তাই যখন কম্যুনিজম গ্রহণ করার পর চীন বলল, পৃথিবীতে হাজার রকমের ফুল ফুটুক–তখন আমরা মনে করেছিলুম, অপরের প্রতি সহিষ্ণুতার ঐতিহ্য স্মরণ করেই চীন একথা বলেছে, কিয়ৎকালের জন্যে রুশ আপন ঐতিহ্য অস্বীকার করে যে মূর্খতা দেখিয়েছিল, তার থেকে সে শিক্ষালাভ করেছে, এবং এখন লাওৎসে কনফুস এবং বৌদ্ধ-ঐতিহ্যের সঙ্গে কম্যুনিজম মিশে গিয়ে এক অভিনব সমাজব্যবস্থা, ধন-বণ্টন পদ্ধতি দেখা দেবে। তার সঙ্গে আমাদের মনের মিল হওয়ার সম্ভাবনা কম, কিন্তু সে এক্সপেরিমেন্ট যে বিশ্বজনের কৌতূহল আকর্ষণ করবে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
কিন্তু এই হাজার রকমের ফুল ফুটুক যে নিতান্ত মুখের কথা, সেটা তিন দিনেই ধরা পড়ে গেল। আমরাই যে শুধু ধরতে পেরেছি তাই নয়, চীনা আক্রমণের পরের দিনই এক সুইস কাগজে একটি ব্যঙ্গচিত্র বেরোয়। ছবিতে জনমানবহীন বিরাট বিস্তীর্ণ এক বরফে ঢাকা মাঠে মাত্র একটি ফুল ফুটেছে। তার নিচে লেখা ভারতবর্ষ। তারই পাশে দাঁড়িয়ে চু এন লাই। পাশে যে সখা দাঁড়িয়ে, তাকে বলছেন, এ ফুলটি আমি তুলে নেব।
অত সহজ নয়।
একদিন জাপান তার উত্তমর্ণ চীনকে আক্রমণ করেছিল। আজ চীন তার উত্তমর্ণ ভারতকে আক্রমণ করেছে।
চীন দেশ কখনও কোনও ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেনি। লাওৎসেকনফুৎস যে জীবনদর্শন প্রচার করেছেন, তাতে আছে কী করে সাধু, সৎ জীবনযাপন করা যায়, কিন্তু ইহলোক-পরলোকে মানুষের চরম কাম্য কি এই পঞ্চভূত পঞ্চেন্দ্রিয়াশ্রিত মরদেহ চৈতন্যের ঊর্ধ্বলোকে কী আছে,
কী করে সেখানে তথাগত হওয়া যায়, এ সম্বন্ধে তাঁরা কোনও চিন্তা করেননি।
অথচ বুদ্ধের বাণী যখন মৃদু কাকলি রবে চীন দেশে পৌঁছল, তখন থেকেই বহু চীনা এদেশে এসেছেন। ইৎসিং, ফা-হিয়েন, য়ুয়ান চাঙ, আরও সামান্য কয়েকটি নাম আমরা সকলেই জানি, কিন্তু এঁরা ছাড়া এসেছেন আরও বহু বহু চীনা শ্ৰমণ। বিশেষ করে য়ুয়ান চাঙের ভ্রমণ-কাহিনী পড়লে আজও মনে হয় যেন পরশু দিনের লেখা! বৌদ্ধ শ্রমণ যেমন যেমন ভারতের নিকটবর্তী হতে লাগলেন, তখন তাঁর হৃদয়মনে কী উত্তেজনা, ভারতবর্ষে পৌঁছে তার প্রতিটি তীর্থ দর্শন করে তিনি কী রকম রোমাঞ্চ কলেবর। কামরূপের রাজা যখন তাঁকে পাহাড়ের উপরে নিয়ে গিয়ে পূর্বদিকে আঙুল দিয়ে দেখালেন, ওই আপনার মাতৃভূমি, পঁচিশ মাইল হয় কি না হয়, তখন বৃদ্ধ শ্ৰমণ চিন্তা করেছিলেন, কত না বিপদের সম্মুখীন হয়ে, কত না ঘোরালো পথে তাকে তথাগতের জন্মভূমিতে আসতে হয়েছে।
ভারতের রাজা হর্ষবর্ধন তাঁকে সসম্মানে সখারূপে গ্রহণ করেছিলেন।
আজ যদি চীন সে সখ্য ভুলতে চায়, ভুলুক।
ভারতও তার রুদ্র রূপ দেখাতে জানে।
জয় হিন্দ।
এক পুরুষ
০১.
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিক।
বিদ্রোহ শেষ হয়ে গিয়েছে। আজকের দিনের যুদ্ধে যাকে ইংরেজিতে বলে মপিং অপ, যেন স্পঞ্জ দিয়ে মেঝের এখান-ওখান থেকে জল শুষে নেওয়া– তাই চলেছে। আজ এখানে ধরা পড়ল জন দশেক সেপাই, কাল ওখানে জন বিশেক। কাছাকাছি কামান থাকলে পত্র-পাঠ বিদ্রোহীগুলোকে তাদের মুখের সঙ্গে বেঁধে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিংবা ফাঁসি। গাছে গাছে লাশ ঝুলছে, যেন বাবুইপাখির বাসা।
পাঁচশো দু-আসপা (দ্বি-অশ্বা) অর্থাৎ এক হাজার ঘোড়া রাখার অধিকারী বা মনসবদার গুল বাহাদুর খান বর্ধমানের কাছে এসে মনস্থির করলেন, এখন আর সোজা শাহি সরকারি রাস্তায় চলা নিরাপদ নয়। তিনি অবশ্য আপদ কাটাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেননি। তিনি ততক্ষণে বুঝে গিয়েছেন গদর (মিউটিনি) শেষ হয়ে গিয়েছে তারা হেরে গিয়েছেন। তিনি কেন, তার সেপাইরা আশা ছেড়ে দিয়েছিল, তিনি নিজে নিরাশ হওয়ার বহু পূর্বেই। সলা-পরামর্শ করার জন্য তিন রাত্রি পূর্বে যে জলসা বসেছিল তাতে তারা অনুমতি চায়, অস্ত্রশস্ত্র ত্যাগ করে গরিবশুরবো, ফকির-ফুকরো সেজে যূথভঙ্গ হয়ে যে যার আপন শহরের দিকে রওনা হবে। এলাহাবাদ, কনৌজ, ফররুখাবাদ, লক্ষ্ণৌ, মলিহাবাদ, মিরাট– যার যেখানে ঘর।
গুল বাহাদুর খান বলেছিলেন, সেটা আত্মহত্যার শামিল। পথে ধরা পড়বে, আর না পড়লেও বাড়িতে পৌঁছানোর পর নিশ্চয়ই। তাঁর মনের কোণে, হয়তো তার অজান্তে, অবশ্য গোপন আশা ছিল বেঁচে থাকবার। সুদ্ধমাত্র বেঁচে থাকবার জন্য নয়, তার বয়স বেশি হয়নি, হয়তো আবার নতুন গদর করার সুযোগ তিনি এ জীবনে পাবেন। কিন্তু যখন দেখলেন, সেপাইদের শিরদাঁড়া ভেঙে গিয়েছে আজকের দিনের ভাষায় যাকে বলে মরাল টুটে গিয়েছে তখন তিনি তাদের প্রস্তাবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। শেষরাত্রে আধোঘুমে অনুভব করলেন, সেপাইরা একে একে তার পায়ে চুমো খেয়ে বিদায় নিল তিনি আগের দিন মাগরিবের নামাজের পর অনুরোধ করেছিলেন, বিদায় নেওয়া-নেওয়ির থেকে তাঁকে যেন রেহাই দেওয়া হয়।
শুনলেন, সেপাইরা চাপা গলায় একে অন্যকে শুধোচ্ছে, কাজটা কি ঠিক হল, বাড়ি পৌঁছানোর আশা কতখানি, সেখানে পৌঁছেই-বা কিস্মতে আছে কী, এ রকম সর তাজ (মাথার মুকুট) সর্দার পাব কোথায়?
গুল বাহাদুর খানের কিন্তু কোনও চিত্তবৈকল্য হয়নি। তাঁর কাছে এরা সব নিমিত্ত মাত্র। তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য, তাঁর প্রাণের একমাত্র গভীর ক্ষুধা– জাহান্নামি শয়তান ইংরেজকে এ দেশ থেকে তাড়িয়ে শাহানশাহ বাদশা সরকার-ই-আলা বাহাদুর শাহের প্রাচীন মুঘলবংশগত শাশৌকৎ তখৃৎদৌলৎ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। আজ যদি এই সেপাইদের দিল দেউলে হয়ে গিয়ে থাকে তো গেছে। এরা তো আর কিছু কাপুরুষ নয়। কিন্তু এরা কাকের মতো একবারই বাচ্চা দিতে জানে। একবার তারা চেষ্টা দিয়েছিল। সফল হতে পারেনি। দু-বার চেষ্টা দেওয়া তো এদের কর্ম নয়। তাই নিয়ে আফসোস্ করে কী ফায়দা। খুদা যদি বাঁচিয়ে রাখেন, আল্লার যদি মেহেরবানি হয় তবে আবার নয়া সেপাই জুটবে, নয়া গদর দামামা পিটিয়ে জেগে উঠবে– তার আশা তিনিই করতে পারেন, এরা করবে কী করে?