লমফ : সে সরেস! নাতালিয়া : ওটা নিরেস, নিরেস, নিরেস!
চুবু : [চিৎকার করে দু জনার গলা চাপবার চেষ্টাতে) শ্যাম্পেন! শ্যাম্পেন। নিয়ে আয়!
যবনিকা
উলটা-রথ
অবতরণিকা
কত না কসরত, কত না তকলিফ বরদাস্ত করে কত চেষ্টা দিলুম, দেশে নাম কেনবার জন্য, আজ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পিছন পানে তাকিয়ে দেখি সব বরবাদ, সব ভণ্ডুল। পরের কথা বাদ দিন, নিতান্ত আত্মজনও আমার লেখা বই পড়ে না। গিন্নিকে–না, সে কথা থাক, তাঁর সঙ্গে ঘর করতে হয়, ওঁয়াকে চটিয়ে লাভ নেই। অথচ আমার জীবনে মাত্র একটি শখ ছিল, সাহিত্যিক হওয়ার। আপনাদের মনের বেদনা কী বলব– তবে হ্যাঁ, আপনারাই হয়তো বুঝবেন, কারণ সিনেমায় দেখেছি, নায়িকা যখন হা নাথ, হা প্রাণেশ্বর, তুমি কোথায় গেলে? বলে হন্যে-পারা স্ক্রিনে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত অবধি টাটুঘোড়ার মতো ছুটোছুটি লাগান তখন আপনারা হাপুস-হুঁপুস করে অবর্ষণ করেন (যে কারণে আমি হলের ভিতরেও রেনকোট খুলিনে), তাই আপনারা বুঝবেন।
যখন দেখি প্রখ্যাত সাহিত্যিক উচ্চাসনে বসে আছেন, তাঁর গলায় মালার পর মালা পরানো হচ্ছে, খাপসুরৎ মেয়েরা তার অটোগ্রাফের জন্য হদ্দমুদ্দ হচ্ছে, তার জন্য ঘন ঘন বরফজল শরবত আসছে, সভা শেষে হয়তো আরও অনেক কিছু আসবে তখন আমার কলিজার ভিতর যেন ইঁদুর কুরকুর করে খেতে থাকে, আমার বুকের উপর যেন কেউ পুকুর খুঁড়তে আরম্ভ করে। সজল নয়নে বাড়ি ফিরি। পাছে গিন্নি অট্টহাস্য করে ওঠেন তাই দোরে খিল দিয়ে বইয়ের আলমারির সামনে এসে দাঁড়াই– তাকিয়ে থাকি আপন মনে আমার, বিশেষ করে আমার নিজের পয়সায় মরক্কো লেদারে বাঁধানো সোনার জলে আমার নাম ছাপানো আমার বইয়ের দিকে।
আমার মাত্র একজন বন্ধু– এ সংসারে। কিন্তু আর কিছু বলার পূর্বে আগেভাগেই বলে নিই, ইনিও আমার বই পড়েননি। তিনি এসে আমায় একদিন শুধোলেন, ব্রাদার, আমিয়িলের জুনাল পড়েছ?
সে আবার কী বস্তু? বই-ই হবে। না? তা সে কি আমার বই পড়েছে যে আমি তার বই পড়ব?
আহা চটো কেন? জল্লাদ যখন কারও গলা কাটে তখন তার মানে কি এই যে, সে লোকটা আগে জল্লাদের গলা কেটেছিল? অভিমান ছাড়ো। আমার কথা শোনো। এই আমিয়েল সায়েব প্রফেসর ছিলেন। তার বাড়া আর কিছু না। যশ প্রতিপত্তি তার কিছুই হয়নি। নিঃসঙ্গ জীবনে নির্জনে তিনি লিখলেন তাঁর জুনাল।
আমি বাধা দিয়ে বললুম, জুনাল-জুনাল করছ কেন? উচ্চারণ হবে জার্নেল। উচ্চারণ সম্বন্ধে আমি বড্ডই পিটপিটে।
বন্ধু বললেন, কী উৎপাত! ওটার উচ্চারণ ফরাসিতে জুর্নাল। এসেছে ডায়ার্নাল থেকে, সেটা এসেছে লাতিন দিয়েস থেকে–যেটা সংস্কৃতে দিবস। ফরাসিতে তাই দিন দিন প্রতি দিন নিয়ে যখন কোনও কথা ওঠে তখন ওই জুর্নাল শব্দ ব্যবহার হয়। তাই দৈনিক কাগজ জুর্নাল, আবার প্রতিদিনের ঘটনা লিখে রাখলে সেটাও জুর্নাল অর্থাৎ ডাইরি। ফার্সিতে দিনকে বলে রোজ, তাই প্রতিদিনের ঘটনার নাম যেখানে লেখা থাকে সেটা রোজনামচা। আবার
আমি বাধা দিয়ে বললুম, হয়েছে, হয়েছে।
সেই আমিয়েল লিখলেন তাঁর জুনাল। মৃত্যুর পর সে-বই বেরোতে সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার বসত শহর জিনিভাতে হয়ে গেলেন লেখক হিসেবে প্রখ্যাত। বছর কয়েকের ভিতর তামাম ইউরোপে। ইস্তেক তোমাদের রবি ঠাকুর সে বইয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। তাই বলি কি না, তুমি একখানা জুনাল লেখো।
আমি শুধালুম, তুমি পড়বে?
বন্ধু উঠে দাঁড়ালেন। ছাতাখানা বগলে চেপে বললেন, চললুম, ভাই। শুনলুম পাড়ার লাইব্রেরিতে পাঁচকড়ি দের কয়েকখানা অপ্রকাশিত উপন্যাস এসেছে। পড়তে হবে।
ভালোই করলেন। না হলে হাতাহাতি হয়ে যেত।
কিন্তু বিশ্বাস করবেন না, তার সেই মোস্ট সাজেশনের পর থেকে এই জুর্নালের চিন্তাটা কিছুতেই আমি আমার মগজ থেকে তাড়াতে পারছিনে। যে-রকম অনেক সময় অতিশয় রদ্দি একটা গানের সুর মানুষকে দিবারাত্তির হন্ট করে। এমনকি ঘুম থেকে উঠে মনে হয় ঘুমুতে ঘুমুতেও ওইসঙ্গে গুনগুন করেছি।
কিন্তু জুনাল লিখতে যাওয়ার মধ্যে একটা মস্ত অসুবিধে রয়েছে আমার। সংস্কৃতে শ্লোক আছে :
শীতেহতীতে বসনমশনং বাসরান্তে নিশান্তে
ক্রীড়ারম্ভং কুবলয়দৃশং যৌবনান্তে বিবাহম।
শীতকাল গেলে শীত-বস্ত্র পরিধান।
আহার গ্রহণ যবে দিন অবসান
রাত্রিকাল শেষ হলে প্রেম আলিঙ্গন!
বিবাহ করিতে সাধ যাইলে যৌবন!
—(কবিভূষণ পূর্ণচন্দ্র)
একশো বছর বয়সে আসন্ন মৃত্যুর সম্মুখে অন্তৰ্জলি অবস্থায় সাততলা ইমারত বানাবার জন্য কেউ টেন্ডার ডাকে না।
জুর্নাল লেখা আরম্ভ করতে হয় যৌবনে। তা হলে বহু বছর ধরে সেটা লেখা যায়। পুস্তকাকারে প্রকাশিত হলে পর পাঠক তার থেকে লেখকের জীবনক্রম-বিকাশ, তার সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব পড়ে পরিতৃপ্ত হয়।
আজ যদি আমি জুনাল লিখতে আরম্ভ করি তবে আর লিখতে পাব কটা দিন? তাই কবি বলেছেন, এ যে যৌবনান্তে বিবাহ!
তা হলে উপায় কী?
তখন হঠাৎ একটি গল্প মনে পড়ে গেল।
এক বেকার গেছে সায়েবাড়িতে। কাচুমাচু হয়ে নিবেদন করল, সায়েব, আপনার এখানে যে কী ভয়ে ভয়ে এসেছি, কী আর বলব! এক পা এগিয়েছি কি তিন পা পেছিয়েছি! সায়েব বলল, ইউ গাগা, তা হলে এখানে পৌঁছলে কী করে? বেকারটি আদৌ গাগা অর্থাৎ যে বদ্ধ পাগল শুধু গাগা করে গোঙরায় ছিল না। বরঞ্চ বলব হাজির-জবাব– অর্থাৎ সব জবাবই তার ঠোঁটে হাজির। বলল, হক কথা কয়েছেন, হুজুর। আমিও তাই মুখ করলুম আপন বাড়ির দিকে। এক পা এগোই তিন পা পেছোই। করে করে এই হেথা হুজুরের বাঙলোয় এসে পৌঁছে গেলুম।