তাই যখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, জুর্নাল লেখার মতো দীর্ঘদিনের ম্যাদ যমরাজ আমায় দেবেন না তখন ওই কেরানির মতো পিছন ফিরলে কী রকম হয়? অর্থাৎ বিগত দিনের জুর্নাল? সেই-বা কী করে হয়? পোস্ট-ডেটেড চেক হয়, কিন্তু প্রি-ডেটেড দলিল করার নামই তো জাল। আজ আমি তো আর লিখতে পারিনে :
‘জন্মাষ্টমী ১৩১১ আজ আমার জন্ম হল। মা তখন তার বাপের বাড়িতে। হায়, আমাকে দেখবার কেউ ছিল না। কী হতভাগ্য আমি!’
পুলিশে ধরবে না তো!
বিবেচনা করি আপনারা ক্লাসিকস পড়েছেন– ঋগবেদ, মেঘনাদ, হ-য-ব-র-ল ইত্যাদি। শেষোক্তখানাতে এক বুড়ো ত্রিশ না চল্লিশ হতে না হতেই বয়েসটা ঘুরিয়ে দিত। তখন তার বয়স যেন কমতির ফটকাবাজারে যাকে বলে মন্দি বা বেয়ার দিকে। তখন তার বয়স হত ত্রিশ, উনত্রিশ, আটাশ করে করে আট হয়ে গেলে ফের বাড়তি বা তেজীর দিকে চালিয়ে দিয়ে নয়, দশ, এগারো করে বয়েস বাড়াত।
কিন্তু এ কৌশল রপ্ত করার জন্য মুষ্টিযোগটা শিখি কার কাছ থেকে? হ-য-ব-র-ল সৃষ্টিকর্তা ওপারে যাবার সময় তাঁর ব্যাটা বাবাজি সত্যজিৎকে কি এটা শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন? তাতেই-বা কী? বাবাজি তো তারও আগে ওঁরই কাছ থেকে শিখে নিয়েছেন, গেছোদাদা হওয়ার পন্থাটি–আমি যদি তার সন্ধানে যাই মতিহারি তখন তিনি ছিকেষ্টপুর। আমি ফিলাডেলফিয়ায় তো তিনি ভেরমন্টে। উঁহু, হল না।
ইরানের কবি অন্য মুষ্টিযোগ বাতলেছেন– তার বৃদ্ধ বয়সে :
আজ এ নিশীথে প্রিয়া অধরেতে চুম্বন যদি পাই।
জোয়ান হইব; এ জীবন তবে গোড়া হতে দোহরাই ॥
শবি আগর আজ লবে ইয়ার বোসে এ তলবম
জওয়ান শওম জসেরো জিন্দেগি দু বারা কুনম্ ॥
পাড়ার ছোঁড়ারা ঢিল ছুড়বে।
আমার গুরু রবীন্দ্রনাথ তা হলে কী বলেন?
শিশু হবার ভরসা আবার
জাগুক আমার প্রাণে,
লাগুক হাওয়া নির্ভাবনার পালে,
ভবিষ্যতের মুখোশখানা
খসাব একটানে,
দেখব তারেই বর্তমানের কালে।
তার পর তিনি কী করবেন?
জমিয়ে ধুলো সাজিয়ে ঢেলা
তৈরী হবে আমার খেলা—
সর্বনাশ! এই বৃদ্ধ বয়সে যদি সক্কলের সামনে তাই করি তবে ডা. ঘোষ আমাকে রাঁচি পৌঁছিয়ে দেবেন।
মোদ্দা কথায় তা হলে ফিরে যাই। আমাকে খামাখা মেলা বকর বকর করাবেন না। অবশ্য আমার মা বলতেন, আমার দোষ নেই। আমাকে টিকা দেবার সময় ডাক্তার ছুরি আনেনি বলে একটা গ্রামোফোনের নিড়ল দিয়ে টিকা দিয়েছিল।
তা হলে একটা মাস চিন্তা করতে দিন। সামনে হোলি। গায়ে রঙ মাখাব। মনেও।
স্লিস্টলার অর্থ নিম উকিল। উকিলের কাছে যাবার পূর্বে আমার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল। সেটি হয়তো পূর্বেও কোনও-কোথাও উল্লেখ করেছি। তাই সেটি আবার বলছি। কারণ মানুষ বিশ্বাস করতে ভালোবাসে যা সে পূর্বেও একাধিকবার শুনেছে–নয়া কথা তার ভালো লাগে না। তাই দেখুন– এটাও আমি আরেকবার বলেছি– একই প্লট নিয়ে ক-গণ্ডা ফিলিম নিত্যি নিত্যি বেরুচ্ছে তার হিসাব রাখেন?
ঘটনাটি সংক্ষেপে এই :
নরক আর স্বর্গের মধ্যিখানে মাত্র একটি পাঁচিলের ব্যবধান। নরক চালায় শয়তান, আর স্বর্গ চালান সিন্ট পিটার। পাদ্রিসায়েবের মুখে শোনা, তাঁরই হাতে থাকে স্বর্গদ্বারের সোনার চাবি।
পাঁচিলটি ঝুরঝুরে হয়ে গিয়েছে দেখে পিটার একদিন শয়তানকে ডেকে বললেন, দেয়ালটা এজমালি। তাই এটার মেরামতি আমি করব এক বছর, তুমি করবে আর বছর। আসলে তোমারই করা উচিত প্রতি বছর। কারণ তোমার দিকে সুবো-শাম জ্বলছে আগুনের পেল্লাই পেল্লাই চুলোতারই চোটে দেয়াল হচ্ছে জখম। আর আমার দিকে সর্বক্ষণ বয় মন্দমধুর মলয় বাতাস। দেয়াল বিলকুল জখম হয় না।
বিস্তর তর্কাতর্কির পর স্থির হল, ইনি এ বছর আর উনি আর বছর দেয়াল মেরামত করবেন। শেষটায় বিদায় নেবার সময় শয়তান ঘাড় চুলকে বলল, দাদা, কিছু যদি মনে না কর, তবে এ বছরটায় তুমিই মেরামতিটা করাও। একটু অভাবে আছি।
পিটার মাই ডিয়ার লোক। রাজি হয়ে গেলেন।
তার পর এক বছর যায়, দু বছর যায়, পাঁচ বছর যায়, দেয়াল পড়ো-পড়ো–শয়তানের সন্ধান নেই। পিটার রেজেস্ট্রি করে চিঠি লিখলেন। ফেরত এল। উপরে লেখা, মালিক না পাইয়া ফেরত। পিটার তখন একাধিকবার শয়তানের বাড়ি গিয়ে কড়া নাড়লেন। ভিতর থেকে তীক্ষ্ণ বামাকন্ঠ বেরুল– কত্তা বাড়ি নেই। পিটার বাড়ির সামনে লটকাইয়া শমন জারি করলেন। কোনও ফায়দা ওতরাল না।
এমন সময় পিটারের বরাতজোরে হঠাৎ শয়তানের সঙ্গে রাস্তায় মোলাকাত। শয়তান অবশ্য তড়িঘড়ি পাশের গলিতে গা-ঢাকা দেবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু এঞ্জেলদের ডানা থাকে। ফুড়ুৎ করে উড়ে গিয়ে পার্ফেক্ট ল্যান্ডিং করে দাঁড়ালেন তার সামনে। খপ করে হাত ধরে বললেন, বড় যে পালিয়ে বেড়াচ্ছ দেয়াল মেরামতির কী হবে?
শয়তান গাইগুই টালবাহানা আরম্ভ করল। পিটার চেপে ধরলেন, পাকা কথা দিয়ে যাও।
তখন শয়তান শেষ কথা বলল, কিছু মনে কর না ভাই, কিন্তু আমি আমার উকিলদের সঙ্গে পরামর্শ না করে কোনও পাকা কথা দিতে পারব না।
নিরাশ হয়ে পিটার শয়তানের হাত ছেড়ে দিয়ে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বাড়ি ফেরার মুখ করে বললেন, ওইখানেই তো তোর জোর। সবকটা নিয়ে বসে আছিস। আমার যে একটাও নেই।
আমার উকিল অবশ্য নরকে যাবেন না। তিনি বলেন, নরক নেই, স্বর্গ আছে।