পল বললে, হক কথা। কিন্তু স্যার, আমরা তো এতক্ষণ আপনার ডিনার যোগাড় করে কেবিনে গুছিয়ে রাখাতে
আমি বললুম, সে কী হে?
পার্সি বললে, আজ্ঞে। যখন দেখলুম, আপনি ডিনারের ঘণ্টা শুনেও উঠলেন না, তখনই আমরা ব্যবস্থাটা করে ফেললুম।
সোনার চাঁদ ছেলেরা। ইচ্ছে হচ্ছিল দু জনকে দু-বগলে নিয়ে উল্লাসে নাগা-নৃত্য জুড়ে দিই। কিন্তু বয়সে কম হলে হবে কী, ওজনের দিক দিয়ে ওরা আমার চেয়ে ঢের বেশি ভারিক্তি মুরুব্বি। বাসনাটা তাই বিকাশ লাভ করল না। বললুম, তবে চল ব্রাদার্স, কেবিনে।
০২.
গড্ডলিকা-প্রবাহে অর্থাৎ ভিড়ের সঙ্গে মানুষ গা ভাসিয়ে দেয় কেন? তাতে সুবিধে এই; আর পাঁচজনের যা গতি, তোমারও তাই হবে। এবং সেহেতু সংসারের আর পাঁচজন হেসে-খেলে বেঁচে আছে, অতএব তুমিও দিব্য তাদেরই মতো সুখে-দুঃখে বেঁচে থাকবে।
আর যদি গড্ডলিকায় না মিশে একলা পথে চল তবে যেমন হঠাৎ গুপ্তধনের সন্ধান পেয়ে যেতে পার ঠিক তেমনি মোড় ফিরতেই আচমকা হয়তো দেখতে পাবে, ব্যাঘ্রাচার্য বৃহল্লাঙ্গুল থাবা পেতে সামনে বসে ন্যাজ আছড়াচ্ছেন!
গুপ্তধনটা একা পেয়েছিলে বলে সেটা যেমন তোমার একারই, ঠিক তেমনি বাঘের মোকাবেলা করতে হবে তোমাকে একাই।
তাই বেশিরভাগ লোক সর্বনাশা ক্ষতির ভয়ে অত্যধিক লাভের লোভ না করে গড্ডলিকার সঙ্গে মিশে যায়।
জাহাজেও তাই। তুমি যদি আর পাঁচজনের সঙ্গে ঘুম থেকে জাগো তবে সেই ভিড়ে তুমি ঝটপট তোমার বেড-টির কাপটি পাবে না। আর যদি খুব সকাল সকাল কিংবা আর সকলের চেয়ে দেরিতে ওঠ তবে চা-টি পেয়ে যাবে তনুহর্তেই, কিন্তু আবার কোনও দিন দেখবে, তখনও আগুন জ্বালা হয়নি বলে চায়ের অনেক দেরি, কিংবা এত দেরিতে উঠেছ যে, বেড-টির পাট উঠে গিয়ে তখন ব্রেক ফাস্ট আরম্ভ হয়ে গিয়েছে বলে তোমার বেড-টি হয় মাঠে, অর্থাৎ দরিয়ায় মারা গিয়েছে।
ইংরিজিতে একেই বলে, নো রিসক, নো গেন অর্থাৎ একটুখানি ঝুঁকি যদি নিতে রাজি না হও তবে লাভও হবে না। লটারি জিততে হলে অন্তত একটা টিকিট কেনার রিস্ক নিতে হয়।
সেদিন ঝুঁকিটা নিয়ে সুবিধে হল না। চা-টা মিস্ করে বিরসবদনে ডেকে এসে বসলুম।
এক মিনিটের ভিতর পল আর পার্সির উদয়।
পল ফিসফিস করে কানে কানে বলল, নতুন সব বার্ডিদের ( অর্থাৎ চিড়িয়াদের) দেখেছেন, স্যার?
এরা সব নবাগত যাত্রী। কলম্বোয় জাহাজ ধরেছে। বেচারীরা এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, ডেকে চেয়ার পাতবার ভালো জায়গার সন্ধানে। কিন্তু পাবে কোথায়? আমরা যে আগে-ভাগেই সব জায়গা দখল করে আসন-জমিন জমিয়ে বসে আছি– মাদ্রাজ থেকে।
এ তো দুনিয়ার সর্বত্র হামেশাই হচ্ছে। মিটিঙে, ফুটবলের মাঠে সর্বদাই আগে গিয়ে ভালো জায়গা দখল করার চেষ্টা সবাই করে থাকে। এমনকি রান্নাঘরের দাওয়ায় বসি ঠিক দরজাটির কাছে। মা রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে বেরিয়েই সক্কলের পয়লা দেবে আমাকে।
ভালো জায়গায় বসতে পারাতে দুটো সুখ। একটা ভালো জায়গা পেয়েছ বলে এবং দ্বিতীয়টা তার চেয়েও বড়। বেশ আরাম করে বসে চিনেবাদাম খেতে খেতে অলস নিরাসক্তভাবে তাকিয়ে দেখতে, অন্যেরা ফ্যা ফ্যা করে কীভাবে ভালো জায়গার সন্ধানে ঘুরে মরছে। পরিচিত এবং অপ্রিয় লোক হলে তো কথাই নেই। এই যে ভড় মশাই, জায়গা পাচ্ছেন না বুঝি? বলে ফিক করে একটুখানি সদুপদেশ বিতরণ করবে, কেন, ওই দিকে তো মেলা জায়গা রয়েছে, বলে হাতখানা মাথার উপর তুলে চতুর্দিকে ঘুরিয়ে দেবে। তার থেকে কেউই বুঝতে পারবে না, কোনদিকে জায়গা খালি। লোকটা দৃষ্টি দিয়ে বিষবৃষ্টি নিক্ষেপ করে গজরাতে গজরাতে তোমার দৃষ্টির আড়াল হবে!
আহ্! এ সংসারে ভগবান তার অসীম করুণায় আমাদের জন্যে কত আনন্দই না রেখেছেন। কে বলে সংসার মায়াময় অনিত্য? সে বোধহয় ফুটবলের মাঠে কখনও ভালো সিট পায়নি।
আমি পল-পার্সিকে জিগ্যেস করলুম, অদ্যকার প্রোগ্রাম কী?
পল বললে, প্রথমত, জিমনাসটিক-হলে গমন।
সেখানকার কর্মতালিকা কী?
একটুখানি রোইং করব।
রোইং সেখানে কি নৌকো, বৈঠে, জল আছে?
সব আছে, শুধু জল নেই।
?
বৈঠেগুলোর সঙ্গে এমনভাবে স্প্রিং লাগানো আছে যে জল থাকলে বৈঠাকে যতখানি বাধা দিত স্প্রিং ঠিক ততখানি দেয়। কাজেই শুকনোয় বসে বৈঠে চালানোর প্র্যাকটিস আর পরিশ্রম দুই-ই হয়।
আমি বললুম, উঁহু। আমার মন সাড়া দিচ্ছে না। আমাদের দেশে আমরা বৈঠা মারি দু হাত দিয়ে তুলে ধরে। তোমার কায়দাটা রপ্ত করে আমার কোনও লাভ হবে না।
পল বললে, তা হলে প্যারালেল বার, ডামবেল কিছু একটা?
উঁহু।
পার্সি বললে, তা হলে পলে-আমাতে বকসিং লড়ব। আপনি রেফারি হবেন।
আমি তো ওর তত্ত্ব কিছুই জানিনে।
আমরা শিখিয়ে দেব।
উঁহু।
পল তখন ধীরে ধীরে বলল, আসলে আপনি কোনওরকম নড়াচড়া করতে চান না। একসেরসাইজের কথা না হয় রইল কিন্তু আর সবাই তো সকাল-বিকেল জাহাজটাকে কয়েকবার প্রদক্ষিণ দেয় শরীরটাকে ঠিক রাখবার জন্য। আপনি তো তা-ও করেন না। কেন বলুন তো?
আমি বললুম, আরেকদিন হবে। উপস্থিত অদ্যকার অন্য কর্মসূচি কী?
পার্সি বললে, আজ এগারোটায় লাউঞ্জে চেম্বার মুজিক। তাই না হয় শোনা যাবে।
পল আপত্তি জানাল। বললে, যে লোকটা বেহালা বাজায় তার বাজনা শুনে মনে হয়, দুটো হুলো বেড়ালে মারামারি লাগিয়েছে।