স্বপ্নে অজানা লিপি, অচেনা বাণী মানুষ যেমন হঠাৎ কোন এক ইন্দ্রজালের প্রভাবে বুঝে ফেলে, আমি ঠিক তেমনি হঠাৎ বুঝে গেলুম নাচের অর্থটা কী। এ শুধু অর্থবিহীন পদক্ষেপ নয়, ব্যঞ্জনাহীন হস্তবিন্যাস নয়। নর্তকীরা নব মিশরের প্রতীক। এরা প্রাচীন মিশরের প্রতীক ফিনসকে তার যুগ-যুগান্তব্যাপী ন্দ্রিা থেকে জাগরিত করতে চাইছে। সে তার লুপ্ত গৌরব নিয়ে সুপ্তিজাল ছিন্নভিন্ন করে আবার মিশরে সুপ্রতিষ্ঠিত হোক, বিদেশি স্বৈরতন্ত্রের কুহেলিকা উদ্ঘাটন করে সেই প্রাচীন সবিতার নবীন মূর্তি দুলোক ভূলোক উদ্ভাসিত করুক।
তবে কি আমারই মনের ভুল? দেখি, ফিক্স মূর্তির মুখে যেন হাসি ফুটে উঠেছে। এ কি জাদুকরদের ভানুমতী, না সৃষ্টিকর্তার অলৌকিক আশীর্বাদ?
আবার অন্ধকার হয়ে গেল।
নিদ্রিতের চোখে যে রকম পড়ে, আমার চোখে ঠিক তেমনি এসে পড়ল পশ্চিমাকাশ থেকে চন্দ্রান্তের রক্তছটা আর পূর্বাকাশ থেকে নব অরুণোদয়ের পূর্বাভাস।
জয় মিশরভূমির জয়।
.
২১.
ইংরেজিতে কী যেন একটা প্রবাদ আছে, —
Early to bed and early to rise.
তার পর কী যেন সব হয়? হ্যাঁ, বাঙলাটা মনে পড়েছে–
সকাল সকাল শুতে যাওয়া সকাল বেলা ওঠা,
স্বাস্থ্য পাবে বিদ্যে হবে, টাকাও হয় মোটা।
গ্রামের তুলনায় শহরে টাকা বেশি, রাস্তায় রাস্তায় বিদ্যের ভাণ্ডার ইস্কুল-কলেজ আর শহরবাসীকে অজর অমর করে রাখবার জন্য কত ডাক্তার কবিরাজ হেকিম না খেয়ে মরছে তার হিসাব রাখে কে? তাই বোধহয় শহরের লোক সকাল সকাল শুতে যাওয়ার আর সকালবেলা ওঠার প্রয়োজন বোধ করে না। গ্রামের লোক তাই এখনও ভোরবেলা ওঠে। কাইরো শহর তাই এখনও ঘুমুচ্ছে– অবশ্য নাক ডাকিয়ে নয়।
আবুল আসফিয়া বললেন তা ঠিক, কিন্তু মুসলমানদের প্রথম নামাজ পড়তে হয় কাক-কোকিল ডাকার পয়লা। এদেশে তাদের বড় বড় মসজিদ মাদ্রাসা আজহর পাড়ায়। সেখানেই যাওয়া যাক। তারা নিশ্চয়ই ঘুম থেকে উঠেছে।
উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু মসজিদের নামাজিদের দেখবার জন্য এ সুদূর কাইরো শহরে আসা কেন? আপন কলকাতায় জাকারিয়া স্ট্রিটে গেলেই হয়!
উঁহু, সেইটেই নাকি কাইরোর প্রবীণ অঞ্চল। অবশ্য পিরামিডের তুলনায় অতিকায় নবীন বয়স মাত্র এক হাজার বৎসর। কিঞ্চিৎ এদিক-ওদিক। প্রাচ্যের রোমান্টিক নগরী কাইরো বলতে জগজ্জনের মনে আরবিস্থানের যে রঙিন তসবির ফুটে ওঠে সে বস্তু নাকি এখনও ওই অঞ্চলেই পাওয়া যায়।
ট্রাম কিন্তু তখনই চলতে আরম্ভ করেছে। কলকাতার ট্রামের তুলনায় অতিশয় লজঝড় এবং ছুটির দিনে ইস্কুল-কলেজের মতো ফাঁকা।
পয়লা ট্রাম দেখামাত্রই আবুল আসফিয়া তড়িঘড়ি ট্যাসিওলাদের পাওনা পয়সা বুঝিয়ে দিয়ে বিদেয় করে দিয়েছেন। পয়সা বাঁচাবার এ ফিকির সবাই জানে কিন্তু বিদেশে-বিভুইয়ে কে জানে কোন ট্রাম কোথায় যায়? আপন কলকাতাতেই যখন ট্রামের গুবলেটে নিত্যি নিত্যি কালীঘাট যেতে গিয়ে পৌঁছে যাই মৌলা আলী, কিংবা বলতে পার মর মর অবস্থায় মেডিকেল কলেজ না পৌঁছে ট্রাম ভিড়ল নিমতলায়। বল্ হরি, হরি বল!
আবুল আসফিয়া বললেন, আল্লা আছেন, ভাবনা কী!
তব সাথী হয়ে দগ্ধ মরুতে
পথ ভুলে তবু মরি
তোমারে ত্যজিয়া মসজিদে গিয়া
কী হবে মন্ত্র স্মরি!
তবু খুব ভরসা পেলুম না। হরিই বল আর আল্লাই বল, তারা সব-কজনা এই কটা বাউণ্ডুলের জন্য অন্য সবকিছু ছেড়ে দিয়ে এই অবেলায় ঠিক ট্রাম ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় পাঠাবার তদারকিতে বসে আছেন– এ ভরসা করতে হলে যতখানি বিশ্বাসী হতে হয় আমি ঠিক ততখানি নই। তা হই আর না হই, আর পাঁচ জনের সঙ্গে সঙ্গে ট্রামেই উঠতে হল।
রাস্তা ক্রমেই সরু হয়ে আসছে। পৃথিবীর সর্বত্র যা হয়– খোলা-মেলার নতুন শহর থেকে নোংরা ঘিঞ্জি পুরনো শহরে শহরে ঢুকবার সময়।
রাস্তার দু দিকে দোকানপাট এখনও বন্ধ। দু-একটা কফির দোকান খুলি খুলি করছে। ফুটপাথের উপর লোহার চেয়ারের উপর পদ্মাসনে বসে দু চারটি সুদানি দারোয়ান তসবি টপকাচ্ছে, খবরের কাগজওলার দোকানের সামনে অল্প একটু ভিড়, চাকর-বাকররা হনহন করে চলেছে বড় সায়েবদের বাড়ি পৌঁছতে দেরি হয়ে গিয়েছে বলে।
তরল অন্ধকার সরল আলোর জন্যে ক্রমেই জায়গা করে দিচ্ছে। কালো চুলের মাঝখানে সাদা সিঁথি ফুটে উঠেছে। তার উপর দেখা যাচ্ছে লাল সিঁদুরের পোঁচ। আকাশ-বাতাসের এই লীলা-খেলাতে সবকিছু যে পাপষ্টি দেখা গেল তা নয়, কিন্তু ট্রামের জানালার উপর মাথা রেখে আধো ঘুমে আধো জাগরণে জড়ানো জড়ানো হয়ে সবকিছুই যেন কিছু কিছু দেখা হল। স্বপ্নে ঘুমে জাগরণে মেশানো অভিজ্ঞতা ভাষাতে প্রকাশ করা কঠিন। ছবিতে এ জিনিস ফোঁটানো যায় অনেক অক্লেশে। তাই বোধহয় চিত্রকরদের সূর্যোদয়ের ছবি সাহিত্যের সূর্যোদয়কে প্রায়ই হার মানায়।
সবচেয়ে সুন্দর দেখাচ্ছিল মসজিদের চুড়ো (মিনার)গুলোকে। কুতুবমিনার যারা দেখেছে তারাই জানে তার সৌন্দর্য কী। মনে হয় সে যেন পৃথিবীর ধুলো-মাটির প্রাণী নয়। সে যেন কোনও রাজাধিরাজের উষ্ণীষ দেশের আপামর জনসাধারণের বহু ঊর্ধ্বে দাঁড়িয়ে ভগবানের আপন হাতের অভিষেক আশীর্বাদের পরশ পাচ্ছে।
তবু কুতুবের পা মাটিতে ঠেকেছে। এদের বহু মিনার দাঁড়িয়ে আছে আল্লার নামাজের ঘর মসজিদের উপর। কিন্তু এরা জানে উপরের দিকে আল্লার কাছে যাওয়ার অর্থ কী। সুস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যতই উপরের দিকে যাচ্ছে ততই ভয়ে জড়সড় হয়ে সরু হয়ে যাচ্ছে–ক্লাসের গাব্দা-গোলা ছেলেও যেরকম হেডমাস্টারের সামনে শরকাঠিটি হয়ে যায়। কিন্তু দ্যুলোক আর সবিতা যেন ওদের অভয় দিচ্ছেন আকাশ যেন তার আপন নীলাম্বরী তাদের পরিয়ে দিতে এসেছেন— পিছনের দিকটা পরা হয়ে গিয়েছে, আর সবিতা যেন অরুণালোকের লম্বা লম্বা দড়ির ফাঁস লাগিয়ে তাদের খাড়া রাখবার চেষ্টা করছেন। তাই দেখে ওমর খৈয়াম বললেন,