অন্যান্য জাতও গ্যোরিঙের গল্পে স্থান পেয়েছে কিন্তু সেগুলো নিয়ে উপস্থিত আমাদের প্রয়োজন নেই। তা সে যাই হোক, রাডেকি তার অবতরণিকায় অহেতুক পাণ্ডিত্য ফলাননি।
ইহ সংসারে আমাদের কত জিনিসেরই না অভাব, এবং তাই নিয়ে একমাত্র মানুষই রোদন করে কিন্তু ওই অভাবের ক্ষতিপূরণ হিসেবে একমাত্র মানুষই হাসতে জানে। মানুষের যে দেহাতীত সত্তা আছে সে-ই আমাদের দেহ থেকে অশ্রুজল ঝরায় এবং সে-ই আমাদের দেহের দু পাশ এবং ভুড়ি দুলিয়ে হাসায়। কিন্তু এই পৃথিবীতে সে জিনিস কী, যা হাস্যকৌতুক রসের সৃষ্টি করে?
প্রশ্ন শুধিয়ে উত্তরে রাডেকিই বলছেন, সব, সবকিছুই…। যেমন সবকিছুই কাঁদাতেও পারে। তারা, ফুল, পশুপক্ষী এদের নিজেদের সত্তা দিয়ে কৌতুকরস সৃষ্টি করে না, কিন্তু মানুষের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপিত হওয়ামাত্রই এগুলো কৌতুকরসের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে কারণ এই মানুষই বিশ্ব-সংসারের হাসি এবং কান্নার কেন্দ্র। কারণ এই মানুষ নির্মিত হয়েছে অর্ধেক পণ্ড থেকে এবং অর্ধেক চৈতন্য দিয়ে। এই যে কাদামাটি আর সৃষ্টিকর্তার মুখের ফুঁ দিয়ে তৈরি মানুষ তার হাসি এবং কান্না অতি সাধারণ সরল, আর গভীর মনোবেদনায় যখন মানুষ কাঁদে তখন তার সে রোদন সম্পূর্ণ ভিন্ন পর্যায়ের। হাসির বেলাও তাই। মানুষ যখন ফুর্তিতে থাকে তখন সে হাসে কিন্তু কৌতুকরসের সৃষ্টি হওয়াতে মানুষ। অকস্মাৎ যে অট্টহাস্য করে ওঠে সে হাসি ভিন্ন। কিন্তু ফুর্তিতে থাকলেই যে কৌতুকের সৃষ্টি হয় এমন কোনও কথা নয়। সেখানে মানুষ হাসে সে ফুর্তিতে আছে বলে, আর এস্থলে তার উল্টোটা– এস্থলে মানুষ হেসে ফুর্তি পায়।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এখানে রাডেকির সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত নন। কিন্তু বলছেন, সুখে (অর্থাৎ যখন ফুর্তিতে আনন্দে আরামে– লেখক) আমরা স্মিতহাস্য হাসি, কৌতুকে আমরা উচ্চহাস্য হাসিয়া উঠি। একটি আন্দোলনজনিত স্থায়ী, অপরটি সংঘর্ষজনিত আকস্মিক। এবং তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আরেকটি তত্ত্বও যোগ দিয়েছেন– আমি বোধ করি, যে কারণ-ভেদে একই ঈথরে আলোক ও বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় তাহা আবিষ্কৃত হইলে তাহার তুলনায় আমাদের সুখহাস্য ও কৌতুক-হাস্যের কারণ বাহির হইয়া পড়িবে। [পঞ্চভূত, রবীন্দ্র রচনাবলি, ২য় খণ্ড ৬১৭। পঞ্চভূত পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় ১৩০৪ সালে। তার পর ১৩২৮ এবং ১৩৩৩-এর মাঝামাঝি কোনও সময়ে আমরা হাসি কেন? এই নিয়ে বিশ্বভারতীর সাহিত্য সভায় আলোচনা করেন। তার অনুলেখন আমার কাছে ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অন্যান্য আরও বহু অনুলেখনের সঙ্গে এটিও কাবুল বিদ্রোহের সময় হারিয়ে যায়। সে সভায় ক্ষিতিমোহন সেন উপস্থিত ছিলেন। তার পাণ্ডুলিপিতে কিংবা হয়তো ওই সময়কার শান্তিনিকেতন পত্রিকায় এর অনুলেখন পাওয়া যাবে। ইতোমধ্যে জনৈক লেখক একটি অত্যুত্তম প্রবন্ধে প্রমাণ করেছেন, হাস্যের কারণ সম্বন্ধে আঁরি বের্গস ও রবীন্দ্রনাথ প্রায় একমত, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের লেখাটি বের্গসর পূর্বেই প্রকাশিত হয়েছিল।]
আর বর্তমান লেখক শুধায় তা হলে বেদনাজনিত অট্টহাস্যও কি ওই একই পর্যায়ে পড়বে? কিংবা দেখব, আকাশের জল, চোখের জল আর গোলাপের জল একই কারণে ঝরছে?
মূল কথায় ফিরে যাই। রাডেকি বলেছেন, একদা সর্বপ্রকারের কাব্যই আবৃত্তি করা হত কিংবা গাওয়া হত। এর বহু পরে মানুষ এগুলো লিখে রাখার প্রয়োজন অনুভব করল। এবং এরও পরে ছাপাখানায় সে কৃষ্ণমৃত্যু প্রাপ্ত হল (আমরা বলব মা কালী কালির চরণাশ্রয় পেল) এবং আজ সে শুধু মানুষের চিত্তাকাশেই জাগরিত হতে পারে। একমাত্র কৌতুকরসই এখনও মুখে মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছাপাখানায় সে পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হয় না। এ যেন কলকল উচ্চহাস্যে এগিয়ে চলেছে পাহাড়ের ঝরনা– মাঝে মাঝে একপাশে গুটিকয়েক পাথরের মাঝখানে যে সে স্তব্ধ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সেই হল তার ছাপায় প্রকাশিত রূপ, কিন্তু সে অতি সামান্য এবং তার উদ্দাম গতিবেগকে কণামাত্র ব্যাহত করে না। এবং অন্য সব কাব্যকলা যেমন যেমন ছাপার গোরস্তানে নীরব হতে লাগল সঙ্গে সঙ্গে কৌতুক-কথিকা এগুলো নিজের ভিতর সংহরণ করে তাদের পুনর্জীবন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে লাগল। তাই কৌতুক-কথিকা চুটকিলা, কখনও-বা কথক ঠাকুরের রূপকথা, কখনও-বা বিষ্ণু শর্মার উপকথা, দশছত্রের উপন্যাস, কাহিনী, কবিতা এমনকি রোমাঞ্চকর নাট্য। সংবাদপত্রের শক্তি এ ধরে এবং কয়েকটি শব্দের সাহায্যে যত্রতত্র যখন তখন এক লহমায় নাট্যশালার বাতাবরণ সৃষ্টি করতে পারে। সে একাধারে রাজদূত, লোকদূত, চারণ এবং নাট্যকার। কৌতুক-কথিকা হাস্যগাথা রচনা পেশাদারের একচেটিয়া নয়, বরঞ্চ বলতে হবে এটি পাঞ্চজন্য রসসৃষ্টি। হাস্যরস-লেখক বলতে যা বোঝায় তাঁদের মতো একটি ছত্র না লিখেও মানুষ তার জীবনে হাস্যরস সঞ্চয় করতে পারে ও সৃষ্টি করতে পারে– জঁ পল বলেন।
লোকমুখে এই হাস্যরস সৃষ্টির ঐতিহ্য বেঁচে রইল কী করে?
রাডেকি বলেন, সমাজের বাজয় রূপ নিত্য প্রয়োজনীয়। স্কুট বাক্য দ্বারা মানুষ আপন মনের চিন্তা, হৃদয়ের অনুভূতি প্রকাশ করে, আপন অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন হয়। তার লীলাভূমি– রাজনৈতিক সভা-সমিতি, থিয়েটার, বারোয়ারি পুজো ইত্যাদি। কিন্তু সমাজের স্বতঃস্ফূর্ত আত্মচেতনা প্রকাশ পায় তখনই যখন রামাশ্যামা সবাই সমান অংশীদার হয়ে হাস্যকলার সৃষ্টি করে। এস্থলে বর্তমান লেখকের টীকা– শুধু তাই নয়, চুটকিলা-ভূমিতে গণতন্ত্রের এমনই কট্টর যে অতিসাধারণ জনও আকছারই ছোট্ট একটি টিপ্পনী কেটে গেরেমভারী মাতব্বরজনকে ডিগবাজি খাইয়ে দেয়)। তার পর রাডেকি এ অনুচ্ছেদ শেষ করেছেন এই বলে : হাস্যরস মানুষে মানুষে যোগসূত্র স্থাপন করে।