And lo! the Hunter of the East has caught
The Sultans turret in a noose of light. —(Fitzerald)
কান্তি ঘোষের ইংরেজি অনুবাদ সচরাচর উত্তম কিন্তু এ স্থলে আমি একটু আপত্তি জানাই। তাঁর অনুবাদে আছে–
পুব-গগনের দেব শিকারির স্বর্ণ-উজল কিরণ তীর
পড়ল এসে রাজপ্রাসাদের মিনার যেথা উচ্চ শির। (কান্তি ঘোষ)*
[*স্বর্গীয় কান্তি ঘোষ আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। আর বহু গুণীজনের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে এ অধমও তার অনুবাদে উচ্ছ্বসিত।]
আসলে কিন্তু সূর্যালোক তীরের মতো মিনারের উপর আঘাত দিতে পারে। আবার নূস–ফাঁসের মতোও তাকে জড়িয়ে ধরতে পারে। তফাত বিশেষ কিছু নেই আর পাগলা কবিরা কত যে উদ্ভট উপমা দেয় তার কি ইয়ত্তা আছে। তবে কি না অনুবাদের বেলা মূলের যত কাছে থাকা যায় ততই মঙ্গল।
প্রকৃতির গড়া নীল, আর মানুষের গড়া পিরামিডের পরেই মিশরের মসজিদ ভুবন বিখ্যাত এবং সৌন্দর্যে অতুলনীয়। পৃথিবীর বহু সমঝদার শুধুমাত্র এই মসজিদগুলোকেই প্রাণভরে দেখবার জন্য সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে কাইরোতে আসেন। পিরামিড যারা বানিয়েছিল তাদের বংশধররাই এসব মসজিদ তৈরি করেছে কিন্তু এদের গায়ে ইতোমধ্যে কিঞ্চিৎ ইরানি গ্রিক রোমান এবং পরবর্তী যুগে বিস্তর আরব রক্ত ঢুকে পড়েছিল বলে এরা বানিয়েছে ভিন্ন। শৈলীতে। বিশেষত পূর্বেই বলেছি– পিরামিড তার লক্ষ লক্ষ মণ ওজন নিয়ে মাটির উপর ভারিক্তি চালে বসে আছে, তার রাজা যেভাবে প্রজাদের বুকের উপর জগদ্দল পাথরের মতো বসতেন তারই অনুকরণ করে। পরবর্তী যুগের মসজিদ যারা বানিয়েছিল তারা মুসলমান। তারা রাজার রাজা সৃষ্টিকর্তাকে দেয় সর্বোচ্চ স্থান। তাই তাদের মসজিদের মিনারগুলো উপরের দিকে ধেয়ে চলেছে, দুলোকেশ্বরের সন্ধানে। কিংবা বলতে পার তারা দাঁড়িয়ে আছে, মুসলমান নামাজ পড়ার সময় যেরকম প্রতিদিন পাঁচ বার সোজা হয়ে আল্লার সামনে দাঁড়ায়। তাই পিরামিডে ভীতিরস, মসজিদে গীতিরস।
পল-পার্সি দেখলুম এ রসে ঈষৎ বঞ্চিত। আমরা পুরনো কাইরোর মাঝখানে পৌঁছাতেই ট্রাম ছেড়ে একটা মসজিদের অদৃষ্টপূর্ব সৌন্দর্য দেখতে আরম্ভ করেছি; ওরা দেখি, মা-মাসির তম্বিতে গিয়ে শীতের গঙ্গাস্নানের সময় আমরা যা করি তাই করছে। গঙ্গা যে সুন্দর সেটা স্বীকার করছে কিন্তু তাতে নিমজ্জিত হওয়ার আনন্দ সম্বন্ধে সন্দিহান।
পার্সি একটু ঠোঁটকাটা। হক্ কথা–অর্থাৎ যেটাকে সে হক ভাবে, সেটা টক হলেও ক্যাট ক্যাট করে বলতে পারে। পলের ভাবটা একটু আলাদা। অশ্বত্থামা যদি পিটুলি গোলা খেয়ে সানন্দে তাণ্ডব নৃত্য জোড়ে তবে পার্সি তাকে তনুহূর্তে বলে দেবে যে দুধের বদলে তাকে ঘোল দিয়ে ফাঁকি দেওয়া হয়েছে, আর পল ভাববে, কী হবে ওর ভুল ভাঙিয়ে তার আনন্দটি নষ্ট করতে, ও যে আনন্দ পাচ্ছে তাতে তো কারও কোনও লোকসান হচ্ছে না!
পার্সি বললে, হুঁহ! যত সব! পিরামিড? হ্যাঁ বুঝি। মোক্ষম ব্যাপার। চারটিখানি কথা নয়। পারি ওরকম একটা বানাতে? মানলুম, এ মসজিদটা সুন্দর কিন্তু এটা বানানো আর তেমন কী?
পার্সিও মসজিদ দেখে বে-এক্তেয়ার হয়নি! সেকথা পূর্বেই বলেছি। কিন্তু এ যুক্তিটি তারও মনঃপূত হল না। শুধাল, পার তুমি বানাতে?
আলবৎ।
আমি বললুম, সন্দেহের কিঞ্চিৎ অবকাশ আছে। আজকের দিনে যেসব কলকজা দিয়ে নানারকম অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস তৈরি করা যায় তাই দিয়ে পিরামিড তৈরি করা অসম্ভব নয়। কিন্তু এ মসজিদে যে নিপুণ মোলায়েম কারুকার্য আছে সেরকম করবার মতো হাত আজকের দিনে আর কারও নেই। আর থাকলেই-বা কী? সেটা তো হবে নকল। তুমি যদি একটি বিরাট দিঘি খোঁড়ো তবে একথা কেউ বলবে না, এটা অমুক দিঘির নকল। তুমি যদি একটা পিরামিড বানাও তবে বলবে না এটা পিরামিডের নকল, কারণ সব পিরামিডই হুবহু একই প্রকারের, কোনওটা বেশি বড় কোনওটা কম বড়। কিন্তু তুমি যদি হ্যামলেট-খানা নকল করে মাসিক পত্রিকায় পাঠাও তবে তারা ছাপবে না, বলবে নকল। তুলনাটা মনঃপূত হল না? তবে বলি, তুমি যদি মোনালিজার ছবি পর্যন্ত হুবহু একে ফেল তবে সবাই বলবে, নকল, তবে ওস্তাদের হাত বটে, বাহ্! কেউ বলবে না, আহ্!
পল শুধাল, বাহু আর আহ্-এর মধ্যে তফাতটা কী?
আমি বললুম, যেখানে শুধুমাত্র হাতের ওস্তাদি কিংবা ওইজাতীয় কিছু একটা, যেমন মনে কর মাটির থেকে একশো হাত উপরে একটা দড়ির উপর হেঁটে চলে যাওয়া, কিংবা মনে কর সিঙ্গিটার মুখের ভিতর আপন মুণ্ডুটা ঢুকিয়ে দেওয়া, এক কথায় সার্কাসের তাবৎ কসরত দেখে আমরা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলি, বাহ্! পিরামিডের বেলাও তাই বলি বাহ! কিন্তু অমিতাভের উত্তম প্রতিকৃতিতে তার শান্ত-প্রশান্ত মুখচ্ছবি কিংবা মান্নার মুখে বিগলিত মাতৃরস দেখে আমরা রসের সায়রে ডুবতে ডুবতে বলি, আহ্! কী আরাম! কী সৌন্দর্য! বাহু-এর কেরানি যতই কঠিন, যতই রোমাঞ্চকর হোক না কেন, তার শেষ মূল্য আহ-এর জিনিসের চেয়ে কম। এভারেস্টের চুড়োয় ওঠা যত কঠিনই হোক না, তার মূল্য তিয়াসী পথিককে একপাত্র জল দেওয়ার চেয়ে অনেক কম। এই যে পার্সি বললে, সে পিরামিড বানানোর মতো কঠিন কর্ম করতে পারে না, সেইটেই সবকিছু যাচাই করার শেষ পরশপাথর নয়। শেক্সপিয়র খুব সম্ভব দড়ির উপরে ধেই ধেই করে নৃত্য করতে পারতেন না। তাই বলে ওই কর্ম তার হ্যামলেটের চেয়ে মূল্যবান এ রায় কে দেবে? আসলে দুটো আলাদা জিনিস। তুলনা করাই ভুল। পিরামিডে আছে ইঞ্জিনিয়ারিং হুনোর হেকমত (স্কিল) আর মসজিদে আছে রসসৃষ্টি (আর্টিস্টিক ক্রিয়েশন)।