আমার ভারি বিরক্তি বোধ হল। এসব লোক কী ভাবে? ভারতবর্ষের লোক যিশুর নাম শোনেনি? তেড়ে বললুম, The book of the generation of Jesus Christ, the son of David, the son of Abraham. Abraham begat- ইত্যাদি ইত্যাদি, –চড়চড় করে মথি-লিখিত সুসমাচার থেকে মুখস্থ বলে যেতে লাগলুম, প্রভু যিশুর ঠিকুজি কুলজি। লোকটা কিন্তু একদম না দমে গিয়ে বললে, ঠিক, ঠিক। এই দেখুন, সেই জায়গা যেখানে প্রভু জন্ম নিলেন। একটা সরাইয়ের আস্তাবলে। মা মেরি আর তার বর যোসেফ তখন প্যালেস্টাইন থেকে এই মিশরের দিকে পালিয়ে আসছিলেন। বেলেহেম গ্রামে সন্ধ্যা হল। সরাইয়ে জায়গা না পেয়ে মা মেরি আশ্রয় নিলেন আস্তাবলে। এই দেখুন, নাজারেত গ্রামের ছবি। কত চিত্রকরই না এ ছবি এঁকেছেন। কত যুগ ধরে। তার পর দেখুন, নাজারেত গ্রামের ছবি। যোসেফ সেখানে ছুতোরের কাজ করতেন, আর মা মেরি যেতেন জল আনতে। এই দেখুন–
আমি বললুম, ব্যস, ব্যস, হয়েছে। কিন্তু আপনি আমার মুশকিলটা আদপেই বুঝতে পারেননি। আমি যদি পোর্টসঈদ থেকে প্রভুর জন্মভূমি প্যালেস্টাইনে চলে যাই তবে সেখানে ফিরে এসে ইয়োরোপে যাবার জন্য আমাকে নতুন করে জাহাজের টিকিট কাটতে হবে। তার পয়সা দেবে কে?–না হয় প্যালেস্টাইন তীর্থ-দর্শন-খর্চা আমি কোনও গতিকে, কেঁদে-ককিয়ে সামলে নিলুম। এক জাহাজের টিকিট একই জায়গা যাবার জন্য দু দুবার কাটবার মতো পয়সা কিন্তু আমার নেই।
আড়কাঠি তো হেসেই কুটিকুটি। আমি বিরক্ত। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল, জাহাজের ডবল ভাড়া লাগবে কেন? আপনি যে জাহাজে করে পোর্টসঈদে এসেছেন সেই কোম্পানিরই আরেকখানা জাহাজ পনেরো দিন পর সেখানে এসে ইয়োরোপ যাবে। আপনি সে জাহাজে গেলেন কিংবা এ জাহাজে গেলেন তাতে কোম্পানির কী ক্ষতি-বৃদ্ধি? ডবল পয়সা নিতে যাবে কেন? আর ওই পনেরো দিনে আপনি দেখে নেবেন প্যালেস্টাইন।
আমি বললুম হুঁ, হুঁ উ-উ-কিন্তু সে জাহাজে যদি সিট না থাকে।
লোকটার ধৈর্যও অসীম। সমুখে বুদ্ধদেবের মতো করুণার হাসি হেসে বললে, কে বললে থাকবে না? এখন তো অফ সিজন, স্ন্যাক পিয়েরিয়েড, অর্থাৎ যাত্রীর ভিড় নেই। আপনি যে জাহাজে এলেন তার কি অর্ধেকখানা ফাঁকা ছিল না? আসছে জাহাজ গড়ের মাঠ।
আমি অনেকক্ষণ চুপ করে রইলুম। চিন্তাশীল লোক বলে নয়। আসলে সবকিছু বুঝতেই আর পাঁচজনের তুলনায় আমার একটু বেশি সময় লাগে। ব্রেন-বক্সে আল্লাতালা রিসিভিং সেটা দিয়েছেন অতিশয় নিকৃষ্ট পর্যায়ের। বাবগুলো গরম হতে লাগে মিনিট তিন। তার পরও চিত্তির। তিনটে স্টেশনে গুবলেট পাকিয়ে দেয় শুধু কড়া শিম্। কিছু বুঝতে পারিনে।
হঠাৎ মাথায় একটা প্রশ্ন এল। জানো বোধহয়, অগা বোকারা মাঝে মাঝে, অর্থাৎ বছরে দু একবার, পাকা স্যানার মতো দু-একটা প্রশ্ন ওঠাতে পারে। তাই শুধালুম, কিন্তু আমি প্যালেস্টাইন গেলে তোমার টাকে কি চুল গজাবে? তোমার তাতে কী লাভ?
লোকটা এইবারে একটু বিরক্ত হল। প্রশ্নটা মোক্ষম কঠিন বলে, না টাক টাক করলুম বলে ঠিক বুঝতে পারলুম না। আমার মগজ তখন ওই একটা কঠিন প্রশ্ন শুধাবার ধকল কাটাতে গিয়ে হাঁপাতে আরম্ভ করেছে।
বললে, আমার কী লাভ? আমার লাভ বিস্তর না হলেও অল্প। অর্থাৎ অল্প-বিস্তর। বুঝিয়ে বলি। আপনাকে নিয়ে যাব কুকের আপিসে। তাদের কাছ থেকে কাটবেন আপনার পয়লা গন্তব্যস্থল, প্যালেস্টাইনের রাজধানী জেরুজালেমের টিকিট। ন্যায্য ভাড়াই দেবেন। কিন্তু কুক্ আমাকে দেবে কমিশন
আমি শুধালুম, কুক্ তোমাকে কমিশন দিতে যাবে কেন?
আমার বুদ্ধির প্রাধর্য দেখে লোকটা প্রায় হতাশ হয়ে বললে, প্যালেস্টাইন সরকার কুকে পয়সা দেয়, তার দেশে টুরিস্ট নিয়ে যাবার জন্য তাতে করে সরকারের দু পয়সা লাভ হয়। তাই তারা কুককে দেয় কমিশন, কুক্ তার-ই খানিকটে দেয় আমাকে। তারা তো আর ট্রেনে ট্রেনে খদ্দেরের সন্ধানে টো-টো করতে পারে না। এ কর্মটি করি আমি। তাই আমার হয় কিঞ্চিৎ মুনাফা! বুঝলেন তো?
পাছে লোকটা আমাকে ফের বোকা বানিয়ে দেয়, তাই তাড়াতাড়ি বললুম, হ্যাঁ, হা, বুঝেছি, বিলক্ষণ বুঝেছি। যদিও আমি ততখানি সংসারী বুদ্ধি ধরিনে বলে ওইসব কমিশন-মিশনের মারপ্যাঁচ আদপেই ধরতে পারিনি।
কিন্তু লক্ষ করলুম, সে প্যাটপ্যাট করে আমার হ্যান্ডব্যাগটার দিকে তাকিয়ে আছে। তার উপরে মোটা মোটা হরফে লেখা ছিল– ALI, লোকটা শুধাল, ব্যাগটা আপনার?
আমি বললুম, হ্যাঁ।
বাহ্! তা হলে তো আপনি মুসলমান। আর জেরুজালেম মুসলমানদের তীর্থভূমি –মক্কার পরেই তার স্থান। আল্লাতালা মুহম্মদ সাহেবকে রাত্রে আরব থেকে জেরুজালেমে এনে সেখান থেকে স্বর্গদর্শনে নিয়ে যান। জেরুজালেমের সে জায়গাটার উপর এখন মসজিদ-উল-আসা। বিরাট সে মসজিদ, অদ্ভুত তার গঠন। এই কিছুদিন হল আপনাদের দেশেরই রাজা হাইদ্রাবাদের নিজাম সেটাকে দশ লক্ষ টাকা খরচ করে মেরামত করে দিয়েছেন। দেখতে যাবেন না সেটা?
তার পর বললে, আসলে কী জানেন? আসলে জেরুজালেম হল ধর্মের ত্রিবেণি। ইহুদি, খ্রিস্টান আর মুসলমান ধর্ম এখানে এসে মিলেছে। এক ঢিলে তিন পাখি।
তীর্থ দেখলে পুণ্য হয়, কি না হয় সেকথা আমি কখনও ভালো করে ভেবে দেখিনি। কিন্তু হিন্দুদের কাশী, বৌদ্ধদের রাজগির যখন দেখেছি, তখন এ তিনটেই-বা বাদ যাবে কেন? বিশেষ কোনও ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব আমি আদপেই পছন্দ করিনে। তাকেই বলে কমুনালিজম। সৃষ্টিকর্তা যখন তার অসীম করুণায় এতগুলো ধর্ম বানিয়েছেন তখন নিশ্চয়ই সব-কটাতেই কিছু-না-কিছু আছে। আর বিশেষ করে মা ভারি খুশি হবে, যখন শুনবে আমি বয়ত-উল-মুদ্দস (পুণ্যভূমি অর্থাৎ জেরুজালেম) দর্শন করেছি। তার বাবাও মক্কা অবধি পৌঁছতে পেরেছিলেন–বয়ত-উল-মুদ্দস দেখেননি। সেখানে শুনেছি, অতি উত্তম তসবি (জপমালা) পাওয়া যায়। এক-গাছ কিনে দিলে মা যা খুশি হবে। সাত বক নামাজ পড়ার সময় (মুসলমানরা সচরাচার পড়ে পাঁচ বক-মা পড়ে সাত) মা তসবি গুনবে, আর আমার ওপর ভারি খুশি হবে।