ইতোমধ্যে দেখি একটি মিশরীয় জাব্বা-জোব্বা পরা ছাত্র আজহর বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ থেকে বেরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসছে। চেহারা দেখে ভারতীয় বলেই মনে হল।
.
২২.
আজহর বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স পুরো-পাক্কা এক হাজার বৎসর। অক্সফোর্ড, কেজি, প্যারিস, বার্লিন এর চেয়ে কয়েকশো বছরের ছোট। তবু আজ যেসব গুণীজ্ঞানীর নাম পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে এঁরা ওইসব ইয়োরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আজহর থেকে যারা বেরোন তাঁদের নাম তো শুনতে পাইনে। হ্যাঁ, মনে পড়ল, মিশরের গাঁধী বলতে যাকে বোঝায় সাদ জগলুল পাশা ছিলেন আজহরের ছাত্র। কিন্তু আর কারও নাম শুনতে পাইনে কেন?
আশ্চর্য! মুসলমানরা যখন স্পেন দখল করল তখন তারা সেখানে আজহরের অনুকরণে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ল। প্যারিস ইউনিভার্সিটির গোড়াপত্তন যারা করেন তাদের অনেকেই লেখাপড়া শিখেছিলেন স্পেনের মুসলমান বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবং প্রথম দিককার পাঠ্যপুস্তকগুলো পর্যন্ত আরবি বই থেকে লাতিনে অনুবাদ করা। আজ আর আজহরের নাম কেউ করে না, করে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের।
কিন্তু আশ্চর্য হই কেন? একদা এই ভারতবর্ষের জ্ঞান-বিজ্ঞান ভারতবর্ষের বাইরে ছড়িয়ে পড়েছিল। গ্রিকরা আমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছিল। পরবর্তী যুগে ইয়োরোপীয়রা আমাদের কাছ থেকে শূন্যের ব্যবহার শিখল (লক্ষ করেছ বোধহয় রোমান হরফে যখন I, I, X, X, C. M. লেখ তখন শূন্যের ব্যবহার আদপেই হয় না।) এবং তারই ফলে তাদের গণিত শাস্ত্র কী অসাধারণ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলল। আরবরা চরক সুশ্রুতের অনুবাদ করল, আরও কত কী। একাদশ শতকে ভারত আক্রমণকারী সুলতান মাহমুদের সভাপণ্ডিত অল-বিরুনি সংস্কৃত শিখে ভারতবর্ষের জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্বন্ধে যে বই লেখেন তা পড়ে সে যুগের মুসলিম জগৎ অবাক হয়ে ভারতবর্ষের গুণগান করেছিল। তারও পরবর্তী যুগে সম্রাট আওরঙ্গজেবের বড় ভাই দারা শিকুর উপনিষদ সম্বন্ধে ফারসি বই লাতিনে তর্জমা হয়ে যখন ইয়োরোপে বেরুল তখন সে বই নিয়ে ইয়োরোপে কী তোলপাড়ই না হয়েছিল। সে যুগের সেরা দার্শনিক শোপেন হাওয়ার তখন বলেছিলেন, এ বই আমার জীবনের শেষ কটা দিন শান্তিতে ভরে দেবে। ওই সময়েই বিশ্বকবি গ্যোটে শকুন্তলার অনুবাদ পড়ে ঘন ঘন সাধু সাধু বলেছিলেন।
এখনও ভারতবর্ষের, আজহরের পুরনো সম্পদের সম্মান ইয়োরোপীয়রা করে কিন্তু আজকের দিনে যারা শুধু সংস্কৃত কিংবা মিশরের আরবির চর্চা নিয়ে পড়ে থাকেন তাদের নাম কেউ করে না। তাঁরা এমনকিছু সৃষ্টি করতে পারেন না কেন যা পড়ে বিশ্বজন বিমোহিত হয়ে পুনরায় সাধু, সাধু রবে হুঙ্কার তোলে?
হায়, এঁদের সৃজনীশক্তি ফুরিয়ে গিয়েছে। কেন ফুরল? তার একমাত্র কারণ, এক বিশেষ যুগে এসে এরা ভাবলেন, এঁদের সবকিছু করা হয়ে গিয়েছে, নতুন আর কিছু করবার নেই, পুরনো পুঁজি ভাঙিয়ে খেলেই চলবে।
এবং তার চেয়েও মারাত্মক কথা– এঁরা অন্যের কাছ থেকে আর কিছু শিখতে চান না। এঁদের দম্ভ দেখে তাই স্তম্ভিত হতে হয়।
আজহরের ছেলেটিকে জিগ্যেস করলুম, তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্স কেমেস্ট্রি বটুনি পড়ানো হয়?
সে শুধাল, এসব কী?
অনেক কষ্টে বোঝালুম।
সে বললে, ধর্মশাস্ত্রে যা নেই, তা জেনে আমার কী হবে?
আমি বললুম, অতিশয় হক কথা। ধর্ম ছাড়া অন্য কোনও গতি নেই কিন্তু ভ্রাতঃ, তোমার পা যদি আজ আছাড় খেয়ে ভেঙে যায় আর ডাক্তার বলে, এক্সরে করে দেখতে হবে কোন্ জায়গায় ভেঙেছে, তখন কি ধর্মশাস্ত্রে এক্সরে-র কল বানাবার সন্ধান পাবে?
উত্তরে কী বলেছিল মনে নেই। ধর্ম রক্ষা করবেন এইজাতীয় কিছু একটা। কিন্তু ইতোমধ্যে দেখি পল-পার্সি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তত্ত্বালোচনা পার্সিকে বিকল করে সে কথা পূর্বেই বলেছি, কিন্তু এস্থলে পল পর্যন্ত বিচল হয়ে পড়ল। আমি যখন একটু থেমেছি তখন দেখি তারা এক দোকানির সঙ্গে দরদস্তুর করছে।
কী ব্যাপার? মিশরের পিরামিডের ভিতর যেসব টুকিটাকি জিনিস পাওয়া গিয়েছে তারই কিছু কিছু এখানে বিক্রি হচ্ছে। আমি বললুম, এসব তো মহামূল্যবান জিনিস গুলো কেনার কড়ি আমাদের কাছে আসবে কোত্থেকে, আর মিশরি সরকার সেগুলো জাদুঘরে সাজিয়ে না রেখে বাজারে বিক্রি করবার জন্য ছাড়বেই বা কেন?
দোকানি বললে, একই জিনিস এত অসংখ্য পিরামিডে এত বেশি পাওয়া গিয়েছে যে সেগুলো সরকার বাজারে ছেড়েছে–ভালগুলো অবশ্য জাদুঘরে সাজানো আছে এবং দামও তাই বেশি নয়।
আমি কিনি-কিনছি কিনি-কিনছি করছি, এমন সময় সেই আজহরের ছেলেটি আমার কানে কানে বললে, তাই যদি হবে তবে ওর দোকানের পিছনের কারখানাতে কী সব তৈরি হচ্ছে। চলুন না, কারখানাটা দেখে আসবেন।
আমি বললুম, কী আর হবে দেখে? জর্মনিতে তৈরি কাশ্মিরি শাল, জাপানে তৈরি খাঁটি অতিশয় খাঁটি ভারতীয় খদ্দর, কলকাতায় তৈরি জর্মন ওষুধ এসব তো বহু বার দেখা হয়ে গিয়েছে। ওর থেকে নতুন আর কী তত্ত্বলাভ হবে?
পল-পার্সিকে বললুম, পাশের ছেলের পাতা থেকে টুকলি করা আর এই জাল মাল তৈরি করাতে তফাত নেই।
পল বললে, মাস্টার ধরতে পারলে কান মলে দেন।
আমি বললুম, সরকারও মাঝে মাঝে এদের কান মলে দেয়।
তখন হঠাৎ খেয়াল হল, আজহরি ছেলেটি যে ফিসফিস করে কানে কানে কথা বলেছিল, সেটা বাঙলায়। তৎক্ষণাৎ তাকে শুধালুম, আপনি কি বাঙালি?