তাবৎ তেপান্তরের ওপারেও লোকালয় থাকে। সাহারার মতো মরুভূমি পেরিয়েও বেদুইন যখন ওপারে ডেরা পাততে পারে তখন এই তেপান্তরের পরেও নিশ্চয়ই বসতি আছে। কিন্তু সেখানে থাকে কি সর্বহারা লক্ষ্মীছাড়ারাই! যাদের প্রাণ ছাড়া আর কিছু দেবার নেই শুধু তারাই তো পারে এ রকম ডাক-ডাকিনীর মাঠে পা ফেলতে!
ভালোই। ভালোই হল। এই তেপান্তরই তাঁর ও ইংরেজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইবে অচল অভেদ্য দুর্গবৎ। সেই হতভাগাদের সঙ্গেও তাঁর বনবে ভালো, hail fellow wellmet, এক বাথানের গরু।
গুল বাহাদুর বললেন, শুকর, আলহামদুলিল্লা।
মাঠে ফেললেন পা।
.
০২.
সংসারের অধিকাংশ লোক না গোলাম না বাদশাহ। বাদবাকির কেউ সরদার কেউ চেলা। ওদের কেউ কেউ জন্মায় হুকুম দেবার জন্য, আর কেউ কেউ সে হুকুম তামিল করার জন্য। ভাগ্যচক্রে অবশ্য কখনও হুকুম-দেনেওলাও জন্মায় হুকুম-লেনেওলা হয়ে। তখনও কিন্তু তার গোত্র বুঝতে অসুবিধে হয় না। সে তখন বাদশাহ হয়ে জন্মালে উজিরের হুকুমমতো ওঠ-বস করে, উজির হলে সর্বক্ষণ তাকিয়ে থাকে কোটালের দিকে তার আদেশ কী। আবার উল্টোটাও হয় ঠিক ওই রকমই। সে পাইক হয়ে জন্ম নিয়েও ফৌজদারকে হামেহাল বাৎলে দেয় তার কর্তব্য কোন্ পথে।
দুঁদে জমিদারের জেল হলে সে তিন দিনের মধ্যেই চোর-ডাকাত নিয়ে কয়েদিখানায় দল খাড়া করে, সপ্তাহের মধ্যেই জেল সুপারিনৃটেডেন্ট তার কথায় হাঁচে, তার হুকুমে কাশে। মওকা পাওয়া মাত্রই উপরওলাকে জানায়, অমুক কয়েদির কন্ডাক্ট ভেরি ভেরি গুড; অ্যামনেস্টির সময় একে অনায়াসে খালাস দেওয়া যেতে পারে। জমিদার বেরিয়ে গেলেই সে তখন খালাসি পায়।
গুল বাহাদুরের জন্ম হয়েছিল হুকুম দেবার জন্য। নামাবলী গায়ে দিয়েই আসুন আর রাইডিং বুট পরেই আসুন, ডোমের দল তাকে চট করে চিনে ফেলল। পিঠে থাবড়া খেয়েই ঘোড়া চিনতে পারে ভালো সোওয়ার কে?
তেপান্তরের মাঠের প্রত্যন্ত প্রদেশে, গ্রাম যেখানে শুরু, সেখানে এক পোড়ো বাড়িতে আশ্রয় নিলেন গুল বাহাদুর। চালের ভিতর দিয়ে আসমান দেখা যায়। রাতে আকাশের তারা তার দিকে মিটমিটিয়ে তাকায়, দিনে কাঠবিড়ালি। ঘরের কোণের গর্ত থেকে একটা সাপ মাথা তুলে তার দিকে জুল জুল করে তাকিয়েছিল। গুল বাহাদুর বলেছিলেন, তশরিফ নিকালিয়ে, আত্মপ্রকাশ করতে আজ্ঞা হোক। গদরের সময় তিনি নিমকহারামি দেখেছেন প্রচুর। সাপ তো তাঁর নুননিমক খায়নি যে তাকে কামড়াতে যাবে।
ডোমরা তার ঘর মেরামত না করে দিলে গুল বাহাদুর কদাচ এই গর্ত বন্ধ করতেন না।
চিকনকালা গ্রামে আসার পরদিন গুল বাহাদুর গিয়েছিলেন গ্রামের ভিতর একটা রোদ মারতে দিল্লির চাঁদনীচৌকে যাওয়ার মতো। এক জায়গায় দেখেন ভিড়। তিনি ভিতরে যাওয়ার উপক্রম করতেই ডোমরা তড়িঘড়ি পথ করে দিল। একটা ছেলে গাছ থেকে পড়ে পা মচকিয়েছে। তার মা হাউমাউ করে আসমান ফাটিয়ে টুকরো টুকরো করে জমিনের উপর ফেলছে।
গুল বাহাদুর বরিশাল গান ফাটিয়ে বললেন, চোপ!
মার কথা দূরে থাক সুবে ডোমিস্থান সে হুঙ্কারে কে কার ঘাড়ে পড়বে ঠিক নেই। এই যে খুদাতালার এত বড় দুনিয়া, তার আধেকখানাই তো ওই তেপান্তরি মাঠ, সেখানেও যেন তারা পালাবার পথ পাচ্ছে না। হুঙ্কার তারা বিস্তর শুনেছে, নামাবলীও বিস্তর দেখেছে, কিন্তু নামাবলীর তলা থেকে এ রকম অট্টরব! নিরীহ গোপীযন্ত্র থেকে গদরের কামান ফাটে নাকি!
চোপ বলে গুল বাহাদুরের হাত গোঁফের দিকে উঠেছিল। তখন মনে পড়ল তিনি গোঁফ কামিয়ে ফেলেছেন।
গুল বাহাদুর ছেলেটার পায়ে হাত বুলোতে লাগলেন।
কে এক ওলন্দাজ না অন্য জাতের অর্টিন্ট বলেছেন, যারা এচিং কিংবা অন্য কোনও প্রিন্টিঙের কাজ করে তাদের হাতের তেলো হবে রাজকুমারীর মতো কোমল, পেশি হবে কামারের মতো কট্টর। প্লেট থেকে ফালতো রঙ তোলার সময় রাজকুমারীর মখমলি তেলো দিয়ে আলতো আলতো করে তুলবে রঙ, আর প্রিন্ট করার সময় দেবে কামারে পেশির জোরে মোক্ষম দাবাওট!
গুল বাহাদুর তাঁর মোলায়েম তেলো দিয়ে ছোঁড়াটার গোড়ালি বুলোতে বুলোতে হঠাৎ পা-টা পাকড়ে ধরে কামারের পেশি দিয়ে দিলেন হ্যাঁচকা ঝাঁকুনি। ছেলেটা আঁৎকে উঠে রব ছাড়ল, কক্!
তিনি বললেন, ঠিক্ হৈ, বেটা, আরাম হো-জায়েগা। ফির বন্দর জৈসা কুদেগা।
এতক্ষণ ছেলেটার পা-টা উরু থেকে কাঠের মতো শক্ত হয়ে উপর-নিচ করছিল না, এবারে গুল বাহাদুর সেটাকে কজা-ওলা বাক্সের ডালার মতো উপর-নিচু করলেন। তার পর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তিন দন সোলাকে রাখবে।
রাখবে শব্দটা বর্ধমান অঞ্চলে তাঁর বাঙলা শেখার প্রচেষ্টার ফল। ডোমরা বুঝল। সোলাকেও বুঝল– শুইয়ে, তিন তো সোজা তিন কিন্তু দ-টা কী চি?
গুল বাহাদুরকে গদরের সময় জাত-বেজাতের সেপাইয়ের সঙ্গে কথাবার্তা কইতে হয়েছিল। তিনি তাই শিখে গিয়েছিলেন, বিদেশি কোনও শব্দ না বুঝতে পারলে তাকে শোনাতে হয় এই শব্দের সম্ভব-অসম্ভব যাবতীয় প্রতিশব্দ। যেমন ইনসান বললে যদি না বোঝে তবে বলতে হবে আদমি, তার পর মানস লোগ বেটা বাচ্চা ইত্যাদি। একটা না একটা বুঝে যাবেই।
গুল বাহাদুর বললেন, তিন্ দন, তিন্ শাম, তিন্ রোজ।
এক ডোম চিৎকার করে বলল, বুঝেছি গো, বুঝেছি। তিন দিন, তে রাত্তির।