তিন দিন পরে গুম গুম করে জাহাজ থেকে নেমে সে পাড়ার আড্ডায় যাবে গল্প করতে– জাহাজ বন্দরে এসে ভিড়েছে কি-না! সেখানে সেই মারাত্মক ঝড়ের একটা ভয়ঙ্কর বর্ণনা দিয়ে শেষটায় পাইপ কামড়াতে কামড়াতে বলবে, আর না, এই আমার শেষ সফর। বুড়ো হাড়ে আর জলঝড় সয় না। সবাই হা-হা করে বলবে, সে কী, কাপ্তেন, আপনার আর তেমন কী বয়স হল? কাপ্তেনও হেঁ-হেঁ করে মহাখুশি হয়ে জাহাজে ফিরবে।
আমি আরও দুই শ্রেণির লোককে চিনি যারা কিছুতেই বাসা বাঁধতে চায় না।
দেশ-বিদেশে আমি বিস্তর বেদে দেখেছি। এরা আজ এখানে, কাল ওখানে, পরশু আরও দূরে, অন্য কোথাও। কখন কোন্ জায়গায় কোন্ মেলা শুরু হবে, কখন শেষ হবে, সব তাদের জানা। মেলায় মেলায় গিয়ে কেনাকাটা করবে, নাচ দেখাবে, গান শোনাবে, হাত গুনবে, কিন্তু কোথাও স্থির হয়ে বেশিদিন থাকবে না। গ্রীষ্মের খরদাহ, বর্ষার অবিরল বৃষ্টি সব মাথায় করে চলেছে তো চলেছে, কিসের নেশায় কেউ বলতে পারে না। বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখাবার চাড় নেই, তাদের অসুখ-বিসুখ করলে ডাক্তার-বদ্যিরও তোয়াক্কা করে না। যা হবার হোক, বাসা তারা কিছুতেই বাধবে না। বাড়ির মায়া কী তারা কখনও জানেনি; কোনওদিন জানবেও না।
ইংলন্ড দুশো বছর ধরে চেষ্টা করে আসছে এদের কোনও জায়গায় পাকাপাকিভাবে বসিয়ে দিতে। টাকা-পয়সা দিয়েছে, কিন্তু না, না, না, এরা কিছুতেই কোনও জায়গায় কেনা গোলাম হয়ে থাকতে চায় না। ইংলন্ড যে এখনও তার দেশে প্রাথমিক শিক্ষার হার শতকরা পুরো একশো করতে পারেনি তার প্রধান কারণ এই বেদেরা। এরা তো আর কোনও জায়গায় বেশিদিন টিকে থাকে না যে এদের বাচ্চারা ইস্কুলে যাবে! শেষটায় ইংরেজ এদের জন্য ভ্রাম্যমাণ পাঠশালা খুলেছে, অর্থাৎ পাঠশালার মাস্টার শেলেট, পেন্সিল নিয়ে ভবঘুরে হয়ে তাদের পিছন পিছন তাড়া লাগাচ্ছে, কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা, তারা যেমন ছিল তেমনি আছে।
খোলামেলার সন্তান এরা– গণ্ডির ভিতর বন্ধ হতে চায় না।
কিন্তু এদের সবাইকে হার মানায় কারা জানো?
রবীন্দ্রনাথ যাদের সম্বন্ধে বলেছেন,
ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন
চরণতলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন।
এই যে আরবসাগর পাড়ি দিয়ে আদন বন্দরের দিকে যাচ্ছি এরা সেই দেশের লোক। সৃষ্টির আদিম প্রভাত থেকে এরা আরবের এই মরুভূমিতে ঘোরাঘুরি করছে। এরা এদিক-ওদিক যেতে যেতে কখনও ইরানের সজল উপত্যকার কাছে এসে পৌঁছেছে, কখনও লেবাননের ঘন বনমর্মরধ্বনিও শুনতে পেয়েছে কিন্তু এসব জায়গায় নিশ্চিন্ত মনে বসবাস করার কণামাত্র লোভ এদের কখনও হয়নি। বরঞ্চ মরুভূমির এক মরূদ্যান থেকে আরেক মরূদ্যানে যাবার পথে সমস্ত ক্যারাভান (দল) জলের অভাবে মারা গেল– এ বীভৎস সত্য তাদের কাছে অজানা নয়, তবু তারা ওই পথ ধরেই চলবে, কোনও জায়গায় স্থায়ী বসবাসের প্রস্তাব তাদের মাথায় বজ্রাঘাতের ন্যায়।
জানি, এককালে আরব দেশ বড় গরিব ছিল, কৃত্রিম উপায়ে জলের ব্যবস্থা করতে পারত না বলে সেখানে চাষ-আবাদের কোনও প্রশ্নই উঠত না। কিন্তু হালে নদ-হিজ্জাজের রাজা ইবনে সউদ পেট্রল বিক্রি করে মার্কিনদের কাছ থেকে এত কোটি কোটি ডলার পেয়েছেন যে সে কড়ি কী করে খরচা করবেন তার কোনও উপায়ই খুঁজে পাচ্ছেন না। শেষটায় মেলা যন্ত্রপাতি কিনে তিনি বিস্তর জায়গায় জল সেঁচে সেগুলোকে খেত-খামারের জন্য তৈরি করে বেদুইনদের বললেন, তারা যেন মরুভূমির প্রাণঘাতী যাযাবরবৃত্তি ছেড়ে দিয়ে এসব জায়গায় বাড়িঘর বাঁধে।
কার গোয়াল, কে দেয় ধুনো!
সেসব জায়গায় এখন তালগাছের মতো উঁচু আগাছা গজাচ্ছে।
বেদুইন তার উট-খচ্চর, গাধা-ঘোড়া নিয়ে আগের মতোই এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায়। উটের লোমের তাবুর ভিতর রাত্রিবাস করে। তৃষ্ণায় যখন প্রাণ কণ্ঠাগত হয় তখন তার প্রিয় উটের কণ্ঠ কেটে তারই ভিতরকার জমানো জল খায়। শেষটায় জলের অভাবে গাধা-খচ্চর, বউ-বাচ্চাসহ গুষ্ঠীসুদ্ধ মারা যায়।
তবু পা-জমিয়ে কোথাও নীড় বানাবে না।
এইসব তত্ত্বচিন্তায় মশগুল হয়েছিলুম এমন সময় হুশ করে আরেকখানা জেলেনৌকা পাশ দিয়ে চলে গেল। দেখি, ক্যাম্বিসের ছইয়ের নিচে লোহার উনুন জ্বেলে বুড়ো রান্না চাপিয়েছে। কল্পনা কি না বলতে পারব না, মনে হল ফোড়নের গন্ধ যেন নাকে এসে পৌঁছল। কল্পনা হোক আর যাই হোক, তত্ত্বচিন্তা লোপ পেয়ে তদ্দণ্ডেই ক্ষুধার উদ্রেক হল।
ওদিকে কবে শেষ ব্যাচের শেষ ডিনার খাওয়া হয়ে গিয়েছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিরীক্ষণ, তত্ত্বচিন্তায় মনোবীক্ষণ বিলক্ষণ সুখনীয় প্রচেষ্টা কিন্তু ভক্ষণ-ভিত্তিম উপেক্ষা করা সর্বাংশে অর্বাচীনের লক্ষণ!
তবু দেখি, যদি কিছু জোটে, না হলে পেটে কিল মেরে শুয়ে পড়ব আর কি।
দশ পা যেতে না যেতেই দেখি আমার দুই তরুণ বন্ধু পল আর পার্সি রামি খেলছে। আমাকে দেখে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, গুড ইভনিং, স্যার!
আমি বললুম, হ্যালো, অর্থাৎ এই যে।
তার পর ঈষৎ অভিমানের সুরে বললুম, আমাকে একলা ফেলে তাস খেলছ যে বড়! জানো, তাস ব্যাসন-বিশেষ, তাসে অযথা কালক্ষয় হয়, গুণীরা বলেন–
ওরা বাধা দিচ্ছে না বলে আমাকেই থামতে হল।
পার্সি বললে, যথার্থ বলেছেন, স্যার।