জীবনের দীর্ঘতম অংশ চিকনকালা গ্রামে কাটিয়ে গুল বাহাদুর বীরভূমি ডোমি ভাষা শিখেছিলেন কিন্তু শেষদিন পর্যন্ত তার হিন্দুস্থানি হ্রস্ব-দীর্ঘ স্বর থেকে তিনি নিষ্কৃতি পাননি। তার দিন শোনাতো দন, কিতাব কতব, হিন্দু হন্দু, বিলকুল বলকল –বাগদিদের কানে।
অঙ্গরখার দাম (চাপকানের নিম্নাঞ্চল) ওঠাতে গিয়ে গোঁফে তা দিতে যাবার মতো তার খেয়াল হল, তিনি ধুতি-উত্তরীয়ধারী।
সেদিন সন্ধ্যায় তিনি আঙ্গিনায় পলাশতলায় চ্যাটাইয়ের উপর শুয়ে। আসমানে দেখেছেন মিজান (দাড়িপাল্লা, মধ্যিখানে তিনটে তারা কাটার মতো, দু দিকে ভার আমাদের কালপুরুষ)। তখন খেয়াল গেল, অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা, রোহিণী, সবই আগের থেকে উদয় হয়েছেন। মনে মনে বিড়বিড় করতে লাগলেন, মিজান, অকরব, কওস, সঙ্কুলা, জদি, দলে, হুৎ–!
দিল্লিতেও তিনি ছাতের উপরই থাকতেন বেশিরভাগ।
ঠাকুরদা শখ করে বানিয়েছিলেন যমুনার উপর একখানি চক-মেলানো বাড়ি। বাড়িখানি ছোট কিন্তু উচ্চতায় সে বাড়ি ও-পাড়ার সব বাড়ি ছাড়িয়ে উঠেছিল। আজকের দিনের ভাষায় একেই বলে বাড়ি হাঁকানো। বৃদ্ধ বয়সেও ঠাকুরদার চোখের জ্যোতি ক্ষীণ হয়ে যায়নি। নাতিকে কোলে বসিয়ে বলতেন, ওই দেখো, ওই দেখো, ওই দূরে, যমুনার ওপারে শাহদারা, গজিয়াবাদ, নাতি দেখত ওপারে শুকনো মাঠ খাঁ খাঁ করছে, আর তার মাঝে মাঝে ঝোঁপ-ঝাড়। কুত্ত্বউদ্দীন আইবেক থেকে আরম্ভ করে বাবুর, হুমায়ুন, রফীউদ্দৌলা মুহম্মদ শাহ– সবাই গিয়েছেন ওপারে হরিণ শিকার করতে। বুড়ো বাদশাহের হরিণ-শিকারের বয়স গেছে–তিনি এখন লাল কেল্লার ছাতের উপর থেকে ওড়ান ঘুড়ি। শাহজাদারা এখনও যান, তিনিও বহুবার গিয়েছেন।
বাহাদুর শাহ ভালো কবিতা লিখতে পারতেন। অবশ্য সে যুগের শ্রেষ্ঠ কবি জওক ও গালিবের তুলনায় তাঁর রচনা নিম্নাঙ্গের। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার কবিতায় এমন একটা সরল সহৃদয়তার গুঞ্জন থাকত যেটা কারও কান এড়িয়ে যেত না। এবং তার মধ্যে ছিল এমন একটা সদ্গুণ যেটা জওক কিংবা গালিব কারওরই ছিল না। জওক-গালিবের মধ্যে হামেশাই হত লড়াই। তৎসত্ত্বেও একে অন্যের প্রশংসা করতেও তারা কুণ্ঠিত হতেন না। শোনা যায় শ্রেষ্ঠতর কবি গালিব নাকি এক মুশায়েরাতে (কবি সম্মেলনে) জওকের কোনও কবিতার দু ছত্র শুনে তাঁকে সর্বসমক্ষে বার বার কুর্নিশ করতে করতে বলেছিলেন, আপনার এ দুটি ছত্র আমাকে বখশিশ দিন; আমি তার বদলে আমার সমস্ত কাব্য আপনাকে দিয়ে দেব। কিন্তু এদের বাক্যের চিকন কাজ বাদশাহ বাহাদুর শাহ যতখানি অনুভব করতে পারতেন, এরা একে অন্যের ততখানি পারতেন না। বাহাদুর শাহ ছিলেন সে যুগের– সে যুগের কেন, তাবৎ উর্দু যুগের সবসে বঢ়িয়া সমজদার।
গদর আমলের ইংরেজরা তাঁর কাব্যপ্রেমকে নিয়ে কত যে ব্যঙ্গ-পি ঠাট্টামস্করা করেছে তার অন্ত নেই। তাদের রাজদরবারেও পোইট লরিয়েট নামক একটি প্রাণী পোষা হয়। তাদের কুরান-পুরাণে আছে, গ্রেট ন্যাশনাল অকেশনে তিনি টপ্পা-ফপ্লাভি লিখতে পারেন, ওইসব অকেশনে দর্জি-ওস্তাদরা যে রকম রাজা-রানির পাতলুন-বুসাৰ্জ বানায়, কিংবা বলতে পারেন হটেন্টটদের রাজদরবারে পালপরবে যে রকম পোষা বাদর দু চক্কর নাচভি লেচে ল্যায়।
আসলে তাদের রাজারা দেবসেনাপতি, অসুরমর্দন, রুদ্ৰাত্মজ কার্তিকের বংশ-অবতংস। তাঁরা তীব্রতম চিৎকারে আকাশ বাতাস সসাগরা পৃথিবী (যে রাজত্বে সূর্য অস্তমিত হন না) প্রকম্পিত করে শিকার করেন খ্যাকশ্যালী। দি লর্ড বি থ্যান্ট– তাঁদের কাণ্ডজ্ঞান আছে।
তাবৎ ইংরেজই অগা, ও-কথা বলা বোধহয় অন্যায় হবে। কারণ পরবর্তী যুগের এক ইংরেজই দুঃখ করে বলেছেন, যেসব গাড়লরা গদরের সময় ভারতবর্ষ শাসন করত তাদের সামনে শেলি কিংবা কিটস এলে যে সম্মান বা অসম্মান পেতেন কবি বাহাদুর শাহ সেই গবেটদের কাছে সেই মূল্যই পেয়েছেন। এবং সেসব সম্বন্ধীরা এই মামুলি খবরটুকুও জানত না যে, তাদের দুই নম্বরের মাথার মণি ওয়ারেন হেস্টিংসও কবিতা লিখতেন, এবং ইংরেজ লেখক জোর গলায় বলেছেন, সে কবিতা বাহাদুর শাহের কাব্যের তুলনায় অতিশয় নিকৃষ্ট এবং ওঁচা।
গুল বাহাদুরের মনে পড়ল, গদর শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক মাস আগে নওরোজের রাতে যে মুশায়েরা বসেছিল তাতে সভাপতির আসন নিয়েছিলেন বাদশা সালাম বাহাদুর শাহ। সেই শেষ মুশায়েরা।
থাক্ থাক, কী হবে ভেবে?
ভাববই না কেন? আমার অতীতকে আমি আঁকড়ে ধরে থাকব না, আর ভবিষ্যৎকেও আমি আলিঙ্গন করতে ভয় পাব না।
রাজত্ব বধূরে যেই করে আলিঙ্গন
তীক্ষ্ণধার অসি পরে সে দেয় চুম্বন।
কী ভয় তাতে? আমার রথ চলবে এগিয়ে, রথের পতাকা পিছন দিকে মুখ ফিরিয়ে কাপবে অতীতের স্মরণে। তাই বলে কি আমার এগিয়ে চলা বন্ধ হবে?
বরঞ্চ বলব, নবজন্ম লাভ, অবশ্য আমি জাতিস্মর।
এই তো সেই আকাশ। এ আকাশ আর দিল্লির আকাশে তো কণামাত্র তফাৎ নেই। এ আকাশ তো আমার। হেসে মনে পড়ল ফিরদৌসির একটি দোঁহা। সম্পত্তির ভাগাভাগির সময় একজন অন্য বখরাদারকে বলল
আজ ফর্শ-ই-খানা তা ব লব-ই বাম্ আজ আন্-ই-মন্
আজ বাম্-ই-খানা তা ব সুরইয়া আল্ আন্-ই-তো।
মেঝের থেকে ছাতটুকু তাই নিলেম কুল্লে আমি
ছাতের থেকে আকাশ তোমার সেইটে তো ভাই দামি।