পার্সি বললে, ওই তো পলের দোষ। বড় পিটপিটে। আরে বাপু, যাচ্ছিস তো সস্তা ফরাসি মেসাজেরি মারিতি জাহাজে আর আশা করছিস, ক্রাইজ্বলার এসে তোর কেবিনের জানালার কাছে চাঁদের আলোতে বেহালা দিয়ে সেরেনেড বাজাবেন!
আমি বললুম, আমাদের দেশে এক বুড়ি কিনে আনল এক পয়সার তেল। পরে দেখে তাতে একটা মরা মাছি। দোকানিকে ফেরত দিতে গিয়ে বললে, তেলে মরা মাছি। দোকানি বললে, এক পয়সার তেলে কী তুমি একটা মরা হাতি আশা করেছিলে?
পার্সি বলল, এইবার আপনাকে বাগে পেয়েছি, স্যার! আপনি যে গল্পটি বললেন তার যে বিলিতি মুদ্রণটি আমি জানি সে এর চেয়ে সরেস।
আমি চোখ বন্ধ করে বললুম, কীর্তন কর।
পার্সি বললে, এই আমাদের পলেরই মতো এক পিটপিটে মেমসায়েব গিয়েছেন মোজা কিনতে। কোনও মোজাই তার পছন্দ হয় না। শেষটায় সবচেয়ে সস্তায় এক শিলিঙে তিনি একজোড়া মোজা কিনলেন। দোকানি যখন মোজা প্যাক করছে তখন তার চোখে পড়ল মোজাতে অতি ছোট্ট একটি ল্যাডার
আমি শুধোলুম, ল্যাডার মানে কী? ল্যাডার মানে তো মই।
আজ্ঞে, মোজার একগাছা টানার সুতো যদি ছিঁড়ে যায় তবে ওই জাগায় শুধু পড়েনগুলো একটার উপর একটা এমনভাবে থাকে যেন মনে হয় সিঁড়ি কিংবা মই। তাই ওটাকে তখন ল্যাডার বলা হয়।
আমি বললুম, থ্যাঙ্কিউ; শেখা হল। তার পর কী হল?
মেম বললেন, ও মোজা আমি নেব না, ওতে একটা ল্যাডার রয়েছে।
দোকানি বললে, এক শিলিঙের মোজাতে কি আপনি একটা মার্বেল স্টেয়ারকেস আশা করেছিলেন, ম্যাডাম?।
আমি বললুম, সাবাস, তোমার বলা গল্পটি আমার গার্হস্থ্য সংস্করণের রাজসংস্করণ বলা যেতে পারে। তদুপরি তোমরা তো রাজার জাত।
পার্সি বললে, ও কথাটা নাই-বা তুললেন, স্যার!
আমি আমার চোখ বন্ধ করে বললুম, জাহাজের দুর্বিষহ গতানুগতিক জীবনকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করবার জন্য কোম্পানি অদ্য অন্য কী ব্যবস্থা করেছেন?
পার্সি বলল, সঙ্গীতে যখন পলের আপত্তি তখন আমি ভাবছি ওই সময়টায় আমি সেলুনে চুল কাটাতে যাব।
আমি হন্তদন্ত হয়ে বললুম, অমন কর্মটি গলা কেটে ফেললেও করতে যেয়ো না, পার্সি! তোমার চুল কেটে দেবে নিশ্চয়ই কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তোমার হাজামও করে দেবে।
কথাটা বুঝতে পারলুম না, স্যর!
আমি বললুম, ওটা একটা উর্দু কথার আড়। এর অর্থ, তোমার চুল নিশ্চয়ই কেটে দেবে ভালো করে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মাথাটিও মুড়িয়ে দেবে।
পার্সি আরও সাত হাত জলে। শুধোল, চুল যদি ভালো করে কাটে তবে মাথা মুড়োবে কী করে?
আমি বললুম, তোমার চুল কাটবে শব্দার্থে, কিন্তু মাথা মুড়োবে বার্থে, অর্থাৎ মেটাফরিকেলি। মোদ্দাকথা, তোমার সর্বস্ব লুণ্ঠন করবে। জাহাজে চুল কাটানোর দর্শনী পঞ্চ মুদ্রা।
পল বললে, সে কী স্যর? চীন দেশে তো পাঁচ টাকায় কুড়ি বার চুল কাটানো যায়।
আমি বললুম, ভারতবর্ষেও তাই। এমনকি বিশ্বফ্যাশানের রাজধানী প্যারিসেও চুল কাটাতে পাঁচ টাকা লাগে না। ব্যাপারটা হয়েছে কী, জাহাজের ফার্স্টক্লাসে যাচ্ছেন পয়সাওয়ালা বড়লোকেরা। তারা পাঁচ টাকার কমে চুল কাটান না। কাজেই রেট বেঁধে দেওয়া হয়েছে পাঁচ টাকা। আমাদের কথা বাদ দাও, এখন যদি কোনও ডেকপ্যাসেঞ্জারও চুল কাটাতে যায় তবে তাকেও দিতে হবে পাঁচ টাকা।
তা হলে উপায়? একমাথা চুল নিয়ে লন্ডনে নামলে পিসিমা কী ভাববেন? তার ওপর পিসিমাকে দেখব জীবনে এই প্রথম, পিসিমার কথা উঠলে বাবা-মা যেভাবে সমীহ করে কথা বলেন তার থেকে মনে হয় তিনি খুব সোজা মহিলা নন। তা হলে পাঁচটা টাকা দরিয়ার জলে ভেসে গেল আর কি, একদম শব্দার্থে।
আমি বললুম, আদপেই না। জিবুটি বন্দরে চুল কাটাবে। বিবেচনা করি, সেখানে চুল কাটাতে এক শিলিংয়েরও কম লাগবে।
পল বললে, আমরা যখন বন্দরে রোদ লাগাব তখন পার্সিটা একটা ঘিঞ্জি সেলুনে বসে চুল কাটাবে। তা হলে তার উপযুক্ত শিক্ষা হয়।
পার্সি আমার দিকে করুণ নয়নে তাকাল।
আমি বললুম, তা কেন? বন্দর দেখার পর তোমাতে-আমাতে যখন কাফেতে বসে কফি খাব তখন পার্সি চুল কাটাবে। চাই কি, হয়তো সেলুনের বারান্দায় বসেই কফি খেতে খেতে পার্সিকে আমাদের মহামূল্যবান সঙ্গসুখ দেব, অমূল্য উপদেশ বিতরণ করব।
পার্সি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে বাও করে বললে, এ যাত্রায় আপনার সঙ্গে পরিচয় না হলে, স্যর, আমাদের যে কী হত–
আমি বাধা দিয়ে বললুম, কিছুই হত না। আমার সঙ্গে বজর বজর না করে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করতে, পাঁচরকমের ছেলে-ছোকরাদের সঙ্গে আলাপচারি হত। অনেক দেখতে, অনেক শুনতে।
দু জনাই সঙ্গে সঙ্গে কেটে পড়ল!
আমি আরব সাগরের আবহাওয়া সম্বন্ধে একখানা বিরাট কেতাব নিয়ে পড়তে লেগে গেলুম।
.
০৩.
আরবের তুলনায় বাঙালি যে অতিশয় নিরীহ সে বিষয়ে কারও মনে কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয় কিন্তু আরব সাগর, সাগর হয়েও বঙ্গোপসাগরের উপসাগরের চেয়ে অনেক বেশি শান্ত এবং ঠাণ্ডা। মাদ্রাজ থেকে কলম্বো পর্যন্ত অধিকাংশ যাত্রী সি-সিকনেসে বেশ কাবু হয়ে থাকার পর এখানে তারা বেশ চাঙা হয়ে উঠেছেন। উত্তর-পূর্ব দিকে মৃদু-মন্দ মৌসুমি হাওয়া বইছে তখনও– এই হাওয়ায় পাল তুলে দিয়েই ভাস্কো দা গামা আফ্রিকা থেকে ভারতে পৌঁছতে পেরেছিলেন। কিন্তু এই সময়ে ওই হাওয়া ভারতের দিকে বয় সে আবিষ্কার গামার নয়। আরবরা এ হাওয়ার গতিবিধি সম্বন্ধে বিলক্ষণ ওকিবহাল ছিল এবং বিশেষ ঋতুতে (মৌসুমে এ হাওয়া বয় বলে এর নাম দিয়েছিল মৌসুমি হাওয়া। ইংরেজি শব্দ মনসুন এবং বাঙলা মরশুম এই মৌসুম শব্দ থেকে এসেছে। কিন্তু মৌসুমি হাওয়ার খানিকটা সন্ধান পাওয়ার পরও গামা একা সাহস করে আরবসাগর পাড়ি দিতে পারেননি। আফ্রিকা থেকে একজন আরবকে জোর করে জাহাজে পাইলট রূপে এনেছিলেন।