ঝিঙে ভয়ে ভয়ে, লোকলজ্জায় কিছুটা বুক ফুলিয়ে, এগিয়ে এল– ভিড় রাস্তা করে দিল। ঝিঙের সঙ্গে শিবুর সদ্ভাব ছিল না।
গুল বাহাদুর বললেন, সব-কিছু চালাও।
ঝিঙে গলে গেল। তার মনে কোনও সন্দেহ ছিল না, শিবু গত হলেই সে হবে গাঁয়ের মোড়ল। মধ্যিখানে বাদ সাধল এই লক্ষ্মীছাড়া বাবাজি। শিবু নিশ্চয়ই মরার সময় এ-ব্যাটাকে বিষিয়ে গেছে। তা হলে এটা হল কী করে? থাক্ এখন, পরে জানা যাবে।
ঝিঙে ডবল উৎসাহে সবকিছু সামলাল। বেশিরভাগ ব্যবস্থা শিবু মরার আগেই করে গিয়েছিল।
শ্মশান থেকে ফিরে এসে ঝিঙে সরদার শিবু মোড়লের দাওয়ায় গুল বাহাদুরের কাছে এসে বসল। গাঁয়ের দু-চারজন তাদের কথার্বাতা শোনবার জন্য এগিয়ে এলে ঝিঙে দিল তাদের জোর ধমক। তারা গুল বাহাদুরের দিকে আপিল-নয়নে তাকাল কিন্তু তার কোনও ভাব-পরিবর্তন না দেখে আস্তে আস্তে সরে পড়ল।
তখন তিনি অতি শান্তকণ্ঠে, ধীরে ধীরে বললেন, মোড়ল, ধমক না দিয়েই যেখানে কাজ চলে সেখানে ধমকের কী দরকার! কিন্তু সে তুমি বোঝো। আমি বলবার কে? আমি তো এদের চিনিনে। এদের কী করে সামলাতে হয় তার খবর রাখো তুমি।
মোড়ল সম্বোধনে ঝিঙে একেবারে পানি হয়ে গেল– জল তো হয়ে গিয়েছিল আগেই। হাতজোড় করে বলল, দেবতা, অপরাধ হয়েছে। কিন্তু ওদের থাকতে বললে না কেন?
গুল বাহাদুর প্রথমেই লক্ষ করলেন ঝিঙে তোতলা। তোতলাকে মোড়ল বানানো কি ঠিক? তখন মনে পড়ল, একাধিক পয়গম্বরও ছিলেন তোতলা।
ঝিঙের কথার উত্তরে বললেন, তুমি মুরুব্বি, একটা হুকুম দিয়েছ। আমি উল্টো কথা বললে তোমার মুখ থাকত কি?
ঝিঙে কিন্তু শিবুর মতো বিচক্ষণ লোক নয়। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে শুধাল, শিবু তোমাকে বলে যায়নি আমাকে মোড়ল না করতে?
গুল বাহাদুর বললেন, না।
শিবুর মতো বিচক্ষণ নয় ঝিঙে, কিন্তু সে শিবুর চেয়ে অনেক বেশি ঘড়েল।
ভাবখানা করল, ওহ! শিবু যদি বলত তবে তুমি আমায় ডাকতে না।
গুল বাহাদুর বললেন, শোন সরদার, শিবু সব কথা বলে যাবার ফুরসত পায়নি। পেলেও যে তোমার কথা বলত, তা-ও তো জানিনে। আর ওর বলাতে না-বলাতে কিছু আসে-যায় না। সে গেছে, এখন গাঁ চালাব আমরা। ওর ইচ্ছে বড়, না, গাঁ-চালানো বড়? ও যদি বলে যেত, আনন্দী গা চালাবে, তা হলে তোমরা কি সেটা মানতে?
গুল বাহাদুরের মনে পড়ল হজরত মুহম্মদও ইহলোক ত্যাগ করার সময় মুসলমানদের জন্য কোনও খলিফা নিয়োগ করে যাননি। গুল বাহাদুর আশ্চর্য হয়ে ভাবলেন, তবে কি অনুন্নত সম্প্রদায়ে এই ব্যবস্থাই বেশি কার্যকরী? তবে কি বংশগত রাজ্যাধিকার পরবর্তী যুগের সৃষ্টি? তার পর মনে পড়ল, ঐতিহাসিক ইবনে খলদুন তার পৃথিবীর ইতিহাসে এই নিয়ে কী যেন এক দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। ভাবলেন, দেখতে হবে। তার পর মনে পড়ল, এখানে তো বইপত্র কিছুই নেই। যাক্ গে এসব কথা।
ঝিঙেকে বললেন, কানাবুড়ি বাতাসীকে বল সে এ ভিটেয় থাকবে। ঝিঙে অবাক। বাতাসীর মতো অথর্ব অচল ঝগড়াটে সাড়ে ষোল আনা অন্ধ এ তল্লাটে দুটি নেই। তার গলাবাজির চোটে পুঁদে মোড়ল শিবুও তার তল্লাট মাড়াত না।
ঝিঙে গুল বাহাদুরের মতলব আদপেই বুঝতে পারেনি। তিনি জানতেন, শিবুর যে কিছু লুকানো টাকা আছে সেটা সকলের অজানা না-ও হতে পারে। রাত্রে ভিটে খোঁড়ার জন্য চোর আসতে পারে। বাড়ির ত্রিসীমানায় আসতে না আসতে বুড়ি চিৎকার করে করে পাঁচখানা গাঁয়ের লোক জড়ো করে ফেলবে। অন্ধের শ্রবণশক্তি চক্ষুম্মানের চেয়ে বেশি। দিল্লির জামি মসজিদের দেউড়িতে এক অন্ধ শুধু গলা শুনে হাজার লোকের জুতো সামলায়। মাদ্রাসার ছোঁড়াদের কেউ মজা দেখবার জন্য অন্যের গলা নকল করলে অন্ধ দু-জোড়া জুতো বাড়িয়ে দিয়ে বলত, এই নাও তোমার জোড়া, আর এই নাও যার নকল করছিলে। লোকে বলত, আগ্রাতে শুকনো পাতা ঝরে পড়লে এ অন্ধ দিল্লির চাঁদনি চৌকে বসে শুনতে পায়। বাতাসী অতখানি কেরানি হয়তো দেখাতে পারবে না, কিন্তু দুটি বেগুন বাঁচাবার জন্য যে বেটি সমস্ত রাত দাওয়ায় বসে কাটায় তার চেয়ে ভালো পাহারাওলা পাওয়া যাবে কোথায়? এখন কয়েক রাত তো পাড়াপ্রতিবেশীরা কান খাড়া রেখে ঘুমুবে শিবুর ভিটেতে খোঁড়াখুঁড়ির শব্দ হচ্ছে কি না শোনবার জন্যে। কয়েকটা রাত যাক, তার পর তিনি সুবিধেমতো তার ব্যবস্থা করবেন।
কিছুক্ষণের ভিতরই শোনা গেল পাড়ার শেষপ্রান্ত থেকে বাতাসীর চিৎকার। চিকনকালা গ্রামটাকে সে বেতারকেন্দ্র বানিয়ে বিশ্বভুবনকে জানাচ্ছে, শিবু গেছে বেশ হয়েছে, আগে গেলেও কেউ মানা করত না, বাতাসী তো নয়ই, কিন্তু এ কী গেরো, সে কেন সামলাতে যাবে শিবুর গোয়াল-খামার, ওই দিকধিড়িঙে মিনসে বাবাজিটা আছে কী করতে, তাকেই তো শিবু ঘটিবাটি চুলো-হাঁড়ি সব-কিছু দিয়ে গিয়েছে, মরে যাই, আর লোক পেল না, কোথাকার হাড়হাভাতে শতেক খোয়ারি- আরও কত কী!
গলার শব্দ কিন্তু এগিয়ে আসছে শিবুর বাড়ির দিকেই।
মোগল শাসনেও চার্জ দেওয়া-নেওয়া নামক মস্করাটা চলত। গুল বাহাদুর সে-মস্করাটা বাতাসীর সঙ্গে করার প্রয়োজন বোধ করলেন না। তাঁর ঘাড়েও তো মাথা মাত্র একটা। সেটা তো চায় ইংরেজ। বুড়িকে দিয়ে চলবে কেন?
আনন্দীকে হাতে ধরে নিয়ে বললেন, চলো।