শিবু মোড়লের ইঙ্গিতে সবাই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল–মায় তার ছ বচ্ছরের ছেলেটাও। অবাক ইশারায় গুল বাহাদুরকে তক্তপোশের একদম কাছে ডেকে নিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, আমার ছেলেটাকে তুমি মানুষ করো। সব তোমাকেই দিলুম।
গুল বাহাদুর ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছেন। ছেলেটার ভার কাঁধে তুলতে তার কণামাত্র আপত্তি নেই। কিন্তু তিনি যে আসলে মুসলমান।
মোড়ল বলল, আমার অনেক শক্র; ছেলেটাকে মেরে ফেলবে।
দুশ্চিন্তার ভিতরও গুল বাহাদুরের মনে পড়ল, হজরত মুহম্মদের পূর্বেও আরবরা ছিল বর্বর। তারাও নির্ভয়ে অনাথকে মেরে ফেলে তার টাকাকড়ি উট তাম্বু কেড়ে নিত। তাই হজরতের নবধর্ম স্থাপনার অন্যতম প্রধান ভিত্তি ছিল অনাথের রক্ষা। মনে পড়ল, স্বয়ং আল্লা হজরতকে মধ্যদিনের আলোর দোহাই, নিশির দোহাই, ওরে বলে তাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে তিনিও অনাথরূপেই জন্ম নিয়েছিলেন,
অসহায় যবে আসিলি জগতে তিনি দিয়েছেন ঠাঁই,
তৃষ্ণা ও ক্ষুধা আছিল যা সব মুছায়ে দেছেন তাই।
পথ ভুলেছিলি, তিনিই সুপথ দেখায়ে দেছেন তোরে
সে-কৃপার কথা স্মরণ রাখি। অসহায় শিশু, ওরে,
দলিনে কভু। ভিখারি-আতুর বিমুখ যেন না হয়।
তাঁর করুণার বারতা যেন রে ঘোষিস জগৎময়।
এ তো আল্লার হুকুম, রসুলের আদেশ। মানা-না-মানার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তোমার ঘাড় মানবে।
কিন্তু তিনি যে মুসলমান। ডোম হোক আর মেথরই হোক, মোড়লের ছাবালের মুখে তিনি জল তুলে দেবেন কী প্রকারে? গুল বাহাদুর চুপ।
শিবু তার লাল ঘোলাটে চোখ মেলে তাঁর দিকে তাকাল কিছুক্ষণ। তার পর ধীরে ধীরে বলল, গোসাই, তুমি গোসাই নও, সে কথা আমি জানি। তুমি কী, তা-ও আমি জানি। কিন্তু আর কেউ জানে না। জানার দরকারও নেই।
কী করে জানলে? এ প্রশ্ন গুল বাহাদুর শুধালেন না। তিনি পল্টনের লোক; বললেন, আমি মুসলমান, জানো?
শিবুর শুকনো মুখ খুশিতে তামাটে হয়ে উঠল। গুল বাহাদুরের হাতখানা আপন হাড্ডিসার দু হাতে তুলে নিয়ে বলল, বাঁচালে, গোসাঁই, তরালে আমাকে। তার পর হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, মুসলমানেরই এক দর্গায় মানত করে মা পেয়েছিল আমাকে। আমি পেয়েছি আনন্দীকে। পীর সৈয়দ মরতুজার ভৈরবীর নাম ছিল আনন্দী।
মুসলমান পীরের দরগায় যে হিন্দু বন্ধ্যা সন্তানের আশায় যায়, এ দৃশ্য গুল বাহাদুর বহুবার দেখেছেন দিল্লিতে নিজাম উদ্দীন আউলিয়ার দরগায় কিন্তু পীরের আবার ভৈরবী হয় কী করে, আর ভৈরবীই-বা কী চিজ, আনন্দী শব্দটাও হিন্দু হিন্দু শোনায়, এসব গুল বাহাদুর কিছুই বুঝতে পারলেন না। কে জানে মুসলমান ধর্ম বাঙলা দেশে এসে কী রূপ নিয়েছে।
বাচ্চাকা ভালা বোলনা-চোলনা, বহুড়ীকা ভালা চুপ–বাচ্চার ভালো বকবকানো, কনের ভালো চুপ ভালো সেপাইও বহুড়ীর মতো চুপ করে শুনে যায়, গুল বাহাদুর চুপ করে শুনে যেতে লাগলেন।
মোড়লের দম ক্রমেই ফুরিয়ে আসছিল। তাই আশকথা-পাশকথা সম্পূর্ণ বর্জন করে শুধু তার ইচ্ছাগুলো বলে যাচ্ছিল, বিষয়-আশয় বোঝবার বয়স হলেই তাকে মামার বাড়ি বিষ্ণুপুরে পাঠিয়ে দিয়ো। সেখানে তার জমিজমা এখানকার চেয়ে ঢের বেশি।
গুল বাহাদুর পুরনো কথায় ফিরে গিয়ে শুধালেন, তোমার ছেলে আমার সঙ্গে থাকলে মুসলমান হয়ে যাবে না।?
মোড়ল বলল, না। আমরা জাতে ডোম। মুসলমানের হাতে খেলেও আমাদের জাত যায় না, আমরা মুসলমানও হইনে। থাক্ অতশত কথা। তুমি নিজেই জেনে যাবে। শোনো, আর যা করতে হয় করো, ছেলেটাকে কিন্তু লেখাপড়া শিখিয়ো না, ওকে ভদ্রলোক বানিয়ো না।
সে কী!
না, ভদ্রলোক বানিয়ো না। আর শোনো, জলের কলসির তলায় মাটির নিচে কিছু টাকা আছে। তোমাকে দিলুম।
গুল বাহাদুরের আবার মনে পড়ল, হজরত তার যৌবন আরম্ভ করেছিলেন, এক বিধবার ব্যবসায়ের কর্মচারীরূপে। বললেন, টাকা ব্যবসাতে খাটাব। তোমার ছেলে পাবে মুনাফার আট আনা।
মোড়ল বলল, যা খুশি কর, কিন্তু লগ্নির ব্যবসা কর না।
গুল বাহাদুরের মুখ লাল হয়ে উঠল। ভদ্র মুসলমান সুদের ব্যবসা করে না।
মোড়ল বলল, আর শোন, খুশ বিরামপুরের ঘোষালদের মেজবাবুর সঙ্গে আলাপ কর। তোমারই মতো। কিন্তু সাবধানে। আর শোন, তোমারই মতো আরেকজন আশ্রয় নিয়েছে বর্ধমানের কাছে, দামোদরের ওপারে–
এবারে গুল বাহাদুর আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। তবু উত্তেজনা চেপে রেখেই তাড়াতাড়ি শুধালেন, কোন গ্রামে?
মোড়ল তখন হঠাৎ চলে গিয়েছে ওপারে, যেখানে খুব সম্ভব গ্রামও নেই, শহরও নেই।
গুল বাহাদুর দু হাত দিয়ে ধীরে ধীরে মোড়লের চোখ দুটি বন্ধ করে দিলেন। মনে মনে আবৃত্তি করলেন,
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
আল্লার কাছ থেকে এসেছি, আর তার কাছে ফিরে যাব। কাফেরের মৃত্যুসংবাদ শুনলে কট্টর-মোল্লা কট্টর উল্লাসভরে এ মন্ত্র উচ্চারণ না করে বলে ওঠে ভিন্ন মন্ত্র–
ফি নারি জাহান্নামা।
একমাত্র ইংরেজদের মৃত্যুসংবাদ শুনলে গুল বাহাদুর দ্বিতীয় মন্ত্রটি একশোবার আবৃত্তি করতেন। আল্লার একশো নাম– মানুষ তার নিরানব্বই জানে– সেই নিরানব্বই নামের উদ্দেশে নিরানব্বই বার আর শয়তানের উদ্দেশে একবার।
দাহ-কর্ম শ্রাদ্ধ, তা-ও আবার ডোমের, এসব কোনওকিছুই গুল বাহাদুর জানতেন না, জানবার চেষ্টাও করলেন না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখলেন। তবে তাঁর গম্ভীর আঁটসাট মূর্তি আনন্দীর হাত ধরে না দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো ঝগড়াঝাটি হতে পারত। মোড়লের মরে যাওয়ার পর বাড়ির সামনে যে ভিড় জমেছিল তার দিকে একবার তাকিয়েই তিনি বুঝতে পারলেন, শাহ্-ইন-শাহ্ বাহাদুর শার দরবারে যদি দৈবপাকে চিকনকালা গ্রামের মাতব্বরদের কুর্নিশ জানাবার অনুমতি লাভ হত তবে তাতে দুই নম্বর হত কে? পয়লা নম্বর তো চলে গিয়েছেন, দুই নম্বর হতেন ঝিঙে সরদার। ভিড়ের মধ্যে ঝিঙের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে ভারি গলায় হুকুম দিলেন, ইধর আও।