সে বললে, হ্যাঁ।
তার পর শুনলুম, বর্ধমানে বাড়ি, দশ বছর বয়সে এখানে সে এসেছে। বাঙলা প্রায় ভুলে গিয়েছে। আরও চার বছর অর্থাৎ সবসুদ্ধ বারো বছর এদেশে কাটিয়ে ফের বর্ধমানে ফিরে যাবে।
সেখানে ফিরে গিয়ে কী করবে? এই বিদ্যের কদর তো ভারতবর্ষে নেই। তাতে আশ্চর্য হবারই বা কী? কাশী থেকে বারো বছর সংস্কৃত শিখে বর্ধমানে ফিরলে তার পাণ্ডিত্যেরই-বা মূল্য দেয় কে? তাকেও তো সেখানে উপোস করতে হয়। একেও তাই করতে হবে। আজ আর প্রাচীন শাস্ত্রের পাণ্ডিত্যের কেউ সম্মান করে না।
কিন্তু ছেলেটির দেখলুম তাই নিয়ে কোনও দুর্ভাবনা নেই। বাপ ধার্মিক লোক, ছেলেকে ধর্মশিক্ষা করতে পাঠিয়েছেন, তাই শিখে সে দেশে ফিরে যাবে– তার পর যা হবার তাই হবে।
দলের কেউ এ দোকানের সামনে দাঁড়াচ্ছে, কেউ ও দোকানের সামনে দাঁড়াচ্ছে। কেনাকাটা হচ্ছে অতি সামান্য। টুকিটাকি নাড়াচাড়াতে আনন্দ অনেক বেশি খরচাও তাতে নেই। এই করে আমরা সমস্ত দিন কাটিয়ে দিতে পারতুম কিন্তু হঠাৎ দলের একজন স্মরণ করিয়ে দিলেন, আমাদের পোর্টসঈদের ট্রেন ধরতে হবে আটটায়। আবুল আসফিয়াকে স্মরণ করিয়ে দিতে তিনি বললেন, চলুন। কিন্তু তার হাবভাবে কোনও তাড়া নেই।
অতি অনিচ্ছায় ট্রামে উঠতে হল। আজহরের ছেলেটি আমার সঙ্গে বাঙলা কথা কইতে পেয়ে আমার সঙ্গ ছাড়তে চায় না। সে-ও চলল আমাদের সঙ্গে। আরবি ভাষা এখন তার জীবনের মূলমন্ত্র, কিন্তু তাই বলে কি মাতৃভাষা বাংলার মায়া এত সহজে কাটানো যায়?
খ্যাচাঙ করে ট্রাম দাঁড়াল। কী ব্যাপার? আগের একটা ট্রাম মোড় নিতে গিয়ে লাইন থেকে ছিটকে পড়েছে। বাদবাকি সব ট্রাম তার পিছনে গড্ডলিকায় দাঁড়িয়ে। লোহার ডাণ্ডা দিয়ে জনকয়েক লোক ছিটকে পড়া ট্রামটাকে লাইনে ফেরত নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। চেষ্টার চেয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি হচ্ছে বেশি। লম্বা লম্বা আলখাল্লা উড়িয়ে রাস্তার ছেলে-বুড়ো ট্রামটার চতুর্দিকে ছুটোছুটি লাগিয়েছে। আর কত প্রকারেরই না উপদেশ, আদেশ অনবরত ট্রামের ভিতর-বাহির দু দিক থেকেই উপচে পড়ছে। দেশের হরির লুট এর কাছে লাগে কোথায়?
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজাটা রসিয়ে রসিয়ে দেখছি, এমন সময় দলের একজনের হুশ হল আটটায় যে আমাদের ট্রেন ধরতে হবে। আমাদের দেহমন কিন্তু ওই রণাঙ্গন থেকে তখন কিছুতেই সরছিল না। কারণ ইতোমধ্যে দেখি ট্রামটি কী পদ্ধতিতে ফের লাইনে তোলা যায় তাই নিয়ে দুইটি দলের সৃষ্টি হয়েছে। যারা ডিপো থেকে এতক্ষণে এসে পৌঁছেছে তারা। বাতলাচ্ছে এক প্রকারের রণকৌশল, আর সব-কটা ট্রামের ড্রাইভার, কন্ডাকটরের দল সে রণকৌশলের বিরুদ্ধে ঘোষণা করছে অন্য জিহাদ। ব্যাপারটা তখন এমনি চরমে পৌঁছেছে যে, উভয় পক্ষ তখন লোহার ডাণ্ডা হাতে করে মুখোমুখি হয়ে সদম্ভে সগর্বে সর্বপ্রকারের আস্ফালনকর্ম সুষ্ঠু পদ্ধতিতে শনৈঃ শনৈঃ এগিয়ে নিয়ে চলেছে। দুই দলের পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন ট্রামের যাত্রী এবং রাস্তার লোক। আর রাস্তার ছোঁড়ারা আলখাল্লা উড়িয়ে তাদের চতুর্দিকে পাই পাঁই করে ঘুরছে, বোঁ করে মধ্যিখান দিয়ে ইসপার-উসপার হয়ে যাচ্ছে, ধরা পড়ে কখনও-বা দু-একটা চড়-চাপড়ও খাচ্ছে।
একটা ফাসটো কেলাস লড়াইয়ের পূর্বরাগ কিংবা পূর্বাভাস!
কিন্তু হায়, পৃথিবীর কত সকর্মই না অসম্পূর্ণ রেখে এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়। এই যে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলুম, নিধিরামকে একদিন মোকামাফিক আচ্ছাসে উত্তম-মধ্যম দেব, তার পূর্বেই তো ম্যাট্রিক পাস করে ইস্কুল ছাড়তে হল! আর নিধে রাস্কেলটা ফেল মেরে পড়ে রইল ইস্কুলে। কী অন্যায় অবিচার। নিধেটা লেখাপড়ায় একটা আস্ত বিদ্যাসাগর, সেকথা জানি, কিন্তু আরও কত খাটাশও তো ম্যাট্রিক পাস করে। ও করলেই-বা কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? আমিও তো দুটো কিল মারার সুযোগ পেতুম। এইসব অবিচার দেখে সংসারের প্রতি আমার তখন ঘেন্না ধরে গিয়েছিল।
আজও তাই হল। দলের লোকের তাড়ায়। তখন আর বেশি সময় হাতে নেই। ট্যাসি নিতে হল।
বুকিং অফিসের সামনে যাত্রার দলের হনুমানের ল্যাজের মতো প্যাঁচ পাকানো কিউ- Q। কেউ কেউ এটাকে U বলে বলে W-ও বলে থাকেন, কারণ জায়গার অভাব থাকলে কিউ সচরাচর এইরকম শেপ-ই নিয়ে থাকে। অথচ গাড়ি ধরার সময় তখন মাত্র পাঁচ মিনিট। আবুল আসফিয়া কিউ-এতে দাঁড়ালেন। আমি তাকে বললুম, ট্রেন মিস নির্ঘাত। তিনি বললেন, আপনারা স্টেশনে যান।
স্টেশনে কখন কোন প্লাটফর্ম থেকে গাড়ি ছাড়বে তার খবর নিয়ে যখন সেই প্লাটফর্মের মুখে দাঁড়ালুম, তখন গেট-চেকার ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে শুধাল–
আপনারা যাবেন কোথায়?
পোর্টসঈদ।(সমবেত সঙ্গীতে)
তবে ট্রেনে গিয়ে আসন নিচ্ছেন না কেন? তাই শুনে পড়ি-মরি হয়ে একদল দিল ছুট ট্রেনের দিকে, আরেক দল যাবে কি যাবে না এই ভাবে না যথৌ ন তন্থৌ হয়ে রইল দাঁড়িয়ে, নড়লুম না আমরা তিনজন, পল, পার্সি আর আমি।
পল বললে, আমাদের টিকিট এখনও কাটা হয়নি।
চেকার ছোকরা বললে, আপনারা যান।
মনে হল ছেলেটি বুদ্ধিমান। আমাদের চেহারা-ছবি দেখে বুঝেছে, আমরা ফাঁকি দিয়ে গাড়ি চড়ার তালে নই। আমরা যখন পয়সা দেবার জন্য তৈরি তখন আমাদের ঠেকিয়ে রাখার কোনও প্রয়োজন নেই।