ক্ষেতভরা ধান গম কার্পাস! সবুজে সবুজে ছয়লাপ। মাঝে মাঝে খেজুরগাছের সারি, আর কখনও-বা এখানে একটা সেখানে একটা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্ষেতের পাহারা দিচ্ছে।
আর নদীর উপর দিয়ে চলেছে উঁচু উঁচু তেকোনা পাল তুলে দিয়ে লম্বা লম্বা নৌকো। এ দেশে বৃষ্টি প্রায় হয় না বলে নৌকোতে ছইয়ের ব্যবস্থা প্রায় নেই। জোর হাওয়ায় নৌকোগুলো চলেছে দ্রুতগতিতে। পালের দড়ি ছিঁড়ে গেলে নৌকো যে ডুবে যাবে সে ডরভয় এদের নেই। তবে বোধ করি এদেশে দমকা হাওয়া হঠাৎ এসে নৌকোকে এলোপাতাড়ি ধাক্কা লাগায় না।
সবুজ ক্ষেত, নানারঙের পাল, ঘোর ঘন নীল আকাশ, চন্চল্ ছলছল জল মনটাকে গভীর শান্তি আর পরিপূর্ণ আনন্দে ভরে দেয়। গাড়ির জানালার উপরে মুখ রেখে আধবোজা চোখে সে সৌন্দর্যরস পান করছি আর ভাবছি, এই সৌন্দর্য দেখার জন্যেই তো বহুলোক রেলগাড়ি চড়বে, আমি যদি এদেশে থাকবার সুযোগ পেতুম তবে প্রতি শনিবারে রেলে চড়ে যেদিকে খুশি চলে যেতুম। কিছু না, শুধু নৌকো, জল, ক্ষেত আর আকাশ দেখে দেখে দিনরাত কাটিয়ে দিতুম।
রাতের কথায় মনে পড়ল, চাঁদের আলোতে এ সৌন্দর্য নেবে অন্য এক ভিন্ন রূপ। সেটা দেখবার সুযোগ হল না– এখানটায়, এবারে।
মাঝে মাঝে নদী, নৌকো, খেজুরগাছ সবকিছু ছাড়িয়ে দেখতে পাই সেই তিনটে বিরাট পিরামিড। কত দূরে চলে এসেছি তবু তারা মাঝে মাঝে মুখ দেখিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে চলেছে আবার কাছের গাছের পিছনে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে, আবার মুখ দেখাচ্ছে। তখনই বুঝতে পারলুম, পিরামিডগুলো কত উঁচু। কাছের থেকে যেটা স্পষ্ট বুঝতে পারিনি।
কম্পার্টমেন্টের মাঝখান দিয়ে চলাফেরার পথ– কলকাতার ট্রামগাড়িতে যেরকম। সেই পথ দিয়ে যে কতরকমের ফেরিওয়ালা এল গেল তার হিসাব রাখা ভার। কমলালেবু, কলা, রুটি থেকে আরম্ভ করে নোটবুক, চিরুনি, মোজা, ঘড়ি, লটারির টিকিট হেনবস্তু নেই যা ফেরিওলা দু চার বার না দেখলে মনে হল লোহার সিন্দুক এবং আস্ত মোটরগাড়ি মাত্র এই দুই বস্তুই বোধ করি ফেরি করা হল না।
এক কোণে দেখি জাব্বা-জোব্বা-পরা এক মৌলানা সায়েব হাত-পা নেড়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন আর তাকে ঘিরে বসেছে একপাল ছোকরা–তারাও পরেছে জাব্ব-জোব্বা, তাদের মাথায়ও লাল ফেজ টুপিতে প্যাচানো পাগড়ি। দু চারজন যাত্রীও দলে ভিড়ে বক্তৃতা শুনছে। পাশের এক ভদ্রলোককে জিগ্যেস করে জানতে পারলুম, ইনি আজহর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ছুটিছাটায় যখন গ্রামের বাড়ি যান তখন তাঁর প্রিয় শিষ্যেরা তার সঙ্গেই বাড়ি যায়। সমস্তক্ষণ চলে জ্ঞানচর্চা। ট্রেনের অন্য লোকও সে শাস্ত্রচর্চা কান পেতে শোনে।
উত্তম ব্যবস্থা। প্রাচীন যুগে গুরুগৃহে বাস এবং বর্তমান যুগের কলেজে গিয়ে পড়াশুনা করা দুটোর উত্তম সমন্বয়। মাঝখানে থার্ড ক্লাস গাড়ির প্যাসেঞ্জার, চাষাভূষোরাও এদের জ্ঞানের কিছুটা পেয়ে গেল। আমাদের দেশের চাষারা তো প্রফেসরদের জ্ঞানের একরত্তিও পায় না।
সঙ্গে সঙ্গে ফেরিওলার কাছ থেকে কলামুলো কিনে নিয়ে মৌলানা সায়েব খাচ্ছেন, ছেলেদেরও খাওয়াচ্ছেন। সে-ও পরিপাটি ব্যবস্থা।
হরেকরকম ফেরিওলাই তো গেল। এখন এলেন আরেক মূর্তি। মুখে একগাল হাসি– আপন মনেই হাসছে– পরনে লজঝড় কোর্ট-পাতলুন, নোংরা শার্ট, টাইয়ের নটটা ট্যারা হয়ে কলারের ভিতর ঢুকে গিয়েছে, আর হাতে একতাড়া রঙিন ছবিতে ভর্তি হ্যান্ডবিল প্যালিট।
কেন যে আমাকেই বেছে নিল বলতে পারব না। বোধহয় আমাকেই সবচেয়ে বেশি বোকা বোকা দেখাচ্ছিল। ফেরিওলারা বোকাকেই সক্কলের পয়লা পাকড়াও করে এ তো জানা কথা। একগাল হাসির উপর আরেক পোঁচ মুচকি হাসি লেপটে দিয়ে শুধাল, কোথায় যাওয়া হচ্ছে স্যর?
ইয়োরোপীয় জাহাজ চড়ে মেজাজ খানিকটে বিলিতি রঙ ধরে ফেলেছে; বলতে যাচ্ছিলুম, তোমার তাতে কী? কিন্তু মনে পড়ল, মিশর প্রাচ্য দেশ, এ প্রশ্ন শুনে অভদ্রতা কিংবা অনধিকার প্রবেশ নয়। বললুম, পোর্টসঈদ।
তার পর?
মোগলাই মেজাজ চেপে নিয়ে বাঙালি কণ্ঠে বললুম, ইয়োরোপ।
ওহ্, তাই বলুন। কিন্তু ইয়োরোপ তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না, তার আগে এই মিশরের পাশের দেশ প্যালেস্টাইনটা ঘুরে আসুন না। আমি তো এক্কেবারে থ। হরেকরকমের ফেরিওলা তো দেখলুম। কেউ বিক্রি করে ছপয়সার জুতোর ফিতে, কেউ বিক্রি করে পাঁচশো টাকার সোনার ঘড়ি কিন্তু একটা আস্ত দেশ বিক্রির জন্য তার আড়কাঠি ট্রেনের ভিতর ঘোরাঘুরি করবে, এ-ও কি কখনও বিশ্বাস করা যায়? তবু ব্যাপারটা ভালো করে জেনে নেবার জন্য শুধালুম, আপনি বুঝি দেশ বিক্রি করেন?
সে আমার কোনও কথার উত্তর না দিয়ে আরেক গাল হেসে তার হাতের তাড়ার ভিতর থেকে কী একটা খুঁজতে আরম্ভ করল। ইতোমধ্যে আমার পাশের ভদ্রলোক তাকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন। সে ঝুপ করে বসে পড়ে তার হাতের উঁই থেকে বের করল প্যালেস্টাইনের হরেকরকম ছবিওলা একখানা রঙচঙ প্যাফ্লিট। তার উপর দেখি মোটা মোটা অক্ষরে লেখা প্যালেস্টাইন Palestine, the land of the lord প্রভুর জন্মভূমি, ইত্যাদি আরও কত কী! তার পর বললে, দেশ বিক্রি করি? হ্যাঁ তাই বটে, তবে কি না যেভাবে ধরেছেন, ঠিক সেভাবে নয়। কিন্তু সেকথা পরে হবে। উপস্থিত দেখুন তো, কী চমৎকার দেশে আপনাকে যেতে বলেছি। যে দেশে প্রভু জিসাস ক্রাইস্ট জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আপনি নিশ্চয় প্রভুর