রোমানরাও নিশ্চয়ই এ হাওয়ার খবর কিছুটা রাখত। না হলে আরবদের বহু পূর্বে দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে তারা এতখানি ব্যবসা-বাণিজ্য করল কী করে? এখনও দক্ষিণ ভারতের বহু জায়গায় মাটির তলা থেকে রোমান মুদ্রা বেরোয়।
তারও পূর্বে গ্রিক, ফিনিশিয়ানরা এ হাওয়ার খবর কতখানি রাখত আমার বিদ্যে অতদূর পৌঁছয়নি। তোমরা যদি কেতাবপত্র ঘেঁটে আমাকে খবরটা জানাও তবে বড় খুশি হই।
এই হাওয়াটাকেই ট্যারচা কেটে কেটে আমাদের জাহাজ এগোচ্ছে। এ হাওয়া যতক্ষণ মোলায়েমভাবে চলে ততক্ষণ কোনও ভাবনা নেই। জাহাজ অল্প-স্বল্প দোলে বটে তবু উল্টোদিক থেকে বইছে বলে গরমে বেগুন-পোড়া হতে হয় না। কিন্তু ইনি রুদ্রমূর্তি ধরলেই জাহাজময় পরিত্রাহি চিৎকার উঠবে। এবং বছরের এ সময়টা তিনি যে মাসে অন্তত দু তিনবার জাহাজগুলোকে লণ্ডভণ্ড করে দেবার জন্য উঠে-পড়ে লেগে যান সে সুখবরটা আবহাওয়ার বইখানাতে একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে।
আবহাওয়ার বিজ্ঞান ঝড় ওঠবার পূর্বাভাস খানিকটা দিতে পারে বটে কিন্তু আরব সাগরের মাঝখানে যে ঝড় উঠল সে যে তার পর কোনদিকে ধাওয়া করবে সে সম্বন্ধে আগে-ভাগে কোনওকিছু বলে দেওয়া প্রায় অসম্ভব।
তাই সে ঝড় যদি পূর্ব দিকে ধাওয়া করে তবে ভারতের বিপদ, বোম্বাই, কারওয়ার, তিরু অনন্তপুরম, (শ্রী অনন্তপুর, ট্রিভাণ্ডএম) অঞ্চল লণ্ডভণ্ড করে দেবে। যদি উত্তর দিকে যায় তবে পার্শিয়ান গালফু এবং আরব উপকূলের বিপদ আর যদি পশ্চিম পানে আক্রমণ করে তবে আদন বন্দর এবং আফ্রিকার সোমালিদের প্রাণ যায় যায়।
একবার নাকি এইরকম একটা ঝড়ের পর সোমালিদের ওবোক শহরে মাত্র একখানা বাড়ি খাড়া ছিল। সে ঝড়ে শহরের সব বাড়ি পড়ে যায়, তার সঙ্গে যদি মাঝদরিয়ায় আমাদের জাহাজের মোলাকাত হয় তবে অবস্থা কীরকম হবে খানিকটা অনুমান করা যায়।
তবে আমার ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস, এরকম ঝড়ের সঙ্গে মানুষের একবারের বেশি দেখা হয় না। প্রথম ধাক্কাতেই পাতালপ্রাপ্তি!
পাতালপ্রাপ্তি কথাটা কী ঠিক হল? কোথায় যেন পড়েছি, জাহাজ ডুবে গেলে পাতাল অবধি নাকি পৌঁছয় না। খানিকটে নাবার পর ভারী জল ছিন্ন করে জাহাজ নাকি আর তলার দিকে যেতে পারে না। তখন সে ত্রিশঙ্কুর মতো ওইখানেই ভাসতে থাকে।
ভাবতে কীরকম অদ্ভুত লাগে! সমুদ্রের এক বিশেষ স্তরে তা হলে যতসব জাহাজ ডোবে তারা যতদিন না জরাজীর্ণ হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায় ততদিন শুধু যোরাফেরাই করবে!
জলে যা, হাওয়াতেও বোধ করি তাই। বেলুন-টেলুন জোরদার করে ছাড়তে পারলে বোধহয় উড়তে উড়তে তারা এক বিশেষ স্তরে পৌঁছলে ওইখানেই ঝুলতে থাকবে না পারবে নিচের দিকে নামতে, না পারবে উপরের দিকে যেতে। তারই অবস্থা কল্পনা করে বোধহয় মুনি-ঋষিরা ত্রিশঙ্কুর স্বর্গ-মর্তের মাঝখানে ঝুলে থাকার কথা কল্পনা করেছিলেন।
আমাকে অবশ্য কখনও কোনও জায়গায় ঝুলে থাকতে হবে না। দ্বিপ্রহরে এবং সন্ধ্যায় যা গুরুভোজন করে থাকি তার ফলে ডুবলে পাথরবাটির মতো তরতর করে একদম নাক বরাবর পাতালে পৌঁছে যাব। আহারাদির পর আমার যা ওজন হয় সে গুরুভার সমুদ্রের যে কোনও নোনাজলকে অনায়াসে ছিন্ন করতে পারে। আমার ভাবনা শুধু আমার মুণ্ডুটাকে নিয়ে। মগজ সেটাতে এক রত্তিও নেই বলে সেটা এমনি ফাপা যে, কখন যে ধড়টি ছেড়ে হুশ করে চন্দ্র-সূর্যের পানে ধাওয়া করবে তার কিছু ঠিক-ঠিকানা নেই। হাজারো লোকের ভিড়ের মধ্যে যদি আমাকে শনাক্ত করতে চাও তবে শুধু লক্ষ কোরো কোন লোকটা দু হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে নড়াচড়া করছে।
অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছিলুম আমার সখা এবং সতীর্থ– একই তীর্থে যখন যাচ্ছি তখন সতীর্থ বলাতে কারও কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়– শ্রীমান পল কোথা থেকে একটা টেলিস্কোপ যোগাড় করে একদৃষ্টে দক্ষিণ পানে তাকিয়ে আছে। ভাবলুম, ওই দিক দিয়ে বোধহয় কোনও জাহাজ যাচ্ছে আর সে তার নামটা পড়ার চেষ্টা করছে।
আমাকে দাঁড়াতে দেখে কাছে এসে বললে, ওই দূরে যেন ল্যান্ড দেখা যাচ্ছে।
আমি বললুম, ল্যান্ড নয়, আইল্যান্ড। ওটা বোধহয় মালদ্বীপপুঞ্জের কোনও একটা হবে।
পল বললে, কই, ওগুলোর নাম তো কখনও শুনিনি!
আমি বললুম, শুনবে কী করে? এই জাহাজে যে এত লোক, এঁদের সব্বাইকে জিগ্যেস কর ওঁদের কেউ মালদ্বীপ গিয়েছেন কি না? অদূরেই-বা কেন? শুধু জিগ্যেস কর, মালদ্বীপবাসী কারও সঙ্গে কখনও ওঁদের দেখা হয়েছে কি না? তাই মালদ্বীপ নিয়ে এ বিশ্বভুবনের কারও কোনও কৌতূহল নেই।
আপনি জানলেন কী করে?
শুনেছি, মালদ্বীপের লোকেরা খুব ধর্মভীরু হয়। এক মালদ্বীপবাসীর তাই ইচ্ছে হয়, তার ছেলেকে মুসলিম শাস্ত্র শেখাবার। মালদ্বীপে তার কোনও ব্যবস্থা নেই বলে তিনি ছেলেকে কাইরোর আজহর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান;- ওইটেই ইসলামি শাস্ত্র শেখার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়। ছেলেটির সঙ্গে আমার আলাপ হয় ওইখানে। বহুবার দেখা হয়েছিল বলে সে আমাকে তার দেশ সম্বন্ধে অনেককিছুই বলেছিল, তবে সে অনেক কাল হল বলে আজ আর বিশেষ কিছু মনে নেই।
ওখানে নাকি সবসুদ্ধ হাজার দুই ছোট ছোট দ্বীপ আছে এবং তার অনেকগুলোতেই খাবার জল নেই বলে কোনও প্রকারের বসতি নেই। মালদ্বীপের ছেলেটি আমায় বলেছিল, আপনি যদি এরকম দশ-বিশটা দ্বীপ নিয়ে বলেন, এগুলো আপনার, আপনি এদের রাজা, তা হলে আমরা তাতে কণামাত্র আপত্তি জানাব না। অন্যগুলোতেও বিশেষ কিছু ফলে না, সবচেয়ে বড় দ্বীপটার দৈর্ঘ্য নাকি মাত্র দু মাইল। মালদ্বীপের সুলতান সেখানে থাকেন এবং তার নাকি ছোট্ট একখানা মটরগাড়ি আছে। তবে যেখানে সবচেয়ে লম্বা রাস্তার দৈর্ঘ্য মাত্র দু মাইল সেখানে ওটা চালিয়ে তিনি কী সুখ পান তা তিনিই বলতে পারবেন।