মালদ্বীপে আছে প্রচুর নারকেলগাছ আর দ্বীপের চতুর্দিকে জাত-বেজাতের মাছ কিলবিল করছে। মাছের শুঁটকি আর নারকেলে নৌকো ভর্তি করে পাল তুলে দিয়ে তারা রওনা হয় সিংহলের দিকে মৌসুমি হাওয়া বইতে আরম্ভ করলেই। হাওয়া তখন মালদ্বীপ থেকে সিংহলের দিকে বয়। সমস্ত বর্ষাকালটা সিংহলে ওইসব বিক্রি করে এবং বদলে চাল ডাল কাপড় কেরোসিন তেল কেনে। কেনাকাটা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তাদের নাকি সেখানে বহুদিন কাটাতে হয়, কারণ উল্টো হাওয়া বইতে আরম্ভ করবে শীতের শুরুতে। তার আগে তো ফেরার উপায় নেই।
পার্সি বললে, কেন স্যর, এখন তো শীতকাল নয়। আমরা তো হাওয়ার উল্টো দিকেই যাচ্ছি।
আমি বললুম, ভ্রাতঃ, আমাদের জাহাজ চলে কলে, হাওয়ার তোয়াক্কা সে করে থোড়াই। মালদ্বীপে কোনও কলের জাহাজ যায় না, খরচায় পোষায় না বলে। তাই আজ পর্যন্ত কোনও টুরিস্ট মালদ্বীপ যায়নি।
তাই মালদ্বীপের ছোকরাটি আমায় বলেছিল, আমাদের ভাষাতে অতিথি শব্দটার কোনও প্রতিশব্দ নেই। তার কারণ বহুশত বৎসর ধরে আমাদের দেশে ভিনদেশি লোক আসেননি। আমরা এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যা অল্পস্বল্প যাওয়া-আসা করি তা এতই কাছাকাছির ব্যাপার যে কাউকে অন্যের বাড়িতে রাত্রিযাপন করতে হয় না। তার পর আমায় বলেছিল, আপনার নেমন্তন্ন রইল মালদ্বীপ ভ্রমণের কিন্তু আমি জানি, আপনি কখনও আসবেন না। যদিস্যাৎ এসে যান তাই আগের থেকেই বলে রাখছি, আপনাকে এর বাড়ি ওর বাড়ি করে করে অন্তত বছর তিনেক সেখানে কাটাতে হবে। খাবেন-দাবেন, নারকেলগাছের তলাতে চাঁদের আলোয় গাওনা-বাজনা শুনবেন, ব্যস, আর কী চাই।
যখন শুনেছিলুম তখন যে যাবার লোভ হয়নি একথা বলব না। ঝাড়া তিনটি বচ্ছর (এবং মালদ্বীপের ছেলেটি আশা দিয়েছিল যে সেখানে যাহা তিন তাহা তিরানব্বই) কিচ্ছুটি করতে হবে না, এবং শুধু তিন বৎসর না, বাকি জীবনটাই কিছু করতে হবে না। একথাটা ভাবলেই যেন চিত্তবনের উপর দিয়ে মর্মর গান তুলে মন্দমিঠে মলয় বাতাস বয়ে যায়। একজামিনের ভাবনা, কেষ্টার কাছে দু-টাকার দেনা, সবকিছু ঝেড়ে ফেলে দিয়ে এক মুহূর্তেই মুক্তি। অহহ!
কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ
দিবা-রাত্রি নাচে মুক্তি, নাচে বন্ধ
সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে পাছে পাছে
তা তা থৈ থৈ তা তা থৈ থৈ তা তা থৈ থৈ ॥
এসব আত্মচিন্তার সবকিছুই যে পুল-পার্সিকে প্রকাশ করে বলেছিলুম তা নয়, তবে একটা কথা মনে আছে, ওরা যখন উৎসাহিত হয়ে মালদ্বীপে বাকি জীবনটা কাটাবে বলে আমাকে সে খবরটা দিল তখন আমি বলেছিলুম
বাকি জীবন কেন, তিনটি মাসও সেখানে কাটাতে পারবে না। তার কারণ যেখানে কোনও কাজ করার নেই, সেখানে কাজ না করাটাই হয়ে দাঁড়ায় কাজের কাজ। এবং সে ভয়াবহ কাজ। কারণ, অন্য যে কোনও কাজই নাও না কেন, যেমন মনে কর এগজামি– তারও শেষ আছে, বি-এ, এম-এ, পি-এইচ-ডি, তার পর কোনও পরীক্ষা নেই। কিংবা মনে কর উঁচু পাহাড়ে চড়া। পাঁচ হাজার, দশ হাজার, ত্রিশ হাজার ফুট, যাই হোক না কেন তারও একটা সীমা আছে। কিন্তু কাজ নেই– এ হল একটা জিনিস যা নেই, কাজেই তার আরম্ভও নেই শেষও নেই। যে জিনিসের শেষ নেই সে জিনিস শেষ পর্যন্ত সইতে পারা যায় না।
কিংবা অন্যদিক দিয়ে ব্যাপারটাকে দেখতে পার।
আমাদের কবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মনে কর একটা ঘর। ঘরে আসল জিনিস দি ইমপর্টেন্ট এলমন্ট হল তার ফাঁকাটা, আমরা তাতে আসবাবপত্র রাখি, খাই-দাই, সেখানে রৌদ্রবৃষ্টি থেকে শরীরটা বাঁচাই। ঘরের দেয়ালগুলো কিন্তু এসব কাজে লাগছে না। অর্থাৎ ইমপর্টেন্ট, হল ফাঁকাটা, নিরেট দেয়ালটা নয়। তাই বলে দেয়ালটা বাদ দিলে চলবে না। দেয়ালহীন ফাঁকা হল ময়দানের ফাঁকা, সেখানে আশ্রয় জোটে না।
তাই গুরুদেব বলেছেন, মানুষের জীবনের অবসরটা হচ্ছে ঘরের ফাঁকাটার মতো, সে-ই দেয় আমাদের প্রবেশের পথ কিন্তু কিছুটা কাজের দেয়াল দিয়ে সেই ফাঁকা অবসরটাকে যদি ঘিরে না রাখো তবে তার থেকে কোনও সুবিধে ওঠাতে পার না। কিন্তু কাজ করবে যতদূর সম্ভব কম। কারণ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছ, ঘরের মধ্যে ফাঁকাটা দেয়ালের তুলনায় পরিমাণে অনেক বেশি।
তার পর আমি বললাম, কিন্তু ভ্রাতৃদ্বয়, আমার গুরুদেব এই তত্ত্বটি প্রকাশ করেছেন ভারি সুন্দর ভাষায় আর সুমিষ্ট ব্যঞ্জনায়, কিছুটা উস্টার সসের হাস্যকৌতুক মিশিয়ে দিয়ে। আমি তার অনুকরণ করব কী করে?
কিন্তু মূল সিদ্ধান্ত এই মালদ্বীপের একটানা কর্মহীনতার ফাঁকাটা অসহ্য হয়ে দাঁড়াবে, কারণ তার চতুর্দিকে সামান্যতম কাজের দেয়াল নেই বলে।
একটানা এতখানি কথা বলার দরুন ক্লান্ত হয়ে ডেক-চেয়ারে গা এলিয়ে দিলুম।
তখন লক্ষ করলুম, পল ঘন ঘন ঘাড় চুলকোচ্ছে। তার পর হঠাৎ ডান হাতটা মুঠো করে মাথায় ধাই করে শুত্তা মেরে বললে, পেয়েছি, পেয়েছি, এই বারে পেয়েছি।
কী পেয়েছে সেইটে আমি শুধোবার পূর্বেই পার্সি বললে, ওই হচ্ছে পলের ধরন। কোনও একটা কথা স্মরণে আনবার চেষ্টা করার সময় সে ঘন ঘন ঘাড় চুলকোয়। মনে এসে যাওয়া মাত্রই ঠাস করে মাথায় মারবে এক ঘুষি। ক্লাসেও ও তাই করে। আমরা তাই নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে থাকি। এবারে শুনুন, ও কী বলে।
পল বললে, কোনও নতুন কথা নয়, স্যর! তবে আপনার শুরুর তুলনাতে মনে পড়ে গেল আমার শুরু কফুসর (আমার মনে বড় আনন্দ হল যে ইংরেজ ছেলেটা ক-ফু-সকে আমাদের গুরু বলে সম্মান জানাল–ভারতবর্ষের ইংরেজ ছেলে-বুড়ো বন্ধুকে কখনও আমাদের গুরু, বলেনি)–এ বিষয়ে অন্য এক তুলনা। যদি অনুমতি দেন।