আমি বললুম, সে কী কথা! লোক হয় দুটোতেই বিশ্বাস করে, নয় একটাতেও না।
উকিল বললেন, ওইখানেই তো ভুল। তোমরা দর্শনের কিছুই জান না। বুঝিয়ে বলছি। স্বর্গ জিনিসটের কল্পনা আমি করতে পারি। খাসা জায়গা, না গরম না ঠাণ্ডা। তোমাদের পরশুরামই তো বলেছেন, ঝোপে-ঝাপে চপ কাটলেট ঝুলছে। পাড়ো আর খাও, খাও আর পাড়। হুরী-পরীদের সঙ্গে দু দণ্ড রসালাপ কর, কেউ কিছু বলবে না। অতএব স্বর্গ আছে। কিন্তু এই পৃথিবীর চেয়ে বেদনাময় জায়গা আমি কল্পনাই করতে পারিনে। অতএব সেটা নেই। যে জিনিস আমি কল্পনাই করতে পারিনে সেটা থাকবে কী করে?
যুক্তিটা আমার কাছে কেমন যেন ঘোলাটে মনে হল। তবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সপ্রমাণ করতে গিয়ে মুনিঋষিরা যেসব যুক্তি দেন তার চেয়ে অবশ্য বেশি ঘোলাটে নয়। কিন্তু সে-কথা থাক। ওটা নিয়ে আমার শিরঃপীড়া নয়। কথায় বলে, বিপদে পড়লে শয়তানও মাছি ধরে ধরে খায়–আমার উকিলটি নরকে না গেলেও শয়তান তার বাঁ হাতের তেলোতে জল রেখে তাতে ডুবে আত্মহত্যা করবে না। বরঞ্চ একটা উকিলকে যদি কোনওগতিকে স্বর্গরাজ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারে তা হলেই তো চিত্তির। ক্লাইভ তো আর গণ্ডায় গণ্ডায় জন্মায় না! এক ক্লাইভে যা করল, তার ধকল আমরা এখনও কাটাচ্ছি। দ্যাখ তো না দ্যাখ, সেন্ট পিটারের পেটের ভাত চাল হয়ে যাবে, তন্দুরি মুর্গি ডানা গজিয়ে পেটের ভিতর ফুড়ুৎ ফুড়ৎ করতে থাকবে।
আমার শিরঃপীড়া :- আমি যদি প্রি-ডেটেড চেক সই করি, অর্থাৎ শুঁটকিকে তাজা মাছ বলে পাচার করি, অর্থাৎ প্রাচীন দিনের ডায়ারি নবীন বলে চালাই তবে কি আমি ভেজালের ভিটকিলিমিতে ধরা পড়ব না?
উকিল পরম পরিতোষ সহকারে বলল, কিছু ভয় নেই। তবে যা লিখবে তার ন আনার বেশি যেন সত্য কথা না হয়। মিথ্যে লিখতে হবে নিদেন সাত আনা। নতুন আইন।
আমার মিথ্যে বলতে কণামাত্র আপত্তি নেই। লেখক মাত্রই মিথ্যেবাদী। এবং মিথ্যেবাদীকেও সংজ্ঞা দিতে গিয়ে গুণীরা বলেছেন, যে লোক দুর্ভাগ্যক্রমে লেখক হওয়ার সুযোগ পেল না, হতাশ-প্রেমিকের মতো হতাশ-লেখক। তবু অবাক হয়ে বললুম, সে কী কথা?
উকিল বলল, ক্যারেট কারে কয় জানো? ২৪ ক্যারেটে খাঁটি সোনা হয়। এখন আইন হয়েছে, চৌদ্দ ক্যারেটের বেশি সোনা দিয়ে গয়না গড়ানো চলবে না। বাকি দশ ক্যারেটের বদলে দিতে হবে খাদ।
আমি অবাক হয়ে বললুম, আমি কি স্যাকরা যে আমাকে এ-আইন শোনাচ্ছেন!
উকিল আমার দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকাল। যেন আমি ফিয়ারলেস নাদিরা বা কাননবালার চেয়েও খাপসুরত। নিজের চেহারার প্রতি ভক্তি বেড়ে গেল।
বলল– এবারে অতিশয় শান্তকণ্ঠে সোনা ভারতবাসীর চোখের মণি, জিগরের টুকরো, কলিজার খুন। তাই দিয়ে যখন আরম্ভ হয়েছে, তখন সর্বত্রই এটা ছড়াবে। যাও, আর মেলা বকর বকর কর না। আর শোনো, তোমার মাথায় যা মগজ তা দিয়ে পুঁটিমাছেরও একটা টোপ হবে না। তুমি নির্ভয়ে লেখো। কেউ পড়বে না। তুমিও পড়বে না– অর্থাৎ ধরা পড়বে না।
আঁতে ফের লাগল। তবে খুব বেশি না। আমার আঁতে গণ্ডারের চামড়ার লাইনিং।
তা সে যাকগে। আইন বাঁচিয়ে লিখব।
***
আমার শক্র চতুর্দিকে। বরঞ্চ আমাকে অজাতশত্রু না বলে অজাতমিত্র বলা যেতে পারে। তারা যে আমার কী বদনাম করে বেড়াচ্ছে তার লেখাজোখা নেই। না, ভুল বললুম। পাড়ার ছোঁড়াদের কাছে আছে। তৃষ্ণার্ত ছাত্রদের বিয়ারদার সমিতিতে চাঁদা দিইনি বলে তারা সেগুলো জিগির বা স্লোগানরূপে ব্যবহার করে। মহরমের হায় হাসান, হায় হোসেন রোদনরব এর তুলনায় অট্টহাস্য।
তারই একটা– আমি নাকি অতিশয় সুপুরুষ। আপনারা অবশ্য একথা শুনে সরল চিত্তে শুধোবেন, এটা আবার কুৎসা হল কী প্রকারে?
ওই তো! ছোঁড়াদের পেটে কী এলেম তা তো আপনারা জানেন না। সূক্ষ্ম তালেবরদের দুষ্টবুদ্ধি। বেদে নাকি আছে, স নে বুদ্ধ্যা শুভয়া সংযুক্ত–তার এক অর্থ নাকি, দেবতা শুভবুদ্ধি দ্বারা আমাদের সংযুক্ত করুন– এক করুন। অশুভ বুদ্ধি যে আরও কত বেশি সংযুক্ত করে, ঋষি সেটা জানতেন না। কারণ আমাদের বঁড়শে ব্যালার বুদু খানসামা লেনের ছোঁড়াদের ঐক্য তিনি দেখেননি।
তা হলে আরও বুঝিয়ে বলি! রবীন্দ্রনাথের লেখাতে আছে, এক হাড়কিপ্টেকে শিক্ষা দেবার জন্য পাড়ার ছোঁড়ারা কাগজে মিথ্যে মিথ্যে ছাপিয়ে দেয়, তিনি নাকি অমুক চ্যারিটি ফান্ডে বিস্তর টাকা খয়রাত করেছেন। আর যাবে কোথা? চ্যারিটি না করে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বাড়ির সামনে চ্যারিটি ম্যাচের ভিড়।
হুবহু ওই একই মতলব।
তখন স্থির করলুম, একটা ফটো তুলে এই উল্টো-রথের সঙ্গে ছাপিয়ে দেব। শুনলুম, কালীঘাটের কাছে ফটো ফ্ল্যাশের নাকি বাসটিং বিজিনেস ফেটে পড়ার উপক্রম। গিয়ে দেখলুম, কথাটা খাঁটি, ছাব্বিশ ক্যারেট খাঁটি। আমার ছবি তুলতে গিয়ে তাদের তিনখানা লেন্স বার্সট করল। আমার শ্যাটারি সৌন্দর্য সইতে না পেরে।
সেই নব্বই বছরের থুরথুরে ফারসি বুড়ির কাছে বাজ পড়াতে তিনি ভিরমি যান। হুঁশ ফিরে এসে বিড়বিড় করে বলেছিলেন, বাজের কী দোষ? আমি যে বড্ড বেশি অ্যাট্রাকটিভ।
ফটো হল না। অইল পেন্টিং-ওলা বলেন, কালো হলেও চলত, তা সে যত মিশই হোক না। কিন্তু এ যে, বাবা, খাজা রঙ। কালো কালির উপর পিলা মসনে। তার উপর কলাইয়ের ডালের পিছলপারা, না-সবুজ না-নীল না-কিচ্ছ। আমার প্যালেট লাটে।