আমরা শুধালুম, তা হলে তারা সে নৈপুণ্য কোনও সূক্ষ্ম কলা নির্মাণে, কোনও সৌন্দর্য সৃষ্টিতে প্রয়োগ করল না কেন?
আবুল আসফিয়া বললেন, সেটা দেখতে পাওয়া যায় তাদের মন্দিরগাত্রে, তাদের প্রস্তরমূর্তিতে।
হায়, সেগুলো এখন দেখার উপায় নেই।
পার্সি ততক্ষণে বালু জড়ো করে বালিশ বানিয়ে তারই উপর মাথা দিয়ে শুয়ে পড়েছে। তত্ত্বালোচনার প্রতি তার একটা বিধিদত্ত আজন্মলব্ধ নিরঙ্কুশ বৈরাগ্য আছে। স্বতই ভক্তিভরে মাথা নত হয়ে আসে।
আবুল আসফিয়া বললেন, অনেক রাত হয়েছে। শহরে ফেরা যাক।
পল অনেকক্ষণ ধরে গম্ভীর হয়ে কী যেন ভাবছিল। মোটরের দিকে যেতে যেতে বললে, আমার কিন্তু সমস্ত জিনিসটা একটা হিউজ ওয়েস্ট বলে মনে হয়। আমরা সবাই চুপ করে শুনলুম।
আমাদের দলের মধ্যে একটি প্রৌঢ়া মহিলা ছিলেন। তিনি বললেন, না, মসিয়ো পল। পিরামিডের একটা গুণ আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন। এর সামনে দাঁড়ালে, বয়সের দিক দিয়ে দেখতে গেলে, আমাকেও তরুণী বলে মনে হয়।
একটা কথার মতো কথা বটে।
আমি বললুম, শাবাশ!
২০. মানুষের চেহারা জাগ্রত অবস্থায় একরকম
২০.
মানুষের চেহারা জাগ্রত অবস্থায় একরকম, ঘুমন্ত অবস্থায় অন্যরকম। শহরের বেলাতেও তাই। জাগ্রত অবস্থায় কোনও মানুষকে বেশ চালাকচতুর বলে মনে হয়, কিন্তু ঘুমন্ত অবস্থায় তাকেই দেখায় আস্ত হাবা গঙ্গারামের মতো। দুপুরবেলা লালদিঘি গমগম করে রাত্রে সেখানে গা ছমছম করে। আমাদের পাড়া পার্ক সার্কাসের ট্রামডিপো অঞ্চল দুপুরবেলা ঘুমিয়ে পড়ে। সন্ধ্যায় হোটেলগুলো যেন কোরাসগান গেয়ে উঠে।
রসের ক্ষেত্রে আমি ছেলে-বুড়োতে তফাত করিনে। আট বছরের ছেলে মহাভারত পড়ে সুখ পায়, আশি বছরের বুড়োও আনন্দ পায়। আবার আট বছরের ছেলে দিব্য কীর্তন গেয়ে শুনিয়ে দিল, ষাট বছরের সুরকানা পণ্ডিত ধরতে পারল না, সেটা কীর্তন না বাউল অর্থাৎ রসবোধের ক্ষমতা বয়সের ওপর নির্ভর করে না।
কিন্তু কোনও কোনও ছোটখাটো রস বয়সের ওপর নির্ভর করে। আট বছরে সিগারেট খেয়ে কোনও লাভ নেই, আঠারোতেই রাস্তায় মার্বেল খেলার রস শুকিয়ে যায়। ঠিক তেমনি রাতের শহর ছোটদের জন্য নয়। তুলনা দিয়ে বলি, সকাল আটটায় আট বছরের ছেলেকে আটখানা ট্যাক্সি ডাকতে পাঠাতে পারি, কিন্তু রাত দশটায় দশ বছরের ছেলেকে দশ জায়গায় পাঠাতে পারিনে।
কিন্তু যেসব দুঁদে ছেলেরা যেমন পল-পার্সি– রাত দুটোর সময় জেগে আছে, তাদের নিয়ে কী করা যায়? আবুল আসফিয়া অভয় জানিয়ে বললেন, কাইরোতে এমন সব নাচের জায়গা আছে, যেখানে বাপ-মা আপন ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে আনন্দ করতে যান।
তারই একটা ক্যাবারেতে যাওয়া হল।
খোলাতে। উপরে মুক্ত আকাশ। চতুর্দিকে জাপানি ফানুসে ঢাকা রঙ-বেরঙের আলোর জ্যোতি ক্ষীণ বলে উপরের দিকে খানিকক্ষণ তাকালে গম্ভীর আকাশের গায়ে চটুল তারার মিটমিট নাচ দেখা যায়।
শ খানেক ছোট ছোট টেবিল। এক প্রান্তে স্টেজ। ডাইনে-বাঁয়ে উইঙ নেই, পিছনে শুধু, হুবহু শুক্তির এক পাটির মতো কিংবা বলতে পার, সাপের ফণার মতো উঁচু হয়ে ডগার কাছে নিচের থেকে বেঁকে আছে স্টেজের বিরাট ব্যাকগ্রাউন্ড। শুক্তিতে আবার ঢেউ খেলানো– এরকম ছোট্ট সাইজের ঝিনুক সমুদ্রপাড়ে কুড়িয়ে পাওয়া যায় দেখতে ভারি চমৎকার। ব্যাকগ্রাউন্ডের পিছনে এরই আড়ালে গ্রিনরুম নাকি, না মাটির নিচে সুড়ঙ্গ করে?
হঠাৎ সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল। ভাবছি ব্যাপার কী। পল-পার্সিকে কানে কানে বললুম, মানিব্যাগ চেপে ধরো!! বলা তো যায় না বিদেশ-বিভুই জায়গা।
নাহ্, আলো জ্বলতে দেখি, শুক্তির সামনে এক স্ফিনকস। পিরামিডের পাশে আমরা এই স্ফিনকসের পাথরের মূর্তি দেখেছি–অবশ্য এর চাইতে পাঁচশো শুণে বড়। কিন্স মিশরের সম্রাট ফারাওয়ের প্রতিমূর্তি। মুখটা রাজারই মতো, শুধু শক্তি আর প্রতাপ বোঝানোর জন্য শরীরটা সিংহের।
পিছন থেকে বেরিয়ে এল ছটি মেয়ে। গলা থেকে পা অবধি ধবধবে সাদা শেমিজের মতো লম্বা জামা পরা। রাস্তায় মিশরি মেয়েদের এরকম জামা পরতে দেখেছি। তবে অন্য রঙের।
আস্তে আস্তে তারা ফিসের চারদিকে ঘুরে ঘুরে নাচতে আরম্ভ করল। বড় মৃদু পদক্ষেপ। পায়রা যেরকম নিঃশব্দ পদসঞ্চারণে হাঁটে। চাঁদ যেরকম আকাশের উপর দিয়ে তারার ফুলকে না মাড়িয়ে আকাশের এপার-ওপার হয়।
পায়ে ঘুঙুর নেই, হাতে কাকন নেই। শুধু থেকে থেকে সমের একটু আগে তেহাইয়ের সময় থেকে বাঁশি, খঞ্জনি আর ঢোলের সামান্য একটুখানি সঙ্গীত। বড় করুণ, অতি বিষাদে ভরা। নীলনদের এপার থেকে মা যেন ওপারের ছেলেকে সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফেরার জন্য ডাকছে। এ ডাক আমি জীবনে বহুবার শুনেছি। যে মা-ই ডাকুক না কেন, আমি যেন সে ডাকে আমার মায়ের গলা শুনতে পাই।
সে ডাক বদলে গেল। এবারে শুনতে পাচ্ছি অন্য স্বর। এ যেন মা ছেলেকে ঘুম থেকে জাগাবার চেষ্টা করছে। এ গলায় গোড়ার দিকে ছিল অনুনয়-বিনয়। তার পর আরম্ভ হল আশা-উদ্দীপনার বাণী। সঙ্গীত জোরালো হয়ে আসছে। পদক্ষেপ দ্রুততর হয়েছে। ছটি নয়, এখন মনে হচ্ছে যেন ষাটটি মেয়ে দ্রুত হতে দ্রুততর লয়ে নৃত্যাঙ্গন অপূর্ব আলিম্পনে পরিপূর্ণ করে দিয়েছে! আর পদক্ষেপের কণামাত্র স্থান নেই।