এক সময় লাইন পায়–ফোনের ওপাশ থেকে দময়ন্তী বলে, তোমার তো কাল আসার কথা–ই-মেইলে তুমি একুশ তারিখ লিখেছ–ঠিক আছে অপেক্ষা করো, আমি আসছি। ওকে আর কিছু বলার সুযোগ নেই তন্ময়ের–নিজেই বিস্ময়ে থ–কুড়ির জায়গায় একুশ লিখেছি আমি–নিশ্চয় আমার মগজ ঘোল হয়ে গেছে–নিজের বোকামিতে নিজেকে শাপান্ত করে।
বিমানবন্দরের বাইরে লোকজন তেমন নেই–যারা আছে তারা। গালগল্প করছে–যাত্রীরা যে যার গন্তব্যে উধাও। কতবার এসেছে কলকাতায়–একটা ট্যাক্সি নিয়ে দময়ন্তীর সল্ট লেকের বাড়িতে চলে যেতে পারে–কিন্তু ওকে এ কথা বলারই সুযোগ পায়নি–দুজনেই ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে যায়–ওকে আর এ কথা বলার সুযোগ নেই–নিশ্চয় এতক্ষণে ও বেরিয়ে পড়েছে। এদিক-ওদিক। তাকিয়ে দেখে বসার জায়গা নেই, ট্রলিটা ভরসা–ওটাতে ঠেস দেয়া যায়। একজন ট্যাক্সি-ড্রাইভার এগিয়ে আসে, কোথায় যাবেন দাদা? আমার ট্যাক্সি আছে–বলুন কোথায় যাবেন?
জানি না কোথায় যাব।
জানেন না?
বললাম তো না।
আপনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন?
হ্যাঁ।
তাহলে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? চলুন পৌঁছে দি। কেউ নিতে আসবে আপনাকে?
হ্যাঁ।
ও তাই বলুন। আগে বলবেন তো। আমি শুধু শুধু গ্যাজাচ্ছি।
শুধু শুধু গ্যাজাওনি।
গ্যাজাইনি? ওর দুই ভ্রূ কপালে ওঠে।
না, গ্যাজাওনি। তোমার কথা শুনতে আমার ভালো লাগছিল।
তাই বলুন। আমার বাপ-ঠাকুরদার ভিটা কিন্তু বাংলাদেশের ফরিদপুরে।
এই তোমাদের এক দোষ। বাংলাদেশের কাউকে দেখলে ওই দেশটায় একটা ভিটে আবিষ্কার করে ফেল।
না দাদা, মিথ্যা বলিনি। সত্যি আমার ঠাকুরদাদার ভিটা ছিল। স্বাধীনতার পরে আমি দেখতে গিয়েছিলাম।
ভিটে তো আর তোমাদের নেই।
তা কি আর থাকে! কত বছর পার হয়ে গেল–আমার জন্মের আগে। যাই বলুন দেশটা খুব সুন্দর।
সুন্দর? তুমি সুন্দর দেখেছ?
হ্যাঁ, তাই দেখেছি। খুব সুন্দর।
সুন্দর না ছাই, একটা ডাস্টবিন।
আপনি না কেমন যেন, যাই।
ও হতাশ হয়ে চলে যায়, বিপ্ন দেখায় ওকে এবং আশাভঙ্গের ম্রিয়মাণ ভঙ্গি ওর পায়ের নিচে জমে যায়–তন্ময়ের মনে হয় ওর পা টানতে কষ্ট হচ্ছে–তাকিয়ে থাকে ও–ওকে দেখে–একজন পোড়খাওয়া জীবনসংগ্রামের রাস্তায় তাড়িত যুবক–কালো রঙের ট্যাক্সির দরজা খুলে বাইরে পা রেখে বসে থাকে। একটু পরে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে একটি চিকন কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচায়। তন্ময়ের ভীষণ হাসি পায়–মানুষের বিচিত্র অভ্যেসের সঙ্গে পরিচিত নয় বলে নানা বিষয়ে কৌতূহলী হয়ে যায়। ছবি তুলবে কি না ভাবে–অল্পক্ষণে একটি মেয়ে কাছে এসে হাত বাড়ায়–ও তখনো ডলার ভাঙায়নি তাই ভারতীয় টাকা ওর কাছে নেই–সে কথা বলতে মেয়েটি ওকে ভেংচি কাটে–শরীরের আকার দেখে মনে হয় তরুণী মেয়ে–উনিশ-কুড়ি বছর হতে পারে–আশ্চর্য, ও রেগে ওঠে না–জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাবে?
তাতে তোমার দরকার কী?
ও অন্য পাশে চলে যায়–ভীষণ নোংরা একটা শাড়ি পরে আছে–ব্লাউজটা ছেড়া–পেটিকোটও পায়ের দিকে হেঁড়া–কাঁধে একটা কাপড়ের ব্যাগ–ব্যাগের পেট ফোলা, কী ঢুকিয়েছে কে জানে–ওর ডান হাত ব্যাগের ভেতরে–আধা খাওয়া একটা পাউরুটি বের করে সেটা চিবুতে থাকে–ওকে তন্ময়ের পাগল মনে হয়নি–পাশ থেকে দশ-বারো বছরের একটি বালক ওকে খ্যাপায়–ওই পাগলি দুধ খাবি?
ও ছেলেটির দিকে তাকায় না। ট্যাক্সিঅলার কাছে গেলে ড্রাইভার পেছনের দরজা খুলে দিলে ও ভেতরে ঢুকে বসে–দরজা খোলা থাকে–হুহু বাতাস ঢোকে সেই পথে–লোকটি মেয়েটির সঙ্গে গল্পে মাতে। তন্ময় ওদের হাত নেড়ে কথা বলার ভঙ্গি দেখে। বছর পাঁচেক আগে দেবাশিষের আমন্ত্রণে কলকাতায় এসেছিল–দমদমের কাছে তাপস আর কল্পনার বাসায় ছিল ব্যবস্থাটা দেবাশিষ করেছিল–খুব ভোরে ফ্লাইট ধরতে হবে বলে বিমানবন্দরের কাছাকাছি থাকা। রাতে কল্পনা বলল, তন্ময় ভোরে আমার বাসায় কাজ করতে যে মেয়েটি আসে ও বাংলাদেশের। খুলনায় বাড়ি, ভোরে তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব।
মনে করে দিও কিন্তু, আবার যেন কাজ করে চলে না যায়।
কবে থেকে কাজ করছে?
তিন-চার মাস হবে। বাড়িতে স্বামী আছে, দুই ছেলেমেয়ে আছে। ওদেরকে শাশুড়ির কাছে রেখে কাজ করতে আসে। কিছু উপার্জন করে ফিরে যায়।
কীভাবে আসে? পাসপোর্ট আছে?
ওসবের বালাই নেই। সীমান্তরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আসে। নয়তো কিছু টাকা-পয়সা দেয় হয়তো।
অভাবী মানুষের দেশ নেই কল্পনা। নিজেদের শ্রমটুকু যাদের মূলধন তাদের সামনে দেশের সীমানাও মুছে যায়। ওরা খোঁজে শ্রম বিক্রির বাজার।
তাপস আর কল্পনা মাথা নাড়ে। কল্পনা বাড়তি যোগ করে বলে, ওরা শ্রম দেয় বলে আমরাও নিজেদের কাজে যেতে খানিকটুকু শান্তি পাই। নইলে ঘরের এত কাজ করে অফিসে যেতে টায়ার্ড হয়ে পড়ি।
অনেক রাত জেগে কল্পনা আর তাপসের কণ্ঠে গান শুনে–আচ্ছা দেয়–মাত্র গতকাল ওরা শান্তিনিকেতন থেকে ফিরেছে–সেই প্রসঙ্গে কথা হয়–ভবিষ্যতে ওরা কী ধরনের অনুষ্ঠান করবে তার কথা বলে। তন্ময় বারবার বলে, আমি কিন্তু ওই মহিলার ছবি তুলব। মনে রেখো।
ভোরে ঘুম ভাঙে একটু দেরিতে–তাড়াহুড়ো করে তৈরি হতে থাকে ও। কল্পনার কাজের লোক বাসনকোসন ধুচ্ছে টের পায়–ভাবে, ও নিশ্চয় ওর জন্য অপেক্ষা করবে–একটু পরে কল্পনা এসে বলে, মেয়েটা তোমার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হলো না।
খানিকটা আহত হয় ও–অপমানিতও–কী হয়েছে ওর–ওর অপরাধটা কোথায়–কল্পনা ওর মনোভাব বুঝতে পেরে বলে, ও তোমাকে ভয় পাচেছ।