আমি বললুম, কী জ্বালা! তোমার এই চীনা লৌকিকতা-ভদ্রতা আমাকে অতিষ্ঠ করে তুললে। কন্-ফু-ৎসর তত্ত্বচিন্তা শুনতে চায় না কোন মর্কট? জানো, ঋষি কন্-ফু-ৎস আমাদের মহাপুরুষ গৌতমবুদ্ধের সমসাময়িক? ওই সময়েই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, ইরানে জরথুস্ত্র, গ্রিসে সোক্রাতেস-প্লাতো-আরিস্ততেলেসে, প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের ভিতরে– তা থাক গে, তোমার কথা বল।
পল বললে, সরি, সরি। ক-ফু-ৎস বলেছেন, একটি পেয়ালার আসল (ইমপর্টেন্ট) জিনিস কী? তার ফাঁকা জায়গাটা, না তার পর্সেলেনের ভাগটা? ফাঁকা জায়গাটাতেই আমরা রাখি জল, শরবত, চা। কিন্তু পর্সেলেন না থাকলে ফাঁকাটা আদপেই কোনও উপকার করতে পারে না। অতএব কাজের পর্সেলেন দিয়ে অকাজের ফাঁকাটা ঘিরে রাখতে হয়। এবং শুধু তাই নয়, পর্সেলেন যত পাতলা হয়, পেয়ালার কদর ততই বেশি। অর্থাৎ কাজ করবে যতদূর সম্ভব সামান্যতম।
তার পর হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে আমাকে বাও-টাও করে অর্থাৎ চীনা পদ্ধতিতে আমায় হাঁটু আর মাথা নিচু করে অভিবাদন জানিয়ে বললে
আমি বাধা দিয়ে বললুম, ফের তোমার চীনে সৌজন্য?
বললে, সরি সরি। কিন্তু স্যর, ওই মালদ্বীপের কথা ওঠাতে আর আপনি আপনার গুরুদেবের কথা বলতে আমার কাছে কন্-ফু-ৎসর তত্ত্বচিন্তা আজ সরল হয়ে গেল। ওঁর এ বাণী বহুবার শুনেছি, অনেকবার পড়েছি কিন্তু আজ এই প্রথম
আমি বাধা দিয়ে বললুম, চোপ্।
.
০৪.
কোনও কোনও জাহাজে কী যেন এক রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় হাওয়াকে ঠাণ্ডা করে সেইটে জাহাজের সর্বত্র চালিয়ে দেওয়া হয়। মনে হয়, এই রৌদ্র-দগ্ধ, জ্বরতপ্ত বিরাট জাহাজরূপী লৌহদানবকে তার মা যেন ঠাণ্ডা হাত বুলিয়ে বুলিয়ে তার গায়ের জ্বালা জুড়িয়ে দিতে চান। কিন্তু পারেন কতখানি? বরঞ্চ রেলগাড়ি প্ল্যাটফর্মে প্লাটফর্মে ছায়াতে দু-দশ মিনিট ঠাণ্ডা হবার সুযোগ পায়, কিংবা উপত্যকার ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় তার গায়ে এসে পাহাড়ের ছায়া পড়ে, ঘন শালবনের ভিতর দিয়েও গাড়ি কখনও কখনও বনানীর স্নিগ্ধছায়া লাভ করে, এবং সুড়ঙ্গ হলে তো কথাই নেই- সেখানকার ঠাণ্ডা তো রীতিমতো বরফের বাক্সের ভিতরকারের মতো কিন্তু জাহাজের কপালে এসব কিছুই নেই। একে তো দিগ-দিগন্তব্যাপী জ্বলছে রৌদ্রের বিরাট চিতা, তার ওপর সূর্য তার প্রতাপ বাড়িয়ে দিচ্ছেন সমুদ্রের জলের উপর প্রতিফলিত হয়ে। কালো চশমা পরেও তখন সেদিকে তাকানো যায় না। রাত্রে অল্প অল্প ঠাণ্ডা হাওয়া বয় বটে, কিন্তু সে ঠাণ্ডাতে গা জুড়োবার পূর্বেই দেখা দেন পূর্বাকাশে সূয্যি-মাস্টার ফের তাঁর রোদের চাবুক হাতে নিয়ে। ভগবান তাঁকে দিয়েছেন লক্ষ লক্ষ কর, এবং সেই লক্ষ লক্ষ হাতে তিনি নিয়েছেন লক্ষ লক্ষ পাকা কঞ্চির সোনালি রঙের চাবুক। দেখামাত্রই গায়ের সবকটা লোম কাঁটা দিয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়ায়।
আমাদের জাহাজে ঠাণ্ডা বাতাস চালানোর ব্যবস্থা ছিল না অর্থাৎ সেটা অ্যারকন্ডিশনড় নয়। কাজেই কি দিনের বেলা কি রাত্রে কখনও ভালো করে ঘুমোবার সুযোগ বঙ্গোপসাগর, আরব সমুদ্র কিংবা লাল দরিয়ায় মানুষ পায় না।
দুপুররাত থেকে হয়তো ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে আরম্ভ করল। ডেকে বসে তুমি গা জুড়োলে। কিন্তু তখন যে কেবিনে ঢুকে বিছানা নেবে তার উপায় নেই। সেখানে ওই ঠাণ্ডা হাওয়া যেতে পারে না বলে অসহ্য গুমোট গরম। গড়ের মাঠে ঠাণ্ডা হয়ে ফিরে এসে গলিবাড়িতে ঘুমোবার চেষ্টা করার সঙ্গে এর খানিকটে তুলনা হয়।
ডেকে যে আরাম করে ঘুমোবে তারও উপায় নেই। ঘুমুলে হয়তো রাত দুটোর সময়। চারটে বাজতে না বাজতেই খালাসিরা ডেকে বালতি বালতি জল ঢেলে সেখানে যে বন্যা জাগিয়ে তোলে তার মাঝখানে মাছও ঘুমুতে পারে না। তখন যাবে কোথায়? কেবিনে ঢুকলে মনে হবে যেন রুটি বানানোর তন্দুরে-আভৃনে– তোমাকে রোস্ট করা হবে।
এই অবস্থা চলবে ভূমধ্যসাগর না পৌঁছনো পর্যন্ত।
তবে সান্ত্বনা এইটুকু যে, তোমাদের বয়সী ছেলেমেয়েরা ঠাণ্ডা-গরম সম্বন্ধে আমাদের মতো এতখানি সচেতন নয়। পল-পার্সি তাই যখন কেবিনের ভিতর নাক ফরফরাতো আমি তখন ডেকে বসে আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে থাকতুম। তখন বই পড়তে কিংবা দেশে আত্মীয়-স্বজনকে চিঠি লিখতে পর্যন্ত ইচ্ছে করে না।
মাঝে মাঝে ডেক-চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়তুম।
একদিন কেন জানিনে হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই সামনে দেখি এক অপরূপ মূর্তি।
ভদ্রলোক কোট-পাতলুন-টাই পড়েছেন ঠিকই কিন্তু সে পাতলুন ঢিলে পাজামার চেয়েও বোধ করি চৌড়া, কোট নেবে এসেছে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত আর মান-মুনিয়া দাড়ির তলায় টাইটা আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে মাত্র। ওঁর বেশভূষায়—ভুল করলুম, ভূষা জাতীয় কোনও বালাই ওঁর বেশে ছিল না– অনেককিছুই দেখবার মতো ছিল কিন্তু প্রথম দর্শনেই আমি সব-কটা লক্ষ করিনি, পরে ক্রমে ক্রমে লক্ষ করে অনেক কিছুই শিখেছিলুম। উপস্থিত লক্ষ করলুম, তাঁর কোর্টে ব্রেস্ট পকেট বাদ দিয়েও আরও দু সারি ফালতো পকেট। তাই বোধহয়, কোটটা দৈর্ঘ্যে হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসেছে।
একে তো এতদিন জাহাজে দেখিনি। ইনি ছিলেন কোথায়? তবে কি ইনি কলম্বোতে উঠেছেন। তা হলেও এ দুদিন ইনি ছিলেন কোথায়?
ভদ্রলোক সোজাসুজি বললেন, গুড নাইট।