প্রথম যখন দোঁহাটি পড়েছিলেন তখন তার মনে হয়েছিল এ কী কাষ্ঠ রসিকতা! আজ হৃদয়ঙ্গম হল, এ শ্লেষ নয়, বিদ্রূপ নয়– ছাত থেকে আকাশই মূল্যবান সেখানেই মুক্তি, সেখানেই নির্বাণ।
ওই তো আকাশের তারা। তাঁর পেয়ারা ঘোড়ার জিনের সামনের উঁচু দিকটা ঠিক এই রকমই পেতলের স্টাড দিয়ে তারার মতো সাজানো ছিল। এ তো কিছু অজানা সম্পদ নয়। দার্শনিক গজ্জালিও তার সৌভাগ্য স্পর্শমণি (কিমিয়া সাদৎ) গ্রন্থে বলেছেন, আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে দেখো, আর আপন অন্তরের দিকে তাকাও বুঝতে পারবে সৃষ্টির মাহাত্ম্য।
দুই-ই অলঙ্ঘ্য নিয়ম অনুসারে চলে। শুধু হৃদয়ের আইন বোঝা কঠিন। স্বাধিকারপ্রমত্ত হয়ে ভাবি, স্বেচ্ছায় করছি- তারারাও হয়তো তাই ভাবে।
তরল অন্ধকার। এ অন্ধকার বুকের উপর দুঃস্বপ্নের মতো চেপে বসে। এর চেয়ে অনেক বেশি মসীকৃষ্ণ দেখাচ্ছে পলাশের ডালগুলো। তারা আঁকাবাঁকা শাখা দিয়ে অন্ধকারের গায়ে এঁকেছে বিচিত্র আলিম্পন। গাছের শক্ত ডাল, অশরীরী অন্ধকার, দূরদূরান্তের তারার দেয়ালি– সবাই একসঙ্গে মিলে গিয়ে পেলব মধুর স্পর্শ দিয়ে শান্তি এনে দিচ্ছে গুল বাহাদুরের দগ্ধ ভালে। এইটুকু তার চোখের মণিতে ধরা দিয়েছে সে সন্ধ্যার অনন্ত আকাশ থেকে পলাশের ডগাটুকু পর্যন্ত। যমুনার পারে প্রাসাদের উপরে এরা তাকে যেমন করে সোহাগ জানাত ঠিক তেমনি তারা এসে ধরা দিল ছেঁড়া চাটাইয়ের উপর শায়িত ফকির গুল বাহাদুরের কাছে।
কৃতজ্ঞ গুল বাহাদুর তার দীর্ঘ দুই হাত তাদের দীর্ঘতম প্রসারণে উচ্চ বিস্তার করে আসমানের দিকে তুলে মোনাজাত করলেন,
তোমার আমার মাঝখানে, বিভু, নাই কোনও বাধা আর
তোমার আশিস বহিয়া আনিল তরল অন্ধকার।
.
০৩.
আরব্য রজনীর গল্পে আছে কোথায় যেন দমস্কস্ না বাগদাদ শহরে, এক ঝুড়ি আণ্ডা সামনে নিয়ে বসে অন-ন শার স্বপ্ন দেখছিল। হুবহু স্বপ্ন না, দিবা-স্বপ্ন। ওই ডিমগুলোই তার সাকুল্য সম্পত্তি। এক ডিম বিক্রি করে মুনাফা দিয়ে সে কিনবে আরও ডিম। তারই লাভে পুষবে মুরগি। তারই লাভে সে যাবে হিন্দুস্থান, সদাগরি করতে। তারই লাভে সে হয়ে যাবে শেষটায় শহরের সবচেয়ে মাতব্বর আমির। তখন প্রধানমন্ত্রী উজির-ই-আলা– যেচে-সেধে তাঁর মেয়েকে দেবেন তার সঙ্গে বিয়ে। তার পর আরও অনেক কিছু হবে। হয়ে হয়ে একদিন এই এমনি খামোখা তার রাগ হয়েছে বেগম সায়েবার ওপরে। তিনি অনেক সাধাসাধি করেছেন তার মান ভাঙাবার জন্য। অন-নশ শার মানিনী শ্রীরাধার মতো অচল অটল। বরঞ্চ হঠাৎ আরও বেশি ক্ষেপে গিয়ে মারলেন বেগম সায়েবাকে এক লাথ। হায়রে, হায়! এতক্ষণ ছিল সুদ্ধমাত্র খেয়ালের পোলাও খাওয়া, দিবা-স্বপ্ন এখন অন্-নশ শার মেরে দিয়েছে সত্যিকার লাথি। সেটা পড়ল সামনে-রাখা ডিমের ঝুড়ির উপর। কুল্লে আণ্ডা ভেঙে ঠাণ্ডা।
এ গল্প কখনও ফ্রক পরে ইংলন্ডে, কখনও দাড়ি রেখে আফগানিস্তানে সর্বত্রই প্রচলিত আছে। এবং সর্বযুগেই সর্বদেশের প্র্যাকটিকেল পাণ্ডারা বেচারি অনু-নশ শারকে নিয়ে কতই না ব্যঙ্গোক্তি করেছেন। সে-ও লজ্জায় রা-টি কাড়ে না।
কিন্তু এ কথাটা কেউ ভেবে দেখে না যে, এ সংসারে অহরহই প্রাত্যহিক জীবনের সংকীর্ণ গণ্ডি ছাড়িয়ে যারা বৃহত্তর ভুবনে চলে যেতে জানে তাদের সবাই অন্-নশ শার– ওই শেষ লাথিটুকু বাদ দিয়ে। যারা আপন নাকের ডগার বাইরে তাকাতে জানে না তারাই দৈনন্দিন দৈন্যে শেষদিন পর্যন্ত নাকানি-চুবানি খায়। দিবাস্বপ্ন আলবৎ দেখতে হয় কিন্তু শেষ লাথিটুকু বাদ দিয়ে। গুল বাহাদুর ঠেকে শিখেছেন। গদরের আণ্ডা বিক্রি হওয়ার পূর্বেই তারা স্বাধীনতার উজির-কুমারীকে লাথি মেরে বসিয়েছিলেন। তিনি সাবধান হয়ে গিয়েছেন। এখন আর কুঁড়েঘরে বসে বালাখানা-রাজপ্রাসাদের স্বপ্ন নয়, গদরের খেয়ালি পোলাও নয়। এখন দেখতে হবে নাকের ডগা ছাড়িয়ে ত্রিশ গজ দূরের স্বপ্ন মাত্র সাংসারিক সচ্ছলতার স্বপ্ন।
তাঁর প্রথম আণ্ডা এল অযাচিত, অপ্রত্যাশিতভাবে।
ডোমেরা এসে সভয়ে তাঁকে নিবেদন জানাল, শিবু মোড়ল যায় যায়। মরার আগে বাবাজির চরণধূলি চায়।
গুল বাহাদুর পড়লেন বিপদে। ওপারে যাওয়ার সময় মুসলমান যেসব তওবা-তিল্লা করে থাকে অনেক হিন্দুদের প্রায়শ্চিত্ত কিংবা জৈনদের পর্যসনের মতো সেগুলো তিনি কোনওমতে সামলে নিতে পারেন, কিন্তু হিন্দুধর্মের তিনি জানেনই-বা কতটুকু? তার আমলে দিল্লির হিন্দুরা তো শিক্ষা-দীক্ষায়, সংস্কৃতি-সভ্যতায় পুরো-পাক্কা মুসলমান বনে গিয়েছে। তারা পরে চোৎ চুড়িদার পাজামা, লম্বা শেরওয়ানি, মাথায় দুকল্পি কিস্তি টুপি আর মুশাইরায় হাঁটু গেড়ে বসে বয়েৎ আওড়ায়– মক্কা-মদিনার মালিক, ইয়া আল্লা, আমাকে ডেকে নাও নবীর নূর হজরত মুহম্মদের পদপ্রান্তে।
বরন্দাবন (বৃন্দাবন)-কে কুন্জ গলিয়ামে (কুঞ্জ গলিতে) কিসজি (শ্রীকৃষ্ণ) কভি কভি বাসরী (বাশরী) বৃজাওৎ (বাজান), এই তো হিন্দুধর্ম বাবদে তাঁর এলেম! ওইটুকু জ্ঞানের ন্যাজ তিনি শিবু মোড়লের হাতে তুলে দিয়ে তাকে নির্ভয়ে বৈতরণীতে নাবতে ভরসা দেবেন কী প্রকারে?
ধরা পড়ার ভয় আছে, অথচ না গিয়েও উপায় নেই। গুল বাহাদুর মনে মনে বললেন, চুলোয় যাক গে। এ রকম ভয়ে ভয়ে কাটাব আর কতদিন! মৃত্যু যে অহরহ মানুষের চুলের ঝুঁটি পাকড়ে ধরে আছে সেটা স্মরণ করে কটা লোক? কিংবা বলা যায়, গুল বাহাদুর ভাবলেন, গায়ে শু মেখে বসে থাকলেই কি আর যম ছেড়ে দেবে?