ফুট লম্বা, ওজন পঁয়ষট্টি কেজি। একটা হোটেল আর দুটো বস্তির মালিক ওর বাবা। ধীর শান্ত প্রকৃতির আনোয়ারের খেলা তার ব্যবহার এবং জামা—প্যান্টের মতন পরিচ্ছন্ন। এখন পার্ট ওয়ান কমার্স—এর ছাত্র। আমার এবং নিমাইয়ের থেকে বছর তিনেকের বড়। আনোয়ার সঙ্গে থাকলে আমাদের পকেট থেকে একটা পয়সাও বার করতে হয় না। বলা বাহুল্য ওকে ছাড়া আমরা সিকি মাইলও চলি না।
বাসে আমরা শ্যামবাজার পর্যন্ত কেউ একটাও কথা বললাম না। আমার একবার শুধু মনে হয়েছিল, বাবাকেও প্রণাম করলে হত। কিন্তু মনের কোথায় যেন একটা চাপা অভিমান বাবার সম্পর্কে রয়ে গেছে। একদিনও আমাকে খেলার বিষয়ে একটা কথাও বলেননি, একবারও খোঁজ নেননি আমি কেমন খেলছি, আমার খেলা দেখতেও যাননি কখনও। ফুটবল সম্পর্কে বাবার তীব্র ঘৃণা আমি ওঁর ঔদাসীন্যের মধ্য দিয়েই বুঝতে পারি। মা মাঝে মাঝে বলতেন, ‘তোর বাবার কাছ থেকে জেনেটেনে নিস না!’ তারপর বলতেন ‘থাকগে।’ একবার শুধু কানে এসেছিল, মা’র কী একটা কথার জবাবে বাবা বললেন, ”ফুটবল আমাকে ফোঁপরা করে দিয়েছে, খোকাকেও দেবে। ওকে বারণ করো।”
শ্যামবাজার থেকে বাস বদল করে এসপ্লানেডে নামলাম ঠিক সওয়া ছটায়। শোভাবাজার টেন্ট—এ পৌঁছে দেখি জনা বারো ছেলে ড্রেস করায় ব্যস্ত। একজনকে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল, ”বিপিনদা আসবে সাতটায়। আমরা এখন রেড রোড দিয়ে সোজা গিয়ে ট্রাম লাইন পেরিয়ে, প্যারেড গ্রাউন্ডটাকে চক্কোর দেব। ফিরে এসে দেখব বিপিনদা অপেক্ষা করছে।”
ভেবে পেলাম না, এখন আমরা তিনজন কী করব। আনোয়ারই বলল, ”বসে থেকে কী করব, চল ওদের সঙ্গে দৌড়োই। বিপিনদা তাতে ইমপ্রেসড হবে।”
আমরাও ড্রেস করে ওদের সঙ্গে দৌড়ে যোগ দিলাম। মিনিট পাঁচেক দৌড়োবার পর, ওরা প্যারেড গ্রাউন্ডের দিকে না ঘুরে বাঁ দিকে এসপ্লানেড—মুখো হল। তার পর ময়দান হকার্স মারকেট—এ ঢুকে টিউবওয়েল থেকে জল নিয়ে জামায়, মুখে, পায়ে ছিটিয়ে আমাদের দিকে হাসল।
”দাঁড়িয়ে দেখছ কী, গায়ে জল লাগাও। ঘামে জবজব না করলে বিপিনদা খুশি হবে না, আবার ছোটাবে। এবার এখান থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে সোজা টেন্ট—এ।” ওদের মধ্যে সব থেকে বয়স্ক যে, আমাদের লক্ষ্য করে বলল।
”খবরদার বিপিনদাকে এ সব বলবে না। যদি ফাঁস করো, তা হলে”—গাঁট্টাগোট্টা একজন ভয়ংকর চোখে আমাদের তিনজনের দিকে তাকাল।
আমরা কোনও প্রশ্ন না করে ওদের মতন গায়ে মাথায় জল দিয়ে ‘ঘাম—জবজবে’ হয়ে নিলাম। যেহেতু নতুন, তাই একজন অনুগ্রহ করে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল, ”রোজ রোজ এতখানি করে একঘেয়ে দৌড় কি ভাল লাগে? দৌড়ের পরই পার্টি করে খেলা, তার পর পাতলা দু’পিস রুটি আর একটা ডিম। এক মাসেই তো টি বি ধরে যাবে! তাই খাটুনি কমাবার জন্যই এসব করি। বিপিনদা জানতে পারলে কিন্তু রক্ষে নেই, মাঠে দাঁড়িয়ে চোখের সামনে কুড়ি পাক দৌড় করাবে।” এই বলে সে হাসতে শুরু করল।
”আমরা তো আর চ্যামপিয়নশিপ ফাইট করতে যাব না, নেমেও যাব না, এখন তো রেলিগেশন প্রমোশন বন্ধ। তবে এত দৌড়োবার দরকারটা কী? অফিসের খেলা আছে, খেপের খেলা আছে, এত ধকল কি সামলানো যায়?” আর একজন এই বলে আমাদের যাবতীয় কৌতূহল মিটিয়ে দিল।
প্রথম দিনেই এই রকম রূঢ় ধাক্কায় গড়ের মাঠ সম্পর্কে মোহভঙ্গ হবে আশা করিনি। আমাদের টগবগে উৎসাহ এইখানেই খানিকটা থিতিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর ‘এইবার চল রে’ বলে ওরা টেন্ট—এর দিকে আবার দৌড় শুরু করল। আমরাও ওদের পিছু নিলাম।
বেঁটে, টাকমাথা এক প্রৌঢ় মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে। পায়ের কাছে গুটি—চারেক বল। হাফপ্যান্টটা হাঁটুর নীচে ঢলঢল করছে। ভুঁড়ি দেখে মনে হয় গেঞ্জির নীচে আর একটি বল রয়েছে। আমরা দৌড়ে এসে ওঁকে গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়ালাম। একজন পেটে হাত দিয়ে কুঁজো হয়ে হাঁফাতে লাগল, একজন শুয়ে পড়ল, আর একজন বলল, ”বিপিনদা যা খাটান, উফ আর পারা যায় না! এবার আমরা মরে যাব।”
বিপিনদার মুখ খুশিতে ঝকমক করে উঠল। কিন্তু যথাসম্ভব গম্ভীর হয়ে বললেন, ”কষ্ট না করলে কি কেষ্ট মেলে? বড় প্লেয়ার কি অমনি—অমনি হওয়া যায়? তোদের আর কী খাটাচ্ছি, আমরা খেলার দিন আড়াইশো ডন, পাঁচশো বৈঠক আর মাঠে চল্লিশ পাক দিয়ে গুনে গুনে একশো শট মেরে দু’ সের দুধ আর আধ সের বাদাম খেয়ে বাবুঘাটে চলে যেতুম। গঙ্গামাটি মেখে দু’ ঘণ্টা বসে থাকতুম। দুপুরে পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়ে মাঠে নামতুম।”
আমার পিছনে দাঁড়ানো সেই গাঁট্টাগোট্টা ছেলেটি চাপা স্বরে বলল, ”ফুটবল খেলত না কুস্তি করত?”
বিপিনদা বোধ হয় আঁচ করতে পেরেছেন যে, কেউ একজন মন্তব্য করেছে। তিনি আন্দাজে আমার দিকে তাকালেন। আমি কাঁটা হয়ে গেলাম।
”ইয়েস, কী যেন বললে?”
আমি রীতিমতো নারভাস হয়ে, কী বলব ভেবে পাচ্ছি না, তখন পিছন থেকে বলে উঠতে শুনলাম, ”আমি বলছিলুম যে বিপিনদাদের সময়ে মিলিটারিদের সঙ্গে খেলতে হত কিনা, তাই ট্রেনিং, খাওয়াদাওয়া ছিল মিলিটারি ধরনের। তাই শুনে এ বলল, ওইভাবে কুস্তি হয়, ফুটবল খেলা যায় না।”
চমকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখি গাঁট্টাগোট্টার তর্জনী আমার দিকে তোলা এবং মুখটি নির্বিকার সারল্যে ভরা। অনেকে মুখ টিপে হাসছে। আনোয়ার হঠাৎ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ”বাজে কথা, প্রসূন আগাগোড়া চুপ করে আছে। কুস্তির কথা তুমিই বলেছ, আমি পরিষ্কার শুনেছি।”
”কে বলেছে আমি বলেছি?” গাঁট্টাগোট্টা তেরিয়া হয়ে এক পা এগিয়ে এসেই কী ভেবে থমকে গেল। আনোয়ার তার হাফপাউন্ড পাঁউরুটির মতো বাইসেপ দুটো একবার শক্ত করেই আলগা করে দিল। বিপিনদা কিন্তু বেশ খুশি হয়েই বললেন, ‘কারেক্ট, কারেক্ট, ফুটবল খেলতে হলে কুস্তির কিছু কিছু প্যাঁচ জানা দরকার, বিশেষ করে লেঙ্গি মারা।” তার পর আমাদের তিনজনের দিকে লক্ষ করে বললেন, ”তোমরা হর্ষর কাছ থেকে এসেছ?”
আমরা ঘাড় নাড়লাম। উনি আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বললেন, ”যাও, ও ধারে গিয়ে শট করো। কত দূর মারতে পারো দেখি।”
।।৪।।
যাক, কিছু একটা দেখাবার মতো কাজ প্রথম দিনে পাওয়া গেল! আমি আর নিমাই এক দিকে আর ৬০/৬৫ গজ দূরে আনোয়ার। আনোয়ারের শটের জোর প্রচণ্ড। আনোয়ারের পেনালটি শট আটকাতে গিয়ে এক গোলকিপারের কবজি ভেঙে যায়। শুনেছি শৈলেন মান্নার শটে খুব জোর ছিল। আমি জোর দেখাবার বদলে কেরামতি দেখাতে লাগলাম। আউট সুইং করালাম, চিপ করলাম, ভলি আর সিজারিয়ান মারলাম, দু’—চারবার বাইসাইকেল কিক করার চেষ্টা করলাম, হল না। পেলের ছবি দেখে এটা নকল করার চেষ্টা করেছিলাম। পরে অবশ্য বুঝি, রীতিমতো জিমন্যাসটিকস না জানলে এই শট মারা যায় না। একজন দেখিয়ে দেবার লোকও চাই।
আনোয়ার বিরাট বিরাট শট করে যাচ্ছে। নিমাই কুড়িয়ে আনছে আর গাঁইগুঁই করছে, ”আমি যেন চাকর। কিছু হবে না … শুধু শট করতেই জানে… আমরা বাদ পড়ে যাব প্রসূন, বুঝলি!… আনোয়ারটার স্কিল বলতে তো ঘণ্টা, বিপিনদাকে বল না এবার একটু ট্র্যাপিং, হেডিং, ড্রিবলিং করে দেখাই।”
বিপিনদা অন্য ছেলেদের দিয়ে একই জিনিস করাচ্ছিলেন, লম্বা লম্বা শট। ওঁর কাছে গিয়ে বললাম, ”বিপিনদা, এবার একটু স্কিল প্র্যাকটিস করব?”
”স্কিল!” মনে হল বিপিনদা শব্দটা প্রথম শুনলেন। ”স্কিল? কী করবে তা দিয়ে?”
মাথা চুলকে বললাম, ”মানে, খেলতে গেলে স্কিল ছাড়া তো খেলা যাবে না।”
”শোভাবাজার ইউনিয়নে স্কিল?” বিপিনদার মুখ এমন হয়ে উঠল যেন দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে কাউকে জুতো পায়ে ঢুকতে দেখছেন। ”আঠাশটা ম্যাচ খেলে আমরা গতবার সাত পয়েন্ট পেয়েছি, তার আগের বছর পেয়েছিলাম পাঁচ পয়েন্ট। লিগের ওঠা—নামা ছিল না তাই রক্ষে। স্কিল লাগে যারা চ্যামপিয়নশিপ ফাইট করে—মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, যুগের যাত্রী এদের। আমরা ফাইট করি রেলিগেশন, নেমে যাওয়া আটকাতে। স্কিল দিয়ে আমাদের কী দরকার?”
”তা হলে এই যে লম্বা লম্বা কিক প্র্যাকটিস করাচ্ছেন!” আমি অতি বিনীতভাবেই তর্ক করার একটা ক্ষীণ চেষ্টা করলাম।
বিপিনদা একগাল হেসে বললেন, ”এই হচ্ছে পদ্ধতি, আমার পদ্ধতি। প্রেশারের মধ্যে সব ম্যাচ আমাদের খেলতে হবে। অপোনেন্ট—এর ন’জন আগাগোড়া আমাদের পেনালটি বক্স—এ থাকবে, তখন কী করবে?”
”ক্লিয়ার করব।”
”গুড! গুড! তোমার দেখছি ব্রেন আছে। কিন্তু কীভাবে ক্লিয়ার করবে?”
”কিক করে।”
”ভেএএরি গুড! সেই জন্যই এই লং কিকিং প্র্যাকটিস। এই একটা স্কিলই আমাদের বেশি কাজে লাগে। এর পর গোটা দুয়েক ট্যাকলিং শেখাব, যাও মন দিয়ে এখন বল মারো। তোমার সঙ্গে এসেছে ওই যে ছেলেটা, নাম কী?” বিপিনদা আঙুল তুললেন আনোয়ারের দিকে। নামটা শুনে বললেন, ”গুড প্লেয়ার, স্টপারে ভাল মানাবে।”
বুঝলাম আনোয়ারের চান্স হয়ে গেল। তাতে ভালই লাগল। আমার পোজিশন হল স্ট্রাইকার, আনোয়ার আমার প্রতিদ্বন্দ্বী নয়।
নিমাইয়ের কাছে গিয়ে বিপিনদার সঙ্গে যা যা কথা হয়েছে বললাম। শুনে নিমাই বলল, ”আমি মোটেই ঘাবড়াচ্ছি না। লেঙ্গি মারার কায়দা দেখিয়ে চান্স করে নেব। তুই বরং নিজের জন্য ভাব।”
আমি মনে মনে বেশ দমে গেছি। ফার্স্ট ডিভিশন ফুটবলের সঙ্গে এইভাবে পরিচয় হবে ভাবিনি। ফুটবলের সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো জানব, চর্চা করব, তারিফ পাব, অনেক উঁচুতে উঠব, এই সব যা ভাবতাম বিপিনদা তা চুরমার করে দিলেন। আমি গুটিগুটি মাঠের বাইরে এসে বসে পড়লাম। কেউ আমাকে লক্ষ করল না। চারটে বল নিয়ে মাঠে এখন প্র্যাকটিস হচ্ছে হেডিংয়ের। একজন পর পর কর্নার কিক করে যাচ্ছে, গোলের মুখে দশ—বারোজন হেড করে বল বের করে দিচ্ছে। ওরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া, হাসাহাসি, গালিগালাজ করছে। একবার হেড করার জন্য সবাই লাফাল, তার পরই একজন নাক চেপে মাঠ থেকে বেরিয়ে এল। কনুই দিয়ে কেউ মেরেছে। আর একবার, গোলকিপার লাফিয়ে উঠে বল—এ হাত দিয়েও ধরল না। কে তার প্যান্টটা এমন জায়গায় টেনে নামিয়ে দিয়েছে যে গোলের থেকে লজ্জা বাঁচানোটাই সে জরুরি কাজ গণ্য করতে বাধ্য হয়েছে।
নাকে ভিজে রুমাল চেপে সেই ছেলেটি আমার কাছে এসে দাঁড়াল। ডিগডিগে রোগা, বয়সে আমার থেকে বছর ছয়—সাতের বড় হবে। চোখাচোখি হতেই বলল, ”কোন পজিশনের?”
বললাম, ”স্ট্রাইকার।”
”কোথা থেকে?”
”পাড়ার ক্লাব। এই প্রথম গড়ের মাঠে।”
আনোয়ার হঠাৎ তলপেটে হাত চেপে কুঁজো হয়ে গেল। কেউ হাঁটু দিয়ে মেরেছে। ও অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে সামলে উঠল। লক্ষ করলাম, গাঁট্টাগোট্টার দিকে আনোয়ার হিংস্র চোখে তাকাচ্ছে। আমি আঙুল তুলে ছেলেটিকে বললাম, ”আচ্ছা, ওই বেঁটেটার নাম কী?”
”পলাশ টিকাদার। ডেনজারাস ছেলে। গত বছর রেফারিকে চড় মেরেছিল, একজনের পা ভেঙে দিয়েছে, টাকা খেয়ে সেমসাইড গোল করে ম্যাচ হারিয়েছে, টেন্ট থেকে একবার চারটে টেরিলিন ফুলপ্যান্ট একসঙ্গে চুরি করেছে। আমরা ওর থেকে দূরে দূরে থাকি।”
‘আপনার নাকে মারল কে? পলাশ?”
”না, রবি। ছেলেটা ভাল। বিপিনদার ইনস্ট্রাকশন, কী আর করবে।”
লক্ষ করলাম, পলাশ আনোয়ারের থেকে দূরে দূরে রয়েছে। আনোয়ার যতবার ওর পাশে আসছে, ও সরে যাচ্ছে। নিমাই ভিড় থেকে তফাতে।
”আপনি শোভাবাজারে ক’বছর?” আমি কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করলাম।
”পাঁচ বছর হবে।”
”ক্লাব বদলাবেন না?”
ওর মুখ ম্লান হয়ে গেল। রক্তমাখা রুমালটা চোখের সামনে অনেকক্ষণ ধরে থেকে বলল, ”বিপিনদা একটা দোকানে কাজ জোগাড় করে দেবে বলেছে।” তার পর রুমালটা মুঠোয় ভরে, ”এইবার নামি” বলে মাঠের দিকে এগিয়ে গেল।
হেডিং প্র্যাকটিস শেষ হয়ে গেছে। এইবার বোধহয় পার্টি করে খেলা হবে। আমি পা থেকে বুট খুলতে শুরু করলাম।
ফেরার সময়ও আসার মতোই কেউ বিশেষ কথা বললাম না। নিমাই একবার বলেছিল, ”মাঠ থেকে উঠে গেলি কেন? এ সব ক্লাবে অত মেজাজ চলে না।” আর একবার বলেছিল, ”পলাশটা মরবে। আনোয়ারকে যা খেপিয়েছে।”
বাড়িতে মা একবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ”কী হল?” মন ভাল ছিল না। দায়সারা জবাব দিলাম, ”প্র্যাকটিস হল খানিকটা দম করার জন্য দৌড়োলুম কিছুক্ষণ। প্রথম প্রথম এই সবই চলবে।”
নীলিমা কোনও প্রশ্ন করেনি, তাতে হাঁফ ছেড়েছি। ওর কাছে ফার্স্ট ডিভিশন সম্পর্কে বলে বলে আমি এমন একটা ধারণা করিয়ে দিয়েছি, ময়দানের ঘেরা মাঠ তিনটে যেন দক্ষিণেশ্বর, কালীঘাট আর ঠনঠনের কালীমন্দির; সেই ধারণাটা প্রথম দিনেই ভেঙে দিলে হয়তো ওর চোখে আমি নেমে যাব।
।।৫।।
সন্ধ্যায় হর্ষদার বাড়ি গেলাম। সব শুনে বললেন, ”আরে বিপিন সিংহী যা করতে বলে, করে যাবি। যা গল্প বলবে, শুনে যাবি। ওর কাছে তো খেলা শেখার জন্য তুই যাসনি। গেছিস একটা ফার্স্ট ডিভিশন টিমে ঢুকে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, এরিয়ান কি যুগের যাত্রীর চোখে পড়তে। সে জন্য একটা ক্লাব তো দরকার। শোভাবাজার না হলে তোর মতো অজানা অনামী একটা জুনিয়ারকে চান্স দেবে কে? স্পোর্টিং ইউনিয়ন কি জর্জ টেলিগ্রাফে গেলেও তো পাত্তা পাবি না।”
”চান্স পাবার থেকেও আমি আগে খেলা শিখতে চাই।”
”ম্যাচ খেলাটাও শেখার পক্ষে দরকারি ব্যাপার। এ—বছরটা একটু নাম কর, পরের বছর এরিয়ান কী ভ্রাতৃসঙ্ঘে চেষ্টা করব। বয়স কম রয়েছে, ছোট ক্লাবে দু—তিন বছর থেকে এক্সপিরিয়ান্স তৈরি হলে বরং সুবিধেই হবে বড় ক্লাবে।”
হর্ষদার সঙ্গে তর্ক করা যায় না। একটা না একটা যুক্তি খাড়া করে চুপ করিয়ে দেবেই। ওকে আমার বলতে ইচ্ছে করছিল—দু—তিন বছরই বা নষ্ট করব কেন ছোট ক্লাবে পড়ে থেকে? আমি এখুনি মোহনবাগানে খেলতে চাই। আমার ফেভারিট টিম মোহনবাগান, আমার স্কুলের পুরনো খাতায় খবরের কাগজ থেকে কেটে চুনি গোস্বামীর ছবি পাতার পর পাতায় সেঁটে রেখেছি। মোহনবাগান টেন্টটাকে দূর থেকে তাজমহল ছাড়া আর কিছু ভাবি না।
গোঁড়া ইস্টবেঙ্গলি নিমাই একবার বলেছিল, ওর স্বপ্ন মোহনবাগানের এগেনস্টে হ্যাট্রিক করা। সে দিন থেকে ওর সম্পর্কে এক টুকরো ঘৃণা মনের মধ্যে জমাট বেঁধেছে। বহু সময় সেটাই নিমাইয়ের বিরুদ্ধে আমার রাগে ফেটে পড়ার কারণ হয়। পরে অবশ্য লজ্জা পাই, কেননা আমায় রাগতে দেখলে নিমাই চুপ করে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে। তার পর বলে, ”তোর বড্ড মেজাজ। ভীষণ অধৈর্য তুই।”
আমি জানি, ধৈর্য ধরার মতো মন আমার নেই। সেটা আনোয়ারের আছে। অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় ও খেলে। অত বড় দেহটা বেড়ালের মতো নাড়াচাড়া করায়। ট্যাকল করে বাঘের মতো রোখ নিয়ে অথচ পরিচ্ছন্নভাবে। কেউ ওকে ফাউল করলে, একবার শুধু তার দিকে তাকায়। সাধারণত তার পর আর ফাউল হয় না। সেই তুলনায় নিমাই মিনিটে একটা—দুটো ছোটখাটো ফাউল করে যাবেই। বেশিরভাগই রেফারির চোখের আড়ালে ঘটে। স্টপারটাকে কিছুতেই নড়ানো যাচ্ছে না, মাঝখানটা এঁটে ধরে আছে, অমনি নিমাই তার পিছনে লেগে গেল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে দেখা যাবে, বল ছেড়ে সে নিমাইয়ের পিছু নিয়েছে রাগী মুখে। তার পর আমার কাজ ফাঁকা অঞ্চলটাকে ব্যবহার করা এবং সেটা করেও থাকি।
অসম্ভব ভাল থ্রু দিতে পারে নিমাই, আর বল সমেত টিঙটিঙে শরীরটাকে পাঁকাল মাছের মতো হড়কিয়ে নিয়ে যেতে পারে তিন—চারজন ডিফেন্ডারের মধ্য দিয়ে। ও জানে, আমি কোথায় থাকব। বলটা ঠিক আমার পায়েই ছুটে আসে পোষা কুকুরের মতো। তখন একটা কাজই বাকি থাকে—হয় আলতো করে, নয়তো প্রচণ্ড জোরে বলটাকে গোলের মধ্যে পাঠিয়ে দেওয়া। অনেকে বলে, নিমাই না থাকলে আমি গোল করতে পারব না। শুনে ভীষণ অস্বস্তি বোধ করি, রাগও হয়। কারুর ওপর নির্ভর করে খেলছি, গোল দিচ্ছি, আমার কোনওই কৃতিত্ব নেই—এটা মানতে চাই না। নিমাইকে আমি সত্যিই ঘৃণা করি। কিন্তু ও তা জানে না। ও আমাকে ভালবাসে।
.
শোভাবাজার ইউনিয়নে আমি প্রথম ১৬ জনের মধ্যে রয়ে গেলাম। আনোয়ার আর নিমাই ফার্স্ট টিমে পর পর সাতটা লিগ ম্যাচে খেলল। সাতটাই আমরা হারলাম। ইস্টবেঙ্গল দিল পাঁচ গোল, ইস্টার্ন রেল চার, কালীঘাট দুই, মহামেডান চার, এরিয়ান পাঁচ, স্পোর্টিং ইউনিয়ন দুই, বি—এন—আর তিন। আমরা একটাও গোল দিতে পারিনি।
আনোয়ার সাতটা ম্যাচই পুরো খেলেছে। বিপিনদার অত্যন্ত ফেভারিট হয়ে উঠেছে ও। সাতটা খেলায় শোভাবাজার ২৫ গোল খেয়েছে। আমার ধারণা, স্টপারে আনোয়ার না থাকলে সংখ্যাটা ৫০ হত। প্রমিসিং হিসেবে ওর বেশ নাম হয়ে গেছে এই ক’টা খেলাতেই। নিমাই দুটো ম্যাচ পুরো খেলেছে, বাকিগুলোয় আধা আর সিকি।
নিমাইয়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে আমার। দু’জন তিনজনকে কাটিয়ে গোলের মুখে অভ্যাস মতো বল ঠেলে দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দ্যাখে কেউ নেই, ওদের ব্যাক কিংবা গোলকিপার বলটা ধরেছে। নিমাই মাঠের চারধারে তাকায়। ওর খেলার ধরন একমাত্র যে বোঝে সে তখন মাঠের বাইরে বেঞ্চ—এ ড্রেস করে বসে আছে। নিমাই যত গোল ওপেন করেছে, তার শতকরা নব্বুইটা থেকে আমি স্কোর করতে পারতামই। দেখতে দেখতে চোখে জল এসে যায়। নিমাই অসহায়ের মতন আমার দিকে যখন তাকায়, মুখ ঘুরিয়ে ফেলি।
আমি জানি, ওরও আমার মতন অবস্থা। আমাকে খেলানো হচ্ছে না অথচ ও চান্স পাচ্ছে, তাতেও ও মরমে মরে আছে। তার উপর নিজের যাবতীয় চেষ্টা বিফল হতে দেখে শেষের দিকে নিমাই আর গা লাগায় না। রাগে আমার সর্বাঙ্গ রি রি করে, যখন দেখি উইংগার কি আর এক ইনসাইড ভুল জায়গায় পাস দেওয়ার জন্য নিমাইকে দাঁত খিঁচোচ্ছে।
আমি আর আনোয়ার ওকে বলেছিলাম, তুই নিজেই গোল কর। ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে খেলায় নিমাই তিনবার শান্ত আর নঈমের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে সামনে থঙ্গরাজকে পেয়েও গোল করতে পারেনি। দু’বার বাইরে মারল, আর একবার হাতে তুলে দিল। ”কীরকম যেন হয়ে গেলুম”—নিমাই পরে আমাকে বলে, ”অত বড় একটা চেহারা দু’হাত মেলে এগিয়ে আসছে! ভয়ের চোটে তাড়াতাড়ি মেরে দিলুম।”
আমিও রেগেই জবাব দিলাম, ”আর মিথ্যা কথা বলে সাফাই দিতে হবে না। যা বল পেয়েছিলি, তাতে গোলে ইয়াসিন থাকলেও গোল হয়। তুই বাঙাল, তাই গোল করিসনি। আমি যদি মোহনবাগানকে এভাবে পেতুম, বলাই দে সুদ্ধু গোলে ঢুকিয়ে দিতুম।”
নিমাই একগাল হেসে বলল, ”তার পর দু’দিন উপোস করে প্রায়শ্চিত্তি করতিস।” কিছুক্ষণ পর ও গলা নামিয়ে বলল, ”খেলার পর যখন টেন্টে ডেকে নিয়ে গেল জল খাওয়াবার জন্য, তখন পি. সিনহা আমার নাম, কত দিন খেলছি, কোথায় থাকি জিজ্ঞাসা করল। কেন বল তো?”
”সামনের বছর পরিমল দে—কে বিদেয় করে তোকে আনবে বলে।”
নিমাই অপ্রতিভ হয়ে চুপ করে গেল। তার পর বেশ রেগেই বলল, ”মোহনবাগানকে গুনে গুনে তিন গোল দেব তা হলে।”
রাজস্থানের সঙ্গে খেলার আগের দিন নোটিশ বোর্ড—এ টিমের লিস্ট—এ আমার নাম উঠল। তিন দিন ধরে আকাশ মেঘলা। বৃষ্টিও হয়ে গেছে দু’দিন। লিস্ট—এ এগারোজনের নামের মাথায় লেখা ‘ইফ রেইন’। পাঁচজনের নামের পাশে পাঁচটি নাম, তাঁদের মাথায় লেখা ‘ইফ নট রেইন’। আমার নাম ‘ইফ নট রেইন’—এর তালিকায়। ব্যাপারটা একজন বুঝিয়ে দিল। বৃষ্টি পড়লে কারা খেলবে আর না পড়লে কারা খেলবে। আমার নামের পাশে টিকাদারের নাম। যদি বৃষ্টি পড়ে তা হলে আমি বাদ, টিকাদার খেলবে।
রাতে ঘুমোতে পারলাম না। ঘন ঘন জানলা দিয়ে আকাশ দেখতে লাগলাম। তারা দেখা যায় না, ঘোলাটে গঙ্গাজলের মতন আকাশ। কাল বিকেলে বৃষ্টি হবে কি হবে না, ঘেরা মাঠে প্রথম খেলার সুযোগ আসবে কি আসবে না, এই চিন্তা করতে করতে একটা ভয় ক্রমশ আমাকে পেয়ে বসল। কাল নির্ঘাত আমি ওপেন নেট মিস করব। এ রকম আগেও হয়েছে।
.
।।৬।।
চাতরায় একবার ফাইনাল খেলাতে নিয়ে গেছিল পাইকপাড়া অগ্রগামী। সারা রাত চিন্তা করেছিলাম অপোনেন্ট ত্রিবেণী যুব সঙ্ঘের স্টপার আর দুটো ব্যাকের কথা। সেমিফাইনালে চারটে গোল দিয়ে মাঠ থেকে বেরোচ্ছি, তখন যে লোকটি আমায় বলেছিল, ”খোকা, তুমি তো বেশ খেলো! কিন্তু তোমার বাঁ পা যে একদম চলে না!”
পরে শুনলাম তার নাম ‘ল্যাটা মন্টে’। ফাইনালে আমাদের অপোনেন্ট স্টপার। বছর কুড়ি আগে কলকাতা মাঠে খুব নামকরা ফরোয়ার্ড ছিলেন এরিয়ানে। এখন মাঝে মাঝে খেলেন স্টপারে। ওঁর ভাল নামটা কেউ বলতে পারল না। ব্যাক দুটি ক’ মাস আগেই জুনিয়ার ইন্ডিয়া টিমের সঙ্গে এশিয়ান ইয়ুথ চ্যামপিয়নশিপ খেলতে গেছিল ব্যাংকক না সিওল—এ। ওদের সেমিফাইনালের খেলা দেখতে দেখতে পাশের লোকটিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘রাইট ব্যাকটার কী নাম, দাদা?”
”সুধীর কর্মকার। যে রকম খেলছে নাম করবে মনে হচ্ছে।”
ফাইনালের আগের রাতে ঘুমোতে পারিনি, শুধু মাথার মধ্যে অবিরাম গুনগুন করেছে ল্যাটা মন্টের কথাটা, ‘তোমার বাঁ পা যে একদম চলে না’ আর চোখে ভেসেছে সুধীর কর্মকারের ট্যাকলিং। ফাইনালের দিন সকলে ল্যাটা মন্টে আমাদের ঘরে এলেন। ত্রিবেণী টিম পাশের ঘরেই কাল থেকে রয়েছে। আমাদের নীলেদা ওকে দেখেই খাতির করে বসিয়ে বলল, ”মন্টেদা, আজ খেলছেন তো?”
”ভাবছি। শরীরটা বড় ম্যাজম্যাজ করছে, গঙ্গায় সাঁতার কেটে ফিট না হলে খেলব না। সাঁতারের মতো এত ভাল ‘বডি ফিট’ করার আর কিছু তো হয় না।”
আমার বয়স তখন চোদ্দো। কথাগুলো শোনা মাত্র ‘বডি ফিট’ করার জন্য আনচান করে উঠলাম।
”আমার এক্সপিরিয়ান্স থেকে যা বুঝেছি, বুঝলি নীলে, খেলার দিন কোনও রকম প্র্যাকটিস নয়। সকালে শুধু সাঁতার আর দুপুরে রেস্ট—কষে ঘুম। বিকেলে অদ্ভুত ঝরঝরে হয়ে যায় শরীরটা, ব্রেনও খুব ভাল ফাংশন করে। ফরোয়ার্ডদের তো অবশ্যই সাঁতার কাটা দরকার। হ্যাঁ, তার আগে আচ্ছাসে তেল মেখে ডলাই—মলাই, মানে মাসাজ করে মাসলগুলোকে আলগা করে নিতে পারলে তো কথাই নেই। গোষ্ঠ পাল, সামাদ থেকে শুরু করে পিকে, চুনি সবাই ম্যাচের দিন সাঁতার কাটত। ওরা রোম ওলিমপিক—এ হারল কেন জানিস?”
আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। মন্টেদা একটা সিগারেট ধরিয়ে শতরঞ্চিতে বাবু হয়ে বসলেন। আমাদের রাইট আউট ইস্টার্ন রেলে খেলে, খুব বইটই পড়ে। বলল, ”হাঙ্গেরি টিমে অ্যালবারটো ছিল যে!”
”থাকলেই বা!”
”টিচি ছিল।”
”তাতে কী হয়েছে?”
আমরা খুবই দমে গেলাম কারণটা খুঁজে না পেয়ে। মন্টেদা কষে সিগারেটে টান দিয়ে শতরঞ্চি উলটিয়ে মেঝেয় ছাই ঝেড়ে বললেন, ”যেখানে ইন্ডিয়া টিমকে থাকতে দিয়েছিল, সেখানে সাঁতার কাটার মতো একটা চৌবাচ্চচাও ছিল না। বডি ফিট করতে পারেনি ম্যাচের দিন। চুনি—প্রদীপ সারা সকাল অনেক খুঁজেছিল যদি একটা পুকুর কী ডোবাও পাওয়া যায়! পায়নি।”
আমি বললাম, ”ম্যাচের দিন চুনি কি সাঁতার কাটে?”
”নিশ্চয়! ওকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো, ওর অমন ডজ, অমন স্পিড, অমন ব্রেন হয় কী করে? সবই মা গঙ্গার কৃপায়। যে জলে কারেন্ট আছে, সেখানে সাঁতার কাটার উপকারিতা যে কী, তা তো জানো না? অরুণ ঘোষ এমন দারুণ খেলে কী করে? শিবপুরে বাড়ি, পা বাড়ালেই গঙ্গা।”
সিগারেটে শেষ টান দিয়ে মন্টেদা উঠলেন, ”যাই, তেলটেল জোগাড় করিগে।”
নিমাই নেই। আনোয়ার আর আমাকে পাইকপাড়া অগ্রগামী খেলাতে এনেছে। আনোয়ারকে বললাম, ”যাবি গঙ্গায়?” ও আঁতকে উঠল, ”গঙ্গায়! আরে বাপস! চৌবাচ্চচায় পর্যন্ত নামি না—সাঁতার জানি না বলে।”
কিন্তু ইস্টার্ন—এর রাইট আউট আর স্পোর্টিং ইউনিয়নের লেফট হাফব্যাক সরষের তেলের খোঁজে ততক্ষণে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। আধ কিলো নিয়ে আমরা চারজন চাতরার গঙ্গার ঘাটে বসে মন্টেদার কথামতো মাসলগুলোকে আধ ঘণ্টা ধরে আলগা করে জলে যখন নামলাম, মন্টেদা তখন ছোট্ট একটা তেলের বাটি হাতে ঘাটে এসে বসলেন। বেশ আরামে সাঁতার কাটা শুরু করলাম।
মন্টেদা চিৎকার করে বললেন, ”ঘাটের কাছে ফুরফুর করে মেয়েদের মতো সাঁতার! তোরা কি ফুটবলার না, লুডো প্লেয়ার?”
প্রবল বিক্রমে আমরা মাঝ গঙ্গার দিকে রওনা হয়ে গেলাম এবং আধ ঘণ্টা পরে যখন ফিরলাম, তখন দম ফেলতে পারছি না। মন্টেদা বাহুতে মালিশ করতে করতে বললেন, ”এই তো, একেই বলে সাঁতার। এখন রেস্ট, জলে ফ্লোট করো এবার।”
অতঃপর আমরা চিত হয়ে জলে ভাসতে শুরু করলাম। মিনিট দশেক পর পাড়ের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম। ভাঁটার টানে চাতরা—ঘাট থেকে বহু দূরে চলে এসেছি। টানের বিরুদ্ধে সাঁতরে ফিরে এসে ঘাটের সিঁড়িতেই আমরা এলিয়ে পড়লাম।
মন্টেদা জলে নামতে নামতে গম্ভীর হয়ে বললেন, ”এবার ভাত খেয়েই শুয়ে পড়বে। মনে রেখো, বিকেলে ফাইনাল খেলা।” তার পর কানে আঙুল ঢুকিয়ে কয়েকটা ডুব দিয়েই তিনি উঠে পড়লেন।
গনগনে খিদে পেয়েছিল। গোগ্রাসে ভাত আর মাংস খেয়েই শুয়ে পড়লাম। যখন ঘুম ভাঙিয়ে দিল, সারা টিম তখন ড্রেস করে মাঠে রওনা হবার জন্য তৈরি। সর্বাঙ্গে ব্যথা, মাথা ঝিম ধরে আছে, চোখে ঘুম জড়ানো, পেট ভার। ডাক ছেড়ে আমার কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করল।
থ্রু বাড়িয়ে দিচ্ছে, ছুটতে পারছি না, হেড করার জন্য শরীর তুলতে পারছি না, সামান্য সাইড—পুশেই ছিটকে পড়ছি, ভলি মারতে পা উঠছে না। মাত্র দশ গজ দূরে একবার ফাঁকা গোল পেয়েও শট নেবার আগেই সুধীর কর্মকার পা থেকে বল ছিনিয়ে নিয়ে গেল। মাঠের চারদিক থেকে টিটকারি আর গালাগাল, বিশেষ করে আমাকেই। কেননা মাঠের মধ্যে সব থেকে বয়স্ক মন্টেদা যে রকম অনায়াসে সব থেকে কনিষ্ঠকে বোকা বানাচ্ছেন, তাতে দর্শকরা মজাই পাচ্ছিল, শুধু পাইকপাড়া অগ্রগামীর অফিসিয়ালরা ছাড়া। হাফ টাইমে আমাকে এবং লেফট হাফ ব্যাককে বসানো হল।
বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত লজ্জায় আমি আর মাথা তুলতে পারিনি। আনোয়ারকে হিংসে করেছিলাম সাঁতার না জানার জন্য। বাঘের মতন ও খেলেছিল। ত্রিবেণী ২—০ গোলে জিতেছিল। প্রথম গোলটা পেনালটি থেকে; মন্টেদা পেনালটি কিক করেন। আনোয়ার পরে বলেছিল, বলটা স্পটে বসিয়ে মন্টেদা একবার গোলকিপারের দিকে তাকান। গোলকিপার দেখল মন্টেদার চোখ ট্যারা। বেচারা ভ্যাবাচাকা খেয়ে কোন দিকে পজিশন নেবে বুঝতেই পারেনি। তার বাঁ দিকে তিন হাত দূর দিয়ে বল গোলে ঢোকে, সে ডান দিকে ডাইভ দিয়েছিল।
রাজস্থানের সঙ্গে খেলার আগের দিন রাত্রে জানলা দিয়ে গঙ্গার মতন ঘোলাটে আকাশের দিকে তাকিয়ে আমার চাতরার ফাইনালের কথা মনে পড়ল। আর হাসি পেল। ওপেন নেট মিস করেছিলাম। কাল করব না, হে ভগবান কাল বৃষ্টি দিও না। আমি ‘ইফ নট রেইন’—এর লিস্টে আছি। জীবনের প্রথম ঘেরা মাঠে খেলার সুযোগটা নষ্ট করে দিও না। তার পর শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
।।৭।।
সকালে উঠে দেখি, কখন যেন বেশ ভালই বৃষ্টি হয়ে গেছে। আকাশে মাঝে মাঝে নীল রঙের ছোপ। মেঘ অনেকটা কেটে গেছে। শরীরটা ঝরঝরে তাজা লাগল। মাকে বললাম, ”আজ আমার খেলা আছে।”
কথাটাকে মা গুরুত্ব দিলেন না। খেলা আমার প্রায় রোজই থাকে। বললাম, ”আজ প্রথম খেলব ফার্স্ট ডিভিশনে।”
মাকে আজ অন্যমনস্ক লাগল। খুবই সাধারণভাবে বললেন, ”ভাল করে খেলিস।”
আশা করেছিলাম উৎসাহে মা’র চোখমুখ ঝলসে উঠবে, কিন্তু কিছুই হল না। অভিমানে আর ওই প্রসঙ্গ না তুলে বললাম, ”খাবার আছে?” মা’র মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ব্যাপারটা আমি বুঝলাম এবং রেগে উঠলাম। কিন্তু কার উপর রাগ করব ভেবে পেলাম না। অরুণা গ্লাস ফ্যাক্টরি? যেখানে লক আউট চলছে আর তুই বাবা বেকার! বাবা এখন দোকানে সামান্য একটা কাজ করেন, যা পান তাতে দু’বেলা কয়েকটা রুটি ছাড়া আর কিছু আমাদের জোটে না।
পিন্টু বুঝতে শিখেছে আমরা দরিদ্র, ওর হাবভাবে এখনই যেন কেমন বুড়োটে ছাপ পড়ে গেছে। বায়না, আবদার বা অভিমান কী রাগারাগি একদম করে না, গম্ভীর হয়ে শুকনো মুখে বেরিয়ে যায়। শুধু কান্নাকাটি জুড়ে দেয় পুতুলটা। তখন নীলিমা ওকে টেনে নিয়ে যায় নিজেদের ঘরে। কিছুক্ষণ পরে দেখা যায় পুতুল খেলা করছে। নীলিমার মা দু’ বছর আগে মারা গেছেন। সেই থেকে সে সংসারের কর্ত্রী। বাবা টাকা এনে ওর হাতে দেয়, নীলিমা গুছিয়ে হিসেব মতো খরচ করে।
রাগটা শেষ পর্যন্ত নিজের উপরই এসে পড়ে। আমারও তো কিছু করণীয় আছে। আজ পর্যন্ত আমি শুধুই নিয়েছি, কিছুই দিইনি। ক্লাস টেনে ফেল করে পড়া ছেড়ে দিয়েছি। স্কুল ভাল লাগে না, তা ছাড়া আমি বুঝে নিয়েছি লেখাপড়া করার মতন মাথাও আমার নেই। আমি ফুটবল খেলতে ভালবাসি; শুধু ফুটবলই খেলি। তাতে বাবা, মা, ভাই, বোন—কারও কোনও উপকারই হয় না।
সংসারে বিন্দুমাত্র সাহায্যও আমি করতে পারি না! মাঝে মাঝে নিজেকে ফালতু মনে হয়। শুধু আড্ডা আর খেলা! কোন মুখে আমি সংসারে দু’মুঠো ভাত দাবি করব? ফুটবল এখনও আমাকে কিছু দাবি করার মতন জোর দেয়নি। আমার সামনে টাকা রোজগারের একমাত্র পথ খোলা রয়েছে, মাঠে। বড় ফুটবলার না হতে পারলে দেশে আমি আর একটা অশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়াব মাত্র।
তীব্র একটা জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে ড্রেস করে ফুটবলটা হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ঢালাই লোহার নানা রকম জিনিস তৈরির একটা কারখানা মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই, তার গায়ে ছোট এক খণ্ড জমি আমাদের প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড। এই জমিতেই ফুটবল খেলা শুরু করি। পিন্টু রাস্তায় তার বন্ধুদের সঙ্গে তুমুল তর্ক করছিল, কানে এল ওর চিৎকার—’য্যা য্যা, জারনেলের মতন স্টপার হতে গেলে নঈমকে আবার নতুন করে খেলা শিখে আসতে হবে।”
আমাকে দেখেই পিন্টু ছুটে এল, ”দাদা, যাব তোর সঙ্গে?”
”আয়।”
বলটা আমার হাত থেকে ও নিয়ে নিল। ক্লাব থেকে বলটা চেয়ে নিয়ে রেখেছি। দুটো তাপ্পি দেওয়া, আকারে অনেকটা পেয়ারার মতন। সকাল বা দুপুরে যখনই পারি রোজ একা একা স্কিল প্র্যাকটিস করি। মাঝে মাঝে পিন্টু আর তার বন্ধুরা আমার সঙ্গী হয়।
আগে বাঁশের কঞ্চি চার হাত অন্তর পুঁতে বল নিয়ে এঁকেবেঁকে ড্রিবল প্র্যাকটিস করতাম। হর্ষদা একদিন বললেন, ”গ্যারিনচাকে এভাবে প্র্যাকটিস করতে বলায়, সে নারাজ হয়ে বলে, ‘অপোনেন্ট তো আর খুঁটি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে না, সে নানাভাবে বাধা দেবেই, কাজেই প্র্যাকটিস করতে হলে সচল মানুষের সঙ্গে ড্রিবল করা দরকার’।”
কথাটা আমার মনে ধরেছিল। সেই থেকে আমি পিন্টু আর তার বন্ধুদের পেলেই প্র্যাকটিসে ডাকি। আজ ওর বন্ধুরা কেউ এল না। কারণ জিজ্ঞাসা করতে ইতস্তত করে পিন্টু বলল, ”দরকার নেই ওদের আসার।”
”কেন, কী হল? ঝগড়া হয়েছে?”
পিন্টু চুপ করে রইল। খানিকক্ষণ পর বলল, ”তুমি নাকি একদিনও খেলায় চান্স পাওনি, বসিয়ে রেখে দিয়েছে। আনোয়ারদা আর নিমাইদা রোজ খেলে?”
আমার মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে এল, ”হাঁটুতে চোট রয়েছে। প্র্যাকটিসে টিকাদার বলে একজন এমন ট্যাপ করেছে যে ভাল করে এখনও শট নিতে পারি না।”
পিন্টুর মুখ স্বস্তিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল আর আমি মনে মনে কুঁকড়ে গেলাম। ওর কাছে আমি হিরো, আর সেটা বজায় রাখতে মিথ্যে কথাগুলো আপনা থেকেই কেন বেরিয়ে এল, ভেবে পেলাম না। হয়তো ভয়ে। প্রচণ্ড এক স্ট্রাইকার আমার ইজ্জতের ডিফেন্স ভাঙবার জন্য আঘাত হানতে উদ্যত। আমি একটা বিশ্রী ফাউল করে তাকে আটকালাম।
.
কারখানার তিনতলা সমান উঁচু দেয়ালটাকে গোল বানিয়ে টারগেট শুটিং করি। ইট দিয়ে দাগ টেনে মাটি থেকে ৮ গজ × ৮ ফুট একটা ঘর করে সেটাকে ছয় ভাগ করে ১, ২, ৩ লিখে দিয়েছি। পিন্টু বা আর কেউ চেঁচিয়ে নম্বর বলে আর আমি শট করি। দেয়ালে লেগে বল ফিরছে, তখন আবার চেঁচিয়ে নম্বর বলে, আমি ফিরতি বল না থামিয়ে হেড দিয়ে কী শট করে আবার টারগেটে পাঠাই। এভাবে মিনিট দশেকেই হাঁফিয়ে যাই। একটু জিরিয়ে আবার শুরু করি। এভাবে প্র্যাকটিস করতে হর্ষদা আমায় বলে দিয়েছিলেন। কোনও দিন শুধুই পেনালটি শট করি গুনে গুনে একশোটা, কিংবা চিপ করি, কেউ বল ছুড়ে দেয় হেড করি, ভলি মারি আর পিন্টুর পাঁচ—ছ জন বন্ধুর সঙ্গে ড্রিবল করি।
আজ শুধুই পিন্টু। গোলে অর্থাৎ দেওয়ালে শট করছি, পিন্টু পিছন থেকে নম্বর বলছে। বল মাঝে মাঝে রাস্তার দিকে ছিটকে গেলে আমিই ছুটে কুড়িয়ে আনছি। এক সময় দেখি, নীলিমা দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে। বুকের কাছে বইয়ের গোছা, পরনে নীলপাড় সাদা শাড়ি। স্কুল থেকে ফিরছে। শাড়ি পরলে ওকে কিছুটা বড় দেখায়। ওর স্কুলটা মাইলখানেক দূরে। বাসে দশ পয়সা ভাড়া, যাতায়াতের সেই কুড়িটা পয়সা বাঁচাবার জন্য হেঁটে যায় আর আসে।
বলটা রাস্তার দিকে যেতেই নীলিমার সঙ্গে চোখাচোখি হল। ও হাসল। আমি বললাম, ‘স্কুল থেকে?” ও ঘাড় নাড়ল। মুখটা শুকনো। কপালে কয়েকটা চুল ঘামে সেঁটে রয়েছে। আঁচল দিয়ে গলা ও ঘাড়ের ঘাম মুছল।
”আমার স্কুল বসবে বিকেলে!” বলে আমি হেসে উঠলাম।
”তাই বুঝি পড়া তৈরি করছ?” নীলিমার সাজানো দাঁতগুলো ঝকঝকে করে উঠল।
”আমি খুব খারাপ ছাত্র, প্রমোশন পাব কি না জানি না!” হতাশার ভান করে বললাম।
”খাটলে পাশ করবেই করবে।”
নীলিমার স্বরে, চোখে, এমনকী দাঁড়াবার ভঙ্গিতে আর পরিহাস নই। আমার ভিতরে আলতোভাবে একটা প্রত্যয় পাখির মতন ডানা মেলে ভেসে এল। হাতের বলটাকে হঠাৎ কিক করে সোজা শূন্যে তুলে দিলাম। পিন্টু চিৎকার করে উঠল, ”তিন।”
একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে ফেললাম। চিত হয়ে মাটিতে শুয়ে বলটাকে ব্যাক ভলি করলাম। এভাবে জীবনে কখনও মারিনি। আশ্চর্য, আশ্চর্য, তিন নম্বর টারগেটের মাঝখানে বলটা দুম করে লেগে ফিরে এল। পিন্টু দু’ হাত তুলে চিৎকার করে বলটার পিছু ধাওয়া করল। নীলিমার বড় বড় চোখ দুটো আরও বড় হয়ে গেছে, আর আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, আমিই প্রসূন ভটচাজ কি না!
”দাদা আর একবার।” পিন্টু আমার কাছে বলটা পাঠিয়ে দিয়ে বলল।
ভালভাবেই জানি, ব্যাপারটা আন্দাজে এবং ভাগ্যের জোরে হয়ে গেছে। আর একবার করতে গেলে, কারখানার চালার উপর দিয়ে বল উড়ে যাবে কি রাস্তার ওপরে পড়বে, তা ভগবানও জানে না।
”হাঁটুতে একটা চোট আছে, এখনও ভাল করে সারেনি।” নীলিমাকে বললাম, ”ফট করে যদি লেগে যায়…”
”না না, আর করতে হবে না!” নীলিমা ব্যস্ত হয়ে বলল।
”আর একবার মারি।”
”না না, আগে পুরোপুরি সারুক।” নীলিমা হাত তুলে বারণ করল। আমি হাঁফ ছাড়লাম। স্ট্রাইকারকে আটকাতে ছোটখাটো ফাউল করাটা খেলার মধ্যেই পড়ে।
”বড্ড খিদে পেয়েছে।” পেটে হাত দিয়ে চোখ মুখ করুণ করে তুললাম। আমি জানি, নীলিমার সঙ্গে ছোট্ট একটা প্লাসটিকের পয়সা রাখার ব্যাগ সব সময় থাকে।
”অমনি খিদে পেয়ে গেল, পড়া শুরু করতে না করতেই!” দু’ আঙুলে ব্লাউজের মধ্যে থেকে ব্যাগটা বার করতে করতে নীলিমা ধমকে উঠল। খুট করে ব্যাগের বোতামটা খুলে ও বলল, ”বেশি নেই, তিরিশটা পয়সা বড়জোর দিতে পারি।”
”মোটে তিরিশ! এমন একটা ব্যাক ভলি দেখালাম!”
”আচ্ছা, পঁয়ত্রিশ।”
”না, না, প্লিজ, আট আনা করো। বদুর দোকানে চারটে কচুরি আর দুটো জিলিপি। ভীষণ খিদে!”
এবার আর ভান নয়। আন্তরিকতার সঙ্গেই বললাম। নীলিমা আমার মুখ দেখেই বুঝল এবং একটি আধুলি দিল।
”ধার রইল।”
”এই নিয়ে কত হল?” গম্ভীর হয়ে নীলিমা বলল।
”হিসেব রেখো, সব একবারে শোধ করে দেব।”
নীলিমা বাড়ি চলে গেল। গত এক বছরে অন্তত পঞ্চাশ—ষাট টাকা এইভাবে ওর কাছ থেকে নিয়েছি। প্রতিবারই বলেছি, লিখে রেখো, সব শোধ দিয়ে দেব। নিশ্চয়ই দেব। আমার এই পরিশ্রম বৃথা যাবে না, যেতে দেব না।
পয়সা হাতে আসতেই খিদেটা চনচনে হয়ে চাড়া দিল। বলটা পিন্টুকে দিয়ে বললাম, ”বাড়ি চলে যা।”
”আর খেলা উচিত নয়। চোটটা আবার চাগিয়ে উঠতে পারে।” বিজ্ঞের মতন পিন্টু আমাকে উপদেশ দিল। হাসি পেলেও হাসলাম না আমি। পিন্টু বল নিয়ে ধাপাতে ধাপাতে চলে গেল।
মিনিট পনেরো পরে বদুর দোকানে গরম কচুরি আর জিলিপি খেয়ে জলের গ্লাসটা হাতে নিয়েই মনে পড়ল, পিন্টুরও খাওয়া হয়নি আজ। পাথর হয়ে গেল আমার সর্বাঙ্গ। শুধু পেটের মধ্যেটা মুচড়ে উঠল।
.
।।৮।।
আমি আর পলাশ টিকাদার পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে আবার আকাশের দিকে তাকালাম। আকাশের উত্তর আর পুব নীলে—ধূসরে মাখা। কিন্তু দক্ষিণ—পশ্চিমে গাঢ় কালো মেঘ। বাতাস বইছে না। ভ্যাপসা গরমে আমরা ঘামছি। বৃষ্টি হবে কি হবে না, বোঝা যাচ্ছে না। আমার প্রথম খেলার ভাগ্য লেখা রয়েছে আকাশে।
ঠাণ্ডা দমকা হাওয়া বয়ে গেল। মেঘটা ছড়িয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে আসছে—তার একটা কোণ মহমেডান মাঠের দিকে। টিকাদারের মুখ খুশিতে ভরে উঠল। বুট পরার জন্য সে টেন্টের ভিতরে চলে গেল। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেঘটা ছড়াচ্ছে পশ্চিম দিকে, হাওয়া বইছে পশ্চিমে। হাঁফ ছাড়লাম।
বুট পরে টেন্ট থেকে বেরিয়ে টিকাদার আকাশে তাকিয়েই বিরক্ত হল। আমার মুখে ক্ষীণ হাসি দেখে সে আবার টেন্টে ঢুকে গেল। এর দশ মিনিট পরেই এক পশলা বৃষ্টি দিয়ে ভেসে পালাল একটা ছোট্ট মেঘ। আমি বুট হাতে শুকনো মুখে টেন্টের এক কোণে দাঁড়িয়ে। নিমাই বুট পরতে পরতে আমাকে লক্ষ করছিল। কাছে এসে বলল, ”খেলবি আজ?” জবাব না দিয়ে আমি মুখ ঘুরিয়ে টেন্টের বাইরে চলে গেলাম।
মিনিট পাঁচেক পরই বিপিনদা ব্যস্ত হয়ে আমাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন!
”কাণ্ড দ্যাখো তো, খেলার ঠিক আগেই বমি শুরু হল। প্রসূন কোথায়, প্রসূন … এই যে দ্যাখো তো নিমাইয়ের কাণ্ড! যাও, যাও ড্রেস করো।”
বেঞ্চে নিমাই শুয়ে। হাত দিয়ে চোখ ঢাকা। হঠাৎ নাকি বমি করতে শুরু করেছে। ড্রেস করে বেরোবার সময় আনোয়ারকে জিজ্ঞাসা করলাম, ”কী হল রে?”
নির্বিকার ভাবে আনোয়ার বলল, ”আধ শিশি আইডিন খেলে বমি তো হবেই।”
শোনামাত্র বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। শুধু বললাম, ”বাঙালটা সব পারে।” নিমাইয়ের কাছে গিয়ে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললাম, ”গুনে গুনে তিনটে গোল দেব।”
চোখ থেকে হাত না সরিয়ে নিমাই বলল, ”মোহনবাগানকে তো?”
”না—” শেষ করার আগেই থেমে গেলাম। হাত নামিয়ে নিমাই জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে।
বললাম, ”আজকে।”
.
আমি হ্যাট্রিক করতে পারলাম না প্রথম খেলায়। শুরু হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমাদের ডিফেনডিং জোনে নেমে এসে আমাকে ট্যাকল করতে হল রাজস্থানের হাফ ব্যাকদের। আনোয়ারের দু’ পাশ দিয়ে দুটো ছেলে, সুকল্যাণ আর সুভাষ বেরোচ্ছে। আমরা দশজন পেনালটি বক্সেপনেরো মিনিটের মধ্যে পাঁচ গোল খেয়ে যাওয়ার কথা। সুকল্যাণের ডান পা থেকে বেরোনো রতিনটে গোলার একটা পোস্টে, একটা আনোয়ারের কাঁধে আর অন্যটা কোন জাদুমন্ত্রে জানি না, বারের উপর দিয়ে তুলে দিল গোলকিপার। বাকি দুটো নষ্ট করল সুভাষ নিজেই। তার পর ১৮ মিনিটে কীভাবে যেন একটা বল ছিটকে সেন্টার লাইনের কাছে চলে এল। আমি বলটা ধরে রাজস্থান গোলের দিকে তাকিয়ে দেখি—গোলকিপার আর আমার মাঝে শুধু ওদের স্টপার ব্যাক ফেন।
মাঝ—মাঠ থেকে আমি বল নিয়ে দৌড়োতে শুরু করলাম, একটু কোনাকুনি, ডান দিকের কর্নার ফ্ল্যাগের দিকে। ফেন আমার সঙ্গেই দৌড়চ্ছে, তার বাঁ দিক কভার করে। লেফট ব্যাক নেমে আসছে। বয়স্ক ফেনকে মুখোমুখি কাটাতে পারব বলে ভরসা হল না। স্পিডে হারাব স্থির করেই হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে বলটা বাঁ দিকে প্রায় পনেরো গজ ঠেলে দিয়ে ফেনকে ডান দিক থেকে প্রচণ্ড দৌড়ে পিছনে ফেলে দিলাম। পেনালটি বক্স—এর মধ্যে যখন ঢুকছি, গোলকিপার অরুণ তীরবেগে এগিয়ে আসছে! সেই সঙ্গে দু’ পাশ থেকে দুই ব্যাক।
আমি শুধু অরুণের শরীরের ভঙ্গিটা লক্ষ করলাম। লাফ দেবার আগে বেড়াল যেমন করে, সেই রকম শরীরটাকে ধনুকের ছিলার মতন টেনেছে। আমি বাঁ দিকে হেলে যাওয়া মাত্রই ও দু’হাত বাড়িয়ে ভেসে এল। আমি মুহূর্তে ডান দিকে বলটাকে টেনে নিলাম এবং ডান পায়ের নিখুঁত নিচু পানচ—এ ডান পোস্ট ঘেঁষে বলটাকে গোলের মধ্যে পাঠালাম আর সেই সঙ্গেই লেফট ব্যাকের প্রচণ্ড চার্জে মাটিতে ছিটকে পড়লাম।
আমার প্রথম গোল! মাটিতে কাত হয়ে এই অবিশ্বাস্য ব্যাপারটার দিকে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি আর জালের গায়ে ধাক্কা খেয়ে বাদামি রঙের ওই গোলাকৃতি বস্তুটা কী নিরীহভাবে বিশ্রাম করছে। আমার সারা পৃথিবী এখন মনে হচ্ছে ওই বলটা। ইচ্ছে করছিল বলটাকে দু’ হাতে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরি।
আমাকে তুলে ধরল দুজনে। রাইট উইং আর রাইট ইনসাইড আনোয়ার। দু’ হাত তুলে ছুটে আসছে। আমার মাথা ঘুরছে তখন। আনোয়ার কী সব বলতে বলতে গালে চুমু খেল। মেম্বার গ্যালারির দিকে তাকালাম। গোটা পঞ্চাশেক লোকও হবে না। মাত্র এই ক’জন সাক্ষী রইল আমার প্রথম গোলের। শোভাবাজারের গোটা টিমটাই আমাকে জড়িয়ে ধরছে, পিঠ চাপড়াচ্ছে। গ্যালারি থেকে কে একজন চিৎকার করে ঠাট্টা করল, ”হয়েছে রে হয়েছে, এবার সেন্টার কর, যেন শিল্ড পাবার গোল দিয়েছিস!” শুনে আমি খুব লজ্জা পেলাম।
দু’ মিনিটের মধ্যেই রাইট উইং—এর ক্রস সেন্টার থেকে সুভাষ হেড করে গোল করল। পরের মিনিটেই আবার একটা একইভাবে হেড করে। হাফ টাইম—এর সময় বিপিনদা এসে উত্তেজিতভাবে আমায় নির্দেশ দিলেন, ”নামবে না তুমি, একদম নামবে না সেন্টার লাইনের এধারে। গোল খাই খাব, তুমি উঠে থাকবে। আর রতন, তুই শুধু বল বাড়াবি।”
রতন হচ্ছে সেই ছেলেটি, প্রথম দিনে যার নাক ফাটতে দেখেছি প্র্যাকটিসের সময়, আর যাকে বিপিনদা একটা চাকরি দেবেন বলেছেন। রতন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তার ক্লান্ত শরীরটা মাটিতে শুইয়ে চোখ বুজল।
একটা অ্যালুমিনিয়ামের গেলাশ আর এক বালতি জল। একজন জল খেয়ে গেলাশটা আর একজনের হাতে দিচ্ছে, সে বালতিতে ডুবিয়ে জল তুলে খাচ্ছে। গেলাশের জন্য অপেক্ষা করছি, তখন টিকাদার বলল, ”খাওয়াচ্ছিস তো আজ!”
”কেন?” বিরক্ত হয়ে বললাম।
”সিজনে শোভাবাজারের প্রথম গোল স্কোর করলি!”
আমি ফিকে হেসে জলের গেলাশের জন্য হাত বাড়ালাম। টিকাদার বলল, ”টিমে আমার জায়গাটা তো খেলি, কমপেনসেট করবি না?”
শুনে আমার ভালই লাগল। বললাম, ”আজ নয়, আর একদিন।”
মাঠে নামবার আগে একবার গ্যালারির দিকে তাকালাম। একেবারে মাথায় এক কোণে কুঁজো হয়ে নিমাই বসে। ওকে আমরা টেন্টের মধ্যে শুইয়ে রেখে বেরিয়েছিলাম। আমায় তাকাতে দেখে চট করে ও হাত তুলল। দেখলাম হাতের আগায় তিনটে আঙুল উঠে রয়েছে।
সুভাষের হ্যাট্রিকের জন্য চেষ্টা করতে গিয়ে ওরা আরও দুটো গোল নষ্ট করার পর সুকল্যাণ হঠাৎ একটা গোল করে মুষড়ে পড়ল। ও বুঝতেই পারেনি পনেরো গজ দূর থেকে মারা বলটা বিনা বাধায় গোলে ঢুকে যাবে। সুভাষ বাঁ হাতের তালুতে ডান হাতের ঘুষি মেরে রাগে ঘোঁতঘোঁত করতে করতে ফিরে গেল এবং দু’ মিনিটের মধ্যেই আনোয়ারকে ছিটকে ফেলে দিল শোল্ডার চার্জে।
আমার কিন্তু অবাক লাগল রতনকে। বিপিনদার নির্দেশই শুধু নয়, ও যেন নিজের দলের বাকিদের কথাও ভুলে গেছে। বল পেয়ে ও একাই ছুটছে। আমি চেঁচাচ্ছি বলের জন্য, কিন্তু রতন কানেই নেয় না। জিরজিরে বুকটা হাপরের মতন ওঠানামা করছে, চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসছে, মুখ লাল, ঘাম গড়াচ্ছে রগ বেয়ে থুতনি পর্যন্ত। তবু রতন তাড়া করছে, বল ধরে আবার একাই এগোচ্ছে এবং যথারীতি ওর পা থেকে বল ওরা কেড়ে নিচ্ছে। কিছু যেন ভর করেছে ওকে, সারা মাঠ চষছে, কিন্তু বোকার মতন, অযথা। আমি অধৈর্য, বিরক্ত হয়ে পড়ছিলাম। মাঠের বাইরে থেকে বিপিনদার চিৎকার কানে এল, ”বল ছাড়, রতন! বল ছাড়, প্রসূনকে দে!”
রতন বল ছাড়ার বদলে নিজেই মাঠ ছাড়ল। পায়ে পা জড়িয়ে পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারছিল না। দু—তিনজনে ওকে ধরে মাঠের বাইরে রেখে এল আর ওর জায়গায় নামল টিকাদার। তার পরই রাজস্থান পেনালটি পেল। ওদের লেফট আউট আমাদের দুজনকে কাটিয়ে গোল পোস্টের কাছে এসে ব্যাক সেন্টার করতে যাবে, টিকাদার তার পেটে লাথি মারল। পেনালটি থেকে গোলটা করল সুভাষ।
৪—১ গোলে এগিয়ে থেকে ওরা এবার একটু আলগা দিল। আমি দু’বার বল পেয়েও কিছু করতে পারলাম না। রাইট উইং—এর একটা ক্রস পাস ভলি মেরে বারের উপর দিয়ে পাঠালাম। আর একবার দুজনকে কাটিয়ে সামনেই পড়ল ফেন। পাশে কেউ নেই যে ওয়াল করব। তাড়াতাড়ি পেনালটি বক্সের মাথা থেকেই গোলে মারলাম, অরুণ আঙুলের ডগা দিয়ে বলটা তুলে বারের ওপারে পাঠিয়ে দিল।
আমার তখন নিমাইয়ের কথা মনে হল। নিমাই থাকলে, ওকে বলটা ঠেলেই ডান দিকের পোস্ট—এর পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণ বরাবর আমার জায়গায় চলে যেতাম। নিমাই ঠিক বলটা পাঠিয়ে দিত আমার এক গজ সামনে। তার পর শরীরটাকে বাঁ দিকে একটু হেলিয়ে ডান পা—টাকে পিছনে এক ফুট তুলে বিদ্যুৎ গতিতে একটি ছোবল।
খেলার শেষ বাঁশি বাজার পর মাঠেই আনোয়ার আর টিকাদারের মধ্যে একটা খণ্ডযুদ্ধ প্রায় বেধে যাচ্ছিল। কারণ সেই পেনালটি। আনোয়ারের মতে, টিকাদার অযথা গোল খাইয়েছে লাথিটা মেরে। লেফট আউট ব্যাক—সেন্টার করতই, কিন্তু তা থেকে গোল নাও হতে পারত, চান্স পাওয়া যেত ক্লিয়ার করার। কিন্তু পেনালটি করিয়ে টিকাদার রাজস্থানকেই শিওর চান্স করিয়ে দিয়েছে।
জবাবে টিকাদার কতকগুলো অশ্রাব্য শব্দ উচ্চচারণ করল, তখন আনোয়ার তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। টিকাদার ভয়ংকর চোখে আনোয়ারের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে, দাঁত চেপে ‘আচ্ছা, দেখা যাবে—’ বলে মাঠ থেকে বেরিয়ে এল।
নিমাই গ্যালারি থেকে নেমে এসেছে। বিপিনদা আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘বেশ, বেশ, ভালই খেলেছ।’ রতন আমার দিকে অদ্ভুত চোখে একবার তাকাল। কেমন বিষণ্ণতা আর ভয় ওর চাহনিতে। দুটো টোস্ট আর একটা সিদ্ধ ডিম খেয়ে যখন আমরা তিনজন বাড়ির পথে রওনা হচ্ছি, রতন ইশারায় আমাকে ডাকল।
”তুমি গরিব ঘরের ছেলে, আমিও তাই”, রতন ভারী এবং স্থির স্বরে বলল, ”এখানে টাকা দেয় না, সুতরাং তুমি নিশ্চয়ই পরের বছর অন্য ক্লাবে যাবে। যাবেই, আমি জানি। তোমার খেলা আছে, তুমি এখানে পচে মরবে কেন!”
আমি চুপ করে রইলাম। রতন আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, ”একটা চাকরি দেবেন বলেছেন বিপিনদা।”
আমি মাথা ঝুঁকিয়ে বললাম, ”জানি।”
”তুমি যদি চাকরি চাও, তা হলে বিপিনদা আগে তোমার জন্যই চেষ্টা করবেন। আমি জানি, আজ তোমার খেলা দেখে বুঝতে পেরেছি।” রতনের স্বর হঠাৎ করুণ দুর্বল হয়ে এল। কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে আমার হাতটাও চেপে ধরল, ”চাকরিটা আমার দরকার! আমার বাড়িতে ভীষণ খারাপ অবস্থা, আমার আগে চাকরিটা দরকার, প্রসূন। কথা দাও, তুমি এখানে কিছু চাইবে না। কথা দাও, তুমি এখানে সামনের বছর থাকবে না।”
আমি ওর চোখের দিকে তাকাতে পারলাম না। অন্য দিকে তাকিয়ে বললাম, ”আমি এখানে থাকতে আসিনি। আরও বড় হতে চাই। বড় ক্লাবে যেতে চাই।”
রতন যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। হাতে চাপ দিয়ে বলল, ”কোথায় যেতে চাও, আমার অনেক চেনা আছে। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, এরিয়ান, যুগের যাত্রী?”
”মোহনবাগানে।”
”এখনই? না, আর একটা বছর অন্তত কোথাও কাটাও। তুমি এখনও নেহাতই জুনিয়ার। এখনই অত বড় ক্লাবে যেয়ো না, বসিয়ে রাখবে। এখন একটা বছর নষ্ট হওয়া মানে ভীষণ ক্ষতি। দেখছ না, আমার অবস্থা। লোভে পড়ে বড় ক্লাবে একদিন আমিও গেছলুম। বসিয়ে রেখে দিল। বড় ক্লাবের মোহ ছাড়তে পারলুম না। আশায় আশায় পরের বছরও রইলুম। একটা মাত্র ম্যাচ খেলালে। তাও আধখানা। তার পর উয়াড়ি, তার পর এখানে। আমারও ইচ্ছে ছিল তোমার মতন—আরও বড় হব।”
রতনের স্বর মৃদু হতে হতে গড়ের মাঠের আবছা সন্ধ্যার সঙ্গে মিশে গেল। আমার মনটা ভারী হয়ে উঠল, মাথা নামিয়ে চুপ রইলাম। রতন গাঢ় স্বরে বলল, ”আজ আমি খেলেছি ভয় পেয়ে। তুমি ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। টিমে আমার পোজিশন বোধ হয় গেল, এই চিন্তাই শুধু মাথায় ঘুরছিল। কিছু মনে কোরো না!” ও আমার হাতে চাপ দিল। আমি মাথা নাড়লাম।
রতন গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ”তুমি গোল দাও, অনেক গোল দাও, বড় ক্লাবে যাও। আর শরীরের যত্ন কোরো। আরও ওজন বাড়াতে হবে, আরও খাটতে হবে তোমায়; এজন্য স্বার্থপর হতে হবে, বাড়ির জন্য ভেবে উপোস দিয়ো না, বরং অন্যের মুখের গ্রাস কেড়ে খাবে। গরিবদের নিষ্ঠুর হতে হবে যদি বড় হতে চায়, নয়তো আমার মতন হবে; এই রকম স্বাস্থ্য নিয়ে কি বড় ফুটবলার হওয়া যায়? প্রসূন, দয়ামায়া মমতা বড় ভয়ংকর শত্রু।”
রতন আচমকাই আমাকে ফেলে রেখে টেন্টের মধ্যে চলে গেল। আনোয়ার আর নিমাই অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছিল। কাছে আসতেই ওরা জানতে চাইল, কী কথা হচ্ছিল। আমার মন ভারী বিষণ্ণ হয়ে গেছিল। বললাম, ”পরে বলব। এমন কিছু সিরিয়াস কথা নয়।” তার পর কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বললাম, ”হ্যাট্রিক হল না রে, নিমাই।”
”খেলা দেখতে দেখতে ইচ্ছে করছিল রাজস্থানের দিকে নেমে পড়ি। শিওর তা হলে সুভাষের হ্যাট্রিক করিয়ে দিতাম।” নিমাই খুব গম্ভীর হয়ে বলল, ”কীরকম ডিফেনস ভেঙে ঢোকে দেখেছিস?”
কথাটা আনোয়ারের গায়ে লাগল। তাচ্ছিল্যভরে বলল, ”দেখেছি, সব তো এক—ঠেঙে। শুধু স্পিড আর শট ছাড়া আছেটা কী? হাবিবকে ওয়াচ করিস। কীরকম ওঠানামা করে, অন্যকে খেলায়, স্পেস কভার করে, কী দারুণ রোখ নিয়ে বিপদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে।”
নিমাই আর কথা বলল না। বাসে ওঠার আগে আমি ওদের বললাম, ”কিন্তু সামনের বছর অন্য ক্লাব দেখতে হবে। এখানে আর নয়।”
.
।।৯।।
বিপিনদা কীভাবে যেন জানতে পারলেন, সামনের বছর আমরা তিনজনই শোভাবাজার ইউনিয়ন ছাড়ব ঠিক করেছি। তিনি আমাদের তিনজনকেই একদিন আড়ালে ডেকে বললেন, ”তোদের জুনিয়ার বেঙ্গলে খেলাব, সামনের বছরটা থেকে যা।”
আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। কেউ কথা বললাম না। ভিতরে একটা অস্বস্তি শুরু হল, কেননা আমরা জানি বিপিনদা তা পারেন। আই.এফ.এ—তে শোভাবাজারের সেক্রেটারি পরিমল ভটচাজের একটা দল আছে, যারা সব কটা কমিটি দখল করে আছে। তারাই শলা—পরামর্শ করে লিগে ওঠা—নামা বন্ধ করিয়েছে গভর্নিং বডির মিটিং—এ। এতে তাদের বড় লাভ—ফুটবল লিগে প্লেয়ারদের জন্য যে খরচ করতে হত, সেটা আর করতে হল না। কেউ টাকা চাইলেই তারা এখন বলে দিতে পারে—গেট খোলা আছে, বেরিয়ে যাও। আমরা রাস্তা থেকে এগারোটা ছেলে ধরে এনে খেলাব। সব ম্যাচ হারলেও, একটা পয়েন্ট না পেলেও কিছু আসে—যায় না, ওঠা—নামা তো বন্ধ।
সত্যি বলতে কী, অবস্থাটা এই রকম না হলে আমাদের মতন আনকোরা উটকো তিনজন ফার্স্ট ডিভিশনে খেলার সুযোগ এত তাড়াতাড়ি পেতাম কি না সন্দেহ। প্রতি বছরই শোভাবাজারের অন্তত দু—তিনজন জুনিয়ার বেঙ্গল টিমে থাকে জুনিয়ার ন্যাশনাল চ্যামপিয়নশিপে। জুনিয়ার ইন্ডিয়া টিমেও দুজন ছিল গত বছর।
”বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি আমার কথা?” বিপিনদা খুব গম্ভীর হয়ে বললেন।
”না—না, তা কেন, তবে—” নিমাই আমাদের মুখপাত্র হয়ে বলল।
”তবে কী? টাকা চাই, চাকরি চাই?”
”না, তা নয়, বড় ক্লাবে খেলার ইচ্ছে তো সকলেরই থাকে।” নিমাই বলল।
”জুনিয়ার বেঙ্গল, জুনিয়ার ইন্ডিয়া, এর থেকেও বড় ক্লাব আর কী আছে! আগে এসব ছাপ নিয়ে নে, তখন দেখবি, বড় ক্লাব তোদের বাড়িতে গিয়ে সাধাসাধি করবে।”
বলতে ইচ্ছে করল, অমন গণ্ডা গণ্ডা ইন্ডিয়া ছাপ মারা প্লেয়ার ময়দানে ঘুরে বেড়াচ্ছে, প্লেয়ার তো মাত্র দু—তিনজন হতে পেরেছে। কিন্তু এসব কথা এখন বলে কোনও লাভ নেই, তাতে তিক্ততাই শুধু বাড়বে। তাই বললাম, ”বিপিনদা, আমরা ভাল করে খেলা শিখতে চাই, ভাল প্লেয়ারদের পাশে থেকে খেলতে চাই। দেখছেন না, প্রত্যেকটা ম্যাচে নিমাই—আনোয়ারের অবস্থা, আমার অবস্থা। কেউ সামলাতে পারে না, আটকাতে পারে না, একটা পাস দিতে পারে না ঠিকমতো, দম নেই, স্কিল নেই, বুদ্ধি নেই। এখানে আমি উৎসাহ পাই না। একা একা কি ফুটবল খেলা যায়?”
বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। গলা চড়ে গেল। নিমাই আর আনোয়ার আমার কথার সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নেড়ে সায় দিচ্ছিল।
বিপিনদার মুখ থমথমে হয়ে উঠল। ”তোরা ক্লাব ছাড়লে পরিমলদা চটবে। ওকে চটিয়ে পারবি উঁচুতে উঠতে? প্রত্যেকটা ক্লাব ওকে ভয় করে। ইন্ডিয়া টিমে তোদের খেলা বন্ধ করে দিতে পারে, যতই তোরা ভাল খেলিস না কেন। আর, তারই ক্লাবে তোরা খেলবি না, রিকোয়েস্ট সত্ত্বেও?”
আমরা আবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম।
আমরা যে দ্বিধায় পড়েছি বিপিনদা বোধ হয় সেটা বুঝতে পারলেন। ”একটা বছর থেকে যা। সামনের বছর সম্ভবত আবার প্রমোশন রেলিগেশন চালু হবে। আমাদের ক্লাবের অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছিস, কয়েকটা মাত্র মেম্বার, আই—এফ—এর ডোনেশনে কি সারা বছর এতগুলো খেলা চলে? এর—ওর কাছে ভিক্ষে করেই চালাতে হয়। তবু কথা দিচ্ছি, সামনের বছর প্রথম কিছু কিছু হাত— খরচা দেবার চেষ্টা করব। থেকে যা তোরা। শোভাবাজারই তোদের প্রথম ফার্স্ট ডিভিশনে খেলিয়েছে, এটা ভুলে যাসনি। তোরা বড় হবি, ফেমাস হবি—এটা কি আমরাও চাই না? তখন কি আমরাও গর্ব করব না?”
বিপিনদাকে অত্যন্ত করুণ দেখাচ্ছে। গলার স্বর গাঢ় আর ভিজে। ভিতরে ভিতরে আমরা বিচলিত হয়ে পড়ছি। পরিমল ভটচাজকে আমরা চোখে দেখেছি মাত্র, আর ওঁর সম্পর্কে শুনেছি অনেক কথা। নিজের স্বার্থ আর ক্ষমতা রক্ষার জন্য উনি যাবতীয় অপকর্ম করতে পারেন ও করেন। যে কোনও ফুটবলারের কেরিয়ার খতম করা ওঁর পক্ষে অতি সামান্য ব্যাপার। বিপিনদা সে সম্পর্কে প্রচ্ছন্ন একটা হুমকিও দিলেন।
নিমাই হঠাৎ বলল, ”আচ্ছা, আমরা দু দিন ভেবে আপনাকে জানাব।”
বিপিনদা আমাদের তিনজনের মুখের দিকে পর পর তাকিয়ে ঘাড় নাড়লেন।
.
আমি হর্ষদার কাছে গেলাম। ছাদে গোটা কুড়ি টবের মাঝে উবু হয়ে হর্ষদা ফুলগাছের পরিচর্যা করছিলেন। আমার কথা শুনতে শুনতে উনি টবের মাটি খুঁড়ে যাচ্ছিলেন একটা শিক দিয়ে। অনেকক্ষণ কথা বললেন না। একটা গোলাপের শুকনো মরা ডাল গাছ থেকে সাবধানে ভেঙে নিয়ে হর্ষদা মৃদু স্বরে বললেন, ”তোর ইচ্ছেটা কী?”
”আমি এখনও ঠিক করতে পারিনি ক্লাব বদল করব কি করব না। নিমাই—আনোয়ারেরও আমার মতন দোটানা অবস্থা। ওরা একবার বলছে, থেকেই যাই, একটা বছর তো! আবার বলছে, ধ্যুত, একটা বছর স্রেফ অযথা নষ্ট করা।”
”প্রসূন, এখন তোর সামনে চ্যালেঞ্জ, নিবি কি নিবি না, সেটা তুই—ই ঠিক কর।”
আমি শক্ত হয়ে গেলাম, হর্ষদার গলার স্বর অত্যন্ত ঠাণ্ডা অথচ দৃঢ়। আমি চুপ করে রইলাম মরা গোলাপ ডালটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। হর্ষদা তা লক্ষ করে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। ”ডালটা মরে গেছে, কিন্তু গাছটা দ্যাখ কেমন জীবন্ত। অন্য ডালে কতগুলো কুঁড়িও ধরেছে। এরকম হয়, সর্বক্ষেত্রেই হয়। মানুষ বেড়ে ওঠে আর ফেলে যায় তার মরা ডালপালা। নতুন ডালে ফুল ফোটায়। এজন্য পরিচর্যা চাই। সার, জল, রোদের তাপ তাকে দিতে হয়। শিকড় থেকে পাতার মধ্যে দিয়ে সে প্রাণশক্তি আহরণ করে। যদি শিকড় নষ্ট হয়, পরিচর্যা না পায়, তা হলে বাড়তে পারে না। মানুষের শিকড় তার চরিত্র। তুই যদি অনুগ্রহ নিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে বড় হতে চাস তো তোর শিকড় পচে যাবে। এই গাছটা বেড়েছে ফাইট করে। আমি একে হেলপ করেছি মাত্র। মানুষ হেলপ নাও পেতে পারে, তখন নিজেকে নিজে হেলপ করতে হয়। যার চরিত্র পচে গেছে, সে পারে না। হেরে যায়, নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। চ্যালেঞ্জ নানা রকম চেহারা নিয়ে আসে, আর মানুষকে তার মোকাবিলা করতে হয়।”
শুনতে শুনতে টের পেলাম সারা শরীরে কলকল শব্দে রক্ত ছুটছে, আর দূর থেকে ভেসে আসা অস্পষ্ট একটা স্বরের মতন আমার বুকের মধ্যে ঢেউ উঠছে। সেই ঢেউয়ের চুড়োয় দাঁড়িয়ে কে যেন বলছে, ”স্ট্রাইকার! স্ট্রাইকার! তোমার সামনে দুর্ভেদ্য ডিফেনস। ভাঙতে কি পারবে না?”
আমি মাথা নামিয়ে নিজেকে শুনিয়ে বললাম, ”পারব।”
হর্ষদা অবাক হয়ে একবার তাকালেন, তার পর মরা ডালটা ছুড়ে ফেলে বললেন, ”মনে আছে, তোকে হেমিংওয়ের একটা গল্প একবার বলেছিলাম—ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি! তাতে এক জায়গায় আছে, ম্যান ক্যান বি ডিফিটেড, বাট… তুই লেখাপড়া শিখলি না কেন রে প্রসূন? তা হলে ইংরিজিতেই বইটা নিজে পড়তে পারতিস। মুখে বললে অনেক কিছু যে নষ্ট হয়ে যায়।”
”আমার মনে আছে হর্ষদা, মানুষকে হারানো যেতে পারে, কিন্তু ধ্বংস করা যেতে পারে না, তাই না?” এই বলে আমি আর সেখানে থাকিনি।
।।১০।।
রাস্তায় বেরিয়ে এলোমেলো হাঁটতে শুরু করি। একা প্রায় ঘণ্টাখানেক আমি হাঁটি। অনেক চেনা ছেলের সঙ্গে দেখা হল, কিন্তু আমি তাদের দেখতে পেলাম না। তারা চোখের উপর দিয়ে ভেসে গেল। অনেকে ডাকল, আমি শুনতে পেলাম না। ভূতে পাওয়ার মতন আমি শুধু হাঁটলাম। আর হর্ষদার কথাটা আওড়ালাম মনে মনে, ”এখন তোর সামনে চ্যালেঞ্জ, নিবি কি নিবি না, সেটা তুই ঠিক কর।”
”অ্যাই প্রসূন, দেখতেই পাচ্ছ না যে।” থমকে দাঁড়ালাম। নীলিমা সামনে দাঁড়িয়ে ভ্রূ কুঁচকে। কোমরে হাত, চোখে বিস্ময়।
”বাব্বাঃ, খবরের কাগজে নাম বেরোয়, তাতেই এই—ছবি বেরোলে কী হবে?”
লজ্জা পেয়ে আমতা আমতা করে বললাম, ”যাঃ, ও রকম নাম গণ্ডা গণ্ডা লোকের রোজই বেরোয়। শোভাবাজার ইউনিয়নের প্লেয়ারের আবার নাম! সত্যি বলছি, দেখতে পাইনি তোমায়। কোথায় গেছিলে? বাড়ি যাচ্ছ এখন?”
লজ্জাটা কাটিয়ে ওঠার জন্য এলোপাথাড়ি প্রশ্ন করলাম, প্রেশারে পড়ে গ্যালারিতে বল ওড়ানোর মতন।
নীলিমা এবার সত্যিই অবাক হয়ে বলল, ”সে কী, এই সময়ে টিউশনি থেকে রোজ ফিরি, তা ভুলে গেছ? কী ব্যাপার, বলো তো? হাত তুলে দাঁড়াতে বললাম, দাঁড়ালে না। একমনে চলেছ তো চলেছই। কথা বলছ, যেন এই মাত্র পরিচয় হল। উঃ, হয়েছে কী?”
”একটা ব্যাপারে মুশকিলে পড়ে গেছি, সেটা নিয়েই চিন্তা করছিলুম। হর্ষদার বাড়ি থেকে ফিরছি। চলো একটু হাঁটা যাক।”
আমরা দুজনে মন্থরগতিতে হাঁটতে শুরু করলাম। কেউ কথা বলছি না। নীলিমা গম্ভীর হলে গিন্নিবান্নি দেখায়। মা—মরা সংসার দু বছর ধরে চালাতে চালাতে ও রীতিমতো ভারিক্কি হয়ে গেছে। নানান দিক ভেবেচিন্তে বাবার সামান্য আয় আর নিজের টিউশনির টাকায় ওকে সংসার চালাতে হয়। তার উপর নিজের স্কুলের পড়া আছে।
হর্ষদার কথাগুলো মনে পড়ছে আর যেন গায়ে ছ্যাঁকা লাগছে—’যার চরিত্র পচে গেছে, সে পারে না!’ ‘মানুষের শিকড় তার চরিত্র!’ ‘চ্যালেঞ্জ নানা রকম চেহারা নিয়ে আসে!’ ব্যাপার কী! এইসব ভাল ভাল কথা দিয়ে আমি কী করব? ফুটবল, ক্লাব বদল, বেঙ্গল কী ইন্ডিয়া টিমে খেলার সঙ্গে এগুলির কী সম্পর্ক? আমার স্কিল, স্পিড, ড্রিবলিং, স্ট্যামিনা, বুদ্ধি দিয়ে খেলব—এ সবের সঙ্গে চরিত্রের যোগ কোথায়? ভিতরে ভিতরে ছটফট করে উঠলাম এক অসহ্য অসহায়তায়। ধরতে পারছি না আমার অপোনেন্ট যে কে, কী যে তার স্ট্র্যাটেজি, বুঝতে পারছি না।
হালকা হবার জন্যই কথা শুরু করলাম, ”টিউশনি থেকে আসছ বুঝি?”
”না, এক পাবলিশারের কাছে গেছিলাম। প্রুফ দেখার কাজ শিখছি, বাবাই ঠিক করে দিয়েছেন।”
”অনেক টাকা পাওয়া যায়?”
নীলিমা মাথা হেলিয়ে পিছন থেকে বেণীটা সামনে টেনে আনল। বেণীর গোড়ার আলগা চুলগুলো আঙুলে জড়াতে জড়াতে বলল, ”অনেক, এক লক্ষ, দু লক্ষ টাকা।”
”ঠাট্টা করছ!”
”মোটেই না। কষ্ট করে সৎভাবে রোজগার করা একটা টাকা আমার কাছে এক লক্ষ টাকার সমান।”
”আমি এখনও রোজগার করতে পারলাম না। বাড়িতে একটা পয়সাও দিই না।” আমি হাসবার চেষ্টা করলাম। নীলিমাও আমার মতন হাসল।
”ফুটবল খেলে তো হাজার হাজার টাকা বছরে পাওয়া যায় শুনেছি। এটাও তো এক রকমের কাজ। যেমন অফিসে, স্কুলে, কলেজে, কারখানায় লোকে কাজ করে। ফুটবলারকে তো ওদের মতনই শিখতে হয়?” নীলিমা আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।
”নিশ্চয়। আমি তো শিখতেই চাই।” এক মুহূর্ত ভেবে আবার বললাম, ”জানো, এখন যে ক্লাবে খেলছি, সেখানে কিছুই শিখতে পারি না। ওরা আর এক বছর থাকতে বলছে। তা হলে কিছু টাকা দেবে, জুনিয়ার বেঙ্গল টিমে খেলিয়ে দেবে, এমনকী ইন্ডিয়া টিমেও। কী যে করি, ভেবে পাচ্ছি না। যদি ওদের কথা না শুনি, তা হলে এসব খেলা বন্ধ করে দেবে। শোভাবাজারের পরিমল ভটচাজের ভীষণ ইনফ্লুয়েন্স অল ইন্ডিয়ায়। ওকে চটিয়ে কোনও ফুটবলার বড় হতে পারে না।”
নীলিমা কিছুক্ষণ কথা বলল না। দেখে মনে হল গভীরভাবে ভাবছে। আমি আবার বললাম, ”হর্ষদা বললেন, এটা একটা চ্যালেঞ্জ।”
”আর কী বললেন?”
ইতস্তত করে বললাম, ”গাছ বেড়ে ওঠে শিকড়ের গুণে। শিকড় হচ্ছে চরিত্র, পচে গেলেই মানুষ মরে যায়।”
নীলিমা রাস্তার উপর থমকে ঘুরে দাঁড়াল। ”প্রসূন, যারা চ্যালেঞ্জ নিয়ে বড় হতে পারে না, তারা বড় হবার যোগ্য নয়। প্রসূন, শিক্ষায় যে ফাঁকি দেয় না, সেই একমাত্র বড় হতে পারে। বড় হতে পারে না কাপুরুষেরা। তুমি কি কাপুরুষ, তুমি কি পরিশ্রমে অনিচ্ছুক?”
”না, তবে সব কিছুতেই ভাগ্য লাগে। পেলে—গ্যারিনচা থাকা সত্ত্বেও ব্রাজিল তো হেরেছে।”
”জানি না কে পেলে কে গ্যারিনচা, কেমন তারা খেলে, কিন্তু তাদের পালটা টিমেও তো ভাল প্লেয়ার থাকতে পারে! জ্যাঠামশায়ের ভাগ্য খারাপ, তাই পা নষ্ট করে অপমানিত হয়ে ফুটবল থেকে বিদায় নিয়েছেন। তোমার ভাগ্যে তা নাও হতে পারে। তা ছাড়া, তোমার উচিত নয় কি বাবার অপমানের শোধ নেওয়া? যারা একদিন তাঁর মুখে থুথু দিয়েছিল, তাদেরই সেই থুথু চাটতে বাধ্য করা? বড় প্লেয়ার না হলে, বড় কিছু একটা না করলে তা পারবে কী করে? কাউকে খুশি করে ইন্ডিয়া টিমে খেলতে পারো, কিন্তু বড় প্লেয়ার হতে পারো না।”
আমি শুধু তাকিয়ে রইলাম বড় বড় চোখ দুটোর দিকে। যে পাষাণ ভারটা চেপে বসেছিল বুকে, সেটা সরে যাচ্ছে। হালকা ঝরঝরে লাগছে নিজেকে। বাবা, আমার বাবা গভীর মর্যাদাবান এক অপমানিত ফুটবলার। ফুটবলকে, হাজার হাজার দর্শককে, তাঁর ক্লাব যুগের যাত্রীকে দিয়েছেন অনেক কিছু, বদলে কিছুই পাননি। দিন—রাত এখন সংসারটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন চাবুক খাওয়া বলদের মতন। বাবা, আমার বাবা ক্লান্ত নিঃসঙ্গ অপমানিত এক ফুটবলার। আর আমি তাঁর স্বার্থপর ছেলে।
”নীলিমা, তুমি আমার বাবাকে ভালবাসো! নিমাই আর আনোয়ার বাদে তুমি আর মা—ই আমার সব থেকে বড় বন্ধু।”
নীলিমা শোনামাত্র মুখ লাল করে মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, ”হয়েছে হয়েছে, ধার দেবার মতন পয়সা এখন আমার হাতে নেই।”
”একটা চানাচুরের দোকান পর্যন্ত যাবার ক্ষমতাও কি তোমার ব্যাগটার নেই?”
.
।।১১।।
মোহনবাগানের সঙ্গে খেলাটার জন্য ছটফটিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। আনোয়ার—নিমাইকে আমি জানিয়ে দিয়েছি, সামনের বছর ক্লাব বদল করবই। ওরা আমাকে অনেক বুঝিয়েছে, কিন্তু আমি ঘাড় নেড়ে গেছি গোঁয়ারের মতন। আমি বলেছি, বড় প্লেয়ার হতে চাই, আর কিছু নয়। সেজন্য যত ঝুঁকি নিতে হয়, নেব। ওরা শুনে চুপ করে থেকেছে।
শনিবার মোহনবাগানের সঙ্গে খেলা আমার জীবনের প্রথম বড় ম্যাচ। প্রথম খেলা। বছরে দু—তিনবার মাত্র আমাদের মতন ছোট ক্লাবের জীবনে এত লোকের সামনে খেলার, চোখে পড়ার, খবরের কাগজে দু—এক লাইন উল্লেখ পাওয়ার সুযোগ আসে। আগের ম্যাচে জর্জ টেলিগ্রাফ দু’ গোলে হেরেছে, দুটোই আমার দেওয়া গোল।
শুক্রবার ক্লাবে এসে নোটিশ বোর্ডে তাকালাম। প্লেয়ারস লিস্ট টাঙানো রয়েছে। সোজা দশ নম্বরে চোখ রাখলাম। এ কী! এস দত্ত কেন? সাধন দত্ত কেন? সাধন, সেই লম্বা সাধন, যে বলে কিক করলেই মাটির চাপড়া ওঠে, কেউ চার্জ করতে এলে বল জমা দিয়ে দেয়। আমার নাম কোথায়? লিস্টের গোড়া থেকে চোখ বুলিয়ে আস্তে আস্তে পাথর হয়ে গেলাম। নিমাই আর আনোয়ারের নাম আছে।
বিপিনদার কাছে গেলাম। গম্ভীর মুখে উনি বললেন, ”ওরা আমার রিকোয়েস্ট রাখবে বলেছে। ওরা নেমকহারাম নয়।”
শোভাবাজার টেন্টটা আমার পায়ের নীচে কাঁপতে শুরু করেছে। আঘাত এসেছে। বুকের মধ্যে কে বলে উঠল, ‘প্রসূন, এইবার তুমি মাঠে নেমেছ। প্রথম গোল খেয়েছ। স্ট্রাইকার, বি রেডি, শোধ দিতে হবে। তার পরেও উইনিং গোল দেওয়া চাই, চাই—ই!’
পরদিন আমরা ৬—০ গোলে হারলাম। গ্যালারিতে বসেছিলাম। খেলা শেষে নিমাই আর আনোয়ার আমায় দেখে ফ্যাকাশে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল।
তারপর শোভাবাজার ইউনিয়ন টেন্টে আর যাইনি।
ভি আই পি রোডে হর্ষদার এক বন্ধুর বিরাট মোটর সারভিসিং ও পেট্রল ফিলিং স্টেশন। সেখানে তিনি আমাকে কাজ ঠিক করে দিলেন। সারভিসিং—এর জন্য নানান যন্ত্রপাতি—এয়ার কমপ্রেশার, ন্যুম্যাটিক গ্রিজ ও মোবিল পামপ, হাইড্রলিক লিফট, ওয়াটার কমপ্রেশার, গ্রিজ ও ওয়াটার গান ইত্যাদি নিয়ে আলাদা বিভাগ। দৈনিক আড়াই টাকা মজুরিতে আমি মেট নিযুক্ত হলাম।
আমার কাজ সকাল আটটায় শুরু। ‘H’ আকৃতির লিফটের উপর মোটরটা প্রথমে ওঠানো হত। তার তলায় দাঁড়িয়ে একটা লোহার খুন্তি দিয়ে মাড—গারড আর শ্যাশি থেকে শুকনো কাদা চেঁছে ফেলে ওয়াটার গান দিয়ে ধুয়ে দেওয়ার কাজ আমাকে দেওয়া হয়। হেড মেকানিক মধু সাহা খুঁটিয়ে আমার কাজ লক্ষ করে তফাতে দাঁড়িয়ে। মাথায় একটা নীল টুপি আর নাকে ন্যাকড়া বেঁধে বেশ ভয়ে ভয়েই কাজ করি। মাঝে মাঝে মধু সাহা আঙুল তুলে হুঙ্কার দেয়, ”ওই যে, ওই যে রয়ে গেছে, ডিফারেনশিয়াল বক্সের তলাতে… দ্যাখ, চোখ দিয়ে টাই—রডটার জয়েন্টটা দ্যাখ।”
এখন সকালের প্র্যাকটিস প্রায় বন্ধই। আমার ছটফটানি শুরু হয়ে গেল। ভোরে উঠে পাঁচ মাইল দৌড়ে আর আধ ঘণ্টা বল নিয়ে কসরত করে কাজে যাই। কিন্তু এইটুকুতে ভাল প্র্যাকটিস তো হয়ই না, উপরন্তু কাজের সময় ক্লান্তি লাগে। মধু সাহার দাঁতখিঁচুনি শুনতে হয়। পাঁচটায় ছুটির পর বলে তো আর পা দিতে ইচ্ছে করে না। আমি রীতিমতো ভাবনায় পড়ে গেলাম। এখানে চাকরি করলে আমার ফুটবল খেলা উচ্ছন্নে যাবে, তাতে সন্দেহ নেই। তবে গাড়িতে পামপ থেকে ডিজেল বা পেট্রল ভরে দেবার কাজটায় অনেক খাটুনি কম। যদি ওই কাজে বদলি করে দেয়, আর রাতের শিফটে, তা হলে সারা দিন সময় পাব। রাতে শুনেছি ঘুমোনোও যায়। যার তেল দরকার সে হাঁকাহাঁকি করে ডেকে তোলে।
হর্ষদাকে অসুবিধার কথা বললাম। শুনে বললেন, ‘আচ্ছা।” দু’দিন পরে মালিক শিশিরবাবু তাঁর ঘরে ডেকে পাঠালেন।
”তুমি ফুটবল খেলো?”
”আজ্ঞে হ্যাঁ।” তটস্থ হয়ে বললাম।
”তোমার অসুবিধে হচ্ছে খেলায়?”
”খেলায় নয়, প্র্যাকটিসে। খেলা এখন বন্ধ রেখেছি।”
”কেন বন্ধ?” ভ্রূ তুলে উনি জানতে চাইলেন। আমি ওঁকে সব বললাম। ”আই সি, আই সি!” বলে কলমটা দিয়ে কপালে টোকা দিতে দিতে কী ভাবলেন। তার পর বললেন, ”তুমি রাতেই যখন কাজ করতে চাও, তাই করো কাল থেকে।”
আমি হাঁফ ছাড়লাম।
আই এফ এ শিল্ডের খেলা আরম্ভ হয়ে গেছে। শোভাবাজারের খেলা প্রথম রাউন্ডে বার্নপুর ইউনাইটেডের সঙ্গে। টিকিট কেটে মোহনবাগান মাঠের গ্রিন গ্যালারিতে বসে খেলা দেখলাম। আর একজন মাত্র ছিল পুব দিকের প্রায় বারো হাজার লোক বসার সেই গ্যালারিগুলোয়। খুব অবাক লেগেছিল লোকটিকে দেখে। টিকিট কেটে এই খেলা দেখতেও কেউ আসে! আমার কাছে প্লেয়ারস কার্ড ছিল, কিন্তু আমি চাই না নিমাই বা আনোয়ারের মুখোমুখি হতে। এখনও আমার কাছে ব্যাপারটা ধাঁধার মতন। প্রসূন—নিমাই—আনোয়ার মানেই ‘থ্রি মাসকেটিয়ারস’। বহু টুর্নামেন্টে আমরা ওই নামেই পরিচিত হয়েছিলাম। এক সঙ্গে খেলতাম, বেড়াতাম, আড্ডা দিতাম। গত ছ’—সাত বছরে মনে পড়ে না এমন কোনও দিন যে, আমাদের রোজ না দেখা হয়েছে।
অথচ আমি আলাদা হয়ে গেলাম ওদের থেকে। ছটফট করেছি দেখা করার জন্য, আবার সঙ্গে সঙ্গে ভেবেছি, ওরা আমাকে না জানিয়ে চুপি চুপি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার মানে ওরা আমাকে আর চায় না। আমাদের মধ্যে তফাত ঘটে গেছে। আমার পথে ওরা ফুটবল নিয়ে এগোতে রাজি নয়। এক এক বার মনে হয় ওরাই ঠিক করেছে। উপরে ওঠার মই কেউ এগিয়ে দিলে, তাতে উঠে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ। আমি চাই নিজে মই বানাতে। তফাতটা শুধু এই—আমি পরিশ্রম করতে চাই ওদের থেকে বেশি।
নিমাই বা আনোয়ারও আমার সঙ্গে দেখা করেনি। বোধ হয় ওরা নিজেদের অপরাধী ভাবছে। আমাকে শোভাবাজার ইউনিয়ন বসিয়ে দিল, অথচ ওরা তার প্রতিবাদ করল না। ভাবতেই মনে হল, ভালই করেছে ওরা আমার সঙ্গে দেখা না করে। যদি জিজ্ঞাসা করি, কেন তোরা আমার পক্ষ নিলি না, কেন খেললি, তখন কী জবাব দেবে? তবু মনে মনে আমি আজও কষ্ট পাই ওদের অভাবে। কাজটা পেয়ে তবু কিছুটা ভুলে থাকতে পেরেছি। সকালে চার ঘণ্টা টানা মাঠে আর রাস্তায় খাটবার পর দুপুরে খানিকটা ঘুমোই। বিকেলে একটা ক্লাবে যাই একসারসাইজ করতে। রাতে বারোটার পর কদাচিৎ কোনও গাড়ি আসে। ঘুমোবার জন্য অনেক সময় পাওয়া যায়।
।।১২।।
বার্নপুর ৩—১ গোল জিতল। নিমাই চমৎকার খেলছিল। এখন আর ও থ্রু বাড়ায় না। বুঝে গেছে সেগুলো শুধু নষ্টই হবে। নিজেই বল নিয়ে এগোয়, গোলে মারে। দুজন ওকে পাহারায় রেখেছে, তবুও নিমাই মাঝে মাঝে বেরিয়েছে। একটা গোলও দিয়েছে। কিন্তু ঝরঝরে একটা টিমকে একজন—দুজন কি সামাল দিতে পারে? গোল খেয়েই বার্নপুর শোভাবাজারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে টুঁটি টিপে ধরল। আনোয়ার পর্যন্ত তিনটে ফাউল করল নিরুপায় হয়ে। হাফ টাইমে বার্নপুর ২—১ গোলে জিতছে।
এর পর বলটা একবার বার্নপুরের লেফট হাফের মিস—কিক থেকে উড়ে এসে গ্যালারিতে পড়ে ড্রপ খেতে খেতে গ্যালারির নীচে ঢুকে গেল। বার করার জন্য অগত্যা আমাকেই গ্যালারির ফাঁক দিয়ে গলে নীচে নামতে হল। বলটা কিক করে মাঠে পাঠাব বলে তুলে ধরেছি, দেখি, নিমাই এগিয়ে আসছে বলটা নিতে। আমি বল হাতে দাঁড়িয়ে রইলাম। ও আমাকে চিনতে পারা মাত্র দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি বলটা ছুড়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বললাম, ”ভাল করে খেল।” ওর মুখে একটা যন্ত্রণা ঝিলিক দিয়েই শুকনো হাসিতে রূপান্তরিত হল। এর পর লক্ষ করলাম, নিমাই আর খেলতে পারল না, বা ওর মধ্যে খেলার কোনও ইচ্ছা দেখতে পেলাম না। খেলা শেষ হবার আগেই আমি মাঠ থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম।
অরুণা গ্লাস ফ্যাক্টরির লক আউট সমানে চলেছে। খুব ভোরে কাজ থেকে বাড়ি ফিরি দৌড়ে মাইল পাঁচেক ঘুরে। রাস্তার লোকেরা আমার হাফ প্যান্ট গেঞ্জি কেডস পরা চেহারাটার সঙ্গে এখন যথেষ্ট পরিচিত, কেউ আর তাকায় না। বাড়িতে ঢুকি প্রায় চোরের মতন। বাবা ঘরে বসে পিন্টু আর পুতুলকে পড়ান এই সময়। আমার খুপরিতে ঢুকে ঢাকা খুলে চটপট রুটি ক’খানা শেষ করেই, বলটা নিয়ে বেরিয়ে যাবার পথে রান্নাঘরে মাকে একটা টাকা দিই। আমার নিজের রোজগারের টাকা। দেবার সময় দারুণ একটা আনন্দ হয়। বাকি দেড়টা টাকায় আমি বেছে বেছে এমন জিনিস কিনে খাই, যাতে বেশি ক্যালরি পাওয়া যায়। আমি সিনেমা দেখা বন্ধ করে দিয়েছি। টেরিলিনের জামা প্যান্টের বয়স প্রায় দেড় বছর হল, সেলাই করে চালাচ্ছি। একজোড়া বুট না কিনলেই নয়। দু—তিনজন এসেছিল টুর্নামেন্টে খেলবার জন্য ডাকতে, রাজি হলে বুট কেন, জামা প্যান্টের সমস্যাও মিটে যেত। আমি রাজি হইনি। সকালে যখন বল হাতে মাঠের দিকে যাই, তখন বই খাতা হাতে মেয়েরা স্কুলে—কলেজে যায়, বাচ্চচা ছেলেরা প্রাইমারি স্কুলে। তখন নীলিমার কথাটা মনে পড়ে আর নিজের মনেই বলি: আমিও তো স্কুলে যাচ্ছি। আমার স্কুল মাঠে, আমার বই খাতা এই বলটা।
বাবাকে একদিন সকালে দেখলাম মাথা নিচু করে অন্যমনস্কের মতন কোথায় চলেছেন। আমি আর পাড়ারই কয়েকটি ছেলে, কারখানার মাঠে তখন হেডিং প্র্যাকটিস করছিলাম। একটি ছেলে বলল, ”প্রসূনদা, আপনার বাবা যুগের যাত্রীতে খেলতেন?”
”হ্যাঁ, কোথায় শুনলি?”
”মেজকাকা কাল বলছিলেন, দারুণ নাকি খেলতেন। দু পায়ে টেরিফিক শট!”
”বাবার খেলা আমি দেখিনি। আমি জন্মাবার এক বছর পরই খেলা ছেড়ে দেন।”
লক্ষ করলাম আমার কথা শোনামাত্র দু—তিনজন নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে মুখ টিপে হাসল। প্রথমে বুঝতে পারিনি এর কারণ।
”আপনার বাবা শিল্ড ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে খেলেছিলেন, তাই না?” একজন বলল।
”ওইটেই তো ওঁর জীবনের শেষ খেলা।” আর একজন বলল।
”কাকা বললেন, একবারে ফাঁকা একটা গোল মিস না করলে, ইস্টবেঙ্গল নাকি হেরে যেত। ও রকম গোল নাকি অন্ধেও দিতে পারে।”
”হ্যাঁ, পারে।” আমি বললাম রাগ চাপতে চাপতে ঠাণ্ডা গলায়, ”তোমার কাকা জীবনে কখনও ফুটবল খেলেছেন কি?”
ছেলেটি থতমত হল।
”সম্ভবত খেলেননি।”
”আপনি জানলেন কী করে?” উদ্ধত চোয়াড়ে ভঙ্গিতে ছেলেটি বলল।
”খেললে কখনও বলতে পারতেন না যে, অন্ধেও গোল দিতে পারে।”
”অনেক ক্ষেত্রে পারে, কিন্তু ঘুষ খেলে পারে না।”
”তার মানে?” থরথর করে উত্তেজনায় আমি কাঁপছি। মাথার মধ্যে গলানো বাষ্প উড়ছে। আমি কিছু আর দেখতে পাচ্ছি না।
”তার মানে আবার কী! সবাই জানে ব্যাপারটা।” ছেলেটি ঠোঁট মুচড়ে দিতেই বাকিরা মুখ টিপে হাসল।
এর পর আমি আবিষ্কার করলাম আমি হাঁটছি। ছেলেটি পেট চেপে ধরে মাটিতে পড়ে বোধ হয় এখনও কাতরাচ্ছে। ফাটা ঠোঁট দিয়ে রক্ত ঝরতে দেখেছি। লাথি মেরেছি না ঘুঁষি, এখন আর মনে নেই। আমি হনহনিয়ে হাঁটতে লাগলাম।
ঘণ্টাখানেক পর বাড়ি ফিরছি, দেখি আমাদের সরু গলিটায় ভিড়। একটা লোক—চেহারায় স্বচ্ছলতা, মাথায় টাক, বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি—আমাদের দরজায় দাঁড়িয়ে মুঠো তুলে চিৎকার করছে, ”আলবাৎ বলব, ঘুষখোর! ঘুষখোর! ঘুষখোর! আমিও সেদিন মাঠে ছিলাম, আমি নিজে চোখে দেখেছি। সেদিন—” লোকটির গলা ধরে এল, ”সেদিন সেই চান্স!” দেখলাম লোকটি সিল্কের পাঞ্জাবির হাতায় চোখ ঘষল, তার পর ফ্যাঁসফেঁসে স্বরে বলল, ”আজও আমরা শিল্ড পাইনি।”
আমি পায়ে পায়ে পিছু হটে গলি থেকে বেরিয়ে এলাম। আবার রাস্তায় কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে বাড়ি ফেরা মাত্র মা ছুটে এসে উঠোনের উপরই আমার চুল মুঠোয় ধরে ঠাস ঠাস করে চড় কষাতে শুরু করলেন।
”কেন, কেন তুই পরের ছেলেকে মেরেছিস! বাড়ি বয়ে তোর বাবাকে অপমান করে গেল। তুই, তুই, তোর জন্যই—”
মা হাঁফিয়ে পড়লেন। ছোট্ট নরম ঠাণ্ডা স্বল্পবাক হাসিখুশি মা। মা’র হাতে ব্যথা লাগছে। দুচোখ বেয়ে দরদর করে জল পড়ছে। পিন্টু, পুতুল গম্ভীর মুখে দূরে দাঁড়িয়ে। বাবার ঘরের দরজার পাল্লা ভেজানো। বিশুবাবুর মেয়েরা উপর থেকে দেখছে। পাশের বাড়ির জানলাগুলোয় অনেক মুখ। নীলিমা এসে মা’র হাত চেপে ধরতেই দ্বিগুণ জোরে মা চেঁচিয়ে উঠলেন, ”কুলাঙ্গার! কুলাঙ্গার! বাপের মান যে নষ্ট করে, তেমন ছেলের মুখ দেখাও পাপ।”
নীলিমা মাকে টেনে রেখেছে। আমি ভেজানো পাল্লা দুটো দড়াম করে খুলে ঘরের মধ্যে ঢুকলাম। বাবা চিত হয়ে শুয়ে, চোখের উপর বাঁ হাত আড়াআড়ি রাখা। শব্দ হতেই হাত সরিয়ে একবার মাত্র তাকালেন।
”বাবা, তুমি ঘুষ নিয়েছিলে?” আমি উত্তেজিত স্বরে প্রশ্ন করলাম।
বাবা কথা বললেন না, শুধু দেখলাম ওঁর গালের চামড়াটা একবার কেঁপে গেল।
”আমার জানা দরকার।”
”আমি তোমায় জানানোর কোনও প্রয়োজন বোধ করছি না। যদি তোমার লজ্জা হয়, তা হলে পিতৃ—পরিচয় দিয়ো না।”
”ওরা যা বলে আমি তা বিশ্বাস করি না।”
বাবা চুপ করে রইলেন। আমার দিকে একবারও তাকাননি। ওঁর শায়িত দেহটাকে হঠাৎ মনে হল ভাঙা একটা গাছের ডাল। শুকনো, মরা।
”আমার অনুরোধ, তুমি আর আমার জন্য কারও সঙ্গে ঝগড়া করবে না। গায়ে হাত দেবে না। হাজার হাজার লোককে মারধোর করে তো তোমার বিশ্বাসকে তাদের মধ্যে সঞ্চার করতে পারবে না। তার থেকে আমি যেমন আছি, তেমনই থাকতে দাও।”
বাবা চোখ থেকে হাত নামিয়ে আমার দিকে তাকালেন। কপালের মাঝখানে মসৃণ চামড়ার বাদামি টিপটা চকচক করছে। বড় বেশি চকচকে, চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
পরদিন মা রান্নাঘরে বসে উনুনে বাতাস দিচ্ছিলেন। আমি টাকাটা চৌকাঠে রেখে বেরিয়ে যাচ্ছি বল হাতে। মা ডাকলেন, কাছে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বাচ্চচা মেয়ের মতো মুখ উঁচু করে বললেন, ”আমার হাতে কাল খুব লেগেছে।”
আমি হেসে ফেললাম। ‘লাগবেই তো। অত জোরে জোরে কখনও মারে?”
”তুই ভাল করে খেলবি? বল, খেলবি?”
আমি একদৃষ্টে মায়ের অপূর্ব মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তার পর আমি মায়ের গলা জড়িয়ে বুকে মুখ চেপে ধরে বললাম, ”খেলব।”
মা আমার মাথায় হাত রেখে ফিসফিস করে বললেন, ”তোর বাবার মতন বড় হতে পারবি?”
হঠাৎ আমার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। মাথায় মায়ের স্পর্শ, ঘ্রাণ পাচ্ছি মায়ের দেহের, মনে হচ্ছে মখমলের মতন সবুজ দূর্বা বিছানো মাঠে, হালকা সাদা—কালো ফুটকি দেওয়া বল নিয়ে ড্রিবল করছি। একের পর এক কাটাচ্ছি, দুলে দুলে এগোচ্ছি। ডাইনে ভাঙছি—বাঁয়ে হেলছি, শূন্যে উঠছি—কখনও হরিণ, কখনও চিতা, কখনও চিলের মতন। নিজেকে বললাম—প্রসূন, সুন্দর খেলার আনন্দ বোধ হয় এই রকম। বড় প্লেয়ার হও, তা হলে মাঠেও তুমি মায়ের বুকে থাকবে। তুমি কি তাই চাও?
”হ্যাঁ, আমি তাই চাই।” আচ্ছন্ন গলায় মাকে উত্তর দিলাম।
।।১৩।।
বছর ঘুরে গেল। আমার এক বছর বয়স বাড়ল। মাথায় লম্বা হয়েছি পাঁচ ফুট সাড়ে দশ ইঞ্চি, ওজন তুলনায় কমই, পঁয়ষট্টি কিলোগ্রাম। নীলিমা স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে। আমি এখন দিনে সাড়ে তিন টাকা পাচ্ছি, অবশ্য কাজটা রাতেই। অরুণা গ্লাস ফ্যাক্টরি এখনও খোলেনি, চোদ্দো মাস বন্ধ হয়ে রয়েছে। বাবা যথারীতি রোজ দুপুরে বেরোন। আরও শুকিয়ে গেছেন, আরও কম কথা বলেন। আমাদের রাত্রের রুটির বরাদ্দ একই রয়েছে, আমিষ খাদ্য বোধ হয় বছরখানেক রান্না করার সুযোগ মা পাননি। দোতলায় বাড়িওয়ালার রান্নাঘর থেকে যে দিন মাংস কষার গন্ধ আসে, পিন্টু আর পুতুল সে দিন প্রাণপণে পড়ার মধ্যে ডুবে যাবার চেষ্টা করে। হর্ষদা আমায় কয়েকবার বলেছিলেন—প্রসূন, এত যে খাটছ, এতে শরীরে ক্ষয় হচ্ছে—সেই ক্ষয় পূরণ করে খাদ্য। ফুটবলারের ভীষণ দরকার প্রোটিন। মাংস, দুধ, ডিম তোমায় খেতেই হবে, নয়তো বিপদে পড়বে। শুনে আমার ভয় হয়েছিল। শরীর ক্ষয়ে গেলে আমার আর রইল কী! কিন্তু মাংস আমি খাব, পয়সা কোথায়?
কাগজে দেখেছিলাম, বি সি রায় ট্রফি খেলার জন্য জুনিয়ার বেঙ্গল টিমের নাম ঘোষিত হয়েছে। এক দিন ভোররাত্রে হাঁকাহাঁকি করে একটা লোক ঘুম ভাঙাল। পেট্রল চাই দশ লিটার, এখনই ভোরের ফ্লাইট ধরতে হবে। মোটরের ভিতর তাকিয়ে আমার চোখ থেকে ঘুম ছুটে গেল। পিছনের সিটে নিমাই আর আনোয়ার, সামনে বিপিনদা বসে। ওরা আমায় দেখে অবাক! বিপিনদা বললেন, ”কী রে প্রসূন, খেলা ছেড়ে এখন এই কচ্ছিস? ভাল, ভাল! একটু তাড়াতাড়ি দে বাবা, দিল্লির ফ্লাইটে এদের তুলে দিতে হবে।”
আমি হাসলাম মাত্র। মোটরে পেট্রল ঢালছি মিটারের দিকে তাকিয়ে। বিপিনদা চেঁচিয়ে গাড়ি থেকে মুখ বার করে বললেন, ”আমার কথা তো বিশ্বাস করলি না, এই দ্যাখ নিমাই, আনোয়ার জুনিয়ার ন্যাশনালে খেলতে যাচ্ছে। তুই থাকলে তুইও যেতিস। তোর এত পসিবিলিটি ছিল।”
বিপিনদা জিভটা টাকরায় লাগিয়ে চুকচুক শব্দ করলেন আক্ষেপের। টাকার ভাঙানি ফেরত দেবার সময় আমার মাথাটা মুখের কাছে টেনে এনে চাপা স্বরে উনি বললেন, ”সামনের বছর আয়, দেড় হাজার দেব, এদের থেকেও বেশি। নিজেকে এভাবে নষ্ট করিস না। এবার রেলিগেশন—প্রোমোশন আছে।”
আমি আবার হাসলাম। ওরা দুজন জড়ভরতের মতন বসে। আনোয়ার বাইরে তাকিয়ে, কিন্তু নিমাই একদৃষ্টে আমার মুখের দিকে। গাড়িটা চলে যাবার পর আমার সত্যিই হিংসা হল। শোভাবাজারে থাকলে আজ আমিও এই মোটরে চেপে দিল্লির প্লেন ধরতে যেতাম। তার পর পরিমল ভটচাজ ঢুকিয়ে দিত জুনিয়ার ইন্ডিয়া টিমে, তার পর ব্যাংকক, সিওল কী টোকিওয়। শুধু একটা বছর যদি থাকি।
নিজের উপর রাগ হল। বোধ হয় বোকামিই করেছি, ক্ষতি করলাম নিজেরই। মুহ্যমান হয়ে খাটিয়ার উপর বসে যখন এইসব ভাবছি, তখন ফিসফিস করে বুকের মধ্যে কে কথা বলে উঠল: ‘কী ক্ষতি করেছ, প্রসূন? পূরণ করে নেবার সময় অনেক পাবে। যাও যাও, প্র্যাকটিসে নামো। খাটো, আরও খাটো। কিচ্ছু বোকামি করোনি। মনে রেখো, কদর পাবে একমাত্র খেলা দিয়েই, বেঙ্গল বা ইন্ডিয়ার ছাপ দিয়ে নয়।’
ভি আই পি রোড ধরে যখন দৌড়োচ্ছি, একটা প্লেন মাথার উপর দিয়ে নিচু হয়ে পশ্চিমে চলে গেল। আমি দাঁতে দাঁত চেপে ঊর্ধ্বশ্বাসে হঠাৎ পাগলের মতন ছুটতে শুরু করলাম।
।।১৪।।
”তোমার কথা রতন আমাকে বলছিল।” সাদা চুলে ভরা মাথাটা ডাইনে—বাঁয়ে নেড়ে পঁয়ষট্টি বছরের দাসুদা অর্থাৎ দাসু গুহ গম্ভীরভাবে আমার আপাদমস্তক দেখলেন। তার পর চেয়ার থেকে উঠে এসে ধাঁ করে বুকে ঘুষি মারলেন। আমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। লেগেছে ভালই, কিন্তু মুখে যন্ত্রণা ফোটালাম না। উনি আমার পিছনে গেলেন। বুঝতে পারছি না, এবার কী করবেন। হঠাৎ একটা ধাক্কা খেলাম। হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে টাল সামলে নিলাম।
দাসুদার মুখে হাসি ফুটল। ”স্ট্রাইকার?”
আমি মাথা হেলালাম। উনি চেঁচিয়ে ডাকলেন, ”কমল, কমল!”
বেঁটে ফরসা কমল পণ্ডিত ছুটে এল। দাসুদা বললেন, ”ছেলেটাকে পঁচিশ পাক দৌড় করা।”
কমলদা সোনালি সংঘের ট্রেনার। ইন্ডিয়া টিমে ব্যাক খেলেছেন বছর দশেক আগে। অসম্ভব দম আছে শুনেছি।
”প্যান্ট এনেছ?”
”না।”
কমলদা প্যান্ট জোগাড় করে দিলেন। মাঠে হকি খেলা হচ্ছে। কিছু দর্শক ছড়ানো ছেটানো। লক্ষ করলাম, ফুটবল—বুট পায়ে খালি গায়ে তিন—চারটি ছেলে টেন্টের বাইরে গান করছে। মনে হল, ওরা প্র্যাকটিসে নামবে হকি খেলাটা শেষ হলেই। ওরা কৌতূহলে আমার দিকে তাকাল। ওদের মধ্যে গোলকিপার রুনুকে মাত্র চিনলাম। দু—একবার শোভাবাজার টেন্ট—এ দেখেছি রতনের সঙ্গে। তবে আলাপ নেই।
কমলদা আমাকে নিয়ে দৌড়োতে শুরু করলেন মাঠের বাইরে দিয়ে। জোরে হাঁটার থেকে কিছু জোরে। পাঁচ পাকের পর দেখি, কমলদা আমার সামনে এবং গতি ক্রমশই বাড়াচ্ছেন। আমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। আঠার মতন সঙ্গে লেগে রইলাম। সতেরো পাকের সময় হকি খেলা শেষ হতে দেখলাম, ফুটবল নিয়ে ওরা মাঠে নেমে পড়েছে। কুড়ি পাকের মাথায় কমলদাকে পিছনে ফেলে এগোতে শুরু করলাম। দাসুদা মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে ওদের দিয়ে পাসিং ও ইনটার—পাসিং করাচ্ছেন, এখন তিনি আমাদের দৌড়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে। দম আমার বুক ভর্তি রয়েছে। কমলদা ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছেন। শেষ পাকটা স্প্রিনট করলাম। কমলদাকে পুরো দেড় পাক পিছনে রেখে থামতেই দাসুদা হাত নেড়ে মাঠের মধ্যে ডাকলেন।
”তোর নামটা যেন কী?”
”প্রসূন।”
”বুট আনিসনি কেন?”
শুনেছি দাসুদা যাদের বুট আনতে বলেন, তারাই ফার্স্ট টিমে খেলার যোগ্যতা পেয়েছে ধরে নিতে হয়। খুশিতে আমি মাথা চুলকোতে লাগলাম। কমলদা তখন এসে আমায় জড়িয়ে ধরেছেন। হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, ”এই প্রথম আমি হারলাম, দাসুদা।”
”ছোঁড়ার দম আছে।” এই বলে দাসুদা আবার প্র্যাকটিস করানোয় মন দিলেন। মাঠের বাইরে এসে আমি ওদের প্র্যাকটিস দেখতে লাগলাম। ডান দিক থেকে উঁচু ক্রস পেনালটি বক্সে ফেলছে একজন, আর তিনজন ছুটে যাচ্ছে বলটা হেড বা ভলি করতে। ফসকাচ্ছে বা বারের অনেক উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে।
আমি গুটিগুটি মাঠের মধ্যে দাসুদার পাশে দাঁড়ালাম।
”আমি একবার চেষ্টা করব?”
দাসুদা মাথা দোলালেন। আমি এগিয়ে গেলাম।
একসঙ্গে দুজন ছুটেছি; বল নিয়ে ডাইনের সাইড লাইন ধরে ছুটে সেন্টার করল একজন। সেন্টারটা ভাল হয়নি, আমাদের দুজনের পিছনে বল পড়ছে। আমি ঘুরে গেলাম গোলের দিকে পিছন ফিরে। বলটা পড়ার আগেই ইনস্টেপ দিয়ে শূন্যে থামিয়ে টুক করে উপরে তুলেই সঙ্গে সঙ্গে পিছনে হেলে মাথার উপর দিয়ে বাইসাইকেল কিক করলাম। মাথা ঘুরিয়ে দেখি, বারের তলায় লেগে বলটা গোলে ঢুকল, আর গোলকিপার হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে। নীলিমাকে এই কিকই দেখিয়েছিলাম আন্দাজে মেরে। কিন্তু এখন দশটার আটটাই গোলে পাঠাতে পারি।
দাসুদা আর কমলদা নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন, অন্য ছেলেরা আমাকে সপ্রশংস চোখে দেখছে। একজন বলল, ”আর একবার করো তো!”
করতে পারলাম না। বলটা পেলাম বুকের উপর, বুক থেকে ঊরুতে নিলাম, তুললাম ধাক্কা দিয়ে কিন্তু শরীর থেকে বাঁ ধারে বলটা একটু সরে গেল। বাইসাইকেল কিকের চেষ্টা না করে আধ পাক ঘুরে ডান পায়ে ভলি মারলাম। গোলকিপার দুহাত বাড়িয়ে ডান দিকে ঝাঁপাবার আগেই বল গোলে ঢুকে গেছে।
দাসুদা হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। কাছে যাওয়া মাত্র জানতে চাইলেন, বাড়িতে কে কে আছেন, বাবা কী করেন, আমি কী করি, কত দূর লেখাপড়া করেছি… ইত্যাদি।
”কাজটা ছেড়ে দে!” দাসুদা বললেন, তার পর আমার বিস্ময় লক্ষ করে যোগ করলেন, ”ও টাকা আমরা দিয়ে দেব তোকে মাসে মাসে, আর কিছু দিতে পারব না।”
আমি রাজি হয়ে গেলাম সঙ্গে সঙ্গেই। ছোট টিমগুলোর মধ্যে সোনালি সংঘের নাম আছে ছক বাঁধা আধুনিক পদ্ধতিতে খেলার। এখানকার ছেলেরা সিরিয়াস, মন দিয়ে প্র্যাকটিস করে দাসুদার চোখের সামনে। কমলদা মাঠের মধ্যে ওদের স্কিল রপ্ত করান। সোনালির নিয়ম—শৃঙ্খলা অত্যন্ত কড়া, সেটা শুধু মাঠেই নয়, বাড়িতেও প্রত্যেক প্লেয়ারকে পালন করতে হয়। দাসুদা প্রায়ই এক—এক জনের বাড়িতে হঠাৎ হাজির হয়ে খোঁজ নেন, কী খাচ্ছে, কখন ফিরছে, কখন ঘুমোচ্ছে।
”সামনের হপ্তা থেকে ট্রান্সফার শুরু হবে, কমলের সঙ্গে আই এফ এ অফিসে গিয়ে সই করে আসবি। কাল ভোর থেকেই প্র্যাকটিসে আয়।”
ফেরার সময় শ্যামবাজারের বাসের দম বন্ধ করা ভিড়ের মধ্যে একবার আমার মনে পড়ল, দাসুদা যখন জিজ্ঞাসা করলেন বংশে কেউ কখনও ফুটবল খেলেছে কি না, তখন আমি ‘না’ বলেছিলাম।
।।১৫।।
আই এফ এ অফিসে সই করতে গিয়ে বিপিনদার সঙ্গে দেখা। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিন্যু থেকে আনন্দবাজার পত্রিকা অফিস পর্যন্ত সুতারকিন স্ট্রিটে হাজারখানেক লোকের জটলা। তার মধ্যে বিপিনদা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। আমাকে দেখে হাত তুলে থামতে ইশারা করলেন। আমি অস্বস্তি বোধ করলাম।
”সোনালিতে সই কচ্ছিস খবর পেয়েছি।”
”আপনি এখানে দাঁড়িয়ে কেন?” আমি প্রশ্ন করলাম।
”উইথড্র করাব আজ নিমাই, আনোয়ারকে। ওরা দুটোর সময় আসবে।” বিপিনদা ঘড়ি দেখলেন। ”তুই তা হলে আমার কথাটা ভেবে দেখলি না? এরা কত দেবে?”
”এক পয়সাও নয়।”
বিপিনদা অবাক হয়ে, ‘অ’ বলেই সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে গেলেন। ঠিক দুটোর সময় আনন্দবাজারের গেটের সামনে কমলদার থাকার কথা। আমি সে দিকে এগিয়ে গেলাম। একদল ছেলে খুব উত্তেজিত হয়ে তর্কাতর্কি করছে। বিষয় নঈম, অরুণ ঘোষ, অসীম মৌলিক, পাপান্না, হাবিব, ধীরেন দে, জ্যোতিষ গুহ, মান্না। হঠাৎ কী যেন হল, ওরা ছুটে গেল আই এফ এ অফিসের দিকে ‘নঈম নঈম’ বলে। একটু পরেই ফিরে এল, ‘যত্তোসব উড়ো গুজব’ বলতে বলতে। আমি ভাবলাম, আমার জন্য এরাও একদিন এখানে এইভাবে অপেক্ষা করবে। আমি দল বদলাতে আসছি শুনে ছুটে যাবে। অথচ এরা জানে না, আমি এখন এদের পাশেই দাঁড়িয়ে। ভাবতেই আমার খুব হাসি পেয়ে গেল।
কমলদার সঙ্গে যখন আই এফ এ অফিসের সিঁড়ি দিয়ে উঠছি, তখন নিমাই আর আনোয়ার বিপিনদার পিছনে নামছে। আমি দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পথ দিলাম। নিমাই চমৎকার ঘিয়ে রঙের একটা প্যান্ট পরেছে। ভীষণ টাইট, কোমরের অনেক নীচে নামানো। জুতোর মুখটা ছুঁচলো। চুল আঁচড়াবার ঢঙটাও বদলেছে, কপালের আধখানা জুড়ে চুল নামানো। আনোয়ার পরেছে একটা নীল নায়লনের স্পোর্টস গেঞ্জি, ফরসা রঙের সঙ্গে সুন্দর মানিয়েছে।
”কেমন আছিস?” আমি বললাম।
ওরা থতমত হল, আশা করেনি আমি কথা বলব।
নিমাই তাড়াতাড়ি বলল, ”তুই রোগা হয়ে গেছিস প্রসূন।”
আমি হাসলাম।
”পরে কথা বলব, এখন চলি।” আনোয়ার মৃদু স্বরে বলল। আমি মাথা কাত করলাম।
পরদিন সন্ধ্যায় মাঠ থেকে ফিরতেই মা দারুণ উত্তেজিত হয়ে বললেন, ”এ ঘরে আয় শিগগিরই, একটা জিনিস দেখাব।” আমি ছুটে গেলাম। মা’র হাতে পাঁচটি একশো টাকার নোট।
”কোত্থেকে পেলে?” প্রশ্ন করলাম অবাক হয়ে। মা একটা চিঠি হাতে দিলেন। চিঠিতে লেখা: ”প্রসূন, কাল ঠিক দুটোর সময় আমি অপেক্ষা করব আই এফ এ অফিসের কাছে, যেখানে তোর সঙ্গে গতকাল দেখা হয়েছিল। ইতি, বিপিনদা।”
মা’র হাত থেকে নোটগুলো নেবার জন্য হাত বাড়ালাম।
”এ টাকা এখুনি ফেরত দিতে হবে। এটা ঘুষ।”
মা’র হাত থেকে নোটগুলো পড়ে গেল। মনে হল যেন ফেলে দিলেন। ফ্যাকাশে মুখে শুধু বললেন, ”ঘুষের টাকা!”
বিপিনদার বাড়ি পৌঁছোলাম রাত দশটায়। অবাক হয়ে বললেন, ”এত রাতে, ব্যাপার কী রে?’
নোটগুলো ওঁর টেবিলে নামিয়ে রেখে বেরিয়ে আসার সময় বললাম, ‘কয়েক ঘণ্টার জন্য টাকাটা আমার কাছে থেকে গেছিল। সে জন্য সুদ আপনার প্রাপ্য। শোভাবাজারের সঙ্গে যে দিন খেলা থাকবে, সে দিন সেটা শোধ দেব।” বলে দরজা পেরোচ্ছি, পিছনে বলতে শুনলাম, ”বটে!”
।।১৬।।
লিগের তৃতীয় ম্যাচ শোভাবাজারের সঙ্গে। এরিয়ানের সঙ্গে ২—২ করে, উয়াড়িকে ৩—০ হারিয়েছে সোনালি। পাঁচটা গোলই আমার, লিগে প্রথম হ্যাট্রিকও। যুগান্তরে লিখেছে, ”সোনালি সংঘের নবাগত ফরোয়ার্ড পি ভট্টাচার্য সুযোগসন্ধানীরূপে পরিচয় দিয়ে গুনে গুনে তিন তিনটি গোল দিয়ে মরসুমের প্রথম হ্যাট্রিক লাভের গৌরব অর্জন করেন।” পিন্টু কাগজ থেকে কেটে রেখে দিয়েছে। ও প্রায়ই এখন বায়না ধরে আমার খেলা দেখার জন্য। যদি খারাপ খেলি ওর সামনে, এই ভয়ে ওকে কখনও মাঠে আনিনি। ও আমার সব থেকে বড় ভক্ত। কিন্তু আজ ওকে এনেছি, আজ আমি কনফিডেন্ট, ভাল খেলবই।
আনোয়ার দূর থেকে হাত তুলল। আমিও হাত তুললাম। তখন খেলার আগে ওয়ারমিং আপ চলেছে। আনোয়ার জগ করতে করতে আমার কাছে এসে বলল, ”খুব গোল দিচ্ছিস, আজ পারবি না।”
”জুনিয়ার ইন্ডিয়া ক্যাম্পে তোর আর নিমাইয়ের নাম আছে দেখলাম।”
আনোয়ার হেসে চলে গেল। নিমাই আমাদের দিকে এল না। রতন একবার বল কুড়োতে এসে বলে গেল, ”সাবধানে থাকবি আজ।”
”কেন?”
”বললুম।”
রতন চলে যাবার পর আমি ওর কথার মানে বোঝার চেষ্টা করেও কোনও হদিস পেলাম না। অবশেষে বুঝলাম হাফ টাইমের মিনিট তিনেক আগে। শোভাবাজার পেনালটি বক্সের মধ্যে আমাদের রাইট আউট ব্যাক সেন্টার করতেই ছুটে গেলাম। আমার সঙ্গে টিকাদারও। বলটা দু’গজ দূরে ড্রপ পড়ে উঠছে, কী করব? ভলি মারলে বারের দশ হাত উপর দিয়ে যাবে। একমাত্র উপায় ডাইভ দিয়ে হেড। সামনে গোলকিপার বেরিয়ে আসছে, আনোয়ারের বুটের ধপধপ বাঁ দিকে, আমি ঝাঁপ দিলাম।
মাথায় বলের স্পর্শ পাবার সঙ্গে সঙ্গে, ডান পাঁজরে প্রচণ্ড একটা যন্ত্রণা ছুরির ফলার মতো বিঁধল। টিকাদার লাথি কষিয়েছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে, চোখে অন্ধকার দেখছি। তার মধ্যেই রেফারির লম্বা হুইসল শুনতে পেলাম।
সাইড লাইনের বাইরে আমাকে শোয়ানো হল। জারসি খুলে বুকে বরফ ঘষা হচ্ছে। চোখ খুলতেই পিন্টুর কাঁদো—কাঁদো মুখটা প্রথমে চোখে পড়ল। হাত তুলে ওকে আশ্বাস দিতে গিয়ে খচ করে বুকে যন্ত্রণা উঠল। হাসলাম শুধু। দাসুদা, কমলদা ঝুঁকে রয়েছেন। এখন হাফ টাইম।
”গোলটা হয়েছে?” আস্তে উচ্চচারণ করলাম।
”হ্যাঁ।” কমলদা বললেন।
”কেউ নেমেছে নাকি?”
”সুশান্ত নামছে।”
”বারণ করুন, আমি খেলব, আমি পারব।” ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। ”আমার কিছু হয়নি।”
”তোকে খেলতে হবে না প্রসূন।”
ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম। আনোয়ারের টকটকে রাঙা মুখ চোখে পড়ল। ”আবার লাগলে সিজনের মতো বসে যাবি।”
রাগে আমি জ্বলে উঠলাম। ”সেই ব্যবস্থাই তো তোরা করেছিস। কাওয়ার্ড।”
আনোয়ারের চোখ দুটো দপ করে উঠল, কথা না বলে চলে গেল।
”খেলতে পারবি? আমার আপত্তি নেই যদি খেলতে চাস।” দাসুদা বললেন।
”কিন্তু দাসুদা—” কমলদা থেমে গেলেন দাসুদার তোলা হাতটাকে দেখে। পিন্টু ফিসফিস করে বলল, ”আনোয়ারদা একা দু’ হাতে তোমায় মাঠ থেকে তুলে আনল। কী গায়ের জোর!”
মাঠে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। বল এখন আমাদের ডিফেনডিং জোনে। নিমাই যথেচ্ছ কাটাচ্ছে, একটার পর একটা বল বাড়াচ্ছে আর শোভাবাজারের ফরোয়ার্ডরা প্রত্যেকটা নষ্ট করছে। শেষে নিমাই শোধ করল গোলটা। আমি জানি, ও করবেই। ওকে রোখার সাধ্য সোনালির ডিফেন্সের নেই। আমাদের আটজন পেনালটি বক্সের মধ্যে। এক ছুটের ওপর তিনজনকে কাটিয়ে শরীরটাকে ডান দিকে বাঁ দিকে করিয়ে ছোট্ট একটা চিপ, বেটাল গোলকিপারের ফ্যালফ্যালে চোখের উপর দিয়ে বলটা গোলে ঢুকে গেল।
আমি দু’—এক বার ছোটার চেষ্টা করে বুঝলাম, পারব না। টিকাদার ছায়ার মতো সঙ্গে রয়েছে। তবু চেষ্টা করলাম। রাইট হাফ উঠে এসেছে। ওর সঙ্গে ওয়াল পাস করে বক্সের মাথায় পৌঁছোলাম। রাইট স্টপার ব্যাক ট্যাকল করতে এল। কাটালাম। লেফট হাফ সামনে। ঠেলে দিলাম বলটা বাঁ দিকের ফাঁকা জায়গায়। আমাদের লেফট আউট উঠে আসছে দেখছি। আনোয়ারের পিছনে চমৎকার জায়গা পড়ে আছে, ওখান থেকে গোল দশ গজ। ছুটে গেলাম সেখানে। লেফট আউট দিল আমাদের লেফট ব্যাককে। বল ধরে ও কাকে দেবে খুঁজছে, আমি হাত নাড়তেই ঠেলে দিল। শোভাবাজারের চারজন আমার দিকে ছুটে এল।
বলটা ঠিকমতো থামাতে পারলাম না। ছিটকে বেরিয়ে গেল পা থেকে। আনোয়ার ছুটে এসে পড়েছে। এবার সোজা গ্যালারিতে পাঠিয়ে দেবে, তা ছাড়া উপায় নেই। তবু একবার শেষ চেষ্টা করলাম। আনোয়ার বলটা মারবার জন্য পা তুলে থমকে গেল। হুড়মুড়িয়ে আমি আর টিকাদার বলের জন্য এগিয়ে গেলাম।
”ওরে বাপস।”
একটা চাপা আর্তনাদ উঠল। আনোয়ার আর টিকাদার মাটিতে পড়ে। বলটা গড়াচ্ছে। ছুটে গিয়ে ধরলাম বলটা। গোল মাত্র পাঁচ—ছ’ গজ দূরে। একটা টোকা দিয়ে বাকি কাজটা সেরে ফিরে তাকিয়ে দেখি, টিকাদার তলপেট চেপে কাটা পাঁঠার মতো ছটফটাচ্ছে। আমি আনোয়ারের মুখের দিকে তাকালাম।
”কী করলি?”
”বেশ করেছি, তোর কী?”
বিপিনদা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন মাঠের মধ্যে চিৎকার করতে করতে : ”সাসপেন্ড করব তোকে। নিজের প্লেয়ারকে মারলি, জানোয়ার কোথাকার! বন্ধুত্বের প্রতিদান হল, সব বুঝি, সব বুঝি।”
আমি লজ্জা পেয়ে সরে গেলাম। রতন আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল, এমন একটা ব্যাপার যে হবে তা সে জানত। টিকাদারকে মাঠের বাইরে নিয়ে যাবার পর শোভাবাজার আর খেলতে পারল না। আমাদের রাইট আউট পর পর দুটো গোল করল। দাসুদা হাত নেড়ে আমাকে মাঠ থেকে চলে আসতে বললেন।
রাত্রে আমার বুকে ব্যথা শুরু হল। মাকে ডাকলাম। পিন্টু বাড়ি এসে মাকে নিশ্চয় মাঠের কথা বলেছে, নয়তো মা প্রথমেই ক্ষুব্ধ স্বরে বলবেন কেন, ”কী দরকার ছিল অমন করে ডেনজারাসলি গোল দেবার? বুকে লাথি খেতে হয় যেখানে, দরকার কি সে কাজ করার?”
মা’র মুখে ইংরিজি শুনলে হাসি পায় আমার। আসলে পিন্টুর কথাই মা’র মুখ দিয়ে বেরোল। বললাম, ”গোল ডেনজারাসলিই পেতে হয়।” গজগজ করতে করতে মা সরষের তেল গরম করে আনলেন। বুকে মালিশ করতে করতে একবার শুধু বললেন, ”ফুটবলই আমার সর্বনাশ করবে।”
।।১৭।।
সকালে বুক টাটিয়ে উঠল। আমার শুধু একটাই ভয়, এত পরিশ্রম করলাম সারা বছর, বুঝি বিফলে গেল। চোট পেয়েছি জানলে দাসুদা বসিয়ে দেবেন। অথচ বড় ম্যাচ একটাও খেলা হল না এখনও। পরশুই খিদিরপুরের সঙ্গে খেলা। আজ কী কাল ক্লাবে না গেলে নিশ্চয়ই কেউ খোঁজ করতে আসবে, জেনে যাবে চোট পাওয়ার কথা।
ভেবে চিন্তে ঠিক করলাম দাসুদা কী কমলদাকে জানিয়ে দিই যে, আমি কলকাতায় নেই। মাসির বিয়েতে মামাবাড়ি চলে গেছি। কিন্তু কাকে দিয়ে খবর পাঠাব! পিন্টু ছাড়া আর কেউ নেই। কালীঘাটে দাসুদার বাড়ি কি গড়িয়ায় কমলদার বাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার মতো ডাঁটো এখনও সে হয়নি। দাসুদার টেলিফোন আছে, নম্বরটা জানি না। ওঁর ভাল নামটাও জানি না। হর্ষদা জানতে পারেন। পিন্টুকে হর্ষদার কাছে পাঠিয়ে দিলাম, আর সাবধান করে দিলাম, একদম যেন চোট পাওয়া সম্পর্কে একটি কথাও না বলে, তা হলে আর কোনও দিন মাঠে নিয়ে যাব না।
পিন্টু টেলিফোন নম্বর আনল। এবার সমস্যা কাকে দিয়ে টেলিফোন করাব। নীলিমাকে ডাকলাম, ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতেই ও গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ল এবং টেলিফোন নম্বর নিয়ে বেরিয়ে গেল। আধ ঘণ্টা পর নীলিমা ফিরল। ওর সাড়া পেয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে হৃৎপিণ্ডটা ধক করে গলায় আটকে গেল। দুই মূর্তি দাঁড়িয়ে, আনোয়ার—নিমাই।
ওদের দেখাচ্ছিল খুবই ব্যস্ত আর সিরিয়াস। আনোয়ার মোটা মোটা আঙুলগুলো আমার বুকে রেখে আলতো চাপ দিল। আমার মুখে যন্ত্রণা ফুটে উঠতে দেখে নিমাইয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা কাত করল। নিমাইও গম্ভীর হয়ে মাথাটাকে দু’বার উপর—নীচ করল। তার পর দুজনে ফিসফিস কী কথা হল, নিমাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আনোয়ার মাকে বলল, ”মাসিমা, ওকে জামা পরিয়ে দিন, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।”
আমি একটাও কথা বলিনি। শুধু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমাকে কোনও পাত্তা না দিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিল। মা আমাকে জামা পরিয়ে দিতে আনোয়ার বলল, ”হাঁটতে পারবি?” আমি মাথা নাড়লাম। নিমাই ট্যাক্সি এনেছে। দু’পাশে দুজনে ধরে আমাকে ট্যাক্সিতে তুলল। আমরা শ্যামবাজারের দিকে রওনা হলাম।
হাড় ভাঙেনি। একস—রে না করলে চিড় খেয়েছে কি না বোঝা যাবে না। ডাক্তার কষে ব্যানডেজ করে দিল বুকটা। শুয়ে থাকতে হবে, নড়াচড়া বারণ। ট্যাক্সিতে ফিরে এলাম। ওরা কেউ আমার সঙ্গে কথা বলল না, আমিও বললাম না। পৌঁছে দিয়ে, মা’র সঙ্গে কথা বলেই ওরা চলে গেল। নীলিমাকে দেখা মাত্র রেগে বললাম, ”কে তোমাকে সর্দারি করে ওদের ডাকতে বলেছে?”
নীলিমা উত্তর দিল, ”টেলিফোন করেছি। বলেছি, দিন পনেরো মামাবাড়ি থাকবে।” এই বলে গম্ভীরভাবে ও আঙুলের ইশারায় আমাকে শুয়ে থাকতে বলে বেরিয়ে গেল।
একস—রে রিপোর্টে কিছুই পাওয়া গেল না।
খিদিরপুর, ইস্টার্ন রেল, মহামেডান, কালীঘাট, রাজস্থান—পাঁচটা ম্যাচ শুয়ে রইলাম বাড়িতে। তিনটে হেরেছি, দুটো ড্র। এর পর আর শুয়ে থাকা গেল না। একদিন সকালে অল্প দৌড়োলাম, সামান্য ব্যায়ামও করলাম, কোনও অসুবিধা হল না। বিকেলে টেন্ট—এ গেলাম। পরদিনই স্পোর্টিং ইউনিয়নের সঙ্গে খেলা। এত দিন মামাবাড়িতে থাকার জন্য দাসুদা মৃদু বকুনি দিলেন এবং জানালেন, টিম হয়ে গেছে। তবে আমি খেলছি। আমার জায়গায় যাকে নামানো হয়েছিল, সে একদম সুবিধা করতে পারছে না।
সাবধানে, ঝুঁকি না নিয়ে প্রায় দাঁড়িয়েই খেললাম। জিতলাম ৩—০। পেনালটি বক্সের মাথায় বল পেয়ে দুটো শট থেকে গোল করলাম। পরের ম্যাচ বি এন আর—এর সঙ্গে। এবার অরুণ ঘোষের মুখোমুখি হয়ে নিজেকে যাচাই করব, এই ভেবে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। কিন্তু মাঠে এসে যখন শুনলাম অরুণ ঘোষ খেলছে না, তখন বেশ ক্ষুণ্ণ হই। মনে হল, অরুণ ঘোষ আমাকে বঞ্চিত করল। নয় মিনিটের মধ্যে দুটো গোল দিয়ে মাঠকে অবাক করে দিলাম। ছোট টিম সোনালি শুরু থেকেই ডিফেনসিভ খেলবে, বোধ হয় এই রকম একটা ধারণা করেছিল বি এন আর। বদলে আমরা সোজা তাদের গোলের দিকে এগিয়ে যাই। পাঁচ মিনিটের পর রাইট আউটের ক্রস করা বল গোলকিপার এগিয়ে এসে পানচ করে সামনে ফেলতেই ছুটে এসে ভলি মেরে নেটে পাঠিয়ে দিলাম। দ্বিতীয় গোল একইভাবে। এর পর বি এন আর গুছিয়ে নিয়ে আমাদের কোণঠাসা করলেও আর গোল দিতে পারেনি। আমাদের গোলকিপার রবি নিশ্চিত চারটে গোল বাঁচিয়েছিল।
পরের ম্যাচে যুগের যাত্রীর সামনে পড়লাম আমরা। লিগে যাত্রী এখন সবার উপরে, একটাও পয়েন্ট নষ্ট করেনি। মোহনবাগান হেরেছে ইস্টার্নের কাছে, ইস্টবেঙ্গল ড্র করেছে রাজস্থানের সঙ্গে। এ বছরে পাঁচটা ম্যাচ খেলেছি মাত্র, কিন্তু তাতেই ময়দানের আনাচে কানাচে, অনেক টেন্টে আমাকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। সামনের বছর কোন ক্লাব আমাকে তুলে নেবে, কত দর হবে, এ সব কথাও নাকি বলাবলি হচ্ছে। লিগের টপ স্কোরার এখন আমি—পাঁচটি ম্যাচে এগারোটা গোল। অসীম মৌলিক দশটা ম্যাচে দশ গোল, অশোক চ্যাটার্জি এগারোটা ম্যাচে আট গোল।
।।১৮।।
নীলিমা স্কুল ফাইনাল পাশ করেছে সেকেন্ড ডিভিশনে। বাড়িতে হইহই পড়ে গেছে সকালেই। তখনও আমি বিছানা ছেড়ে উঠিনি। বাড়িওয়ালা বিশু দত্ত চেঁচাচ্ছে: ”নুটুবাবু, খাওয়াতে হবে।”
”নিশ্চয় নিশ্চয়, কী খাবেন বলুন!”
”রাবড়ি। বড়বাজারের রাবড়ি।”
ঘরের বাইরে এলাম। দেখি, নীলিমা প্রণাম করছে মাকে। তার পর আমাদের ঘরে ঢুকল। বাবা আছেন ঘরে। মা ফিসফিস করে আমাকে বললেন, ”তোর কাছে টাকা আছে? একটা শাড়ি দিতুম! আহা, কত কষ্ট করে লেখাপড়া করেছে।”
”বাবার কাছে নেই?’
”এই মাসটা চালাবার মতন আছে।”
”আমার কাছে টাকা বারো আছে। তাই দিয়ে কি শাড়ি হবে?”
মা ভেবে বললেন, ”থাক তা হলে, পরে দেবখন।”
”জ্যেঠিমা, প্রসূন আমার থেকে কত বড়?” নীলিমা ঘর থেকে বেরিয়ে বলল, ”ছ’ মাসের বেশি কি?”
মা হেসে বললেন, ”ওই রকমই হবে।”
এর পরই একটা ভয়ংকর অপ্রতিভতার মধ্যে নীলিমা আমাকে ফেলে দিল। গোল থেকে এক গজ দূরে বল পেয়ে গোলের বাইরে মারলে মাঠভর্তি লোকের সামনে যা হয়, সেই রকম বোঁ বোঁ করে উঠল মাথাটা। নীলিমা প্রণাম করেছে আমায়। পাশ করলে দেখছি কাণ্ডজ্ঞান লোপ পায়! আমি আমতা আমতা করে কী সব বলতে বলতে ঘরে পালিয়ে এলাম। শুনলাম নীলিমা বলছে, ‘প্রসূন যত মন দিয়ে প্র্যাকটিস করে, আমি যদি সেভাবে পড়তাম, তা হলে স্কলারশিপ পেতাম।”
উঁকি মেরে দেখলাম, নীলিমা বালতি হাতে কলঘরে যাচ্ছে। ওকে ডাকলাম।
”এবার তো কলেজ?”
”হ্যাঁ। টাকা জোগাড় করতে হবে, প্রায় একশো।”
মনে মনে সিঁটিয়ে গেলাম। যদি এখন এত দিনের ধারের টাকা চেয়ে বসে। তাড়াতাড়ি বললাম, ”তোমাকে কিছু একটা উপহার দিতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু হাতে এমন টাকা নেই যে কিনতে পারি।”
নীলিমা কিছু বলতে যাচ্ছে, এমন সময় পিন্টু ব্যস্ত হয়ে ঘরে ঢুকল।
”দাদা, একটা লোক তোমায় ডাকছে। বলল, খুব দরকার।”
গলিতে বেরিয়ে দেখি, রঙিন বুশ শার্ট গায়ে, ফরসা, কটা—চোখ, বছর চল্লিশের একটি লোক দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখেই খুব পরিচিতের ভঙ্গিতে বলল, ”প্রসূন, একটা কথা ছিল, চলো একটু বাইরে গিয়ে বলব।”
রাস্তায় এসে বললাম, ”যা বলবার এখানেই বলুন, আমি আর যাব না, কাজ আছে।”
একটা ফিয়াট গাড়ি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে লোকটা বলল, ”চলো না একটু ঘুরে আসি, মোটরে বসেই বলব। কথাটা খুবই প্রাইভেটলি বলতে চাই।”
লোকটার চালচলন আমার বিশ্রি লাগছে, তার উপর ‘প্রাইভেটলি’ কথা বলার প্রস্তাবটা ভাল লাগল না। বললাম, ”আপনার প্রাইভেট কথা এখানে দাঁড়িয়েও বলতে পারেন, কেউ শুনতে পাবে না।”
লোকটা এধার—ওধার তাকিয়ে, গলা খাঁকারি দিয়ে ফিসফিস করে বলল, ”কালকের ম্যাচটা তুমি খেলো না।”
”যাত্রীর সঙ্গে খেলব না?” আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম। ”বলছেন কী আপনি!”
”তুমি কত টাকা আর পাও সোনালি থেকে, মাসে মাসে একশো… খবর রাখি, সব ক্লাবেরই খবর রাখি।” লোকটা হঠাৎ পকেট থেকে একশো টাকার একটা নোট বার করে আমার হাতটা টেনে মুঠোয় গুঁজে দিল। ”খেলতে চাও যদি, নিশ্চয়ই খেলবে। কুড়ি—পঁচিশ বছর কলকাতায় কোনও বড় ট্রফি আমরা পাইনি, এবার ভাল চান্স এসেছে লিগ পাবার, কাল তুমি ব্যাগড়া দিয়ো না ভাই।”
আমি তখনও বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠিনি। বললাম, ‘আমি ব্যাগড়া দেব?”
”ভয় তোমাকেই প্রসূন। কলকাতার সব ক্লাব এখন তোমাকে ভয় করে; মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহামেডান সবাই। কাল তুমি গোল দিয়ো না।”
এতক্ষণে আমি সংবিৎ ফিরে পেয়েছি। একশো টাকার নোটটা লোকটার বুকপকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বললাম, ”এখন থাক। আপনি আমাদের বাড়িতে আসুন, আমার বাবার হাতে এটা দেবেন।”
লোকটা ইতস্তত করে বলল, ”তোমার বাবা কী করেন?”
”বেকার। একটা ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন। লক আউট হয়ে বন্ধ।”
”তা হলে তো তোমরা বেশ অসুবিধের মধ্যে রয়েছ।” লোকটা বুকপকেটে হাত দিয়ে বেশ খুশি হয়েই বলল, ”তোমার উচিত সংসারকে হেলপ করা।”
আমি কথা বললাম না। লোকটাকে নিয়ে সটান বাবার সামনে হাজির করলাম। নীলিমা তখন বাবার কাছে বসে কলেজে ভর্তি হওয়ার অসুবিধে নিয়ে কথা বলছে। আমি কোনও ভূমিকা না করে বললাম, ”বাবা, কাল যুগের যাত্রীর সঙ্গে আমাদের খেলা। কাল আমি যেন না খেলি বা খেললেও যেন গোল না দিই, এই কথা ইনি বলছেন আর একশো টাকা আমায় দিতে চাইছেন।”
আচমকা এমন ভাবে বললাম যে, শুধু বাবা আর নীলিমাই নয়, কটা—চোখ লোকটাও আড়ষ্ট হয়ে গেল। অবশেষে বাবা মৃদু স্বরে বললেন, ”কোন ক্লাবের সঙ্গে খেলা?”
”যুগের যাত্রী।” আমি বললাম। মনে হল বাবার চোখ ঝলসে উঠল। ওঁর কপালের উপর আমি অবধারিত চোখ রাখলাম।
বাবা মাথা নিচু করে বললেন, ”আমি জানি না। আমি কোনও কথা বলব না। তুমি নিজেই ঠিক করো ঘুষ তুমি নেবে কি না।”
বাবা মাথা তুলে আমার মুখের দিকে তাকালেন। আমার বুক কাঁপতে শুরু করেছে। নীলিমা কী যেন বলবার চেষ্টা করছে আর আমি কী যেন একটা করতে চাইছি। আমার মনের মধ্যে তখনই কার কণ্ঠস্বর শুনলাম, ”প্রসূন, দ্যাখো দ্যাখো, তোমার বাবার অপমানিত কপাল। ওখানে বিজয়তিলক এঁকে দেবে তুমি, হ্যাঁ তুমিই।”
”কাল যাত্রীকে আমি হারাবই”, দাঁতে দাঁত চেপে বললাম। তার পর লোকটার দিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড চিৎকার করে বললাম, ”গেট আউট!”
লোকটা অবাক হল মাত্র, কিন্তু ঘাবড়াল না। যাবার সময় মুচকি হেসে বলে গেল, ”তুমি গোল দিতে হয়তো পারো, কিন্তু গোল খাওয়া বন্ধ করতে পারবে না। ফুটবল এগারো জনের খেলা মনে রেখো।”
আমার খুপরিতে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে আমি বসেছিলাম। ঘরে কে এসে দাঁড়াল। মুখ তুলে দেখি, নীলিমা একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে। সাগ্রহে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ”বাবা কিছু বললেন কি তার পর?”
”না, শুধু অনেকক্ষণ পর চোখ থেকে এক ফোঁটা জল মুছে নিতে দেখেছি।”
”আমি ঠিক করিনি নীলিমা?”
নীলিমা ভারী স্নিগ্ধ নরম স্বরে বলল, ”তুমি আজ সব্বাইকে এত বড় উপহার দিলে প্রসূন। ওহ এত বিরাট! প্রসূন, কাল তুমি দারুণ খেলবে, ঠিক জিতবে।”
।।১৯।।
ফুটবল যে এগারো জনের খেলা, এই সত্য নির্মমভাবে উপলব্ধি করলাম পরদিন। আর একটি শিক্ষা পেলাম—’জিতবই’ এমন কথা কদাচ বলবে না। যাত্রীর কাছে আমরা ২—৩ গোলে হেরে গেলাম। মাঠে যে এত ভিড় হবে কল্পনা করিনি। মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টারই বেশি। ওরা যাত্রীর হার চায়, তাই সোনালিকে মদত দিতে ওরা সবাই সোনালির সাপোর্টার হয়ে গেছে। ওরা আশা করেছিল, আমি একটা কিছু করব।
কিন্তু যাত্রী শোভাবাজার নয়। অত্যন্ত আঁটসাঁট আর চমৎকার গুছোনো ডিফেনস। ওদের লেফট হাফ অমিয় আর রাইট স্টপার ব্যাক দুলাল গত বছর মারডেকা টুরনামেন্ট খেলে এসেছে। গোলকিপার শ্যাম যে দিন খেলে, সে দিন একটি মাছিও গোলে ঢুকতে পারে না। তবে সেই দিনটি যে কোন খেলায় আসবে, তা কেউ বলতে পারবে না, শ্যামও না।
রাইট—ইন বিষ্ণু মিশ্র এ বছর জুনিয়ার ইন্ডিয়া ক্যাম্পে ডাক পেয়েছে, বলের উপর ভাল কনট্রোল আছে, তবে নিমাইয়ের মতো নয়। কিন্তু অনেক বেশি পরিশ্রমী আর যেমন ওঠে তেমনই নেমেও আসতে পারে। বুদ্ধিটা একটু কম। লেফট আউট আব্রাহামের মতো দ্রুত উইঙ্গার কলকাতায় দ্বিতীয় নেই। পেনালটি বক্সের কোণ থেকে ডান পায়ে এমন শট নেয়, যার শতকরা নব্বুইটা গোলে ঢুকবেই। লেফট—ইন শিবরমন ছোটখাটো, অত্যন্ত চতুর, বক্সের মধ্যে ছুঁকছুঁক করে বেড়ায়। কখন যে গোল ছিনিয়ে নিয়ে যাবে, বোঝা কঠিন। বয়স হয়ে গেছে, কিন্তু সেটা জানতে দেয় না।
আমরা মরিয়া হয়ে খেলব প্রতিজ্ঞা করে নেমেছিলাম। পনেরো মিনিট পর্যন্ত দু’ পক্ষই সতর্ক হয়ে শুধু মাঝ মাঠে খেলেছি। তার পরই বিষ্ণু হঠাৎ বল নিয়ে এগোয় আমাদের গোলের দিকে। রাইট হাফ ওর পিছু নেয়। বিষ্ণু বাঁ দিকের কর্নার ফ্ল্যাগের দিকে সরে গেল, আব্রাহাম ভিতরে ঢুকে এল। বিষ্ণু ব্যাক পাস দিল অমিয়কে, সে দিল আব্রাহামকে। কুড়ি গজ থেকে গোলে দুর্বল নিচু শট করল আব্রাহাম। সোনালির গোলকিপার রবি ঝাঁপিয়ে ধরতে পারল না। আমার মনে হল, রবি যেন ইচ্ছে করেই দেরিতে ঝাঁপিয়েছে। হঠাৎ সেই কটা—চোখের কথাটা মনে চমকে উঠল, ”গোল দিতে হয়তো পারো, কিন্তু গোল খাওয়া বন্ধ করতে পারবে না।”
আমি শিউরে উঠলাম। তা হলে একশো টাকার নোটের কাছে নিজেকে বিক্রি করার লোক সোনালিতে ওরা পেয়েছে। কিন্তু ক’জনকে কিনেছে জানি না। প্রত্যেকের উপর আমার সন্দেহ হচ্ছে এখন। রাইট আউট একটা সহজ বল ট্র্যাপ করতে গিয়ে বাইরে পাঠাল, অমনি সন্দেহ হল। পারলে নিশ্চয় আমাকেই দিতে হত, কেননা চমৎকার জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে। আব্রাহাম রাইট ব্যাককে কাটাতে গিয়ে পারল না। রাইট ব্যাক বলটা পায়ে রেখে লোক খুঁজতে তাকাচ্ছে, আব্রাহাম বল ছিনিয়ে নিল আর আমার সন্দেহ হল। সোনালির গলদ দেখছি আর সন্দেহ হচ্ছে।
হাফ টাইমের দু’ মিনিট আগে যাত্রী দ্বিতীয় গোল দিল। ডান দিক থেকে চমৎকার মুভ করে বাঁ দিক থেকে শেষ করল আব্রাহাম। পোস্ট আর ক্রসবারের কোণ দিয়ে বিদ্যুৎবেগে বলটা ঢুকল। রবির কিছুই করার ছিল না। হাফ টাইমে দাসুদাকে বললাম আমার সন্দেহের কথা, আর গতকাল যা ঘটেছে। দাসুদা রবির কাছে গিয়ে কথা বলতে লাগলেন। দূর থেকে দেখলাম রবি খুব অবাক হয়ে গেল, হাত নেড়ে তর্ক শুরু করতেই দাসুদা ইশারায় রিজার্ভ গোলকিপার অজিতকে ওয়ারম—আপ করতে বললেন। রবির মুখ ফ্যাকাশে হতে দেখলাম।
খেলা আবার শুরু হতেই আধ মিনিটের মধ্যে আমি গোল দিলাম। সেন্টার লাইন থেকে বল নিয়ে তিনজনকে কাটিয়ে ষোলো গজ থেকে শট নিলাম। শ্যাম ঠাওর করতে পারেনি, অন্তত তিন গজ বাইরে দিয়ে যাওয়ার কথা যে বলের, সেটা বেঁকে এসে ঢুকতে পারে। বিরাট গর্জন উঠল ইস্টবেঙ্গল মাঠ কাঁপিয়ে। আমি এই প্রথম গোল দেওয়ার পর এত বড় আওয়াজ পেলাম। তিন মিনিট পর রাইট আউট তরতরিয়ে উঠে ক্রস করল। শ্যাম গোল ছেড়ে বেরোতে সেকেন্ড তিনেক মাত্র দেরি করে, বল মাটিতে পড়া মাত্র হাফ ভলিতে নেটে পাঠিয়ে দিলাম।
গ্যালারিতে যেন বাজ ডেকে উঠল আর মাঠ যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট। চার—পাঁচ জন আমাকে জাপটে ঘাড়ে পিঠে ওঠার চেষ্টা করছে। দম বন্ধ হয়ে মারা যাবার মতো অবস্থা। এর পর গ্যালারি থেকে শুধু ”প্রসূনকে বল দে, প্রসূনকে, প্রসূনকে” রব উঠতে লাগল।
যাত্রী দ্বিগুণ উদ্যমে আক্রমণ শুরু করেছে। একে একে আমরা পিছিয়ে নেমে ঠেকাবার চেষ্টা করছি। চাপ ক্রমশই বাড়ছে। নতুন অনভিজ্ঞ অজিত পাগলের মতো খেলছে। লক্ষ করলাম, আমার কাছে যাত্রীর দুজন দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। পঁয়ষট্টি মিনিট পর্যন্ত যাত্রীকে রুখে আর পারা গেল না। অমিয়র চিপ থেকে বিষ্ণু হেড করল, বারে লেগে বল ফিরে আসছে, রাইট স্টপার বলটা উড়িয়ে দিতে গিয়ে মিস—কিক করে বিষ্ণুর পায়েই দিল। সেখানে থেকে বিষ্ণু সহজেই গোল দিল।
হেরে গেলাম। মাঠ থেকে বেরোচ্ছি আর শুনছি ”ওয়েল প্লেড প্রসূন… সাবাস প্রসূন!” কিন্তু আমি মনে মনে কুঁকড়ে আছি। ‘যাত্রীকে হারাব’ বলে বাবার সামনে জাঁক করেছি। হারাতে পারলাম না। হঠাৎ পিঠে একটা মৃদু চাপড়ানি আর চাপা স্বরে ‘তুমি সত্যিই ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে’ শুনে পিছনে তাকিয়ে সেই কটা—চোখকে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে যেতে দেখলাম।
টেন্টে ফিরে রবিকে কয়েকটা কথা বলার ইচ্ছে হয়েছিল, কিন্তু বলতে পারলাম না। উন্মনা হয়ে ও এক কোণে বসে রইল, কারও সঙ্গে কথা বলল না। তার পর নিঃশব্দে এক সময় টেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল। পিন্টু আমার সঙ্গে রয়েছে, তাড়াতাড়ি বাড়ি রওনা হলাম। বাসে পিন্টু বলল, ”নিমাইদা আমার সামনে বসেছিল। তোমাকে একটা ছেলে গালাগাল দিতেই নিমাইদা তাকে এক চড় কষিয়ে দিয়েছে।”
”আনোয়ার ছিল?”
”হ্যাঁ। নিমাইদাকে বার বার বলছিল তুই থাকলে প্রসূন আরও দু—তিনটে গোল পেত।”
”কী বলল নিমাই?”
”কিছু বলেনি।”
বাড়ি ফিরে অন্ধকার ঘরে শুয়ে রইলাম। খেলার রেজাল্ট পিন্টুই সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে। মা একবার ঘরে ঢুকে আবার বেরিয়ে গেলেন। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম না খেয়েই।
।।২০।।
যাত্রী লিগ চ্যাম্পিয়ান হল না। শিল্ডও শেষ হল না কোর্টের ইনজাংশনে। এর থেকেও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটল পরের বছরের শুরুতেই। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, যুগের যাত্রী, তিনটি ক্লাবই আমাকে চেয়েছে। আমার ইচ্ছে মোহনবাগানে যাওয়ার। কিন্তু শুনলাম, হাবিব আর সুকল্যাণকে ওরা নিচ্ছে, সুভাষকে ইস্টবেঙ্গল। আমি দোটানায় পড়েছি—যাব কি যাব না, গেলে খেলার সুযোগ পাব কি পাব না, এমন সময় যাত্রী আমায় ছ’হাজার টাকা দর দিল।
যাত্রীর সম্পাদক অনাদি বিশ্বাসের বাড়িতে কথা হচ্ছিল। আর ছিল সেই কটা—চোখ। পরে ওর নামটা জেনেছি, ডাকুদা। যাত্রীর টিম সিলেকশন কমিটির মেম্বার। বছরে হাজার দশেক টাকা খরচ করে। ক্লাবের মধ্যে প্রতিপত্তিতে সম্পাদকেরও উপরে। ডাকুদাই নাকি বিশেষ করে আমাকে চেয়েছে।
”তুমি অনিল ভটচাজের ছেলে। তোমার উপর তো যাত্রীর বিশেষ দাবি আছে।” সম্পাদক এই বলে তাকাল ডাকুদার দিকে। ডাকুদা শুধু মাথা নাড়ল। ”বাপ—ছেলে একই ক্লাবে খেলবে, এটাই তো স্বাভাবিক। তা ছাড়া—” সম্পাদক থেমে গেল। ডাকুদার দিকে একবার তাকিয়ে কেশে বলল, ”তোমার বাবার উপর সুবিচার করেনি যাত্রী। আমি জানি। কিন্তু তখন আমি তো ক্লাবের একটা অরডিনারি মেম্বার। সেই ফাইনাল খেলা আমি দেখেছি। আহ, কী খেলা তোমার বাবার, এখনও চোখে ভাসছে। অথচ ওর নামেই কিনা কলঙ্ক রটানো হল। এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে। আমাকেই করতে হবে।” সম্পাদকের যেন আবেগে কণ্ঠরোধ হল। আমার মন দুলে উঠছে বাবার প্রশংসা শুনে। যাক, তা হলে সবাই বিশ্বাস করে না।
”এবার আমরা ইয়ং টিম করব। বয়স হয়ে গেছে বেশির ভাগেরই। তোমাদের দিয়েই রিপ্লেস করাব। বাইরে থেকে আর প্লেয়ার আনব না। কেড়ে নাও, এই সব বুড়োদের হটিয়ে জায়গা কেড়ে নাও। ইন্ডিয়া টিমে যাত্রীর কোটা আছে, আমি তোমায় পুশ করব। স্কুল ফাইনালটা পাশ করো, আমি তোমায় ব্যাঙ্কের চাকরিতে ঢুকিয়ে দেব। যাত্রীর মেস আছে, সেখানে থাকবে। ভাল খাবে, ভাল করে খেলবে… এত অল্প বয়স, কত সম্ভাবনা তোমার সামনে।” সম্পাদক আন্তরিক স্বরে যেভাবে বলল, তাতে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম।
”ছ’ হাজার টাকা এখন তোমায় কেউ দেবে না, কিন্তু আমরা দেব।” ডাকুদা হাতের নখ পরীক্ষা করতে করতে বলল, ”এটা কিন্তু ঘুষ নয়।”
আমি এবার একটু লজ্জা পেলাম। বললাম, ”আমি সৎভাবে টাকা রোজগার করতে চাই।”
”নিশ্চয় নিশ্চয়, তাই তো উচিত।” সম্পাদক টেবিল চাপড়ে বলে উঠল। ডাকুদা ঘড়ি দেখে বলল, ”আচ্ছা প্রসূন, তা হলে এই কথাই রইল। তুমি ভেবে দেখো। এখনও মাসখানেক সময় তো আছে।”
ওখান থেকে আমি সোজা দাসুদার বাড়ি গেলাম। সব কথা শুনে দাসুদা বললেন, ”তুই যাত্রীতেই যা। সোনালিতে থাক, এমন কথা আমি বলব না। নিজের ভবিষ্যৎ তোকে দেখতে হবে তো। ফুটবলই তোর সব কিছু। তুই এবার বড় ক্লাবে যা। তবে সাবধানে থাকিস। ওখানে টাকাপয়সা যেমন বেশি, দলাদলিটাও বেশি। ডাকু লোকটা সুবিধের নয়। অনেক ছেলের ক্ষতি করেছে, কেরিয়ার শেষ করে দিয়েছে।”
”আমার কী ক্ষতি করবে? আমি যদি খেলতে পারি, তা হলে আমায় আটকাবে কে? খেলা দেখিয়েই এতটা এসেছি, আরও যাব।” আস্থাভরেই কথাগুলো বললাম। দাসুদা হেসে বললেন, ”তাই যেন পারিস।”
আমি যাত্রীতেই সই করলাম। ডাকুদা সেই দিনই দু’হাজার টাকা দিল। বাকিটা সারা বছরে চার কিস্তিতে দেবে। আমি সই করার দু’দিন পরেই কাগজে দেখি, আনোয়ার আর নিমাই যাত্রীতে সই করেছে। মনে মনে আমি ভীষণ খুশি হলাম।
দাসুদাকে বলেছিলাম, যদি খেলতে পারি, তা হলে আমায় আটকাবে কে? কিন্তু খেলার সুযোগই যদি না পাই, তা হলে পারি কি পারি না, প্রমাণ করব কেমন করে। যাত্রীর প্রথম পাঁচটা ম্যাচ ড্রেস করে সাইড লাইনের ধারে বেনচে বসে থাকলাম। আমাকে খেলানো হচ্ছে না, আমি নাকি খুবই কাঁচা, অনভিজ্ঞ। বালী প্রতিভা কি কালীঘাটের সঙ্গে খেলার মতন যোগ্যতাও নাকি আমার নেই। এই সব টিমের সঙ্গে খেলাতেও যাত্রীর কমিটি মেম্বারদের মুখ শুকিয়ে আসে, নতুন ছেলেদের নামাতে ভয় পায়। যদি পয়েন্ট যায়, তা হলে দোষ পড়বে কমিটির ঘাড়ে। তার থেকে নামী বুড়ো প্লেয়াররা নিরাপদ, কিছু ঘটলে দায়িত্বটা ওদের।
আনোয়ারকে প্রথম দুটো ম্যাচ খেলানো হয়নি। বালীর সঙ্গে ভাল খেলল, তার পর আর বসেনি। নিমাইও ওই ম্যাচে আধখানা খেলেছে। পরের ম্যাচ খিদিরপুরের সঙ্গেও আধখানা। কালীঘাটের সঙ্গে খেলার দশ মিনিটেই শিবরমনের চোট লাগা হাঁটুতে আবার লাগতে নিমাই নামে। দুটো গোলও দেয়। নিমাইকে এখন আর বসানো যাবে না।
যাত্রীর কোচ প্রিয়দাকে একদিন অধৈর্য হয়ে বললাম, ”আমাকে কি বসিয়ে রাখার জন্য এনেছেন?”
”কী করব ভাই,” নির্বিরোধী প্রিয়দা এধার—ওধার তাকিয়ে চাপা স্বরে বললেন, ”টিম করে সিলেকশন কমিটি, আর কমিটি মানে ডাকুদা। আমাদের কোনও কথাই কানে নেয় না। তুমি বরং ওকেই জিগ্যেস করো।”
ডাকুদাকে সেই দিনই ধরলাম। ওর কয়েকজন পেটোয়া প্লেয়ার আছে, তার মধ্যে দুজন বিষ্ণু আর আব্রাহাম তখন ডাকুদার সঙ্গে ক্লাব টেন্টের বাইরে বাগানে চেয়ারে বসে গল্প করছিল। আমি সটান জিজ্ঞাসা করলাম, ”ডাকুদা, আমাকে নিয়ে এলেন, কিন্তু খেলাচ্ছেন না কেন?”
”দরকার হলেই খেলাব।” ডাকুদা হাতের নখের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলেন।
”কবে দরকার হবে?”
”বলতে পারছি না এখন। হয়তো এই সিজনে দরকার নাও হতে পারে।”
”তা হলে এত টাকা খরচ করছেন কেন আমার জন্য? বসে থেকে যে আমার খেলা নষ্ট হয়ে যাবে।” কাতর স্বরে আমি বললাম।
”যাত্রীর মতন ক্লাব তোমার মতন দু’—চারটে প্লেয়ারকে বসিয়ে টাকা দিলে দেউলে হয়ে যাবে না। টাকার জন্যই তো খেলা, তা যখন পাচ্ছ তখন এত উতলা হওয়া কেন?” ডাকুদা তার কটা—চোখ দুটো বিরক্তিতে সরিয়ে নিলেন আমার মুখের উপর থেকে।
বিষ্ণু ব্যস্ত হয়ে বলল, ”এখন যা তো, আমরা দরকারি কথা বলছি, পরে যা বলার বলিস।”
মুখ কালো করে আমি চলে এলাম। নিমাই হেসে হেসে দুটো ছেলের সঙ্গে টেন্টের মধ্যে কথা বলছে। দেখেই বোঝা যায় পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলে। প্রায়ই ওদের দেখি, নিমাইকে নিয়ে সন্ধ্যার পর বেরিয়ে যেতে। নিমাই আমার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে আবার গল্প করতে লাগল। আনোয়ার আজ আসেনি। আমি ক্লাব থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার ধারে এসে দাঁড়ালাম।
একদৃষ্টে জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে পড়ল, দু’ হাজার টাকা নিয়ে বাড়িতে পৌঁছোনো মাত্র কেমন উৎসবের মতন হইচই শুরু হয়ে গেছিল। বিশু দত্তও নেমে এল উপর থেকে। পিন্টু, পুতুল, নীলিমা ভিড় করে দাঁড়াল। বাবা বাড়ি ছিলেন না।
”আরে বাব্বাঃ, ফুটবল খেলে অ্যাতো টাকা পাওয়া যায়, তা হলে তো ছোটবেলায় বল পেটালেই লাভ হত দেখছি!” বিশু দত্ত বলল।
”সবার কি আর সব জিনিস হয় দত্ত মশাই, এ সব হল গিয়ে ভগবানদত্ত ব্যাপার। প্রসূনকে তো একটা রিসেপশন দেবার ব্যবস্থা করা উচিত।” নুটুদা চট করে গম্ভীর হয়ে গেলেন।
”তার আগে একটু খাওয়াদাওয়া হোক। কী প্রসূন, পরোটা আর মাংস হবে নাকি?”
মা তখুনি টাকা দিলেন। বিশু দত্তই বাজারে গেল। সারা বাড়ির নেমন্তন্ন। নীলিমাকে বললাম, ”এবার আমার সব ধার শোধ করব। এখন আমিও কলেজে ভর্তি হয়েছি—ফুটবলের কলেজে।”
বাবা অনেক রাত্রে ফেরেন। আমি জেগে শুয়েছিলাম। মা নিশ্চয়ই বাবাকে বলবেন। উত্তরে বাবা কী বলবেন? দারুণ খুশি হবেন, না যথারীতি মুখ ফিরিয়ে চুপ করে থাকবেন! এক সময় বাবা ফিরলেন। ও ঘরে মা’র কথা বলার শব্দ পেলাম। তার পর আলো নিভে গেল। সকালে মাকে জিজ্ঞাসা করলাম—বাবাকে বলেছ? মা বললেন, ”উনি খুব অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, আমি সাত বছর খেলেও এত টাকা পাইনি।”
।।২১।।
আনোয়ার আর নিমাইয়ের সঙ্গে যাত্রীতে এসে প্রথম দেখা প্র্যাকটিস শুরুর আগের দিন। ড্রেসিং রুমে আমরা জনা—কুড়ি, কারোর সঙ্গেই তেমন আলাপ নেই। ওদের দুজনের পাশে আমি বসেছিলাম আড়ষ্ট হয়ে। প্রিয়দা আমাদের কাছে ফুটবল সম্পর্কে ছোটখাটো একটা বক্তৃতা দেন। ওঁর পাশে বসেছিল ডাকুদা। যুগের যাত্রীর ঐতিহ্য এবং তা বহন করার দায়িত্ব সম্পর্কে আমাদের সচেতন করে ডাকুদাও দু’—চার কথা বলে।
”ফুটবল খুবই সহজ খেলা, যদি না তুমি একে জটিল করে খেলো।” প্রিয়দা প্রথমেই এই কথাটা বলেছিলেন, ”আমরা এত বড়, এত পুরনো টিম, কিন্তু আজ পর্যন্ত কখনও লিগ বা শিল্ড পাইনি। একবার মাত্র ফাইনালে উঠেছিলাম, কিন্তু—” ডাকুদা থেমে গিয়ে আমার দিকে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সকলের চোখ আমার উপর এসে পড়েছিল।
আমি প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, যেন তারা অদ্ভুত জন্তু দেখছে। কারোর ঠোঁট বাঁকা, কেউ কেউ চোখে চোখে হাসল। আমি মাথা নিচু করে ঘেমে উঠলাম। মনে হল, ডাকুদা ইচ্ছে করেই আমাকে এই অবস্থায় ফেলেছে। যেন কিছু একটার প্রতিশোধ নিচ্ছে। নিমাই তখন হঠাৎ বলেছিল, ”ফাইনালে উঠে কেউ না কেউ তো হারবেই। আমরা আবার যাত্রীকে ফাইনালে তুলব, শিল্ডও নেব।” বলে নিমাই সকলের মুখের দিকে তাকায়। শুধু আনোয়ারই বলে, ”নিশ্চয়ই।”
বেলেঘাটায় যাত্রীর মেসে আর চারজনের সঙ্গে নিমাইও থাকে। আনোয়ার আর আমিও ছিলাম লিগ শুরুর আগে পর্যন্ত। সকালের প্র্যাকটিস বন্ধ হওয়ায় আর একটার পর একটা খেলায় বসে থাকায় বিরক্ত ও হতাশ হয়ে আমি বাড়ি চলে আসি। মেসে কারও সঙ্গে পারতপক্ষে কথা বলতাম না।
নিমাই আর আনোয়ারকে বিশেষ করে এড়িয়ে চললাম। দেখা হলে কথা হত। সাধারণ কথা। আগের মতন গলাগলি আর ফিরে আসেনি। কিন্তু বুঝতে পারি, ওরা চায় আবার আমরা ‘থ্রি মাসকেটিয়ারস’ হই। কিন্তু আমিই সহজ হতে পারি না। সকলের সামনে ডাকুদা শিল্ড ফাইনালের কথা তোলার পর থেকে আমি কুঁকড়ে গেছি।
বাড়িতে কেউ খেলা নিয়ে কথা বলত না। খেলার দিন দুপুরে যখন বাড়ি থেকে বেরোই, তখন শুধু পিন্টুর কথা মনে পড়ত। কিন্তু ও স্কুলে থাকে দুপুরে। বাড়িতে থাকলেও মাঠে যাবার বায়না ধরবে না। ও বোঝে আমার অবস্থাটা। নীলিমা আর মা, ওরাও কিছু বলে না। দিনরাত পড়াশোনা করে ফেল করলে, বাড়ির লোক যেমন ব্যবহার করে, ওরা তাই করছে। শুধু বিশু দত্ত একদিন দোতলা থেকে চেঁচিয়ে বলেছিল, ”কী গো প্রসূন, কাগজে আর নামটাম দেখছি না যে?”
.
কখন যে চোখ দিয়ে টসটস করে জল পড়তে শুরু করেছে বুঝিনি। বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস জমে উঠেছিল। ধীরে ধীরে সেটা গঙ্গার ঠাণ্ডা হাওয়ায় মিশিয়ে দিলাম। কানে কানে কে যেন বলল, ‘হাল ছেড়ো না, হতাশ হোয়ো না প্রসূন! উদ্যত থাকো, সময় এলেই আঘাত করবে।’ আমি আপন মনে মাথা নাড়লাম। পারব না, আর আমি পারব না। ইডেনের ধারে বাসস্ট্যান্ড। আমি শেষ বাসে উঠে বাড়ি এলাম।
.
হাওড়া ইউনিয়নের সঙ্গে ৫—০ গোলে যাত্রী জিতছে, খেলা শেষ হতে প্রায় দশ মিনিট বাকি। ডাকুদা ইশারায় প্রিয়দাকে ডাকল। তার পর প্রিয়দা আমার কাছে এসে বললেন, ”ওয়ারম আপ প্রসূন।”
অবাক হয়ে গেলাম। তা হলে কি কপাল ফিরল! প্রিয়দা রাইট আউট সলিল করকে ডেকে নিলেন। নামার আগে মাঠে আঙুল ঠেকিয়ে যখন কপালে বুকে ছোঁয়ালাম, সারা শরীর কেঁপে গেল। নিমাই ছুটে কাছে এসে বলল, ”বল দেব, গোল কর।”
আধ মিনিটের মধ্যেই নিমাই বল পাঠাল, হাওড়ার হাফ লাইন বরাবর। ছুটে গিয়ে ধরতে পারলাম না। গ্যালারিতে আওয়াজ উঠল। চারদিকে তাকিয়ে কেমন অস্বস্তি হল। নতুন নতুন লাগছে সব। প্লেয়াররা কত দূরে ঠিক আন্দাজ হচ্ছে না। কখন ছুটব, ফাঁকা জমি কোথায়, বল কোথা থেকে আসবে, কিছু বুঝছি না।
দিন—রাত পড়ে জলের মতন যা মুখস্থ ছিল, এখন আর তা মনে পড়ছে না। অনেক দিন বই না খুললে যা হয়। উৎকণ্ঠায় ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। ক’ মিনিট পরেই হুইসল বাজবে। তার মধ্যে একটা কিছু করতেই হবে। ডজ করব কি তিন—চার জনকে? চেঁচালাম, ”নিমাই, দে।”
গ্যালারিতে হাসির রোল উঠল। একজনকে কাটিয়েই হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। বলকে সেই রকম আগের মতন অনুভব করতে পারছি না। বলটা পায়ে আছে কি নেই, বুঝতে পারিনি। শরীরটাকে কতখানি দোলাব, কোমর থেকে ঝাঁকুনিটা কখন দেব, আন্দাজ করতে পারিনি।
নিমাই বল নিয়ে ডান দিকের কর্নার ফ্ল্যাগের দিকে এগোচ্ছে। আমি ভিতরে ঢুকে এলাম বক্সের মধ্যে। নিমাই কাটাল লেফট ব্যাককে। বলটা আমায় ঠেলেই স্টপারকে সঙ্গে নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে বলল, ”বল দে আমায়।” আমি বল ঠেললাম সোজা স্টপারের পায়ে। গ্যালারি বিরক্তি জানাল বেশ জোরেই। নিমাই করুণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ”ঘাবড়ে গেছিস। বি স্টেডি।”
.
পাঁচ গোলে জিতছি, তাই আমার বোকামি আর অপদার্থতা রাগের বদলে মজার জিনিস হয়ে উঠল গ্যালারিতে। খেলার মধ্যে আর কিছু উত্তেজনা নেই, তাই ওরা নিষ্ঠুর হয়ে উঠল। একটার পর একটা ভুল করছি আর মনে হচ্ছে যেন ডুবে যাচ্ছি। বিষ্ণু কোমরে হাত দিয়ে হাসছে। অমিয় মজা পেয়ে বলছে, ”অ্যাই, অ্যাই, প্রসূনকে বল দে।” গ্যালারি ফেটে পড়ছে হাসিতে। নিমাইয়ের ডিফেনস চিরে দেওয়া থ্রু—টা যখন প্রচণ্ডভাবে পোস্টের চার গজ বাইরে মারলাম, তখন হাওড়ার দু—তিনজনও হাসি চাপতে পারল না। আমি হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে পড়লাম। আর তখনই খেলা ভাঙার হুইসল বাজল। কে এসে আমার পিঠে হাত রাখল। মুখ তুললাম। দেখি, নিমাই চলে যাচ্ছে।
আমি যাত্রীর টেন্টের দিকে লিগ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর যাইনি। ক্লাব থেকে লোক এসেছিল ডাকতে। শিবরমনের হাঁটুতে জল জমেছে। এই সিজনে আর খেলতে পারবে না। নিমাই আর বিষ্ণুর উপর চাপ পড়ছে খুব। একটা ম্যাচও জিরোতে পারেনি ওরা। মাঝে মাঝে দীপুদাকে খেলানো হয়েছে ওদের একজনকে বসিয়ে। দীপুদা তেরো বছর আগে যাত্রীতে প্রথম খেলা শুরু করেন। এখন আর পারেন না। নতুন ছেলেদের মধ্যে সৌমেন আর বলাইয়ের নাম কাগজে দেখেছি।
যাত্রী লিগে চতুর্থ হয়েছে। বছরের সব থেকে বড় কৃতিত্ব মোহনবাগানের কাছ থেকে একটা পয়েন্ট নেওয়া। নিমাই প্রথমে গোল দিয়েছিল। পেনালটি থেকে প্রণব গাঙ্গুলী শোধ করে। কাগজ পড়ে বুঝতে পারলাম না নিমাই কেমন খেলেছে। রিপোর্টারদের মধ্যে যাত্রীর সাপোর্টার একজনও নেই। মোহনবাগানকে গোল দিতে পেরে নিমাই যে দারুণ খুশি, তাতে আমার সন্দেহ নেই।
বিকেলে আমার ছোট্ট পাঠশালায় পিন্টুর বন্ধুদের নিয়ে প্র্যাকটিস করছিলাম। তখন নিমাই আর আনোয়ার এসে হাজির। আমি অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম শুধু। ওরা রংচঙে বুশ শার্ট পরেছে, চুলগুলো যেমন বড়, জুলফিও তাই। পায়ে দামি চটি। দুজনেরই হাতে বিদেশি ঘড়ি।
”যাস না কেন টেন্টে?” নিমাই বলল।
আমি ফিকে হাসলাম। ”কেন যাই না সেটা তো বুঝতেই পারিস।”
”ফুটবল খেলায় ওরকম অনেক কিছু হয়। মাঠে আয়, প্র্যাকটিস কর, আবার খেলা ফিরে পাবি। এই ছোট মাঠে বল নিয়ে বাচ্চচাদের সঙ্গে ঠুকঠুক করে খেলা আরও খারাপ করছিস কেন?” আনোয়ার বলল।
তর্ক করতে পারতাম, ইচ্ছে হল না। বললাম, ”যাব’খন। প্র্যকটিস হচ্ছে নাকি?”
”হবে না? শিল্ডের খেলা তো এসে গেল। এবার ইন্ডিয়ার বাইরের টিম খেলতে আসছে। তুই আয়, তোকে দরকার। ফরোয়ার্ড আর কেউ তো নেই। বিষ্ণু ইনজুরি নিয়ে খেলেছে লিগের শেষ ক’টা ম্যাচ। আবার লেগে গেলে একদম বসে যাবে।” নিমাই ঘড়ি দেখতে দেখতে বলল।
”ডাকুদা আমায় খেলাবে ভেবেছিস?”
”আয় না, তার পর দেখা যাবে। গড়ের মাঠ থেকে দূরে থাকিস না, ওতে ক্ষতিই হবে। সকালে আসিস, কেমন?”
মনটা চনমন করে উঠল। গড়ের মাঠ, শিল্ড, ফুটবল এই শব্দগুলোয় শিহরন লাগে। শিল্ডে খেলার লুকোনো ইচ্ছেটা মাথা চাড়া দিল, আবার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীর গ্যালারির বিদ্রূপের হাসিও কানে বেজে উঠল। আমি বলে ফেললাম, ”কেমন যেন ভয় করছে।”
ওরা অবাক হয়ে গেল। আনোয়ার বলল, ”কীসের ভয়? পাবলিককে? গোল দে, দেখবি, ওরাই আবার তোকে মাথায় তুলে নাচবে।”
নিমাই বলল, ”গোল তুই পাবিই, আমি তো আছি।” ঘড়ি দেখে বলল, ”রাজুরা অপেক্ষা করছে রে, আনোয়ার! আর নয়, দেরি হয়ে গেছে। তা হলে কাল, কেমন?”
ওরা চলে যাবার পর মনে হল, আগের দিন হলে এমন করে আমায় ফেলে নিমাই কিংবা আনোয়ার চলে যেত না, এমন পোশাকি ঢঙে কথা তো বলতই না। আমি অনেকক্ষণ ভাবলাম ওদের কথা। ঠিকই বলেছে, এই ছোট জমিতে ছোটদের সঙ্গে খেলে কিছুই হবে না। গড়ের মাঠের বিরাট জমি, হাজার হাজার লোক, সেই আবহাওয়া আর উত্তেজনার কাছাকাছি থাকতে হবে। দেহে মনে শুষে নিতে হবে। ঠিক করলাম, আবার যাত্রীর মাঠে যাব প্র্যাকটিসে।
।।২২।।
আমার যে কত বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয় আছে, সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝলাম যাত্রী শিল্ড ফাইনালে উঠতেই। টিকিট, টিকিট, একখানা টিকিট। ‘প্রসূন, তোকে সেই কত ছোট্টটি দেখেছি, আর কী বড়ই না হয়ে গেছিস… প্রসূন, মনে আছে কী বলেছিলিস… প্রসূনদা আমি কিন্তু ছাড়ব না, আপনার দরজায় হাংগার স্ট্রাইক হবে, মাঠে যেতে দোব না…’ ঝালাপালা হয়ে গেলাম আমি। হেসে মাথা নেড়ে ‘আচ্ছা দেখব, চেষ্টা করব’ এই সব বলে পাশ কাটাচ্ছি। যুগের যাত্রী কুড়ি বছর পর আই এফ এ শিল্ড ফাইনালে! সেমি ফাইনালে মহামেডানকে এক গোলে হারিয়েছে। গোলটা দিয়েছে অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি—প্রসূন ভট্টাচার্য।
দ্বিতীয় রাউন্ডে যাত্রীর প্রথম খেলায় আমি আর বিষ্ণু আধাআধি খেলি কটক কম্বাইন্ডের বিরুদ্ধে। বিষ্ণু খোঁড়াচ্ছিল। ওকে তুলে নিয়ে প্রিয়দা আমাকে নামান। ৩—০ জিতি, তার মধ্যে একটা গোল আমার। অমিয়র লম্বা থ্রো নিমাই হেড করে আমার পায়ে ফেলামাত্র হাফ ভলিতে মারি বারো গজ থেকে। গোলকিপার নড়ার সময় পায়নি। তৃতীয় রাউন্ডে গোয়ার ভাসকো ক্লাবকে ২—০ হারালাম। আমি গোল করতে পারিনি, সলিল আর আব্রাহাম গোল দেয়। ও দিক থেকে রেঙ্গুন ইউনাইটেড উঠেছে কোয়ার্টার ফাইনালে। জলন্ধর লিডারসকে ২—১ গোলে হারিয়ে উঠল সেমি ফাইনালে। এই প্রথম ইডেনে বসে আমি ফুটবল খেলা দেখলাম। রেঙ্গুনের সেন্টার ফরোয়ার্ডের আর রাইট হাফের খেলা আমার ভাল লাগল। আর কারও নাম মনে রাখতে পারিনি, শুধু মংবা আর লি সান ছাড়া। মংবা—র বেশ বয়স হয়েছে, অন্তত পঁয়ত্রিশ তো বটেই। প্রথম গোল খেয়েই রেঙ্গুন চঞ্চল হয়ে ওঠে, খেলায় সাময়িক বিশৃঙ্খলা আসে। মংবা বল ধরে শান্ত ধীরভাবে প্লেয়ারকে কাটিয়ে দেখেশুনে বাড়িয়ে দিচ্ছিল। খেলার গতি ধীরে করে আবার টিমকে গুছিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত মংবা তার চমৎকার বল কন্ট্রোল ক্ষমতাকে যেভাবে কাজে লাগাচ্ছিল, তাতে শ্রদ্ধা হল ওর উপর। লি সান—ও বয়স্ক, নিজেদের পেনালটি বক্স পর্যন্ত নেমে এসে বল নিয়ে আবার উঠছিল। চট করে একজনকে বলটা ঠেলে দিয়েই লি সান আচমকা বুলেটের মতো এগিয়ে আবার পাশটা নেয়। একসঙ্গে দুজন কেটে যায় সেই দৌড়ে। দু’পায়ে তৈরি কিক, হেড দিতে ওঠে সবাইকে ছাড়িয়ে। শুনলাম বর্মা টিম থেকে দুজনেই এবার বাদ পড়েছে।
আমরা এরিয়ান আর শিখ রেজিমেন্টাল সেন্টারকে হারিয়ে উঠলাম সেমি ফাইনালে। আমি গোল করতে পারিনি দুটো খেলাতেই। মহামেডান দু’ দিন ড্র করে ইস্টবেঙ্গলকে এক গোলে হারিয়ে আমাদের সামনে পড়ল, ও দিকে উঠল মোহনবাগান—রেঙ্গুন ইউনাইটেড।
সেমি ফাইনাল খেলার আগের দিন ক্লাব প্রেসিডেন্টের পার্ক সার্কাসের বাড়িতে আমাদের রাখা হল। তিনতলায় বিরাট একটা হলঘরে আমরা রইলাম। আব্রাহাম, শ্যাম, অমিয়—রা অনেক রাত পর্যন্ত তাস খেলল। সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনে হল শোভাবাজারের টিকাদারের মতো যেন একজনকে ঢুকতে দেখলাম গেট দিয়ে। একটু পরে প্রিয়দা থমথমে মুখে দুজন সিনিয়ার প্লেয়ারকে ডেকে নিয়ে গেলেন।
দুপুরে খাওয়ার পর শ্যাম আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ”একটা বিশ্রী খবর এসেছে প্রসূন, আনোয়ার নাকি টাকা খেয়েছে।”
থ’ হয়ে গেলাম আমি। অকল্পনীয় এবং ডাহা মিথ্যে। আমি বললাম, ”বিশ্বাস করি না।”
”সত্যি—মিথ্যের কথা নয়! খেলার ঠিক আগে কারও সম্পর্কে এ ধরনের কথা রটলে তাকে বসাতে হয়। মুশকিল হয়েছে ম্যাচটা মহামেডানের সঙ্গে আর আনোয়ারও মুসলমান। চট করে সবাই বিশ্বাস করে নেবে।”
”খবরটা কে দিল?”
”সকালে দু’বার উড়ো টেলিফোন এসেছে, তা ছাড়া টিকাদার এসেও বলে গেল আনোয়ারকে নাকি পরশু রাতে গ্র্যান্ড হোটেল থেকে বেরোতে দেখেছে, সঙ্গে ছিল মহামেডানের দুজন অফিসিয়াল।”
”বাজে কথা!” আমি চিৎকার করে উঠলাম। ”আনোয়ার আর আমি পরশু একসঙ্গে টেন্ট থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়ি গেছি। এ সব টিকাদারের বদমাইসি, ও শোধ নেবার জন্য রটাচ্ছে।”
আমি ছুটে ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখি, ডাকুদা আর প্রিয়দা গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে। বাকি সবাই বিস্মিত, অপ্রতিভ চোখে কেউ কেউ নির্বাক, কেউ চাপা স্বরে দু’—একটা কথা বলছে। ঘরের এক কোণে দেয়ালে ঠেস দিয়ে আনোয়ার বসে।
”আনোয়ারের আজ না খেলাই উচিত।” ডাকুদা বলল, ”মনে অস্বস্তি নিয়ে খেলা যায় না।”
”নিশ্চয়ই খেলবে।”
আমার গলার স্বরে এমন কিছু ছিল, সবাই চমকে উঠল। ”বাজে মিথ্যা গুজবের কাছে মাথা নোয়াব কেন?”
”যদি আজ যাত্রী হারে, যদি আনোয়ারের গলদেই গোল হয়, তা হলে আমাদের আর আনোয়ারের অবস্থাটা কী হবে বুঝতে পারছ?” ডাকুদা বলল। এত উদ্বিগ্ন হতে কখনও ওকে দেখিনি।
আমি তাকালাম নিমাইয়ের দিকে। নিমাই চুপ করে শুনছিল এতক্ষণ। বলল, ”আনোয়ার যদি খেলে, যাত্রী হারবে না।”
গলা খাঁকারি দিয়ে শ্যাম বলল, ”আনোয়ার আজ খেলবে। নয়তো আমার বদলে অন্য কেউ গোলে খেলুক।”
আব্রাহাম বলল, ”আনোয়ারকো খেলানেই হোগা।”
গড়িয়ে পড়ার একটা শব্দ শুনে আমরা তাকিয়ে দেখি, ঠেস দিয়ে বসা আনোয়ার জ্ঞান হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।
আনোয়ার বিকেলে খেলেছিল। গোলটা আমি দিয়েছিলাম বটে, কিন্তু একজনে একটা টিমের সঙ্গে কীভাবে লড়তে পারে, সে ধারণাটা সে দিনই প্রথম হল। খেলার পর আমরা আনোয়ারকে কাঁধে করে মাঠ থেকে বেরোই। শ্যাম দু’বার মাত্র বল ধরে সারা ম্যাচে। আনোয়ারকে চারবার আমি মহামেডান পেনালটি বক্সের মধ্যে দেখেছি, গোল করতে উঠে এসেছিল।
পর দিন মোহনবাগান হেরে গেল রেঙ্গুন ইউনাইটেডের কাছে ০—২ গোলে।
।।২৩।।
রাত্রে ঘুম আসছে না। শিল্ড ফাইনালের আর ৪০ ঘণ্টাও বাকি নেই। কাল সকালে আমরা প্রেসিডেন্টের বাড়িতে জমা হব। সেখান থেকে ফাইনাল খেলতে ইডেনে যাব। ছটফট করছি বিছানায়। অস্বস্তি আর উত্তেজনা, ভয় আর আশা সব মিলিয়ে আমার সারা শরীর দপদপ করছে, মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। এমন সময় কে ঘরে ঢুকল। অন্ধকারে তাকিয়ে বুঝলাম, মা।
পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মা বললেন, ”ঘুম আসছে না!”
প্রশ্ন নয়, মা যেন খবরটা জানিয়ে দিলেন। আমি ‘ উ’ বলে মা’র কোলে মাথা তুলে দিলাম।
”জানি। এই রকমই হয়। ফাইনাল খেলা কী জিনিস আ উমার জানা আছে।”
”বাবা কিছু বলেননি! আমি যাত্রীর হয়ে ফাইনাল খেলব, বাবা কিছু বলেননি?”
”ও ঘরে তোর মতোই ছটফট করছে।”
মা আমার সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। ধীরে ধীরে ঘুম নেমে আসছে। স্নিগ্ধ হয়ে জুড়িয়ে আসছে শরীর। মা’র শরীর থেকে দূর্বা ঘাস আর ভিজে মাটির গন্ধে ম ম করে উঠছে ঘরটা। মনে হচ্ছে, বল নিয়ে আমি খেলা করছি। ঘুম জড়িয়ে আসছে সর্বাঙ্গে। তন্দ্রাচ্ছন্ন গলায় বললাম, ”কাল টিকিট পাঠিয়ে দেব, তুমি দেখতে যেয়ো!”
তার পর আমি সাদা—কালো ফুটকি দেওয়া বলটা নিয়ে হেলে দুলে এগোতে লাগলাম, লাফালাম, হঠাৎ ছুটলাম। পড়ে গিয়ে আবার উঠলাম। মার বুকের মধ্যে বড় বড় ঢেউয়ের ওঠা—পড়ার শব্দ হচ্ছে। প্রবল বেগে বাঁধ—ভাঙা বন্যার জল যেন ছুটে আসছে।
”পরশু তোর বাবাও খেলবে খোকা। তোর মধ্যে দিয়ে ফিরিয়ে আনবে যা হারিয়েছে। তুই জিতবি, ঠিক জিতবি।”
ক্রমশ মা’র গলার স্বর দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে আর এগিয়ে আসছে প্রচণ্ড গর্জন। আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। আমি কোথায় যাব, কোথায় আশ্রয় নেব? সাহায্যের জন্য চিৎকার করে উঠলাম—স্ট্রাইকার, স্ট্রাইকার!
গর্জনটা আরও জোরে আমাকে গোল হয়ে ঘিরে ধরল।
.
এত লোক! ষাট—সত্তর হাজারের কম নয়। সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল আমার শট রেঙ্গুনের বার ছুঁয়ে বেরিয়ে যেতেই। পঁয়ত্রিশ গজ থেকে শটটা নিয়েছিলাম, আচমকা।
বাইরে থেকে প্রিয়দা পাগলের মতন হাত নাড়ছেন, আমাকে পিছিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিতে দিতে। আজ সকালে বারবার আমাকে বলেছেন, দশ নম্বরের সঙ্গে ছায়ার মতো থাকবে গোপাল। তুই নেমে এসে গোপালের জায়গাটা সামলাবি। লি সান—টাই হচ্ছে ডেনজারাস। ওকে আটকালে ওদের অ্যাটাক খোঁড়া হয়ে যাবে।
গোপালকে নিয়ে লি সান একবার ডাইনে আর একবার বাঁয়ে যাচ্ছে। বড় বড় গ্যাপ পড়ছে আমাদের ডিফেনস—এ। আমি নেমে এসে কোন দিক যে সামলাব ভেবে পাচ্ছি না। ওদের অ্যাটাক খোঁড়া করতে গিয়ে যাত্রীর অ্যাটাকই খোঁড়া হয়ে গেছে, তবু মাঝে মাঝে এগিয়েছি আর প্রিয়দা হাত নেড়ে আমাকে পিছিয়ে যেতে বলেছেন। এক সময় নিমাইকে বললাম, ”এভাবে চললে আমরা গোল খাব। ওদের বক্সে বল নিয়ে গিয়ে খেলতে হবে। আমাদের ডিফেনস থেকে প্রেশার তুলতে হবে, নয়তো এই প্রেশার রাখতে পারব না।
বলতে বলতেই আমরা গোল খেলাম। কর্নার ফ্ল্যাগের কাছ থেকে রেঙ্গুনের লেফট আউট সেন্টার করে। লি সানকে নিয়ে গোপাল ব্যস্ত। লেফট ব্যাক উঠে এসেছিল। চলতি অবস্থাতেই কুড়ি গজ থেকে ধাঁধানো শটে বলটা পোস্টে লেগে গোলে ঢুকল। সারা ইডেন স্তব্ধ। শুধু কয়েকটা হাততালির শব্দ শোনা গেল। খেলার বয়স এখন মাত্র কুড়ি মিনিট।
সেন্টারে বল বসাবার সময় নিমাই বলল, ”উঠে খেল। প্রিয়দার দিকে আর তাকাসনি।”
পরের মিনিটেই নিমাই থেকে আব্রাহাম, আবার নিমাই এবং সে দু’জনকে কাটিয়ে রিভারস পাস দিল আমাকে। গোল হতে পারে! ইডেন দাঁড়িয়ে উঠে খ্যাপার মতো চিৎকার করে উঠল ”গো ও ও ল, গো ও ও ল।” আমার সামনে গোল। স্টপার আর ব্যাকের মাঝখানে একটা ফাঁক দেখতে পাচ্ছি। দ্বিধা করলাম, মারলে যদি গোল না হয়! বরং আর একটু এগিয়ে যাই। ভুল করলাম এইখানেই। বলটা ঠেলে দিয়ে এগিয়ে যাবার মুহূর্তে মংবা—র পরিচ্ছন্ন স্লাইডিং ট্যাকলে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। স্টপার বলটা নিয়ে বেরিয়ে গেল।
যখন উঠলাম, ইডেনের আর্তনাদ তখন আছড়ে পড়ছে গ্যালারি থেকে। আমি মাথা নামিয়ে ফিরে যাচ্ছি, তখন প্যাভিলিয়নের সামনের গ্যালারি থেকে কে চেঁচিয়ে উঠল, ”কার ব্যাটা দেখতে হবে তো!” আমি মুখ তুলে তাকালাম।
আনোয়ার অনবদ্য খেলছে, অমিয়ও। শ্যামের আজ সেই দিন, যে দিন ও পাগলার মতো খেলে। পর পর তিনটে অবধারিত গোল বাঁচিয়ে যাত্রীর ডিফেনসকে ও চাঙ্গা করে তুলেছে। আঠারো গজ লাইনের কাছে এসে ও উইঙ্গারদের ক্রসগুলো ফরোয়ার্ডের মাথা থেকে তুলে নিয়েছে। বক্সের বাইরে পর্যন্ত বেরিয়ে এসে চার্জ করে বল ক্লিয়ার করেছে। গোলটা খাওয়ার পরই আমাকে উপরে রেখে নিমাই আর সলিল নেমে এসেছে যাত্রীর হাফ এলাকায়।
একা মাঝ—মাঠে দাঁড়িয়ে মনে হল গ্যালারি থেকে লোকেরা যদি এখন হুড়মুড় করে নেমে আসে? কেন যে মনে হল জানি না, আমি ভয়ে পিছিয়ে এলাম। আর ঠিক তখনই আনোয়ার বলটা লব করে রেঙ্গুন হাফ এলাকার ঠিক সেই জায়গায় ফেলল, যেখান থেকে আমি এইমাত্র পিছিয়ে এসেছি। রেঙ্গুনের স্টপার ছাড়া আর কেউ নেই। বলটা ধরবার জন্য সে বাঁদিকে দৌড়োচ্ছে। আনোয়ার চিৎকার করে উঠল, ”প্রসূন, বল ধর।”
ওর গলার স্বরে কী যে ছিল, মনে হল পারব। মরিয়া হয়ে ছুটতে শুরু করলাম। স্টপার যখন বুঝতে পারল, তার আগেই আমি বলের কাছে পৌঁছোব, শেষ চেষ্টা হিসাবে সে ঝাঁপ দিল আমার পায়ের উপর। লাফিয়ে উঠলাম, ওকে ডিঙিয়ে মাটিতে পা রেখেই দেখি, আমার সামনে কেউ নেই। শুধু গোলকিপার ইতস্তত করছে গোল ছেড়ে বেরোবে কি না।
বলটাকে সামনে ঠেলে লম্বা দৌড় শুরু করলাম। পিছনে পায়ের শব্দ পাচ্ছি। ইডেনের গর্জন ধাপে ধাপে উঠছে আর রেঙ্গুনের গোল ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে। বক্সে ঢুকে পড়েছি। গোলকিপার এবার বেরিয়েছে। কানে তালা লাগানো চিৎকার আমার চারপাশে। বলটা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। জানি, পিছনে কেউ আসছে বলটা ছিনিয়ে নিতে।
ডান দিকে হেলে বলটাকে মারার জন্য বাঁ পা তুললাম। গোলকিপার বাঁ দিকে ঝুকল। মুহূর্তের ভগ্নাংশে বাঁ দিকে হেলে ডান পায়ে বলটা আলতো করে ওর মাথার ওপর দিয়ে চিপ করে পাঠালাম। বেচারা বাঁ দিকে ঝোঁকা অবস্থায় অসহায়ের মতো ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, বলটা গোলে ঢুকছে।
তার পর যাত্রীর দশজন আমার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল আর গর্জনে ভেঙে পড়ল ইডেনের আকাশ। যখন সেন্টারে এসে দাঁড়ালাম, তখনও বুঝতে পারছি না কী ঘটেছে। সত্যিই কি গোল করলাম! বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই হাফ টাইমের বাঁশি বাজল।
।।২৪।।
”দারুণ গোল হয়েছে… আমি তো ভেবেছিলুম, এটাও মিস করবি।” প্রিয়দা উত্তেজনায় হাঁফাচ্ছেন।
”এই গোলই মিস করেছিল একজন।” পিছন থেকে একটা গলা শুনলাম। আমি ফিরে তাকালাম না। জানি, একজোড়া কটা—চোখ এখন আমার পিঠে বিঁধে রয়েছে। ভোলেনি, অনেকেই ভোলেনি। ড্রেসিং রুমে কে ট্রানজিস্টর খুলেছে। পুষ্পেন সরকারের গলা শুনতে পেলাম, ”…শিল্ড ঘরে তুলতে পারবে কি না এখনই বলতে পারছি না, তবে যুগের যাত্রীর তরুণ স্ট্রাইকার প্রসূন ভট্টাচার্য যে অপূর্ব দক্ষতায় গোলটি শোধ দিল তা বহু দিন স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন, এই প্রসূনেরই বাবা অনিল ভট্টাচার্য কুড়ি বছর আগে শিল্ড ফাইনাল খেলেছিলেন এই যুগের যাত্রীর হয়ে। পিতা—পুত্রে আই এফ এ শিল্ড ফাইনালে খেলার নতুন নজির আজ গড়ে উঠল। হয়তো গ্যালারিতে বসে অনিলবাবু এখন দেখছেন…”
বাবা! আসবেন কি খেলা দেখতে! কাল চারটে টিকিট পাঠিয়েছিলাম—বাড়ির জন্য তিনটে, হর্ষদার একটা। কিন্তু বাবা আসবেন বিশ্বাস হয় না। তবু আবার মাঠে নামার সময় গ্যালারিগুলোর দিকে তাকালাম। অজস্র হাত আমার উদ্দেশে নড়ছে। কিন্তু আমি একটা মুখও দেখতে পেলাম না। শুধু আবছা ঘষা কাচের মধ্য দিয়ে যেন হাজার হাজার বিন্দুর নড়াচড়া চলেছে কতকগুলো রেখা তৈরি করে। এর মধ্যে কোথাও কী বাবা বসে আছেন!
রেঙ্গুন ইউনাইটেড ঝড়ের মতো শুরু করল। মিনিট পাঁচেক আমাদের কাঁপিয়ে দিয়ে হঠাৎ ওদের যেন দম ফুরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে যাত্রী উঠে এল ওদের হাফ লাইনে। নিমাই, আব্রাহাম চমৎকার বল রাখছে মাটিতে, পায়ে বল ছিটকে যাচ্ছে স্ফুলিঙ্গের মতো। নিমাই তছনছ করছে হাফ লাইন পর্যন্ত, কিন্তু নিরেট শক্ত ডিফেনসের পাঁচিলটা টপকাতে পারছে না। আমি জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছি গোলে শট নেওয়ার। কোথাও যদি আলগা থাকে ভিতরে ঢোকার।
গোল হচ্ছে না। খেলা শেষ মুখে এসে গেছে। অধৈর্য গ্যালারির গর্জন উঠছে নামছে। এমন সময় নিমাইকে ফাউল করল ওদের রাইট ব্যাক, আঠারো গজ লাইনের বাঁ দিকে হাত দুয়েক বাইরে। ফ্রি কিক। বলটা বসিয়ে নিমাই আমার দিকে তাকিয়ে দুটো আঙুল দেখাল। বুঝে গেলাম ও কোথায় বল পাঠাবে। প্র্যাকটিসে এই সঙ্কেতগুলো আমরা ঠিক করে নিয়েছি। ওরা পাঁচজনে পাঁচিল তুলে দাঁড়িয়েছে। নিমাই আর বিষ্ণু তৈরি হয়েছে শট নিতে। আব্রাহাম হঠাৎ বাঁ দিকে ছুটে গেল, সঙ্গে সঙ্গে ওকে পাহারা দিতে গেল একজন। আমি ডান দিকে সরে গিয়ে তাকালাম ঠিক পেনালটি স্পটে। নিমাই সেটা লক্ষ করল। পাঁচিলের পিছনে ফাঁকা জায়গা রাখা হয়েছে, যাতে গোলকিপারের দৃষ্টি ব্যাহত না হয়। রেফারি হুইসল দিতেই নিমাই আর বিষ্ণু এগোল শট নিতে। নিমাই একটু পিছিয়ে। বোঝা মুশকিল কে শট নেবে। তবে, যে কেউই বুঝতে পারবে এটা বহু ব্যবহৃত একটা প্যাঁচ। বিষ্ণু শট নিতে এসে বলের উপর দিয়ে লাফিয়ে যাবে আর নিমাই শট করবে।
বলের উপর দিয়ে বিষ্ণু লাফিয়ে গিয়ে বাঁ দিকে ছুটে গেল, কিন্তু নিমাই শট না নিয়ে বলটা নিখুঁত মাপে চিপ করল পাঁচিলের মাথা ডিঙিয়ে পেনালটি স্পটের উপর। এবার সব কিছু নির্ভর করছে আমার ছুটে যাওয়ার এবং ঠিক সময়ে পৌঁছোনোর উপর। দিনের পর দিন আমার পাঠশালায় পিন্টুকে নিয়ে যার প্র্যাকটিস করেছি, এবার তার পরীক্ষা। মোটরবাইকের হঠাৎ স্পিড তোলার মতো আমি প্রচণ্ড দমকে, ছিলে—ছেঁড়া ধনুকের মতো ছিটকে ঢুকলাম।
দেরি হয়ে গেছে। চার পা এগোনো মাত্র বুঝে গেলাম বলটাকে হাফ ভলিতে নিলে বারের উপর দিয়ে চলে যাবে। হঠাৎ বুকের মধ্যে কে বলে উঠল, ”স্ট্রাইকার, এবার ঘা মারো, সর্বশক্তি দিয়ে মারো!” শেষ চেষ্টায় চার গজ দূর থেকে ঝাঁপ দিলাম। বল থেকে চোখ সরাইনি। কপালের ডান দিকে বলটা লাগছে, হাতুড়ির মতো মাথাটা দিয়ে আঘাত করলাম বলে—আর মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়লাম।
চারদিক কেমন শান্ত নিস্তব্ধ! ঘাস আর মাটির মিষ্টি সোঁদা গন্ধে বুক ভরে যাচ্ছে। আমি মুখ তুলে দেখছি অদ্ভুত একটা দৃশ্য, রেঙ্গুন ইউনাইটেডের গোলকিপার গোলের মধ্য থেকে কুড়িয়ে নিল সাদা—কালো ফুটকি আঁকা আমার পৃথিবীটাকে। এর পর ধীরে ধীরে একটা গর্জন আমাকে কাঁপিয়ে দেহের উপর দিয়ে বয়ে যেতে শুরু করল।
.
লক্ষ্মণ মালি এসে বলল, ”আপনাকে একজন মেয়েছেলে ডাকছে।”
যাত্রীর টেন্টের বাইরে তখন উৎসব চলেছে। হাউই, পটকা আর তুবড়ির শব্দে আলোয় আলোয় ঝলমল করছে গড়ের মাঠের এই দিককার আকাশ। বাইরে এলাম খালি গায়ে। নীলিমা আর পিন্টু দাঁড়িয়ে। ভেবেছিলাম মাকে দেখব।
”এ কী তোমরা! খেলা দেখতে তুমি এসেছিলে? এখনও বাড়ি যাওনি, মা কোথায়?” একটানা অনেকগুলো প্রশ্ন করলাম। বাড়ির লোককে দেখে সত্যিই ভাল লাগছে।
”জেঠিমা সকাল থেকে দক্ষিণেশ্বরে। আর জ্যাঠামশাই বললেন, একটু অপেক্ষা করে যাই, এবার হয়তো বাজি পোড়ানো হবে, তাই—”
”বাবা! বাবা কোথায়?” আমার গলা ধরে এল।
”বাইরে। বললেন, তোমরাই দেখা করে এসো।”
ছুটে বাইরে যেতে গিয়ে থমকে গেলাম। তার পর ফুলগাছগুলোর মধ্য দিয়ে রেলিং—এর ধারে গিয়ে বাইরে তাকালাম। একটা তুবড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। ক্রমশ আলোর ঝাড় চালচিত্রের মতো ছড়িয়ে পড়ল। দেখতে পেলাম, অনেক লোকের মধ্যে একজনের কপালে চিকচিক করছে একটা টিপ। অত্যন্ত উজ্জ্বল, মর্যাদাবান।
তুবড়ির আলোয় আমাকে দেখতে পেয়ে তখন অনেকে ছুটে আসছে ”প্রসূন, প্রসূন!” বলে।
অলৌকিক দিলু
অলৌকিক দিলু – মতি নন্দী – কিশোর উপন্যাস
”দিলু, এর পরই বাইগাছি। এবার দরজার দিকে এগোতে হবে।” এই বলে বোকামামা উঠে দাঁড়ালেন। ব্যাঙ্ক থেকে নাইলনের ব্যাগটা নামিয়ে বেঞ্চে বসা যাত্রীদের হাঁটু ঠেলতে—ঠেলতে বেরোতে লাগলেন, তার পিছু পিছু দিলীপ। তারও হাতে একটা ব্যাগ, কাঁধে কাপড়ের ঝুলি। ট্রেনের কামরা ভিড়ে ঠাসা। তাদের মতো আরও অনেকে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়েছে।
বোকামামা গলা নামিয়ে বললেন, ”এদের পিছু—পিছু এগোবি, দেরি করলেই কিন্তু রান আউট হয়ে যাবি। হুড়মুড়িয়ে লোক এমনভাবে উঠবে যে, তোকে আর নামতে দেবে না, ঠেলতে ঠেলতে আরও পেছনে পাঠিয়ে দেবে। লোকাল ট্রেনে চড়ার অভ্যেস নেই তো।”
শুনে গলা শুকিয়ে গেল দিলুর। এতক্ষণ সে জানলা দিয়ে দেখে এসেছে এক—একটা স্টেশনে ট্রেন থেমেছে আর প্ল্যাটফর্মের লোকেরা টেনে ওঠার জন্য কীরকম ধাক্কাধাক্কি/করছিল। দু—তিনজনকে ছিটকে প্ল্যাটফর্মে গড়াগড়িও দিতে দেখেছে।
বোকামামা বললেন, ”ওঠার থেকে নামাটাই শক্ত। ব্যাগটা মাথার ওপর তুলে ধর, নয়তো হাত থেকে ছিটকে যাবে।”
দিলু হাতের ব্যাগ মাথায় তুলল। ট্রেন বাইগাছি স্টেশনে দাঁড়ানো মাত্র দরজার লোকেরা হুড়হুড় করে নামতে শুরু করল। পেছন থেকে ঠেলা খেয়ে দিলু হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে ওঠার সময় কে তার পা মাড়িয়ে দিল। ”আহ” বলে ওঠার আগেই সে প্ল্যাটফর্মে ছিটকে পড়ে গেল। বোকামামা তার হাত ধরে টেনে সরিয়ে না আনলে দু—তিনজন লোকের পায়ের তলায় সে পড়ে যেত।
দিলুর ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা থেঁতলে গেছে। ডান পায়ের চটির চামড়ার ফিতেটা ছিঁড়ে পা থেকে খুলে ট্রেনের কামরাতেই রয়ে যাওয়ায় সে ফ্যালফ্যাল চোখে ছেড়ে দেওয়া ট্রেনটার দিকে তাকিয়ে রইল।
বোকামামা বললেন, ” তোর আর দোষ কী, কখনও তো বনগাঁ লাইনের ট্রেনে চড়িসনি। তিরিশ বছর যাতায়াত করছি আমি, কতবার যে ধুতি খুলে গেছে! তাই ট্রেনে চড়ার জন্য ধুতি ছেড়ে প্যান্ট ধরেছি। তুই যে আস্ত নামতে পেরেছিস—য়্যা! চটি কোথায়?”
দিলু করুণ স্বরে বলল, ”ট্রেনে।”
বোকামামা বিলীয়মান গার্ডের কামরার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ”তা হলে বাঁ পায়েরটা পরে থেকে আর কী হবে, ফেলে দে। একজোড়া নতুন চটি বরং কিনে দিচ্ছি। তবু ভাল, ব্যাগটা ধরে রাখতে পেরেছিস।”
দিলুর পায়ের দিকে এবার বোকামামা ভাল করে তাকালেন। চোখ কুঁচকে বললেন, ”হল কী তোর আঙুলে?” একটু ঝুঁকে দেখে বললেন, ”বুড়ো আঙুলের নখটা যে আধখানা উঠে গেছে। কী কাণ্ড দ্যাখ তো, মামার বাড়িতে বেড়াতে এসে দু—দুটো অ্যাকসিডেন্ট চটি গেল, নখ ওপড়াল। শিগগিরি চল ডাক্তারখানায়। ইঞ্জেকশন, ওষুধ, ব্যান্ডেজ করাতে হবে। অফিস ছুটির পরের ট্রেনে ওঠাটাই বোকামি হয়েছে।”
প্ল্যাটফর্ম থেকে লোকজন বেরিয়ে যাওয়ার পর ওরা দু’জন স্টেশন থেকে বেরিয়ে এল। ডাক্তারখানা শিবানী মেডিক্যাল হল পঞ্চাশ গজের মধ্যেই। ডাক্তারবাবু তখনও এসে পৌঁছননি। তিনি বিকেল চারটে থেকে হাবড়ায় এক ডাক্তারখানায় বসেন দু’ঘণ্টার জন্য। রোগীর ভিড় থাকলে সেটা আড়াই ঘণ্টাও হয়ে যায়। কম্পাউন্ডার মদনগোপাল বয়স্ক মানুষ। বললেন, ”ডাক্তারবাবুর ফি দেবেন কেন, আমিই যা করার করে দিচ্ছি, দশটা টাকা দেবেন।”
বোকামামা রাজি হয়ে গেলেন। মদনগোপাল অ্যান্টিটিটেনাস ইঞ্জেকশন দিয়ে মলম লাগিয়ে তুলো দিয়ে ঢেকে ব্যান্ড—এইড দিয়ে আঙুলটা মুড়ে দিলেন।
”সাবধানে থাকবে খোকা, ধাক্কাটাক্কা যেন না লাগে। জলটল লাগিও না। দিন পনেরো লাগবে ঠিক হয়ে যেতে।”
দিলুর খুব খারাপ লাগছে বোকামামার পঁচিশ টাকা খরচ করিয়ে দেওয়ায়। ‘পদসেবা’ জুতোর দোকানটা কুড়ি গজ দূরে। সবচেয়ে কমদামি হাওয়াই চটি। দিলু ঠিক করল, তাই কিনবে। কিন্তু বোকামামা দোকানে ঢুকেই বললেন, ”এই ছেলেটির পায়ের ভাল চটি আছে?”
সেলসম্যান বলল, ”আছে।” এই বলে সে একটা বাক্স এনে তার থেকে একজোড়া চটি বের করে দিলুর পায়ের সামনে রাখল।
বোকামামা হুকুম করলেন, ”পরে দেখ, বুড়ো আঙুলে লাগে কি না।”
দিলু চটি পরল। বুড়ো আঙুলে যে ফিতেটা রয়েছে সেটা নখে লাগছে হাঁটতে গেলেই।
বোকামামা দিলুর মুখ লক্ষ করে বুঝে গেলেন, লাগছে। বললেন, ”এই চটি চলবে না। পায়ের আঙুলে স্ট্র্যাপ থাকবে না এমন চটি আছে?”
সেলসম্যান দু—তিনটি বাক্স খুলে মাথা নেড়ে বলল, ”সব চটিতেই বুড়ো আঙুলে স্ট্র্যাপ দেওয়া।”
দিলু তখন বলল, ”মামা, হাওয়াই চটিতে বুড়ো আঙুলে লাগবে না।”
বোকামামা ক্ষুণ্ণ স্বরে বললেন, ”হাওয়াই বড় কমদামি, আচ্ছা ঠিক আছে আপাতত কাজ চালানো নিয়ে কথা।”
তিরিশ টাকার হাওয়াই চটি পায়ে দিয়ে দিলু মামার সঙ্গে দোকান থেকে বেরিয়ে এল। সামনেই যশোহর মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, বোকামামা বললেন, ”দিলু এদের ছানার জিলিপি বিশ্ববিখ্যাত, চেখে দেখবি?”
মামার অনেক টাকা সে খরচ করিয়ে দিয়েছে। খরচটা আর যাতে না বাড়ে তাই বলল, ”মিষ্টি আমার ভাল লাগে না।”
”সে কী রে, যশোরের ছানার জিলিপি। একটা অন্তত খেয়ে দেখ।”
বোকামামা দোকানে ঢুকলেন, তার সঙ্গে দিলুও। একটা লম্বা পালিশহীন কাঠের টেবিলে ওরা বসল। বোকামামা শিঙাড়া আর ছানার জিলিপি একটা করে দিতে বললেন।
”সেই কখন ভাত খেয়েছিস, নিশ্চয় খিদে পেয়ে গেছে। এই সময় শিঙাড়া ভাজা শুরু হয়। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় লোকে কিনে নিয়ে যায়। উত্তর চব্বিশ পরগনার বেস্ট শিঙাড়া এখানে হয়।”
কলাপাতায় গরম শিঙাড়া আর নধর চেহারার ছানার জিলিপি দিয়ে গেল। খিদে সত্যিই পেয়েছিল দিলুর। শিঙাড়ায় কামড় দিয়ে তার আর মনে হল না মামার টাকা খরচ করিয়ে দিল। সে ধরে নিল ভাগ্নে হিসেবে এটা তার প্রাপ্য।
ছানার জিলিপির একটা টুকরো ভেঙে মুখে দিতেই সেটা মসৃণভাবে মুখের মধ্যে ভেঙে মিলিয়ে গেল। এমন মিষ্টি সত্যিই সে কখনও খায়নি।
”মামা, তুমি এই ছানার জিলিপিকে বিশ্ববিখ্যাত বললে কেন? বিশ্বে আর কোথাও ছানার জিলিপি হয় কি না তা কি তুমি জানো?”
বোকামামা দুধঘাট উচ্চচ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার। স্কুলের প্যাডে ওঁর নাম হরিসাধন ঘোষের পর লেখা আছে এম. এ. বি. টি। তিনটি বিষয়ে ক্লাস নেন—ভূগোল, ইতিহাস ও অঙ্ক। বিশ্ব সম্পর্কে মোটামুটি একটা জ্ঞান তাঁর থাকার কথা এবং তাঁর ধারণা সেটা তাঁর আছে।
”এই পশ্চিমবাংলার বাইরে ছানার জিলিপি কোথাও হয় না, হলেও সেটা জিলিপি নয়, পান্তুয়া। আর এই রাজ্যে শুধু) বাইগাছিতেই এমন জিলিপি হয়। সুতরাং অনায়াসেই একে ওয়ার্ল্ড ফেমাস বলা যায়।”
”আর শিঙাড়াকে উত্তর চব্বিশ পরগনার বেস্ট বললে কী করে?”
বোকামামা ঠোঁট চওড়া করে হাসলেন। ”বত্রিশ বছর আগে বঙ্গবাসী কলেজে যখন পড়তুম তখন থেকে, দমদম টু গোবরডাঙা যত নামী খাবারের দোকান, সবক’টায় খেয়েছি, দমদম টু রানাঘাট মেন লাইনেও সব বড় দোকান দেখা হয়ে গেছে। এরকম ফুলকপির শিঙাড়া কেউ পারে না তৈরি করতে। কেমন লাগছে বল?”
”ভাল।”
”তা হলে আর একটা?”
দিলু মাথা কাত করল।
দোকান থেকে বেরোবার আগে বোকামামা দশটা শিঙাড়া কিনে নিলেন বাড়ির জন্য। ওরা ভ্যান রিকশা স্ট্যান্ডে এসে দুধঘাট যাওয়ার রিকশা পেয়ে গেল। জনা চারেক যাত্রী রিকশায় বসে। ওরা দু’জন চড়তেই রিকশা ছেড়ে দিল। আঙুল বাঁচাতে দিলু পা ঝুলিয়ে বসল। এক মাইল পথ, দশ মিনিটেই পৌঁছে গেল।
বোকামামা অর্থাৎ হরিসাধন ঘোষ দেশভাগের পর পাঁচ বছর বয়সে খুলনা জেলার স্বল্পবাহিরদিয়া গ্রাম থেকে বাবা ও জ্যাঠার এবং লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু পরিবারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছিলেন। বোকামামার বাবা পঞ্চাননের এক বন্ধু থাকতেন বারাসাতে। তিনিই ব্যবস্থা করে দুধঘাটে ফলের বাগান সমেত পাঁচবিঘে জমি পুকুরসহ ছোট একটা বাড়ি কিনিয়ে দেন পঞ্চাননকে। সেই বাড়িতে দাদা দাশরথিকে নিয়ে বসবাস শুরু করেন আটচল্লিশ সাল থেকে।
পঞ্চাননের একটি ছেলে হরিসাধন, দাশরথির একটি মেয়ে মল্লিকা, ডাকনাম মলু। মলু যখন দশ বছরের তখন দাশরথি সাতদিনের জ্বরে মারা যান। তখন ভাল ডাক্তার বা ওষুধপত্র দুধঘাটে পাওয়া যেত না। মলুর মা স্বামীর মৃত্যুর এক বছর পর পাকস্থলীর ক্যান্সারে মারা যান। পিতৃ—মাতৃহারা মলুকে নিজের মেয়ের মতো বড় করে তোলেন পঞ্চানন, তাকে বি—এ পাশ করিয়ে প্রচুর খরচ করে বিয়েও দেন কলকাতার এক উঠতি উকিলের সঙ্গে। হরিসাধনের দুই মেয়ে এবং দু’জনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। বড়টি থাকে দুর্গাপুরে, ছোট মেয়ে কটকে। পঞ্চানন পঁচাশি বছর বয়সে এখনও বাগানের পরিচর্যা করেন, বাজারে যান, ছেলেকে ধমকান।
হরিসাধনের স্কুল—অন্ত—প্রাণ। এই স্কুলেই তিনি পড়েছেন। তখন ছিল তিনটি খড়ের চালের ঘর। শিক্ষকদের বসার ঘরের একধারে কাঠের পার্টিশান দেওয়া খুপরিতে বসতেন হেডমাস্টারমশাই। শিক্ষক ছিলেন আটজন।
দুধঘাটের প্রাক্তন জমিদার ও সরকারি কন্ট্রাক্টর ধনী ও শিক্ষানুরাগী অঘোর চক্রবর্তী নিঃসন্তান ছিলেন। টাকা জমানোয় তাঁর আগ্রহ ছিল না। তাঁরই দেওয়া জমি ও পাঁচ লক্ষ টাকা দুধঘাট স্কুল খোলনলচে বদলে ঝকঝকে আধুনিক চেহারা নেয় তিরিশ বছর আগে। এর চার বছর পর হরিসাধন ‘ফিফথ সার’ রূপে স্কুলে যোগ দেন।
স্কুলের এখন তিনটি পাকা বাড়ি, সায়ান্স ল্যাবরেটরি, খেলার বিরাট মাঠ এবং একুশজন শিক্ষক ও সাতশো ছাত্র নিয়ে এলাহি ব্যাপার। গত বছর হরিসাধনের স্কুল থেকে নব্বুইটি ছেলে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল। পঁচাত্তরজন পায় ফার্স্ট ডিভিশন, আটজন পায় স্টার।
শুধু এই জেলাতেই নয়, সারা রাজ্যে দুধঘাট স্কুল বিখ্যাত পড়াশুনোয় এবং ফুটবল খেলাতেও। দিল্লিতে তিনবার সুব্রত কাপ ফাইনাল খেলে একবার কাপ জিতেছে। জেলার জুনিয়ার ভলিবল, কবাডি, খোখো দলে দুধঘাট স্কুলের ছেলে নেই এমন ঘটনা গত দশ বছরে ঘটেনি। পড়া এবং খেলায় যা কিছু খ্যাতি সবই হেডমাস্টার হরিসাধন ঘোষের অক্লান্ত আন্তরিক ও সৎ চেষ্টার ফসল। তিনি স্কুলে যেমন রাশভারী, কঠোর শৃঙ্খলনিষ্ঠ, নিয়মানুবর্তী, ঠিক তার উলটোটি হয়ে যান স্কুল থেকে বেরিয়ে এলেই।
হরিসাধন মাঝে—মাঝে কলকাতায় যান। হাতে সময় থাকলে বোন মলুর সঙ্গে দেখা করে আসেন। মৌলালির কাছে মলুর স্বামী তরুণ কর বিরাট একটা পুরনো বাড়ি কিনে সংস্কার করিয়ে বউবাজারে পৈতৃক বাড়ি থেকে ভিন্ন হয়ে এসে বসবাস করছেন। মলুর চার ছেলে, ছোট ছেলে দিলু। কলকাতায় প্রধান শিক্ষক সমিতির সভায় যোগ দিতে এসে হরিসাধন বোনের বাড়ি এসেছিলেন। মলুর সঙ্গে কথায়—কথায় জানতে পারেন দিলু ষান্মাসিক ক্লাস পরীক্ষায় একশোর মধ্যে ইংরেজিতে চব্বিশ, ইতিহাসে তিরিশ, অঙ্কে কুড়ি নম্বর পাওয়ায় স্কুল থেকে গার্জেনকে হুঁশিয়ার করে চিঠি দেওয়া হয়েছে এই বলে, অ্যানুয়াল পরীক্ষায় যদি একটি বিষয়েও ফেল করে তা হলে ক্লাস নাইনে ওকে প্রোমোশন দেওয়া হবে না। ওর পড়াশুনোর দিকে আপনারা নজর দিন।
”জানো বোকাদা, চিঠিটা পেয়ে এমন রাগ হল যে, দিলুকে আচ্ছা করে পেটালুম, সারাদিন খেতে দিলুম না। ওর বাবা বলল স্কুল ছাড়িয়ে অন্য স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবে। কিন্তু লেখাপড়ায় খারাপ ছেলেকে তাও ক্লাস নাইনে কি নতুন স্কুলে ভর্তি করানো সম্ভব? বাড়ির কাছে আদর্শ বিদ্যাভবন নামে একটা স্কুল আছে কিন্তু সেখানে শুনেছি মাস্টাররাই ঠিকমতো ক্লাসে আসে না। তিরিশটা ছেলে মাধ্যমিক দিয়েছিল গত বছর। দু’জন কোনওক্রমে সেকেন্ড ডিভিশন, এগোরোজন ফেল। এমন স্কুলে ওকে দিলে তো আরও খারাপ হয়ে যাবে লেখাপড়ায়।”
হরিসাধন বললেন, ”দিলুর অসুবিধেটা কোথায়, ওকে পড়ায় কে? রোজ দু’বেলা কি পড়তে বসে?”
মল্লিকা বললেন, ”দু’বেলা? সকালে ঘুম থেকেই তো ওঠে আটটায়, পড়বে কখন? স্কুল থেকে ফিরেই ছুটবে খেলার মাঠে, সন্ধেবেলায় মাস্টারমশাই আসেন, পড়তে বসে ঢুলবে। উনি বিরক্ত হয়ে বলেন, যাও ঘুমোও গিয়ে, আর পড়তে হবে না। ঘণ্টাখানেক কানমলা, গাঁট্টা খেয়ে নমো নমো করে পড়া সেরে খেয়েদেয়েই বিছানায়। এই হল রোজকার রুটিন। ওয়ান ডে ক্রিকেট থাকলে স্কুলে যায় না, সারাদিন টিভির সামনে। এত মারধোর করি, এত বোঝাই, তবু শোধরাতে চায় না। কী যে করি, প্রব্লেম চাইল্ড হয়ে উঠেছে।”
হরিসাধন বললেন, ”তোর অন্য ছেলেরা কেমন?”
”সলু তো ল কলেজে বাবার পেশায় ঢুকবে, বিলু আর্ট কলেজে এ—বছর ভর্তি হল, কালু ডিগ্রি কোর্সে সায়ান্স পড়ছে। পড়াশুনোয় সবাই ভাল। কাউকে আমায় তাগিদ দিয়ে পড়ার কথা বলতে হয়নি। শুধু এই ছোট ছেলেটাই জ্বালিয়ে মারছে, কী যে করি।”
”কিছু করতে হবে না তোকে। তোর জ্যাঠার হাতে ওকে ছেড়ে দে। বাবা ঠিক ওকে তৈরি করে দেবে।”
মল্লিকা দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বললেন, ”এই বয়সে জেঠু ওকে সামলাবেন কী করে?”
হরিসাধন হেসে ফেললেন, ”বাবাকে তুই অনেকদিন দেখিসনি তাই বললি। হাঁটুর বাতে ইদানীং একটু কাহিল, তবু বহুদিন তেলকই খাননি বলে গতবছর নিজে হাতে জাল ফেললেন পুকুরে, হনুমানে আম নষ্ট করছিল, বন্দুক বের করে ফায়ার করলেন, ভাগ্যি ভাল মরেনি। যদি মরত তা হলে আমরা ও বাড়িতে আর টিকতে পারতুম না। বাবা পঁচাশি হলে কী হবে পাঁচ বছর আগেও কোদাল দিয়ে বাগানে মাটি কোপাতেন। তুই বাবার কাছে এক বছর ওকে রাখ। আমার স্কুলে ওকে ভর্তি করিয়ে নোব। পরীক্ষাটা দিয়েই দুধঘাটে চলে আসুক।”
দিলুর অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ হওয়ার দশদিন পর হরিসাধন কলকাতায় আসেন নিজের কাজে। একটা ইতিহাস বই লিখেছেন নবম—দশম শ্রেণীর জন্য, প্রকাশকের কাছে তার পাণ্ডুলিপি জমা দিয়ে দুপুরে বোনের কাছে এলেন ছোট ভাগ্নের খবর নিতে।
”কী ঠিক করলি?” হরিসাধন প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর দিলেন, ”দুটো প্যান্ট আর শার্ট একটা ব্যাগে ভরে দে। ওকে আজ নিয়েই যাব। দিন সাতেক থেকে দেখুক। যদি মন বসে যায় তা হলে আমাদের কাছেই থাকুক। তোর বা তরুণের তাতে আপত্তি আছে?”
মল্লিকা বললেন, ”আপত্তি কী গো! আমরা তো বেঁচে যাই। আগের দিন তুমি যা বললে দিলুর বাবাকে সে সবই বলেছি। উনি তো শুনে আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। বললেন, অতবড় নামী স্কুলে পড়ার এমন সুযোগ, হেডমাস্টার মামা, দিলুর তো মহাভাগ্যি। এখানে আজেবাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশে গোল্লায় যাচ্ছে, সলু বলছিল, মা ওকে কোনও হস্টেলে পাঠিয়ে দাও।”
হরিসাধন আঁতকে ওঠার মতো দু’হাত তুলে বললেন, ”না, না, খবরদার নয়। এই ছেলেদের এলোমেলো প্রকৃতিটাকে বাঁধতে হবে, ঠিক পথে অর্থাৎ যে পথে গেলে ওর বিকাশ ঘটবে সেই পথে ওকে চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে। হস্টেলে ওকে বাঁধার লোক কেউ থাকবে না। কিন্তু দিলু কি দুধঘাটে গিয়ে থাকতে রাজি হবে?”
মল্লিকা ভ্রূ কুঁচকে একটু বিরক্তি মাখানো গলায় বললেন, ”ওর রাজি হওয়া—না হওয়ায় কী আসে যায়। ওর ভালর জন্যই আমরা ওকে পাঠাচ্ছি। এটা ওকে মেনে নিতে হবে।”
দিলুকে ডেকে আনলেন মল্লিকা। ভাল স্বাস্থ্যের জন্য বয়সের তুলনায় ওকে বড়ই দেখায়। বাবার মতো কালো গায়ের রং, কোঁকড়া ঝাঁকড়া চুলের সঙ্গে চিরুনির সম্পর্ক মাঝেমধ্যে ঘটে। চৌকো মুখের গড়ন চোখদুটি শান্ত কিন্তু চোখের আড়ালে একটা কঠিন জেদি মন ধিকধিক অবিরত জ্বলছে। হরিসাধন সেটা লক্ষ করলেন।
”দিলু যাবি আমার সঙ্গে দুধঘাটে গিয়ে ক’টা দিন থেকে আসবি।”
”যাব। কবে?”
”আজই।” হরিসাধন ঘড়ি দেখলেন, ”পাঁচটা চল্লিশের ট্রেনটা ধরব। রেডি হয়ে নে।”
পাঁচ মিনিট পর দিলু এসে বলল, ”বোকামামা, আমি রেডি!”
হরিসাধন ভ্রূ তুলে তার ছোট ভাগ্নের দিকে তাকালেন। রংচটা জিনসের ট্রাউজার্স, ছাপছোপ দেওয়া হাফহাতা গেঞ্জি, পায়ে চটি, কাঁধে ঝুলি, হাতে নাইলনের ব্যাগ। একে কি রেডি হওয়া বলে!
হরিসাধনের চাহনি থেকে দিলু বুঝে গেল তার বেশবাস মামার মনঃপূত হয়নি। সে বলল, ”এই তো ভাল, হালকা ঝরঝরে। যাব তো মামার বাড়ি, সাজগোজের দরকার কী। জিনস একটা দারুণ সুবিধের জিনিস, ময়লাটয়লা হলেও চলে যায়।”
আর কথা বাড়াননি হরিসাধন।
.
বাগানের মধ্যিখানে ছোট দোতলা বাড়ি। যিনি এটি বানিয়েছিলেন তিনি একজন সিনেমা প্রযোজক, কলকাতায় থাকতেন। বাগানবাড়ি হিসেবেই এটি ব্যবহার করতেন, বছরে তিন—চারবার আসতেন। দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তুরা দলে দলে এসে ফাঁকা জমিগুলো দখল করে ঘর তুলে বসতে শুরু করতেই প্রযোজকমশাই বাড়ি, বাগান এবং পুকুরটি বিক্রি করে দেন পঞ্চাননকে।
বাড়িটি চৌকো আকৃতির। পেছন দিকে দোতলায় দুটি ঘরের সামনে টানা একটি টালি ঢাকা বারান্দা। সেটি এত চওড়া যে, তাকে দালানই বলা যায়। দোতলার দু’টি ঘরের নীচে একটি হলঘর ছিল। পঞ্চানন তার মাঝখানে দেওয়াল তুলে দুটি ঘর করে নিয়েছেন। এর একটি ঘর হরিসাধনের পড়া ও লেখার এবং বাইরের লোকেদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। সকাল থেকে লোক আসে, বিশেষ করে স্কুলসংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে। রাত্রে বারোটা পর্যন্ত বই পড়া ও লেখা নিয়ে থাকেন এই ঘরে। দোতলার বারান্দার নীচেও লম্বা একটা সিমেন্টের চওড়া লাল চাতাল। সেখান থেকে কুড়ি মিটার এগোলেই তিরিশ মিটার চওড়া পঞ্চাশ মিটার লম্বা পুকুরে নামার শান বাঁধানো সিঁড়ি। দশটা ধাপ নামলে জল, বর্ষাকালে সাত ধাপ নামলেই।
ভ্যান—রিকশা থেকে নেমে পাশের একটা পথ ধরে কুড়ি মিটার এগিয়ে বাঁ দিকে পাঁচিল ঘেরা দিলুর মামার বাড়ি। ওরা বুকসমান উঁচু লোহার গেট ঠেলে ঢুকল। সন্ধ্যা উতরে গেছে, অন্ধকার গাঢ়। দু’দিকে আম, কাঁঠাল, পেয়ারা গাছ। তার মাঝখান দিয়ে একটা পথ বাড়ির সদর দরজা পর্যন্ত। দরজার দু’পাশে উঁচু রক। চারধাপ সিঁড়ি ভেঙে ওরা রকে উঠতেই ”ঘেউ, ঘেউ” করে ছুটে এল একটা কুকুর অন্ধকার বাগান থেকে। দিলু সরে এল মামার গা ঘেঁষে।
হরিসাধন ধমক দিলেন, ”এই ভেলো, চুপ কর, চুপ।”
ভেলো ডাক বন্ধ করে, কাছে এল। হরিসাধন দরজার কড়া নাড়লেন। ভেলো দিলুর হাঁটু, চটি শুঁকেটুকে ল্যাজটা নাড়ল।
”ভেলোর কাজ ভয় দেখানো আসলে কিন্তু খুব ভিতু। বাগান পাহারা দেয়। শেয়াল তাড়া করে। এই অঞ্চলে চুরি ডাকাতি খুব বেশি। একবার আমাদের বাড়িতে ডাকাতির চেষ্টা হয়েছিল, তোর দাদু দোতলার বারান্দা থেকে বন্দুকের আওয়াজ করে ডাকাত তাড়ায়—”।
সদর দরজার মাথার ওপর আলো জ্বলে উঠল। দরজা খুলে দিল এক প্রৌঢ়া। হর্ষমুখী কাজের লোক, পনেরো বছর আছে। নামটা মুখে মুখে হয়ে গেছে ‘হষ্য’, এই বাড়িতে সারাদিন থাকে। প্রাক্তন জমিদার বিশ্বাসদের জমি বর্গায় চাষ করে তার স্বামী, আর আছে এক ছেলে বসুদেব ওরফে বাসু। ওরা তিনজন থাকে পাশের গ্রাম ছোট হুড়ায়। হরিসাধন বাসুকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন, এবার তার ক্লাস এইট হবে। পরীক্ষায় বাসু প্রথম পাঁচজনের মধ্যে থাকে। পঞ্চানন বাড়িতে সপ্তাহে দু’দিন বাসুকে পড়ান তাই নয়, তার বইপত্তর, খাতা, জামা—জুতো সবই কিনে দেন।
হর্ষমুখী দিলুকে দেখে অবাক হল। চেঁচিয়ে সে ডাকল দিলুর মামি সুলেখাকে, ”ও বউদি এসে দ্যাখো গো দাদার সঙ্গে কে এসেছে।”
সুলেখা ছিলেন দোতলায়। ব্যস্ত হয়ে নেমে এলেন। বাড়িতে একটাও ছেলেমেয়ে নেই। সারাদিন তার ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কেউ এলে সুলেখা খুশি হন নানারকম রান্না করে খাওয়াবার সুযোগ পেয়ে। ব্যাগ থেকে শিঙাড়ার ঠোঙাটা বের করে হরিসাধন হর্ষর হাতে দিয়ে বললেন, ”আমরা খেয়ে এসেছি, এগুলো তোদের জন্য, যশোর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের। বাবা বোধ হয় বাড়ি নেই, গোটা দুয়েক তুলে রাখিস।”
সুলেখা বললেন, ”দিলু কয়েকদিন থাকবে তো?”
দিলু বলল ”হুঁ।”
ছেলেবেলায় মায়ের সঙ্গে দিলু মামার বাড়িতে একবার এসেছিল। এখানকার সবই ভাল শুধু সময় কাটানোটাই হয় সমস্যার। তার সমবয়সী কেউ নেই। মন খুলে কথা বলতে না পারলে সেই জায়গা তার ভাল লাগে না।
হরিসাধন বললেন, ”কয়েকদিন বলছ কী, ভাল লাগলে দিলু এখানেই থেকে যাবে। মলুর সঙ্গে আমার সেরকমই কথা হয়েছে।”
শুনে দিলু মনে মনে হাসল। শুধু মামার বাড়িই নয়, মৌলালিতে নিজেদের বাড়িও তার ভাল লাগে না। নিঃসঙ্গ একঘেয়ে লাগে। দাদারা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত, তার সঙ্গে কথা বলার সময়ই হয় না। কথা বললেও বয়সের তফাতটা তারা সবসময় মনে রেখে কথা বলে। মা সারাক্ষণ ব্যস্ত ঝি—চাকর, রান্না—খাওয়া নিয়ে। সারাক্ষণই খিটখিট করে যায় আর আপনমনে প্রায়ই একই কথা বলে—এতবড় সংসার সামলানো কি চাট্টিখানি কথা! দিলু লক্ষ করেছে, মা বি—এ পাশ হলেও বই পড়ে না, এমনকী খবরের কাগজও নয়। সন্ধে থেকে টিভি—র সামনে বসে হাবিজাবি যা দেখানো হয় তাই দেখে। বাবার সঙ্গে দিলুর কদাচিৎ দেখা হয়। সকাল আটটায় ঢোকে একতলার সেরেস্তাঘরে, তারপর সারাদিন কোর্টে, তারপর সন্ধে থেকে আবার সেরেস্তায়, রাত এগারোটা পর্যন্ত। দিলু মার কাছে শুনেছে বাবা জজের সামনে একবার দাঁড়ালেই মক্কেলকে আট হাজার টাকা দিতে হয়।
বাড়িতে থাকলে দিলু হাঁফিয়ে যায়। পাড়ায় একটা পার্ক আছে, অ্যালবার্ট স্কোয়ার। সেখানে সারা বছরই ফুটবল আর ক্রিকেট খেলা চলে। এত ভিড় হয় যে, খেলার জায়গা পাওয়াই মুশকিল। বিজয়ী সঙ্ঘ, বন্ধু পরিষদ আর সিক্স বুলেটস—এই তিনটি ক্লাব মাঠটাকে ভাগ করে নিয়েছে। বুলেটসরা শুধুই ফুটবল আর বাকি দুটি ক্লাব প্রধানত ক্রিকেট খেলে। দিলু বিজয়ী সঙ্ঘের সদস্য। স্কুল থেকে ফিরেই সে পার্কে ছুটে যায়। খেলা ছাড়াও আছে তার বন্ধুবান্ধব। তাদের সঙ্গে সে শুধু খেলার গল্প করে যেটা বাড়িতে কেউ করে না।
মামিকে বলা বোকামামার কথাটা শুনে দিলু মনে মনে নিশ্চিন্ত হল এখানে থাকা তার হবে না। সমবয়সী কেউ নেই, যার সঙ্গে খেলা যায়, গল্প করা যায়।
”দিলু, হাতমুখ ধুয়ে নাও। হষ্য, ব্যাগ আর থলি মেসোমশাইয়ের ঘরে রেখে আয়। ওখানেই দিলু থাকবে।” সুলেখা তারে ঝোলানো গামছাটা দিলুর হাতে দিলেন।
পঞ্চানন বাড়ি ফিরলেন রাত আটটা নাগাদ। দিলু তখন বারান্দায় একটা চেয়ারে পুকুরের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল। বারান্দার ইলেকট্রিক আলো জলে পড়ে চিকচিক করছে, চারধারে অন্ধকার, নারকেল আর সুপুরি গাছ পুকুরের পাড় ঘেঁষে সারি দিয়ে। জোর বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে, শব্দ হচ্ছে সরসর। দূরে দু—তিনটি বাড়িতে জ্বলা আলো ছাড়া দিলু কিছু দেখতে পাচ্ছে না। একটানা ঝিঁঝি—র ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ কানে আসছে না। কলকাতায় এই সময় এমন নিঃসাড় চুপচাপ পরিবেশের কথা সে ভাবতে পারে না। এইরকম শান্ত নির্জনতার মধ্যে বসে থাকাটা তার কাছে নতুন অভিজ্ঞতা, বেশ ভাল লাগছে।
পঞ্চানন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে চেঁচিয়ে বললেন, ”আমার দাদু কোথায়?” বারান্দায় পৌঁছে বললেন, ”শুনলাম তোমার পায়ের নখ নাকি উঠে গেছে।”
দিলু উঠে দাঁড়াল। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ”ও কিছু নয়। এরকম আগেও হয়েছে। ফরওয়ার্ড খেলেছি, বলটা ছিল ইয়র্কার, ফসকালুম, বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর বলটা পড়ল, নখটা ফেটে গেল। ওটা পচে গিয়ে পরে নতুন নখ গজাল, এবারও তাই হবে।”
যতক্ষণ কথা বলছিল দিলু, তার মুখের তাচ্ছিল্যের ভাবটা লক্ষ করছিলেন পঞ্চানন। আঘাত অগ্রাহ্য করতে গিয়ে একটা বেপরোয়া ঔদ্ধত্য নাতির কণ্ঠস্বরে ফুটে উঠল। তিনি মনে মনে তারিফ করলেন।
”দাদু, ওই যে বললে ইয়র্কার, সেটা কী জিনিস?”
দিলু চোখ কুঁচকে বলল, ”ফাস্ট বোলাররা দেয়, এটা ওদের একটা বড় অস্ত্র। বলটা সোজা ব্যাটের তলায় এসে পড়ে। এ বল সামলানো বেশ শক্ত। থামাতে গিয়ে ব্যাটের তলা দিয়ে গলে এল বি কি বোল্ড আউট করে দেয়।”
পঞ্চানন চোখ বিস্ফারিত করে বললেন, ”ওরে বাব্বা, এ তো দারুণ বল। তুমি এ বল করতে পারো?”
দিলু বলল, ”আমি ফাস্ট বোলার নই, ব্যাটসম্যান।”
যে লোক ইয়র্কার বল কাকে বলে জানে না, তার সঙ্গে ক্রিকেট নিয়ে কথা বলতে দিলু আর আগ্রহ বোধ করল না। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে সে বলল, ”দাদু, তোমার শোয়ার ঘরের দেওয়ালে একটা বন্দুক ঝুলছে দেখলাম। বোকামামা বলল তুমি নাকি ডাকাত তাড়িয়েছ গুলি ছুড়ে, সত্যি?”
পঞ্চানন বললেন, ”বলেছে নাকি বোকা? আরে ও কিছু নয়, অনেককাল আগের কথা, তখন এখানে এত ঘরবাড়ি হয়নি। এই বারান্দা থেকে ফাঁকা আওয়াজ করেছিলুম। ওরা তিন—চারটে বোমা ছুড়েই পালাল। ডাকাতিতে সবে হাতেখড়ি হয়েছে। পাকা ডাকাত হলে পালাত না।”
দিলু বলল, ”দাদু, আমাকে বন্দুক চালানো শিখিয়ে দেবে?”
পঞ্চানন অবাক হয়ে বললেন, ”শিখবে? কেন?”
দিলু বলল, ”শিকার করব।”
”বাঘ, সিংহ?”
”হ্যাঁ, তবে এখানে আর সিংহ পাব কোথায়? সেজন্য তো আফ্রিকায় যেতে হবে।”
”তুমি কোথাও মারার জন্য বাঘ—সিংহ পাবে না। সারা পৃথিবীতে আইন করে ওদের মারা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ওদের মেরে মেরে সংখ্যাটা এত কমিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, লোপাট হয়ে যাচ্ছে। যে ক’টা বেঁচে আছে তাদের বংশবৃদ্ধির জন্য আইন করে রক্ষা করা হচ্ছে। আমাদের দেশে আগে চিতাবাঘ ছিল, এখন একটাও নেই। যে চিতাটা শেষ বেঁচে ছিল দিল্লির চিড়িয়াখানায়, সেটা বছর চারেক আগে মারা গেছে। মজা কি জানো, কাগজে প্রায়ই দেখবে লেখা হয়, চিতাবাঘের আক্রমণে গ্রামবাসী নিহত বা গোরু—ছাগল মেরে খেয়েছে। আসলে ওটা লেপার্ড, দুটো আলাদা প্রাণী। লেপার্ডের কোনও বাংলা নেই, তাই চিতা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়।”
”বেশ, তা হলে পাখি মারব।” দিলু জেদি গলায় বলল। বন্দুক চালানো তাকে শিখতেই হবে।
পঞ্চানন অবাক হয়ে বললেন, ”কেন! পাখি কি তোমার কোনও ক্ষতি করেছে? শুধু শুধু কেন তাদের খুন করবে?”
দিলু খুন শব্দটিতে অপ্রতিভ হয়ে পড়ল। আমতা আমতা করে কী একটা বলার চেষ্টা করল। পঞ্চানন ওকে কাছে টেনে নিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বললেন, ”শিকার যারা করে তারা জীবন ভালবাসে না, তারা নিষ্ঠুর লোক। বনের প্রাণীকে মানুষের সমাজের খুব দরকার। ওরা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। কেঁচো, ব্যাং, ইঁদুর, সাপ, ফড়িং, পোকামাকড় এরাও প্রত্যেকেই কোনও না কোনওভাবে আমাদের উপকার করে।”
এবার তর্ক করার ঢঙে দিলু বলল, ”তা হলে আমরা মাছ ধরে খাই কেন, ওরাও তো প্রাণী।”
”নিশ্চয় প্রাণী। আমরা যদি মাছ না খাই তা হলে কী হবে? এই যে পুকুরটা ওতে মাছ আছে, যদি না ধরি তা হলে মাছগুলোর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থা হবে যে, পুকুরে ওদের চলাফেরার জায়গা থাকবে না, তখন ওরা নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করে মরবে। আমরা মাছ খাই তো প্রয়োজনে, খাবার হিসেবে। শুধু শুধু মজা পাওয়ার জন্য তো ওদের মারি না। আসলে এটাও প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখা। যাকগে এসব কথা, তোমার ইচ্ছে হয়েছে বন্দুক ছোড়ার, কেমন?”
দিলু মাথা হেলাল। পঞ্চানন ওর কাঁধে চাপড় মেরে বললেন, ”ছুড়বে। আমি দেখিয়ে দোব।”
হষ্য এসে ডাকল খাওয়ার জন্য। ওরা নীচে নেমে এল। পরপর তিনটি কাঠের পিঁড়ির সামনে কাঁসার থালায় ভাত বেড়ে রাখা। বাবু হয়ে বসে শেষ কবে খেয়েছে, দিলু মনে করতে পারল না। জন্ম থেকেই বাড়িতে চেয়ার টেবলে খাওয়া। এই মামার বাড়িতেই তাকে মেঝেয় বসে কাঁসার থালা বাটি গেলাসে খেতে হচ্ছে। এটা তার খারাপ লাগে না। পঞ্চানন প্রাচীন মানুষ, জীবন যাপনও প্রাচীন ধারায়। বসবাসের জায়গা বদল করলেও সাবেকি অনেক কিছু বদলায়নি।
দিলু মাঝখানে, দু’পাশে হরিসাধন ও পঞ্চানন। পরিবেশন করছেন সুলেখা। খেতে খেতে হরিসাধন জিজ্ঞেস করলেন, ”বাবা, তা হলে কী ঠিক হল?”
পঞ্চানন বললেন, ”ঠিক হল নাইটগার্ড পার্টি তৈরি করা হবে। পাড়ার ছেলেরা পালা করে সারারাত পাহারা দেবে, বিশেষ করে পূর্ণেন্দুদের বাড়ির এলাকাটা। ওখানেই তো পরশু দুটো লোককে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে।”
হরিসাধন চিন্তিত স্বরে বললেন, ”ব্যাপারটা ভাবিয়ে তুলল। পূর্ণেন্দুকে বেশ সাবধানে থাকতে হবে। কিছুদিন যেন বাড়ি থেকে না বেরোয়।”
খাওয়া থামিয়ে পঞ্চানন বললেন, ”তাতে কী লাভ হবে? কতদিন বাড়িতে বসে থাকবে? একদিন না একদিন তো বেরোতেই হবে। কাজ করে কলকাতায়, ট্রেনে তো ওকে উঠতেই হবে। কাগজ খুললেই তো দেখি দিবালোকে ট্রেনের কামরার মধ্যে ডাকাতি, খুন ঘটে চলেছে।”
দিলু এইসব কথাবার্তার মাথামুণ্ডু বুঝতে না পেরে মামা আর দাদুর মুখের দিকে মাথা ঘুরিয়ে দু’বার তাকাল। শুধু তার মনে হল খুব গোলমেলে কোনও ব্যাপার এই পূর্ণেন্দু নামের লোকটা ঘঁটিয়েছে, তাই তার জীবনের ভয় আছে।
.
রাত্রে দাদুর পাশে বিছানায় শুয়ে দিলু সামনের দেওয়ালে ঝোলানো দোনলা বন্দুকটার দিকে তাকিয়ে ছিল। পঞ্চানন তা লক্ষ করলেন। বললেন, ”দাদু, কাল তোমাকে দেখিয়ে দোব কীভাবে বন্দুক চালাবে।”
”দাদু, নাইটগার্ডের কথা মামাকে তখন বলছিলে। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে কি মামাও থাকবে, তুমি থাকবে না?”
”আমি এই বুড়োবয়সে রাতপাহারা কি দিতে পারব? এসব অল্পবয়সীদের জন্য। সত্যি—সত্যি যদি গুণ্ডাবদমাশদের মুখোমুখি হতে হয় তা হলে তো এক থাপ্পড়ে আমায় ফেলে দেবে।”
দিলু বলল, ”কেন, তুমি বন্দুকটা নিয়ে পাহারায় বেরোবে। বন্দুক দেখলে ওরা চোঁ চোঁ দৌড় দেবে।”
পঞ্চানন হেসে ফেলে বললেন, ”দাদু, এখনকার গুণ্ডাদের কাছেও বোমা, পিস্তল, পাইপগান থাকে। এই বুড়ো বয়সে কি আমি পারব? তোমার মামাও পারবে না। বোকা আবার ভিতুও, বয়সও তো ওর পঞ্চাশ পেরিয়েছে। এবার তুমি ঘুমোও।”
দিলু পরদিন যথারীতি দেরিতে ঘুম থেকে উঠল। ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দেখল টেবলে তারই বয়সী একটি ছেলে মাথা নামিয়ে মন দিয়ে খাতায় কী যেন লিখছে। পাশের চেয়ারে বসে দাদু ঝুঁকে খাতার দিকে তাকিয়ে।
”উহুঁহুঁ, হ্যাজবিন নয় হ্যাজবিন নয়, হ্যাডবিন হবে। সেদিন কতবার বলে দিলুম, কাজটা করে যাচ্ছিল তার মানে পাস্ট কন্টিনিউয়াস, অতীতের ঘটনা। যা বলে দিই সেটা বাড়িতে গিয়ে আবার ঝালিয়ে নিলে এই ভুলটা হত না।” পঞ্চানন যখন কথাগুলো বলছিলেন ছেলেটি তখন দিলুর দিকে তাকিয়ে ছিল।
”আরে দাদু, এসো, এসো, ঘুমোচ্ছ দেখে আর ডেকে তুলিনি। গ্রাম—পাড়াগাঁয় লোকের ঘুম সূর্য ওঠার সঙ্গেই ভাঙে, শুতেও যায় তাড়াতাড়ি। এখানে থাকলে তোমারও এই অভ্যেস হয়ে যাবে। এই হল বাসু, ভাল নাম বসুদেব, আমাদের হষ্যর ছেলে। সোমবার থেকে পরীক্ষা, ক্লাস এইট হবে। তোমার তো হবে নাইন। বাসু, এই হল দিলু।”
বাসু হাসল দিলুর দিতে তাকিয়ে। দিলু দেখল ঝকঝকে সাজানো দাঁত, পাতাকাটা চুল, আয়ত চোখে বন্ধুত্বের চাহনি, শীর্ণ লম্বাটে মুখ, রং শ্যামবর্ণ, ছোটখাটো রোগা শরীর।
দিলু অস্বস্তি বোধ করল দাদুর একটা কথায়, ”তোমার তো হবে নাইন। হবে কিনা কে জানে, পরীক্ষা দিয়েই তার মনে হয়েছে পাশ বোধ হয় করতে পারবে না।”
”দাদু নীচে যাও, দাঁত মেজে নাও। ব্রাশ এনেছ তো?”
আধঘণ্টা পর পঞ্চানন আর বাসু যখন একতলায় নামল, দিলু তখন একটা বড় বাটি ভর্তি চিঁড়ে দুধ কলা গুড় মাখা খাচ্ছে।
পঞ্চানন বললেন, ”ডাবের জল খাবে নাকি?”
দিলু মাথা কাত করে বলল, ”হুঁ।” ডাবের জল খেতে তার ভাল লাগে। আগের বার যখন এসেছিল, প্রতিদিন অন্তত দু’তিন গ্লাস ডাবের জল খেয়েছে।
”বাসু, রিদু তো এখনও আসেনি, তুই—ই ডাব পেড়ে দে।”
পঞ্চাননের কথা শেষ হওয়ামাত্র বই খাতা রেখে বাসু হর্ষকে বলল, ”মা, দড়িগাছাটা দাও তো।”
পুকুরের দু’ধারের পাড় ঘেঁষে সার দিয়ে সুপুরি আর নারকেলের গাছ। তার পেছনে সার দিয়ে গোটা কুড়ি বেগুন গাছ। তার লাগোয়া মাচায় করলা আর উচ্ছে ঝুলছে। তার নীচে জমির ওপর লতিয়ে রয়েছে কুমড়ো গাছ। আট নম্বরি ফুটবলের মতো দুটো সোনালি রঙের কুমড়ো জমিতে বিশ্রামরত। পঞ্চানন চোখ কুঁচকে গাছের নারকেলগুলো লক্ষ করে একটি গাছ দেখিয়ে বাসুকে বললেন, ”ওটায় ওঠ, ডাবগুলো কচি রয়েছে।”
বাসু জামা খুলে গাছটার দিকে এগোল। একটা কাঠবেড়ালি ল্যাজ তুলে তুড়ুক তুড়ুক লাফিয়ে গাছটা বেয়ে খানিকটা ওপরে উঠে বাসুতে দেখতে পেয়ে চটপট নেমে ঝোপের মধ্যে লুকোল। দেখে দিলুর খুব মজা লাগল। দড়ির দুটি প্রান্ত বেঁধে নিয়ে দুই পায়ের গোছে মালার মতো গোল করে আটকে বাসু দু’হাতে গাছটা জড়িয়ে টেনে টেনে নিজেকে তুলে নিচ্ছে ওপরে। প্রায় পাঁচতলা উঁচু গাছ। গাছটা হেলে রয়েছে পুকুরের দিকে। দিলু অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবল ওই রোগা শরীরে কী জোর আর কী সাহস। ফিসফিস করে সে পঞ্চাননকে বলল, ”দাদু, আমাকে নারকেল গাছে চড়া শিখিয়ে দেবে?”
উৎসাহিত গলায় পঞ্চানন বললেন, ”নিশ্চয় দেব। আগে তোমার পায়ের নখটা ঠিক হোক। নারকেল, সুপুরি সব গাছে উঠবে। প্র্যাকটিস করতে করতে দেখবে তুমি হুঁশিয়ার হয়ে গেছ, তোমার সাহসও বেড়ে গেছে, ইয়র্কার বল খেলতে তোমার আর অসুবিধে হবে না।”
বাসু গাছের মাথায় পৌঁছে গেছে। পাতার আড়ালে ওর হাঁটু পর্যন্ত গোটানো প্যান্ট আর পা দুটো দেখা যাচ্ছে। এক হাতে গাছ জড়িয়ে অন্য হাতে এক—একটা ডাব ধরে মুচড়ে মুচড়ে ছিঁড়ে নিয়ে বাসু পুকুরে ছুড়ে ফেলতে লাগল। গোটাছয়েক পুকুরে ফেলে সে যা করল তাতে দিলুর চোখ কপালে উঠল, হাঁ হয়ে গেল মুখ।
পায়ের দড়িটা নীচে ফেলে দিয়ে বাসু দু’ পা দিয়ে গাছে একটা জোর ধাক্কা দিল। পেছন ফিরে পুকুরের জলে প্রায়—বসা অবস্থায় সে ঝপাত করে পড়ল, পাঁচতলা সমান উচ্চচতা থেকে।
গলা শুকিয়ে গেছে দিলুর, ঠোঁট চেটে বলল, ”দাদু একটু ভুল হলে ও তো জলে না পড়ে ডাঙায়ও পড়তে পারত!”
”তা তো পারতই। কতবার ওকে বারণ করেছি এভাবে নামিসনি, কোনদিন মরবি, নয়তো সারাজীবন পঙ্গু হয়ে থাকবি। আসলে কী জানো, তোমাকে দেখে বাহাদুরি দেখাবার লোভ সামলাতে পারেনি।”
বাসু সাঁতার কেটে ডাবগুলো একে একে পাড়ে ছুড়ে দিয়ে ঘাটে এসে জল থেকে উঠল। বাড়ির ভেতরে গিয়ে ভিজে প্যান্টটা ছেড়ে গামছা পরে একটা কাটারি হাতে ফিরে এল। দুই কোপে ডাবের মুণ্ডু উড়িয়ে বাসু সেটা একগাল হেসে এগিয়ে ধরল দিলুর দিকে।
ডাবটা হাতে নিয়ে দিলু বলল, ”অত ওপর থেকে ঝাঁপ দিতে তোমার ভয় করল না?”
বাসু আবার হেসে মৃদুস্বরে বলল, ”না।”
ছোট ছোট ডাব, দিলু চারটে ডাবের জল খেল, ওরা কেউ খেল না। বাকি ডাবদুটো বাসু ভেতরে নিয়ে গেল। এই সময় দুটি ছেলে পঞ্চাননের সঙ্গে কথা বলতে এল।
তাদের একজন বলল, ”জ্যাঠামশাই, লালুদা জানাল, কাল দুপুরে দুটো অচেনা লোক ওর দোকানে এসে পূর্ণেন্দুর খবর নিয়েছিল। লালুদা তখন দোকানে ছিল না, ওর কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করে পূর্ণেন্দু বাড়ি থেকে বেরোয় কি না, বেরোলে কখন বেরোয় কোনদিকে যায়। আমাদের কিন্তু ব্যাপারটা সুবিধের মনে হচ্ছে না। আজ রাত থেকেই পাহারায় বেরোতে হবে। বড় টর্চ, লাঠি সবার তো নেই, তাই জোগাড় করতে বেরিয়েছি। আপনার কাছে কী আছে?”
পঞ্চানন বললেন, ”লাঠি তো নেই ছড়ি আছে, তাই দিয়ে তো গুণ্ডা সামলানো যাবে না। টর্চ আছে চার ব্যাটারির, সেটা দিচ্ছি। দিলু, দৌড়ে দোতলায় গিয়ে আমার ঘরের টেবলে একটা টর্চ আছে সেটা নিয়ে এসো তো।”
দিলু টর্চ এনে দিতে সেটা নিয়ে ছেলেদুটি চলে গেল।
”দাদু, ব্যাপারটা কী বলো তো?” কৌতূহলী দিলু জিজ্ঞেস করল। ”কাল তুমি আর মামা পূর্ণেন্দু নামের একজনের কথা বলছিলে। মনে হল ওর বিপদ ঘটেছে।”
”বিপদ বলে বিপদ! পূর্ণেন্দু চাকরি করে সল্টলেকে সেচভবনে। সাতদিন আগে বিধাননগর স্টেশন থেকে বাড়ি ফেরার জন্য ট্রেনে উঠেছে। ট্রেন যখন বামনগাছি পৌঁছেছে তখন কামরার মধ্যেই একটা ছেলেকে রিভলভার দিয়ে বুকে গুলি করে তিনজন প্ল্যাটফর্মে নেমে যাচ্ছিল। পূর্ণেন্দু ছিল দরজার কাছে, সে শেষের জনকে জাপটে ধরে। ধস্তাধস্তি হতে হতে ট্রেন ছেড়ে দেয়। এর পর কামরার লোকেরা এমন গণপিটুনি শুরু করে যে, গুণ্ডাটা তাইতে মারা যায়।”
পঞ্চাননকে থামিয়ে দিয়ে দিলু বলল, ”বুঝেছি, গুণ্ডারা এখন বদলা নেওয়ার জন্য পূর্ণেন্দুকে মারার চেষ্টা করছে, কেমন? এরকম ঘটনা আমাদের পাড়াতেও ঘটেছে, তবে রিভলভার নয়, প্রথমে বোমা মারে, রাস্তায় লোকটা পড়ে যায়, তখন ক্ষুর দিয়ে গলা কেটে ওরা মোটরবাইকে উঠে চলে যায়। লোকটা নিজের বাড়ির দোরগোড়ায় খুন হয় সকালে বাজার করে ফেরার সময়।”
”কী মুশকিলে পূর্ণেন্দু পড়েছে বলো তো।” পঞ্চানন চিন্তায় পড়ে গেলেন, ”খুনি ধরে এখন নিজেই খুন হতে চলেছে। ওরা বাড়িটা ঠিক খুঁজে বের করেছে। আমাদের পাড়ার লোকেরা খুব ভাল, খুব মিলমিশ। কেউ বিপদে পড়লে পাশে দাঁড়ায়, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ওকে বাঁচাবার জন্য ছেলেরা রাতপাহারা দেবে। কিন্তু দিনের বেলাতেও তো ওকে মারার জন্য আসতে পারে। তোমাদের পাড়ায় যে খুনটা হয়েছিল সে তো সকালেই ঘটেছিল। আগে এসব রাতের অন্ধকারে হত, এখন দিনের বেলাতেও হয়। লোকভর্তি ট্রেনের কামরা আর তারই মধ্যে কিনা গুলি করে নেমে চলে যায়! ভাবতে পারো?”
দিলু বলল, ”দাদু, ওরা আচমকা হঠাৎ অ্যাটাক করে, এক মিনিট আগেও তুমি জানতে পারবে না। দুপুরে হয়তো সদর দরজায় কড়া নাড়ল। যেই দরজা খুলবে অমনই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে বোমা মেরে কি গুলি চালিয়ে ছুটে বেরিয়ে এসে মোটরবাইকে চেপে হাওয়া হয়ে যাবে। অ্যাকশনটা করতে লাগবে বড়জোর দু’মিনিট, তখন তোমার রাতপাহারাওলারা কোথায়?”
পঞ্চানন আরও চিন্তায় পড়ে গিয়ে বললেন, ”তাও তো বটে। আমি বরং পূর্ণেন্দুর বাড়ির লোকেদের বলে আসি সদর দরজা সারাক্ষণ বন্ধ রাখবে। আর কেউ কড়া নাড়লে জানলা দিয়ে আগে দেখে নেবে অচেনা লোক কি না।”
পঞ্চাননের সঙ্গে দিলুও বেরোল। গতকাল ভ্যানরিকশা থেকে যেখানে সে নেমেছিল তার থেকে পঞ্চাশ—ষাট মিটার এগিয়ে লালুর মুদির দোকানের উলটো দিকে পূর্ণেন্দুদের বাড়ি। একতলা নিচু পাঁচিল ঘেরা বাড়ি। কাঠের ছোট্ট গেট। ইট বিছানো সরু পথ দিয়ে গিয়ে একটা চৌকো বারান্দায় উঠতে হয় দু’ধাপ সিঁড়ি ভেঙে। বারান্দাটার দু’দিকে হাঁটু সমান উঁচু দেওয়াল। তার ওপরে বসানো লোহার গ্রিল। গ্রিল ঘেরা থাকলেও বারান্দাটাকে দু’দিক খোলাই বলা যায় আর বাকি দু’দিকে ঘর। গ্রিলেরই দরজা। বাইরে থেকে এই দরজা দিয়ে বারান্দায় ঢুকে ঘরে যেতে হয়। একটা বেঞ্চ, একটা ছোট নিচু টেবল আর দুটো স্টিলের ফোল্ডিং চেয়ার নিয়ে বাইরের লোকেদের বসার জন্য বারান্দাটাকে ব্যবহার করা হয়। বাড়ির বাইরে দেওয়ালে পলেস্তরা নেই। বোধ হয় টাকায় কুলোয়নি তাই বাড়িটা সম্পূর্ণ করতে পারেনি, পরে টাকা জমিয়ে পলেস্তরা করে নেবে। এইরকম বাড়ি এই অঞ্চলে অনেক, দিলু দেখেছে। পূর্ণেন্দুদের বাড়িটার দু’পাশে কিছু জমি, তাতে একটা পেয়ারা আর কয়েকটা পেঁপেগাছ। জমিতে পড়ে আছে ভাঙা ইট, টালি, কাঠের টুকরো; দিলুর নজর গেল পেয়ারাগাছে, কয়েকটা পেয়ারা বেশ বড় আর ডাঁশা।
কাঠের গেট দিয়ে ঢুকে গ্রিলের দরজার পাশে দেওয়ালে কলিং বেল। পঞ্চানন বোতাম টিপলেন। বেল বাজার শব্দ হল না।
”নির্ঘাত লোডশেডিং। এই এক ঝামেলা। সারা সকাল, দুপুর এই চলবে।” পঞ্চানন বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে ডাকলেন, ”পূর্ণেন্দু, পূর্ণেন্দু….নবেন্দু, দিব্যেন্দু—”
ভেতরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন পূর্ণেন্দুর মা বিভা। বিধবা মহিলা।
পঞ্চানন বললেন, ”বাড়িতে কেউ নেই? পূর্ণেন্দু কোথায়, কী করছে? দেখতে এলুম।”
গ্রিলের দরজা ভেতর থেকে তালা দেওয়া। বিভা চাবি দিয়ে তালা খুলে বললেন, ”ছেলেরা এইমাত্র বেরোল। কলেজ, আপিস কামাই করে বাড়িতে বসে পাহারা ক’দিন দেবে। ভগবান আছেন দেখবেন, আর আছেন আপনারা। দাঁড়িয়ে কেন, বসুন।”
পঞ্চানন চেয়ারে বসলেন। এই সময় বারান্দার পেছনের ঘরের জানলার একটা পাল্লা ফাঁক করে উঁকি দিল একটা মুখ। চোখ দুটিতে ভয় চাপার চেষ্টা। দিলুর মনে হল এই লোকটিই পূর্ণেন্দু।
পঞ্চানন তাকে দেখে বললেন, ”বেরিও না এখন ঘর থেকে। অত ভয় পাওয়ারই বা কী আছে, আমরা তো রয়েইছি। তেমন কিছু মনে হলে আমাকে ডেকো।”
পূর্ণেন্দু বলল, ”দুপুরে আপনাকে ডাকতে হলে তো মাকে বাড়ি থেকে বেরোতে হবে, তখন যদি ঢুকে পড়ে। দেখছেন তো বাড়িটা একদম খোলা, কোনওরকম প্রোটেকশন নেই।”
দিলু এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল। এইবার বলল, ”দাদু, আমরা এসে তো দুপুরে থাকতে পারি। তুমি বন্দুকটা হাতে নিয়ে থাকবে। গুণ্ডারা এলেই গুলি চালাবে।”
”ঠিক বলেছিস।” পঞ্চানন উৎসাহে চেয়ার থেকে লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করলেন, পারলেন না। হাঁটুতে বাতের উপদ্রব ঘটল। ”বন্দুক তো সেইজন্যই রাখা, ডাকাত গুণ্ডা তাড়াবার জন্য।”
দিলু বলল, ”তা ছাড়া বন্দুকে যাতে জং না ধরে সেজন্য মাঝে মাঝে ওটা ছোড়াও দরকার।”
বিভা জানতে চাইলেন, ”মেসোমশাই, এই ছেলেটি কেন?”
”নাতি, মলুর ছেলে। বেড়াতে এসেছে। ভাল লাগলে থেকে যাবে, এখানেই পড়াশুনো করবে বোকার স্কুলে।”
দিলু বলল, ”দাদু তা হলে কি আজ দুপুর থেকেই পাহারায় বসবে।”
”আজ নয়। বন্দুকটা ঠিক আছে কি না, কার্ট্রিজগুলো ছ’সাত বছর পড়ে রয়েছে, সেগুলো ফাটবে কিনা আগে পরখ না করে কি পাহারায় বসা যায়?”
বিভা ভেতরে গিয়ে একটা প্লেটে চারটে নারকেল নাড়ু আর এক গ্লাস জল নিয়ে এসে বললেন, ”প্রথম এলে, একটু মিষ্টিমুখ করো।”
দিলু ইতস্তত করছিল, পঞ্চানন চোখের ইশারায় খেয়ে নিতে বললেন।
বাড়ি ফেরার সময় দিলু বলল, ”দাদু, তুমি বলেছিলে বন্দুক চালানো শিখিয়ে দেবে, এবার সেটা শিখিয়ে দাও, তা হলে কার্ট্রিজ আর বন্দুকটা ঠিক আছে কি না তাও সেইসঙ্গে দেখা হয়ে যাবে।”
”হ্যাঁ, এটা একটা যুক্তি বটে।” পঞ্চানন নাতির পিঠ চাপড়ে বললেন।
.
দোনলা বন্দুকটার ঘাড় মটকে দিয়ে পঞ্চানন এক চোখ বন্ধ করে পরপর নলের ভেতরে তাকালেন, গন্ধ শুঁকলেন, নাক কোঁচকালেন।
”বহুকাল পরিষ্কার করা হয়নি। আগে একটু তেল দিয়ে পরিষ্কার করেনি।”
পঞ্চানন আলমারি থেকে একটা শিশি বের করলেন। খুঁজে—পেতে একটা আড়াই হাত লম্বা কঞ্চি জোগাড় করে তার মাথায় ন্যাকড়া বেঁধে তাতে তেল ঢাললেন। এবার কঞ্চিটা নলের মধ্যে ঢুকিয়ে ঘষাঘষি করে ধুলোময়লা সাফ করলেন। সেফটি ক্যাচ দুটো টেনে পরপর ট্রিগার টিপলেন, খটাস খটাস শব্দ হল। বন্দুকের মটকানো ঘাড় সোজা করে, বাঁটটা বগলের কাছে কাঁধে ঠেকিয়ে বন্দুক তুলে বারান্দার বাইরে নারকেল গাছের দিকে তাক করলেন।
দিলু একমনে দাদুর সবকিছু লক্ষ করে যাচ্ছিল। এ পর্যন্ত যতটুকু দেখল তাতে তার মনে হলে বন্দুক ছোড়ার মধ্যে জটিলতা কিছু নেই। খেলনা পিস্তলে ক্যাপ লাগিয়ে সেফটি ক্যাচটা টেনে আঙুল দিয়ে ট্রিগার টেনে দিলে ‘ফটাস’ শব্দ হয়, সত্যিকারের বন্দুকে হয় ‘গুড়ুম’। তবে বন্দুক ধরা হাতটা স্থির রাখা দরকার আর নিশানাটাকে ঠিকভাবে একদৃষ্টে দেখা। ফাস্ট বোলার যখন ডেলিভারি করছে তখন ব্যাটসম্যান যেমন মাথাটা অনড় রেখে অপেক্ষা করে বলটাকে একদৃষ্টে লক্ষ করার জন্য, দিলুর মনে হল এটাও অনেকটা সেইরকম। তবে শুটার হওয়া তার ইচ্ছে নয়, সে হতে চায় ব্যাটসম্যান। শুধু শখ মেটানোর জন্য সে একবার বন্দুক ছুড়তে চায়।
পঞ্চানন একটা ছোট কাঠের বাক্স আলমারির মাথা থেকে নামালেন। ডালাটা খুলে তিনি দিলুকে বললেন, ”এই হচ্ছে কার্ট্রিজ, যাকে বাংলায় বলে কার্তুজ।”
দিলু দেখল ক্রিকেট বলের রঙের ইঞ্চি চারেক লম্বা মোটা চুরুটের মতো গোলাকার গোটাদশেক কার্ট্রিজ। একদিকটা পেতলে মোড়া, তবে মধ্যিখানে ছোট্ট একটা তামার টিপ। পঞ্চানন বুঝিয়ে দিলেন, ট্রিগার টিপলে এই তামাটায় সেফটি ক্যাচটা ঘা দেয়। আর তখনই ফায়ার হয়।
দিলু বলল, ”দাদু, তুমি আগে একটা গুলি ছুড়ে দেখাও, তারপর আমি ছুড়ব।”
পঞ্চানন দুটো নলে দুটি গুলি ভরলেন। বারান্দায় এসে এ—ধার ও—ধার তাকালেন, গুলি কোনদিকে কোথায় ছুড়বেন সেই লক্ষ্যটা নির্বাচন করতে। কিছুই তাঁর মনে ধরল না। অবশেষে নীচে তাকিয়ে চোখ পড়ল পুকুরে। ঠিক করলেন, জলেই গুলি ছুড়বেন।
”এইবার দেখো, বাঁ পা—টা একটু সামনে বাড়িয়ে বন্দুকের নলের এই জায়গাটা বাঁ হাতের চেটোর ওপর রেখে, বাঁটটা কাঁধের এইখানে চেপে নলের শেষে সর্ষে দানার মতো যে মাছিটা রয়েছে, একচোখ বন্ধ করে, মাছিটাকে তোমার টার্গেটের সমান লাইনে রাখো। ব্যাপারটা বুঝেছ?”
দিলু লক্ষ করছিল দাদুর ভাবভঙ্গি। পুকুরের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে ধরতেই সে সামনে তাকাল। তখন পুকুরের অপর পাড়ে একটা দশ বারো বছরের মেয়ে দড়ি ধরে একটা খয়েরি রঙের গোরুকে নিয়ে যাচ্ছে, পেছনে বাছুর।
পুকুরের মধ্যিখানে তাক করে পঞ্চানন ট্রিগার টিপলেন। নিস্তব্ধ পরিবেশ খানখান করে বন্দুকের শব্দ হতেই কোথা থেকে ভেলো ঘেউ ঘেউ ডেকে উঠল, গোরুটা থমকে দাঁড়িয়ে হাম্বা রব তুলে বাছুরের দিকে এগিয়ে গেল, গাছগুলো থেকে গোটা তিরিশ পাখি নানান রকম স্বরে ডাকতে ডাকতে ওড়াউড়ি শুরু করল।
পঞ্চানন বন্দুকটা দিলুর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ”দাদু, এবার তুমি ছোড়ো।”
দিলু আগে থেকেই নজর করেছিল বাগানে গাছে ঝুলে থাকা একটা এঁচোড়কে। বন্দুকটা হাতে পেয়ে সময় নষ্ট না করে এবং দাদু বুঝে ওঠার আগেই সে এঁচোড়টা তাক করে ট্রিগার টানল। আবার একটা প্রকৃতির শান্ততা এলোমেলো করা শব্দ। পাখিদের ভীত স্বরে ওড়াউড়ি, ভেলো দিশাহারা ডাক ডাকতে ডাকতে ছুটল বাছুরটারই দিকে, বাছুরটা ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠে ছুটতে ছুটতে গিয়ে পড়ল পুকুরে।
এঁচোড়টা গাছ থেকে জমিতে পড়ে গড়াগড়ি যাচ্ছে। দেখে দিলুর রোমাঞ্চ হল। প্রথম গুলি ছোড়াতেই সে শিকার করে ফেলেছে। পঞ্চানন মুগ্ধ স্বরে বলে উঠলেন, ”শাবাশ দাদু, শাবাশ।”
তখনই মেয়েটির আর্ত চিৎকার তারা শুনল, ”ওগো বাঁচাও, বাছুর ডুবে যাচ্ছে, বাঁচাও।”
দিলু বারান্দা থেকে দেখল বাছুরটা সাঁতরে পাড়ের দিকে এসেছে কিন্তু পাড়টা খাড়াই, ওখানে জল গভীর, দাঁড়াবার মতো তল নেই। বেচারা আঁকুপাকু করছে জমি পাওয়ার জন্য। কিন্তু পাচ্ছে না। ওর মা পাড়ের কিনারে এসে ডাকছে আর চারদিকে তাকাচ্ছে উদভ্রান্ত বিস্ফারিত চোখে।
মেয়েটি ছুটতে ছুটতে বারান্দার নীচে এল। মুখ তুলে চেঁচিয়ে বলল, ”ও দাদু, বাছুরটাকে তুলে দাও না, ও ডুবে মরে যাবে যে।”
দিলুর ইচ্ছে করল, বারান্দা থেকে লাফিয়ে পড়ে বাছুরটাকে জল থেকে তুলে আনতে। হায়, সে তো কলকাতার হাজার হাজার ছেলের মতো সাঁতার জানে না। বাছুর না হয়ে যদি মানুষের বাচ্ছা হত তা হলেও সে দূর থেকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারত না। সে ছয় মারতে পারে, জলে ঝাঁপ দিতে পারে না।
বারান্দা থেকে অসহায় দৃষ্টি ছাড়া আর কিছু না পেয়ে মেয়েটি সময় নষ্ট না করে বাড়ির ভেতরে ছুটে গেল, ”মামি ও মামি, ও হষ্য মাসি—” বলতে বলতে।
এর পরই দিলু দেখল, তার পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী মামি সুলেখা শাড়িটাকে গাছকোমর বাঁধতে বাঁধতে একটা ওলিম্পিক স্প্রিণ্টারের মতো ছুটে যাচ্ছে। বাছুরটা তখন জলে ডুবছে আর উঠছে। মামি পুকুরের পাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে দু—তিনটি হাত পাড়ি দিয়ে বাছুরটার কাছে পৌঁছে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল।
পঞ্চানন ও দিলু যখন নীচে নেমে ঘাটে পৌঁছল তখন হর্ষ সেখানে এসে গেছে, আর সুলেখাও বাছুরটাকে বুকে জড়িয়ে সাঁতার কেটে ঘাটের নীচের ধাপে এসে দাঁড়িয়েছে। হর্ষ জলে নেমে বাছুরটাকে দু’হাতে তুলে ঘাটের ওপরের ধাপে এনে শুইয়ে দিল। জল খাওয়ার জন্য বাছুরটা বমি করছে। ছুটতে ছুটতে ওর মা এসে গেল। জিভ দিয়ে সে চাটতে শুরু করল বাছুরটার মাথা পিঠ বুক।
সুলেখা হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, ”হষ্য, উনুনে পোস্ত চাপিয়ে এসেছি, দৌড়ে যা। এতক্ষণে বোধ হয় পুড়ে গেছে।”
পঞ্চানন বললেন, ”যাক পুড়ে। বউমা, তুমি না এসে পড়লে বাছুরটাকে আর বাঁচানো যেত না।”
”বাবা আমি বাঁচাবার কে, ভগবতীর সন্তান, মা—ই বাঁচিয়েছেন।” সুলেখা দু’হাত জোড় করে কপালে ঠেকালেন।
দিলু ফিসফিস করে দাদুকে বলল, ”আমাকে সাঁতার শিখিয়ে দেবে?”
”দোব। বাসুর পরীক্ষাটা হয়ে যাক, ওকে বলব, ও ভাল সাঁতার জানে।”
”তুমি জানো না?”
”জানি। তবে এই পঁচাশি বছর বয়সে জলে নামার ক্ষমতা আর নেই। দেখলে না বাছুরটা ডুবছে দেখেও দাঁড়িয়ে রইলুম।” বিষণ্ণ হতাশ স্বরে পঞ্চানন বললেন। দাদুর মুখ অপরাধীর মতো দেখাচ্ছে দেখে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো স্বরে দিলু বলল, ”তোমার আর দোষ কী, বয়স তো সব মানুষেরই হয়, ইয়ং ম্যানের মতো ক্ষমতা কি চিরকাল কারুর থাকে? বুড়ো হলে আমারও থাকবে না।”
পঞ্চানন হেসে ফেললেন নাতির বিজ্ঞের মতো কথা শুনে। বললেন, ”ক্ষমতা থাকতে থাকতে একটা দাগ কেটে যাও।”
দিলু অবাক হয়ে বলল, ”দাগ। সে আবার কী!”
”মানুষ হয়ে জন্মেছ যখন এমন কিছু একটা করো যা চিরকাল সবার মনে থাকবে। আমার কথা নয়, স্বামীজির কথা।”
দিলু ভুরু কোঁচকাল। স্বামীজি! দাদু বোধ হয় স্বামী বিবেকানন্দর কথা বলছেন। সে নাম শুনেছে কিন্তু ওঁর কোনও লেখা পড়েনি। বই পড়তে তার ভাল লাগে না।
দুপুরে ঘুম আসে না দিলুর। কলকাতায় হয় তখন স্কুলে এবং ছুটি দিন হলে খেলার মাঠে। খেলা থাকলে স্কুল পালিয়ে খেলতে যায়, বাড়ির কেউ তা জানে না। দুপুরে ঘুমন্ত দাদুর পাশে চিত হয়ে শুয়ে দেওয়ালে ঝোলানো বন্দুকটার দিকে তাকিয়ে সে চলচ্চিচত্রের মতো মনের মধ্যে দেখে যাচ্ছে সকাল থেকে যা যা ঘটেছে।—দাদুর কাছে বাসুর ট্রানস্লেশন করা, নারকেল গাছে বাসুর ওঠা, সেখান থেকে পুকুরে ঝাঁপ দেওয়া, খচাখচ কাটারি দিয়ে ডাব কাটা। এর একটাও সে করতে পারবে না। এর পর পূর্ণেন্দুদের বাড়ি যাওয়া, সেখান থেকে ফিরে বন্দুক থেকে প্রথমবার গুলি ছুড়েই গাছ থেকে এঁচোড় ফেলে দেওয়া…ভাবতেই দিলুর শরীর গরম হয়ে উঠল। এটা তো মিরাকল। কীভাবে যেন ঘটে গেল। এটা দৈব ঘটনা ছাড়া আর কী হতে পারে!
এরকম ঘটনা তো ক্রিকেটেও ঘটেছে। দিলুর মনে পড়ল বিজয়ী সঙ্ঘের সঙ্গে সালকিয়ায় গিয়েছিল ম্যাচ খেলতে, অবশ্য রিজার্ভ প্লেয়ার হিসেবে। হঠাৎ প্রবল বৃষ্টি নেমে মাঠে জল জমে গেল, খেলা বন্ধ। টিমের স্কোরার বলাইদা জমিয়ে ক্রিকেটের গল্প বলেন। তিনি শুরু করলেন ষাট সালে ব্রিসবেন মাঠে পৃথিবীতে প্রথম টাই হওয়া টেস্ট ম্যাচের গল্প। সেই টেস্ট খেলেছিল বিচি বেনোর অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ফ্রাঙ্ক ওয়ারেলের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দু’দলেই বাঘা বাঘা প্লেয়ার। একদিকে সোবার্স, কানহাই, হল, হান্ট, রামাধিন, ভ্যালেন্টাইন, অন্যদিক ববি সিমসন, ডেভিডসন, হার্ভি, ও’নিল, গ্রাউট, ম্যাকডোনাল্ড, ক্লাইনের মতো ক্রিকেটাররা।
বলাইদা যেন মাঠে বসে নিজের চোখে ম্যাচটা দেখেছেন এমনভাবে প্রথমদিন থেকে শেষদিন পর্যন্ত বর্ণনা দিয়েছিলেন:
”মিরাকল ছাড়া আর কী বলব। জেতার জন্য অস্ট্রেলিয়ার দরকার তিন রান, বাকি রয়েছে তিন বল, হাতে দুটো উইকেট। হলের বলে মেকিফ ব্যাট চালালো। বল স্কোয়ার লেগ বাউন্ডারির কাছে বড় বড় ঘাসে আটকে থেমে গেল। তীরবেগে ছুটে এসে হান্ট বলটা তুলে নিয়ে প্রায় নব্বই গজ দূর থেকে ছুড়ল। নিখুঁত ছোড়া, সোজা আলেকজান্ডারের গ্লাভসে। তখন দুটো রান নেওয়া হয়ে গেছে, তার মানে ম্যাচ টাই হয়ে গেছে। জিততে হলে আর একটা রান দরকার, ওরা সেই তৃতীয় রানটা নেওয়ার জন্য দৌড়ল। তখনই আলেকজান্ডারের হাতে বলটা পৌঁছল। গ্রাউট ডাইভ দিয়েও রান আউট থেকে রক্ষা পেল না। স্কোর তখন সাতশো সাঁইত্রিশ অল। দু’বল বাকি, জিততে এক রান দরকার। ক্লাইন এল ব্যাট করতে। এর পরই ঘটল সেই মিরাকল। ক্লাইন হলের প্রথম বলটা লেগের দিকে ঠেলে দিয়েই ছুটল। বারো গজ দূর থেকে ছোঁ মেরে সলোমন বলটা তুলেই ছুড়ল। ধীরেসুস্থে টিপ করে ছোড়ার সময় ছিল না। মাত্র একটা স্টাম্প ছাড়া আর কিছু তার নজর করার ছিল না। যদি ফসকাত তা হলে মেকিফ পৌঁছে গিয়ে অস্ট্রেলিয়া জিতে যেত। বলটা কিন্তু সোজা গিয়ে লাগল স্টাম্পে। এক বল বাকি থাকতে ম্যাচ টাই, একে দৈব ঘটনা ছাড়া আর কী বলব।”
দিলু বিড়বিড় করল, ”মিরাকল, মিরাকল। আমারটাও মিরাকল।”
দাদু ঠিক যেমনটি বলেছিল সেইভাবেই বন্দুকটা ধরে গুলিটা ছুড়েছিল। কাঁধে একটা ধাক্কা লেগেছিল মাত্র। ছররাগুলো লেগেছে এচোড়ের বোঁটার কাছে। তার টিপ যে ভাল এটা সে ক্রিকেট মাঠে ফিল্ড করার সময় জেনে গেছল। ম্যাচে গোটা দুয়েক রান আউট সে করবেই।
বিছানা থেকে উঠে দিলু বারান্দায় এল। সারা বাড়ি নিঝুম। পাশের ঘরটা বোকামামার। মামি এখন বোধ হয় ঘুমোচ্ছে। মামা স্কুলে। হাওয়াই চটিটা পায়ে দিয়ে দিলু নীচে নেমে এল। দালানে মাদুরে শুয়ে পাশ ফিরে হর্ষমুখী ঘুমোচ্ছে। দিলুর চটির শব্দে সে শোয়া অবস্থাতেই বলল, ”কে রে?”
”আমি দিলু।”
”কোথায় চললে?” হর্ষ উঠে বসল।
”ভাল লাগছে না। যাই একটু বাইরে ঘুরে আসি।”
”ভাল না লাগলে কাজ করো, জগৎ সংসার ভুলে থাকতে চাও যদি তা হলে মাছ ধরো। চলো তোমাকে একটা ছিপ দিচ্ছি।”
হর্ষ ভাঁড়ার ঘর থেকে পাঁচ হাত লম্বা বাঁশের কঞ্চি আনল। তার সরু প্রান্তটিতে প্রায় সাত হাত লম্বা শক্ত সুতো বাঁধা, সুতোর মাঝামাঝি বাঁধা শোলার চার ইঞ্চি একটা কাঠি, এটা ফাতনা। সুতোর প্রান্তে জিজ্ঞাসা চিহ্নের মতো সরু তারের বঁড়শি। ছিপটা, কলাপাতায় একমুঠো ভাত আর একটা বড় প্লাস্টিকের মগ হর্ষ দিলুর হাতে দিয়ে বলল, ”যাও ঘাটের নীচের ধাপে বসে পুঁটিমাছ ধরো আর এই মগে মাছ রাখো। দেখবে কেমন মজা লাগবে।”
দিলু লাজুক স্বরে বলল, ”কী করে ধরতে হয় একটু দেখিয়ে দেবে, কখনও তো মাছ ধরিনি।”
সে হর্ষর সঙ্গে পুকুরঘাটে এল। সিঁড়ির ধারের দিকে দাঁড়িয়ে বঁড়শিতে ভাত গেঁথে হর্ষ ছিপটা বাতাসে ছপাৎ করে মারল। বঁড়শিটা দূরে জলে গিয়ে পড়ল। বঁড়শি ডুবে গিয়ে ফাতনাটা ভাসছে।
”এবার ফাতনাটাকে নজর করো।”
দিলু দেখল একটু পরেই জলে স্থির হয়ে ভাসা ফাতনাটা তিরতির করে নড়ে উঠল। হর্ষ ছিপটা শক্ত করে ধরল। তার চোখ তীক্ষ্ন, ঠোঁটের কোণে হাসি।
”মাছ এখন ঠোকরাচ্ছে।”
ফাতনাটা একটা ডুব দিতেই সঙ্গে সঙ্গে হর্ষ ছিপে হ্যাঁচকা টান দিল। আঙুলখানেক লম্বা একটা পুঁটি বঁড়শিতে ছটফটাচ্ছে। মাছটাকে মুঠোয় ধরে হর্ষ বলল, ”এবার দেখো কী করে বঁড়শিটা মাছের মুখ থেকে ছাড়িয়ে নেবে।”
দিলু মন দিয়ে দেখল হর্ষ কীভাবে মাছের মুখের মধ্য থেকে বঁড়শিটা বের করল।
”এইবার তুমি নিজে মাছ ধরো, এ পুকুর পুঁটিমাছ ভরা। মাছ ধরে এই মগে রাখবে। আমি যাচ্ছি।” হর্ষ চলে গেল।
যেমনটি দেখিয়ে দিয়েছিল হর্ষ, সেইভাবে দিলু গভীর মনোযোগে আধঘণ্টায় আটবার ব্যর্থ হয়ে তিনটে পুঁটি বঁড়শিতে গেঁথে তুলল। তাইতে সে এত আনন্দ পেল যে, তার মনে হল ম্যাচে আট ওভার বল করে তিনটে উইকেট যেন পেয়েছে।
”কী দাদু, ক’টা হল?” পঞ্চানন বারান্দায় দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বললেন।
”তিনটে, তবে হ্যাটট্রিক নয়।”
”হবে, হবে, এই তো সবে হাতেখড়ি। উইকেটের চরিত্র, ব্যাটসম্যানের মেজাজ ভাল করে বুঝে নাও, তারপর বড় হুইল ছিপ দোব। তখন আর চুনোপুটি নয়, রুই—কাতলা খেলিয়ে তুলবে।”
পঞ্চানন নীচে নেমে এসে ঘাটের সিঁড়িতে দাঁড়ালেন। দিলু তখনই টান মেরে বঁড়শি তুলল। তাতে মাছ নেই, ভাতও নেই।
ঠাট্টা করে পঞ্চানন বললেন, ”রান চুরি করে ব্যাটসম্যান পালাল। রান আউট করতে পারলে না। শুনেছি বড় বড় অনেক ক্রিকেটারের নাকি মাছধরার নেশা আছে, সত্যি?”
দিলু বঁড়শিতে ভাত গাঁথতে গাঁথতে বলল, ”আমিও শুনেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা একমনে ফাতনার দিকে তাকিয়ে কনসেনট্রেট করলে নাকি ব্যাটিংয়ের সময় সেটা কাজে লাগে। জানি না কথাটা সত্যি কি না, তবে মাছের সঙ্গে একটা বুদ্ধির লড়াই যে হয় পুঁটিমাছগুলো আমাকে তা টের পাইয়ে দিয়েছে। দাদু, আমার কিন্তু বেশ মজা লাগছে।”
”তা হলে মামার বাড়িতে থেকে যাও।”
দিলু বঁড়শি ছুড়তে গিয়ে থমকে গেল। কলকাতার বাড়িটা তার ভাল লাগে না ঠিকই, কিন্তু বাড়ির বাইরে অনেক বন্ধু আছে, ক্রিকেট আছে, ম্যাচ খেলা আছে, হার—জিতের উত্তেজনা আছে। কিন্তু এখানে কী আছে? এখানে তো একা—একাই থাকতে হবে, বাড়িতে সমবয়সী কেউ নেই যার সঙ্গে সমানে—সমানে কথা বলা যাবে। এটা ঠিকই সে নারকেল গাছে উঠতে পারে না, সাঁতার জানে না কিন্তু প্রথমবার বন্দুক হাতে নিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছে সে কী করতে পারে।
”দাদু, এখানে তো খেলার কোনও সুযোগই নেই।” দিলু বঁড়শি জলে ছুড়ে দিয়ে বলল।
”কে বলল নেই? কোন খেলাটা খেলতে চাও? ফুটবল, কবাডি, ভলি, খো খো, ক্রিকেট—”
”ক্রিকেট আছে!” দিলু একটু অবাক হয়ে বলল।
”অবশ্যই। তুমি কি দুধঘাটকে অজ পাড়াগাঁ ভেবেছ? পলিউশান, মিছিল, ট্রাফিক জ্যাম, উৎকট শব্দ, নোংরা ছাড়া কলকাতায় আর যা যা পাওয়া যায় তার অনেক কিছুই এখানে পাবে, মায় ডাকাত—গুণ্ডা ক্রিকেটও। ফুটবল—ক্রিকেটের কোচিং সেন্টার পর্যন্ত আছে। এখানে অনেক খেলার টুর্নামেন্ট হয়। পরীক্ষার জন্য খেলাধুলো এখন বন্ধ, শেষ হলেই শুরু হয়ে যাবে। আশপাশের সাত—আটটা গ্রামের ছেলেরা আসে খেলতে। তুমি বরং এখানে থাকো, সঙ্গীসাথী অনেক পেয়ে যাবে, টানো টানো—” পঞ্চানন চেঁচিয়ে উঠলেন।
সচকিত হয়ে দিলু বড়শিতে টান দিল। দাদুর কথা শুনতে শুনতে ফাতনা থেকে চোখ সরে গেছল। মাছ উঠল না। পঞ্চানন হাসতে হাসতে বললেন, ”ফাতনা থেকে চোখ একদম সরাবে না।”
দিলুর মনে পড়ল বলাইদার একটা কথা—”ব্র্যাডম্যান যখন ব্যাট করতেন, বল থেকে একদম চোখ সরাতেন না।” কী আশ্চর্য, দাদু হুবহু একই কথা বললেন, তবে ব্যাটিংয়ের নয়, মাছ ধরার সম্পর্কে। সে ছিপ গুটিয়ে বলল, ”আজ এই পর্যন্ত, আবার কাল হবে।”
পঞ্চানন বললেন, ”কাল দুপুরে কিন্তু পূর্ণেন্দুদের বাড়িতে পাহারায় বসতে হবে। তুমি সঙ্গে যাবে তো?”
”সঙ্গে করে বন্দুকটা নেবে কিন্তু।”
রাত্রে খেতে বসে হরিসাধন বললেন, ”শুনেছ বাবা কাল সকালে নেতাজি কলোনিতে কী কাণ্ড হয়েছে, আজ আমাদের রাধুবাবুর কাছে শুনলুম সব।”
পঞ্চানন অবাক হয়ে বললেন, ”কিছু শুনিনি তো, কী হয়েছে?”
”দোকানে বসে চা খাচ্ছিল লালু নামের একটা ছেলে, বছর চব্বিশ বয়স। তখন অটো রিকশায় দুটো লোক এসে দোকানের সামনে দাঁড়ায়, ওদের দেখেই লালু ছুটে দোকানের মধ্যে ঢুকে যায়। অটো থেকে নেমে দুটো লোক ওকে তাড়া করে দোকানে ঢুকে দুটো বোমা ফাটিয়ে অটোয় চেপে পালাতে থাকে। রাস্তার লোক অটোটাকে তাড়া করলে ভিড়ের মধ্যে জোরে চালাতে গিয়ে অটোটা উলটে যায়।”
দিলু বলে উঠল, ”তারপর লোকেরা ওদের ধরে গণপ্রহারে মেরে ফেলল, তাই তো?”
”সেটাই হয়ে থাকে।” হরিসাধন হেসে বললেন, ”এক্ষেত্রে তা হয়নি। লোকেরা ওই দু’জনকে আর অটোর ড্রাইভারকে ধরে রেখে থানায় খবর দেয়, পুলিশ এসে তিনজনকে ধরে নিয়ে যায়। আর লালুকে হাসপাতালে পাঠায়, ইনজুরি খুব বেশি নয়, বোধ হয় বেঁচে যাবে।”
পঞ্চানন জিজ্ঞেস করলেন, ”ছেলেটাকে মারতে এসেছিল কেন?”
”লালুও একটা গুণ্ডা, ল্যাংড়া ভোলার দলের। আর যারা ওকে মারতে এসেছিল তারা বাপির দলের। ট্রেনে যাকে গুলি করে মারল সে বাপির দলের ছেলে, আর তাকে মারল ল্যাংড়া ভোলার লোকেরা। খুনের বদলা নিতে আজ এসেছিল বাপিরা। এই ভোলার লোকেদের একজনকেই সেদিন পূর্ণেন্দু ট্রেনে জাপটে ধরেছিল। আর দু’জন ট্রেন থেকে নেমে পালায়। পুলিশ সন্দেহ করছে সেই পালানোদের একজন হল এই লালু।”
দিলু বলল, ”এই লালুই ট্রেনের খুনিদের একজন কি না সেটা তো সবচেয়ে ভাল বলতে পারবে পূর্ণেন্দুদা, উনি তো খুব কাছের থেকে দেখেছেন।”
হরিসাধন বললেন, ”দেখেছে বলেই তো ওর প্রাণসংশয়। ল্যাংড়া ভোলা তো সেজন্যই পূর্ণেন্দুকে খুঁজছে। ও যদি বলে, হ্যাঁ এই লোকটা সেদিন ট্রেনে খুনির দলে ছিল তা হলে পুলিশ লালুকে অ্যারেস্ট করবে। ভোলা এখন চাইবে পূর্ণেন্দুকে চুপ করিয়ে দিতে। কী গেরোয় যে ছেলেটা পড়ল, কেন যে গুণ্ডাকে জাপটে ধরতে গেল।”
পঞ্চানন রাগ চেপে গম্ভীর স্বরে বললেন, ”তুই কি বলতে চাস পূর্ণেন্দু অন্যায় কাজ করেছে?”
বাবার গলার স্বরে থতমত হরিসাধন বললেন, ”অন্যায় করেছে বলছি না, তবে এখন যা সময় পড়েছে তাতে—।”
”তাতে কী?”
”গুণ্ডা বদমাশদের না ঘাঁটানোই ভাল।”
”চোখের সামনে খুন করতে দেখলেও মুখ ঘুরিয়ে থাকবে, খুনিকে ধরার চেষ্টা করবে না। তুই একজন শিক্ষক হয়ে এই কথা বলছিস!”
বাবার ধমক খেয়ে তখন হরিসাধন মুখ নামিয়ে মৃদু স্বরে বললেন, ”চেষ্টা করে কী লাভ হল, এখন তো নিজেই বাড়ি থেকে বেরোতে পারছে না। ওরা তো বাড়িতে এসেও মেরে ফেলতে পারে, যা দিনকাল।”
দিলু এইবার কথা বলল, ”ইসস মারা যেন খুব সোজা, আমি আর দাদু কাল থেকে বন্দুক নিয়ে দুপুরে ওদের বাড়িতে বসে পাহারা দোব, আসুক না গুণ্ডারা, দেখা যাবে।”
হরিসাধন অবাক হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকালেন। পঞ্চানন বললেন, ”দুপুরে পাড়ার ছেলে—ছোকরারা থাকে না, ঠিক করেছি ওই সময়টায় বন্দুক নিয়ে পাহারা দোব পুর্ণেন্দকে।”
”বাবা, গুণ্ডা বদমাশদের কাছে সকাল দুপুর বিকেল রাত বলে কোনও সময় নেই। যখন ইচ্ছে তখন, যেখানে ইচ্ছে সেখানে ওরা খুন করে গটগটিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। কাগজ খুললেই রোজ একটা দুটো এমন ঘটনার খবর তুমি দেখতে পাবে। পাহারা দেবে দাও সেইসঙ্গে একটা চোঙাও হাতে রেখো, মুখে দিয়ে চেঁচিয়ে লোক জড়ো করতে হবে তো।”
হরিসাধনের পরিহাসটা গায়ে না মেখে পঞ্চানন নাতির দিকে তাকিয়ে ভ্রূ নাচালেন। ভাবখানা এমন, দেখেছ কী বুদ্ধি! দিলু চোখ টিপে সায় দিল।
রাতে পঞ্চানন খুঁজেপেতে একটা বড় পেস্ট বোর্ডের টুকরো জোগাড় করলেন, পানের খিলি সাজার মতো গোল করে পাকিয়ে চারটে আলপিন দিয়ে আঁটলেন! চোঙাটার মুখের দিকটা সরু, অনেকটা তালপাতার ভেঁপুর মতো, তবে যথেষ্ট মোটা।
দিলু বলল, ”দাদু, একটা ট্রায়াল দিয়ে দেখব চোঙাটার ক্ষমতা কতটা!”
”কী ট্রায়াল দেবে?”
”এই ধরো চিৎকার করে বলব, ”ডাকাত ডাকাত, বাঁচান বাঁচান, ধরুন ধরুন’।”
আঁতকে উঠে পঞ্চানন বললেন, ”খবরদার, এত রাত্তিরে এই ট্রায়াল দিলে কী হবে জানো? পিলপিল করে পাড়ার লোক বেরিয়ে আসবে আর ভেলোটা সারারাত চিৎকার করে পাড়া মাথায় তুলে রাখবে।”
খাওয়াদাওয়া সেরে দুপুর বারোটা নাগাদ দিলু বন্দুক ঘাড়ে আর পঞ্চানন পেস্টবোর্ডের চোঙা হাতে নিয়ে পূর্ণেন্দুদের বাড়িতে হাজির হল।
বিভা তালা খুলে ওদের ভেতরে নিয়ে এলেন। ”মেসোমশাই আপনারা এসে যে কী ভরসা জোগালেন, পুনু তো আধমরা হয়ে রয়েছে। খালি বলছে, ‘আর কখনও এমন বোকামি করব না, মরে গেলেও করব না,’ আপনি ওকে একটু বুঝিয়ে বলুন তো।”
পঞ্চানন ভেতরে গেলেন, সঙ্গে দিলু। জানলাগুলো বন্ধ, ঘর অন্ধকার।
”পূর্ণেন্দু জানলাগুলো খোলো, দমবন্ধ হয়ে এমনিতেই যে মারা যাবে। ওরা যখন আসবে তখন বন্ধ করে দিও। ভয় কী, আমার সঙ্গে দিলু আছে, বন্দুক আছে, লোক ডাকার জন্য চোঙা আছে।”
পূর্ণেন্দু একটা জানলা খুলে দিয়ে ওদের দিকে তাকাল। একজনের বয়স পঁচাশি, অন্যজনের পনেরো, দেখে সে খুব ভরসা পেল বলে মনে হল না। বলল, ”বন্দুকে গুলি ভরা আছে তো?”
দিলু বলল, ”নিশ্চয় আছে, দেখবেন?” সে বন্দুকের ঘাড় মটকে দেখিয়ে দিল দুটো নলেই কার্ট্রিজ ভরা।
দেখে আশ্বস্ত হল পূর্ণেন্দু। এবার সে আর একটা জানলা খুলল। দিলু জানলার বাইরে তাকাতেই চোখে পড়ল পেয়ারাগাছ, ওপরের ডালে ক্রিকেট বল সাইজের চার—পাঁচটা ডাঁসা ডাঁসা পেয়ারা। তার জিভে জল এসে গেল। সে ফিসফিস করে দাদুকে বলল, ”পেয়ারাগুলো দেখেছ দাদু, দারুণ না?”
পূর্ণেন্দু বলল, ”খেতে ইচ্ছে করছে? যাও পেড়ে খাও। নার্সারি থেকে চারা কিনে এনে বাবা লাগিয়েছিলেন, খুব মিষ্টি, বিচি নেই।”
দিলু ঘর থেকে বেরিয়ে গ্রিলের দরজা খুলে বাইরে থেকে হাত গলিয়ে হুড়কোটা লাগিয়ে দিল। বাঁ দিকে বাড়ির আড়ালে গাছটা। কাঠের গেট থেকে সেটা দেখা যায় না। ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জানলা দিয়ে পঞ্চানন বললেন, ”দাদু, পায়ের আঙুলটায় নজর রেখো, ধাক্কাটাক্কা যেন না লাগে।”
পেয়ারাগুলো মগডালের কাছাকাছি। কীভাবে ওখানে পৌঁছনো যায় সেটা ভাল করে দেখে নিয়ে নীচের একটা মোটা ডাল লাফিয়ে ধরে ঝুলে পড়ল দিলু। দুলতে দুলতে জিমন্যাস্টদের বার—এর ওপর শরীর তুলে নেওয়ার মতো সে নিজেকে তুলে নিল। তারপর এ—ডাল সে—ডাল করে পৌঁছে গেল পেয়ারাগুলোর কাছে। হাত বাড়িয়ে একটা ছিঁড়ে নিয়ে প্যান্টের পকেটে রেখে আর একটা ছিঁড়ল।
ঠিক সেই সময়ই রাস্তায় মোটরবাইকের শব্দ শোনা গেল। দিলু পাতার আড়াল থেকে দেখল জিনসের ফুলহাতা জ্যাকেট গায়ে, মাথায় লাল ক্রিকেট ক্যাপ, চোখে কালো কাচের চশমা পরা একটা মোটা লোক মোটরবাইক চালিয়ে কাঠের গেটের সামনে এসে থামল। বাইকের পেছনে বসে রোগাপটকা একটা ছেলে। পরনে বুশ শার্ট, হাতে একটা ছোট থলি। সে গেটের পাল্লা খুলে ভেতরে ঢুকল। দিলু নিঃশব্দে গাছ থেকে নামতে শুরু করল।
”পূর্ণেন্দু….অ্যাই পূর্ণেন্দু, বাড়ি আছিস।” ছেলেটা কর্কশ স্বরে চিৎকার করে উঠল। ”কদ্দিন ইঁদুরের মতো গর্তে লুকিয়ে থাকবি। বেরিয়ে আয় বাইরে, নইলে পেটো মেরে তোর খুপড়ি উড়িয়ে দোব, তোর বাড়িব সবক’টার লাশ ফেলব।”
ছেলেটা যখন এইসব বলছে দিলু তখন গাছ থেকে নেমে ঘরের দেওয়ালের গা ঘেঁষে এগোচ্ছে। ঘরের জানলাটা ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। দেওয়ালের কিনারে এসে খুব সন্তর্পণে একটা চোখ বের করে দেখল ছেলেটা ডান হাত তুলে দাঁড়িয়ে, হাতে ধরা বলের মতো গোল একটা বোমা যাকে পেটো বলে।
দিলুর হাতে পেয়ারা। আপনা থেকেই তার মুঠো শক্ত করে চেপে ধরল সেটা। সেই সময় ঘরের থেকে বেরিয়ে এলেন পঞ্চানন, হাতে বন্দুক।
”কী চাই, কী চাই? ভাগো এখান থেকে, গুণ্ডামি করার আর জায়গা পাওনি। গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দোব।”
দিলু এক চোখ দিয়ে দেখল ছেলেটা দাঁত বের করে হাসছে।
”ওরে বুড়ো ব্যাটা, বন্দুক হাতে খুব রোয়াব দেখছি। ওসব বন্দুক ফন্দুক অনেক দেখা আছে।”
এর পরই প্রচণ্ড একটা শব্দ আর ধোঁয়া। মুহূর্তে দিলুর মাথার মধ্যে লক্ষ ভোল্টের বিদ্যুতের ছোঁয়া লাগল, ঝলসে উঠল বলাইদার কথাগুলো—এর পরই ঘটল সেই মিরাকল, ক্লাইন হলের প্রথম বলটা লেগের দিকে ঠেলে দিয়েই ছুটল। বারো গজ দুর থেকে সলোমন ছোঁ মেরে বলটা তুলে নিয়েই ছুড়ল। ধীরে সুস্থে টিপ করে ছোড়ার সময় ছিল না। মাত্র একটা স্ট্যাম্প ছাড়া আর কিছু—দিলু দেওয়ালের আড়াল থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল। টিপ করে ধীরেসুস্থে ছোড়ার সময় নেই। সে পেয়ারাটা ক্রিকেট বল ছোড়ার মতো ছুড়ল ছেলেটার মাথা লক্ষ্য করে।
”বাপস”, মাত্র একটা শব্দ করেই ছেলেটা গাছের কাটা ডালের মতো পড়ে গেল। পেয়ারাটা তার বাঁ কানের পাশে রগে লেগেছে।
মোটরবাইকের এঞ্জিন বন্ধ না করে লোকটা সিটে বসে ছিল। ছেলেটাকে পড়ে যেতে দেখে এঞ্জিন বন্ধ করে বাইকটাকে দাঁড় করিয়ে রেখে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে এল। দিলু এবার পকেট থেকে দ্বিতীয় পেয়ারাটা বের করল। লোকটা তার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে মুখের সামনে হাত তোলার আগেই পেয়ারাটা বের করল। লোকটা তার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে মুখের সামনে হাত তোলার আগেই পেয়ারাটা দুই চোখের মাঝে নাকে গিয়ে লাগল।
ক্যাপটা মাথা থেকে উড়ে গিয়ে বেরিয়ে পড়ল টাক। চশমাটা দু’ টুকরো। নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। লোকটা রীতিমত শক্তসমর্থ, অন্য কেউ হলে মুখ চেপে বসে পড়ত, তা না করে সে ছুটে রাস্তায় বেরিয়ে এসে মোটরবাইকে উঠে স্টার্ট দিল।
দিলুও তাড়া করে গেট দিয়ে বেরিয়ে এল। বেরোবার মুখে ছোঁ মেরে জমি থেকে পেয়ারাটা কুড়িয়ে নিয়েছিল। বাইকটা বারো—চোদ্দো মিটার এগিয়ে গেছে, দিলু তখন মাথা লক্ষ্য করে পেয়ারাটা ছুড়ল। টাকের ধারে লেগে পেয়ারাটা ছিটকে গেল। লোকটা মাথা নিচু করে নিয়ে উধাও হয়ে গেল প্রচণ্ড স্পিড তুলে।
বোমাটা গ্রিলের লোহায় লেগে ফেটেছে। বন্দুক হাতে মেঝেয় উপুড় হয়ে থাকা পঞ্চানন অক্ষত এবং হতভম্ব, কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। এমন একটা মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরি হবে এবং বেঁচে যাবেন সেটা স্বপ্নেও ভাবা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
”বাঁচান বাঁচান, খুন করে ফেলল….ছুটে আসুন, ডাকাত পড়েছে।” পূর্ণেন্দু ঘর থেকে বেরিয়ে এসে চিৎকার করে যাচ্ছে। চোঙাটা হাতে ঝুলছে।
”মুখে চোঙাটা লাগিয়ে চেঁচাও।” পঞ্চানন ধমকে উঠলেন।
পূর্ণেন্দুর চিৎকারে নয়, বোমার শব্দেই আশপাশ থেকে কয়েকজন ছুটে এল। তারা এসে দেখল একটা ছেলে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে, পাশে একটি থলি, বন্দুক হাতে পঞ্চানন, চোঙা হাতে পূর্ণেন্দু আর ঝাঁকড়া চুলের কৃষ্ণবর্ণের একটি কিশোর শান্ত চোখে একটা পেয়ারা নিয়ে লোফালুফি করছে।
একজন উত্তেজিত হয়ে বলল, ”গুলি করেছেন জ্যাঠামশাই, গুলি। কোথায় মেরেছেন, পেটে না মাথায়?”
পঞ্চানন অবাক হয়ে বললেন, ”গুলি করব কী, হতভাগাটা কি আমাকে টাইম দিল। ভাগ্যিস গ্রিলে লেগে ফেটে গেল, যদি ফোকর দিয়ে গলে ভেতরে এসে ফাটত, তা হলে,” পঞ্চানন শিউরে উঠে যোগ করলেন, ”বোমাটা ছোড়ার জন্য হাতটা তুলেছে দেখেই আমি তো মেঝেয় শুয়ে পড়েছিলুম মাথায় হাত চেপে।”
” তা হলে ডাকাতটা এভাবে পড়ে আছে কেন। দেখুন তো প্রণববাবু ওর কী হয়েছে।” লুঙ্গির কষি আঁটতে আঁটতে এক প্রৌঢ় বললেন।
”আমি কেন, আপনিই দেখুন না। আমাকে এখুনি কলেজে যেতে হবে।” বলতে বলতে প্রণববাবু পিছু হটে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
”এখন ওঁর পড়াতে যাওয়ার কথা মনে পড়ে গেল।” লুঙ্গি পরা প্রৌঢ় বিড়বিড় করে কথাগুলো বলে গুণ্ডাটাকে চিত করে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বললেন, ”কই কোথাও তো রক্তটক্ত দেখছি না। তবে কপালের বাঁ দিকটা রক্ত জমে ফুলে রয়েছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা দিয়ে মারা হয়েছে। কিন্তু মারল কে?”
ভিড়ের মধ্য থেকে একজন বলল, ”এখন এটাকে নিয়ে কী করা হবে। অজ্ঞান অবস্থায় গণপ্রহার করা মনে হয় উচিত হবে না, বরং থানায় ফোন করে খবর দিন আর দেখুন ওর সঙ্গের কেউ আশেপাশে ঘাপটি মেরে আছে কিনা। মনে হচ্ছে ল্যাংড়া ভোলার দলের ছেলে।”
পূর্ণেন্দু বলল, ”একটা মোটরবাইক আসার শব্দ পেয়েছি, সেটা চলে যাওয়ার শব্দও শুনেছি।”
কয়েকজন রাস্তায় এসে এধার ওধার তাকিয়ে ফিরে এসে জানাল, রাস্তায় অচেনা কাউকে দেখা গেল না। আবার গুঞ্জন শুরু হল—তা হলে মারল কে? কী দিয়ে মারা হয়েছে?
একজন থলিটা তুলে ভেতরে দেখে বলল, ”আরে, দুটো বোমা এখনও রয়েছে এর মধ্যে।”
পঞ্চানন আঁতকে উঠে ব্যস্ত হয়ে বললেন, ”রেখে দাও, রেখে দাও, পূর্ণেন্দুকে যে খুন করার জন্যই এসেছিল ওটা তার প্রমাণ, নাড়ানাড়ি কোরো না।”
দিলু পেয়ারাটা প্যান্টে ঘষে পরিষ্কার করে নিয়ে চিবোতে শুরু করল। যেমন মিষ্টি তেমনই নরম। এখানকার কেউ তাকে চেনে না, তার দিকে কেউ তাকাচ্ছেও না। লোকজনের কথাবার্তা সে শুনছে আর মনে মনে হাসছে।
পূর্ণেন্দুকে আশ্বস্ত করে পঞ্চানন বললেন, ”আর কেউ তোমাকে মারার জন্য এ—তল্লাটের ধারেকাছেও আসবে না। হাতের বন্দুক হাতেই রয়ে গেল অথচ দ্যাখো ধরাশায়ী।” আঙুল দিয়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা গুন্ডাটাকে দেখালেন। এর পর দিলুর দিকে ফিরে বললেন, ”দাদু, তুমি তো তখন বাইরে ছিলে, কে ওকে মারল দেখেছ কি?”
দিলু তখন পেয়ারাটায় শেষ কামড় দিচ্ছে, অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, ”আমি! দেখব কী করে, তখন তো আমি পেয়ারা গাছের ওপরে। বাব্বা, ওই সময় কেউ গাছ থেকে নামে? তবে দাদু তখন মনে হল, জাদুকর ম্যানড্রেকের মতো কালো কোট পরা মাথায় কালো টুপি একজন যেন চোখের পলকে এই পাঁচিলের ওপর দিয়ে হুসস করে লাফিয়ে বেরিয়ে গেল, সত্যি—সত্যি ম্যানড্রেক হলে তো মিরাকল!”
শুনে একজন বলল, ”দুধঘাটে ম্যানড্রেক! জেঠু আপনার নাতির কল্পনাশক্তির তারিফ করতেই হবে!”
দিলুর তখন বলতে ইচ্ছে করল, ‘আমিই মিরাকলটা ঘটিয়েছি।’ কিন্তু বাহাদুরি নেওয়া তার স্বভাবে নেই তাই বলতে পারল না। তা ছাড়া যদি প্রমাণ চায়! প্রমাণ তো সে খেয়ে ফেলেছে। কেউ তাকে পেয়ারা ছুড়তে দেখেনি, এই ব্যাপারে সে স্থিরনিশ্চিত। কিন্তু দিলু জানে মোটরবাইকে চড়া টেকো গুন্ডা, ল্যাংড়া ভোলা, তা দেখেছে।
.
কীভাবে যেন রটে গেল পূর্ণেন্দুকে রক্ষা করতে দৈবীশক্তির আবির্ভাব ঘটেছিল। ল্যাংড়া ভোলার দলের বোমা ছোড়ার ওস্তাদ ডেয়ারডেভিল ছেলে শান্টু বোমা ছুড়েই অজ্ঞান হয়ে হয়ে। জ্ঞান ফেরে দুধঘাট থানায়। সে জানায়, কী একটা শূন্য থেকে তার রগে প্রচণ্ড ঘা দিল, তারপর আর কিছু তার মনে নেই। পূর্ণেন্দু, পঞ্চানন বা বাড়ির লোকেরা এবং যারা ছুটে এসেছিল তারা কেউই দেখেনি শান্টুর রগে কে, কী দিয়ে মারল। সবারই একই জিজ্ঞাসা, তা হলে কি ভূতে এসে মারল। না কি হেডমাস্টারের কলকাতা থেকে আসা ভাগ্নে যা বলল, জাদুকর ম্যানড্রেকের মতো পোশাক পরা একটা লোককে পাঁচিল ডিঙিয়ে পালাতে দেখল, সেটাই ঠিক?
গবেষণা হল লালুর মুদির দোকানে : ”পূর্ণেন্দুর মা রেগুলার রাধাগোবিন্দর মন্দিরে প্রণাম করতে যান, রেগুলার বাড়িতে সত্যনারায়ণের পুজো দেন। ও বাড়ি ঘিরে আছে দেবতার রক্ষাকবচ, ল্যাংড়া ভোলাফোলার ক্ষমতা কি ওখানে ট্যাঁফোঁ করে? গোবিন্দজি নিজে থাপ্পড় মেরেছেন শান্টুকে, ব্যাটা ভাগ্যবান।”
আলোচনা হল দশরথ হেয়ার কাটিং সেলুনে: ”আমার বউ বলল, উঠোনে যখন কাপড় শুকোতে দিচ্ছে তখন বিশাল একটা চাকতির মতো কী যেন নিঃশব্দে উড়ে গেল পূর্ণেন্দুর বাড়ির দিকে খুব নিচু দিয়ে, আর তাই থেকে লাঠির মতো সবুজ একটা আলো হঠাৎ একবার বেরোল। বউ নিজের চক্ষে দেখল আলোর লাঠিটা আধ সেকেন্ড জ্বলেই নিভে গেল। লোকে বলে এসব গাঁজাখুরি গপ্পো, আরে বাবা, আমার বউ তো গাঁজা খায় না, খবরের কাগজও পড়ে না, তা হলে সে কী করে বলল ফ্লাইং সসার উড়ে যেতে দেখেছে? লেসার বিম দিয়ে শান্টুকে যে হিট করেছে মঙ্গল গ্রহের ইউ ফো তাতে কোনও সন্দেহ নেই।”
শান্টুর অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার পেছনে কী রহস্য রয়েছে তাই নিয়ে যখন দুধঘাটে নানারকম গালগল্প চলছে তখন বাইগাছি স্টেশনে এক সকালে বোমা, পাইপগান, লোহার রড আর ভোজালি নিয়ে ঘণ্টাদুয়েক ধরে যুদ্ধ হয়ে গেল ল্যাংড়া ভোলার দলের সঙ্গে বাপির দলের। ভোলার দলের ‘খুনি’ দুটি ছেলে মারা গেল এবং তাকে তল্লাট ছেড়ে পালাতে হল, যদিও তার বাড়ি বাইগাছিতেই। পালাবার আগে সে বলে গেছে, ”শিগগিরি ফিরে আসছি, দেখে নেব বাপিকে।” এখন বাইগাছি স্টেশন রোডের ব্যবসায়ী ও দোকানদারদের থেকে মাসিক তোলা আদায় করে শুধু বাপির গুন্ডারা, বাপি এখন সাইকেল ও ভ্যানরিকশা ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট।
পূর্ণেন্দু এখন নিশ্চিন্তে অফিস যাচ্ছে। দুধঘাট স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে, বাসু কিন্তু নিয়মিত সকালে আসে বাড়িতে কষা অঙ্ক পঞ্চাননকে দেখাতে এবং নতুন অঙ্ক শিখে নিতে। দিলুর পায়ের নখ ঢাকা ব্যান্ড—এডটা খোলা হয়েছে, নতুন নখ গজাচ্ছে। পঞ্চাননকে সে বলল, ”দাদু এখন তো সাঁতারটা শিখে নেওয়া যায়।”
তার নখ পরীক্ষা করে পঞ্চানন জানালেন, কাল থেকে বাসুর ট্রেনিংয়ে সে সাঁতার শিখবে। পরদিন দিলু জীবনে প্রথম কোনও জলাশয়ে নামল। বাড়িতে বরাবর শাওয়ারে স্নান করেছে। এক পা এক পা করে সিঁড়ির ধাপ মাড়িয়ে কোমর জল পর্যন্ত গিয়ে পিছু ফিরে ঘাটের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা দাদুর দিকে সে তাকাল।
পঞ্চানন চে�চিয়ে বললেন, ”জলে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার। আরও নামো, বাসু ওকে একটু ঠেলে দে তো।”
বাসু তার পাশেই কোমর জলে। দিলু বাধা দেওয়ার আগেই সে মুচকি হেসে তার পিঠে একটা ছোট্ট ঠেলা দিল। টলমল করতে করতে দিলু জলে পড়ে গেল। দাঁড়াবার চেষ্টা করে পায়ের তলায় ঠাঁই পেল বটে কিন্তু তখন মাথার ওপরে চার আঙুল জল। আঁকুপাকু করে মাথাটা তুলে ”হাফফ হাফফ” শব্দ মুখ দিয়ে বের করে আবার সে জলের নীচে নেমে গেল। এইভাবে পাঁচবার ওঠানামা করার পর পঞ্চানন হাঁক দিলেন, ”বাসু তোল।”
বাসু জলে নেমে দিলুর পেছনে গিয়ে পিঠে ঠেলা দিল। পায়ের নীচে সে সিঁড়ি পেল। হাত বাড়িয়ে দিলুকে টেনে কোমর জলে দাঁড় করাল। থমথমে রাগী মুখে দিলু সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে পঞ্চাননকে বলল, ”এটা কী হল দাদু, আমাকে নাকানি চোবানি করে জল খাওয়ালে।”
উৎসাহ ভরে পঞ্চানন বললেন ”তুমি তো সাঁতারের অর্ধেক শিখে ফেললে। জলের সঙ্গে পরিচয় তো হয়ে গেল, এবার ভাব জমাও। যাও যাও, আবার নামো।”
”না।” মুখগোঁজ করে দিলু বসে পড়ল।
”ক্রিকেট বল কখনও পায়ে হাতে মাথায় লেগেছে?” পঞ্চানন জানতে চাইলেন।
”অনেকবার।”
”সেজন্য তুমি কি ক্রিকেট খেলা বন্ধ করে দিয়েছ?”
দিলু কয়েক সেকেন্ড সময় নিল দাদু কী বলছে চাইছেন সেটা বুঝে নিতে। তারপরই উঠে দাঁড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। বাসু হাত বাড়িয়ে দিল।
”হাত—পা ছুড়ে যেমন—তেমন করে হোক ঘাটের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করো। আমি পাশে পাশে থাকব। ভয়ের কী আছে।” বাসু শান্ত গলায় ভরসা দিল।
ঘাটের শেষধাপ থেকে হাত দশেক দূরে বাসু তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে বলল, ”যাও এবার।”
ভয়ে দিলুর বুকের মধ্যেটা হিম হয়ে রইল তিন—চার সেকেন্ড। ডুবে যাব, ডুবে যাব। বাঁচতে হবে, আমাকে বাঁচতে হবে। দিলুর বুকের মধ্যে কে যেন চিৎকার করে উঠে বলল, ”চেষ্টা করো দিলু, বাঁচার চেষ্টা করো।’
হাত—পা ছুড়ে সে ঘাটের দিকে নিজেকে টেনে নিয়ে গিয়ে বুকজলে দাঁড়িয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে সাফল্যের আনন্দে হাসিতে মুখ ভরিয়ে ফেলল।
”শাবাশ দাদু, শাবাশ।” দিলু মুখ তুলে পঞ্চাননকে বুড়ো আঙুল দেখাল।
”আর একবার হবে নাকি?” বাসু জলের মধ্যে দশ হাত দূরেই রয়েছে। সেখান থেকেই দিলুকে ডাক দিল।
”হবে। তুমি ওখানেই থাকো, আমি তোমার কাছে যাব।” চেষ্টা করে দশহাত যেতে পেরেছে, উত্তেজনা আর উৎসাহে এখন সে টগবগ করে ফুটছে। দিলু দু’হাত ছুড়তে ছুড়তে জল ঠেলে এগিয়ে গেল বাসুর দিকে। বাসু তিন—চার হাত পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়সাঁতার কেটে অপেক্ষা করছে। হাঁসফাঁস করতে করতে দিলু বাসুর কাছে পৌঁছেই প্রাণপণে তার গলা জড়িয়ে ধরল।
”আরে ছাড়ো ছাড়ো, এভাবে ধরলে ডুবে যাব যে। পেছন দিকে এসে আমার কাঁধ ধরে একটু জিরিয়ে নাও, তারপর আবার যাবে।” বাসু যথারীতি শান্ত অনুত্তেজিত স্বরে বলল, ”জোরে আঁকড়ে ধরবে না, তা হলে দু’জনেই ডুবব।”
দিলু ঘাটে ফিরল। তবে সাঁতরে নয়, বাসুর পিঠে চড়ে। দু’হাত দিয়ে দু’পাশে জল সরিয়ে সরিয়ে বাসু এগিয়ে চলল। দিলু আলতো করে তার দুটো কাঁধ শুধু ধরে রইল। তাকে ঘাটে পৌঁছে দিয়ে বাসু আপন খুশিতে সাঁতার কেটে পুকুরের অপর প্রান্তে প্রায় পঞ্চাশ মিটার চলে গেল।
”দাদু, আমি কবে ওপারে যেতে পারব?” দিলু উন্মুখ আশা নিয়ে জিজ্ঞেস করল।
”আজ তো সবে হাতেখড়ি হল। অ আ হস্যই দিঘ্যির ওপর দাগা বুলোও কিছুদিন। অধৈর্য হলে চলে?”
দাগা বুলোতে হলে তো মামার বাড়িতে বেশ কিছুদিন থেকে যেতে হবে। সাঁতার শেখার এমন সুযোগ ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় ফেরা যায় না। পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর আগে পুকুরের ওপারে যাবে এমন একটা প্রতিজ্ঞা মনে মনে করে ফেলল। ক্লাস নাইনে পৌঁছনোর থেকেও তার কাছে এখন পুকুরের ওপারটাই একমাত্র লক্ষ্য। তা ছাড়া মাছ ধরাটা, বিশেষ করে হুইল ছিপ দিয়ে বড় বড় রুই—কাতলা খেলিয়ে খেলিয়ে তোলা, দাদু বলেছেন টেস্ট ম্যাচে ছক্কা মারার মতো ব্যাপার। দু—তিনটে ছক্কা না মেরে কি দুধঘাট থেকে যাওয়া যায়!
তা ছাড়া নারকেল গাছে ওঠা, গাছ থেকে পুকুরে ঝাঁপ। এই মজাটা সে কলকাতায় কোথায় পাবে। কলকাতার ছেলেকে ডাউন দেওয়ার জন্য বাসুর বাহাদুরি দেখানোর জবাব দিয়ে যেতে হবে। দিলু মনে মনে বলল, দাঁড়াও। সাঁতার আর গাছে চড়াটা শিখে নি। দাদু তো হাতে করে শেখাবেন না, শেখাবে বাসু। ছেলেটা সত্যিই ভাল, সবসময় হাসে, ওর নাম হওয়া উচিত ছিল হাসু। ওর একটাই দোষ, বড্ড বেশি বই পড়ে, অঙ্ক কষে। দাদু বলেছিল গরিবের ছেলে, মানুষ হয়ে উঠতে হলে তো পড়াশুনো করতেই হবে। কিন্তু বাসু তো মানুষই, তা হলে মানুষ হয়ে ওঠাটা আবার কী জিনিস? দিলু কিছুক্ষণ ভেবে ধাঁধাটার উত্তর বের করতে পারেনি।
বাসু প্রতিদিন সকালে ছোট হুড়া থেকে দু’ মাইল হেঁটে এসে পঞ্চাননের কাছে পড়তে বসে এবং প্রতিদিনই দিলু ঘুম ভেঙে বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। বাইরে দালানে বেরোলেই তো দেখতে হবে দাদু বাসুকে হয় ব্যাকরণ ধরছেন নয়তো রচনা লেখা শেখাচ্ছেন। আর তাকে দেখলেই বলবেন, ‘এই যে দাদু ঘুম ভাঙল’—শুনতে এত খারাপ লাগে। তার চেয়ে বরং যদি বলেন, ‘আজ উঠতে দেরি করে ফেলেছ। যাও চট করে মুখ ধুয়ে এসে পড়তে বসে যাও’—এইরকম কিছু বললে বাসুর সামনে লজ্জায় পড়তে হয় না। কিন্তু পড়ার জন্য দাদু আজ পর্যন্ত একটা কথাও বলেননি। অবশ্য পরীক্ষার পর মামার বাড়ি এসে কেউ লেখাপড়া করতে বসেছে বলে সে শোনেনি। ‘মামার বাড়ি ভারী মজা কিল চড় নাই’ কথাটা তা হলে তৈরি হয়েছে কী জন্য!
একদিন সাঁতার কেটে উঠে বাসু বলল, ”তুমি দাবা খেলতে পারো?”
দিলু বলল, ”না। তাস দাবা পাশা, তিন কর্মনাশা। যেসব খেলা বসে বসে খেলতে হয় তা আমার ভাল লাগে না।”
”বসে ধৈর্য ধরে খেলতে হয় বলে তোমার ভাল লাগে না কিন্তু কর্মনাশা বলছ কেন? পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ লোক দাবা খেলছে, তাদের কি কর্মনাশ হচ্ছে? ঠাণ্ডা মাথায় হিসেব কষে যুক্তি দিয়ে দাবা খেলায় জিততে হয়। লুডো কি পাশার মতো এতে ভাগ্যের হাত নেই। সেইজন্যই তো দাদু আমাকে দাবা খেলা শিখিয়ে দিয়েছেন, যাতে ব্রেনের কাজ করার ক্ষমতা বাড়ে। দুধঘাটে তো দাবা কম্পিটিশন হয়, দাদু তিনবার জিতেছেন, কাপ পেয়েছেন, তুমি জানো না?” বাসু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
দাদুর এহেন গুণপনার কথা না জানার জন্য দিলু অপ্রতিভ বোধ করল কিন্তু মুখভাবে তা ফোটাল না। বলল, ”কতদিন আগে কাপ জিতেছেন? কই ঘরে তো কোনও কাপটাপ দেখিনি!”
”বছর দশেক আগে শেষ জিতেছেন। লোকজনকে দেখাবার জন্য কাপ মেডেল সাজিয়ে রাখা, সার্টিফিকেট বাঁধিয়ে রাখা দাদু একদম পছন্দ করেন না। বলেন, বিশ্ব কি ভারত চ্যাম্পিয়ান হওয়া তো নয়, দুধঘাট চ্যাম্পিয়ান। এ আর লোককে দেখাব কী! কাপগুলো আলমারির মাথায় পড়ে থেকে থেকে ধুলো জমছিল, মামি সেগুলো ঝেড়েমুছে নিজের ঘরে আলমারিতে সাজিয়ে রেখেছেন, তুমি দেখে এসো।”
দিলু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ধীরে নিচু স্বরে বলল, ”ধৈর্য আমার সত্যিই কম। ক্রিজে গিয়েই দুমদাম ব্যাট চালাই, লাগে তুক না লাগে তাক। আমার হায়েস্ট কত জানো—আট বলে পঁয়ত্রিশ তাতে পাঁচটা সিক্সার, একটা ফোর একটা সিঙ্গল। আমাকে নেয় শুধু ফিল্ডিংয়ের জন্য।”
”শুধু ফিল্ডিং দিয়ে কতদিন আর চান্স পাবে, সেইসঙ্গে ব্যাটিং বা বোলিংয়ের একটা তো চাই।”
দিলু মাথা নাড়ল ম্লান হেসে।
”তুমি কখন দাবা খেলো, কার সঙ্গে?”
”রোজ খেলি না, পড়তে পড়তে যখন মাথা ভার হয়ে যায় একঘেয়ে লাগে তখন বিশালাক্ষী মন্দিরে গিয়ে ওখানকার পুরুতমশাই গোবিন্দ ঠাকুরের সঙ্গে ঘণ্টাখানেক খেলি। উনি খুব ভাল খেলেন, একবারও ওঁকে হারাতে পারিনি।”
”আচ্ছা বাসু, আর কতদিনে পারব ওপারে যেতে। কলকাতায় ফেরার আগেই পুকুর পার হতে চাই।” দিলু উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করল উত্তরের জন্য।
বিব্রত মুখে বাসু বলল, ”তোমার দেখছি তর সইছে না। শ্বাস নেওয়া আর ছাড়াটা এখনও ঠিক হয়নি। মাঝপুকুরে দম ফুরিয়ে গেলে বিপদে পড়বে।”
”তুমি তো আমার পাশে পাশে থাকবে।”
রাত্রে অন্ধকার ঘরে বিছানায় শুয়ে দিলু চাপাস্বরে বলল, ”দাদু দাবা খেলাটা শিখিয়ে দেবে?”
”তোমায় কে বলল আমি দাবা খেলতে জানি!”
”বাসু। ও তোমার কাছে শিখেছে বলল।”
”দাবার বোর্ড আর ঘুঁটি বাসুকে দিয়ে দিয়েছি। কাল বাইগাছি বাজার থেকে কিনে এনে দেবে। ওখানে স্পোর্টস কর্নার নামে দোকানটায় পাওয়া যাবে। হঠাৎ দাবা শেখার ইচ্ছা হল যে?”
”আমার ধৈর্য কম সেটা তো বন্দুক ছোড়া দেখেই বুঝেছ। টিপ করার জন্য সময় না দিয়েই ফায়ার করেছি।”
”আর তাতেই এঁচোড় পড়ে গেল। আমার কী মনে হয় জানো দাদু, তুমি যদি সময় নিয়ে টিপ করে গুলিটা ছুড়তে তা হলে এঁচোড়টা গাছেই থেকে যেত। ধৈর্য কম বলে নয়, এটাকে তোমার গুণই বলো আর দোষই বলো তুমি জন্মগতভাবে পেয়েছ। বাসু খুব ব্রিলিয়ান্ট নয় কিন্তু খুব পরিশ্রমী, ও ভাল রেজাল্ট করে খাটুনির জোরে। যতটুকু ট্যালেন্ট আছে সেটাকে ও ডিসিপ্লিন দিয়ে গুছিয়ে নিয়ে কাজে প্রয়োগ করে এটা ও জন্মগতভাবে পেয়েছে।” পঞ্চানন এই পর্যন্ত বলে চুপ করলেন। কথাগুলো দিলু বুঝতে পারল বলে তার মনে হল না। প্রসঙ্গ বদল করে তিনি বললেন, ”দাবা খেলা শিখতে চাও কি ধৈর্য বাড়াবার জন্য?”
”হ্যাঁ, ব্যাটিংয়ের জন্য।”
”সুনীল গাওস্কর ছশো মিনিট আটশো মিনিট ব্যাট করত কি দাবা খেলে?” পঞ্চানন গম্ভীর স্বরে কথাটা বলে নিঃশব্দে হাসতে শুরু করলেন, অন্ধকারে দিলু তা দেখতে পেল না।
”জানি না দাবা খেলত কি না।”
”যতদূর জানি ক্রিকেট ছাড়া গাওস্কর আর কোনও খেলা খেলত না। যদি ব্যাটিংয়ে উন্নতি করতে চাও তা হলে মনপ্রাণ ঢেলে ব্যাটটাই করে যাও। দাবা খেলাটা শেখো, খেলো, এটা মাথার খেলা, ক্ষতিকর নয়। দাবাতে শুধু বুদ্ধির লড়াই হয় না এতে যুক্তি আর বিচারক্ষমতাও বাড়ে।”
”তা হলে কর্মনাশা বলে কেন?”
”যারা খেলাটা জানে না তারাই বলে। আসলে বহু বছর আগে যেসব লোকের কাজকম্মো ছিল না, কাজ করার দরকার হত না, তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে দাবা খেলে সময় কাটাত। এটা প্রায় একটা নেশার মতো। এই নিয়ে নানান গল্প আছে। একটা লোক দুপুরে বউকে ভাত বাড়তে বলে তেল মেখে গামছা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোল নদীতে গিয়ে চান করবে বলে। যাওয়ার পথে দেখল তার দুই পড়শি বাড়ির দাওয়ায় বসে দাবা খেলছে। দেখে লোকটা ওদের পাশে বসে পড়ল আর বাড়ি ফিরল পরদিন সকালে। এইবার বুঝলে তো দাবার নেশা কী মারাত্মক। ঘরসংসার, খিদে—তেষ্টা সব ভুলিয়ে দেয়।”
”ওরে বাবা, না দাদু, দাবা খেলা আমার দ্বারা হবে না। মাথার খেলা মাথাতেই থাকুক, তুমি অন্য কোনও খেলার কথা বলো যাতে আমার সময় কাটে। বড্ড একঘেয়ে লাগছে। পুঁটিমাছ কতক্ষণ ধরব বলো তো, আর সাঁতার তো সারাদিন ধরে কাটা যায় না।”
”বাসুকে বলব তোমাকে স্কুলের মাঠে নিয়ে যেতে। পরীক্ষা শেষ, এখন ছেলেরা খেলতে নেমে পড়েছে, ফুটবল ক্রিকেট ভলি কবাডি সব পাবে।”
পরদিন বাসুর সঙ্গে দিলু সাঁতার কেটে মাঝপুকুর পর্যন্ত গেছে, তখন বাসু বলল, ”এবার ফেরো, আজ এই পর্যন্ত।” দু’জনে যখন ঘাটের কাছাকাছি তখন হর্ষ হন্তদন্ত হয়ে ঘাটে এসে চেঁচিয়ে বলল, ”অ বাসু তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখ তো বিন্দুপিসির বাড়ির পেছনের বিশ্বাসদের শিমুল গাছটা কারা যেন কেটে ফেলছে। বুড়ি মানুষ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে খবর দিল।”
বাসু ঝটপট হাত চালিয়ে ঘাটে পৌঁছল। হর্ষ তখনও বলে চলেছে, ”গাছটা নাকি ওরা বিক্রি করে দিয়েছে। আহা পঞ্চাশ—ষাট বছরের কতবড় গাছ, টাকার লোভে বিক্রি করে দিল! তুই দৌড়ে গিয়ে বিশ্বাসদের মেজো কত্তাকে গাছকাটা বন্ধ করতে বল।”
বাসু শুকনো প্যান্ট শার্ট পরে নিয়েই ছুটল বাড়ির দিকে। হর্ষ ছলছল চোখে বলল, ”লাল টকটকে ফুল মাটিতে পড়ে থাকত, ফুল কুড়োতুম, তুলো বের করে জমিয়ে জমিয়ে পুতুলের বালিশ—বিছানা করতুম, ও গাছ কি আজকের, জম্মো থেকে দেখছি।”
হর্ষর মুখের দিকে তাকিয়ে দিলুর মনে হল বাল্যসঙ্গী শিমুল গাছটার অপমৃত্যু ঘটছে শুনে খুবই আঘাত পেয়েছে। এখন তার মনে পড়ল খবরের কাগজে মাসছয়েক আগে একটা খবর বেরিয়েছিল, কলকাতায় একটা লোক তার বাড়ির সামনে রাস্তার একটা গাছের ডাল কাটিয়েছিল সেজন্য তার জরিমানা হয়। তাই নিয়ে বাবা আর দাদা বলাবলি করেছিল, অনুমতি ছাড়া গাছকাটা এখন বারণ। পরিবেশরক্ষার জন্য এই আইন করা হয়েছে। যদি কাটতেই হয় তা হলে সেখানে নতুন গাছের চারা লাগিয়ে কাটতে হবে।
দিলুর ইচ্ছে করল ছুটে গিয়ে আইনের কথাটা বিশ্বাসদের মেজো কর্তাকে বলে আসে। বাসুর সঙ্গেই তার ছুটে যাওয়া উচিত ছিল। বাসু কি জানে কাজটা বেআইনি। এতক্ষণে হয়তো গাছটা কেটে ফেলেছে।
আধঘণ্টার মধ্যে বাসু ফিরে এল। মুখ থমথমে। এক চোখে আগুন, অন্য চোখে জল।
”কী হল, গাছকাটা বন্ধ করেছে?” দিলু ব্যগ্রস্বরে জানতে চাইল।
”না, করল না। আমি বারণ করলুম, যে লোকটা গাছ কিনেছে সে আমাকে চড় মেরে বলল, ”তুই কে রে? যা ভাগ, পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে গাছ কিনেছি, তোর কথায় কাটব না? দুটো লোক গাছে উঠে মোটা মোটা ডালগুলো দা দিয়ে কাটছিল। একজন নেমে এসে গলার কাছে দা ঠেকিয়ে বলল, ”মাথা নামিয়ে দোব যদি আর একটা কথা বলেছ।’ আমি তখন মেজো কত্তার খোঁজে গেলুম। ওঁর বাড়িতে বলল উনি কলকাতা গেছেন, আমি চলে এলুম।”
”গাছ কতটা কেটেছে?” দিলু উত্তেজিত স্বরে বলল, ”তোমার মাথা কেটে দেবে বলল, স্পর্ধা তো কম নয়!”
”বড় তিনটে ডাল কেটেছে, এখন বোধ হয় মাথাটা কাটছে। গাছের মালিক যদি গাছ বিক্রি করে দেয় আমরা কী করতে পারি।” হতাশ দেখাল বাসুকে।
”পুলিশ খবর দিতে পারি।”
”কোনও লাভ হবে না। পুলিশ ডায়রি নেবে না। নিলেও একটা পুলিশ আসবে চার ঘণ্টা পর, ততক্ষণে গাছ কাটা হয়ে যাবে। পুলিশের ওপর ভরসা নেই বলেই তো লোকেরা ডাকাত গুণ্ডা ধরে পিটিয়ে মেরে ফেলে। তুমি কি জানো সেই লালু ছেলেটাকে, যাকে পুলিশ অজ্ঞান অবস্থায় পূর্ণেন্দুদার বাড়ি থেকে সেদিন নিয়ে গেল, সে এখন বাইগাছিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখন সে ল্যাংড়া ভোলার দল ছেড়ে বাপির দলে। পুলিশকে বলে গাছ রক্ষা করতে পারবে না, করতে হলে নিজেদেরই করতে হবে।”
বাসুর কথা শুনতে শুনতে দিলু অবাক হল, ঘৃণায় রি রি করে উঠল তার মন। অবশেষে বলল, ”চলো তো একবার দেখি কী করা যায়। চড় মারা বের করছি।”
হুঁশিয়ার করে সুলেখা বললেন, ”কোনও গণ্ডগোল পাকিও না যেন। মুখে যা বলার ভালভাবে বলবে। মামা আসুক, যা করার তিনিই করবেন।”
হর্ষ বলল, ”গাছ কেটে ফেলার পর আর কী করার থাকবে বউদি? চল আমিও তোদের সঙ্গে যাব।”
তিনজনে মিলে রওনা হল ছোট হুড়ার দিকে, ছ’—সাত মিনিট হনহনিয়ে হাঁটার পর শুরু হল পাকা বাড়িগুলোর শেষ প্রান্ত। এবার দেখা যেতে লাগল বাঁশের দরমা আর খড়ের চালের বাড়ি। বড় রাস্তা থেকে দূরে বড় বড় গাছ আর তার আড়ালে গ্রামের আভাস। হর্ষ আর বাসু ডান দিকে গোরুর গাড়ি চলার মতো একটা ভাঙাচোরা রাস্তায় নামল। দিলু তাদের পেছনে। সে এধার—ওধার তাকিয়ে হর্ষ আর বাসুর অলক্ষ্যে ইটের দুটো টেনিস বল সাইজের টুকরো চট করে কুড়িয়ে পকেটে রাখল।
”ওই দেখো আমাদের ঘর আর ওই দেখো বিন্দুপিসির ঘর, ওর পেছনেই শিমুল গাছটা,” বাসু আঙুল তুলে দেখাল যেখানে দাঁড়িয়ে সেখানে একটা খালি গোরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে। কাছেই একটা খেজুর গাছে দুটো বলদ দড়ি দিয়ে বাঁধা। গাড়োয়ানকে দেখা গেল না। রাস্তাতেও লোকজন নেই। রাস্তার ধারের জলায় একটা ছোট মেয়ে কলমি শাক তুলছে।
বাসু বলল, ”গাড়িটা এনেছে কাটা গাছ নিয়ে যাওয়ার জন্য।”
ওরা আর একটু এগোল। এবার গাছটার ওপরের দিক স্পষ্ট দেখা গেল বিন্দুপিসির ঘরের চালের ওপর দিয়ে। খালি গায়ে লুঙ্গি গুটিয়ে নীচের ডালে দাঁড়িয়ে একটা লোক বড় দা দিয়ে ওপরের ডাল কোপাচ্ছে।
”তোমরা এগিয়ে গিয়ে কথা বলো, আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি। বাসু ওই লোকটাই কি তোমার গলায় দা ঠেকিয়েছিল?”
”হ্যাঁ। আর চড় মেরেছিল যে, সে নীচে দাঁড়িয়ে।”
হর্ষ আর বাসু এগিয়ে গেল। দিলুর থেকে গাছের লোকটা মিড অন থেকে স্ট্রাইকারের উইকেটের দূরত্বে। লোকটা মাথা নিচু করে নীচের দিকে তাকাল, বোধ হয় দু’জন নতুন লোককে দেখার জন্য। দিলু হর্ষমাসির তীক্ষ্ন গলার স্বর শুনতে পেল। কথা—কাটাকাটি শুরু হয়েছে। দিলু পকেটে হাত ঢুকিয়ে বিন্দুর ঘরের চালের ওপর দিয়ে লোকটির মাথাটুকু দেখতে পাচ্ছে।
লোকটা দা হাতে নিয়েই মাটিতে পড়ল ”বাবা গো” বলে পাকা বেলের মতো। দিলু আর এক সেকেন্ড না দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরে ছুটে গোরুর গাড়ির কাছে এসে একটা বলদের গলায় হাত বুলোতে শুরু করল। একটা হইচইয়ের শব্দ তার কানে আসছে। বলদটা আরামে চোখ বুজিয়ে ফেলল।
একটু পরেই দুটি লোক একজন অজ্ঞান রক্তাক্ত লোককে চ্যাংদোলা করে নিয়ে এল। লোকটার মাথায় বাঁধা গামছা, তাদের পেছনে হর্ষ এবং বাসু। বহনকারীদের একজন গাড়োয়ান। সে ব্যস্ত হয়ে বলদ দুটিকে গাড়িতে জুততে শুরু করল।
দিলু অবাক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ”বাসু, হয়েছে কী?”
বাসু বলল, ”লোকটা গাছের ওপর ছিল, হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেল।”
প্যান্ট আর বুশশার্ট পরা বেঁটে গোলগাল গড়নের মাঝবয়সী লোকটিকে দেখে দিলুর মনে হল এই বোধ হয় সে—ই, যে গাছটা কিনেছে এবং বাসুকে চড় মেরেছে। লোকটি চোখেমুখে উদ্বেগ, বিরক্তি, ভয় আর উত্তেজনা নিয়ে বলল, ”কী গেরোর ফেরে পড়লুম এখানে কোথায় ডাক্তার কোথায় ওষুধপত্তর, সেই বাইগাছি যেতে হবে। হাত—পা ভাঙলে তো হাসপাতাল ছাড়া গতি নেই। সেও সাত—আটমাইল, কত খরচ হবে কে জানে! দশ বছর ধরে অন্তত চারশো গাছ কেটেছে, একবারও পড়েনি আর আজই—ওরে যোতনে একটু তাড়াতাড়ি কর বাবা, মরেটরে গেলে বহু টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।”
হর্ষ বলল, ”পড়ে গেছে না অপদেবতায় ঠেলে ফেলে দিয়েছে। ও গাছে তেঁনার বাস আমার জন্মের আগে থেকে। তাঁকে বাসের ঘর থেকে উচ্ছেদ করলে তিনি সহ্য করবেন কেন।” দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে হর্ষ অবদেবতার উদ্দেশে প্রণাম জানাল।
”অপদেবতা!” লোকটি চমকে উঠল, ”তার মানে ভূত?”
”বেম্মদত্যি! সাদা ধুতি চাদর, এই মোটা পৈতে, পায়ে খড়ম। কতদিন রাতে খটমট আওয়াজ যে শুনেছি।”
”যোতনে তাড়াতাড়ি কর। ব্যাটাকে গাড়িতে তুলে শোয়া।” দু’জনে ধরাধরি করে আহত লোকটিকে তুলল। ”এই যাঃ, গাছ কাটার দা—টা তো ওখানেই পড়ে আছে, যোতনে দৌড়ে গিয়ে নিয়ে আয় না বাবা।”
যতীন একগুঁয়ের মতো ঘাড় বেঁকিয়ে বলল, ”আমি এখন গাছতলায় যেতে পারব না। আপনি গিয়ে নিয়ে আসুন।”
লোকটি কাঁচুমাচু মুখে বাসুকে বলল, ”খোকা তুমি যাবে আমার সঙ্গে?”
বাসু বলল, ”চলুন।”
ওরা দু’জন এগিয়ে যেতেই হর্ষ ফিসফিস করে দিলুকে বলল, ”কেমন ভয়টা দেখালুম বলো তো। ওই গাছটার ধারেকাছে জীবনে আর আসবে না।”
আহত লোকটার জ্ঞান ফিরে আসছে। উঁ উঁ শব্দ বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে। যতীন ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল, ”কেমন আছিস রে বেচু, খুব যন্তাোন্না হচ্ছে?”
কোনওক্রমে বেচু বলল, ”কী হয়েছে আমার?”
যতীন বলল, ”কী আবার হবে, বেম্মদত্যির গাঁট্টা খেয়ে পড়ে গেছিস।”
.
বাড়ি থেকে দুধঘাট স্কুল এক মাইল। বাসুর সঙ্গে দিলু বিকেলে হাজির হল স্কুলের মাঠে। স্কুলের যে এতবড় ঘাসে ঢাকা মাঠ থাকতে পারে, দিলু তা ভাবতে পারে না। মাঠের মাঝখান থেকে তুলে পঞ্চাশ—ষাট মিটার বল মারলে ওভার বাউন্ডারি হবে। কলকাতায় তার স্কুলের কোনও খেলার জায়গা নেই, আছে একটা ছোট উঠোন। তাতে বড়জোর একটা বাস্কেটবল কোর্ট হতে পারে। তাকে খেলতে হয় পাড়ার পার্কে। সেখানে ঘাসের বালাই নেই, জমি এবড়োখেবড়ো। দুধঘাট স্কুলের মাঠ দেখে তার চোখ জুড়িয়ে গেল।
”বাসু, মাঠটা এত সুন্দর করে রেখেছে কী করে?” দিলু জিজ্ঞেস করল, ”মাঠের মালিক তো স্কুল নিশ্চয় অনেক টাকা খরচ করে।”
বাসু বলল, ”কত খরচ করে তা আমি জানি না, সেটা বলতে পারবেন তোমার মামা, হেডসার।”
মাঠের তিনধারে সার দেওয়া নারকেল আর সুপুরি গাছ, মামার বাড়ির পুকুরের ধারে যেমনটি, তবে এখানে গাছের সংখ্যা অনেক বেশি। চোখ বুলিয়ে দিলুর মনে হল, সব মিলিয়ে অন্তত একশো সুপুরি আর নারকেল গাছ রয়েছে।
”এখানে খেলাধুলোর জন্য যা খরচ হয় তা দেয় এরা।” বাসু আঙুল তুলে গাছগুলোকে দেখাল। ”স্কুলবাড়ির পেছনে আছে দিঘি, বড় বড় মাছ, তারাও দেয় খরচের টাকা। স্কুলের আর আশপাশের গ্রাম থেকে যারা খেলতে আসে তারা একটা পয়সাও দেয় না, শুধু দেয় পরিশ্রম। প্রতি মাসে একটা ছুটির দিনে শ’দুয়েক ছেলে নেমে পড়ি মাঠে। দিঘি থেকে জল পাম্প করে মাঠে ছিটোই, ঘাস লাগাই, চারপাশের আগাছা সাফ করি, মাঠে একটা ইটের টুকরোও পাবে না। হেডসার নিজে একটা চেয়ারে বসে থাকেন, আমরা কাজ করি।”
দিলুর এখন মনে পড়ল তাদের ক্লাসের নীলমণির কথা। বাংলার সেরা জুনিয়ার দাবাডু, জাতীয় জুনিয়ার চ্যাম্পিয়ানশিপ খেলতে কোজিকোড় গিয়ে তেরো দিন স্কুল কামাই হয়। রানার্স হয়ে ভারতের দু’নম্বর হয়েছে। নীলমণির বাবাকে ডেকে হেডমাস্টার বলেন, ‘হয় দাবা খেলুক নয়তো স্কুল ছাড়ুক। স্কুলে কামাই করে দাবাটাবা খেলা চলবে না।’ নীলমণি স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। এখন সে দিনরাত দাবা খেলে, দাবার বই পড়ে, দাবার কথা ভাবে। সে গ্র্যান্ড মাস্টার হবেই হবে।
বাসুর গর্বে ঝলমল করা চোখের দিকে তাকিয়ে দিলুর খুব ভাল লাগল। নিজের হাতে যারা মাঠের যত্ন করে, সেবা করে, তারা মাঠকে ভালবাসবে, এ আর নতুন কথা কী। ভাল মাঠ না পেলে ভাল খেলা হয় না, দিলু তা নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে জানে। কলকাতায় ভাল মাঠই তো নেই। বিশেষ করে বর্ষাকালে যা অবস্থা হয়। চটি খুলে হাতে নিয়ে দিলু বলল, ”চলো ঘাসের ওপর দিয়ে একটু হাঁটি। কলকাতায় তো এমন ঘাসের ওপর হাঁটা হয় না।”
মখমলের মতো নরম ঘাসে পা ডুবিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার শরীর শিরশির করে উঠল। সুন্দর একটা আমেজ তার শরীর ভরিয়ে দিল। মাঠের ধারে একটা পাকা ঘর, সেটা দেখিয়ে দিলু জানতে চাইল, ”ওটা কী?”
”ওখানে খেলার জিনিসপত্তর থাকে। গোলপোস্টের জাল, ক্রিকেটের নেট, ব্যাট বল প্যাড, উইকেট, ভলিবলের নেট, এইসব। মেডিকেলের কিট ব্যাগও আছে। আমাদের কোনও মালি নেই, হেডসার বলেছেন যেদিন মালির দরকার হবে সেদিনই স্কুলে খেলা বন্ধ করে দেবেন।”
উত্তরদিকের গোলপোস্টের পেছনে কবাডি আর ভলিবল কোর্টে তখন খেলা চলছে। দুটো কোর্টের ধারে জনা চল্লিশ বয়স্ক দর্শক, দুধঘাটেরই লোক। ওরা দু’জন সেদিকে এগিয়ে গেল। ফুটবল ক্রিকেট কেউ খেলছে না দেখে দিলু অবাক হল। তার কৌতূহল মেটাতে বাসু জানাল, ফুটবলাররা আজ মছলন্দপুরে গেছে টুর্নামেন্ট খেলতে, আর মাটি খুঁড়ে নতুন মাটি ফেলা হয়েছে প্র্যাকটিস পিচে গোবর সার দিয়ে ঘাস বোনা হচ্ছে, তারপর রোল করে নেট পড়বে। ওদিকে দক্ষিণদিকের গোলপোস্টের পেছনে, বর্ষা কেটে গেলে পুজোর আগেই হয়তো প্র্যাকটিস শুরু হবে। কথা হচ্ছে কংক্রিটের পিচ করার, তা হলে সারা বছরই প্র্যাকটিস করতে পারবে।
বাসুর কথা শুনতে শুনতে দিলুর হাত নিশপিশ করে উঠল। সে ব্যগ্রস্বরে জিজ্ঞাসা করল, ”এখানে রোজ খেলা হয়?”
”রোজ হয়। স্কুল ছুটির পরই শুরু হয়, যারা দূরে থাকে তারা খেলেটেলে বাড়ি ফেরে। ছুটির দিনে তো সকাল থেকে শুরু হয়ে যায়। তখন একটা দেখার মতো দৃশ্য, একসঙ্গে চার—পাঁচ রকমের খেলা মনে হবে খেলার হাট বসে গেছে। তুমি খেলতে না জানলেও তখন তোমার ইচ্ছে করবে ছুটে গিয়ে কোনও একটা খেলায় নেমে পড়ি। দাদু বলেন এজন্যই স্কুলের রেজাল্ট এত ভাল হয়।”
দিলু মনে মনে আক্ষেপ করল, তার যে এমন দাদু আর মামা আছে এটা সে আগে কেন জানত না! জানলে কী করত? তা হলে কি মামার বাড়িতে এসে থাকত? প্রশ্নটা তাকে দোনামনা অবস্থার মধ্যে ফেলে দিল।
বাড়ি ফেরার পরে দিলু বলল, ”আচ্ছা বাসু, ব্যাট বল নিয়ে খেলা নয় এখন বন্ধ, কিন্তু ফিল্ডিং প্র্যাকটিস তো করতে পারে।”
”পারে মানে!” বাসু থমকে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে তাকাল। ”রোজ করে, প্রত্যেককে ব্যায়াম করতে হয়, দৌড়তে হয়, তারপর ফিল্ডিং, আজ সকালেও করেছে। প্রতাপদা না এলেও রোজ সকালে এসব করতেই হবে।”
দিলু জিজ্ঞেস করল, ”কে প্রতাপদা, কোচ?”
”হ্যাঁ। রঞ্জি ট্রফি শেষ, খেলেছেন আট বছর আগে, স্পিন বোলার ছিলেন। মোটরবাইক অ্যাক্সিডেন্টে পা ভেঙে যাওয়ার পর খেলা ছেড়ে দেন, বারাসাতে থাকেন, চাষের সার আর বীজের ব্যবসা, ওখান থেকেই বাইকে আসেন।”
”আমি ফিল্ডিং প্র্যাকটিস করব, তুমি প্রতাপদাকে একবার বলবে?”
”কাল সকাল ছ’টায় আমি মাঠে হাজির থাকব, কিন্তু তুমি কি ওই সময় আসতে পারবে? তোমার তো ঘুম ভাঙে—।”
বাসুর কথা শেষ করতে না দিয়ে দিলু তাড়াতাড়ি বলল, ”না, না, খুব ভোরে আমি উঠব, তুমি দেখে নিও।”
দিলু কথা রেখে ভোরে বিছানা ছাড়ল। স্কুলের গেটে পৌঁছে দেখল বাসু দাঁড়িয়ে আছে, তাকে দেখে হাসল। হাসিটার অর্থ বুঝতে দিলুর অসুবিধে হল না—তা হলে সত্যি—সত্যিই ঘুম ভেঙেছে দেখছি।
মাঠটাকে পাক দিয়ে সাতটি ছেলে জগ করছে। দিলু হাওয়াই চটি খুলে বলল, ”চলো, আমরাও ওদের সঙ্গে জগ করি।”
ছেলেগুলির পেছন পেছন ওরাও জগিং শুরু করল। বাসুকে ওরা চেনে কিন্তু নতুন ছেলেটি কে? কৌতূহলে ওরা বারবার পেছন ফিরে তাকাতে লাগল। ওদের মধ্যে সর্দার ছেলেটি, যার পরনে সাদা হাফপ্যান্ট সাদা টি—শার্ট আর ক্রিকেট বুট, মাথা ন্যাড়া, সে সবার আগে ছুটছে। দিলু চারপাক সবে শেষ করেছে তখন ন্যাড়ামাথা হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে বলল, ”এবার স্ট্রেচিং।”
মাঠের ধারে ওরা ব্যায়াম শুরু করল। দিলু দেখল একটি ছেলে ফিসফিস করে বাসুকে কী জিজ্ঞেস করল বাসুও চাপাস্বরে জবাব দিল। দিলু জানে বাসু কী বলল—হেড সারের ভাগ্নে, কলকাতায় থাকে বেড়াতে এসেছে। ব্যায়ামরত ছেলেদের ফিটনেস দিলুকে অবাক করল। এভাবে সে আগে কখনও ব্যায়াম করেনি। ছেলেদের শরীরের নড়াচড়া দেখে বুঝে গেল সে যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে।
ব্যায়ামের পর শুরু হল ক্যাচ লোফা, গ্রাউন্ড ফিল্ডিং, উইকেটকিপারকে বল ছোড়া। মাঠের মাঝে একটা স্টাম্প পোঁতা, সেখানে প্যাড—গ্লাভস পরে দাঁড়িয়ে একটি ছেলে, তার পাশে ব্যাট হাতে ন্যাড়ামাথা। সে ব্যাট দিয়ে প্রথম বলটা তুলে মারল, বল নারকোল গাছের মাথা ছাড়িয়ে উঠে প্রায় আকাশ ছুঁয়ে ফেলার মতো উচ্চচতায় উঠে গেছে। দিলুর ডান দিকে পাঁচ গজ দূরে যেটা ডানহাতি ব্যাটসম্যানের লং অফ, দাঁড়ানো ছেলেটির দিকে বল নামছে। সে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলটা লক্ষ করতে করতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য তিন পা পিছিয়ে গেল। বল এবার জমিতে পড়বে। চিলের শিকার ধরার মতো ঝাঁপিয়ে ছোঁ মেরে ডান হাতের তালুতে বলটা ধরেই একপাক গড়িয়ে ছেড়ে দেওয়া স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে উঠেই ছুড়ল উইকেটকিপারকে। বলটা জমি না ছুঁয়ে সোজা এসে লাগল সেই একমাত্র স্টাম্পটিতে।
সবারই চোখ কপালে উঠল। গত পাঁচ সেকেন্ডে তারা যা দেখল বিশ্বাস করতে পারছে না। একজন তো বলেই উঠল, ‘আনতাউড়ি হয়ে গেছে, ফ্রুক।” ন্যাড়ামাথা চেঁচিয়ে বলল, ”আর একবার করে দেখাতে পারবে?”
”চেষ্টা করে দেখব।” বলার পরই দিলুর চোয়ালের পেশি দপ করে উঠল।
ন্যাড়ামাথা বলটা তুলে ব্যাট দিয়ে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করল। বল উঠল একস্ট্রা কভারে দিলুর থেকে পনেরো গজ পেছনে। তিরাশির বিশ্বকাপ ফাইনালে ভিভ রিচার্ডসের ক্যাচ ধরার জন্য কপিলদেব যেভাবে বলের দিকে তাকিয়ে ছুটেছিল, দিলু প্রায় সেইভাবেই কভার থেকে ছুটে বাঁ কাঁধের কাছে বলটা লুফেই শরীর ঘুরিয়ে ডান হাতে ছুড়ল। আগের মতোই বল এসে স্টাম্পে লাগল।
চোখগুলো কপালে না উঠে ছানাবড়ার আকার নিল। কারও মুখে কথা নেই, শুধু বাসু ছুটে গিয়ে দিলুকে জড়িয়ে ধরল। ”অদ্ভুত, অদ্ভুত! পরপর দু’বার! তুমি তো অর্জুনের মতো লক্ষ্যভেদ কর দেখছি।”
এমন সময় মোটরবাইকে প্রতাপ লাহিড়ি গেট গিয়ে ঢুকল। ছিপছিপে লম্বা, গোলগলা লাল রঙের গেঞ্জিপরা। বয়স বোঝা যায় না, দেখে মনে হয় পঁয়ত্রিশ, আসলে চল্লিশ। পায়ে স্নিকার। প্রতাপ কলকাতায় উত্তরপল্লী সঙ্ঘের ক্রিকেট সচিব, তারা সি এ বি লিগের প্রথম ডিভিশনে খেলে।
”কীসের লক্ষ্যভেদ রে?” প্রতাপ ওদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল।
একজন উত্তেজিত গলায় বলল, ”এই যে এই ছেলেটা, আজই প্রথম এসেছে। বাসু বলল হেডসারের ভাগ্নে কলকাতায় থাকে, নাম দিলু, দিলীপ। দুটো দারুণ ক্যাচ নিয়েই নিমেষে বল ছুড়ে স্টাম্পে দু’—দু’বার মারল ওই ওখান থেকে।” ছেলেটি আঙুল দিয়ে দেখাল দিলু যেখান থেকে বল ছুড়েছে।
প্রতাপের ভ্রূ কুঁচকে উঠল। বল ছোড়ার দূরত্বটা চোখ দিয়ে মাপল। ওরা দাঁড়িয়ে ডীপ একস্ট্রা কভারে। প্রতাপ বলটা হাতে নিয়ে লং অফের দিকে তাকিয়ে আচমকা বলটা জোরে গড়িয়ে দিল, যেখানে স্কোয়ার লেগ আম্পায়ার দাঁড়ায় সেইদিকে। চিৎকার করে উঠল, ”গোওও, রান।”
দিলু ধনুক থেকে বেরোনো তিরের মতো ছুটে গিয়ে শর্ট স্কোয়ার লেগের কাছে জমি থেকে বলটা কুড়িয়েই শরীর মুচড়ে সেই একমাত্র স্টাম্পের দিকে ছুড়ল। প্রতাপ হতভম্ব হয়ে দেখল স্টাম্পটা ছিটকে চারহাত দূরে গিয়ে পড়েছে। সে বিড়বিড় কল, ”অবিশ্বাস্য, অবিশ্বাস্য, হতে পারে না। তা হলেও ভালভাবে দেখে নেওয়া দরকার।”
এবার ব্যাট হাতে নিল প্রতাপ। স্কোয়ার লেগ থেকে পয়েন্ট, আধখানা মাঠে তুলে তুলে এলোমেলো বল মারল। দিলু প্রত্যেকটা ক্যাচ ধরে স্টাম্পে ছুড়ল, এগোরোবার স্টাম্প ফেলে দিল, শুধু একটি সোজা জমা পড়ল উইকেটকিপারের গ্লাভসে।
প্রতাপের মুখ গম্ভীর থমথমে হয়ে উঠল উত্তেজনা চাপার চেষ্টায়। হাতের আঙুল কাঁপছে। একটা অসাধারণ আবিষ্কার তার চোখের সামনে। মনে মনে বলল, বারোবার পরীক্ষায় এগারোটাতে সফল, এটা কি আবিষ্কার নয়? বাংলা কি ভারত ছেড়েই দিলাম, পৃথিবীতেও কি একটা এমন ফিল্ডার এখন আছে? জন্টি রোডস। দুর, দুর বারোটায় বড়জোর পাঁচটা কি ছ’টা লাগাতে পারবে। ছেলেটাকে হাতছাড়া করা যাবে না। ও বোধ হয় জানে না কী ঈশ্বরদত্ত প্রতিভা ওর মধ্যে রয়েছে। দিলুর সঙ্গে সে কথা শুরু করল:
”কলকাতায় তুমি থাকো কোথায়??”
”মৌলালিতে।”
”কোনও ক্লাবে কি খেলো?”
”অ্যালবার্ট স্কোয়ারে বিজয়ী সঙ্ঘ ক্লাবে।”
”ওখানে বলাই মিত্তির আছে না?”
”হ্যাঁ। বলাইদা আমাদের স্কোরার।”
”ময়দানে কখনও খেলেছ?”
”না। আমাদের ক্লাবের ময়দান পর্যন্ত যাওয়ার ক্ষমতা এখনও হয়নি।”
”যদি তোমাকে ময়দানের কোনও ক্লাব ডাকে, যাবে?”
চকচক করে উঠল দিলুর চোখ। ময়দান মানে সি এ বি লিগের ক্লাব। তারপর বেঙ্গল টিমে, তারপর ইন্ডিয়া টিমে। উত্তেজনা দমন করে স্বাভাবিক স্বরে সে বলল, ”আমায় ডাকবে কেন, কী এমন খেলেছি!”
প্রতাপ মনে মনে বলল, ‘যা দেখলুম তার অর্ধেকও যদি দেখাতে পারো তা হলে তোমায় নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে।’ কিন্তু মুখে সে বলল, ”কলকাতায় কবে ফিরছ? কোন স্কুলে কোন ক্লাসে পড়ো?”
উত্তর দিতে দিলু ইতস্তত করল। পরীক্ষার ফল বেরোতে এখনও সাতদিন বাকি। তার আগেই বাড়ি ফিরতে হবে। সে নব্বুইভাগ নিশ্চিত, পাশ করতে পারবে না। দাদাদের কিংবা বাবার মতো তার মগজ পড়াশুনোর জিনিসপত্রে ভরা নেই, এটা সে মাকে অনেকদিন আগেই জানিয়ে রেখেছে। মা শুধু বলেছিলেন, ‘নীচের ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গে বসতে তোর লজ্জা করবে না?’
তার মনে এল বোকামামার কথাটা : ‘ভাল লাগলে দিলু এখানেই থেকে যাবে।’ এ—কথা শুনে সেদিন সে মনে মনে হেসেছিল। মায়ের সঙ্গে ছেলেবেলায় মামার বাড়িতে এসে নিঃসঙ্গ বোধ করত কিন্তু এবার সে করছে না, বরং ভালই লাগছে। এই ক’দিনে এমন কয়েকটা ব্যাপার ঘটে গেছে যাতে সে মজা পেয়েছে, অবাক হয়েছে, সবচেয়ে বড় কথা, এমন তকতকে একটা মাঠে খেলার সুযোগ আর খেলার জন্য এত ছেলে সে কোথায় পাবে?
”সরস্বতী ইনস্টিটিউশনে। ক্লাস এইটে পরীক্ষা দিয়েছি। কলকাতায় ফিরব কবে ঠিক নেই।” একটু আনমনা দেখাল দিলুকে।
প্রতাপ বলল, ”এখানে থাকলে তুমি সারা বছরই খেলার সঙ্গে যোগ রাখতে পারবে আর কলকাতাও তো বেশিদূর নয়, বরানগর থেকে বাসে ময়দানে পৌঁছতে যে সময় লাগবে এখান থেকেও ততটাই লাগবে। তুমি দুধঘাট স্কুলে ভর্তি হয়ে যেতে পারো, কলকাতার যে—কোনও ভাল স্কুলের থেকে একটুও খারাপ নয়। আচ্ছা, তোমার বয়স কত, তোমার গার্জেন কে, বাবা?”
বয়স বলতে গিয়ে দিলু বরাবরই লজ্জায় পড়ে যায়। তার দেহের আকার দেখে বেশিরভাগ লোকই ধরে নেয় সতেরো—আঠারো।
”পনেরোয় পড়ব দু’ মাস পর।” তারপরই সে তাড়াতাড়ি যোগ করল, ”আমাদের বংশের সবাই খুব লম্বাচওড়া, বাবা সওয়া ছ’ফুট, পঁচানব্বুই কেজি, আমার গার্জেন।”
প্রতাপ কী যেন ভাবল, তারপর বলল, ”আগে হেডসার হরিসাধনবাবুর সঙ্গে কথা বলি।”
বাসু এতক্ষণ অন্যদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিল। এবার বলল, ”হেডসারের সঙ্গে নয় প্রতাপদা, আগে কথা বলুন দিলুর দাদুর সঙ্গে, উনি খেলা খুব ভালবাসেন।”
”এখুনি যাচ্ছি।” প্রতাপ তখনি বাইকে উঠে রওনা হল দিলুর মামাবাড়ির উদ্দেশ্যে, বাড়িটা সে চেনে, আগে দু—তিনবার গেছে। পুকুরধারের বেগুন খেতে পঞ্চানন তখন একটা টুলে বসে রিদুকে দিয়ে গাছগুলোর গোড়ায় মাটি খুঁড়িয়ে সার দেওয়ার কাজ দেখছিলেন, চার বছর আগেও তিনি এই কাজ নিজের হাতে করেছেন। এমন সময় হাজির হল প্রতাপ। পঞ্চানন তাকে দু’বার দেখেছেন এই বাড়িতে, হেডমাস্টারের সঙ্গে কথা বলতে এসেছিল। প্রতাপ পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবে ঠিক করেই রেখেছিল এবং তাই করল। পঞ্চাননের মুখে দেখে মনে হল খুশি হয়েছেন, সে আশ্বস্ত হল।
”আমার নাম প্রতাপ লাহিড়ি, আমি—”
পঞ্চানন হাত তুলে বললেন, ”জানি, তুমি তো এ বাড়িতে আগে এসেছ, ছেলেদের ক্রিকেট শেখাও। বোকা তো এখন বাড়ি নেই।”
”আমি এসেছি আপনার কাছেই, আপনার নাতির খেলার ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে।” এই পর্যন্ত শান্তভাবে বলেই প্রতাপ উচ্ছ্বসিত হয়ে দু’হাত ঝাঁকিয়ে বলল, ”কী বলব আপনাকে, অদ্ভুত, আউট অব দিস ওয়ার্ল্ড, কখনও দেখিনি—”
পঞ্চানন চোখ পিটপিট করে বললেন, ”ব্যাপার কী, দিলু করেছে কী?”
”অসাধারণ, অবিশ্বাস্য ফিল্ডার। মাঠের যেখান—সেখান থেকে বল ধরেই বিদ্যুৎগতিতে ছুড়ে স্টাম্পে মারছে, একটা স্টাম্পে।”
”তাতে হয়েছে কী?” পঞ্চানন বুঝতে পারছেন না স্টাম্পে বল মারার মধ্যে অসাধারণত্বের কী আছে।
”হয়েছে কী!” প্রতাপ উত্তেজিত হতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ”মাঠে এইরকম একটা ফিল্ডার থাকলে ব্যাটসম্যানের অবস্থাটা কী হবে একবার ভেবে দেখুন। একটা রান নেওয়ার আগে চোদ্দোবার তাকে ভেবে দেখতে হবে, দুটো রান নেওয়ার আগে—নাহ, দ্বিতীয় রানটা নিতেই যাবে না যদি দেখে দিলু বলটা ফিল্ড করতে যাচ্ছে। এরকম একটা ফিল্ডার মাঠে থাকলে অপোনেন্টের রান কত কমে যাবে ভাবতে পারেন। রান আউট হয়ে যাওয়ার ভয়ে ক্রিজ ছেড়ে বেরোবেই না। যেদিকে দিলু থাকবে সেদিকে স্ট্রোক নেবেই না, আর অন্যদিকে মারতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনবে। এবার বুঝতে পারছেন আপনার নাতি কী জিনিস?”
পঞ্চানন শান্তস্বরে বললেন, ”বুঝলাম, তা আমার কাছে কেন, আমি তো আর ব্যাট করব না।”
”ওকে আমার ক্লাব উত্তরপল্লীতে খেলাতে চাই। ক্লাবটা বরানগরে। ফার্স্ট ডিভিশনে গড়ের মাঠে খেলে। বাচ্চচা ছেলে, ওর অভিভাবকদের অনুমতি নেওয়া উচিত বলে মনে হল, তাই আপনার কাছে এসেছি। বেশিরভাগ বাবা—মাই তো পড়াশুনো ফেলে খেলাধুলো পছন্দ করেন না।”
”আমি ওর বাবা নই, মা’ও নই। তুমি তাদের কাছেই যাও।”
”ছেলেটিকে আমি এখানে রাখতে চাই। এখানকার এত ভাল মাঠ, অফুরন্ত প্র্যাকটিসের সুযোগ, আর এত ছেলে, এ—সবই সম্ভব হয়েছে দুধঘাট স্কুল আর তার হেডমাস্টারের জন্য। এই স্কুল তো কলকাতার কোনও স্কুলের চেয়ে লেখাপড়ায় কম নয়। আমি বলি কী, দিলু মামার বাড়িতে থেকে পড়াশুনো করুক আর ক্রিকেটটা কলকাতায় আমার ক্লাবের হয়ে খেলুক।” প্রতাপ হাত জোড় করে প্রার্থনার ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল।
পঞ্চাননের ঠোঁটে একচিলতে হাসি খেলে গেল। বললেন, ”দিলু যদি এখানে থাকে তা হলে আমি খুশিই হব, কিন্তু ওর বাবা—মা সেটা চাইবে কিনা তা আমি জানি না। আমার ছেলের সঙ্গে কথা বলে দেখতে হবে।”
যাওয়ার আগে প্রতাপ বলে গেল, ”আমি কলকাতায় গিয়ে দিলুর বাবার সঙ্গে কথা বলব।”
একটু পরেই দিলু ফিরল। দাদুকে বেগুন খেতে টুলে বসে থাকতে দেখে সে কৌতূহলে এগিয়ে গেল। রিদু উবু হয়ে খুরপি দিয়ে গাছের গোড়ার মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে সরে যাচ্ছে করলার মাচার দিকে।
”তুমি নাকি অসাধারণ ফিল্ডিং করো, মাঠের যেখান—সেখান থেকে বল মারো স্টাম্পে!” পঞ্চানন বললেন, ”অবিশ্বাস্য কাণ্ড করেছ স্কুলের মাঠে।”
দাদু এরই মধ্যে জেনে গেছে, তার মানে ইতিমধ্যেই প্রতাপদা এসে বলে গেছে। দিলু প্রশংসা শুনলে আড়ষ্ট বোধ করে, লজ্জাও পায়। প্রসঙ্গ ঘোরাবার জন্য বলল, ”দাদু, ওই কুমড়ো দুটো তো পেকে গেছে, কাটবে না?”
পঞ্চানন মুখ ফিরিয়ে করলার মাচার নীচে কুমড়োদুটোর ওপর চোখ রাখতেই চোখের মণি স্থির হয়ে গেল। মাচা থেকে একটা সাপ ঝুলছে, ফণা তুলে রয়েছে রিদুর মাথার একহাত ওপরে। রিদু পাশের বেগুনগাছের দিকে সরার জন্য নড়লেই ছোবল মারবে।
দাদু কথা না বলে একদৃষ্টে সামনে তাকিয়ে রইল কেন জানার জন্য দিলুও তাকাল। সাপটার ফণা অল্প অল্প দুলছে। শিরশির করে উঠল তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত। সাক্ষাৎ যম রিদুদার মাথার ওপর।
”গোখরো।” পঞ্চানন ফিসফিসিয়ে বললেন, তারপর কুড়ি হাত দূরে উবু হয়ে বসা রিদুকে চাপা গলায় হুঁশিয়ার করলেন, ”রিদু যেমনটি আছিস ঠিক তেমনিই থাক, নড়বি না, তোর মাথার ওপর সাপ ঝুলছে।”
শোনামাত্র নিথর হয়ে গেল রিদু। বছর চল্লিশ বয়স। জীবনে সে অনেক সাপের মুখোমুখি হয়েছে। সে জানে এইরকম মুহূর্তে কী করতে হয়। দিলু জানে সাপের কান নেই, কিন্তু চোখ আছে, শুনতে পায় না কিন্তু দেখতে পায়। সে নীচে তাকিয়ে পায়ের কাছে দেখতে পেল একটা শক্ত মাটির ঢেলা। খুব ধীরে ধীরে হাঁটু ভেঙে ডান হাতটা নামিয়ে কুড়িয়ে নিল ঢেলাটা। স্ট্রোক নেওয়ার আগে ব্যাট পেছনে তোলার মতো সাপটা ফণা একটু পিছিয়ে নিল। পঞ্চানন একদৃষ্টে সাপের দিকে তাকিয়ে, তার কণ্ঠনালী নড়ে উঠল ঢোক গেলার জন্য। দিলু মাথাটা সামান্য ঘুরিয়ে চোখের কোণ দিয়ে তাকাল একবার, আর মুহূর্তের মধ্যে বাঘের লাফের মতো ঝলসে উঠল তার ডান হাত।
দু’হাত লম্বা সাপটা ছিটকে পড়েছে জমিতে, রিদুর সামনে। ছটফটাচ্ছে, পাকিয়ে পাকিয়ে মোচড়াচ্ছে শরীরটা। মাথাটা থেঁতলে রক্তাক্ত। পঞ্চানন তাকিয়ে রইলেন নাতির দিকে, ঢেলাটা যে সাপের মাথায় লাগল সেটা তিনি দেখেছেন এবং কে সেটা ছুড়ল তাও বুঝেছেন, তাঁর মুখে কথা সরল না। দিলুর মুখ নির্বিকার।
”রিদু, তুই যমের বাড়ি থেকে ফিরে এলি।” পঞ্চাননের মুখ দিয়ে বেরোনো এটাই প্রথম কথা। রিদু বাঁশের একটা খেটো দিয়ে সাপটাকে পিটিয়ে মারতে মারতে বলল, ”বড় কত্তা, সাপের এমন দশা হল কী করে বলো তো? খুব বাঁচা বেঁচে গেছি, এ তো গোখরো সাপ গো।” রিদু শিউরে উঠল।
দিলু বলল, ”দাদু, বাসু বাড়ি চলে গেছে, আজ আমি একাই পুকুরের ওপারে যাব।” এই বলে সে ছুটে বাড়ির মধ্যে চলে গেল।
পঞ্চানন রিদুকে বললেন, ”বাড়ি যা, আজ আর কাজ করতে হবে না। পরে বলব সাপটার দশা এমন হল কী করে।”
তেল মাখতে মাখতে দিলুকে পুকুরঘাটের দিকে যেতে দেখার পর বাড়িতে এসে পঞ্চানন সুলেখাকে বললেন, ”বউমা, আজ দুটো রহস্যের সমাধান করেছি, সেই লাল গুণ্ডার অজ্ঞান হওয়ার, আর গাছ কাটতে কাটতে লোকটার পরে যাওয়ার। বাড়ির বাইরের কাউকে যদি না বলো, হষ্যকেও নয়, তা হলে রহস্যটা ফাঁস করতে পারি।”
সুলেখা কথা দিলেন, কাউকে কিছু বলবেন না। পঞ্চানন তখন পুত্রবধূর কানে কানে বললেন, ”এসব দিলুর কাণ্ড।” তারপর তিনি বউমাকে জানালেন প্রতাপের কাছে যা শুনেছেন আর নিজের চোখে সাপটাকে যেভাবে মরতে দেখেছেন তার বিবরণ। অবশেষে বললেন, ”আমার এখন মনে হচ্ছে আগের ঘটনা দুটোও দিলুর কীর্তি। লেখাপড়ায় ওর মন নেই। শুধু ক্রিকেট খেলতে চায়, তাই খেলুক। প্রতাপ চাইছে ওকে এখানে এনে পড়াশুনো করাতে, তাই করাব।”
প্রতাপ একটা দিনও দেরি করতে রাজি নয়, পরের দিনই সে কলকাতায় গিয়ে বলাই মিত্তিরের খোঁজ নিল অ্যালবার্ট স্কোয়ারে। সেখানে একটি ছেলে বলে দিল তার বাড়িটা কোথায়। সে বাড়িতেই বলাইকে পেয়ে গেল। তাদের পরিচয় বহুদিনের। বলাই একসময় কালীঘাট ক্লাবে কয়েক সিজন উইকেট কিপিং করেছে, প্রতাপও তখন কালীঘাটে।
”বলাই তোদের ক্লাবে দিলীপ কর নামে একটা ছেলে খেলে, ওর বাবাকে চিনিস?”
বলাই অবাক হল, এমন একটা প্রশ্ন প্রতাপ প্রথমেই করায়।
”ব্যাপার কী বল তো হঠাৎ দিলুর খোঁজ? ওকে তোদের ক্লাবে নিতে চাস বুঝি?”
”না, না, তেমন কিছু নয়, মানে—” প্রতাপ বলাইয়ের কৌতূহলটায় বিব্রত হয়ে পড়ল। তার এই খোঁজ নেওয়ার আসল কারণটা জানাজানি হয়ে গেলে অনেক ক্লাবই দিলুর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে এটা সে জানে।
”তুই ওকে খেলতে দেখেছিস?” বলাই চোখ সরু করে তাকাল।
”না।”
”তা হলে ওর সম্পর্কে ইন্টারেস্ট নিচ্ছিস কেন?” বলাইয়ের ভ্রূ কুঁচকে উঠল।
”ওর ফিল্ডিং প্র্যাকটিস দেখেছি।” যা বলতে চায়নি অবশেষে প্রতাপ সেটাই বলে ফেলল।
”আহহ তাই বল। প্রতাপ লাহিড়ি কেন দিলুর বাবার খোঁজ নিচ্ছে এবার সেটা বুঝতে পারলুম। ওর বাবা তরুণ কর খুব বড় উকিল, প্রচুর পয়সা, থাকে এগারো নম্বর রিপন রো—এ, পাশের পাড়ায়। দিলু পড়াশুনোয় একদমই ব্রাইট নয়, ওর বাবা তাই খেলাধুলোর ওপর হাড়ে চটা। আমরা তো ওকে টিমে নিই শুধু ওর ফিল্ডিংটার জন্য। অন্তত তিনটে ক্যাচ নেবে কি রান আউট করবেই। যদি একটু ধরে ব্যাটটা করতে পারে তা হলে খুব তাড়াতাড়ি উঠে আসবে।”
প্রতাপ উঠে পড়ল। তার যা জানার জানা হয়ে গেছে, এবার তাকে তরুণ করের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তালতলায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে সময় কাটিয়ে রাত আটটা নাগাদ সে পৌঁছল রিপন রো—এ দিলুদের বাড়ি। সেখানে চারজন মক্কেল তখন অপেক্ষা করছে। তরুণ করের ক্লার্ক জানাল, ঘণ্টাখানেকের আগে দেখা করা সম্ভব হবে না। প্রতাপ একটা চেয়ারে হতাশ হয়ে বসে পড়ল। ঘরের দরজা দিয়ে বাড়ির অন্দর থেকে বেরিয়ে সদর দরজায় যাওয়ার পথটা দেখা যাচ্ছে, প্রতাপ সেইদিকে তাকিয়ে আকাশ—পাতাল ভেবে যাচ্ছে।
একসময় বাড়ির ভেতর থেকে দু’জন মহিলা বেরিয়ে সদর দরজার দিকে গেলেন। প্রতাপ শুনতে পেল—”খুব ভাল লাগল, কতদিন পরে এলে, আবার কিন্তু এসো।” দামি জরিপাড় হলুদ শাড়ি পরা মহিলা অন্দরের দিকে ফিরে যাচ্ছেন, প্রতাপের মনে হল ইনি এ—বাড়ির গিন্নি, দিলুর মা। সে লাফ দিয়ে ঘরের বাইরে এসে বলল, ”আপনি কি দিলুর মা?’
মল্লিকা ঘুরে অবাক হয়ে বললেন, ”হ্যাঁ, আপনি?”
নমস্কার করেই প্রতাপ তাড়াতাড়ি বলল, ”আমি দুধঘাট থেকে আসছি, হরিসাধনবাবু, পঞ্চাননবাবু আমাকে ভালই চেনেন। আমি আপনার কাছে একটা আর্জি নিয়ে এসেছি দিলুর সম্পর্কে।” এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলার পরই তার মনে পড়ল নিজের পরিচয়টা দেওয়া হয়নি। ”আমার নাম প্রতাপ লাহিড়ি, আমি দুধঘাট স্কুলের মাঠে ক্রিকেট কোচিং করি।”
মল্লিকাকে কৌতূহলী দেখাল, ”দিলুর সম্পর্কে কী বলবেন?”
”আপনার ছেলে অসাধারণ প্রতিভাবান। ওর মতো ফিল্ডার পৃথিবীতে এখন আছে কিনা আমার জানা নেই।” প্রতাপের স্বর গদগদ পর্যায়ে পৌঁছল। ”ওকে আমাদের ক্লাবে খেলাতে চাই।”
”আপনি ঘরে এসে কথা বলুন।”
তরুণের চেম্বারের পাশের ঘরের দরজা খুলে ধরল মল্লিকা। কার্পেটে—সোফায় সাজানো বসার ঘর। দু’জনে মুখোমুখি বসল।
”আর্জিটা কী?” মল্লিকা সোজাসুজি কথা পাড়লেন।
”দিলুর ক্রিকেট ভবিষ্যতের কথা ভেবে বলছি ওকে এখানে না রেখে মামার বাড়িতে রাখুন। ওখানে খেলার ব্যবস্থা আর সুযোগ কলকাতার চেয়ে অনেক ভাল।”
”আমি আর দিলুর বাবা চাই আমার দাদা, জ্যাঠামশাইয়ের কাছে দিলু থাকুক, তবে শুধুই লেখাপড়ার জন্য, খেলার জন্য নয়। ওখানে গিয়েও যদি এখানকার মতো দিনরাত খেলা—খেলা করে তা হলে যাওয়ার কোনও মানেই হয় না। লেখাপড়ায় দিলু ভাল নয়, আর দুধঘাট স্কুলের সুনামের কথা আমরা জানি। দাদাও চান ওকে লেখাপড়া শেখার জন্য ভর্তি করে নিতে। হয়তো দিলু পৃথিবীর সেরা ফিল্ডার, জানি না কী দেখে পৃথিবীর সেরা বলে দিলেন, তবু মুখ্যু সেরা—ফিল্ডারের বাবা—মা হতে আমরা চাই না, ধরে নিতে পারেন এটা ওর বাবারও কথা। এবার আপনি আসতে পারেন।” মল্লিকা উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার জানালেন। ওঁর দৃঢ় স্বর আর কঠিন ভঙ্গি প্রতাপকে আর কথা বাড়াতে সাহস জোগাল না।
কিন্তু প্রতাপ নাছোড়বান্দা। তার ধারণা, সে একটা বিরাট উপহার ভারতকে দিতে পারবে, দিলুর অবিশ্বাস্য ফিল্ডিং প্রতিভাকে তুলে ধরে। বাবা—মায়ের আপত্তিকে যেভাবেই হোক পাশ কাটিয়ে দিলুকে ময়দানে নামাবে এই প্রতিজ্ঞা করে প্রতাপ পরদিনই দেখা করল পঞ্চাননের সঙ্গে।
বিকেলে দোতলার বারান্দায় বসে দু’জনে যখন কথা বলছিল দিলু তখন স্কুলের মাঠে ফিল্ডিং অনুশীলন করায় ব্যস্ত।
”মলু বলল, মুখ্যু সেরা—ফিল্ডারের মা—বাবা তারা হতে চায় না, তা হলে কী হতে চায় সেটা কি বলেছে?” পঞ্চানন শীতল দৃষ্টিতে প্রতাপের দিকে তাকালেন।
”না, সেটা স্পষ্ট করে বলেননি, তবে বলেছেন, শুধুই লেখাপড়া করুক এটাই তিনি চান, আর সেজন্যই ওকে এখানে রাখতে রাজি।”
”লেখাপড়া বলতে আমরা যা বুঝি তা হল একটা ভাল চাকরি পাওয়া, নয়তো কোনও পেশায় যাওয়া। লক্ষ্যটা টাকা রোজগার, এর বাইরেও অবশ্য কেউ কেউ ব্যবসা—বাণিজ্য করে। কিন্তু লেখক হয়ে, গান গেয়ে, সেতার কি তবলা বাজিয়ে, ছবি এঁকে, মূর্তি গড়ে এমনকী খেলাধুলো করেও যে প্রচুর টাকা, নাম যশ খ্যাতি অর্জন করা যায়, এটা আর বাবা—মায়ের মাথায় ঢোকে না। এইসব লোকেদের কিন্তু আমাদের খুব দরকার। দিলুর মতো ছেলেদের তো এগিয়ে দিতে হবে, ওরা যা হয়ে উঠতে চায় তাই হয়ে উঠুক। দেখো বাবা, আমি কিন্তু মলুর চিন্তার সঙ্গে একমত নই। আমি পুরনো ধারার মানুষ কিন্তু মলু তো দেখছি একেবারে মান্ধাতার আমলে পড়ে রয়েছে, কী যে লেখাপড়া শিখল!” পঞ্চানন মাথা নামিয়ে আক্ষেপে নাড়লেন।
”তা হলে?” প্রতাপ ঝুঁকে আশার আলো দেখতে পাওয়ার মতো চোখে তাকিয়ে রইল।
”তা হলে আর কী!” পঞ্চাননের স্বর বদলে গেল, কঠিন ভঙ্গিতে সোজা হয়ে বসলেন, ”দিলু যদি এখানে থাকে তা হলে আমার ইচ্ছানুযায়ী তাকে পড়াব, শেখাব। এটা ওর বাবা—মাকে মানতে হবে।”
”তা হলে দিলুর খেলা বন্ধ হচ্ছে না।” প্রতাপ নিশ্চিত স্বরে বলল।
পঞ্চানন জবাব না দিয়ে মুখ ফিরিয়ে পুকুরের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
চারদিন পর রবিবার দুপুরে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য হরিসাধন দিলুকে নিয়ে বাইগাছি স্টেশনে সাইকেল ভ্যানরিকশা থেকে নামলেন। নেমেই দিলু বলল, ”বোকামামা, তোমার বিশ্ববিখ্যাত জিনিসটা আর একবার চেখে দেখতে ইচ্ছে করছে।”
দারুণ খুশি হলেন হরিসাধন, ”নিশ্চয় হবে। তার আগে পদসেবা, এই হাওয়াই চটি পরে বাড়িতে গেলে তোর মা বলবে দাদাটা কিপ্টে হয়ে গেছে, একজোড়া ভাল চটিও ভাগ্নেকে কিনে দিলে না। আগে চটি, তারপর ছানার জিলিপি।”
দু’জনে পদসেবায় ঢুকল। সেই সেলসম্যানটি একা দোকানে বসে, ওদের দেখেই চিনতে পেরে হেসে বলল, ”বুড়ো আঙুলের নখটা ঠিক হয়ে গেছে?”
হরিসাধন বললেন, ”এখন একদম নতুন নখ। এবার বের করো তো সেই চটি জোড়া, প্রথম যেটা দেখিয়েছিলে।”
ছেলেটি বাক্স আনল। দিলু চটি পরে হাঁটল। হরিসাধন দেড়শো টাকা গুনে দিয়ে বললেন, ”হাওয়াইটা বাক্সে ভরে নে।”
এর পর তারা এল যশোহর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে। যে টেবিলটায় ওরা বসে ছিল সেটাতেই বসল। একটা ছেলে টেবলে এসে দাঁড়াল। হরিসাধন জিজ্ঞেস করলেন, ”ক’টা বলব?” দিলু আঙুল দিয়ে ‘ভি’ দেখাল, ”হরিসাধন ছেলেটিকে বললেন, ”দুটো করে দাও।”
দিলু মোট তিনবার ‘ভি’ দেখায়। বোনের জন্য কুড়িটা ছানার জিলিপি দড়িবাঁধা হাঁড়িতে হাতে ঝুলিয়ে হরিসাধন টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াবার দশ মিনিটের মধ্যেই ট্রেন এসে গেল।
ট্রেনে হরিসাধন একবার জিজ্ঞেস করলেন, ”দিলু, আবার কবে আসবি?”
”শিগগিরই আসব, তবে এবার আসব থাকার জন্য। নীচের ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গে বসা আমার দ্বারা হবে না।” এই বলে সে পায়ের পাতা উঁচু করে নতুন চটি ঘুরিয়ে—ফিরিয়ে দেখতে লাগল।
.
হরিসাধনের সামনে গরম ফুলকো লুচি আর বেগুনভাজার প্লেট টেবলে রেখে মল্লিকা বললেন, ”বোকাদা একটা লোক এসেছিল, নাম বলল প্রতাপ লাহিড়ি, চেনো নাকি?”
”চিনি।” আহার্য বিষয় সামনে থাকলে হরিসাধনের কথাবার্তা সংক্ষিপ্ত হয়ে যায়।
”কী করে বলো তো? এই ক’দিন আগে হঠাৎ এসে বলল, দিলুকে মামার বাড়িতে রেখে পড়ান। আমি তো অবাক, গায়ে পড়ে পরামর্শ দিতে এসেছে, ব্যাপার কী! বলল, তোমার স্কুলে নাকি খেলার ব্যবস্থা খুব ভাল, দিলুর মতো ফিল্ডার এখন পৃথিবীতে নেই, এইসব হাবিজাবি আমাকে বোঝাতে চাইছিল। আমি পরিষ্কার বলে দিয়েছি আগে পড়া, তারপর খেলা। দুধঘাটে যদি যায় তো লেখাপড়াই করতে যাবে, খেলতে নয়।”
”প্রতাপ এইসব বলেছে নাকি?”
”বলেছে ওর ক্লাবে দিলুকে খেলাবে। স্কুলে পড়া ছেলে ক্লাস না করে মাঠে গিয়ে খেলবে?”
”দূর দূর, যেতে দেবই না।” বেগুনভাজা লুচি দিয়ে মুড়তে মুড়তে হরিসাধন উত্তর দিয়ে মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। মলুকে প্রতাপ কী বলেছে তা তিনি জানেন না। কিন্তু এটা বুঝে গেছেন প্রতাপের কথায় মলু বিগড়ে গেছে। ওকে খুশি করা দরকার।
”দারুণ লুচি, তোর করা?”
”নয় তো কে করবে, রাঁধুনি তো আসবে সন্ধেবেলায়।”
”আরও দুটো দে।” হরিসাধন আড়চোখে বোনের মুখটা দেখে নিলেন। কাজ হয়েছে।
মল্লিকা গোটাছয়েক লুচি আর গরম বেগুনভাজা নিয়ে এল। ততক্ষণে হরিসাধন কী বলবেন ভেবে নিয়েছেন। তিনি জানেন মল্লিকা স্কুলের এখনকার অবস্থা দেখেনি।
”মলু আমি ভাবছি স্কুলের মাঠটায় গোলাপ চাষ করব। স্কুলের বেঞ্চিগুলো ভেঙে ঝরঝর করছে। গভর্নমেন্ট টাকা দিতে পারে না। সারাবার খরচ তোলা যাবে গোলাপ ফুল বেচে। আগে খেলা না আগে ক্লাসে বসে পড়া?”
”আগে পড়া তো বটেই। তোমার স্কুলের অত ভাল রেজাল্ট, ভাল করে বসে পড়া না শুনলে রেজাল্ট কি ভাল থাকবে! তুমি খেলার মাঠ তুলে দিয়ে গোলাপ চাষই করো।”
”তুই তা হলে দিলুকে পাঠিয়েই দে।” বেগুন ভাজা ঠাণ্ডা হয়েছে কিনা আঙুল ছুঁইয়ে দেখে হরিসাধন কাজ শুরু করে দিলেন।
”কিন্তু দাদা, প্রতাপ যে বলল—”
”ও কিছু নয় কিছু নয়, ভাগিয়ে দোব। ক্লাবে খেলবে কী এইটুকু ছেলে!”
মল্লিকা প্লেটে চারটে সন্দেশ আনলেন।
”পারব না রে পারব না, ছ’টা ছানার জিলিপি খেয়ে ট্রেনে উঠেছি। হরিসাধন কাতর চোখে তাকালেন। পরেরবার এসে খাব। তরুণ কখন ফিরবে?”
”দশটার আগে তো নয়ই, তাসের আড্ডায় বসলে ওর বাড়ির কথা মনে থাকে না। পরশু দিলুর রেজাল্ট বেরোবে, কী হবে সে তো সবার জানাই আছে। বংশে এই প্রথম একটা মুখ্যু ছেলে হল, মুখ দেখানো দায় হবে।”
খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে হরিসাধন বললেন, ”চলি রে।”
”সামনের রোববারই ওকে দুধঘাটে পৌঁছে দিয়ে আসব।”
সবার যা জানা, দিলু সেটাকে অজানা হতে না দিয়ে পরীক্ষায় ফেল করল। একটা বড় সুটকেস এবং দিলুকে সঙ্গে নিয়ে পরের রবিবার সকালে মল্লিকা মোটরে রওনা হলেন দুধঘাটের উদ্দেশ্যে। তাসের আড্ডা ফেলে তাঁর স্বামী সঙ্গে যেতে রাজি হননি। জাতীয় সড়ক থেকে পিচের সরু ভাঙাচোরা একটা রাস্তা চলে গেছে দুধঘাটের দিকে। সেই রাস্তার ওপরে দুধঘাট স্কুল। মল্লিকার নির্দেশমতো ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে যখন স্কুলবাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছে তখন স্কুলের মাঠে খেলার মেলা বসে গেছে। শিউরে উঠে মল্লিকা দেখলেন ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে একটি ছেলে বলটা আকাশের দিকে তুলে মারল। দুটো ছেলে ছুটল ক্যাচ ধরতে। মল্লিকা আড়চোখে পাশেবসা ছেলের দিকে তাকালেন, দিলু তখন অন্য জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে।
”জেঠু দিয়ে গেলুম তোমার ফেল—করা নাতিকে। ” প্রণাম করে মল্লিকার এটাই প্রথম কথা, ”এবার পাশ করিয়ে দাও দেখি।”
পঞ্চানন একগাল হেসে দিলুর দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে বললেন, ”এবার থেকে দু’বেলা শুধু পড়া, পড়া আর পড়া।”
”নিশ্চয়। বি—এ—টা পাশ না করলে লোকে বলবে কী! স্কুলের মাঠে দেখলুম খুউব খেলা চলছে, বোকাদা বলল গোলাপের চাষ করে বেঞ্চি সারাবার টাকা তুলবে ওই মাঠ থেকে। তুলুক, তুলুক।”
”আমাকেও বোকা বলেছে। আমি বললুম খুব ভাল কথা, টাকা তো আসবেই। তা ছাড়া সামনে গোলাপ বাগান থাকলে স্কুলটাও কত সুন্দর দেখাবে। বোকার মাথায় বুদ্ধি আছে।” পঞ্চানন মিটিমিটি হাসতে লাগলেন।
”নীচে যাই, বউদি তো রান্নাঘরে ঢুকল, কী রাঁধছে দেখি গিয়ে। বউদির এই এক বাতিক, কাউকে পেলেই ধরে বেঁধে খাওয়াবে।” মল্লিকা বলতে বলতে সিঁড়ির দিকে এগোলেন।
”পরশু নারকেল পাড়িয়েছি। যাওয়ার সময় চন্দ্রপুলি নিয়ে যাবি কিন্তু।”
মা সিঁড়ি দিয়ে অদৃশ্য হওয়ামাত্র দিলু উৎকণ্ঠিত স্বরে বলল, ”দাদু, স্কুলের মাঠে গোলাপের চাষ, কী ব্যাপার?”
মাছি তাড়াবার মতো নাকের সামনে হাত নেড়ে পঞ্চানন বললেন, ”রাখ তো গোলাপ, ধানচাষ হবে বলেনি এটাই স্কুলের ভাগ্যি।”
কথার অর্থ বুঝতে পেরে দিলুর মুখ নিঃশব্দ হাসিতে ভরে গেল। গেঞ্জিটা খুলে জিনসের প্যান্ট খুলল। জাঙিয়া পরা অবস্থায় সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছে তখন পঞ্চানন বললেন, ”যাচ্ছ কোথায়?”
”পুকুরে। মাকে দেখাব সাঁতরে ওপার পর্যন্ত যেতে পারি। আমাদের বাড়িতে কেউ সাঁতার জানে না, খুব অবাক হয়ে যাবে।”
”খবরদার নয়। সাঁতারও খেলার মধ্যে পড়ে। মা দেখলে এখুনি গাড়িতে তুলে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। সাঁতার টাতার সব কাল থেকে।”
সন্ত্রস্ত দিলু প্যান্ট পরে নিল চটপট।
”দাদু, বোকামামাও তা হলে মিথ্যে কথা বলে।”
”শুধু বোকামামা? যুধিষ্ঠির পর্যন্ত বলেছিলেন। বোকাকে তো একবার নরক দর্শন করতেই হবে।”
হরিসাধন ক্লাস এইটেই ভর্তি করালেন দিলুকে। ইচ্ছে করলে ক্লাস নাইনেও করাতে পারতেন। কিন্তু তা করালেন না একটা কারণে, আর সেটা শুধু বাবাকেই তিনি বলেছিলেন। ”দিলুর যা বিদ্যের বহর তাতে ওকে ক্লাস সিক্সে ভর্তি করালে ঠিক হত। ওর আত্মসম্মানে আঘাত লাগবে বলে সেটা আর করলুম না। কী করে যে এইট পর্যন্ত উঠল, ভেবে পাচ্ছি না। তবে ক্লাস নাইনে উঠতে হলে ওকে আদাজল খেয়ে প্রথম থেকেই লাগতে হবে, বাবা তুমি একটু কড়া হও।”
প্রথম দিন বাসু ক্লাস ঘরের বাইরে দিলুর জন্য অপেক্ষা করে থেকেছিল, ওকে সঙ্গে নিয়ে বাসু ক্লাসে ঢোকে, দু’জনে পাশাপাশি বসে। দিলুকে ইতিমধ্যেই অনেক ছেলে চিনে ফেলেছে তার অবিশ্বাস্য ফিল্ডিং ক্ষমতার গল্প শুনে। সে যে একদিন নামকরা ক্রিকেটার হবে এমন একটা ধারণা স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে চাউর হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। ফলে সবারই নজর তার ওপর। এটা তাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিল। শিক্ষকরা ক্লাসে তার প্রতি একটু বেশি মনোযোগী, কারণ দিলীপ হরিসাধনবাবুর ভাগ্নে, এটা তাকে বিপদে ফেলে দিয়েছে।
প্রতি সারই পড়াতে পড়াতে তার দিকে তাকিয়ে বলবেন, ”বুঝতে পেরেছ? না পারলে জিজ্ঞেস করো, বারবার করো যতক্ষণ না মাথায় ঢুকছে।” দিলু ঘাড় নেড়ে জানায় সে বুঝেছে। কিন্তু আসলে সে বিন্দুবিসর্গও বোঝেনি। আর সেটা বুঝতে পারে তার পাশে বসা বাসু। সে ফিসফিস করে দিলুকে বলে, ”ঘাড় নাড়লে যে কিছুই তো বোঝনি, সারকে জিজ্ঞেস করো।” জিজ্ঞেস করতে হলে বিষয়টি সম্পর্কে কিছুটা জানা থাকা চাই, তাও সে ভাল করে জানে না। কলকাতার স্কুলে তার এই ঝামেলা ছিল না। সাররা জানতেন তাকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। শুধুই সময় নষ্ট, তাই কেউ তার দিকে দৃকপাতও করতেন না।
অন্ধকার ঘরে পঞ্চাননের পাশে রাত্রে চিত হয়ে শুয়ে সে ফিসফিস করে বলল, ”দাদু জেগে আছ?”
”আছি, কিছু বলবে?”
”হ্যাঁ। আমার খুব অসুবিধে হচ্ছে স্কুলে। সারেরা যা পড়ান আমি বুঝতে পারি না।”
”কেন পারো না সেটা কি ভেবে দেখেছ?”
”হ্যাঁ। পড়ায় আমি মন দিতে পারি না। সবসময় শুনি আমার মাথা নেই মাথা নেই, আমার দ্বারা লেখা পড়া হবে না, আমি মুখ্যু হয়ে থাকব। আচ্ছা দাদা, কী করলে পড়াশুনোয় ভাল হওয়া যায়, তুমি জানো?”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পঞ্চানন বললেন, ”জানি।”
”জানো?” দিলু পাশ ফিরে দাদুর মুখোমুখি হল।
”বল ধরে উইকেটে ছোড়ার সময় গোটা মাঠটা চোখের নজরে থাকে না, শুধু তিনটে স্টাম্প নজরে থাকে?”
”শুধু তিনটে স্টাম্প ছাড়া আর কিছু দেখি না। অন্য কিছু তখন দেখতে গেলে বলটা এধার—ওধার হয়ে যাবে।”
”অর্জুন পাখির চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখেননি, গল্পটা তো জানো।”
”জানি।”
”রোজ যেমন ফিল্ডিং প্র্যাকটিস করো তেমন রোজ দু’বেলা পড়া নিয়ে বসবে আর বোলারের হাত থেকে বেরিয়ে আসা বলটা সারা মনপ্রাণ দিয়ে যেভাবে বুঝতে চেষ্টা করো ঠিক সেইভাবে পড়ায় মনপ্রাণ আটকে দেবে, বুঝতে চেষ্টা করবে পড়াটা, তা হলেই পারবে।”
”বলছ পারব?” বালিশ থেকে দিলুর মাথা উঠে গেল।
”নিশ্চয় পারবে। পড়াশুনো ব্যাপারটা একদমই শক্ত জিনিস নয়। বাসুকে দেখো না, যখন পড়ে কি লেখে তখন ওর কানের পাশে অ্যাটম বোমা ফাটলেও শুনতে পাবে না।”
”বাসু তো খেলে না, আমি কি খেলা বন্ধ করে দোব?”
”একদম নয়। বাসু একধরনের, তুমি আর—এক ধরনের। ওর মনের ডিসিপ্লিনটা তুমি লক্ষ করবে, ওটা তোমার খেলাতেও লাগবে। গল্প শুনেছি গাওস্করের এই ডিসিপ্লিনটা ছিল, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভুলে গিয়ে শুধু বলটাকেই দেখত। এই দেখাটাকে রোজ অভ্যাস করতে হয়, তুমি কখনও তা করোনি।”
দিলু চুপ করে রইল। পঞ্চানন আর কথা বাড়ালেন না, তিনি চাইলেন দিলু ভাবুক। লেখাপড়ায় পিছিয়ে থাকাটা ওর আত্মসম্মান বোধকে আঘাত করেছে, এটাই ভাল লক্ষণ।
পঞ্চানন ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন সূর্য ওঠার, সূর্যকে প্রণাম করে দিনের কাজ শুরু করেন। সেদিনও অন্ধকার থাকতে থাকতে উঠে বারান্দায় এলেন। রেলিং ধরে পুকুরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বাতাস এই সময় স্তব্ধ থাকে। পাখিদের ডাক ছাড়া প্রকৃতিতে কোনও সাড় নেই। নিজের মধ্যে মগ্ন হওয়ার এটাই ঠিক সময়। পঞ্চানন মগ্ন হয়ে গেলেন।
”দাদু।”
পঞ্চানন চমকে তাকালেন প্রায়ান্ধকার বারান্দার অপর প্রান্তে। চেয়ারে দিলু বসে, পঞ্চানন কাছে এলেন, ”দাদু তুমি! এখনও তো ভোর হয়নি।”
”শুধুই পাখির চোখ দেখার জন্য অর্জুন কী করেছিলেন সেটাই খুঁজছি। গাওস্কর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভুলে যায় কী করে সেটা আমায় জানতে হবে।”
”খোঁজে, জানো। এটা তোমাকে নিজে—নিজেই করতে হবে।” পঞ্চানন ঝুঁকে দিলুর কানের কাছে মুখ এনে বললেন, ”দাদু তুমি পারবে, তুমি আমার সেরা নাতি হবে।”
কয়েকদিন পর রবিবার সকালে মোটরবাইকে প্রতাপ এসে হাজির। দিলু তখন দোতলার বারান্দায় টেবলে বাসুর মুখোমুখি বসে ‘আধুনিক যুগ’ বিষয়ে ছোট ছোট দশটি প্রশ্নের উত্তর তৈরি করার জন্য ইতিহাসের বই পড়ে যাচ্ছে। বাসুকে লিখতে হচ্ছে রচনা। ক্লাসে বাংলার সার যেসব পয়েন্ট বলে দিয়েছেন খাতা থেকে সেগুলো দেখে সে ‘সংবাদপত্রের প্রয়োজনীয়তা’ সম্পর্কে লিখছে। পঞ্চানন একতলায় ছেলের বসার ঘরে তাকে খোঁজাখুজি করছেন বই। মোটরবাইকের শব্দ শুনে বেরিয়ে এলেন।
”মেসোমশাই দিলু আজ প্র্যাকটিসে যায়নি, কী ব্যাপার?”
”স্কুলে টাস্ক দিয়েছে তাই করছে।”
”ওকে একবার কলকাতা যেতে হবে সি এ বি—তে নামটা রেজেস্ট্রি করাতে, আমিই নিয়ে যাব।”
”কবে?”
”কাল কি পরশু।”
”প্রতাপ একটা কথা মনে রেখো, ওর বাবা—মা কিন্তু খেলার ঘোর বিরোধী। যদি জানতে পারে কলকাতার মাঠে খেলছে তা হলে আমাদের মুখ আর দর্শন করবে না মলু। আমি এই নিয়ে খুবই চিন্তার মধ্যে আছি।”
শুনে প্রতাপও চিন্তায় পড়ে গেল। সে বলল, ”তা হলে কি আপনি পিছিয়ে যাচ্ছেন? দিলুকে কি কলকাতায় খেলতে দেবেন না?”
”না, না, তা বলছি না। তবে এমন একটা কিছু ভাবো যাতে ওর বাড়ির লোকেরা যেন জানতে না পারে। পড়া নিয়ে এখন ও খুব খাটছে, মোটামুটি ধরে ফেলেছে। এখন ওর মানসিক উৎসাহটা চাই আর সেটা পাবে ওর সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা থেকে।”
”তা হলে তো ওকে মাঠে যেতে হবে।”
পঞ্চানন শঙ্কিত স্বরে বললেন, ”হবে, কিন্তু লুকিয়ে। যদি দিলু চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে, আমার ধারণা করবেই, তা হলে তো খবরের কাগজ ঝাঁপিয়ে পড়বে।”
”নিশ্চিত থাকুন মেসোমশাই, ময়দানে আমাদের খেলায় কোনও রিপোর্টার আসে না, সাধারণ পাবলিক তো আসেই না। প্লেয়ারদের আত্মীয় কি বন্ধুবান্ধব দু—চারজন হয়তো খেলা দেখে, আমরা তো মোহনবাগান—ইস্টবেঙ্গল নই। খবরের কাগজ দিলুর কথা জানবেই না।” প্রতাপকে নিশ্চিন্ত দেখাল।
পঞ্চানন অবাক হয়ে বললেন, ”বলছ কী, খবরের কাগজে না বেরোলে দিলুর ট্যালেন্টের কথা দেশের লোক জানবে কী করে? ওটাই তো আসল ব্যাপার। দিলুকে তো বাংলার ক্রিকেট কর্তাদের চোখে পড়তে হবে, নইলে ও উঠবে কী করে?”
”এ তো মহা সমস্যায় পড়া গেল। কাগজে নাম বেরোনো চাই অথচ বাড়ির লোক জানবে না, তা কী করে হয় মেসোমশাই। বাড়ির লোকেরা মুখ্যু তো নয়, খবরের কাগজ পড়বেই, খেলা পছন্দ করে না বলে হয়তো খেলার পাতা পড়বে না কিন্তু পাড়ার লোকজন কি বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে শুনে ফেলতে তো পারে।”
”তা তো পারেই, আর তা হলেই সর্বনাশটা হয়ে যাবে। তুমি এ বছরটা বাদ দাও প্রতাপ, পড়াশুনোয় একটু ভাল রেজাল্ট করলে ওর বাপ—মাকে তখন বুঝিয়ে সুঝিয়ে নরম করতে পারব।”
প্রতাপ হতাশ হয়ে বলল, ”একটা বছর নষ্ট হবে। ভেবেছিলুম পনেরো বছরেই ওকে ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলাব।”
”অত কম বয়সে এদেশে কেউ খেলেছে নাকি?” পঞ্চানন কৌতূহলী হয়ে উঠলেন।
”বলেন কী? পাঞ্জাবের ধ্রুব পাণ্ডভ! কী ট্যালেন্টেড ব্যাটসম্যান যে ছিল। দিল্লি থেকে ট্যাক্সিতে পাটিয়ালায় বাড়ি ফেরার পথে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেল এই তো ক’বছর আগে বিরানব্বুই সালে। ছেলেটা তো পনেরো বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই রঞ্জি ট্রফিতে সেঞ্চুরি করেছিল।”
”আমি তো জানতুম শচীন টেন্ডুলকর সবচেয়ে বাচ্চচা বয়সে রঞ্জি ট্রফিতে সেঞ্চুরি করে।”
”না মেসোমশাই, ধ্রুব পাণ্ডভ মারা না গেলে ওর কথাই মনে রাখতেন, শচীন সেঞ্চুরি করে সাড়ে পনেরো বছর বয়সে। পাণ্ডভের আর একটা রেকর্ড, সবচেয়ে কম বয়সে এক মরশুমে হাজার রান ও—ই করেছে আঠারো বছর তখনও পূর্ণ হয়নি। রেকর্ড ছিল শচীনেরই। লক্ষ করে দেখবেন যারা বড় হয় তারা মাথাচাড়া দেয় পনেরো ষোলো সতেরো বছর বয়সেই। দিলুর কিন্তু এক্সপোজারটা এখনই হওয়া দরকার। পুজোর পরই নেট পড়বে তখন নজর দিতে হবে ওর ব্যাটিংয়ে। অন্তত চল্লিশ—পঞ্চাশটা রান করার মতো না হলে শুধু ফিল্ডিং দিয়ে কতটা আর এগোবে।”
”তুমি কি এই সিজনেই দিলুকে মাঠে নামাতে চাও?”
”পারলে তাই নামাব, কিন্তু যে বাধার কথা বললেন তাতে তো হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। কী যে মুশকিল হল!” প্রতাপের গলা নেতিয়ে পড়ল।
”দেখি একটু ভেবে, তুমি বিকেল পর্যন্ত আছ তো, একবার ঘুরে যেও।”
প্রতাপ চলে যাওয়ার পর পঞ্চানন দোতলায় এলেন। দিলু টেবলে ঘাড় নিচু করে লিখে চলেছে, বাসুও লেখায় ব্যস্ত। ওরা মুখ তুলে তাকাল না। পঞ্চানন রেলিং ধরে পুকুরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনে মনে ভেবে যাচ্ছেন দিলুর খেলার জন্য কী করতে পারেন।
”এভাবে দাঁড়িয়ে কী ভাবছ দাদু?”
দিলুর প্রশ্নে চমকে উঠে পঞ্চানন ফিরে তাকালেন। বই খাতা বন্ধ করে দিলু উঠে দাঁড়াল। বাসুও লেখা বন্ধ করল।
”হয়ে গেছে তোমাদের?”
বাসু ঘাড় নাড়ল। পঞ্চানন বললেন, ”বিকেলে খাতা দেখে দোব, এখন থাক।”
”মনে হচ্ছে আপনি খুব চিন্তায় পড়ে গেছেন।” ভ্রূ কুঁচকে বাসু বলল।
”তা একটু পড়ে গেছি।” এই বলে পঞ্চানন প্রতাপের সঙ্গে তাঁর যা কথাবার্তা হয়েছে ওদের বললেন। শুনে দিলুর মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। বাসু চুপ করে রইল।
একতলা থেকে হর্ষর গলা শোনা গেল ”অ দিলু—বাসু তোরা নাইতে যাবি না?” রবিবার দুপুরে বাসু এই বাড়িতে ভাত খায়। ওরা গামছা নিয়ে তেল মাখতে মাখতে পুকুরঘাটের দিকে যাচ্ছে, হঠাৎ বাসু দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ”দিলু একটা কাজ করলে হয় না, তোমার নামটা যদি বদলে দেওয়া যায়?”
অবাক হয়ে দিলু তাকিয়ে রইল, ”সে কী! নাম বদলাব?”
”হ্যাঁ বদলাবে। তা হলে কাগজে নাম বেরোলেও বাড়ির কেউ ধরতে পারবে না।”
”য্যাহহ, এভাবে কি খেলা যায়! খেলবে একজন আর নাম হবে আর একজনের।”
”নামটা শুধু বদলে নেওয়া, তাতে অসুবিধের কী আছে। কত লোকই তো ছদ্মনাম নেয়। এই তো যে অভিধানটা দাদুর ঘরে রয়েছে, চলন্তিকা, ওটা লিখেছেন রাজশেখর বসু, আবার উনিই গল্প লিখেছেন পরশুরাম নামে। দুটো নাম নেওয়া অনেক লোকই আছে তুমিও নয় থাকবে, তাতে অসুবিধে কী, বরং সুবিধের কথাটা ভাবো।”
বাসুর কথায় দিলু দ্বিধায় পড়ে গেল। মন থেকে বাসুর যুক্তি সে মানতে পারছে না, আবার খেলার সুযোগ তৈরি করার জন্য এই চালাকিটাও তার মন্দ লাগছে না। তাকে দোনামনার মধ্যে থাকতে দেখে বাসু বলল, ”আসল ব্যাপার তো ধরা না পড়ে খেলে যাওয়া, তুমি তো চুরি—ডাকাতি করার জন্য নাম বদলাচ্ছ না, বদলাচ্ছ একটা ভাল উদ্দেশ্যেই। যখন নাম হয়ে যাবে, দেখবে তোমার বাবা—মা কিছু বলবেন না। বরং গর্ব করে বললেন, দিলু আমাদের ছেলে, আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে।”
বাসুর কথা শুনতে শুনতে চকচক করে উঠল দিলুর চোখ। সে মনের চোখে নিজেকে দেখতে পেল ইডেনের মাঠ থেকে ক্লাব হাউসের ড্রেসিংরুমে ফিরছে, হাততালি দিতে দিতে পেছনে আসছে শচীন, সৌরভ, রাহুল। লোকে দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি দিচ্ছে, দিলু, দিলু নাম ধরে সারা স্টেডিয়াম থেকে চিৎকার ভেসে আসছে, ততদিনে লোকে অবশ্য জেনে গেছে তার আসল নামটা। নকল থেকে আসল নামে ফেরাটা কী আর এমন শক্ত ব্যাপার!
”দিলু, মানুষ বাঁচার জন্য অনেক সময় অন্য নাম নেয়, তোমার খেলাকে বাঁচাবার জন্য একটা কোনও নাম নিলে তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।” কথাটা বলেই বাসুর কী যেন মনে পড়ে গেল, বলল, ”জানো তো পাণ্ডবরাও অজ্ঞাতবাসের সময় বিরাটরাজের বাড়িতে এক—একজন ছদ্মনাম নিয়ে থেকেছিলেন। ওরা নিতে পারলে তুমিই বা পারবে না কেন?”
”ঠিক আছে, নোব।” বলেই দিলু দু’হাত বাড়িয়ে জলে ঝাঁপ দিয়ে হাত পাড়ি দিতে শুরু করল।
বিকেলে প্রতাপ এল। পঞ্চানন বারান্দা থেকে তাকে দোতলায় উঠে আসতে বললেন।
”ভেবে দেখলেন?” প্রতাপ দোতলায় উঠেই বলল।
”দেখেছি। তবে আমি নয়, বাসু।” পঞ্চানন হাসিমুখে বললেন। বাসু খেয়েদেয়ে দুপুরেই ছোট হুড়ায় ফিরে গেছে। ”ছেলেটার সত্যিই মাথা আছে।”
পঞ্চাননের মুখ দেখে প্রতাপ আশান্বিত হল। ”ব্যাপার কী বলুন তো! মনে হচ্ছে রাস্তা বের করে ফেলেছেন।”
”দিলুর নামটা বদলাতে হবে। কাগজে নাম বেরোলেও বাড়ির লোক ধরতে পারবে না। শুধু দেখতে হবে ছবি যেন না বেরোয়।”
প্রতাপ চোখ বুজে রইল কয়েক সেকেন্ড। চোখ খুলল বিশাল একটা হাসি মুখে মাখিয়ে। ”ছবি নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না মেসোমশাই। লোকাল ক্রিকেটের ছবি খবরের কাগজে কখনও বেরোয় না।”
.
উত্তরপল্লী সঙ্ঘ বরানগরের ক্লাব, সেখানে একটা ছোট মাঠে তাদের নেট প্র্যাকটিস হয়। দিলু প্র্যাকটিস করে দুধঘাট স্কুলের মাঠে। প্রতিদিন স্কুল ছুটির পরই মাঠে নেমে পড়ে ফিল্ডিং ঝালিয়ে নিতে। তারপর নেটে ব্যাটিং।
”ও কী ও কী, ড্রাইভ করলে কিন্তু বলটা উঠে গেল কেন? শর্ট একস্ট্রা কভার তো বুকের কাছে ক্যাচটা পেয়ে যাবে। আগের বলটাতেও দেখলাম এই ব্যাপার হল, লং অফে পল্লব ক্যাচটা নিল। অল অ্যালং দ্য কার্পেট বল যাবে এমনভাবে ড্রাইভ করো। মারার সময় মুখ উঠে যাচ্ছে, বডি থেকে ব্যাট দূরে থাকছে। পিচের কাছে পা পৌঁছচ্ছে না বলে।”
দিলু মুখ নামিয়ে প্রতাপের কথাগুলো শুনল। ব্যাট হাতে ক্রিজে আবার স্টান্স নিয়ে বলল, ”ঠিক আছে।” মনে মনে স্মরণ করল প্রতাপদার কথাগুলো: মাথা নড়বে না, স্থির রাখবে, সামনের পা বলের পিচের কাছে নিয়ে যাবে, মাথা একটু নামাবে। এর পর যদি শট কভারে দিকে মারতে চাও তা হলে বাঁ কাঁধটা সেই মুখো করে শরীরের ভর সামনের পায়ে আনবে। ফলো থ্রুটা হবে সোজা যেদিকে বল মেরেছ।
বোলার বল করল শর্ট পিচ অফ স্টাপের এক হাত বাইরে। দিলু স্কোয়ার কাট করতে গিয়ে ফসকাল।
”কেন ফসকালে? এমন বলেই তো ব্যাটসম্যানের আহ্লাদ হয়। তুমি পা একদম না নড়িয়ে একই জায়গায় রেখে ব্যাটটা চালিয়েছে। এই দ্যাখো।” এই বলে প্রতাপ দিলুর হাত থেকে ব্যাটটা নিয়ে দেখাল সে কীভাবে ব্যাট চালিয়েছিল। তারপর দেখাল শটটা নেওয়ার সময় ডান পা কোথায় নিয়ে যাবে। ”টিভিতে দেখো টেন্ডুলকর কীভাবে মারে।”
দিলু আবার স্টান্স নিয়ে দাঁড়াল, এবারের বলটা মন দিয়ে লক্ষ করে বুঝল হাফভলি আসছে সোজা তার সামনে। ছয় মারবে কি? মুহূর্তে বিচার বদলে ফেলে সে প্রতাপদার কথামতো ড্রাইভ করল। ঘাসের ডগা ঘষড়ে বিদ্যুৎগতিতে বোলারের বাড়ানো ডান হাতের পাশ দিয়ে বল বেরিয়ে গেল। প্রতাপ হাততালি দিয়ে বলল, ”দ্যাটস ইট।”
আরও কয়েকটা ড্রাইভ করল দিলু, বল উঠল না জমি থেকে। প্রতাপ বলল, ”অনেক তো শট নিলে, ক্রিকেটে শট না নেওয়ারও খেলা দরকার পড়লে খেলতে হয়। এবার তুমি দশটা বল ডিফেন্স করো। এগিয়ে বা পিছিয়ে এমনভাবে বল থামাও যেন ব্যাট লেগে বল সেখানেই পড়ে গাছ থেকে খসে পড়া আপেলের মতো।”
প্রতাপ তিনটি ছেলেকে দিলুর দু’পাশে তিন মিটার দূরে দাঁড় করিয়ে দু’জন অফ স্পিনারকে বল করতে দিল। প্রথম বলটা অফ থেকে একটা ঘুরে এল যে, দিলু একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ব্যাট সামনে বাড়িয়ে দিল। ব্যাটে লেগে বল শর্ট লেগের হাতে গেল। সে ফ্যালফ্যাল চোখে প্রতাপের দিকে তাকিয়ে রইল।
”ফুটওয়ার্ক কোথায়? যেখানে পিচ পড়ল পা বাড়িয়ে সেখানেই তো বলটা ব্যাট দিয়ে থাবড়ে দিতে পারতে। আবার বলছি ফুটওয়ার্ক ছাড়া ব্যাট করা যায় না। এতকাল শুধু ছয় মেরে গেছ এটা ব্যাটিং নয়, এবার ব্যাট করাটা শেখো।”
দিলু দশটা বল খেলল তাতে দু’বার ব্যাটের কানায় লাগল, দু’ বার লাগল প্যাডে, একটা ফসকাল, বাকিগুলো ঠিকঠাক আটকাল। বাসু নেটের বাইরে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছিল। দিলু যখন পরের ব্যাটসম্যানকে দেওয়ার জন্য প্যাড খুলছে বাসু ডাকল, ”দুলু।” দিলু তখন মুখ নামিয়ে একহাঁটু মুড়ে অন্য প্যাড খোলায় ব্যস্ত, বাসুর দিকে তাকাল না। বাসু এবার একটু জোরে ডাকল, ”অ্যাই দুলাল।” দিলু মুখ তুলে তাকিয়ে কপালে কুঁচকে বলল, ”আমাকে বলছ?” তারপর হো হো করে হেসে উঠল। ”তাই তো ভুলেই গেছলুম আমি দুলাল কর।”
ভবানীপুর মাঠে উত্তরপল্লীর প্রথম লিগ খেলা ইয়াং ফ্রেন্ডসের সঙ্গে। উত্তরপল্লীর ক্যাপ্টেন সনৎ দত্ত যে প্লেয়ার্স লিস্ট আম্পায়ারকে দিলে তাতে এগারো নম্বরে লেখা ডি কর। নতুন ছেলে, বয়স কম, কারও সঙ্গে কথা বলছে না, টেন্টের বাইরে একা চুপচাপ। শুধু প্রতাপ লাহিড়ি ওর সঙ্গে বার দুয়েক কথা বলে সনৎকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ”সনৎ একে একটু দেখিস, ময়দানে প্রথম ম্যাচ খেলতে নামছে।”
সনৎ স্মিত হেসে দিলুর কাঁধ ধরে ছোট্ট একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ”নার্ভাস লাগছে?”
দিলু মাথা নেড়ে বলল, ”না।”
”আগে কোন ক্লাবে খেলেছ?”
”বিজয়ী সঙ্ঘ।”
সনৎ চোখ কুঁচকে প্রতাপের দিকে তাকাল। প্রতাপ তাড়াতাড়ি বলল, ”মৌলালির অ্যালবার্ট স্কোয়্যারের ক্লাব, খুবই ছোট ক্লাব।”
সনতের খেলোয়াড়—জীবনে এটাই প্রথম ঘটনা তার দলের এগারোজনের সবাইকেই সে চেনে না। এগারো নম্বরের ডি কর ব্যাট করে না বল করে তাইই সে জানে না। গতরাতে সেক্রেটারি প্রতাপ লাহিড়ি বাড়িতে ফোন করে বলেছিল, ”সনৎ একটা নতুন ছেলেকে কাল খেলাব। স্কুলে পড়ে। দেখা যাক টিকতে পারে কি না, পারলে মনে হয় অনেকদূর যাবে, একটু গাইড করিস।”
নতুন ছেলে সম্পর্কে সনৎ তখন কিছু জিজ্ঞেস করেনি। এরকম নতুন ছেলে প্রতিবছরই দু—তিনজন আসে, একটা দুটো ম্যাচ খেলিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়, এই ছেলেটাও হয়তো সেই রকম একটা দুটো ম্যাচের জন্য এসেছে। প্লেয়াস লিস্টে নামগুলো লিখে দিয়েছে প্রতাপ। ডি কর নামটা এগারো নম্বরে। দেখেই সনৎ ধরে নেয় বোলার।
”কী বল করো?” সনৎ জিজ্ঞেস করল। দিলু তাকাল প্রতাপের দিকে।
”দুলাল বোলার নয়।” প্রতাপ স্বর নামিয়ে বলল। সনৎকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে দেখে সে যোগ করল, ”সাত নম্বরে ব্যাট করবে।”
টস হল। জিতেছে ইয়াং ফ্রেন্ডস, তারা প্রথম ব্যাট করবে। মাঠে নামল সনতের সঙ্গে দশজন। ধর্মতলায় মাঠটা শহিদ মিনারের ধারেই বাসস্ট্যান্ডের লাগোয়া, আশেপাশে খাবারের দোকান, লোকজনের ভিড় লেগেই আছে। মাঠের আউটফিল্ডের বহু জায়গায় ঘাস নেই, যেখানে আছে ঘাস সেখানে বড় বড়। জমি অসমান, কাগজ, ফলের খোসা, ভাঁড়ের টুকরো, শালপাতা ইতস্তত ছড়িয়ে। দুধঘাটের মাঠ পলকের জন্য দিলুর চোখে ভেসে উঠল আর তখনই সনৎ তাকে আঙুল দিয়ে লং লেগের দিকটা দেখিয়ে বলল, ”ওখানে।”
যে ওপেন করল সে প্রথম তিনটি বল অফস্টাম্পের অনেকটা বাইরে দেখে ছেড়ে দিল। চতুর্থ বল মিড অফে ঠেলে দিয়ে একটা রান নিল। এবার বল পড়ল শর্ট পিচ, ব্যাটসম্যান সপাটে ঘুরিয়ে বাট চালাল। দিলু দেখল বল তার দিকেই আসছে। ফিল্ড করার সময় বলের জন্য সে অপেক্ষা করে না, তা করলে ব্যাটসম্যান রান নেওয়ার সময় পেয়ে যায়। তাই সে বলের দিকে ছুটে গিয়ে সময় কমিয়ে দেয়। এখনও সে তাই করল। বলটা ডান হাতে কুড়িয়েই ছুড়বে বলে সে নিচু হয়েছে আর তখনই অপ্রত্যাশিত জমির একটা উঁচু জায়গায় ঠোক্কর খেয়ে বলটা লাফিয়ে তার নাক আর কপালের মাঝে লাগল।
রক্ত ঝরছে তার নাক দিয়ে। রুমাল চেপে তাকে টেন্টে আনা হল। নাক ফুলে উঠেছে, সামান্য একটু কেটেছে। ”প্রথম ম্যাচে প্রথমবার বল ধরতে গিয়েই এমন অমুঙ্গুলে কাণ্ড!” প্রতাপকে বিচলিত দেখাল।
ডাক্তার খোঁজা হল, পাওয়া গেল না। ডেটল দিয়ে ধুয়ে প্লাস্টার লাগিয়ে দিলুকে একটা চেয়ারে বসিয়ে রাখা হল। একজন বরফ আনতে ছুটল। এক ঘণ্টা খেলার পর জলপান বিরতি। ইয়ং ফ্রেন্ডসের তখন বিনা উইকেটে চুয়াত্তর রান। ওপেনার দু’জন মারার বল প্রচুর পেয়েছে। এতক্ষণ রুমালে মোড়া বরফের টুকরো দিলু নাকে চেপে ধরে বসে ছিল। এবার প্রতাপের কাছে গিয়ে সে বলল, ”আমি নামব, ঠিক হয়ে গেছি।”
”গুড, ভেরি গুড, এই তো চাই।” প্রতাপকে খুবই উৎসাহী দেখাল। ”যাও, নেমে পড়ো।”
দিলু ছুটতে ছুটতে মাঠে গিয়ে বলল, ”আমি ফিট। সনৎদা এবার আমায় কভারে ফিল্ড করতে দিন।”
সাবস্টিটিউট মাঠ ছেড়ে ফিরে গেল। দিলু আম্পায়ারকে জানাল সে আবার খেলতে নেমেছে। সনৎ তাকে কভারেই রাখল। শুরু হল খেলা। ব্যাটসম্যান প্রথম বলটাই ড্রাইভ করল একস্ট্রা কভারে, কলকাতার মাঠে দুটো রান তো নেওয়া যায়ই। দিলুর ডান দিকে দশ মিটার দূর দিয়ে বল যাবে, সে তাড়া করল। চাঁদোয়ার নীচে স্কোরারের পাশের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল প্রতাপ, অস্ফুটে সে স্কোরারকে বলল, ”এবার একটা রান আউট দেখ।”
বলটা ছোঁ মেরে তুলে একই সঙ্গে সে বোলারের উইকেটে ছুড়ল। ওরা দ্বিতীয় রানটা নিচ্ছিল। বোলারের প্রান্তে যাচ্ছিল যে, পপিং ক্রিজের দু’মিটার আগে সে হতাশ হয়ে দেখল উইকেট ভেঙে গেল, বেলদুটো ছিটকে পড়ল তিন—চার হাত দূরে। ফিল্ডাররা ছুটে গেল দিলুর দিকে। অচেনা নতুন বাচ্চচা ছেলে তাই সবাই পিঠ চাপড়াল, নয়তো ওকে জড়িয়ে ধরত। এক উইকেটে পঁচাত্তর রান। তিন নম্বর ব্যাটসম্যান গার্ড নেওয়ার পর আধমিনিট ফিল্ডারদের অবস্থান দেখে স্টান্স নিল।
প্রথম বলটা সে মিড অফে পুশ করে সাত—আট পা এগিয়ে গেল, দিলুকে বলের দিকে ছুটে যেতে দেখে থেমে গেল। ঘুরে ক্রিজে ফিরতে লাগল অলস ভাবে হেঁটে। তার ভাবখানা, একটা রান তো ছিলই, নন—স্ট্রাইকার কেন যে বেরোল না। এর পরই সে হতভম্ব হয়ে চোখের সামনে দেখল তার অফস্টাম্পকে ডিগবাজি খেতে। তাড়াতাড়ি সে ক্রিজের ওপারে ব্যাট রাখল। উইকেটকিপার আর দু’জন স্লিপ ফিল্ডার চিৎকার করে অ্যাপিল করতেই স্কোয়ার লেগ আম্পায়ার আঙুল তুললেন। অবিশ্বাস্য রান আউট। ফিল্ডাররা ছুটে গিয়ে দিলুর কাঁধ ধরে ঝাঁকাল। একজন তো গলা জড়িয়ে ধরল। একজন বলল, ”মিরাকুলাস।”
ইয়াং ফ্রেন্ডসের দুই উইকেটে পঁচাত্তর। পরপর দু’বলে দুটো উইকেট পড়ে গেল এবং সে দুটো কোনও বোলার পায়নি।
এক নম্বর ব্যাটসম্যান এখনও ক্রিজে, এল চার নম্বর। সনৎ তাকে ঘিরে দিল তিনজন ফিল্ডার দিয়ে। দিলুকে আনল সিলি পয়েন্টে। ব্যাটসম্যান আড়চোখে তাকে দেখল, চোখে সন্দেহ আর ভয়, উঁচু করে দেওয়া অফস্পিন বল, ব্যাটসম্যান দু’পা বেরিয়ে পিচের কাছে পা বাড়িয়ে ঝুঁকে কপিবুক রক্ষণাত্মক খেলল। ব্যাটের কানায় লেগে বলটা ঘুরে গেল সিলি পয়েন্টে। ঝোঁকানো শরীর তোলার সময় নেই দেখে সে দ্রুত ডান পাটা জমিতে ঘষড়ে ক্রিজের দিকে ঠেলে দিল কিন্তু দাগের ওপারে পৌঁছল না এবং ততক্ষণে অফস্টাম্পে লাগা বল ছিটকে প্রথম স্লিপের পায়ের কাছে। সে—ই প্রথম ছুটে গিয়ে দিলুকে বুকে জড়িয়ে জমি থেকে এক ফুট তুলে ধরল।
”হ্যাটট্রিক হ্যাটট্রিক,” চাঁদোয়ার নীচে দু’হাত তুলে নাচছে প্রতাপ। ”ফিল্ডারের হ্যাটট্রিক শুনেছে কেউ কখনও, তিনটেই ডাইরেক্ট থ্রো থেকে, কারও সাহায্য ছাড়াই।” এর পর স্কোরারকে ধমকে বলল, ”হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে না থেকে তিনটে রান আউটের পাশে লেখো ডাইরেক্ট থ্রো বাই ডি কর।”
ইয়াং ফ্রেন্ডসের রান তিন উইকেটে পঁচাত্তর। এর পর দু’জন ব্যাটসম্যানের কেউই আর রান নিতে ভরসা পেল না, যেদিকে দিলু রয়েছে। কভারে দিলুকে রেখে সনৎ বোলারদের নির্দেশ দিল অফস্টাম্পের বাইরের দিকে বল করতে। তারা সেইভাবেই বল করে যেতে লাগল। ব্যাটসম্যানরা যা মারে সবই মিড অফে বা কভারে যাচ্ছে। দিলুকে ছুটে যেতে দেখলেই তারা রান নিতে আর দৌড়য় না। শেষে বেপরোয়া হয়ে এক নম্বর ব্যাটসম্যান অফ স্টাম্পের বাইরের একটা ওভারপিচ বল ঘুরিয়ে মিড উইকেটে মারল, ব্যাটে ঠিকমতো বলটা না—লাগায় ক্যাচ উঠে গেল কভারে, দিলু সহজেই ধরে নিল। ইয়াং ফ্রেন্ডস চার উইকেটে আশি।
দশ রান যোগ হওয়ার পর আর একটি উইকেট পড়ল। বোল্ড। পরের ব্যাটসম্যান, দিলু—ভীতি কাটাবার জন্য তুলে ছয়—চার মেরে তিরিশটা রান করল এগারো বলে। শেষ পর্যন্ত সে স্টাম্পড হল। ছয় উইকেটে একশো কুড়ি। আট নম্বর ব্যাটসম্যান এসে দ্বিতীয় বলটা ঠেলল পয়েন্টে দিলুর পাশ দিয়ে, বল কুড়োতে সে ছুটল প্রায় পঁচিশ মিটার, ব্যাটসম্যান সেইদিকে তাকিয়ে, এর পরই সে আবিষ্কার করল নন—স্ট্রাইকার তার পাশে উত্তেজিত স্বরে বলছে, ”ছোট ছোট।” স্ট্রাইকার বলল, ”এখন আর ছুটে কী হবে।” দিলুর ছোড়া বল ধরে বোলার ততক্ষণে বেল ফেলে দিয়েছে। ”বলটা কে চেজ করছে আগে সেটা দেখবি তো।” বলতে বলতে সে মাঠ ছাড়ল।
সাত নম্বর ব্যাটসম্যান এখনও রয়ে গেছে এবং ইনিংসের শেষ পর্যন্ত নট—আউট রয়ে গেল ছত্রিশ বলে ছয় রান করে। শেষ তিন ব্যাটসম্যান একটি লেগবাই বাউন্ডারি সহ তোলে আট রান। এগারো নম্বরের ক্যাচ দিলু নেয় ব্যাকোয়ার্ড পয়েন্টে। ইয়াং ফ্রেন্ডস এক উইকেটে ছিল পঁচাত্তর রানে, সেখান থেকে অল আউট একশো তেত্রিশে, দিলু মাঠে ফিরে আসার পর দশটা উইকেট পড়ে আটান্ন রানে।
ছয় নম্বরে নামার জন্য দিলু প্যাড পরেছিল। উত্তরপল্লী চার উইকেটে একশো পঁয়ত্রিশ করায় তাকে আর মাঠে নামতে হয়নি। প্রতাপের মুখ থমথমে, উত্তেজনা চেপে রাখার চেষ্টায়। গতরাত থেকে সে সিঁটিয়ে ছিল, মনে মনে বলে গেছে ”ডোবাসনি দিলু ডোবাসনি।” সকাল সাতটার মধ্যে সে মোটরবাইকে দুধঘাটে পৌঁছে দেখে দিলু পুকুরে সাঁতার কাটছে। আশ্চর্য, ছেলেটার কোনও টেনশন নেই, এই সময়ে কি কেউ জলে ঝাঁপাঝাঁপি করতে পারে! আটটার সময় দাদুকে মামাকে মামিকে প্রণাম করে সে প্রতাপের পেছনে বাইকে চড়ে বসে। দু’জনের মধ্যে সারা পথে একটাও কথা হয়নি।
প্রতাপকে জনে জনে জিজ্ঞেস করল, ”ছেলেটিকে পেলে কোথায়?”
”গ্রাম থেকে কুড়িয়ে পেয়েছি।” সে নিস্পৃহ স্বরে জবাব দেয়।
”নাম দেখছি ডি কর, ডি—টা?”
”ডি হল দুলাল।”
”গ্রামের নামটি কী?”
”ছোট হুড়া, ওখানে একটা স্কুলে আমি কোচ করি, দুলু সেই স্কুলে পড়ে।” প্রতাপ হুঁশিয়ার হয়ে বলল। দুধঘাট নামটা যেন চাউর না হয়ে যায়। কোনওভাবে যদি মৌলালির বাড়িতে কথাটা পৌঁছয়, ডি কর নামের একটা ছেলে দুধঘাটে থাকে সে ময়দানে তার প্রথম ম্যাচেই ফিল্ডিং—এ তাক লাগিয়ে দিয়েছে, তা হলে সন্দেহ আর কৌতূহল জাগবেই, ডি কর দিলু নয় তো? প্রতাপ তাই গ্রামের নামটা বদলে দিল।
ভবানীপুর মাঠের লাগোয়াই ক্রীড়া সাংবাদিকদের ক্লাবের তাঁবু। সব কাগজের লোক সেখানে বিকেলে জড়ো হয়। ময়দানে ছড়ানো মাঠগুলোয় যত খেলা হয়েছে তার স্কোরবুক নিয়ে ক্লাবের লোকেরা তাঁবুতে এসে সাংবাদিকদের জানায়। অবশ্য জনপ্রিয় বড় ক্লাবের লোকেরা আসে না, সাংবাদিকরাই তাদের ক্লাবে যায় রেজাল্ট নিতে। উত্তরপল্লীর স্কোরার ছেলেটি খাতা নিয়ে ক্রীড়া সাংবাদিকদের তাঁবুতে গেল। সে মুখচোরা, বুদ্ধিটাও কম। সে স্কোরবুকটা খুলে কথায় ব্যস্ত এক সাংবাদিকের সামনে এগিয়ে ধরল।
”দেখার সময় নেই, সেঞ্চুরি হয়েছে কি না বলো।”
”না।”
”হ্যাটট্রিক হয়েছে?”
”না।”
”ঠিক আছে, রেজাল্টটা বলো।”
”ইয়াং ফ্রেন্ডস একশো তেত্রিশ, উত্তরপল্লী সঙ্ঘ চার উইকেটে একশো পঁয়ত্রিশ তুলে ছ’ ছইকেটে জিতেছে।”
”আর কিছু হয়েছে?”
”উত্তরপল্লীর একটা ছেলে দারুণ ফিল্ড করেছে। দুটো ক্যাচ চারটে রান আউট—”
”ঠিক আছে। মোহনবাগান—ইস্টবেঙ্গলে খেলুক তখন রান আউট ক্যাচট্যাচ লেখা যাবে।”
স্কোরবুক বগলে নিয়ে ছেলেটি তাঁবু থেকে বেরোচ্ছে তখন একজন তাকে পেছন থেকে ডাকল, ”শুনুন।”
সে ফিরে তাকিয়ে দেখল শীর্ণ, চশমাপরা একটি অল্পবয়সী ছেলে, পায়ে চটি, তার দিকে জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে চলল, ”তখন কী যেন কানুদাকে বলছিলেন—চারটে রান আউট দুটো ক্যাচ, একজনই কি করেছে?”
”তবে না তো বললুম কেন?”
”দেখি স্কোরবইটা?” এই বলে সে স্কোরবইটা বগল থেকে টেনে নিয়ে পাতা ওলটাল, স্কোর দেখতে দেখতে কপালে ভাঁজ তুলে বলল, ”এটা কী লেখা, কীসের হ্যাটট্রিক?”
”রান আউটের। পরপর তিন বলে তিনজনকে ডাইরেক্ট থ্রোয়ে উইকেট মেরে আউট করেছে, এমন ঘটনার কথা শুনেছেন কখনও?”
সেই নবীন সাংবাদিক এধার—ওধার তাকিয়ে স্কোরারকে তাঁবুর গেটের বাইরে টেনে আনল। স্কোরবই থেকে দরকারি তথ্য নোটবইয়ে টুকে নিয়ে ডি কর সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করল।
”আপনার কোন কাগজ?”
”প্রভাতী, নিশ্চয় নাম শোনেননি, যাদবপুর থেকে নতুন বেরিয়েছে। আচ্ছা ছোট হুড়াটা কোথায় বলুন তো?”
”জানি না। বারুইপুর কি শ্রীরামপুরের দিকে হবে।”
”আচ্ছা এই দুলাল আগে কোন ক্লাবে খেলেছে?”
”জানি না।”
ধর্মতলায় মোটরবাইক থেকে নেমে প্রতাপ ওষুধের দোকান থেকে কয়েকটা ক্যাপসুল কিনল। দিলুর হাতে দিয়ে বলল, ”এখনই একটা খেয়ে নাও, রাতে একটা খেও। আর কাল সারাদিনে তিনটে খাবে, ব্যথা কমে যাবে।”
প্রতাপ একটা সফট ড্রিঙ্কসের বোতল কিনে দিলুর হাতে দিয়ে বলল, ”এখানকার জল খুব খারাপ, এই দিয়ে ক্যাপসুলটা গিলে খাও।”
সন্ধ্যা উতরে গেল দুধঘাটে ওদের পৌঁছতে। বাড়ির সবাই অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। সুলেখারই চোখ প্রথম পড়ল দিলুর নাকে।
”কী হল নাকে? বেশ ফুলে রয়েছে দেখছি।”
”কিছু না, একটা বল লেগেছে।” দিলু তাচ্ছিল্যভরে বলল। ”এখন ঠিক হয়ে গেছে। ওষুধ খেয়ে নিয়েছি।”
”প্রতাপ হল কী? খেলল কেমন?” হরিসাধন উৎকণ্ঠিত হয়ে জানতে চাইলেন।
মুখে গাম্ভীর্য আর স্বরে ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে প্রতাপ বলল, ”চারটে রান আউট দুটো ক্যাচ, ভাবা যায়। আপনার ভাগ্নে যে কী জিনিস লোকে এইবার জানবে। ফিল্ডিং কাকে বলে আজ তা দেখাল। কত সহজে পটাপট উইকেটে মারল, ক্লাবের ছেলেরা তো থ বনে গেছে। মেসোমশাই আমি বলেছিলুম না আউট অব দিস ওয়ার্ল্ড, ওর ফিল্ডিং পৃথিবীর বাইরের ব্যাপার। ভাল মাঠ পেলে দিলু আজ দেখিয়ে দিত ফিল্ডিং কোথায় নিয়ে যাওয়া যায়, ছ’জন আউট ওর হাতে। একটা বোলার ছ’টা উইকেট পেলে তাকে নিয়ে নাচানাচি শুরু হয়ে যাবে। দিলু শুধু ফিল্ডিংয়ের জোরেই দেখবেন কত ওপরে ওঠে।”
হরিসাধন ব্যস্ত হয়ে বললেন, ”ওর সামনে এত প্রশংসা কোরো না প্রতাপ, মাথা ঘুরে যাবে।”
পঞ্চানন বললেন, ”ঠিক কথা। তবে প্রশংসা অনেক সময় উৎসাহ বাড়িয়ে উজ্জীবিত করে তোলে, এটাও মনে রেখো। দাদু তা হলে তুমি আজ খেল দেখিয়েছ, কত লোক দেখল?”
প্রতাপ মিয়োনো স্বরে বলল, ”জনা পঞ্চাশেক হবে। বাইশটা প্লেয়ার, তিন—চারজন রিজার্ভ, দুটো করে স্কোরার আর আম্পায়ার, মালীটালি, ঝালমুড়ি, চা—ওলা আর ক্লাব অফিশিয়াল। তবে সবাই খেলা দেখছিল না।”
”খবরের কাগজের লোক?” পঞ্চানন জানতে চাইলেন।
”একজনও না, এসব ম্যাচে ওঁরা আসেন না সেটা একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে।” প্রতাপ হেসে পঞ্চাননের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। ”মৌলালি অন্ধকারে থাকবে।”
মৌলালি অন্ধকারে থাকলেও বাংলার জুনিয়ার নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান আশিস ঘোষ তার যাদবপুরের বাড়িতে সকালে চা খেতে খেতে টেবল থেকে নতুন বেরোনো কাগজ ‘প্রভাতী’ তুলে নিয়ে প্রথমেই খেলার পাতা খুলে চোখ বোলাতে বোলাতে ঝুঁকে পড়ল একটা মোটা হেডিং দেখে: ”সি এ বি লিগে রান আউটের হ্যাটট্রিক।” তার নীচে পাতলা হেডিং : ”গ্রামের ছেলের অবিশ্বাস্য ফিল্ডিংয়ে ছয়জন আউট।” আশিস দ্রুত খবরটা পড়ে নিয়ে টেলিফোন নম্বরের ছোট নোটবইটা থেকে একটা নম্বর বের করে ডায়াল করল।
”কে প্রতাপ?…আমি আশিস বলছি, আজ কাগজে একটা খবর…কাগজটার নাম প্রভাতী, আমাদের এখান থেকে নতুন বেরিয়েছে…না অন্য কোনও বড় কাগজে তো চোখে পড়ল না দুলাল কর যা করেছে সে তো ফ্যান্টাস্টিক। বয়স কত?…পনেরো? ছেলেটাকে দেখতে হবে তো, তোদের পরের খেলা কবে, কার সঙ্গে? …শনিবার, ক্যালকাটা ইউনাটটেডের সঙ্গে ওদের মাঠে? দেখতে যাব।”
.
ইউনাইটেড মাঠ ভবানীপুর মাঠের তুলনায় অনেক ভাল। ফুটবল মরশুম ছাড়া বছরের বাকি সময় এই মাঠের ওপর দিয়ে লোক চলাচল না—করায় ঘাস সমানভাবে চারিয়ে রয়েছে, মাঠের জমিও সর্বত্র সমতল। তাঁবুর ফেন্সিংয়ের বাইরে লোহার চেয়ারে বসে প্রতাপ, আশিস ঘোষের অপেক্ষায়। ব্যাট করছে ইউনাইটেড। প্রথম তিনটি উইকেট পড়ল আট রানে, তিনজনই রান আউট এবং দিলুর ছোড়া বলে। একস্ট্রা কভার আর ডিপ পয়েন্টের মাঝামাঝি জায়গায় সে ফিল্ড করছে। ডান দিকে ও বাঁ দিকে প্রায় চল্লিশ মিটার জায়গা জুড়ে তার রাজত্ব বিস্তৃত।
তিনজনই দ্বিতীয় রান নেওয়ার সময় আউট হয় এবং বোলার প্রান্তে, আউট হওয়ার ধরন আগের ম্যাচের মতোই। ইউনাইটেড ব্যাটসম্যানরা একটাই ভুল করেছে, তারা দিলুকে বুঝে নিতে একটু দেরি করে ফেলেছে, যখন বুঝল অফের দিকে একটা বিপজ্জনক ফাঁদ তাদের বধ করার জন্য পাতা রয়েছে ততক্ষণে তিনজন ফাঁদে ধরা পড়ে গেছে।
প্রভাতীর সেই সাংবাদিকটি, যার নাম অলোকেন্দু, স্কোরারদের টেবলের পাশে একটা চেয়ার টেনে এনে বসে গেছে। সে খুবই খুশি, এখন পর্যন্ত অন্য কোনও কাগজের লোক মাঠে হাজির নেই। সম্পাদক উত্তরপল্লীর আগের ম্যাচের লেখাটার প্রশংসা করে তাকে বলেছেন, ”অন্য কোনও কাগজে তো খবরটা নেই, তুমি ছেলেটার সব খেলা কভার করবে। ভেরি পিকিউলার, শুধু ফিল্ডিংয়েই ছ’—ছ’টা উইকেট নিচ্ছে একজন। ম্যাচটা অবশ্য তুচ্ছ, ব্যাটসম্যানরাও নির্বোধ, কিন্তু ওর ডাইরেক্ট থ্রোগুলো তো সত্যি।”
চোখের সামনে তিনটে থ্রো সোজা উইকেটে লাগল। আরও পাঁচটা মেরেছে কিন্তু তাতে কেউ রান আউট হয়নি। অলোকেন্দু প্রতিটি থ্রোয়ের হিসেব রেখেছে—আট থ্রো, তিন আউট। সে তাঁবুর পাশের রাস্তা দিয়ে একটি লোককে হেঁটে যেতে দেখে মনে মনে আঁতকে উঠল, সর্বনাশ সত্যসন্ধি কাগজের শতদলদা, এখানে এসে পড়বে না তো। শতদল মাঠের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অলোকেন্দুকে দেখে এগিয়ে এল।
”অলোকেন্দু এখানে কী করছ, মোহনবাগান মাঠে যাবে না? এখানে কারা খেলছে?”
অলোকেন্দু মনে মনে বলল, হে ভগবান এখন বল যেন দুলালের কাছে না যায়, ছুড়লেই তো উইকেটে মারবে। তাইতে শতদলদার যদি কৌতূহল জেগে ওঠে, আর এখানেই যদি বসে পড়ে।
”খেলছে উত্তরপল্লী আর ক্যালকাটা ইউনাইটেড। একটুখানি দেখেই মোহনবাগান মাঠে যাব, খেলা তো ইস্টার্নের সঙ্গে।”
”হ্যাঁ, এসো। আমি এগোলাম।”
অলোকেন্দু হাঁফ ছাড়ামাত্র দিলু লংঅফে উঁচু করে ওঠা বলে ক্যাচ ধরল প্রায় তিরিশ গজ ছুটে, গোলকিপারের মতো ঝাঁপিয়ে জমি থেকে চার আঙুল ওপরে। অ্যাপিলের চিৎকারে শতদল থমকে একবার মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে আবার হাঁটতে লাগল। অলোকেন্দু নোটবইয়ে হিসেব লিখল। হাত কাঁপছে। মনে মনে বলল, ভগবান আজ যেন সাতটা হয়, তা হলে চুটিয়ে লিখব। এক ইনিংসের ম্যাচে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড বললে কি ভুল হবে? উইকেটকিপারের অনেক শিকার আছে এক ইনিংসে, কিন্তু ফিল্ডসম্যানের ক’টা আছে? দুলাল কর যদি আজ দশটা শিকার করে ফেলে। কেউ নেই, একজনও রিপোর্টার নেই, স্কুপ হয়ে যাবে।
অলোকেন্দু স্কুপ করল বটে তবে দিলুর শিকার—সংখ্যা ভগবান দশটার বদলে করে দিলেন আট। পাঁচ রান আউট, তিন ক্যাচ। মোট তেরোবার স্ট্যাম্পে বল লাগিয়েছে। ক্যালকাটা ইউনাইটেড পঁয়ষট্টি অল আউট। ফিল্ডাররা মাঠ থেকে ফিরছে। প্রতাপও চেয়ার ছেড়ে তাদের সঙ্গে তাঁবুতে ঢুকতে গিয়ে দেখল আশিস ঘোষ দাঁড়িয়ে। প্রতাপ বলল, ”এ কী এখানে দাঁড়িয়ে, কতক্ষণ এসেছিস? বাইরে বসলি না কেন?”
”ভাল করে দেখতে হলে লোকজন থেকে একটু তফাত হয়ে দেখতে হয়।”
”কেমন দেখলি?”
”প্রতাপ, এ ছেলেটা তো ভগবান রে!” আশিস দু’হাত বাড়িয়ে প্রতাপের হাত ধরল।” একাই তো শেষ করে দিল ইউনাইটেডকে। আমি ওর সবকটা রান আউট আর ক্যাচ এখানে দাঁড়িয়ে দেখেছি। যেখান—সেখান থেকে বল তুলে উইকেটে মারে, একটাও মিস করল না, এটা তো জন্মগত ক্ষমতা। না হলে হাজার প্র্যাকটিস করেও এ—জিনিস আয়ত্ত করা যায় না। ওকে চোখে চোখে রাখিস।”
”আমাকে আর রাখতে হবে না, ও যেখানে থাকে সেখানে চোখে রাখার ঠিক লোক আছে। আশিস, এই ছেলেটাকে অপেক্ষা করিয়ে পচিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। ওকে নিজের চোখে তো দেখলি, এবার ঠেলে তুলে দে।”
”আর একটা ম্যাচ খেলুক, ব্যাটটা কেমন করে দেখি, তারপর আন্ডার সিক্সটিনে ওকে ঢোকাবার জন্য মিটিংয়ে নাম তুলব।”
পঁয়ষট্টি রান টপকাতে উত্তরপল্লীর দুটো উইকেট খরচ হল। দিলু এই ম্যাচেও ব্যাট করার সুযোগ পেল না। খেলা আড়াইটের মধ্যেই শেষ।
অলোকেন্দু তখন ফোটোগ্রাফারের জন্য মাথার চুল ছেঁড়ার মতো অবস্থায়। দুলালের একটা ছবি তার চাই। কত ফোটোগ্রাফারই তো কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে মাঠে ঘুরে বেড়ায় খবরের কাগজে ছবি বিক্রি করবে বলে। আর আজই কারও পাত্তা নেই। দৌড়ে মোহনবাগান মাঠে গিয়ে খোঁজ করে দেখবে ভেবে সে প্রতাপের কাছে গিয়ে বলল, ”দুলাল এখন দশ—পনেরো মিনিট থাকবে তো, আমি দৌড়ে একজন ফোটোগ্রাফার ধরে আনছি।”
”কীজন্য?” প্রতাপ মনে মনে সিঁটিয়ে প্রশ্ন করল।
অলোকেন্দু অবাক হয়ে বলল, ”কেন ছবি তোলার জন্য। কাল প্রভাতীতে বেরোবে। দুটো ম্যাচে চোদ্দো, ভাবতে পারেন! ওর ছবি বেরোবে না তো কার বেরোবে, প্লিজ দশ মিনিট একে থাকতে বলুন।” বলেই সে ছুটতে শুরু করল মোহনবাগান মাঠের উদ্দেশ্যে।
”দিলু, বিপদ ঘনিয়ে আসছে, কাগজে ছবি বেরোবার ব্যবস্থা হচ্ছে।” দিলুর কানে ফিসফিস করে প্রতাপ বলল, ”এখুনি কেটে পড়তে হবে।”
পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রতাপের মোটরবাইক ছুটল দুধঘাটের দিকে। যখন পৌঁছল তখনও বিকেল। ওরা যখন বাড়ির কাছাকাছি, দেখল রাস্তার ধারে একটা ইটের চাঙড়ের ওপর হর্ষ বসে। মোটবাইক দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল, ”থামো, থামো, এখন আর বাড়িতে যেও না। উফফ কখন থেকে তোমাদের জন্য বসে আছি। দুপুরে মলুদি এসেছে।”
”মা!” দিলুর মুখ শুকিয়ে গেল।
”দিলুর মা? সর্বনাশ করেছে। কী বলা হয়েছে ওঁকে?” প্রতাপ প্রমাদ গনল।
”বউদি বুদ্ধি করে বলেছে, ছোট হুড়োয় এক বন্ধুর বাড়িতে দিলুদাদা ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে গেছে, সন্ধের আগেই এসে যাবে। তোমাদের আগাম জানিয়ে দেওয়ার জন্য মেসোমশাই আমাকে বললেন হষ্য রাস্তায় নিমতলায় গিয়ে বসে থাক। ওদের আসতে দেখলেই কী বলতে হবে শিখিয়ে দিবি। আর বলবি, খুব ভাল হয় যদি দিলু মাছ হাতে বাড়ি ফেরে।”
”মা—আ—ছ! এখন কি বাজার বসেছে? আচ্ছা আমি বাইগাছি বাজারটা দেখে আসছি নয়তো বারাসাতে চলে যাব, আমার চেনা এক মাছওলা আছে।” প্রতাপ আর কথা বাড়াল না। বাইক ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটাল।
”দিলুদাদা তুমি এখন আর বাড়ি যেও না, একেবারে মাছ হাতে বাড়ি ঢুকবে, এখানে বসে থাকো।”
প্রতাপ বাইগাছি গিয়ে দেখল বাজার সুনসান। দেরি না করে মোটরবাইক ঘুরিয়ে ছুটল বারাসাত। সেখানেও মাছের বাজারে লোক নেই, এই সময় থাকার কথাও নয়। কাছেই তিনকড়ির বাড়ি, ছোটবেলার বন্ধু, বাজারে মাছের বড় কারবারি। প্রতাপ হাজির হল তার বাড়িতে।
”তিনু বড় বিপদে পড়ে গেছি, এখুনি একটা মাছ চাই, কিলো দুইয়ের মধ্যে হলেই হবে।”
”মাছ আসবে সন্ধেবেলায় হাওড়ার বাজার থেকে। ঘণ্টাখানেক বোস।” তিনকড়ি নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে সিগারেটে টান দিয়ে বলল।
”পারব না রে, এক ঘণ্টা বসতে পারব না। সকালের কোনও মাছ পড়েটড়ে নেই।”
”কাটা রুই আছে, সাতশো গ্রামের মতো, চলবে? তা হলে দিতে পারি।”
”চলবে চলবে, মুড়োটা আছে তো?”
”আছে, ল্যাজাটাও আছে। গাদা আর পেটি বিক্রি হয়ে গেছে।”
তিনকড়ি বাড়ি থেকে বাজারে এল। প্রতাপ ছোট একটা থলি কিনে নিল। কঠোর বাক্সে বরফ চাপা দেওয়া পলিথিনে মোড়া মাছ বের করে তিনকড়ি প্রতাপের থলিতে ঢুকিয়ে দিল।
”কত দাম বল।”
”দিতে হবে না। আমার ছেলেটাকে বরং দুধঘাট ইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দিস। তোর তো চেনা আছে হেডমাস্টারের সঙ্গে।”
”আছে, ভর্তি করিয়ে দোব।”
প্রতাপ প্রায় ছুটে গিয়ে বাইকে চড়ে বসল। আধঘণ্টা কাবার হয়ে গেছে। দিলুর মা যদি এখনও থাকেন তা হলে ভালই নিজের চোখে দেখে যাবেন ছেলে সত্যি মাছ ধরতে গেছল আর ধরেও ছিল একটা কিলো দুয়েকের রুই। অত বড় মাছ খাবার লোক বাড়িতে নেই, তাই সে আধখানা বন্ধুর বাড়িতে দিয়ে এসেছে। প্রতাপ মনে মনে একটা গল্প বানিয়ে ফেলল। তার মনে হল মোটামুটি এটা বিশ্বাসযোগ্যই হবে। তবে একটা মুশকিল, মাছের টুকরোগুলো বরফে ঠান্ডা হয়ে রয়েছে। দিলুর মা কি মাছে হাত দেবেন? প্রতাপের মনে খচখচানি ধরল।
নিমগাছতলায় ওরা দু’জন বসে অপেক্ষা করছে। হর্ষ হাত বাড়িয়ে আগে থলিটা নিয়ে ফাঁক করে দেখল।
”গোটা মাছ পেলুম না। কাটা ছিল তাই নিয়ে এলুম। একটা দু’ কিলোর রুই দিলু ধরেছিল, তার আধখানা বন্ধুর বাড়িতে দিয়ে এসেছে, ওদের ছিপ ওদের পুকুর, দিলু তো দিতেই পারে, পারে না?” প্রতাপ তার গল্পটা অনুমোদন পেতে দেখল হর্ষর মুখভাবে।
”খুব ভাল বলেছেন। আমি তাই বলব।”
ওরা বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। প্রতাপ ব্যস্ত হয়ে ডাকল, ”এই যে এই যে, মাছটা কিন্তু ঠাণ্ডা, বরফে ছিল সকাল থেকে।”
”সে আমি ঠিক করে নোব। দূর থেকে মলুদিকে দেখাব এমনভাবে যে, আর হাতই ছোঁয়াবে না।”
প্রতাপ বাইকে চড়ে ফেরার সময় গেট দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে দেখল একটা মোটরগাড়ি দাঁড়িয়ে। সে আশ্বস্ত হল, দিলুর মা এখনও ফিরে যাননি।
বাড়িতে ঢুকেই হর্ষ চেঁচিয়ে বলল, ”ও মলুদি, ও বউদি দেখে যাও দিলুদাদা কতবড় একটা মাছ ধরেছে।”
ওরা দোতলায় ছিল। হর্ষর বাড়ি—মাথায়—করা চিৎকারে তাড়াতাড়ি নেমে এল। ততক্ষণে একটা গামলায় মাছের টুকরোগুলো হর্ষ ঢেলে ফেলেছে।
”দ্যাখো গো মলুদি, তোমার ছেলের কিত্তি। কতবড় মাছ ধরে আবার আধখানা ওদের দিয়েও এসেছে।”
পঞ্চানন বললেন, ”এইরকমই তো হওয়া উচিত। আর হবে নাই বা কেন, মলুর ছেলে তো! দেওয়াথোওয়ার হাত তো দিলু মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছে।” আড়চোখে তিনি দেখলেন মলুর চোখ পুলকে জ্বলজ্বল করছে।
হর্ষ ব্যস্ত হয়ে বলল, ”বউদি, আমি চট করে দুটো মাছ মলুদিকে ভেজে দি।” বলেই সে মাছের গামলা নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল।
মলু যথাসাধ্য উদ্বিগ্ন হওয়ার চেষ্টা করে বলল, ”জেঠু পুকুরের ধারে বসে মাছধরাটা কিন্তু বিপজ্জনক, দিলু সাঁতার জানে না।”
”ঠিক কথা, এটা তো আমার মনে ছিল না। আচ্ছা মলু, ওকে সাঁতারটা শিখিয়ে দিলে কেমন হয়?” পঞ্চানন গম্ভীর মুখে বললেন।
”দাও, তবে যাকে—তাকে দিয়ে শেখাতে যেও না। ডুবে গেলে বাঁচাতে পারবে এমন কাউকে দিয়ে শিখিয়ো।”
মাছভাজা খেয়ে মলু চলে যাওয়ার পর পঞ্চানন জিজ্ঞেস করলেন দিলুকে, ”দাদু আজ ক’টা হল?”
”আটটা।”
”আজ খুব বাঁচান বেঁচে গেছ, তবে বারবার মাছধরার গল্প কিন্তু টিকবে না। পরের ম্যাচ কার সঙ্গে?”
”ব্রাদার্স ইউনিয়নের সঙ্গে, ওদের মাঠেই খেলা।”
”কলকাতা আমার পক্ষে দূরে হয়ে যায়, এই বেতো হাঁটু নিয়ে অত হাঁটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, খুব ইচ্ছে করে একবার তোমার খেলা দেখতে।”
”দাদু, শেষ কবে ময়দানে খেলা দেখেছ?”
”চুয়াত্তরের ডিসেম্বরে। পটৌডি ক্যাপ্টেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইডেনে হারল। ওহ ফোর্থ ডে—র সকালেই চন্দ্রশেখর বোল্ড করল লয়েডকে এখনও চোখে ভাসে, তারপর স্লিপে কালীচরণের ক্যাচ নিল বিশ্বনাথ, চন্দ্ররই বলে। ওখানেই শেষ হয়ে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দু’ চোখ ভরে দেখেছি বিশ্বনাথের ব্যাটিং। প্রায় ছ’ঘণ্টা ব্যাট করে একশো ঊনচল্লিশ রান করেছিল, গিবস আর অ্যান্ডি রবার্টস ছিল বোলার। অমন ব্যাটিং আর দেখা যাবে কি না জানি না। এখন তো যে সেঞ্চুরি করে তাকেই আর্টিস্ট বলা হয়, বিশ্বনাথের ওই খেলা দেখলে আর বলত না।” পঞ্চানন মাথা নাড়তে লাগলেন, দিলু বুঝতে পারল না দাদুর এই আক্ষেপটা বিশ্বনাথের মতো ব্যাটিং আর দেখা যাবে না বলে নাকি সবাই আর্টিস্ট হয়ে যাচ্ছে বলে!
পরের দিন স্কুল ছুটির পর দিলু নেটে ব্যাট করছিল। একটা বল জোরে ড্রাইভ করতেই ব্যাটের কানা ভেঙে একটুকরো কাঠ উড়ে গেল। দিলু অপ্রতিভ হয়ে নেট থেকে বেরিয়ে এল। আর একটা ব্যাট আছে কিন্তু সে আর নেটে ঢুকল না। মাঠের মাঝে কয়েকজনের সঙ্গে ক্যাচিং প্র্যাকটিস শুরু করল। একটু পরেই এল প্রতাপ।
”দিলু, কাল কেউ রান আউট হয়নি তো?”
”হর্ষ মাসি আর দাদুর রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে এত ভাল বোঝাপড়া, যে, মা কোনও চান্সই পায়নি স্ট্যাম্পে হিট করার।”
”আশিস ঘোষ দুপুরে ফোন করেছিল, এই নভেম্বরে আন্ডার সিক্সটিন বিজয় মার্চেন্ট ট্রফির খেলা। বেঙ্গল টিমের জন্য প্রবাবেলদের নিয়ে একটা ট্রায়াল ম্যাচ খেলতে চায়। তোমার নাম করল, ট্রায়ালে তোমাকে আর একটু দেখে নিতে চাইছে। আমি ভাবছি রবিবার দুধঘাটে খেলাটা করার জন্য বললে কেমন হয়; তোমার মামার সঙ্গে আজই কথা বলব, ওর পারমিশন ছাড়া তো খেলা সম্ভব নয়, সন্ধ্যায় উনি বাড়ি থাকেন কি?”
”মামা তো এখনও স্কুলেই রয়েছেন, ওঁর ঘরে গিয়ে দেখা করুন না।” প্রতাপ ব্যস্ত হয়ে রওনা হল হেডমাস্টারের ঘরের দিকে, মিনিট কুড়ি পরে টগবগিয়ে ফিরে এল হাসিমুখে। দিলু ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করল, ”মামা কী বললেন?”
”এক কথায় রাজি। তাই নয় লাঞ্চ, টি সবই স্কুল দেবে, এমনকী বাইগাছি স্টেশন থেকে এখানে আসার জন্য ভ্যান রিকশার ব্যবস্থাও করবেন বললেন। ওঁর ঘর থেকেই ফোন করলাম আশিসের বাড়িতে, পেলাম না; রাত্রে আর একবার করব, না পেলে কাল সি এ বি—তে যাব।” প্রতাপ অস্থিরভাবে দু’হাত কচলাল।
রাতে সে আশিস ঘোষকে ফোন করে পেয়ে গিয়ে বলল, ”ট্রায়াল ম্যাচটা আমাদের এখানে মানে দুধঘাটের স্কুলের মাঠেই কর না। চমৎকার মাঠ, তবে ইডেনের মতো অত বড় নয়। শেয়ালদা থেকে একঘণ্টা লোকাল ট্রেনে, হাজারদেড়েক লোক তো খেলা দেখবেই। তা ছাড়া লাঞ্চ—টি দিতে স্কুল রাজি।”
”খুব ভাল কথা, আগে দেবু ঘোষালের সঙ্গে কথা বলে নিই; দেবু কোচ, ওর মতামতই এ—ব্যাপারে চূড়ান্ত। ওকে এখুনি ফোন করে তোকে জানাচ্ছি, তুই বাড়ি আছিস তো?” আশিস ফোন রেখে দিল। প্রতাপ ফোনের পাশে বসে রইল। আধঘণ্টা পর ফোন বেজে উঠতেই সে ছোঁ দিয়ে রিসিভার তুলেই বলল, ”আশিস?”
গম্ভীর স্বর এল ”আমি দেবু! কে, প্রতাপদা বলছেন?”
”আশিস তোমায় বলেছে সব?”
”সব মানে, আপনি ট্রায়ালটা দুধঘাটে করাতে চান। ওখানে একটা স্কুল আছে না? শুনেছি খুব নামকরা স্কুল, স্টার লেটার পায় গণ্ডা গণ্ডা। মাঠটা ক্রিকেট খেলার উপযুক্ত কি!”
”আমি ওখানে কোচ করি। স্কুলের একটা ছেলে এ—বছরই কলকাতায় আমার ক্লাবে দুটো ম্যাচ খেলে ন’টা রান আউট করেছে, পাঁচটা ক্যাচ নিয়েছে। কুড়িটা উইকেটের চোদ্দোটা ও একা ফেলে দিয়েছে। ছেলেটাকে খেলিয়ে দেখতে পারো। ভারতে এখন এমন ফিল্ডার নেই, বয়স পনেরো। মাঠ সম্পর্কে বলতে পারি মোহনবাগান মাঠের মতোই মাঠ।”
”নাম কী ছেলেটার?”
”দুলাল কর।”
”কাগজে নামটা দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না।”
”নামকরা ক্লাবে খেললে দেখতে পেতে। তা হলে রবিবারে তোমরা খেলতে রাজি?”
”দেখুন প্রতাপদা, এটা সরকারিভাবে ট্রায়াল ম্যাচ নয়। বিজয় মার্চেন্ট ট্রফিতে ম্যাচ হয় তিনদিনের। একদিনের ম্যাচটা খেলতে চাই পনেরোটা ছেলে বেছে নেওয়ার জন্য, আমি ডিস্ট্রিক্টের ছেলে খুঁজছি। রবিবারে ট্রেন কখন?”
”সকাল আটটা পাঁচের ট্রেনে আসাটাই সুবিধের। বাইগাছি স্টেশনে আমরা রিসিভ করব, ওখান থেকে সাইকেল ভ্যানে স্কুলে। প্লেয়ারদের ইকুইপমেন্টস আর বল তোমরা আনছ, আমরা স্ট্যাম্প দোব আর তিরিশজনের লাঞ্চ—টি, আর কিছু?”
”আম্পায়ার দু’জন?”
”একজন আমি আর একজন আশিস বা তুমি। হোয়াইট কোট কিন্তু দিতে পারব না।”
.
হইচই পড়ে গেল দুধঘাটে। স্কুলের ছেলেরা পোস্টার লিখে বাইগাছি বাজারে, স্টেশনে, পোস্ট অফিসের, সিনেমা হলের, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দেওয়ালে পর্যন্ত সেঁটে দিল: ”বাংলার জুনিয়ার ক্রিকেটদলের ওয়ান ডে ম্যাচ/দুধঘাট উচ্চচ মাধ্যমিক স্কুল মাঠে/দলে দলে দেখতে আসুন/রবিবার দোসরা নভেম্বর।” আর—একটা পোস্টারে: ”আসুন দেখুন/বাংলার অলৌকিক ফিল্ডার দুধঘাট স্কুলের ছাত্র/দিলীপ কর/ অষ্টম শ্রেণী/এই ম্যাচে খেলিবে।”
স্কুলের মাঠে প্রতিদিন দিলুর ফিল্ডিং বহু ছাত্রই দেখেছে। কলকাতায় দুটো ম্যাচে তার কৃতিত্বের খবর বাসু মারফত সারা স্কুলে ছড়িয়ে যাওয়ায় দিলু এখন সবার দেখার পাত্র। স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকলেই ছেলেরা ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকায়। সুব্রত কাপ জেতা দুধঘাট স্কুলের ছেলেরাও এত নজর টানেনি, যা দিলু পেতে শুরু করেছে। বিকেলে তার ফিল্ডিং প্র্যাকটিস দেখার জন্য ছাত্ররা তো বটেই, গ্রামের লোকেরাও এখন ভিড় করে থাকে।
সৌরভ গাঙ্গুলি, টিভি, খবরের কাগজের দৌলতে ক্রিকেট এখন জনপ্রিয়তায়, বাইগাছি—দুধঘাটে ফুটবলকে দু’নম্বরে ঠেলে পয়লা জায়গাটা নিয়ে নিয়েছে। স্কুলের ছেলেদের নিজেদের মধ্যে খেলা ম্যাচ ছাড়া স্থানীয় লোকেদের আর কোনও ক্রিকেট দেখার সুযোগ হয় না। দেখতে হলে যেতে হয় কলকাতায়। এখন কলকাতাই আসছে দুধঘাটে। বিজয় মার্চেন্ট ট্রফিতে বাংলার হয়ে যারা খেলবে তারা আসছে, আর তাদের সঙ্গে খেলবে দুধঘাটের ছেলে, এটা কি কম কথা!
উত্তেজনায় ফুটে উঠল দুধঘাট। হরিসাধন ডেকে পাঠালেন, যশোহর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিক শঙ্কর নাগকে।
”শঙ্করবাবু, কলকাতা থেকে ছেলেরা খেলতে আসবে, ক্রিকেট। তাদের লাঞ্চে আমি আপনার ছানার জিলিপি খাওয়াব। মনে রাখবেন, আপনার জিলিপিকে আমি বিশ্ববিখ্যাত মনে করি।”
”সে ঠিকই করেন। স্পেশ্যাল কেয়ার নিয়ে বানাব। ক’জন খাবেন?” নাগমশাই নম্রস্বরে জানতে চাইলেন।
”তিরিশজন। ক’টা করে খাবে আমি বলতে পারছি না, তবে ছোটরা মিষ্টি খেতে ভালবাসে। আপনিই বলুন কত লাগবে।”
শঙ্কর নাগ মাথা চুলকোলন, সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে কী যেন গোনাগুনি করলেন তারপর বললেন, ”কখন খাবে? লাঞ্চ তো খেলার মধ্যিখানে হয়। সেইরকম নিয়ম মেনেই তো খেলা হবে?”
”হ্যাঁ, একদলের ইনিংস শেষ হওয়ার পর লাঞ্চ হবে।” হরিসাধন হেসে উঠে বললেন।
”সার, লাঞ্চটা তো রান্না করতে হবে। সেটা কি স্কুলই করবে?”
”হ্যাঁ। সমরেশবাবুর বাড়ি কাছেই। বুবু কেটারার্সের লোক এসে ওর বাড়িতে তৈরি করবে চিকেন স্টু। সঙ্গে পাউরুটি, স্যালাড, কলা আর ছানার জিলিপি। এ তো বিয়েবাড়ি নয় যে, খাওয়াটাই আসল ব্যাপার, এরা আসছে খেলতে। এবার বলুন কটা লাগবে?”
‘মাথাপিছু পাঁচটা করেই ধরি?” নাগমশাই প্রশ্ন করে আশা নিয়ে তাকালেন।
”পাঁ—আ—চ—টা। বললুম না ওরা খেতে নয়, খেলতে আসবে।” হরিসাধনের মুখে বিরক্তি।
”তা হলে চারটে করে। তিরিশজনই তো আর খেলবে না। তা ছাড়া কারও ভাল লেগে গেলে, লাগবেই, সে আরও দুটো চাইবে। তখন কি আর নেই বলবেন? তাতে ইস্কুলের বদনাম হবে না?”
অকাট্য যুক্তি। স্কুলের বদনাম হরিসাধন হতে দিতে পারেন না। রাজি হয়ে গেলেন। ফিল্ড রেস্ট্রিকশনের তিরিশ গজের সার্কল, বাউন্ডারি লাইনে চুনের দাগ, পিচে জল দেওয়া, রোল—করা প্রতাপ দাঁড়িয়ে থেকে করাল। পঞ্চায়েত থেকে লাল—নীল—হলুদ কাগজের শিকল সুপুরি গাছগুলোয় জড়িয়ে মাঠ ঘেরা হল। লাঞ্চে জলপান বিরতির জন্য কাচের গ্লাস আর জাগ, চা এবং কাপ ডিশ কেটারারই দেবে। একতলায় ক্লাস ফাইভের দুটো ঘর ড্রেসিংরুম হবে। বেঞ্চগুলো, টিচার্স রুম থেকে দশটা চেয়ার আর দুটো টেবল আনা হবে মাঠের ধারে খাটানো ইউনিভার্সাল ডেকরেটরের চাঁদোয়ার নীচে। ফার্স্ট এড বক্স নিয়ে ডাক্তার পোদ্দার সারাক্ষণই থাকবেন কথা দিয়েছেন। দুটো ব্ল্যাকবোর্ড, ডাস্টার, খড়ি স্কোরবোর্ডের জন্য রেডি করে রাখা হয়েছে। নেট প্র্যাকটিসের নেটও চটজলদি খাটিয়ে নেওয়ার মতো অবস্থায় মাঠের বাইরে রাখা হবে। বলা যায় না খেলতে নামার আগে হয়তো ওরা নেট চাইতে পারে। টয়লেটে ব্লিচিং পাউডার দু’দিন ধরে দেওয়া হচ্ছে। মাইক তো থাকবেই।
দুধঘাট স্কুল প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। অবশেষে রবিবার এল। সেদিন সকালেও দিলু পুকুরে সাঁতার কাটল অন্যান্য দিনের মতো। দশটায় ম্যাচ আরম্ভ হবে। এখন আটটা। বর্গমূলের অঙ্ক করার জন্য বই আর খাতা নিয়ে সে টেবলে বসল। পঞ্চানন তখন বললেন, ”দাদু, আজ এসব থাক। এখন বরং তুমি মনে মনে ম্যাচটা খেলো। তুমি তো প্রতিদিন প্র্যাকটিস করে নিজেকে তৈরি করেছ, এখন চোখ বন্ধ করে নিজেকে দ্যাখো ফিল্ড করছ। ব্যাটসম্যান বল মারল, যেদিকে বল যাচ্ছে তুমি ছুটলে, বলের কাছে যত তাড়াতাড়ি পৌঁছনো যায় সেইভাবে ছুটলে, বলে চোখ রেখে তুললে, উইকেটের আন্দাজ নিলে, ছুড়লে। মনে মনে বারবার এটা করো সব ভুলে গিয়ে।” এই বলে পঞ্চানন নীচে নেমে গেলেন দিলুকে একা রেখে।
সওয়া ন’টায় মোটরবাইকে প্রতাপ হাজির হল। হরিসাধন সকাল থেকেই স্কুলে। প্রতাপের পেছনে বসার আগে দিলু বলল, ”দাদু মাঠে যাচ্ছ কখন?”
”এই একটু পরে টুকটুক করে হেঁটে চলে যাব।” পঞ্চানন দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে বললেন, ”দুর্গা দুর্গা।”
প্রতাপ বলল, ”আপনি রেডি হয়ে থাকুন। দিলুকে পৌঁছে দিয়েই আমি আসছি, আপনাকে নিয়ে যাব।”
স্কুল ফটকের সামনে দিলুকে নামিয়ে দিয়ে প্রতাপ বাইক ঘুরিয়ে নিল পঞ্চাননকে নিয়ে আসার জন্য। এক মিনিট পরেই বাইগাছি স্টেশন থেকে সারি দিয়ে ছ’টা সাইকেল ভ্যান রিকশায় পা ঝুলিয়ে বসা পঁচিশ—ছাব্বিশটি ছেলে পৌঁছল। তাদের পিছু পিছু এল আরও চারটি রিকশা। তাতে লম্বা লম্বা ব্যাগে তাদের ব্যক্তিগত খেলার সরঞ্জাম। ছেলেরা যে যার নিজের ব্যাগ হাতে নিয়ে ফটক দিয়ে ঢুকল। হরিসাধন এবং দু’জন শিক্ষক দাঁড়িয়ে।
”সোজা চলে যাও, একতলায় ডান দিকের দুটো ঘর ড্রেসিংরুম।” হরিসাধন স্কুলবাড়ির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন। ”দরজাতেই কাগজে টিমের নাম লেখা আছে।” গতকাল প্রতাপ জানিয়ে দেয় দুটো দলের নাম দেওয়া হয়েছে রেড আর ব্লু। ছেলেরা চারধারে চোখ বোলাতে লাগল। দিলু তাদের কাছেই দাঁড়িয়ে। শুনতে পেল তাদের কথা।
”কী বিউটিফুল গ্রাউন্ড আর সারাউন্ডিং। সারি দিয়ে কোকোনাট আর সরু সরু পামগাছ।”
”অংশু ওগুলো পাম গাছ নয় রে সুপুরি গাছ।” একজন সংশোধন করে দিল।
একজন বলল, ”দাদুর কাছে শুনেছি একসময় ইডেন ঘিরে ছিল দেবদারু গাছ। তখন একটা কংক্রিটের খণ্ডও ছিল না ইডেনে। গঙ্গার দিক থেকে হাওয়া আসত, পুরনো বলও সুইং করত।”
আর একজন বলল, ”এখানে ধানখেত থাকলে বলতুম অংশু ওই দেখ, ওই গাছ দিয়ে দারুণ তক্তা হয়।”
অংশু স্বাস্থ্যবান, ফরসা, চোখা নাকমুখ। দামি জিনস পরা। ওদের কথা শুনে হাসতে হাসতে বলল, ”বল, বল, বলে যা, সারাক্ষণ ট্রেনে পেছনে লেগেছিস, আবার এখানেও। এবার একটু চুপ কর। এখানকার লোকেরা শুনলে—” সে এধার—ওধার তাকাল। চোখাচোখি হয়ে গেল দিলুর সঙ্গে, দিলু হাসতে লাগল। ”এই দেখ একজন হাসছে।”
ছেলেরা এগিয়ে যাচ্ছে ড্রেসিংরুমের দিকে। দিলু এখনও জানে না সে রেড না ব্লু কোন দলে পড়েছে। কলকাতায় দেবু ঘোষাল টিম করেছে, দিলু তাকে কখনও দেখেনি, সে আশিস ঘোষকেও চেনে না। কোন ঘরে ঢুকবে বুঝতে না পেরে একতলার করিডরে দাঁড়িয়ে রইল। সবাই দরজায় আঁটা কাগজ দেখে দুটো ঘরে আলাদা হয়ে ঢুকল দেখে দিলু বুঝে গেল ওরা জানে কে কোন দলের। ওরা নিশ্চয় বলতে পারবে দুলাল কর বা ডি কর, রেড না ব্লু কোন দলে।
সে কিন্তু কিন্তু করে রেড ঘরে ঢুকল। ছেলেরা প্যান্ট শার্ট বদলে জুতো পরায় ব্যস্ত। সামনেই অংশু বেঞ্চে বসে জুতোর ফিতে বাঁধছে। দিলু নিচু স্বরে তাকে জিজ্ঞেস করল, ”তোমাদের টিমে কি এখানকার কোনও ছেলে আছে?”
অংশু প্রথমে তার আপাদমস্তক দেখল। তারপর বলল, ”একেবারে ড্রেস করেই এসেছ দেখছি। বোসো। তোমার নামে পোস্টার দেখলুম স্টেশনে, লোকাল হিরো। আমি রেডের ক্যাপ্টেন অংশুমান সিনহা।” অংশু হাত বাড়িয়ে দিল, দিলু হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে ওর পাশে বসল। অংশুকে তার মনে হল পরিষ্কার স্বচ্ছ মনের, সহজেই বন্ধু হয়ে যেতে পারে। উত্তরপল্লীর সনৎদা বয়সে তার দ্বিগুণ। আচরণে কথাবার্তায় সবসময়ই বুঝিয়ে দেন তিনি ক্যাপ্টেন, দিলু আড়ষ্ট বোধ করেছে।
”দেবুদা বলেছেন তুমি দারুণ ফিল্ড করো, যে—কোনও পজিশনে। আমি উইকেটকিপার। তোমার নাম তো দুলাল কর, এই স্কুলে পড়ো, আমি লা মার্টিনিয়ারে।” বলতে বলতে অংশু লম্বা ব্যাগ থেকে ব্যাট প্যাড গ্লাভস এমনকী একটা হেলমেটও বের করল। দেখে দিলু অস্বস্তিতে পড়ল। তার মনে হল, এর প্রত্যেকটাই বেশ দামি। কৌতূহলে সে ব্যাটটা হাতে তুলে নাচাল। দাঁড়িয়ে ব্যাটটা ধরে স্টান্স নিয়ে দু’বার কাল্পনিক বলে ডিফেন্সিভ খেলল এক পা পিছিয়ে এসে। অংশু তাকে লক্ষ করছিল, বলল, ”তোমার প্লেয়িং কিটস কোথায়?”
”স্কুলের ঘরে রয়েছে।” দিলু বলতে পারল না তার নিজস্ব কোনও খেলার সরঞ্জাম নেই, ব্যাটও নেই। দুটো ম্যাচে তার প্যাড, ব্যাট, অ্যাবডোমেন গার্ড সবই ছিল উত্তরপল্লী ক্লাবের। স্কুলের ব্যাটটার কানা সেদিন ভেঙেছে। আর যে ব্যাটটা আছে তা দিয়ে ম্যাচ খেলা যায় না। অংশুর মতো তারও নিজের ব্যাট প্যাড গ্লাভস থাকা দরকার।
”হারি আপ বয়েজ।” দাঁড়িয়ে উঠে অংশু তাড়া দিল।
অংশুর গলার স্বর শুনে দিলু অবাক! কোথায় সেই হাসিখুশি হালকা ভাব, এ তো ক্যাপ্টেনের দাপুটে গলা।
অংশু বলল, ”নেট রয়েছে দেখলাম, ভবানী বলগুলো নিয়ে চল। রবি, নিমু, শান্তু ব্যাট নিয়ে নেটে যা।” দিলুকে বলল, ”তুমিও চলো। থ্রো করবে, আমি ধরব।”
ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাইরের ভিড় দেখে দিলু তাজ্জব বনে গেল। স্কুল মাঠের এমন চেহারা সে দেখেনি। সারা মাঠ ঘিরে বসে রয়েছে নানান বয়সী মানুষ, আর কমপক্ষে স্কুলের প্রায় পাঁচশো ছেলে। প্রতাপ তাকে দেখে হাতছানি দিয়ে ডাকল। দাদু কোথায়? দিলু চেয়ারগুলোর দিকে তাকিয়ে পঞ্চাননকে দেখতে পেল।
”দেবুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দি। তোমাকেই ও আজ বিশেষ করে দেখবে।”
কাছেই দাঁড়িয়ে দেবু ঘোষাল। কম কথার মানুষ। দিলুর কাঁধে হাত রেখে বলল, ”মনে হচ্ছে না টেনশনে রয়েছ। টিমের সঙ্গে মিশে যাও। তুমি তো অংশুর টিমে, ও খুব ম্যাচিওরড ছেলে।”
আশিস ঘোষ দেবুর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। দিলুর সঙ্গে কোনও কথা বলল না। মাঠের একধারে অংশু গ্লাভস হাতে পরে একজনের ছোড়া বল ধরে ফেরত পাঠাচ্ছে। গোল হয়ে দাঁড়ানো পাঁচজনকে একটি ছেলে ক্যাচিং প্র্যাকটিস করাচ্ছে। মাঠের আর একদিকে একই ব্যাপার হয়ে চলেছে। ওরা ব্লু দল। স্কুল মাঠে সাদা জামা সাদা ট্রাউজার্স পরা গুটিতিরিশেক ছেলে ব্যাট—বল নিয়ে নেমেছে এমন দৃশ্য আগে কেউ কখনও দেখেনি। দুধঘাটে এটা বিরাট ঘটনা।
আশিস ঘোষ আর প্রতাপ দুই আম্পায়ার। ওদের সঙ্গে মাঠের মাঝে গিয়ে টস করল অংশু আর ব্লু—এর ক্যাপ্টেন আরিফ মহম্মদ। আরিফ টস জিতে ব্যাট নিল। দুটো টিম করেছে দেবু। রেড দলে রেখেছে যারা ভাল ব্যাট করে, ব্লু দলে রয়েছে ভাল বোলাররা। মাইকে ঘোষিত হল টসের ফল এবং দুটো টিমের নাম। ডি কর নামটা উচ্চচারিত হওয়া মাত্র মাঠ ঘিরে হর্ষধ্বনি উঠল।
অংশু ড্রেসিংরুমে ফিরে এসে দিলুর সঙ্গে সবার পরিচয় করিয়ে দিল। ”একে তোমরা আজই প্রথম দেখছ, এর নাম দুলাল কর। এই স্কুলেই পড়ে। ভাল ফিল্ড করে।” ছেলেরা একসঙ্গে বলে উঠল, ”হাই।”
দেবু দরজায় এসে বলল, ”মাঠে নামো, দেরি হয়ে গেছে পনেরো মিনিট। মনে রেখো চল্লিশ ওভারের খেলা। ফিল্ড রেস্ট্রিকশন থাকবে পনেরো নয়, তেরো ওভার।”
ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই ক্লাস টেনের দুটি ছাত্র দরজা বন্ধ করে পাহারায় দাঁড়াল। হেডসারের কড়া নির্দেশ, প্লেয়াররা ছাড়া আর কেউ ঘরে ঢুকতে পারবে না। মাঠে এসে অংশু দিলুকে বলল, ‘কোথায় দাঁড়াবে?”
”কভারে।” দিলু পছন্দ করে ওই জায়গায় ফিল্ড করতে।
ছিপছিপে লম্বা অমিতাভ দে মিডিয়াম পেসের বোলার। তার প্রথম বল লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে থেকে আউট সুইং করে অফ স্টাম্পে। ব্যাটসম্যান পিছিয়ে গিয়ে জোরে ড্রাইভ করল। দিলু কুঁজো হয়ে গুটিগুটি এগোচ্ছিল। বলটা তার ডান দিক দিয়ে যাচ্ছে। তার দিকে সে ঝাঁপিয়ে কোনওক্রমে বাঁ হাত বাড়িয়ে বলটা হাতে লাগাল। বলটা ছিটকে তিন মিটার গিয়ে থেমে রইল। নন স্ট্রাইকার কয়েক পা বেরিয়ে জমিতে পড়ে থাকা বলটার দিকে তাকিয়ে দোনামনা করে স্ট্রাইকারের দিকে মুখ ফেরাল। স্ট্রাইকার হাত তুলে তাকে যখন রান নিতে বারণ করছে ততক্ষণে দিলু ছুটে গিয়ে বলটা কুড়িয়ে ছুড়েছে বোলারের উইকেটে। স্টাম্প ছিটকে যাওয়ার পর নন—স্ট্রাইকারের ব্যাট স্পর্শ করল পপিং ক্রিজের পেছনের জমি। দু’হাত তুলে ফিল্ডাররা চিৎকার করে উঠতেই আঙুল তুলল আশিস ঘোষ। প্রথম বলেই ফিরে গেল একজন। অংশু ছুটে গেল দিলুর কাছে, অন্যরাও ছুটে এসে হাই ফাইভ করার জন্য ঠেলাঠেলি শুরু করল।
অংশু বলল ”স্টেশনে পোস্টার দেখে খুব তো হাসাহাসি করেছিলিস, তখন আমি কিন্তু হাসিনি, এইবার হাসব।”
পরের ছেলেটি মাঠে নামছে। ব্যাটসম্যান এগিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে লাগল দিলুকে দেখিয়ে। নবাগত ঘাড় নেড়ে জানাল সে বুঝেছে। বাকি পাঁচটা বল অফস্টাম্পের বাইরে দিয়ে গেল, অংশু ধরল।
দ্বিতীয় ওভার। বল করবে সুনন্দ। ব্যাটসম্যান বাঁ হাতি। বেঁটে, গাট্টাগোট্টা। তৃতীয় বলে গালিতে ক্যাচ, ফিল্ডারের হাত থেকে পড়ে গেল। পরের বলে কাট করে গালির পাশ দিয়ে দুটো রান নিল। পঞ্চম বলে সোজা ড্রাইভে চার রান, ওভারের শেষ বলে হল নো বল এবং গ্লান্স করে এক রান।
চারটে ওভার বিনা ঘটনায় কেটে গেল, রান এক উইকেটে চোদ্দো। পঞ্চম ওভারে বাঁ—হাতি সোজা ছয় মারল অমিতাভকে। দর্শকদের মধ্যে হইহই পড়ে গেল। ছাত্ররা ”উই ওয়ান্ট সিক্সার” স্লোগান তুলল। বাঁ—হাতি পরের বলে আবার ছয় মারল, বল পড়ল স্কুলের পাঁচিলের বাইরে। তুমুল চিৎকার নারকেল গাছের মাথা ছাড়িয়ে উঠে গেল। নিচু ক্লাসের ছেলেরা মাঠে ঢুকে নাচানাচি শুরু করতেই লাইফ সায়ান্সের সার ছুটে গেলেন, ”কোয়ায়েট, কোয়ায়েট” বলে ছেলেরা দৌড়ে দর্শকদের ভিড়ে মিশে গেল। পর পর দুটো ছয় আর দর্শকদের উচ্ছ্বাস তার মাথায় রক্ত চড়িয়ে দিয়েছে।
অমিতাভ পরের বল দিল গতি একটু কমিয়ে, আগের দুটো ছয় যেভাবে ব্যাট চালিয়ে মেরেছিল বাঁ—হাতি, এবারও সেইভাবে ব্যাট চালাল। বলটা দুটো নারকেল গাছের উচ্চচতায় উঠে একস্ট্রা কভার বাউন্ডারির দিকে যাচ্ছে এবং বলে চোখ রেখে দিলুও সমানে ছুটছে। সম্ভবত ওভার বাউন্ডারি হবে। বলের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিলু ঝাঁপাল, দু’পাক গড়িয়ে উঠে দাঁড়াল বল হাতে।
সারা মাঠ চুপ। যখন বুঝল দিলু ক্যাচ ধরেছে, ফিল্ডাররা ছুটে গেল, হাততালি দিয়ে চিৎকার করতে লাগল ‘দি ই লি ই প, দি ই লি ই প”। দিলু ফিরে তাকিয়ে চাঁদোয়ার নীচে চেয়ারে বসা দাদুকে দেখতে পেল ডান হাত মুঠো করে তুলে দাঁড়িয়ে।
ফিরে এসে উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়ে অংশু প্রথম স্লিপকে বলল, ”হ্যাঁ রে, কী বলছে ওরা শোন তো!”
প্রথম স্লিপ শুনে বলল, ”দিলীপ দিলীপ বলছে মনে হচ্ছে।”
অংশু বলল, ”দিলীপ কেন, ওর নাম তো দুলাল। দেবুদা তো তাই বললেন।”
প্রথম স্লিপ কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে বলল, ”নাম যাই হোক, ক্যাচটা কীরকম নিল দেখলি। পোস্টারে ঠিকই লিখেছে।”
”বুদ্ধি করে অমিতাভ স্লোয়ার দিল বলেই ক্যাচটা উঠল।” অংশু মনে করিয়ে দিল।
এর পরে যে ছেলেটি ব্যাট হাতে নামল সে এক হাস্যকর পরিস্থিতি তৈরি করল। অফের দিকে মারা কোনও বলেই সে রান নিতে রাজি নয়। সহজ সিঙ্গল থাকলেও সে ”নোও ও” হাঁক দিয়ে উলটোদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। চারদিকে হাসাহাসি শুরু হল, তার পার্টনার বিরক্ত হয়ে তার সঙ্গে কথা বলল। কিন্তু সে নিজের বিবেচনা বোধে অনড় রইল। তবে লং লেগে দুটো চার সে মেরেছে আর মিড উইকেট থেকে দুটো সিঙ্গল নিয়েছে।
অতিরিক্ত লেগবাই নিয়ে ব্লু—এর রান দু’ উইকেটে চল্লিশ, এগারো ওভারে। দুই ব্যাটসম্যানই উইকেটের গতি ও বাউন্সের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। বড় একটা পার্টনারশিপ ধীরে ধীরে তৈরি হওয়ার পথে। ওপেনার ছেলেটি অমিতাভর বদলি নতুন বোলার রাজীব জয়সোয়ালকে কাট করে সহজ রান আছে দেখে ”ইয়েস” বলে ছুটল। মাঝপথে গিয়ে দেখল নন স্ট্রাইকার বেরোয়নি। সে চেঁচিয়ে উঠল, ”রান, রান”।
দিলু বাঁ পাশে ঝাঁপিয়ে বলটা ধরে উপুড় হয়ে পড়ে ছিল। ধড়মড়িয়ে উঠে হাঁটু গাড়া অবস্থাতেই ডান হাতে ফাঁকা স্ট্রাইকার প্রান্তে বল ছুড়ে অফস্টাম্প ফেলে দিল। রাগ চাপতে চাপতে ছেলেটি মাঠ ছাড়ল। তেরো ওভার সম্পূর্ণ, চুয়াল্লিশ রান তিন উইকেটে, রানরেট প্রায় সাড়ে তিন।
অংশু এবার আনল তার অফ স্পিনার বুদ্ধদেব চ্যাটার্জিকে। মাঠে ফিল্ডার রাখার বাঁধাবাঁধি এখন আর নেই। অংশু ফিল্ডারদের ছড়িয়ে দিল গণ্ডির বাইরে। দিলুকে নিয়ে এল সিলি মিডঅফে ব্যাট থেকে দশ হাত সামনে। আর একজনকে রাখল ব্যাকওয়ার্ড শটলেগে ব্যাটসম্যানের পিঠের কাছে।
সামনে নাকের কাছে একজন পেছনে পিঠ ঘেঁষে একজন, ব্যাটসম্যানটি অস্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে তুলে তুলে দেওয়া চারটি বল পা বাড়িয়ে ঝুঁকে থামিয়ে দিল। একটা বল ব্যাট থেকে সামান্য উঠে গেছল, দিলু সামনে ঝাঁপিয়েও ক্যাচটা পেল না। হতাশ ব্যাটসম্যান ঠিক করল আক্রমণই আত্মরক্ষার সেরা উপায়। পঞ্চম বলটায় প্রচণ্ড জোরে ড্রাইভ করল। জমি থেকে ইঞ্চি দুয়েক ওপর দিয়ে বলটা পা ফাঁক করে ঝুঁকে থাকা দিলুর দিকে জ্বলন্ত গোলার মতো সোজা ধেয়ে গেল।
দু’হাতের তালু চকিতে নামিয়ে দিলু বলটা ধরে নিয়েই মাথার ওপরে ছুড়ে দিয়ে আবার লুফল। দু’জনকে রান আউট, দুটো ক্যাচ কোনওটাই সহজ ছিল না। হাতের ডায়েরি বইটা দেখতে দেখতে দেবু ঘোষাল পাশের লোককে চাপা গলায় বলল, ”এরকম অলরাউন্ড ফিল্ডার জীবনে দেখিনি! চারটে উইকেট তো ওরই।”
চতুর্থবার ছুটে যাওয়ার উৎসাহটা একটু স্তিমিত হয়ে গেল ফিল্ডারদের। রাজর্ষি দিলুর হাতের তালু দুটো পরীক্ষা করে ঠাট্টার সুরে বলল, ”দেখ, বলটারই হয়তো লেগেছে।”
বুদ্ধদেব বাংলার একজন প্রতিশ্রুতিমান স্পিনার, প্রথম ডিভিশান লিগে ফুলবাগান দলে খেলে। লেংথ আর লাইন বজায় রাখায় নিখুঁত, ফ্লাইটের হেরফের ঘটানোতেও ওস্তাদি দেখিয়েছে, স্পিন করানোর ব্যাপারটায় এখনও নিয়ন্ত্রণ আসেনি, টপ স্পিন আয়ত্ত করার জন্য খাটছে। ওর বলে উইকেটের আশেপাশে প্রচুর ক্যাচ ওঠে, সেগুলো ধরার লোক পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রথম চারজন আউট হয়ে গেছে। পাঁচ ও ছয় নম্বর ব্যাটসম্যান শূন্য রানে ব্যাট করছে। ব্লুয়ের উঠেছে চুয়াল্লিশ রান, হাতে রয়েছে ছয় উইকেট আর পঁচিশ ওভার। ব্লু দুশো রানে পৌঁছবার আশা করতে পারেই, যদি এই জুটিটা দাঁড়িয়ে যায়। জয়সোয়ালের বলে একটা চার আর তিনটি সিঙ্গল হল।
এবার বুদ্ধদেবের ওভার। সে দিলুকে আর একটু এগিয়ে ব্যাট থেকে ছ’হাত দূরে দাঁড়াতে বলল। তুলে প্রথম বলটা দিল, লেংথের একটু শর্ট, স্পিন ছিল না। ছেলেটি পিছিয়ে ব্যাট দিয়ে থামাল। এবারের বল আর একটু তুলে একই লেংথে, তবে স্পিন করিয়ে। আবার পিছিয়ে এসে ব্যাট দিয়ে আটকাল।
ব্যাটসম্যানের কপালে ফুটল দুশ্চিন্তার রেখা। সেটা লক্ষ করল দিলু। তার মনে হল, এবার ও ভুল করবে।
তৃতীয় বল আর একটু তুলে এবার গুডলেংথে। ব্যাটসম্যান তাড়াতাড়ি ঝুঁকে ডিফেন্সিভ ব্যাট পাতল। ব্যাট থেকে লোপ্পা হয়ে বল জমা পড়ল দিলুর হাতে। লাফিয়ে উঠে এবার দিলুই ছুটে গেল বোলারের কাছে, জড়িয়ে ধরল বুদ্ধদেবকে।
অংশু বলল, ”দুলাল দৌড়ে গিয়ে অ্যাবডোমেন গার্ড পরে এসো, আর আমার হেলমেটটা। সিনগার্ড নেই, থাকলে ভাল হত।”
দিলু ড্রেসিংরুমের দিকে ছুট লাগাল।
ঠিক সেই সময় বাইগাছি স্টেশনে ট্রেন থেকে নামল মলু। মোটরগাড়ি গ্যারাজে গেছে সেল্ফস্টার্টারের গোলমাল সারাতে। স্টেশনে টিকিট কালেক্টর থাকে না, মলু হাতের টিকিট হাতে নিয়ে বেরোতেই চোখে পড়ল লাল কালিতে লেখা পোস্টার—আসুন, দেখুন/বাংলার অলৌকিক ফিল্ডার দুধঘাট স্কুলের ছাত্র।
এর পরই মলুর চোখ সরু হল ও ভ্রূ জুড়ে গেল দিলীপ কর নামটা দেখে। পোস্টারের দিকে আধ মিনিট তাকিয়ে থেকে সে রিকশা স্ট্যান্ডে গিয়ে দেখল জায়গাটা ফাঁকা। কী ব্যাপার! একজন নাপিত একটি লোকের দাড়ি কামিয়ে দিচ্ছে। সে তাকেই জিজ্ঞেস করল, ”স্ট্যান্ডে রিকশা নেই। কী ব্যাপার, ধর্মঘট নাকি?”
খুর চালাতে চালাতেই লোকটি বলল, ”খালি যাচ্ছে আর আসছে, দুধঘাট ইস্কুল মাঠে আজ কিরকেট খেলা আছে না। একটু দাঁড়ান, এখুনি ফিরে আসবে।”
মলুকে মিনিট তিনেক দাঁড়াতে হল। ততক্ষণে পাঁচজন লোক জুটে গেল। তাদের কথা শুনে সে বুঝল, ওরাও স্কুল মাঠে যাবে।
”ছেলেটা নাকি সত্যিই অলৌকিক, যেখান—সেখান থেকে যা ছোড়ে তাই লেগে যায়।”
”আমিও তাই শুনলুম দুধঘাট স্কুলে পড়ে একটা ছেলের কাছে। রোজ ছুটির পর মন দিয়ে বল ছোড়া, ক্যাচ ধরা প্র্যাকটিস করে। দেখি গিয়ে কেমন অলৌকিক।”
”ছেলেটা হেডমাস্টার মশাইয়ের ভাগনা। উনি খুব উৎসাহ দেন খেলাধুলোয়।”
মলু স্তম্ভিত হয়ে শুনে গেল। ভ্যান রিকশা পর পর তিনটি এসে হাজির।
”দুধঘাট স্কুল, দুধঘাট স্কুল।” এর রিকশাওলা জানান দিল চেঁচিয়ে।
ওরা ছ’জনই উঠে বসল রিকশার তিনদিকে পা ঝুলিয়ে। স্কুলের ফটক থেকেই ভিড় শুরু হয়েছে। পাঁচিলের ওপর লোক দাঁড়িয়ে। মলু কোনওক্রমে ঠেলেঠুলে ঢুকে দাঁড়াবার জায়গা করে নিল। মাঠে চোখ বুলিয়ে সে খুঁজে পেল না দিলুকে। পাশে দাঁড়ানো ছেলেটিকে সে জিজ্ঞেস করল, ”আচ্ছা, দিলীপ কর খেলছে না?”
ছেলেটি খুবই অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, ”সে কী, এতক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করছেন দিলীপ খেলছে কিনা?”
অপ্রতিভ মলু বলল, ”আমি এইমাত্র এলাম।”
”খেলছে তো দিলীপই, পাঁচজনকে আউট করেছে। ওই তো হেলমেট পরা উবু হয়ে বসে।” ছেলেটি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে দিতেই চেঁচিয়ে উঠল ”কট কট। দিলু আবার ক্যাচ নিয়েছে।”
মলু দেখল, ব্যাটসম্যানের পায়ের কাছে এক হাত বাড়িয়ে দিলু শুয়ে, হাতে লাল রঙের বল। সারামাঠ চিৎকার করছে আর লাফাচ্ছে। চাঁদোয়ার পাশে স্ট্যান্ডে খাড়া করা ব্ল্যাকবোর্ডে একটি ছেলে ৫১—৫ মুছে খড়ি দিয়ে লিখল ৫৯—৬।
”এই নিয়ে ছেলেটা ছ’জনকে একাই ফিরিয়ে দিল, অবিশ্বাস্য প্রতিভা।” মলুর পেছনে কে একজন বলল।
”ছেলেটার সম্পর্কে যা সব শুনতাম মনে হত বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছে। এখন দেখছি একটুও বাড়ানো কথা নয়। অবিশ্বাস্য প্রতিভা বলছেন কী, অলৌকিক বলুন। অনেকদূর যাবে, বিরাট নাম করবে।”
মলু ধাঁধায় পড়ে গেল। এসব কথা দিলুর সম্পর্কেই কি বলা হচ্ছে? এত লোক উচ্ছ্বসিত হচ্ছে কি দিলুর জন্য? আশ্চর্য তো। দিলু অবিশ্বাস্য প্রতিভাবান, কই আমরা কেউ তো জানতুম না। মলু ভিড়ের মধ্যে পথ করে বাউন্ডারির ধারে গিয়ে দাঁড়াল।
অংশু বোলার বদল করে আবার আনল অমিতাভকে। দিলুকে বলল প্রথম স্লিপে দাঁড়াতে।
”হেলমেটটা রেখে আসি।”
”লাইনের ধারে টুয়েলফথম্যান রয়েছে, ওর হাতে দিয়ে এসো।”
হেলমেট খুলে হাতে নিয়ে দিলু বাউন্ডারি লাইনে দৌড়ে গেল। ছেলেটির হাতে হেলমেটটা দেওয়ার সময় চোখে পড়ল মা দাঁড়িয়ে তার দিকেই তাকিয়ে।
ছ্যাঁত করে উঠল তার বুকের মধ্যে। ধরা পড়ে গেছি। তারপরই দেখল, মা ডান হাতটা তুললেন, মুখে মা—দুর্গার মতো একটা হাসি।
আশীর্বাদ। দিলু মাথাটা হেলিয়ে হাসল, তারপর ছুটে এসে দাঁড়াল স্লিপে। অমিতাভ প্রথম বলটা ঠুকে দিতে গিয়ে শর্ট পিচে ফেলল। কাঁধের কাছে ওঠা বলটা মারার জন্য ব্যাটসম্যান সপাটে ব্যাট ঘোরাল। বল ব্যাটের কানায় লেগে দিলুর মাথার অনেক ওপর দিয়ে থার্ডম্যান অঞ্চলে উঠে গেল। দিলু ক্যাচ নেওয়ার জন্য দৌড়চ্ছে, থার্ডম্যানে ফিল্ড করছে যে সেও দৌড়ে আসছে। দু’জনে মুখোমুখি হয়ে থমকে দাঁড়াল। বলটা তাদের মাঝখানে পড়ে লাফিয়ে উঠতেই দিলু বল ধরে নিয়েই ঘুরে গিয়ে ছুড়ল। অংশু দিলুর দিকে মুখ করে, উইকেটের পেছনে ছোড়া বলটা ধরার জন্য। ব্যাটসম্যানরা দ্বিতীয় রানটা নিচ্ছে, রান নেওয়া সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই অংশুর গায়ে ছিটকে এসে লাগল স্টাম্পের একটা বেল। ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা হল ৭১—৭।
মলু এধার—ওধার তাকাতে—তাকাতে দেখতে পেল জেঠুকে। পাশের চেয়ারে বসা এক পাকাচুলকে মাথা নেড়ে কী বোঝাচ্ছেন। মলু ভিড় ঠেলে এগোতে লাগল।
অংশু ঠাট্টা করে দিলুকে বলল, ”সাতটা তো হল, বাকি তিনটে আর পড়ে থাকে কেন, নিয়ে ফেলো।”
দিলু মাথা চুলকে বলল, ”স্পিনার আসুক, তখন দেখা যাবে।”
দেখা অবশ্য হল না। চার ওভার পর আবার বুদ্ধদেব বল করতে এল। তার প্রথম ওভারেই দুটো চার, একটা দুই নিয়ে ব্লু—র ইনিংস একশোয় পৌঁছল একত্রিশ ওভারে। পাঁচ আর আট নম্বর ব্যাটসম্যান এখন ক্রিজে। আট নম্বর বেপরোয়া হয়ে ব্যাট চালাচ্ছে। সুনন্দকে দুটো ছয় মারার পর দুটো ডট বল, তারপরের বলটায় বোল্ড হয়ে গেল। নবাগত প্রথম বলেই পিছিয়ে এসে ডাইভ করেই পিছলে পড়ল। ডানপায়ের গোড়ালি লাগল অফ স্ট্যাম্পে, বেল পড়ে গেল। শেষ ব্যাটসম্যান লাজুক মুখে এল। সে ব্যাট করতে পারে না সবাই জানে এবং সেটা সে জানিয়েও দেয় ঝাড়ু দেওয়ার মতো ব্যাট চালিয়ে। ঝাড়ু মেরে এক রান পেয়ে সে মস্ত বড় করে হেসে নিল। আশাতীত সৌভাগ্যে।
পাঁচ নম্বর তখনও নট আউট চল্লিশ রানে। তার লক্ষ্য একটি অর্ধশত রান পাওয়ার, হাতে রয়েছে চল্লিশ বল। ঝাড়ুদারকে বাঁচিয়ে রেখে আরও দশটি রান তাকে করতে হবে, যেভাবেই হোক বোলিং থেকে ওকে সরিয়ে রাখতে হবে। ওভারের বাকি আরও চার বল। শেষ বলে একটা রান নিয়ে ওধারে যাবে ঠিক করে সে তিনটে বল থামাল। ঝাড়ুদারকে মাথা নেড়ে ইশারায় বলল, এইবার রান নিতে তৈরি হও।
বুদ্ধদেব বল করার আগে অংশু ব্যাটসম্যানের উদ্দেশ্যটা বুঝে ফিল্ডারদের কাছে নিয়ে এল। দুই বা চার রান যদি পায় পাক, এক বা তিন রান যেন না পায়। বুদ্ধদেব বলটা করল আচমকাই মিডিয়াম পেসে, প্রায় ইয়র্কার। পাঁচ নম্বর তাড়াতাড়ি ব্যাট নামাল। ব্যাটে লেগে বল পিচের মাঝখানে এসে থেমে গেল। এদিকে দু’জনেই সেকেন্ড তিনেক ইতস্তত করে রান নিতে ছুটল। বুদ্ধদেব ছুটে এসে বল কুড়িয়েই ছুড়ল। অংশু বলটা ধরেই উইকেট ভেঙে দিল। ঝাড়ুদার রান আউট। ব্লু—র ইনিংস শেষ একশো তেরো রানে।
আম্পায়ার প্রতাপ লাহিড়ি আঙুল তোলামাত্রই স্কুলের প্রায় পঞ্চাশটি ছেলে রে রে করে মাঠে ঢুকে পড়ল। দিলুকে একজন কাঁধে বসাবার চেষ্টা করে পারল না। দু’জন চেষ্টা করল পাঁজাকোলা করতে, পারল না। অবশেষে ছ’জন তাকে ধরে মাথার ওপর লম্বা করে তুলল এবং সেই অবস্থায় বহন করে নিয়ে গেল ড্রেসিংরুমে। দিলু মুখ ফিরিয়ে দেখার চেষ্টা করল মা আর দাদুকে। ভিড়ে তারা আড়াল পড়ে গেছে, সে দেখতে পেল না।
.
ডেসিংরুমে সুনন্দ বলল, ”ভাগ্যিস এখানে খেলতে এসেছি তাই এমন একটা দৃশ্য দেখার সুযোগ হল।”
দেবাংশু ফিসফিস করে তার কানে বলল, ”আর এমন ফিল্ডিং দেখার কথাটাও বল।”
”নিশ্চয় বলব। তবে এখানে নয়, কলকাতায় ফিরে।”
অংশু বলল দিলুকে, ”বাকি তিনটে আর হল না। বিজয় মার্চেন্টে আমাদের প্রথম খেলা কটকে ওড়িশার সঙ্গে, সেখানে আশা করব এক ইনিংসে দশটাই।”
দিলু বিভ্রান্ত স্বরে বলল, ”বেঙ্গল টিমে আমি। কী এমন করলুম?”
অংশু বলল, ”দুশো তেরোটাকে একশো তেরো করে দিয়েছ। ব্লু টিমে যেসব ব্যাটসম্যান রয়েছে তাদের চারজন লাস্ট উইকে ফিফটি করেছে, আজ দশের বেশি করেনি। তুমি টিমে আসছই। কত নম্বরে ব্যাট করবে?”
”যতয় পাঠাবে।”
”দেবুদার সঙ্গে কথা বলে দেখি।”
হরিসাধন এসে তাড়া দিলেন লাঞ্চ খাওয়ার জন্য। দুটো টিম দোতলায় টিচার্স রুমে গেল। চারটে টেবল জোড়া দিয়ে তাতে রাখা হয়েছে চিকেন স্টু, কলা, স্লাইসড পাউরুটি, স্যালাড আর ছানার জিলিপি। প্রত্যেকে প্লেট হাতে ইচ্ছেমতো স্যালাড, পাউরুটি ও চিকেন তুলে নিয়ে দেওয়ালের ধারে রাখা চেয়ারে বসে খেতে শুরু করল।
হরিসাধন বললেন, ”আয়োজন খুবই সামান্য, যতটুকু আমাদের সাধ্য—”
তাকে হাত তুলে থামিয়ে আরিফ বলল, ”ক্লাব ম্যাচে আমাদের এমন খাওয়া জোটে না, চিকেন তো ভাবাই যায় না!”
অংশু বলল, ”এখুনি তো মাঠে নামতে হবে, বেশি খেলে নড়াচড়া করতে পারব না। এইরকম হালকা খাবারই ভাল।”
ছেলেদের খাওয়া দেখে হরিসাধন বিষণ্ণ হলেন। প্রচুর পাউরুটি আর স্টু পড়ে রইল। ওরা শুধু স্যালাড খেল, বেরিয়ে যাওয়ার সময় প্রত্যেকে হাতে নিল একটা করে কলা। তিনি এবং গণেশ নাগ সবচেয়ে দুঃখ পেলেন ছানার জিলিপির দুটো প্লেট দেখে। দেওয়া হয়েছিল পঞ্চাশটা, নিঃশেষ হলে আরও পঞ্চাশটা স্টিলের ট্রে—তে চটপট টেবলে আনার জন্য রেডি করে রাখা আছে, তাও ফুরিয়ে গেলে আরও পঞ্চাশটা আসবে। কিন্তু প্রথম পঞ্চাশটাই ফুরোল না। দেখা গেল গোটা বারো প্লেটে পড়ে রয়েছে।
”সার আপনি বলেছিলেন ছোটরা মিষ্টি খেতে ভালবাসে।” গণেশ নাগ মাথা চুলকোলেন।
”শ্রাদ্ধ আর বিয়েবাড়িতে সাপ্লাই দিয়ে দিয়ে খাওয়ার একটা হিসেব আপনার মাথায় বদ্ধমূল হয়ে গেছে—মাথাপিছু পাঁচটা। আপনাকে বলেছিলুম ওরা খেতে নয়, খেলতে আসছে। এখনকার ছেলেরা ভীষণ হেলথ কনশাস মনে রাখবেন।”
”সার, মিষ্টি খাওয়ানোর প্রস্তাবটা তো আপনারই ছিল।” ভয়ে ভয়ে বললেন গণেশ নাগ।
”বলেছি তো কী হয়েছে। যত জিলিপি রয়ে গেছে স্কুলের যে সব ছেলে কাজ করছে তাদের একটা করে দিয়ে দিন।”
ব্যাটিং অর্ডার তৈরি করেছে দেবু ঘোষাল। দিলুকে রেখেছে পাঁচ নম্বরে, তিনজন আউট হলে নামবে। অংশুকে ঘরের বাইরে ডেকে নিয়ে সে বলল, ”তখন স্পিনার এসে যাবে, খেলাও তখন কুড়ি ওভারে পৌঁছবে। মনে রাখিস চল্লিশ ওভারের খেলা, কুড়ি থেকে তিরিশ ওভার—ওই সময়টায় এক—দুই করে রান নিয়ে ওভারে ছ’টা করে রান, দেখি ছেলেটা ওইসময় কেমন ব্যাট করে।”
ঘরে ফিরে এসে অংশু ব্যাটিং অর্ডার পড়ে শোনাল। প্রথম চারজন প্যাড পরতে শুরু করল। দিলু তাকিয়ে রইল ওদের ব্যাট প্যাড গ্লাভসের দিকে। সবই নিজেদের, দেখেই বোঝা যায় বেশ দামি। নিজস্ব সরঞ্জাম বলতে জুতো জোড়া ছাড়া তার কিছুই নেই। সবই স্কুলের। কমদামি প্যাডজোড়া ময়লা, বাঁশের কঞ্চি আর তুলো দিয়ে তৈরি, ওজনে ভারী। প্যাডের একটায় ওপরের বাকল নেই, দুটো বাকলে টাইট করে পায়ে ধরে রাখা যায় না, একটু ছুটলেই প্যাড নেমে আসে। অথচ এদেরগুলো কী হালকা, বাকল দেওয়া নয়। তিনটে পট্টি চেপে লাগিয়ে দিলে আঠার মতো এঁটে থাকে। গ্লাভসেও কবজির কাছে জড়ানো ওই আঠার মতো পট্টি। আর ব্যাট।
দিলু অংশুর ব্যাটটা তুলে ওজনটা অনুভব করতে করতে পাশে বসা সুনন্দকে হালকা চালে জিজ্ঞেস করল, ”ব্যাটটার দাম কত?”
সুনন্দ দশ নম্বরে ব্যাট করবে। দেরি আছে মাঠে নামতে, হয়তো নামতেও হবে না। তার আগেই একশো চোদ্দো রান উঠে যাবে। জুতোর ফিতে খুলছে মুখ নিচু করে। দামটা বলল, কিন্তু দিলু স্পষ্টভাবে শুনতে পেল না।
”কত বললে?”
”সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা।” সুনন্দ মুখ তুলে একটু চড়িয়ে বলল।
দিলু বলল, ”দিশি ব্যাটের দামও কি এইরকম?”
সন্দীপ একটু অবাক হয়ে বলল, ” এটা তো দিশি ব্যাটই। আমাদের কাশ্মীরি উইলোয় তৈরি পি ডি এম বা লারসন তো সাহেবরাও কিনছে।”
দিলু ব্যাটটা সযত্নে বেঞ্চের ওপর রেখে দিয়ে স্কুলের কানা ভাঙা ব্যাটটা দুই হাঁটুর মধ্যে চেপে ধরল। দাম জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে আর তার নেই।
ভরত আর কমলেশ দুই ওপেনার ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, দু—তিনজন বলে উঠল, ”বেস্ট অব লাক।” দিলু ঘর থেকে বেরিয়ে এসে লম্বা করিডরে দাঁড়াল। এখান থেকে দুটো উইকেটই দেখা যায়। ওয়ান ডাউন রাজর্ষি তার পাশে এসে দাঁড়াল।
”দুলাল, তুমি কি এখানেই থাকো?”
”হ্যাঁ, কেন বলো তো!” দিলু অবাক হল প্রশ্নটায়।
”অ্যালবার্ট স্কোয়ারে বন্ধু পরিষদে খেলতুম, তখন তোমায় দেখেছি। তোমার বাড়ি তো মৌলালিতে। তা হলে এখানে কেন?”
”এখানে মামার বাড়ি। পরীক্ষায় ফেল করে এখানে এসে স্কুলে ভর্তি হয়েছি।”
দিলুর সরল স্পষ্ট উত্তর রাজর্ষির মনে দাগ কাটল। ‘ফেল করে’ কথাটা কত সহজে বলল। রাজর্ষিও সহজ ভাবে বলল, ”তোমার ব্যাটটা তো দেখলুম কানাভাঙা, একটা ভাল ব্যাট কিনে নাও।”
কত সহজে বলে দিল ‘কিনে নাও।’ নিশ্চয় পয়সাওলা ঘরের ছেলে। দিলুর বলতে ইচ্ছে করল, দামি ব্যাট দিয়ে খেললেই কি দামি ইনিংস খেলা যাবে?
রাজর্ষি মাঠের দিকে তাকিয়ে। ভরত গার্ড নিল প্রতাপ লাহিড়ির কাছ থেকে। বোলিং শুরু করবে আরিফ। প্রথম বল ভরত ব্যাট তুলে ছেড়ে দিল, দ্বিতীয় বলটায় আধা ফরওয়ার্ড খেলল, ব্যাট—প্যাডের মধ্য দিয়ে বলটা গলে এসে অফ স্টাম্প ফেলে দিল।
দিলুর দিকে তাকিয়ে হেসে রাজর্ষি এগোল মাঠে নামার জন্য। ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা হল ০—১। দিলুর পাশ দিয়ে ভরত ড্রেসিংরুমে ফিরে এল। রাজর্ষি প্রথম বলেই পিছিয়ে খেলে বলটা ফস্কে এল বি ডবলু হল। রেড দল ০—২। দিলু ঘরে এসে প্যাড পরা শুরু করল। দেবাংশু নামল ব্যাট করতে। মাঠ ঘিরে সাড়াশব্দ নেই। প্রথম ওভারেই পড়েছে দুটো উইকেট দু’বলে। দর্শকদের মধ্যে কে একজন বাঁজখাই গলায় চিৎকার করল, ”হ্যাটট্রিক চাই।”
লোকটির দাবি পূরণ করতেই যেন আরিফ কপিলদেবের মতো অসাধারণ আউটসুইং করিয়ে বলটা ফেলল অফ স্টাম্পে। দ্বিতীয় স্লিপ গোড়ালির কাছে ক্যাচটা ধরেই গড়িয়ে পড়ল।
হ্যাটট্রিক প্রথম ওভারেই। রেড ০—৩। দুধঘাটে হ্যাটট্রিক একটা বিরাট ঘটনা। দিলুকে ব্যাট হাতে নামতে দেখে বিশাল অভ্যর্থনা গাছের কাকগুলোকে ভয় পাইয়ে উড়িয়ে দিল।
ওভারের দুটো বল বাকি। দিলু আউট সুইঙ্গারগুলো দেখে নিয়ে ছেড়ে দিল। কানা ভাঙা ব্যাট দিয়ে সুইং করা বল খেলতে যাওয়া মানেই বিপদ ডেকে আনা, এটা সে বুঝে গেছে। দ্বিতীয় ওভার, কমলেশ খেলবে অরুণ মেহটার বলে। পাঁচটা বল খেলল একটা বাই বাউন্ডারি, মিড উইকেট থেকে দুই নিয়ে কমলেশ মিড অফে ক্যাচ তুলে ফিরে গেল। রেড ৬—৪। ছয় রানে চার উইকেট পড়ে গেছে। ক্রিজে এল অংশু।
”দুলাল ডাউন দ্য শাটার, ঝাঁপ ফেলে দাও।” অংশুকে নড়বড়ে দেখাল। প্রথম ওভারেই এতবড় ধাক্কা পেলে কোন অধিনায়ক না নার্ভাস হয়ে পড়বে।
পরের ওভারে বল করতে এল আদিত্য মজুমদার। ইনসুইং করায়, মাঝে মাঝে দেয় লেগকাটার। অংশু মারার বল মারল না, সিঙ্গল রান নিতেও রাজি নয়। মেডেন ওভার।
হ্যাটট্রিক করে আরিফ উৎসাহে ফুটছে। তার দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলটা ওভার পিচ। দিলু স্ট্রেট ড্রাইভ করল। ফলো থ্রুতে আরিফ বলটা থামাতে পারল না। চার হল। অংশু কপাল কুঁচকে শুধু তাকাল। পরের বলে দিলু আবার স্ট্রেট ড্রাইভে বাউন্ডারিতে বল পাঠাল। তৃতীয় বলটা আরিফ বাম্প করাতে চেষ্টা করল, দিলুর কাঁধের কাছে বল উঠতেই সে পুল করল। মিড উইকেটের ওপর দিয়ে ছয় হল। আরিফকে প্রথমে অবাক, তারপর নিজের ওপর বিরক্ত; এখন উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। চতুর্থ বল গুড লেংথে, কিন্তু সুইংটা বড় হয়ে গেল। দিলু স্কোয়ার ড্রাইভ করল। পয়েন্ট ও কভারের মাঝ দিয়ে বাউন্ডারিতে যাওয়া বলের দিকে সবাই তাকিয়ে, দিলু তাকিয়ে তার ব্যাটের দিকে। ভাঙা জায়গাটা থেকে ছোট্ট একটা কুচি খসে গেছে।
মাঠ ঘিরে পাগলামির স্রোত বইছে। বল বাউন্ডারিতে পৌঁছলেই বাচ্চচা ছাত্ররা মাঠে ঢুকে নাচানাচি করছে। লাইফ সায়ান্স মাস্টারমশাই হাল ছেড়ে দিলেন। হরিসাধন অতিকষ্টে নিজেকে সংযত রেখেছেন। সবাই জানে দিলু তাঁর ভাগ্নে, চিৎকার করা বা দু’হাত তুলে অঙ্কের বরদাবাবুর মতো লাফালে পক্ষপাতিত্ব দেখানো হয়ে যাবে। তবে আরিফের হ্যাটট্রিক হতেই তিনি দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি দিয়েছেন। মলু, যে ক্রিকেটের কিছুই বোঝে না, সেও চারপাশের গনগনে উত্তেজনার আঁচে ঝলসে মুখ লাল করে ফেলেছে। ফিসফিস করে সে পাশে বসা জেঠুকে বলল, ”দিলুটা করছে কী?”
পঞ্চাননও চাপা স্বরে বললেন, ”মাকে বলছে তুমি আমাকে চেনোনি, বোঝোনি। আমি তোমার সেরা ছেলে।”
আরিফের পঞ্চম বলটা সোজা নারকেল গাছের পাতায় গিয়ে লাগল। দিলু চোখের সামনে ব্যাট তুলে দেখল, ভাঙা জায়গাটায় চিড় ধরেছে, আবার একটু কুচি খসে পড়বে। অংশু এগিয়ে এল। দিলুর হাত থেকে ব্যাটটা নিয়ে নিজের ব্যাট তার হাতে দিয়ে হাসল। দিলু ইতস্তত করে বলল, ”দামি ব্যাট। যদি ভেঙে যায়?”
”ভাঙুক। এর চেয়েও দামি টিমের উইন।”
কথাটা শুনেই ঝিনঝিন করে উঠল দিলুর সারা শরীর। দু’বার ব্যাটটা হাতে নাচিয়ে সে স্টান্স নিল। আরিফ এবার জোরে ফুল পিচে বল করল সোজা কাঁধের সমান উচ্চচতায়। আশিস ঘোষ নো বল ডাকল কিন্তু দিলু বলটাকে পুল করে ছয় মেরে দিল লং লেগ বাউন্ডারিতে। এক এবং ছয় রান হল। এক ওভারে একত্রিশ রান নিল দিলু।
অংশু এগিয়ে এল কথা বলতে। দিলু বলল, ”শাটারটা আটকে গেছে, ডাউন করতে পারছি না।”
”আরিফ শ্যাটারড। আর ও বল করবে না মনে হচ্ছে। শাটারটা তুমি আর একটু ওপরে তোলো।”
হাতে দুটো ব্যাট নিয়ে কমলেশ মাঠে ছুটে এল। অংশু একটা বেছে নিয়ে দিলুর ভাঙা ব্যাটটা তার হাতে দিল। আদিত্যর প্রথম বলে পয়েন্ট থেকে অংশু একটা রান নিল। তার রান এবং এই রানটাতেই সে রইল যখন রেড টিমের টোটাল চার উইকেটে সাতান্নয় পৌঁছল। দিলুর পঞ্চাশ, একুশ বল খেলে। একস্ট্রা হয়েছে ছয় রান।
দিলু ব্যাটটা চাঁদোয়ার দিকে লম্বা করে দেখিয়ে দু’বার ঝাঁকাল। পঞ্চানন মলুকে বললেন, ”তোকে দেখাচ্ছে। ওঠ, উঠে হাত নাড়।” মলু সদ্য ঘুমভাঙার মতো ধড়মড়িয়ে উঠে দু’হাত নাড়তে লাগল। পেছন থেকে কে বলে উঠল, ”দিলুর মা।” লোকে তাকে দিলুর পরিচয়ে চিনেছে। মলুর কান গরম হয়ে উঠল।
শতরানে দিলুর পৌঁছতে যখন পনেরো রান বাকি, জয়ের জন্য রেডের তখন দরকার ষোলো রান। আগ্নেয়গিরির মতো মাঠ তখন ফুটছে। হবে কি হবে না। বাজি ধরা শুরু হয়ে গেছে।
”বলছি হবে। সেঞ্চুরি হবেই। বাজি?” এক যুবক বলল, পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে। ”যশোহরের ছানার জিলিপি যত প্যারিস।”
”গেল গেল গেল।” আঁতকে উঠল আর এক যুবক। দিলু ওভারের শেষ বলে এক রান নিচ্ছিল, শর্ট লেগে বল ঠেলে দিয়ে। অংশু দৌড় শুরু করে দেখল, এক ফিল্ডার বল কুড়িয়েছে। অংশু থমকে দাঁড়িয়ে চে�চিয়ে বারণ করল রান না নেওয়ার জন্য। কিন্তু দিলু তখন পিচের মাঝামাঝি এসে গেছে। ফিল্ডার বল ছুড়ল উইকেটকিপারকে আর অংশু অতিক্রম করল দিলুকে। তখনই উইকেটকিপার তিনটি স্টাম্প হাতের ধাক্কায় ফেলে দিল। দিলুর দিকে তাকিয়ে অংশু হাসল মাত্র, তারপর হাঁটা শুরু করল। সারা মাঠ হাততালি দিয়ে তার স্বেচ্ছায় এই রান আউট হওয়াকে তারিফ জানাল।
একটা কিছু ঘটে গেল দিলুর মধ্যে। পরের ওভারে সে পেল এক বাঁ হাতি স্পিনারকে। প্রথম চারটে বলে সে অন আর অফে ড্রাইভ করে তিনটি চার এবং সোজা একটা ছয় মেরে রেড—এর ইনিংস একশো পনেরো রানে পৌঁছে দিল। তার শতরান হল চল্লিশ বলে।
এরপর আবার দেখা গেল সেই দৃশ্য। দিলুকে ঘাড়ে শুইয়ে মাঠ থেকে ড্রেসিংরুমে নিয়ে যাওয়া। তবে এবার তাকে বহন করল অংশুর ক্যাপ্টেন্সিতে রেড দলের ছেলেরা।
পাঁচ মিনিট পর ড্রেসিংরুমের বাইরে মলু, পঞ্চানন আর প্রতাপ। ব্যাটটা হাতে নিয়ে দিলু বেরিয়ে এল। মুখে একগাল হাসি, কপালে ঘাম, এলোমেলো চুল আরও এলোমেলো।
মলু হাতব্যাগ খুলে চিরুনি বের করল।
”কাছে আয়।”
দিলু এগিয়ে এসে মাথা নিচু করল। আঁচড়ে দিতে দিতে মলু বলল, ”চুল তো নয় কাকের বাসা, এবার ন্যাড়া করে দোব।” আঁচল দিয়ে দিলুর মুখের ঘাম মুছে দিল। ব্যাটটা দেখে বলল, ”কার ব্যাট?”
”অংশুর। জানো মা, এটার দাম সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা!”
”অ। তরুণ করের ছেলে আর কখনও যেন পরের ব্যাট নিয়ে না খেলে।” মলু গম্ভীর কঠিন গলায় কথাটা বলে প্রতাপের দিকে তাকাল। ”ব্যাটম্যাট কোনটে ভাল কোনটে মন্দ, আমি বুঝি না। আপনি কাল আমাদের বাড়িতে এসে আমাকে দোকানে নিয়ে যাবেন। ব্যাটের সঙ্গে আর কী কী লাগবে তারও একটা লিস্টি করে আনবেন। ব্যাট লিখবেন দুটো। একটা ভেঙে গেলে অন্যটায় খেলবে। পরের ব্যাট নিয়ে খেলা উচিত নয়।”
প্রতাপ ঘাড় নাড়ল। মলু এবার পঞ্চাননের দিকে তাকাল। ”জেঠু, তুমিই হচ্ছ পালের গোদা। লেখাপড়া করতে তোমার কাছে রাখলুম, আর তুমি—!”
মলু আঁচলে চোখ মুছল।
মিনু চিনুর ট্রফি
কলকাতা থেকে আটাশ মাইল উত্তরে গঙ্গার পশ্চিম তীরে, লঞ্চঘাট থেকে আধমাইল, জি টি রোড থেকে সিকি মাইল আর রেল স্টেশন থেকে এক মাইল দূরের মহাদেবপুর উপনগরীতে প্রায় চার হাজার লোকের বাস। মহাদেবপুর গড়েছে মহাদেব জুট অ্যান্ড টেক্সটাইল মিলস, সংক্ষেপে যাকে বলা হয় এম জে টি এম, তারই প্রতিষ্ঠাতা—মালিক মহাদেবদাস মাধোকিয়া। এই উপনগরীতে আছে দুটো বাজার, ছোট একটা হাসপাতাল, স্কুল, মন্দির, অডিটোরিয়াম, লাইব্রেরি, পাওয়ার হাউস, খেলার মাঠ, ছোটদের পার্ক, অফিসারদের ক্লাব—যেখানে আছে এক বিঘৎ ঘাস গজিয়ে যাওয়া একটা টেনিস কোর্ট, আর দুটি ক্যারম খেলার বোর্ড। মহাদেবপুর মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। এখানকার অনেক লোকেরই মোটরগাড়ি আছে, দরকার হলে চট করে কলকাতা ঘুরে আসতে পারে।
মহাদেবপুরের পৌরব্যবস্থা এম জে টি এম—এর নিজস্ব। তাদেরই খরচে এবং তদারকিতে এর দেখভাল করা হয়। এজন্য আলাদা একটা বিভাগ আছে এবং তার সর্বোচ্চচ কর্তা হলেন তন্ময় বসুমল্লিক। ইনি ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, বলিষ্ঠ, দীর্ঘদেহী, চোখা নাক মুখ। দূরপাল্লার সাঁতারে নাম ছিল এবং অর্থনীতির এম এ। কলকাতা পৌরসভায় বছর চারেক চাকরি করে ভারত স্বাধীন হওয়ার দু’বছর পরই মহাদেবপুরে আসেন।
তন্ময় যেমন হাসিখুশি, সরল, তেমনই গোঁয়ার প্রকৃতিরও। সাবেকি রীতিনীতি মেনে চলতে অভ্যস্ত এমন পরিবারে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা; তিনি উদার মনের মানুষ, বড় চাকরি করলেও মেলামেশায় কোনও বাছবিচার করেন না। তাঁর স্ত্রী তপতী ইলাহাবাদের মেয়ে। বাবা সেখানকার নামী উকিল ছিলেন। বাড়িতে টেনিস কোর্ট ছিল। ভাইদের সঙ্গে বাড়িতে, পরে কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে টেনিস খেলেছেন। চ্যাম্পিয়ানের তিন—চারটে ট্রফিও পেয়েছিলেন। সাইকেল চালিয়ে বন্ধুর বাড়ি যাওয়ার সময় একটা খ্যাপা ষাঁড়ের শিং থেকে বাঁচার জন্য তপতী রাস্তার পাশের নালায় সবেগে নেমে যাওয়ায় তাঁর ডান পায়ের গোড়ালির হাড় কয়েক টুকরোয় পরিণত হয়। দু’বার অপারেশনের পর পা যৎসামান্য ছোট হয়ে যায় বলে একটু জোরে হাঁটলেই ধরা পড়ে তিনি খোঁড়া।
স্বামী যতটা কালো, তপতী ততটাই ফরসা। ক্লাবে অনেকেই রসিকতা করে ওঁদের ‘পূর্ণিমা—অমাবস্যা’ বলে ডাকে। শুনে ওঁরা দু’জন হাসেন। স্বামীর মতো তপতীও জেদি কিন্তু গোঁয়ার নন। কোনও লক্ষ্য একবার স্থির করে ফেললে যতক্ষণ না তা পূরণ হচ্ছে, হাল ছাড়েন না। গোড়ালি ভাঙার পর বগলে ক্রাচ দিয়ে তাঁকে চলাফেরা করতে হত। বাড়ির সবাই ধরে নেয় আজীবন এইভাবেই তাঁকে চলতে হবে। কিন্তু মনের জোর আর স্বাভাবিকভাবে হাঁটার জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা, এই দুইয়ে মিলে তাঁকে এমনই জেদি করে তোলে যে, দিনের পর দিন ব্যায়াম ও মালিশ করে এক বছরের মধ্যেই ক্রাচের ওপর নির্ভরতা থেকে তপতী নিজেকে মুক্ত করে নেন।
এই বসুমল্লিক দম্পতি নিজেরা খেলার চর্চা এক সময় করেছেন, খেলা ভালবাসেন। এঁদের দুই ছেলে, মৃন্ময় আর চিন্ময়। দু’জনেই পড়ে মহাদেবপুরের এম ডি এম স্কুলে, মৃন্ময়ের ক্লাস থ্রি, চিন্ময়ের ক্লাস ওয়ান। আজ ওদের স্কুলের বাৎসরিক স্পোর্টস।
খাওয়ার টেবলে তন্ময় টোস্টে জেলি মাখাতে মাখাতে হাতঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে হাঁক দিলেন, ”মিনু, চিনু, হারি আপ। ঠিক সাতটায় আমাদের পৌঁছতে হবে। কুইক ব্রেকফাস্ট শেষ করো, আর সময় নেই।”
”বাবা, আমি রেডি।” বলতে বলতে শোওয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এল মিনু। নয় বছর বয়স কিন্তু দেখতে দশ—এগারোর মতো। মায়ের মতো অতটা না হলেও, ফরসা, স্বাস্থ্যবান, চটপটে। সাদা হাফপ্যান্টের মধ্যে গোঁজা সাদা গেঞ্জি, সাদা মোজা, সাদা কেডস। চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। তন্ময় স্নেহভরে বড় ছেলের দিকে তাকালেন, চোখে ফুটে উঠল তারিফ। এক্কেবারে স্পোর্টসম্যানের মতো দেখাচ্ছে!
”বোস।” তিনি তাঁর পাশের চেয়ারটা দেখালেন। টোস্ট প্লেটে রেখে সেটা মৃন্ময়ের সামনে এগিয়ে দিয়ে তন্ময় বললেন, ”আজ কিন্তু একটার বেশি নয়। এর সঙ্গে এক গ্লাস দুধ আর একটা কলা। পেট হালকা থাকলে জোরে দৌড়নো যায়… চিনু কী করছে? চিনু হারি আপ। … দ্যাখো তো দেরি করছে কেন!”
তন্ময় জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন টেবলের উলটো দিকে। তপতী মন দিয়ে সেদ্ধ ডিমের খোসা ছাড়াচ্ছেন। কথা না বলে তিনি উঠে গেলেন ছেলেদের ঘরে।
বিব্রত মুখে চিনু তাকাল মায়ের দিকে। বাঁ হাতের মুঠোয় পেটের কাছে প্যান্টটা ধরা।
”কী হল?” তপতী ভ্রূ কুঁচকে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলেন। ”প্যান্ট অমন করে ধরে আছিস কেন?”
”বোতাম।” ভয়ে সিঁটিয়ে যাওয়া স্বর চিনুর।
”বোতাম!”
তপতী প্যান্টধরা চিনুর হাতটা টানতেই সেটা হাঁটুর কাছে নেমে যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি সেটা ধরে চিনু টেনে তুলল। আধুলি মাপের একটা সাদা বোতামের ভাঙা অংশ প্যান্টে আটকে রয়েছে।
”হাতে আর সময় নেই, ব্রেকফাস্ট করেই বেরোতে হবে, আর এখন কিনা তোর প্যান্টের বোতাম ভাঙা… ইচ্ছে করছে তোকে একটা…।” ডান হাতটা তুলেও তপতী নামিয়ে নিলেন। অসহায় ফ্যালফ্যাল চোখে চিনু তাকিয়ে রয়েছে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গায়ের রং, রুগণ, দুর্বল শরীর। গেঞ্জি পরা না থাকলে ওর কণ্ঠা আর পাঁজরের হাড় দেখা যেত। পা দুটো সরু, দুটো হাতও তাই। তপতীর চোখের রাগ ধীরে ধীরে মায়ায় ভরে এল। স্কুল থেকে বলে দিয়েছে স্পোর্টসে সাদা প্যান্ট গেঞ্জি পরে যেতে হবে। দ্বিতীয় আর সাদা প্যান্ট নেই। চট করে যে লাগিয়ে দেবেন, ওই মাপের তেমন বোতামও ঘরে নেই। কী করা যায় এখন?
”বউদি, বরং একটা সেফটিপিন লাগিয়ে দাও।” ঘরের দরজা থেকে রাতদিনের কাজের লোক বেলা পরামর্শ দিল। হাতের চুড়ি থেকে সেফটিপিন খুলে তপতীর হাতে দিতে দিতে বলল, ”দাদা তাড়া দিচ্ছে, চেঁচামেচি শুরু করবে।”
তপতী আর কথা না বলে হাঁটু গেড়ে বসে কোমরের কাছে প্যান্টটা টেনে ধরে সেফটিপিন লাগিয়ে দিলেন। চিনুর হাত ধরে যখন তিনি খাবার ঘরে এলেন, তন্ময় তখন উৎসাহভরে মিনুকে স্টার্ট নেওয়ার কৌশল দেখানোয় ব্যস্ত। ছোট ছেলের দিকে তাকাবার ফুরসত নেই।
”যখন বলবে অন ইওর মার্ক… গেট… সেট…” তন্ময় ঘরের মেঝেয় হামা দেওয়ার ভঙ্গিতে, একটা পা সামনে, অন্যটা পিছিয়ে। সামনের পায়ের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে দু’হাতের আঙুলে ভর রেখে সামনে ঝুঁকে। ”কান খাড়া করে রাখবি, এটা খুব দরকারি ব্যাপার,… এই কানটা, বুঝলি? পিস্তল ফায়ারের আওয়াজ শোনামাত্রই…।”
”বাবা, আমাদের আন্টি বলেছেন হুইসল বাজানো হবে।”
”অ। একই ব্যাপার, মোটকথা ওই আওয়াজটা শোনার জন্য তুমি কান খাড়া করে রাখবে। যেই হুইসল বাজল অমনই তুমি…”, তন্ময় মোজাইক করা মেঝেয় পায়ে চাপ দিয়ে স্টার্ট নিতে গিয়ে প্রথম পদক্ষেপটিতেই পিছলে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন।
তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে উঠে প্রথমেই তিনি সবার মুখ দেখে নিলেন। কোনও মুখেই হাসির টান পড়েনি। দেখে স্বস্তি বোধ করে বললেন, ”তা হলে মিনু স্টার্টিং ব্যাপারটা বুঝে গেলে, কেমন। এবার ঝালিয়ে নাও একবার।”
মিনু বাবার দেখানো মতোই মেঝেয় হামা দেওয়ার ভঙ্গিতে শরীরটাকে রেখে কানখাড়া করে রইল।
”কারেক্ট, নাউ… অন ইওর মার্ক… গেট… সেট… ফরররর।” তন্ময় মুখেই হুইসল বাজালেন। মিনু স্টার্ট নিয়েই হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
”এ কী, পড়ে গেলি কেন?” তন্ময় বিস্মিত এবং ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন। ”বারে! তুমি তো এইভাবেই স্টার্ট নিলে।” মিনুর ভ্যাবাচাকা মুখ। গলদটা কোথায় হল বুঝতে পারছে না।
খুকখুক হাসির শব্দে তন্ময় মুখ ফেরালেন স্ত্রীর দিকে। জ্বলন্ত দৃষ্টি হেনে বললেন, ”এতে হাসির কী আছে?”
”তোমার বলে দেওয়া উচিত ছিল পিছলে পড়াটা স্টার্টিং টেকনিকের মধ্যে পড়ে না।” গম্ভীর মুখে কথাটা বলে তিনি ছোট ছেলের চেয়ারটা টেবলের নীচে আর একটু ঠেলে দিলেন। প্যান্টে আঁটা সেফটিপিনটা এখনকার মতো স্বামীর নজরে না পড়াই ভাল।
”গাড়ি বার করছি। তাড়াতাড়ি এসো।” তন্ময় দুটো ওয়াটারবটল টেবল থেকে তুলে বেরিয়ে গেলেন মিনুকে সঙ্গে নিয়ে।
”মা, আমি খাব না, খিদে নেই।” চিনু করুণ স্বরে বলল।
”ওসব বললে হবে না, খেয়ে নাও। বাবা মাখন মাখিয়ে দিয়েছে, একটা অন্তত খাও। কখন ফিরব তার ঠিক নেই, খালি পেটে থাকলে… আচ্ছা দুধটুকু খাও।” দুধের গ্লাস ছেলের মুখে তুলে ধরলেন তপতী। পাঁচন গেলার মতো মুখ করে চিনু গ্লাস শেষ করল।
”মা, আমিও কি ওইভাবে স্টার্ট নেব?”
”যেমন খুশি তেমনি ভাবে স্টার্ট নিবি, এটা ওলিম্পিকস নয়। এবার চল… আমার পেছন পেছন আয়, বাবার নজরে যেন সেফটিপিনটা না পড়ে, তা হলে দক্ষযক্ষ বেধে যাবে।”
”মা, দক্ষযজ্ঞ কী?”
”পরে বলব।”
বাইরে থেকে মোটরের হর্ন শোনা গেল। ওরা দু’জন প্রায় ছুটেই বাংলো থেকে বেরোল। একতলা টালির ছাদের বাড়ি। সামনের দিকে ছোট ফুলের বাগান। রাস্তার দু’পাশে বড় বড় গাছের সারি এবং একই ধরনের বাংলো রাস্তার দু’ধারে। সম—পদমর্যাদার লোকেরা এই রাস্তায় বাস করে। পুরনো ভক্সহল গাড়ির সামনে বসল তন্ময় ও তপতী, পেছনে দুই ছেলে। মোটরগাড়িটা এক সাহেবের কাছ থেকে কেনা।
স্কুলটা মহাদেবপুরের দক্ষিণ প্রান্তে গঙ্গার ধারে। স্কুলের লাগোয়াই, দুটো ফুটবল ম্যাচ একসঙ্গে খেলা যায় এত বড় মাঠ। একধারে শামিয়ানা, চেয়ার, টেবল, ফুলদানি, মাইক্রোফোন, স্তূপ করা প্রাইজসামগ্রী, খাবারের বাক্স ইত্যাদি। শামিয়ানার সামনে অভিভাবকদের জন্য কয়েক সারি চেয়ার। রঙিন কাগজের তৈরি শিকল গোটা বারো বাঁশের খুঁটিতে মালার মতো দুলছে। এক আন্টি অবিরাম ঘোষণা করে চলেছেন মাইকে। অনুষ্ঠান সভাপতি এম জে টি এম—এর জেনারেল ম্যানেজার এবং প্রাইজ হাতে তুলে দেবেন প্রধান অতিথি এক প্রাক্তন ফুটবলার, এঁরা দু’জন আসবেন স্পোর্টস শেষ হওয়ার কাছাকাছি সময়ে। সারামাঠে উদ্দীপনা, উৎসাহ, কেমন একটা উৎসব উৎসব ভাব।
বসুমল্লিক দম্পতি দুই ছেলে নিয়ে যখন হাজির হলেন তখন স্পোর্টস শুরু হয়ে গেছে। উঁচু ক্লাসের ছেলেদের ইভেন্টগুলো মাঠের অন্যদিকে পুরুষ শিক্ষকদের তদারকিতে চলছে। তাদের আটশো মিটার দৌড় তখন মাঝপথে। মাঠের মাঝে চুনকাম করা খুরি দশ মিটার অন্তর বসানো ট্র্যাক ঘিরে। গাড়ি থেকে নেমেই চিনু ফিসফিস করে মাকে বলল, ”ওইখানে আমাদের দৌড়তে হবে?”
”ওখানে বড় ছেলেদের দৌড় হবে। তুই তো পঞ্চাশ মিটরে দৌড়বি। এদিকে ওই যে লম্বা লম্বা দাগ, ওখানে তোদের দৌড়তে হবে।”
ওঁরা ‘গেস্ট’ লেখা সংরক্ষিত জায়গার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন—তখন সুবেশা, স্থূলকায়া এক মহিলা হাতছানি দিয়ে তপতীকে ডাকলেন। ”মিসেস বসুমল্লিক, আগে ওই টেবলে বসা মিস দাসের কাছে গিয়ে জানিয়ে আসুন আপনার ছেলেরা এসেছে। …ক’টা ইভেন্টে ওরা নামবে?”
”অনেক ইভেন্ট। মিনুর তো রানিং ইভেন্টই তিনটে, তা ছাড়া স্যাক রেস, অঙ্ক রেস, জিলিপি রেস, ব্যালান্স রেস… এক মিনিট মিসেস সেন, এসে বলছি।” তপতী কথা অসমাপ্ত রেখে মিস দাসের টেবলের দিকে ছুটলেন। সেখানে বাবা—মায়েদের ভিড়। সবাই হাজিরা জানাবার জন্য ব্যস্ত।
”প্রতীক ঘোষ, ক্লাস ফোর, সেকশন ‘এ’।”
”বিশ্বনাথ জানা, ক্লাস ফোর, সেকশন ‘এ’।”
”কিংশুক চ্যাটার্জি…”
”সুভাষ দত্ত…”
মিনিটপাঁচেক পর তপতী সুযোগ পেলেন। নাম, ক্লাস, সেকশন শুনে মিস দাস খাতা দেখে বললেন, ”মৃন্ময় তো সাতটা ইভেন্টে নাম দিয়েছে আর চিন্ময় চারটেতে। সবক’টাতেই ওরা নামবে তো?”
”নিশ্চয়।”
”পঁচাত্তর মিটার এখনই শুরু হবে। মৃন্ময়কে রেডি রাখুন। নাম অ্যানাউন্স করলেই স্টার্টিং লাইনে পৌঁছে দেবেন। তারপরই আছে চিন্ময়ের পঞ্চাশ মিটার।”
তপতী ফিরে এসে দেখলেন চিনু একা দাঁড়িয়ে।
”বাবা, দাদা কোথায়?”
”ওইদিকে।” আঙুল দিয়ে চিনু দেখাল ভিড়ের শেষে মাঠের একটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে তন্ময়ের নির্দেশে মৃন্ময় গা—ছাড়ানোর ব্যায়াম করছে।
”মা, আমিও কি এখন দাদার মতো করব?”
”না। অত করার তোর দরকার নেই।”
”মা, আমার কেমন ঘুমঘুম পাচ্ছে। আমার ইচ্ছে করছে না দৌড়তে।”
”ঘুম পাচ্ছে বললে কি এখন চলে? ওই শোন দাদার নাম অ্যানাউন্স হল। দৌড়ে গিয়ে ওদের ডেকে আন।”
ডাকতে আর হল না। তন্ময় আর মিনুকে এগিয়ে যেতে দেখা গেল স্টার্টিং লাইনে হাতে কাগজ—কলম আর মাথায় সাদা কাপড়ের ক্যাপ পরা ব্যস্তসমস্ত এক আন্টির দিকে।
মিনু পঁচাত্তর মিটার দৌড়ে শুধু প্রথমই হল না, দ্বিতীয় জনকে প্রায় পনেরো মিটার পেছনে রেখে দিল। দর্শকদের সবার চোখে তারিফ আর মুগ্ধতা। দৌড় শেষ করেই মিনু ছুটে এসে ফিনিশিং লাইনের ধারে দাঁড়ানো মাকে জড়িয়ে ধরল। ছেলের মুখ চুম্বনে ভরিয়ে তপতী তাকালেন স্বামীর দিকে। মিনু কোমর জড়িয়ে ধরেছে বাবার। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তন্ময়ের মুখে গভীর তৃপ্তির সঙ্গে ফুটে উঠল অহঙ্কার।
”যেভাবে স্টার্ট নেওয়াটা শিখিয়েছিলাম তাতে ফার্স্ট না হয়ে কোনও উপায় নেই। টেকনিক… ইটস টেকনিক, বুঝলে!”
”তার মানে, তোমার স্টার্টিং টেকনিকের জন্যই মিনু ফার্স্ট হল, ওর নিজের কোনও কৃতিত্ব এতে নেই?”
থতমত হয়ে তন্ময় বললেন, ”না, না, সে কী কথা! অবশ্যই মিনু নিজের ক্ষমতায় প্রথম হয়েছে।”
”তুমি শুধু মিনুকেই টেকনিক শিখিয়েছ, চিনুকে কিন্তু কিছুই শেখাওনি।”
”ওকে আর কী শেখাব, একদমই বাচ্চচা, তা ছাড়া খুবই দুবলা, ভেরি, ভেরি উইক।”
তপতী চুপ করে রইলেন। কথাটা খুবই সত্যি। তাঁর ছোট ছেলে খুবই দুবলা। ক্লাস ওয়ানের পঞ্চাশ মিটার দৌড়ের জন্য যখন নাম ডাকা হল, তপতী তখন চিনুকে স্টার্টিং লাইনে পৌঁছে দেওয়ার সময় বললেন, ”তুমি যেমন পারো তেমনই দৌড়িও, কেমন? এটা ওলিম্পিকস নয় যে, গোল্ড মেডেল পেতেই হবে। মজা মনে করো এই দৌড়টাকে। তোমাকে ফার্স্ট হতে হবে না।”
চিনু কথাগুলোর কী অর্থ করল কে জানে, তবে ঘাড় নাড়ল। স্টার্টিং লাইনে সব প্রতিযোগীই বাচ্চচা ছেলে, তার মধ্যে চিনুকে তার রুগণতার জন্য আরও বাচ্চচা দেখাচ্ছে। লাইনে দাঁড়িয়ে সে অসহায়ের মতো বারবার তাকাল মার দিকে। তপতী হাত নাড়লেন।
শুরুর হুইসল বেজে উঠতেই হইহই করে উঠল দর্শকরা, যার অধিকাংশই বাবা—মা। উৎসাহভরে অনেকেই প্রতিযোগীদের সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে লাগলেন দূরত্ব রেখে। দৌড় শুরু হতেই চিনু দশ মিটার মতো গিয়েই পেটের কাছে প্যান্টটা ধরে দাঁড়িয়ে মার দিকে তাকাল। তপতী হাত নেড়ে ওকে ছুটতে ইশারা করলেন।
”চিনু, দাঁড়িয়ে থেকো না, দৌড়ও।”
প্যান্ট মুঠোয় ধরে চিনু দৌড় শুরু করল আবার এবং সমাপ্ত করল হাঁসফাঁস করতে করতে সবার শেষে পৌঁছে। সফল প্রতিযোগীদের মায়েরা ছুটে গেল ছেলেদের কাছে, তাদের জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগল। চিনু দৌড় শেষ করে মুখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তপতী পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে ঝুঁকে কপালে চুমু দিয়ে বললেন, ”তুমি ফিনিশ করেছ, এতে আমি খুব খুশি হয়েছি।”
কাঁধের কাছে জামায় চোখ মুছে চিনু হাসল। ”সেফটিপিনটা খুলে গেল।”
তন্ময় এগিয়ে এসে বললেন, ”তুই ওভাবে দাঁড়িয়ে পড়লি কেন?” তারপরই প্যান্টে আঁটা সেফটিপিনটার দিকে তাঁর নজর পড়ল। ”এ কী, প্যান্টে ওটা কী?”
”দোষটা আমারই। লন্ড্রি থেকে কেচে আসার পর লক্ষ করিনি বোতামটা ভেঙে গেছে। বেরোবার তাড়ায় আর সময় পাইনি নতুন বোতাম লাগাবার, তাই—।” তপতী অপরাধীর মতো মুখ করে বললেন। তারপরই গলায় উচ্ছ্বাস এল, ”কিন্তু চিনু রেসটা কেমন শেষ করল বলো।”
”ইয়েস, ইয়েস,” চিনুর পিঠে হালকা চাপড় দিলেন তন্ময়। ”শেষ পর্যন্ত দৌড়েছে, রণে ভঙ্গ দেয়নি। এটাই তো চাই। মিনু তোর নেক্সট ইভেন্টের কল দিচ্ছে। এর পর চিনুর কী আছে?”
”বোধ হয় জিলিপি রেস।”
”মিনু চল, এটাতেও কিন্তু ফার্স্ট হতে হবে।”
ওরা দু’জন চলে যেতেই চিনু মায়ের কোমর জড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, ”আমি আর নামব না… আমার ভাল লাগছে না।”
”সে কী! জিলিপি রেস কী মজার, তা জানিস? দড়িতে জিলিপি ঝুলিয়ে দেবে, দৌড়ে গিয়ে লাফ দিয়ে দিয়ে কামড়ে ছিঁড়ে নিয়ে আবার ফিরে আসতে হবে।”
”না মা, আমার ভাল লাগছে না। শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।” চিনু অনুনয় করল। তপতী ছেলের কপালে হাত রেখে ভ্রূ কোঁচকালেন।
”তোর গা তো বেশ গরম। জ্বর হয়েছে বোধ হয়। থাক তা হলে, আর দৌড়োদৌড়ি করতে হবে না। আয় বসি।”
চিনুকে কোলে নিয়ে তপতী বসলেন একটা চেয়ারে। পেছন থেকে ঝুঁকে মিসেস সেন বললেন, ”আপনার বড় ছেলেটি খুব ভাল দৌড়েছে।”
মুখ ফিরিয়ে তপতী হাসলেন শুধু।
”মনে হয় সব ক’টাতেই ও ফার্স্ট হবে।”
তপতী আবার হাসলেন।
”আপনার ছোট ছেলের তখন হল কী, দাঁড়িয়ে পড়ল কেন?”
”প্যান্ট খুলে পড়ছিল। বোতামটা ভেঙে গেছে।”
”অ অ। আমি ভাবলুম ঘাবড়ে গিয়ে… ওর সঙ্গে যারা দৌড়চ্ছিল তাদের স্বাস্থ্য তো খুবই ভাল।”
তপতীর মাথা গরম হয়ে উঠল কথাটা শুনে। ভাল স্বাস্থ্য দেখে চিনু ভয় পেয়ে গেছল, এমন একটা ধারণা হল কী করে এই মহিলার! চিনু মায়ের বুকে মাথা রেখে চোখ বুজে জড়িয়ে ধরে রয়েছে। তপতী ওর মাথায় গালে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,”বাড়ি যাবি?” চিনু মাথা নাড়ল।
ছেলেকে নিয়ে তপতী উঠলেন। তন্ময়কে খুঁজে বার করে বললেন, ”চিনুকে বাড়ি নিয়ে যাব, পৌঁছে দাও। জ্বর জ্বর লাগছে। আমার মনে হয় এখন ওর শুয়ে থাকা দরকার।”
”আমি এখন যাব কী করে, এই শুরু হতে যাচ্ছে মিনুর ফিফটি মিটারটা। বরং তুমিই গাড়ি নিয়ে চলে যাও, আমরা রায়চৌধুরীর গাড়িতে চলে যাব।” তন্ময় গাড়ির চাবি তপতীর হাতে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে চলে গেলেন।
তপতী গাড়ি চালান, তবে মহাদেবপুরের মধ্যেই। কলকাতা বা অন্য কোথাও যেতে হলে তিনি স্টিয়ারিং ধরেন না। জি টি রোডের ট্রাফিককে তিনি ভয় পান। বাড়ি যাওয়ার পথেই ডাক্তার সিনহার কোয়ার্টার। তপতীর মনে হল চিনুকে একবার ওঁকে দিয়ে দেখিয়ে নেওয়া ভাল।
ডাক্তার কোয়ার্টারে নেই, কলকাতায় গেছেন সপরিবারে। তপতী ফিরে এসে চিনুকে শুইয়ে দিলেন। থার্মোমিটারে তাপ মাপলেন, প্রায় একশো ডিগ্রি। ছেলেকে জড়িয়ে তিনিও শুয়ে পড়লেন।
রীতিমতো হইহই করে তন্ময় ও মৃন্ময় বাড়িতে ঢুকল।
”হিপ হিপ হুররে…থ্রি চিয়ার্স ফর মৃন্ময় বসুমল্লিক… হিপ হিপ… হুররে।” তন্ময় বাড়ি কাঁপিয়ে তাঁর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন। তপতী প্রায় ছুটেই বসবার ঘরে এলেন। বাবা আর ছেলের হাত ভর্তি কাপ, মোট সাতটা। তার সঙ্গে একটা বাক্সে রুপোর মেডেল, চ্যাম্পিয়ানের পুরস্কার। এ ছাড়াও একটা তোয়ালে, একটা কিট ব্যাগ, একটা ওয়াটার বটল আর সার্টিফিকেটগুলো।
”ওমমা, মিনু তো বিপদে ফেলে দিল! এত কাপ এখন আমি রাখি কোথায়?”
তপতী ছেলেকে কাছে টেনে নিলেন। মিনুর মুখ লাজুক হয়ে উঠল।
”এই তো সবে শুরু।” কাপগুলো টেবলে সাজিয়ে রাখতে রাখতে তন্ময় বললেন। ”এবার থেকে বছর বছর গণ্ডায় গণ্ডায় কাপ—মেডেল আসবে। এগুলো এখন এখানেই থাক, লোকে দেখুক।”
দাদা, একটা কাচের আলমারি তৈরি করিয়ে তাতে সাজিয়ে রাখুন।” পরামর্শটা দিল বেলা।
”সেটা আমিও ভেবেছি। আসার সময় রায়চৌধুরীর বউ তো আজ রাতে মিনুকে নেমন্তন্ন করেছে। পায়েস খাওয়াবে। চিনুকেও পাঠিয়ে দিতে বলেছে।”
”চিনু যেতে পারবে না, জ্বর প্রায় একশো।” তপতী জানালেন।
”ডাক্তার দেখাতে হয় তা হলে।” তন্ময় ব্যস্ত পায়ে ছেলেদের ঘরের দিকে চলে গেলেন। ঘুমন্ত চিনুর কপালে হাত দিয়ে চিন্তিত মুখে বললেন, ”সিনহাকে কি একবার ডাকব?”
”ওঁরা সব কলকাতায় গেছেন। তুমি বরং কলকাতায় ফোন করে অপূর্ববাবুর সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করো। চাইল্ড স্পেশালিস্ট দেখানোই ভাল।”
”হ্যাঁ দাদা, কলকাতার ডাক্তারই দেখান। চিনুর প্রায়ই জ্বর হয়, রাতে খুকখুক করে কাশেও।” বেলা এসব জানে, কেননা রাতে সে ছেলেদের ঘরের মেঝেয় শোয়।
রায়চৌধুরীরা, শুভা এবং রাজেন, বছরখানেক রয়েছে মহাদেবপুরে। মাসছয়েক মাত্র ওদের বিয়ে হয়েছে। ধনী পরিবারের সন্তান। রাজেন টেক্সটাইল এঞ্জিনিয়ার। মা আর বাবা মাঝে মাঝে এসে ছেলের কাছে থাকেন। রাজেন সাউথ ক্লাবে টেনিস খেলত, ক্যালকাটা হার্ডকোর্ট চ্যাম্পিয়ানশিপে দু’বার সেমিফাইনালে উঠে প্রেমজিত লাল নামে জুনিয়ার ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়ানের কাছে হেরে গেছল। বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ানশিপের কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে যায় আর এক তরুণ জয়দীপ মুখার্জির কাছে। অতঃপর রাজেন বুঝে যায় টেনিসে বড় খেলোয়াড় হওয়ার মতো প্রতিভা তার নেই, অতএব পড়াশুনোয় মন দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। টেনিস ছেড়ে দিলেও রাজেন ক্লাব ছাড়েনি। ছুটির দিনে মোটরে সে কলকাতায় যায় শুভাকে নিয়ে। এলগিন রোডে তাকে বাপের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে চলে যায় কাছেই সাউথ ক্লাবে। অল্প খেলা, আড্ডা বেশি এবং পরদিন সকাল ছ’টার মধ্যেই মহাদেবপুরে ফিরে কাজে লেগে যাওয়া। এইভাবেই তারা কলকাতার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে যাচ্ছে।
আজ তারা কলকাতায় যায়নি স্কুলের স্পোর্টস দেখবে বলে। রাজেনের মা পায়েস রেঁধেছেন। বেলার সঙ্গে রাতে মিনু গেল পায়েস খেতে। অবশ্য পায়েসের সঙ্গে লুচি—বেগুনভাজাও ছিল। মিনুকে পৌঁছে দিয়ে বেলা ফিরল একটা বড় বাটি ভর্তি পায়েস নিয়ে।
”শুভাদির শাশুড়ি দিলেন।” খাওয়ার টেবলে বাটিটা রেখে বেলা জানিয়ে দিল।
”কার জন্য দিলেন?” তন্ময় প্রশ্নটা করেই চামচেতে খানিকটা পায়েস তুলে মুখে দিল। ”নলেন গুড় আর গোবিন্দভোগ চাল, ফাস ক্লাস,… কত দিন যে টেস্ট করিনি এই গন্ধটা!”
”কার জন্য আবার, সবার জন্যই দিয়েছেন।” তপতী সতর্ক গলায় বললেন। ‘ফাস ক্লাস’ শব্দ দুটির আড়ালে কী ইচ্ছা উঁকি দিচ্ছে সেটা অনুমান করতে তাঁর অসুবিধে হয়নি।
”এইটুকু জিনিস কী করে সবাইকে দেবে তুমি!” তন্ময় যেন একটু বেশি রকম অবাক হলেন, ”তার থেকে বরং…” কথা শেষ হওয়ার আগেই তপতী হাত তুলে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বেলাকে বললেন, ”দাদা আজ রাতে কষ্ট করে ওইটুকু পায়েস খেয়েই থাকবেন, ওঁর খাবারটা তুলে রাখো। … মিনুকে ওদের বাড়ি থেকে কখন আনতে যাবে?”
”আনতে যেতে হবে না। শুভাদির শ্বশুর বললেন, পৌঁছে দেবেন। মিনু তো ওনার সঙ্গে দাবা খেলতে বসে গেছে।”
”দাবা?” স্বামী—স্ত্রী প্রায় একসঙ্গেই অবাক প্রশ্ন তুললেন।
”মিনু দাবা খেলতে পারে?” তন্ময় স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলেন।
তপতী বললেন, ”আমি তো জানি না! কোনও দিন তো খেলতে দেখিনি!”
বিস্মিত তন্ময় চেয়ারে বসে পায়েসের বাটিটা টেনে নিয়ে একবার স্ত্রীর দিকে তাকালেন, ”একটু চেখে দেখবে নাকি?”
”কালই আমি নলেনগুড় আর গোবিন্দভোগ চাল আনিয়ে পায়েস করে একা সব খাব।” তপতী ঘরে চলে গেলেন, ঝাঁঝালো স্বরে কথাগুলো বলে। থার্মোমিটারে চিনুর তাপ দেখলেন। একই রকম রয়েছে।
”মা আমি কি পায়েস খাব?” দুর্বল স্বরে চিনু বলল।
”খাবে, তবে আজ নয়। আগে সেরে ওঠো।”
”যদি ডাক্তারবাবু বারণ করেন?”
”তা হলে খাবে না।” কথাটা বলে তপতী কষ্ট পেলেন। পায়েস খাওয়ার ইচ্ছা কার না হয়। কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য, বিশেষ করে সন্তানের মঙ্গলের জন্য তিনি কঠোর হতে দ্বিধা করবেন না।
”যতদিন না ডাক্তারবাবু তোমায় পায়েস খেতে দিচ্ছেন ততদিন আমিও পায়েস খাব না!”
”কেন তুমি খাবে না?”
”খাব না এই জন্যই, আমার ছোট্ট চিনু পায়েস খেতে না পেয়ে কষ্ট পাচ্ছে, আমিও সেই কষ্টের ভাগ নেব। তা হলে চিনুর কষ্টটা অনেক কমে যাবে। তাই না?”
তপতীর মনে হল চিনুর জ্বরক্লিষ্ট মুখে হালকা একটা হাসি ফুটে উঠল। ”যাঃ, তুমি বাজে কথা বলছ। এইভাবে কি কষ্ট কমে? তোমার যখন পা ভেঙেছিল তখন তো তুমি বিছানায় শুয়ে থাকতে, তোমার মাও কি বিছানায় শুয়ে থাকত তোমার কষ্টের ভাগ নিতে?”
”সবার কষ্ট কি একরকমের হয়? তুমি ছোট, তোমার কষ্ট একরকমের, যখন আমার পা ভাঙে তখন তো আমি যথেষ্ট বড়, তাই আলাদা রকমের কষ্ট হত।”
”কী কষ্ট হত তোমার?”
তপতী একটুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, ”খুব ভোরবেলায় উঠে বাগানে গিয়ে দেখতুম ফুলের নতুন কোনও কুঁড়ি ফুটেছে কি না, খালি পায়ে ভিজে ঘাসের ওপর হাঁটতুম, আমায় দেখলে টমি ছুটে এসে আমাকে ঘুরে ঘুরে লাফালাফি করত আর ল্যাজ নাড়ত, আমি তখন ছুটতুম, টমিও ছুটত… বিকেলে টেনিস খেলতুম দাদার সঙ্গে, বাবা তাড়াতাড়ি কোর্ট থেকে ফিরলে আমাদের সঙ্গে খেলতেন। এইসব কিছুই করতে না পারার জন্য কষ্ট হত।”
”মা, আমি টেনিস খেলব তোমার সঙ্গে। তোমার তো একটা র্যাকেট আলমারিতে তোলা আছে, আমি দেখেছি। ওটা দেবে আমায়?”
”নিয়ে কী করবি?”
”বাইরে বাগানে গিয়ে দেয়ালে বল মেরে মেরে খেলব। আমাকে একটা টেনিস বল কিনে দেবে?”
”দেব। এখন আর কথা নয় চিনু, এবার ঘুমো।”
”দাদাকে একটা র্যাকেট কিনে দিও, তা হলে দু’জনে খেলব।”
”কিনে দোব… এবার ঘুমো।”
”আমাদের এখানে টেনিস খেলার মতো জায়গা নেই, সেই ক্লাবে গিয়ে খেলতে হয়। এখানে একটা কোর্ট থাকলে খুব ভাল হত, তাই না?”
”হ্যাঁ, ভাল হত।”
”কপালে হাত দিয়ে দেখো, এখন আমার জ্বর নেই।” চিনু মায়ের হাতটা তুলে নিয়ে নিজের কপালে রাখল। তপতীর মনে হল, সত্যিই যেন জ্বরটা কম।”
”রাতে তোর কাশি হয়?”
”হ্যাঁ।”
”একদম ঠাণ্ডা লাগাবি না। এবার থেকে সবসময় সোয়েটার পরে থাকবি।”
ঘরের দরজা থেকে বেলা বলল, ”বউদি, দাদার খাবার কি তুলে রাখব, উনি তো পায়েস খাননি।”
তপতী তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে খাওয়ার ঘরে এসে দেখলেন বাটিতে পায়েস যেমন ছিল তেমনই রয়েছে। তন্ময় বসার ঘরে বড় সোফায় টানটান শুয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন। তপতী বাটিটা থেকে একটা প্লেটে অর্ধেক পায়েস ঢেলে নিয়ে বেলাকে বললেন,”এটা দাদাকে দিয়ে এসো। আর বোলো কাল পায়েস করব সবার জন্য।”
বেলা ফিরে আসতেই তপতী বললেন, ”এই পায়েসটা তুমি খেয়ে নিয়ো।”
”সে কী বউদি, তুমি খাবে না!”
”না। চিনু ভাল হোক, ওর সঙ্গে খাব।”
এই সময়ই ধুপধাপ পায়ের শব্দ করে মিনু ফিরল, তার সঙ্গে রাজেনের বাবা ব্রজেন রায়চৌধুরী। বয়স প্রায় সত্তর। তামাটে রং, লম্বায় ছয়—দুই, ওজন একশো সত্তর পাউন্ড, মাথাভর্তি ধবধবে ব্যাকব্রাশ করা চুল। চোখে পড়ার মতো হল ওর গোঁফ। খুবই পুষ্ট এবং গোরুর শিঙের মতো ডগা দুটো ওপর দিকে তোলা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি মেজর ছিলেন সেনাবাহিনীতে, স্বাধীনতার পর মিলিটারি ছেড়ে এক বিলিতি সওদাগরি অফিসে যোগ দেন। বছর তিনেক আগে বিভাগীয় ম্যানেজারের পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। হাতের অফুরন্ত সময় কীভাবে কাটাবেন, ধর্মচর্চায় না গ্রামের বাড়িতে পোলট্রি করে, এই ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্তে আসতে না পেরে অবশেষে দাবায় মন দেন। এখন তাতেই ডুবে আছেন।
পায়েসের নেমন্তন্ন রাখতে গিয়ে মিনুর চোখ পড়ে বসার ঘরের টেবলে রাখা দাবার ছকের ওপর। কৌতূহলী হয়ে সে ঘুঁটিগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে থাকে। ব্রজেন ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে সিগার খেতে খেতে তিনবার পড়া আগাথা ক্রিস্টির একটা গোয়েন্দা—বই পড়ছিলেন সময় কাটাবার জন্য আর কিছু না পেয়ে। হঠাৎই তাঁর চোখ পড়ল মিনুর ওপর। তাঁর মনে হল এই বাচ্চচা ছেলেটি দাবায় আগ্রহী। একে যদি খেলাটা শিখিয়ে দেওয়া যায়, তা হলে সারাদিনে গোটা চল্লিশ হাই তোলা থেকে বোধ হয় রেহাই পাওয়া যেতে পারে।
”দাবা খেলবে?”
”হ্যাঁ।”
”খেলেছ কখনও?”
”না, তবে খেলতে দেখেছি।”
মিনুর সপ্রতিভ উত্তর ব্রজেনের ভাল লাগল। তিনি টেবলে উঠে গিয়ে সাদা ঘুঁটিগুলো ছকে সাজিয়ে বললেন, ”এবার তুমি কালো ঘুঁটিগুলো সাজিয়ে দিতে পারবে?”
মিনু সাজানো সাদা ঘুঁটি দেখে দেখে সাজিয়ে দিল কালো ঘুঁটি এবং বেশ দ্রুতই।
”ঘুঁটিগুলোর নাম জানো?”
”হ্যাঁ। এটা গজ, এটা ঘোড়া, এটা নৌকো, এটা রাজা।”
”কোনটের চাল কীরকম তা জানো?”
”জানি।”
”ঘোড়ার চাল দেখাও তো।”
মিনু আড়াই চাল দেখাল। ব্রজেন অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,”তুমি শিখলে কার কাছে? বাড়িতে কেউ খেলে না কি?”
”স্কুলে দু’জন সার টিফিনের সময় টিচার্স রুমে খেলেন। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি।” মিনুর দাঁত ঝলসে উঠল হাসিতে। ”দেখতে, দেখতে খানিকটা শিখে গেছি।”
”দেখি তো কেমন তুমি শিখেছ!” ব্রজেন উদ্দীপিত হয়ে উঠলেন। যদি একটা খেলার সঙ্গী জোটে। ”তোমার সাদা ঘুঁটি, আমার কালো। নাও চাল দাও।”
মিনু রাজার সামনের বোড়ে দু’ঘর এগিয়ে দিল। ব্রজেন তার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে প্রথম চাল দিলেন। দশ—বারো চাল খেলার পর তাঁর মনে হল, ছেলেমানুষি বুদ্ধিতে খেললেও এই বাচ্চচা ছেলেটিকে এক মাসের মধ্যে চলনসই প্রতিপক্ষ হওয়ার মতো করে গড়ে তুলতে পারবেন। মিনু তার প্রথম খেলায় হারল পনেরো চালে।
”ঘুঁটি সাজাও, এবার আমার সাদা।” ব্রজেন উত্তেজনা বোধ করছেন। নিভে যাওয়া সিগারটা ধরালেন।
”দাবা এখন থাক।” ব্রজেনের স্ত্রী তাড়া দিলেন। ”খেয়ে নিয়ে বরং আবার বোসো, লুচি ভাজতে শুরু করেছে বউমা।”
খাওয়ার সময় ব্রজেন মিনুর পিঠে হাত রেখে শুভাকে বললেন,”মিনু যে এত তাড়াতাড়ি খেলাটা ধরে ফেলবে, ভাবতেই পারিনি। আমার একটা সমস্যা মিটে গেল বউমা।”
”মিনু আজ কত প্রাইজ পেয়েছে যদি দেখতেন! আপনার ছেলে বলছিল, ও ন্যাচারাল অ্যাথলিট, যে খেলা ধরবে তাতেই ওপরে উঠবে। হবে নাই—বা কেন, বাবা—মা দু’জনেই অল্পবিস্তর স্পোর্টসের মধ্যে ছিল, বাবা সাঁতারে, মা টেনিসে। পরিবারের আবহাওয়াও তো অনেক সাহায্য করে ছেলেমেয়েদের।”
”তোমার এক ভাইকে দেখেছি, কী যেন নাম?” ব্রজেন জানতে চাইলেন মিনুর দিকে তাকিয়ে।
”চিন্ময়, চিনু। … কাকিমা, আমি আর একটা বেগুনভাজা খাব।”
ব্রজেন তারিফ ভরা স্বরে বললেন, ”মিনু তো দেখছি ভাল খাইয়েও। বউমা, একটা নয়, দুটো বেগুনভাজা আর লুচি, চলবে তো?” মিনু সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ল। ”চিনু আজ ক’টা প্রাইজ পেল?” ব্রজেন প্রশ্ন করলেন মিনুকে।
”একটাও নয়। জ্বর এসে গেল, একটায় নেমে আর নামেনি।”
শুভা বলল, ”বড় রুগণ ছেলেটা, খেলাধুলো ওর দ্বারা হবে না।”
খাওয়ার পর ওরা দু’জন আবার খেলতে বসল। মিনু প্রতিপক্ষের ঘুঁটির দিকে হুঁশ না রেখে চাল দিলেই ব্রজেন প্রত্যেকবারই তার ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন।
”তুমি যে মন্ত্রীটা ওইখানে দিলে কিন্তু লক্ষ করলে না আমার গজ ওই কোণ থেকে এসে একে মেরে দেবে। নাও, চাল ফিরিয়ে নতুন চাল দাও। … আমি কিন্তু আর চাল ফেরত দেব না বলে রাখলাম।”
মিনু একবার ঘোড়া দিয়ে একটা বোড়েকে খেতেই ঘোড়ার খালি করে দেওয়া ঘরে ব্রজেন তাঁর মন্ত্রীকে তুলে মিনুর রাজাকে কিস্তি দিলেন। ”আমি ইচ্ছে করেই বোড়েটাকে তোমার ঘোড়ার মুখে ফেলে দিয়েছিলাম, দেখি তুমি টোপ গেলো কি না। তুমি গিলে ফেললে আর আমারও কিস্তি দেওয়ার রাস্তা পরিষ্কার হয়ে গেল। … ভাবো, সময় নিয়ে প্রত্যেকটা চাল দেওয়ার আগে ভাবো। সবদিক বিবেচনা করো। একদম তাড়াহুড়ো করবে না।”
হেরে গিয়ে মিনুর মুখ প্রায় লাল হয়ে উঠল। চোখে হেরে যাওয়ার লজ্জা, সেটা লক্ষ করে ব্রজেন বললেন, ”খেলা শিখেই কেউ ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ান বটভিনিকের মতো খেলতে পারে না। তুমি এখন বারবার আমার কাছে হারবে, তারপর এমন একটা সময় আসবে যখন তুমিই আমায় বারবার হারাবে। হারা আর হারানো এই দুইয়ের মাঝে শুধু প্র্যাকটিস আর প্র্যাকটিস।”
”আর এক হাত খেলব।” মিনু চোখ নামিয়ে বলল।
”আর নয় আর নয়, রাত হয়ে গেছে।” শুভা তাড়া দিল। ”মিনু, বাড়ির সবাই ভাববে, এবার বাড়ি যাও।”
”খেলুক না বউমা।”
”না বাবা, দশটা বাজে। ওইটুকু ছেলের এখন শুয়ে পড়ার কথা।”
”ঠিক আছে, তা হলে কাল আবার আমরা বসব, কেমন? এবার চলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।”
।।২।।
তন্ময়ের বন্ধু অপূর্ব হালদারের চেম্বার ওয়েলিংটন স্কোয়ারের কাছে ধর্মতলা স্ট্রীটে। লন্ডন থেকে ডিগ্রি পাওয়া শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, তন্ময়ের স্কুলের সহপাঠী। চিনুকে দেখাবার জন্য তারিখ ও সময় ঠিক করতে তন্ময় ফোন করেছিল অপূর্বকে। ”তোর ছেলেকে দেখাবার জন্য আবার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লাগবে নাকি! যেদিন খুশি, রবিবার বাদে সন্ধে ছ’টা থেকে আটটার মধ্যে চলে আয় চেম্বারে।” তন্ময় এই উত্তর পেয়েছিল।
”তা হলে আর দেরি করে লাভ নেই, কালই চলো।” উদ্বিগ্ন স্বরে বলেছিল তপতী। ”জ্বরটা রয়েই গেছে। বাড়ছে কমছে, সঙ্গে কাশিটাও, ব্যাপারটা ভাল ঠেকছে না।”
সুতরাং পরদিন যাওয়াই ঠিক হল। বিকেল পাঁচটা নাগাদ তারা মহাদেবপুর থেকে রওনা হয়। মিনুকে নিয়ে সামান্য ঝামেলা হল রওনা হওয়ার আগে। সাড়ে তিনটের সময় স্কুল থেকে ফিরেই সে বাড়ির কাছে একটা ছোট মাঠে ফুটবল খেলতে যেত। এখন আর যায় না। এখন যায় ব্রজেনদাদুর সঙ্গে দাবা খেলতে। দাবা তাকে রীতিমতো আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। বল খেলার বদলে রোজ সে ঘণ্টা তিনেক বসে থাকে দাবার ছকের সামনে, একটা বুড়োমানুষের মতো।
সেদিন যথারীতি সে দাবার ছকের দিকে একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে চিন্তায় মগ্ন। এমন সময় বেলা গিয়ে তাকে ডাকল। ”মিনু শিগগির এসো, ওরা সবাই রেডি হয়ে গেছে, তুমি গেলেই গাড়িতে উঠবে।”
মিনু তখন তার ঘোড়াকে বাঁচাবার জন্য কোথায় সরাবে ভেবে পাচ্ছে না। বেলার কথা শুনে রেগে উঠে সে বলল, ”আমি যাব না যাও। চিনুকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবে তো আমি গিয়ে কী করব? এখন ভাগো।”
বেলা ফিরে এসে তন্ময় ও তপতীকে শুনিয়ে দিল মিনুর কথাগুলো। তন্ময় প্রায় লাফিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে তপতী বললেন, ”তোমায় যেতে হবে না, আমি যাচ্ছি।” তপতী দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।
”মিনু, বাবা অপেক্ষা করছেন।” তপতী কথাটা বলে ব্রজেনবাবুর দিকে তাকালেন, ”আমরা কলকাতা যাব, মিনুও সঙ্গে যাবে। আজ আর ও খেলবে না।”
”তোমরা যাও না…” আবদেরে নাকি সুরে মিনু বলতে শুরু করেছিল।
”মিননু।” কঠিন চাপা স্বরে তপতী তাকে থামিয়ে দিলেন, ”উঠে এসো।”
মায়ের চোখে ধকধকে আগুন দেখে মিনু উঠে পড়ল।
”মায়ের কথা শুনতে হয়। খেলা আজকের মতো অ্যাডজোর্নড রইল।” মিনুর পিঠে হাত রেখে স্নেহভরে ব্রজেনবাবু বললেন, ”ছকে ঘুঁটিগুলো যেমন আছে ঠিক তেমনই থাকবে। কাল আবার শুরু হবে, আমি প্রথমে চাল দেব, কেমন? এখন যাও। বাবা—মার অবাধ্য হতে নেই।”
তারা অপূর্ব হালদারের চেম্বারে পৌঁছল সওয়া ছ’টায়। বসার ঘর ভর্তি রোগী আর সঙ্গের লোক। তন্ময় ছাপা স্লিপে নাম লিখে পাঠাল। ডাক্তারকে দেখিয়ে একজন বেরিয়ে আসতেই তাদের ডাক পড়ল। অপূর্ব ছোটখাটো গোলগাল চেহারার মানুষ, চোখে চশমা, মুখে সবসময় হাসি। অনেকদিন পর দেখা হলে যেরকম কথাবার্তা হয় তাদের মধ্যে, তাই হল। বাইরে রোগীরা অপেক্ষা করছে, তাই ডাক্তার কথা বদল করে চিনুর দিকে নজর দিলেন। চোখ, জিভ, বুক, শ্বাস—প্রশ্বাস, গলার ভেতর, পেট ইত্যাদি শরীরের সাধারণ পরীক্ষাগুলো করতে করতে তিনি তপতীর কাছ থেকে চিনুর নিয়মিত জ্বর হওয়া, কাশি হওয়া সম্পর্কে খবর নিয়ে ভুরু কোঁচকালেন।
”ছেলেটা বড় রোগা। ওকে কি বড় ছেলেটার মতো স্বাস্থ্যবান করা যায় না?” তন্ময় কথাটা বলে মিনুর কাঁধে হাত রাখলেন সস্নেহে।
”কেন মোটা করা যাবে না! শরীরের যত্ন নিলে, ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া, খেলাধুলো, ছোটাছুটি করলে, মন প্রফুল্ল থাকলে স্বাস্থ্য ভাল হবেই। তার আগে এখন দেখতে হবে ওর শরীরে অসুখটা কী।” অপূর্ব চিনুর মুখের দিকে চোখ রাখলেন। ডাক্তারের মুখে হাসি থাকলেও তপতীর বুক ছমছম করে উঠল। বেচারা চিনু। বসে—যাওয়া চোখমুখ এখন যেন আরও বসে গেছে।
ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখে তন্ময়ের হাতে দিয়ে বললেন, ”বুকটা এক্স—রে করিয়ে নে আর সেইসঙ্গে মানটু টেস্টও।”
শুনেই তপতী প্রায় আর্তনাদের মতো স্বরে বললেন,”সে কী। এসব তো…।”
ভয়ে আর বাকি কথাগুলো বললেন না।
”এগুলো রুটিন চেক—আপ। টিবি যে হয়েছেই আপনি তা ধরে নিচ্ছেন কেন?” তপতীর উদ্বিগ্ন মুখের দিকে ডাক্তার তাকালেন। ”কিংবা যদি হয়েই থাকে তাতেই বা ভয় পাওয়ার কী আছে। টিবির অ্যালার্জি আছে কি না সেটা বোঝার জন্যই মানটু টেস্ট। অন্য অনেক রোগের ব্যাপারেও এই টেস্ট করা হয়। তা ছাড়া এমন এমন সব ওষুধ বেরিয়েছে, কমপ্লিটলি সারিয়ে দেবে। এখন প্রোটিন, ভিটামিন, আয়রন এইসব ওর দরকার। ওষুধগুলো লিখে দিলাম, ঠিকমতো খাওয়াবেন।” ডাক্তার খুব সহজ ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে গেলেন। কিন্তু তপতী তাতে আশ্বস্ত বোধ করলেন না। ছোট্ট চিনুর অবোধ সরল মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর চোখ জলে ভরে এল।
”তন্ময়, এক্স—রে—টা ভাল জায়গা থেকে করবি। তোদের ওখানে তো মিলের হাসপাতাল আছে, কেমন সেটা?”
”অফিসারদের জন্য ব্যবস্থা ভালই, তবে লেবারদের জন্য নয়।”
”এক্স—রে প্লেট আর মানটু টেস্টের রিপোর্ট আমাকে দেখিয়ে যাবি, আর ওষুধগুলো এখনই যাওয়ার পথে কিনে নিয়ে যা, আজ থেকেই খাওয়াতে শুরু কর। লিখে দিয়েছি কখন কতবার খাওয়াতে হবে।”
ওরা চেম্বার থেকে যখন বেরিয়ে আসছে ডাক্তার তখন বললেন, ”তন্ময়, তোর বড় ছেলেকে দেখে মনে হচ্ছে যেন শরীরের ওজন একটু বেশিই। কত ওজন এখন? বয়স কত হল?”
”বলতে পারব না, ওজন কখনও করাইনি। বয়স নয় চলছে। জিজ্ঞেস করলি কেন, খারাপ কিছু?” তন্ময়কে উৎকণ্ঠিত দেখাল।
”বয়সের তুলনায় তো বড়ই দেখাচ্ছে। খারাপ কেন হবে, বেশ ভাল হেলথ। তবে এক্সারসাইজ না করলে মোটা হয়ে যেতে পারে। খেলাধুলো করে?”
”তা করে। স্কুলের স্পোর্টসে সাতটাতে ফার্স্ট হয়েছে।”
”গুড, ভেরি গুড।”
মহাদেবপুরে ফেরার পথে তন্ময় ওষুধগুলো কিনে নিলেন। গাড়ির পেছনের সিটে তপতী দুই ছেলেকে নিয়ে বসেছিলেন। সারা পথ তারা খুব কমই কথা বলল। একসময় মিনু জিজ্ঞেস করল, ”মা, টিবি কি একটা অসুখ?”
হ্যাঁ।
চিনুর কি টিবি হয়েছে? তপতী চমকে উঠে চিনুকে জড়িয়ে ধরলেন। ”না, হয়নি।”
পরদিন তপতী মিলের হাসপাতালে চিনুকে নিয়ে গেলেন। তাকে দেখে অল্পবয়সি ডাক্তার সিনহা অবাক হয়ে বললেন, ”কী ব্যাপার বউদি, আপনি এখানে! কিছু হয়েছে নাকি? দাদা কোথায়?”
”কারও কিছু হয়নি। সবাই ভাল আছে, শুধু আমার এই ছোট ছেলেটা ছাড়া। আপনাকে ভাই দুটো কাজ করে দিতে হবে। আপনার দাদার বন্ধু ডাক্তার হালদার কাল চিনুকে পরীক্ষা করে ওর বুকের এক্স—রে আর মানটু টেস্ট করাতে বললেন।”
তপতী প্রেসক্রিপশনটা বিস্মিত ডাক্তার সিনহার হাতে তুলে দিলেন। সেটা পড়তে পড়তে ডাক্তার বার—দুই চিনুর দিকে তাকালেন। তপতীকে কিছু বলতে গিয়েও বললেন না।
”আপনি একটু বসুন, ব্যবস্থা করছি।” ঘর থেকে ডাক্তার বেরিয়ে গেলেন, এবং ফিরলেন মিনিট পাঁচেক পর। ”ওকে নিয়ে আসুন। আপনার ভাগ্য ভাল, এক্স—রে মেশিনটা আজ সুস্থ আছে, চারদিন ধরে কাজ করছিল না।”
চিনুর বুকের ছবি নেওয়া হল। ডাক্তার ওর বাঁ হাতের পুরো বাহুতে ছুঁচ ফুটিয়ে ওষুধ ঢুকিয়ে হাতের সেই জায়গাটায় একটা টাকার মাপের বৃত্ত এঁকে দিলেন কালি দিয়ে। বৃত্তের মধ্যে চামড়ার রং বদলায় কি না বা ফুলে ওঠে কি না সেটা তিনদিন লক্ষ করতে হবে। ব্যাপারগুলো চিনু কৌতূহলভরে দেখে গেল।
তিনদিন ধরে তপতী বার বার চিনুর হাতটা নজর করলেন। বৃত্তের মধ্যে চামড়া ক্রমশই গোলাপি হতে শুরু করল, ওখানকার চামড়াটা ফুলেও উঠল। আর সেই সঙ্গে তপতীও মনে মনে ভেঙে পড়লেন। যা ভয় করেছিলেন বোধহয় সেটাই তবে ঘটেছে। এবার আর নিজে নয়, তন্ময়কে তিনি চিনুর সঙ্গে পাঠালেন, হাসপাতালে। গম্ভীর মুখে আধঘণ্টা পর তন্ময় ফিরলেন ডাক্তার সিনহার মানটু টেস্ট রিপোর্ট পকেটে নিয়ে।
”কী লিখেছে রিপোর্টে?” ব্যাকুল তপতী জিজ্ঞেস করলেন।
”যা ভয় করেছিলে তাই, পজিটিভ। কালই ওকে নিয়ে অপূর্বর কাছে যাব। দেরি করব না চিকিৎসা শুরু করতে।” তন্ময় অধৈর্য কণ্ঠে বললেন।
.
এক্স—রে থেকে চিনুর ফুসফুসে সামান্য একটা স্পট পেয়েছিলেন ডাক্তার হালদার। তন্ময়কে তিনি বললেন, ”খাওয়ার ওষুধগুলো লিখে দিচ্ছি, ইঞ্জেকশন ওখানকার ডাক্তারকে দিয়ে দিইয়ে নিবি। তিনমাস পর আবার এক্স—রে করিয়ে আমায় দেখাবি। একদম ভয় পাবি না, ওর যা হয়েছে সেটা প্রায় কিছুই নয়।” এ ছাড়াও তিনি চিনুর খাওয়া, থাকা, পোশাক, ঘোরাফেরা ইত্যাদি বিষয়ে কী কী যত্ন নিতে হবে তাও তন্ময়কে বলে দেন।
এর পরই বসুমল্লিক পরিবারে একটা পরিবর্তন এসে গেল। আলো বাতাস রোদ আসে এমন ঘরে চিনুর থাকা দরকার আর সে রকম দক্ষিণ—পুব খোলা ঘর বাড়িতে একটাই। বসবার ঘর। তপতী বললেন, ”দরকার নেই আমার বাইরের লোকজন আসার, তাদের বসাবার জন্য ঘর। চিনু ওই ঘরেই থাকবে।” তন্ময় তাতে সায় দিয়ে বলেন,”সোফাটোফাগুলো খাওয়ার ঘরে নিয়ে যাচ্ছি, কেউ এলে ওখানেই বসবে।”
পরিবর্তন এল খাওয়ার ব্যাপারেও। শুধু চিনুর জন্যই নয়, মিনুর জন্যও দুধ, মাখন, ছানা, ডিম, ভেজানো ছোলা—মটর। বেড়ে গেল ডাল ও সবুজ শাকপাতা, ডাঁটা, মাটির নীচে জন্মানো আনাজ। পেয়ারা, কলা বা মরসুমি ফল। মাছের পরিমাণও বাড়ল। সপ্তাহে তিনদিন চিকেন স্টু।
”রোগটা ছোঁয়াচে, আমার মনে হয় আলাদা বাসন থাকা দরকার চিনুর জন্য।” তন্ময়ের এই কথায় সায় দিলেন তপতী। সাবধানের মার নেই, বাড়িতে আরও একটা ছেলে রয়েছে। অতঃপর চিনুর জন্য প্লেট, গ্লাস, বাটি ইত্যাদি কেনা হল।
একদিন রাত্রে সকলের খাওয়াদাওয়ার পর চিনুকে ঘুম পাড়িয়ে তন্ময় ও তপতী খাওয়ার ঘরে বসে কথা বলছিলেন।
”এবার থেকে জল ফুটিয়ে খাওয়াই উচিত। এখানে ট্যাঙ্কের যে জল, তাতে কত যে ব্যাকটিরিয়া।” তপতীর কথাটাকে সমর্থন করলেন তন্ময়। যদিও তিনি মহাদেবপুরের পৌর বিভাগের কর্তা, তবু তিনি জলের পরিশুদ্ধতায় পুরো আস্থা রাখেন না।
”আমাদের এখন মনেপ্রাণে ছেলেদের স্বাস্থ্যের কথাটা ভাবতে হবে। কে ভেবেছিল এমন একটা রোগ, যেটা না খেতে পাওয়া, অস্বাস্থ্যকর জায়গায় থাকা লোকেদেরই হয়, সেই রোগ কিনা আমার ছেলের হল!” তন্ময়ের গলায় ক্ষোভ আর অসহায় ক্রোধ। ”কেন হবে চিনুর, কেন, কেন? এবার থেকে একটা রোগকেও আর বাড়িতে ঢুকতে দেব না। সাধ্যে যতটা কুলোয় আমি চেষ্টা করে যাব।”
”সেজন্য তা হলে খরচ করতে হবে।” তপতী দ্বিধাভরে বললেন। সংসারটা তাঁকেই চালাতে হয় এবং সেজন্য নির্ভর করতে হয় স্বামীর বাঁধা বেতনের ওপর।
”করব খরচ। ছেলেদুটোই তো আমাদের সবকিছু। ওদের সবল, সুস্থ রাখা, লেখাপড়া শিখিয়ে দশজনের একজন করে তোলা, এজন্য আমার শেষ কপর্দকও খরচ করব।” কথাগুলো বলে তন্ময় এমনভাবে তপতীর দিকে তাকালেন, যেন জটিল একটা অঙ্ক কষে ফেলে ফলটা ঠিক হয়েছে কি না জানতে চাইছেন।
”এজন্য আমাদের কষ্ট করতে হবে।” তপতী শান্তস্বরে বললেন।
”হবেই তো। কষ্ট না করলে কি সফল হওয়া যায়?” তন্ময় উত্তেজিত হয়ে তালুতে ঘুসি বসালেন।
”দেখো, আমার মনে হচ্ছে মিনুর এই দাবা খেলাটা বন্ধ করতে হবে। এটা নেশার মতো ওকে পেয়ে বসেছে। আগে বিকেলে মাঠে খেলতে যেত, এখন যায় না। এইটুকু ছেলের পক্ষে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকাটা ভাল নয়।”
”তা তো নয়ই, কিন্তু করবটা কী?” তন্ময়কে অসহায় দেখাল। ”কিছু একটা তো করতে হবে।” তপতীর স্বরে দৃঢ়তা ফুটে উঠল।
.
প্রতিদিনের মতো মিনু আর চিনুকে নিয়ে তপতী ভোরে বেড়াতে বেরিয়েছেন। রোজই তারা হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার ধারে যায়। পিচঢালা রাস্তাটা ফেরিঘাটে শেষ হয়েছে। সেখানে একটা কাঠের বেঞ্চে তারা বসে। ভোরের নির্মল বাতাস নদীর ওপর দিয়ে এসে তাদের শরীরকে তাজা করে তোলে। বুকভরে তারা টাটকা বাতাস জমা করে। ফেরার সময় মিনু দৌড়য়। তখন চিনু বলে, ”মা, দাদার সঙ্গে আমিও দৌড়ে বাড়ি যাব।” তপতী ওকে দৌড়তে দেন না। ”আগে ডাক্তারবাবু বলুন, তারপর।”
কিন্তু আজ চিনু বায়না ধরল, সে দৌড়বেই। কী ভেবে তপতী বললেন,”আচ্ছা। কিন্তু জোরে নয়।”
.
মিনু লম্বা কদমে জোরেই ছুটতে শুরু করল, তার পেছনে চিনু। ভোরের নির্জন রাস্তায় তখন গাড়ি চলা শুরু হয় না। ওরা নিশ্চিন্তেই ছুটছিল। বড় রাস্তা থেকে বাঁ দিকে বেঁকে ওরা একটা সরু রাস্তায় ঢুকে গেল। তপতী হাঁটার বেগ বাড়ালেন, ছেলেরা তাঁর দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য হতেই।
মিনুর অনেক পেছনে চিনু। রাস্তার দু’ধারে মিলের ব্যারাক। কম মাইনের শ্রমিকরা এখানে থাকে। একতলা টানা লম্বা বাড়িগুলো ছাড়িয়ে কিছুটা ফাঁকা মাঠ, তারপর ডান দিকে ফিরে আবার একটা চওড়া রাস্তা। মিনু ব্যারাকটার শেষপ্রান্তে যখন পৌঁছেছে তখন কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে মুখ ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়েই থেমে পড়ল। চিনু ভয়ে সিঁটিয়ে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে আর দুটো কুকুর তাকে কামড়াবার জন্য তেড়ে যাচ্ছে পায়ের গোড়ালি তাক করে।
”চিইনউউ।” বলে চিৎকার করে মিনু পাগলের মতো ছুটতে শুরু করল ছোট ভাইয়ের দিকে। দাদাকে ছুটে আসতে দেখে চিনু প্রায় চোখ বুজে মিনুর দিকে ছুট দিল। সঙ্গে সঙ্গে কুকুর দুটো তার পিছু নিল। মিনু যখন জড়িয়ে ধরল ভাইকে, একটা কুকুর তখন চিনুর কেডসে প্রায় দাঁত ছুঁইয়ে ফেলেছে। চিনুকে পিছনে ঠেলে দিয়ে মিনু দু’হাত মুঠো করে শূন্যে এলোপাথাড়ি ঘুসি চালাতে শুরু করে দিল। কুকুর দুটো আর না এগিয়ে দাঁত বার করে বারবার তেড়ে যেতে লাগল।
সেই সময় ব্যারাক থেকে একটা লোক বেরিয়ে এসে, দুটো তেরিয়া কুকুরের সামনে একটি ছেলেকে ঘুসি চালিয়ে যেতে দেখে কুকুরদুটোকে ধমকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল, ”আর কিছু করবে না, এবার তোমরা যাও। তবে ছুটো না।”
মিনু ভাইয়ের কাঁধ একহাতে জড়িয়ে ধরে টানল, ”ভয় কী রে? আমি থাকতে ভয়ের কিছু নেই। চল, এবার হেঁটে হেঁটে যাই। খানিকটা গিয়ে আবার দৌড়ব।”
চিনু থরথর কাঁপছে। ভয়ে ফ্যাকাসে মুখে রক্ত তখনও ফিরে আসেনি। দাদার হাত আঁকড়ে ধরে বলল, ”কামড়ে আমার মাংস খুবলে নিত, না রে?”
”অত সোজা যেন, খোবলাব বললেই যেন খোবলানো যায়। টেনে এমন একটা লাথি মারতাম যে, দাঁতগুলো ভেঙে যেত।” মিনু লাথি ছুড়ে দেখাল। তাচ্ছিল্যে ঠোঁট বাঁকাল।
”দাদা, তুই মাকে বলে দিবি না তো?”
”বললে কী হয়েছে?”
”মা তা হলে আমায় আর ছুটতে দেবে না।”
”তা হলে ছোট আমার সঙ্গে। না ছুটলে অসুখ সারবে না।”
ঘটনাটার কথা তপতী জানতে পারেননি। তার বদলে জানতে পারলেন আর একটা কথা। যেভাবেই হোক চিনুর অসুখটার কথা গোপন করা সত্ত্বেও অনেকেই জেনে গেছল। একদিন মিনু স্কুল থেকে ফিরে এসে তপতীকে বলল, ”জানো মা, সুব্রত আজ আমার ওয়াটারবটল থেকে জল খেল না।”
”কেন? তুই জল দিতে গেছলি কেন?”
”ও আজ ওয়াটারবটল নিয়ে যেতে ভুলে গেছল। ক্লাসে ওর খুব তেষ্টা পেয়েছিল তাই দিলীপের কাছে জল চাইল। আমি বললুম, ‘আমারটা থেকে খা’, ও বলল, ‘তোর ওয়াটারবটল থেকে জল খাব না। তোদের বাড়িতে ক্ষয়রোগের রুগি আছে। তোর জল খেলে আমারও ক্ষয়রোগ হবে।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ক্ষয়রোগ কাকে বলে?’ ও বলল,’ক্ষয়ে ক্ষয়ে ভ্যানিশ হয়ে যায় বলে এর নাম ক্ষয়রোগ।’ হ্যাঁ মা, সত্যি? চিনু ভ্যানিশ হয়ে যাবে?”
শুনতে শুনতে তপতীর চোখে জল এসে গেল। কথাগুলো নিশ্চয় সুব্রত বাড়িতে শুনেছে বলেই বলেছে। বাড়ির লোকরা কী নিষ্ঠুরের মতো এইরকম কথাবার্তা বলেছে। সুব্রত মজুমদারের মা প্রতিভা খুবই অমায়িক, মিষ্টভাষী, প্রায়ই স্বামীর সঙ্গে অফিসার্স ক্লাবে যান, সেখানে গল্পের আসর বসান। তপতীকে দেখলেই বলেন, ”এই যে পূর্ণিমা, তোমার অমাবস্যাটি কোথায়?”
গরম লোহার শিকের মতো ‘ভ্যানিশ’ শব্দটা ঢুকে গিয়ে তপতীর মাথাটা গরম করে দিল। একটা জেদ তাঁকে ধীরে ধীরে পেয়ে বসল। তিনি স্থির করলেন আজই ক্লাবে যাবেন এবং চিনুকে সঙ্গে নিয়ে।
সন্ধ্যার পর বসুমল্লিকরা চিনুকে নিয়ে ক্লাবের সামনে ভক্সহল থেকে নামলেন। সঙ্গে ফুটোনো জলে ভরা ওয়াটারবটল। মিনুকে তাঁরা সঙ্গে আনেননি। ক্লাবের লনে ছোট ছোট টেবল ঘিরে চেয়ার। দশ—বারোটি দম্পতি এবং তাঁদের বাচ্চচা ছেলেমেয়েরা চেয়ার ভরিয়ে রেখেছে। একটি টেবল ঘিরে পাঁচজন মহিলা, তাদের মাঝে প্রতিভা মজুমদার হাত নেড়ে নেড়ে, ভ্রূ নাচিয়ে কথা বলে যাচ্ছেন, বাকি চারজন মুগ্ধ হয়ে শুনছেন। তপতী আর তন্ময়কে দেখে প্রতিভা আজ আর হাত তুললেন না। ফিসফিস করে অন্যদের কী যেন বললেন। সকলেই মুখ ঘুরিয়ে বসুমল্লিকদের দিকে তাকাল।
লনের মাঝখানে লোহার পোস্টের মাথায় উজ্জ্বল বিদ্যুতের আলো। তার নীচে একটা ফাঁকা টেবলে ওঁরা বসলেন। বেয়ারা এল, কিছু খাবে কি না জানতে।
”কী আছে আজ?” তন্ময় জানতে চাইলেন।
”চিকেন পকৌড়া, শিঙাড়া, চানা—মটর।”
তন্ময় হাত তুলে বেয়ারাকে থামিয়ে দিলেন। ”ওসব খাবার চলবে না।”
”তিন গ্লাস জল দাও আগে, তারপর এক পট চা আর তিনটে কাপ।” তপতী ফরমায়েশ দিলেন। তারপর চিনুকে বললেন, ”যা, দোলনায় চড় গিয়ে।”
একধারে দুটি দোলনা, স্লিপ এবং সি—স্য রয়েছে বাচ্চচাদের খেলার জন্য। কিছু বাচ্চচা খেলছে। দোলনায় দুলছে দুটি মেয়ে। চিনু গিয়ে দোলনার পাশে অপেক্ষা করতে লাগল। হঠাৎই প্রতিভাদের টেবল থেকে একজন চেঁচিয়ে উঠল, ”শিলু, শিগগির চলে এসো এখানে।” কিন্তু শিলু নামের মেয়েটি মায়ের কথা অগ্রাহ্য করে দুলেই চলল। তার মা উঠে গিয়ে দোলনা থামিয়ে শিলুর গালে চড় কষিয়ে টানতে টানতে নিয়ে এলেন।
খালি দোলনাটায় চিনু উঠতে পারছিল না, তপতী উঠে গিয়ে তাকে বসিয়ে দিয়ে দোল দিতে লাগলেন। মিনিট পাঁচেক পর ছেলেকে নিয়ে টেবলে ফিরে এলেন। বেয়ারা চা ও জল দিয়ে গেছে। একটা গ্লাস থেকে জল ফেলে দিয়ে বাড়ি থেকে আনা জল তাতে ভরে চিনুকে বললেন, ”একটু জল খা।”
চিনু যখন জল খাচ্ছে, তপতী আড়চোখে দেখলেন প্রতিভা তাঁদের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। তিনটি কাপে তিনি চা ঢাললেন, তবে একটিতে যৎসামান্য। সেটি চিনুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ”এক চুমুক, ব্যস।” জীবনে চা খায়নি চিনু, সে অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকাল। ”যা বলছি কর, ঠিক এক চুমুক।”
চিনু তাই করল। তপতী আড়চোখে তাকালেন আবার এবং মনে মনে হাসলেন। সেই সময় ক্লাবে ঢুকল রাজেন এবং শুভা। বসুমল্লিকদের দেখতে পেয়ে তাদের টেবলেই ওরা এসে বসল। বেয়ারা এল। কী খাদ্য আছে, জানতে চাইল রাজেন এবং শুনে নিয়ে সে তন্ময়কে বলল, ”দাদা তা হলে পকৌড়াই আনাই। বউদি, শিঙাড়া চলবে?”
”না।” হেসে তপতী বললেন, ”কোনওটাই না।”
”সে কী! আমি তো আপনাদের খেতে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে।”
”যে খাবার আমার ছেলেদের খেতে দিই না, সে খাবার এখন আমরাও খাচ্ছি না।” তন্ময় উত্তর দিলেন। ”আসলে চিনুর এই অসুখটাই আমাদের সচেতন করে দিয়েছে। আমাদের, মানে ছেলেদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারটা। ওদের ভাল স্বাস্থ্য গড়ে দেওয়ার কাজে আমরা নেমেছি। সেজন্য কিছু বিধিনিষেধ আমরা মানছি। তার মধ্যে রয়েছে এই খাওয়ার ব্যাপারটা। মুখরোচক এইসব খাবার ওদের খেতে দিই না, সেজন্য আমরাও খাই না।” তন্ময় হাসতে শুরু করলেন।
”দারুণ কাজে নেমেছেন তো।” এই বলে রাজেন পাশে দাঁড়ানো বেয়ারাকে বলল,”শুধু চা দাও।”
”কিছু খাবে না তোমরা!” তন্ময় বললেন কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হয়ে।
”না দাদা। কিছু বিধিনিষেধ আমিও আজ জারি করলাম। যে খাবার আপনারা খাবেন না, সে খাবার…।”
রাজেন শেষ করার আগেই তন্ময় হেসে উঠলেন। ”নিষেধ মেনে শেষ পর্যন্ত চলতে পারবে তো? বাঙালির নোলা বিশ্বাসঘাতকতায় খুব পটু।”
”আপনাদের একটা কাজের তো পরিচয় পেলাম, এর পর আর কী কাজে নেমেছেন?”
”নামা হয়নি, তবে নামার জন্য চিন্তা করছি।” তপতী বললেন। ”ওদের কোনও একটা খেলা শেখানোর ব্যবস্থা করা। শুধুমাত্র পুষ্টিকর খাওয়া দিয়েই তো স্বাস্থ্য হয় না, শরীর গড়তে পরিশ্রমেরও দরকার হয়।”
”আচ্ছা রাজেন, ওদের কোন খেলা শেখানো যায় বলো তো?”
তন্ময়ের বলার ভঙ্গিতে বোঝা গেল তিনি এটা নিয়ে চিন্তিত।
”এখানে খেলা শেখানো!” ভ্রূ কপালে তুলে রাজেন হতাশভাবে মাথা নাড়ল।
”এখানে মাঠটাঠ আছে, কিন্তু লোকের কোনও উৎসাহ নেই। এই দেখুন না ওই যে টেনিস কোর্টটা, কত বড় বড় ঘাস গজিয়ে গেছে, কেউ খেলে না বলেই তো! সবাই তাস আর ক্যারাম খেলে চা—শিঙাড়া খেয়ে বাড়ি চলে যায়। অথচ খেলার জন্য নেট, কিছু পুরনো বল ক্লাবে পড়ে আছে। ঘাস ছাঁটাইয়ের জন্য একটা লন—মোয়ারও রয়েছে।
”একদিন মিস্টার ভটচাযকে বলেওছিলাম, নতুন সেক্রেটারি হলেন, ক্লাবের হালটা একটু ফেরান। শুধু আড্ডা দেওয়া ছাড়াও মেম্বাররা যাতে একটু ছোটাছুটি করে ঘাম ঝরাতে পারে, তার ব্যবস্থা করুন না! উনি বললেন, ‘কী ব্যবস্থা করব বলুন? টেবল টেনিস বোর্ড কেনার জন্য কমিটি মিটিংয়ে প্রপোজাল দিলাম, সবাই হাঁ হাঁ করে উঠল। বলল, ‘বোর্ড পাতবেন, জায়গা কোথায়?’ আসলে বোর্ড পাতলে তাস খেলার টেবলগুলো তুলে দিতে হবে তো। বললাম, ‘টেনিস কোর্টটাকে ঠিকঠাক করে দেখুন না আবার চালু করা যায় কি না।’ উনি বললেন, ‘কিসসু হবে না, খেলার লোকই পাওয়া যাবে না। আপনাকে একা একাই খেলতে হবে।’ ভেবে দেখলাম, মিস্টার ভটচায বাজে কথা বলেননি। তবে লোকটা খেলা ভালবাসেন।”
রাজেন নিরুৎসাহিত গলায় কথাগুলো বলে চায়ের কাপ নেওয়ার জন্য শুভার দিকে হাত বাড়াল। তপতী মুখ ঘুরিয়ে অন্ধকার টেনিস কোর্টটার দিকে তাকালেন। কিছু একটা তিনি ভাবছেন। প্রতিভাদের টেবলের মহিলারা উঠলেন। বাড়ি যাওয়ার জন্য ছেলেমেয়েদের ডাকাডাকি শুরু হল।
”আমি একবার মিস্টার ভটচাযের সঙ্গে দেখা করব।” তপতী বললেন।
”কেন?” তন্ময় জানতে চাইলেন।
”যদি কোর্টটাকে আবার জাগিয়ে তোলা যায়। দেখি উনি ক্লাবঘরে আছেন কি না।” তপতী চেয়ার থেকে উঠলেন। কয়েক পা যেতেই পড়লেন প্রতিভার সামনে।
”তোমার ছোট ছেলের নাকি খুব অসুখ হয়েছে শুনলাম,” অত্যন্ত উদ্বিগ্ন মুখ প্রতিভার। অসুখটা যেন তাঁর নিজের ছেলেরই হয়েছে।
”হ্যাঁ।”
”আহা রে, একেই তো বরাবরের রুগণ, তার ওপর আবার অসুখ, ছেলেটার যে কী কপাল! অসুখটা কী?”
”টিউবারকুলাসিস, যাকে বলে ক্ষয়রোগ।” তপতী ধীর স্বরে বললেন।
”ও মা! টিইবিই! ভাল ডাক্তার দেখাচ্ছ তো?”
”দেখাচ্ছি।”
”এখন কেমন আছে? মুখ দিয়ে রক্ত টক্ত ওঠে?”
”ওই তো বসে রয়েছে দেখুন না! এখন চিনু ভোরে ওর দাদার সঙ্গে ছোটে।”
”না, না, না, ছোটাছুটি করিও না, ফুসফুস ড্যামেজ হলে ধুঁকতে ধুঁকতে সারা জীবন কাটাবে, চিরকালের মতো অক্ষম হয়ে যাবে।”
”আর নয়তো ক্ষয়ে ক্ষয়ে ভ্যানিশ হয়ে যাবে।” তপতী হাসতে শুরু করলেন। প্রতিভা সন্দিহান চোখে তপতীর হাসি দেখতে দেখতে গম্ভীর হয়ে গেলেন।
”যাই, দেরি হয়ে যাচ্ছে।” বলে প্রতিভা হনহনিয়ে এগিয়ে গেলেন।
ক্লাবের অফিসে বসে কমল ভটচায দু’জন মেম্বারের সঙ্গে কথা বলছিলেন। প্লাইউডের পার্টিশন করা খোপের মতো একটা ঘর। দরজায় পাল্লার বদলে একটা পরদা ঝুলছে। তপতীকে দেখে কমল ভটচায অবাক হলেন।
”আপনি! কী ব্যাপার? বসুন, বসুন।”
”একটা বিষয়ে একটু কথা বলতে এসেছি।” একমাত্র খালি চেয়ারটায় বসে তপতী কোনও ভনিতা না করে বললেন, ”ক্লাবের টেনিস কোর্টটাতে খেলার ব্যবস্থা করুন। জানি মেম্বারদের খুব একটা উৎসাহ নেই, কিন্তু তাদের ছেলে মেয়েদের তো থাকতে পারে।”
কমল ভটচায আচমকা এমন একটা অনুরোধের সামনে পড়ে ভেবে পেলেন না কী জবাব দেবেন। কিন্তু কিন্তু করে বললেন, ”এমন একটা প্রস্তাব অবশ্য রাজেন রায়চৌধুরী একবার আমাকে দিয়েছিলেন। উনি তো একসময় কলকাতায় টেনিস খেলতেন, শুনেছি ভালই খেলতেন, তাই হয়তো টেনিস প্রীতিতেই কথাটা তুলেছিলেন। কিন্তু মিসেস বসুমল্লিক, অসুবিধেটা কী জানেন, মেম্বাররা সারাদিন নানান শিফটে মিল আর অফিস করে রিল্যাক্স করার জন্য এখানে আসেন, তাই কেউ আর টেনিস নিয়ে উৎসাহী হন না। তবে আপনি যেটা বললেন, ছেলেমেয়েদের কথাটা, হ্যাঁ, এটা ভেবে দেখা যেতে পারে। কিন্তু করে কে? কোর্টটায় শুধু বড় বড় ঘাসই নয়, বড় বড় গর্তও আছে। খোয়া, নুড়ি ছড়ানো, জমি অসমান। রীতিমতো মেহনত করতে হবে ওটাকে নিয়ে। এদিকে ক্লাবে একজন বেয়ারা, একজন কুক। মালি ছিল, তাকে এই মাসেই ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মাসের অর্ধেক দিন তার দেখাই পাওয়া যেত না।”
”আপনার অসুবিধেগুলো আমি বুঝতে পারছি।” তপতী নম্র আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন। ”কিন্তু কেউ যদি দায়িত্বটা নেয় তা হলে কি আপনি সাহায্য করবেন?”
”নিশ্চয় করব। কিন্তু সাহায্য বলতে কী বোঝাচ্ছেন? আপাতত আমার লোকবল নেই। বেয়ারা কি কুক, মাঠের কাজ করবে না বললে তাদের দিয়ে করাতে পারব না। অর্থবলও তেমন নেই যে, লোক ভাড়া করতে পারব। নামেই অফিসার্স ক্লাব, অর্ধেক মেম্বারই তিন—চার মাসের চাঁদা বাকি ফেলেছেন। তাই নিয়েই তো এঁদের সঙ্গে কথা বলছিলাম।” কমল ভটচায হাত দিয়ে দেখালেন এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকা দু’জনকে।
”লোকজন বা টাকা কিছুই দিতে হবে না, শুধু কোদাল, ঝুড়ি, বালতি, জল এইসব; আর লন—মোয়ারটা দিলেই হবে।”
”মোয়ারটা খারাপ হয়ে পড়ে আছে। একটা চাকা আর কী যেন ভেঙেছে।”
”সে আমি সারিয়ে নেব।… তা হলে আপনি অনুমতি দিচ্ছেন।”
”অবশ্যই। যদি দায়িত্ব নিয়ে কোর্টটাকে উদ্ধার করতে পারেন তা হলে সত্যিই একটা কাজের কাজ হবে। কিন্তু মিসেস বসুমল্লিক—” কমল ভটচায থেমে গলা নামিয়ে বললেন, ”খেলার জন্য লোক পাবেন তো?”
”নেটের দু’ধারে দাঁড়াবার জন্য ইতিমধ্যেই দু’জনকে পেয়ে গেছি—আমার বড় ছেলে আর আমি।”
।।৩।।
পরদিন ভোরে ফেরিঘাট থেকে মিনু ও চিনু দৌড় শুরু করার পর তপতী হাঁটতে শুরু করলেন বাড়ির বদলে ক্লাবের দিকে। উদ্দেশ্য, দিনের আলোয় ভাল করে কোর্টের অবস্থাটা দেখে নেওয়া।
মিনিট কুড়ি পর তিনি পৌঁছলেন। রাত্রে ক্লাবঘরে শোয় বেয়ারা কান্তি। তার দেশ নদিয়া জেলার এক গ্রামে। বাড়িতে বউ, ছেলে মেয়ে আছে। বয়স্ক লোক, মানুষ ভাল। সে তপতীকে চেনে। এত সকালে ‘মেমসায়েব’কে ক্লাবে দেখে কান্তি হতভম্ব।
”মালি তার জিনিসপত্র কোথায় রাখে কান্তি, আমি একটু দেখব।”
ক্লাবঘরের পেছনে একটা ঢাকা জায়গায় মোয়ারটা দেয়ালে ঠেস দেওয়া। একটা চাকা খোলা, তবে ভাঙেনি। ছাঁটাই হওয়া ঘাস যে লোহার ডালাটায় পড়ে, সেটা ঝুলে রয়েছে। ঘাস ছাঁটাই করার একটা ব্লেড ভাঙা। কোদাল একটা আছে বটে, তার বাঁশের হাতলটা নেই। একটা শাবলও রয়েছে। কোনও ঝুড়ি নেই। টেনিসের নেটটা খুঁজে পাওয়া গেল না।
”আপনি কী করবেন এসব দিয়ে?” কান্তি তো অবাক!
”মাঠ বানাব। ওই টেনিস কোর্টটাকে খেলার যোগ্য করে তুলতে হবে।”
”আপনি করবেন?”
”লোক দিয়ে করাতে হবে।”
কোর্টের অবস্থা দেখে তপতীর কপালে দু—তিনটে ভাঁজ পড়ল। ঘাস এত লম্বা যে, প্রথমে হেঁসো দিয়ে না কাটলে মোয়ার চালানো যাবে না। জমিতে কয়েকটা জায়গায় মাটি ফেলতে হবে, গর্ত বোজাতে হবে, ঢিপির মতো উঁচু জায়গায় মাটি চাঁছতে হবে আর ভাঙা ইটের টুকরো, কাঁকর বাছতে হবে। এত ‘হবে’ কিন্তু তাঁকে দমাতে পারল না। প্রথমেই মোয়ারটা সারাতে হবে, একটা কি দুটো মাটি ফেলার ও তোলার ঝুড়ি চাই, কোদালের জন্য হাতলও।
”কান্তি, একজন কি দু’জন মজুর জোগাড় করতে পারবে? আর একজন ঘেসুড়ে?”
”তা পারা যাবে।”
”তোমাকে আমি পরশু বলব।”
তপতী যখন বাড়ি ফিরলেন সবাই তখন খাওয়ার টেবলে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল।
”কেমন দেখলে?” তন্ময় জানতে চাইলেন।
”যা দেখব ভেবেছিলাম তাই দেখলাম। তবে হয়ে যাবে। তোমার একটু সাহায্য চাই। মোয়ারটা ভাঙাচোরা, ওটাকে সারাতে হবে। তোমার তো অনেক মিস্ত্রি আছে, একজনকে পাঠিয়ে দাও না ওটা ঠিক করে দেবে।”
”পাঠাব। আর কী দেখলে?”
”দেখলাম বেশ কিছু টাকা খরচ করতে হবে, মিস্ত্রি লাগাতে হবে।”
”টাকা!” তন্ময় নড়েচড়ে বসলেন। চিনুর চিকিৎসা আর সুষম পুষ্টিকর খাদ্য চালু হয়ে সংসার খরচ যথেষ্ট বেড়ে গেছে। মাইনের টাকা হিসেব করে খরচ করতে হচ্ছে এবং খরচটা করে তপতী। সুতরাং টেনিস কোর্ট সংস্কারের জন্য খরচের টাকা যে তাঁদের পক্ষে দেওয়া কষ্টকর হবে, এটা তপতী জানেন।
”টাকা আমাদের খরচ করতে হবে নাকি! ক্লাব দেবে। মেম্বারদের ছেলেমেয়েরাই তো খেলবে।” তন্ময় মৃদু স্বরে আপত্তি জানালেন।
”মনে রেখো মেম্বারদের ছেলে মেয়েদের মধ্যে আমদেরও দুটো ছেলে আছে। ওদের মুখ চেয়ে একাজ আমায় করতেই হবে। আমি মেম্বারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলব।” তপতীর চোখ জ্বলজ্বলে, কণ্ঠস্বরে আবেগ এবং দৃঢ়তা।
”চাঁদা তুলবে! কত করে চাঁদা?”
”দশ টাকা প্রতি ফ্যামিলি। একবারই শুধু দিতে হবে।”
”দঅঅশ টাকা!” তন্ময়ের চোয়াল ঝুলে পড়ল। ”জানো, এই দশ টাকায় বারো সের চাল পাওয়া যায়, আড়াই মাস খবরের কাগজ কেনা যায়…।”
”দুটো হরলিকস কেনা যায়, চার সের সর্ষের তেল কেনা যায়, চার সের পাঁঠার মাংস কেনা যায়… তাতে কী হল?” তপতীর চোখে চ্যালেঞ্জ।
”এত টাকা কী কেউ বাচ্চচার খেলার জন্য দেবে?” তন্ময় স্পষ্টতই সন্দেহ প্রকাশ করলেন। ”প্রাইভেট টিউটর রাখার জন্য টাকা খরচ করতে বললে করবে কিন্তু ছেলে মেয়ের খেলার জন্য…।” তন্ময় কথা অসম্পূর্ণ রেখে মাথা নাড়লেন।
”এসব হতাশার কথা। আগে সবাইকে বলে তো দেখি।”
”ঠিক আছে, বলে দেখো।” তন্ময়ের মুখ দেখে মনে হল না তিনি হতাশা কাটাতে পেরেছেন।
মিনু—চিনু চুপ করে খেয়ে যাচ্ছিল আর বাবা—মার কথা শুনছিল। এবার মিনু বলল,”মা, আমি টেনিস খেলব?”
”হ্যাঁ।”
”আর কে খেলবে?”
”এখানকার সবাই খেলবে।”
চিনু ফিসফিস করে বলল, ”মা আমি?”
”সোমবার তোমার এক্স—রে করার দিন। কলকাতায় ডাক্তারকাকা সেটা দেখবেন। তারপর তিনি যদি খেলতে বলেন তো খেলবে।”
”মা, তুমিও খেলবে? আগে তো খেলতে!” মিনু বলল।
”হ্যাঁ, আমিও খেলব… যদি দরকার পড়ে।”
.
”আরে মিসেস বসুমল্লিক! কী ব্যাপার?” সুধা ঘোষাল অবাক হয়ে অভ্যর্থনা জানালেন তপতীকে। বাংলোর বারান্দায় বেতের চেয়ার টেনে বললেন, ”বসুন, বসুন। অনেকদিন পর এলেন।”
”মাসতিনেক প্রায়। ছোট ছেলের অসুখের জন্য কোথাও আর যেতে পারি না।” চেয়ারে বসলেন তপতী। সুধা ঘোষালের স্বামী এখানকার চিফ লেবার অফিসার। ওঁদের এক ছেলে সুধেন্দু ক্লাস সেভেন—এ পড়ে।
”ছেলে এখন কেমন আছে?”
”ভাল। অল্প অল্প ছুটছে, কোনও কষ্ট হচ্ছে না।”
”ভোরে তো দেখি দুই ছেলেকে নিয়ে বেড়াতে বেরোন, খুব ভাল এটা। আমিও মাঝে মাঝে ভাবি সকালে একটু বেড়াই। কিন্তু মুশকিল কী জানেন, ডান হাঁটুতে একটু বাতের মতো হয়েছে, তা ছাড়া সুধেন্দুকে নিয়ে পড়াতে বসতে হয়। ক্লাস সেভেন থেকে যদি পড়ায় জোর না দেয় তা হলে স্কুল ফাইনালে ভাল রেজাল্ট করবে কী করে?”
”স্কুল ফাইনালের তো এখনও অনেক দেরি।”
”অনেক দেরি!” সুধা ঘোষাল আর্তনাদ করে উঠলেন। ”মাত্র চারটে বছর, দেখতে দেখতে কেটে যাবে। একে আপনি অনেক দেরি বলছেন?”
তপতীর মনে হল, সুধা ঘোষাল এমনভাবে তাঁর দিকে তাকিয়ে, যেন একটা মানুষকে হঠাৎ বনমানুষে রূপান্তরিত হতে দেখলেন। তিনি অপ্রতিভ বোধ করে সুধা ঘোষালকে তুষ্ট করার জন্য বললেন,”সুধেন্দু তো পড়াশোনায় খুবই ভাল, অমন ছেলে ক’টা আর হয়, এবারও তো ফার্স্ট হয়ে উঠল।”
”সেটা তো স্কুলের ফার্স্ট, কিন্তু গোটা বাংলার তো নয়। ওর বাবা এম এসসি—তে ফার্স্ট ক্লাস সেকেণ্ড হয়েছিল, আমি বি এ—তে ডিস্টিংশন পেয়েছি। সুধেন্দুকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট তো হতেই হবে। ওর বাবা তো বলে, ‘ছেলে বাপকে ছাড়িয়ে না গেলে সে আর ছেলে কীসের?’ তবে ছেলেও বাপ—মায়ের মন বোঝে, সবসময় পড়ার বই নিয়ে থাকে।”
”কিন্তু মিসেস ঘোষাল, আপনাদের যেমন ইচ্ছে তেমনি ছেলেরও তো কিছু ইচ্ছে থাকতে পারে।”
”ছেলের ইচ্ছে! সুধেন্দুর? ওর একটাই ইচ্ছে, বাপ—মার মুখ উজ্জ্বল করা, আই এ এস, কি আই পি এস হয়ে সমাজের একজন হওয়া। সেইভাবেই আমরা ওকে তৈরি করতে চাই।”
”ওর বয়স এখন কত, তেরো?”
”হ্যাঁ।”
”এই বয়সের ছেলেদের তো খেলতে ইচ্ছে করে, আর সেইজন্যই আপনার কাছে আসা।” সুধা ঘোষালকে কথা বলার কোনও সুযোগ না দিয়ে তপতী বলে চললেন, ”ক্লাবে যে টেনিস কোর্টটা পড়ে আছে সেটাকে সংস্কার করে ছেলে মেয়েদের খেলার ব্যবস্থা করতে চাই, সেজন্য কিছু টাকার দরকার, তাই আপনার কাছে এসেছি যদি দশটা টাকা চাঁদা দেন। সুধেন্দুর বিকেলে একটা কিছু খেলা তো দরকার।” তপতী শেষ বাক্যটির ওপর ভরসা করলেন। ছেলের খেলার একটা ব্যবস্থা হলে কোন মা আর টাকা না দিয়ে থাকতে পারবেন। কিন্তু ফল হল বিপরীত।
”বিকেলে খেলা? …পাঁচটার সময় সুধেন্দুর ইংলিশ টিউটর আসে। এই তো ভেতরের পড়বার ঘরে ও এখন পড়ছে। সকালে আমি পড়াই, বিকেলে টিউটর, অফিস থেকে ফিরে ওর বাবা ওকে নিয়ে বসেন। ওর খেলার সময় কোথায়? আমরা তো ওকে বারবার বলি জীবনে এখনই পড়ার সময়, যা কিছু জ্ঞান এখনই আহরণ করে নাও, খেলার জন্য পরে অনেক সময় পাবে, ঠিক কি না বলুন?”
তপতী ঢোঁক গিললেন। ”বলছিলাম কী, যদি দশটা টাকা চাঁদা—”
”না, না, না, সুধেন্দুকে পড়া ফেলে খেলতে আমরা পাঠাব না। এই দেখুন আপনাকে চা দেওয়া হল না।”
”চা খাব না, আমি এখন উঠি। আরও কয়েকজনের কাছে যেতে হবে।” তপতী চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন।
.
”তপতীদি, আপনি যা করতে চাইছেন সেটা তো খুবই ভাল। ছেলে মেয়েদের সত্যিই এখানে নিয়মিত খেলার কোনও ব্যবস্থা নেই।” চন্দ্রিমা দত্ত তাঁর পাঁচ বছরের মেয়ে লঘিমাকে কোলের কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে বললেন। ”আমি তো সেইজন্যই লঘুকে নাচের স্কুলে ভর্তি করিয়েছি।”
”খুব ভাল করেছ। তবে ফিজিক্যাল এক্সারসাইজটাও যদি ওই সঙ্গে করে, তা হলে নাচটা আরও ভাল হবে।”
”তা হয়তো হবে। কিন্তু তপতীদি, টেনিস আর নাচ দুটো চালানো ওর পক্ষে অসম্ভব! বাড়িতে রেগুলার নাচের প্র্যাকটিস, তার সঙ্গে টেনিস, এইটুকু বাচ্চচা, দেখছেনই তো শরীরের হাল, নিতে পারবে না।”
তপতী বুঝে গেলেন, চন্দ্রিমার কাছ থেকে কিছু পাওয়া যাবে না। নিজের ছেলে মেয়েরা না খেললে তারা চাঁদাও দেবে না। তবু তিনি বললেন, ”বেশ, লঘু নয় খেলতে পারবে না, কিন্তু অন্য অনেকের ছেলে মেয়ে তো খেলবে, তুমি চাঁদার দশটা টাকা দাও। স্রেফ চ্যারিটি।”
”উনি তো এখন নেই, বাড়ি আসুন, ওঁকে বলব।”
তপতী আর কথা বাড়ালেন না। ধরে নিলেন কিছু পাওয়া যাবে না।
.
সুভাষ সেন অমায়িক, মার্জিত এবং এম জে টি এম—এর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ম্যানেজার। তপতীর কথা মন দিয়ে শুনে চশমার কাচ রুমালে মুছতে মুছতে বললেন, ”মিসেস বসুমল্লিক আপনার উদ্যোগের সঙ্গে আমি শতকরা একশো ভাগ একমত। কিন্তু মুশকিল একটাই, আর দু’মাস পর শঙ্কু শান্তিনিকেতন চলে যাচ্ছে। ওখানে পাঠভবনে পড়বে।”
”তা হলে তো আর কিছু বলার নেই।” তপতী মুখে হাসি টেনে আনলেন। বাংলোর সিঁড়ি দিয়ে যখন নামছেন, পেছন থেকে ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলেন সুভাষ সেনের হাতে মানিব্যাগ, তাই থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করেছেন। ”এটা নিয়ে যান।”
তপতী বাড়ি ফিরলেন তিরিশ টাকা সংগ্রহ করে। অনিরুদ্ধ আর গৌতমের বাবা—মা খুব উৎসাহিত হয়েই চাঁদা দিয়েছেন। তন্ময় জানালেন কাল সকালে মেশিন শপের একজন যাবে লন—মোয়ারটা নিয়ে আসার জন্য। একদিনেই সম্ভবত সারানো যাবে।
”কিন্তু তিরিশ টাকায় কী হবে?” তন্ময় প্রশ্ন তুললেন।
”বাকিটা আমাদেরই দিতে হবে।” তপতী শান্ত স্বরে স্বামীর চোখে চোখ রেখে বললেন। ”আমাদের ছেলেদের মুখ চেয়েই খরচ করতে হবে। একদিন বলেছিলে, ওদের সুস্থ সবল রাখা, ভাল স্বাস্থ্য গড়ে দেওয়ার দায়িত্ব বাবা—মার। এজন্য শেষ কর্পদকটুকুও খরচ করবে।”
”বলেছিলাম।”
”তা হলে অমন চোখ করে তাকিয়ে আছ কেন?
”তাকিয়ে নেই, শুধু ভেবে যাচ্ছি। আমার অফিসের একটা ছেলের বিয়ে, নেমন্তন্ন করেছে। এগারোশো টাকা মাইনে থেকে সংসার খরচ, চিকিৎসা, গাড়ির পেট্রল, মেজ জ্যাঠার বাড়িতেও বিয়ে এই মাসেই। বিয়ের উপহার আর টেনিস কোর্ট—ম্যানেজ করব কী করে?”
”কিছু কিছু খরচ কমিয়ে ম্যানেজ করতে হবে। কমানোর প্রথম ধাপ হোক গাড়ি আর না চড়া। চিনু স্কুলে যায় না, মিনু হেঁটেই যাতায়াত করতে পারবে, আমি সঙ্গে যাব। তুমিও হেঁটে অফিস যাবে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে, ভুঁড়ি হয়ে যাচ্ছে তাই হাঁটছি।”
”পরশু এক্স—রে করিয়ে চিনুকে কলকাতা নিয়ে যেতে হবে। কীসে যাব, ট্রেনে?”
”মোটরে। এটা ব্যতিক্রম বলেই ধরতে হবে।”
পরদিন মিনুকে নিয়ে তপতী বেরোলেন স্কুলে পৌঁছে দিতে। দু’জনের মাথায় দুটো ছাতা। মিনু প্রথমে অবাক হয়েছিল হেঁটে স্কুলে যেতে হবে শুনে। তপতী তাকে বুঝিয়ে বললেন, ”আধ মাইল তো রাস্তা, এর জন্য গাড়িতে চড়ার কী দরকার? তুই তো রোজ এক মাইল হেঁটে ফেরিঘাট যাস আর দৌড়ে ফিরিস। পারবি না স্কুলে হেঁটে যেতে? অক্ষম তো নোস। তোর বাবা দু’মাইল হেঁটে স্কুলে যেতেন, দু’মাইল হেঁটে ফিরতেন।”
এই শেষ কথাটাতেই কাজ হয়ে গেল। ”মা আমি দৌড়ে স্কুলে যাব?” মিনু টগবগ করে উঠল।
”না, না, অত বাহাদুরিতে কাজ নেই।”
”জানো মা, আমাদের স্কুলের অনেক বড় ছেলে সাইকেলে আসে। আমাকে একটা সাইকেল কিনে দেবে?”
”দোব, যখন তুমি বড় ছেলে হবে।”
মিনুকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে তপতী ক্লাবে গেলেন। কান্তির কাছে শুনলেন, সায়েবের পাঠানো একটা লোক সাইকেল রিকশায় তুলে মোয়ারটা নিয়ে গেছে।
”কিন্তু কান্তি, ঘাস কাটার ব্যবস্থা তো তাড়াতাড়ি করতে হবে। আর কোদালের হাতলের জন্য একটা বাঁশ কিংবা ডাণ্ডা দরকার।”
”যে লোকটা দুধ আর ডিম দিয়ে যায় তাকে কালই আমি বলে দিয়েছি। ও থাকে এই মাইল দুয়েক দূরে বল্লভপুরে। বলেছিল আজ সকালে পাঠিয়ে দেবে লোক। তা এখনও তো এল না!” কান্তিকে বিব্রত দেখাল।
”ততক্ষণে একটা কাজ করা যাক। নেট—টা কোথায় আছে দেখো তো।”
”দেখেছি। সেক্রেটারির আপিস ঘরে যে কাঠের আলমারিটা তার পেছনে ডাঁই হয়ে পড়ে আছে। বার করব কী! যা ধুলো ঝুল ময়লা, হাত দিতে ঘেন্না করে?”
”দেখি তো।” তপতী একাই দেখতে গেলেন অফিস ঘরে।
তপতী আলমারির পেছনে উঁকি দিয়ে দেখলেন। কান্তি মোটেই বাড়িয়ে বলেনি। তালগোল পাকানো নেটটা যেন ধুলোর ঢিপি। তিনি ঝুঁকে হা