.
সেই থেকে ভাবছি কী করি?
তা হলে আবার একটা মাস ভাবতে দিন।
কিন্তু তাতেই-বা কী? দশ ঘণ্টা বাতি জ্বালিয়ে রাখার পর সেটা নিভিয়ে দিলে ঘরে যে অন্ধকার, এক মিনিট জ্বালিয়ে রাখার পর নিভিয়ে দিলেও সেই অন্ধকার।
এক মাস চিন্তা করলেই-বা কী, আর এক মিনিট চিন্তা করলেই-বা কী?
এক ঝাণ্ডা
বহু শক্তিকামী জন, দেশ যখন স্বাধীন, তখন রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন না। কারণ সে সময় রাজনীতির ক্ষেত্রে নানা মুনির নানা মত, নানা পাণ্ডার নানা দল। এসব ঝামেলার ভিতর ঢুকতে হলে প্রথমত দরকার গণ্ডারের মতো চামড়া, দ্বিতীয়ত বিপক্ষকে নির্মমভাবে হানবার মতো ক্ষমতা, তৃতীয়ত দেশের নেতা হওয়ার মতো এলেম এবং তাগদ আমার আছে এই দম্ভ। যাদের এসব নেই, তারা হয়তো আপন গণ্ডির লোককে তাদের মতামত জানান, বড়জোর কাগজে লিখে সেগুলো প্রকাশ করেন, কিন্তু দৈনন্দিন রাজনীতি যতদূর সম্ভব এড়িয়ে চলেন।
কিন্তু এমন সময়ও আসে, যখন তারা এক ঝাণ্ডার নিচে এসে দাঁড়ান। সে দিন এসেছে।
পরাধীন জাতের একমাত্র রাজনীতি স্বাধীনতা-সগ্রামে যোগদান করা। স্বাধীন জাতি আক্রান্ত হলে তার একমাত্র রাজনীতি আক্রমণকারীকে দেশ থেকে বিতাড়িত করা। সে বিতাড়িত না হওয়া পর্যন্ত সে দেশের অন্য কোনও রাজনীতি থাকতে পারে না। বিধানসভা, রাজ্যসভা, ট্রেড ইউনিয়ন, এমনকি পাড়ার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানে তখন বিরুদ্ধ পক্ষ বলে কিছু থাকতে পারে না। দেশের লোক যাকে নেতা বলে মেনে নিয়েছে তাকে তখন প্রশ্নজালে উদ্ব্যস্ত না করা, কিংবা গুরুগম্ভীর মাতব্বরি-ভর্তি উপদেশ দিয়ে তার একাগ্র মনকে অযথা চঞ্চল না করা। যদি সে নেতার প্রতি দেশের আস্থা চলে যায়, তবে তাকে তাড়াবার জন্য গোপনে দল পাকাতে হয় না। দেশের সর্বসাধারণ তখন চিৎকার করে ওঠে ও সে সময় তাঁকে সরে দাঁড়াতে হয়। ১৯৪০-এ চেম্বারলেন যেরকম মানে মানে সরে দাঁড়ালেন।
এটা শুধু সম্ভব, যেখানে গণতন্ত্র আছে। ডিটেটরদের স্বৈরতন্ত্রে এ ব্যবস্থা নেই। সেখানে গেস্তাপো, ওপণ্ড বহস্তে জনসাধারণের কণ্ঠ রুদ্ধ করে রাখে– যতদিন পারে। তার পর একদিন মুসলিনিকে মরতে হয় গুলি খেয়ে এবং মাথা নিচের দিকে করে ঝুলতে হয় ল্যাম্পপোস্ট থেকে, হিটলারকে মরতে হয় আত্মহত্যা করে।
রবীন্দ্রনাথ একস্থলে বলেছেন, আমি যে আমার ভগবানে বিশ্বাস করি তার কারণ তাঁকে অবিশ্বাস করার স্বাধীনতা তিনি আমাকে দিয়েছেন–ঠিক ঠিক কথাগুলো আমার মনে নেই বলৈ পাঠক অপরাধ নেবেন না।
আমি যে পণ্ডিতজির নেতৃত্বে বিশ্বাস করি, তার কারণ তাঁকে অবিশ্বাস করার অধিকার তিনি আমাকে দিয়েছেন। তিনি গণতন্ত্র, ব্যক্তি-স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন বলেই সে স্বাধীনতা আমাকে দিয়েছেন। তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন বলেই আপনাকে, আমাকে, আর পাঁচজনকে বিশ্বাস করেছেন আমরা যে-রকম তাকে বিশ্বাস করেছি। আমাদের একান্ত প্রার্থনা, আমরা যেন তার সে বিশ্বাস-ভঙ্গ না করি। শত্রু দেশ থেকে বিতাড়িত না হওয়া পর্যন্ত তাঁরই ভাষায় বলি, আরাম হারাম হ্যায়!
আমার দুঃখের অবধি নেই, শেষ পর্যন্ত চীনদেশ আমাদের আক্রমণ করল! প্রায় ত্রিশ বছর পূর্বে জাপান যখন চীন আক্রমণ করে, তখন ভারতবাসীমাত্রেই মর্মাহত হয়েছিল। সদয় পাঠক এস্থলে আমাকে একটি ব্যক্তিগত ঘটনার উল্লেখ করতে অনুমতি দিন। আমি তখন জর্মনিতে পড়াশুনা করি। সে সময় আমাকে ভারতীয় সংস্কৃতি সম্বন্ধে একটি বক্তৃতা দিতে হয়। প্রসঙ্গক্রমে চীন-জাপানের কথা ওঠে! আমি বলেছিলুম, এই যে অর্বাচীন জাপান সংস্কৃতি, ঐতিহ্যে তার পিতামহ চীনের বুকে বসে তার দাড়ি ছিঁড়ছে, এর চেয়ে অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস আর কী হতে পারে। পরদিন দুই বয়স্ক চীনা ভদ্রলোক আমার বাড়িতে এসে উপস্থিত– এঁরা দুজনেই আপন দেশের অধ্যাপক। জর্মনি এসেছিলেন ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে। অপেক্ষাকৃত বয়স্ক জন আমার দু হাত চেপে ধরে বললেন, জাপান শক্তিশালী জাতি। অক্ষম চীনের প্রতি দরদ দেখিয়ে তার বিরাগভাজন হতে যাবে কে? আপনি কাল সন্ধ্যায় যা বলেছেন, সে শুধু ভারতবাসীই বলতে পারে। অন্য জনের চোখ দিয়ে হঠাৎ ঝরঝর করে জল বেরিয়ে এসেছে। আমি জানতুম, চীনা ভদ্রসন্তান অত্যন্ত সংযমী হয়, সহজে আপন অনুভূতি প্রকাশ করে না, কিন্তু এখানে এ কী করুণ দৃশ্য! আর আমি পেলুম নিদারুণ লজ্জা। আমি পরাধীন দেশের জীবনমৃত অর্ধ-মনুষ্য। আমার কী হক্ক এসব বিষয় নিয়ে মতামত প্রকাশ করবার!
আজ জানতে ইচ্ছে করে, এই দুই অধ্যাপক এখনও বেঁচে আছেন কি না! থাকলে তারা কী ভাবছেন!
কিন্তু এসব কথা বলার প্রয়োজন কী? ভারতবর্ষের সঙ্গে চীনের যে কত যুগের হার্দিক সম্পর্ক, সে তো স্কুলের পড়ুয়া জানে। শুধু এ দেশ নয়, চীন দেশেও। কারণ চীন দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আছে; আজ যদি চীনের টুথব্রাশ-মুসটাশহীন নয়া হিটলাররা সে ঐতিহ্য অস্বীকার করে বর্বর অভিযানই কাম্য মনে করেন, তবে যেসব সভ্য-ভূমিতে এখনও ঐতিহ্য সংস্কৃতির মর্যাদা আছে, তারা চীনের এই অর্বাচীন আচরণ দেখে স্তম্ভিত হবে। অবশ্য এ আচরণ সম্পূর্ণ নতুন নয়। রুশ দেশ যখন প্রথম কম্যুনিজম ধর্ম গ্রহণ করে তখন সে দেশও তার গগল, পুশকিন, তুর্গেনিয়েভ, চেখফকে বুর্জুয়া, শোষক, প্রগতিপরিপন্থী বলে দেশ থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করেছিল, কিন্তু কিছুদিন যেতে-না-যেতেই দেখতে পেল, কূপমণ্ডুক হয়ে থাকতে চাইলে অন্য কথা, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়– মানবসভ্যতার যে চিরন্তন দেয়ালী উৎসব চলছে, তাতে যদি রুশ তার ঐতিহ্যের প্রদীপ নিভিয়ে বসে থাকে তবে সে অন্ধকার কোণ থেকে কেউ তাকে টেনে বের করবে না। তাই আজ আবার রুশ দেশ বিনাবিচারে তার সাহিত্যিকদের পুস্তক ছাপে– সেগুলোতে সে যুগের অনাগত কম্যুনিজমের জয়ধ্বনি থাক আর না-ই থাক।