আমার মন তখন যাব যাব করছে। তখন পলের কথাতে বুঝলুম, সে কতখানি ভদ্র ছেলে! আমাকে বললে, আবুল আসফিয়াকে ছেড়ে আমরা যাব না।
সেই উৎকট সঙ্কটের সময়ও আমার মনে পড়ল, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরও বিশেষ অবস্থায় স্বর্গে যেতে রাজি হননি।
আমাদের চোখের সামনে স্টেশনের বিরাট ঘড়ি। সেটা তখন দেখাচ্ছে, ৭, ৫৯।
কলাপসিবল গেটের ভিতর দিয়ে দেখছি, আমাদের ট্রেনের গার্ড বীরোচিত ধীর পদে টহল দিচ্ছে, আর মাঝে মাঝে ট্যাকঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে।
মিশর তো প্রাচ্য দেশ, আরামের দেশ, অপনচুলায়িটির দেশ। ওরা আবার সময়মতো গাড়ি ছাড়ার যাবনিক পদ্ধতি শিখল কোথা থেকে? সংসারের অবিচারের প্রতি আবার আমার ঘেন্না ধরল। ট্রেন তো বাবা, সর্বত্রই নিত্য নিত্য লেট যায়। এই যে সোনার মুল্লুক ইংলন্ড, যার প্রশংসায় এ পোড়ার দেশের সবাই পঞ্চমুখ দশানন, সেই দেশ সম্বন্ধেই শুনেছি, এক ডেলি প্যাসেঞ্জারের ট্রেন রোজ লেট যেত এবং বেচারী তাই নিয়ে অনেক আবেদন-ক্রন্দন করার পর একদিন সত্যি সত্যি কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সময়ে ট্রেন স্টেশনে এল। লোকটি উল্লাসভরে স্টেশনমাস্টারকে কনগ্রাচুলেট করাতে মাস্টার বিমর্ষ বদনে বললে, এটা গতকালের ট্রেন; ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা লেট।
সেই পরানের দ্যাশ বিলেতেই যদি এই ব্যবস্থা তবে এই খানদানি গেরেমভারী মিশরে মানুষ কি শুধুমাত্র আমাদের দলকে ভ্যাংচাবার জন্যই কণ্টকে কণ্টকে ট্রেন ছাড়তে চায়?
দেখি, গার্ড সাহেব দোদুল্যমান গতিতে আমাদের দিকে আসছে। চেকারকে কী যেন শুধাল তার পর উত্তর শুনে আমাকে বললে, আর তো সময় নেই, গাড়িতে উঠুন।
লোকটির সৌজন্যে আমি সমোহিত হয়ে গেলুম। কে আমরা, আমাদের জন্য ওর অত দরদ কিসের? স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, আমরা মার্কিন টুরিস্ট নই যে তাকে কড়া-কাঁড়া সোনার মোহর টিপস দেব। মিশরের ট্রেন লোহালক্কড়ের বটে, কিন্তু মিশরীয় গার্ডের দিল মহব্বতের খুনে তৈরি।
আমি পাগল-পারা খুঁজছি সৌজন্য ভদ্রতার আরবি, তুর্কি, ফারসি বাক্য, যা দিয়ে আমি তাকে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি। ইংরেজিতে তো আছে শুধু ছাই, থ্যাঙ্কু, ফরাসিতে মেসি, মেসি, জর্মনেও নাকি ডঙ্কি না ডাঙ্কে কী যেন একটা আছে কিন্তু ওই সামান্য একটা-দুটো শব্দ দিয়ে গার্ড সায়েবের সৌজন্যসমুদ্রে আমার হাল পানি পাবে কেন?
তবুও তেরিয়া হয়ে বলে গেলুম, আনা উশকুরুকুম চোক তশকুর এদরং এফেলং খৈলি তশকুর মিদমহাতান, কুরবান আরও কত কী, উল্টা-সুন্টা। তার মোদ্দা অর্থ, মহাশয় যে সৌজন্য দেখাইলেন, তাহা ভারতবর্ষের ইতিহাসে যুগযুগান্তব্যাপী অবিস্মরণীয় হইয়া থাকিবে কিন্তু হালফিল আমরা লৌহ-বর্মশকটে আরোহণ করিতে অক্ষম যেহেতুক আমাদের পরমমিত্র চরমসখা শ্রীশ্রীমান আবুল আসফিয়া নুরুউদ্দিন মুহম্মদ আব্দুল করীম সিদ্দিকিকে পরিত্যাগ করিয়া দেশান্তর গ্রহণ করিতে সম্পূর্ণ অক্ষম।
সঙ্গে সঙ্গে আরবি, তুর্কি, ফারসি তিন ভাষাতেই বিস্তর ক্ষমা ভিক্ষা করলুম।
আর মনে মনে মোক্ষম চটছি আবুল আসফিয়ার ওপর। লোকটার কি কণামাত্র কাণ্ডজ্ঞান নেই? দলের নেতা হয়ে কোনওরকম দায়িত্ববোধ নেই? সাধে কি ভারতবর্ষ স্বরাজ্য থেকে বঞ্চিত!
হঠাৎ পল-পার্সি দিল ছুট। তারা আবুল আসফিয়াকে দেখতে পেয়েছে। এবং আশ্চর্য, লোকটা তখনও নিশ্চিন্ত মনে রেলের এক কর্মচারীকে স্টেশনের বড় ঘড়িটা দেখিয়ে কী যেন বোঝাচ্ছে। বোঝাচ্ছে কচু! নিশ্চয়ই বোঝাচ্ছে, ওদের ঘড়ি ফাস্ট যাচ্ছে। তা যাচ্ছে তো যাচ্ছে, সেকথা বুঝিয়ে কী তোমার টাকেতে চুল গজাবে– ওদিকে ট্রেন মিস করে?
কথার মাঝখানেই পল আর পার্সি পিছন থেকে তাঁকে দু হাতে ধরে দিলে হ্যাঁচকা টান। তার পর দিল ছুট গাড়ির দিকে। আমিও পড়ি-মরি হয়ে সেদিকে। দলের যারা ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল তারাও জয়োল্লাসে হুঙ্কার দিয়ে উঠেছে। আবুল আসফিয়া হাত ছাড়াবার চেষ্টা করছেন। স্টেশনের আন্তর্জাতিক জনতা যে যার পথ ভুলে তাকিয়ে রয়েছে আমাদের দিকে। পুলিশ দিয়েছে হুইসল। তবে কি দিনেদুপুরে কিন্যাপিং! কিন্তু এ তো,
উল্টো বুঝলি রাম, ওরে উল্টো বুঝলি রাম,
কারে করলি ঘোড়া, আর কার মুখে লাগাম?
এখানে তো বুড়ো-ধাড়িকে পাকড়ে নিয়ে চলেছে দুটো চ্যাংড়া!
গাড়ি ঠিক সময়ে ছেড়েছিল না লেটে, আবুল আসফিয়ার ঘড়ি ঠিক না রেলের ঘড়ি ঠিক এসব সূক্ষ্ম প্রশ্নের সমাধান হল না। গার্ড সায়েব যেভাবে পিছন থেকে পাকা হাতে আমাদের ধাক্কা দিয়ে দিয়ে গাড়িতে ওঠাল তার থেকে অনুমান করলুম, এ প্রকারের কর্ম করে করে তার হাত ঝানু হয়ে গিয়েছে।
আবুল আসফিয়া তখনও পলকে বোঝাবার চেষ্টা করছেন, তাঁর ওই ঘড়িটাই সুইজারল্যান্ডের ক্রনোমিটার পরীক্ষায় পয়লা প্রাইজ পেয়েছিল। মিশরিদের সময়জ্ঞান নেই। আমরাও অতিশয় সরল। চিলে কান নিয়ে গেল শুনেই—
.
২৩.
আহা! সুন্দর দেশ!
খালে-নালায় ভর্তি। গাড়ি মিনিটে মিনিটে গম্, গড়ম, গড়ড় করে সেসব নালার উপর দিয়ে পেরুচ্ছে। তার পর গাড়ি বলে বড়ঠাকুরপো-ছোট্ঠাকুরপো, বড়ঠাকুরপো-ছোটঠাকুরপো, তার পর ফের নালার উপর গ, গড়ম গড়ড়ম। আর গাড়ির শব্দ যে এত মিষ্টি কে জানত? এ ট্রেন মিস করলে আর দেখতে হত না!
খাল-নালা তো বললুম, কিন্তু এক-এক নদ-নদী এমনই চওড়া যে বোধ করি সেগুলো নীলেরই শাখা-প্রশাখা। আর সেগুলোতে জলে-ডাঙার মাঝখানে ফাঁক প্রায় নেই। নিতান্ত বর্ষাকাল ছাড়া আমাদের নদীর জল যান তলিয়ে, আর পাড়গুলো থাকেন খাড়া হয়ে। সে জল অত নিচু থেকে উপরে তোলা যায় না বলে সে জল থেকেও নেই। চাষি তাই দিয়ে শীতকালে আরেকটা ফসল তুলতে পারে না। এদেশের লোক সৃষ্টির সেই আদিম প্রভাতে চাষবাস শেখার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের একমাত্র নদী নীলের গা থেকে এত হাজার হাজার খাল নালা কেটে রেখেছিল যে সে নদী গম্ভীর হবার সুযোগ পায়নি এবং ফলে নীলের জল দেশটাকে বারো মাস টৈটম্বুর করে রাখে।