তন্ময় ব্রিত হয়ে বলে, আমি নাচের কথা বলিনি। বলেছি, ওরা আমাদের একা রেখে গেছে।
জানি। তবে আপনার কথা অনুযায়ী একা থাকার সুযোগটা আমরা কাজে লাগাতে পারি।
হ্যাঁ, আমরা গল্প করতে পারি। গল্প করতে আমার খুব ভালো লাগে। সুন্দর গল্প হলে সময় দারুণভাবে ভরে যায়।
অনিমা ভ্রূ নাচায়। বলে, ছবি তোলার কী হবে?
তন্ময় মুগ্ধতায় মাথা নাড়ে–চমৎকার সময় ওর বুকের ভেতরে তোলপাড় করে। গভীর আবেগে বলে, আমরা না হয় একটু পরেই ছবি তুলি।
অনিমা মাথা নাড়ে, ঠিক আছে।
আমি আপনার বিভিন্ন মুহূর্তকে আমার ক্যামেরায় ধরব। জানতেও পারবেন না। জিজ্ঞেস করব না। নো পারমিশন। নো বিজনেস।
আমি কিন্তু পরীক্ষা নেব। দেখব কতটা পারেন।
না পারলে?
শাস্তি পেতে হবে।
কী শাস্তি?
সেটা ভেবে দেখব।
আমি কি নিজের শাস্তির কথা নিজে বলব?
বলুন দেখি কী?
বলব?
হ্যাঁ, অবশ্যই বলবেন। শাস্তি দিতে তো আমার কোনো ভয় নাই।
শাস্তিটা হবে—
থামলেন যে–
আপনার মুঠিতে আমার হাত জায়গা পাবে।
এত অল্প শাস্তি?
আরো কঠিন শাস্তি দেবেন?
দিতেও পারি।
সেটা নিতে আমি রাজি।
দুজনে হাসিতে মেতে ওঠে। হাসতে হাসতে মেঠোপথে এগোয়। দেখা যায় জনশূন্য রাস্তায় দূর থেকে একদল হাটুরে আসছে। দুজনে স্টেশনে আসে।
তৌফিক অফিসে ব্যস্ত। মাসুম সবুজ পতাকা ওড়াচ্ছে। ট্রেন আসছে। দুজনে মানুষের ওঠানামা দেখে। তারপর তন্ময় একাই স্টেশন মাস্টারের ঘরের দিকে এগোয়। দরজায় দাঁড়িয়ে কর্মরত তৌফিকের একটি ছবি তোলে কুঁচকানো কপালের ওপর লুটিয়ে থাকা একগুচ্ছ চুল, কাঁচা-পাকা ভ্রু এবং মোটা নাকের আদল, নত চোখের পাতা তন্ময়ের ক্যামেরায় শিল্পের আবেদন ফুটিয়ে তোলে। ক্যামেরার ক্লিক শব্দে তৌফিক মুখ ফেরায়। তন্ময় ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, আমি আপনার একটি বিশেষ সময়কে ধরে রাখলাম। যখন অবসরে ছবিগুলো দেখবেন মনে করবেন এই সময়টা আপনার জীবনে ছিল।
তৌফিক হাসিমুখে মাথা নাড়ে। বলে, বসো বাবা। আমার ছেলে নেই। অনিমা আমার কাছে ছেলে-মেয়ে দুয়েরই আনন্দ। তোমার মধ্যে আমি ছেলের ভালোবাসা পাচ্ছি। মনে হয় পরজনমে তুমি আমার ঘরেই জন্মাবে। জন্মাবে তো?
তন্ময় হাসতে হাসতে বলে, আপনার মতো বাবা পেলে আমি। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করব।
তৌফিক চোখ মোছে। তন্ময় বোঝে জীবনের টানাপড়েন তাকে অনেক ভেতরে টেনে রাখে। অনেক কষ্ট, বেদনা এবং বিষাদের সমুদ্রের চারদিকে এই বুড়ো লোকটি একা একা কলার ভেলায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এক জীবনে তার সমুদ্র পাড়ি দেয়া সম্ভব হবে না। ড়ুবতে হবে এই বিষাদের সমুদ্রেই। তখন ও জিজ্ঞেস করে, আপনার জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল স্মৃতি কি?
সবচেয়ে উজ্জ্বল বা অনুজ্জ্বল বলে কোনো স্মৃতি নেই। স্মৃতি একটাই আছে।
মাত্র একটা?
হ্যাঁ, গৌরবের স্মৃতি একটা থাকলেই হয়।
আপনার গৌরবের স্মৃতির কথা আমি শুনতে চাই। বলবেন কি?
তোমাকে একা কেন, তোমার মতো হাজার ছেলেমেয়ের কাছে বলতে চাই। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা।
উত্তেজনায় তৌফিক দাঁড়িয়ে পড়ে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলে, তখন আমার বয়স ছিল আঠারো। তারপর দম নেয়। চেয়ারে বসে। সরাসরি তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলে, জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলাম নয় নম্বর সেক্টরে। সে একটা দারুণ সময় ছিল আমার জীবনে। প্রতিদিন মৃত্যুর মুখখামুখি হয়েও মৃত্যুকে ভয় পাইনি। কী সাহস ছিল, কী শক্তি, কী উত্তেজনা। এখনো ভাবলে আমার শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করা যে-কোনো মানুষের পণ্যের কাজ তলায়।
তনায় অভিভূত কণ্ঠে বলে, আমার বয়সটা যদি তখন এমন থাকত তাহলে আমিও যুদ্ধ করতাম। কেন যে আমি যুদ্ধের সময়টা মিস করলাম! নিজের জন্মের ওপর এজন্য আমার রাগ হচ্ছে। সঠিক সময়ে সঠিক বয়স থাকা ভাগ্যের ব্যাপার। আমি আপনার মতো ভাগ্য পেলাম না।
হো-হো করে হাসে তৌফিক। বলে, তুমি যে আফসোস করলে সেজন্য আমার গর্ব আছে, বুঝতে পারছি আমাদের ছেলেরা সংকট মোকাবেলার জন্য তৈরি আছে।
এ সময় ফোন এলে তৌফিক ব্যস্ত হয়ে যায়। তন্ময় দেখতে পায় অনিমা দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়ায়। ওকে দেখে তন্ময় বেরিয়ে আসে। অনিমা মৃদু স্বরে বলে, বাবাকে হাসতে দেখে আমি ভাবলাম কী ব্যাপার ঘটল! বাবা হাসছে কেন, মা মারা যাওয়ার পরে গত দু’বছরে বাবা এমন প্রাণখুলে হাসেনি। বাবা যে কত প্রাণবন্ত একজন মানুষ ছিলেন!
দুজনে হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনের অপর প্রান্তে এসে বেঞ্চের ওপর বসে। টেলিফোন ছেড়ে তন্ময়কে না দেখে তৌফিক অকস্মাৎ শূন্যতা বোধ করে। ছেলেটির সঙ্গে কথা বলতে ভালোই লাগছিল। গেল কোথায় ও? দরজায় দাঁড়াতেই দেখতে পায় ওরা দুজনে তন্ময় হয়ে গল্প করছে। মেয়ের কথা ভেবে তৌফিকের বুক ভরে যায়। মৃদু হাসি নিয়ে ফিরে এসে চেয়ারে বসে।
তন্ময় এবং অনিমার সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। খুব গভীরভাবে দুজনে দুজনকে বুঝেছে তা নয়, তারপরেও ভালো লাগার প্রচ্ছন্ন আবেশ দুজনের মুগ্ধতাকে প্রগাঢ় করে। দুজনে হাত ধরে রেললাইনের ওপর দিয়ে হেঁটে যায়। তন্ময় বলে, বেশ সুন্দর এ জায়গাটা। তবে দুঃখ
একটাই।
অনিমা অবাক হয়ে বলে, কী?
অনিমা বুঝতে পারে তন্ময়ের মুখে দুষ্টুমির হাসি। ও একটা কিছু বলে মজা করবে। তন্ময় একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ধারেকাছে নদী নেই। তবে—
এস অনিমা পরেরটুকু শোনার জন্য অপেক্ষা করে। কিন্তু তন্ময় থেমে যায়। অনিমার কাছ থেকে শুনতে চায় প্রতিধ্বনি। অনিমা নিজেও মৃদু হাসির সঙ্গে বলে, তবে? তবে কি নদীর বিকল্প অন্য কিছু?