আমি সম্পূর্ণ একমত নই। হাসির চেয়ে কান্না, আনন্দের চেয়ে বেদনাই আমাদের একে অন্যকে কাছে টানে বেশি। এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হতে পারে। কিন্তু এস্থলে একটি সামান্য উদাহরণ দিলেই বোধহয় যথেষ্ট হবে। বৈঠকখানায় বসে শুনতে পেলুম, বাড়ির বউ-ঝিরা রান্নাঘরে কাজ করতে করতে হঠাৎ একসঙ্গে হেসে উঠল। আমি সঙ্গে সঙ্গে হাসির হিস্যাদার হতে কিংবা কারণ অনুসন্ধান করতে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির ভিতর ছুটে যাইনে। কিন্তু সবাই যদি একসঙ্গে ডুকরে কেঁদে ওঠে তবে অবশ্যই যাই।
এ বড় অদ্ভুত সমস্যা। দুঃখ-বেদনা আমরা দেখতে চাইনে, কিন্তু কাব্যে ঠিক সেই জিনিসটেই আমরা খুঁজি।
কৌতুক-হাস্য সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথও পঞ্চভূতে লিখেছেন, রামায়ণের সীতা বিয়োগে রামের দুঃখে আমরা দুঃখিত হই, ওথেলোর অমূলক অসূয়া আমাদিগকে পীড়িত করে, দুহিতার কৃতঘ্নতাশরবিদ্ধ উন্মাদ লিয়রের মর্মর্যাতনায় আমরা ব্যথা বোধ করি কিন্তু সেই দুঃখ-পীড়া বেদনা উদ্রেক করিতে না পারিলে সে-সকল কাব্য আমাদের নিকট তুচ্ছ হইত। এতখানি বলার পর রবীন্দ্রনাথ সূত্র দিচ্ছেন, বরঞ্চ দুঃখের কাব্যকে আমরা সুখের কাব্য অপেক্ষা অধিক সমাদর করি। আমরা সম্পূর্ণ একমত। তবে তিনি যে কারণ দিয়েছেন– কারণ, দুঃখানুভব আমাদের চিত্তে অধিকতর আন্দোলন উপস্থিত করে–সেখানে সবাই একমত না-ও হতে পারেন।
আজ যে বাঙলা দেশে রাজশেখরের এত খ্যাতি তার কারণ গড্ডলিকা কজ্জলী নয়– তার কারণ তাঁর চলন্তিকা, রামায়ণ-মহাভারতের অনুবাদ, হয়তো-বা তার প্রবন্ধাবলি। যদিও আমার ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস তার হাস্যরস অতুলনীয়, কিন্তু তাঁর অন্যান্য সৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করার মতো– তা সে শ্রেষ্ঠতর কিংবা নিকৃষ্টতরই হোক– লেখক বাঙলা দেশে আছে। চলন্তিকার চেয়ে ভালো অভিধান ইংরেজিতে আছে কিন্তু হাস্যরসিক রাজশেখর, জেরম কে জেরম, উডহাউসের বহু বহু ঊর্ধ্বে।
তা সে যাক। কিন্তু এই যে রবীন্দ্রনাথ বললেন, এবং আমরাও স্বীকার করলুম, দুঃখের কাব্য আমরা সুখের কাব্য অপেক্ষা অধিক সমাদর করি–তাই যদি হয় তবে ফিলিমওয়ালারা কেন বলেন ট্র্যাজেডি অচল, দর্শক কমেডি দেখতে চায় এবং শুধু এ দেশে নয়, পৃথিবীর সর্বত্রই নাকি অল্পবিস্তর তাই।
তার কারণ বোধহয় এক হতে পারে যে, শিওর রূপকথা কখনও ট্র্যাজেডিতে সমাপ্ত হয় না, এবং যেহেতুক সিনেমা-দেখানেওয়ালারা ত্রিশ বছর বয়সেও শিশুমন ধরেন তাই তারা ট্র্যাজেডি পছন্দ করেন না। কিন্তু এস্থলে সে আলোচনা কিঞ্চিৎ অবান্তর।
***
রাডেকি তার অবতরণিকায় আরও অনেক মধুর এবং জ্ঞানগর্ভ কথা বলেছেন। এবং শেষ করেছেন এই বলে, হাস্যকথিকার (চুটকিলার) প্রাণরস কিন্তু ওই বস্তু শব্দের মাধ্যমে বলাতে ছাপাখানার মারফতে নয়। তুলনা দিয়ে বলেছেন, প্রথমটা যেন উচ্ছল প্রাণরসে সঞ্চারিত উড়ন্ত প্রজাপতি– ছাপাখানার মাল যেন পিন দিয়ে বেঁধা কাঁচের বাক্সের ভিতর মৃত প্রজাপতি।
রাডেকি অবতরণিকা শেষ করেছেন তাই এই বলে, আমি হালে একটি চমৎকার রসিকতার গল্প শুনতে পেলুম। তদ্দশ্যেই সেটি লিখে নিলুম। পরে সেটি ছাপায় প্রকাশিত হল! যিনি সেই গল্পটি বলেছিলেন সে কথক সেটি পড়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বেশ হয়েছে। কিন্তু স্বরলিপি কই?
অর্থাৎ এ যেন কেউ রবীন্দ্রসঙ্গীত না গেয়ে আবৃত্তি করে শোনাল। স্বামীজির জন্মশতবার্ষিকী। তিনি নাকি এরই কাছাকাছি অন্য একটি তুলনা দিয়েছেন। অনুবাদ যেন কাশ্মিরি শালের উল্টো পিঠ। ডিজাইনটা বোঝা যায় কিন্তু অন্য সবকিছু লোপ পায়।
হিটলার
এই গত রবিবারের আনন্দবাজারেই দেখি, আমাদের শিবুদা হিটলারকে নিয়ে একখানা পান ছেড়েছেন। হের হিটলার নাকি নিজের গোঁফ কামিয়ে ছদ্মবেশে বহাল তবিয়তে আর্জেন্টিনায় বিরাজ করছেন। এর ওপর বিশুদার পান–তার গোঁ গেছে, এখন গোঁফও গেল। [হিটলার গোঁফ কামালেই যে তাঁর পক্ষে সেইটেই সর্বশ্রেষ্ঠ ছদ্মবেশ এই নিয়ে ১৯৩৩-৩৪-এই একটি কাঁচা রসিকতা চালু ছিল। একদা হিটলার, গ্যোরিঙ, গ্যোবেলস্ ও রোম ছদ্মবেশে দেশের রাজনৈতিক আবহাওয়ার ঠাহর করার জন্য বেরোলেন। হিটলার গোঁফ কামালেন, গ্যোরিঙ সিভিল ড্রেস পরলেন, গ্যোবেলস কথা বন্ধ করে দিলেন এবং রোমে একটি প্রিয়দর্শন তরুণী সঙ্গে নিলেন। এস্থলে বলে দেওয়া প্রয়োজন গ্যোরিঙ বড্ড বেশি ইউনিফর্ম ভালোবাসতেন, গ্যোবেলস্ প্রপাগান্ডা চিফ বলে সমস্তক্ষণ বকর বকর করতেন আর রোম সমরতিগামী অর্থাৎ হোমোসেকসুয়েল ছিলেন।]
আমি কিন্তু পানটার দিকে নজর দিচ্ছি না। আমার নজর ওই তত্ত্বকথাটির দিকে যে, হিটলার এখনও বেঁচে আছেন।
সত্যি নাকি?
আমি এবার জর্মনিতে বেশি লোককে এ প্রশ্ন শুধোইনি। তার কারণ আমি নিজে যখন নিঃসংশয় যে হিটলার বেঁচে নেই তখন এ বিষয়ে প্রশ্ন জিগ্যেস করে আমার লাভ কী? যে দু-একজনকে শুধিয়েছিলাম তারাও নিঃসংশয় বেঁচে নেই।
তা হলে প্রশ্ন, তিনি যে বেঁচে আছেন এ গুজবের উৎপত্তি কোথায়?
হিটলার মারা যাওয়ার মাস তিনেক পর বার্লিনের কাছে শহর পসদামে মিত্রশক্তির এক বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে নাকি স্তালিন বলেন, তাঁর বিশ্বাস, হিটলার মারা যায়নি, গা-ঢাকা দিয়ে আছেন। এর কিছুদিন পর রাশান এনসাইক্লোপিডিয়ার নতুন সংস্করণের প্রকাশ হয় এবং তাতে বলা হয়, হিটলার অদৃশ্য হয়েছেন তিনি যে মারা গেছেন একথা রুশ কর্তৃপক্ষ সরকারিভাবে অস্বীকার করলেন। ইতোপূর্বে দুনিয়ার সর্বত্র কত রকমের যে গুজব রটল তার ইয়ত্তা নেই। আর্জেন্টাইন, সউদি আরব কোনও জায়গাই বাদ পড়ল না, যেখানে হিটলার নেই। এমনকি এক কাষ্ঠরসিক প্রকাশ করলেন, তিনি প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের মাঝখানে বিরাজ করছেন। সে যুগে শুটনিক-জাতীয় কোনও কিছু আবিষ্কৃত হয়নি। না হলে হয়তো বলা হত, তিনি চন্দ্রলোকে বাস করছেন। তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। চন্দ্রের লাতিন নাম লুনারিস– যা থেকে লুনাটিক–উন্মাদ–শব্দটা এসেছে এবং অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, পরাজয়ের চরম অবস্থায় হিটলার নাকি উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন–তবে বদ্ধ উন্মাদ নয়, মুক্ত উন্মাদ। তাই আপন আদি বাসভূমে চলে গেছেন।