গদর আরম্ভ হয়েছিল এলোপাতাড়ি কিন্তু পরে দিল্লিতে লালকেল্লার তসবিখানাতে যে মন্ত্রণাসভা বসেছিল সেখানে স্থির হয়, গুল বাহাদুরকে পাঠানো হবে বাঙলা দেশে। সেখানকার বাগদিরা এককালে ছিল বাদশাহের সেপাহি। ইংরেজ তাদের বিশ্বাস করত না বলে ইংরেজ ফৌজে তাদের স্থান হয়নি। শুধু তাই নয়, ইংরেজ তাদের অন্য কোনওরকম কাজ তো দিলই না, উল্টো হুকুম করল তারা যদি আপন জমি নিজে চাষ না করে তবে সে জমি কোম্পানি বাজেয়াপ্ত করবে। বাগদিদের আত্মসম্মানে লাগে জোর ঘা। যে তলোয়ার দিয়ে সে দুশমনের কলিজা দু টুকরো করে দেয়, তাই দিয়ে সে খুঁড়বে মাটি! তার চেয়ে সে তলোয়ার আপন গলায় বসিয়ে দিলেই হয়, কিংবা মওকা পেলে দুশমনের গলায়–
গুল বাহাদুরকে বাঙলা দেশে পাঠানো হয়, এই বাগদি ডোমদের জমায়েত করে এক ঝাণ্ডার নিচে খাড়া করবার জন্য।
আফসোস্, আফসোস্! হাজার আফসোস্! একটু, আর একটু আগে আরম্ভ করলেই তো– গুল বাহাদুর নিজের মনেই বললেন, থাক্ সে আফসোস্। এখন বর্তমানের চিন্তা করা যাক্।
বাগদিদের সাহায্যেই তিনি জোগাড় করলেন ধুতি নামাবলী। তিনি এখন বৃন্দাবনের বৈষ্ণব। বাঙলা জানেন না, জানেন হিন্দি। আসলে সেটাও ঠিক জানেন না। তিনি ছেলেবেলা থেকে বাড়িতে বলেছেন দিল্লির উর্দু, মকতবে শিখেছেন ফারসি, আর বলতে পারতেন দিল্লির আশপাশের হিন্দির অপভ্রংশ হরিয়ান। কিন্তু তাই নিয়ে অত্যধিক শিরঃপীড়ায় কাতর হবার কোনও প্রয়োজন নেই। এই রাঢ় দেশে কে ফারাক করতে যাবে, দিল্লির হরিয়ানা থেকে বৃন্দাবনের ব্রজভাষা।
দাড়িগোঁফ কামাতে গিয়ে একটুখানি খটকা বেধেছিল, এক লহমার তরে! তার পর, মনে মনে কান্নার হাসি হেসে বলেছিলেন, তা কামাবো বইকি, নিশ্চয়ই কামাবো। লড়াই হেরেছি, তলওয়ার ফেলে দিয়েছি, পালাচ্ছি মেয়েছেলের মতো– এখন তো আমাকে মেয়েমানুষ সাজেই মানায় ভালো।
শেষটায় হঠাৎ অট্টকণ্ঠে চেঁচিয়ে বলেছিলেন, ইয়াল্লা, আমি কী গুনা করেছিলাম যে এ সাজা দিলে?
ক্রুশবিদ্ধ যিশুখ্রিস্টও মৃত্যুর পূর্বে চিৎকার করে বলেছিলেন, হে প্রভু, তুমি আমাকে বর্জন করলে কেন?
বাগদিরা তাঁর হাহাকার হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিল। তেঁতুলতলায় শুইয়ে দিয়ে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে সান্ত্বনা দেবার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল।
দুপুররাতে চাঁদের আলো মুখে পড়াতে ঘুম ভাঙল। দেখলেন, ঘুমিয়েও ঘুমোননি। ঘুমন্ত মগজও তাঁর জাগ্রত অবস্থার শেষ হাহাকারের খেই ধরে মাথা চাপড়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে তার সান্ত্বনাও খুঁজে পেয়েছে। কী সান্ত্বনা? গুল বাহাদুর, এ কি তোমার ফাটা কিস্মাৎ, না তোমার বাপ-ঠাকুর্দার ভাঙা কপাল? মনে নেই, দেওয়ান-ই খাসের যেখানে লেখা–
অগর ফিরদৌস বররূয়ে জমিন অস্ত
ওয়া হমিন অস্ত হমিন অস্ত হমিন অস্ত।
ভূস্বর্গ যেখানে খুশি বলো, মোর মন জানে।
এখানে, এখানে দেখো তারে, এই এখানে।
তারই সামনে নাদির কর্তৃক হৃতসর্বস্ব, লাঞ্ছিত, পদদলিত বাদশা মুহম্মদ শাহ কপালে করাঘাত করে কেঁদে উঠেছিলেন,
শামাতে আমাল-ই-মা সুরুতে নাদির গিরিফৎ।
কপাল ভেঙেছে, আমারই কর্মফল
নাদির মূর্তিতে দেখা দিল।
তখন কি তোমার পিতামহ তার নুন-নিমকের মালিক শাহিনশার সে দুর্দৈব দাঁড়িয়ে দেখেননি? বাদশার খাস আমির সর-বুলন্দখান, হাজার দু-আম্পা মনসবের মালিক। তোমার পিতামহ তখন কী করতে পেরেছিলেন? আলবত্তা, হ্যাঁ, হাবেলিতে ফিরে এলে তাঁর জননী তাঁকে শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিলেন, দাড়িগোঁফ কামিয়ে ফেল, আর তলওয়ারখানা শাহিনশাকে ফেরত দিয়ে এসো।
তার পর দীন-দুনিয়ার মালিক আকবর-ই-সানী (দ্বিতীয় আকবর) যখন ইনিয়ে-বিনিয়ে বিলাতের বাদশার কাছে দরখাস্ত পেশ করলেন তাঁর তনখাহ্ বাড়িয়ে দেবার জন্য মেথর যে-রকম জমাদারের কাছে তখা বাড়াবার জন্য আরজি পেশ করে–তখন সে বেইজ্জতি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন তোমার বাপ। শোনোনি যে বাঙালিন বাবু* [*রাজা রামমোহন রায়] সে দরখাস্ত নিয়ে বিলায়েত গিয়েছিলেন তিনি পর্যন্ত নাকি তার জবান, ঢঙ আর শৈলী দেখে শরম বোধ করেছিলেন।
তাই বলি, তুমি এত বুক চাপড়াচ্ছ কেন?
তাদের তুলনায় তোমার মনসবই (পদমর্যাদা) বা কী, বাদশাহ তোমাকে চেনেনই-বা কতটুকু? নানাসায়েব, লছমীবাঈ এঁরা সব গায়েব হয়েছেন, আর তুমি তাঁতি এখন ফারসি পড়বে। হয়েছে, হয়েছে, বেহ হয়েছে। গিদড়ের গর্দানে লোম গজালেই সে শের-বাবর হয় না!
আল্লাহ জানেন, এসব তত্ত্বকথা চিন্তা করে গুল বাহাদুর খান কতখানি সান্ত্বনা পেয়েছিলেন। পরবর্তী জীবনেও তার আচার-ব্যবহার থেকে অনুমান করা যেত না, তিনি তাঁর কপালের গর্দিশ কতখানি বরদাস্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বড় রাস্তা থেকে নেমে ডান দিকে মোড় নিয়ে, ফের বাঁ দিকে পুরো পাক খেয়ে তিনি পেরোলেন অজয় নদ। উঁচু পাড়ি বেয়ে উঠেই দেখলেন, সমুখে দিকদিগন্ত প্রসারিত খরদাহে দগ্ধ সবিতার অগ্নি-দৃষ্টিতে অভিশপ্ত চিতানল– ভস্মীভূত প্রান্তর।
অবাঙালির তো কথাই নেই, এ দেশের আপন সন্তানও এই তেপান্তরি মাঠের সামনে ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে। এর নাম বাঙলা রেখেছে কোন কাষ্ঠরসিক।
কিন্তু গুল বাহাদুর শিউরে ওঠেননি; তাঁর জীবন কেটেছে দিল্লি-আগ্রার চারদিকের খাকছার দেশ দেখে দেখে। সেরেফ উনিশ-বিশের ফারাক।